Next
Previous
1

ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


ধারাবাহিক


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক



। নয়।



পিতৃদেব অসুস্থ, ঢাকায় বসে খবর পেলেন রামমোহন। মা-বাবার আদরের সন্তান তাকে বলা যাবে না, কিন্তু এই খবর শুনে খুবই উদ্বেগ বোধ হ’ল তার। ঢাকার কালেক্টর টমাস উডফোর্ড তার বস, সটান তার কাছে গিয়ে জানালেন, ছুটি চাই। 

টমাস বললেন, কী ব্যাপার, রয়? এখন ছুটি –

রামমোহন বললেন, বাড়ি থেকে খবর পেয়েছি, বাবার শরীর খুব খারাপ। আমি সেখানে যেতে চাই।

টমাস বললেন, বাবাকে দেখতে যেতে চাও? তুমিই না বলেছিলে, তোমার বাবা তোমাকে দেখতে চান না! একবার না, দু-দুবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই বাবাকে দেখতে এখন তোমায় ছুটতে হবে? 

রামমোহন বললেন, সে তুমি বুঝবে না। আমি যাচ্ছি।

টমাস বললেন, যাচ্ছি মানে কী? হুট করে বলা নেই কওয়া নেই, যাচ্ছি বললেই হ’ল? তোমার এই দেওয়ানগিরি কে করবে এখানে? আমি? আগে একটা লোক খুঁজে বের করি, তাকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দাও, তারপর যাওয়ার কথা ভেব। কতদিনের জন্যে যেতে চাও?

ফট করে মুখের ওপর ইস্তফাপত্র বের করে ছুঁড়ে দিলেন রামমোহন। হনহন করে বেরিয়ে এলেন তার কক্ষ থেকে। ঢাকা থেকে খানাকুল যেতে অনেক সময় লাগবে, বেলায় বেলায় বেরিয়ে পড়াই ভাল।

উডফোর্ড লোকটা খারাপ না, একে তিনি অনেক দিন ধরেই চেনেন। শুধু উডফোর্ড না, কলকাতায় যাতায়াতের শুরু থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে তার ওঠাবসা মন্দ না। যখন তার বছর চব্বিশ বয়স, বাবা রামকান্ত দানপত্র করে জমিজমা বিলিবন্টন করে দিলেন পুত্রদের মধ্যে। রামমোহনের ভাগে যা পড়ল, তা নেহাত কম না। তার খাজনা আদায় করে সরকারের ঘরে রাজস্ব জমা দিয়ে আর সেই সংক্রান্ত খরচাপাতি বাদ দিলেও তার হাতে থেকে যেত বছরে প্রায় হাজার বাইশ টাকার মত। সে তো অনেক টাকা। সেই টাকা ফেলে না রেখে রামমোহন তার সুব্যবস্থা করতে কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেন সে সময়। কলকাতায় তখন উঠতি বয়সের ইংরেজ ছোকরাদের ভীড়। ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ ভর্তি হয়ে এরা আসে, কলকাতায় কম্পানির কোনও কাজে তারা বহাল হয়ে যায়, আর মাইনের টাকায় ফুর্তিফার্তা করে। মদ-মাংসের ঢালাও কারবার। একবার এর স্বাদ পেয়ে গেলে চরিত্র নীচে নামতে তো বেশি সময় লাগে না, ফলে এদের অনেকেরই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ব্যাঙ্ক বলে তখন কোনও বস্তু তৈরি হয়নি আর কম্পানির ঊর্ধতন কারও কাছে হাত পাতা যায় না, তাতে চাকরিটা খোয়ানোর সম্ভাবনা, তাই তারা টাকা ধার করত দেশি লোকদের কাজ থেকে। রামমোহন এদের টাকা ধার দিয়ে বেশ দু’পয়সা আয়ের রাস্তা খুঁজে পেয়ে গেলেন। 

এ রকম ধারের কারবার করত আরও কিছু দেশি বাবু, রামমোহনের সাথে তাদের আলাপ হলো। তবে এদের চেয়ে ইংরেজদের সাহচর্যই তার বেশি ভাল লাগত। ওদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ কারবার করতে করতে ইংরাজি ভাষাটা বেশ আয়ত্বে এসে গেল তার। ধারের কারবার মূলতঃ বিশ্বাসের ওপরেই। একখণ্ড কাগজে বড় জোর লেখা থাকে, এত টাকা ঋণস্বরূপ বুঝিয়া পাইলাম। 

এইভাবেই একদিন অ্যান্ড্রু র‍্যামজের সঙ্গে আলাপ। সে এক রাইটার, মানে কম্পানির খাতাপত্র লেখে। তার সাথে পড়াশুনার বদভ্যাসও আছে। সেই পড়াশুনার অভ্যাসটা সঞ্চালিত হয়ে গেল রামমোহনের মধ্যেও। ইংরাজি বই পড়ে তার চোখের সামনে খুলে গেল এক নতুন দুনিয়া। আরও বেশি করে সেই দুনিয়াকে জানার আগ্রহ পেয়ে বসল তাকে। 

একদিন অ্যান্ড্রু তার কাছে ধার চেয়ে বসল সাড়ে সাত হাজার টাকা। সে কী এক ব্যবসায়ে সেই টাকা লাগাতে চায়। একসাথে এতগুলো টাকা একজনকে এখনও অবধি ধার দেননি রামমোহন। একটা কাগজে লিখে এতগুলো টাকা দেবেন, যদি ফেরৎ না পাওয়া যায়! লোকটা বন্ধুর মতো হলেও তো বিদেশি। ভেবে ঠিক করলেন, কাগজে লেখার বদলে আইনি সাহায্য নেওয়াই ভাল, অ্যাটর্নি ধরে দলিল-টলিল লিখিয়ে তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন রামমোহন। দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, হ্যাঁ, এই ব্যবস্থাটাই ভাল। আমাদের দেশে অবশ্য এ ধরণের আইন-টাইন কিছুই ছিল না, লোকে ধর্মমতে যা ভাল মনে করে, সেটাই আইন, কিন্তু বিদেশিদের ব্যাপার তা না, তাদের সব কিছু লেখাপড়া করা থাকে – এই কাজটা দোষের, এতে এই শাস্তি। 

এই দলিলে সই করেই আইন ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে গেলেন রামমোহন। এর পর থেকে যাকেই টাকা ধার দেন, সব আইনের কাগজে সই সাবুদ করিয়ে। আর এ সব করতে সদর দেওয়ানি আদালতেও তাকে ঘুরতে হতো ভালই, তিনি শিখে নিলেন মুসলমানি আইন, পরিচিত হলেন তার সাথে যুক্ত মৌলবিদের সঙ্গেও। ছোটবেলায় শেখা আরবি-ফার্সি ঝালিয়ে নিতে লাগলেন তাদের সঙ্গে আদান-প্রদানের মাধ্যমে। 

টমাস উডফোর্ডের সঙ্গে আলাপও এই টাকা ধারের সূত্রেই। রামমোহনের কাছ থেকে যে উপকার তিনি পেয়েছিলেন, তার প্রতিদানেই পরে যখন তিনি ঢাকার কালেক্টর নিযুক্ত হন, রামমোহনকে তার দেওয়ানির চাকরি দেন তিনি। রামমোহন তখন বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বিতাড়িত। 

সুরাই মেলের কুল
ব্যাটার বাড়ি খানাকুল
ওঁ তৎসৎ বলে ব্যাটা বানিয়েছে ইস্কুল ...

সুরাই মেলের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম রামমোহনের। এই খানাকুল বর্ধমান চাকলার (পরবর্তীতে হুগলী জেলায়) এক গ্রাম। দ্বারকেশ্বর নদীর এক তীরে কৃষ্ণনগর, অন্য তীরে রাধানগর। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী যে কৃষ্ণনগর, এটা সেই কৃষ্ণনগর নয় বলে লোকমুখে এর নাম খানাকুল কৃষ্ণনগর। রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদে নবাবের অধীনে সরকারী কর্মচারী ছিলেন, নবাবের কাছ থেকে রায় উপাধি পেয়ে তিনিও কৃষ্ণচন্দ্র রায় নামে পরিচিত হন। মুর্শিদাবাদের শাঁকাসা গ্রামে ছিল তার নিবাস, সেখান থেকে নবাবের শাসনে বর্ধমানরাজের অধীনে বেশ কিছু গ্রামের জমিদারি দেখভালের সুযোগ পেয়ে তিনি প্রথমে খানাকুল কৃষ্ণনগরে বসতি স্থাপন করেন, পরে নদীর অন্য তীরে রাধানগরে উঠে যান। রাধানগরেই রামমোহনের জন্ম হয়। 

কৃষ্ণচন্দ্রের তিন পুত্রের কনিষ্ঠ ব্রজবিনোদ মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার অধীনে সম্ভ্রান্ত পদে বহাল ছিলেন। পরে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে রাধানগরে ফিরে যান। জীবনের অন্তিমকালে পরম বৈষ্ণব ব্রজবিনোদ যখন ভাগীরথীতীরে অবস্থান করছিলেন, তখন শ্রীরামপুরের চাতরা নিবাসী শাক্ত ভঙ্গকুলীন শ্যাম ভট্টাচার্য তার কাছে এসে প্রার্থনা করেন, তার পুত্রদের একজন যেন শ্যামের কন্যাকে গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব-শাক্তে বিবাহ এক রকম দুরূহ ব্যাপার, কিন্তু গঙ্গাতীরে এই অবস্থায় একজনের অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়াও যায় না। নিরুপায় ব্রজবিনোদ সম্মত হয়ে তার সাত পুত্রকে এক এক করে অনুরোধ করতে লাগলেন শ্যামের কন্যা তারিণীর পাণিগ্রহণ করতে। বড় মেজ সেজ ন’ পর পর চারপুত্র সেই প্রস্তাবে আমল দিল না। পঞ্চম পুত্র রামকান্ত এক রকম পিতৃসত্য রক্ষার্থেই মেনে নিল এই অসম-বিবাহ। তারিণী শ্বশুরালয়ে ফুলঠাকুরানি নামে প্রতিষ্ঠিত হলেন। 

এই রামকান্ত-তারিণীর দ্বিতীয় পুত্র রামমোহন। জগন্মোহন তার সহোদর দাদা। রামলোচন নামে এক বৈমাত্রেয় ভাই ছিল তাদের। 

আর পাঁচটা শিশুর মতোই রামমোহনের ছেলেবেলা শুরু হয়। পড়াশুনায় তার মতি ছিল খুব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে গুরুগৃহ, ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠী আর মৌলবিদের আরবি-ফার্সি শেখার জায়গা। বাড়িতেই রামমোহন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও কিছু ফার্সি ভাষা শেখেন। মুখে মুখে শিখতে হতো সংস্কৃত শ্লোক, শুভঙ্করী আর্যা আর তালপাতায় হাতের লেখা মকশো করতে হতো। মোগল যুগে ফার্সিই রাজভাষা, সরকারি সব ব্যাপারে ফার্সি জানতেই হয়। পিতা-পিতামহ এই ভাষা জানতেন, তার কিছু রামমোহনে সঞ্চারিত হয়। পরে আরবি শেখার জন্য রামকান্ত তাকে পাটনা পাঠিয়ে দেন। সেখানে আরবি ভাষায় অ্যারিষ্টটল ও ইউক্লিডের বই পড়ে ফেলেন রামমোহন। সঙ্গে ছিল আরবি ভাষায় কোরান পাঠও। পাটনায় শিখগুরু গোবিন্দ সিঙের জন্ম হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, এখানেই আছে তখত পাটনা সাহেব বা হরমন্দির সাহেব গুরদোয়ারা। গুরদোয়ারার মৃদঙ্গ সঙ্গীত তাকে স্পর্শ করেছিল। অল্প বয়সে একাধিক ধর্মের গ্রন্থপাঠ ও তাদের সংস্কারের অনুভবের মাধ্যমে তার মধ্যে একেশ্বরবাদের ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে। সুফিদের সহজিয়া দর্শন তাকে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে। 

পাটনায় বছর তিনেক কাটানোর পর রামকান্ত রামমোহনকে পাঠিয়ে দেন কাশীতে পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত শেখার জন্য। আগে থেকেই ধর্মগ্রন্থ পাঠে মতি ছিল বলেই খুব অল্প সময়ে রামমোহন বেদ ও বেদান্তে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রাচীন হিন্দু ব্রহ্মজ্ঞান ও মুসলমানি একেশ্বরবাদের সামঞ্জস্য লক্ষ করে ক্রমে ক্রমে তার মধ্যে প্রচলিত হিন্দু-সংস্কারের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে থাকে। কাশী থেকে ফিরে এসে এই নিয়ে রামকান্ত ও রামমোহনের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। 

মাত্র ষোল বছর বয়সে রামমোহন এক পুস্তিকা লিখে ফেলেন – ‘হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী’ নাম দিয়ে। ছাপা বই না, হাতে লেখা, তবে তার ছত্রে ছত্রে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। বাবা রামকান্ত প্রচণ্ড ধর্মভীরু, তিনি এসব অন্যায় আর বরদাস্ত করতে পারলেন না। বাড়ি থেকে বের করে দিলেন রামমোহনকে। 

বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি কিছুকাল তিব্বতে কাটিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের আচার-ব্যবহার-কথাবার্তা সম্যকরূপে পর্যবেক্ষণ করে রামমোহন একসময় ফিরে এলেন। তিব্বতে দেখে এলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনযাত্রা। 

