গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in গল্পদীপঙ্কর কোলকাতায় এসেছে শেষ চিহ্নটুকু মুছে দেবে বলে। শেষ বলতে ফ্লাটটা। অনেকদিন থেকেই পড়ে আছে। অকারণে ফেলে রাখার মানেই নয় না। তবু কোর্টে সই করার সময় বুকটা চিনচিন করে উঠলো। জীবনের প্রথম সম্পত্তি বলে কথা। বাবা চিরকাল ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। তখন মনে হতো, পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই থাকবে না! কোর্ট থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর সোজা আশ্রমে চলে এলো। কোলকাতায় এলে এখানেও আসা হতো। গুরুদেবের বয়েস হয়েছে। বেশি কথা বলেন না। তবু তাঁর কাছে কিছুক্ষণ বসলে শক্তি পাওয়া যায়।
আশ্রমের বাগানে একটি মেয়ে খেলছে। মুখটা খুব চেনা। মনে পড়লো, ফেসবুকে দেখা। সে কাছে গিয়ে বলল, ‘কেমন আছো তিন্নি?’ মেয়েটা খেলা থামিয়ে কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে রইল। তারপর ছুট দিলো বাবা মায়ের দিকে, ‘ঐ লোকাটা আমার নাম ধরে ডাকছে’। আশ্রমের বারান্দায় বসে থাকা দম্পতি উঠে আসছে দীপঙ্করের দিকে। কলেজ বয়েসে এই চিত্রিতার প্রেমে পড়েছিল দীপঙ্কর। বিয়েটা নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণে হয়নি। চিত্রিতার বাবা ধারণাই করতে পারেন দীপঙ্কর একদিন এমন বড় হয়ে উঠবে! কাছে এসে ভুত দেখার মতো আঁতকে উঠে চিত্রিতা বলল, ‘আরে, তুমি এখানে?’ তারপর ‘কলেজের বন্ধু’ পরিচয়ে আলাপ করিয়ে দিলো স্বামী জয়ন্তর সঙ্গে। তার গলায় ধড়া, খালি গা, পরনে এক খণ্ড সাদা থান, পায়ে হওয়াই চটি, মুখে না কাটা দাঁড়ি, উষ্কখুষ্ক চুল। জয়ন্ত বিরস হেঁসে বলল, ‘বাবার শ্রাদ্ধের কাজ আশ্রমে করাবো। তাই কথা বলতে এসেছি। আমাদের খুব ছোট ফ্ল্যাট। তাছাড়া খরচ খরচাও এখানে কম হবে’। আরও দুএকটা কথা বলতে না বলতে একজন সেবক এসে জয়ন্তকে বললেন, ‘আসুন ছোট মহারাজ আপনাকে ডাকছেন’।
তিন্নি একটা প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করে চলে গেছে বাগানের ঐ দিকে। চারিদিক অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে আসছে খুব দ্রুত। দীপঙ্কর বলল, ‘এবার তাহলে চলি!’ চিত্রিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘এমা, আমাদের তো কথাই হল না’। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত পোস্ট দেয় চিত্রিতা। ওর বিষয়ে সেভাবেই অনেক কিছু জেনেছে দীপঙ্কর। তবে সে নিজে একটিভ নয়। চিত্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে দীপঙ্কর বলল, ‘কি জানতে চাও বলো?’
আশেপাশে কেউ নেই এখন। মনকে শক্ত করে সরাসরি আসল প্রশ্নটা করেই ফেলল চিত্রিতা, ‘এখনো কি ভালোবাসো?’
দীপঙ্কর মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি?’
মুহূর্তে চিত্রিতার দুই চোখ ছলছল করে উঠলো। মাটির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘সেদিন আমাকে নিয়ে পালিয়ে কেন গেলে না?’ কোন উত্তর মাথায় আসছে না দীপঙ্করের। চিত্রিতার গাল বেঁয়ে নেমে আসছে চোখের জল। পুরনো দিনগুলোর কথা হুড়মুড় করে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। চিত্রিতা হাত বাড়িয়ে দীপঙ্করের হাত স্পর্শ করলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথার মধ্যে চমকে উঠলো বিদ্যুৎ। যেমনটা হয়েছিল প্রথম স্পর্শের দিনে।
তিন্নি এখন এদিকেই আসছে। দীপঙ্করের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে চিত্রিতা বলল, ‘একটা কিছু তো বলো!’
সে দুই হাতের মাঝে চিত্রিতার হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘বিশ্বাস করো, সেদিন পালিয়ে গেলে আমাদের প্রেম এত টাটকা থাকতো না, এত বছর পরেও!’