Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















 চতুর্থ এবং পঞ্চম পর্ব




 চতুর্থ পর্ব

পানু রায় বড়কালীর অফিসে ঢুকেই দেখলেন ঘর আলো করে সেক্রেটারির টেবিলে বসে আছে এক লম্বা, ফর্সা, নীলচক্ষু, কৃষ্ণকেশী সুন্দরী। বুঝতে অসুবিধে হলনা এই মহিলাই এলিনা রাই, বড়কালীর নতুন সেক্রেটারি। আসবাবপত্রগুলোর অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। টেবিলটা আগে যেদিকে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে উল্টোদিকে রাখা হয়েছে। কুচকুচে কালো মেহগিনির প্রেক্ষাপটে এলিনা রাইএর রঙ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। পানু রায় বুঝলেন টেবিলের অবস্থান পরিবর্তনের পিছনে অন্য কিছু ভাবনাচিন্তা কাজ করেছে। পানু রায় নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন যে জানালার পর্দার রঙ এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছে যাতে তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের উজ্জ্বলতা অনেকগুন বেড়ে যায় আর তার সঙ্গে বেড়ে যায় এলিনার সযত্নে প্রসাধন করা মুখের ঔজ্জ্বল্য। পানু রায় দরজা খুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অফিসের ফোন বেজে উঠলো। এলিনা হাসিমুখে পানু রায়কে স্বাগত জানিয়ে ফোনটা তুলে নিল। ঠোঁটের কাছে ফোনটা নিয়ে কয়েক মিনিট এত আস্তে কথা বলল এলিনা যে এত কাছে বসে থেকেও কিছুই শুনতে পেলেন না পানু রায়। শুধু শুনতে পাওয়া গেল ফোন রাখার সময় এলিনা বলল,’ কৃষ্ণকালী শহরে নেই। আমি দুঃখিত। আমি জানিনা উনি কবে ফিরবেন। আপনি কোনও মেসেজ দিতে চান? ও আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।‘ফোন রেখে এলিনা পানু রায়ের দিকে তাকাল। পানু রায় বললেন,’ আমার নাম পানু রায়।‘

-আপনিই পানু রায়। আপনার কথা স্যারের কাছে শুনেছি। আপনিই ওনার আইনি পরামর্শদাতা, তাই না?’

-ঠিক বলেছেন।

-আপনার অফিস থেকে আপনার সেক্রেটারি একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললেন আমি যেন স্যার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওনাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।

-অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি কি টেবিলটা সরিয়েছেন? ওটাতো আগে ওখানে ছিল না।

-না আমি সরাইনি।

-কিন্তু মনীষা যখন ছিল তখন ওটা উল্টোদিকে ছিল।

-হ্যাঁ, মনীষা টেবিলটা যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে আমি সরিয়েছি। ও টেবিলটা ভুল জায়গায় রেখেছিল। ওখানে আলো ঠিকমত পৌঁছচ্ছিল না।

-মনীষার সঙ্গে আপনার কথা হয়?

-না, সেরকম কথা হয় না। তবে এখানে দু’বার এসেছিল। তার বেশি কিছু নয়।

-ওর নাম আগে মনীষা ঝা ছিল। এখন ওর পদবি কী হয়েছে জানেন?

-ওর সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে তার নাম পরেশ প্রসাদ।

-ঠিক ঠিক। আমার এবার মনে পড়েছে। আচ্ছা এলিনা, কৃষ্ণকালী এখন কোথায়?

-উনি ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন।

-কবে গেছেন?

-উনি গতকাল বিকাল থেকে অফিসে নেই।

পানু রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও বিশেষ কারণে গেছেন?’

এলিনা বলল,’ না, বিশেষ কিছু নয়। আপনি তো জানেন উনি প্রায়ই ব্যবসার কাজে বাইরে যান। ওনার বিভিন্নরকম ব্যবসা আছে। তাছাড়া নানা শহরে ওনার সম্পত্তিও আছে।

পানু রায় বললেন,’ আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি ওনাকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকি।‘

-হ্যাঁ, আমি ওনাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি।

-আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব দরকার।

-সেটা কি রেবা কৈরালা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে?

পানু রায় মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কেন? একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’

এলিনা বলল,’ দেখুন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমি চাই না এই আলোচনায় কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। আমরা কি এই অফিস সামনে থাকে বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে স্যারের ব্যক্তিগত কেবিনে গিয়ে আলোচনা করতে পারি? সেখানে কেউ আসতে পারবে না।

পানু রায় বললেন,’ অবশ্যই।‘এলিনা চেয়ার থেকে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে অফিস বন্ধ করে পিছনের দিক দিয়ে গিয়ে একটা মস্ত দরজা খুলে একটা সুসজ্জিত বিশাল ঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে পানু রায়ও ঢুকলেন। এলিনা কৃষ্ণকালীর মস্ত মেহগিনি টেবিলের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঘুরে পানু রায়ের দিকে সোজা তাকিয়ে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল কোনও সিনেমার শট দিচ্ছে।

- স্যার কিন্তু ভীষণ রেগে যাবেন যদি শোনেন যে আমি আপনার সঙ্গে রেবা কৈরালার ব্যাপারে কোনও কথা বলেছি। আপনি মানুষের চরিত্র ভালোই বোঝেন এবং আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে রেবা কৈরালা একজন অত্যন্ত স্বার্থপর এবং ধুরন্ধর মহিলা।আপনি নিশ্চয়ই জানেন রেবা কৈরালার সঙ্গে স্যারের ছেলে কালীকৃষ্ণের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন কালীকৃষ্ণের নজর একটি অন্য মেয়ের দিকে পড়েছে এবং রেবা কৈরালা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি না রেবার আসল উদ্দেশ্য কী? তবে রেবা নিজের লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি রেবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চাই না এবং আশা করি আপনিও চান না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলি, আপনি কিন্তু খতিয়ে না দেখে ওর গল্পে বিশ্বাস করবেন না।

এতটা বলে এলিনা একটু থামল। তারপর বলল,’ স্যার বা কালীকৃষ্ণ যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমি আপনাকে এসব কথা বলেছি তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য তাহলেও স্যারের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার কোনও পরিবর্তন হবে না। এখন আপনি বলুন আপনি আমাদের এই আলোচনার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন না স্যারকে এই আলোচনার কথা জানিয়ে দেবেন।

পানু রায় বললেন,’ আপনি আমাকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলেছেন। কথা দিলাম সেই বিশ্বাস অটুট থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কোনও তৃতীয় ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও একথা জানবে না।‘

এলিনা পানু রায়ের সামনে এগিয়ে এসে বলল,’ অনেক ধন্যবাদ।‘ তারপর নিজের হাতদু’টো পানু রায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। পানু রায় নিজের দু’ হাতের মধ্যে এলিনার হাতদু’টো নিয়ে বললেন,’ আমার বয়স ১০৫। এখন আমি আসি।‘ বিস্মিত এলিনা অবাক হয়ে দেখল শিরদাঁড়া সোজা করে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পানু রায়।




 পঞ্চম পর্ব

বড়কালীর অফিস থেকে বেরিয়ে পানু রায় সুন্দরীকে ফোন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,’ মনীষা ঝা মানে এখন মনীষা প্রসাদের ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুন্দরী বলল,’দাদু, ধরে থাক। আমি তোমাকে মনীষার ফোন নম্বর কিংবা ঠিকানা দিচ্ছি।‘

-আমার ঠিকানা চাই।

কিছুক্ষণ পরে সুন্দরী পানু রায়কে মনীষার ঠিকানা জানিয়ে বলল,’ মনীষাকে আমার আদর আর শুভেচ্ছা জানিও।‘

‘অবশ্যই’ বলে পানু রায় হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে মনীষার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল,’ এসে গেছি।‘ পানু রায় ভাড়া মিটিয়ে বললেন,’ একটু অপেক্ষা কর। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব।‘

ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে পৌঁছে বেল বাজাতে যাবেন ঠিক তখনই একগাল হেসে দরজা খুলে দাঁড়াল মনীষা। বলল,’ পানু রায়!!! আপনাকে কতদিন পরে দেখলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! ভেতরে আসুন।‘পানু রায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, মনীষা।‘ মনীষা হেসে বলল,’ আপনি আগের মতই রসিক আছেন। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে আর মাত্র দু’ মাস। আমাকে এখন দেখতে হয়েছে হাতির মত। আমি বাড়ির সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বসার ঘরটাও পরিস্কার করা হয় না। অপরিচ্ছন্নতা ক্ষমা করবেন। এই চেয়ারটায় বসুন। কী নেবেন চা না কফি? ‘

-না না, ঠিক আছে। আমি এসেছিলাম কৃষ্ণকালী সম্বন্ধে কিছু খবর জানতে।

-কী সংক্রান্ত খবর?

-আমি জানতে চাই কী করে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে?

-কেন? উনি কি শহরের বাইরে?

-হ্যাঁ, সেটাই তো সমস্যার কারণ।

-আপনি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

-হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই প্রথমে যোগাযোগ করেছিলাম।

-কিন্তু যা জানার ছিল তা জানতে পারলেন না, তাই তো?

-না, আসলে কিছুই জানতে পারলাম না।

মনীষা হেসে বলল,’ আমিও দু’বার অফিসে গিয়েছিলাম।এমনি জানতে সব কী রকম চলছে। কোনও উত্তরই পাইনি। তাই আর যাইনা।

-তোমার সঙ্গে কৃষ্ণকালীর দেখা হয়েছিল?

-না, দু’বারের একবারও না। প্রথমবার আমি জানতাম উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার এলিনা তো স্যারকে জানাতেই চাইলনা যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

-কিন্তু কেন? কিছু আন্দাজ করতে পার?

-আমি জানিনা। আমি স্যারের অফিসে কাজ করেছি প্রায় বারো বছর। বারো বছর সময় ওনার ব্যবসা এবং ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পক্ষে যথেষ্ট, তাই না? ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর উনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। উনি যখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসছিলেন তখনই আমার বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু ওনার এই অবস্থায় আমি কিছুতেই ওনাকে লম্বা ছুটি নেবার কথা বলতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন আমি বিয়ে প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলাম যাতে ওনার ব্যবসার কোনও ক্ষতি না হয়।

-তারপর?

- উনিই কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি কিছু একটা ওনাকে বলতে পারছি না। তারপর আমার আঙ্গুলে হীরের আংটি দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমার বিয়ে কবে। তারপর কথায় কথায় বুঝতে পারলেন যে আমি ওনার কাছে ব্যাপারটা লুকোতে চাইছি। উনি ভীষণ রাগারাগি করলেন। বললেন এটা আমার করা উচিৎ হয়নি এবং আর দেরি না করে বিয়েটা সেরে ফেলতে। না হলে, উনি আমাকে আর অফিসে আসতে দেবেন না। এমন মানুষ আজকের দিনে সত্যিই পাওয়া যায় না।

-যখন তুমি ওখানে ছিলে তখন রেবা কৈরালার কথা শুনেছিলে?

-না, রেবা কৈরালা পরে এসেছে। আমি যখন ছিলাম তখন কালীকৃষ্ণের প্রেম চলছিল এলিনা রাইএর সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছিল বলে শুনছিলাম। ঘন ঘন সুন্দরী মেয়েদের প্রেমে পড়া কালীকৃষ্ণের স্বভাব। পরে শুনলাম রেবা কৈরালা বলে এক সুন্দরীর আগমণ ঘটেছে কালীকৃষ্ণের জীবনে। তাই এই ভাঙন এলিনার সঙ্গে ভালোবাসার। কালীকৃষ্ণের অনুরোধে স্যার এলিনাকে চাকরিতে বহাল করেন। অফিসের শোভা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসেনি এলিনা। নীতিজ্ঞানহীন এবং নাকউঁচু এক মহিলা। টাইপ করা ছাড়া আর কিছু ওর আসেনা। সারাদিন টিভি আর ভিডিওতে সুন্দরী সেক্রেটারিরা কীরকম পোষাক পরে, কীরকম সাজগোজ করে সেইসব দেখে দেখে সময় কাটায়।

-তাহলে, কৃষ্ণকালীর ব্যবসা কী করে সামলাচ্ছে এলিনা?

-আমিওতো সেটাই জানতে চাই।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী কাঠমান্ডুতে আছে। কাঠমান্ডুতে গেলে সাধারণত কোথায় থাকে কৃষ্ণকালী?

মনীষা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’ সাভেরা মোটেলে থাকার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। ওটা অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু খুব ভালো বলে শুনেছি। আমি বারদুয়েক বুকিং করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এলিনা অবশ্যই জানবে স্যার কোথায় উঠেছেন।

-এলিনা বলল ও কিছু জানেনা।

মনীষা ঘাড় নেড়ে বলল,’ হতেই পারেনা। স্যার বাইরে থাকলেও সবসময়ে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এমনকি যখন উনি কাউকে না জানিয়ে কোথাও যেতেন তখনও কিন্তু আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমাকে জানিয়ে রাখতেন প্রয়োজনে কোথায় ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।‘

-কিন্তু এলিনা বলল এই ব্যাপারে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অবশ্য সত্যি কথা নাও বলতে পারে। হয়ত ইচ্ছে করেই জানাল না।

-মিথ্যে বলছে বলেই আমার মনে হয়, মিঃ রায়।আমি আপনাকে এতটুকু প্রভাবিত করতে চাইনা। আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন বিয়ের পর একটা মেয়ের অনেক পরিবর্তন হয়। বাড়িতে অনেক বেশি সময় দেবার দরকার হয়। সম্পূর্ণ নিজের সংসার। সব দায়িত্ব নিজের। তবুও ওই অবস্থায় স্যারকে একেবারে ছেড়ে যাবার কথা ভাবিনি। আমি স্যারকে বলেছিলাম সময় করে মাঝেমধ্যে এসে আমি এলিনাকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। কিন্তু এলিনা কোনও আগ্রহ দেখাল না। আমি চলে এলাম। ভাবলাম কিছু দরকার হলে নিশ্চয়ই ফোন করবে।তার পরেও ফোন এলনা দেখে একদিন ওই অঞ্চলে কিছু কেনাকাটা সেরে ভাবলাম হাতে যখন একটু সময় আছে অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, অনেকদিন দেখা হয়নি। স্যারের যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি। কিন্তু এলিনা আমার সঙ্গে বাইরের লোকের মতই ব্যবহার করল। বলল স্যারের সঙ্গে দেখা হবে না। উনি নাকি জরুরী মিটিংএ আছেন। ফিরে এলাম। প্রায় দু’মাস পরে আবার একদিন কী মনে হল অফিসে গেলাম। সেদিন এলিনা আমার সঙ্গে একটু বেশি ভদ্রতাই করল। প্রায় দশ পনের মিনিট বসে রইলাম। এলিনার সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচ্ছিলাম। ও কিন্তু স্যারকে জানালই না যে আমি দেখা করতে এসেছি। আমি আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলাম না।ফিরে এলাম। ভাবলাম যদি দরকার হয় স্যার নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবেন।

-ফোন এসেছিল?