প্রায় বছর চারেক তিনি এইভাবে ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছিলেন। বাবা রামকান্ত ছেলেকে তাড়িয়ে দিয়ে বিশেষ সুখী ছিলেন না, তিনি এর মধ্যেই পুত্রের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রেরিত লোকের সঙ্গেই একদিন রামমোহন ফিরে এলেন নিজের গৃহে। বাবা আনন্দের সঙ্গেই ছেলেকে গ্রহণ করলেন। ভাবলেন, বিয়ে দিয়ে ছেলেকে সংসারী করে দিলে এই বাউণ্ডুলেপনা, এই অধার্মিক মনোভাব দূর হয়ে যাবে। মা তারিণী দেবীও হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে শোকের সমুদ্র থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

বিয়ে হ’ল রামমোহনের। একটা না, এক এক করে তিনবার। প্রথমা স্ত্রী বেশিদিন বাঁচেননি, তিনি গত হতেই দ্বিতীয় ও পরে তৃতীয়বারের জন্যে দার পরিগ্রহ করেন রামমোহন – সবই পিতৃ-অনুগ্রহে। সেই সঙ্গে চলল আবার আগের মতই প্রবল আগ্রহে সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ পাঠ। আবার পিতা-পুত্রে বিবাদ বাধতে লাগল। রামমোহন পিতাকে শ্রদ্ধা করলেও নিজের মত ষ্পষ্টভাবে জানাতে দ্বিধান্বিত নন। রামকান্ত প্রচলিত মতের পক্ষে, যদিও বৈষ্ণব, সুতরাং স্বভাববিনয়ী, কিন্তু তার পক্ষেও রামমোহনের উগ্র মনোভাব মেনে নেওয়া শক্ত। 

ততদিনে অবশ্য রামকান্ত জমিজমা ছেলেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছেন। রামমোহন সেই দান নিতে অস্বীকার করেও তার দেখাশুনা করছেন নিয়মিত। রাজস্ব জমা করছেন বর্ধমানের রাজার কোষে। উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন কলকাতা। সেখানে চলছে তার ইংরাজি শিক্ষা, আইন শিক্ষা, আরবি-ফার্সি চর্চা। 

রামকান্ত ভেবেছিলেন একবার বাইরে গিয়ে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে ছেলের। এবার সে ধর্মকর্ম ছেড়ে সংসারে মন দেবে, জমিজমা বাড়াবে। সেদিকে মন নেই রামমোহনের। তার জন্মের মাত্র দু’বছর আগেই বাংলায় ঘটে গেছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সেই ঘা শুকায়নি এখনও। হেস্টিংস ও পরে কর্ণওয়ালিশ এসে রাজস্ব ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ করেছেন বটে, তবে তাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ স্বস্তিতে নেই। কর্ণওয়ালিশ প্রথমে জমিদারি পাঁচ বছরের জন্যে ইজারা দিয়ে হাঁড়ির চাল পরীক্ষা করে নিলেন, পরে দশ বছরের জন্যে। পাঁচশালা ও দশশালা ব্যবস্থায় কম্পানির ঘরে খাজনা আসা শুরু হতেই সেটাকে করে দিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। 

এসব চলাকালীন অনেকেই প্রচুর কামিয়ে নেন, অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। রামকান্ত বেশ অনেকটা জমির জমিদার হয়েছিলেন, তবে আইন এমনই কড়া যে দিনের দিন রাজস্ব যে কোনও কারণে জমা না পড়লে জমিদারকে জেলে ভরে দেওয়া হবে আর তার জমিদারি ফের নিলামে উঠবে। দাম দিয়ে তা কিনে নেবে অন্য কোনও জমিদার। 

এই সব সমস্যা এড়াতেই জমি ভাগ করে বন্টন করে দিলে খানিকটা সুবিধে, রামকান্ত তাই করলেন। কিন্তু ছেলের বেয়াদপি এমনই বেড়ে চলল, যে দ্বিতীয়বারের জন্যে তাকে ঘাড়ধাক্কা দিতেই হ’ল। আগের বারের মত পুরোপুরি তাড়িয়ে দিলেন না, মাঝে মাঝে পয়সাকড়ি পাঠাতে লাগলেন কলকাতায়, তবে ঐ অবধিই। 

কলকাতা থেকে রামমোহন চলে গেলেন ঢাকা, টমাস উডফোর্ডের দেওয়ান হয়ে। রামমোহনের জমি দেখাশুনা করতে লাগলেন রামকান্ত। রামমোহন জানতে পারলেন না, যে জমিদারি সামলে রাজস্ব আদায় করে তিনি বহু টাকা উদ্‌বৃত্ত হিসাবে ঘরে তুলতেন, সেই একই জমির রাজস্ব অনাদায়ে রামকান্ত গ্রেপ্তার হয়ে জেলে চলে গেছেন। তাকে রাখা হয়েছে হুগলির দেওয়ানি জেলে। পরের বছর একই দায়ে পৃথক জমির জমিদার বড়দা জগন্মোহনও চলে গেল মেদিনীপুর দেওয়ানি জেলে। জেলেই রামকান্তর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সোনাদানা ও অন্যান্য সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় বর্ধমানের বাড়িতে। সে খবর যায় রামমোহনের কাছে। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রামমোহন বাড়ির পথ ধরেন। 

পিতার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হ’ল না রামমোহনের, খানাকুল পৌঁছানোর আগেই তিনি মর্মন্তুদ খবর পেলেন – পিতৃদেব প্রয়াত। শুধু তাই নয়, মাতৃদেবী নিজের গয়নাগাঁটি বন্ধক রেখে শ্রাদ্ধশান্তিও চুকিয়ে ফেলেছেন অপৌত্তলিক রামমোহনের জন্য অপেক্ষা না করেই। তিনি চাননি ম্লেচ্ছভাবাপন্ন ‘বিধর্মী’ পুত্রের কোনও সংস্পর্শ থাকুক পিতার অন্তিম সংস্কারে। বড়দা জগন্মোহন তখনও মেদিনীপুর জেলে বন্দী, সেই জেলের মধ্যে বসে তিনি পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেছেন যতটুকু করা সম্ভব সেভাবে। 

হতাশ রামমোহন কলকাতা ফিরে এলেন। তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। এই জাত-পাত-ধর্ম-পুতুলপুজো-বিবাহ-সন্তান-সম্পত্তি সব এক বিপুল শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সাধারণ মানুষ এ সবের ওপরে ভাবতেই পারে না। লেখাপড়া জানে না মানুষ, শেখার ইচ্ছেই নেই। একজন যা বলল, তা নিয়েই নাচতে শুরু করে অন্য হাজারজন। ইংরাজি বইপত্তর পড়ে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি – ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন – ও তৎসংক্রান্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নাম শুনেছেন রামমোহন। সে সব এ দেশে কই? কবে আসবে? কে আনবে? ইংরেজ এ দেশে প্রভু হয়ে বসেছে, তাদের সব কিছু কার্যকলাপ তাদের নিজেদের সুযোগ সুবিধার জন্যেই। এ দেশের মানুষের সুযোগ সুবিধার কথা তবে কে ভাববে? 

কলকাতার গঙ্গাতীরে পিতৃশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করলেন রামমোহন। তিনি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী নন তো কী! তিনি হিন্দুই। সন্তান পিতার শ্রাদ্ধ করবে, এটাই হিন্দু সংস্কার, তিনিও করবেন। অতি প্রত্যূষে গঙ্গার তীরে এসে দাঁড়ালেন রামমোহন। পুবের আকাশে রঙ ধরছে, আর একটু পরেই দিনমণি উদিত হবেন। 

পবিত্র গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে এসে লাগল দিনের প্রথম সূর্যকিরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূর্য। নতুন শতাব্দী সদ্য শুরু হয়েছে, সদ্যোজাত শিশুর মত হামাগুড়ি দিচ্ছে সে। মনুষ্যশিশুকে মানুষ করে তুলতে হলে তার হাত ধরতে হয়, তাকে হাঁটা শেখাতে হয়। এর জন্যে কাউকে দায়িত্ব নিতেই হয়। ভারতবর্ষের নতুন শতাব্দীকে ঘুম থেকে জাগানোর দায়িত্ব তিনিই নেবেন। 

পরলোকগত পিতৃদেবকে স্মরণ করে রামমোহন মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন – মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ ...


(প্রথম খণ্ড সমাপ্ত)
1

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ১১
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 08
5th. July, 1942. Sunday.


প্রিয় কিটী,

গত শুক্রবার ইহুদি বিদ্যালয়ের (এখন যেখানে আমরা পড়ি) বার্ষিক রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি এবার প্রথম থেকেই বার্ষিক পরীক্ষায় খুব একটা ভাল ফল করব, এমন কিছু আশা করিনি। করার কথাও নয়। যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমি আর আমার পরিবার বর্তমানে চলেছি, তাতে পড়াশুনা ভাল হওয়ার কথাই নয়। সেদিক থেকে দেখলে, আমার ফলও খুব একটা খারাপ হয়নি। একটাতে আমি বেশ খারাপ গ্রেড নম্বর পেয়েছি। বীজগণিতে পাঁচ গ্রেড নম্বর, দুটো বিষয়ে ছয় গ্রেড নম্বর আর বাকীগুলোতে সাত বা আট গ্রেড নম্বর পেয়েছি। বাড়িতে আমার গ্রেড নম্বর দেখে সবাই বেশ খুশী। অবশ্য পরীক্ষায় আমি কত গ্রেড নম্বার পেলাম বা আমি কি’রকম করলাম সে ব্যাপারে আমার মা আর বাবার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের চেয়ে একদম আলাদা। আমার অভিভাবকরা একটু অন্য প্রকৃতির। আমি সন্তুষ্ট হলেই তাঁরা খুশী। তাঁরা চান আমরা যেন পড়াশুনাটা করি। তাতেই তাঁরা খুশী। আমার ফলাফল ভাল হলো না খারাপ হলো, কম পেলাম, না বেশী পেলাম, এসব নিয়ে বেশী তাঁরা বেশী চিন্তাও করেন না। বকাবকিও করেন না। শুধু মনে করিয়ে দেন, আরও ভাল করে পড়তে হবে। পড়াশুনাটা করতে হবে। 


এই ছবিটি অ্যানির দশমতম জন্মদিনে তোলা হয়। ছবির একেবারে ডান দিক থেকে প্রথম জন হোল মারথা (Martha ); ডান দিকের দ্বিতীয় জন হলো, লেটজী (Letje); ডানদিকের তৃতীয় জন হলো মেরী বস (Meri Bos); তার পাশে ক্যাথে ইগেডী (Kathe “Kitty” Egydi) ছবিতে কিটী সব থেকে গাঢ রঙের স্কার্ট পড়ে আছে। এই কিটী অবশ্য সেই কিটী নয়, যাকে সম্বোধন করে অ্যানি তার ডাইরি লিখেছিল; ডান দিক থেকে পঞ্চম জন হলো জুল্টেজী কেটেল্লাপের (Juultje Kethellaper), এই মেয়েটি অ্যানির অন্যান্য বন্ধুদের থেকে বেশ লম্বা; ষষ্ট, সপ্তম ও অষ্টম জনে মধ্যে একজন অ্যানি, বাকি দুজনের নাম জানা যায়নি। একেবারে বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুসী (Lucia “Van” Dijk)। এদের বিস্তৃত পরিচয় নীচে “অনুবাদকের সংযোজিত অংশ”- এর মধ্যে দেওয়া হলো। 



আমার মা আর বাবা মনে করেন, আমি যদি আমার রেজাল্টের নম্বর দেখে পড়াশুনার মাত্রাটা বুঝতে পারি তা’হলে, আজ ফল খারাপ হলেও তা আমি নিজে নিজেই ঠিক করে নেব। আর নিজে থেকেই পড়াশুনায় ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠব। তখন সব কিছু আস্তে আস্তে ভাল হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাঁদের মতে রেজাল্ট নিয়ে বেশী চিন্তা করার দরকার নেই। আমি কিন্তু তাঁদের সঙ্গে একমত নই। আমি আমার রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা করি। আমি কখনই খারাপ ছাত্রী হিসাবে চিহ্নিত হতে চাই না। ফলাফল আর বয়সের ভিত্তিতে যখন আমার স্কুলের মন্টেসরী বিভাগের সপ্তম মানে থাকে উচিৎ ছিল, তখন আমায় আমার বর্তমানের ইহুদি স্কুলের শিক্ষিকাগণ সেকেন্ডারী বিভাগের জন্য মনোনীত করেছিলেন। অন্যান্য ইহুদি বাচ্ছারা যখন ইহুদি স্কুলের মন্টেসরী বিভাগে যাচ্ছিল, তখন আমার বাবা ইহুদি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে একটু অনুরোধ করাতেই তিনি আমাকে এবং লীসকে সেকেন্ডারী বিভাগে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। আর তাতেই কিছুটা হলেও আমাদের চাপ একটু বেড়ে গিয়েছিল। হয়ত আমাদের বাবারা এবং আমাদের প্রধান শিক্ষিকা, আমাদের উপর এই বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন যে, আমরা আরও ভাল করার চেষ্টা করব। আমরাও চাইনি বাবা-মা আর প্রধান শিক্ষিকার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে। আমার বোন মারগটেরও ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল। যথারীতি সে খুব ভাল ফল করেছিল। অস্বীকার করা যায় না সে আমাদের চেয়ে পড়াশুনায় অনেক বেশী ‘সিরিয়াস’। সেটা তার রেজাল্টেই দেখা যায়।  


