Next
Previous
0

গল্প - দোলা সেন

Posted in



















[১]

“ ও মণিদি, কেমন হয়েছে বলো তো কার্ডটা?”

“এতক্ষণ ধরে একটা কার্ড বানালি? আমারটা দেখ, কি সুন্দর একটা পাখি বানিয়েছি। মিতু, তুই কিছু বানাচ্ছিস না যে!” তিন্নি মুখ না তুলেই বলে উঠল। সে তখন পাখির চোখে পুঁতি বসাতে ব্যস্ত।

“ধ্যেৎ। এগুলো কোনো উপহার হলো? আমি বাপিকে বলব নিউ মার্কেট থেকে একটা খুব সুন্দর গিফ্ট কিনে আনতে”।

মিতু বরাবরই একটু নাক উঁচু। ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। হর হপ্তা কলকাতা যায়।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে দেখে, মণিদি হাল ধরতে এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ ধরে একটা ফুলসমেত ফুলদানি বানানোর কাজে মেতে ছিল। ওর হাতের কাজ অসাধারণ। সামনে টিচার্স ডে। এই হোস্টেলের মেয়েদের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা টিচার্স ডের উপহার আর রাখি কখনো দোকান থেকে কেনে না। ওদের হাতের কাজ বড়দের তত্ত্বাবধানে বরাবরই খুব সুন্দর হয়। যেমন এই ঘরে পাঁচজন তাদের মণিদির কাছে বসে নানারকম জিনিস তৈরি করছিল।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা দেখে মায়া হলো মণিদির। সে হাল ধরল এবার।

‘আসলে কী জানিস, উপহারের আসল দাম তার আন্তরিকতায়। সবসময়েই যে সেটা জিনিসই হতে হবে তার মানে নেই। খুব অন্যরকমভাবেও দেওয়া যায় সেটা”।

দিয়া হালে পানি পেল যেন। খুব উৎসাহভরে বলল – “মণিদিদি, আমি না একটা বিদেশী গল্পে পড়েছিলাম দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে তাদের মিসকে ভালোবেসে রক গার্ডেন বানিয়ে দিচ্ছিল। একটা দ্বীপ থেকে পাথর আনার সময় নৌকোডুবি হয়ে...”

দিয়ার গলাটা ভারি হযে এল। মণিদিদি সস্নেহে ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলল – “বিদেশ যেতে হবে কেন রে? এই আমাদের দেশেই...”

গল্পের গন্ধ পেয়ে সক্কলে হাতের কাজ ফেলে মণিদিদির চারপাশে গোল হয়ে বসে – “বলো, বলো”।

মণিদি একটু হেসেই ফেলল – “এটা শুনতে গেলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হবে কিন্তু”।

রিঙ্কু রঙমাখা হাতটা মনের ভুলে মাথায় বুলিয়ে ফেলে বলে – “তা হোক। তুমি বলো”।

অগত্যা ফুলদানিটা টেবিলের ওপর যত্ন করে সরিয়ে রাখে মণিদি। তারপর হাতটা মুছে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেল

“ বেশ কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলি? ১৯৪৬ এর শেষের দিকে। সে এক অস্থির সময়...”

‘অস্থির কেন?” – দিয়া চুপ থাকতে পারে না মোটেই।

মণিদি তিন্নির দিকে ঘুরল – “এর উত্তর তুই দিতে পারবি?”

তিন্নি আঙুল গোনে – “সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতা। তার আগে উমম্... ছেচল্লিশের দাঙ্গা?”

“একদম ঠিক। যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সিংহের আধিপত্য সারা বিশ্বেই অস্তমিত হবার মুখে। ভারতও তার থেকে বাদ নয়। কিন্তু কে চালাবে সেই সদ্য স্বাধীন দেশ? কিভাবে রক্ষা করা যাবে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য?

যতই গান লেখা হোক – বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান _ নানা জাতি, নানা মতের মিলনে সে মহাসাগরে সেতু বাঁধা সহজ কাজ নয়। নানা স্বার্থের সংঘাতে জ্বলে উঠল ভারত। উজ্জ্বল শিখায় নয়, প্রবল জাতিগত দাঙ্গায়। সেই কালো দিনের অবসান ঘটাতে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ভাগ হোক ধর্মের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষও নেতাদের মতোই বিশ্বাস করল – “স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি”। ইংরেজ ভারত ছাড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে – সূর্যোদয়ের পর যেভাবে রাতের অন্ধকার নিমেষে দূর হয়”।

মিতু চিন্তিতভাবে বলল – “তবে যে বাবা বলে, শাসক বদলালেই উন্নতি হয় না? মানুষদের ভাবনা বদলাতে হয় আগে?”

মণিদি সোজা হয়ে বসল – “কাকু একদম ঠিক বলেছেন রে। তাহলে শোন - ঠিক সেই সময়ে, এই অস্থির চিত্রপট থেকে অনেক দূরে কয়েকজন মানুষ অন্যরকম ভাবছিলেন। তাঁদেরও মনে হয়েছিল, মানুষের মনে যদি চেতনার আলো, শিক্ষার দ্যুতি না পৌঁছানো যায়, তাহলে স্বাধীনতা কথাটির অর্থ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। যেমন মনে হওয়া, তেমনি কাজ। তৈরি হলো ‘সেবা সংঘ’। বিভিন্ন অনগ্রসর এলাকায় তাঁরা স্কুল তৈরির কাজে লেগে পড়লেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কাজটা সহজ নয় মোটেই। এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে শিক্ষিত করে তোলার পথে প্রধান বাধা দ্বিমুখী। এক - বিদায়ী ইংরেজ শাসক, দুই – স্থানীয় ভূস্বামী বা রাজা”।

রিঙ্কু অস্থির হয়ে উঠল – “কেন মণিদি? ইংরেজ কেন? আমাদের আধুনিক শিক্ষায় ওদের অবদান তো কম নয়! বেথুন সাহেবের কথাই ধরো, কিম্বা হ্যালহেড বা উইলিয়াম কেরি...। মেয়েদের স্কুল, বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে এঁদের অবদান তো আমরা ইতিহাসেই পড়েছি। তাহলে ছেচল্লিশে হঠাৎ তারা শিক্ষবিরোধী হয়ে উঠল কেন গো?”

মণিদি বলল – “তোরা একটা শব্দ বোধহয় খেয়াল করিসনি। সেবা সংঘ কাজ করছিল অনগ্রসর এলাকায়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য। যেখান থেকে ইংরেজ শাসকের, ভূস্বামীদের সেবা মেলে। মজুর, চাষী, জেলে...। এরা শিক্ষিত হলে - সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে চিনলে - নিঃশব্দে রোজের বেগার খাটবে কে?”

দিয়া বিরক্ত হচ্ছিল – “ গল্পের মাঝখানে নিজেদের জ্ঞান জাহির না করলেই নয়? মণিদি গল্প বলো”।

মণিদি হেসে ফেলে শুরু করল – “আসলে পটভূমিটা না জানা থাকলে, এ গল্পের কোনো মানে থাকে না রে। যাই হোক শোন –

রাজস্থানের দক্ষিণ পশ্চিমে ডুংগারপুর রাজ্য। সেখানকার রাজা – মহারাওয়াল লক্ষণসিংহ। যে সে রাজা নন, রাজ্যে তাঁকে সম্মান জানানোর জ্ন্য পনেরখানা গান স্যালুটে হয়। সে এক বিশেষ সম্মান। খোদ ইংল্যান্ডের মহারানী সে অনুমতি দিয়েছেন! তা স্কুল করার জন্যে, সেই রাজ্যের ভীল অধ্যুষিত গ্রাম রাস্তাপালকে বেছে নিয়েছিলেন সেবা সংঘের কিছু নিবেদিত কর্মী।

প্রস্তাব শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মহারাওয়াল। বুনো ভীলের দল চিরটাকাল মুখ বুজে রাজপুতদের সেবা করে এসেছে। রাজার চাবুককে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছে ঈশ্বরের প্রসাদের মতো। যে সব সরল চোখে, ঈশ্বর আর মহারাওয়াল সমার্থক ছিল, সেই চোখ ফোটাতে চায় ওই উটকো আপদগুলো? তারপর কি আর ওরা আগের মতো মান্য করবে মহারাওয়ালকে?

না না, এসব কিছুতেই চলতে পারে না। অতএব তিনি ফতোয়া জারি করলেন – এ রাজ্যেতে নাহি রবে শিক্ষা সদাচার... হাঃ হাঃ হাঃ।

থামানো গেল না কিন্তু! রাজা জমি না দিলে কী হবে, এগিয়ে এলেন নানাভাই কণ্ঠ নামের এক মহাপ্রাণ। নিজের বাড়ি তিনি খুলে দিলেন স্কুলের জন্য। শিক্ষকেরও অভাব হলো না, জানিস? এগিয়ে এলেন সেঙ্গাভাই। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – রাজদণ্ডের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও জুটে গেল!”

তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল – “তারপর? ওরা পড়তে পারল?”

মণিদি বোধহয় শুনতে পেল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত ক্লাসরুম।

[২]

ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ক’ লিখতেই...

“ক সে কলম” – নানা স্বরের ঐকতানে ক্লাসরুমটা গমগম করে ওঠে। নানান বয়েসের মানুষের ভিড় সেখানে। খস খস... পেনসিলের প্রবল ঘষায় খাতা যায় যায়। তবু ক লিখতে পারার আনন্দে কালো মুখগুলি বড় উজ্জ্বল। আর সেই আলোয় উদ্ভাসিত সেঙ্গাভাইয়ের মুখ। শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছেন তিনি –

“ইয়ে কলম সামহালকে রখনা। ইসকে তাকত..

জানো তো, এই কলমের জোর রাজার দণ্ড, পুলিশের ডাণ্ডার চেয়েও শক্তিশালী। মনে রেখ, শিক্ষাই শক্তির উৎস। যেদিন নিজেদের চিনতে শিখবে, সেদিন তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহারাওয়ালও নয়”।

“রাম, রাম। এইসা মত বোলিয়ে” – বর্ষীয়ান ছাত্রটির মুখে চোখে ভয় – মহারাওয়াল যে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ!

“রাজাকে খিলাফ কুছ শুননা ভী পাপ হ্যায়।”

সেঙ্গাভাইয়ের চোখদুটো একবার জ্বলে উঠেই শান্ত হয়ে যায়। শুধু এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যেই, এই দুর্মর শক্তিশালী ভীলজাতি যুগ যুগ ধরে রাজপুত শাসকের অত্যাচার সয়ে আসছে নির্বিবাদে। আজও ডুংগারপুরের ভীলেরা চরমভাবে নির্যাতিত।

স্বাধীনতা দরজায় কড়া নাড়ছে – মাসকয়েকের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। একথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ যদি স্বাধীনতার অর্থই না বোঝে, তাহলে তাদের অধীনতার শিকল কখনো ঘুচবে না। শিকলের মালিকানার হাতবদল ঘটবে শুধু। তাই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনার যেটি প্রথম ধাপ। এই রাস্তাপাল গ্রামে সেবা সংঘের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার কারণ এটাই।

সেঙ্গাভাই বলছিলেন –

“আজ পড়া থাক। একটা গল্প শোন বরং।

এই বনে, পাহাড়ে একসময় শুধু ভীলেরা থাকত। তাদের ছিল – বনের শিকার, খেতির ফসল, চাঁদের আলোয় ঢোলথালের দ্রিমি দ্রিমি, কৌড়ির সুরে ছেলেমেয়েদের নাচ।

প্রায় পাঁচশ বছর আগে গিহ্লোট বংশের এক নির্বাসিত রাজকুমার, তার কিছু অনুচরকে নিয়ে, ভীলরাজা ডুংগারিয়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর একসময় সেই বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে, সে নিজেই রাজা হয়ে বসল। সেই ডুংগারিয়ার নাম থেকেই তোমাদের এই রাজ্য - ডুংগারপুর!’

বছর বারোর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায় এইবার – ‘এই গিহ্লোট বংশের রাজা নাগাদিত্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ভীলবিদ্রোহ হয়েছিল না? পুরো রাজবংশ ভীলেদের রোষে ছারখার হয়েছিল। উয়োলোগ দেওতা নেহি হ্যায় বাপু। ইনসান হ্যায়। অগর গলতি করে তো...’

সেঙ্গাভাই সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন। আগে বলা কাহিনি ঠিক মনে রেখেছে কালিবাঈ। বড় তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই মেয়েটি।

চাষী বাপমায়ের মেয়ে। তার বাবার বড় শখ মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেঙ্গাভাইধের কাছে আসা দিদিমণিদের মতো। এমন অপমানিত দাসের জীবন হবে না তার।

পড়া এগিয়ে চলছিল – নতুন করে নিজেদের চিনতে শিখছিল সরল মানুষগুলো। ক সে কলম থেকে শুরু করে ইতিহাস, ভূগোল, যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর হয়ে আসা অত্যাচারের আর তার প্রতিবাদের গল্প...


[৩]

মণিদি বলে চলছিল এক ঘোরের মধ্যে –

“ঠিক এখান থেকেই বিপদের আঁচ পাচ্ছিলেন মহারাওয়াল। স্বাধীনতার সঙ্গে সিংহাসনের মতো ভীলদের নিঃশর্ত আনুগত্যও যদি হারাতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিপত্তিরও অবসান ঘটবে! এই জন্যেই পাঠশালা স্থাপনায় এত আপত্তি ছিল ডুঙ্গারপুরের অধিপতি মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংহের। তবু কী অসীম দুঃসাহস ওই নানাভাই কণ্ঠের! সে নিজের বাড়ি পাঠশালার জন্য দান করেছে! এর একটা ব্যবস্থা...”

দিয়ার গলা ভারি হয়ে উঠেছে উৎকণ্ঠায় – “ওদের উপর খুব অত্যাচার করল ওই মহারাওয়াল?”

মণিদি কেমন যেন হাসল – “মহারাওয়াল ভয় পেয়েছিলেন, বুঝলি। আসলে রাজপুত আর কজন? ওঁর সব সৈন্য বা রক্ষকদের বেশিরভাগই তো ভীল। তাদের বাড়ির অনেকেই যাচ্ছে ওই স্কুলে। কে জানে কী শিখে আসছে সেখান থেকে! তাদের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না তিনি। যদি তারা ঘুরে দাঁড়ায়? না না, এত বড় ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং খবর পাঠালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ইংরেজ তখন জানে এবার তাদের ছেড়ে যেতে হবে এই আরাম আয়েশ আর দৌলত। তারাও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভ উগরে দেবার এই সুযোগটা তারা ছাড়ল না।

তারিখ ছিল - ১৯৪৭ এর ১৯শে জুন। পুলিসবাহিনী এলো পাঠশালা বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ালেন নানাভাই আর সেঙ্গাভাই। পুলিশ এটাই চাইছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর বীরত্ব দেখাবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নির্বিচার লাঠি চলল। নানাভাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। সেঙ্গাভাই মারের চোটে জ্ঞান হারালেন। গ্রামের লোককে ভালোমতো শিক্ষা দিতে সেঙ্গাভাইয়ের আহত অচেতন দেহকে গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল তারা। গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ব্রিটিশের পুলিস। আর ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় পাথর হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল সারা গ্রামের মানুষজন। রাওয়ালের বিরুদ্ধে, পুলিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই যে এই অসহায় মানুষগুলির যুগ যুগ বাহিত রক্তের শিক্ষা! তারা অঝোরে কাঁদছিল, যেমন করে কেঁদে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

সেই সময়, তখন মাঠে কাজ করছিল কালিবাঈ। গোলমাল শুনে কাস্তে হাতেই দৌড়ে এসেছিল। তার গুরুকে ওরা...

‘বাপজিইইই’ – আর্ত চিৎকার করে কাস্তে হাতেই প্রাণপণে দৌড়াল কালিবাঈ। অন্ধ আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল পুরুষানুক্রমে বাহিত সংস্কার। পুলিস মজা দেখার জন্য গাড়ি থামাতেই, মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দড়ি কেটে ফেলল এক কোপে। তাই দেখে চটক ভাঙল অন্য মেয়েদেরও। তার দল বেঁধে এগিয়ে এল সেঙ্গাভাইয়ের পরিচর্যায়। কালিবাঈ জল আনছিল মুখে দেবার জন্যে।

এত সাহস, পুলিসের কাজে, মজা দেখানোয় বাধা? ক্ষিপ্ত পুলিস গুলি চালাল। রক্তে স্নান করা দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালিবাঈয়ের আনা জলে মিশে গেল তারই রক্তের ধারা। আর সেই রক্ত তুফান তুলল জমে থাকা অসহায় মানুষগুলোর মনে।

তাদের হতবাক আতঙ্ক ক্ষোভে ফেটে পড়ল এতক্ষণে। শত্রুহননের ডাক দিয়ে, মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে। সংকেত পেয়ে, ভীলেরা দলে দলে তাদের তীরধনুক, বর্শা নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। পালিয়ে বাঁচল পুলিসবাহিনী। সব ভুললেও মারুর ডাক ভোলেনি তারা। পিছু হটলেন রাওয়ালও”।

তিন্নি শুধু বলল – “তারপর?”

মনিদি বলল – “ হ্যাঁ, তারও পর থাকে বইকি। এরপর আরও বড় বাহিনী এসেছিল রাস্তাপালে। ভীলদের গ্রামটাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছিল। কিন্তু কী জানিস, আলো যখন জ্বলে তখন কিছুতেই অন্ধকার জিততে পারে না। এ লড়াই সেখানেই থামল না। অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলেন লক্ষ্মণ সিং। ভীলদের পড়াশোনার অধিকার মেনে নিতে হযেছিল তাঁকে”।

মিতু হাঁটুতে মুখ রেখে শুনছিল এতক্ষণ। এবার মুখ তুলল। জলে ভেজা চোখ না মুছেই, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল – “ডুঙ্গারপুর মনে রেখেছে কালিবাঈকে?”

মণিদি বলল – শহীদের বলিদান বৃথা যায় না রে মিতু। ডুঙ্গারপুর তাকে শুধু মনে রাখেনি, প্রাণে রেখেছে তার শিক্ষার আর্তিকে। গুরুর জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য শহীদ হওয়া সেই মেয়ে বেঁচে রইল ডুঙ্গারপুরের মানুষের ভাবনায়, কাজে। সেখানে আজ ৮৪.৩৮% জন স্বাক্ষর”।

লম্বা শ্বাস ছাড়ল মেয়ের দল – “আমরাও আর পড়ায়, কাজে ফাঁকি দেব না মণিদি। যেটা ঠিক বলে জানব, তার জন্য লড়ব”।

মণিদি হাসল – “বিপ্লব আলো ছড়ায় যুগে যুগে। কখনো হারিয়ে যায় না, মনে রাখিস।”

********

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর উদযাপনে মূর্তি গড়ছিলেন ভাস্কর। একহাতে কাস্তে, অপর হাতে বই দিয়ে কালিবাঈয়ের মুখে তৃপ্তির হাসিটি বড় যত্ন করে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলো।
0

পথে প্রান্তরে - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার

Posted in






ভীমা শঙ্কর

গল্প বলছে এই শিবের সাথে ত্রিপুরাসুরের যুদ্ধ হয়েছিল। দুজন ডাকিনী যোগিনী শিবকে জিততে সাহায্য করেছিল। ভাবো একবার গল্পের গরু কৈলাসে উঠে গেল! শিবের সাহায্য লাগছে!! বেশ, লাগছে। বিশ্বাসে মিলায়ে ----- তাই তাদের দুজনেরও মন্দির আছে। এখানে।

ভীমা নদীর খাতে বলে ভীমাশঙ্কর। বলছে জ্যোতিঃ লিঙ্গ।

আচ্ছা, এই জ্যোতিঃ লিঙ্গ সব কেন ভারতে? শিব কি সবার শিব নয়?

ধর্মস্থান। ব্যবসার সুযোগ অনেকরকম। ভি আই পি দর্শন ৫০০ টাকা। রুদ্রাভিষেক ২১০০ টাকা। লোকজন আসে। থাকে। হোটেল লাগবে, আছে। খাওয়াদাওয়া ? আছে। তবে কিনা নিরামিষ। সব ধর্মস্থানের চরিত্র একরকম। কোথাও ভিড় বেশি, কোথাও কম। আমি খুব একটা বিশ্বাসী লোক নই। আমার দেখার চোখটা এই রকমই।তবে এখানে একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে। এখানে ছোঁয়া যায় লিঙ্গ! ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা। ২৩০ সিঁড়ি ওঠানামা আছে।

বেরিয়ে পড়ার আগে এই টুকুই খবর জোগাড় করা গেল। টান টা অনেকটা রাস্তা গাড়িতে যাওয়ার। তাও আধা পাহাড়ি রাস্তা। চলো বেড়িয়ে পড়া যাক।

প্রতিযোগিতা ছিল। আরো একটা নাম ঘোরাফেরা করছিল ভান্ডারধারা। ওটাকে চেক করার ভার পড়ল আমার ওপর। আসলে আমাদের দুজনেরই তখন সময়ের অভাব। বেড়ানোর ছক দায়সারা ভাবে হয় না। অথচ তাই হচ্ছে দেখ।

ভান্ডারধারা ইগতপুরির কাছে একটা রিসোর্ট গ্রাম। এই ইগতপুরি নামটার সাথে জড়িয়ে আছে স্মৃতির গল্প। আমাদের মামাবাড়ি ছিল বম্বেতে। মানে মার বাপের বাড়ি। বছরে, দু বছরে একবার দুবার বম্বে যাওয়া হত। তখনই শোনা নাম ইগতপুরি। সেই ছোটবেলায়। মা আগে থেকেই বলে দিত “ইগতপুরি আসছে” আমরা তিন ভাই (আর একভাই ছোট কিনা, মনে নেই) ঠেলাঠেলি করে জালনার পাশে গিয়ে বসতাম। কাচ ফেলা থাকত। তখন কয়লার ইঞ্জিন ছিল। কাচ খোলা থাকলে গুঁড়ো কয়লা আসত ভেতরে। মানুষ থেকে বিছানা পত্তর সব কালো করে দিত। তখন একটা ব্যাপার ছিল , সঙ্গে হোল্ডোল (হোলড অল) থাকত। তাতে থাকত বিছানা পত্তর আরো কত কি!! ইগতপুরি আমাদের কাছে খুব আদরের। কারন এবার গুহা আসবে পর পর। পশ্চিম ঘাট পর্বত মালা। আমরা পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ছি। আর এবার ইঞ্জিন বদল হবে। কয়লার ইঞ্জিন বাদ, ডিজেল ইঞ্জিন লাগবে। জালনার কাচ খোলা যাবে।

ভান্ডারধারা যেতে হলে মুম্বাই থেকে সোজাসুজি যাওয়া যায়, ১৮৫ কিমি। গাড়িতে যাওয়াই যায়। প্রাভারা নদির পাড়ে, একদম প্রকৃতির কোলে এই গ্রাম। লেক, ঝর্না হাত বাড়ালেই। উইলসন বাঁধ, আরথার লেক, রান্ধা ঝোরা। ট্যুরিস্ট তো আসবেই। আমরাও যেতে পারি, যেতেই পারি। থাকব কোথায়? দেখি, থাকার জায়গা খুঁজি। পুরুষওয়াড়ি বলে একটা জায়গায় নাকি ‘জোনাকি মেলা’ আছে। সত্যি? ওখানে এল ই ডি র উৎপাত থাকবে না তো? যাব তাহলে। দেখতেই হবে। জোনাকির আলোয় মেলা, নাকি মেলাই জোনাকি আছে ওখানে?

বলছে দু দুটো গড় আছে। রতনগড় আর হরিশ্চন্দ্রগড়। ও হরি, এতো পাহাড় চড়ার জায়গা! আমরা পারব কি? পাহাড় চড়তেই হবে এমন কথা নেই। দেখিই না খাওয়া থাকার কি ব্যবস্থা। ওখানে। ”কালসুবাই” ট্রেক শুরু হয়। সাহ্যাদ্রি পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চুড়া এটাই। দেখি, দেখি দেখাই যাক না।

ব্যাপারটা না নিতে পারছি, না ফেলতে পারছি। দেখি দেখি হোটেল দেখি।

একটাও পছন্দ হচ্ছে না। সব হোটেল ট্রেকারদের সুবিধে বুঝে করা। তাও না হয় মানিয়ে নেওয়া যায়। ওয়াশরুম ছবিতেই যা দেখাচ্ছে, আসলে কি হবে? ভাবাই যাচ্ছে না। হাতে সময় নেই একদম। যেতে হলে আজই বুক করতে হবে। আমাদের যাত্রা পরশু। টেনশন হচ্ছে ।

ফোন এল। আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা ভীমাশঙ্কর যাচ্ছি। হোটেল বুক হয়ে গেছে। আমি একাই ডিসিশন নিলাম। টাকা দিয়ে দিয়েছি। ২৩, ২৪। ২২আমার বাড়ি চলে আসবেন। আমরা সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়ব। গাড়িও ঠিক। ইনোভা। আমরা চার জন। আরাম করে যাবো।

বাঁচলাম।
0

কবিতা - গৌতম দাস

Posted in



















দিকনির্দেশ

এখানে আর আমার নাম কেউ মুখে আনে না, সময়, সে তো আসলে চলে বিপরীত অপেক্ষায়, হারুনের ছেলে বন্ধুদের সাথে কাজের খোঁজে বিদেশ গিয়ে ফিরলো না আর

হারুন রোজ তাই অপেক্ষায় থাকে একটি চিঠির, আর ঐ যে মেয়েটি সামনের শনিবার বয়-ফ্রেন্ডকে বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে বলে বাসের হাতল ধরতে ছুটেছিল

সে-ও আর ফিরে আসেনি বাসস্টপে, ছাপোষা মধ্য বয়স্ক মানুষটিও চায়ের ভাড় বেঞ্চে রেখে সেই যে সেদিন রাস্তা পার করে সিগারেট কিনতে গেলো

আজও সে ফিরে আসলো না...

আসলে বড় অপেক্ষার শহর এই শহর, সন্ধে নামলে তাই এখানে কাঁধ জড়িয়ে বাতাসের উৎসব শুরু হয়, বুড়ো ক্ল্যারিনেটবাদকের টুপি তখন উপচে ওঠে করুণায়, পাতাল রেলের সিঁড়ির শেষে ফিসফিস করে গল্পে মেতে ওঠে দুই অসফল মানুষ

ছদ্মবেশী শহর তাদের কথা শুনবে বলে কান পাতে তখন

আর আমি বাড়ি ফেরার দিকনির্দেশ যেন হারিয়ে ফেলি

শুধু মনে পড়ে যেদিকেই হাঁটি, এ অপেক্ষার শেষ নেই, সাবধানে হাঁটি

জানতে চাইলে কাউকে বলি না কতদূর আসলে যেতে চাই...

বাড়ি ফেরার আগে মৃত্যুর পরেরটুকু শুধু যেন লিখে যেতে চাই...







প্রতিশ্রুতি

আলো জ্বালানো নিষেধ, মেঘে মেঘে ঢেকে গেছে সব তারা, ধুলোবালি মনে স্মৃতিকথা নিয়ে বসে আছি ছাদের কিনারে

নাবিক তো ঘরে ফেরে এসময়ই, দুয়ার খুলে দেয় তার নারী, তবু সমুদ্র আর চাঁদ আজ আত্মহত্যার স্বপ্ন দেখে

যেমন নি:শর্ত কবিতার মত তুমি আজও ভেসে যাও জোৎস্না হয়ে, পাহাড়ের বুকে বদলাও বারবার তোমার গতিপথ

প্রতিশ্রুতিগুলি চিরদিন শুধু থেকে যায়

গোপন কথার মতই সৎ







মিথ্যে

মনে মনে দৃশ্যপট এভাবেই সাজিয়েছি

পথ চলতি এ শহরের কোনো এক ব্যস্ত অথবা অব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ করেই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে একদিন, দূর থেকে তোমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ব আর কাছে এসে চোখ তুলে আমায় দেখে চমকে উঠবে তুমি, ততক্ষণে আমার ধুকপুক করা বুকের ওঠানামা সামলে খুব আলতো করে তোমায় জিজ্ঞাসা করব, কেমন আছ, ঈষৎ ঘাড় নেড়ে সেকথার জবাব দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুমি জানতে চাইবে কবে চশমা নিলাম, ছেলে কোন ক্লাসে পড়ছে, বৌকে নিয়ে গতবার শীতে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলাম কি না, আমিও জেনে নেব তোমার মেয়ে বনজোৎস্নার কথা, তোমার স্বামীর কথা, অলস দুপুরে এখনও কি তুমি মাঝে মাঝে রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকো, এইসব ...

আসলে এসব এক দৃশ্যকল্প মাত্র অথবা এক অস্থির অস্থিরতা যা শুধু আমাকেই ছুঁয়ে থাকে অথবা বলতে পারো গলে পড়া মোমের নীচের বাসনা-রুদ্ধ মুখ

কিংবা মেনে নিতে পারো সেই বিশ্বাস

বিন্দুর ওপর যে কোনো সময় আমি জেগে উঠতে পারি, জেগে উঠতে পারি এক সৌধ হয়ে অথবা সংকেত ছাড়াই চলে যেতে পারি কখনো বিস্মৃতির আড়ালে...

তস্কর বাতাস শুধু তখন ছুঁয়ে থাকবে তোমায়, ছুঁয়ে থাকবে আমার আকাঙ্ক্ষা হয়ে...

একদিম তুমি একে বিভ্রম বলেছিলে

কিন্তু সত্যি বলো তো, কখনো কি মিথ্যে বলতে পেরেছিলে...
0

কবিতা - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in





আজকে মে-দিন।
সামনে টান টান পড়ে থাকা ঝিমধরা পথ তোমায় ডাকছে!
পথের উপর লেপ্টে থাকা ম্লান রোদ্দুরের-আলো ইশারায় ঈঙ্গিতে তোমায় ডাকছে!
এই পথ চলে গেছে লড়াই-এর ময়দানে,
এই পথ শেষ হয়েছে ক্ষুধার্ত শিবিরের পরিখায়।
এই পথ ছুটে গেছে মেহনতী মানুষের ইচ্ছের দিকে,
এই পথ মিশে গেছে পাঠশালার অনুভবে, ভালবাসায়।

গত কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে,
মানুষের ভালবাসা উজ্জ্বল বৃষ্টির মতো
ধুইয়ে দিয়েছে মে-দিনের এই অনন্ত পথ।

এখনও পথে ছড়ানো কিছু লাল ফুল –
সেই সব রক্তাক্ত ইতিহাসের চিহ্ন, যা আমরা ভুলি নি।
এখনও পথে ছড়ানো কিছু হলুদ ফুল –
মেহনতী আকাঙ্ক্ষার সেইসব পীতাভ চিহ্ন –
যার জন্যে আমরা যুগ যুগ লড়াই করেছি।
এই পথে কিছু সাদা ফুল এখনও ছড়ানো বাকী
যা আমাদের নিয়ে যাবে আগামীর দিকে।

আজকে মে-দিন।
সামনের অনন্ত পথ প্রতীক্ষায় ঝিম মেরে আছে,
মেহনতী মানুষের মন বর্ণময় রামধনু, কিম্বা বাঁকা কাস্তে।
একটা অনন্ত পথের সামনে দাঁড়িয়ে আজকের মে-দিনটা হেসে হেসে পেপার বেচছে!

3

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in



















হালকা সাদা নর্তকী
ভেসে বেড়াচ্ছিল
সকাল থেকে

বাতাসের মোহে ও আনুকূল্যে
আকাশের উপরের দিকে
আকাশ জুড়ে

নিজের ধীরে গতি মেনে
সমুদ্রের উপরে ডানা মেলে
জল ছুঁয়ে যায়

তীরের কালো কালো পাথরগুলি
ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে
শুয়ে আছে
নর্তকীর সামনে

একের পর এক
একের থেকে এক আলাদা ঢেউগুলি
কোঁকড়ানো ঝালর লাগানো অলঙ্কারের
মতো
নর্তকীর পা ছুঁয়ে যায়

ঘূর্ণিঝড়ের তির্যক বাতাসে
জলের ছিটেয়
নিজেকে ভিজিয়ে নিল
ঠোঁট রাখে
ঢেউ অলঙ্কারের উপরে

জল স্পর্শ করে
পাগুলি ভিজিয়ে নেয়
নর্তকীর নরম,
অবরোহী সিদ্ধান্তে

জল ফ্যাকেশে হয়
নর্তকীর পায়ের রঙে,
গরিমায়

ফ্যাকেশে জল ঢেউ ভাঙতে শুরু
করে
ভাঙতে ভাঙতে ঢেউ শান্ত হয়ে যায়

আরেক ঢেউের নাচনীতে
নর্তকী কাঁপতে কাঁপতে
নিজের ঠোঁট বেঁকিয়ে
জলের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে

ওর শরীর জুড়ে
সাদা রেশমি পোশাক
জলের শব্দ নর্তকীর কানে আসে
জলের ঝাপটায় রেশমি পোশাক ভিজতে থাকে

এখানে এখন এর থেকে
সুন্দর কিছু নেই

নর্তকীর সুখের শরীরে
অর্থহীন আগুনে, দাবানলে
হৃদয় কাঁপিয়ে
নর্তকী ভেসে যায় আকাশে
বাতাসের মোহে।
0

কবিতা - কুমকুম বৈদ্য

Posted in





রোদ বৃষ্টির মিষ্টি আলাপ খুব জমেছে
ভিজবে বলে বর্ষাতি আজ অপেক্ষাতে
পদ্ম পাতা হীরের লোভে বুক চিতিয়ে
বেলের কুঁড়ি মেলবে বলে গন্ধ ছড়ায়

পায়ের নিচে গরম বালির মরীচিকা
গাছের ছায়া স্বপ্ন দেখে শীতলপাটি
কৃষচূড়া আকাশ জুড়ে লালচে ছড়ায়
বারান্দাতে রোদ ছুঁয়েছে জলের বাটি

জ্বলব বলে হওয়ার নিচে দাঁড়িয়েছিলাম
সূর্য কি আর তোমার মত রাগতে পারে?
নিবিয়ে দিলো ছটাক মেঘের আভাস এসে
আমিও তাই তপ্ত দিনে ডিঙা ভাসাই

গরম হাওয়া আজ ছুঁয়েছে দেশের মাটি
ছোয়াঁচ লেগে পাশের বাড়ির তপ্ত চুলা
এসব বুঝি গরম দিনের তপ্ত দাওয়াই
এসব ছেড়ে আমরা বরং দাওয়ায় জুড়াই
0

কবিতা - ইন্দ্রাণী সরকার

Posted in






ড্যান্ডিলায়নের পাপড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কদমের রেণু ঘাসের ওপর ঝরে পড়ে রোদেলা আকাশে মেঘদের নৌকো ভেসে চলে পাহাড়ের মাথায় সবুজ আঁকিবুঁকি তেরছা আলো ঝুঁকে আছে দোরের আনাগোনায় দূরে একটি ফড়িং পাতার চৌখুপিতে উঁকিঝুঁকি মারে বনশালিক কিছু মাথা নাড়িয়ে বচসায় রত ছবির মত বাড়িগুলি নদীর ওপারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে জলে কিছু নৌকো অল্প হাওয়ায় ঢেউয়ের দোলায় কচিপাতার ফাঁক দিয়ে উড়ে যায় রঙিন প্রজাপতিদের পাখা ।



0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







সার্ডিন মাছের ঝাল

সার্ডিন মাছ আঁশ ছাড়িয়ে পেট পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে হবে। কড়াইয়ে তেল গরম করে, বেশ সময় নিয়ে ভাজতে হবে মাছগুলো। মাছ ভাজা তেল সরিয়ে, কড়াইয়ে আবার তেল নিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মিনিট দুয়েক ভেজে, জল ঢেলে দিতে হবে। পরিমান মতো কাসুন্দি ও পোস্তবাটা মিশিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে রাখতে হবে। জল ফুটে উঠলে, ওই পেস্ট ঢেলে দিয়ে আবার ফুটে উঠলে ভেজে রাখা মাছগুলি দিয়ে নুন, ঝাল চেখে নিয়ে, ঝোল একটু গাঢ় হলেই নামিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন।

কাসুন্দি না দিয়ে সর্ষেবাটা দিয়েও করা যায়। সার্ডিন কিন্তু খুব নরম মাছ, কাটার সময়ে বা ঝোলে দিয়ে ফোটানোর সময়ে তাই সাবধানে করতে হবে। পেটের সব ফেলে পরিষ্কার করে নেওয়াই ভালো, কারণ পেটে প্রচুর কাদামাটি থাকতে পারে।



0

সম্পাদকীয়

Posted in

































১৩৪৮ সনের পয়লা বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ আশি ছুঁইছুঁই। কবির শেষ জন্মোৎসব পালনের অনুষ্ঠান। ক্ষিতিমোহন সেন পাঠ করলেন কবির লিখিত এক ভাষণ। 'সভ্যতার সংকট' শিরোনামের সেই প্রবন্ধের উৎসারণ সামগ্রিক এক হতাশা থেকে। যা কিছু শোভন, সুন্দর, ন্যায়ানুগ, তার সর্বাঙ্গে যেন দুর্দশার গ্রহণ! তিনি লিখলেন, 'প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে!'

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চুরাশি বছর পরে আমরা আজ যে সামাজিক পরিমন্ডলে আবদ্ধ, সেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলি কি একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করা হয়ে থাকলেও এমন এক যুগমানবের কলম-নিঃসৃত মনে হয় না, যিনি আজকের দিনটি স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন? অথচ সুন্দরের পূজা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।

বেশি নয়, মাত্র আটমাস আগের একটি ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল নগরজীবন। কর্তব্যরত একজন তরুণী-চিকিৎসক ধর্ষিত এবং খুন হয়েছিলেন। ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটি থেকে জল গড়িয়েছিল অনেকদূর। বিক্ষোভের আঁচ পৌঁছে গিয়েছিল এক মহাদেশ থেকে অন্যত্র। এক যুগেরও বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া 'নির্ভয়ার স্মৃতি' এখনও বহু মানুষের মনে অমলিন। কিন্তু যে 'রিপুর প্রবর্তনায়' একের পর এক ঘটে চলেছে মানবতার এই বলাৎকার, তাকে বশে আনা গেছে কি? যাবে কোনওদিন? আপাতভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জটিল নানান অনুষঙ্গ। জিন যার অন্যতম। একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গেই বিশেষ এই রিপুটিকে বশে আনার বিষয়টি সম্পর্কিত বলে ভাবা মানবসমাজের পরিচায়ক।

চারপাশের লক্ষণগুলি কিন্তু অন্য ভবিষ্যত নির্দেশ করে। মহারাষ্ট্রের অম্বাজোগাই শহরে একজন মহিলা আইনজীবী প্রকাশ্য, এক বর্বর শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলেন। দিল্লির অনতি দূরত্বে আইসিসিউ- এর ঘেরাটোপের মধ্যে ধর্ষিতা হলেন এক এয়ারহোস্টেস আর আমাদের এই বঙ্গে কী ঘটল? প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রথমে পাঁচ লক্ষ টাকার প্রতারণা তারপর অভিযোগ জানানোর ফলে সেই তরুণীকে ধর্ষণ!

এ কোন সমাজের অন্তর্গত আমরা? যা কিছু নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল, তার সবকিছুই ভূলুণ্ঠিত। আর কি কখনও চেতনা ফিরবে? সামাজিক ন্যায় কি কখনও প্রতিটি প্রত্যন্তবাসীর নাগালে আসবে? কোনওদিন কি আমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে কাটিয়ে উঠতে পারব রিপুর তমসা, দাঁড়াতে পারব নতুন এক ভোরের সামনাসামনি?

সুস্থ থাকুন। ন্যায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in






তারপর মানুষ নিজের কাছে ফেরে। অনেক অনেক দিন পেরিয়ে, বছর পেরিয়ে, শত্রু- মিত্র ভেঙে ফেরে। সময় তাকে অনেক কিছু দেয়। অনেককিছু নেয় সে সময়ের কাছ থেকে। ধার করে। পরে ফেরত দেবে ভাবে। জল-ঝড়-বাতাসের ঝাপট। খোলা মাঠ; বদ্ধ দরজা। রোমাঞ্চ, শিহরণ। মান-অপমান। সময় কেড়েও নেয় প্রচুর। ওইযে ছিল নির্মল একটা মন; ভালোলাগার একটা পৃথিবী; রোমাঞ্চ মণ্ডিত একটা চিলেকোঠা--- হারিয়ে যাওয়া সেই চাবি। কাকে বলবে এইসব গাল-গল্প! কাকে শোনাবে একঘেঁয়েমির চিত্র! সবাই যে আজ একরকম, প্রৌঢ়ত্বের মন নিয়ে হাঁটছে। অনেক কিছু জেনে গেছে এই অজানার চেতনা। তার কাছে যে আজ, আলো বাতাসের সবটুকু রিদম জানা। সান্দ্র বিকেলের হাওয়ায় ততক্ষণে শ্রান্ত অবসন্ন সেই মন, হৃদয়। অথচ, নির্জন হয়েছে সে; শক্ত হয়েছে আরও। ঝুরো ঝুরো বালির প্রাচীরে লেগেছে যেন সিমেন্টের ধারালো প্রলেপ। কিন্তু সে নিঃসঙ্গ, একাকী। সমস্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে শহরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে-- এই শহর আবিষ্কারের নয়; নতুনের নয়; নাকি রোমাঞ্চকর শিহরণকারী। তখন সে হয়ে পড়ে আরও বিধ্বস্ত। একা। নির্জন। পৃথিবীর এই নিঃসঙ্গতম মানুষটি কী ভাবে তখন! আলো অন্ধকার ডিঙিয়ে কীভাবে তুলে আনা যাবে আলোচনার পর্ব! কীভাবে নিজেকে ভাসানো যাবে আবার সেই নতুনের স্রোতে! একে একে খুলে রাখা বর্ম পরে নিয়ে আবার যদি ঝাঁপ দিতে পারা যেত মারিয়ানার খাদে! যদি এই দমবন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার আগে খোলা আকাশের স্পর্শ আবার আরেকবার পাওয়া যেত যদি! আর তখনই সে খুঁজতে বসে নিজেকে। যুদ্ধ করে। প্রাণপণে ফিরিয়ে আনতে চায় সেই দুনিয়াটিকে। আর তখন আবার আলো-বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। অন্ধকার এবং ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে ভাব জমায়। জানলার ফাঁক দিয়ে খোঁজে নীলনদের বিস্তৃত উপত্যকা।

"The man spoke little. This is the way of those who live alone, but one felt that
he was sure of himself, and confident in his assurance. That was unexpected in
this barren country. He lived, not in a cabin, but in a real house built of stone
that bore plain evidence of how his own efforts had reclaimed the ruin he had
found there on his arrival. His roof was strong and sound. The wind on its tiles
made the sound of the sea upon its shore"

ঠিক এরকমই, জাঁ গিয়োনো ফ্রাঁস লেরক নিজেকে খুঁজেছিলেন। তার আগের সেই জীবন্ত পৃথিবী-- যে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, জল-ক্ষুধা-আশ্রয় দিয়েছিল। মেষ পালকের গানে ভরে উঠেছিল জীবন। তার বহুবছর পরে, যুদ্ধ হিংস্র পৃথিবী ভেঙে একটা নিঃসঙ্গ লোক প্রান্তর ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওই আশ্রয়ের খোঁজে। শান্তির আশ্রয়ে। নির্জনতার আশ্রয়ে। যেখানে সে মুখোমুখি হবে নিজের। কথা বলবে। নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে। আর এই আত্মপরীক্ষনটি চলে নির্জনে। অন্ধকারের ভিতর আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে। তখনই লেখক বসেন, পুরনো অক্ষরের কাছে। তেমন সীমিত অক্ষরমালা তাঁকে এতদিন ভ্রান্ত একটি পথের সন্ধান দিয়েছে। আর সারা টি জীবন তিনি সেই সীমিত অক্ষরের পেছন পেছন ছুটেছেন। সৃষ্টির নেশায়। আবিষ্কারের নেশায়। দিস্তার পর দিস্তা কাগজে সেই সীমিত অক্ষর নিয়ে খেলা করেছেন। নেড়েচেড়ে দেখেছেন। সাজিয়েছেন। ভেবেছেন, দারুণ একটা আবিষ্কার! সারা পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে দেখবে এই অক্ষরের ঝলকানি। কিন্তু আজ যখন সময় হয়েছে, সেই অক্ষরের কাছে ফিরে দেখেন যে আত্ম গর্বীমন খুঁজে পায় একঘেয়েমি, বিড়ম্বনা। সবকিছুই তখন ফ্যাকাশে। বহু ব্যবহৃত।

" আসলে সবই আদ্যিকালের। পৃথিবীও বদ্যিবুড়ি। শুধু কচিকাঁচারা, তরুণ-তরুণীরা প্রথম প্রথম দেখছে বলে, স্বাদ নিচ্ছে বলে তাদের চোখে জিভে সব আশ্চর্য ঠেকে। সতেরো বছরের ছেলেটি কলকাতা শহরে এসে যে রোমাঞ্চ অনুভব করবে আমি টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্কে গিয়ে তার এক কণাও পাব না। কলকাতাই আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে তার সহোদরা নগরীদের সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে, তালিম দিয়েছে। "
( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

নতুন সিলেবাস। পাঠ্যসূচি। নতুন বই। ভাবি, কি না কী লুকানো আছে তার অন্তরে। মলাট খোলার পর দেখা গেল, চর্বিতচর্বন। বুঝতে পারলাম, এই পর্বের পরে আসবে অন্য একটি পর্ব। ঠিক যেটা আমি জানি, সেও জানে। লেখকও জানেন হয়ত সেটুকু। তারপর পাঠক হিসেবে তাকে আর খোলার প্রয়োজন অনুভব করি না। কেননা, রোমাঞ্চের অভাব মানুষকে উৎসাহী করে তোলে যেমন, রোমাঞ্চের পরে পৌঁছে দেয় একটি স্থিরতায়। তখন সে তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে বসে, বর্তমান রোমাঞ্চকর অবস্থানটিকে। তাই আমরা বাস্তবে যখন কারো সঙ্গে কথা বলি, নতুন অপরিচিত ব্যক্তিটি আশ্চর্যতম অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হন আমাদের সামনে। তারপর যখন দু-চারটি কথার পরে বুঝতে পারি, আসলে আমার পূর্বে জানা ব্যক্তিটির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বর্তমান ব্যক্তিটির। তখন আমরা যত না ওই অচেনা ব্যক্তিটির মধ্যে নতুনত্বের খোঁজ করি তার অধিক মেলাতে বসি পূর্বে চেনা ব্যক্তিটির সঙ্গে। আর তখনই আমরা হাঁপিয়ে পড়ি। ক্লান্ত হই।

তা বলে কিন্তু পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই! শুধু দৃষ্টি পাল্টেছে আমার। আমি-ই পুরনো হচ্ছি পৃথিবীর কাছে। জাবালির মতো। অসহায়তার চোখ নিয়ে কোথায় খুঁজবো রোমান্সের শরীর? মন? বয়েসে না, মনে এসে ছায়াপাত করে বার্ধক্য। মনে হয় এতদিন কী করলাম! শুধুমাত্র কিছু ডিগ্রির কাগজ। অ্যাডমিশন ফি। কলেজ। ক্যাম্পাস থেকে বেরোতেই পারলেই যেন বাঁচি তখন। দমবন্ধ লাগে। হাঁপ এসে যায়। স্কুল লাইফের বন্ধুরা নেই। প্রিয় শিক্ষকেরা এখন বহুদূরের। ছাড়তে ছাড়তে হারাতে হারাতে এই বিরাট কোলাহলে। সম্বল মাত্র কয়েকটি অক্ষর। শব্দ। আর এই পুরনো অভ্যেস, মনখারাপ নিয়ে কী আর কলম চলে? "এই অবস্থায় এসে কি আর লেখালিখি করা যায়!" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় অভিজ্ঞতা। অনন্তের পৃথিবী। সময় ভেঙে মেশে মহাকালের স্রোতে। আনন্দের গতিধারা আবার বইতে শুরু করে। একে একে উঠে আসে, দেশের বাড়ি। জানলা-ভাঙা নিগমানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছুট ছুট করে কবাডির মাঠ। প্রথম চোখের ইশারা। হেরে যাওয়া নয়, পূর্ণ ব্যাগের ভারে আমি নতুন হই। সামনের দিকে তাকাই। আবার হাঁটে মানুষের আকাঙ্খার পথ।

" আমি এখন কালস্রোতের কোথায় আছি? কত মাইল উত্তরে, কত মাইল দক্ষিণে? আমার ডানদিকে কত আলোকবর্ষ? আর বাঁয়েই বা কত? অঙ্কটা বেশি জানলে বা ধারণাশক্তি বেশি থাকলে হিসেবটা কিভাবে করা যেত জানি না। আপাতত আমার ছোটো হিসেবে, আমি এই ১৯৮৮ তে, পৃথিবীতে কলকাতায় আছি। আমি পেরিয়ে এসেছি অনন্ত কাল+ ষাট বছর। আর এখনো যেতে হবে হয়তো বছর পাঁচেক+ অনন্ত কাল।" আর তখনই ঝুমঝুম করে বেজে উঠল জাদুগরের ম্যাজিক বাক্স। অনন্ত শব্দটাতেই বিশাল বড় একটা পৃথিবী যেন খুলে গেল তার রঙবেরঙের ওড়না উড়িয়ে। তখনই আবার এসে বসল কবিতার খাতা। অক্ষরের পংক্তি। " এই দৃশ্যমান এবং বেদনীয় জগৎই কবিতার বিষয়-- আধার এবং আধেয়। এতদিন আমি ওই জগতের কথা ভেবেই কাটিয়েছি। অনন্তকালকে দুইপাশে রেখে এবার সাহস করে অন্যভাবে দেখা যাক। এই প্রকাশিত জগতের ওপিঠে বা অন্তরালে নিশ্চয়ই রয়েছে অপ্রকাশিত জগৎ। যেমন চাঁদের দেখা-পিঠের আড়ালে রয়েছে তার অদেখা-পিঠ। যেমন গাছের পাতার আলো-পড়া পিঠের অন্যদিকে রয়েছে তার অন্ধকার-জমা পিঠ। এমন কি বিন্দুরও, যদি অবস্থিতি থাকে, তারও সূচিমুখের আড়ালে আছে অজানা আঘাত।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আর এখানেই মণীন্দ্র গুপ্ত খুঁজে দেন একটি অন্ধকার জগতের সকাল। যাতে অন্ধকার রাজ্যেও ভেসে উঠছে সন্ধের ইমন। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য রাগ-রাগিনী। এতদিন মনে রাখা অন্ধকার আসলে অন্ধকার নয়। বরং আশ্চর্য রহস্যময় একটা কবিতা। যার পরতে পরতে আবিষ্কারের কাপড়। ঘোমটার আড়ালে আশ্চর্য সেই রূপের ঝলক। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছবির রহস্যময়ী অবগুণ্ঠন। নির্জন অন্ধকার তাঁকে দিয়েছিল আলোর মহিমা- দ্যুতি। আর তখনই অনুভব করি, আবহমানের ধারা। নিজেকে স্নান করাই। শুদ্ধ হই।

প্রকৃতি আমাদের সত্ত্বা। আমাদের বিকাশ। আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পথের পথপ্রদর্শক। আর প্রকৃতির আপন ধারার পথই হচ্ছে নিয়ম। রীতি। ধর্ম। অনুশাসন। আধার এবং আধেয়। আর সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফেরাটাই সাধনা। প্রকৃতির সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাই ধর্ম। অজস্র ধুলোর বিন্দুর মাঝে নিজের আমিকে খোঁজা।অনন্তের খোঁজ বিপুলের খোঁজ। সেই খোঁজাটাই যখন দুর্বার হয়ে ওঠে তখনই আমরা সৃষ্টি আনন্দের খোঁজ পাই। ছুঁতে পারি তার এক দুটি আলোক স্ফুলিঙ্গ। ধন্য হই। আসলে সমস্তটাই প্রকৃতিতে বর্তমান। সমস্ত জিনিসই সাজানো আছে প্রকৃতির ঘরে। তার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। নিত্য সঙ্গে অনিত্য মিশে গেছে প্রবহমান কালে। ‘একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি’ (কঠোপনিষদ (২:২:১২))। শুধু তোমার প্রয়োজন মতো খুঁজে নাও তাকে। সাজিয়ে নাও ব্যবহার যোগ্য করে। ক্ষুদ্র আমি তখনই মেলে বিরাট আমি'র সঙ্গে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, স্পর্শের মধ্য দিয়ে এই anticlimax পথের সূচনা। বিস্তারিত দৃশ্যের মধ্য থেকে প্রসারিত হবে এইসব রোমাঞ্চকর পথের অনুভব । বোধ। জ্ঞান। এতদিন যা যা সংগ্রহ করেছ তা থেকে বানিয়ে নিতে হবে সংযোজন। তাই কবিতা বিজ্ঞানীর কথায়,

" কবির খুব প্রয়োজনীয় নিকট বন্ধু হতে পারেন নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সমুদ্রতত্ত্বের লোকেরা; ভূবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিবিদ্যার লোকেরা-- যাবতীয় অনুসন্ধিৎসু মানুষের দল। আড্ডা মারতে হয় তো এঁদের সঙ্গে। যেমন ভাব তেমনি লাভ। প্রথমোক্তদের মানুষ-ঘেঁষা পেশা ক্রমশ তাঁদের মূঢ়মতি ও হীনবুদ্ধি করতে থাকে। মনুষ্য সংশ্রব মনুষ্যত্বের পক্ষে সর্বথা ভালো নাও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্তেরা ঠিক উলটো-- মহাপ্রকৃতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে তাঁদের চেতনা উদ্ভাসিত হতে থাকে। তাঁরা খুঁজে খুঁজে যাকে পান সে তো অভিজ্ঞতা বটেই, তাছাড়া যেপথে খোঁজেন সে পথও অভিজ্ঞতায় ছাওয়া। এই অভিজ্ঞতাগুলি কবির জগতের ভূমি, আকাশ, আবহাওয়া ও স্বপ্নের মৌল।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তাই অসীমের পথে যাত্রী হতে পারেন কবিরাই। আলোকের ঝরণা ছেড়ে সহজেই নেমে যেতে পারেন মারিয়ানার গভীর খাদে। কেউ নেই। অনুসরণ অনুকরণের কোনও ধারা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় না তাঁর কাছে। তিনি খোঁজেন এবং খোঁজেন। তিনি দেখেন এবং বোঝেন। উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্য থেকে ছেঁকে তোলেন শব্দ। ধনী থেকে দরিদ্র সবাই তাঁর বন্ধু। আবার কেউ না বন্ধু নন। তাদের উপলব্ধির অভিজ্ঞতাটুকুই বন্ধু তাঁর। সৎসঙ্গের ব্যাখ্যাটা তাই এখানে যোজন বিস্তৃত। শিশুটিও তাকে দিতে পারে তার শিশুদের সন্ধান, ষোড়শী যুবতী দিতে পারে প্রথম প্রেমের ইশারা আবার মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধটি দিতে পারেন রহস্যময় পরাবাস্তবের ইঙ্গিত।

"কবিতা যার একদিক অনির্দেশ্য অনির্বচনীয়কে স্পর্শ করে আছে, সে কেমন হবে, কেমন হওয়া তার উচিত, এমন কোনও ফরমান জারি করা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু প্রারম্ভিকভাবে এটুকু বলা যায়, কম্পিউটার, গাইগার কাউন্টার, পরমাণবিক বোমা, মঙ্গল চাঁদ শুকতারায় যাবার হাউই ও জাহাজ যে সূক্ষ্ম, নিপুণ, সংবেদনশীল, নির্ভুল, প্রলয়বীর্য, অনন্তভেদী, অমোঘলক্ষ্য ধ্যানের ফল, আমাদের কবিতাকেও যেতে হবে সেই পথে। এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমি কবিতার মধ্যে কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতির লোহালক্কড় বা নাড়িভুঁড়ি বা কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ ভরে দিয়ে তাকে এক মহাপন্ডিত রোবট বানাতে চাইছি। আমি চাইছি তার আত্মা হোক অনন্তসম্ভব, আর সেই অনুযায়ী তার দেহ হোক নিখুঁতগঠন।’ ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

এই নির্বিকার যাপনের শেষে ঘরে তুলতে পারবো শব্দের মালাকে! সাজাতে পারবো! প্রকৃতির দিকে মুখ করে বলতে পারি যদি- দেখো, তোমার ঘর থেকে জিনিস এনে কীভাবে সাজিয়ে তুলেছি, অন্দরসজ্জা। "আর কবিতার শেষে, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানো বা অভাবিত মোচড় দিয়ে থামা বা এতক্ষণের সারা শরীর ভরা চাপকে অকস্মাৎ মুক্ত করে দেওয়া এইভাবে শেষ করার অর্থ নাটকীয়তা, প্রকটতা, বাদ্যকারের তেহাই মারার লোভ"। তখনই ভেঙে যাচ্ছে নিরহংকার সাধনা। লোভ আসছে; প্রতিহিংসা পরায়ন মন আসছে। পুরস্কারের লোভে নিজের স্বতন্ত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত কবি। তখন ভ্রান্ত পথ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না, " ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমরা যেখানে আছি, যেখানে ছিলাম, যেখানে থাকব তার একদিকে অনাদি, অন্যদিকে অশেষ। সব কবিতা, সব গল্প, সব জীবনেরই শুরু যেমন স্রোতের মাঝখান থেকে ধরে নিতে হয় তেমনি তার শেষও ছেড়ে দিয়ে যেতে হয় মাঝখানেই।" তবে এই যে আমি রোজ প্রত্যহ নিয়ম করে খোলা খাতার সামনে বসে থাকছি। ধরতে চাইছি অখন্ডের নিত্যতাকে! কী হবে? শুধু শুধু হাপিত্যেশ করে বসে থাকা অনন্তের দিকে মুখ করে? কিছু পাওয়া নেই? অনন্ত আমাকে ফিরিয়ে নেবে স্রোতে? আর আমি ভেসে যাবো খড়কুটোর মতো? না; তা নয়। তোমার চাওয়াটা ঠিক। পাওয়াটা নয় হয়ত। এইযে তুমি পাওয়ার জন্য চাইতে বসেছ তখনই তোমার মধ্যে অস্থিরতা আসছে। অসন্তোষ আসছে। তুমি ধ্যানমগ্ন হতে পারছ না তোমার সৃষ্টির কাছে। বাইরের কোলাহল তোমাকে ভ্রমের লোভে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ভোগের দিকে। আর তুমি তোমার ফেলে রাখা কাজ ছেড়ে উঠে যাচ্ছ শুঁড়ি মাতালের ঠেকে। ওখানে গিয়েও শান্তি নেই। তোমার ফেলে রাখা কাজ তোমাকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই থাকতে দিচ্ছে না এই নেশার পৃথিবীতে। অথচ, যেতেও পারো না তুমি। এই অস্থিরতা যখন তোমাকে ফিরিয়ে আনলো তোমার দায়বদ্ধতার কাছে, সৃষ্টির সমীপে; তখন মনে হচ্ছে শিকল লাগল পায়ে। তুমি চাইলে মুক্তি। আকাশের দিকে। পাখির মতো করে। কিংবা হয়ত যখন ফিরে এলে ফেলে রাখা কাজের কাছে, ততক্ষণে অভিমান বশত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেও। আর এই হল " অ্যান্টিক্ল্যাইম্যাক্স। কি হবে কি হবে ভেবে মন ক্রমাগত উত্তেজিত ও আকুল হতে থাকে, এবং তারপর হয়তো কিছুই ঘটে না। পাঠক শূন্যে ঝুলে থাকেন, আর তাঁর কল্পনা কাজ করতে থাকে গল্পের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে"। ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমারও আর ফেরা হয়না। সব ছেড়ে যাওয়া-রা চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু। সামনে এসে দাঁড়ায় আরও দৃশ্য। আর আমিও প্রতিটি দৃশ্যমানের কাছে তুলে ধরি আমার কবিতা; শব্দ; অক্ষর। মিলেমিশে তৈরি হয় কবিতা ভাবনা। সাদা কাগজের সামনে এসে বসি। একপাশে কোলাহল করে হেঁটে যায়, আমার বাস্তব; অন্যদিকে মৌন সাধনায় রত আমার যাপন। কোনও দ্বন্দ্ব নেই, রেশ নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে ভেবে হেঁটে যাওয়া। বসত গড়ি। মনের মধ্যে লালন বাজে। রবীন্দ্রনাথ বাজে। সুমন এসে মেশে মাঝের স্রোতে। দেখি ততক্ষণে জমে ওঠা-রা মিলিয়ে গেছে শূন্যে। আর তখনই অসংখ্য খোঁজের মধ্যে তৈরি হয় প্রবহমানের ধারা। যেন এটাই মোক্ষ নয়, এখানেই শেষ নয়। বরং অন্তিম ভেবে শুরুর খোঁজ শুরু হয় এখান থেকেই। এখান থেকেই মহাকাব্যের চলন। যুধিষ্ঠির হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে শীতল অতীত। সামনে অপার সৌন্দর্য। হাতছানি দিচ্ছে। সত্য বলে কিছু কী আদৌ! বরং এতদিনের জেনে আসা প্রিয় সত্য-রা, পদে পদে ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে। তখনই তিনি অনুভব করেন, সত্য মানে তখন এগোনো। চিরন্তন। এগোও, এগোও। এগিয়ে যাও। চরৈবতি...চরৈবতি। আমিও হাঁটি। আর ভাবি, " একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো"( রামপ্রসাদ সেন)। আর আমি চোখ খুলে নত হই, নতুন হই দৃশ্যের কাছে। এইযে অন্তিম লাইন বলে ভেবে এসেছি এতদিন, সেখানেই সংযোজিত হয় আবিষ্কারের পথ। আলোক বিন্দু। যে আমাকে পথ দেখাবে শুধু। থেমে থাকা, স্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে মেলাবে অনন্ত আবহমানতার স্রোতে।
0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



















প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সমগ্র দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে বলেছেন সাইবার জালিয়াতির বিরুদ্ধে। কোভিড পরবর্তী যুগে সাইবার ক্রাইম মহামারীর ন্যায় অত্যধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনগণ ভীত, সন্ত্রস্ত। একেকটা দিন যায় আর যারা তখনও ‘টার্গেট’ হয়নি শ্বাস ফেলে। যারা আক্রান্ত তারা প্রায় সর্বস্বান্ত।

সব সময়েই সমাজে ভাল ও মন্দ দু ধরনের মানুষ থাকে, একদল যখন কিছু ভাল কাজ করে অন্যদল তার বিপরীতে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে যখনই কোন নতুন আবিষ্কার বা পুরনোকে উন্নত করেছে তখনই অন্য এক গোষ্ঠী তাকেই সম্বল করে মানুষের ক্ষতি সাধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা পারমাণবিক ‘ফিউশন’ বা একীকরণ হোক অথবা ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের মত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। পারমাণবিক একীকরণ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার আগেই তৈরি হয়ে গেল মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক বোম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার পরীক্ষাও করা হোল, বিনা দোষে মারা গেল দেড় থেকে আড়াই লক্ষ লোক, চিরকালের মত পঙ্গু হয়ে গেল আরও বেশি এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের শরীরে সেই বিষ বহন করতে লাগল।

বৈদ্যুতিক থেকে বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় প্রবেশ করে এসে গেল কমপিউটার। কায়িক শ্রম লাঘব করে শুরু হোল নতুন এক শ্রমজীবন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পেশার অধিকারী ব্যক্তি, আদতে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এই শ্রমে ঘাম ঝরে না কিন্তু ঘুম কাড়ে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবার ও সমাজ জীবন ধাক্কা খাচ্ছে। অতিরিক্ত শ্রমে ক্লান্ত যুব সমাজকে ক্লান্তি দূর করতে নানা ভোগ্যপণ্য ও উৎকট বিনোদনে মজিয়ে দিচ্ছে। হাতের মুঠোফোনে বিরামহীন হরেক বিনোদন, শ্লীল অশ্লীলে ভেদাভেদ ঘুচে যাচ্ছে বয়সের ভেদাভেদ না মেনেই। আর্থিক বৈষম্যের শিকার সমাজ, একদলের হাতে অর্থ অফুরন্ত অন্যদের বাড়ন্ত। বাড়ছে দ্বেষ হিংসা ঘৃণা পরিবার থেকে সমাজে, বৃহত্তর সমাজে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক এই সুযোগে জাগিয়ে তুলছে মানুষের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ একাধিক প্রক্রিয়ায়, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কেও। শহরের এই ব্যধি অচিরেই ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত গ্রাম্য জীবনে। সারা পৃথিবী এক অস্থির অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে এল ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের পরিচয় নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা। ডিজিটাল পরিচয় পত্র অনেক সুবিধেজনক ও সুরক্ষিত, ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আর্থিক লেনদেন।

আধার কার্ডে প্রত্যেকের পরিচয় সরকারের ঘরে সুরক্ষিত বলা হলেও সব জায়গায় সেই সুরক্ষাকবচ খুলে দিতে হচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে ফোনের সিম, হাসপাতাল থেকে শ্মশান সর্বত্র। ওঁৎ পেতে ছিল দুষ্টু লোকেরা। ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকার ঝাঁপি নিয়ে। দুর্নীতির বাজারে বিক্রি হয়ে গেল আমাদের পরিচয়, যেন আমরাই বিক্রি হয়ে গেলাম। আর কিছু গোপন রইল না। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”, রবি ঠাকুরের গান যে এইভাবে সত্যি হয়ে উঠবে এত বছর পরে তা কি উনি জানতেন? আমতা আমতা করে সরকার একসময় স্বীকার করতে বাধ্য হোল কিছু ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরে ছাঁকনিটাই তো ফুটো। সুরক্ষিত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই হয়নি। চোর আটকাতে সদর বন্ধ, খিড়কী দরজা হাট খোলা। আমাদের সব ডেটা এখন ক্রিমিনালদের হাতে। তারা রীতিমতো অফিস চালাচ্ছে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তাদের হাতে, নিত্যনতুন ক্রাইমের ফর্মূলা লিখছে। তাদের মাথায় এমবিএ ডক্টরেট মহাজ্ঞানীজন। শলাপরামর্শ দেওয়ার শিক্ষক আছে। আছে মনস্তাত্বিকও। তাদের পরিচালনা করছে কিছু মাফিয়া যাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশাল ব্যবসা। একাধিক জায়গায়। ফাঁদ পাতা রয়েছে এ ভুবনে সর্বত্র।

এক দশকেরও আগে আমার জি-মেল সে হ্যাক করেছে বলে এক কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র আত্মীয় জানালো। পড়াকালীন অবস্থায় শিখে নিচ্ছে জালিয়াতির পাঠ। চেকপয়েন্ট গবেষণা অনুসারে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে তিরিশ শতাংশ করে সাইবার ক্রাইম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত বছর সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং অনুমান আর চার বছরে চোদ্দ ট্রিলিয়ন ডলার ছোঁবে। এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের হিসেব। এবছর দ্বিতীয় কোয়ার্টারে গড়ে প্রতি সংস্থায় প্রতি সপ্তাহে ১৬৩৬ বার আক্রমণ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি বছর তেরো শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে এবছর প্রথম চার মাসে ৭৪০,০০০ সাইবার ক্রাইম কেস নথিভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে ৮৫% অনলাইন আর্থিক জালিয়াতি। এর মধ্যে ১,১৭,২০০ টির হদিস মিলেছে। বিশ্বে এবং এশিয়াতে যথাক্রমে দশম ও ষষ্ঠ স্থানে আছে ভারত। এ বছর সংস্থা এবং ব্যক্তি উভয়েই অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রতি এক লাখে ৪৪৬ জন আক্রান্ত। তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী শহর বেঙ্গালুরুতে সব থেকে বেশি ক্রাইম নথিভুক্ত হয়।

খুব প্রচলিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হোল – অন্যের কমপিউটার বা নেটওয়ার্কে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া বা হ্যাকিং, সন্দেহজনক সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার কমপিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরিচিতি তথ্য চুরি, ইলেকট্রিসিটি ফোন বা জলের বিল নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে টাকা মেরে দেওয়া, ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে তথ্য বা টাকা পাঠাতে বলা, চাকরি পাওয়ার নাম করে টাকা হাতানো। কোনরকম ভয় দেখিয়ে যেমন পর্নোগ্রাফি, বেআইনি লটারি, মধুচক্র বা মাদক সংক্রান্ত কোনো চক্রের নাম করে তার সাথে যুক্ত থাকার খবর পুলিশ বা সিবিআই নাম নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসানো।

প্রতি ৩৭ সেকেন্ডে একজন আক্রান্ত হচ্ছে ভারতে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ষোল থেকে চব্বিশ বছরের ছেলে বা মেয়ে। মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে পঁচাত্তর বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিরা কম আক্রান্ত হলেও সহজে তাদের কব্জা করে টাকা আদায় করা যায়। প্রবীণদের প্রধান সমস্যা বয়সের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে না পারা, সহজেই পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়া বা রক্ষা করা। তারা কোনো কাগজে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড তার সাথেই লিখে রাখেন যা সবসময় বিপদের। এছাড়া ফোনে বা হোয়াটস অ্যাপে বা মেইলে এমন কোনো মেসেজ বা ছবি পাঠানো হয় এবং তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বা ডিজিটাল অ্যারেস্টের হুমকি দেওয়া হয় যার ফলে সেই ব্যক্তি সামাজিক অবমাননার সম্মুখীন হতে পারে এমন সংবাদে সহজেই আনমনা বৃদ্ধকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তাকে তার থেকে উদ্ধারের নামে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা আজকাল খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। গত বছর প্রায় লক্ষাধিক পেনশনপ্রাপক এই ধরনের জালিয়াতির শিকার।

ব্যক্তিগত স্তরে জটিল পাসওয়ার্ড বানানো (এটা প্রবীণদের পক্ষে মনে রাখা মুশকিল) এবং মাঝেমাঝে বদলে ফেলা, সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা, সফটওয়্যার আপডেট, ফায়ারওয়াল ব্যবহার, ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। সাইবার অপরাধ মোকাবিলা করার জন্য সরকারিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কাজ শুরু হয়েছে এবং পুলিশের প্রতি থানা ও হেড কোয়ার্টারে অপরাধ নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব থেকে সুবিধেজনক ব্যক্তিগত স্তরে অচেনা নম্বরে সাড়া না দেওয়া বা ভুল করে ধরলেও যখন বোঝা যাচ্ছে সন্দেহজনক তখন তিরিশ সেকেন্ডের আগেই ফোন কেটে দেওয়া। ফোনের দখল যেন কোনভাবেই অপরাধীর হাতে না চলে যায়।

যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন সদা সতর্ক থাকার কথা, মানুষের মন বিশেষত প্রবীণ মন অন্যমনস্ক, বিষাদগ্রস্ত, চিন্তাশীল, ক্লান্ত থাকেই আর সেই দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে সচেতন রাখা মুশকিল। সেই সুযোগটাই নেয় সাইবার অপরাধীরা, হাতিয়ে নেয় কষ্টোর্পাজিত লাখ লাখ টাকা। সরকার উপযুক্ত সতর্কতা ও যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে সব নাগরিককে তাদের পরিচয় ও গোপন তথ্য সর্বত্রগামী করে দিয়ে বিপদের সামনে ফেলেছে।
4

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম ৩১ জানুয়ারী ১৯৪৩। সত্তর দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তার লেখা পাঁচটা কাব্যগ্রন্থ, একটা নির্বাচিত কবিতা সংকলন, এছাড়াও রয়ে গেছিল বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতা, একটা পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়, কবির প্রকাশিত, অগ্রন্থিত বা অপ্রকাশিত কবিতাগুলোকে এক মলাটের মধ্যে ধরে রাখার। ২০২২ এর জানুয়ারীতে কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিকের সবিশেষ উৎসাহে, তাদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয় ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ত্ব, যিনি রকে আড্ডা দিচ্ছেন, বন্ধ কারখানার গেটে শ্লোগান দিচ্ছেন, বাচ্চাদের সাথে দোলনায় ঝুলছেন, রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, বোহেমিয়ান হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, কবিতা লিখছেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করছেন, গনসংগীতের মহড়ায় নীরব শ্রোতা বা গানে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, নিজের বাড়ির ছোট্ট কামরায় বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা বসাচ্ছেন, সম্পাদনা করছেন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা। এই হলেন আমাদের পার্থ দা, পার্থ বন্দোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বদলে তিনি নিজে বন্দোপাধ্যায় বানানই লিখতেন)।
প্রসঙ্গত জানাই পার্থ বন্দোপাধ্যায় জীবন কেটেছে কোলকাতার একটা সম্পন্ন অঞ্চলে, হাজরা রোডে। কিছু বামপন্থী গন আন্দোলনের সাথে প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন। সেই হিসেবেই তিনি একজন বামপন্থী ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছুকাল একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তারই এক অনুজ বন্ধু, শ্যামল ভট্টাচার্য – ‘পার্থদার রাজনীতি যত না মস্তিষ্কের ততোধিক হৃদয়ের। যত না তাত্ত্বিক গোঁড়ামির, তার চেয়ে বেশী মানবিক উদারতার’ [ সুত্র – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]।
তিনি মূলতঃ কবি হলেও নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। তার নির্মিত চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমাও তৈরী হয়েছে। জীবনের প্রথম দিকে ‘ফুল ফুটুক’ ও তার পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে ‘ম্যানিফেস্টো’ ও ‘পর্বান্তর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের দিনগুলোতে ‘ম্যানিফেস্টো’ একসময়ে খুব উল্লেখযোগ্য একটা পত্রিকা ছিল এবং একে ঘিরেই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ীতে বসতো বৈঠক, সাহিত্যসভা। সেখানে চলতো সাহিত্যিক আলোচনা ও নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক। পার্থ বন্দোপাধ্যায় সক্রিয়ভাবে একসময়ে যুক্ত ছিলেন শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে। তিনি গান ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ ‘গণবিষাণ’-এরও একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, নাট্যকার, নির্দেশক, গীতিকার। তার লেখার উপর গনবিষাণ-সংস্থা অন্ততপক্ষে ন’খানা গণসংগীত স্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। আর্থিক উপার্জন তার তেমন একটা ছিল না, একান্নবর্তী পরিবারে তিনি ছিলেন বে-রোজগারে বা কম রোজগেরে মানুষ। পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন রত্না বন্দোপাধ্যায়কে। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান প্রাঙ্গণ। জীবনের শেষ দিকে এসে পার্থ বন্দোপাধ্যায় নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন। তছাড়া পায়ে বাতের জন্যে একা একা চলা ফেরা করতেও অসুবিধে হতো। অবশেষে তিনি প্রয়াত হন ১৭ মার্চ ২০১৫তে।
# # #

পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জীবন যেমন অধ্যয়ণের বিষয়, তার কবিতার বৈচিত্র্যময়তাও তেমনি আকর্ষনীয়! ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটির পরিপ্রেক্ষিতে তার কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। কবির ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি ‘মহাশ্বেতা’ পাঠকদের জন্যে তুলে ধরছি।
পাতার আগুন জ্বালি
জ্বলে ওঠে বসন্তের দিন
#
হলুদ শিখার নৃত্য মধুবাতাসের বুকে
কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে নিভে যায়
পড়ে থাকে অবশিষ্ট একরাশ শাদাকালো ছাই
#
তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই বলে আজ
মহাশ্বেতা, ভষ্ম থেকে প্রতিমা বানাই (মহাশ্বেতা)

এতো কোনো কবিতা নয়, একটা ইতিহাস। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের দিনে কেউ কেউ আগুন জ্বালতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয় নি সেই চেষ্টা – সত্তর দশকে আগুন জ্বলেছিল বটে, কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে তা নিভে গেছে, পড়ে আছে ছাই এর অবশেষ। অন্য দিকে একসময়ে রাশিয়া, চীন, পূর্ব-ইউরোপ সাম্যবাদের ধ্বজা নিয়ে মানুষের আশা স্বপ্নের প্রতীক ছিল, তাও ততোদিনে ভেঙে পড়েছে। তবুও হাল ছাড়েন না কবি। যে স্বপ্নের প্রতিমাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল, আগুন নিভে গেলেও মহাশ্বেতা সময়ের জন্যে কবি অবশেষে নির্মান করেন তার ভষ্মের প্রতিমা। ‘মহাশ্বেতা’ সেইসব আশা-ভঙ্গুর সময়ের জন্যে নির্মিত একটা কবিতার ভাষ্কর্য! অবশ্যই এটা কবিতা হিসেবেও অনন্য!
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা লেখা শুরু সত্তরের দশকে। সত্তর দশকের সন্ত্রাস, ৭২ সালের নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের পটপরিবর্তন, ৭৩ সালের খাদ্য-অমিল, ৭৪এর সরকার বিরোধী আন্দোলন, রেল ধর্মঘট, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশ জুড়ে এমার্জেন্সী, বন্দীমুক্তি আন্দোলন – এই সব বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ – যার রচনা কাল ১৯৬৮ -১৯৭৯, এখানকার লেখা কবিতাগুলো অনেকটাই সোজা সাপ্টা, বেশীর ভাগ বিবৃতিধর্মী, কোথাও আবেগময় এবং কোথাও কোথাও ছুঁয়ে আছে কাব্যিকতা!
সোজাসাপ্টা উচ্চারণে তিনি লেখেন –
‘পোষ্টার অথবা কবিতা
যে যা খুশি ভেবে নিতে পারো
আমি চাই কথাগুলো আটটা পাঁচটার গেটে অনায়াসে মিশে যাক
তেতে উঠুক অবস্থানের তাবু’। [পোস্টার অথবা কবিতা –১৯৬৮]
এরকমই ভাবেই পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার কবিতার মধ্য দিয়ে প্রান্তিক শোষিত সংগ্রামী মানুষদের প্রতি অনুগত থাকতে চান। এই দিনগুলোতে তার বক্তব্যের মধ্যে নেই কোনো কাব্যিক লুকোচুরি, সোজা সাপ্টা কথাতেই তিনি লেখেন –
‘শৃঙ্খলিত মানুষের চলার ছন্দের মধ্যে
জেগে উঠছে যে ঘুম-ভাঙার গান
হে সময়, আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো
হাতুড়ির ঘা মেরে
প্রতিদিন রক্তের ভেতরে তোমার অবিরাম নির্দেশ পাঠাও।’
(আমাকে নির্দেশ দাও / রচনাকাল – ১৯৭০)।
উপরের লাইনগুলো কতোটা কবিতা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে এই কবিতার মধ্যে সময়ের যথার্থ আবেগ রয়েছে, রয়েছে সমাজ সচেতনতা। এরপরে ১৯৭৩ সাল, দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব। এ সময়ে লেখা কবিতার কথাগুলো পাঠকের হৃদয়কে বিদ্ধ করে, যখন পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার দীর্ঘ কবিতাটিতে লেখেন –
‘ভারতবর্ষ, তোমার চোখের মণিতে দুর্ভিক্ষের কালো থাবা
তোমার মাথার উপরে মৃত্যু .........
ভারতবর্ষ, তোমার অহিংসার মন্ত্র আমাকে দীক্ষিত করেনি – আমি ব্রাত্য
আমি কোনো ফতোয়া মানিনি
মৃত্যু আমার বাঁপাশে ডানপাশে
আমার দিকেও নেমে আসছে পুষ্টিহীনতার করাল প্রতিহিংসা
#
হাজার হাজার জেল গারদ তুলে কেউ আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না
...... আমি কাউকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তুলে নেবার জন্য প্ররোচিত করিনি
-আমি সেই চন্ডাল
প্রত্যেকটা চিতার পাশে জেগে থাকছি
প্রত্যেকটা চিতার পাশে, আগুন আগলে রাখছি ঘৃণায়।’ [ মার্চ ’৭৩]

১৯৭৪ সালে দেশ জোড়া রেল ধর্মঘট, কবি রেল ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, লিখছেন কবিতা, যদিও তার লেখার লাইন অনেক জায়গাতেই শ্লোগানধর্মী! যেমন, উদ্ধৃত অংশের শেষের লাইনগুলো –
‘প্রত্যেকটি ধর্মঘটি রেল-কর্মীর মাথার উপরে ঝুলছে গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা
.........
তবু এই প্রতিজ্ঞামুখর সময়
বার বার জ্বলে উঠছে আগুনের অপ্রতিহত ইস্তাহার
যার কিছুই নেই তার কিছু হারাবার ভয় নেই
(রেল ধর্মঘটের আজ চার দিন / রচনাকাল - ১১ই মে ১৯৭৪)

‘বৃষ্টির দিনে কলকাতার এক উপাখ্যান’ দীর্ঘ কবিতাটাতে কবি জলে ভেজা শহরের চিত্র তুলে ধরে ব্যক্ত করেন নিজস্ব ক্ষোভ। আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’এ কবি একজন ভিয়েতনামি মানুষের ধারাভাষ্যে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছেন তার ক্ষোভ ও ঘৃণা। প্রথম কাব্যগ্রন্থভুক্ত এইসব কবিতাগুলো মূলতঃ শ্লোগান বা বিবৃতিধর্মী; তবুও কবিতার ভেতর দু’চারটে দৃশ্য বা চমকপ্রদ বর্ণনা পাঠককে আকুল করে।
যদিও ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির কিছু কবিতার উচ্চারণ কাব্যিক কারণে মনকে ছুয়ে যায়, কবিতা সেখানে শ্লোগান নয়। তিনি কবিতাকে লেখেন জীবনকে ছুঁয়ে, কবিতার ভাষা ছুঁয়ে থাকে প্রাচীন লোককথা, কবিতার লাইনগুলো গভীরতায় একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। যেমন –
শীতের প্রস্তুতি ছিল গাছে গাছে পাতায় পাতায় ......
যা ছিল না আজও নেই
সে কেবল গরিবের গরম পোশাক ......
দিন যায় রাত্রি আসে
পৌষের আকাশ নিয়ে অভাগী ফুল্লরা গায়
আজো সেই বুক-ভাঙা যন্ত্রণার গান
দঃখীর সম্বল বলতে
জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ ...(জানু ভানু কৃশানু / রচনা-১৯৭৪)
এই কবিতায় আসে অভাগী ফুল্লরার কথা। দুঃখী মানুষের সম্বল জানু, অর্থাৎ হাঁটু, যেটা জড়িয়ে সে শীত কাটায়। ভানু অর্থাৎ সূর্য, সেটাই কৃশানু বা রুগ্ন-দেহ বস্ত্রহীন মানুষের শীতের সম্বল। লোককথা এবং শব্দের গূঢ় ব্যবহার এই কবিতাটাকে নান্দনিক করে তোলে।
পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার অনেক কবিতাতে নিপুন ছন্দের স্বাক্ষর রেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে বক্তব্যের দিক থেকে মনোগ্রাহী একটা কবিতা, ‘হেলে’র কিছু লাইন।
ভয় পাস নে ভয় পাস নে ছেলে
কেউটে কিংবা গোক্ষুর নয় ও সাপ নেহাত হেলে
কামড়ে দিলে পা
খুব জোরতো দুচার দিনের ঘা
#
আর সাহস করে ছেলে
যদি তুলতে পারিস লাঠি
দেখবি ও সাপ পায়ের কাছে
ঠান্ডা মেরে গুটিয়ে আছে দিব্যি পরিপাটি ... (হেলে)।
এই কবিতাটা, যতদূর মনে পড়ছে, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সুর করে নিজেই গেয়েছেন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার বিষয় সাধারণ মানুষ, নিরন্ন মানুষ, ফুটপাথের মানুষ। রাস্তার শিশুদের নিয়ে লেখা কবিতা ‘রাস্তায় যে বড়ো হবে’। এই কবিতার কয়েকটা লাইন –
‘একটি শিশু সোনার থালা’
মিথ্যে কথা – অলীক প্রতিশ্রুতি
তোর চাই নতুন বর্ণমালা
অ-য়ে অন্ন
আ-য়ে আশ্রয় ......
... এ পৃথিবী তোকে যতই বঞ্চিত করুক
তোর হাতেই নতুন পৃথিবী গড়বে
যদি তুই শিখে নিতে পারিস
শ-য়ে শ্রেনি
স-য়ে সংগ্রাম।
এই লাইনগুলোর মধ্যে দেখি কবি তার বিবৃতিধর্মীতা ভেঙে পাঠকদের দিকে ছুড়ে দেন কিছু নতুনতর শ্লোগান, যার আবেদনও অনবদ্য।
কবিতাসমগ্র-র পাতা পালটে আমরা পৌঁছে যাই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে – ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’, যার প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮৬।
কবির প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এখানেও অব্যাহত। একজন সংগ্রামী সচেতন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি লেখেন –
‘পায়ের নিচে ফুঁসছে মাটি
মাথার ওপর রক্তমাখা আকাশ
তাকাস, তোরা যাত্রাপথে মাথার ওপর তাকাস।’ (দিন আসছে)
এই পর্বের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার বাস্তব জীবনে জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে, ভাগ নিয়েছেন মজুরদের নুন্যতম দাবী দাওয়ার প্রশ্নে। তিনি পথ হেঁটেছেন শ্রমিকদের মিছিলে। তিনি ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের সাথে বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণায় বসেছেন।
‘রুগ্ন শিল্পের মজুরদের ধারাবাহিক রুগ্নতার প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না আপনার
জীবন যখন গলানো পিচের মতো ফুটতে থাকে অভাবের কড়াইয়ে
খিদে যখন মৃত্যুর ছায়ার মতো পাক খেতে থাকে তলপেটে
চেনা গন্ধমাখা বৌয়ের শাড়ি চাপা অন্ধকারে হয়ে যায় ফাঁসের দড়ি-
তাতে আপনার কী যায় আসে – আপনি আটতলার বাসিন্দা .....’ (খোলা চিঠি / মাননীয় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র সমীপেষু)। এই কবিতাটা সে সময়ে বন্ধ-থাকা এ-স্টক কারখানার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, যে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে কবি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন।
কিংবা,
‘কারখানাতে / তালা মানেই / জীবন ফালাফালা / কেউ দিয়েছে গলায় দড়ি / কেউ দিয়েছে / রেল লাইনে গলা / কারখানাতে / তালা মানেই / শাদা থানের শাদা আকাশ / শূন্য ভাতের থালা ...... বন্ধ গেটের / অস্ত্রবিহীন তাঁবুর থেকে / উঠছে নতুন নারা / লোহার জাল / যতই কঠিন হোক / এসমা- ন্যাসা / হোকনা যতই জারি / লোহা গলানো হাতই পারে / ভাঙতে জারিজুরি’। ‘লোহার জাল’ শীর্ষক এই কবিতাতে দেখি কবি বিশ্বাস রাখেন শ্রমিকশ্রেণীর সংঘবদ্ধ সামূহিক শক্তিতে।
‘কারখানা লকআউট
দুমাস ছমাস নয়, পুরো চোদ্দমাস
ছেঁড়াফাটা রঙচটা তাঁবুর ভেতর বাড়ে দীর্ঘ হাহুতাশ ......
তাঁবু আগলে বসে থাকে মহিম-মাসুদ-পরিমল’। (সপ্তমী)
দুর্গা পূজা, সপ্তমীর দিন হিন্দু মুসলমান শ্রমিকেরা বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে। এই কবিতা তার পক্ষেই লেখা সম্ভব, যেহেতু কবি নিজে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছেন, তাদের মিছিল মিটিং ধর্ণায় ভাগ নিয়েছেন।
এই পর্বের কবিতাগুলো যে শুধু শ্রমিক মজদুর ভাবনা নিয়ে লেখা তা নয়। সাধারণ বিষয় নিয়ে অনেক কবিতা আছে এই গ্রন্থে। যেমন ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ বিষয় হিসেবে একটা ব্যতিক্রমী কবিতা, উপেক্ষিত পাখি কাকেদের নিয়ে লেখা কবিতা। ‘আমি-র মুখে’ কবিতাটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ ভাঙ্গার কবিতা, আত্ম-আহমিকা বিসর্জন দেয়ার আহ্বানের কবিতা। লেকের রাস্তায় রঙচটা শাড়ি, ফাটা কামিজ পরা যুবতীরা তার কবিতার বিষয় হয়ে যায়( তিনটি যুবতী চলে যায়)। ‘প্রচ্ছদপট’ কবিতায় তিনি লেখেন ক্ষয়িষ্ণু বঞ্চনাময় এই সমাজ ও পৃথিবীর কথা –
‘নিরবধি কাল নয়, বিপুলা পৃথিবী নয়
এ মাটির কাছে তুমি চেয়েছিলে পিপাসার জল
এ মাটি দিয়েছে জল – তার চেয়ে ঢের বেশি ঢেলেছে গরল’

তবুও কবি বিশ্বাস করেন সাথীদের সাথে মিলে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে। লেখেন এই সুপরিচিত কবিতাটা, যাকে একটা জনপ্রিয় গানেও রূপ দেয়া হয়েছে।
‘শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি
নতুন মানুষজন
শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি বুঝতে শিখি
কে ভাই – কে দুশমন’ ( শ্লোগান থেকে )।

এরপর ১৯৯১ সালে প্রকাশ পেলো পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চটি কবিতার বই ‘তোমার জন্য, তোমাদের জন্য’। এখান থেকেই তার লেখার পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শ্লোগান, আন্দোলন, সমাজ ইত্যাদি বিষয় থাকলেও তার কবিতায় প্রেম বিষয়টা তেমনভাবে উচ্চারিত ছিল না। এই বইএর প্রথম কবিতা ‘তোমাকে’ – তাতে তিনি লিখলেন – ‘ঊর্মিমালা, আমাকেও ডাকো তুমি, ডাকো আজ অন্য কোন নামে’!
কবির নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা প্রেম ভলোবাসার স্মৃতি এতোদিন কবিতায় উহ্য ছিল, জানি না কেন, তার কবিতার বইতে তিনি তেমন ভাবে প্রকাশ করেন নি! এই তৃতীয় বইটাতে দেখলাম, কবি তুলে ধরেছে তার জীবনে প্রেমের স্মৃতি – ‘উনিশ বছর আগে’ কবিতায় –
‘মনে আছে, আমরা ছিলাম মুগ্দ্ধ আমাদের শরীরের ঘ্রাণে ও আস্বাদে
ঊনিশ বছর আগে, এরকমই ঝমঝম সন্ধ্যার ভেতর #
তুমি, আমি, ভালোবাসা ... মেঘ বৃষ্টি ঝড়’।
কিংবা, যে প্রেমের কথা কবি এতোদিন বলেন নি, এবারে তা লিখলেন কবিতায়,
‘তুমি বলেছিলে
এক আকাশ ভালোবাসার নীচে
দুজন মানুষ অকুলান হবে না’ (রাত্রি যায়)।
অথবা, ‘এপ্রিলের মৃত্যু’ কবিতায় নারীকে নিয়ে লিখলেন অসামান্য এই লাইনগুলো –
‘খোলা মাঠে গাছের মতো সাবলীল যে মেয়েটি
একদিন বৃষ্টির দিকে খুলে রেখেছিল শরীর
তাকেও দেখতে পাবে
বিবাহের যৌতুকে সেও পেয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা’ – তাহলে কি কবির পর্যবেক্ষণে বিবাহ-পরবর্তী সময়ে মেয়েটি সুখী নয়? বিবাহ তাকে উপহার দিয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা?
প্রেম ভালোবাসা বিরহ এসব কবিতার পাশাপাশি এই বইতে আছে কয়েকটি অসামান্য কবিতা, যেমন ‘মহাশ্বেতা’ বা ‘আলেয়া’! ‘মহাশ্বেতা’ – কবিতাটার উদ্ধৃতি এই নিবন্ধর প্রথমেই দিয়েছি, ‘আলেয়া’ থেকে তুলে দিচ্ছি তার কবিতার প্রথম তিনটে লাইন –
‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি
ফাঁসজাল হয়ে সমানে টানছে, সামনে টানছে শুধু
কিছুই জানিনা কদ্দুর যাওয়া – নিবিড় তিমির ধূ ধূ’।

কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বিতান ভৌমিক লিখেছেন, কবির “রাজনৈতিক কর্মীসত্তার সাথে ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখা পাই এক প্রেমিকের। দরদী মন তার কবিতায় রয়ে গেল। প্রেমিক স্বভাবও তার কবিতায় রয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীর উপস্থিতি তুলনায় কমে এল।” [সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায় (এখানে আলোচিত বইটি)।]
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪এ। এই পর্বের কবিতার অভিমুখ কিছুটা আলাদা। প্রেম, জীবন, সমাজ, পরিবেশ অনেক কিছুই রয়েছে – শ্লোগান ও বিবৃতি কমে এসেছে।
এই পর্বের একটা অসামান্য কবিতা, নগরায়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ-ধ্বংসের বিরুদ্ধে –
‘ভীষণ ধারালো জিভে গোঁফ চেটে নিয়ে
বাঘিনিকে স্থির ভাবে বলেছিল বাঘ
-জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে লোকালয়ে যাবো
শুয়োর হরিণ যদি না পাই তো ক্ষতি নেই
মানুষের হাড়মাংস খাব।’ (জঙ্গল ফুরিয়ে আসছে)
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টা যে কতো মারাত্মক হতে পারে, তা চার লাইনে বাঘের ভয়াবহ ডায়ালগে এখানে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘ভিন্ন জীবন’ কবিতার প্রথম লাইন কাব্যিকতার মাধুর্যে পরিপূর্ণ, - ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ – এই লাইন আমাদের ভাবনাকে আরো বিস্তৃতি দেয়। ‘বাংলার বিবেক / ১৯৯০’ কবি লেখক কবি বুদ্ধিজীবিদের দিকে ছুঁড়ে দেন তীব্র কঠাক্ষ! ‘চাঁদিপুর’ কবিতায় প্রেমের এক তীব্র আর্তি –
‘জোয়ারের অপেক্ষায় ঝাউয়ের ছায়ার নীচে বসে আছি আমরা দুজন
কখন সমুদ্রে যাব শরীরের অসম্ভব আকাঙ্খা জুড়াতে যাব কখন – কখন
মরে যেতে ইচ্ছে করে কোনো দিন জীবনের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেলে’।
প্রসঙ্গত বলি, উপরের কবিতাটা কবি লেখেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে যখন তারা চাঁদিপুর ঘুরতে গিয়েছিলেন। [ কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]
এমনি ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। চলতে চলতে একসময়ে কি জীবনের রেস্ত সত্যিই ফুরিয়ে আসে, কেন তবে হাতের তালুতে কপাল সুদ্ধু মাথাটা ঢলে পড়বার ভয়, সে কি কোনো মৃত্যুর বিষণ্ণ চিন্তা? ‘শীতগ্রীষ্মের মাঝখানে’ কবিতায় কবি কেন উচ্চারণ করেন – ‘রেস্ত ফুরিয়ে আসছে ইয়ার’।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ প্রকাশিত হয় ২০০২এ, এর কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৯৯-২০০২। এটাই কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ। যদিও নান্দীমুখ সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’।
যথাক্রমে কবির চতুর্থ ও পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ ও ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ সম্পর্কে বিতান ভৌমিকের নিরীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ – “মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতার যে উন্মেষ দেখেছিলাম ‘সাদা পাতার দেশ’ কাব্যগ্রন্থে সেই মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতা ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ কাব্যগ্রন্থে আরও পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। নিচুতলার মানুষের প্রতি যে দরদ কবির সাথে ছায়ার মতো এতদিন জেগেছিল সেই দরদের ভেতরেও এবার দেখা দিল একধরণের দার্শনিক বোধ।” [ সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়]
কবিতাসমগ্র-র পরবর্তী অংশে আছে কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যার তিনি কোনো নামকরণ করে যান নি।
কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’ থেকে একটা পুরো কবিতা তুলে দিচ্ছি, যে লেখায় কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায় হয়তো নিজেকেই নিজে মেলে ধরেছেন – ‘কবির স্বভাবে নেই / দুদন্ড সুস্থির হয়ে / চুপচাপ বসা / স্বজনে বাচাল বলে / দুর্জনেরা বলে বোলচাল / কবি ভাবেঃ কেল্লা ফতে / এতদিনে করেছি কামাল / # / গ্রীষ্ম ও বর্ষায় নেই / কবির নিজস্ব কোনো / নিরাপদ ছাতা # / তুচ্ছাতি বিষয় নিয়ে এ সংসারে / কবে আর কার মাথা ব্যথা / # / রোদেই পুড়ুক / আর জলেই ভিজুক / ঋতুর তরঙ্গভঙ্গে / কবির আকাশ তবু / সত্যবদ্ধ খোলা সাদা পাতা’।
এ ছাড়াও রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সময়ে লেখা পুস্তকাকারে অগ্রন্থিত কবিতা। এই অংশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মণিমাণিক্যের মতো অনেক কবিতা, যা কিনা কবির কাব্যিকতা ও তার ব্যক্তিজীবনকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।
জীবনের শেষর দিকের লেখা কবিতাতে দেখি, তার রাজনৈতিক ভাবনার বাঁক – এক্ষুনিই আমাদের এই পৃথিবীটাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে - এই জাতীয় রাজনৈতিক তীব্র কর্মিসত্ত্বা তার মধ্যে যা কিছুটা ছিল, তা কালের প্রবাহে অবসিত হয়েছে। যে কাজ কবি পারেন নি, তা সম্পন্ন করার জন্যে তো তার উত্তরসূরীরা রয়েছে। ‘দিন কাটছে’ কবিতাটা পড়লে এই ভাবনার পরিবর্তনটা স্পষ্ট হবে –
‘সামনে উঁচু পাহাড়
ঠিক পেরিয়ে যাব আমি না পারলে আমার ছেলে
তেমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই আর’। (অগ্রন্থিত কবিতা)
‘জেগে থাকি’ কবিতায় খুঁজে পাই একজন জীবনানন্দীয় রোমান্টিক কবিকে – ‘ যতক্ষণ জেগে থাকি / এক পৃথিবীর গন্ধ লেগে থাকে বুকের ভেতর’ (অগ্রন্থিত কবিতা)।
সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে একটা অসাধারণ লেখা হিসেবে পাঠকদের নজর কাড়বে ‘সে কাঁদেনি’, পুরো কবিতাটাই তার ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ থেকে তুলে দিলাম -
‘অঝোর বৃষ্টির রাত
একাই ভিজেছে আজ পাষাণপ্রতিমা
আমি জানি- আর কেউ সে কথা জানে না।
#
অবিশ্রান্ত ধারাপাত
সারা রাত সে কাঁদেনি – কেঁদেছে আকাশ।’


পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাতে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, সেগুলোকে পরপর লিখলে এরকমটা দাঁড়ায় –
১- কবিতাতে দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ব্যবহার।
২- কোথাও কবিতাতে নাটকীয় সংলাপ ধর্মিতা।
৩- কলাবৃত্ত, মিশ্র-কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত ইত্যাদি সব ছন্দর ব্যবহারে পারদর্শিতা।
৪- কবিতার মধ্যে চমৎকার নিয়ে আসেন চলতি বা তৎসম শব্দ, দেশজ শব্দ কিংবা প্রাচীন কবিতার উদ্ধৃতি বা লাইন। যেমন – ‘আয়মনকুলির শোকে উথালিপাথালি নদী আজো পাড় ভাঙে’ লাইনে দেশজ শব্দ ‘উথালিপাথালি’র নিপুন ব্যবহার।
৫- কবিতার বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্য। যেমন –‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ কবিতাটা, যা কিনা কবির মৌলিক কল্পনা প্রতিভারও একটা দৃষ্টান্ত ।
৬- কবিতার জগতটা বর্ণ, দৃশ্য, গন্ধ-স্পর্শের এক মিশ্রিত জগত। চিত্রধর্মিতা তার কবিতার একটা বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা জনহীন বায়বীয় পরিবেশে ভেসে বেড়ায় না।
৭- কবির কবিতার বিষয় মূলত নাগরিক জীবন। তার সাথে মিলে যায় দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি, মানুষের বেঁচে থাকার কষ্টকর চেষ্টা, মজদুর শ্রমিকের লড়াই, প্রতিবাদ-বিদ্রোহ, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, এমনকি নৈসর্গিক নানা চিত্রমালা।
৮- কবিতার বিভিন্ন জায়গাতে অসামান্য সব চিত্রকল্পের ব্যবহার। যেমন- ‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি’ কিংবা ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ ইত্যাদি সব লাইন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাচর্চা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি রঞ্জিত গুপ্তর একটা মূল্যায়ন খুব প্রাসঙ্গিক – ‘সত্তরের কাব্য আন্দোলনের প্রথম দিনগুলিতে যে শিল্পহীন প্রচারধর্মীতার একমুখী চর্চা চলেছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের সেদিনের স্বরটি তার দ্বারা ছিল অনেকাংশে আক্রান্ত। তবু কবি তার অন্তর্লীন স্বভাবে ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাব্যিক সুষমারিক্ত তার সেদিনের বিবৃতিধর্মীতার পেছনে আসলে কোন অকবিসুলভ অক্ষমতা ছিল না। বরং তিনি যেন সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন প্রচলিত রূপবদ্ধ ভেঙ্গে কবিতার ভিন্নতর ভাষা খুঁজে নিতে।’ [ গ্রন্থসূত্র – কালের মন্দিরা – রঞ্জিত গুপ্ত]।
# # #
কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক সম্পাদিত ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ পড়তে পড়তে এই নিবন্ধটি লিখতে প্ররোচিত হয়েছি। এতোক্ষণ যা লিখলাম, তা বেশীর ভাগই কবির কবিতা নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া, কবির জীবনের দু চারটে কথা। প্রসঙ্গক্রমে জানাই পেশাগত কারণে আমি বহির্বঙ্গে থাকতাম, তবুও পার্থদার সাথে আমার সামান্য কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মনে পড়ে, আমি মধ্যপ্রদেশ থেকে কোলকাতায়, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সত্যেনদা’র ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছি, আমার ক্লাসমেট কবি তমাল ভৌমিকের সাথে দেখা করবো বলে। দেখলাম, কিছুক্ষণ পরে তমাল এলো, তার সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়! তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি মহলে বেশ পরিচিত। আমি তো বিনা নোটিশে পার্থদা’কে দেখে অবাক! জানলাম, পার্থদা আমার সাথে নাকি দেখা করতেই এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। এম্নিভাবেই পার্থদা ছিলেন সবারই বন্ধু – তিনি যেমন আমার বন্ধু, তেমনি অনায়াসে সম্ভবতঃ আমার ছেলেরও বন্ধু!
এবার ‘কবিতাসমগ্র’ বইটি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
এই বইটি নির্মাণে সম্পাদক-দম্পতি (কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক) অত্যন্ত সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুর অল্প কয়েকটা বছরের মধ্যেই তার সবগুলো লেখাকে জড়ো করেছেন, তাকে ২৭২ পৃষ্ঠার একটা সুন্দর বইএর আকার দিয়েছেন। হয়তো তাদের সাথে আরো কিছু বন্ধুসাথীরা ছিলেন, যারা পেছনে থেকে এই বিশাল কর্মকান্ডটিকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন, যার সবটা আমি জানি না। তবে এক্ষেত্রে মূল উদ্যোগটি সংকলন সম্পাদক কাজরী ও বিতানেরই। মৃত্যুর পরে প্রায়শঃই কবি লেখকেরা হারিয়ে যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মতো কবি ও একজন বিশেষ ব্যক্তির লেখাগুলোকে সংরক্ষিত রাখাটা অবশ্যই সময়ের বিচারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ – যা সম্পাদকদ্বয় করে দেখিয়েছেন।
‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটা হাতে নিলেই বোঝা যায়, এটা কোনো দায়সারা গোছের কাজ নয়। অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদিত এই কবিতাসমগ্রে রয়েছে গ্রন্থ বা বিষয়ভিত্তিক এক একটা পর্ব, পর্বের প্রথমে প্রত্যেকটি প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি আছে, আর গ্রন্থভিত্তিক সূচি। পরিশিষ্টে আছে গ্রন্থতালিকা, প্রকাশকাল, প্রকাশকের নাম ঠিকানা। পরিশিষ্টে আরো আছে, পরিশ্রম করে তৈরী করা, সমস্ত কবিতাগুলোর বর্ণানুক্রমিক সূচি – যা ভীষণ উপযোগী।
কবিতাসমগ্রটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে যে দুটো বিশেষ পর্বের সংযুক্তিকরণে – (১) পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যা কবি তার জীবিত অবস্থায় প্রকাশের আলোয় আনতে পারেন নি। (২)অন্য পর্বটা পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ – যেগুলো পান্ডুলিপি, ডায়েরী বা অন্য কোনো সূত্রে জোগাড় করে গ্রন্থিত করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য কাজ। যদিও কবির পরিবারের ও কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। তবুও এই মূল্যবান সংকলনটার সম্পাদক হিসেবে কাজরী ও বিতানের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
যথেষ্ট মোটা সাইজের বই, কাগজের কোয়ালিটি, বাঁধাই, প্রচ্ছদ ইত্যাদি খুবই ভালো। সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছে তন্ময় মৃধা। বইটার মূল্য মাত্র চারশো টাকা, বইটার প্রকাশক – অন্যতর পাঠ চর্চা কেন্দ্র, কোলকাতা – ৭০০০৪৭। গ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত হয়েছে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়, ‘কবিতার অনুরাগী পাঠকদের হাতে’। বইটাতে কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের নিজস্ব হাতে লেখা পান্ডুলিপি, ব্লার্বে তার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া আছে।
এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার আগে বন্ধুপ্রতিম বিতান ভৌমিক জানিয়েছিল তাদের এই পরিকল্পনার কথা। তার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে কিছুটা অনুমান করতে পারি, সম্পাদকদ্বয় ও তাদের কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের কতই না পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিতে হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি প্রকাশ করবার জন্যে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থটি কোন বড় প্রকাশনা বা বিগ হাউজ পাবলিশার্সের আর্থিক বা ব্যবসায়িক আনুকুল্যে ছাপা হয় নি।
পরিশেষে আরো যে কথাটা বলতে চাই, কবির কবিতা পড়বার সাথে সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়কে জানাটাও খুব জরুরী - গ্রন্থটির ‘ভূমিকা’র মধ্যে এই কাজটি খুব সুন্দর ভাবে পাঠকদের জন্যে করে রেখেছেন বিতান ভৌমিক। প্রায় ১৫ পৃষ্ঠা দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা, বিশ্লেষণ, কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, সাল-তামামি। এই সুন্দর ভূমিকাটির জন্যে বিতান ভৌমিককে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই।
সত্তর দশকের কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাহিক ভাবে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপরের আলোচনায় তার কবিতাসমগ্রর একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে এই কবির জীবনটাও স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার একটা বিষয়। যার মধ্য দিয়ে সত্তরদশক ও তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলনের একটা ছবি আমরা খুঁজে পেতে পারি। আশা করি, ভবিষ্যতে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘গ্রন্থসমগ্র’ও প্রকাশিত হবে। তাতে তার সমগ্র সাহিত্য ও জীবন নিয়ে আরো বেশী আলোচনা ও চর্চার সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হবে, এবং তা হবে সময়েরই প্রয়োজনে।
0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in







যে দেশে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, সেখানে বিপদটা আসার আর বাকী নেই । এই বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে ঘরে ও বাইরে , দুদিক থেকেই আসা লড়াইটাকে সামলাতে গিয়ে দেখলাম বেশ গভীরতা ।

আসলে আমার আশঙ্কা , পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশের অধিকাংশ রাজ্যই কি তবে পৌঁছে গেল এমন একটি স্তরে, যেখানে দুর্নীতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে?

এই কথা মনে হওয়ার কারণ হিসাবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়।

তবে, পাশাপাশি এ কথাটিও ভুললে চলবে না, আর জি কর কাণ্ডের পরেই এ রাজ্যের মানুষ যে ভাবে রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করেছেন, সেই প্রতিবাদ কিন্তু কিছু অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে ভুলে যাওয়ার কথা নয়, বা এমনও নয় যে, শিক্ষক নিয়োগে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির কথাও সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়েছেন।

যদিও ঐ নিয়োগের দুর্নীতির ফল বেড়িয়ে গেছে , দুর্নীতি প্রমাণিত – দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।

কাজেই শাসক নিয়েই এখন দেশের মানুষ চিন্তিত, তবে এ কথা সত্যি, শাসক পরিবর্তন করে ক্ষমতায় কাকে আনবে, তার দিশা আপাতত পশ্চিমবঙ্গে খুবই সমস্যার , কারণ নিরঙ্কুশ ভাবে গ্রহণীয় কথাটাই বোধ হয় আজকাল আর এখানে খাটেনা । শুধু দুর্নীতিটাই একমাত্র ইস্যু নয় ।

খোলা বাজারের কারণে মানুষ বা সমাজের সামনে অনেক দুয়ার খুলে গেছে , যেমন যার দ্বারা কিছুই হবেনা বলে ধরে রেখেছে তারই বাবা , সে এখন বিরাট প্রোমোটার হয়ে দুটো বাড়ির মালিক । অস্বাভাবিক মনে হয়না আজকাল । কা র ণ যোগ্য তা ব্যাপারটাই ঘেঁটে গেছে , যারা নিরুপন করবে , তাদেরও যোগ্যতার মাপকাঠি তে বিচার হয়নি । এরকমই একটা অবস্থায় চলছে ।

এগুলোর পেছনে যেটা কাজ করছে সেটা হলো – রাজনীতি যে সম্ভাবনাময় তারই ‘বহিঃপ্রকাশ’ বা ‘করোলারি’ । অনেক দিক খুলে দেয় , তারই একটা ছোট্ট সংস্করণ। ঐ ছেলেটিকে দেখে পাশের বাড়ির খোকাও বখে যাবে তারপরে কারুর হাত ধরে ঐ কাজই করবে ।

এটা একটা নিশ্চিন্তি , যার পক্ষে মাসে পাঁচ হাজার টাকা কামানো টা ছিল স্বপ্ন , সে পেলো হাতে দশ হাজার টাকা , ভগবান বলে তাকে তো মানবেই – যে দিলো টাকাটা -- এটাই করা হচ্ছে এবং হচ্ছে খুব ‘সুপরিকল্পিত’ ভাবে ।

শাসকের হাতে সারা দেশের সম্পদটাই ব্যবহার যোগ্য । নানান ভাবে । ঐ আমরা কিছু নাম দিয়েছি , গণতান্ত্রিক দেশ বলি তো , তাই , যেমন Municipality , panchyayat , gram sabha , যাদের হাতে থাকে দেশের সমগ্র খালি জায়গার লীজ । মানে শাসকের হাতে। সেটার ব্যবহার কেমন ভাবে হবে , কতটা আইন যোগ্য , কিভাবে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান হবে , সবটাই শাসকের নিয়ন্ত্রনে।

ঐ কাজগুলোকে শাসক দল আপাতভাবে লীজ নেয় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামে’ , যেমন রাস্তা মেরামতের কাজ , গ্রামের পুকুর কাটার কাজ , জঙ্গল পরিস্কার করার কাজ – সবই করবে সরকারি দপ্তর , কিন্তু সিদ্ধান্ত শাসকের ।

কাজেই এগুলোই হলো শাসকের মুলধন, যার আশে পাশে মৌ মাছি ঘুরঘুর করবে, আর শাসক তাদের আটকাবে ও জালে পুড়বে , তোতা পাখী বানাবে । শাসন ক্ষমতা চালাবে এই ভাবেই ।

কেন তারা শুনবে , কারণ তাদের নিজের আওকাত নেই , সাধারণ প্রক্রিয়াতে নিজেদের জীবন যাপনে তারা অভ্যস্ত নয় , হয় চুরি ছিনতাই , না হয় লোক ঠকানো – মার দাঙ্গা – পয়সা নিয়ে দাঙ্গা কেনা , চিটীং বাজী করে , অথবা শাসকের ধামা ধরে ।

যারা তাদের নেবে , অবশ্যই সেই শাসককে হতে হবে মিশন লেস আন রেজিমেন্টেড অ্যাজেন্ডার কান্ডারী । কোনো নিশানা নেই – একমাত্র ভোটে জেতা ছাড়া।

সাধারণ পদ্ধতিতে স্কুল কলেজে পড়াশুনো করে , চাকরির পরীক্ষা দিয়ে , কিংবা স্পেসালাইজড কোনো কোর্স করে নিজেকে উপযুক্ত করবার ইচ্ছাটা তাদের হয়না , আমাদের ছোটো বেলায় দেখা , বাবা বলতেন , গ্রাজুয়েট হয়েছিস একটু টাইপটা শিখেনে। যদি ইংরাজী জানতাম , তাহলে শর্ট হ্যান্ডটাও শিখে নে , দেখি কোথাও স্টেনো গ্রাফারের চাকরী পাওয়া যায় কিনা । আজকাল সেখানে কম্পিউটার ও তারই অনুষঙ্গ অনেক কিছু হয়েছে ।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলাদা কারণ, হয় তাদের মেধা নেই , না হয় কয়েক প্রজন্ম ধরে এর সাথে তাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই । এদের রোজগার চিরকালই সরকার করিয়ে দেয় নানান রকম ভাবে। সংখ্যা আজও আছে , অনেক ।

শাসকের হাতে যদি এত কিছু থাকে নতুন কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেবে কেন । নতুন শিল্প নিয়ে মাথা ব্যাথা করবে কেন ? লোক দেখান কিছু শিল্প মেলাই যথেষ্ট।

এই মানুষ গুলোই তো শাসককে অর্থ যোগাবে , শ্রম যোগাবে, ভোটের সময় বুথ আগলাবে -- দরকারে দুচারটে লাশও ফেলবে নির্ভয়ে , কারণ প্রশাসনের রক্ষা কর্তা যে পুলিশ, সেও তো অনেকটাই এ সমস্ত কাজের সাথে যুক্ত।

ঐ ‘বাধ্য’ থাকা ।

‘বাধ্যতা’ই সৃষ্টী করতে হবে । দেশের শাসকের কাছে সেটাই প্রথম কাজ ।

কেউ স্বভাবতই বাধ্য, ‘অবস্থার প্রেক্ষিতে’ --কেউ আবার , ‘আরো চাওয়ার দলে’, সেও বাধ্য - কেউ আবার, ‘বিপদ বা অপকর্ম সামলাতে ’, সেও বাধ্য – কেউ আবার চায়, ‘অবস্থার পরিবর্তন’ – সেও বাধ্য – যেমন , ঐ যাদবপুরের ছোট ফ্ল্যাট বেচে সাল্ট লেকের সরকারি আবাসনের তিন কামড়া ফ্ল্যাট , সুযোগ চাই ।

‘বাধ্যে’র এই বিচিত্র বিভাগ থেকে শাসককে বাছতে হয় – ‘প্রায়োরিটি’ ঠিক করতে হয় , তবে না চলে দেশ ।

শাসক সমস্যায় পড়ে তাদের নিয়ে যাদের বোঝা বড়ই মুশকিল । বর্তমানে এরা সংখ্যায় কম হলেও , এরা মেধাবী গোত্রের । বোঝার দিকটা বেশ প্রখর । কাছে আসে নানান কাজের মধ্য দিয়ে । শাসক কে ‘অবলিগেটেড’ করে তোলে বা তোলার ক্ষমতা রাখে – নিজেদের মেধার জোড়ে। আবার সেই সুবাদে বিশাল সুবিধাও নিয়ে নেয় ঐ তালে গোলে । শাসক কিছু ক্ষেত্রে বিপদেও পড়ে। দেখা গেছে ।

উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই , আমাদের চোখে দেখা ,জানা , ঘুরে বেড়ানো মানুষ এরা।

দেশ চালানো কি অতই সহজ । অত সহজে কি চালানো যায় । আর এতদিন এ ভাবে টিকে থাকা যায় এ সমস্ত দিকগুলোকে না ভেবে। ।

তবে মানুষের অস্বস্তির প্রকাশ তো থাকবেই প্রতি বাদের মাধ্যমে । কাজেই প্রতিবাদ যদি হতে হয় – ঐ বাধ্যতা সৃষ্টীর অঙ্কুরেই আঘাত হানতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে , নইলে নিম্নমেধা রাজ করবে – যেমনটা বর্তমানে করছে – মেধার বৃদ্ধি মানেই আত্মনির্ভরতা – মানেই শাসকের আজ্ঞাবহ না হওয়া – মানেই নিজের মতবাদ তৈরি – ক্যাডারে ঘাটতি পড়বে , কোত্থেকে আসবে ক্যাডার যাদের আসার মূল কারণই নিজেদের কিছু করার সামর্থ নেই বলে ।

তবে আশার কথা হল মানুষ কিন্তু এখন নির্বাচনের চেয়েও প্রতিবাদের রাজনীতিতে আস্থা রাখতে চাইছেন। প্রমাণ বেশ মিলেছে গত কিছু সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির আঙ্গিনায় ।

কেবল বুঝছেনা প্রতিবাদের ভাষার রঙ্গটা কেমন হবে । এটা ঠিক যে অধিকাংশ মানুষই চান সুবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদ। প্রতিবাদের রাস্তাতেই যে একমাত্র আসল ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব—সেই মানসিকতাই এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করছে।

খুবই স্বাভাবিক , দেখা গেছে বিশেষত বেশ কয়েকটা ইভেন্টের পরে ।

যদিও আমার মনে হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অন্য দলকে আনলেই যে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই , কারণ সিস্টেমের পচা ঘা সহজে যায়না – তবুও তুলুমূল্য বিচারের সময় এসেছে – মানুষকে বাছতে হবে – আধা এদিক আধা ওদিক করলে শাসক আবার বর্তমান শাসকের সব দোষগুলি নিয়ে নতুন রুপে আবির্ভূত হবে , যেটা কাম্য নয় ।

কাউকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার এমন একটা জায়গা দেওয়া যাবেনা যেখানে বিরোধীদের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যাবে । আমরা গণতান্ত্রিকতার মূল কাঠামো পাল্টাতে পারবোনা । কিন্তু কিছুটা সংশোধন বোধ হয় করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সংখ্যা গরিষ্ঠতার মাত্রা বেশী হওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে একটা অহংবোধ , তার থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে, কিভাবে ? কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন শাসকের ভয় থাকবে, আসন হারানোর ভয়, ক্ষমতার থেকে দুরে চলে যাওয়ার ভয় থাকবে , ফেল করার ভয় থাকবে , তবেই দেশ বা রাজ্যকে ঠিকমতন বুঝবে । অর্থাত রোজ যেন পরীক্ষা দিতে হয় , প্রমাণ করতে হয় যে আমরা যা করছি সেটাই করা সম্ভব , আমার মনে হয় তখনই নাগরিক বেস্ট সরভিসটা পাবে। কি ভাবে করতে হবে সেটাকেই সাজাতে হবে – সবাইকে সাথে নিয়ে এক নির্মোহ আলোচনার মাধ্যমে।

এই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সামনে রেখে পরিবর্তনটাকে এফেক্টিভ করতে একটা বিচার, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের কাছ থেকে আশা করা বোধ হয় অমুলক নয় ।