মনীষা রাগে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ আমি নিশ্চিত যে আমি চলে আসার পর অন্তত একশ’ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে ওরা যেখানে আমার সাহায্য দরকার ছিল।আমি বুঝতে পারি ঐ নাটুকে, ন্যাকা এলিনা কেন আমাকে ফোন করেনি কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা কেন স্যার আমাকে ফোন করলেন না? যে খবরটা আমার দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না সেই খবর এলিনা ফাইল ঘেঁটে খুঁজেই পাবে না, খবর দেওয়া তো দূরের কথা। কোথায় কোন ফাইল আছে তাই ও ভালো করে জানেনা।

- তুমি কৃষ্ণকালীকে তারপর কখনও ফোন করনি?

-না। আমি ভেবেছিলাম দরকার হলে স্যার আমাকে ফোন করবেন। আমি চাইনি ঐ মেয়েটা তৃতীয়বারের জন্য আমাকে হেনস্তা করুক।

-বেশ, আজ তাহলে আমি আসি। তুমি মাঝেমধ্যে ফোন কোরো। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমাদের অফিসে এসো। আমি এবং সুন্দরী খুব খুশি হবো তুমি এলে।ভালো থেকো।আশা করি সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।

-নিশ্চয়ই আসবো। খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়ে।খুব ভালো থাকবেন।

মনীষা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না পানু রায় অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠে অফিসের দিকে রওনা দিলেন।
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















।। ১ ।।

কোজাগরী জোৎস্না।মাথার উপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সারা গ্রাম।গাছগাছালি,ঘর-বাড়ি,মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নায় বিভোর। খিলখিল করছে সর্বত্র।তার আভায় পাড়ার খেলার মাঠও এখন টইটুম্বুর।বউ-ঝি,ছেলে-পুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।গোটা মাঠ এখন কয়েকটা ভাগে সীমানা তৈরি করেছে।

এই কোণে বউ-ঝিরা।

বউ-বসান্তি খেলছে। ঐ তো, একটা মেয়ে

কিৎকিৎ কিৎকিৎ করে, বউয়ের মাথা ছুঁয়ে, দৌড়ে তাড়া করছে অপর পক্ষের মেয়েটাকে।সেও আঁক-কেটে, বাঁক-কেটে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার দলের অন্যরা তখন বউকে মুনে আছে,যাতে উঠে পালাতে না পারে!

মাঠের মাঝে ছেলে-পুলের দল।

কাবাডি খেলছে। অন্যের কোর্টে ঢুকে একজন লাফাচ্ছে আর কাউকে ছুঁয়ে পালিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে

-কাবাডি,কাবাডি…

-ভোলা, মেরেই আসবি। দম ফেলবি না। যাহ, মেরে এলেই আমার শালী তোর… মার ভোলা। মেরে আয়য়য়য়…

উত্তর দিকটায় মাঝবয়সীরা গল্প-গুজবে মশগুল।কারো কারো হাতে বিড়ির আগুন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় তাদেরই একটা দল আবার তাস খেলছে।

রাস্তার কোলটা বয়স্কদের।ইটের রাস্তায় বসে, পা ঝুলিয়ে আছেন মাঠে।একথায় সেকথায় তাঁরাও চন্দ্রতাপে বার্ধক্যকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ফেলে আসা কোজাগরী রাতে।

এ গ্রামের বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো। বলতে গেলে প্রায় সবাই রাত জাগে। ভরা জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে, হুল্লোড়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এটুকুতে সবার ছাড়।কেউ কাউকে বকেও না।এ রাতটার জন্য সমবচ্ছর অপেক্ষা করে তারা।

সন্ধ্যা থেকেই হরিনামের দল, বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায়। দু'পাড়ার দুটো দল।যেমন পুরোহিত নিয়ে কাড়াকাড়ি,তেমনি ঐ গানের দলের। পুরোহিত না পেলে নিজেরাই সেরে নেয়,কিন্তু হরিনামের দল লাগবেই।বলতে গেলে তারা সারারাত গান গেয়ে, সব বাড়ি তাই শেষ করে উঠতে পারে না। কার বাড়ি আগে যাবে? সেই নিয়ে রাগারাগি। তবুও পুজোর উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করে। কি করবে? হরিনামের দল ছাড়া যে পুজো সম্পূর্ণ হয় না।অগত্যায়,অপেক্ষা করতে করতে কারো চোখ ঢুলুঢুলু। 'পুজো দেখব', 'পুজো দেখব' করে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে শেষে। তবে সারারাত খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে তাদের সমবেত ক্লান্ত গানও বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।

রাস্তায় লোকজনেরও কমতি থাকে না। এপাড়া ওপাড়া থেকে কচিকাঁচা তো আছেই, সঙ্গে বউ-ঝি-বুড়িরা। প্রসাদ, নাড়ু তো তারা নিচ্ছেই, সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিলিয়ে দেওয়া বাতাসা-খই-মুড়ি। কারো কোঁচড়ে, কারো বা পুটলিতে।

পীযুষদের বাড়ির পুজো-বাতাসা-খই-মুড়ি বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। লুচি, ছোলার ডাল খেয়ে এসে সে সবেমাত্র মাঠে পা দিচ্ছিল।

অম্লান দৌড়ে এল তার কাছে। হাঁপাচ্ছে।

-ও-দা, যা-যাবে না?

-কোথায় রে?

-সে-সেই, ব-বলেছিলে না !

-অহ! কিন্তু এখন তো অনেক রাত !

-তাতে কি হয়েছে? দিনের আলোর মতো তো দেখা যাচ্ছে সব। চলো…

-হ্যাঁরে, পটকা নেই এখানে? ওকেও নয় ডেকে নে?

-দুর, চলো তো।আর কাউকে জোড়াতে হবে না।

আজ লক্ষ্মীপূজোর বাজার করে ফেরার সময় পীযুষ দেখেছিল ব্যাপারটা। সাইকেল থেকে নেমে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে।

-এ মাঠে শালতি নৌকা? তেলেডোঙা ছাড়া এ বস্তু তো দেখা যায় না! এল কোথা থেকে? মাঠের টলটলে জলে শালতিটা তরতর করে চলছে।

-আরে, ওঠা কে? বারুণকা' না?

ধজি জলের ভেতরে চেপে ধরে নৌকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে।আবার তুলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

তখনই মনটা নেচে ওঠে...

-আজ রাতে যদি ঐ নৌকায় চড়ে সারা মাঠটা ঘোরা যায়? ওহ ,কি যে আনন্দ

হবে! জোৎস্না রাত।ফুরফুরে হাওয়া।জলের ঝিকমিকি !

ওহ,আর সে ভাবতে পারছে না।

-নাহ, আজ রাতে আসতেই হবে। যার নৌকা হোক, আমি চাইলে বরুণকা না করবে না।

পথে অম্লানের সঙ্গে দেখা।তাকেই একথা সে বলেছিল।

-ও দা, নৌকা দেবে তো?

-চল না দেখি।আমি চাইলে হয়তো না করবে না। কিন্তু…

-কিন্তু কি?

-ভরা পূর্ণিমা।তায় আবার এত রাত।

-কার নৌকা জানো?

-না। তবে শুনলাম নাকি রাতে পাহারা দেবার জন্য ওটা ভাড়া করেছে।মাঠে নাকি কারা বেশ কিছুদিন জাল পাতছে। মাছ চুরি হচ্ছে খুব। তাই কাল থেকে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেছে।

-কারা ভাড়া করেছে?

-আরে, ঐ, স্বর্নজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনার যে গ্রূপ আছে না,তারাই।ওরাই তো মাছ চাষ করেছে।

কথা বলতে বলতে তারা এখন এপাড়ায়। বরুণদের উঠোনে।

-এরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে!

-হ্যাঁ।তাই তো।চল… ফিরে যাই।

-একবার নয় ডেকেই দেখো না? যদি…

-বলছিস। কিন্তু… দাঁড়া, একবার ডেকেই দেখি।…কাকা। ও… কা… কোমর সমান মাটির বারান্দা।একটা বিছানা পাতা রয়েছে। মশারিও খাঁটানো।

ভেতরে কেউ একজন শুয়ে আছে মনে হয়।

পীযুষ হতাশ হয়ে পড়ল।

-নারে, সাড়া দিল না।

-আর একবার ডাকোই না।

আশাভঙ্গের ভয়ে পীযুষ অম্লানের কথা রাখল।

-কাকা, ও কাকা… জেগে আছো? কাকা…

মশারির ভেতর থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে এল

-কে পলাশ? আরে, একটু শুতে দে। ক'টা বাজে? এক্ষনি ডাকছিস?

-সবেমাত্র চোখটা জুড়ে এসেছে।এসে হাজির হলি।

ইতস্তত করছে পীযুষ। আমতা আমতা করে উঠল।

-কা-কাকা আ-আমি। পীযুষ।

এবার মশারির বাইরে মুন্ডুটা বেরিয়ে এল।

-এত রাতে? তোমার তো সেই সন্ধেয় আসার…

-না… মানে… আসলে…

-তোমার কাকীমা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল, যদি আসো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়ল।দাঁড়াও।ডাকি?

-না, না। আসলে আমি… নৌকা চড়ব বলে… একটু দেবে?

-দেখো কান্ড!

-দাও না, কাকা… কি বলবে পীযুষকে? মেয়েটা তার কাছে পড়ে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় সে। বেশ মেধাবী। কলেজে পড়ছে। নিজের খরচা নিজেই চালায় টিউশন করে। বাজে নেশাও নেই।গ্রামে একটা সুনাম আছে তার।ব্যবহারও ভালো। অনেকেই তাকে স্নেহ করে। বরুণও তাদের মধ্যে একজন। নিজের পাড়ার ছেলেরা বলেছিল

-আজ রাতে নৌকাটা দিও। একটু ঘুরব।

কিন্তু তাদের ভাব-গতিক ভালো ঠেকেনি বরুণের।মাল-খেয়ে কোথায় আবার বিপদ বাধিয়ে বসবে… তাই তাদের না করে দিয়েছে। কিন্তু পীযুষ তো তাদের থেকে আলাদা। কি যে বলবে? ভাবছে।

-ও কাকা,কি হল? দাও না…

-ঠিক আছে। এই দেখো, চাবিটা আবার কোথায় রাখলুম?

টর্চ জ্বেলে বিছানা হাতড়াচ্ছে।

-কিন্তু আমাদের তো আবার একটু পরেই বেরতে হবে… আচ্ছা… সে নয় দেখব'খন।

চাবিটা নাও। কিন্তু মাঠের মাঝখানে যাবে না। বড় বড় পুকুর। বেশ গভীর। আর ঐ পোতাগুলো ভালো নয়। দূরে থেকো। আর সাবধান, ঘোর পূর্ণিমা কিন্তু। সঙ্গে আমি নয় যেতুম। কে আছে আর? সবেমাত্র শুয়েছি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। একটু না ঘুমলে…

-আমি আর অম্লান। ঠিক আছে,

মনে থাকবে।

চাবিটা হাতে নিল পীযূষ। আহ্লাদে তাদের পা যেন মাটিতে পড়ছে না। এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।

দুটো বাড়ির পরেই মাঠ। শালতিটা শিকল দিয়ে রাস্তার গাছের সঙ্গে বাঁধা। তালা লাগানো।

অম্লান আগেই উঠে গেছে। পীযুষ তালা খুলে শিকল ছুঁড়ে দিল নৌকায়। দু-হাতে নৌকা ঠেলে লাফিয়ে পড়ল তার খোলে।


।। ২ ।।

তিনটে গ্রাম। তাদেরকে জুড়ে আছে তিনটে রাস্তা। রাস্তা জুড়ে গাছ আর গাছ। আর তাদের মাঝে কয়েকশ বিঘে জমি ঘিরে এই বিশাল মাঠ। মাঠে কয়েকটা পুকুর। সুতিখাল। সবটা জুড়েই ফিসারি।

পঞ্চায়েতের সহযোগিতা আছে বলে মালিকদের সঙ্গে কোনো-প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই মাছচাষ। ইনকাম হলে নাকি রাস্তার কাজে লাগাবে। তাই কাউকে একটা পয়সাও দেয়নি। বর্ষায় অনেকেই জাল পেতে মাছ ধরত। সেটাও বন্ধ। তা নিয়ে অনেকের ক্ষোভ। সকলের সন্দেহ লাভের টাকা নাকি ওরাই মেরে দেবে। তাই লোক চুরিচামারী করে, জাল পাতে।

মাঠের কোথাও এক-মানুষ জল। কোথাও বেশি। দু-এক জায়গায় শোলা-চাষ। ধানগাছ নেই বললে চলে। বর্ষায় সব হেজে গেছে। কোথাও কোথাও ঘাস আর ঘাস। বাদ বাকিটায় কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। তবে সারা মাঠের বুকে দুটো উঁচু পোতা, তাল-খেজুর-বাবলাকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মতো জেগে আছে তারা।

আলতো আলতো বাতাস বইছে। তিরতির করে ঢেউ উঠছে। তাদের নৌকা চলেছে তরতরিয়ে। আকাশ-গঙ্গায় যেন দুই অচিন নাবিক পরিক্রমায় বেরিয়েছে। এ জলরাশি, নদীর মতো দরাজ বুকে তাদের যেন কাছে টেনে নিয়েছে। নৌকার এক মাথায় বসে আছে পীযূষ। যেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তার স্বর্গরাজ্যে বিরাজ করছেন। নীরবতায় অবিমিশ্র জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে তার শরীর। অম্লান ধজি চেপে এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে আসছে। প্রত্যেকবার এসে যেন সে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।

-কিরে অম্লান, কেমন লাগছে বললি না তো?

