ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বানরায়ণ, পর্ব ৩
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সে রাতটা সম্বর্ত আর তার দলবল আমাদের গ্রামেই থাকলো। সর্দারের যদিও ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ ছিলো না, কিন্তু ওদের কিছু বলার সাহসও ছিলো না তার। একশো জন সশস্ত্র প্রশিক্ষিত যোদ্ধাকে প্রতিরোধ করার মতন ক্ষমতা আমাদের গ্রামের মানুষের ছিলো না।
কিন্তু তার প্রয়োজনও ছিলো না। গাঁয়ের অল্পবয়সী পুরুষরা সবাই একেবারে মেতে উঠেছিলো এদের নিয়ে। রীতিমতন ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিলো কুঁকড়ো, ছাগল আর শুয়োর মেরে। সঙ্গে আমাদের মেয়েদের চোলাই করা তালের মদ। অনেক রাত পর্যন্ত হই-হুল্লোড়, নাচ-গান-বাজনা চলেছিলো। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। সর্দার শুধু ভুরু-টুরু কুঁচকে বসে নিজের ডোঙা থেকে চুমুক দিচ্ছিলো ঘন ঘন, আর থেকে থেকে রক্তচক্ষে দেখছিলো গাঁয়ের যুবতী মেয়েদের। যে কোনও বহিরাগত পুরুষের ব্যাপারে সর্দারের মনে যে একটা বিতৃষ্ণামিশ্রিত সন্দেহের ভাব ছিলো, সেটা আমরা জানতাম।
নারী-পুরুষের সামজিক আচরণে যে প্রভেদ হতে পারে, সেরকম কোনও ধারনা আমদের ছিলো না। আমাদের মেয়েরা পছন্দ মাফিক পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারতো, ভাঙতেও পারতো নিজেদের ইচ্ছে মতন। ঘর বাঁধার আগেই গর্ভ হলেও কোনও আপত্তি ছিলো না আমাদের সমাজের। গোলপাতায় ছাওয়া আমাদের ছোট ছোট মাটির ঘরগুলোর মতনই ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী ছিলো আমাদের সমাজ নির্দিষ্ট সম্পর্কগুলো। কিন্তু সম্প্রীতির অভাব ছিলো না তার জন্য। আসলে, মানুষের উপর মানুষের যে অধিকার থাকতে পারে, সেই বোধটাই ছিলো না আমাদের।
সেই জন্য, সর্দারের ভুরু কুঁচকানি আর চোখ রাঙানি সত্ত্বেও ঝিকি, ডানা, মাকিরা অবধারিত ভাবেই রাতের অন্ধকারে এক সময়ে গিয়ে মিশে গেলো ওদের মধ্যে। একে ভিনদেশি পুরুষ... তায় বলশালী যোদ্ধা! তাদের প্রতি যুবতী মেয়েরা যে আকৃষ্ট হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? তাই পরদিন কাক-ডাকা ভোরে, যখন গ্রামের আঙিনায় ইতস্তত পড়ে থাকা নেশাগ্রস্ত গ্রামবাসী আর সৈনিকদের ঘুম ভাঙছে, তখনও ডানা আর মাকি দু’জন বিশালদেহী অপরিচিত পুরুষের বুকের কাছে ঘুমে অচেতন।
যাওয়ার আগে সম্বর্ত আর এক দফা বক্তৃতা দিয়ে গেলো। এ যুদ্ধ ধর্মরক্ষার যুদ্ধ, মহাপাপিষ্ঠকে মহাদণ্ডদানের যুদ্ধ... কত যশ, কত সম্মান, কত প্রাচুর্য অপেক্ষা করে আছে অদূর ভবিষ্যতে কিষ্কিন্ধার রাজকীয় বাহিনীতে যোগদানকারীদের জন্য... ইত্যাদি, ইত্যাদি! বলে গেলো, ওদের নিয়োগশিবির আরও দশ’বারো দিন থাকবে ওখানে। তার মধ্যে গিয়ে নাম নথিভুক্ত না করালে আর সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে।
রোদ ওঠার আগেই সম্বর্তর দল ভারি পা ফেলতে ফেলতে সারবদ্ধ ভাবে আমাদের গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আর তারপর শুরু হলো গণ্ডগোল। ভয়ানক গণ্ডগোল।
এই ভাবে কেউ কোনওদিন সর্দারের বিরোধিতা করেনি তাম্বলি গ্রামে। সর্দার একেবারে এঁড়ে বসলো, গ্রাম ছেড়ে কারও কোথাও যাওয়া চলবে না। কোথায় কার সঙ্গে কার যুদ্ধ হচ্ছে, তার নেই ঠিক! তার জন্য আমাদের কারও জীবন বিপন্ন করার কোনও প্রশ্নই নেই। বিধান দিয়ে সর্দার গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। আর তারপরেই হলো বিস্ফোরণটা।
মোহক, পাহান, জাদু, বুগা, চম্বুক... সবাই মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলো, সৈন্যশিবিরে নাম লেখাতে যাবে। বাইরের জগতের এত খবর একসঙ্গে কোনওদিন এসে পৌঁছয়নি তাম্বলি গ্রামে এর আগে। অযোধ্যা, লঙ্কা, কিষ্কিন্ধা... কি রকম জায়গা এসব? মানুষ গুলোই বা কি রকম? ত্রিভুবনের প্রভু রামচন্দ্র! ত্রিভুবন মানে কি? আমরা তো জানি উপরে ওই আকাশ, আর তার নীচে এই পাহাড় আর জঙ্গল। আবার আর একটা ভুবন কোথায় আছে? সেখানেই কি লঙ্কা, যে পুরীতে ধনরত্ন পথের ধারে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকে? অথৈ জলের পারাবার... সে কেমন হয়?
