0

সম্পাদকীয়

Posted in





মনে পড়ছে ঠিক এক বছর আগের কথা। গতবছর এইসময় দেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল লক ডাউন। তখনও জানতাম না, অতিমারী নামক ভয়াবহ এক বিশ্ব রাজনীতি গ্রাস করে ফেলবে আমাদের। যদিও এক বছর পর প্রতিষেধক আমাদের মুঠোয়। আপাতত দেখার এটাই যে, এই বিপুল জনসংখ্যা কিভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আসে। আশার কথা এই যে, উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতের অতিমারী পরিস্থিতি সামান্য হলেও আশাব্যঞ্জক। সত্যিই কি? নাকি এখানেও চলছে রাজনীতির 'খেলা'?

১৯১৩ সালের ৮ মার্চ পালিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারীদিবস। বিগত শতাধিক বছরের মধ্যে এ বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। কিন্তু তৃণমূল স্তরে? প্রকৃত আলো কি সেখানে পৌঁছেছে? সমানাধিকারের প্রশ্নে এলিটিস্ট মনোভঙ্গিও কি সঠিক বার্তা বহন করে? এসব নিয়ে অনেক তর্ক হতে পারে। এই আবহেই আমাদের এবারের ব্লগাজিনে রইলো আন্তর্জাতিক নারীদিবস সংক্রান্ত বিশেষ ক্রোড়পত্র। লিখেছেন বিশিষ্টজন। আপনাদের মতামত আমাদের সমৃদ্ধ করবে। 
ভালো থাকুন! সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অভীক কুমার চৌধুরী

Posted in

মোহনবাগান বেমক্কা হেরে গেলো সেদিন রাতে , মনমেজাজ খুব খারাপ। তাই হরিদার চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিতে গেলাম, যদিও এইসময় আমার বন্ধুরা কেউ আড্ডা দিতে আসে না, ওদের সময় দশটার পরে। তবুও পা বাড়ালাম।

এইতো এসে গেছে ব্যাঙ্কের লোক, আসুন আসুন। ভিতর থেকে কেউ ডাক দিলো - আরে দাদা যে , কি মনে করেছেন আপনারা। দেশের অর্থনীতির কি যে ক্ষতি করছেন আপনারা বোঝেন?-- চায়ের দোকানের ভিতরে বসে থাকা মুখচেনা কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো। জানিনা উনি অর্থনীতির ছাত্র কিম্বা শিক্ষক কিনা।

পাশ থেকে আর একজন ফুট কাটলো -- টানা চারদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ ,কি মজা , সরকারি ব্যাঙ্কের বাবুরা সব ঘরে বসে মাইনেটি পাবেন । একদম অচেনা একজনের হা-হুতাশ -- সাধারণ মানুষের কি যে কষ্ট তা যদি ওরা বুঝতো .....

হরি দা আদা দিয়ে বড় এক ভাঁড় চা দাও দেখি -- আমি দোকানের ভিতর সেঁধিয়ে গেলাম। দোকানে চারটে বেঞ্চি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আটদশজন বসে আছে। একটি কমবয়সী ছেলে সাতসকালের বাসি খবরের কাগজ গোগ্রাসে গিলছে। ছেলেটি আমায় বললো, কাকু ভালো আছেন?

আমি মৃদু হাসলাম। প্রথমজন আবার জানতে চাইলেন, কি হলো দাদা?

সত্যি টানা চারদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ, খুব অসুবিধা তাইনা? সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলি, আচ্ছা যদি এই সরকারি ব্যাঙ্কগুলো যদি একদম বন্ধ হয়ে যায় তবে?

হরিদা মুখ বেঁকিয়ে বললো, আর ভাবছো কেন চৌধুরী, ওরা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে যাবে। কতোদিনকার সাধ।

হরিদার বিদ্যের দৌড় বড়জোর পাঁচ কেলাস, কবে বিহারের সুদূর গ্রাম থেকে এসে এখানে চায়ের দোকান দিয়েছে । কিন্তু আমি জানি হরিদা বোধ, বুদ্ধি, চেতনা ও মননে অনেকের থেকে উন্নত।

আমি মানুষের মুখগুলো ভালোভাবে দেখলাম, একজন সরকারি পেনশনভোগী, একজন প্রাইভেট অফিসে কাজ করে,একজন আধা রাজনীতিক আর বাকিদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিনা। শুধু কমবয়সী ছেলেটির কোন আগ্রহ নেই।

আমিও একটি সরকারি ব্যাঙ্কে চৌত্রিশ বছর কাজকরে অবসর নিয়েছি, কাজেই এরকম প্রশ্ন বা তাচ্ছিল্যের অনেকবার মুখোমুখি হয়েছি। মোটামুটি যে মন্তব্য বা প্রশ্নগুলি এতবছর ধরে শুনে আসছি সেগুলো লেখার শুরুতেই পেয়েছি। এমনই আরো অনেক অনেক প্রশ্নের মধ্যে - আর কত মাইনে বাড়াতে হবে এদের (ধর্মঘট মানেই জানে মাইনে বাড়ানোর দাবি, যদিও যাদের বাড়ির কেউ ব্যাঙ্কে কাজ করে তারা জানে আসল অবস্থা) / ব্যাঙ্কের পরিসেবা (ষেবা লিখলাম না ইচ্ছে করে) খুব খারাপ / স্টাফেরাতো আমাদের মানুষ বলে মনেই করে না / কোনোদিন পাসবুক আপডেট হয়না (কেউ কেউ একইদিনে জমা দিয়ে ও তুলে প্রতিক্ষেত্রে পাসবুক মেলে ধরেন ) / আমাদের টাকায় মাইনে পাচ্ছে (মানে যা জমা দিচ্ছে তার থেকেই .....)

আরো এইধরণের হাজারো অভিযোগ।

আর সকলের একটাই নিদান - ব্যাঙ্ক গুলো বেসরকারি করে দাও , তবে বাছাধনেরা টের পাবে।

ওপরের অভিযোগগুলির উত্তর বা প্রতিবাদ, পক্ষে বা বিপক্ষে অনেকে অনেকভাবে বিভিন্ন ফোরামে পরিসংখ্যান দিয়ে অনেকদিন ধরে লিখেছেন, বলেছেন বা আজ প্রতিমুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াতে চর্চা চলছে , তাই আমি আর বিশেষ কিছু বলবো না। চায়ের দোকান থেকে অনেকক্ষণ চলে এসেছি আর বেশি কিছু না বলে।

আমি শুধু যে ব্যাঙ্কে তিনদশকের বেশি সময় কাটিয়ে এলাম তার বিষয়ে কিছু বলি। বিবাদী বাগে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের উল্টোদিকে যে, "তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে / সব গাছ ছাড়িয়ে / উঁকি মারে আকাশে .. " সেখানেই পেয়ে গেলাম জীবনধারণের অক্সিজেন, দু দুটো কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির প্রলোভন ছেড়ে। তারপর কত শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এসেছে গেছে, তবুও বসন্ত দরজায় কড়ানাড়া দিয়েছে বারবার। চাকরি করতে করতে কত অচেনা মানুষ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখদুঃখের সাথী করে নিয়েছে সেটা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক শব্দ খরচ করতে হবে, তাই সেকথা অন্য কোনোদিন। আজ শুধু আমার অভিজ্ঞতা একটু ভাগ করেনি। আমি নিজে এটিএম, গুগুল পে, নেট ব্যাঙ্কিং, মোবাইল ব্যাঙ্কিং ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত বলে ব্যাঙ্কে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু এবারে যেতেই হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে, সাইনবোর্ড পাল্টে গেছে। ভিতরে ঢুকে মনে হলো সব কিছুতেই কেমন "উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে" বিজ্ঞাপন, যেখানে দশজন স্টাফ ছিল, সেখানে মেরেকেটে তিন থেকে চার। চেনা কেউ নেই বলেই চলে, বাংলা ভাষাটাই যেন অনেকের কাছে অচেনা। অবশ্যই দুএকজন খুব আন্তরিক কর্মী আজও আছে, তাদের কাজ করার আগ্রহ বা চেষ্টা কোনোকিছুর ঘাটতি নেই। তবে তারাও নিধিরাম সর্দার, হাতে বন্দুক নেই, বন্দুক আছেতো টোটা নেই, টোটা আছেতো কিভাবে ছুঁড়তে হবে জানা নেই, সব কিছু আছেতো অন্তর্জাল ছিঁড়ে গেছে। ওরা কাজ করবে কি ভাবে? পেনশনের দিন কখন পেনশন জমা পড়বে কেউ জানে না। জমা টাকার সুদে যাদের দিন চলে তাদের ন্যায্য পাওনাও অনিয়িমিত, কোনোরকমে নাগাদ জমা - তোলার কাজ চলছে। স্বল্পসঞ্চয় আমানতকারী প্রতিনিধিদের তিনমাসের বেশি কাজ বন্ধ , আর মানে পেটের ভাত বন্ধ । কর্তৃপক্ষের কিছু এসে যায় না , তারা সবেতেই সংযুক্তিকরণের মালা জপছে। সবদিকে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা।

অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আরো অনেকের সাথে অসুস্থ বৃদ্ধা, অশক্ত বৃদ্ধ। পেনশন তুলতে পারলে তবে ওষুধ কেনা যাবে, সুদের টাকা না পেলে কাল কি হবে কেউ জানেনা। নিজের কোনো পরিচয় না দিয়েই কোনোরকমে কিছু কাজ সেরে বেড়িয়ে এলাম, জানিনা বাকি কাজ কি করে হবে। সত্যি তো, সাধারণ মানুষের দুঃখের কথা কে ভাবে?