একটু হাঁপিয়ে গেছে সে। তার প্রাণের মাঝে আনন্দের স্রোত বইছে হু হু করে।

-কি বলব দাদা? পারলে যেন সাঁতার দেই। কি যে ভালো লাগছে! রাতে বাড়ি ফিরব না। ও… বরুণকা যা বলে বলুক। সেই সকালে…

-দূর পাগল। রাতে হিম পড়বে।ঠান্ডা লেগে যাবে।

-ও লাগুক গে।

-লাগুক গে? তারপর তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে সঙ্গে আমি ছিলাম।আমাকে ছাড়বে?

-ওসব আমি জানি না।

আজ অম্লানকে দেখে পীযুষের খুব ভালো লাগছে।

এই তো ক'দিন আগেই পীযুষই তাকে সবার সামনে মেরেছিল। আর মারবেই না কেন?

তার লেখা চিঠিটা পড়বে তো পড়বে একেবারে সুরমার বাবার হাতে। মেয়েকে প্রেমপত্র? মেনে নিতে পারে? সোজা চলে এসেছিল পীযুষের পড়ানোর জায়গায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল

পীযুষের। তার আস্কারাতেই অম্লান নাকি এমন করেছে। এখানে সে নাকি গুপ্ত-বৃন্দাবন তৈরি করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে নাকি এসব শেখানো হয়!

সারা গ্রামে কেউ কোনোদিনই তার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। নিজে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।তাও আবার টিউশনি করে। ঠিকমতো মাইনেও দেয় না অনেকেই। তবুও সে কোনোদিন তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। অথচ এই লোকটা একঘর ছেলেমেয়ের সামনে তাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিচ্ছে? অপমান করছে?

ডাকিয়ে এনেছিল অম্লানের বাবা-মাকে। তাদের ছেলে এমন করতে পারে সে কথা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।কিন্তু সুরমার বাবা তোড়পে যাচ্ছে সমানে।

অম্লানও কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না।

প্রথম থেকেই না না করছে। কিন্তু সুরমা? বাবার ভয়ে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সবার সামনে বলেই ফেলল

-হ্যাঁ, ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

অম্লান মরিয়া হয়ে ওঠে

-এ-এই মি-মিথ্যে কথা একদম বলবি না।

সুরমার পাশেই ছিল পুটু। সে ফুঁসে উঠল।

-মিথ্যে কথা না? ঠিক আছে,এসব বাদ দে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুই ওর গায়ে হাত দেসনি? কিরে বল, এটাও মিথ্যে?

মাথা আর ঠিক রাখতে পারল না পীযুষ। ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল অম্লানকে।

-এসব শেখাই এখানে? কিরে? বল? তোর জন্য আমি অপমানিত হব? এতজনের সামনে আমাকে… ছিঃ ছিঃ…

কাল থেকে আর তুই পড়তে আসবি না। বের হ। দূর হয়ে যা…

অম্লানের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অম্লানের মা কেঁদে উঠল।

-আর কত জ্বালাবি? তোর জন্য কারো কাছে কি মুখ দেখাতে পারব না? মর না, মর। মরলে তো আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগে।

-ওহ, তুমি আর গোল পাকিও না। থামো দেখি।

বলতে বলতে অম্লানের বাবা,এগিয়ে গেল সুরমার বাবার কাছে। তার হাত দুটো ধরে বলল

-দাদা, ছেলে মানুষের কাজ। মাপ করে দিও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, ও আর এমন করবে না। সব ভুলে যাও, দাদা। পাঁচ-কান হলে আরো খারাপ হবে… সুরমা, মা রে, মন খারাপ করিস না।পীযুষ, এখন আসি বাবা, পরে কথা বলব।

সপ্তাখানেক পরে অম্লানের বাবা-মা পীযুষের হাতে ধরে বলেছিল

-বাবা, ওকে একবার ক্ষমা করে দিতে পারো না? স্কুলেও যাচ্ছে না। ঘর বন্ধ করে থাকে। ঠিক মতো খায় না। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে যদি যেতে....

-ঠিক আছে কাকিমা, আমি যাবো। এতজনের মাঝে ওকে মেরেছি তো, তাই হয়তো ও খুব কষ্ট পেয়েছে।

অম্লান আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। পীযুষ তার সেই দগ্ধ ঘায়ে অল্প অল্প করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে থাকল। সেও পীযুষের আরো কাছের হয়ে উঠল।

এখন দেখলে তা আর মনে হবে না যে, সে ক'দিন আগেই এমন একটা কাজ করেছিল।


।। ৩ ।।

জামা স্যাঁতস্যাঁত করছে। চুল ভিজে ভিজে ভাব। হিম ঝরছে। জোলো হাওয়া বইছে ফুরফুর করে। পীযুষের শীত শীত করছে।

-অম্লান, এবার চল ফিরি। ওরা তো আবার পাহারা দিতে বের হবে। চল।

-আর একটু থাকি না দাদা?

-না, চল অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার তুই বস। তখন থেকে তো বাইছিস। আমি চালাই।

-তুমি চালাবে? পারবে?

-ধজিটা তো দে.....

-হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও। সোজা ঐ পোতায় নিয়ে গিয়ে তোলো। তারপর সেই পুস্কর গুনীনের মতো ভুতে আমাদের আটকে রাখুক সারারাত।

-মন্দ হবে না। কি বলিস?

অন্য গ্রাম ঘেঁষেই চলছিল তারা। পুকুর পাড়ের মাচা মাঠের উপর ঝুলছে, জল ছুঁই ছুঁই ভাব। অম্লান কিছু একটা ধরে টান দিল।

-আরে কি ছিঁড়ছিস? চারদিকে জল। মাচায় কি কোথায় উঠে থাকবে কে জানে?

-ওহ, কত বড় শসা! খাবে?

-না, চল। লোকে খারাপ বলবে।এমন করে?

-তথাস্তু বৎস।

-পাকামি করছিস। ওদিকে বরুণকা'রা হয়তো অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ রে সোজা যাব?

অম্লানের মতের অপেক্ষা না করে সোজা বাইতে শুরু করল। পীযুষের অপটু হাতে শালতি এঁকে বেঁকে চলছে। চাইছে সোজা নিয়ে যেতে, কিন্তু বেঁকে যাচ্ছে অন্যদিকে।

অম্লান নৌকার মাথায় ছোট্ট বেদির মতো চৌকোয়, উল্টোমুখ করে বসে, পা ঝুলিয়ে দিয়েছে জলের উপর। পীযুষ নাজেহাল হচ্ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে আছে নিজের ঘোরে।

অনেকখানি এগিয়ে এসেছে তারা। মাঝমাঠ। পীযুষ অনন্তর পোতা এড়িয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু নৌকা যেন সেই দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় করছে তার। পোতার লম্বা লম্বা তালগাছগুলো যেন কোন মায়াবলে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর শীত শীত করছে না। পোতার একদম কাছেই এসে পড়েছে।

ধজিটা জোরে চাপল পীযুষ।

-একি! থৈ পেল না কেন? পুকুরে পড়লাম নাতো ?

টান পড়ল ধজিতে। টানার চেষ্টা করছে সে।

-জালে আটকায়নি তো? বোধহয় পুকুরের মুখেই জাল পেতেছিল। একি! ধজিটা নৌকার তলায় ঢুকে যাচ্ছে যে!

প্রাণপনে টানছে সে। জোরে টানতে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে।

-অ-অম্লান, আ-আমরা মনে হয় পুকুরে পড়েছি। ধজিটা জালে আটকেছে মনে

হচ্ছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

পোতার কাছে বড়ো পুকুরের উপর তারা ভাসছে। নৌকা দুলতে দুলতে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে পুকুরের ভেতরে। পীযুষ ঝুঁকে পড়ে ধজিটা টানার চেষ্টা করছে সমানে।

-কই রে? দেখ…

অম্লান এগিয়ে এল পীযুষের কাছ। ধাক্কা মারল সজোরে। ঝপাস করে জলে পড়ল পীযুষ। কেঁপে উঠল পুকুরের জল।

-সবার সামনে আর মারবি আমাকে? বল? সুরমার সামনে তুই চড় মেরেছিলি?

পীযুষ ভুস করে ঠেলে উঠল জলের উপর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাচ্ছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে।

-এ-এ-এটা কি ক-ক-করলি তু-ই?

সাঁতরে কাছে আসছে সে। অম্লান রাগে ফুঁসছে। হাতে শিকলটা তুলে নিয়ে পাক দিচ্ছে শূন্যে।

তার মূর্তি দেখে পীযুষ শিউরে উঠছে। সাঁতার ভুলে যাচ্ছে সে। তার উপর এই গভীর পুকুর, পোতা, সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা-রাত তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।

নৌকার কাছে এল পীযুষ। লোহার শিকলটা সপাট করে আড়ছে পড়ল তার মাথায়।

-আ-আ-আ…

ডুবে গেল পীযুষ।

-তোর জন্য স্কুলে সবাই টিটকারী করেছিল। সেই থেকে স্কুলে ঢুকতে পারিনা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাড়ার লোকও আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সব, সব তোর জন্য। মর তুই মর…

-অম্লা…

লোহার শিকলের আঘাতে মাথা ঘুরছে পীযূষের। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে…

অম্লানের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল জোলো মাঠে।

শূন্যে ঘোরানো শিকল আসতে আসতে গতি হারিয়ে নেমে এল তার কাছে। দরদর করে ঘামছে সে।

অপেক্ষা করছে জলের দিকে তাকিয়ে।

নৌকা এখন পুকুরের মাঝখানে ভেসে আছে স্থির হয়ে।

জলের তোলপাড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

অম্লান জেগে বসে রইল সেখানে।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in



















মনে হয় একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। কী হবে কেউ জানে না। সবাই ভাবছে কিনা তাও জানে না সৃজনী। কিন্ত তার নিজের মনে হচ্ছে কিছু একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আছে। দূরে একটা ট্রেন, তাও যেন কেমন মন খারাপ করে একা হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়চ্ছে না। ঢিমে তাল। দুর্দিনটা কীভাবে আসবে এটা নিয়েও ভাবে সৃজনী। ভূমিকম্প রূপে, প্রলয় রূপে, তীব্র ঝড় ঝঞ্ঝা হয়ে? নাকি অন্যকিছু? কিছুই ভেবে উঠতে পারে না সে, কিন্তু একটা দুর্দিন যে আসবে সেটা সে বোঝে। কারণ আর তাদের বাড়ির উত্তর পুর্ব কোণের ছাদে বসে একটা কাক এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে ওটা নাকি খুব খারাপ ব্যাপার! জ্যোতিষ না বললেও, সৃজনীর মনে মনে যেন কিছু একটার আভাস পাচ্ছে। আজ ভোরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দেখল একটা শকুন মনমরা হয়ে দূরের একটা বাড়ির ছাদ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও কোনো খাবার মেলেনি হয়তো। দুদিন আগেও দেখল সুইমিং পুলের জলে ভোরের চাঁদটা খুব কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল সৃজনী জানে না। এই নয় যে, বাইরে খুব জোরে বাতাস বইছিল। বাতাসও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের পূর্বে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, এটা সি স্তব্ধতা কী কে জানে। সবই কেমন যেন একটা ভাসা ভাসা, অনিশ্চিত ব্যাপার। তবুও একটা দুর্দিন যে ঘনিয়ে আসছে সেটা সে খুবই বুঝতে পারছে। দিনদিন রোদ খুব চড়া হচ্ছে। বারান্দার গাছগুলোয় নিয়মিত জল দিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। কাগজফুল, অর্কিড আর দু একটা নাম না জানা ফুল তার টবে আছে। সে খুব বেশি গাছ চাষও করেনি, আর গাছেদের নামও বিশেষ জানে না। এরমধ্যে স্নেক প্ল্যান্টটা পুরোই মরে গেল। গোড়া উপড়ে ফেলে দিতে হয়েছে গাছটা টব থেকে। আর একটা পাতাবাহার, রোজই প্রায় পাতা ত্যাগ করে খোলস ত্যাগের মতো। দুদিন ছাড়াই দেখা যায় গাছটার গোড়ার দিক থেকে একটা করে পাতা ব্রাউন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে, অভিমানে না লজ্জায় বোঝা মুশকিল মাথা নত করেই থাকে। গোড়া থেকে সেই পাতাটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সৃজনী। জানলার ধারে দাঁড়িয়েও সে দেখে দূরের ঘাস, শহরের গাছ, অন্যান্য বাড়ির ছাদের ফুল সব কেমন শুকিয়ে যেন একটা জেহাদ ঘোষণা করছে। কিসের জেহাদ কে জানে। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সৃজনী ওই একই জিনিস দেখতে পায়। সবাই যেন প্রতিবাদ করতে করতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে টাইপের অবস্থা। তবুও কোথাও কি খুশির খবর নেই? আছে তো। আজ মৌমিতা দৌড়ে এসে বলল, সে টিমের ওনার। সে একটা টিম কিনেছে। তাদের কমপ্লেক্সে। হ্যাঁ, একেবারেই আই পি এলের মতো ব্যাপার আর কী। একেবারেই খেলা খেলা ব্যাপার। কারণ খেলোয়াড়রা টাকা পায় না। কিন্তু সব নিয়ম কানুনই হয় ওই আই পি এলের নিয়ম মেনে। এখানেও অকশন বিড হয়, টিম ওনার থাকেন, খেলোয়াড় কেনা হয়, টাকা না পেলেও। একটা মিছিমিছি দাম হাঁকা টাইপের, কিন্তু টিম ওনাররা নাকি টাকা পায় শোনা গেছে। পিচ তৈরি করে, রাতে মাঠে আলো-টালো দিয়েই খেলা হয়। একেবারে ইলাহি ব্যাপার। মৌমিতা দৌড়ে এসে সৃজনীকে বলল,

হাই! হ্যালো! কেমন আছো? গুডমর্নিং

গুডমর্নিং, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?