অ্যানের দিদি মারগট। ১৯৪১ সালে এই ছবিটা তোলা হয় 

মারগট এমনিতেই বুদ্ধিমতি ছিল। তাই তার পক্ষে বিশেষ সম্মান সহ পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। আর সেটাই সে হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বিশেষ পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা আমাদের স্কুলে কিছু ছিল না। অর্থাৎ ক্লাসে কে কোন স্থান অধিকার করেছে, সে বিষয়ে রেজাল্টে কিছু উল্লেখ থাকত না। তাই তার রেজাল্টে বুদ্ধিমত্তার আভাস, প্রাপ্ত নম্বর বা গ্রেডে থাকলেও, তার কোনও বিশেষ উল্লেখ “মতামত” কলমে থাকত না। আমাদের বাবা ইদানীং বেশীরভাগ সময় বাড়িতেই থাকতেন। ইহুদি হিসাবে তার উপর সামাজিক অনেক বিধিনিষেধ এমনিতেই চেপে বসেছিল। তাঁকে তাঁর নিরাপত্তার কারণেই কিছুটা অন্তরীণ অবস্থায় থাকতে হতো। আর, ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে অন্তরীণ অবস্থা থেকে তাঁর বিশেষ কিছু আর করার ছিল না। বাইরের অস্থির অবস্থার করণে ব্যবসার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যে সেখানে বিশেষ কিছু করার মতো ছিল না বললেই চলে। আর যদি বা ছিল, বা যতটুকু ছিল, তা’ও ক্রমেই অনাবশ্যক হয়ে পড়ছিল। ইহুদিদের উপর ব্যবসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধের জেরে বাবার “ওপেক্টা” (Opekta) নামের কম্পানীটি, শ্রী কোওফুইস-এর (Mr. Koophuis) নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রাভিস এন. ডি. কম্পানীর সাথে মিশে গিয়েছিল, আর মিঃ ক্রেলার তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন কোলেন এন্ড কোঃ (Kalen & Co.) কম্পানীর অংশীদ্বারত্বের মধ্যে দিয়ে তা অধিগ্রহণ করে নেন ।


ছবির বাম দিক থেকে ‘মিয়েপ গীস’; জোহানেস ক্লেলম্যান (Johannes Klelman); ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার (Victor Kuglar); মাঝখানে বসে, ওটো ফ্রাঙ্ক; এবং তাঁর পাশে বসে বেপ ভোস্কুজিল (Bep oskuijil)। এই চারজন, ওটো ফ্রাঙ্কের অন্তরীণ অবস্থায় তাঁর ব্যবসার ভার নেন। এমন কি ব্যবসাকে রক্ষা করার স্বার্থে তাঁরা ওটো ফ্রাঙ্কের প্রতিষ্ঠিত ওপেক্টার মালিকানা ক্যুগলারের পরিচালনাধীনে ট্রাভিস এন. ডি. নামাঙ্কিত কম্পানির মধ্যে অধিগৃহীত করেন। কারণ ১৯৪০-৪১ সালে জার্মান সরকার সিদ্ধন্ত নেয় যে, ইহুদি মালিকানাধীন সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরকারী নোটিশে বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে ওটো ফ্রাঙ্ক তাঁর এই চার বিশ্বস্ত সহযোগীকে নিয়ে হস্তান্তকরণের পরিকল্পনা করেন। 



কয়েকদিন আগে আমরা আমাদের বাড়ির পাশের ছোট গলি পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম। তখন প্রথম বাবা আমাদের বললেন, শীঘ্রই আমাদের কোনও গোপন জায়গায় আত্মগোপন করতে হবে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, পৃথিবীতে এমন কি ঘটেছে, যে তিনি হঠাৎ এ’কথা আমাদের বললেন। তিনি বললেন,

“ঠিক হয়ত এই মুহূর্তে তেমন কিছু ঘটেনি, বা ঘটার কোনও প্রত্যক্ষ আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও অ্যানি, তুমি ত’ জান গত প্রায় বছরখানেক ধরে আমরা অন্যদের কাছ থেকে আমাদের খাবার-দাবার, জামাকাপড় এমনকি আসবাবপত্র পর্যন্ত নিয়ে চলেছি। নিজেদের নামে সংগ্রহ করার কোনও ক্ষমতা বা সরকারী অনুমোদন আমাদের নেই। আমরা চাই না জার্মানরা আমাদের সবকিছু বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে আমাদের কপর্দকশূন্য করে দিক। তার চেয়েও বড় কথা, আমরা চাই না, আমরা জার্মানদের খপ্পরে গিয়ে পড়ি। তাই আমার মতে কিছু ঘটার আগেই, স্বইচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে আমাদের আত্মগোপন করা প্রয়োজন। আর তা করাও উচিত। ধরা দেওয়ার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকা আদৌ সমীচীন হবে না।”

“কিন্তু বাবা কখন আমাদের যেতে হবে?” সত্যি কথা বলতে, বাবা এতটাই গম্ভীর আর কঠিনভাবে আমাদের কথাগুলো বললেন যে, আমার মনে মনে ভয় হতে শুরু করল। 

বাবা বললেন, “তুমি এ’সব নিয়ে বেশী চিন্তা করো না। আমরা সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করব। তুমি তোমার এই কিশোরীর জীবনটাতে তোমার মতো করে যতদূর সম্ভব আনন্দ আর খেলাধুলা উপভোগ কর।” ব্যাস, আর কোনও কথাই বললেন না। হায়, এই বিষাদ-ময় সত্য কথাটা যেন তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত না হয়। এটাই প্রার্থনা। 



তোমার অ্যানি 





-----------------------------------------------------------------------------------------

অনুবাদকের সংযোজিত অংশ - 

১) ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার (Victor Gustav Kuglar): অ্যানি তার ডাইরিতে ক্যুগলারকে মিঃ ক্রেলার (Mr. Kraler) নামে উল্লেখ করেছে। ক্যুগলার তথা ক্রেলার ছিলেন ডাচ নাগরিক। তিনি মিঃ ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ভ্যান ড্যানের সাথে একসাথে ব্যবসা করতেন। মিঃ ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ড্যান দুজনেই হিটলারের ইহুদি নিধনের ভয়ে, গোপন অ্যানেক্স ভবনে আত্মগোপন করতে বাধ্য হলে, মিঃ ক্রেলার তাঁর আর তিনজন সহকর্মীর সাথে অফিস বিল্ডিং এবং অ্যানেক্স লুকিয়ে থাকা পরিবারগুলির দেখাশুনা করতেন। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। 

ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার বা মিঃ ক্রেলার 

২) জোহানেস ক্যোলম্যান (Johannes Klelman): অ্যানি তার ডাইরিতে ক্যোলম্যানকে মিঃ কোওফুইস (Mr. Koophuis) নামে উল্লেখ করে। মিঃ কোওফুইস ছিলেন ডাচ নাগরিক। তিনি মিঃ ক্রেলারের সঙ্গে ওটো ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ড্যানের ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। নেদারল্যান্ডে ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেওয়াতে তিনি ইহুদিদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার দায়িত্ব নেন। এ’ছাড়াও যে সমস্ত ইহুদি আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হয়েছিল, তিনি তাদের নিজ দায়িত্বে লুকিয়ে খাদ্য সরবরাহ করার ভার নিয়েছিলেন। 

জোহানেস ক্যোলম্যান (Johannes Klelman)

৩) মারথা ভ্যান দেন বরগ (Martha) অ্যানির স্কুলের বন্ধু ছিল। মারথা জাতিগত ভাবে ইহুদি হলেও, জার্মান বাহিনী তাকে হত্যা করেছে, এ’রকম কথা শোনা যায়নি। 

৪) রীয়া “লেটজী” স্যুইলেন্স (Rei “Letje” Swillens) লেটজী অ্যানির মন্টেসরী স্কুলে অন্যতম প্রিয় বন্ধু ছিল। স্কুলে সারাক্ষণ অ্যানির সাথে থাকত। অ্যানি তার গোপন কথা লেটজিকে নির্দ্বিধায় বলত। লেটজীর পরবর্তীকালের স্মৃতি কথা থেকে আমরা জানতে পারি, অ্যানির এক মামাকে নাৎসিরা ইহুদি বলে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, এবং সে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে যায়। রীয়া স্যুইলেন্সরা ছিল খ্রিষ্টান। তাই তাদের পরিবার যুদ্ধের সময় অ্যামডারস্টামে নিরপেক্ষভাবে থাকতে পেরেছিল। বড় হয়ে লেটজী শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। এবং অ্যামস্টেল্ভেনে (Amstelveen) স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। অ্যানির দশমতম জন্মদিনে লেটজীও নিমন্ত্রিত ছিল।

৫) মেরী বস (Mary Bos) মেরী বসও অ্যানির মন্টেসরী স্কুলের বন্ধু ছিল। পাতলা গড়নের মেরী খুব ভাল ছবি আঁকতে পারত। আর তার জন্যে বন্ধু মহলে তার বেশ কদর ছিল। অ্যানি তার ডাইরিতে মেরী বসের কথা বেশী না লিখলেও, এক জায়গায় লিখেছে, যে একদিন স্বপ্ন দেখেছে, যে সে আর পিটার শিফফ একসঙ্গে মেরীর আঁকা ছবি দেখছে। মেরী তার বাবার সঙ্গে ১৯৪০ সালে আমেরিকা চলে যায়। যাওয়ার আগে অ্যানি তাকে একটি সুন্দর বিদায় সম্বর্ধনা লিখে দিয়েছিল। মেরী আমেরিকায় গিয়ে, অ্যানির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। পরে অ্যানির ডাইরি পড়ে তার অ্যানির কথা মনে পড়ে। সে জানতে পারে অ্যানি ও তার পরিবার জার্মানিদের কতটা অত্যাচার সহ্য করে কষ্টকর মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। মেরী বব শ্ন্যেডারকে বিবাহ করে। মেরী বব এখনও বেঁচে আছেন ও আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। 

৬) ক্যাথে “কিটী” ইগ্যেডি (Kathe “Kitty” Egyedi) কিটী অ্যানি অপেক্ষা মেরী বসের কাছের বন্ধু ছিল। মেরী বস বাবার সাথে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও কিটী তাকে অনেকদিন পর্যন্ত নিয়মিত চিঠি লিখত। ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাইয়ের (এই দিন অ্যানিরা সপরিবারে তাদের নির্ধারিত গোপন আস্তানায় চলে যায়) কয়েকদিন আগে, কিটী অসুস্থ অ্যানিকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েছিল। সেদিন সে প্রথম অ্যানির চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বময়ী রূপটা উপলব্ধি করে। অ্যানি তার ডাইরিতে যে কিটীর কথা উল্লেখ করেছে, সেই কিটী এই কিটী ছিল না। কারণ অ্যানির সাথে এই কিটীর খুব একটা ঘনিষ্টতা ছিল না। ইহুদি হওয়া স্বত্বেও কিটীদের পরিবার জার্মানির ইহুদি বিদ্বেষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তারা ওই সময় থেরেসিয়ান্সটাডে (Theresienstadt) গোপনে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ হয়ে ছিল। কিটীর বাবা ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। কিটীও বড় হয়ে বাবার পেশাকেই গ্রহণ করে। 

৭) জুল্টেজী কেটেল্লাপের (Juultje Ketellaper) জুল্টেজে অ্যানির মন্টেস্বারীর বন্ধু ছিল। জুল্টেজেকে নাৎসি বাহিনী সপরিবারে সবিবরের (Sobibor) অসামরিক বন্দী শিবিরের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলে। 

৮) লুসীয়া “লুসী” ভ্যান ডিজক (Lucia “lucie” Van Dijk) লুসী অ্যানির সঙ্গে মন্টেসরীতে একসাথে পড়ত। লুসীর মা জার্মানের নাৎসি সমর্থিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ব্লকের (National Socialist Block) গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। প্রায় যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেতেন। লুসীও মায়ের সাথে ব্লককে সমর্থন করত। লুসীর বাবা প্রথমে ঐ দলের সমর্থক থাকলেও পরে তাদের জাতি বিদ্বেষী কার্যকলাপে বিরক্ত ও হতাশ হয়ে, ব্লক থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। লুসী এন. এস. বি.-কে সমর্থন করে শুনে অ্যানি তার প্রতি হতাশ ও মানসিক ভাবে আহতও হয়েছিল। কিন্তু অ্যানিকে তার বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক বুঝিয়েছিলেন যে, ওরা তার অপছন্দের রাজনীতি করলেও মানুষ হিসাবে তারা ভাল হতেই পারে। রাজনীতিকে ঘৃণা করতে গিয়ে অ্যানি যদি মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করে, তাহলে সেটা অন্যায়। লুসী নিজেও তার সমর্থনের ব্যাপারে দোলাচলমানতার মধ্যে ছিল। সেও মন থেকে এস. এন. বি. –কে পূর্ণ ভাবে সমর্থন করতে পারেনি। তারপর বাবার পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে সে নাৎসিদের তরুণ সংগঠনের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে। তার ঠাকুমাও এই দলটাকে শুধু অপছন্দই করতেন না, বরং ঘৃণা করতেন। ১৯৪২ সালে লুসী এস. এন. বি.- র সঙ্গ ছেড়ে দেয়। যুদ্ধের পর লুসী বিয়ে করে পরবর্তী জীবন অ্যামডারস্টামে কাটিয়ে দেয়। 

ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট পার্টি (National Socialist Party) শুধু জার্মানির রাজনীতিতে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট পার্টির একটি বড় ভূমিকা ছিল। অ্যানির ডাইরির প্রেক্ষাপট যথাযথভাবে অনুধাবন করার জন্য, এই রাজনৈতিক দলটির ভূমিকা পাঠকদের জানা প্রয়োজন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর হিটলার মিউনিকে তাঁর নাৎসি দল গঠন করেন। ১৯২৯ সালে হিটলার জার্মান প্রজাতান্ত্রের সাধারণতান্ত্রিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে জার্মানকে রক্ষা প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে, “নাশিয়নাল সোতসিয়ালিষ্ট পার্টি” –কে সাথে নিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। (নাশিয়নাল-এর “না”, আর সোতসিয়ালিষ্টের-এর “ৎসি” নিয়ে “নাৎসি” – এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন জওহর লাল নেহেরু, তাঁর “বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ” [Glimpses of World History] গ্রন্থে; শ্রী গৌরাঙ্গ প্রেস, সেপ্টেম্বর ১৯৫১; পৃঃ – ৮৮০)। এই দলকে নিয়ে তিনি ১৯২৯ সালে ওয়েমার সাধারণতন্ত্রের ক্ষমতা দখলের প্রথম চেষ্টা করেন। কিন্তু বিফল হন এবং অভ্যুত্থানের চেষ্টার অপরাধে তিনি কারারুদ্ধ হন। কারাগারের ভিতর তিনি তাঁর “মেই ক্যাম্ফ” (Mein Kamf) বইটি লেখেন। পরবর্তীকালে এই বইটাই হয়ে ওঠে, নাৎসিদের বাইবেল। নরডিক জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার স্লোগান যেমন জার্মান যুবকদের আকৃষ্ট করেছিল, জাতীয়তাবাদ ও নরডিক জাতির প্রাধান্য জার্মানির ব্যবসায়ীদেরও আকৃষ্ট করেছিল। এর পশ্চাতে ছিল, ইহুদি বণিক ও শিল্পপতিদের একাধিপত্যের প্রতি জার্মান ব্যবসায়ীদের বিরক্তি ও হতাশা। হিটলারের ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট ব্লকের প্রধান কর্মসূচী ছিল - ১) ভার্সাই সন্ধিকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা; ২) এরিয়ান জার্মান জাতির অধিবাসীদের নিয়ে জার্মান রাষ্ট্র গঠন করা; ৩) জার্মান ইহুদি সম্প্রদায়কে দেশদ্রোহী রূপে চিহ্নিত ও উচ্ছেদ করা; এবং ৪) মার্ক্সবাদের বিরোধীতাকে সামনে রেখে জাতীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা। জাতীয় সমাজতন্ত্রের গোপন এজেন্ডা ছিল, “শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদিতে রাষ্টের কিছুটা নৈব্যক্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। 



0

ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস

Posted in


ধারাবাহিক

ফেরা - ৫
রাজর্ষি পি দাস


০৬। ০৭। ২০১৯ 
কলকাতা 


লেখাটা বড় হয়ে গেল, ভেবেছিলাম অর্পিতার সঙ্গে আর চালাকি না করে সত্যি কথা বলব! তাই হয়ত বেশি লেখা হয়ে গেল! 

আজ ভোররাত থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা দরজা দিয়ে ওপাশের কিছু দেখা যাচ্ছে না! আমি আমার রুটিন অনুযায়ী সাবিত্রী থেকে জল নিয়ে ঘুণোর হাত থেকে ওষুধ নিয়ে পেটে চালান করে এককাপ চা হাতে নিয়ে বসেছি ডাক্তার অর্পিতার চার্ট নিয়ে! ইতিমধ্যে দশটা দাগ পড়েছে। আজ এই বৃষ্টির দিনে ‘পেট শপ বয়েজ’ শুনলে হয় না! হোক, হোক! “জাস্ট গিভ মি ওয়ান মোর চান্স...” 



নবমী 

অনেকক্ষণ---না ৩০০০+ ক্ষণ ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছি গীরিন দাদুর পিঠের গল্পটা মনে করার। পিঠের টুকরোগুলোকে কে ফেলে গেছিল রাজকুমারী না রাক্ষস! নাকি রাজকুমার? পিঠে গাছের গন্ধ শুঁকে শুঁকে একা আবিস্কার করেছিল রাজকুমারীকে পিঠেগাছের গুঁড়িতে বাঁধা অবস্থায়? নীলা জ্যোৎস্না, হ্যাঁ গিরিন দাদু নীলা জ্যোৎস্নাই বলতেন, নীলা জ্যোৎস্নায় রাক্ষস ছোট্ট পিঠে গাছে ঠ্যাং ঝোলাতে ঝোলাতে বলত- কিরে, পিঠে চাই না রাজকুমারী ... পিঠেসাপটা, পুলি, চষি, মালপোয়া চারদিকে ঝুলে আছে। হাত বাড়ালেই পেড়ে ফেলা যাবে, নাকে এখন গন্ধ লেগে আছে, আর গল্পটা যেদিনই শুনতাম ঠিক এই জায়গায় আসলেই জীবে জল এসে যেত, আজও এসে গেল। সেই সকাল থেকে কিছু খাইনি। আমার সামনে এখন বিশাল বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের এপারে আদিগঙ্গা, পাশে গড়িয়া গাড়িব্রিজ, নীচে চাঁদের আলোয় গঙ্গাস্নানে উত্তেজিত ৪ – ৫টা সাদা শুয়োর। এক মাতাল সাথী বলে ওঠে, একেই বলে “শুদ্ধ শুয়োর। খাতি যা লাগবে না!” 

আমি ঠিক আদিগঙ্গার জল ছুঁই ছুঁই একটা সাময়িক চুল্লুর ঠেকে বসে। ক্ষিদের পেটে চুল্লু ঢুকে পেটের প্রোটিন চেঁছে খাওয়ার চিনচিনে ব্যাথাতে পিঠের গন্ধ মিশে আমার রোমান্টিক অনুশীলনকে বেশখানিকটা আশকারা দিল। গিরিন দাদু আমার দাদু না হয়েও বরাবর নাতি-স্নেহ আর প্রশ্রয় দিতেন। দাদুর অভাব বোধ করিনি। আমার ঠাকুমা বা দিদিমাও গিরিন দাদুর মতো আমার রক্তের ঠাকুমা দিদিমা ছিলেন না, আমি ডাকতাম বউ বলে। তবে ওটা ছিল আচার, এখন এই চুল্লু হাতে আচার চলবে না। 

বউ তোমার সাথে অনেকদিন গল্প হয়নি, একটু সবুর কর। 

কিন্তু বউয়ের কথা মনে পড়ল কেন। ও, আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা! আজ বুদ্ধ জন্মেছিলেন বৌকে ছেড়ে যাবেন বলে! কিন্তু গৌতমের বউ কি বুদ্ধের প্রেমিকা ছিলেন? প্রেমিকা হওয়া কতটা জরুরি বউ হবার জন্য, বা উল্টোটা- তুপু আমার প্রেমিকা – নাঃ, প্রেমিকা কি করে হবে! ও তো জানেই না আমি ওকে ভালোবাসি। তাহলে বউ হতে আপত্তি কোথায়! তিনটে শুয়োর হঠাৎ একটা শুয়োরের পিঠে চাপতে চাইছে। বিকট আওয়াজে মনে হলো চাঁদ আর ব্রিজটা বেঁকে গেল। 

ব্যাপারটা আবার শুরু থেকে শুরু করা যাক, আমি তুপুকে ভালোবাসি, তুপু জানে না আমি কী বাসি, তাই আমিও জানি না তুপু কি বাসে? কিন্তু মাঝমধ্যেই আমার দাড়ি খামচে দশবারোটা দাড়ি উপড়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলে – বুড়ো তোকে কে বিয়ে করবে?

ওর স্ফীত নাকের পাটা আমাকে যে কোনও মুহূর্তে, সে স্মৃতি হোক আর দৃশ্যমান স্থির এবং শক্ত করে দেয়। বাকী রইল ওর চোখ। ওর চোখ আমাকে অপরাধী নয়, শয়তান বা কবি নয়, ঈশ্বর করে দিতে পারে। ওর শরীরের ওমের জন্য স্পর্শ দূরের কথা, পাশে চুপচাপ বসে থাকার জন্য, আমি একটা দিনও অনশন করতে পারি না; তবু তুপু আমার। ভীষণভাবে, মারাত্মকভাবে আমার। ওর জন্য কাউকে খুন করতে পারবো না, কিন্তু না মরে নিজেকে বারবার খুন করতে পারবো আজীবন। পকেটে দশ টাকা আছে। ২ টাকার গাঁজা + ৫০ পয়সার বাতাসা + এক টাকার চারমিনার + ৫০ পয়সার বিড়ি + কলের জল ফ্রি। হাতে ৬ টাকা থাকবে। কাল সকালে ২ টাকার কচুরি- হ্যাঁ, সকালের খাবারটা ঠিকঠাক হওয়া চাই, এয়ার ফোর্সের অতটুকুই বেঁচে আছে + কফি হাউসে যাওয়ার বাস ভাড়া এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে ৩ টাকা + দুবার চা, তারপর? এই তারপর শব্দটা ফাঁক পেলেই আচ্ছা আচ্ছা মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। যেমন-- মাথা কাজ করছে না, গাঁজা চাই, রুটি তরকার বদলে বাতাসা চাই। গিরিন দাদু কোথায় তোমার পিঠে গাছ! 

রাত ১ টার সময় মামার বন্ধ দোকানে টাকা তারপর টিনের দরজায় প্রথমে হাত ডলে দেওয়া, তারপর চাপড়--আমি কবিতা লিখি বলে মামা মানে এই মুদি দোকানের মালিক আমার অত্যাচার অল্পবিস্তর সহ্য করে দেন। এরপর আরেক মামা আছে, তুপুর বাবা, মামা বলেই ডাকি, সবাই আমার মায়ের ভাই, প্রথম মামা বাতাসা দিল, দ্বিতীয় মামা শুতে দেয়! 

দ্বিতীয় মামার বাড়িতে, মানে তুপুর বাড়িতে খাবো না বলে শুতে দেবে না এমন তো কথা হয়নি। একটা বাবুই পাখীর বাসার মতো ছোট্ট দরজা, কিন্তু সবার জন্য পরিমিত শয্যা টানটান। তাছাড়া ‘খাব না’ এ তো আমারই রুক্ষ ঘোষণা ছিল। রুক্ষতার কারণ আমার বাজার করতে না পারা আর দ্বিতীয় কারণ মামার আর্থিক অবস্থা, আমি গরিব বলে মামা কেন ডেইলি মাছ কিনতে পারবে না! মামা তো আমার মামা, আমার বয়সে বড়। গরীব কেন হবে? প্রতিদিন টানাটানি করে খাওয়ার অবসান ঘটাতে একদিন মামীর অনেক অনুরোধকে নস্যাৎ করে দুহাত ছড়িয়ে বলেছিলাম --- নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মামাকে কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসেছিলাম, কারণ তুপু সারাদিন ‘বাবা বাবা’ করত! 

আর এই ‘মিল-বর্জন’ ঘোষণার পর প্রত্যেক রাতে দরজা খোলার পর রাত্রি ১১,১২,১ টা হোক মামী হাসতে হাসতে বলত ---এ কী তোর পা দেখতে পাচ্ছি না তো! দাঁড়িয়ে আছিস কি করে! 

তারপর পেছন থেকে আকুতি---খেয়েছিস তো, বাড়িতে আলুসেদ্ধ ভাত আর ডাল আছে। 

নিকুচি করেছে আলুসেদ্ধ ভাত! 

আমি চোখ চেপে সোজা একটা ৫ বাই ৮ ফুট ঘরে ৩ বাই ৬ ফুট টানটান বিছানার নীচে, বাতাসা ভরা পেট নিয়ে টানটান নীল নাইলন মশারীর ভিতরে, টানটান বিছানাকে এলোমেলো করে চিতপটাং! মামী নিঃশব্দে একটা ভয়ংকর ৬ ইঞ্চি ব্লেডের সিলিং ফ্যান চালিয়ে- আমি ততক্ষণে আউট! একঘুমে সকাল ৭টা। আমি ও বাড়ির জল স্পর্শ না করে বেরিয়ে পড়ি। না, আমি তুপুর মুখ দেখবো না। আমাদের ঝগড়া চলছে। আমার বয়স ৩০, তুপুর বয়স ১২! 

এদিকে পেপসি ঢুকছে। পেপসি কারখানা করবে বলে গড়িয়া উত্তাল! সাথে রামকৃষ্ণ নগরের লোকজন সমীরের বেসুরো গান শুনে শুনে পাগল হয়ে সমীরকে পাগলা গারদে দেওয়া যায় কিনা ভেবে ভেবে চায়ের দোকান ফাটিয়ে দিচ্ছে! 

