Next
Previous
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









নারীর ভেতর যে আগুন বা অগ্নিময় শক্তি আছে তাকে সমাজ বা সমসমাজ বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চিনতে পারে না।ফলে নারীকে সবসময়ই একটা কোমল,পেলব ছায়াতরু হিসেবে দেখানর চেষ্টা করা হয়।আমরা যারা সমাজতত্ত্ব বা সামাজিক জীবন বা নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি তখন দেখতে পাই যে নারীকে বৃক্ষ ভাবার অর্থ তাকে কুড়োল দিয়ে মারলে সে কথা বলবে না, তার গায়ে আগুন দিয়ে দিলে সে কথা বলবে না,তার গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও সে কথা বলবে না,তাকে দড়ির ফাঁস তৈরি করে, সটান ঝুলিয়ে দিলেও সে কথা বলবে না।কারণ গাছ নীরব থাকে।কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে বৃক্ষের সঙ্গে নারীর তুলনা হলেও নারী কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার স্বজ্ঞান নিয়ে জাগরিত থাকে। তার বুদ্ধিমত্তা, তার প্রজ্ঞা,তার মেধা তার জিজ্ঞাসা, তার যাবতীয় আবিষ্কারের চিন্তা -সবটা একটা নতুন ভুবন এবং নতুন ভুবনের যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে আমাদের সামনে, যেটা আমরা বারে বারে যুগে যুগে কালে কালে দেখেছি দেশে এবং বিদেশে। বেদের যুগে,উপনিষদের যুগে পরবর্তী সময় মহাভারত, রামায়ণকে যদি মহাকাব্যও ধরে নি, কল্পনাও করি।সেই সময়টা ধরে নিয়ে দেখবো নারী কিন্তু সব সময় অত্যন্ত সচেতন, সংবেদনশীল তাকে সেইদিক থেকে বৃক্ষ যেমন বলা যায়, তার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধের ক্ষমতাও আছে। যে প্রতিরোধ করে, প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে নতুন করে সমাজ বাস্তবতার চেহারা বদলে দেয়।এখানে আগুনের ডালপালা বলা হয়েছে মেয়েদের।আগুনের ডালপালা অর্থে বৃক্ষ গভীরে যখন আগুন লেগে যায় অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশ শোষণ, বঞ্চনা এবং নারীকে দাবিয়ে রাখার যে স্বভাব -প্রবণতা সেইটা যখন ভেতরে ভেতরে পেট্রোল, কেরোসিন, বারুদ জমাতে জমাতে দেশলাই কাঠি জ্বেলে বা মশালের আলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তখন এই শান্ত বৃক্ষরা হয়ে ওঠে অগ্নিময় কালান্তক কোনো যাত্রা।আর এই অগ্নিময়তা নিয়েই সে যাত্রা করে সূর্য শিকারে।সূর্য শিকার অর্থে এখানে জীবনের চরম সত্যকে চরম ভাবনাকে চরম জিজ্ঞাসা এবং প্রশ্নের প্রতি উত্তরকে সমূহভাবে, সামূহিকভাবে নিয়ে আসা,এটাই তার আগুনের ডালপালা হিসেবে সূর্য শিকারের দিকে যাত্রা আমাদের মনে হয়।ফলে সূর্য শিকার থাকে আগুনের ডালপালাও থাকে। নারী তার সমাজ বাস্তবতা এবং তার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্যাগ তিতিক্ষা ও জীবনের যাবতীয় যে কষ্ট, বঞ্চনা তার মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। সেই পৃথিবীর নাম সবুজ, এবং চিরন্তন এক যাত্রার স্বপ্ন নিয়ে থাকা ভুবন পথে যাত্রার কথাই বলে দেয় আমাদের।
নারী আমার কাছে শেকলে বাাঁধা সারমেয় ,পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের এই আস্ফালন যেন আবহমানের।আগেকার দিনে রাজা মহারাজার সভায় চিতা বাঘ দেখা যেত, আকবর ও জাহাঙ্গীরের সভায় চিতা রয়েছে গলায় শেকল বেল্ট বাধা।শিকারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো তারা।আর কুকুরকে তো রাখেই।এই ব্যাপারটা ক্রমশ করে দেওয়া হল। পুরুষ নারীর সব অধিকার হরণ করবে কিন্তু নারী তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে পারবে না।নারী অসূর্যম্পশ্যা। সে সূর্যের মুখও দেখতে পারবে না।