তবে মানতে হবে, মাননীয় সরকার বাহাদুরের কানে গেছে আমজনতার দাবি, বাছাধনদের টের পাওয়াতে হবে। সরকারি ব্যাঙ্কগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে একদম ঘ্যাঁট পাকিয়ে দিতে হবে, তারপর কোন এক সুদিনে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বেচে দিতে হবে বেনিয়াদের হাতে। তবেই না বাছাধনরা টের পাবে, অবশ্য বাছাধন মানে তখন শুধু ব্যাঙ্কের কর্মী অফিসাররা নয়, আপামর সাধারণ জনতা। তাই ব্যাঙ্ক লাঠে উঠলেও এক লক্ষ টাকার বেশি কেউ পাবে না, যত টাকাই আমানত থাকুক। অতএব আনন্দ করুন, আনন্দ করুন প্রাইভেট ব্যাঙ্কে যাবেন, মোটা টাকা রাখবেন। এটিএম, ক্রেডিট কার্ড সব পাবেন, ধাঁ চকচকে অফিস। তবে হ্যাঁ, ব্যাঙ্কের কাউন্টারে বসে থাকা সেই ছেলিটিকে আর কোনোদিন পাবেন না যার কাছে গিয়ে অকপটে জানাতেন আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা। আর ছেলেটিও হাসিমুখে আপনার সমস্যা মেটাতে সচেষ্ট থাকতো।ম্যানেজারের চেম্বারে আর কাউকে হয়তো পাবেন না, যিনি সব জরুরি কাজ ফেলে আপনার জন্য তৎপর হয়ে উঠতেন। সে ছেলেটি আজ শত খুঁজলেও পাবেনা ক্রিস্টমাসের আগের দিন নিজের হাতে তৈরি কেক নিয়ে ব্যাঙ্কে হাজির মিস ক্যাথরিন, হাই হিরো, মেরি খ্রীষ্টমাস (জীবনে ওই একজনই আমাকে হিরো বলে সম্বোধন করতেন )। কিম্বা আলী চাচার সেই দরদমাখা স্বর, হ্যাঁরে বাছা, তোর মুখটা এতো শুকনো লাগছে যে, জ্বর রয়েছে নাকি, তুই আজ অফিসে এলি কেন?

আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে সেইসব ভালোবাসার সম্পর্ক রেখা বৌদি, সুনীলদা, রত্নামাসি, চ্যাটার্জী খুড়োদের? এখন সবাই শুধুই কাস্টমার। নামহীন,  গোত্রহীন সংখ্যার দল।

এইভাবেই অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে - আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, উত্তুঙ্গ পর্বত থেকে মালভুমি, মরুভুমি হয়ে নদী বিধৌত সমভূমি আর উপকূল ঘিরে সাগরের অতল জলের আহ্ববান। বিষিয়ে যাচ্ছে আমাদের আকাশ, বাতাস, পরিবেশ। বিকিয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যাঙ্ক, ভারতীয় রেল তার ট্রেন প্লাটফর্ম সমেত, ভারতীয় জীবন বীমা, বিমান বন্দর, জাহাজঘাটা, কয়লা, লোহা আরো সব খনিজ রত্ন ভান্ডার আর সুজলাং, সুফলাং শস্যশামলাং দেশমাতৃকা । কিন্তু তাতে আমাদের কি আসে যায়?

আমরা মেতে থাকি ধর্মে ও সিরিয়ালে আর 'ঘন্টাখানেক সঙ্গে ঘুমোন', ভাবতে থাকি সেবায়েতরা এখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছেন কিনা, শুনতে থাকি মানবসেবায় নিয়োজিত প্রাণ দিদি দাদাদের অভিনয় ছলচাতুরী আর অমৃতকথন। আর আপাতত ব্যাঙ্কের (থুড়ি ,কর্মচারীদের) পিন্ডি চটকানো চলুক, চারদিন কেন ব্যাঙ্ক বন্ধ (দুদিন শনি, রবি ) এই নিয়ে। পরে দুদিন আবার বীমা শিল্পে ধর্মঘট। তারপর কোনো এক শুভক্ষনে পবিত্র গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে আসি।

কিন্তু না, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। তাই কেউ কেউ চোখ খোলা রাখে, প্রতিবাদ হয়, ধর্মঘটে নামতে হয়। ঘরে বসে সবেতন ছুটি নয়, প্রতি ক্ষেত্রে মাইনে কাটাতে হয় (সুযোগ সন্ধানীরা অবশ্য ফাঁকফোকর খোঁজে)। ব্যাঙ্ক বাঁচলে তবেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বাঁচবে। তাই ব্যাঙ্ককে ও দেশের সম্পদকে লুঠেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে সর্বাত্মক প্রতিরোধে নামতেই হবে - "অনেকতো দিন গেলো বৃথা এ সংশয়ে , এস এবার সকল দ্বিধা পার হয়ে..."।

ধ্বংসের মুখমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের সকলকে লড়তে হবে একসাথে, বন্ধু তুমিও থেকো আমাদের পাশে। নাহলে একদিন সেইদিন সঙ্গীবিহীন পথ খুব তাড়াতাড়ি মিশে যাবে কৃষ্ণগহ্বরে।

পরিশেষে আবার স্মরণ করি ১৯৩৭ সালের মহামানবের আবির্ভাবের পুণ্যদিনে কবিগুরুর সেই অমোঘ সাবধানবাণী।

"নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস--
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে। " ---শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

0 comments:

0

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in


‘আজ রাত্রে না হলেও
আগামী কাল রাত্রে
আমি জেলে যাব। ...
অন্তরের একটি পাতাও নড়ছে না
অচৈতন্য ঘুমের মতো আমার মন
                                               শান্ত
                                               নির্বিকার
আমার মন
              শান্ত
                              নির্বিকার;
কারণ, নবজাত শিশুর মতো
নীল আকাশ আমি দেখছি।
কাল
শহরের ময়দানে আমি হেঁটে গিয়েছিলাম।
হেঁকে বলেছিলাম
‘আমাদের ভাই বন্ধুদের আমরা যেন না মারি,
যেন শয়তানের জন্যে
না মরি।’   
                                                     [শয়তানদের জন্যে যেন না মরি]


দাঁড়ান দাঁড়ান,
আচ্ছা, এই কবিতাটা সুভাষের যেন কোন বইয়ের?
ম্‌ম্‌ম্‌, নাকি অপ্রকাশিত?
খুব চেনা চেনা এই মুখভাষা, ভাষার এই ভঙ্গি
কুরুশকাঠিতে বোনা সেই উলিডুলি শব্দ নকশা
কবিতার দেহভঙ্গিতেও বিশুদ্ধ সুভাষিত সুবাস
কিন্তু...

আসলে যে ভাষায় মানুষ স্বপ্ন দেখে ও দেখে না
মুখে আঁচল চেপে গুমরে কাঁদে ও কাঁদে না
যে ভাষায় দিনগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে
কিড়মিড় দাঁতে কপালের মিনমিনে ঘাম মুছে নেয় ও মুছে নেয় না
কৈশোরের নিষিদ্ধ যৌনতার মতো লুকোনো তীব্রতায়
যে ভাষায় আজন্ম নাড়িভুঁড়ি খাবলে খায় বেয়াদপ খিদে
ঈগলের ঠোঁটে কলজে ঠোকরানোর সময়ে
প্রমিথিয়ুসের গোঙানির অথবা
শুকনো পাতায় জ্বালানো আগুনের যে দাউদাউ ভাষা
শয়তানের দোর্দণ্ড সপাং-এর সামনে যে ভাষায়
মানুষ শিরদাঁড়া টানটান করে রুখে দাঁড়ায়
যে ভাষা মানুষকে প্রেমিকাওষ্ঠের মতো মাখন নরম
আর ইস্পাতের মতো কঠিন করে তোলে
যে ভাষায় আমরা ইচ্ছেগুলোকে
ঘুড়ি বা পায়রার মতোন আকাশে ওড়াই
আর ভাবনাদের ডেকে বলি –
আয় না রসময়ের চায়ের ঠেকে
তেলকুচকুচে ছারপোকা বেঞ্চিতে
হাঁটুতে হাঁটু কিম্বা কাঁধে কাঁধ ঠুকে
দু’চিমটে আঙুলে গরম ভাঁড়ে
ফুঁ দিতে দিতে
ফুঁ দিতে দিতে
বসি
বলি
উঃ, কতোদিন দেখিনি তোকে
যে ভাষায় উজাড় বুকে উদ্বাহু নিষাদে
সম্বোধন করি আমার প্রিয় দেশকে
স্বাধীনতাকে
কোকিল ঋতুকে
আর কোমল ঋষভের নরম স্বগত ভাষায়
নিবিড় ডাকি আমার নরমতর ভালোবাসাকে
... কেন তোমায় আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়
বিচার সবেমাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
যে, ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।...
... ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সর্বদা ফুর্তি থাকে।                           [জেলখানার চিঠি]

ঠিক এই ভাষায়
অবিকল এই মুখভাষায় অবলীলায় কবিতা লিখেছেন নাজিম হিকমত।
যদিও যে ভাষায় তিনি লিখেছেন,
সেই তুর্কী ভাষা অনুবাদক সুভাষ জানতেন না
সুভাষের অনুবাদ মূলত ইংরেজি ও কিছু ফরাসি তর্জমা থেকে।
তবে নাজিম মুখভাষায় লিখেছিলেন কিনা – কীকরে জানলাম?
আসলে, গদ্য বা কথা বলার ভাষা আর
কবিতার ভাষায় বৈষম্য মানেননি নাজিম
‘নাজিম হিকমতের কবিতা’ বইয়ের শুরুতে