সমীর মুখার্জি গৌতমদার, মানে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, ‘নাগমতি’ সিনেমার ক্যামেরা অ্যাসিট্যান্ট ছিল। ক্রমশঃ গৌতমদার বিশেষ স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠে। গৌতমদা কিছুদিন হলো মারা গেছেন আর তারপরের রাতেই নাকি গৌতমদা সমীরকে স্বপ্নে এসে বলে গেছেন ওঁর গানের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় শুধু সমীরের। স্বপ্নে এহেন উত্তরাধিকার পাওয়া সমীর সাতদিনের মধ্যেই বেপোরয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হাতে গীটার বা গাঁজার কল্কে আর গলায় গান। আর সমীরের সংসর্গে দুটোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। একে তো গানগুলো উদ্ভট, পাড়ার লোকেদের কাছে অচেনা, তার সাথে বেসুরোপনা আর গীটারের ঝ্যাং ঝ্যাং—আমিও সমীরকে দেখলেই পালাই! কিন্তু কত পালাবো, এক রাস্তায় থাকি—প্রায় শুনতে হয় গৌতমদার গান সমীরের গলায়! আশায় আশায় বসে আছি—সমীরের গলায় শুনলে যে কোনও মানুষ জীবন থেকে আশা শব্দকে বাদ দিতে বাধ্য! কিন্তু সমীর বলে ওর সাথে নাকি সরস্বতী রাতে এসে গান গেয়ে যায় আর ও সাদা হাঁসকে ভালো করে স্নান করিয়ে দেয়! কেন? গৌতমদা আসে না কেন? সমীর বিরক্ত হয়। দু’দিন পর দেখা গেল সমীরের পাড়ার গলিতে দুটো রাজহাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

তো একদিন রাতে ঠিক হলো সকালে সমীরকে পেপসি বিরোধী ধর্নায় নিয়ে গিয়ে গান গাওয়াতে হবে। সমীর তো শুনেই রাজি। ও জানতে চায়, মিক্সার থাকছে কি? আর মাইক্রোফোন কোন কম্পানীর? আমি বাধ্য হয়ে রাত্রিবেলা এক উঠতি নকশাল ছেলের সাথে হাত মিলিয়ে একটা রাজহাঁস তুলে হোটেল বিক্রী করে দিই। ফলাফল হাতেনাতে, সকালবেলা সমীর পাড়ার প্রায় সবার বাড়ির সামনে গিয়ে খিস্তি করা শুরু করল! পেপসি বিরোধীদের দেখলেই প্রায় মারে আর কি। ওদিকে বিকেলে শুনলাম সিপিএম আর এক নকশাল গ্রুপের মধ্যে গড়িয়া কলেজে পেপসি বিরোধীতা নিয়ে খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। নকশাল গ্রুপের অভিযোগ সিপিএম নাকি পেপসি গ্রুপের কাছে বিক্রী হয়ে গেছে। আর বিকেলবেলা সমীর আবিষ্কার করল বাকী একটা সাদা হাঁসের গায়ে কারা যেন গাড়ির লাল রঙ স্প্রে করে ছেড়ে দিয়েছে। আর সরস্বতীর বাহনের সেকি কষ্ট, শুকিয়ে যেতে যেতে একটিবারের জন্য ডানা ঝাপ্টে ঘাড় সোজা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে মরে গেল! সমীরের মদ আনতে দেরী হয়েছিল। তখন গ্রীন লেভেল হিট হুইস্কি, পাইট এনে যখন ঢালল, লাল রঙ গলতে গলতে ডানার জট খুলে গিয়ে পালক নরম হয়ে এল কিন্তু প্রাণ ফিরে এল না! আর এসব পুরোটাই ঘটল তুপুদের বাড়ির সামনে! পুরোটা তুপু দেখল। 

সে রাতে তুপুর আমার সাথে ঝগড়া মারামারির পর্যায়ে পৌঁছোয়! আঁচড়ে চুল টেনে আমাকে রক্তাক্ত করে দেয়! কারণ আমার প্রিয় রঙ লাল! তুপুর বিশ্বাস আমার বন্ধুরাই হাঁসের গায়ে গরম লাল প্লাস্টিক পেইন্ট ঢেলে দিয়েছে। আমি ওই রাত দশটার সময় সেই নকশাল ছেলেটিকে খুঁজতে বেরোলাম, মাথায় রক্ত চেপে গেছে। একটা হাঁস সরিয়েছিলাম সমীরকে থামানোর জন্য, আর ও পুরো ব্যাপারটাকে নিজের রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগাল! 

এগারোটা নাগাদ খুঁজে পেলাম একটা নতুন অর্ধেক তৈরি বহুতলের ভিতরে। ওরা চার পাঁচজন বিড়ির আগুনে কথা বলছিল। আমি ঢুকেই বললাম – এদিকে এসো তো! ও জবাবে বলল –- এই তো রাজা এসে গেছে, রাজা আজ রাতে এই ঘোড়াটা তোমার কাছে রাখবে? বিড়ির আগুনে চিনতে পারি কালো রিভল্বারকে! এ তো সার্ভিসের রিভল্বার, এয়ার ফোর্সে অনেকবার গুলী চালিয়েছি, ভীষণ পরিচিত, কিন্তু আজ মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল! 

আমি নিঃশব্দে নীচে নেমে গেলাম! মামার বাড়ির দিকে যেতে যেতে শুনলাম আশেপাশে কোথাও সমীর গান গাইছে—ভালোবাসি স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে, ভালোবাসি...খুব একটা বেসুরো মনে হলো না কিন্তু!


0

ধারাবাহিক - সুদেব ভট্টাচার্য

Posted in


ধারাবাহিক


সদগুরু 
সুদেব ভট্টাচার্য



পর্ব ২ 


সৌরপতি প্রত্যুষ তাঁর অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন। প্রচণ্ড এক কষ্টে তাঁর শ্বাস দ্রুত আসা যাওয়া করছে। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর শিষ্যরা। উত্তরের জানলা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই ভগবান তাঁর রশ্মি পাঠাচ্ছেন তাঁকে। এই রশ্মির রেখা ধরেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সৌরপতি পাড়ি দেবেন সূর্যলোকে। দিবাকরম আর ধর্মকাম এসে দাড়ালেন তাঁর মাথার কাছে। তাঁদের দেখে এই কষ্টের মধ্যেও এক সরল হাসির রেখা ফুটে উঠল সৌরপতির মুখে। তিনি অতি ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, 'আমার মৃত্যুর পরে দিবাকরম, ধর্মকাম ও কিরণজ্যোতি -এই তিনজন মঠের পরবর্তী সৌরপতি হবে। আমাকে ভগবান সেরকম সংকেতই দিয়েছেন। আমার অবর্তমানে এই তিনজন সন্ন্যাসী দীক্ষা দিতে পারবেন এবং সূর্যদেবের প্রধান সেবাইত হিসেবে কাজ করবে।'

সবাই মাথা নত করে তাঁর কথাতে সায় দিল। সৌরপতি প্রত্যুষের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই কিরণজ্যোতি তাঁর মুখে একটু জল দিলেন। 

সৌরপতি প্রত্যুষ আবার বলতে লাগলেন, 'তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ কোরো না। মনে রেখো, সূর্যপ্রাপ্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এই নশ্বর দেহের কোনও মূল্য নেই আমাদের কাছে। ভগবান প্রাপ্তিই আসল সুখ। তাই আমার শিক্ষাগুলি মনে রেখো তোমরা। দিবাকরম, তোমার ওপরে আমার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। তুমি এই সূর্যমন্ত্র সারা পৃথিবীবাসীর কাছে পৌঁছে দেবে একদিন। আমাকে কথা দাও তুমি, পুত্র।'

দিবাকরমের চোখে জল ভরে আসছে। তিনি নিজেকে চিরদিন দীন হীন ভেবে এসেছেন। তিনি এতবড় দায়িত্ব পালন করবেন কি করে? তবু এই সময় অবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। তিনি গুরুদেবের পা স্পর্শ করে বললেন, 'কথা দিলাম।'

সৌরপতি প্রত্যুষের চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল বেড়িয়ে ঝরে পড়ল বালিশে। তাঁর মুখে এখন প্রশান্তির হাসি। সময় আগত বুঝে দিবাকরম জোরে জোরে, সূর্যগায়ত্রী পড়ে শোনাতে লাগলেন তাঁর কর্ণকুহরে। সবাই সমবেত স্বরে তাই অনুসরণ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সৌরপতির মুখ হাঁ হয়ে গেল, প্রাণবায়ু মিশে গেল সূর্যরশ্মির সাথে। ধর্মকাম জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে প্রণাম নিবেদন করলেন, তারপর জানলার কপাট রুদ্ধ করে দিলেন। সবাই একে একে এসে গুরুদেবের পায়ে সূর্যমুখী ফুল রেখে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকু উজাড় করে দিল। একমাত্র দিবাকরমের মনে শুধু ঘুরতে থাকল সৌরপতির শেষ কথাগুলি।


*******

সৌরপতি প্রত্যুষের দেহাবসানের পর একবছর কেটে গেছে। এখনও দিবাকরম নিজেকে গুছিয়ে উঠতে পারেননি। এদিকে তিনি গুরুর অনুজ্ঞাও ভুলতে পারছেন না। তিনি কীভাবে সূর্যদেবের কথা ছড়িয়ে দেবেন সমগ্র পৃথিবীর বুকে? একদিন নিজের গুরুর প্রতিমূর্তির সম্মুখে বসে এসবই চিন্তা করছিলেন নব সৌরপতি। এখন এই মঠে তিনি ছাড়াও আরও দুজন সৌরপতি রয়েছেন - ধর্মকাম ও কিরণজ্যোতি। ওঁরা নিজেদের মত করে গুটিকতক শিষ্যও বানিয়ে ফেলেছেন। খুবই ধর্মপ্রাণ ওঁরা। ওঁদের দেখে দিবাকরম মুগ্ধ হন সর্বক্ষণ। তবে তিনি মনে মনে এটাও বুঝতে পারেন যে কিরণজ্যোতি হয়ত তাঁকে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা করেন। অনেক ভেবে তিনি এই ঈর্ষার একটা সম্ভাব্য কারণও খুঁজে পেয়েছেন। সন্ন্যাসের আগে দিবাকরম যখন সুখব্রত ছিলেন, তখন তাঁর অগাধ পয়সা ছিল। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। ইংরাজীও বেশ অনেকক্ষণ টানা বলতে পারেন। আর তাই তাঁর কথা বাচনভঙ্গী সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে কিরণজ্যোতি গ্রাম্য মানুষ, কথাতেই ভাষার টান রয়েছে। তাই হয়ত তাঁর জনপ্রিয়তাও খানিক কম দিবাকরমের চেয়ে। এছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পাননি দিবাকরম। তিনি নিজে কখনও কুব্যাবহার করেননি কিরণজ্যোতির সঙ্গে। কারণ তিনি তাঁর সন্ন্যাস জীবনে যেটুকু সারমর্ম অনুধাবন করতে পেরেছেন তাতে তিনি জেনেছেন যে জাগতিক শিক্ষার কোনও মূল্যই নেই আসলে। তাঁর এই জ্ঞান, পাণ্ডিত্য সবই তাই সূর্যেন্দ্রীয় প্রীতি ইচ্ছায় সমর্পিত। আর সন্ন্যাস গ্রহণের পর কেউ দরিদ্র থাকতে পারে না। তাদের সকলের এখন একটাই পরিচয় তারা মহান সৌরপতি প্রত্যুষের শিষ্য। এই মঠের দেওয়ালের ভিতরে এই ভিন্ন আর কোনও পরিচয় থাকতে পারে না। 
একদিন নিজের ভাবী কর্তব্য সম্পর্কে নানা কথা চিন্তা করছিলেন সৌরপতি দিবাকরম। এমন সময় ধর্মকাম প্রবেশ করলেন সেই ঘরে। প্রকৃত গুরুভাইয়ের মতোই দিবাকরমের মনোভার লাঘব করার জন্য সচেষ্ট হলেন তিনি। দিবাকরম তাঁকে খুলে বললেন তাঁর মনের সমস্ত কষ্ট এবং গুরুদেবের দেহ রাখার আগে তাঁর প্রতি বলে যাওয়া সেই অমোঘ বাণীর কথা। সব কিছু শুনে ধর্মকাম তাঁকে বোঝালেন যে ঈশ্বরের নাম প্রচারেই দিবাকরমের সন্ন্যাসজীবনের সার্থকতা। আর সেই নাম প্রচারের মূল ভিত্তিই হলো বই। জনসাধারণের জন্য লিখিত একটি সহজবোধ্য পুস্তক ছাড়া পৃথিবীতে সূর্যদেবের প্রচার প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই প্রথমেই দিবাকরমের উচিত সৌরদের সমস্ত পুঁথি দিয়ে একটি পুস্তক রচনা করা। এবং যেহেতু ইংরাজীতে তিনি পারদর্শী তাই সেই বেদ, পুঁথি, ইত্যাদি গ্রন্থগুলি তাঁকে যথাযথ ভাবে অনুবাদ করতে হবে যাতে দেশের বাইরেও সমস্ত মানুষের কাছে সেটা সহজবোধ্য হয়ে যায়। দিবাকরম এতক্ষণে যেন দিশা পেলেন একটা। ধর্মকামের মুখ থেকে যেন আসলে তিনি গুরুর আদেশই পেলেন। তিনি মনোস্থির করলেন যে সমস্ত সৌরপুঁথি তিনি অনুবাদ করবেন ইংরাজীতে। এবং তারপর তাঁর আসল কাজ শুরু হবে।


*********

শেষ দশ বছর ধরে দিবাকরম হাতের কাছে যা পেয়েছেন শুধু পড়েছেন। কোনারক সূর্যমন্দিরে গেছেন অনেকবার। সূর্যের মহিমার সন্ধানে তিনি যতই অতলে ডুব দিয়েছেন ততই যেন তিনি বিস্মিত হয়েছেন। তাঁর মনে হচ্ছে প্রতিধাপে তিনি সূর্যলোকে চলে যাচ্ছেন। এই তো তাঁর প্রভু কোল পেতেই রয়েছেন। সূর্যের প্রাচীনত্ব সীমাহীন। তাই শুধু হিন্দু ধর্মই নয়, পৃথিবীর সমস্ত পেগান ধর্মের পথে তিনি সন্ধান করেছেন পরম সত্যের। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ আত্মার উপলব্ধি। তাই এই ক’বছরে ইনকা সভ্যতা, মিশর সভ্যতা - সবকিছু তিনি কন্ঠস্থ করে ফেলেছেন। দশখানা সৌরপুঁথি ইংরেজীতে ভাষান্তরও করে ফেলেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এদিকের কাজ তিনি অনেকটাই গুটিয়ে এনেছেন। এবারে আসল কাজ সাধন করার পালা। কিন্তু সেখানেই তাঁর সন্দেহ হচ্ছে প্রবল। 
দিবাকরমের বয়স এখন প্রায় সত্তর বছর। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। অথচ এখনও তাঁর কানে সৌরপতি প্রত্যুষের বাণী স্পষ্ট বেজে ওঠে - 'কথা দাও পুত্র।' কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর কি বা করতে পারবেন? ধর্মকাম গত হয়েছেন দু’বছর আগেই। এখন এই মঠে অবশিষ্ট রয়েছেন দুইজন সৌরপতি মাত্র। তাঁরা চলে গেলে এই বিশাল কর্মকাণ্ড কে সামলাবে? যোগ্য উত্তরসূরির জন্য ভগবানের সঙ্কেত না পেলে তিনি তো কাউকে নির্দিষ্টও করতে পারবেন না সৌরপতি পদের জন্য। 

একদিন হেমন্তের বিকেলে শেষ বইটা অনুবাদের পর দিবাকরম যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।এতদিনের নিরলস পরিশ্রম তাঁর অনেকটাই লাঘব হলো। কিন্তু এরপরের পদক্ষেপ কি হবে সেই নিয়ে তিনি বেশ ধন্দেই ছিলেন। বিকেল হয়ে আসছে, সান্ধ্যপূজার সময় আসন্ন। সৌরপতির দেহেও যেন ক্লান্তি নেমে আসছে। দিবাকরম এগিয়ে চললেন গর্ভগৃহের দিকে। সূর্যাস্ত না হলে পুজো শুরু করা যাবে না। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন মন্দিরপ্রাঙ্গণে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন মেঘের ওপারের জগতে। যেখানে তাঁর গুরু আছেন, আছেন গুরুভাই ধর্মকাম। ওঁরা এখন রোহিতাশ্বের ন্যায় সূর্যের সেবা করে চলেছেন অহরহ। তাঁর ভাগ্যে কি আছে সেখানে পৌঁছনো? বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরেও সূর্য আকাশে রয়েছে দেখে একটু অবাকই হলেন সৌরপতি। আজকে তো আরও আগেই সূর্যাস্ত হবার কথা। তবে কি ভগবান তাঁকে কোনও সঙ্কেত দিতে চাইছেন? 