প্রাচীন কালে মুঘল শাসনের সময়, মুঘল সম্রাটরা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতেন নাা পাছে সম্পত্তি ভাগ হয়, এই ভালো না লাগাকে মাথায় রেখে জাহানারা, রোশেনারা কারোরই বিয়ে হয় নি। আকবর এই আইন চালু করেছিলেন। তারা কিন্তু ঝরোখার ভিতর দিয়ে রাজপুত বীরদের দেখতেন- সুউচ্চ বুক, চওড়া কাঁধ, সুন্দর গোঁফ,সুপুরুষরা যাচ্ছে বা মধ্য এশিয়ার কোনো যোদ্ধাকে দেখতেন।কারণ তখন তো মধ্য এশিয়া থেকে আসতেন পেশাদার যোদ্ধারা মুঘল সেনা দলে চাকরি করতে, তাতার,তুর্ক,উজবেক,ইরানি থেকে সবাই আসতেন আর্মিতে-মোঘল সৈন্য দলে।তখন রাজ প্রাসাদের নারীরা লুকিয়ে বীর যোদ্ধাদের দেখতেন।কিন্তু বাইরে থেকে যোদ্ধারা বাইরে থেকে তাঁরা দেখতে পেতেন না।মুঘল হারেমে খোজা অর্থাৎ নপুংসক পাহারাদার রাখতেন।বা যাঁরা বাদশাহদের রক্ষিতা ছিলেন, তাদের পাহারাদারির জন্য - খোজা, নয়তো তাতারানি রাখা হতো পাহারাদার হিসেবে।তাদের মন মানসিকতা হচ্ছে এমন তুমি আমার সম্ভোগের বস্তু। আমার বাগানের গোলাপ তুমি।তোমাকে যখন ইচ্ছে ছিঁড়ব। যখন ইচ্ছে বুক পকেটে রাখব,যখন মনে হয় গন্ধ শুঁকব৷কখনও ফুলদানিতে রাখব,কখনও তাকে পদদলিত করব। আমাকে কেউ কিচ্ছু বলার নেই।আবার ইচ্ছে হলে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে দূরে ভাসিয়ে দেবো কোথাও।এটা যে সবটাই আমার ইচ্ছে। গোলাপের কোনো ইচ্ছে নেই। তার কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই।সে শুধু ফুটে যাবে।গন্ধ বিলিয়ে পুরুষ নামক বস্তুকে খুশি রাখবে।কখনো ফুলদানিতে, কখনো তাকে পদদলিত করব।এই যে পুরুষতন্ত্রের পুরনো খেলা, এই খেলাটা ক্রমশঃ নারী ধরে ফেলেছে। কল্যাণী দত্তের 'পিঞ্জরে বসিয়া'তে কিন্তু অন্যভাবে আঁকা হিয়েছে মেয়েমহল,নারীমহলের ছবি।সেখানে দেখা যায় যে আমাদের হিন্দু বাঙালি নারীরা অন্দর মহলে তাস খেলছে দাবা খেলছে, গ্রাবু, বিন্তি, সামনে সাজান পানের বাটায়,পান, জর্দা,চুন,,ছোটো এলাচ,বড় এলাচ, কিমাম। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন,কখনো কখনো চাপা গলায় মহিলা মহলের খিস্তি মৃদু গালাগালি-চাপা স্বরে, কখনও কখনও রসের কথা-আদি রসের কথা,একটু আদি রসাত্মক গুপ্তজ্ঞান জগতের কথাও হচ্ছে। এটা মেয়ে মহলের মুক্তি কিন্তু নয়। পুরুষরা যে বারমুখো, অর্থাৎ সন্ধ্যা হলে বাবু ধুতিটি পরে পাঞ্জাবিটি গায়ে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ,কানে আতর দিয়ে, চললেন রক্ষিতার বাড়ি, নয়তো বাইজি সন্নিধানে।তাদের প্রতিহত করার, রেজিস্ট করার ক্ষমতা কিন্তু অন্তঃপুরবাসিনীদের থাকছে না।

আসলে নারী প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিভাবান। যেহেতু নারী ভালো সংগঠক,যেহেতু সমস্ত পৃথিবীটাকে ভালো করে চালাতে পারেন,যেহেতু নারী পূর্ণ আকাশ,তাই পুরুষের ভয় যদি নারীর কাছে হেরে যাই,যদি তাকে দাবিয়ে দেয়,তাকে যদি তাড়িয়ে দেয়,তাড়িয়ে দেয় মানে গৃহ ত্যাগ নয়,কোন মতামত পছন্দ না হলে যদি তা নিমেষে উড়িয়ে দেয় তার ভয় পুরুষের। এটা নারীর স্বাধিকারের প্রশ্ন।আমি সন্তান ধারণ করব কী করব না, আমার গর্ভে সন্তান আসবে কি আসবে না,এই সিদ্ধান্ত নারী যদি নিতে না পারে, তাহলে কী করে নারী স্বাধীনতা আসবে।আগুনের ডালপালা বলা হচ্ছে কেন, নারীর ভেতর যে বিস্ফার আছে,যে প্রতিভা আছে,সেই প্রতিভাকে সে বিস্তৃত করতে চায়। হ্যাঁ, না বলতে চায়,তখনই সে বিদ্রোহী ।কিন্তু তার শিকড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু সে যখন শুদ্ধ স্বরে হ্যাঁ বা না বলতে চায় তখনই সে বিদ্রোহী। এই যে আগুনের ডালপালা, এই যে শিরোনামের দিকে আমরা আসছি, এই আগুনের ডালপালাগুলি ক্রমশঃ সম্প্রসারিত করছে তারা সূর্য শিকার করতে।