নাজিম নিজেই জানাচ্ছেন –

‘সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত, সংগ্রাম আর প্রেরণা, জয়-পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা, খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব ক’টি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যে ধারণা দেয় না।

 ‘কবিতার, গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার ভিন্নতা নতুন কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন – যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র, গভীর, একান্ত জটিল – অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা। সে ভাষায় উপস্থিত থাকে জীবনের সমস্ত উপাদান। কবি যখন লেখেন আর যখন কথা বলেন কিম্বা অস্ত্র হাতে নেন – তিনি একই ব্যক্তি। কবিরা তো আকাশ থেকে পড়েননি যে, তাঁরা মেঘের রাজ্যে পাখা মেলবার স্বপ্ন দেখবেন; কবিরা হলেন সমাজের একজন – জীবনের সঙ্গে যুক্ত, জীবনের সংগঠক।‘

নাজিমের কবিতা তাই
শিল্পের আয়নায় জীবনের ক্লোজআপ সেলফি-মুখ 

নাজিমের কবিতা তাই
তার সংঘাত আর সংগ্রাম

নাজিমের কবিতা তাই
পরাজয় ভেদ করে চিরকালীন জয়ের ঠিকানা
আপামাথা টগবগে জীবন আর জীবনভর
লড়াই ও তীব্র ভালোবাসার কথা

নাজিমের কবিতা তাই
নিভৃত পাঠের সময়েও
সমুদ্রের মতো সোচ্চার মোনোলগ
যেন আয়নার মুখোমুখি বজ্রকন্ঠে আত্মশাসন।

এই জন্যই কবিতা ও যাপনে
আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানির মতো
তুরস্ক আর কলকাতার কোনো ভেদ নেই
এইজন্যই সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর আশ্চর্য অগ্রজ
নাজিম হিকমতের কবিতা আর যাপন
মিলে চলে গেছে এক বৈকুন্ঠের দিকে

‘নাজিম হিকমতের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৫৮ সালে তাশখন্দ্‌ শহরে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে। প্রাণচঞ্চল সুপুরুষ দীর্ঘকায় চেহারা। হাজার মানুষের ভিড়েও সে চেহারা হারাবার নয়। দেখে কে বলবে তখন তাঁর ছাপ্পান্ন বছর বয়েস। তুরস্কে বড়ো ঘরে তাঁর জন্ম। সতেরো বছর বয়সে নৌবাহিনীর অফিসার হিসেবে শিক্ষানবীশ থাকার সময় নৌবিদ্রোহে যোগ দেওয়ায় দেশ ছেড়ে তাঁকে সরে পড়তে হয়। এই সময় তিনি যান সদ্য বিপ্লবোত্তর রুশদেশে। কিছুদিন পর ফিরে এসে তিনি বামপন্থী দলভুক্ত হয়ে তুরস্কের জাতীয় বিপ্লবে অংশ নেন।... হিকমতকে আমি দ্বিতীয়বার দেখি ১৯৬২ সালে কায়রোয় আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে। তার বছরখানের পর হিকমত মস্কোয় মারা গেলেন। হিকমতকে দু-দুবার কাছে পেয়েও ফরাসি বা রুশ ভাষা জানা না থাকায় তাঁর সঙ্গে মন খুলে আলাপ করা সম্ভব হয়নি।’ [অনুবাদ প্রসঙ্গে – সুভাষ মুখোপাধ্যায়]

পনেরোই জানুয়ারি উনিশ’শ দুই
তৎকালীন অটোমান অধুনা গ্রিসের সালোনিকায় জন্ম।
বাবা সরকারি কর্তা, মা শিল্পী, দাদু তুরস্কের সম্ভ্রান্ত রাজপুরুষ।
মা ও দাদুর উৎসাহেই চোদ্দো বছর বয়সে
অর্থাৎ সুভাষের জন্মেরও তিন বছর আগে
কবি হিসেবে প্রথম প্রকাশ।
উনিশ’শ বাইশে রাশিয়ায় আলাপ
মায়াকভস্কির সাথে, আর সেই থেকে
আমৃত্যু মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই ময়দানে –

... এক পাহাড়ের চূড়ায় আমি আনাতোলিয়ার একটি গ্রাম
তুমি আমার সবচেয়ে রূপবতী মহিমান্বিত নগরী
তুমি আর্ত চীৎকার,
                   আমার দেশ।
যে পদচিহ্ন তোমাকে খুঁজছে,
                   সে তো আমারই।।                          [তুমি আমার দেশ]

 

জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে
যারা মাটির পিঁপড়ের মতো
সমুদ্রের মাছের মতো
আকাশের পাখির মতো
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মতো সরল
যারা ধ্বংস করে
যারা সৃষ্টি করে।                               [আমি জেলে যাবার পর]

এই তো মার্ক্সবাদী দর্শন –

বয়সে সতেরো বছরের ছোটো কবি সুভাষ
তাঁর সত্যিকার অগ্রজ কলমকে খুঁজে পেলেন।
এবং উনি পেলেন বলেই আমরাও পেয়ে গেলাম
ঋজু সহজ বাঙলায়
‘নাজিম হিকমতের কবিতা’
ভাগ্যিস!

– অনুবাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫২। ঈগল পাবলিশিং কোং। ১১/বি চৌরঙ্গী টেরাস, কলিকাতা ২০। প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৫২। দাম দেড় টাকা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৮। বাইশটি কবিতার সংকলন। পরবর্তীতে ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ গ্রন্থভুক্ত বিশ্ববাণী সংস্করণে আরো দুটি কবিতা সংযোজিত।
‘এ বইতে যে ক’টি কবিতা আমি অনুবাদ করেছি, তার সবগুলিই প্রায় ইংরেজি থেকে। ফরাসী ভাষায় প্রকাশিত হিক্‌মতের একটি কবিতা সংকলন থেকে কয়েকটি কবিতা অনুবাদের ব্যাপারে গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রণজিৎ গুহের সাহায্য নিয়েছি! হিকমতের কবিতা অনুবাদ করতে করতে একটা কথা কেবলই মনে হয়েছে – যদি মূল ভাষায় কবিতাগুলো পড়তে পারতাম। বাংলায় তার অনুবাদ তাতে হয়ত আরেকটু যথাযথ হতে পারত। ... সভয় শ্রদ্ধায় ছায়ার মত পায়ে পায়ে চলবার চেষ্টা করেছি। [সু মু – অনুবাদ প্রসঙ্গে]

‘এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।... দুঃখের বিষয়, কলকাতায় আজও তুর্কী ভাষা জানা এমন কারো খোঁজ পাইনি আমি যাঁর দ্বারস্থ হতে পারি। ফলে ইচ্ছে থাকলেও নাজিম হিকমতের কবিতার গভীরে ডুব দেবার আমার শক্তি নেই।... কবিতার অকৃত্রিম কিংবা অবিকল ভাষান্তর কখনও সম্ভব নয়। অনুবাদক শক্তিশালী এবং নিষ্ঠাবান হলে বড়জোর তিনি করতে পারেন অন্যের কবিতাকে নিজের ভাষায় যথাসম্ভব ঢেলে সাজাতে। একাজে খানিকটা সুবিধে হয় মূলভাষা জানা থাকলে কিংবা তার খানিকটা আঁচ পেলে। সে সুবিধে না থাকলে কবিতা বাছাইয়ের ব্যাপারেও পুরোপুরি পরনির্ভর হওয়া ছাড়া অনুবাদকের অন্য কোনো উপায় থাকে না।’ [ সু মু - নাজিম হিকমত প্রসঙ্গে – নাজিম হিকমতের আরো কবিতা]

হৃদরোগে মৃত্যু - উনিশ’শ তেষট্টির তেসরা জুন।
একষট্টি বছরের জীবনে
কোনো ফৌজদারি অপরাধে নয়
বরং মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা,
অথবা অর্থনৈতিক সাম্যের কথা
শোষণমুক্তির কথা বলার মতো
রাষ্ট্রবিরোধী সাংঘাতিক সাংঘাতিক অপরাধের অভিযোগে
(‘রাষ্ট্রবিরোধী’ – এই শব্দটা ইদানিং আমাদের নিকট পড়শি)
সর্বমোট ছাপ্পান্ন বছরের কারাদণ্ডিত –
শাসক সত্যিই ভয় পেয়েছিলো
তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটা কলমকে -
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী কবি
নাজিম হিকমতের তিন আঙুলের ফাঁকে যার মগ্ন বসবাস।
উনিশ’শ আঠাশ থেকে দশ বছরে পাঁচ বছরের বেশি সময়
নাজিম কাটান জেলে।
ফের আটত্রিশে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগানোর অপরাধে
আঠাশ বছরের জেল হয় তাঁর।
কখনো তিন মাসাধিক কাল চার বাই ছ’ফুট জেলকুঠুরি
কখনো সপ্তাহের পর সপ্তাহ জাহাজের পায়খানার মধ্যে
একমনে চুপিচুপি শুধু
কলমে আর শব্দে
ধৈর্যে আর বোধে
ক্রোধে আর অটুট বিশ্বাসে
মেরুদণ্ডের হাড়ে শান দিয়ে গেছেন হিকমত
পরে আনাতোলিয়ার জেলে থাকাকালীন
সহবন্দী কৃষকদের মারফৎ চুপিচুপি
বাইরে পাঠাতে থাকেন
সেই সব তেজস্ক্রিয় কবিতার অস্ত্রশস্ত্রাদি।
উনপঞ্চাশে নাজিমের মুক্তির জন্য
প্যারিসে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক কমিটি
একযোগে উদ্যোগী হন
নেরুদা, পিকাসো, আরাগঁ, সার্ত্র, রোবসনেরা।
বিশ্ব জনমতের চাপে বন্দীমুক্তির পরেপরেই
গুরুতর হৃদরোগী নাজিমকে জোর করে
মিলিটারিতে ভর্তির চেষ্টা হলে
আবার স্ত্রীপুত্র ফেলে গোপনে দেশ ছাড়া।
জীবনের শেষ তেরো বছর
সোভিয়েত ছাড়াও বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে
অজস্র লিখে গেছেন নাজিম।