এমন সময় কিরণজ্যোতি এলেন পুজো দেখবার জন্য। আকাশে সূর্য দেখে তিনি বললেন, 'বিকেলের পরেও আকাশে আলো! এর মানে এখনও অনেক কাজ বাকি। তাই না বন্ধু?' 

দিবাকরম চমকে উঠলেন। সবকিছু তাঁর সামনে পরিস্কার করে দিলেন সূর্যদেব। সত্যিই তো তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু অক্ষম তো নন। তাঁর এখনও অনেক কাজ বাকি। গুরুদেবকে দেওয়া কথা তাঁকে রাখতেই হবে। তিনি সম্মতিতে মাথা নেড়ে বললেন, 'হ্যাঁ আপনি যথার্থই বলেছেন। আমার এখন অনেক কাজ বাকি। ভাবছি আগামী পরশুই আমি বেড়িয়ে পড়ব। এখানে আর কিছুতেই মন টিকছে না। আসলে ঘর থেকে অনেক দূরে আমাকে প্রভুর কিরণ পৌঁছে দিতে হবে, সেই আভাসটাই যেন দৃঢ় হচ্ছে ক্রমশ। তাই আমার এতদিনের সঞ্চিত যৎসামান্য পুঁজি নিয়েই আমি বিদেশ যাত্রা করব।'

কিরণজ্যোতি সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। আর এতক্ষণে সূর্যদেবও যেন আকাশে সচল হলেন। ধীরে ধীরে তিনি হারিয়ে গেলেন পশ্চিমের চক্রবালে। দুই সন্ন্যাসী কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন।


0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত 
সুবল দত্ত 


।।৬।।


হাত মেলানোর সময় সৌমজিত মিঃ ইভানোভিচের চোখে চোখ রাখতে পারলোনা। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। চকচকে পারদর্শী আকাশনীল কঠিন মারবেলের মতো চোখের মণি সোজা তার ভিতর অব্দি যেন ঢুকে যাচ্ছে। সে যেন তার গোপন ইচ্ছে অনিচ্ছে সবকিছুই পড়ে ফেলছে। অসম্ভব হিপনোটিক। চোখে চোখ মেলানো যায় না। চোখ ফিরিয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে তার সারা অঙ্গ সমেত তার মানসিক স্থিতি ওই লোকটা জিভ বার করে চেটে চলেছে। মাঝে মাঝেই প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছে সমু। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ভারী কিছুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছে আশরীর। সৌমজিত তার আর্মি জীবনে এরকম পরিস্থিতির সামনা কখনও করেনি। এ এক অদ্ভুত অবাস্তব ব্যাপার। এই আর্মীদের স্পেশ্যাল টাস্কফোর্সে হিপনোটিজম ট্রেনিং এর কথা সৌমজিতের অবশ্য শোনা, কিন্তু এত দেশ ঘুরেছে কোথাও কোনওদিন কোনও আর্মি গ্রুপে দেখেনি। কোনও কোনও দেশের টপসিক্রেট সার্ভিসের হাইপ্রোফাইলের অফিসারদের কয়েকজনকে হিপনোটিজম শেখানো হয়। মিলিটারি ইনটেলিজেন্ন্সএ সম্মোহনের ব্যবহার যে কত বিপজ্জনক একবার এক সেমিনারে সেই ব্যাপারে খুব আলোচনা হয়েছিল। সমুর মনে পড়েনা তার আর্মি ট্রেনিংএ, মানে অস্ত্রশিক্ষা থেকে ম্যানেজমেণ্ট ট্রেনিং অব্দি, কোথাও মানসিক শক্তি দিয়ে অন্যপক্ষকে বশ করার কোনও বিদ্যাচর্চা ছিল কি না। এই রাশিয়ান অফিসারটি কি সেইরকমই কিছু করছে? ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সমু দেখল ওই দোভাষী লোকটাও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। প্রাণপণে মনসংযোগ করে শরীর মন চোখ শক্ত করে রাশিয়ান অফিসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,- টেল মি মিস্টার সারগেই ইভানোভিচ, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? দোভাষী লোকটি তর্জমা করে অফিসারটিকে রাশিয়ান ভাষাতে বলল আর সমুর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল – আপনি বাংলাতে বলতে পারেন স্যার। আমার এতে বরং সুবিধেই হবে। 

শালা! আমাকে আন্ডার এসটিমেট করিস হারামজাদা! ঝাঁ করে রাগ চেপে গেল মাথায় সৌমজিতের। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে গুটিয়ে নিল। দোভাষী এপয়েন্টেড হয়েছে ওদের তরফ থেকে। আর এই পরিবেশে ওকে বোঝানো যাবেনা ও কত ছোটো আর আমি কত উঁচুতে। আর একটু মাথা ঠাণ্ডা হতে সৌমজিত বুঝল বিনা সন্মোধনে একটা বাজে সস্তা মার্কা ইংরেজি কথা ব্যবহার হয়েছে। মার্জিত রুচিসম্পন্ন কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু সার্ভিস লাইফের শুরু থেকেই এই ব্যাপারটা তার আসেনা। তার চেয়ে উঁচু পদবী ছাড়া কারও সাথে কথা বলতেই আপনা আপনিই মেজাজটা রুক্ষ হয়ে যায়। নিষ্ঠুরতায় যে সৌমজিত আনন্দ পায় সে কথা তার সব সাবর্ডিনেটরাই জানে। অনেককে সামান্য অছিলায় চাকরি থেকে ফায়ার করে দেবার বদনাম হেডকোয়ার্টারে আছে। কয়েকটা নিরপরাধের কোর্টমার্শালের কেসও আছে। ঐসব নির্বিবাদে কোনওকিছু না ভেবেচিন্তেই করে ফেলে। 

সৌমজিত আরও একটু সহজবোধ করলো। একরকম ভালোই হলো। এই দোভাষীটা বরং ওর উপকারই করেছে। হঠাৎ করে ওকে রাগিয়ে দিতে একটা আচ্ছন্ন সম্মোহক আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেছে। ও সহজভাবে অফিসারটির চোখে চোখ রাখতেই দেখল ওর নীল সবুজ চোখের ভাষা একেবারেই বদলে গেছে। ওর চোখে কৌতুক। অফিসারটি হেসে কথা বলা শুরু করল। দোভাষী সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করতে লাগলো। রাশিয়ান ভার্সেস ইংরেজি ও বাংলা। রাশিয়ান সাহেব কিছু ইংরেজি শব্দেরও ব্যবহার করতে লাগলেন। 

সারগেই: গুডমর্নিং মেজর জেনারেল। দেখছি যতটা টাফ আপনাকে লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি। আনপেনিট্রেবল।

সৌমজিত: কেন? কেন এইরকম কথা উঠল? কি দেখে বললেন কথাটা? কেউ কি আমার নিয়ে কিছু বলেছে?

সারগেই: না না, কেউ কিছু বলেনি। আমি কিছু জেনেও আসিনি। কেবল আপনাকে স্টাডি করতে চেষ্টা করছিলাম।

আপনি রিয়ালি একটা ব্যতিক্রমি চরিত্র। প্লীজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ টেক ইট এজ আ ফান,

আপনি হাইলি এগ্রেসিভ আর অফেনসিভ।

সৌমজিত: এইটাই কি আমাদের মিটিংএ আলোচ্য বিষয় মিঃ ইভানোভিচ?

সারগেই : সরি স্যার। আই এপোলোজাইজ ফর দ্যাট। নাউ লিভ ইট। কাজের কথায় আসা যাক। এখানে তো

আমাদের তিনদিনের রুটিন একসারসাইজ। বিগ্রেডিয়ার আর কমাণ্ডার রুটিন ম্যাপ রিহার্স করছে। 

আমাদের বুলস্ আই কি ওই শিমুলিয়া পাহাড়ের গা? রকেট লঞ্চার কি পাহাড়ের উপরে?

সৌমজিত: তাইতো আমাদের চুক্তির ব্রীফে আমাদের সুপ্রীম বসেরা সাইন করেছেন। ওনাদের আদেশ আমরা চেঞ্জ

করার কে?

সারগেই: এই ব্যাপারেই তো আমাদের আর আপনাদের কয়েকজন পারসোনেল হাইলি কনডেম করছে। আমরা তো জানতামই না যে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের একটা দুর্লভ গবেষণার বিষয় ওই শিমুলগাছের শিকড় আর অর্জুন গাছটির ব্যাপার। পাহাড়ের উপরে ওই গাছদুটো না কেটে ফেললে হাই প্রিসিসেনের রকেট লঞ্চার ইনস্টল্ড হবে না। 

সৌমজিত: কিন্তু এটা তো করতেই হবে। আমরা রুটিনের বাইরে যেতে পারিনা।

সারগেই: আপনাদের সাথে আমাদের এই একটা ব্যাপারেই তফাত। নিজের স্বার্থ নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে দেশকে পর্যন্ত আপনাদের কেউ কেউ বিক্রি করে দিতে পারে। অর্জুন গাছের লাল রস দিয়ে কুষ্ঠ রোগ নিরাময় হয়। তাই আমরা ওই গাছকে পুজো করি। আমি জানি ১৯৫৫ সালে রাশিয়া চেয়েছিল আপনাদের দেশে আকন্দ গাছের ও অর্জুন গাছের চাষ করবে। তা থেকে ড্যাপসোন ওষুধের কারখানা বসাবে। রাশিয়ায় তখন লেপ্রসি এপিডেমিক। আপনাদের এখানেও তখন তাই। কিন্তু আপনাদের অর্থমন্ত্রীর একগুয়েমী আর লোভের জন্যে তা হলো না। মার্ক কম্পানীকে বাজে এন্টিবায়োটিকের লাইফ লং পেটেন্ট দিয়ে দিলেন। আর আপনারা ওই বহুমূল্য ভেষজ চিনতেও পারলেননা। আপনাদের দেশে লেপ্রসি বেড়েই চললো। 

সৌমজিত: এসব আমাকে বলে কি লাভ?

সারগেই: (একটু ঝুঁকে একদৃষ্টিতে ওর চোখে চোখ রেখে) এই শিমুলিয়াতেই কেন জয়েন্ট এক্সসারসাইজের ব্যবস্থা করলেন? আমি ডেড শিওর আপনিই এতে ইনিসিয়েটিভ নিয়েছেন। স্বীকার করুন। আমি কিন্তু সব জেনে যাচ্ছি।

সৌমজিত: (হাঁসফাঁস করতে করতে উঠে দাঁড়ায়) কি সব ইডিয়টিক আনপার্লিয়ামেণ্টারি কথাবার্তা! রাবিশ! আপনি আমাকে হিপনটাইজ করছেন।

সারগেই: (হো হো করে হেসে ওঠে) বলেছিলামনা! আ টাফ গাই। কিছুতেই কিছু করা গেল না। কিন্তু শুনুন মেজর জেনারেল। আমরা এই মিশনকে কনডেম করছি। তাছাড়াও আপনি ওই বস্তির মাঝে ওদের কুঁড়েঘরের পাশ দিয়ে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে বলেছেন। এটা সরাসরি শোষণ। আমরা সাচ্চা কম্যুনিষ্ট। এসব বরদাস্ত করব না। তাছাড়া তিনদিন পর জঙ্গলে উগ্রবাদী মারার জন্যে কোম্বিংগ অপারেশন চালাবেন কাকে মারার জন্যে? কিল অর কেপচার লিস্টে কয়েকটা আদিবাসীর নাম আছে দেখলাম। সেই কয়েকটা অসহায় বঞ্চিত আদিবাসীকে মারার জন্যে? এমেজিং! যারা খেতে পায়না, আশ্রয় নেই, পরার কাপড় নেই.... 