এই সব নিয়ে প্রচুর আলোচনা, প্রচুর স্বপ্নবিলাস সারা রাত ধরে চলেছে। যতটুকু সম্বর্তের দল বলেছে, বলেনি তার থেকে অনেক বেশি। শুধু যে কথাটা বারবার সবাই বলেছে, সেটা হলো কুমরিকার উপকূলে সেতু বন্ধন হচ্ছে। সমুদ্রের উপর অমন সেতু নাকি এই পৃথিবীর কোথাও তৈরি হয়নি এর আগে। এই পৃথিবী... সেটা কত বড়? আমাদের এই পাহাড়-জঙ্গল-নদী-ঝর্ণা পেরিয়ে, কিষ্কিন্ধা, অযোধ্যা, লঙ্কা ছাড়িয়ে, আরও কত দূর?
এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যই তো যেতে হবে। কেউ কোনওদিন জানতো আমাদের এই চেনা-জানা জগতের বাইরে আরও এত কিছু আছে? এত ঘটনা ঘটছে? লঙ্কার ধনরত্ন, বীরত্বের যশ, সে সব কিছু যদি সত্যি নাও হয়, শুধুমাত্র সেই পৃথিবীটাকে দেখার জন্য, চেনার জন্যই তো যেতে হবে। যেতেই হবে...
সর্দারের ঘরের বাইরে কোলাহলটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। একসময় সেটা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছলো, যে সর্দার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ঝড়ের মতন। রক্তচক্ষু, রাগে কম্পমান। ষাঁড়ের মতন গর্জন করতে লাগলো। যে বা যারা যাবে সৈন্যদলে নাম লেখাতে, তারা যেন আর কোনওদিন ফিরে আসার কথা না ভাবে, তাম্বলি গ্রামের দরজা তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি...
হঠাৎ সর্দারের প্রচণ্ড তেজের সামনে পড়ে অপর পক্ষ কিছুক্ষণের জন্য একটু চুপসে গেলেও একটু পরেই আবার তাদের অসন্তোষ প্রকাশ পেতে লাগলো। তারপর উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে যখন প্রায় ফাটো ফাটো অবস্থা, সর্দার আর পাগলা পাহান দু’জন দু’জনের উপর তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে এলো ঠাকুর্দা।
সর্দারকে সবাই শ্রদ্ধা করতো, ভালোওবাসতো। কিন্তু আড়ালে তার গোঁয়ার্তুমি নিয়ে লোকে হাসাহাসিও করতো। কখনও কখনও বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েও পড়তো তার সঙ্গে কেউ কেউ। কিন্তু ঠাকুর্দাকে সবাই একটা অন্যরকম সম্ভ্রমের চোখে দেখতো। ভয় পেতো। তাই সে আসতেই সবাই চুপ করে গেলো। সর্দারও।
ঠাকুর্দা এমনিতে সব সময় গম্ভীর, আত্মস্থ, বেশ ভারিক্কি চালে থাকতো। কিন্তু মাঝে মাঝে তার স্বপ্ন হতো। মানে, ঘুমের ভিতর যে স্বপ্ন সবাই দেখে, সেই স্বপ্ন নয়। সজাগ অবস্থাতেই হঠাৎ কিরকম শিউরে উঠে এক্কেবারে স্থির হয়ে যেতো বুড়ো সোমুক, আমার ঠাকুর্দা। সেই ভাবে কেটে যেতো বেশ খানিকটা সময়। কাচের মতন স্বচ্ছ্ব চোখ, যে চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তাদের দৃষ্টি বহু দূরের কোনও কিছুর উপর নিবদ্ধ, এবং সে দূরত্ব দৈর্ঘ্যে মাপার নয়। তারপর এক সময় তার সম্বিৎ ফিরে আসতো। বা সম্বিৎ বলাও ভুল। ফিরে আসতো তার নিজস্ব চেতনার খানিকটা, আর সে প্রায় তদ্গত অবস্থায় বলতে থাকতো... সেই ঘোরের মধ্যে সে কি দেখলো। সে সব বেশির ভাগ সময়েই আমরা কিছু বুঝতাম না। শুধু এইটুকু বুঝতাম, যে সে সব অন্য সময়ের, অন্য জায়গার কথা।