সূর্য যা পৃথিবীকে আলো দেয়,নিজের গাত্র বর্ণ বা হেমবর্ণ অগ্নিবর্ণ আলো দিয়ে সে সূর্য শিকার করতে চাইছে।এই সূর্য শিকারের মধ্য দিয়েই ত্রিপুরার নারীদের লেখা অন্য নারী লেখকদের চেয়ে আলাদা।এবং সূর্য শিকার তারাই করবেন কারণ তাদের আগুনের ডালপালা আছে।এবং সেইটা তারা গোড়া থেকে মানে একটা মেয়ে যখন বড় হয়ে উঠে, আস্তে আস্তে যখন তার বালিকা বেলা থেকে কৈশোর বেলা,কৈশোর থেকে যখন যৌবন বেলা তখন থেকেই ঘরের মা বাবারা বুঝাতে থাকেন এটা করতে হবে,ওটা করতে হবে,এসব না মানলে পাপ হবে।এবং অদ্ভুত ভাবে মেয়েরা সবই মেনে চলতো।নারীর এতো প্রতিভা যে তাকে পুরুষ একশোতে একশো না বলে সাত বলতে চায়।পুরুষরা বরাবরই বলে থাকেন মেয়ে মানুষ বারো হাত কাপড়েও লেংটা।মেয়ে মানুষ উড়বে ছাই,....গুণ গাই।এটি নারীর বিপর্যয়।
প্রথম জীবনে পিতা, দ্বিতীয় জীবনে পতি,তৃতীয় জীবনে পুত্র।ফলে নারী সকলের কর্তা।এখানে নারী সমান সমান ফলে সকলের কর্তাকে সব সময়ই মানসিক এবং শারিরীকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।বছরের পর বছর নারীকে সন্তান জন্ম দেয়া,প্রত্যেক মাসে রজঃ নিবৃত্তি হয় দীর্ঘ সময় ধরে এদিকে পুরুষের কোনো খেয়ালই নেই।সেটাকে যদি সমাজ বুঝতে না পারে,তাহলে আগামী দিনে পরিবার,সমাজ,দেশ, রাষ্ট্র কীভাবে এগোবে।

রাষ্ট্র কিন্তু আসলে মনহীন একটা যন্ত্র।একটা হেডলেস ক্রিচার।সে সবাইকে গ্রাস করতে চায়।মাথার চিবিয়ে ফেলতে চায়।নষ্ট করতে চায়।সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি মেয়ে দাঁড়ায়।একটি পুরুষ মানুষের স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়ানো ও মেয়ের দাঁড়ান মধ্যে ফারাক আছে।একটি জেলে একজন পুরুষ প্রচন্ড মার খেতে পারেন কিন্তু একটি মেয়েকে তো সেখানে ধর্ষিত হতে হয়।এ-ইটা হচ্ছে রাষ্ট্র। মহেশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী গল্পের শেষে দোপদী মেঝেন শেষে মনে করছেন অর্থাৎ যখন তাকে ধর্ষণ করছে তখন তার পুলিশ অফিসারের উচ্ছ্রিত পুরুষাঙ্গ সমেত গোটা শরীরটাকে নিজের গভীরে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতে বাধ্য হয়ে,পুরুষাঙ্গটিকে চলমান পিস্টন ভাবতে শুরু করে ভয়ানক যন্ত্রণা ও ব্যথার ভেতর। এখানে একটি রাষ্ট্র কীভাবে নারীর শরীর দখল করে।এর পর মীনাক্ষী সেনের গল্প,এর পর জয়া গোয়ালা,নারী এবং তার স্বকীয়তা, স্বাধীনতা এইটা যদি তার পুরুষের সহমর্মিতার,বন্ধুতার সব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁরা এগুচ্ছেন ,নারী ক্রমশঃ ক্রমশঃ রিভোল্ট করবে।তাকে পিঞ্জরে রাখা যাবে না।পিঞ্জরে বসিয়া সুখ হয়ে সে কথা বলবে না।এর জন্য কিন্তু দায়ী থাকবে পুরুষ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

অর্থাৎ মেয়ে মানুষ যে একটা ইমপর্টেন্ট পার্সন তাকে যে গুরুত্ব দিতে হয় সেইটাই শেখানো হয় না বেশিরভাগ পরিবারে।ঘরে যেকোনো কথা বললে মেয়ে শুনতে চাইলে বা বলতে চাইলে তাকে সব সময়ই বলা হয় এই তুমি মেয়েছেলে সব কথার মধ্যে তুমি কথা বলছ কেন।মনে হয় মেয়েমানুষ যেন মানুষই নন তাই এই বিষয়ে ঘর থেকেই শিক্ষা দেয়া দরকার। সেটা একমাত্র হতে পারে নারী জাগরণ এবং সাহিত্যের যে মহানুভব খেলা তার মধ্য দিয়ে হতে পারে।
তবে ত্রিপুরার সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে আলদা তার কারণ ত্রিপুরার ভৌগোলিক যে অবস্থান, যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক যে পরিবেশ, যেভাবে আর্মি এবং রাষ্ট্র অত্যাচারের থাবা নামিয়েছে সেটা বাংলায় কিছুটা হয়েছে হয়তো কিন্তু ত্রিপুরায় একটি পর্যায়ে ভীষণভাবে হয়েছে।ফলে সেখানকার নারী লেখকদের লেখা আলাদা তো হবেই। স্বতন্ত্র উচ্চারণ স্বাভাবিক ভাবেই হবে।এবং সেই স্বতন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়েই কিন্তু তাঁরা এগুচ্ছেন। এবং এগুতে এগুতে অর্জন করছেন একটা স্বাধীনতা।সেই স্বাধীনতার পতাকা- সংগ্রামের নিশান,তাঁরা নিজেদের স্বোপার্জিত ভূমিতে প্রোথিত করেছেন।