সারগেই উঠে পড়লেন। কথার ফুলঝুরি ছুটল। কিন্তু দোভাষী চুপ করে গেল। আর সে তর্জমার ভাষা পেল না। কথা বলতে বলতে ইংরেজিতে চিত্কার করে স্টপ ইট স্টপ ইট বলে বেরিয়ে গেলেন সারগেই ইভানোভিচ। 















0

অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


অণুগল্প


সত্য
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস



পশ্চিম আকাশে এখন রঙের খেলা… লালচে-কমলা আকাশে দিনশেষের ক্লান্তি মিশেছে। সব পাখিরা ঘরে ফিরছে। শুধু শান্তনব দেবব্রতের কোথাও ফেরবার নেই। পরিখা-মধ্যে শরশয্যায় শায়িত তিনি। ক্ষণকাল পূর্বে সমস্ত কুরু-পাণ্ডব জ্ঞাতি ফিরে গেছেন তাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করে। এখন তিনি একা। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

-"কুরুশ্রেষ্ঠ…"
পরিচিত বলিষ্ঠ পুরুষকন্ঠের আকুতিভরা ডাকে তাকান ভীষ্ম। এই কন্ঠে নম্রতা থাকতে পারে, এ কথা তিনি জানতেন না। বিষ্ময় গোপন করে তিনি তাঁর পদতলে আসীন দেবকান্তি পুরুষকে আহ্বান করেন, "এসো রাধেয় কর্ণ।" 

ঈষৎ নতমুখে সূতপুত্র এগিয়ে আসেন ভীষ্মের নিকটে। ভীষ্ম তাকান কর্ণের বিব্রত মুখের দিকে, "তোমার মতো পরাক্রমী যোদ্ধার দৃষ্টিতে আজ কিসের ছায়া?" 

কর্ণ মৃদুস্বরে বলেন, "কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি সামান্য সূতপুত্র। দুর্যোধনের বন্ধুতায় আজ সিংহাসনলাভ করেছি। আমি জানি না এতে আমার অপরাধ কি! তবে আমি আপনার বিরাগভাজন, এ কথা আমি জানি। আমি করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। "ভীষ্ম স্নেহভরে স্পর্শ করেন কর্ণকে, "তুমি এসেছো, আমার ভালো লাগছে, কৌন্তেয়।" 

কর্ণ চমকে ওঠেন। বৃদ্ধের প্রাচীন ক্লান্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। কর্ণ ফিসফিস করেন, "আপনি…" মুখের কথা কেড়ে নেন ভীষ্ম, "আমি দেবর্ষি নারদের কাছে শুনেছি তোমার জন্মকথা। আমি জানি তুমি সূতপুত্র নও। তোমার পিতা সূর্য।" 

কর্ণ তিক্তকন্ঠে বলেন, "তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গাঙ্গীন, আমি জন্মমাত্র পরিত্যক্ত। আমি আমার মায়ের কাছে অযাচিত লজ্জাবিশেষ।" 

ভীষ্ম মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলেন, "তিনি তোমার জন্মদাত্রী। তাঁর প্রতি এ বিদ্বেষ তোমার অশোভন।" কর্ণ থমকে যান। ভীষ্মের হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে কাতরকন্ঠে বলেন, "বীরশ্রেষ্ঠ, আপনি কি আমায় ক্ষমা করেছেন?" 

ভীষ্মের স্বরে কোমলভাব ফিরে আসে। তিনি এক হাতে আলিঙ্গন করেন কৌন্তেয়কে, "আমি তোমার স্পর্ধায় ক্রুদ্ধ হইনি কখনও। কিন্তু দুর্যোধনের সান্নিধ্যে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ। বারংবার খর্ব করতে চেয়েছো পাণ্ডবদের। আমি তোমার তেজোহানি করবার নিমিত্ত তোমায় মুহুর্মুহুঃ কটুবাক্য বলেছি। রাজন, তুমি অস্ত্রচালনায় অতুলনীয়। তোমার দান ও জ্ঞানের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তুমি কেন দুর্যোধনের পাপের ভাগী হচ্ছো? তুমি অস্ত্রত্যাগ করো। ফিরে যাও সত্যের পথে।" 

কর্ণ দীর্ঘ সময় নতশিরে বসে থাকেন ভীষ্ম-সান্নিধ্যে। ছায়া নামছে। দূরে, অনেক দূরে বিলাপধ্বনি শোনা যাচ্ছে মৃত সৈনিকের স্ত্রীর। কর্ণ উঠে দাঁড়ান একসময়, "পুরুষোত্তম, আমি যোগ্যতা সত্ত্বেও সারা জীবন অপমানিত হয়েছি। একমাত্র দুর্যোধন আমার প্রতিভাকে মর্যাদা দিয়েছেন। আমি তার কল্যাণার্থে উৎসর্গ করেছি আমার সমস্ত কিছুকে। এটাই আমার সত্য। এর বিরোধিতা করতে আমি অপারগ। আপনি ক্ষমা করুন আমায়।" 



নমস্কারান্তে ফিরে যাচ্ছেন এক বঞ্চিত নায়ক, যিনি শীঘ্রই সত্যরক্ষার্থে ত্যাগ করবেন তাঁর কবচ-কুণ্ডল। ভীষ্মের দৃষ্টি তার গমনপথের দিকে। ছায়া গাঢ় হতে হতে অষ্পষ্ট করে দেয় দৃষ্টিসীমানা। তারপর সব অন্ধকার।


0

অণুগল্প - রাখি পুরকায়স্থ

Posted in


অণুগল্প


কুয়াশার আয়না
রাখি পুরকায়স্থ



শীতের সকালে জুবিলি পার্কের নুড়ি বিছানো পথ ধরে হাঁটা আমার কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। আজ জীবন প্রান্তে পৌঁছে, কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতিপটে দীর্ঘ জীবনছবি যেন ক্রমশঃ আবছা হয়ে আসছে। তবুও রোজ সেসময় কুয়াশা ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়ায় ছেঁড়া জামা পরা সাত-আট বছরের এক শ্যামলা বালক! আমার চোখের সামনে তখন ভেসে ওঠে সাদা কালো একগোছা জীবনছবি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে খালি পায়ে ইতস্ততঃ হেঁটে বেড়ানো সেই ছেলে। জনৈক রেলযাত্রীর ফেলে দেওয়া এক টুকরো পাউরুটি কুঁড়িয়ে পেয়ে তার মলিন মুখে হঠাৎ আলোর ঝলক। আমি দেখি, খাবারের দোকানের সামনে এক পেট ক্ষুধা বয়ে বেড়ানো ছেলেটির হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা, ক্ষুধার জ্বালায় ধূলার উপর তার কেঁদে ঘুমিয়ে পড়া, আর দেখি তার চোখের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো জলের দাগ। পুরানো গন্ধ মাখা ছবিগুলি আমার চোখের সামনে পর পর এসে ধরা দেয়। যেন বহুযুগ ধরে হৃদয়ের নিভৃত কোণে যত্নে রাখা একটি ছবির বইয়ের ধূলি ধুসর পাতাগুলি আমি রোজ উল্টেপাল্টে দেখি। ছেলেটি আমাকে স্মৃতির ওপার থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে আর আমি পরস্পরকে দেখি। মাঝে বয়ে যায় সত্তোরটি বছর।

সঞ্জিবনী আবাসনের দ্বিতলে সারাজীবনের সঞ্চয়ে কেনা দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে আমার বড় কষ্ট। তবুও রোজ প্রাতঃভ্রমণে আসি। যুগান্তপারের স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসচিত্রপটে। সেই তীব্র টানে শীতের কুয়াশার চাদরে মুড়ে বিজনে ‘নিজের’ সঙ্গে দেখা করি।

0

ছোটগল্প - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


ছোটগল্প


রতিবিকার
উত্তম বিশ্বাস



রাত্রির অন্ধকার নেমে এলেই ইচ্ছাময়ী আমাকে আর চোখের আড়াল হতে দেয়না। তখন আমাদের একান্ত বুনোপার্বণ, মিঠেপাতা পান আর কর্পূর লবঙ্গের বাটায় যতটুকু নৈবেদ্য সাজানো সম্ভব - তারও অধিক কল্পনা করে চরিতার্থ করি আমি আমার গুহাচারী অন্তরমকে!

সকালে লাবণ্য আসে। আমার খটবিছানা গোছায়। মর্দিত বালিশের পাশে যদিবা কোনওদিন অক্ষত বেলকুড়ির মালাগাছা সে কুড়িয়ে পায়, অমনি সেটিকে তার খোপায় জড়িয়ে ভৈরবী সুরে গুনগুন করে গাইতে গাইতে আমার ধূলিমলিন ঘরবারান্দা ঝাড়চোপ দেয়, আর খিলখিল করে হাসতে থাকে! লাবণ্যের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করার আগেই মা আমাকে রস্ত করে---‘লাবণ্যের হাসিতে সূর্যোদয় লেখা আছে রতিকান্ত! ওকে ধমকে লাভ নেই; কাল কিন্তু বাগানে একটি কুঁড়িও ফুটবেনা!’

‘কিন্তু ও যে একটা মাসমাইনের দাসী মা!’ 

‘মানুষের সংসার চিরকাল দাসীবাঁদীকেই বেশি ভালোবাসে রতিকান্ত! যেমন আমি তোমার বাবার সংসারে ছিলাম! জানো, আমি এই এতটুকু বয়সে যখন প্রথম ঘরের বাইরে পা বাড়ালাম—’ আমার স্নেহময়ী তাঁর আঁচলের খুঁট থেকে একমুঠো কুন্দ দিয়ে বলেছিলেন, -‘আশালতা, আর যাই কর, এগুলো যেন তোমার উঠোন থেকে কোনওদিন না শুকোয়!’ আর তাই, আমি আমার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সেই সত্য রক্ষা করে চলেছি, বাপ!---আর লাবণ্য হলো আমার সেই ইচ্ছা; ব্যাধিগ্রস্ত ঘুমের দেশে একটিমাত্র ভাড়াটিয়া শুকতারা!’ 

লাবণ্য আসে সস্তা বিলিতি পোশাক পরে। মা অবশ্য প্রথম প্রথম উত্যক্ত করত,--‘থাকিস তো বাদা অঞ্চলে লাবণ্য; এত আঁটসাঁট জামাকাপড় কোথায় পাস, শুনি!’

‘গেল মাসে লেডিজ কামরায় এক হকার দিদির কাছ থেকে এই খাটো জামাটা কিনেছি গো! বোঝ তো হাসনাবাদ লোকাল!’ 

‘ভালো করেছ। ওগুলো এবার চটপট পালটে এসো বাপু!’

বাইরে গাড়িবারান্দার সাথে ওর জন্যে একটি প্রসাধনকক্ষ বানিয়ে দিয়েছি; একান্ত মায়ের ইচ্ছাতেই। রোজ সকালে মোটা মোটা শাঁখা চুড়ির শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। বুঝতে পারি লাবণ্যের চা প্রস্তুত হয়ে গেছে।–‘ন্যাড়াবোচা হাতে কোনওদিন জলখাবার সাজাতে নেই লাবণ্য, এতে সংসারের অমঙ্গল হয়; লক্ষ্মী ছেড়ে যায়!’ -কথাটা এখন সারাদিন টুংটাং করে বাজতে থাকবে লাবণ্যর অলংকারে! ও এখন এসেই তাই ছোট্ট সাজের বাক্সটি খুলে দু’হাত ভরে শাঁখাচুড়ি পরে নেয়। 

তন্দ্রা ঘুমোয় পাশের ঘরে। তন্দ্রা আমার অগ্নিসাক্ষী করে আনা স্ত্রী। ও যতক্ষণ ঘুমোতে থাকে; ততক্ষণে সকালের সমস্ত গানপ্রিয় পাখিরা তাদের প্রতিদিনের কলকাকলির সরগম শেষ করে উড়ে যায় দূরদূরান্তের বনে। আমার স্তন্যদায়িনী আশালতা, এইখানে তন্দ্রার কাছে একেবারে পরাজিত সেপাই! আর তাই একান্ত নিরুপায় হয়ে, হাতে ঝকঝকে একটা পেতলের সাজি নিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে একটার পরে একটা কুড়িয়ে ফ্যালে – নিকানো উঠোনের বুকে ঝরে পড়া শিউলির রাশি! লাবণ্যর হাসি উপচে পড়ে উঠোনে! না হেসে উপায় আছে, অমনি মায়ের দপ্তর থেকে ভুরিভুরি অভিযোগ জমা পড়বে না! আর অভিযোগ সত্য বলে প্রমানিত হলে, বৎসরান্তে আর্থিক পদোন্নতিও বন্ধ তার! মনখারাপের অসুখ তাই লাবণ্যকে কখনওই স্পর্শ করতে পারে না। আর করবেই বা কি করে; মা যে রোজ তাকে পুরনো পেতলের ঘটিখানি মাজতে পাঠিয়ে দেয়… আমাদের পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত পদ্মপুকুরে। ওটা নামেই পদ্মপুকুর বটে; কিন্তু পদ্মের চাষ এখন আর ওতে করা হয়ে ওঠে না। তবে অবহেলায় আর অনাদরে, সাবেকী পলিমাটিতে এখন ওতে থরে থরে ফুটে থাকে সাদা শাপলার দল। জননীর আদেশ---‘সিঁড়িতে আলতাপরা পায়ের পাতা ডুবিয়ে, ঘটিতে জলের ঢেউ তুলবি! অন্তত সেই ঢেউ যাতে একশোটি শাপলার বুকে দোলা দেয়—সেদিকে লক্ষ্য রাখিস লাবণ্য! আর হ্যাঁ, জলের নীচে তাকিয়ে যদি দেখিস সেখানে সূর্য নেই; তাহলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সূর্য প্রকাশ হলে ভরে তুলবি পুণ্যঘট!’

