Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।