জীবনকে অন্তঃস্থল থেকে দেখার মানস-চক্ষু ও শক্তিশালী কলমের লেখিকা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবন প্রারম্ভেই সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখেছিলেন।তাঁর কথায় ঐশ্বরিক প্রেমের কাহিনি নয় ছিল সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ,হাসি কান্নার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। লেখক মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ওঠে এসেছে নারীর সমকালীন সমাজের নানা দ্বন্দ্ব, জটিলতা,অপরিনত প্রেম,অবৈধ প্রেম ও নানা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ। তিনি উপন্যাসে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

মীনাক্ষী সেনের 'জেলের ভেতর জেল' উপন্যাসটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি 'পাগলাবাড়ি' ও দ্বিতীয়টি 'হাজতি নম্বর মেয়াদী নম্বর।' পাগলাবাড়ি পর্বটি চৌদ্দটি কাহিনির মাধ্যমে তোলে ধরেছেন লেখক।
মা কাহিনিতে মা'এর নাম মীরা।মীরা বদ্ধ পাগল।তাই তাকে জেলে ঢুকিয়ে চেন দিয়ে বেধে রাখা হত।কিছুদিন পর তার গর্ভে মানব শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠছিল।তাকে পুলিশ প্রথমে দু রাত থানায় রাখে।তারপর স্থানীয় জেল ঘুরে পাগলবাড়িতে।সে কোথাও ধর্ষিত হয়েছে - হয় থানায় নয় তো পথে।পিতার ধারণা পুলিশই তাকে ধর্ষণ করেছে।পাগলবাড়িতে কয়েকমাস থাকার পর সুস্থ হয়ে ওঠে - জ্ঞান ফিরে পায়।তখন সে সাত মাসের গর্ভবতী। সে ঠিক সময়ে সজ্ঞানে শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছে।শিশুর পিতৃ পরিচয় জানা নেই।সে কুমারী মা।লেখকের বর্ণনায়- ' মায়ের চেয়েও ভয়াবহ তার চেহারা।হাড়গুলো অপুষ্টির ফলে সরু-সরু।এক ফোঁটা মেদ তো নয়ই,কোনো মাংসও নেই শরীরে। মনে হয়; শীর্ণ হাড়ে আলগাভাবে যেন জড়ানো আছে গায়ের চামড়া।'
কুমারী-মা মীরার কঠোর সংগ্রাম শুরু হয় পরম ধন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার।সন্তানের জন্য কোন আহার জেল কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করে নি।কারণ সে হল ' না- বন্দি শিশু।' স্বেচ্ছায় তার মা জেলে রেখেছে।না বন্দী,না অপরাধী শিশুর মায়েরা সর্বদা ক্ষমতাধর অত্যাচারীদের পায়ে পড়ে থাকে।হাত কচলে,তোষামোদ করে,পা টিপে,পিঠ চুলকে,শরীর দিয়ে- সর্বস্বান্ত হয়।
'সেই নীল নীলিমা ও একজন ওয়ার্ডার' কাহিনিতে রয়েছে রূপ লাবণ্যে পূর্ণ অসামান্য সুন্দরী নীলিমার স্থান হল ডিগ্রি ঘরে।ডিগ্রিঘর হল শাস্তি ঘর। নীলিমা অনাথ।ছোটো বেলায় মা বাবা মারা যাবার পর এক অভিজাত -ধনী দম্পতি নিজ সন্তানের মতো নীলিমাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে,লেখাপড়া শিখিয়ে লালন পালন করে। বয়ঃসন্ধিকালে নীলিমা জেনে যায় সে হিন্দু ও অনাথ। মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব সে লড়াই করে একদিন ঘরে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।নারীমাংস লোলুপ শ্বাপদের হাতে পড়ে ধর্ষিত হয়।তারপর হাত বদল হতে হতে চলে আসে পতিতা পল্লীতে।এখানে তার মূল্য চড়া।কাজেই তার বিশ্রাম নেই।এই পতিতা পল্লীতে ঢোকা সহজ কিন্তু বেরনো প্রায় অসম্ভব। অনাথ হলেও নীলিমা রাজনন্দিনীর মতো বেড়ে উঠেছিল।ফলে পতিতা পল্লীতে অসহ্য যন্ত্রণায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে নীলিমা।