‘উনিশ শো একান্ন কি বাহান্ন সালে কলকাতায়, জানি না কী ক’রে, আমাদের বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরিজি তর্জমা। ইংরিজি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তবু প’ড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রধানত সেই কবিতাগুচ্ছ অবলম্বন ক’রেই বাংলায় বার হয়েছিল আমার ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’। অনেকে বলেন, এই সময়কার আমার নিজের অনেক কবিতাতেও নাজিম হিকমতের লেখার ছাপ পড়েছে।...’[সু মু – নাজিম হিকমত প্রসঙ্গে]

এই বইয়েরই দ্বিতীয় কবিতার আংশিক উচ্চারণ করেই
আমি এই রচনা শুরু করেছি।
কবিতাংশের শরীর লক্ষ্য করুন পাঠক,
‘শান্ত’ আর ‘নির্বিকার’ শব্দদুটি
দুটি আলাদা পংক্তির বিশালত্বে
দু’বার দু’রকম মার্জিন-মেজাজে
(Indentation-এর বাঙলা তর্জমা কি – অক্ষমতার ক্ষমাপ্রত্যাশী)
পৃথক সুরের আয়তনে খোদাই হলো
কবিতার শরীর-ভাস্কর্যে।
আসলে এইভাবে দুটি শব্দের মাঝখানের শূন্যতার দৈর্ঘ্য-দূরত্বের তারতম্যে
শব্দ দুটির পারস্পরিক সম্পর্কের
সুর
রঙ ও
সময়ের
আশ্চর্য বদল ঘটতে থাকে –
যা কবি ও পাঠক উভয়ের কাছেই এক গভীর অন্তর্মুখি উপভোগ্য খেলা -
মার্জিন ভাঙার খেলাটা কি তবে সুভাষের এই অগ্রজের থেকেই শেখা?
যদিও বাঙলাকবিতায় এই খেলা শুরু সম্ভবত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হাতেই
সুভাষ জন্মানোর চার বছর আগে

‘বলাকা’ বইয়ের ‘চঞ্চলা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
... নাড়ীতে নাড়ীতে তোর চঞ্চলের শুনি পদধ্বনি,
বক্ষ তোর উঠে রণরণি
নাহি জানে কেউ –
রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ
কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যকুলতা;
মনে আজি পড়ে সেই কথা –
যুগে যুগে এসেছি চলিয়া
স্খলিয়া স্খলিয়া
চুপে চুপে
রূপ হতে রূপে
প্রাণ হতে প্রাণে;
নিশীথে প্রভাতে
যা-কিছু পেয়েছি হাতে
এসেছি করিয়া ক্ষয় দান হতে দানে
গান হতে গানে। ...’

কিন্তু পদাতিক থেকে অগ্নিকোণ অবধি কোথায় এই মার্জিন-মেজাজ?
বরং নাজিম অনুবাদকালে
অন্যত্র
সুভাষ নিজেকে ভাঙছেন এবং প্রথম লিখছেন -

ভেঙো নাকো, শুধু ভাঙা নয়।
চাষের জন্যে যে জমিটা পেলে ভালো হয়,
সে তো ঠিক
বালি-চিক-চিক
ডাঙা নয়।

 

দেখ দেখ, এই ছোট্ট সবুজ উঠোনেই –

 

হামাগুড়ি দেয়,
ব্যথা পেলে কাঁদে,
পড়ে গেলে ঠেলে ওঠে ফের,
ছোট ছোট দুটো মুঠো দিয়ে বাঁধে
সাধআহ্লাদ আমাদের। ...

 

ভেঙো নাকো, শুধু ভাঙা নয়। ...                     [শুধু ভাঙা নয় – ফুল ফুটুক]


’৫২তে প্রকাশ পায় ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’
আর তার পরের কাব্যগ্রন্থ এই ‘ফুল ফুটুক’ বইয়েই
আরো ধারালো হয়ে উঠছেন সুভাষ -

‘... আমরা বলেছিলাম যাবো
                                                  সমুদ্রে।
নদী বলেছিল যাবে
সমুদ্রে।
আমরা বলেছিলাম যাবো
সমুদ্রে।
আমরা যাবো।।                                             [আমরা যাব]

(‘যাব’ এবং ‘যাবো’ – বানানে এই ‘ও’কার প্রমাদ – কার? মুদ্রকের নাকি স্বয়ং কবির? জানিনা। তবে কবির অন্যমনষ্কতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না – উদাহরণ - ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থের পরপর দুটি কবিতা – ‘পোড়া শহরে’ আর ‘পাথরের ফুল’ – প্রথমটায় লিখছেন ‘...যেখানে ঢেউ তুলে আমাকে ডেকে নেবে নদী/ যেখানে যাব/আর আসব না।’ আর পরেরটাতেই ‘...যাবো বলে/সেই কোন্‌ সকালে বেরিয়েছি-/উঠতে উঠতে সন্ধে হল।’ এই বিষয়ে আমি নিতান্তই মাছিমারা এবং ‘আমরা যাব’ কবিতায় ‘কবিতা সংগ্রহ ১’, দেজ-এর সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণপন্থী আর ‘যত দুরেই যাই’ থেকে উদাহরণে ‘কবিতা সংগ্রহ ২’, দেজ-এর দ্বিতীয় সংস্করণ, - উভয়েরই প্রকাশকাল জুলাই ২০০৩ )

কবিতার এই নব্য শরীর বিন্যাস কোত্থেকে পেলেন সুভাষ?
হিকমত লিখেছিলেন -

‘...পৃথিবীকে পাঁচ টুকরো করলে তার এক টুকরো
এশিয়া,
এশিয়ার অনেক দেশের একটি দেশ
ভারতবর্ষ,
ভারতবর্ষের অনেক শহরের একটি শহর
কলকাতা,
সেই কলকাতার একটি মানুষ
বাঁড়ুজ্যে।...         [কলকাতার বাঁড়ুজ্যে]

সুভাষের কবিতা লেখা শুরু আটতিরিশে।
ছেষট্টিতে প্রকাশিত তাঁর অষ্টম বই ‘কাল মধুমাস’এর
পঞ্চম কবিতা।
সুভাষ লিখছেন –

‘...মাথার ওপর লম্বা একটা লাঠি উঁচিয়ে
কোলে-পো কাঁখে-পো হয়ে
একটা ট্রাম
তার পেছন পেছন
তেড়ে গেলে
তারের গায়ে অনেকক্ষণ ধ’রে ঝুলে থাকল
একটা একটানা
ছি
ছি
শব্দ                                      [খোলা দরজার ফ্রেমে]

চোদ্দ বছর আগে সুভাষের অনুবাদে হিকমত লিখছেন -

‘...তিন নম্বর ট্রাক গেল থেমে।
অন্ধকার,
জ্যাক্‌,
পাম্প,
হাত,
লোকটার শাপান্তকারী হাত, শাপান্ত করতে হচ্ছে বলেই ক্রুদ্ধ।
... ভেতরকার টিউবটা ফেটে চৌচির
ফাল্‌তু কোনো
টায়ারও নেই।...
... খুলে দিগম্বর হল সে...
কোট, পাজামা, জাঙ্গিয়া, শার্ট, লাল চাদর
শুধু আহম্মদের পায়ের জুতোজোড়া ছাড়া আর সব কিছুই
টায়ারের পেটে গিয়ে
পেট উঁচু হল।
এ এক ধ্রুপদী আলাপ।
বন্দরেরর গায়ে শহর
তার সাদা ওড়না।...
ঘন্টায় তিরিশ মাইল বেগে চলেছি।
পুরনো ট্রাক, সামালকে ভাই, সামালকে –
সামলে চলো যেন পাহাড়গুলো দেখতে না পায়
উলঙ্গ অনাবৃত আহম্মদকে। ... [আহম্মদ ড্রাইভার]

প্রান্তিক খেটে খাওয়া জীবনের এই অজস্র খুঁটিনাটি
লড়াই-আহত যাপনের প্রতিটি রোমকূপের বিশদ বর্ণনা
ফোঁটা ঘামের সঙ্গে রাস্তার ধুলোর জবরদস্ত ঐক্য
বনাম শাসক-রাষ্ট্রের ধুন্দুমার লড়াইয়ের রক্ত-রসায়ন
মানুষ এবং তার সাথে
প্রকৃতি পরিবেশ মহাকালের
নিষ্ঠুর অনুষঙ্গ ও নিবিড় হৃদয়ঘটিত একাত্মতা –
হিকমত লিখলেন

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি...

সেরেজের বাজারে
কাঁসারির ঝাঁপের সামনে
একটি গাছে ঝুলছে বদরুদ্দিন আমার।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি...

