ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল
Posted in ধারাবাহিকআঠারো
জানো মুন,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে।তুমি শুনছো মুন।মুন বললো,লেখক মশাই শুনছি। এইসব আবেগের কথাও লিখে ফেলো গল্পে।ভালো লাগবে।
তারপর শোনো মুন, কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না,ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। হাসি,খুশি সহজ সরল জীবন।
ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । সেই ঘরে থেকেই আমরা ভয় দেখাতাম সুদখোর মহাজনকে।সুদখোর ভূতের ভয়ে চাঁদা দিতো বেশি করে। বলতো, তোরা পাহারা দিবি। তাহলে চাঁদা বেশি দেবো।
পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।
বিজয় এবার থামলো। মুন গল্প শুনে খুব খুশি। স্বামী তার লেখক। এই গরবে মুনের গরবিনী হৃদয় দুলে উঠলো।সমস্ত অভাব, না পাওয়ার দুঃখ নিমেষে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মুন পরম আনন্দময় চাঁদের পদধ্বনি শুনতে পেলো তার অনুভবে।
মুন বলল,তুমি বাবা হতে চলেছ।
বিজয় বলল,কী আনন্দের কথা। কই একবার তার পদধ্বনি শুনি।বিজয় মুনের ভরাপেটে কান দিয়ে শুনল আগমনী সংগীত।হবু সন্তান পেটের ভিতরে পা ছুঁড়ছে। বিজয় মুনকে বলে,জীবনের প্রবাহ থেমে থাকে না।
সভ্য হওয়ার আগে মানুষ বনে বনে ঘুরে বেড়াতো ।তখন এত হিংসা ছিলো না । বনে পশু পাখি ঘুরে বেড়াত। সবুজ গাছ মানুষের মন জুড়িয়ে দিত । তখন এত গরম আবহাওয়া ছিল না ।মানুষের রোগ বালাই এত ছিল না । এই কথাগুলো বল ছিলো সমীর তার ছেলে মেয়েদের ।
বিজয় নদীর কাছাকাছি একটি গ্রামে বাস করতো। পড়ানোর পাশাপাশি সে গাছ লাগাত ছাত্রদের নিয়ে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে ।স্ত্রী রমা খুব কাজের মহিলা ছিলেন । কাজের ফাঁকে গাছ লাগাতেন ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে । বিজয় গ্রামে গিয়ে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে গাছ লাগাত ।আবার সময় পেলেই বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে অনেক অজানা তথ্য গ্রামবাসীদের শোনাত । একজন ছাত্র প্রশ্ন করল,
--- বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে কি বোঝায় গো বিজয় দা?একজন গ্রামবাসী জিজ্ঞাসা করলেন ।
বিজয় বলল,--আমাদের পৃথিবীর নানা দিকে বরফের পাহাড় আছে ।অতিরিক্ত গরমে এই বরফ গলে সমুদ্রের জল স্তর বাড়িয়ে দেবে ।ফলে সুনামী , বন্যায় পৃথিবীর সবকিছু সলিল সমাধি হয়ে যাবে ।
---তাহলে এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় কি?
-মানুষকে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে ।
গ্রামের একটা লোক বলল,--কি পদ্ধতি বলুন দাদা । কি করতে হবে আমাদের?
---এই যে পাখি ওপশুরা মল ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে তার সঙ্গে গাছের বীজ থাকে ।এই বীজ গুলি থেকে বিভিন্ন গাছের চারা বেরোয় । বাবলা,গুয়ে বাবলা,নিম, বট,প্রভৃতি চারা প্রকৃতির বুকে অযাচিত ভাবেই বেড়ে ওঠে ।শিমূল গাছের বীজের থেকে তুলো একটি ছোট বীজসহ উড়ে চলে আসে । একে আমরা বুড়ির সুতো বলি । তারপর বর্ষাকালে জল পেয়ে বেড়ে ওঠে ।
---তাহলে আমাদের কাজ কি?
---আমাদের কাজ হলও ওই চারা গুলি বড় করা ।তার জন্য আমাদের বাঁশের খাঁচা বানিয়ে ঢাকা দিতে হবে । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যদি এই নিয়মে মেনে গাছ লাগায় তবেই একমাত্র বিশ্ব উষ্ণায়নের কোপ থেকে রক্ষা পাবে ।