পতিতাপল্লীর সঙ্গে জেলের নিবিড় যোগাযোগ। চিকিৎসার জন্য পাগলবাড়িতে ঠাঁই হলেও তার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডিগ্রিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।যদি কোনো পাগল তার সোনার অঙ্গে দাগ ফেলে দেয় আঁচড় কামড় দিয়ে।ডিগ্রিতে থাকলেও খাওয়া দাওয়ায়,চিকিৎসা, ওষুপথ্য,কম্বল এসব সে তার মালিকদের তদারকিতে পেয়ে যেত।কারণ সে যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে তার স্থানে যাবে ততই তাদের লাভ।ওরা ওঁৎ পেতে থাকে ঠিকানাহীন পাগলীরা সুস্থ হয়ে ওঠলে আত্মীয় সেজে এদের নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুকিয়ে দেয়।
এর পরের কাহিনি শোভা।অপরূপ সুন্দরী ষোড়শী শোভার সঙ্গে প্রণয়ের অভিনয় করেছিল পাশের বাড়ির এক ধনীর দুলাল।কালীঘাটে নিয়ে বিয়ে করে এবং ভাড়াবাড়িতে রেখে শোভার শরীর ভোগ করে।পরে শোভার পেটে সন্তান এলে ভাড়া বাড়িতে তাকে ফেলে চলে যায়।শোভার পিতা শোভাকে বাড়ি নিয়ে আসে।পরে শোভার এই অবস্থা দেখে মামলা করতে বাধ্য হয় । মামলার ফলে তিনজনই জেলে আসতে বাধ্য হয়।শোভা- তার সন্তান ও সন্তানের জনক।পরে ছেলেটি অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় এবং জেলে পড়ে রইল শোভা।

বেশ কিছুদিন পর জেলের চূড়ান্ত অবহেলার মধ্যেই আবার এক শিশু পুত্রের জন্ম দেয় শোভা।পুত্রসন্তানের জন্মের জন্য শোভা আশায় বুক বাঁধে এবার নিশ্চয়ই স্বামী ও শ্বশুর তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।কিন্তু তা হয় নি।তাঁর সন্তান নিয়ে স্বামীর সংশয়।শোভা আদালতে শুনেছে সন্তানের রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত হবে সন্তানের পিতৃত্ব।কিছুদিন পর হাসপাতালের ভাঙা জং ধরা উন্মুক্ত লোহার খাটে কয়েকদিন কাটিয়ে শোভার শিশুপুত্রটি মারা যায়।নানা কুৎসিত গালাগালি করে শোকাতুরা শোভাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নোংরা অস্বাস্থ্যকর হাজতি নম্বরে।সন্তান-শোক ও জীবন যন্ত্রণা শোভাকে বিধ্বস্ত করে তুলে। জেলে এমন রটনাও ছিল যে শোভাই তার আত্মজাকে খুন করেছে।সদ্যোজাত পুত্রের মৃত্যুতে শোভার সমস্ত আশাই শেষ।

শোভার দেড় বছরের জেল।কোনোদিন মেয়াদি নম্বরের দিদিদের সঙ্গে কথা হয় নি।একরাতে মীরা,আরতিরা খুব মারধর করে শোভাকে।পরদিন জেলের দিদিরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মারধরের কারণ জানতে চাইল।শোভা উত্তরে জানায় হাজতি নম্বরের এক বন্দিনী শোভার বান্ধবী। তাকে শোভা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিল। শোভা লেখাপড়া জানতো- হাতের লেখা যেহেতু শোভার সুন্দর। জেলখানার ভেতর এসব চলত।প্রেমপত্র লেখার পুরুষ চরিত্র মেটরা।মেট অর্থাৎ সাজা পাওয়া পুরুষ বন্দীরা নানা কাজের জন্য মহিলা ওয়ার্ডে ঢোকার অনুমতি পেত।যেমন- দুজন বন্দিনী মিলে এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি তৈরি হয়।এর মধ্যে মীরা একজন।সেই চিঠি গিয়ে পড়ে মীরার হাতে।হাতের লেখা যেহেতু শোভার তাই যত আক্রোশ তার ওপর।শোভা সেই মেটকে চেনেও না।সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। মীরা শোভাকে শাসিয়ে ডিগ্রি ঘরে ঢুকিয়েছে।অবশেষে শোভা জেলারের নির্দেশে নিরপরাধ কিশোরী শোভাকে ডিগ্রি থেকে মুক্ত করা হয়।অথচ আইনের আশ্রয়ে থেকে শোভাকে চূড়ান্ত গঞ্জনা, অত্যাচার সইতে হয়েছে।মাতৃত্ব নিয়ে নানা কদর্য-প্রশ্ন।আত্মজকে হারাতে হয়েছে।তার স্বামী বিয়ে করেছে।সন্তান হয়েছে।এতোসব মানসিক আঘাত সইতে না পেরে স্বাভাবিক ভাবেই শোভা পাগল হল।