নক্ষত্রহীন এই নিশুতি রাত্রে
নিষ্পত্র গাছের ডালে
বৃষ্টিতে ভিজছে
আমার শেখের উলঙ্গ শরীর। ...           [শেখ বদরুদ্দিনের মহাকাব্য থেকে]

‘কলকাতার বাঁড়ুজ্যে’, ‘আহম্মদ ড্রাইভার’ ও ‘শেখ বদরুদ্দিনের মহাকাব্য থেকে’ – তিনটি পৃথক মহাকাব্যের একেকটি অংশ। ‘বাঁড়ুজ্যে’ হলেন কলকাতার একজন বিপ্লবী, তাঁকে নিয়ে হিকমত ‘বাঁড়ুজ্যে কেন খুন হলেন’ নামে একটি মহাকাব্য লিখেছেন। ‘আহম্মদ ড্রাইভারে’র স্থান তুরস্কের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে। ‘শেখ বদরুদ্দিন’ তুরস্কের পুরনো যুগের এক গণবিদ্রোহের নায়ক। আদিম সাম্যবাদী সমাজের আদর্শে তিনি ছিলেন অনুপ্রাণিত। সেকালের শাসকশ্রেণীর হাতে তাঁর ফাঁসি হয়। [সু মু – অনুবাদ প্রসঙ্গে]

আর বাষট্টিতে প্রকাশিত ‘যত দূরেই যাই’ বইয়ে
সুভাষের কলম নির্মাণ করলো ‘পা রাখার জায়গা’ -

পৃথিবীটা যেন রাস্তার খেঁকি-কুকুরের মতো
পোকার জ্বালায়
নিজের ল্যাজ কামড়ে ধ’রে
কেবলি পাক খাচ্ছে;
আর একটা প্রকাণ্ড ফাঁকা প’ড়ো বাড়িতে
তার বিকট আর্তনাদই হল
জীবন
অথবা আরো দশ বছর পরে বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে
‘ছেলে গেছে বনে’ বইয়ে
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক এ বাঙলায়
গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে সুভাষ লিখছেন –

বুকে বাঁধছে ঢাল যতই ছেড়ে যাচ্ছে নাড়ি
ভয় পেয়ে দেখাচ্ছে ভয়
পথে বসছে ফাঁড়ি

ইষ্টনাম জপতে জপতে
হাতে ধরল খিল
হাতের ঠোঙা হাতেই রইল
মিঠাই নিল চিল

ঘোড়া টিপেছে গুলি ফুটেছে হাত ছুটেছে
মাভৈ
টিপসইয়ের যা নমুনা রে ভাই
তাতে তো ভয় পাবই

ভয় পেয়েছি বিষম ভয় পেয়েছি ভয় ভীষণ
আত্মারাম ছাড়তে চাইছে
খাঁচার ইস্‌-
টিশন


নাজিম” নামের অর্থ প্রতিভা, প্রভা, ঔজ্জ্বল্য।
আমার নিজের খুব মনে হয়,
প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে তিনি পাবলো নেরুদার সমকক্ষ
যেমন সত্যজিতের পাশে আমাদের ঋত্বিক।

আমরা একটি আপেলের আধখানা
বাকি আধখানা আমাদের এই বিপুলা পৃথিবী

আমরা একটি আপেলের আধখানা
বাকি আধখানা অগণিত মানুষ

তুমি একটি আপেলের আধখানা
বাকি আধখানা আমি

তুমি আর আমি।।                  [তুমি আমি]

নেরুদা-নাজিম বা সত্যজিত-ঋত্বিকে
আপেলের কে কোন আধখানা
তা নিয়ে বিরোধ বা লড়াই নয়
ইতিহাস সাক্ষী
আছে পরস্পরের প্রতি হেঁটমাথা শ্রদ্ধা
নাজিমের সঙ্গে সুভাষেরও তেমনি –
যদিও সুভাষকে নাজিম কতোটা চিনতেন
আদৌ চিনতেন কিনা – জানিনা
কিন্তু
বাকি আধখানা জানি


১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনূদিত ‘নাজিম হিকমতের আরো কবিতা’। প্রচ্ছদশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী। প্রকাশক – ব্রজকিশোর মণ্ডল, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ৭৯/১, বি মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা ৯। মুদ্রক – আনন্দমোহন দত্ত। নারায়ণী প্রেস। ২৬/সি কালিদাস সিংহ লেন, কলকাতা -৯। দাম – দশ টাকা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮২। মোট ২৭টি কবিতার সংকলন।

এ বইয়ের অবিসংবাদিত নায়ক তারান্তা-বাবু –
আলাদা শেষ চিঠি সমেত সাকুল্যে তেরোটি পত্রকাব্য
রবিঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’ যে কারণে
পত্র অথচ নিছক পত্র নয়,
রোম থেকে লেখা তারান্তা-বাবুকে পাঠানো এই পত্রাবলীও
চিঠি ছাপিয়ে একটা সময়ের প্রবল ইতিহাস

আমাকে তারা বলে
রোমের
জন্মবৃত্তান্ত
আর ঐ যে! ... ছিপছিপে নেকড়ে বাঘিনী
  আর তার পেছনে
মোটাসোটা দিগম্বর রোমুলুস আর রেমুস
আমার ঘরের চারপাশে হেঁটে বেড়ায়।
আহা, তাই ব’লে কেঁদো না;
এ রোমুলুস
সেই রোমুলুস নয়
নীল রুদ্রাক্ষের বণিক
যে লোকটা
প্রকাশ্য দিবালোকে
ভাল্‌-ভালের হাটতলায়
তোমার নাবালিকা বোনকে ধর্ষণ করেছিল।
ইনি হলেন রাজা রোমুলুস, প্রথম রোমক।

‘তারান্তা-বাবুকে লেখা পত্রাবলী’তেও দেখছি
কোথাও কোথাও হাইফেনহীন ‘তারান্তাবাবু’ –
কোনটা সঠিক জানি না।
যাই হোক, যা বলছিলাম,
প্রথম চিঠির পরে আট নম্বরটি দেখুন –

মুসোলিনি বড় বেশি বকবক করে, তারান্তাবাবু।
নিজের খেয়ালে
বন্ধুহীন অবস্থায়
যেন কোনো কচি খোকাকে
ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে ঘোর অমানিশায়।
সপ্তমে গলা চড়িয়ে
আর নিজের কন্ঠস্বরেই ধড়মড়িয়ে উঠে
ভয়তরাসে কখনও জ্বলে উঠছে
কখনও দগ্ধ হচ্ছে,
বকবকানির কামাই নেই!
লোকটা বড় বেশি বক্‌বক্‌ করছে, তারান্তাবাবু।
কারণ
ভয়ে ওর আত্মারাম খাঁচাছাড়া

এই ভাষায় সপ্তমে গলা চড়িয়ে কথা বলতে
কথার মতো সাবলীল আটপৌরে ঢঙে কবিতা লিখতে
যে হিম্মত আর বুকের পাটা লাগে,
অগ্রজের থেকেই কি সুভাষ পেয়েছিলেন
আশকারার ধিকিধিকি আগুন?

... ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা।
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়। ...

‘নাজিম হিকমতের আরো কবিতা’ অনুবাদের পাশাপাশি
একই বছরে প্রকাশিত
‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ কবিতায় সুভাষ লিখছেন

লেনিনকে আমরা দাঁড় করিয়ে রেখেছি ধর্মতলায়
ট্রামের গুমটির একপাশে।
আঁস্তাকুড়ের ভাত একদল খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে
ডাস্টবিনে হাত চালিয়ে দিয়ে।

লেনিন দেখছেন। ...


তবে আমার কাছে এই তারান্তা-বাবু সিরিজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কবিতাটি
‘শেষ চিঠি’
যা আসলে দুটি সোজাসাপটা সাংখ্য তালিকা
একটি
ইংরেজ শ্রমিকের মজুরি ১০০ ধরে
আমেরিকা কানাডা আয়ার্ল্যাণ্ড নেদার্ল্যাণ্ড পোল্যাণ্ড স্পেন ও ইতালির শ্রমিক মজুরির আনুপাতিক হার
আর অন্যটি
ইতালিতে ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ বেকারি আর দেউলিয়াপনার তালিকা,
শেষে একদম টানা গদ্যে লিখছেন –

এই পরিসংখ্যানটি হল,তারান্তা-বাবু, ইতালির ফ্যাসিজ্‌মের জাব্‌দাখাতা। আগামী বছরগুলোতে কী ঘটবে? আমাদের দেশের মাটিতে মরতে এসেছে যে নওজোয়ান সৈনিকের দল, এর উত্তর রয়েছে তাদের কাছে।

কী অসম্ভব হিম্মত লাগে জেলখানায় বসে
সারা বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের লড়াইকে এইভাবে প্রেরণার দায়িত্ব পালনে,
কী অসম্ভব বুকের পাটা থাকলে
জাব্‌দাখাতার সাংখ্যতালিকাকেও কবিতা হিসেবে ঘোষণা করা যায়


‘নাজিমের নিজের বিপ্লবী জীবনের মহিমা আর আন্তর্জাতিক মনুষ্যত্ববোধ – এই দুটি গুনই তাঁর কবিতার সর্বজনীন আবেদনের সঞ্চার করেছে। ... নাজিমের কবিতায় যে সর্বজনীনতা, তার শিকড় রয়েছে বিশেষভাবে তাঁর স্বদেশেরই মাটিতে। নাজিমের জীবন আর তাঁর কাব্য অভিন্ন। তাঁর কবিতাই তাঁর জীবনের ইতিবৃত্ত। সমসাময়িক তুরস্কের ধারাবিবরণ তাঁর কবিতায়। তাই নাজিমের সব কবিতা কালানুক্রমে সাজালে তুরস্কের ইতিহাস বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। তুর্কী ভাষায় নাজিম হিকমত আধুনিক কবিতার জনক। প্রথাগত ছন্দ ভেঙে তাকে তিনি এনে দাঁড় করান মুখের কথার কাছাকাছি। [সু মু – নাজিম হিকমত প্রসঙ্গে – নাজিম হিকমতের আরো কবিতা]