গুটিকয়েক মুঠোফোন, দুচারটে ওষুধের কৌটো আর দুটো বাঁধানো চশমা ছাড়া, সংসারের আর সব জীবিত ও পালিত প্রাণীর সঙ্গে তন্দ্রার তেমন প্রাণের সংস্রব নেই। ওর আসক্তি বলতে, শব্দ-ছন্দ-দ্বন্দ্বহীন অতলান্ত নিদ্রা আর নিঃসঙ্গ নির্জন মৃত্যুপুরীর মত অন্ধকার! জগৎসংসারে নানাবিধ রোগব্যাধি আর বিচিত্র উপসর্গের উৎস অনুসন্ধানই তন্দ্রার জীবনের একমাত্র ব্রত! ওর কাজের ঘড়িতে তাই রাতে ও দিনে নিজের দিকে তাকানোর কোনও আলাদা নির্দেশক নেই। মনে পড়ে দ্বিরা গমনের রাতে তন্দ্রা আমার বুকের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল,--‘শুধু শুধু মরুভূমিতে কুয়ো খুড়তে গেলে রতিকান্ত! তোমার চোখে যে বিপ্লবের ইশারা, --এর জন্যে কিন্তু মোটেও প্রস্তুত নই আমি! আমাকে ক্ষমা কর!’ অপরদিকে কালো দিঘির মতো মায়ের সজল চোখদুটো লক্ষ্য করে বুঝতাম, সে যেন আরও কিছু একটা চাইছে! তাই মায়ের জন্যে এনে দিয়েছি লাবণ্যকে; আর লাবণ্যর জন্যে আনতে হয় গৃহবধূর সাজসজ্জা অলংকার চন্দন। অপর দিকে তন্দ্রার জন্য একটু অধিক আতিশয্য---খাদ্য-খাদকের দূরত্ব; আর জীবনসঞ্চারী ঔষধ!

ছাদে রৌদ্র ছড়িয়ে পড়লে মা মাদুর বিছিয়ে লঙ্কা শুকোতে দেয়; অমনি লাবণ্য মায়ের অন্তরের কথা অনুভব করে, হাওনদিস্তা এনে একহাত ঘোমটা টেনে পিঁড়ি পেতে বসে যায় লঙ্কা কুটতে! হাওনদিস্তার দুমদুম শব্দে, লাবণ্যর শাঁখাচুড়ির টুংটাং রুনুঝুনু আওজে মায়ের চোখে সহজেই আষাঢ় ঘনিয়ে আসে! তখন ঘনঘন শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে, আর এক যে ছিল তাদের বৌকালের ঝিকালের গল্প পাড়ে! লাবণ্য মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সাকনিতে মরীচগুড়ো টোকে আর মায়ের কথায় এলে দেয়,---‘তোমারও তাহলে ঢেঁকির অভিজ্ঞতা আছে মা?’

‘হাড়গুলো যদি কুলোয় তুলে বাতাস দেওয়া যেত; দেখাতাম কতটা ধুলো!’

বেলা পড়ে আসে। লাবণ্যর চোখের পাতাজোড়া অস্তরাগের বলাকার ডানার মতো দেখায়! এবার অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে কপাল থেকে মুছে ফ্যালে ধ্যাবড়ানো সিঁদুরের টিপ আর গৃহস্তের দ্বার ব্যাকুল করা চঞ্চল দুখানি পায়ের পাতা থেকে গৃহশ্রী আলতা! সন্ধ্যা নামে। তুলসীমঞ্চে প্রদীপ শিখাটির দেখাদেখি, আকাশের সন্ধ্যাতারাটিও চিকচিক করে জ্বলে ওঠে! সেই আলোতে লাবণ্য দেখতে পায়,-জননীর চোখদুটিও যেন পদ্মপাতায় বেসামাল জলের মতো টলমল করে উঠল,--‘কাল তুই আসবি তো লাবণ্য?’ মায়ের এহেন শিশুসুলভ আশঙ্কা লাবণ্যর অতিপ্রিয় পদাবলী! সেও জোনাকির মতো কৌতুহল জিইয়ে রেখে জবাব দেয়,--‘দেখি! রাতটুকুনি যদি বাঁচি; কাল অবশ্যই খবর দেব! আজ এই পর্যন্ত। আটটা বাজলে লোকাল পাব না!’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! যা! যা! পোষাক পালটে নে! গয়নাগুলো বাক্সে রেখে যা!’ 

সবদিন তন্দ্রা ঘরে ফেরে না। রাত করে ঘরে ফিরলে ভীষণ বিচলিত হয়ে উঠি! ক্লান্ত ফুটলাইটের আলো যতদূর হেলে পড়ে, তারও চেয়ে বহুদূর প্রসারিত হতে থাকে আমার মানসিক উদ্বেগ। রাস্তার পাশে ফুলভারে আনত কদমের শাখা যখন বৃষ্টির ছাটে আন্দোলিত হতে থাকে; আর তার চঞ্চল ছায়া কম্পিত হতে হতে নিশাচর ক্ষুধার্ত খেচরের ডানায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়--- ঠিক সেই মুহূর্তে আরও দূর আলোকস্তম্ভের নীচে একটি অগ্রবর্তিনী অথচ ধীরমন্থর ছায়া চোখে পড়ে; ঠিক যেন সমাধিক্ষেত্র হতে ফিরে আসা ধ্বস্ত সন্ন্যাসিনীর মতো! তন্দ্রা ঘরে ফেরে। ওর মানুষিক পরিস্থিতি অনুমান করে নিয়ে, কোনও কোনও দিন বৈঠকখানার জানলার ধারটায় গিয়ে বসি। যেদিন ওর কথাবলার স্পৃহা থাকে, বগবগিয়ে পুরো কলসিটাই উপুড় করে ঢেলে দেয়! আবছা আলোয় ব্যালকনির গ্রিল বেয়ে কেয়েরি করা লতার মতো লতিয়ে ওঠে কথা---‘আজ আমার জন্যে এত রাত জেগে, হঠাৎ কি মনে করে রতিকান্ত!!’

‘ভুলে গেলে আজকের দিনটার কথা?’

‘না ভুলিনি! জীবনের প্রথম ডেজারট সাফারি ছিল! ওফহ! তোমার জন্যে একটা দারুণ সুগন্ধি কিনেছিলাম; কিন্তু হরিদার বিশেষ অনুরোধে ওটা তাকে দিয়ে আসতে হলো। মানুষটা এমনিতেই খুব চাপা স্বভাবের; মুখফুটে কারও কাছে কোনও কিছু আজ পর্যন্ত চাইতে দেখিনি। আজ লাশকাটা ঘরে লম্বা লাইন ছিল! এত ব্যস্ততা ঠেলে ও যখন আমার ঘরে সুগন্ধি চাইতে এল, বুঝলাম নিশ্চই ওর শারীরিক কিছু একটা অসুবিধা হচ্ছে! হরিদা কি বলেন জান, ‘এরপর কোনও লাশের গাঁটে যদি দেখি আতর নেই; তার পোস্টমর্টেম হবে না!’ সুগন্ধির ইতিহাস, আর লাশকাটা ঘরের কর্মী হরিদার কথা আরও দীর্ঘায়িত হতে দিলে তন্দ্রা খুশি হতো; কিন্তু এমন নারকীয় দৃশ্য আমার কল্পনালোকে ডানা ছড়িয়ে দিক এটা আমি চাইনে! কথা ঘুরিয়ে দিই,---‘খাবে তো? খেয়ে নাও কিছু!’

‘খিদে নেই! সকাল থেকে একটার পর একটা মৃত্যু! ওফ অসহ্য! মর্গে ঠাঁই নেই; কেও মেঝেই গড়াগড়ি খাচ্ছে, কেও পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রসূতি মায়ের পাশে! মাঝে মাঝে মনে হয় গোটা একটা ব্যাধিগ্রস্ত পৃথিবীর ভারে গুড়িয়ে যাচ্ছি আমি!’

‘তোমার শরীর ঠিক আছে তো, তন্দ্রা ?’

‘জানতাম, আজও তুমি ঠিক শুধুমাত্র আমার শরীরের খোঁজটুকুই নেবে! মাংসের দোকানে খরিদ্দার যেমন মাংসের খবর নেয়!’ বুঝতে পারি তন্দ্রা মেরুঝড় হয়ে উঠছে! সামান্য তুষারকুচিও যে মুহূর্তের মধ্য বর্শার ফলা হয়ে বিঁধতে পারে; অর্থাৎ ইচ্ছাময়ীর শরণাপন্ন হওয়াই এখন একমাত্র সান্ত্বনা!

আজ শয়নকক্ষে প্রবেশ করতেই মাথার ওপর দিয়ে যেন একঝাক মরুপাখি উড়ে গেল! কামনার সুরভিত কক্ষে হঠাৎ যেন অবাঞ্ছিত বর্গীর হানা অনুভব করলাম! ইচ্ছাময়ীর অদর্শনে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল!

‘কাউকে খুঁজছ, রতিকান্ত?’

‘হ্যাঁ! নিশ্চই বুঝতে পেরেছ! কোথায় সে!’

‘ওই তো, বাইরের বারান্দায় রেখে এসেছি!’

‘অনুমতি নিয়েছিলে? নাকি এটুকুরও প্রয়োজন বোধ কর না আর?’

তন্দ্রা এবার শুকিয়ে আসা পাহাড়ি ঝোরার মতো হাসবার চেষ্টা করল,--‘অনুমতি! ওই নিষ্প্রাণ পুতুলের কাছে?’

‘প্রতিমা যখন মন্দিরের বেদীতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তখন নিশ্চই তাঁকে নিষ্প্রাণ ভাবা হয় না!’

‘আমি কিন্তু পৌত্তলিক নই, রতিকান্ত! রক্তমাংসের কাটাছেঁড়া নিয়েই আমার কারবার! এটুকুতেই রক্তশূন্য হয়ে পড়লে; তাও আবার সামান্য একটি পুতুলের জন্যে!’

‘ও সামান্য নয়, তন্দ্রা! ও আমার ইচ্ছাময়ী! আমার অভ্যাসের দাসী!’

‘বেশ! বেশ! সেবাদাসী না পেলে পাথরেও দেবতার এত রতি বিভঙ্গ সঞ্চার হতো না বোধহয়! তা তোমার ইচ্ছাময়ীকে কোথায় পেলে, শুনতে পারি?’

‘তোমরা মেয়েরা যেখানে বিপ্লবের জন্য ব্যাকুল; চিনের বাজার আমাদের জন্য সেখানে স্বতন্ত্র উপহার! নারীশূন্য শয্যা, পুরুষের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদার --- সেটা তুমি ভালো করেই জান, তন্দ্রা!’

‘আচ্ছা, চিনদেশের বাজারে আমার মতো মন্দভাগ্য মেয়ের জন্য একজন ইচ্ছাময়ের সন্ধান দিতে পার, রতিকান্ত! যে শুধুমাত্র আমার শরীরের খোঁজ নিয়েই দায় সারবে না; আমার মনের আটচালা ঘরেও সে উঁকি মারবে – বর্ষায় বসন্তে, শীতে ও তুফানে! এমন ইচ্ছাময় সত্যিই কি চিনদেশের বাজারে পাওয়া যাবে, রতিকান্ত!’

‘আবেগ সংযত কর, তন্দ্রা! ইচ্ছাময়ী বাজারজাত হলেও ওই কিন্তু আমার প্রকৃত শরীর সহচরী; আমার একান্ত সেবিকা! আমার ইচ্ছার নদীটাকে কখনই কিন্তু সে লুনি হতে দেয়নি!’

‘শুনতে পাই, এদেশের কৃষিক্ষেত্রে যখনই বড়বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে; দেশের তত্বজ্ঞানীরা হয় প্রকৃতিকে আর না হয় বর্গীর দলকেই দায়ী করে দায় সেরেছেন! এদেশের অধিকাংশ অশিক্ষিত অপদার্থ কৃষককূলের ইতিহাস কিন্তু কখনই---!’ 

‘চুপ কর, তন্দ্রা! লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্যের প্রতি তোমার আগ্রহ বেশি! নিষ্ফলা নারীর মুখে এসব মানায় না!’

‘এটাই হলো আসল কথা! ভোগবাদের পৃথিবীতে ইচ্ছাময়ীদের এত কদর কেন এইবার বুঝলাম! তোমাদের খাটবিছানা কেবল আঙুরলতা চায়; আখরোট হলেই কোপ! এই তো! কিন্তু একদিন যদি ওদের মুখেও কথা বসানো যায়; সেদিন সম্ভোগে পরিতৃপ্তি আসবে তো, রতিকান্ত?’

মায়ের ঘরে চোখ পড়তেই দেখলাম ঘরে আলো জ্বলছে। ঠুকঠাক আওয়াজে কৌতূহলী হয়ে উঁকি মেরে দেখলাম ইচ্ছাময়ীকে বারান্দা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে, মা তার খাটের ওপর বসিয়ে; হাওনদিস্তসায় পান থেঁতো করছে আর আপনমনে অনর্গল বকে চলেছে,--‘না! মোটেও কাপুরুষ ছেলেকে আমি পেটে ধরিনি! তুই বল ইচ্ছা, লাবণ্যর মতো রক্তমাংস থাকলে তোরও বমি করতে ইচ্ছা হতো কি না? মা হয়ে সন্তানের সন্ন্যাস! এ আমি কিছুতেই দেখে যেতে পারি না! সত্যি করে বল! না হলে তুইও ছেঁচা খাবি!’ 

দেখলাম, মায়ের হাওনদিস্তার তালেতালে ইচ্ছাময়ীও কেমন অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়ছে; যেমনটা খোলাছাদে লঙ্কা কুটতে কুটতে লাবণ্যও মাথা ঝাঁকাত---!




দরজায় দাঁড়িয়ে তখনও তন্দ্রা, আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল,---আসল বিকারটা কোথায়!