হাওয়াবিবির কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই হাওয়াবিবি কৃষক দম্পতির একমাত্র বেঁচে থাকা সন্তান। অত্যন্ত আদরে বেড়ে ওঠা তার। তখন তাকে বিয়ে দেবার জন্য এক রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া গেল।হাওয়ার বাবা জায়গাজমি বিক্রি করে ধারদেনা করে তেরো বছরের আদরের হাওয়াকে বড় লোকের বাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য।হাওয়া কুরূপা এই অজুহাতে তার বর তাকে নির্যাতন শুরু করে।শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতে তাকে বউ ছেলের মন ভরাতে পারছে না।দোষ হাওয়ারই।কিছুদিন পর হাওয়া শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে আসে।কন্যার এই অবস্থা দেখে মা -বাবাও অসুস্থ হয়ে যায়। হাওয়া বাবা মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।পাশেই ফুপুর বাড়ি।ফুপুতো ভাইয়েরা ও ফুপু তাদের দেখাশোনা ও খোঁজ খবর নিত।কিছুদি পর উভয় বাড়ির ইচ্ছায় ফুপুতো ভাইয়ের সঙ্গে হাওয়াবিবির বিয়ে হয়।হাওয়ার দিন সুখে কাটতে লাগলো শরীরে স্বাস্থ্য ও লাবণ্যের জোয়ার এলো।ঠিক তখনই লম্পট প্রথম স্বামী রূপ লাবণ্যে ভরপুর হাওয়ার দিকে কু-নজর দেয়। হাওয়াকে একদিন একা পেয়ে বলাৎকার করার চেষ্টা করে।হাওয়া সে কথা স্বামী ও দেবরকে জানালে তারা সেই লম্পটকে হত্যা করে। তিন জন জেলে যায়।হাওয়া আর জামিন পায় নি।
দুই নারী কাহিনির নায়িকা শিবানীদি।শিবানীদির ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়েছিল- আর দশজন মেয়ের মতোই।প্রেমে প্রতারণা, অবৈধ সহবাস, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর অস্বীকার হওয়ার পর অস্বীকার করা ইত্যাদি। শিবানী অত্যন্ত দরিদ্র-ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে।রোগা-পাতলা চেহারা।আকর্ষণীয় তেমন কিছু ছিল না।তবে বয়সের স্বভাবে যৌবন এসেছিল এবং এক অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটা ক্রমে দৈহিক সম্পর্কে পরিণত হয়।শিবানী গর্ভবতী হয়।পাড়ার লোকজন শিবানীর পক্ষে ছিল।ওরা চাপ দেয় ছেলের বাড়িতে।কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে অস্বীকৃত হয়।

শিবানী ছেলেটিকে খুব ভালোবাসত এবং জানত সেই তার স্বামী। অভিযোগ ছিল ছেলেটির বাবার ওপর।বাবার অসম্মতি ছিল। শিবানীর বাবাও তাকে আর বাড়িতে স্থান দেয় নি।ফলে জেলখানার নিরাপদ আশ্রয়ে তাকে চলে যেতে হয়। রুগ্ন স্বাস্থ্য শরীরে আরেকটি জীবন বড় হতে থাকে শিবানীর ভেতর সবার আশঙ্কার মধ্যে সে শিশুপুত্রের জন্ম দিল। ঔষধ-পত্রের যোগান নেই,কীকরে সে সন্তানকে বাঁচাবে।অনেক কষ্টে শিশুর জীবন রক্ষা করে।বাচ্চাটিও দুর্ভাগা, কারণ শিবানীর বুকে দুধ না থাকায় সে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে।বিচারের দিন শিক্ষক তার ছেলে ও স্ত্রীকে অস্বীকার করল। সে তাদের চেনেই না।হাকিম রক্ত পরীক্ষার কথা বলল।প্রকৃত বাবা কে তা প্রমাণের জন্য কিন্তু শিবানীর স্পষ্ট কথা 'আমার ছেলেকে বাঁচাতে হবে।এ ছেলে শুধু আমার।' সে আর কোনোদিন তার পিতৃত্ব দাবী করতে পারবে না।অর্থাৎ মনে প্রাণে শিবানী তাকে ত্যাগ করেছে।
এক্ষেত্রে শিবানী অন্যান্য মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।অন্যান্য মেয়েরা শত প্রবঞ্চনার পরেও আবার স্বামীর ঘরে যেতে বা স্বামীকে নিয়ে ঘর করতে চায়।কিন্তু জেলখানা থেকে বেরিয়ে তার শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবে শিবানী?ঠিক এই সময় আরেক নারী তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।নবদ্বীপের এক মাসী এসে প্রস্তাব দিল তার বাড়ি যেতে একজন স্ত্রী লোকের অভাবে তার সংসারটি ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে শিবানী রাজি হয়ে গেল।