ভালো আছি। জানোতো আমি একটা টিম ওনার। কিন্তু সবাই কেমন আমার পিছনে লাগছে। বলছে আমার টিম নাকি হারবে।

ও তাই নাকি? তুমি টিম ওনার? দারুণ ব্যাপার তো। না না জিতবে তোমার টিম চিন্তা কোরো না

সৃজনী মৌমিতার আহ্লাদি আহ্লাদি গলা থামিয়ে দিয়ে তাকে জেতার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। সৃজনীর মনে হল, মৌমিতা নিজেকে কেমন যে নীতা আম্বানি নীতা আম্বানী ভাবতে শুরু করেছে। খুশিতে টগবগ করছে। খুব এন্থুজিয়াসটিক মহিলা, তাকে দেখলেই বোঝা যায়। কোনো একটা ছুতো নাতা পেলেই সে হইহই করতে ভালোবাসে। খুব মজা করে, ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে এনজয় করে সব ব্যাপার। সৃজনীর দেখে মনে হয়, বাঃ এই তো বেশ ভালো ব্যাপার। কোথাও তো খুশি বেঁচে আছে। তার চারপাশের মানুষজন কেমন আনন্দে আছে। এসব দেখতেও বেশ ভালো লাগে। তবুও তার মধ্যেই তার মনে হয় একটা দুর্দিন এগিয়ে আসছে। কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর সে শুনতে পায়। কোথাও কি তাল কেটে গেছে? নাকি একতারার তারটাই ছিঁড়ে গেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সৃজনী। তাহলে কি আর বাউল গান হবে না? আর কি শান্তিকেতন যাবে না সে? ট্রেনে উঠে কত বাউল শুনেছে সে। এ সুরেও তো মন উদাস হয়েই থাকে। এও তো বিষাদ। বিষাদ সুর শুনে আনন্দ কিংবা সুখ হতে পারে কিন্তু খুশি বা উত্তেজনা কি হবে? উন্মাদনা? বাউলরা তো উন্মাদই। বায়ু রোগ। কে জানে। সৃজনীর ফোন বেজে ওঠে। দূরের গ্রাম থেকে আসা এক খবর। একশো কিলোমিটার দূরে এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সেখানে দিঘির শীতল জল আছে। জলের বুকে হাঁস খেলে বেড়ায়। দূরভাষ বেজে ওঠে। দূরভাষের কাজই তাই। দূর থেকে ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া। সৃজনীর ভাই জানতে চাইল,

কি রে তুই কী কিছু পার্সেল পাঠিয়েছিস?

হ্যাঁ, গেছে ওটা?

হ্যাঁ, এসেছে তো। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, যার জিনিস সে ঠিক বুঝেছে। সে ওটা পেয়ে খুব খুশি। নিয়ে পুরোনো বাড়িতে চলে গেছে। দিদিদের দেখাতে। সে তো আনন্দে লাফাচ্ছে।

যাক ওটা যে পৌঁছেছে সেটাই দেখার ছিল। ওটা একটা পরীক্ষামূলক পাঠানো গিফট। এখন ওখানে অনলাইন জিনিস পাঠানো যায় কিনা সেটাই দেখার ছিল। যাক তাহলে এবার চাইলে এটা সেটা পাঠাতে পারি।

হ্যাঁ, পারিস তো। সব আসে এখন।

বলে আরও একটা কুশলাদির খবর নিয়ে সৃজনী ফোন রেখে দিল। ভাবল, এই তো খুশি আনন্দ এসব কিছু নেই সে ভাবছে কেন? দিব্যি আছে। খুঁজে নিলেই হয়। সৃজনীর একটা ছোট্ট ভাইজি আছে পাঁচ বছরের, সে লিপস্টিক পাগল মেয়ে। সৃজনীকে দেখলেই বলে, ‘পিসিমনি লিপস্টিক কিনে দেবে। তুমি এবার যখন আসবে লিপস্টিক নিয়ে আসবে আমার জন্যে’। ছোট্ট ভাইঝির আবদার মেটাতে সে এই অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়। সব সময় অতদূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। গিয়ে ফেরাটা একটু পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সময় সুযোগ বুঝে যেতে হয়। কিন্তু মন তো খচখচ করে ভাইঝির আবদারে। তাই সে অনলাইনেই পাঠিয়ে দেয়। এভাবে দূর থেকেই একটু তার আবদার ছুঁয়ে নেওয়া। একশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। সেখানেও আজ সব জিনিস অনলাইন পৌঁছে যায়। সব সংস্থা থেকেই। কলকাতা বা কলকাতার কাছে হতে হবে এমনটা আর নয়। চোখের সামনে সব দ্রুত কেমন বদলে যাচ্ছে। দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। একটা একটা দৃশ্য, তার আয়ু খুব ক্ষীণ। যেন আর বেশিদিন করে টিকতে চায় না, রচিত হয়েই শেষ হয়ে যেতে চায়। গ্রাম শহর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে দেশ বিদেশ হয়েছে। গোটা পৃথিবী এখন গোটা গ্রাম। সত্যিই তো আর তো কোনো তফাৎ নেই। সব কেমন কাছের হয়ে গেছে। কেবল কাছের হচ্ছে না, একজন মানুষের কাছে আর একজন মানুষ। বা কাছের মানুষ বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তারা, সব দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এত দূরে সরে গিয়ে সব যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। তবুও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সৃজনীর সেই এক আশঙ্কা কিছু যেন একটা দুর্দিন আসতে চলেছে। সেই দুর্দিনে কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি। কিন্তু এ দুটোর মাঝে কি আর কোনো দুর্দিন হতে পারে? যদি হয়, তাহলে সেটাই বা কী? সৃজনী নিজেও জানে না, কিন্তু সে খুব ভালোমতো বুঝতে পারছে একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে, কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘের মতোই। রাস্তা খুব প্যাচপেচে। কদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি হল। সে একটু ভিজেও গেছে বেরিয়ে। শোনা যাচ্ছে আরও বড়ো কোনো আশঙ্কার কথা, কারণ সরকার থেকে অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি হয়েছে। এর মধ্যেই সৃজনী তার পরিচিত মানুষদের থেকে মেসেজ পেতে থাকল,

কি রে তোদের ওখানে ভূমিকম্প টের পেলি? খবরে তো দেখাচ্ছে ওদিকের সব সিলিং ফ্যান দুলতে দেখা গেছে…

না, কোনোরকম কম্পনের টের পাইনি। আজকাল ফেসবুক না খুললে বুঝি না যে, ভূমিকম্প হয়েছে।

সে কি? পাসনি?

না, ভূমিকম্প কেবল সোস্যাল মিডিয়ায় হয়। ছোটোবেলার মতো আর শাঁখ বাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় না বা কিছুবছর আগে পর্যন্ত যে, কলকাতার হাইরাজগুলো থেকে সব ভয়ে নেমে এসে গেট টুগেদার হত সেসবও হয়। এখন মানুষের অভ্যেস হয়ে গেছে আফটার শকের আর ভয় পায় না…

ভূমিকম্প ঘিরে সৃজনীর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সবার আগে মনে পড়ল তার প্রতিবেশী সোমালিদির কথা। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামা তো দূরের কথা। ঘর থেকে বেরিয়ে লবিতে বসে বসে কান্না আর কাঁপ। সৃজনী একটুও ভয় না পেয়ে, তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই সে ফেসবুক, টিভি সবই অন করল। চোখ কপালে তুলে সৃজনী কেবল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। দেশলাই বাস্কের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়া, ধসে পড়া ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার শুনতে লাগল। থাইল্যান্ডের রজধানী ব্যাঙ্কককের একটা নির্মীয়মান হাইরাইজ চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও সে দেখতে পাচ্ছে… এরপর মৃত্যু নিয়ে আর ভাবার কী আছে তার। মায়ানমারে এমন দুর্দিন মানুষ টের পাচ্ছে, তার প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বকলকাতা দিল্লিও তার সামান্য আঁচ পেয়েছে। যা সৃজনী পায়নি। কিন্তু সৃজনী আরও কোনো বড়ো দুর্দিন আসার সঙ্কেত যেন ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন রূপে তা আসবে সেটার সে আজও টের পায়নি। কিন্তু লোকজন বলাবলি, ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে কলকাতা নিয়ে। কলকাতায় এখন অনেক আকাশছোঁয়া বিল্ডিং। সেগুলোও দেশলাই বাক্স হবে কিনা এ বিষয়টা এখন মানুষের বৈঠকি আড্ডার ঢুকে পড়েছে।

সৃজনীর মতো কেউই জানে না সে দুর্দিন কীভাবে আসছে। কিন্তু আসছে। প্রকৃতি নটরাজ হলে কারোর কোনো রেহাই নেই। জীবন এখন গলা পর্যন্ত দুর্দিনে ডুবে থেকেও আরও বড়ো কোনো দুর্দিনের অপেক্ষায়।

কিন্তু কতটা বড়ো কেউ জানে না। সৃজনী কেবল টের পায় একটা দুর্দিন আসছে অবিলম্বে।

এরমধ্যেও তার সেই ছোট্ট ভাইঝি এতটাই খুশি যে, সে রোজ লিপস্টিকের বাক্সটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে যায়। এর থেকে বড়ো শান্তি সৃজনীর কাছে আর কিছু নেই। টিভি বন্ধ করে দেয়।
0

গল্প - দোলা সেন

Posted in



















[১]

“ ও মণিদি, কেমন হয়েছে বলো তো কার্ডটা?”

“এতক্ষণ ধরে একটা কার্ড বানালি? আমারটা দেখ, কি সুন্দর একটা পাখি বানিয়েছি। মিতু, তুই কিছু বানাচ্ছিস না যে!” তিন্নি মুখ না তুলেই বলে উঠল। সে তখন পাখির চোখে পুঁতি বসাতে ব্যস্ত।

“ধ্যেৎ। এগুলো কোনো উপহার হলো? আমি বাপিকে বলব নিউ মার্কেট থেকে একটা খুব সুন্দর গিফ্ট কিনে আনতে”।

মিতু বরাবরই একটু নাক উঁচু। ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। হর হপ্তা কলকাতা যায়।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে দেখে, মণিদি হাল ধরতে এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ ধরে একটা ফুলসমেত ফুলদানি বানানোর কাজে মেতে ছিল। ওর হাতের কাজ অসাধারণ। সামনে টিচার্স ডে। এই হোস্টেলের মেয়েদের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা টিচার্স ডের উপহার আর রাখি কখনো দোকান থেকে কেনে না। ওদের হাতের কাজ বড়দের তত্ত্বাবধানে বরাবরই খুব সুন্দর হয়। যেমন এই ঘরে পাঁচজন তাদের মণিদির কাছে বসে নানারকম জিনিস তৈরি করছিল।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা দেখে মায়া হলো মণিদির। সে হাল ধরল এবার।

‘আসলে কী জানিস, উপহারের আসল দাম তার আন্তরিকতায়। সবসময়েই যে সেটা জিনিসই হতে হবে তার মানে নেই। খুব অন্যরকমভাবেও দেওয়া যায় সেটা”।

দিয়া হালে পানি পেল যেন। খুব উৎসাহভরে বলল – “মণিদিদি, আমি না একটা বিদেশী গল্পে পড়েছিলাম দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে তাদের মিসকে ভালোবেসে রক গার্ডেন বানিয়ে দিচ্ছিল। একটা দ্বীপ থেকে পাথর আনার সময় নৌকোডুবি হয়ে...”

দিয়ার গলাটা ভারি হযে এল। মণিদিদি সস্নেহে ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলল – “বিদেশ যেতে হবে কেন রে? এই আমাদের দেশেই...”

গল্পের গন্ধ পেয়ে সক্কলে হাতের কাজ ফেলে মণিদিদির চারপাশে গোল হয়ে বসে – “বলো, বলো”।

মণিদি একটু হেসেই ফেলল – “এটা শুনতে গেলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হবে কিন্তু”।

রিঙ্কু রঙমাখা হাতটা মনের ভুলে মাথায় বুলিয়ে ফেলে বলে – “তা হোক। তুমি বলো”।

অগত্যা ফুলদানিটা টেবিলের ওপর যত্ন করে সরিয়ে রাখে মণিদি। তারপর হাতটা মুছে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেল

“ বেশ কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলি? ১৯৪৬ এর শেষের দিকে। সে এক অস্থির সময়...”

‘অস্থির কেন?” – দিয়া চুপ থাকতে পারে না মোটেই।

মণিদি তিন্নির দিকে ঘুরল – “এর উত্তর তুই দিতে পারবি?”

তিন্নি আঙুল গোনে – “সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতা। তার আগে উমম্... ছেচল্লিশের দাঙ্গা?”

“একদম ঠিক। যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সিংহের আধিপত্য সারা বিশ্বেই অস্তমিত হবার মুখে। ভারতও তার থেকে বাদ নয়। কিন্তু কে চালাবে সেই সদ্য স্বাধীন দেশ? কিভাবে রক্ষা করা যাবে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য?

যতই গান লেখা হোক – বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান _ নানা জাতি, নানা মতের মিলনে সে মহাসাগরে সেতু বাঁধা সহজ কাজ নয়। নানা স্বার্থের সংঘাতে জ্বলে উঠল ভারত। উজ্জ্বল শিখায় নয়, প্রবল জাতিগত দাঙ্গায়। সেই কালো দিনের অবসান ঘটাতে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ভাগ হোক ধর্মের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষও নেতাদের মতোই বিশ্বাস করল – “স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি”। ইংরেজ ভারত ছাড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে – সূর্যোদয়ের পর যেভাবে রাতের অন্ধকার নিমেষে দূর হয়”।

মিতু চিন্তিতভাবে বলল – “তবে যে বাবা বলে, শাসক বদলালেই উন্নতি হয় না? মানুষদের ভাবনা বদলাতে হয় আগে?”

মণিদি সোজা হয়ে বসল – “কাকু একদম ঠিক বলেছেন রে। তাহলে শোন - ঠিক সেই সময়ে, এই অস্থির চিত্রপট থেকে অনেক দূরে কয়েকজন মানুষ অন্যরকম ভাবছিলেন। তাঁদেরও মনে হয়েছিল, মানুষের মনে যদি চেতনার আলো, শিক্ষার দ্যুতি না পৌঁছানো যায়, তাহলে স্বাধীনতা কথাটির অর্থ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। যেমন মনে হওয়া, তেমনি কাজ। তৈরি হলো ‘সেবা সংঘ’। বিভিন্ন অনগ্রসর এলাকায় তাঁরা স্কুল তৈরির কাজে লেগে পড়লেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কাজটা সহজ নয় মোটেই। এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে শিক্ষিত করে তোলার পথে প্রধান বাধা দ্বিমুখী। এক - বিদায়ী ইংরেজ শাসক, দুই – স্থানীয় ভূস্বামী বা রাজা”।

রিঙ্কু অস্থির হয়ে উঠল – “কেন মণিদি? ইংরেজ কেন? আমাদের আধুনিক শিক্ষায় ওদের অবদান তো কম নয়! বেথুন সাহেবের কথাই ধরো, কিম্বা হ্যালহেড বা উইলিয়াম কেরি...। মেয়েদের স্কুল, বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে এঁদের অবদান তো আমরা ইতিহাসেই পড়েছি। তাহলে ছেচল্লিশে হঠাৎ তারা শিক্ষবিরোধী হয়ে উঠল কেন গো?”

