Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in





৩)
রাই আজ থেকে সারাদিন ফ্রী। সোমেশ কদিনের জন্য শিলিগুড়ি যাবে আর সেখান থেকে মণিপুর হয়ে দিন সাতেকের মত বাইরে থাকবে। এমনিতে সোমেশের সাথে আজকাল কেজো কথাবার্তা ছাড়া ভাল করে কথাই হয়না। তিতলি বাড়ি থাকলে তাও মায়ে বেটীতে আগে দিনগুলো কাটত হইহই করে। এখন তিতলি ব্যাঙ্গালোরে পড়তে চলে যাওয়ায় সেটাও বন্ধ। এবার থেকে সারা দিনে তিনটে নিয়ম করে ডিসিপ্লিন্ড ও সংক্ষিপ্ত ফোনকল আসবে, একটা সকাল এগারোটায়, একটা বিকেল পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটায় আর শেষেরটা রাত দশটায়। রাত্রে সোমেশ নিজেও বেশীক্ষণ জাগতে চায়না যেমন রাইকেও জাগিয়ে রেখে বিব্রত করেনা। আসলে ফোন সোমেশের ফোন আসলে রাইএর শুধু হ্যাঁ, না আর আচ্ছা এই কটি শব্দ ছাড়া অন্য কিছু শব্দ ব্যবহার করতে হয়না। সোমেশ ছোট ছোট বাক্যে সবটাই বলে দেয় একতরফা। ঠিক যেন ওদের অফিসের এ্যাংলো ইন্ডিয়ান বুড়ি স্টেনো মিসেস ফ্যান্সীকে ডিকটেশন দেওয়ার মত। বরং ওই ফোনগুলোর মধ্যবর্তী বিচ্ছিন্ন সময়গুলোই রাই এর একদম নিজস্ব। সে তখন আলী কে গাড়ি বের করতে বলে ইচ্ছেমতন কখনো বিগবাজার বা শপার্স স্টপ বা অক্সফোর্ডবুকস্টোর কিংবা কখনো মা'র কাছে সখের বাজারে একবেলা কাটিয়ে আসে। বিত্তবান রায়বাড়ির মাঝবয়সী রাই এর সাথে আজ থেকে তিরিশবছর আগের প্রজাপতির মত ফুরফুরে রাইকে কোন হিসাবেই আর মেলানো যায় না। হাতের মুঠো দিয়ে দিন, সময় আর বয়স সবই আস্তে আস্তে যে গলে ছড়িয়ে গেছে কবেই, তা টের পাওয়ার আগেই বেলা পড়ে আসছে।

**************
মেসেঞ্জারে টুংটাং সুরে অরাতিদমনের বার্তাটি ভেসে এল। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার মেসেঞ্জারে টেক্সট বিনিময় হয়েছে। আস্তে আস্তে শুকনো 'আপনি-আজ্ঞে ' সম্বোধন খসে গিয়ে নিকটতম 'তুমি'র দিকে এগোচ্ছে ওদের ভার্চুয়াল সম্পর্কটা। ছেলেটার সত্যি বড়ই কমবয়েসী। এই ছাব্বিশ কি সাতাশ বছরের হবে! তিতলিটাই তো দেখতে দেখতে কুড়ি বছরের প্রায়! নিজেকে মাঝেমাঝে বড্ড হ্যাংলা বেহায়া বলে মনে হয়। আসলে অরাতিদমনের সবকিছু ওর স্বপ্নিল চোখদুটো, দুষ্টুমিষ্টি হাসি, ওর কবিতাগুলো, এসবই দেখলে রাই বয়সটাকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে। প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে হলুদবনের ভিতরে। বড্ড দেরী হয়ে গেল 'অরাতিদমনে'র দেখা পেতে। নিজেকে নিয়ে এই সংশয়, এই টানাপোড়েনের মানে তাহলে কি রাই সত্যি ফুরিয়ে যাচ্ছে?

************
ঋজু রাইকে দেখে তড়িঘড়ি উঠে এগিয়ে আসতে গিয়ে একটা চেয়ারের পায়া'তে হোঁচট খেয়ে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল। রাই এর ঠোঁটেও সেই বিশ্বজয়ী হাসির ছোঁয়া এসে লাগে। ঋজু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে রাইএর হাতটা আলগা আঙুলে এসে ছোঁয়। 'চল কোণের টেবিলটায় বসি! ' রাই বলে - 'কি হয়েছে রে তোর আজ! কেমন যেন তর সইছে না? '
ঋজু বত্রিশ পাটি বিকশিত করে বলে,
'কাল মাইনে পেয়েছি! টু হান্ড্রেড রুপীজ! আজকে কফি উইথ পকোড়া দিয়ে এই শর্মাই দেবীর পূজোর ভোগ চড়াবে!'