শীর্ণ,উপোসী,মলিন, দুর্বল শরীর, কিন্তু মন প্রচণ্ড শক্তিশালী, জেলখানার সবাই শিবানীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু শিবানীর বুকে অসীম সাহস।প্রতারক প্রেমিকের দ্বারা ধাক্কা খেয়ে জীবনের কঠিন পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ভালোবাসার কাহিনিতে লেখক মেয়েদের প্রেমের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।একটি মেয়ে বিয়ে করেছে, তার বিয়ের বয়স হয় নি।এদিকে সে অন্তঃসত্ত্বা। বাবা তাকে জেদ মেটানোর জন্য একটা হোমে রেখে দেন - যাতে সে তার ভালোবাসার পাত্রকে ভুলে যায়।মেয়েটি হোমে সন্তানের জন্ম দেয়। ছাড়া পেয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়।মেয়েটি নিজে নানা সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজ আত্মমর্যাদা লাভ করে।
রীতা নামে একটি মেয়েকে ওর মা লাভ কেসে ফাঁসিয়ে জেলবন্দী করেছিল।মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল গৃহ শিক্ষকের বিরুদ্ধে। মায়ের হীন বেশ্যাবৃত্তিতে রীতার সহমত ছিল না।এই ছিল তার অপরাধ।
হাজতি নম্বর কাহিনিতে রয়েছে বিচারাধীন বন্দীদের থাকার কথা।কিন্তু বাস্তবে ঐ ঘরে সাজা পাওয়া মেয়াদি এবং নিরপরাধ বন্দিনীরা থাকত।শিশুরা,না-অপরাধী পাগলরাও থাকত।হাজতি নম্বরের ভিড় দিনে দিনে বেড়েই চলছিল।ফলে আয়তন তো আর বাড়ে নি।শুলে একজনের পা অপরজনের গায়ে লাগে।হাসি, কান্না, ঝগড়া গল্প সবই চলতে থাকে সমান তালে।হাজতি নম্বরের এক মেয়ে শিখা।আর দাপটে বন্দিনীদের অবস্থা কাহিল।সে ছিল সকলের ত্রাস।এ হেন কাজ নেই যে সে পারে না।অশ্লীল ভাষায় গালাগাল-মারপিট,সবই সে অবলীলায় করে যেত।
শিখার জেলে আসার কারণ সে ছিল গরীবের মেয়ে- তার স্বামী শ্রমিক। কারখানার মালিকের ছেলের সঙ্গে শিখা পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর তাদের টাকা পয়সা ফুরিয়ে যায়।তারপর বাঁচার তাগিদে শুরু করে জালিয়াতি।পরে পুলিশের হাতে দুজনেই ধরা পড়ে।ছেলেটি অবশ্য জামিনে বাড়ি চলে যায়।তখন স্বামী তাকে ত্যাগ করে। শিখার আর কেউ নেই খোঁজ খবর করার।কাজেই তার আর জামিন হয় নি।সে সহজেই মেট্রনের খুব কাছের লোক হয়ে গেল।শিখা প্রধান মেট হয়ে ওঠে।সে আচারে ব্যবহারে যেমন ব্যাতিক্রম তেমনি পোশাক -আশাকেও উদ্ভট। শুধু হাত কাটা ব্লাউজ আর সায়া পড়ে ঘুরে বেড়াত।শিখার নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য শিখার পুরুষ সঙ্গীর অভাব হয় না।তার আবার মেয়ে সঙ্গীও চাই।মনের চাহিদা পূরণ না হলে নানাভাবে অত্যাচার চালাত অন্যান্য বন্দীদের ওপর।বিশেষত সন্ধ্যার পর জেলখানার মৃদু আলোতে শিশু, কিশোর-কিশোরী,বৃদ্ধাদের সামনে চলত জৈবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থের প্রয়াস।শুধু শিখা নয় অন্যান্য বন্দিনীরাও এই আচরণে সামিল হত।
জেলের ভেতর জেল উপন্যাসে একটি জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডের বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের ছবি চিত্রিত করা হয়েছে।

জয়া গোয়ালার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'এই সীমান্তে।' এই কাহিনির জীবন স্রোত চা বাগানের খেটে খাওয়া সাধারণ নারী পুরুষ। চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি নারীদের শোষণ, অত্যাচার ও নারীর নিরাপত্তাহীনতার ছবি দিয়ে রচিত হয়েছে এই আখ্যান।কাহিনির নায়ক যদু।সমগ্র উপন্যাসে টুকরো টুকরো গল্প ফুটে ওঠেছে।নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সব পেছনে ফেলে যদুরা কীভাবে বাগানের কুলি হয়ে ওঠে তার ইতিহাস এখানে ফুটে ওঠেছে। সমাজের মহাজনেরা সুদের ব্যবসায় কীভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে তার গল্পও রয়েছে।