মণিদি বলল – “তোরা একটা শব্দ বোধহয় খেয়াল করিসনি। সেবা সংঘ কাজ করছিল অনগ্রসর এলাকায়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য। যেখান থেকে ইংরেজ শাসকের, ভূস্বামীদের সেবা মেলে। মজুর, চাষী, জেলে...। এরা শিক্ষিত হলে - সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে চিনলে - নিঃশব্দে রোজের বেগার খাটবে কে?”

দিয়া বিরক্ত হচ্ছিল – “ গল্পের মাঝখানে নিজেদের জ্ঞান জাহির না করলেই নয়? মণিদি গল্প বলো”।

মণিদি হেসে ফেলে শুরু করল – “আসলে পটভূমিটা না জানা থাকলে, এ গল্পের কোনো মানে থাকে না রে। যাই হোক শোন –

রাজস্থানের দক্ষিণ পশ্চিমে ডুংগারপুর রাজ্য। সেখানকার রাজা – মহারাওয়াল লক্ষণসিংহ। যে সে রাজা নন, রাজ্যে তাঁকে সম্মান জানানোর জ্ন্য পনেরখানা গান স্যালুটে হয়। সে এক বিশেষ সম্মান। খোদ ইংল্যান্ডের মহারানী সে অনুমতি দিয়েছেন! তা স্কুল করার জন্যে, সেই রাজ্যের ভীল অধ্যুষিত গ্রাম রাস্তাপালকে বেছে নিয়েছিলেন সেবা সংঘের কিছু নিবেদিত কর্মী।

প্রস্তাব শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মহারাওয়াল। বুনো ভীলের দল চিরটাকাল মুখ বুজে রাজপুতদের সেবা করে এসেছে। রাজার চাবুককে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছে ঈশ্বরের প্রসাদের মতো। যে সব সরল চোখে, ঈশ্বর আর মহারাওয়াল সমার্থক ছিল, সেই চোখ ফোটাতে চায় ওই উটকো আপদগুলো? তারপর কি আর ওরা আগের মতো মান্য করবে মহারাওয়ালকে?

না না, এসব কিছুতেই চলতে পারে না। অতএব তিনি ফতোয়া জারি করলেন – এ রাজ্যেতে নাহি রবে শিক্ষা সদাচার... হাঃ হাঃ হাঃ।

থামানো গেল না কিন্তু! রাজা জমি না দিলে কী হবে, এগিয়ে এলেন নানাভাই কণ্ঠ নামের এক মহাপ্রাণ। নিজের বাড়ি তিনি খুলে দিলেন স্কুলের জন্য। শিক্ষকেরও অভাব হলো না, জানিস? এগিয়ে এলেন সেঙ্গাভাই। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – রাজদণ্ডের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও জুটে গেল!”

তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল – “তারপর? ওরা পড়তে পারল?”

মণিদি বোধহয় শুনতে পেল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত ক্লাসরুম।

[২]

ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ক’ লিখতেই...

“ক সে কলম” – নানা স্বরের ঐকতানে ক্লাসরুমটা গমগম করে ওঠে। নানান বয়েসের মানুষের ভিড় সেখানে। খস খস... পেনসিলের প্রবল ঘষায় খাতা যায় যায়। তবু ক লিখতে পারার আনন্দে কালো মুখগুলি বড় উজ্জ্বল। আর সেই আলোয় উদ্ভাসিত সেঙ্গাভাইয়ের মুখ। শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছেন তিনি –

“ইয়ে কলম সামহালকে রখনা। ইসকে তাকত..

জানো তো, এই কলমের জোর রাজার দণ্ড, পুলিশের ডাণ্ডার চেয়েও শক্তিশালী। মনে রেখ, শিক্ষাই শক্তির উৎস। যেদিন নিজেদের চিনতে শিখবে, সেদিন তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহারাওয়ালও নয়”।

“রাম, রাম। এইসা মত বোলিয়ে” – বর্ষীয়ান ছাত্রটির মুখে চোখে ভয় – মহারাওয়াল যে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ!

“রাজাকে খিলাফ কুছ শুননা ভী পাপ হ্যায়।”

সেঙ্গাভাইয়ের চোখদুটো একবার জ্বলে উঠেই শান্ত হয়ে যায়। শুধু এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যেই, এই দুর্মর শক্তিশালী ভীলজাতি যুগ যুগ ধরে রাজপুত শাসকের অত্যাচার সয়ে আসছে নির্বিবাদে। আজও ডুংগারপুরের ভীলেরা চরমভাবে নির্যাতিত।

স্বাধীনতা দরজায় কড়া নাড়ছে – মাসকয়েকের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। একথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ যদি স্বাধীনতার অর্থই না বোঝে, তাহলে তাদের অধীনতার শিকল কখনো ঘুচবে না। শিকলের মালিকানার হাতবদল ঘটবে শুধু। তাই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনার যেটি প্রথম ধাপ। এই রাস্তাপাল গ্রামে সেবা সংঘের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার কারণ এটাই।

সেঙ্গাভাই বলছিলেন –

“আজ পড়া থাক। একটা গল্প শোন বরং।

এই বনে, পাহাড়ে একসময় শুধু ভীলেরা থাকত। তাদের ছিল – বনের শিকার, খেতির ফসল, চাঁদের আলোয় ঢোলথালের দ্রিমি দ্রিমি, কৌড়ির সুরে ছেলেমেয়েদের নাচ।

প্রায় পাঁচশ বছর আগে গিহ্লোট বংশের এক নির্বাসিত রাজকুমার, তার কিছু অনুচরকে নিয়ে, ভীলরাজা ডুংগারিয়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর একসময় সেই বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে, সে নিজেই রাজা হয়ে বসল। সেই ডুংগারিয়ার নাম থেকেই তোমাদের এই রাজ্য - ডুংগারপুর!’

বছর বারোর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায় এইবার – ‘এই গিহ্লোট বংশের রাজা নাগাদিত্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ভীলবিদ্রোহ হয়েছিল না? পুরো রাজবংশ ভীলেদের রোষে ছারখার হয়েছিল। উয়োলোগ দেওতা নেহি হ্যায় বাপু। ইনসান হ্যায়। অগর গলতি করে তো...’

সেঙ্গাভাই সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন। আগে বলা কাহিনি ঠিক মনে রেখেছে কালিবাঈ। বড় তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই মেয়েটি।

চাষী বাপমায়ের মেয়ে। তার বাবার বড় শখ মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেঙ্গাভাইধের কাছে আসা দিদিমণিদের মতো। এমন অপমানিত দাসের জীবন হবে না তার।

পড়া এগিয়ে চলছিল – নতুন করে নিজেদের চিনতে শিখছিল সরল মানুষগুলো। ক সে কলম থেকে শুরু করে ইতিহাস, ভূগোল, যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর হয়ে আসা অত্যাচারের আর তার প্রতিবাদের গল্প...


[৩]

মণিদি বলে চলছিল এক ঘোরের মধ্যে –

“ঠিক এখান থেকেই বিপদের আঁচ পাচ্ছিলেন মহারাওয়াল। স্বাধীনতার সঙ্গে সিংহাসনের মতো ভীলদের নিঃশর্ত আনুগত্যও যদি হারাতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিপত্তিরও অবসান ঘটবে! এই জন্যেই পাঠশালা স্থাপনায় এত আপত্তি ছিল ডুঙ্গারপুরের অধিপতি মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংহের। তবু কী অসীম দুঃসাহস ওই নানাভাই কণ্ঠের! সে নিজের বাড়ি পাঠশালার জন্য দান করেছে! এর একটা ব্যবস্থা...”

দিয়ার গলা ভারি হয়ে উঠেছে উৎকণ্ঠায় – “ওদের উপর খুব অত্যাচার করল ওই মহারাওয়াল?”

মণিদি কেমন যেন হাসল – “মহারাওয়াল ভয় পেয়েছিলেন, বুঝলি। আসলে রাজপুত আর কজন? ওঁর সব সৈন্য বা রক্ষকদের বেশিরভাগই তো ভীল। তাদের বাড়ির অনেকেই যাচ্ছে ওই স্কুলে। কে জানে কী শিখে আসছে সেখান থেকে! তাদের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না তিনি। যদি তারা ঘুরে দাঁড়ায়? না না, এত বড় ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং খবর পাঠালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ইংরেজ তখন জানে এবার তাদের ছেড়ে যেতে হবে এই আরাম আয়েশ আর দৌলত। তারাও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভ উগরে দেবার এই সুযোগটা তারা ছাড়ল না।

তারিখ ছিল - ১৯৪৭ এর ১৯শে জুন। পুলিসবাহিনী এলো পাঠশালা বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ালেন নানাভাই আর সেঙ্গাভাই। পুলিশ এটাই চাইছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর বীরত্ব দেখাবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নির্বিচার লাঠি চলল। নানাভাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। সেঙ্গাভাই মারের চোটে জ্ঞান হারালেন। গ্রামের লোককে ভালোমতো শিক্ষা দিতে সেঙ্গাভাইয়ের আহত অচেতন দেহকে গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল তারা। গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ব্রিটিশের পুলিস। আর ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় পাথর হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল সারা গ্রামের মানুষজন। রাওয়ালের বিরুদ্ধে, পুলিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই যে এই অসহায় মানুষগুলির যুগ যুগ বাহিত রক্তের শিক্ষা! তারা অঝোরে কাঁদছিল, যেমন করে কেঁদে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

সেই সময়, তখন মাঠে কাজ করছিল কালিবাঈ। গোলমাল শুনে কাস্তে হাতেই দৌড়ে এসেছিল। তার গুরুকে ওরা...

‘বাপজিইইই’ – আর্ত চিৎকার করে কাস্তে হাতেই প্রাণপণে দৌড়াল কালিবাঈ। অন্ধ আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল পুরুষানুক্রমে বাহিত সংস্কার। পুলিস মজা দেখার জন্য গাড়ি থামাতেই, মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দড়ি কেটে ফেলল এক কোপে। তাই দেখে চটক ভাঙল অন্য মেয়েদেরও। তার দল বেঁধে এগিয়ে এল সেঙ্গাভাইয়ের পরিচর্যায়। কালিবাঈ জল আনছিল মুখে দেবার জন্যে।

এত সাহস, পুলিসের কাজে, মজা দেখানোয় বাধা? ক্ষিপ্ত পুলিস গুলি চালাল। রক্তে স্নান করা দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালিবাঈয়ের আনা জলে মিশে গেল তারই রক্তের ধারা। আর সেই রক্ত তুফান তুলল জমে থাকা অসহায় মানুষগুলোর মনে।

তাদের হতবাক আতঙ্ক ক্ষোভে ফেটে পড়ল এতক্ষণে। শত্রুহননের ডাক দিয়ে, মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে। সংকেত পেয়ে, ভীলেরা দলে দলে তাদের তীরধনুক, বর্শা নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। পালিয়ে বাঁচল পুলিসবাহিনী। সব ভুললেও মারুর ডাক ভোলেনি তারা। পিছু হটলেন রাওয়ালও”।

তিন্নি শুধু বলল – “তারপর?”

মনিদি বলল – “ হ্যাঁ, তারও পর থাকে বইকি। এরপর আরও বড় বাহিনী এসেছিল রাস্তাপালে। ভীলদের গ্রামটাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছিল। কিন্তু কী জানিস, আলো যখন জ্বলে তখন কিছুতেই অন্ধকার জিততে পারে না। এ লড়াই সেখানেই থামল না। অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলেন লক্ষ্মণ সিং। ভীলদের পড়াশোনার অধিকার মেনে নিতে হযেছিল তাঁকে”।

মিতু হাঁটুতে মুখ রেখে শুনছিল এতক্ষণ। এবার মুখ তুলল। জলে ভেজা চোখ না মুছেই, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল – “ডুঙ্গারপুর মনে রেখেছে কালিবাঈকে?”

মণিদি বলল – শহীদের বলিদান বৃথা যায় না রে মিতু। ডুঙ্গারপুর তাকে শুধু মনে রাখেনি, প্রাণে রেখেছে তার শিক্ষার আর্তিকে। গুরুর জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য শহীদ হওয়া সেই মেয়ে বেঁচে রইল ডুঙ্গারপুরের মানুষের ভাবনায়, কাজে। সেখানে আজ ৮৪.৩৮% জন স্বাক্ষর”।

লম্বা শ্বাস ছাড়ল মেয়ের দল – “আমরাও আর পড়ায়, কাজে ফাঁকি দেব না মণিদি। যেটা ঠিক বলে জানব, তার জন্য লড়ব”।

মণিদি হাসল – “বিপ্লব আলো ছড়ায় যুগে যুগে। কখনো হারিয়ে যায় না, মনে রাখিস।”

********

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর উদযাপনে মূর্তি গড়ছিলেন ভাস্কর। একহাতে কাস্তে, অপর হাতে বই দিয়ে কালিবাঈয়ের মুখে তৃপ্তির হাসিটি বড় যত্ন করে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলো।
0

পথে প্রান্তরে - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার

Posted in






ভীমা শঙ্কর

গল্প বলছে এই শিবের সাথে ত্রিপুরাসুরের যুদ্ধ হয়েছিল। দুজন ডাকিনী যোগিনী শিবকে জিততে সাহায্য করেছিল। ভাবো একবার গল্পের গরু কৈলাসে উঠে গেল! শিবের সাহায্য লাগছে!! বেশ, লাগছে। বিশ্বাসে মিলায়ে ----- তাই তাদের দুজনেরও মন্দির আছে। এখানে।

ভীমা নদীর খাতে বলে ভীমাশঙ্কর। বলছে জ্যোতিঃ লিঙ্গ।

আচ্ছা, এই জ্যোতিঃ লিঙ্গ সব কেন ভারতে? শিব কি সবার শিব নয়?