দীর্ঘ কবিতায় অসাধারণ মুন্সিয়ানা ছিলো নাজিমের।
আর জেলের কুঠুরিতে বসে লেখা চিঠিকাব্য
শাসকের পাহারা-চোখে নিরামিষ চিঠির ছাড়পত্র পেয়ে
অথবা না পেয়ে গোপনে হাতে হাতে
পৃথিবীময় ছড়িয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ কবিতার মধ্যে,
সুভাষেরও প্রথম দীর্ঘ কবিতা ঠিক এর পরবর্তী প্রকাশিত বইয়েই
মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ -
নাজিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দীর্ঘ কবিতা ‘জেলখানার চিঠি’
বা পরের সংকলনে ‘তারান্তা-বাবুকে লেখা পত্রাবলী’ ছাড়াও
‘চানকিরি জেল থেকে চিঠি’

একদিন বিকেলে
জেলখানার ফটকের ধারে ব’সে
আমরা পড়েছিলাম গজলীর রুবাই :
“সেই বিশাল নীল বাগিচা
রাতের।
নর্তকীদের ঘুরপাকে চমক দেয় সোনা।
কাঠের বাক্সে মৃতের দল শুয়ে।”
যদি কোনোদিন,
আমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে,
ঘোর বৃষ্টির মত
জীবন যদি গুরুভার ঠেকে,
তাহলে আবার গজলীর রুবাইগুলো প’ড়ো।
আর, এও জানি,
পিরায়ে আমার,
লোকটার বেদম একাকিত্ব
আর মৃত্যুর মুখোমুখি
মহিমান্বিত ভয়
তোমার শুধু করুণারই উদ্রেক করবে।

১৯৬৭ সালে আমেরিকার আইওয়া শহরে এক আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে গিয়ে শঙ্খ ঘোষের আলাপ হলো তুর্কি মেয়ে বিয়ার্শানের সাথে – ঐ শতাব্দীর তুর্কি কবিতা নিয়ে তাঁর আসন্ন বক্তৃতার ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্রে উঁকি দিয়ে শঙ্খ ঘোষ হঠাৎ একটি নাম দেখে উল্লসিত হয়ে উঠলেন – নাজিম হিকমত!

বাঁকা ঠোঁটে বিয়ার্শান বললেন – মনে হচ্ছে তোমার খুব চেনা? নামটা আগে শুনেছো!

শঙ্খ বললেন – অবশ্যই! ইনি তো আমাদের প্রিয় কবিদের একজন।

‘আমাদের মানে?’

‘বাঙালি কবিতা পাঠকের।’

‘কিছু একটা গোলমাল করছো তুমি। অন্য কারোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছো ... মানে, নাজিম হিকমতের কোনো কবিতা তুমি আগে পড়েছো?’

‘একটা-দুটো নয়, পনেরো বছর ধরে পড়ছি, অনেক কবিতা, বাঙলাতেই...’

‘ইম্পসিব্ল, খোদ তুরস্কেই দীর্ঘকাল ধরে নিষিদ্ধ নাজিমের কবিতা পড়া শুরু হয়েছে ষাট সালের পর, আর এখন তো মোটে সাতষট্টি!’

‘তার মানে, তোমাদের কবিতা তোমাদের থেকে আগে আমরাই পড়েছি, অনুবাদ বই প্রকাশিত হয়েছে সেই বাহান্ন সালে...’

কথায় কথায় বিস্ময় বিহ্বলতা কাটতে শেষমেশ বিয়ার্শানের স্বীকারোক্তি – ‘ এবার বুঝতে পারছি সব। আমরা শুনেছি নিষিদ্ধ থাকাকালীন জেলখানা থেকে গোপনে গোপনে লুকোনো ইশতেহারের মতো তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়তো – নানা দেশের সংগ্রামীদের প্রেরণা ছিলো ওঁর কবিতা – এইভাবেই তবে তা পৌঁছে গেছে ভারতেও...’

[শঙ্খ ঘোষের লেখা “ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম” বইয়ের পৃষ্ঠা ২৩-২৪]

নাজিমের শ্রেষ্ঠ কবিতা অবশ্যই ‘জেলখানার চিঠি’
নিরাশা-হতাশা বনাম লড়াই-আশার নিপুণ শাব্দিক নাটকীয় বিবরণে
ব্যক্তিগত আর সমষ্টির যাপন ও স্বপ্নের পরিসরকে
কালবৈশাখির দুরন্ত গতিতে একাকার
আকাশচুম্বী বজ্রনির্ঘোষে যেন
সভ্যতার পরম মানবিক সত্য শোনাচ্ছেন নাজিম -

আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার, আমি তোমাকে ভালবাসি।
...

যে সমুদ্র সব চেয়ে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি
সব চেয়ে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠেনি
আমাদের সব চেয়ে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
তা আজও আমি বলিনি

নাজিম মৃত্যুকে নখের ডগায় রেখে পট্‌ করে শব্দ তোলার হিম্মত
নাজিম শোষণ-মুক্তির পেশ করা আগুন-দাবিসনদ
নাজিম মার খেতে খেতে
মাটিতে মিশে যেতে যেতে
উঠে দাঁড়ানো একচ্ছত্র শিরদাঁড়ার শপথহুঙ্কার
নাজিম শতাব্দীর চেয়েও অনেক বড়ো একটি আপেলের নিরঙ্কুশ আধখানা
যার বাকি আধখানার নাম কবিতা
নাজিম কপালের ঘামকালিতে লেখা সরলরৈখিক চূড়ান্ত আশাবাদ
যা যুগ থেকে যুগান্তরে পীড়িত মানুষের
লড়াই-চিঠির পাণ্ডুলিপি

আমার শতাব্দীর শেষের দিনগুলো বড়ো সুন্দর হবে
সূর্যালোকে ঠিকরে পড়বে আমার শতাব্দী, আমার প্রিয়,
ঠিক তোমার চোখের মতো।।               [বিংশ শতাব্দী, পৃ ১১৬]

‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার মাঘ, ১৩৬৪ সংখ্যায়
অমলেন্দু বসু পঁচিশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রবন্ধে প্রমানের চেষ্টা করেছেন -
কবি সুভাষের চোখ ধাঁধানো চিরকুট সম্ভাবনা
অগ্নিকোণের তল্লাট পেরিয়ে
হিকমত ঝড়েই নাকি পথ হারিয়েছে,
‘ফুল ফুটুক’এর ফুল ফুটতে না ফুটতেই
ক্রমমন্থর নিরুদ্দীপ্ত পরিণতিতে পাঠক প্রত্যাশা নাকি রুদ্ধ।
আমি কবিতার ডাক্তার নই, কবিতায় আমার শ্বাসাবাস,
সেই সম্পর্কের যাপন-সূত্রে এটুকু বুঝি যে
কবিতার বিপ্‌বিপ্‌ ডেসিবেল মাপা যায় না স্টেথোস্কোপে,
আর আমার ধারণা,
নাজিম হিকমত বা পরবর্তীতে
পাবলোনেরুদা বা ভাপ্‌ৎসারভদের অনুবাদে
বাঙলা পাঠকের যে বিস্তর ভিসাহীন বিশ্বভ্রমণের ঋদ্ধি –
এ তো কবি সুভাষেরই অবদান -
সেখানে একশোয় একশো
সুভাষের অনুবাদে হাতেখড়িই তো হিকমতে
যে অনুবাদের মূল প্রেরণা ছিলো
‘পরিচয়’ পত্রিকাকে আধখানা আপেল খাওয়ানো
যার বাকি আধখানা এই বিপুলা পৃথিবীর অগণিত মানুষ –
সেখানেও একশোয় একশো
এবং আপাদমস্তক এক তরুণ রাজনৈতিক কবির
বিশ্বভরা প্রাণের মাঝখানে তার নিজের ঠাঁইঠিকানা সন্ধান –
আবার একশোয় একশো
সবকিছুই সর্বোচ্চ মানে সসম্মানে কালোত্তীর্ণ।
সুভাষের পরবর্তী সমস্ত লেখার মধ্যে তাই
অগ্রজ হিকমতের প্রচ্ছন্ন শ্বাসশাসন।

বাঙলা কবিতার জলে তাই নাজিম হিকমত
সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়েছেন, একাকার হয়েছেন সুভাষে
এই কলয়ডিয় দ্রবণের নাম
সুভাষ হিকমত বা নাজিম মুখোপাধ্যায়
গোলাপ যে নামে ডাকো -
এই পদাতিক আমাদের আগামী দেড়শো বছরেরও একচ্ছত্র অহঙ্কার - [২- ১৯৯]

দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে
সাতটি রঙের
ঘোড়ায় চাপায় জিন।
তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে
আনতে চলেছি
লাল টুকটুকে দিন।।


0 comments:

0

প্রবন্ধ - দেবাশিষ ভৌমিক

Posted in

অজ্ঞতার দিনরাত্রি

ছোটবেলায় আমরা জানতাম যে আমাদের মানুষ হতে হবে আর মানুষ হওয়া মানে দেশ ও দশের মুখ উজ্জল করা। উজ্জল করা কাকে বলে সেই বিষয়ে খুব একটা পরিস্কার ধারনা না থাকলেও একটা বিষয় বুঝতাম যে বিশাল বাড়ি বা দামী গাড়ি থাকলেই মানুষ হওয়া বোঝায় না।দারুন বৈভবশালী জীবন যাত্রাও খুব একটা গৌরবের বস্তু নয়।বরং হঠাৎই কিছু দামী জিনিস কেনা হয়ে গেলে সেটা জাহির করতে লজ্জাই লাগত।বস্তুত যে সব বন্ধু ও খেলার সাথিদের সাথে বড় হয়ে উঠছিলাম তাদের মধ্যে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে বা সাট্টা খেলে- হয়ত অল্প নেশাভাং ও করে- এবং পড়াশুনার সাথে কোনও রকম সম্পর্কহীন ছেলেরাও প্রচুর সংখ্যায় ছিল।অনেকেই বস্তীতে থাকত, তাদের যে ঠিকঠাক খাবার দাবার জুটত এমনও নয়।এখন স্পনসরশিপ নিয়ে নানা ছুঁতমার্গের কথা শুনি, অথচ আমাদের অনুজপ্রতীম বন্ধু ভুতো সাট্টায় আশাতিরিক্ত অর্থ রোজগার করে, অর্থাৎ তিনটি সংখা ক্রমপর্যায় সহ মিলিয়ে দিয়ে, সেই অর্থে একদিন ব্যাপি ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।ভুতো মেমোরিয়াল শিল্ড নামক সেই প্রতিযোগিতায় আমরা সকলেই খেলেছিলাম, এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিরপেক্ষতার স্বার্থে ভুতো শুধু যে খেলেনি তা নয়, বরং রেফারি হিসেবে সবকটি খেলা পরিচালনা করেছিল। অথচ আমরা কয়েক জন ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পড়তাম আর টাই পড়েই ইস্কুলে যেতাম।হেলথ ড্রিঙ্ক আর জীবাণুরোধক পাঁচিলের আড়ালে নিরাপদে থেকে কেরিয়ার তৈরির জন্য প্রস্তুত হওয়ার পরিবেশটাই ছিল না।সন্তানদের পুষ্টি বা ইমুইনিটি দূরে থাক, ছোটখাটো শরীর খারাপ বা চোট আঘাত নিয়েও বাবা মায়েরা সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন।আমাদের পেট পরিস্কার না হলে তাদের কখনও চিন্তিত মুখে বাথরুমের সামনে অপেক্ষা করতে দেখিনি।বেশী মিষ্টি বা লজেন্স খেলে যে দাঁতে পোকা (আমরা ক্যাভিটির নামই শুনিনি তখন) হবে সেই বিষয়েও তাদের উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলায় অথবা ইস্কুলের স্পোর্টসে আমরা হারলাম কী জিতলাম সেটাও তাদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায়নি।বাচ্চাদের জন্য আলাদা ঘরের কথা ভাবাই যেত না।আমাদের “ক্রাঞ্চি ব্রেকফাস্ট” ছিল না, রোজকার খাবার দাবারের মধ্যে এনারজি জোগাবার জন্য “ফ্রুট আ্যন্ড নাট” ছিল না। আমাদের মা বাবারাও ফাইবার, প্রবায়োটিক এত সব জানতেন না। ফলে আমাদের মত শয়তানদের সামলানোর জন্য তারাও সেসব খেতেন না।তা সত্বেও তাদের চড়-থাপ্পর অথবা হাতপাখার দাপট কিছুমাত্র কম ছিলনা।টিফিনে প্রায় বাঁধাধরা ছিল চিনি লাগানো বিস্কুট আর বিবর্ণ একটি সন্দেশ বা রুটি তরকারী। ফলে আমরা নির্বিচারে ফুচকা-ঘুগ্নী-কুল-ঝালমুড়ি এবং হজমি খেয়েই মোটামুটি স্বাধীন জীবন যাপন করতাম। এমনকি আমাদের পেট পরিষ্কার হলো কিনা তা জানতে বাড়ির বড়রা চিন্তিত মুখে বাথরুমের সামনে অপেক্ষা করতেন না।কঠিন নজরদারি না থাকায় আমাদের স্বাধীনতা ক্ষেত্র বাড়ির মধ্যেও অল্প বিস্তর বিস্তৃত ছিল। নিজেদের বাড়ির রেডিও বা রেকর্ড-প্লেয়ার (যে অল্প সংখ্যক বাড়িতে ছিল)তার গুনমান নিয়ে বড়াই যে করে অন্যদের পরিহাস করা যেতে পারে সে কথা মনে হয়নি কখনও। দুপুরের রান্না শেষ হলে খোলা উনুনের পড়ে যাওয়া আঁচে বড় গামলায় সোডা ও গোলা সাবানের মিশ্রনে ছাড়া জামাকাপড় সিদ্ধ হত।তারপর উঠোন জুড়ে দড়ি টাঙ্গিয়ে শুকোন।তারপরে আবার আরেকটা তরল লাগিয়ে সেগুলিকে যে সুগন্ধী ও আরামদায়ক করা দরকার সে ধারনাও ছিলনা।ইস্কুলের বই আর মাস্টারমশায়দের পড়ানো থেকেই মোটামুটি পড়াশোনা হয়ে যেত, “লারনিং অ্যাপ” ছিলও না আর তার প্রয়োজনও বোধ করিনি।বরং আগ্রহ ছিল লুকিয়ে পড়া হলদে মলাটের বইয়ের পাতায়।সকালে (ছুটির দিনে) খেলা অথবা ইস্কুল, বিকেলে খেলা ও সন্ধে্বেলা পড়তে বসে ঘুমনো। এই রকম নিরুপদ্রব ও অনুত্তেজক দিন যাপনের ফলে আমরা না হতে পেরেছি কম্পিটিটিভ না হতে পেরেছি কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড।লেখাপড়া শেষ করে বাবা কাকাদের মতো হাতব্যগ ও টিফিনকৌটো নিয়ে দশটা পাঁচটা অফিস করবো এই ছিল সর্বোচ্চ আকাঙ্খা।জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র যে আসলে প্রতিযোগীতা এবং সেই প্রতিযোগীতায় জিততেইই হবে, এরকম কোন তাগিদ আমাদের মধ্যে ঢোকানোই হয়নি। আমাদের মায়েরা ভোরবেলা কয়লার উনুনে আঁচ তুলে ইস্কুল-কলেজ-অফিস যাত্রীদের পাতে সময়মতো ভাত দিতে এত ব্যস্ত থাকতেন যে আমাদের সঙ্গে দৌড়ে আমাদের মনে জেতার অভ্যাস তৈরী করাটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি।।ফলে যা হওয়ার তাই হল।আমরা স্মার্ট হলাম না; অনলাইনে জিনিস কেনায় সড়গড় হতে পারলাম না। সেই বাজারে গিয়ে মাছের দোকানে-আলুর দোকানে আড্ডা মেরে রিকশা করে বাজার আনার প্রাচীন অভ্যাস রয়েই গেল।রেস্তোরায় খেতে গিয়ে খাদ্য-পানীয় পরিবেশকদের কিভাবে ডাকবো সে বিষয়ে শিক্ষা না থাকায় একবার অর্ডার দেওয়ার পরে সেটা আর পালটানো গেলনা।শর্টস পড়ে শিস দিতে দিতে আঙ্গুলের ডগায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে গাড়িতে স্টার্ট দেওয়া অধরাই রয়ে গেল।বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-জন্মদিন-শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে পার্টি করার সুযোগ হলনা।বারমুডা যে এক রকমের প্যান্ট সেকথা জানতে এত দেরী হয়ে গেল যে আমরা বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য উদ্ধার করতে পারলাম না।ঢোলা পায়জামা পড়েই দিন কেটে গেল।ভোরবেলা কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়ার ধোঁওয়ায় দিনের শুরু আর রাতে সদর দরজায় তালা পড়ে দিনের শেষ, এই সীমার মধ্যেই ছিল আমাদের সব গতিবিধি।আমরা জানতেই পারলাম না যে কোনটা আধুনিক গ্লোবাল উচ্চারন, ‘ডিরেক্ট’ না ‘ডাইরেক্ট’; ‘ফিনান্স’ না ‘ফাইনান্স’।‘সিওর’ কে ‘স্যুয়োর’ বলার কায়দাও রপ্ত হল না।সরস্বতী পূজো আর দোলের দিনে আমাদের চিত্ত নিশ্চিত ভাবেই একটু বেশীই চঞ্চল থাকত।আড় চোখেই যেটুকু দেখা। রোজকার চেনা হলেও, “হাই বেবী” বলে সম্বোধনের সাহস দেখাতে পারিনি।

ইস্কুল শেষ করে কলেজ এবং তারও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরেও আমাদের জীবন যে একই রকম রয়ে গেল তার প্রধান কারণ ছিলেন আমাদের শিক্ষককুল।পেপার লেখা বা বিদেশ যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্বন্ধে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না করে তারা আমাদের সেই সব আকাশছোঁওয়া প্রাতিষ্ঠানিক মিনারগুলিকে প্রশ্ন করতে শেখালেন।নিতান্তই আটপৌরে দিনযাপন করা এই মানুষগুলির কাছেই জানলাম কিভাবে পাড়া-প্রতিবেশী-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনদের সামনে বিদেশী ডিগ্রীধারী-সুউপায়ী-প্রবাসী ভালো ছেলের উদাহরণ না হয়েও জীবন কাটানো যায়।সোজা কথায় স্যানিটাইজারের বদলে খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টির জলেই ভিজতে হলো।“Reading Capital” পড়ে আমরা জীবনের রকমারি অর্থ খোঁজার কাজে ব্যাপ্ত হলাম।সুশীল সমাজের আজীবন-সদস্য পদ গ্রহণ করা, আলিগরী পায়জামা পড়ে পচিশে বৈশাখ নিয়ম করে রবীন্দ্রসদনে যাওয়া আর অষ্টমী পূজোয় অঞ্জলি দেওয়া সব অধরাই থেকে গেল।কন্টিনেন্টাল খাবারকে বিজাতীয় ভেবে আমরা অনাদির মোগলাই পরোটা আর কষা মাংসের আকর্ষণেই আটকে থাকলাম।