শেষ বিকেলের মায়াবী আলো এসে দাড়িগোঁফে অবিন্যস্ত রুক্ষ শুষ্ক ঋজু র মুখে জাফরি কেটে দিয়ে ঝলমল করে।
রাইও গলায় মধু মাখিয়ে বলে ওঠে -
' তাহলে বল আজ ট্যাক্সি চেপে তারাতলা অবধি যাব একসাথে! বল আগে হ্যাঁ?'

সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় আজ ঝেঁপে ফুল ফুটেছে। আর তার কোল ঘেঁষে কল্লোলিনী শহর বয়ে চলেছে অবিশ্রাম স্রোতে। ট্যাক্সিতে বসে ঋজুর কাঁধের ওপর মাথাটা হেলিয়ে দিল রাই। ওরা ভাবতেই পারেনি জনবহুল কংক্রিটের শহরেও আজকাল এত তাড়াতাড়ি বসন্তকাল এসে যায়।

******************

কানহাইয়ার গোকূল ছেড়ে চলে যাবার প্রায় পক্ষকালপর্বের অবসান হয়েছে। এই প্রত্যহ দিনরাত্রির পলগুলি রাধার জীবনে একটা প্রত্যক্ষ পরিবর্তন এনে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। ওর সবচেয়ে প্রিয় নীলাম্বরীর কঞ্চুলিকাগুলি অবহেলায় এদিক সেদিক পড়ে থাকে আজকাল। এগুলির প্রতিটায় কানহাইয়ার স্পর্শ লেগে আছে। যে রত্নখচিত মঞ্জীরগুলি রাত্রিকালীন অভিসারে একদা ত্যাগ করে তাকে বের হতে হতো, সেগুলিকেও স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়না। মনে আছে একবার তার প্রবল অভিমান ভাঙাতে কানহাইয়া ওর পদপল্লবদুটি ধরে প্রায় নিজের মাথায় স্পর্শ করাতে যাচ্ছিল; অতিকষ্টে সে নিবৃত্ত করে তাকে। ওই মঞ্জীরগুলিতেও কানহাইয়ার চুম্বনরেখার দাগ আছে। আসলে কানহাইয়া আর রাধা অভেদসত্ত্বা।রাধার কোনও কিছুরই সংস্রব যেমন কানহাইয়ার স্পর্শ মুক্ত নয়; তেমনই কানহাইয়ারও সর্বত্রই রাধারঙ্গ আঁকা । এ এক গভীর সম্বন্ধ বলেই, প্রতিপদে এত জ্বালা, এত দহন। আয়ান আজকাল রাধার অঙ্গ স্পর্শ করতে উৎসাহ বোধ করে না। রাধা ভাবে আয়ান কি কখনো একবারও পারে না অধিকার ও প্রবলদৃঢ়তার সাথে রাধাকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করে কানহাইয়ার প্রতি সব মনোবাসনাকে মুছে দিতে! হায় নিষ্ঠুর নিয়তি! এবার থেকে কি রাধার সব কটি রাত্রি কি বিনিদ্রই কাটবে?

*********

চিতোরের রাণী হিসাবে যা যা জৌলুস থাকবার তার সবটাই তো ছিল মীরার। সাধারণ পরিবারের মেয়ে রাজবধূ হয়ে বাপের বাড়ির গর্ব শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাণা সঙ্গা যার শ্বশুরমশায়, গোটা রাজপুতানার লোকে যাকে শ্রেষ্ঠ মানে বীরত্বে আর শৌর্য্যে, সেই যখন মীরাকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে চাইল, মেওড়ের গ্রামে জ্বলে যাওয়া বাজরার ক্ষেতে নতুন করে খুশীর ঝোঁক উঠেছিল। গ্রামের মাতব্বর বুড়ো নরবর্ সিং এসে মীরার বাবাকে আসন্ন ভাগ্যোদয়ের জন্য একমণ ভইঁসা ঘিয়ের লাড্ডু আর হালওয়া খাওয়ানোর জন্য আগাম ফরমান দিয়ে চৌপাইতে বসে ফুকফুক করে সুটঠায় টান মারছিল।তার ধবধবে সাদা হয়ে যাওয়া গালপাট্টায় তামাকের ধোঁয়া মাখিয়ে সোনালী সূর্যদেব সেদিনকার মত অস্ত গেলেন। বালিকা মীরার তখনো বিয়ের বুদ্ধি হয়নি। সাগাই এর গয়না পাওয়ার খুশীতে লাফাতে লাফাতে ওর আবাল্যের 'গিরিধর' কে খবরটা দিতে এসে সে প্রথম দেখল যে কালো মসৃণ পাথরের 'লালাজী'র মুখটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে। মীরার বালিকা মনে ঘনাল দ্বিধা আর দোলাচলের মেঘ। চিতোরের রাজবধূ হলে কি 'গিরিধারী'কে চিরদিনের জন্য ছেড়ে থাকতে হবে মীরাকে?