সেদিনও ঠাকুর্দার অবস্থা খানিকটা ওই রকমই ছিলো। আগের দিন বিকেলবেলা সম্বর্ত বক্তৃতা দেওয়ার সময় আমি ঠাকুর্দাকে তন্ময় হয়ে যেতে দেখেছিলাম। আর কেউ দেখেছিলো কিনা জানি না। সবার মন তখন বক্তৃতার দিকেই ছিলো। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম, বুড়ো সোমুক অন্য কিছু দেখছে। তারপর আর সারা সন্ধে তার দিকে মন দেওয়ার বিশেষ সময় পাইনি। হই হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছিলো। সত্যি কথা বলতে, ক্ষণিকের জন্য দেখা ঠাকুর্দার ওই আবিষ্ট ভাবটার কথা আমি ভুলেও গিয়েছিলাম। মনে পড়লো তাকে আসতে দেখে। এসে সর্দারের মুখোমুখি খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বলতে আরম্ভ করলো...
‘‘ওদের যেতে দে, সর্দার। যেখানে ওরা যাবে, সেখানে এক বিরাট কর্মকাণ্ড হচ্ছে। আমি স্বপ্ন পেয়েছি। ওখানে ওদের যেতেই হবে। সেটাই ভবিতব্য। তুই আটকালেও ওরা জোর করে যাবে।’’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে দাঁড়িয়ে রইলো বুড়ো। সর্দার ভ্রূকুটিকুটিল চোখে তকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো ঠাকুর্দা।
‘‘সবাই ফিরবে না। কোনও যুদ্ধ থেকেই সবাই ফেরে না। কিন্তু যারা ফিরবে, তারা সঙ্গে করে কি অমূল্য সম্পদ নিয়ে আসবে, সে তুই বা কেউই এখন ভাবতেও পারবে না, সর্দার। শুধু ধনরত্ন নয়। যাদের সঙ্গে ওদের দেখা হবে, তারা... তারা...’’
কথা শেষ করতে পারলো না বুড়ো সোমুক। কেমন ঘোরের মধ্যে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলো সেখান থেকে। খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর আকস্মিক উল্লাসে ফেটে পড়লো মোহক, পাহানের দল। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সর্দারের সামনে গোল গোল করে নাচতে লাগলো।
সর্দারের করুণ অবস্থাটা আমার ভালো লাগছিলো না। বুড়ো গোঁয়ার আর রাগী হলেও ভালোবাসতো সবাইকে। সবার ভালোর জন্য চিন্তা করতো। হয়তো সেই ভাবনা থেকেই নিষেধ করছিলো যেতে। কিন্তু কিছু করার নেই। যেতেই হবে। সেটাই ভবিতব্য...
আমি চুপচাপ সরে এলাম ওখান থেকে। মনের ভিতর তোলপাড়। কে কে যাবে? মোহক, পাহান, চিরু, জাদু, বুগা, চম্বুক, গোর্তন... আর কে কে? কে কে ফিরবে? যারা ফিরবে, তাদের মধ্যে কি ঋচিক নামেও কেউ থাকবে...? যদি না থাকে, তাহলেও বা কি? তার জন্য খুব বেশি কষ্ট কেউ পাবে কি? বুড়ো সোমুক পেতেও পারে...
সে রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর আমি চুপি চুপি গেলাম ঠাকুর্দার ঘরে।