ধর্মস্থান। ব্যবসার সুযোগ অনেকরকম। ভি আই পি দর্শন ৫০০ টাকা। রুদ্রাভিষেক ২১০০ টাকা। লোকজন আসে। থাকে। হোটেল লাগবে, আছে। খাওয়াদাওয়া ? আছে। তবে কিনা নিরামিষ। সব ধর্মস্থানের চরিত্র একরকম। কোথাও ভিড় বেশি, কোথাও কম। আমি খুব একটা বিশ্বাসী লোক নই। আমার দেখার চোখটা এই রকমই।তবে এখানে একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। এখানে ছোঁয়া যায় লিঙ্গ! ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা। ২৩০ সিঁড়ি ওঠানামা আছে।

বেরিয়ে পড়ার আগে এই টুকুই খবর জোগাড় করা গেল। টান টা অনেকটা রাস্তা গাড়িতে যাওয়ার। তাও আধা পাহাড়ি রাস্তা। চলো বেড়িয়ে পড়া যাক।

প্রতিযোগিতা ছিল। আরো একটা নাম ঘোরাফেরা করছিল ভান্ডারধারা। ওটাকে চেক করার ভার পড়ল আমার ওপর। আসলে আমাদের দুজনেরই তখন সময়ের অভাব। বেড়ানোর ছক দায়সারা ভাবে হয় না। অথচ তাই হচ্ছে দেখ।

ভান্ডারধারা ইগতপুরির কাছে একটা রিসোর্ট গ্রাম। এই ইগতপুরি নামটার সাথে জড়িয়ে আছে স্মৃতির গল্প। আমাদের মামাবাড়ি ছিল বম্বেতে। মানে মার বাপের বাড়ি। বছরে, দু বছরে একবার দুবার বম্বে যাওয়া হত। তখনই শোনা নাম ইগতপুরি। সেই ছোটবেলায়। মা আগে থেকেই বলে দিত “ইগতপুরি আসছে” আমরা তিন ভাই (আর একভাই ছোট কিনা, মনে নেই) ঠেলাঠেলি করে জালনার পাশে গিয়ে বসতাম। কাচ ফেলা থাকত। তখন কয়লার ইঞ্জিন ছিল। কাচ খোলা থাকলে গুঁড়ো কয়লা আসত ভেতরে। মানুষ থেকে বিছানা পত্তর সব কালো করে দিত। তখন একটা ব্যাপার ছিল , সঙ্গে হোল্ডোল (হোলড অল) থাকত। তাতে থাকত বিছানা পত্তর আরো কত কি!! ইগতপুরি আমাদের কাছে খুব আদরের। কারন এবার গুহা আসবে পর পর। পশ্চিম ঘাট পর্বত মালা। আমরা পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ছি। আর এবার ইঞ্জিন বদল হবে। কয়লার ইঞ্জিন বাদ, ডিজেল ইঞ্জিন লাগবে। জালনার কাচ খোলা যাবে।

ভান্ডারধারা যেতে হলে মুম্বাই থেকে সোজাসুজি যাওয়া যায়, ১৮৫ কিমি। গাড়িতে যাওয়াই যায়। প্রাভারা নদির পাড়ে, একদম প্রকৃতির কোলে এই গ্রাম। লেক, ঝর্না হাত বাড়ালেই। উইলসন বাঁধ, আরথার লেক, রান্ধা ঝোরা। ট্যুরিস্ট তো আসবেই। আমরাও যেতে পারি, যেতেই পারি। থাকব কোথায়? দেখি, থাকার জায়গা খুঁজি। পুরুষওয়াড়ি বলে একটা জায়গায় নাকি ‘জোনাকি মেলা’ আছে। সত্যি? ওখানে এল ই ডি র উৎপাত থাকবে না তো? যাব তাহলে। দেখতেই হবে। জোনাকির আলোয় মেলা, নাকি মেলাই জোনাকি আছে ওখানে?

বলছে দু দুটো গড় আছে। রতনগড় আর হরিশ্চন্দ্রগড়। ও হরি, এতো পাহাড় চড়ার জায়গা! আমরা পারব কি? পাহাড় চড়তেই হবে এমন কথা নেই। দেখিই না খাওয়া থাকার কি ব্যবস্থা। ওখানে। ”কালসুবাই” ট্রেক শুরু হয়। সাহ্যাদ্রি পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চুড়া এটাই। দেখি, দেখি দেখাই যাক না।

ব্যাপারটা না নিতে পারছি, না ফেলতে পারছি। দেখি দেখি হোটেল দেখি।

একটাও পছন্দ হচ্ছে না। সব হোটেল ট্রেকারদের সুবিধে বুঝে করা। তাও না হয় মানিয়ে নেওয়া যায়। ওয়াশরুম ছবিতেই যা দেখাচ্ছে, আসলে কি হবে? ভাবাই যাচ্ছে না। হাতে সময় নেই একদম। যেতে হলে আজই বুক করতে হবে। আমাদের যাত্রা পরশু। টেনশন হচ্ছে ।

ফোন এল। আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা ভীমাশঙ্কর যাচ্ছি। হোটেল বুক হয়ে গেছে। আমি একাই ডিসিশন নিলাম। টাকা দিয়ে দিয়েছি। ২৩, ২৪। ২২আমার বাড়ি চলে আসবেন। আমরা সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়ব। গাড়িও ঠিক। ইনোভা। আমরা চার জন। আরাম করে যাবো।

বাঁচলাম।
0

কবিতা - গৌতম দাস

Posted in



















দিকনির্দেশ

এখানে আর আমার নাম কেউ মুখে আনে না, সময়, সে তো আসলে চলে বিপরীত অপেক্ষায়, হারুনের ছেলে বন্ধুদের সাথে কাজের খোঁজে বিদেশ গিয়ে ফিরলো না আর

হারুন রোজ তাই অপেক্ষায় থাকে একটি চিঠির, আর ঐ যে মেয়েটি সামনের শনিবার বয়-ফ্রেন্ডকে বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে বলে বাসের হাতল ধরতে ছুটেছিল

সে-ও আর ফিরে আসেনি বাসস্টপে, ছাপোষা মধ্য বয়স্ক মানুষটিও চায়ের ভাড় বেঞ্চে রেখে সেই যে সেদিন রাস্তা পার করে সিগারেট কিনতে গেলো

আজও সে ফিরে আসলো না...

আসলে বড় অপেক্ষার শহর এই শহর, সন্ধে নামলে তাই এখানে কাঁধ জড়িয়ে বাতাসের উৎসব শুরু হয়, বুড়ো ক্ল্যারিনেটবাদকের টুপি তখন উপচে ওঠে করুণায়, পাতাল রেলের সিঁড়ির শেষে ফিসফিস করে গল্পে মেতে ওঠে দুই অসফল মানুষ

ছদ্মবেশী শহর তাদের কথা শুনবে বলে কান পাতে তখন

আর আমি বাড়ি ফেরার দিকনির্দেশ যেন হারিয়ে ফেলি

শুধু মনে পড়ে যেদিকেই হাঁটি, এ অপেক্ষার শেষ নেই, সাবধানে হাঁটি

জানতে চাইলে কাউকে বলি না কতদূর আসলে যেতে চাই...

বাড়ি ফেরার আগে মৃত্যুর পরেরটুকু শুধু যেন লিখে যেতে চাই...







প্রতিশ্রুতি

আলো জ্বালানো নিষেধ, মেঘে মেঘে ঢেকে গেছে সব তারা, ধুলোবালি মনে স্মৃতিকথা নিয়ে বসে আছি ছাদের কিনারে

নাবিক তো ঘরে ফেরে এসময়ই, দুয়ার খুলে দেয় তার নারী, তবু সমুদ্র আর চাঁদ আজ আত্মহত্যার স্বপ্ন দেখে

যেমন নি:শর্ত কবিতার মত তুমি আজও ভেসে যাও জোৎস্না হয়ে, পাহাড়ের বুকে বদলাও বারবার তোমার গতিপথ

প্রতিশ্রুতিগুলি চিরদিন শুধু থেকে যায়

গোপন কথার মতই সৎ







মিথ্যে

মনে মনে দৃশ্যপট এভাবেই সাজিয়েছি

পথ চলতি এ শহরের কোনো এক ব্যস্ত অথবা অব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ করেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে একদিন, দূর থেকে তোমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ব আর কাছে এসে চোখ তুলে আমায় দেখে চমকে উঠবে তুমি, ততক্ষণে আমার ধুকপুক করা বুকের ওঠানামা সামলে খুব আলতো করে তোমায় জিজ্ঞাসা করব, কেমন আছ, ঈষৎ ঘাড় নেড়ে সেকথার জবাব দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুমি জানতে চাইবে কবে চশমা নিলাম, ছেলে কোন ক্লাসে পড়ছে, বৌকে নিয়ে গতবার শীতে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলাম কি না, আমিও জেনে নেব তোমার মেয়ে বনজোৎস্নার কথা, তোমার স্বামীর কথা, অলস দুপুরে এখনও কি তুমি মাঝে মাঝে রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকো, এইসব ...

আসলে এসব এক দৃশ্যকল্প মাত্র অথবা এক অস্থির অস্থিরতা যা শুধু আমাকেই ছুঁয়ে থাকে অথবা বলতে পারো গলে পড়া মোমের নীচের বাসনা-রুদ্ধ মুখ

কিংবা মেনে নিতে পারো সেই বিশ্বাস

বিন্দুর ওপর যে কোনো সময় আমি জেগে উঠতে পারি, জেগে উঠতে পারি এক সৌধ হয়ে অথবা সংকেত ছাড়াই চলে যেতে পারি কখনো বিস্মৃতির আড়ালে...

তস্কর বাতাস শুধু তখন ছুঁয়ে থাকবে তোমায়, ছুঁয়ে থাকবে আমার আকাঙ্ক্ষা হয়ে...

একদিম তুমি একে বিভ্রম বলেছিলে

কিন্তু সত্যি বলো তো, কখনো কি মিথ্যে বলতে পেরেছিলে...
0

কবিতা - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in





আজকে মে-দিন।
সামনে টান টান পড়ে থাকা ঝিমধরা পথ তোমায় ডাকছে!
পথের উপর লেপ্টে থাকা ম্লান রোদ্দুরের-আলো ইশারায় ঈঙ্গিতে তোমায় ডাকছে!
এই পথ চলে গেছে লড়াই-এর ময়দানে,
এই পথ শেষ হয়েছে ক্ষুধার্ত শিবিরের পরিখায়।
এই পথ ছুটে গেছে মেহনতী মানুষের ইচ্ছের দিকে,
এই পথ মিশে গেছে পাঠশালার অনুভবে, ভালবাসায়।

গত কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে,
মানুষের ভালবাসা উজ্জ্বল বৃষ্টির মতো
ধুইয়ে দিয়েছে মে-দিনের এই অনন্ত পথ।

এখনও পথে ছড়ানো কিছু লাল ফুল –
সেই সব রক্তাক্ত ইতিহাসের চিহ্ন, যা আমরা ভুলি নি।
এখনও পথে ছড়ানো কিছু হলুদ ফুল –
মেহনতী আকাঙ্ক্ষার সেইসব পীতাভ চিহ্ন –
যার জন্যে আমরা যুগ যুগ লড়াই করেছি।
এই পথে কিছু সাদা ফুল এখনও ছড়ানো বাকী
যা আমাদের নিয়ে যাবে আগামীর দিকে।

আজকে মে-দিন।
সামনের অনন্ত পথ প্রতীক্ষায় ঝিম মেরে আছে,
মেহনতী মানুষের মন বর্ণময় রামধনু, কিম্বা বাঁকা কাস্তে।
একটা অনন্ত পথের সামনে দাঁড়িয়ে আজকের মে-দিনটা হেসে হেসে পেপার বেচছে!

3

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in



















হালকা সাদা নর্তকী
ভেসে বেড়াচ্ছিল
সকাল থেকে

বাতাসের মোহে ও আনুকূল্যে
আকাশের উপরের দিকে
আকাশ জুড়ে

নিজের ধীরে গতি মেনে
সমুদ্রের উপরে ডানা মেলে
জল ছুঁয়ে যায়

তীরের কালো কালো পাথরগুলি
ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে
শুয়ে আছে
নর্তকীর সামনে

একের পর এক
একের থেকে এক আলাদা ঢেউগুলি
কোঁকড়ানো ঝালর লাগানো অলঙ্কারের
মতো
নর্তকীর পা ছুঁয়ে যায়

ঘূর্ণিঝড়ের তির্যক বাতাসে
জলের ছিটেয়
নিজেকে ভিজিয়ে নিল
ঠোঁট রাখে
ঢেউ অলঙ্কারের উপরে

জল স্পর্শ করে
পাগুলি ভিজিয়ে নেয়
নর্তকীর নরম,
অবরোহী সিদ্ধান্তে

জল ফ্যাকেশে হয়
নর্তকীর পায়ের রঙে,
গরিমায়

ফ্যাকেশে জল ঢেউ ভাঙতে শুরু
করে
ভাঙতে ভাঙতে ঢেউ শান্ত হয়ে যায়

আরেক ঢেউের নাচনীতে
নর্তকী কাঁপতে কাঁপতে
নিজের ঠোঁট বেঁকিয়ে
জলের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে

ওর শরীর জুড়ে
সাদা রেশমি পোশাক
জলের শব্দ নর্তকীর কানে আসে
জলের ঝাপটায় রেশমি পোশাক ভিজতে থাকে

এখানে এখন এর থেকে
সুন্দর কিছু নেই

নর্তকীর সুখের শরীরে
অর্থহীন আগুনে, দাবানলে
হৃদয় কাঁপিয়ে
নর্তকী ভেসে যায় আকাশে
বাতাসের মোহে।
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in





রোদ বৃষ্টির মিষ্টি আলাপ খুব জমেছে
ভিজবে বলে বর্ষাতি আজ অপেক্ষাতে
পদ্ম পাতা হীরের লোভে বুক চিতিয়ে
বেলের কুঁড়ি মেলবে বলে গন্ধ ছড়ায়

পায়ের নিচে গরম বালির মরীচিকা
গাছের ছায়া স্বপ্ন দেখে শীতলপাটি
কৃষচূড়া আকাশ জুড়ে লালচে ছড়ায়
বারান্দাতে রোদ ছুঁয়েছে জলের বাটি

জ্বলব বলে হওয়ার নিচে দাঁড়িয়েছিলাম
সূর্য কি আর তোমার মত রাগতে পারে?
নিবিয়ে দিলো ছটাক মেঘের আভাস এসে
আমিও তাই তপ্ত দিনে ডিঙা ভাসাই

গরম হাওয়া আজ ছুঁয়েছে দেশের মাটি
ছোয়াঁচ লেগে পাশের বাড়ির তপ্ত চুলা
এসব বুঝি গরম দিনের তপ্ত দাওয়াই
এসব ছেড়ে আমরা বরং দাওয়ায় জুড়াই
0

কবিতা - ইন্দ্রাণী সরকার

Posted in






ড্যান্ডিলায়নের পাপড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কদমের রেণু ঘাসের ওপর ঝরে পড়ে রোদেলা আকাশে মেঘদের নৌকো ভেসে চলে পাহাড়ের মাথায় সবুজ আঁকিবুঁকি তেরছা আলো ঝুঁকে আছে দোরের আনাগোনায় দূরে একটি ফড়িং পাতার চৌখুপিতে উঁকিঝুঁকি মারে বনশালিক কিছু মাথা নাড়িয়ে বচসায় রত ছবির মত বাড়িগুলি নদীর ওপারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে জলে কিছু নৌকো অল্প হাওয়ায় ঢেউয়ের দোলায় কচিপাতার ফাঁক দিয়ে উড়ে যায় রঙিন প্রজাপতিদের পাখা ।



0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







সার্ডিন মাছের ঝাল

সার্ডিন মাছ আঁশ ছাড়িয়ে পেট পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। কড়াইয়ে তেল গরম করে, বেশ সময় নিয়ে ভাজতে হবে মাছগুলো। মাছ ভাজা তেল সরিয়ে, কড়াইয়ে আবার তেল নিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মিনিট দুয়েক ভেজে, জল ঢেলে দিতে হবে। পরিমান মতো কাসুন্দি ও পোস্তবাটা মিশিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে রাখতে হবে। জল ফুটে উঠলে, ওই পেস্ট ঢেলে দিয়ে আবার ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মাছগুলি দিয়ে নুন, ঝাল চেখে নিয়ে, ঝোল একটু গাঢ় হলেই নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন।

কাসুন্দি না দিয়ে সর্ষেবাটা দিয়েও করা যায়। সার্ডিন কিন্তু খুব নরম মাছ, কাটার সময়ে বা ঝোলে দিয়ে ফোটানোর সময়ে তাই সাবধানে করতে হবে। পেটের সব ফেলে পরিষ্কার করে নেওয়াই ভালো, কারণ পেটে প্রচুর কাদামাটি থাকতে পারে।



0

সম্পাদকীয়

Posted in

































১৩৪৮ সনের পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ আশি ছুঁইছুঁই। কবির শেষ জন্মোৎসব পালনের অনুষ্ঠান। ক্ষিতিমোহন সেন পাঠ করলেন কবির লিখিত এক ভাষণ। 'সভ্যতার সংকট' শিরোনামের সেই প্রবন্ধের উৎসারণ সামগ্রিক এক হতাশা থেকে। যা কিছু শোভন, সুন্দর, ন্যায়ানুগ, তার সর্বাঙ্গে যেন দুর্দশার গ্রহণ! তিনি লিখলেন, 'প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে!'

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চুরাশি বছর পরে আমরা আজ যে সামাজিক পরিমন্ডলে আবদ্ধ, সেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলি কি একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করা হয়ে থাকলেও এমন এক যুগমানবের কলম-নিঃসৃত মনে হয় না, যিনি আজকের দিনটি স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন? অথচ সুন্দরের পূজা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।

বেশি নয়, মাত্র আটমাস আগের একটি ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল নগরজীবন। কর্তব্যরত একজন তরুণী-চিকিৎসক ধর্ষিত এবং খুন হয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটি থেকে জল গড়িয়েছিল অনেকদূর। বিক্ষোভের আঁচ পৌঁছে গিয়েছিল এক মহাদেশ থেকে অন্যত্র। এক যুগেরও বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া 'নির্ভয়ার স্মৃতি' এখনও বহু মানুষের মনে অমলিন। কিন্তু যে 'রিপুর প্রবর্তনায়' একের পর এক ঘটে চলেছে মানবতার এই বলাৎকার, তাকে বশে আনা গেছে কি? যাবে কোনওদিন? আপাতভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জটিল নানান অনুষঙ্গ। জিন যার অন্যতম। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গেই বিশেষ এই রিপুটিকে বশে আনার বিষয়টি সম্পর্কিত বলে ভাবা মানবসমাজের পরিচায়ক।

চারপাশের লক্ষণগুলি কিন্তু অন্য ভবিষ্যত নির্দেশ করে। মহারাষ্ট্রের অম্বাজোগাই শহরে একজন মহিলা আইনজীবী প্রকাশ্য, এক বর্বর শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলেন। দিল্লির অনতি দূরত্বে আইসিসিউ- এর ঘেরাটোপের মধ্যে ধর্ষিতা হলেন এক এয়ারহোস্টেস আর আমাদের এই বঙ্গে কী ঘটল? প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রথমে পাঁচ লক্ষ টাকার প্রতারণা তারপর অভিযোগ জানানোর ফলে সেই তরুণীকে ধর্ষণ!

এ কোন সমাজের অন্তর্গত আমরা? যা কিছু নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল, তার সবকিছুই ভূলুণ্ঠিত। আর কি কখনও চেতনা ফিরবে? সামাজিক ন্যায় কি কখনও প্রতিটি প্রত্যন্তবাসীর নাগালে আসবে? কোনওদিন কি আমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে কাটিয়ে উঠতে পারব রিপুর তমসা, দাঁড়াতে পারব নতুন এক ভোরের সামনাসামনি?

সুস্থ থাকুন। ন্যায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in






তারপর মানুষ নিজের কাছে ফেরে। অনেক অনেক দিন পেরিয়ে, বছর পেরিয়ে, শত্রু- মিত্র ভেঙে ফেরে। সময় তাকে অনেক কিছু দেয়। অনেককিছু নেয় সে সময়ের কাছ থেকে। ধার করে। পরে ফেরত দেবে ভাবে। জল-ঝড়-বাতাসের ঝাপট। খোলা মাঠ; বদ্ধ দরজা। রোমাঞ্চ, শিহরণ। মান-অপমান। সময় কেড়েও নেয় প্রচুর। ওইযে ছিল নির্মল একটা মন; ভালোলাগার একটা পৃথিবী; রোমাঞ্চ মণ্ডিত একটা চিলেকোঠা--- হারিয়ে যাওয়া সেই চাবি। কাকে বলবে এইসব গাল-গল্প! কাকে শোনাবে একঘেঁয়েমির চিত্র! সবাই যে আজ একরকম, প্রৌঢ়ত্বের মন নিয়ে হাঁটছে। অনেক কিছু জেনে গেছে এই অজানার চেতনা। তার কাছে যে আজ, আলো বাতাসের সবটুকু রিদম জানা। সান্দ্র বিকেলের হাওয়ায় ততক্ষণে শ্রান্ত অবসন্ন সেই মন, হৃদয়। অথচ, নির্জন হয়েছে সে; শক্ত হয়েছে আরও। ঝুরো ঝুরো বালির প্রাচীরে লেগেছে যেন সিমেন্টের ধারালো প্রলেপ। কিন্তু সে নিঃসঙ্গ, একাকী। সমস্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে শহরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে-- এই শহর আবিষ্কারের নয়; নতুনের নয়; নাকি রোমাঞ্চকর শিহরণকারী। তখন সে হয়ে পড়ে আরও বিধ্বস্ত। একা। নির্জন। পৃথিবীর এই নিঃসঙ্গতম মানুষটি কী ভাবে তখন! আলো অন্ধকার ডিঙিয়ে কীভাবে তুলে আনা যাবে আলোচনার পর্ব! কীভাবে নিজেকে ভাসানো যাবে আবার সেই নতুনের স্রোতে! একে একে খুলে রাখা বর্ম পরে নিয়ে আবার যদি ঝাঁপ দিতে পারা যেত মারিয়ানার খাদে! যদি এই দমবন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার আগে খোলা আকাশের স্পর্শ আবার আরেকবার পাওয়া যেত যদি! আর তখনই সে খুঁজতে বসে নিজেকে। যুদ্ধ করে। প্রাণপণে ফিরিয়ে আনতে চায় সেই দুনিয়াটিকে। আর তখন আবার আলো-বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। অন্ধকার এবং ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে ভাব জমায়। জানলার ফাঁক দিয়ে খোঁজে নীলনদের বিস্তৃত উপত্যকা।

"The man spoke little. This is the way of those who live alone, but one felt that
he was sure of himself, and confident in his assurance. That was unexpected in
this barren country. He lived, not in a cabin, but in a real house built of stone
that bore plain evidence of how his own efforts had reclaimed the ruin he had
found there on his arrival. His roof was strong and sound. The wind on its tiles
made the sound of the sea upon its shore"

ঠিক এরকমই, জাঁ গিয়োনো ফ্রাঁস লেরক নিজেকে খুঁজেছিলেন। তার আগের সেই জীবন্ত পৃথিবী-- যে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, জল-ক্ষুধা-আশ্রয় দিয়েছিল। মেষ পালকের গানে ভরে উঠেছিল জীবন। তার বহুবছর পরে, যুদ্ধ হিংস্র পৃথিবী ভেঙে একটা নিঃসঙ্গ লোক প্রান্তর ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওই আশ্রয়ের খোঁজে। শান্তির আশ্রয়ে। নির্জনতার আশ্রয়ে। যেখানে সে মুখোমুখি হবে নিজের। কথা বলবে। নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে। আর এই আত্মপরীক্ষনটি চলে নির্জনে। অন্ধকারের ভিতর আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে। তখনই লেখক বসেন, পুরনো অক্ষরের কাছে। তেমন সীমিত অক্ষরমালা তাঁকে এতদিন ভ্রান্ত একটি পথের সন্ধান দিয়েছে। আর সারা টি জীবন তিনি সেই সীমিত অক্ষরের পেছন পেছন ছুটেছেন। সৃষ্টির নেশায়। আবিষ্কারের নেশায়। দিস্তার পর দিস্তা কাগজে সেই সীমিত অক্ষর নিয়ে খেলা করেছেন। নেড়েচেড়ে দেখেছেন। সাজিয়েছেন। ভেবেছেন, দারুণ একটা আবিষ্কার! সারা পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে দেখবে এই অক্ষরের ঝলকানি। কিন্তু আজ যখন সময় হয়েছে, সেই অক্ষরের কাছে ফিরে দেখেন যে আত্ম গর্বীমন খুঁজে পায় একঘেয়েমি, বিড়ম্বনা। সবকিছুই তখন ফ্যাকাশে। বহু ব্যবহৃত।

" আসলে সবই আদ্যিকালের। পৃথিবীও বদ্যিবুড়ি। শুধু কচিকাঁচারা, তরুণ-তরুণীরা প্রথম প্রথম দেখছে বলে, স্বাদ নিচ্ছে বলে তাদের চোখে জিভে সব আশ্চর্য ঠেকে। সতেরো বছরের ছেলেটি কলকাতা শহরে এসে যে রোমাঞ্চ অনুভব করবে আমি টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্কে গিয়ে তার এক কণাও পাব না। কলকাতাই আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে তার সহোদরা নগরীদের সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে, তালিম দিয়েছে। "
( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

নতুন সিলেবাস। পাঠ্যসূচি। নতুন বই। ভাবি, কি না কী লুকানো আছে তার অন্তরে। মলাট খোলার পর দেখা গেল, চর্বিতচর্বন। বুঝতে পারলাম, এই পর্বের পরে আসবে অন্য একটি পর্ব। ঠিক যেটা আমি জানি, সেও জানে। লেখকও জানেন হয়ত সেটুকু। তারপর পাঠক হিসেবে তাকে আর খোলার প্রয়োজন অনুভব করি না। কেননা, রোমাঞ্চের অভাব মানুষকে উৎসাহী করে তোলে যেমন, রোমাঞ্চের পরে পৌঁছে দেয় একটি স্থিরতায়। তখন সে তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে বসে, বর্তমান রোমাঞ্চকর অবস্থানটিকে। তাই আমরা বাস্তবে যখন কারো সঙ্গে কথা বলি, নতুন অপরিচিত ব্যক্তিটি আশ্চর্যতম অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হন আমাদের সামনে। তারপর যখন দু-চারটি কথার পরে বুঝতে পারি, আসলে আমার পূর্বে জানা ব্যক্তিটির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বর্তমান ব্যক্তিটির। তখন আমরা যত না ওই অচেনা ব্যক্তিটির মধ্যে নতুনত্বের খোঁজ করি তার অধিক মেলাতে বসি পূর্বে চেনা ব্যক্তিটির সঙ্গে। আর তখনই আমরা হাঁপিয়ে পড়ি। ক্লান্ত হই।

তা বলে কিন্তু পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই! শুধু দৃষ্টি পাল্টেছে আমার। আমি-ই পুরনো হচ্ছি পৃথিবীর কাছে। জাবালির মতো। অসহায়তার চোখ নিয়ে কোথায় খুঁজবো রোমান্সের শরীর? মন? বয়েসে না, মনে এসে ছায়াপাত করে বার্ধক্য। মনে হয় এতদিন কী করলাম! শুধুমাত্র কিছু ডিগ্রির কাগজ। অ্যাডমিশন ফি। কলেজ। ক্যাম্পাস থেকে বেরোতেই পারলেই যেন বাঁচি তখন। দমবন্ধ লাগে। হাঁপ এসে যায়। স্কুল লাইফের বন্ধুরা নেই। প্রিয় শিক্ষকেরা এখন বহুদূরের। ছাড়তে ছাড়তে হারাতে হারাতে এই বিরাট কোলাহলে। সম্বল মাত্র কয়েকটি অক্ষর। শব্দ। আর এই পুরনো অভ্যেস, মনখারাপ নিয়ে কী আর কলম চলে? "এই অবস্থায় এসে কি আর লেখালিখি করা যায়!" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় অভিজ্ঞতা। অনন্তের পৃথিবী। সময় ভেঙে মেশে মহাকালের স্রোতে। আনন্দের গতিধারা আবার বইতে শুরু করে। একে একে উঠে আসে, দেশের বাড়ি। জানলা-ভাঙা নিগমানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছুট ছুট করে কবাডির মাঠ। প্রথম চোখের ইশারা। হেরে যাওয়া নয়, পূর্ণ ব্যাগের ভারে আমি নতুন হই। সামনের দিকে তাকাই। আবার হাঁটে মানুষের আকাঙ্খার পথ।

" আমি এখন কালস্রোতের কোথায় আছি? কত মাইল উত্তরে, কত মাইল দক্ষিণে? আমার ডানদিকে কত আলোকবর্ষ? আর বাঁয়েই বা কত? অঙ্কটা বেশি জানলে বা ধারণাশক্তি বেশি থাকলে হিসেবটা কিভাবে করা যেত জানি না। আপাতত আমার ছোটো হিসেবে, আমি এই ১৯৮৮ তে, পৃথিবীতে কলকাতায় আছি। আমি পেরিয়ে এসেছি অনন্ত কাল+ ষাট বছর। আর এখনো যেতে হবে হয়তো বছর পাঁচেক+ অনন্ত কাল।" আর তখনই ঝুমঝুম করে বেজে উঠল জাদুগরের ম্যাজিক বাক্স। অনন্ত শব্দটাতেই বিশাল বড় একটা পৃথিবী যেন খুলে গেল তার রঙবেরঙের ওড়না উড়িয়ে। তখনই আবার এসে বসল কবিতার খাতা। অক্ষরের পংক্তি। " এই দৃশ্যমান এবং বেদনীয় জগৎই কবিতার বিষয়-- আধার এবং আধেয়। এতদিন আমি ওই জগতের কথা ভেবেই কাটিয়েছি। অনন্তকালকে দুইপাশে রেখে এবার সাহস করে অন্যভাবে দেখা যাক। এই প্রকাশিত জগতের ওপিঠে বা অন্তরালে নিশ্চয়ই রয়েছে অপ্রকাশিত জগৎ। যেমন চাঁদের দেখা-পিঠের আড়ালে রয়েছে তার অদেখা-পিঠ। যেমন গাছের পাতার আলো-পড়া পিঠের অন্যদিকে রয়েছে তার অন্ধকার-জমা পিঠ। এমন কি বিন্দুরও, যদি অবস্থিতি থাকে, তারও সূচিমুখের আড়ালে আছে অজানা আঘাত।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আর এখানেই মণীন্দ্র গুপ্ত খুঁজে দেন একটি অন্ধকার জগতের সকাল। যাতে অন্ধকার রাজ্যেও ভেসে উঠছে সন্ধের ইমন। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য রাগ-রাগিনী। এতদিন মনে রাখা অন্ধকার আসলে অন্ধকার নয়। বরং আশ্চর্য রহস্যময় একটা কবিতা। যার পরতে পরতে আবিষ্কারের কাপড়। ঘোমটার আড়ালে আশ্চর্য সেই রূপের ঝলক। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছবির রহস্যময়ী অবগুণ্ঠন। নির্জন অন্ধকার তাঁকে দিয়েছিল আলোর মহিমা- দ্যুতি। আর তখনই অনুভব করি, আবহমানের ধারা। নিজেকে স্নান করাই। শুদ্ধ হই।

প্রকৃতি আমাদের সত্ত্বা। আমাদের বিকাশ। আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পথের পথপ্রদর্শক। আর প্রকৃতির আপন ধারার পথই হচ্ছে নিয়ম। রীতি। ধর্ম। অনুশাসন। আধার এবং আধেয়। আর সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফেরাটাই সাধনা। প্রকৃতির সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাই ধর্ম। অজস্র ধুলোর বিন্দুর মাঝে নিজের আমিকে খোঁজা।অনন্তের খোঁজ বিপুলের খোঁজ। সেই খোঁজাটাই যখন দুর্বার হয়ে ওঠে তখনই আমরা সৃষ্টি আনন্দের খোঁজ পাই। ছুঁতে পারি তার এক দুটি আলোক স্ফুলিঙ্গ। ধন্য হই। আসলে সমস্তটাই প্রকৃতিতে বর্তমান। সমস্ত জিনিসই সাজানো আছে প্রকৃতির ঘরে। তার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। নিত্য সঙ্গে অনিত্য মিশে গেছে প্রবহমান কালে। ‘একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি’ (কঠোপনিষদ (২:২:১২))। শুধু তোমার প্রয়োজন মতো খুঁজে নাও তাকে। সাজিয়ে নাও ব্যবহার যোগ্য করে। ক্ষুদ্র আমি তখনই মেলে বিরাট আমি'র সঙ্গে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, স্পর্শের মধ্য দিয়ে এই anticlimax পথের সূচনা। বিস্তারিত দৃশ্যের মধ্য থেকে প্রসারিত হবে এইসব রোমাঞ্চকর পথের অনুভব । বোধ। জ্ঞান। এতদিন যা যা সংগ্রহ করেছ তা থেকে বানিয়ে নিতে হবে সংযোজন। তাই কবিতা বিজ্ঞানীর কথায়,

" কবির খুব প্রয়োজনীয় নিকট বন্ধু হতে পারেন নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সমুদ্রতত্ত্বের লোকেরা; ভূবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিবিদ্যার লোকেরা-- যাবতীয় অনুসন্ধিৎসু মানুষের দল। আড্ডা মারতে হয় তো এঁদের সঙ্গে। যেমন ভাব তেমনি লাভ। প্রথমোক্তদের মানুষ-ঘেঁষা পেশা ক্রমশ তাঁদের মূঢ়মতি ও হীনবুদ্ধি করতে থাকে। মনুষ্য সংশ্রব মনুষ্যত্বের পক্ষে সর্বথা ভালো নাও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্তেরা ঠিক উলটো-- মহাপ্রকৃতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে তাঁদের চেতনা উদ্ভাসিত হতে থাকে। তাঁরা খুঁজে খুঁজে যাকে পান সে তো অভিজ্ঞতা বটেই, তাছাড়া যেপথে খোঁজেন সে পথও অভিজ্ঞতায় ছাওয়া। এই অভিজ্ঞতাগুলি কবির জগতের ভূমি, আকাশ, আবহাওয়া ও স্বপ্নের মৌল।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তাই অসীমের পথে যাত্রী হতে পারেন কবিরাই। আলোকের ঝরণা ছেড়ে সহজেই নেমে যেতে পারেন মারিয়ানার গভীর খাদে। কেউ নেই। অনুসরণ অনুকরণের কোনও ধারা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় না তাঁর কাছে। তিনি খোঁজেন এবং খোঁজেন। তিনি দেখেন এবং বোঝেন। উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্য থেকে ছেঁকে তোলেন শব্দ। ধনী থেকে দরিদ্র সবাই তাঁর বন্ধু। আবার কেউ না বন্ধু নন। তাদের উপলব্ধির অভিজ্ঞতাটুকুই বন্ধু তাঁর। সৎসঙ্গের ব্যাখ্যাটা তাই এখানে যোজন বিস্তৃত। শিশুটিও তাকে দিতে পারে তার শিশুদের সন্ধান, ষোড়শী যুবতী দিতে পারে প্রথম প্রেমের ইশারা আবার মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধটি দিতে পারেন রহস্যময় পরাবাস্তবের ইঙ্গিত।

"কবিতা যার একদিক অনির্দেশ্য অনির্বচনীয়কে স্পর্শ করে আছে, সে কেমন হবে, কেমন হওয়া তার উচিত, এমন কোনও ফরমান জারি করা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু প্রারম্ভিকভাবে এটুকু বলা যায়, কম্পিউটার, গাইগার কাউন্টার, পরমাণবিক বোমা, মঙ্গল চাঁদ শুকতারায় যাবার হাউই ও জাহাজ যে সূক্ষ্ম, নিপুণ, সংবেদনশীল, নির্ভুল, প্রলয়বীর্য, অনন্তভেদী, অমোঘলক্ষ্য ধ্যানের ফল, আমাদের কবিতাকেও যেতে হবে সেই পথে। এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমি কবিতার মধ্যে কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতির লোহালক্কড় বা নাড়িভুঁড়ি বা কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ ভরে দিয়ে তাকে এক মহাপন্ডিত রোবট বানাতে চাইছি। আমি চাইছি তার আত্মা হোক অনন্তসম্ভব, আর সেই অনুযায়ী তার দেহ হোক নিখুঁতগঠন।’ ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

এই নির্বিকার যাপনের শেষে ঘরে তুলতে পারবো শব্দের মালাকে! সাজাতে পারবো! প্রকৃতির দিকে মুখ করে বলতে পারি যদি- দেখো, তোমার ঘর থেকে জিনিস এনে কীভাবে সাজিয়ে তুলেছি, অন্দরসজ্জা। "আর কবিতার শেষে, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানো বা অভাবিত মোচড় দিয়ে থামা বা এতক্ষণের সারা শরীর ভরা চাপকে অকস্মাৎ মুক্ত করে দেওয়া এইভাবে শেষ করার অর্থ নাটকীয়তা, প্রকটতা, বাদ্যকারের তেহাই মারার লোভ"। তখনই ভেঙে যাচ্ছে নিরহংকার সাধনা। লোভ আসছে; প্রতিহিংসা পরায়ন মন আসছে। পুরস্কারের লোভে নিজের স্বতন্ত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত কবি। তখন ভ্রান্ত পথ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না, " ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমরা যেখানে আছি, যেখানে ছিলাম, যেখানে থাকব তার একদিকে অনাদি, অন্যদিকে অশেষ। সব কবিতা, সব গল্প, সব জীবনেরই শুরু যেমন স্রোতের মাঝখান থেকে ধরে নিতে হয় তেমনি তার শেষও ছেড়ে দিয়ে যেতে হয় মাঝখানেই।" তবে এই যে আমি রোজ প্রত্যহ নিয়ম করে খোলা খাতার সামনে বসে থাকছি। ধরতে চাইছি অখন্ডের নিত্যতাকে! কী হবে? শুধু শুধু হাপিত্যেশ করে বসে থাকা অনন্তের দিকে মুখ করে? কিছু পাওয়া নেই? অনন্ত আমাকে ফিরিয়ে নেবে স্রোতে? আর আমি ভেসে যাবো খড়কুটোর মতো? না; তা নয়। তোমার চাওয়াটা ঠিক। পাওয়াটা নয় হয়ত। এইযে তুমি পাওয়ার জন্য চাইতে বসেছ তখনই তোমার মধ্যে অস্থিরতা আসছে। অসন্তোষ আসছে। তুমি ধ্যানমগ্ন হতে পারছ না তোমার সৃষ্টির কাছে। বাইরের কোলাহল তোমাকে ভ্রমের লোভে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ভোগের দিকে। আর তুমি তোমার ফেলে রাখা কাজ ছেড়ে উঠে যাচ্ছ শুঁড়ি মাতালের ঠেকে। ওখানে গিয়েও শান্তি নেই। তোমার ফেলে রাখা কাজ তোমাকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই থাকতে দিচ্ছে না এই নেশার পৃথিবীতে। অথচ, যেতেও পারো না তুমি। এই অস্থিরতা যখন তোমাকে ফিরিয়ে আনলো তোমার দায়বদ্ধতার কাছে, সৃষ্টির সমীপে; তখন মনে হচ্ছে শিকল লাগল পায়ে। তুমি চাইলে মুক্তি। আকাশের দিকে। পাখির মতো করে। কিংবা হয়ত যখন ফিরে এলে ফেলে রাখা কাজের কাছে, ততক্ষণে অভিমান বশত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেও। আর এই হল " অ্যান্টিক্ল্যাইম্যাক্স। কি হবে কি হবে ভেবে মন ক্রমাগত উত্তেজিত ও আকুল হতে থাকে, এবং তারপর হয়তো কিছুই ঘটে না। পাঠক শূন্যে ঝুলে থাকেন, আর তাঁর কল্পনা কাজ করতে থাকে গল্পের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে"। ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমারও আর ফেরা হয়না। সব ছেড়ে যাওয়া-রা চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু। সামনে এসে দাঁড়ায় আরও দৃশ্য। আর আমিও প্রতিটি দৃশ্যমানের কাছে তুলে ধরি আমার কবিতা; শব্দ; অক্ষর। মিলেমিশে তৈরি হয় কবিতা ভাবনা। সাদা কাগজের সামনে এসে বসি। একপাশে কোলাহল করে হেঁটে যায়, আমার বাস্তব; অন্যদিকে মৌন সাধনায় রত আমার যাপন। কোনও দ্বন্দ্ব নেই, রেশ নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে ভেবে হেঁটে যাওয়া। বসত গড়ি। মনের মধ্যে লালন বাজে। রবীন্দ্রনাথ বাজে। সুমন এসে মেশে মাঝের স্রোতে। দেখি ততক্ষণে জমে ওঠা-রা মিলিয়ে গেছে শূন্যে। আর তখনই অসংখ্য খোঁজের মধ্যে তৈরি হয় প্রবহমানের ধারা। যেন এটাই মোক্ষ নয়, এখানেই শেষ নয়। বরং অন্তিম ভেবে শুরুর খোঁজ শুরু হয় এখান থেকেই। এখান থেকেই মহাকাব্যের চলন। যুধিষ্ঠির হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে শীতল অতীত। সামনে অপার সৌন্দর্য। হাতছানি দিচ্ছে। সত্য বলে কিছু কী আদৌ! বরং এতদিনের জেনে আসা প্রিয় সত্য-রা, পদে পদে ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে। তখনই তিনি অনুভব করেন, সত্য মানে তখন এগোনো। চিরন্তন। এগোও, এগোও। এগিয়ে যাও। চরৈবতি...চরৈবতি। আমিও হাঁটি। আর ভাবি, " একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো"( রামপ্রসাদ সেন)। আর আমি চোখ খুলে নত হই, নতুন হই দৃশ্যের কাছে। এইযে অন্তিম লাইন বলে ভেবে এসেছি এতদিন, সেখানেই সংযোজিত হয় আবিষ্কারের পথ। আলোক বিন্দু। যে আমাকে পথ দেখাবে শুধু। থেমে থাকা, স্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে মেলাবে অনন্ত আবহমানতার স্রোতে।