জ্ঞান ও জীবন

এখন পরিস্থিতির কারনে মশা-ছারপোকা-উই অথবা আরশোলা কিংবা ইদুর মারার ওষুধের থেকেও জনপ্রিয় হয়েছে করোনা ঠেকানোর ওষুধ। মাস্ক-সাবান-স্যানিটাইজার ছাড়িয়ে এখন বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে যে কোন কোন কোম্পানীর তৈরী দেওয়ালের রঙ মায় প্লাইউডও করোনা ঠেকাতে কার্যকর। আর ইমিউনিটির তো কথাই নেই। দুধ-হলুদ থেকে শুরু করে রান্নার তেল, এমনকি কাঁচাকলা ও তেলাকুচো পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে ইমিউনিটির জমিদারি নিয়ে বসে আছে। এখন চেনাজানা মানুষেরা, যাদের আমরা কখনও সন্দেহ করিনি, তাদের স্বাস্থের গূঢ় রহস্য প্রকাশ করছেন। আমরা এখন জানতে পারছি বুলবুলি পিসীর মাসতুতো ননদের জা ছোট থেকেই হলুদ ছাড়া দুধ খাননি। অথবা পাড়ার টাবলুদার খুড়তুতো শালা দুবেলাই ভাতের পাতে তিতপটলের পাতা পাঁচফোড়ন দিয়ে বেঁটে খান। রহস্যের কি শেষ আছে! বাচ্চার ঘ্যানঘ্যানে কান্নার আসল কারন যে ভেজা ন্যাপি, অথবা রান্নায় কোন তেল দিলে এন্তার তেলেভাজা খেলেও যে কলজে টসকে যাবেনা, অথবা ফাইবার দেওয়া বিস্কুট খেলে যে পেট পরিষ্কার হয়ে মন ভালো থাকে, ইত্যাদি নানাবিধ বিজ্ঞাপনী তথ্য রোজই আমাদের জ্ঞান বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ বিজ্ঞাপন এখন সৌন্দর্য বৄদ্ধির উপাদান অথবা স্বাস্থবর্ধক পানীয়ের সীমানা অতিক্রম করে আমাদের জীবনধারনের সচেতনতা তৈরী করতে সক্রিয় হয়েছে। বিজ্ঞাপনের পর্দায় বাবা মায়েরা যখন সন্তান কে উইনার অথবা গ্লোবাল তৈরী করার পন্থা তুলে ধরছেন, তখন এটাও বোঝা যায় যে বিজ্ঞাপন আমাদের মূল্যবোধ তৈরীর ক্ষেত্রেও হাত বাড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন আমাদের বোঝাচ্ছে যে আধুনিক হতে গেলে প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দী হতে হবে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রচন্ড গতিতে ছুটে প্রথম হতে হবে। স্মার্ট ফোন আর স্মার্ট টেলিভিশন সেটের সাথে মানানসই স্মার্ট মানুষ, যার সমস্ত দিনটাই ডিজিটাল ও দ্রুতগতি। সেই স্মার্ট পরিবারের শিশু অনলাইনে অডিও ভিসুয়াল শিক্ষা লাভ করে। তার মা পাশে বসে সেই স্টাডি মেটিরিয়ালের মান পরখ করেন। বাবা চিন্তিত সেই শিক্ষার সময়োপযোগিতা নিয়ে। শিশুরা একসাথে বসে কম্পিউটারে ব্রেন-গেমস খেলে। সন্তানদের বন্ধু বেছে দিতে অভিভাবকেরা যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন। সন্তান দ্রুত কম্পিউটার কোড লিখতে শিখলে মা-বাবা গর্বিত হন। অনলাইন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পরা কিশোর-কিশোরীর স্বপ্ন কম্পিটিটিভ পথ ধরে লঙ ড্রাইভে মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরী-বিদেশী গাড়ি-বিদেশে ছুটি কাটানো-পঁচিশতলার ফ্ল্যাটে দূষণহীন প্রাকৄতিক পরিবেশে দিনযাপনের দরজায় পৌছে যায়। হঠাৎ রাস্তায় বা আপিস অঞ্চলে বন্ধুদের সাথে আর দেখা করার দরকার হয়না। সারাদিনই ফেসবুক অথবা গ্রুপ-হোয়াটস্আ্যপ পোস্টে দেখে বা পূর্ব নির্ধারিত গেট-টুগেদারে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি রেস-ট্র্যাকে প্রতিদ্বন্দীদের তুলনায় আমি কতটা এগিয়ে আছি। সেলফির জন্য গলাগলি করে পোজ দিলেও অকারনে হেসে উঠতে পারিনা। পিছিয়ে পরলেই ডিপ্রেশন জড়িয়ে ধরে। তখন বারান্দায় একলা বসে রাতের আকাশ দেখতে দেখতে মদ খাই। জড়াজড়ি করে দুজনে যৌনক্রীড়া করি, আমি আর আমার স্মার্টফোন।

সিগনাল মেনে চলুন

ছোটবেলায় জেনারেল নলেজ সিলেবাসে ট্র্যাফিক সিগনালের নিয়ম পড়তে হত। এখন মার্কেট সিগনাল বুঝতে শেখাটা আবশ্যিক, না হলে কম্পিটিশনে পিছিয়ে যেতে হবে। এই কথাটা মাইক্রোচীপ আকারে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেই সফল হয় শিক্ষা। দ্রুত সিড়ি চড়তে শুরু করি। আকাশ ছোঁওয়া উচ্চতায় সকলের আগে একলাই উঠতে চাই কেননা ওখান থেকে দুনিয়াটা যেমন দেখা যায় তেমন আর কোনখান থেকে নয়। ক্রমশঃ সুতো ছিড়ে যেতে থাকে। মেঘ ছাড়িয়ে আরও একলা হয়ে যাই। স্মার্ট মস্তিষ্ক আমাকে বিষন্ন হতে দেয়না। এবার শুরু হয় নিজের সাথে রেস। সীমাহীন একটা মাঠে চলতে থাকে নিরন্তর দৌড়। আমাকে নিয়ন্ত্রন করে যায় মার্কেট সিগনাল। রক্ত-মাংস-আবেগ-মোহ-ভালোবাসা সবই চলে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের প্রোগ্রাম মাফিক। জীবন চলতে থাকে অনলাইন। অর্থহীন হয়ে ওঠে চায়ের দোকান-পাড়ার রোয়াক-লেবুতলা বাজার।

ভার্চুয়াল কম্যুনিটি

বাড়িতে অতিথি সমাগম হলে আমরা ছোটরা বিশেষ উৎফুল্ল হতাম। প্রথমত পড়তে বসা থেকে রেহাই। তবে দ্বিতীয় কারনটা আরও অনেক বেশী আকর্ষনীয়। আগমন পূর্বনির্ধারিত হলে তো কথাই নেই, হঠাৎ এসে পড়া অতিথিদের ক্ষেত্রেও লুচির সাথে আলুর দমের (শীতকালে ফুলকপি) আর হাঁসের ডিমের কষার থেকে আমরাও বাদ যেতাম না। এখন সামাজিকতাও স্মার্ট হয়েছে। আমাদের মাস্টারমশায় কল্যান সান্যাল বলতেন ভারচুয়ালও এবং সেটা গৄহকর্তা ও অতিথি দুই পক্ষেরই জানা এবং সেই নিয়ম তারা মেনেও চলেন। বিষয়টা উনি বুঝিয়ে ছিলেন একটা অসম্ভব উদাহরন দিয়ে। এখন নাকি প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া খাবার খাওয়ার নিয়ম নেই। খাবার পরিবেশিত হলে প্রশংসা করে ও ধন্যবাদ জানিয়ে তা প্লেটেই রেখে দিতে হয়। তারপর অতিথি বিদায় নিলে গৄহকত্রী বিধি মেনে সেগুলি আবার তুলে রাখেন পরের বার পরিবেশনের জন্য। এই ভাবে একই খাবার দিনের পর দিন চলতে থাকে। এর ফলে এখন নাকি আসল খাবার আর তৈরীই হয়না। সবই মাটির। কৄষ্ণনগরে বানানো হয়। হয়তো সব সম্পর্কও এখন এই ভাবেই তৈরী হয়। আর তৈরী হয় সেগুলি চালানোর সিগনাল বিধি।

ফুটনোট

কয়েক দিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম, নাম Wall-E। একটা দৄশ্যে দেখলাম অনেক মানুষ পথ হাঁটছেন। সবাই একা। কেউ কারো সাথে কথা বলছেন না। আর সবাই প্রচন্ড ব্যস্ত নিজের নিজের গন্তব্যে পৌছনোর জন্য। হঠাৎই এক জন পড়ে গেলেন। অন্য কেউ এগিয়ে এসে তাঁকে তুললেন না। মানুষটিও যেন এটা জানতেন। তিনি কাউকে অনুরোধও করলেন না। পকেট থেকে একটা যন্ত্র বের করে সিগনাল পাঠালন, কয়েকটা রোবট এসে ওনাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

0 comments: