Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জল রেখা ১০ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



হঠাৎ প্রচণ্ড কষ্টে ঘুম ভেঙে গেলো নিরূপের। অসহ্য ব্যথা হচ্ছে বুকে পেটে। দুর্বল শরীরেও বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেলো টয়লেটের দিকে। যা খেয়েছিল ডিনারে সব উঠে আসতে লাগলো যন্ত্রণাদায়ক অম্লতার সঙ্গে। তবুও বমি হয়ে যাবার পরে অনেকটা হাল্কা বোধ করলো নিরূপ। মুখে চোখে জল দিয়ে এসে আবার শুয়ে পড়লো। ভাবছিল সে... তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা কমে গেল তাঁর শারীরিক কষ্ট বমনের সাথে সাথে। কিন্তু অতীতের যা ভুলভ্রান্তি, সে সব কি বিষের অণু পরমাণু হয়ে ভেঙে ভেঙে মিশে গিয়েছে তার শরীরে? কোনওভাবেই কি কোনও পথ খোলা নেই সেই সব ভ্রান্তি থেকে নিষ্ক্রমণের? হয়ত বা কোনও এক অদ্ভুত সময়ে তারা সব একত্রিত হয়ে মরণবাণের মত তাকে প্রত্যাঘাত করবে। হয়ত সেই জন্য সে পালিয়ে থাকতে চায় তার অতীত থেকে। ঘুমাবার চেষ্টা করছিল সে। পারছিল না। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল তার তন্দ্রা। কখনও বা মনে আসছিল সেই অতীতের দিনগুলি। 

ঠিকঠাক তারিখ মনে পড়ছিল না তার। কত বছর আগে? চোদ্দ বছর? হ্যাঁ, তাই হবে। চোদ্দ বছর আগেই তার পোস্টিং হয়েছিল সেই পাহাড়ঘেরা শহরতলিতে। ‘সেখানে মেঘ গাভীর মত চরে’... হ্যাঁ, নিরূপ কবিতা ভালবাসত খুব। দুনিয়াটা অন্যরকম এক গোলাপি ভালবাসার চশমায় দেখত। কলেজ জীবনে সেভাবে কোনও মহিলাকে ভাল লাগেনি তার। মেয়ে ক্লাসমেট যারা ছিল তাদের বন্ধু ভাবলেও সেরকম বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি কারও সাথেই। সে যেন অপেক্ষায় থাকত কোনও এক মানসীর। যাকে কখনও সে দেখেনি, কিন্তু হঠাৎ কখনও দেখা হবে তার সাথে মাঝরাস্তায়। দমকা হাওয়ায় সরে যাবে সেই মানসীর মাথার ওড়না। চকিত চাহনিতে হঠাৎ হবে চার চোখের মিলন। সেই সময়ে বাতাসে মিশে যাবে ফুলের সুগন্ধ; সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে বেজে উঠবে মধুর সঙ্গীত,... এরকমই ভাবত সে। পরে যতবার নিজের এই ভাবনার কথা সে ভেবেছে, হাসি পেয়েছে; করুণা করেছে নিজেকেই। হয়ত বা ভাবনার ভুলের জন্যই মানুষ নিজের জীবনে অনেক ভ্রান্তির গলিঘুঁজি গড়ে তোলে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা সে খুঁজে পায়না। 

কিন্তু এই ভাবনার অনেকখানিই মিলে গিয়েছিল সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলে, যেদিন তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল আইয়মের। আইয়মকে দেখতে মোটেই আর পাঁচটা পাহাড়ি মেয়ের মত ছিলনা। কতকটা বাঙ্গালী মেয়ের মত টানা টানা চোখ, অনেকখানি টেনে আইলাইনার লাগিয়ে আরও উজ্জ্বল করে তুলত সে তার চোখের চাহনি। লাল লিপস্টিক লাগাতেও বেশ ভালবাসত সে। সেদিন বিকেলেও সেজেগুজে যাচ্ছিল সিনেমা দেখতে, নাকি মেলা দেখতে সেইই জানে। ভুল করে তার দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল। আসলে পাহাড়ের ঢালে পাঁচটা সিঁড়ি নিচেই ছিল আইয়মের বান্ধবীর দরজা। বান্ধবীকে ডাকতে ডাকতে আর ছাতার জল ঝাড়তে ঝাড়তে খোলা দরজা দিয়ে একদম ঢুকে পড়েছিল নিরূপের আঙ্গিনায়। 

নিরূপ তখন সেখানেই চায়ের টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল অফিস কলিগ দাসের জন্য। ছুটির বিকেল, শনিবার ছিল; আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা ছিল এটা মনে আছে। ওই পাড়ায় পাহাড়ের ধাপে সবগুলো বাড়ি দেখতে একই ধরণের ছিল। ভুল হওয়াটা খুব দোষের কিছু নয়। প্রথম ভুলটা আইয়মের ছিল। কিন্তু পরেরগুলো? আইয়ম তো দু মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল নিজের ভুল। বুঝতে পেরে ‘সরি’ বলে বেরিয়েই যাচ্ছিল। নিরূপের কি ওই মুহূর্তে অতটাই প্রগলভ হওয়ার প্রয়োজন ছিল? জানে না সে। বাতাসে সত্যিই সেসময় ভেসে এসেছিল নাম-না-জানা ফুলের সুগন্ধ। আইয়মের মাথার হালকা ওড়না খসে পড়েছিল বর্ষার জলের ফোঁটার চুমকি নিয়ে। অপ্রস্তুত চোখে হয়ত বা কিছু বেশীক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে সে তাকিয়েছিল নিরূপের দিকে। অচেনা কবিতার মত এক নারী পথ ভুলে এসে দাঁড়িয়েছিল তার আঙ্গিনায় ফুলে ফুলে ঢাকা নীলমণিলতা গাছটির পাশে। সেই ছবিটি এখনও অমলিন জেগে আছে নিরূপের মনে। 

আইয়ম দুঃখপ্রকাশ করে চলে যাবার জন্য যখনই পেছন ফিরেছিল, নিরূপের মনে হয়েছিল এই তার সেই মানসী। এক মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে চলে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়েছিল পেছন পেছন। জানতে চেয়েছিল, ‘ম্যাডাম, হোয়েন উইল ইউ রিপিট সাচ আ সুইট মিস্টেক?’ আইয়ম পাহাড়ের মেয়ে; সমতলের নয়। পুরুষতান্ত্রিক নয়, সে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে উঠেছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়নি এই হাল্কা ফ্লার্ট শুনে; উল্টে হেসেছিল, উচ্চস্বরে না হলেও, হেসেছিল সপ্রতিভ ভঙ্গীতে। জানতে চেয়েছিল সত্যিই কি নিরূপ অপেক্ষা করবে তার ভুল করবার জন্য? নিরূপ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল ভুলের জন্য নয়, সে অপেক্ষা করবে ঠিকের জন্য। ঠিকঠাক চিনে যেন সে আসে তার আঙ্গিনায়। বিশেষ তাড়া না থাকলে এখনই কি এককাপ চা খেয়ে যেতে পারেনা? গৃহস্থের অকল্যাণ হবে অমন শুধু-মুখে ফিরে গেলে... ইত্যাদি আরও কি যেন বলেছিল সে ওই মুহূর্তে; সেসব আর এখন মনে নেই। অত কথা সে অতীতে প্রথম দেখায় কোনও মহিলার সঙ্গে বলেনি, পরেও নয়। 

মনে আছে কথাবার্তার ফাঁকে জেনে নিয়েছিল তার নাম, আদায় করে নিয়েছিল আবার তার বাড়িতে আসার প্রতিশ্রুতি। আইয়মের হাতে গুঁজে দিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার লেখা চিরকুট। শুধু নাম নয়, ওই মুহূর্তে নিরূপ আরও জেনে নিয়েছিল ‘আইয়ম’ নামের অর্থ। মিষ্টি হেসে সেই নারী বলে গিয়েছিল তার নামের অর্থ ঋতু, সময়। নিরূপ বুঝেছিল পাহাড়ে মেঘ, বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়ার মাঝে কিভাবে যেন বসন্ত ঋতু এসে জায়গা করে নিতে চাইছে তার জীবনে। 



2

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ৮
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 05
24th. June, 1942, Wednesday.


প্রিয় কিটী,

প্রচণ্ড গরম পড়ে গেছে। বলতে পার বাড়ির মধ্যেই গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এই গরমে, ভাবতে পার আমাদের হেঁটে যেতে হচ্ছে। কারণ আমাদের সাধারণের জন্য সংরক্ষিত যানে যাওয়ার সরকারী অনুমতি নেই। যেখানেই যাব সেখানেই হয় আমাদের হেঁটেই যেতে হবে অথবা সম্ভব হলে পা-দানি ওয়ালা টমটম গাড়ীতে যেতে পারি। হাঁটার সময় যখন পাশ দিয়ে, ট্রামগুলোকে যেতে দেখছি, তখন আবার নতুন করে অনুভব করছি ট্রামগুলো সত্যিই কি সুন্দর ছিল। কিন্তু কি করব, আমরা ইহুদি, আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, আমরা ট্রামে চড়তে পারব না। আমাদের যাতায়াতের জন্য সরকারী হুকুমে বরাদ্দ শুধু পা-দানি ওয়ালা ট্মটম গাড়ী। আমাদের জন্যে সেই ভাল। জান, কাল দুপুরবেলায়, মধ্যাহ্ন ভোজের আগে, আমায় “জান-লুকেনস্ট্রাটে (Jan-Lukenstraat) দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত দেখাতে যাওয়ার কথা ছিল। আমায় যেতেও হয়েছিল। বলতে পার প্রায় হেঁটেই। জায়গাটা ঠিক কোথায় জান? স্ট্যাডসটিয়ারটউনেন (Stadstimmertuinen), যেখানে আমাদের স্কুল, সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আর সবসময় ত’ অত দূরের জন্য টমটম গাড়ী পাওয়া যায় না । ওখান থেকে ঘুরে এসে আমাকে আবার সরাসরি স্কুলে যেতে হয়েছিল। অতটা পথ ঘুরে দাঁত দেখিয়ে এসে তারপর স্কুলে আসা। এত ক্লান্ত লাগছিল যে বিকালের দিকে স্কুলে বসে বসেই আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যভাল, খিদে তেষ্টা পায় নি। আসলে দাঁতের ডাক্তারের সহকারিনী ভদ্রমহিলা খুব ভাল আর বেশ দয়ালু ছিলেন। আমি যখন ডাক্তারের ওখানে বসে ছিলাম, তখন উনি আমায় একগ্লাস শরবৎ খেতে দিয়েছিলান। সত্যিই ওই মহিলার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ওইটুকু না পেলে, আমি কি করে যে থাকতাম, কে জানে! 

Merwedeplein এর সেই বাড়ি যেখানে অ্যানি ও তার পরিবার ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বাস করত।

টমটম ছাড়া আমাদের কেবল ফেরী পথে পারাপার করার অনুমতিও আছে। সুতরাং কোথাও যেতে হলে, হয় ট্মট্ম গাড়ী অথবা ফেরী পারাপার, এই আমাদের জন্য বর্তমানে যাতায়াতের বন্দোবস্ত। জোসেফ ইসরেলস্কেড ( Josef Israelskade ) থেকে কেবল একটাই মাত্র নৌকা আছে। আমরা যখনই কোথাও যাব বলি, নৌকার মাঝি আমাদের বিনা বাক্যে তৎক্ষণাৎ সেখনে নিয়ে যায়। অন্যথা করে না। বলতে পার এটাই আমাদের ভাগ্য। তাই বলছিলাম, আমাদের এই অসহনীয় অবস্থার জন্য কখনই হল্যান্ডবাসীকে দায়ী করা বা দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তারা ত’ আমাদের জন্য এই নিয়ম করে নি। বরং তারা আমাদের যাওয়া আসার এই অসুবিধাটা উপলব্ধি করে। আর তার জন্যে সাহায্যও করে। 

এর মধ্যেই একটা ভাল খবর হলো, আমাকে এখন হয়তঃ আর স্কুলে যেতে হবে না। এর প্রাথমিক কারণ হলো, গত ইস্টারের ছুটির সময় আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, আমার বাবা তার সুন্দর টাকা রাখার বাক্সটা তাঁর এক বিশ্বস্ত খ্রিস্টান পরিবারের কাছে নিরাপদে রাখার জন্য দিয়েছে। তাই যাওয়ার হাতখরচের টাকাও তিনি এখন দিতে পারবেন না, অথবা নতুন সাইকেলও কিনে দিতে পারবেন না। ভগবানের দয়ায়, আমাদের স্কুলে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ছুটি শুরু হবে। অতএব, আর মাত্র এক সপ্তাহ কাটাতে পারলেই স্কুল যাওয়া সংক্রান্ত এই দুঃশ্চিন্তা থেকে আমি মুক্তি পাব। জান, গতকাল একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি কিছুটা আনমনে সাইকেল রাখার শেডের পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। চমকে উঠে, চার দিকে তাকিয়ে খুঁজে দেখি, একটি সুন্দর দেখতে ছেলে আমায় ডাকছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎই মনে পড়ে গেল, আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় আমার বন্ধু ইভার বাড়ীতে ছেলেটির সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। মনে পড়ল ছেলেটি বেশ লাজুকের মতো আমার দিকে পরিচয় করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। নিজের নাম বলেছিল হ্যারী গোল্ডবারগ ( Harry Goldberg )।


হ্যারী গোল্ডবারগ, ( আসল নাম, হেলো সিল্ভারবুরগ-Hello Silberburg, সিল্ভারবুরগ ওরফে গোল্ডবারগের এই ছবিটি ১৯৭৮ সালে তোলা) আত্মগোপনের আগে অ্যানির প্রথম রোমান্টিক সম্পর্ক এঁর সাথে গড়ে ওঠে। 

ওকে আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে, আমি প্রথমে একটু অপ্রস্তুত আর অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ও আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসছে কেন! তবে কথাটা বেশীক্ষণ আমায় ভাবতে হয় নি। কারণ সে-ই সরাসরি আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘সে আমার সাথে স্কুলে যেতে পারে কি’না!! আমিও বললাম, “আমি যে দিকে স্কুলে যাব, তুমিও ত’ সেদিক দিয়েই স্কুলে যাবে। তাই তোমার সাথে একসাথে স্কুলে যেতে আমার কেন কোনও আপত্তি থাকবে!!” এ’রকমই একটা উওর আমি মজা করেই তাকে দিয়েছিলাম। তারপর অবশ্য ওর সাথেই আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। জান, হ্যারীর বয়স, আমার আন্দাজ ষোল হবে। হ্যারী একসাথে যাওয়ার সময় বিভিন্ন রকম মজার মজার কথা বলত। আমার বেশ ভাল লাগত। পরের দিন সকালেও দেখি, হ্যারী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মনে হয়, এখন থেকে হ্যারী আমার জন্য এ’ভাবেই অপেক্ষা করবে।

ইতি,
অ্যানি
0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত 
সুবল দত্ত 



তমসায় কেঁদে উঠলো কেঁপে কেঁপে, আর তার অন্তর দৃষ্টিতে জেগে উঠলো ইতিহাস

পেরো 

আনাড়ি জংলীদুটোকে দিয়ে কাজ করানো খুব কঠিন। এটা পেরো হাড়েহাড়ে বোঝে। খরস্রোতা পাহাড়ি জঙ্গলি নদীর একেবারে পিছল খাড়া খাই থেকে একটা মানুষের দেহ এত উপরে উঠিয়ে আনা এমনিতেই ঝামেলা। তার উপর এই লোকগুলো মানুষ পাথর কাঠের গুঁড়িকে একই গুরুত্ব দেয়। এইসবকে দিয়ে দল তৈরি করে শিক্ষিত লোভী অমানুষ শোষকদের সামনা করা খুব কঠিন কাজ। গাছপালা জানোয়ার পাখি পোকামাকড় জংলী মানুষ যেই হোক না কেন, জঙ্গল রানী তার প্রজাকে এক অতিন্দ্রিয় স্পর্শকাতরতা দিয়েছে। বিপদ এলেই সে তাকে আগেভাগে তার সংকেত দিয়ে দেয়। সংকেত পড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও সে তাকে দেয়। বংশানুক্রমে সেই সংকেত আদিবাসীরা তাদের পূর্বজের কাছ থেকে পায়। এই নিয়মেই জঙ্গলের প্রাণী বিপদসংকুল বনানীতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা পায়। বাজ পড়ার আগে মানুষের চুল খাড়া হয়ে যায় ছুঁচের মত। সতর্ক হয়ে যদি সে সেখান থেকে সরে যায় তো ভাল, নচেত্‍ মৃত্যু। বাঘ আসেপাশে ওত পেতে থাকলে তার গায়ের বিকট গন্ধে সতর্ক হয়ে যায় শিকার। একধরনের বুনোঘাসও মারণ বিপদের সময় বিকট গন্ধ ছড়ায়। যার ইন্দ্রিয়ের সাড় আসে সেই বাঁচে। কিন্তু এই দোগলা আদিবাসীরা ওই স্পর্শকাতর ক্ষমতাটি দিনদিন হারিয়ে ফেলছে যেন। আর আমি কি ওদের চেয়ে আলাদা? পেরো দোষারোপ করে নিজেকে। আগে জঙ্গলে দিশাহারা পথহারা হয়ে মাসের পর মাস যখন ঘুরে বেড়াতাম, খাদ্য পানীয়ের কোনও কি অভাব হতো? বড় বড় পাথরের কোলে লম্বা লম্বা রসালো ঘিকুমারির পাতা থেকে জল, বনকলা, মহুল, ঘুঘু আর সাপের মতন তুড়মাছ। উইঢিবি ভেঙে সাদা সরস উইপোকা। ফরফর করে ডানা মেলে উইগুলো উড়তো আর আঁজলা ভরে ধরতাম আর মুখে পুরতাম। কিন্তু উইঢিবি ভাঙ্গলেই যে উই ডানা মেলে উড়তে থাকবে তা নয়। সেই উইঢিবি যদি সাপের কবলে থাকে, তা ভাঙ্গতেই ফোঁস করে লাফিয়ে বিষধর খরিস কপালে ছোবল মারলেই তার আর বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু তখন এমন হতো, ঢিবির গায়ে হাত বুলিয়েই বুঝে যেতাম সেটাতে নির্বিষ ডানাওলা পূর্ণ উই আছে, কি ভিতরে শমন।

কিন্তু আজকাল সেই হুঁশটা আর নেই। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি আজকাল। শহুরে মানুষের ফন্দিফিকির শিখে এমন হচ্ছে হয়ত। আমার তো নাহয় কারণ আছে, কিন্তু এই আদিবাসী ভাইগুলোর? জংলি নদীর মারন পিছল উঁচু পাড়ের উপরে জেরকাকে তুলে আনতে যে কি কষ্ট হলো সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তার উপর খাড়ির ভিতরে রাত নামছে। জেরকাকে উপরে তুলে আনতে একবার ওদের কাঁধ থেকে যখন পিছলে আবার সে মাথার ভরে গড়িয়ে পড়ল, তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম ওটা মড়া। জেরকা ওই অবস্থাতেও যে মারা যায়নি সেটা জঙ্গল রাণীর কৃপা। জেরকা এখন হাত পা ছড়িয়ে মড়ার মতন মাটিতে পড়ে। চাঁদনী আলোয় গোরা সাবজী হলুদ চট্টানের উপর শোয়া কালো মেয়ের খোলা বুকে কান রেখে শুনছে সে বেঁচে আছে কী না। পেরো চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে রয়ে গেল। বড় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। অবশ্য সাবজী জেরকার গায়ে লেপ্টে যেতেই পারে। সাবজীর হক আছে। কিন্তু পেরোর গা রিরি করে ওঠে। জেরকা তো ওর মা, সেটা পেরো ভালই জানে। কিন্তু ওই জানা অব্দি। মন প্রাণ সাড়া দেয় না। কোনও অনুভূতি হয়না জেরকার সামনাসামনি হলে। বরং অস্বস্তি হয়। এমনকি কোনও প্রাণীরই মাদা পছন্দ নয় তার। পেরোর একটু দেখা পেলেই জেরকা মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। এই ব্যাপারটাও পেরোর মাথায় ঢোকেনা। পেরোর মাথায় তাই হয়তো একটাই নির্দেশ কাজ করে। মাদী বাদ দিয়ে সমস্ত মদ্দা জানোয়ার তার হয় শিকার, নয় খাদ্য। এরমধ্যে মাদী হিংস্র হলেও তাকে এড়িয়ে চলে। পেরো জানে জেরকা সাবজীর মতন না হলেও কিন্তু শিক্ষিত। আদিবাসী বুনো মানুষের হকের জন্য জেরকা শহরের বাবুদের সাথে অনেক লড়াই করে। অনেকবার জেল খেটেছে। ওকে এখন কে জখম করেছে কে জানে? এই কথা মনে আসতেই পেরোর গা গরম হয়ে গেল। গতকালই একটা লোভী পোচারকে সে খাঁড়ির দলদলে পুঁতে দিয়ে এসেছে। জেরকার অনিষ্টকারীকে সে কোনও মতে ক্ষমা করবেনা। ধরতে পারা চাই। আসলে লোভী চোরডাকাত খুনীর চেয়ে অনেক বেশি শয়তানী বুদ্ধি ওই সরকারি লুঠেরাদের। ওদের কাছ থেকে ভালো কিছুই আশা করা যায় না। সরকারি চাকুরে হওয়ার আগেই তাদের রক্তের স্বভাব বদলে যায়। তারপর শুরু হয় নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চাকরি বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে লোভকে আর তোষামদপ্রিয়তাকে কি ভাবে পরিশীলিত করা যায় দিনরাত এই চিন্তা। আদিবাসীদের নানান অনুদান সরকারি অফিসে যখন আসতো তখন পেরো সকলকে নিয়ে সেখানে যেত আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতো। ওদের চোখে শিক্ষিত হওয়ার অহংকারের পর্দা, তাই পেরোর সামনেই ঐসব নাটক চলতো। ভাবতো বুঝি পেরো জঙ্গলী নির্বোধ। পেরোর গা গসগস করতো রাগে।

সাবজী উঠে দাঁড়ালেন। পেরোকে বললেন,- নাড়ি খুব কমজোর। মাথায় গায়ে প্রচুর আঘাত। মনে হয় কেউ ভোজালি দিয়ে অনেক জায়গায় স্ট্যাব করেছে। শরীরে মনে হয় খুন খুব কম। আদিবাসী রক্ত বলেই এখনও প্রাণ আছে। জ্ঞান ফেরাতে হবে। এখান থেকে ওকে সরানো দরকার। ঘরে নিয়ে চল।

ঘরে নিয়ে যেতে হবে? পেরো অবুঝের মতো সাবজীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্জন বনানীর জ্যোত্‍স্না। চারদিক পরিষ্কার দৃশ্যমান। সাবজী বললেন –জানি পেরো। তোদের ঘর বলে তো এখন কিছুই নেই। আপাতত আমার ঘরে নিয়ে চল। তুই তো এখানে মোস্ট ওয়ান্টেড। তোর মাথার দাম পাঁচ লাখ। আমাদের গ্রামের সবাই ছাড়া ওরা কেউ তোর এখানে আসা যাওয়ার খবর জানেনা। দেখ আমরা সবাই কতো ভালবাসি তোকে। জেরকার নামেও ওয়ারেন্ট আছে। তবু আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। লেফ্টনেণ্ট সমুর সাথে যা হবে তার চেয়ে এর জান বাঁচান বেশি প্রয়োজন। তুই ওখানে পৌঁছে দিয়ে চলে যা। আমি সামলে নেব।

কি মনে হতে পেরো জেরকার পাশে বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে গলার পাশে আঙুল দিয়ে একটা শিরা টিপে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে লাগলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সাবজী থোড়া রুকিয়ে। ইসকা বদন গর্ম করনে কে লিয়ে এক দাওয়া ম্যায় জানতা হুঁ। বদন ঠাণ্ড হো রাহা হ্যায়। ম্যায় আভি লায়া- এই কথা বলে সেখান থেকে হাওয়ার বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

চাঁদটা যেন মস্তবড় রূপোর থালা হয়ে আকাশে ঝুলে আছে। জঙ্গলের এই এলাকাটা সবচেয়ে উঁচু। এখান থেকে পৃথিবীটা ঢালু হয়ে গড়িয়ে অশেষ অন্ধকারে নেমে গেছে। রাতচরা মাংসাশী শ্বাপদের ধর্মই হচ্ছে রাতের বেলায় শিকারের খোঁজে ওরা পাহাড়িয়া জঙ্গলের নিচে নেমে যায়। টাপু তাই সবচেয়ে নিরাপদ। পেরোর কাছে এই জঙ্গলের এলাকা নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতই চেনা। চোখ বন্ধ করেও যেখানে খুশি যেতে পারে। যেতে যেতে বিছুটির ধারালো পাতায় পা ঘষটে গেল। অজস্র ছুঁচ বেধার মতো পাদুটোতে অসহ্য জ্বালা। পেরো লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়তে লাগলো। একটা মস্ত চৌড়া বাঁশ ঝাড় পেরিয়ে একটা ফিট সাদা মতন জায়গায় এল। কোয়ার্জ পাথরের একটা স্তুপ থেকে হাজার চাঁদ ঠিকরে প্রতিফলিত হচ্ছে। চাঁদের আলোতেও চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পেরো দেখল তার গায়ে চকরা বকরা নক্সাকাটা আলো। একটু এগিয়েই একটা গর্তে বেশ কিছুটা ঝাড়ির সামনে উবু হয়ে বসল। প্রচুর কলস উদ্ভিদের পাতা ঢাকনা খুলে ফাঁদ পেতে রয়েছে। পাতার ডগা ছোটো ঘটি আকারের। কলসগুলোর মুখ মধুতে চকচক করছে। অনেক জায়গায় কলস পাতা দেখেছে পেরো। সেগুলো খুবই ছোটো। এখানকারগুলো অনেক বড়। প্রায় এক হাতের আঁজলার সমান। পেরো কয়েকটা কলসপাতা ছিঁড়ে নিল। আর একবার একটু ছোটো দৌড়। এবার লম্বা লম্বা ঘন গাছের আড়ালে একটা গোল মতন চত্বর।চত্বরটার মাঝে চ্যাটালো পাথর।পাথরে মাঝে মাঝে কয়েকটা ছোটো বড় গর্ত। চত্বরের চারপাশের গাছগুলোর লম্বা লম্বা ডালগুলো পাথরের উপরে নুয়ে। গাছের ওই শাখাগুলোতে প্রচুর মৌচাক ঝুলে আছে। প্রকৃতির কি অদ্ভুদ খেয়াল ! পাথরের উপর ঘন হয়ে নুয়ে থাকা ডালগুলি থেকে ঝুলে থাকা মৌচাকের মধু বৃষ্টির জলের সাথে বা এম্নিতেই হাওয়ার দাপটে টপ টপ করে ঝরে পড়ে জমা হয় পাথরের গর্তে। পচন হয়। তৈরি হয় বিরল মদ মাধ্বী। মহা সঞ্জীবনী সুরা। পেরো জানে এখানকার মৌমাছিগুলো ভয়ানক হিংস্র।মারকুটে। তবে এখানকার সন্ধান শুধু পেরোই জানে। আর জানে একটা ভালুক। ভালুকটা আসে গভীর রাতে। এসে মধু সুরা পান করে যায়। পেরো কখনও কখনও আসে সন্ধ্যের গোড়ায়। ওদের ভিতরে অজান্তেই একটা বোঝাপড়া হয়েছে। কেউ কাউকে ঘাটাতে চায়না।

খুব সাবধানে পা টিপে টিপে পেরো একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। পাথরের চট্টানটা হালকা সাদা, তাই গাছের ঘেরায় অন্ধকার হওয়া সত্বেও আভাসে বোঝা যায়। চোখ কান খোলা রেখে কিছুক্ষণ দেখল নিঃশব্দ নিঝুম। কেউ নেই। হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের মাঝবরাবর পৌঁছে একটা গর্তে হাত ডুবিয়ে দেখল বেশ কিছুটা তরল জমা আছে। কলস পাতা কয়েকটা ডুবিয়ে তাতে ভরে নিলো আর আঁজলা ভরে কিছুটা খেয়েও নিলো। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে দৌড় লাগালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রথমেই মাটিতে পড়ে থাকা জেরকার গলার কাছে হাত দিয়ে দেখলো গা ঠাণ্ড কিন্তু গলার কাছে ধুকধুকি নড়ছে।


0

ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



(দেবগ্রাম নামক অখ্যাত গ্রামের সম্পন্ন এক গৃহস্থের বালক এক প্রত্যুষে গৃহত্যাগ করিল সেই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধার সাহায্যে, যে বৃদ্ধার সেই বালকটি অপেক্ষা আপনজন আর কেহ নাই, কিন্তু অনাথা বৃদ্ধা পরিবারেরও কেহ নহেন। বালকটি আর কেহ নহে, সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার কনিষ্ঠ পুত্র। কিন্তু বালকটি গৃহত্যাগ করিল এমন এক সময়ে যখন গৃহে অপর এক সন্তানের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আসিয়াছে, বাটীস্থ সকলে ভীত, সন্ত্রস্ত। এমত সময়ে বালকটী গৃহত্যাগ করিল উচ্চবিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে। বালকটি গৃহত্যাগ করিল, কিন্তু বাটীস্থ সকলের কি হইল?
পরদিন সকালে গৃহের মহিলা ও পুরুষদিগের নিকট বালকটির গৃহত্যাগের সংবাদ কি গোপন রহিল, নাকি বালকটিকে তাঁহারা বিস্মৃত হইলেন? যদি জানিলেন, তাহা কি প্রকারে? )

পরবর্তী অংশ.........


সকালে ঘরে ঘরে চা পৌঁছাইবার দায়িত্বে আছে আরও একটি কন্যা, সেও আশ্রিতা। গরীব বাপ- মায়ে তাহাকে দোজবরে বিবাহ দিয়াছিল, তাহাতে শুধুমাত্র অরক্ষণীয়া নামটি ঘুচিয়াছে। কিন্তু পাত্রের স্ত্রীটি বর্তমান, ইহার সহিত ঘর করে নাই, সেই স্ত্রীর সহিত সংসার করে। এই কন্যাটির নাম মালতী, সম্পর্কে সেও বুঝি শিবতোষের কন্যা স্থানীয়া। বাপ-মা মরিতে শিবতোষের নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে।মালতীর তাহাতে দুঃখ নাই। এইখানে আশ্রয় পাইয়া সে ভাল আছে। অমন স্বামীর ঘর করা অপেক্ষা ইহাদের সহিত সুখ-দুঃখে থাকা ঢের ভাল বলিয়া মনে করে। 

মালতী কর্তামশাইয়ের ঘরে চা পৌঁছাইয়া দিতে গিয়াছিল, দ্বিতল হইতে নামিয়া আসিয়া পাকশালে মুখ বাড়াইয়া কহিল---উপরে কাকাবাবু বড় বৌদিদিকে ডাকছেন, কথা আছে বললেন।

তখন গ্রামাঞ্চলে শ্বশুর-বৌয়ের কথাবার্তা বিশেষ হইত না, হইলেও কদাচিৎ। রোগ বালাই হইলে তবেই, নচেৎ পিত্রালয় হইতে কেহ আসিলেও কথা হইত অন্যের মারফৎ। শিবতোষ তাহা খুব একটা মানিতেন না, প্রয়োজনে কথা কহিতেন। বধূগুলি তাঁহার কন্যাস্বরূপা। যে শিশুকন্যাগুলিকে তিনি কোমল বয়সে গৃহে আনিয়াছিলেন, তাহাদিগের অবহেলা সহ্য করিতে পারিতেন না। বোধকরি স্বীয় কন্যার মৃত্যু তাঁহাকে এইরূপ ভাবিতে বাধ্য করিয়াছিল।

মালতীর কথা শুনিয়া পারুলবালা স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। কথাটি সোনা পিসির কানে গিয়াছিল। মুখ বাঁকাইয়া বলিয়া উঠিলেন—তোমার যাবার কি দরকার বাছা, আমি শিবুকে শুধিয়ে আসছি। একি বেয়াক্কেলে কথা! শিবুর যেমন..., যাই দেখি’ বলিয়া সুন্দরি শিবতোষের ঘরের দিকে যাইবার জন্য পাকশালা হইতে বাহির হইলেন। দুই জায়ে নিম্নস্বরে কিছু বলাবলি করিতে লাগিল। আজিকার সকালে আর তাহাদের ‘আরাম ঘরে’ আরাম করিয়া চা পান হইল না।

খানিক পরেই সুন্দরি ভারি মুখে ফিরিয়া আসিলেন, পারুলবালাকে বলিলেন—‘যাও বাছা, তোমাকেই ডাকছে। জানি না বাপু, এই বাড়ির সবই অন্যরকম। কে কবে শুনেছে, শ্বশুর ঠাকুর সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে বৈঠকখানায় না বসে ঘরের বৌদের ডেকে পাঠাচ্ছে! যাও, শুনে এসো। বেশী করে ঘোমটা দিও, তুমি আবার টুনটুনির মত কান পর্য্যন্ত ঘোমটা দিও না। আমাদের সময় চোখে রাস্তা দেখতে পেতাম না এত বড় ঘোমটা ছিল, যাও!’ 

সকালবেলা এইসব কথাবার্তা টুনটুনির ভাল লাগিতেছিল না। সুন্দরির কথার ইঙ্গিতে সে বিরক্ত বোধ করিতেছিল। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত কথা বলিতে ইচ্ছা করিল না, তাহার মনে অজানা আশঙ্কা ভিড় করিতেছিল। ছোট ঠাকুরপো কোথায়, তিনিও কি ভাসুর ঠাকুরের মত স্বদেশী হইলেন? এই বাড়ির মধ্যম পুত্রটি ছোট ঠাকুরপোকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, ছোট ঠাকুরপোর সন্ধান না পাইলে কি হইবে, এই ভাবিয়া টুনটুনির বুকে ভয় জমিতেছিল। ধীরে ধীরে সে পাকশালা হইতে বাহির হইয়া কুটনা কুটিবার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। এখন সকালের আলোয় পুনর্বার স্বামীর ঘরে যাওয়া ঠিক হইবে না, লজ্জা করিবে, রীতি অনুযায়ী তাহা নিন্দারও বটে। কিন্তু কি এক উৎকন্ঠা তাহাকে ঘিরিয়া রহিল। 

পারুলবালা এক পা এক পা করিয়া দ্বিতলে শ্বশুর মহাশয়ের ঘরের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পিছনে অত্যুৎসাহী সোনাপিসি। শিবতোষের নিকট তাড়া খাইলেও কৌতুহল বড় বালাই। ঘরের সামনে আসিয়া গলা খাঁকারি দিয়া শিবতোষকে ডাকিলেন— বড়বৌমা দাঁড়িয়ে আছেন’। 

বধূদিগের সম্বন্ধে সম্মান করিয়া কথা বলিতে শিবতোষই শিক্ষা দিয়াছেন। বধূদিগের এত সম্মানও কেহ কেহ ভাল চোখে দেখে না, কিন্তু শিবতোষের সম্মুখে তাহার অন্যথাও কেহ করিতে সাহস করে না। শিবতোষ বোধকরি ভিতরে গৃহিণীর সহিত কথা কহিতেছিলেন, সুন্দরির গলা পাইয়া বাহিরে আসিয়া দরজার মাঝখানে দাঁড়াইলেন, সুন্দরিকে দেখিয়া ঈষৎ ভুরু কুঞ্চিত করিলেন, বলিলেন— তুমি কেন, নিচে যাও।‘

সুন্দরি একবার দুজনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিচে নামিয়া গেলেন। শিবতোষের চিন্তাচ্ছন্ন মুখ এইবার পারুলের দিকে ফিরিল। কহিলেন বড়বৌমা, রণ কোথায়, সে কি তোমায় কিছু বলে গেছে?’ শ্বশুরের সহিত কথা কহা পারুলের অভ্যাস নাই, স্বামীর ব্যাপারে তো নয়ই, কোনওদিন কহেনও নাই। পারুল ভীত হইল। তাহাকে নিশ্চুপ দেখিয়া শিবতোষ আবার প্রশ্ন করিলেন— কোথায় সে’?

বড়বৌমা কি বলিলেন, শিবতোষ শুনিতে পাইলেন না। শুধু ‘ছোট ঠাকুরপো কথাটি কানে গেল। বলিয়া উঠিলেন— আঃ, আবার তাকে কেন, তাকে কে বলতে বলেছে এসব কথা...ডাকো তাকে’।

পারুলবালা আবার বলিতে চেষ্টা করিল, পারিল না। ঠোঁট কাঁপিতেছে, চক্ষে জল...শুধু কোনওমতে আবার বলিল— ছোট ঠাকুরপো...’

শিবতোষ এইবার বিরক্ত হইলেন, ঈষৎ জোরে বলিলেন কি হচ্ছে কি, রণ কোথায়? আমি কি জ্ঞানের কথা তোমায় শুধুচ্ছি? খালি ছোট ঠাকুরপো, ছোট ঠাকুরপো......কোথায় সে? 

নেই, পাওয়া যাচ্ছে না--’

—‘ক্‌কি...’ এইবার গর্জন করিলেন শিবতোষ। কিন্তু বলিতে বলিতেই দেখিলেন বড়বৌমা মূর্ছিত হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন। অতিকষ্টে পারুলবালা সাহস সঞ্চয় করিয়া শ্বশুরমহাশয়ের সম্মুখে কথা কহিয়াছে, কিন্তু শেষরক্ষা করিতে পারে নাই।

আতঙ্কে শিবতোষের শরীর হিম হইয়া গেল।



(ক্রমশঃ)
2

ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস

Posted in


ধারাবাহিক


ফেরা – ২
রাজর্ষি পি দাস



ষষ্ঠি 

অক্টোবর ২০১৯ 

ডক্টর অর্পিতা বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। আমাকে অনুশাসনে বাঁধতে বাঁধতে অপরাধী করে তুলছে। সারাদিন নিজেকে ক্রিমিন্যাল মনে হয়। আজ বাড়ি ফাঁকা, তাই আমিও ঠিক করেছি একটা ২ লিটার আর সি ফাঁকা করে দেবো! সবাই মার্কেটিং এ গেছে! -সবাই বলতে? আশ্চর্য এ বাড়িতে আমি ছাড়া আর কে থাকে! 



ঠিক আজকের দিনে, ষষ্ঠীতে, আমার প্রথম হিরো গান্ধী ঢাকি আসত। সুদূর তিনসুকীয়ার খগেশ্বর রোডের খেলার মাঠে আজকের দিনে ঠিক দুপুর ২-৩ এর মধ্যে আমার হিরোর পদার্পণ ঘটত। আমি মহালয়ার দিন থেকে দুপুর গুনতাম। গান্ধী এসেই ঢাকে প্রথমে ডানহাতের কাঠির ডি ঢি ড্যাং/ ডি ঢি ড্যাং/ ডি ঢি ড্যাং-ব্যাস পড়াশুনা বন্ধ, নিয়মনীতির মৃত্যু, অপার স্বাধীনতা, মা ঠিক ঢাকের বাঁ কাঠি বাজার আগে বলত--নে তোর গান্ধী এসে গেছে! সারা শরীরে নোনতা শিহরণ নিয়ে এক হাতে হাফপ্যান্ট ধরে ঐ যে দৌড়–আহা বাড়ি থেকে মাঠে পৌঁছনোর ঐ ২ মিনিটের আনন্দ আমি আজও অতিক্রম করতে পারি নি। প্রথম ট্রেনে চড়া, প্রথম নারীর সম্মতি, প্রথম বেতন, প্রথম পাহাড় বা সমুদ্র- কেউ পারে নি। ঐ দৌড়তে দৌড়তে চোখ ভিজে যেত আর যখন আমি গান্ধীর সামনে গান্ধী ঝাপসা। আমার হিরো আমার দিকে তাকিয়ে যথারীতি গোঁফের হাসি। দুতিনবার পাক মেরে অফ তালে বাজিয়ে সোজা আবার বোধনের তালে - ইতিমধ্যে আমার বন্ধুরা- না শুধু আমার বন্ধুরা নয়, দাদা-কাকু-জেঠু-দাদু সবাই হাসিহাসি মুখ নিয়ে গান্ধীকে ঘিরে দাঁড়াত। শুধু আমার নয় পুরো পাড়ার ছুটি ঘোষণা করত আমার হিরো। 

বাজানো শেষ হলে আমরা ক্ষুদেরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কারণ এবার ঢাকের পেছনে জল ঘষার পালা – কে আগে! কোনওদিন সামনের চামড়ায় স্পর্শ করার সুযোগ পাই নি, দাদারাও পেতেন না। গান্ধী নিজের ঢাক বলা যায় বুকে আগলে রাখতেন। আমরা ঘ্যানঘ্যান করলে গান্ধীর প্রতিবছর এক উত্তর – কোন ক্লাস? আমরা কোনও উত্তর দিতাম না। কারণ আমরা পরের উত্তরটা জানতাম – মেট্রিক পাশ কর, তারপর।

আমার কাছে পূজার চেয়ে অনেক বড় ছিল আমাদের ঢাকি। বাকী যাঁদেরকে নিয়ে এত হুলুস্থুলু তাঁরা তো সবাই মাটির ডেলা। বাক্যালাপ করা যায় না, প্রতিক্রিয়াশূন্য রংচঙে তিনজন মহিলা, দুজনপুরুষ, একটি সিংহ, একটি কেলানো মহিষ, একটি নেংটি ইঁদুর, একটি পেঁচা, একটি ময়ুর, একটি হাঁস ও একজন গণেশ। পেছনে এক একা মাকড়শার ঝুলের মত শিব ঝুলছে। প্রতিবছর একই সমাহার। হ্যাঁ গণেশের প্রতি আমার একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল, সেটা কেন বলতে পারবো না, হয়ত ভবিষ্যত দেখেতে পেতাম সেটা তখন বুঝতে পারতাম না, এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝি। 

আমার হিরো কিন্তু প্রতিবছর নতুন কিছু না কিছু তাল তুলে আনত। সেটা অষ্টমীর রাতে আরতি প্রতিযোগিতায় আছড়ে পড়ত আর আচ্ছা আচ্ছা আরতি করিয়েরা তাল কেটে দাঁড়িয়ে পড়ত। তবে ভুপতিদার ব্যাপার আলাদা ছিল, গান্ধীও ওঁকে শ্রদ্ধা করতেন। ভুপতিদা মানেই আরতিতে প্রথম পুরস্কার। দুজন দুজনকে দাঁড় করিয়ে দিত আর হাসত। একমাত্র ঐ ভুপতিদার আরতির সময় গান্ধী পায়ে বড় ঘুঙুরের গোছা পড়ত আর ভুপতিদার তো ওটা নিজস্ব শব্দমেজাজ ছিল। ধুনুচি খেলা শেষ হলে শুরু হতো দুজনের আসল নাচ, ঐ প্রথম তালনৃত্য কাহাকে বলে দেখা। পাড়ার মেয়েরা রবীন্দ্র সংগীতে নাচত কিন্তু সেটা কেমন যেন বাসীরুটি খাওয়ার মত শক্তশক্ত লাগত! 

ভুপতিদার ধুনুচি করিশ্মা দেখানোর সময় গান্ধী তিনতালে বাজিয়ে যেত, তারপর নিজের নতুন তাল ঢাকে খুব মৃদু থেকে চড়া, ততক্ষণে দুজনের পায়ের তিনবেড়ির ঘুঙুর, ভুপুতিদাকে একটা একটা সময় দাঁড়িয়ে পড়তে হতোই।! সাথে তুমুল হাততালি আর চিৎকার, না ভুপতিদার হেরে যাওয়ার জন্য নয়, কারণ এবার শুরু গান্ধীর নাচ। ভুপতিদা হাসতে হাসতে তিনবেড়ির ঘুঙুরে তালটা ধরে রাখতেন আর গান্ধী অদ্ভুত সব তাল, মাঝেমধ্যেই মধ্যে শুধু ডানহাতের চেটো দিয়ে ঢাক ঘষে অভূতপূর্ব সাউন্ড - সর্বোপরি শূন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে মুহূর্মুহূ ঘুরে দাঁড়ান। কাঠি কিন্তু চলছে-- শিরদাঁড়া দিয়ে আনন্দ উথলে চোখের জল সাথে প্রবল ধোঁয়া, টিউবের আলো, ঢাকের তাল আর ঘুঙুরের ছমছম মিলেমিশে এক অস্পষ্ট স্বর্গীয় আবহে একজন শীর্ণ ঢাক বাদকের ঐ স্কীল, স্টাইল, প্রাণশক্তি এক জলজ্যান্ত দেবতার জন্ম দিত। 

না, একজন ঢাকির ঐ ম্যাজিক, শোম্যানশিপ আর কোথায়! আমি দামড়া হয়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক ঢাকি দেখেছি, শুনেছি- নাঃ! আর ঢাকের ঐ টোন! এখন ঢাক শুনলে মনে হয় বেসুরো বাজছে। 

না, মেট্রিক পাশ করার পর গান্ধীর সাথে আর দেখা হয় নি, ততদিনে জাতি-ভাষা দাঙ্গায় গল্প সব অন্য হয়ে গেছে। তবে আমার হিরো আমার মধ্যে এখনো বেঁচে আছে। জানি না গান্ধীদা এখনও বেঁচে আছে কিনা বা কোথায় থাকে। সে এখনও ষষ্ঠীর দিন-- দুপুর ২-৩ এর মধ্যে ঠিক বেঁচে ওঠে, সে যেখানেই থাকি না কেন, বেজে ওঠে আর দশমী পর্যন্ত স্বাধীন ও উদ্দাম আমি -- ২ লিটার RC আছে গান্ধীদা। না, পুরো নাম জানি না! চিয়ার্স গান্ধীদা! 

ঘুণো খামরাই অর্দ্ধেক ২ লিটার আর সি বোতলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে পাথর হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কটা বাজে? ঘুণো দুবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর দিল – আড়াইটে!

গান্ধীদা যেবার থেকে আসা বন্ধ করে দিল, আমি তখন ক্লাস এইট–আর দুবছর বাকী মেট্রিক পাশ করতে! কিন্তু ঐ বছর পুজোর আগেই ডেকা-টিটু, আমাদের পাড়ার একমাত্র অহমীয়া সমবয়সি ছেলে, মাঠে আসা ছেড়ে দিয়েছে। ফুটবল খেলায় সামান্য লাথালাথি, যেটা ভীষণ স্বাভাবিক ছিল, ডেকা টিটুর একটা উক্তি আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ‘ক্যালা বঙ্গালি’। কেলা শব্দটা অহমীয়াতে একটা মজা করার শব্দ, প্রয়োগ হতে শোনা-দেখা হাসি ঠাট্টার মধ্যে। বিশেষ করে সমবয়সীদের মধ্যে। সিরিয়াসলি ব্যবহার করা হতো কাউকে হেটা করার জন্য, অপমান করার জন্য। কিন্তু একটা পুরো জাতির জন্য, তাও আবার বাঙালির জন্য এই বিশেষণ জীবনে প্রথম শুনে আমার হতবাক হয়ে পড়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণের জন্য! নন্তু, আবার দুএকবার ওকে থামানোর চেষ্টা করলে টিটু ঘাড় গুঁজে আরও একবার বলে উঠেছিল – ক্যালা হুনিছা নে কিম কলুন ময়? একটা শিরশিরানি আবহের মধ্যে সবাইকে হতভম্ব করে ডেকা টিটু ঐ যে একবারও পিছনে না তাকিয়ে মাঠ ছাড়ল, তারপর আর আসামে বাঙালীর জীবন আগের মত রইল না। আমরা সবাই ভয় পাওয়া মহিষের মত মাঠের মাঝখানে গায়ে গায়ে গা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। বড়দের মুখে শোনা নিজেদের ভাষা –পরিচয়ের সংকট প্রথম অনুভব করলাম। আমরা কোনওদিন টিটুকে আহমীয়া ভাবি নি, আমাদের মত একজন ভেবেছি, কেউই ওর সাথে অসমীয়া ভাষায় কথা বলতাম না। তবে পিছনে লাগার সময় অসমীয়া বলতাম --- ‘ডেকা তর পোঁদখন এনেকা’ বলে নন্তুর নিজের পাছা বেকিয়ে দাঁড়ানোটা সবাইকে হাসিয়ে দিত। এমনকি ডেকা টিটুও হেসে ফেলত। তারপরই শুরু হতো একটা ছদ্ম-তাড়া, ধরে ফেলতে পারলে ধস্তাধস্তি। না হলে ঐ তাড়াতেই যে যার বাড়ী। বাকী সবাই হেসে লুটোপুটি। এবং পরের দিন আবার সেই মাঠ – হয় ফুটবল নাহলে ক্রিকেট অথবা পিট্টু... কিন্তু এবার সবাই কোনওরকম কথা না বলেই বুঝে গেলাম টিটু আর আসবে না। তাঁর তিন-চারদিন পর শুনেছিলাম জেঠুর স্বগোক্তি – ‘বাঙালির আবার মাইর খাইবার সময় আইসে। ক্যালা বঙ্গালী’ 

ক্যালা বঙ্গালীই বটে! আমাদের ব্যারাকে, মানে মজুমদার ব্যারাকে বিখ্যাত সেনাইরাম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক ভট্টাচার্য স্যার ওঁর পরিবার নিয়ে আমাদের ব্যারাকে থাকতেন। তখন আমি ক্লাস সেভেন। উনিও দেখি একদিন ডেকা টিটুর ঘটনার পর ওনার সদাহাসি মুখে শুকনো হাসি ছড়িয়ে আমাদের সবাইকে ‘যাও দে’ বলে ভাই, মাকে নিয়ে চলে গেলেন। ভট্টাচার্য স্যার গতমাসেও আমাদের বাড়িতে বা বুড়াদের বাড়িতে ওঁর ঘাড় পিছন দিকে হেলিয়ে ব্র্যান্ডেড হাসি হেসে সবাইকে টাটকা রাখতেন। কিন্তু কথা বলতেন একদম নীচু গলায়, মার্জিত, শিক্ষিত উচ্চারণ। সাধারণ অহমীয়াদের উচ্চারণ দোষ ওঁর ছিল না। উনি বলতেন, নিখুঁত বাংলায় – বৌদি আমাদের ঐ তাম্বুল পানটা উচ্চারণের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! বলেই একটা তাম্বুল পান মুখে নিয়ে সেই ব্র্যান্ডেড হাসি – হো হো হো- উনি ব্যারাকের যেই বাড়িতেই থাকুন না কেন ওঁর হাসি প্রত্যকটা বাড়িতে গমগম করত। দেখতে অনেকটা গ্রিক দেবতাদের মতন, নাক আর থুতনি সহ, পাকা গমের মত গায়ের রঙ, মাছ খেতে ভীষণ ভালবাসতেন-- বিশেষ করে ইলিশ মাছ। সেটা কি জানতাম না। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে পেয়াজ পর্যন্ত ঢুকত না। উনি হা হা করে হাসতে হাসতে বলতেন -- আমি কিন্তু বাঙালি মেয়েকেই বিয়ে করব! বৌদি আপনি তো কলকাতার মেয়ে আমার জন্য একজন সুন্দরী ...। হ্যাঁ, উনি শুদ্ধ কলকাতার বাংলা বলতেন। আমরা বলতাম- কেল্কেশিয়ান কয়! 

ডেকা ডাক্তার আর ভট্টাচার্য স্যার ছাড়া খগেশ্বর রোড পাড়ার আর মাত্র একমাত্র অসমীয়া ফ্যামিলি গোহাই ফ্যামিলি, যাদের পূর্বপুরুষের নামে আমাদের পাড়া খগেশ্বর গোহাই রোড। ওঁদের ফ্যামিলির সবাই ঐ দেবতার মত দেখতে, পার্থক্য, নাকচিবুক আর গায়ের রঙ, মানে ভট্টাচার্য স্যারের তুলনায়। গায়ের রঙ মুসুর ডালের মত আর নাক চিবুক মঙ্গলইড। গোঁহাই পরিবারের কেউ কখনও পাড়ার কোনও বাঙালি মহিলা আর শিশু-বালকদের সাথে অহমীয়া ভাষায় কথা বলতেন না। ডেকা পরিবারের কেউ না, ভট্টাচার্য পরিবারের কেউ না। ফলে, অহমীয়া ভাষার মত একটি মিষ্টি আর মেলড্রামাটিক ভাষা আমার মা আর আমার আর শেখা হলো না। বাল্যে শেখা হয় নি আমার আশেপাশে কেউ বলতেন না বলে আর পরে শিখি নি ‘কেলা বঙালী’ আন্দোলনের একজন অন্যতম চরম ভিক্টিম হয়ে। যদিও আমাদের পাড়ার কোনও অহমীয়া সদস্য ভুল করেও, ঐ বছর ১২, ডেকা টিটুর একবার মুখখারাপ করা ছাড়া, কোনও অপ্রীতিকর শব্দ তো দূরের কথা কোনওরকম কঠোর শরীরীভাষাও প্রকাশ করেননি -- কক্ষনো না! কোনওদিনও না! 

তবে আমি কিন্তু ভিক্টিম হবার রাগ আর হতাশা অনেকদিন অব্দি ভুলতে পারি নি। সংখ্যালঘু হবার যন্ত্রণা শেয়ার করা যায় না। বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। একটা অদ্ভুত ভয়, নিজের ছায়াকে দেখে চমকে ওঠার মত! দাঁতে দাঁত চেপে আমি আমার প্রিয় অসমীয়া বন্ধুদের সাথে নিজের পাড়ায় হলে বাংলা বলতাম আর বাইরে হলে হিন্দি বলতাম। মাতৃভাষা আর রাষ্ট্র ভাষা থেকে সরতাম না। এমনকি ১৯৯২ তে গুয়াহাটির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা, ‘আলফা’ অঞ্চল- ‘লাচিত নগরে’ আমার এয়ার ফোর্সের সিনিয়র কলিতাদার বাড়িতে হিন্দি কথা বলা শুরু করলে ওনার দিদি কলিতাদাকে – তুমি কই আছিলা হি তিনচুকিয়ার লরা! কলিতাদা সাথে সাথে- কলকাতার বাংলায় আমাকে– দাস বাংলা বল... বাংলা...! দিদিও সাথে সাথে হেসে অসমীয়া আঙ্গিকে কলকাতার বাংলা বলা শুরু করলেন এবং ২-৩ রকমের মাছ দিয়ে প্রায় গ্রাস বানিয়ে খাইয়ে দেবার মত যত্ন করেন। সাথে বাঙ্গালী আর অসমীয়াদের মাছ রান্নার মিল ও অমিল নিয়ে টানা বাংলায় ৩০ মিনিট বক্তৃতা, পরিশেষে ‘বাঙ্গালীরাই ভাল মাছ রান্না করে’ দিয়ে সমাপ্তি। শুধু দিদিই নন, বাড়ীর অন্যান্য সদস্যরাও আমার সাথে কথা বললেন ঐ বাংলা ভাষায় প্রায় আরও ২ ঘন্টা--আমার ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য গাড়ি বের করা অব্দি। সেই প্রথম আমার কোনও অসমীয়াভাষীদের সাথে বাংলায় কথা বলতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছিল। খাওয়ার পর প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি হেরে যাবো-এই প্রায় অসমীয়া বলা শুরু করলাম বলে! হেরে যাওয়া শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ আমার তখনও মনে হতো, আমার ১৩ বৎসর বয়স থেকে পতন ও পচনের যাবতীয় অসমীয়াদের। বড় হয়ে বুড়ো হয়ে আজ বুঝি আমি ভুল ছিলাম। আমার ২ থেকে ১৮ বৎসর অব্দি বেড়েবর্তে ওঠার ভুমিভাষা তথা ভুমিজনগনের প্রতি অনীহাই আসামে ‘কেলা বঙালি’ আন্দোলনের বোধন। হয়তো পূর্ববাংলাতেও বাঙালি মুসলমানদের প্রতি হিন্দু বাঙ্গালীদের দৈনন্দিন জীবনে চরম হেটা করার অভ্যাসের ফল পূর্বপাকিস্তান! তারপর বাংলাদেশও জন্ম নিল ঐ হেটা করার বিরোধীতা থেকে। তফাত, প্রথম ক্ষেত্রে ধর্ম, দ্বিতীয় অবস্থায় ভাষা! ভাষা আমার মনে হয় ধর্ম থেকেও বেশি শক্তিশালী, অন্তত ভাষা হারালে যে মানসিক ডিপ্রেশন আসে তার সাথে অন্য কোনও কারণের কোনও তুলনাই হয় না! 

তবে বাঙালি কারা! চিটাগাং থেকে খেদানো জেঠু বরিশাল থেকে পালানো বাবাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন 

বাবা বলতেন ‘আমরা’! 

জেঠু এই ‘আমরা’ শব্দটিকে কখনও কাউন্টার করতেন না, শুধু ক্যাপ্সটনের ধোঁয়া ছাড়তেন। বাঙ্গালীর দ্বিতীয় মাইগ্রেশনে, যারা ব্যবসায়ী, তাঁদের নতুন জেনারেশন চলল কলাকাতার দিকে আর যারা সিলেটি চলল শিলচরের দিকে! এই প্রথম শুনলাম বাংলা ভাষার জন্য প্রথম প্রাণ দিয়েছিলেন সিলেটের ছাত্র! আমার প্রিয় বন্ধু বুড়া চোখ ভাসিয়ে বুক ভাসিয়ে চলে গেল শিলচরে! মামা বাড়িতে! দুম করে একটা সামজিক বসবাস চারদিক থেকে ভেঙ্গে পড়ল! এই প্রথম বাঙালি বুঝতে পারল - আসাম আর তাহাদের নয়। 

যখন বাঙ্গালির দ্বিতীয় মাইগ্রেশন চরমে, জেঠু একদিন তাঁর হলুদ তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে ক্যাপ্সট্যান সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইজ্রায়েলীদের নাম শুনেছেন? ইজ্রায়েলী...! বাঙালি হিন্দুদের ভবিষ্যত কি জানেন! মাঠে ঘাটে নিজের দ্যাশরে বুকে নিয়া ঘুইর‍্যা বেরাইতে হইব, খুব শিগরী দেখবি আমাদের আর কোনও দ্যাশ থাকবো না! 

এই প্রথম শুনলাম ‘বাঙালি হিন্দু’ শব্দ! 



বাদাম আনতে গিয়ে কোথায় চলে গেলে ঘুণো? ও ঘুণো ...ঘুণো! আররে... বোতলটা কোথায় গেল!!
0

রম্যরচনা - সাম্য দত্ত

Posted in



রম্যরচনা


পাঁচ এক্কে এক 
সাম্য দত্ত





29শে এপ্রিল

-না, কাল আপনাকে দেখলাম উশ্রীর ধারে, মর্নিং ওয়াক কারছিলেন।তাই ভাবলাম একবার দেখা কোরে যাই, হে হে হে।
-ওটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস, আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে করছি।
-ভেরি গুড, ভেরি গুড! তা, গিরিডিতে আপনার কেতো দিন হোলো?
-আমাদের কয়েক পুরুষের বাস এখানে। বাবা এখানকার নামী চিকিৎসক ছিলেন, দাদু...
-অউর, আপকা হাতিয়ার?
-হাতিয়ার? 
-দ্যা ভেনিশিং গান।
হেসে বললাম, আপনি বিজ্ঞানের জগতের খবরও রাখেন তাহলে?
-উপায় আছে প্রোফেসর, খবর দিবার লোক আছে।
-সে তো বুঝতেই পারছি।
লোকটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ। বসার ঘরে আজ আমার ল্যুমিনিম্যাক্সটা জ্বালানো হয়নি, কিন্তু আবছা অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারছি লোকটার জ্বলজ্বলে, ধূর্ত দুটো চোখ একদৃষ্টে আমারই দিকে চেয়ে আছে।
-একবার দিখাবেন?
-ও জিনিস তো হাতের কাছে রাখিনা সবসময়। ওটা থাকে আমার ল্যাবরেটরিতে।
আবার বিরতি, এবার আরো দীর্ঘ। তারপর আবার সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা, হিসহিসে কন্ঠস্বর, আমি ফিফটি ল্যাকস অফার করছি প্রোফেসর। আপনি ইচ্ছা কোরেন তো আজহি দিতে পারি, কেশ।


মাথা নেড়ে বললাম,  টাকার আমার অভাব নেই। তাছাড়া, হঠাৎ করে বড়লোক হবার বাসনাও নেই। একা মানুষ, দিব্যি চলে যায়।সুতরাং....
-সেভেন্টি ফাইভ ল্যাকস, সোচিয়ে প্রোফেসর।


লোকটার ধৃষ্টতা এবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে একটু কড়া করেই বলতে হলো, আমার প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমার দীর্ঘদিনের সাধনার ফল। তাদের একটিকেও বেচে মুনাফা করার মানসিকতা আমার নেই। বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না।
-ওয়ান কোরোর প্রোফেসর, ফাইনাল অফার। সোবার কাছে আমি জিনিস চেয়ে নিই না, দরকার হোলে...
-জানি। আমার আর কিছু বলার নেই। আপনি আসুন।
-এটা আপনার শেস কোথা?
-শেষ কথা।

রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু বললেন, আচ্ছা, এই অ্যানাইহিলিন যন্তরটা কি মশাই?
-নিশ্চিহ্নাস্ত্র। ফেলুদা বলল, শত্রুকে জখম না করে, বিনা রক্তপাতে তাকে একেবারে গায়েব করে দেবার মোক্ষম হাতিয়ার। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে দুশমনের দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিলেই কেল্লাফতে।
- আরেব্বাস! এর কাছে আপনার কোল্ট পয়েন্ট থ্রি টুও তো নস্যি মশাই! 
-সে তো বটেই! তবে শুধু অ্যানাইহিলিনই নয়, প্রোফেসর শঙ্কুর প্রত্যেকটি আবিষ্কারই এককথায় ইউনিক। আপনি মিরাকিউরল বড়ির নাম শুনেছেন?
এর উত্তরে লালমোহনবাবু বললেন, তিনি প্রোফেসর শঙ্কুর নামই এই প্রথম শুনছেন। 
-কাগজে ছবি দেখলুম মশাই! বেঁটেখাটো, টাকমাথা, মুখে ছুঁচলো দাড়ি। এতবড় কনভেন্টর দেখে বোঝে কার সাধ্যি! 

'কনভেন্টর' অবিশ্যি 'ইনভেন্টর'-এর জটায়ু সংস্করণ। তবে ভদ্রলোক বললেন, গিরিডিতে তাঁর এক পরিচিত থাকেন।
-অবিনাশ চাটুজ্জ্যে। এথিনিয়াম ইনস্টিটিউটে তিন ক্লাস ওপরে পড়ত। যদি যাবার মতলব করেন, তাহলে বলুন, এই বেলা লিখে দিই।


এখানে বলে রাখি, বিখ্যাত আবিষ্কারক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর আবিষ্কার অ্যানাইহিলিন পিস্তল বা নিশ্চিহ্নাস্ত্র যে তাঁরই ল্যাবরেটরি থেকে থেকে চুরি গেছে, একথা কাগজে পড়েছিলাম। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই যে ভদ্রলোক ফেলুদাকে ফোন করে তার সাহায্য চাইবেন এই চুরির তদন্তে, সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। শঙ্কু অবশ্য বলেছিলেন, তিনি ফেলুদার সুনামের সঙ্গে পরিচিত। 

-তোমার বাবা জয়কৃষ্ণ ছিলেন আমার সহপাঠী। তোমাদের বাড়ি গিয়েছি তাঁর সঙ্গে, তখন অবিশ্যি তুমি খুবই ছোট।

উত্তরে ফেলুদা জানিয়েছিল সেও প্রোফেসর শঙ্কুর গুণমুগ্ধ, এই বিপদে তাঁকে সাহায্য করতে পারলে তার ভালোই লাগবে। 


-তাহলে তোমাকে বলে রাখি, দু'দিন আগে বেনারসের এক ভদ্রলোক হঠাৎ বেয়াড়া এক আব্দার নিয়ে হাজির হন। তিনি অ্যানাইহিলিন কিনতে চান, এক কোটি পর্যন্ত অফার করেন।
-এবং আপনি রাজি হননি, তাই তো?
-সে আর বলতে! কি জানো ফেলুবাবু, বিজ্ঞানকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজে লাগাব, তেমন ইচ্ছে তো হয়নি কখনও!
-ভদ্রলোকের নাম?
-তোমার পুরনো আলাপী। মগনলাল, মগনলাল মেঘরাজ।


ফোনটা এসেছিল আধঘন্টা আগে। ইদানীং ফোন এলে ফেলুদা স্পিকারে দিয়েই কথা বলে। প্রোফেসরের কথা শেষ হওয়ামাত্র শুনতে পেলাম, আমার ঠিক পাশেই লালমোহনবাবুর হাঁটুদুটো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেয়ে বিশ্রী ঠকঠক আওয়াজ তুলেছে। ভদ্রলোকের মাথাটাও ক্রমশ যেন নীচের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, ধরে না ফেললে হয়ত পড়েই যাবেন। ওঁকে দোষ দেওয়া যায় না। অতীতে যতবার এই দুর্ধর্ষ দুশমনের সঙ্গে ফেলুদার সংঘর্ষ হয়েছে, প্রত্যেকবার একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে ওঁর ওপর দিয়ে। আমিও যেন বুকের ভেতরের ধুকপুকুনিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আর কতবার? কতবার এই ভয়ানক শয়তানের মুখোমুখি হতে হবে? 


ফেলুদা কিন্তু দেখলাম বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ঠিকই বলেছেন, এঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার মোলাকাত হয়েছে। নিঃসন্দেহে একটি অসামান্য বিচ্ছু। তবে ভাববেন না, এই বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুলের ব্যবস্থা আমিই করব।

ফেলুদাকে এত অস্বাভাবিকরকম গুম মেরে যেতে অনেকদিন দেখিনি। শঙ্কুর ফোনটা এসেছিল সকালে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্রথমে বেনারসের ইনস্পেক্টর তেওয়ারি আর তারপর লালবাজারের ইনস্পেক্টর গড়গড়ি ফোন করে জানালেন, ফেলুদার কথামতো কাশী এবং কলকাতায় মগনলালের দুই বাড়ি আর গদিতে একসাথে রেইড হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায় নি, তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাশীতেই মগনলালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন বাজে ন'টা। এই চার ঘন্টা ফেলুদা একনাগাড়ে আমাদের বসার ঘরটাতে পায়চারি করেছে, তার ভুরুদুটো অসম্ভব কোঁচকানো, যদিও এখন ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস দেখে বুঝতে পারছি ও হয়ত একেবারে অন্ধকারে নেই। মাঝেমধ্যে থেমে ওর নীল ডায়রিতে হিজিবিজি কিসব লিখেছে আর একটার পর একটা চারমিনার ধ্বংস করেছে। জানি এইসময় ও কথা বলা পছন্দ করে না, তবু খেতে বসে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, পিস্তলটা তো মগনলাল পায়নি, তাই না ফেলুদা! 
উত্তরে গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলল, পেলে সে আর এ তল্লাটে থাকত না। দুনিয়াময় ও জিনিসের খদ্দেরের তো আর অভাব নেই।

-তাহলে এবার?
-এবার মাছ। তারপর দই, তারপর চাটনি। তারপর একটা পান খেয়ে গিরিডিতে একটা ফোন করব। তারপর ঘুম। 
একটু থেমে বলল, তবে, আমার মন কি বলছে জানিস, তোপসে! চেনা পথে এই রহস্যের সমাধান হবে না।দেখি, প্রোফেসর কি বলেন....




30শে এপ্রিল

আজ রাত দশটা নাগাদ ফেলুর ফোন পেলাম। মগনলালের বাড়িতে খানাতল্লাসি যে নিষ্ফল হয়েছে, সেটা জানিয়ে ও বলল, প্রোফেসর, আমার ধারনা মগনলাল এই চুরির সঙ্গে জড়িত নয়। আপনার অস্ত্রের ওপর তার লোভ ষোলআনা, কিন্তু সেটা তার হাতে পৌঁছয়নি। 

মনের মধ্যে একটা সন্দেহ ক্রমেই দানা বাঁধছিল। বললাম, ফেলু, আমি যা ভাবছি, তুমিও কি ঠিক তাই ভাবছ?
ফেলু একমুহূর্ত চুপ। তারপর বলল, এছাড়া আর উপায় নেই প্রোফেসর। যিনি এসব কিছুর মূলে থেকেও এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাঁর সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর উপায় দেখছি না।

-তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি ফেলুবাবু। বেশ, আমি আমার নিওস্পেক্ট্রোস্কোপ বের করে রাখব। তোমরা তিনজন বরং কালই এখানে চলে এস। তবে একটা কথা-
-কি?
-অ্যানাইহিলিন চুরি যাবার পর থেকে মানসিক চাপটা বেশ টের পাচ্ছি। এ অবস্থায় হয়ত আমার পক্ষে কনসেনট্রেট করার অসুবিধা হবে। সুতরাং, একজন ভালো মিডিয়ামের খোঁজ করতেই হচ্ছে! 
-সে আর ভাবনা কি? একজন তো হাতের কাছেই আছেন।

-কে? কার কথা বলছ?
-নাম বললেই চিনবেন, তারিণীচরণ বাঁড়ুজ্যে।




চা এল। দুধ-চিনি ছাড়া চা। খুড়ো তা'তে একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়ির একটা ধরালেন। কিন্তু গপ্প মাঝপথে থেমে গেলে কী আর শ্রোতাদের ভালো লাগে! তাই ভুলু একটু তাড়া দিল, কী হল খুড়ো! শুরু করুন আবার! 
-দাঁড়া, দাঁড়া! -খুড়ো বললেন, সেই বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ হেঁটে এইচি। একটু রেলিশ করে চা খেতে না পারলে কি আর গপ্প বলার মুড থাকে!
-আচ্ছা, ফেলু মিত্তির তো নামকরা ডিটেক্টিভ। -মাঝখান থেকে ন্যাপলা হঠাৎ ফোড়ন কাটল, তাঁর সঙ্গে আপনার সত্যিই পরিচয় আছে, নাকি এটাও ওই আর্টের খাতিরে রঙ চড়াচ্ছেন?

সত্যি! খুড়োকে এরকম কথা বলার সাহস এক ন্যাপলারই আছে! 

খুড়ো কিন্তু ভুরুটা ওপরে তুলে বললেন, বলিস কি! আমার ইস্কুল লাইফের বন্ধু ছিল সিদ্ধেশ্বর বোস। আমরা দুজনে ছিলাম, যাকে বলে হরিহর আত্মা! সেই সিধুকে তোদের ওই টিকটিকি জ্যাঠা বলে ডাকে, সেই সুবাদেই পরিচয়। কম করে বিশ বচ্ছর তো হবেই.... তা সে যাকগে.... আমরা গিরিডি পৌঁছলাম পয়লা মে বিকেলের দিকে। ঠিক হলো, রাত গভীর হলে শঙ্কুর ল্যাবরেটরিতেই বসা হবে। প্ল্যানচেটের অভিজ্ঞতা যে আমার আছে, সে কথা তোদের আগেও বলেছি। তবে শঙ্কুর এই যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তাই তাকে বলেছিলাম আগেভাগে যেন আমাকে একটা ডিমনস্ট্রেশান দিয়ে দেয়। নিওস্পেক্ট্রোস্কোপ। অ্যাসিড ব্যাটারি তোরা দেখেছিস তো? অনেকটা সেইরকম দেখতে একটা যন্তরের সঙ্গে দুটো বৈদ্যুতিক তার দিয়ে জোড়া একটা ধাতব হেলমেট। মনে মনে তারিফ করলাম। এরকম যন্তর থাকলে মিডিয়ামের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

রাত দুটোর পর বসা হলো। যন্তরটাকে রাখা হয়েছে একটা গোল টেবিলের ওপর আর তা'কে ঘিরে পাঁচটা চেয়ার সাজিয়ে বসেছি আমরা পাঁচজন। আমার ডান দিকে লালমোহন, তার পাশে তপেশ। বাঁদিকে ফেলুচাঁদ আর শঙ্কু। 

আমি প্রথমেই বলে নিলাম, 'তোমরা সবাই জানো আজ আমরা কোন প্রেতাত্মাকে আহ্বান করতে চলেছি। ঘটনাচক্রে ইনি আমাদের প্রত্যেকেরই বিশেষ পরিচিত। এখন আমাদের কর্তব্য হলো, এক মনে তাঁর স্মরণ করা। শেষবার তাঁকে যেভাবে দেখেছ, সেটুকুই হুবহু মনে করার চেষ্টা কর।'


মিডিয়াম যেহেতু আমি, হেলমেট আমাকেই পড়তে হলো। প্রথম আধঘন্টা চুপচাপ। তারপর হঠাৎ একটা তবলার বোলের মতো শব্দ পেয়ে দেখি, লালমোহনের হাতদুটো কেঁপে উঠে টেবিলটাকে তবলার মতো বাজিয়ে তুলেছে। ভাগ্যিস ছোকরা নিজেই ভুলটা টের পেয়েছিল, তাই জিভ কেটে 'সরি!' বলে কোনমতে হাতদুটো স্টেডি করে নিলে।


আরো আধঘন্টা কাটল। ভেতরে ভেতরে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছি, এমন সময়! এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বুঝলি! ল্যাবরেটরির ঘড়িতে ঢং-ঢং করে তিনটে বাজছে, আর পাঁচজোড়া চোখের সামনে যন্ত্রের ঠিক সেন্টারে একটা নীলচে ধোঁয়া ধীরে ধীরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। আর তার ভেতরে ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে একটা কঙ্কালের অবয়ব। প্রথমে দেখা গেল গলা থেকে ওপরের দিকটা, তারপর ক্রমে ক্রমে শরীরের নীচের অংশ। ধারালো মুখ, ক্ষুরধার দৃষ্টি, ঠিক যেমনটি চিনতাম। থুতনির খাঁজটা? হ্যাঁ! সেটাও দেখা যাচ্ছে! আরও পনেরো মিনিট পর পুরো শরীরটা স্পষ্ট হলো। আর চিনতে ভুল হবার কোনও কারণ নেই! 


-হ্যাল্লো, মাই চিলড্রেন! অনেকদিন পর তোমাদের একসাথে দেখে বড় ভালো লাগছে।

সেই গমগমে গলা, সেই নিখুঁত সাহেবি উচ্চারণ! কি বলবো তোদের, লাস্ট শুনেচি নাইন্টি টুতে। অ্যাদ্দিন পরও গায়ে কাঁটা দিল!

আমাদের মধ্যে ফেলুই প্রথম কথা বলল,
-আমরা খুব বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।

-হ্যাঁ, জানি। খোদ নিশ্চিহ্নাস্ত্রই নিশ্চিহ্ন। কি, তাই তো, মাই ডিয়ার প্রোফেসর? 
-আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা অবিশ্যি প্রথমে মগনলালকে সন্দেহ করেছিলাম - শঙ্কুর জবাব।
-হা হা হা। মগনলাল! সেই যার একটি ভেঙে পাঁচটি হয়, সেই ভিলেন! না হে, এটা তার কীর্তি নয়।
-তবে কে?
-আই টুক ইট।
-আপনি!
 এবার আমাদের হাঁ হবার পালা। 

-ওহ্ ইয়েস! আই হ্যাড টু পারফর্ম মাই লাস্ট ভ্যানিশিং অ্যাক্ট।


আড়চোখে একবার ঘরের বাকি মুখগুলো দেখে নিলাম। অন্ধকারেও দিব্যি বুঝতে পারছি, আমি যে তিমিরে, অন্যরাও সেই তিমিরেই। তবুও সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, 
-কিন্তু কি ভ্যানিশ করলেন স্যার? একটু বুঝিয়ে বলবেন কি!" 

-ডেথ 
ঘর কাঁপিয়ে উত্তর এল। 
-মৃত্যু। অ্যানাইহিলিনের ট্রিগার টিপে মৃত্যুকেই নিশ্চিহ্ন করে দিলাম। সো দ্যাট আই কুড স্টে অ্যালাইভ, ফরেভার।

-হ্যা....হ্যা....হ্যালাইভ! 
জটায়ুর গলাটা বোধহয় ভয় আর বিস্ময়ের কম্বিনেশনেই একটু কেঁপে গেল।

-ইয়েস লালমোহন, আয়্যাম অ্যালাইভ। তোমাদের মধ্যে দিয়েই তো আমি বেঁচে আছি। তুমি, তপেশ, ফেলু, তারিণী আর শঙ্কু। অনেকটা পাজলের পাঁচটা টুকরোর মতো। এবার বুঝেছ?
-বুঝেছি।
শঙ্কুর উত্তর।

-এবার টুকরোগুলো জুড়ে দাও। কি পাচ্ছ বল দেখি?


মনে হলো ধাঁধাটা ধরতে পেরেছি। মনে জোর এনে বললাম, 
-আমরা যাঁর বহুমুখী প্রতিভার পাঁচটি প্রজেকশন, সেই আপনাকে।

-রাইট এগেইন! সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে মৃত্যু বড় অস্বস্তিকর একটা পরদার মতো, বুঝলে! তোমাদের রেখে গেলাম; যাতে বড়, আরো বড় হবার নেশায় পেয়ে সবাইকে বেজায় বুড়ো হয়ে যেতে না হয়। অথচ যখন দেখি চারপাশে ঠিক সেইটাই হচ্ছে, তখন বুঝতে পারলাম, আমার কাজ এখনও ফুরোয়নি! তাই.... আচ্ছা, রহস্যের সমাধান তো হলো, এবার বিদায়! জিতে রহো বচ্চো! ভালো থেকো, আর যারা আগামী কয়েকশো বছর তোমাদের মধ্যে দিয়ে আমায় খুঁজবে, তাদের খুব ভালো রেখো। টেক কেয়ার!


নীল ধোঁয়ার কুণ্ডলী সমেত আত্মা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক মিনিট সব চুপ। তারপর ফেলু উঠে বাইরে গেল, বুঝলাম চারমিনার ধরাবে। শঙ্কুর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ বোজা, যেন ধ্যানস্থ। জানলা দিয়ে সকালের প্রথম আলো এসে পড়ছে। সূর্য উঠছে, দোসরা মে'র সূর্য। মনে মনে বললাম, হ্যাপি বার্থডে, মানিকবাবু।



2

রম্যরচনা - সাঈদা মিমি

Posted in


রম্যরচনা


ঔরঙ্গজেব সমাচার
সাঈদা মিমি





দিস ইজ আ

মা বাবা তার নাম রাখলো ঔরঙ্গজেব, বড়জনের নাম ছিলো দারাশিকো, ছোটপুত্র হুমায়ুন, এরপরে একমাত্র কন্যা জাহানারা, পুরো মুঘল পরিবার। তাদের পিতা বাবর একজন দর্জি, মা মেহেরুন্নেসা গৃহিণী। ঔরঙ্গজেব নাইন পাশ দিয়ে আর পড়লো না, সে ভেবেছিলো কোনও ধনীকন্যাকে বিয়ে করবে, আসলে ইচ্ছেটা ষোলআনা থাকলেও পনেরআনাই জলে গেলো, বড়ভাইয়ের বিয়ে হলো, ছোটভাইয়েরও, এরপর একমাত্র বোনের, ঔরঙ্গজেব মাঝখানেই ঝুলে থাকলো। তার আর বিয়ের সম্বন্ধ আসে না, আসবে কি? সে কোনও চাকরি করে? করবেই বা কেন? সে সম্রাটপুত্র কিংবা নিজেই সম্রাট, বাপের ঘাড়েই খায়। সেবার চৈত্র মাসে এক অবাক কাণ্ড হলো, এক স্কুল মাস্টারনী এল ঔরঙ্গজেবকে দেখতে, পাত্র পছন্দ হলে রাজি হয়ে যাবে। কালোকুলো মেয়ে, গড়নও সুবিধের নয়। তবু ঔরঙ্গজেব খুশি, পাত্রী চাকরিজীবি। ঘর ঘুরে দেখলো মেয়েটা, তারপর ঢুকলো পাত্রের কামরায়, কি থেকে কি হয়ে গেলো বোঝার আগেই দেখি, মেয়েটা নাক চেপে দৌড় আর বলছে, দিস ইজ পাঁঠার গন্ধ। ওহ হো, বলাই হয়নি, ঔরঙ্গজেব অতিরিক্ত গিধর, তার কামরায় ঘরের সদস্যরাও ঢোকে না। চ্যাংড়া মফিজ এইসব দৃশ্য দেখছিলো, পরদিন সকালে দেখা গেলো ঔরঙ্গজেবের কাঠের জানালায় কে বা কারা লিখে রেখেছে, দিস ইজ আ পাঁঠার গন্ধ।




ঔরঙ্গজেব ও পিতলের বদনা

ঔরঙ্গজেবের কিছু বিষয়ে শুচিবাই ছিলো বাড়াবাড়ি ধরনের, এই যেমন ঘরলাগোয়া কোনও বাথরুমে সে যাবে না, কাউয়ার দল চোখ মেলার আগে সে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের পাশে দোকান কর্মচারীদের যে গণটয়লেট সেখানে যেতো, হাতে থাকতো একটা ঝকঝকে পিতলের বদনা, সেটা প্রতিদিন নিজেই মাজতো, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস ব্রজেশ্বর স্টাইলে স্নান করতো পুকুরে, একটা ন্যাকড়া দিয়ে শরীর ডলতো আর স্নান শেষে গামছাটা পড়ে কোনওমতে লুঙ্গি ধুয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দিতো, আমরা লজ্জায় ওদিকে যেতামই না। এদিকে ছোট কাকিমা কয়েকদিন থেকেই প্রশ্ন করে করে আমায় উত্যক্ত করছেন, “হ্যাঁ রে পরী, পাত্রপক্ষ তোকে দেখে যায়, কথা আগায় না ক্যান? তুই তো দেখতে কম সুন্দরী না!” এর উত্তর কাকিমাকে দেয়া সম্ভব নয়, প্রত্যেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এলেই আমি আর প্রতুল মিলে ভাঙ্গানি দেই। কি করবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আছে, এত পাত্র দেখার দরকার কি? কাকিমা একটু চুপ থেকে আবারও বলে ওঠেন, “কাল ভোরে দরজা খুলে যার চেহারা দেখবো তার সঙ্গেই তোকে বিয়ে দেবো!” হায় কাকিমা, ভোরে তো দুধওয়ালা এসে বেল বাজায়….. কাকা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে কাকিমার কাছে আমাকে রেখে যান। রাতের তামাশা রাতেই শেষ কিন্তু সকালে আমরা দরজা খুলতেই দেখি, ঔরঙ্গজেব পিতলের বদনা নিয়ে গণটয়লেটে যাচ্ছে! আমি হতভম্ব, কাকিমা প্রায় অজ্ঞান।



ছাত্ররা কেন না’ বলেছিলো

শেষতক বাবর দর্জি ক্ষেপে উঠলো একদিন, এই দামড়াকে আর কতদিন বসিয়ে খাওয়াবো? মেহের, ওকে কাজ করতে বলো, কিছু না পারলে আমার সাথে দর্জিগিরি শিখুক। ঔরঙ্গজেবের খুবই সম্মানে লাগলো, তার পেটে বিদ্যার জোর আছে, সে কিনা করবে দর্জির কাজ! নেভার….. হুংকার ছাড়লো সে, যদিও শব্দটা চিঁ হিঁ হ্রেষার মতো শোনালো। মাস্টারী করবো আমি…। ‘তা কর বাপু। এই যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের সাথে লজিং হুজুরের ঘর সেখানে বসে পড়া. নয়তো বৈঠকখানা ঘরেই’ -মেহেরুন্নেসা বেগম বললেন। কয়েকজন ছাত্রও জুটে গেলো, শুরুটা মন্দ ছিলো না, ছয় সাতজন ছেলেমেয়ে হেলেদুলে পড়ছে, ঔরঙ্গজেব একটা বেত হাতে বেশ ভাব নিয়ে পড়ায় এবং প্রতিটি লাইন পড়ানো শেষে বাচ্চাদের প্রশ্ন করে ‘বুঝতে পারছিস?’ এটা তার মুদ্রাদোষ, সেটা না হয় মেনে নেয়া গেলো। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যতটা না বলে তার চাইতে বেশি থুতু ছিটায়, ওর সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে সে থুতু ওয়াশ হয়ে যাবে। যারা জানে তারা ঔরঙ্গজেবের সাথে কথা বলে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে, হতভাগা বাচ্চারা এসব কিভাবে জানবে? যখন জানাটা হলো তখন ওরা আর নিশ্চুপ বসে রইলো না, একজন স্যারকে দিলো একটা রুমাল, আর প্রত্যেকে হাতে রাখা শুরু করলো জাপানী পাখা, ঔরঙ্গজেব কথা বলতে শুরু করতেই তারা মুখের সামনে পাখা মেলে ধরে। বিষয়টা আর সহ্য হলো না ঔরঙ্গজেবের, একদিন সঠিক নিয়মে বেতপ্রয়োগ করে সে বেতটাকে ভেঙেই ফেললো। ক্ষেপে গেলো বাচ্চাদের বাবামায়েরা, তিনমাসে দেড়হাজার টাকা কামাইয়ের পর ঔরঙ্গজেবের টিউশনী ব্যবসা লাটে উঠলো।



সম্বল ওই ছারপোকা ঠাসা কম্বল তার বাল্যবন্ধু ছিলো…

মেহের ফুপু বেশ ভারী মহিলা ছিলেন, তিনি হাঁটাচলা করতেন ধীরে, কথাও বলতেন আস্তে খুব নীচুস্বরে, পান খেতেন, হাসতেন, কখনও ঝগড়া করতেন না। তবে দুই একদিন পরপরই আছাড় খেয়ে পড়ে যেতেন তিনি। কি মুশকিল, সারাবাড়ি তোলপাড়, কি হয়েছে? মেহেরুন্নেসা আছাড় খেয়েছে - অ, এ আর নতুন কি? যা সবাই মিলে তোল ওকে –অর্থাৎ আছাড় না খাওয়াটাই তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই বান্দা একদিন টেনেটুনে ঔরঙ্গজেবের কম্বল ফেললেন ঘরের চালে, সাথে তর্জনগর্জন, ‘এই হারামজাদা আমার ছেলে হয় কেমনে? আমি এত ছিকছাক (সাফসুতরো) মানুষ, অরে কি হাসপাতাল থেকে বদলে দিয়েছে?’ মেহের ফুপুর জন্য কষ্ট হয়, একা একা কম্বল শুকাতে দিচ্ছেন, আমরা কেউ যাইনি, কাজের বুয়ারাও না, রিনিচিনির মা-বুয়া আম্মাকে বললো, ‘ওরে ভাবীছাব’ কোম্বল ভরা উরাস(ছারপোকা) আর কি গোন্ধ! মেহের আফায় ওয়া টানতেয়াছে কেম্নে?’  মেহের ফুপু ঔরঙ্গজেবের মা হয়ে ঠেকেছেন, তাই শীত আসার আগেই শুকাতে দিয়েছেন কম্বলটা। ঔরঙ্গজেব তখন বাসায় ছিলো না, ফিরে তার কম্বল চালের ওপর দেখেই এক চিৎকার, ‘কে আমার কম্বল ধরেছে?’ ‘আমি, আর কে তোর পিছামারা জিনিসে হাত দেবে? খবিশ, সারা কম্বলে ছারপোকা। বিছানা বালিশে সব বের কর, মর্কট পাঁঠা…… -মেহের ফুপু বলে শেষ করেছেন কি করেন নাই, চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এক খাবলা দিয়ে কম্বল টেনে নামালো ঔরঙ্গজেব, ‘খবরদার আমার কোনও জিনিসে কোনওদিন হাত দিবেন না। খাটমল, মশা এরা আমার দোস্ত, অরা না কামড়ালে আমার ঘুম ভালো হয় না’, বলেই গটগট করে ঘরে চলে সে, মেহের ফুপু বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।



পাড়ায় রটিয়া গেলো একি কারবার? মুখ দেখানোটা বুঝি হয়ে গেলো ভার…

সাত সকালে তিনটা কুকুর, আর ছয়টা ছানা মিলে শোরগোল। একটা বাড়ি বটে, এতগুলা কুকুর থাকার দরকার কি? কোথায় ঘুরছে, কাকে তাড়া করছে, কে কামড় খেলো, অতিষ্ঠ হবার উপক্রম। ঔরঙ্গজেবের একটা চাকরি হয়েছে, খাদ্যগুদামের রাত্রি পাহারাদার। আমরা বেঁচেছি, ঘাটে কিংবা উঠানে বা পিতলের বদনা হাতে তাকে যখনতখন দেখা যায় না। সে সারারাত পাহারা দেয়, পাখি ডাকার আগে বাসায় এসে ঘুমায়, দুপুরে খেয়ে আবার ঘুমায়, বিকেলে সত্তর দশকের নায়কদের মতো একটা বেলবটম প্যান্ট এবং সাদাকালো কোমর চিপা স্ট্রাইপ শার্ট পরে বের হয়ে যায়। মেহের ফুপুর গজরগজর প্রায়ই শুনি, ‘শুয়োরটার জামা কাপড় দিয়েও তেলা পোকার গুয়ের গন্ধ, এ কি পয়দা করেছি আমি এলাহী!’ তবে রবিবার ঔরঙ্গজেবের ছুটির দিন, ওই দিন আমরা ওঁদের বাসার ধারেকাছেও ঘেঁষি না। ঔরঙ্গজেবের স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো কিন্তু তার আধামাইল দূর থেকে পাঁঠার গন্ধ, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি ধরণের বর্ণনা হয়ে গেলো, হোক গে। তার ওপর শয়তানটা খালি গায়ে বাইরের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কান চুলকায়, তারপর কাঠিটা মুছে আঙুল শুঁকে আবার চুলকায়, ওয়াক, ওয়াক… এমনি এক রবিবাবের ঘটনা, সেজ কাকিমা প্রতি রবিবার একজন ফকির খাওয়ান, সেদিন দুপুরে একপিস কালবোশ মাছ, আগের দিনের মাংস, আট মিশালি শাক আর ঘন ডাল দিয়ে একপ্লেট ভাত দিয়ে ফকিরকে বিদায় করেছেন কাকিমা, আধাঘন্টা পরে তুমুল হৈ চৈ, গালিগালাজ আর অভিসম্পাত। সবাই দৌড়ে আসে, গেটের কাছে ঔরঙ্গজেবের হাতে ভাতের প্লেট এবং তখনও সে খাচ্ছে, ফকিরটা বিবিধ উচ্চারণে চীৎকার করে যাচ্ছে। হলোটা কি? কি আবার, ফকিরের মেনু চেক করতে গিয়ে সে ফকিরের খাবারটাই খেয়ে নিয়েছে! মেহের ফুপু আর ক্রোধ দমন করতে পারলেন না, একটা চেলাকাঠ নিয়ে ধাঁই করে বসিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবের পিঠে। সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো খবর, আমাদের কোথাও মুখ দেখানোর আর উপায় রইলো না….



সে কেবল হাত ধরেছিলো

ঔরঙ্গজেব দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলো না এবং কুচ্ছিতও নয়। নাকটা? বেশ টিকোলোl মুখটা? চৌকাl গায়ের রঙ? ফর্সা। হ্যাঁ, কবিতা আপু একদিন ক্ষেপে বলেছিয়া “ব্যাটাছেলের এতো সাদা হওয়ার দরকার কি? আমি এত কালো কেন?” কবিতা আপু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়l। তখন যৌথ পরিবারগুলোয় এইরকম সবাই মিলেঝুলেই থাকতো। ঔরঙ্গজেব কবিতা আপুকে দেখলেই ঝুঁকে হাতদুটি জোড় করে বলতো, 'মা কালী করালী, নমস্কার' -ক্ষেপে উঠতো আপু, আমি কি এতই কালো, অ্যাঁ! সেই কবিতা আপুর বিয়ে হলো বেজগাওয়ে, পাত্র দোজবর কিন্তু বড় ভালোমানুষ। ঔরঙ্গজেব রঙ্গ করে বললো, মা কালী, রাতের আন্ধারে তোরে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবে না তোর জামাই। বিস্ফোরিত হলো কবিতা আপু, সেই প্রথমবারের মতো সত্যটা বলে দিলো। আরও চারবছর আগে যখন ঔরঙ্গজেব ক্লাস সেভেনে পড়তো, একদিন মেজকার বাঁশঝাঁড়ের নীচে কবিতা আপুকে প্রস্তাব দিয়েছিলো সে। আপুর দুটি হাত ধরে খুব বিনয় করে বলেছিলো, তোর চামড়া কালো কিন্তু বড় মিস্টি তুই দেখতে, আহা কি গড়ন! দেবীর মতন। আপু পটে যেতে পারতো। কিন্তু পুবমুখী বাতাস সব গড়বড় করে দিলো। ঔরঙ্গজেবের শরীরের বোটকা গন্ধ তার নাকে আছড়ে পড়তেই বমি এসে গেলো শুচিবাইগ্রস্ত কবিতা আপুর, হাতটা ছাড়িয়ে ওয়াক ওয়াক করে দৌড়। সেই থেকে ঔরঙ্গজেব আর কবিতা আপুর শত্রুতার সূত্রপাত।



ঔরঙ্গজেব বিড়ালটিকে গুতা দিয়েছিলো

মেহের ফুপুর একটাই শখ, প্রতি শুক্রবার সিনেমা দেখতে যাওয়া, ফুপাও এইক্ষেত্রে দুইধাপ এগিয়ে। চিপাচুপার মধ্য দিয়ে চলা জীবন, এই কষ্টের মাঝে ওই সিনেমা দেখাটাই একটু অক্সিজেন। এদিকে প্রতিদিনের দুধের হিসেবটা মিলছে না, একপোয়া দুধ আর একপোয়া পানি ইজ ইকোয়ালটু আধাসের, কিন্তু রাতে সবাইকে ভাগ করে দিতে গিয়ে কম কম মনে হয় যেন! গলার কাঁটা ঔরঙ্গজেবকে সন্দেহ হলো, চুপিচাপি নজরদারি করে দেখলেন ঔরঙ্গ দুধের পাতিলের কাছে যায় না, ফুপুর মায়াই হলো, আহা, ছেলেটা তার খবিশ বটে, চোর নয়। এইসব সাত আট চিন্তা মাথায় নিয়ে ফুপু ফুপা গেলেন নাইট শো দেখতে, ছবির নাম বেদের মেয়ে, আর ঔরঙ্গজেব ঢুকলো রান্নাঘরে। বিকেলে সে দেখেছে, মা তার দই পেতে রেখে গেছে। ঘরে ঢুকে কি দেখলো সে? একটা সাদা লোমের ময়লা বেড়াল খালি দুধের পাতিল চাটছে। বেড়াল এল কোত্থেকে? তা বাপু চারচালা কাঠের ঘর, দুইপুরুষ পুরোনো, ভাঙ্গা ছ্যাঁদা তো আর কম নেই, সেইরকম একটা দিয়ে বেড়ালবাবা প্রবেশ করেছেন। তবে রে চোরা, বলেই একটা লাকড়ি দিয়ে বেড়ালটার পেট বরাবর গুতা মারলো সে, ‘কেঁয়াও’ শব্দ করে ছুট লাগালো বিল্লি। মাঝরাতে ফুপু ফুপা ফিরেছেন, ফুপার কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে, ‘বাইর হও বাইর হওরে সাপ, লোকে তোমায় দেখতে চায়…,’ ফুপুও তরল মেজাজে, কেবল বেদের মেয়ের কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরের তালা খুলতেই দেখেন ঔরঙ্গজেব দরজার পাশে বসে কুঁইকুঁই করে কাঁদছে, বেড়াল কেঁয়াও করে ছুট লাগানোর আগে ঔরঙ্গজেবের হাতে খামচি দিয়ে গেছে, বাজু থেকে কনুই পর্যন্ত রক্ত জমা। সাপ বের হলো না। কিন্তু ঔরঙ্গজেবকে নাভির গোড়ায় চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন নিতে হলো। প্রতিটা সুঁই ফোটানোর সময় সে একটা কথাই বারবার বলেছিলো, আমি কিছু করিনাই, কেবল বেড়ালটাকে কাঠ দিয়ে গুতা দিয়েছি।



ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া

বাবর দর্জি মানুষ খারাপ নয়, একটাই দোষ, সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। বৌ মেহেরুন্নেছা দেখতে কুরূপা নয়, কিন্তু সে বুড়ি হয়ে গেছে, ভারীও। আফসোস, সে ভাবে, আরও অনেক কিছুই তো ভাবে, একটু সাহস করে কিছু কর্ম করেও ফেলে। এই যেমন কমবয়সি মেয়েরা জামার মাপ দিতে এলে গজফিতা নিয়ে স্মার্টলি দাঁড়ায় সে, চেস্টের মাপ নেয়ার সময় আলগোছে বুকে হাত দেয়, একটু টিপেটুপেও দেখে। কাহিনী চাউর হয়ে গেলো, মেহের ফুপু সব শুনে বাবর মিয়াকে বাসা থেকেই বের করে দিলো, তার একার সাহসে কাজটা হয়নি, পুরো পরিবারই পাশে দাঁড়িয়েছিলো। বাবর মিয়া নিরীহ ঘরজামাই হয়ে থাকতে চেয়েছিলো, কি হয়ে গেলো, হায়! যদিও শোধরাবার সুযোগে রইলো সে তক্কে তক্কে, আর কাহিনী রটে যাওয়ায় মফস্বলে কমে আসতে থাকলো তার কাস্টমার। বেলার মা তো স্পষ্ট বলেই দিলো, খবরদার ও ব্যাডার কাছে কেউ কাপড় বানাইতে যাও বুঝি, দুধি হাত দেয়! পুত্র ঔরঙ্গজেব কাহিনীটা মাথায় গেঁথে রাখলো। সেবার ফাল্গুন শুরুতে মামাতো ভাইয়ের বিয়ে, সারাবাড়িতে উৎসবের ধুম, রাতে হ্যাজাক বাতির আলোয় রঙ্গীন কাগজের সজ্জাগুলি ওড়ে, আর ওড়ে ঔরঙ্গজেবের হৃদয়ের নীলঘোড়া, রোমান্টিক ভাবনায় সে ভেসে যায়। ফানাফিল্লাহ অবস্থায় মানুষ কি করে তা সে নিজেও জানে না, যেমন ঔরঙ্গজেবও জানতো না, মৃদু আলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে রাঁধুনি লতিফার বুক টিপছে। লতিফা জানতো, সে উপভোগও করছিলো, তখনি ঔরঙ্গজেবের বড়মামা দৃশ্যটা দেখে ফেলেন। নাউজুবিল্লাহ, বলে তিনি ক্যাঁক করে ঔরঙ্গের ঘাড় চেপে ধরেন, হারামজাদা, কুলাঙ্গার বাপের আওলাদ। তারপরের বৃত্তান্ত ভাসাভাসা, ঔরঙ্গজেব কেবল উপলব্ধি করে, প্রথমবারের মতো পাওয়া স্বপ্নের নীলঘোড়া উড়ে উড়ে প্রথম আসমান পার হয়ে চলে যাচ্ছে।



তাবলিগে গেলো ঔরঙ্গজেব

ঔরঙ্গজেব তীব্র হতাশায় আক্রান্ত, কোনও নারী তাকে চায় না, একটা ভুল ট্রিপ সেই সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে দিলো, কে জানতো অন্ধকারে কাজের বুয়া দাঁড়িয়ে তার সোহাগ নিচ্ছে! সে নিজে অনুধাবন করার পর নিজের প্রতি এই প্রথম তার ঘৃণা জন্মালো। এখন তো ঘরের কেউ তার সাথে কথা বলে না, খাবারটাও একা খেতে হয়। একটা চাকরি জুটেছিলো অনেকদিন আগে, সেটাও নেই, নাইটগার্ড ঔরঙ্গজেব ঘুমিয়ে পড়েছিলো পাহারার বেঞ্চিতে, আর চোর সেই রাতেই এল। কত থানা পুলিশ, ধড়পাকড়, একমাস জেলের যবের রুটি খেয়ে তার শরীরে পাঁঠা-যব ধরনের গন্ধ তৈরি হলো। বাড়ি ফেরার পর আরেক নারকীয় অবস্থা, দেখে তার বিছানাপত্র ঝকঝকে, পুরা মাথায় রক্ত উঠে গেলো, কয়েক রাত প্রায় নির্ঘুম কাটানোর পর আবার মিশ্র গন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হলো সে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমুনি লেগে এসেছিলো, এমন সময় ট্যারা মনসুর এসে এক থাবড়া লাগালো ঘাড়ে, কি ভাবতাছস হালায়? ট্যারা মনসুর ধড়িবাজ কেজো, সব শুনে ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে গেলো নটীদের পাড়ায়। প্রতিবাদ করার আগেই উপলব্ধি করলো, সে এক পানসে রূপসীর ঘরে বসে আছে.. এই পর্যন্ত থাক, বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। এরপর মেহের ফুপুর জমানো পয়সা চুরি করে সে নটীদের পাড়ায় গেলো। তারপরের ঘটনা সঙ্গীন, ধরা খেলো ঔরঙ্গজেব, উপরি পাওনা পিটুনি, তারপর জ্বর, সবশেষে প্রতিজ্ঞা, ‘থাকিতে হস্ত/ হবো না রমণীর দারস্থ…’ নাবালকরা পড়বেন না যেন। শয়তানটা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো এই পদ্য, মাকে অর্থ জিজ্ঞেস করে আমিও মার খেয়েছি। কাহিনী যখন বেতাল পথে, বড়কাকা বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবের সাথে কথা বলে, তাবলিগে পাঠিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবকে।



যারে দিবি ফালাইয়া, তারে লইয়া যা কালাইয়া

মুঘল পরিবারটি ঔরঙ্গজেবের বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। এই উৎকট সুযোগে বাবর মিয়া পুনরায় নিজ ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছেন। সবার পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার পর রাত্রির গোপনে স্ত্রীর পাও ধরেছেন তিনি। ভাবার অবকাশ কম যে, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, মেহেরুন্নেসা এখনও অপ্রসন্ন। ইতিমধ্যে বড় একটা আছাড় খেয়ে তার পা মচকেছে, পুকুরে স্নান সেরে ফেরার সময় টের পেলেন কি যেন একটা হাঁটুর কাছে নড়াচড়া করছে, তারপর দেখেন আজদাহা এক জোক, অতঃপর আছাড়। লবন দিয়ে জোক ছাড়ানো হয়েছে, কিন্তু পা ফুলে ঢোল, বিকট চিৎকার দেওয়ায় গলাও বন্ধ। এদিকে এলাকায় মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। পাড়ার ঢোল আফ্রিকান উপজাতিদের ঢোলের চাইতেও মারাত্মক। ওটাকে চোখে দেখা যায় না কিন্তু শব্দ করে ফিসফিস, তারপর সেই শব্দ বজ্রপাতের রূপ নেয়। এই মুহূর্তে প্রতিবেশীরা ঔরঙ্গকে বিয়ে করিয়ে দেবার দাবীতে সোচ্চার। মুশকিলে আছেন মেহের ফুপু, ‘কোনও মেয়ে তো হারামজাদার বৌ হতে চায় না! কোন অমাবশ্যায় এই জুতার খোলটাকে পেটে ধরেছিলাম আমি?’ পরামর্শ বেলার মা-ই দিলো, ‘যারে দিবা ফালাইয়া, তারে লইয়া যাও কালাইয়া।' মানে কি? কালাইয়া পটুয়াখালিতে, ওখানে বিবাহযোগ্য কন্যাদের অভাব নাই। ঘটক লাগানো হলো, দেখাশোনা চলতে লাগলো, শেষতক এক জোতদারের পাঁচ নাম্বার বিবির বড়কন্যার সন্ধান এল। একটা মিনিবাস ভাড়া করে পুরো দলবল রওনা দিলো পাত্রী দেখতে। মেয়ে পছন্দ হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হবে। একটা কথা না বললেই নয়, রান্না হয়েছিলো অনেক পদ, বুড়া গুড়াদের দল খেয়েছিলো নোলা ডুবিয়ে। অবশেষে ডিম গড়নের এক মেয়েকে এনে বসানো হলো পাত্রপক্ষের সামনে। সবাই করছিলো উসখুস, ঔরঙ্গজেব খুসখুস। কি যে হলো তার, প্রথমে তার পেটে কামড় দিলো, তারপর ধপাস করে পড়েই খিঁচুনি উঠলো। পাত্রের মৃগীরোগ, বিয়ে ডিসমিস। ঔরঙ্গজেব দাড়িজোব্বা রেখে যৌবনকে উৎসর্গ করে দিলো, যদিও সুখাদ্যগুলোর কথা তার সারাজীবনই মনে ছিলো।



0

অণুগল্প - মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর

Posted in










ছবি - ত্বিষাম


অণুগল্প


স্ত্রৈণ 
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর 



হারমোনিয়ামটা পেল্লায় সাইজ। সাবেকী আমলের। জার্মান রিডের। কালের প্রহারে শরীরে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেলেও এর বনেদী চেহারায় এখনও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

বংশলতিকা বেয়ে বেয়ে হারমোনিয়ামটার জিম্মাদার এখন আমি। এর মূল মালকিন ছিলেন আমার প্রপিতামহী অন্তরা চৌধুরী। তিনি ছিলেন বেথুনের গ্র্যাজুয়েট এবং সংস্কৃতিমনা। তখন ব্রিটিশ আমল। ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার বেশ নাম। শুনেছি আমার জমিদার প্রপিতামহ খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন তার রূপে-গুণে ফিদা হয়ে যান। এবং সামাজিক প্রতিপত্তির প্রভাব খাটিয়েই হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলেন। বিয়েতে শাড়ি, গহনা এবং অন্যান্য সওগাতের সাথে বিলেতে স্পেশাল অর্ডারে তৈরী এই হারমোনিয়ামটাও ছিলো। 

আমার পিতামহের কাছে শোনা টুকরো টুকরো গল্প বিশ্লেষণ করে আমি অনুমান করি, খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী অসম্ভব ভালবাসতেন স্ত্রী অন্তরা খানকে। বিয়ের পর তিনি ঘরকুণো হয়ে পড়েন এবং অন্তরা চৌধুরীর গানে বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাটা দিন। নিশ্চয়ই অন্তরা চৌধুরী তার একমাত্র শ্রোতাকে প্রগাঢ় ভালোবেসেই গান শোনাতেন এবং সেই সাথে চলতো এই হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে তার ললিত আঙ্গুলের পরশ। অবশ্য বিষয়টিকে নেতিবাচক বিশ্লেষণও দেওয়া যায়। বিয়ের পরপরই খান বাহাদুর সম্পূর্ণ স্ত্রৈণ হয়ে পড়েন এবং সেই সাথে শুরু হয় জমিদারীকর্মে তার চরম অবহেলা। ঠাকুর্দার মুখেই শুনেছি বিয়ের পর থেকেই খান বাহাদুররে জীবিকা হয়ে পড়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে জমি বিক্রি করা। আমার ঠাকুর্দা হাশেম চৌধুরী যথেষ্ঠ বৈষয়িক হলেও তার পক্ষে জমিদারী উদ্ধার করা আর সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া ইতোমধ্যে ভারত ভাগ হয়ে গেছে এবং পূর্বপাকিস্তানে জমিদারী প্রথা বিলোপও হয়ে গেছে। 

সঙ্গীতে আমার অনুরাগ দেখেই একদিন ঠাকুর্দা বললেন, 'কবীর, মায়ের হারমোনিয়ামটা তো অনেকদিন আগলে রাখলাম। আমি তো গানের গ-ও বুঝি না। আমাদের বংশে শুধু তুই-ই মায়ের গুণটি পেয়েছিস। নিয়ে নে তুই, আর কেউ তো এর মর্যাদা বুঝবে না।' খুশীতে ডগোমগো হয়ে সাথে সাথেই নকশীকাটা বাক্স থেকে বের করে বাজাতে শুরু করি। স্কেলিং পুরোপুরি নষ্ট। নিয়ে গেলাম ঢাকার সেরা হারমোনিয়ামের কারিগর ‘যাদব এন্ড যাদব’ কম্পানির অতুলবাবুর কাছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন তিনি। শেষটায় হতাশ হয়ে বললেন, ‘এটা আর ঠিক হওয়ার নয়। এর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। অ্যান্টিক হিসেবে ইচ্ছে করলে রেখে দিতে পারেন’। সেই থেকেই হারমোনিয়ামটি ড্রয়িং রুমে শোভা পাচ্ছিলো। 

ঠাকুর্দা গত হয়েছেন অনেক বছর। বাবা-মাও গত। এক সপ্তাহ হলো বিয়ে করেছি। মৌসুমীও গান গায়। ফুলশয্যার পরের রাতে ড্রয়িং রুমে রাখা হারমোনিয়ামের বাক্সটি ওর চোখে পড়ে। ডালা খুলে বের করে হারমোনিয়ামটি নিয়ে এল বেডরুমে। আমি বললাম, ‘মিছেমিছি টেনে নিয়ে এলে, এটার স্কেলিং তো ঠিক নেই। এর আয়ু শেষ। ঠিক আছে তোমাকে কালকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবো’। ওর মুখে রহস্য হাসি। কিছুক্ষণ আঙ্গুল চালালো রিডগুলোতে। তারপর গাইতে শুরু করলো – 

তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ 
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া 
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক .. 

ওমা ওর সুরেলা কন্ঠের সাথে তাল রেখে হারমোনিয়াম তো ঠিকই বাজছে। কোথাও এতটুকু ছন্দপতন নেই! নিজেকে মনে হচ্ছে জমিদার খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী আর ও আমার প্রেয়সী স্ত্রী অন্তরা চৌধুরী। মুগ্ধ হয়ে শুনছি গান। আমারও স্ত্রৈণ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।