যদুর মেয়ে চম্পা কাঁচা কুয়োয় পড়ে ঠ্যাং ভাঙে।সেই মেয়েকে সারিয়ে তুলতেই নকুল সাহার দ্বারস্থ হয়।আর সেই সুযোগে তার অসহায়তাকে পুঁজি করেই মহাজনের গদি মজবুত করে। পাঠক ভারাক্রান্ত হয় লীলার দেহ বিনিময়ের অধ্যায়ে।ক্ষুধার কাছে সতীত্ব তার অর্থ হারায়।দেহ বিক্রি করে স্বামী সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয় লীলা।পরিণতিতে লীলার গর্ভসঞ্চার। পরে জড়িবুটি দিয়ে খালাস পাবার চেষ্টা করে।এবং শেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয় লীলা।লীলার শরীর বিক্রির ঘটনার শিউরে ওঠে যদু।মনে পড়ে চম্পার মুখ।চম্পার জীবনের অন্তিম পরিণতি যদি লীলার মতই হয়,যদু কি পারবে তা রুখতে? ভীত হয় দরিদ্র পিতা।
জয়া গোয়ালা সমাজের ক্ষত,সমাজের ব্যাধির ছবি,প্রান্তিক মানুষের জীবন যুদ্ধের ছবি আঁকে বিশ্বস্তভাবে।একদিকে গরিবী অপরদিকে জীবনে টিকে থাকার লড়াই,'এই সীমান্তের' শরীর জুড়ে।
'তবু মাদল বাজে' উপন্যাসে জয়া গোয়ালা সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেছেন। প্রান্তিকমানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জীবন যুদ্ধ এই উপন্যাসের বিষয় বস্তু নয়।সমাজের বেআব্রু কুসংস্কারের দগদগে ঘা'কে কীভাবে শুধুমাত্র নারীদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন লেখক।
উপন্যাসের শুরুতেই আঁতুড় ঘরে ডমরুর বউ ফুলির এক ভয়ানক মৃত্যু দৃশ্য। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরেছে ফুলির শরীর থেকে।ধাই ফুলমতী ফুলির প্রসব করালেও প্রসব সম্পন্ন হয় নি।ফুলির পাগলের মতো অবস্থা।ডাকা হল ডমরু ওঝাকে।ফুলিদের অগাধ বিশ্বাস ওঝার ওপর।কিন্তু তা যে সম্পুর্ণ কুসংস্কার। ফলে ফুলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।এখানে যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাব তা জয়া গোয়ালা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
তারপর উন্মোচিত হল ধাই ফুলমতির ডাইনি হবার গল্প।ওঝার এত সব ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র তো বিফলে যাবার কথা নয়,তাহলে হলটা কী? তবে ধাই- এরই কীর্তি। এই ধাই আস্তএকটা ডাইনি।কিন্তু নিরক্ষর ডমরু কিছুতেই বিশ্বাস করে না ফুলমতী ডাইনী।তার শুধু মনে পড়ে আতুড় ঘরে ফুলিকে প্রাণ ঢেলে সেবা করেছিল ফুলমতী।'তবু মাদল বাজে'এই প্রান্তিক মানুষদের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক জেহাদ।
দিপালী ভট্টাচার্যের 'বিদগ্ধা ধরিত্রী' উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। তিনি লিখেছেন-' আমার ঠাকুমাকে আমার দাদু পাঁচকুড়ি পাঁচটাকা দিয়ে এনেছিল।ঠাকুরমার মুখেই শুনেছি এই কথা।যার যত কন্যা সন্তান থাকবে, সে তত বড় ব্যবসায়ী।আজকাল যুগ পাল্টেছে। এখন রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। এ কোন ব্যবস্যা।পুত্র বিক্রয় না ব্যবসায় মালিক বদল। স্বামীর ক্ষুধা মেটানোই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
পুরুষ - মানুষের অনেক রূপ। সে কখনো স্বামী, কখনো পুত্র, কখনো পিতা, কখনো বন্ধু।তবে যাই হোক না কেন প্রকৃত পক্ষে পুরুষজাতি নারীকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। সে রাজা থেকে শুরু করে সবাই।সত্যি কথা হল আমাদের সমাজের নিম্ন মানসিকতা, শিক্ষার অভাব প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত। প্রকৃত পক্ষে উপন্যাসটি আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে দেশভাগের ফলে নারীদের অসহায়তা নিয়ে।সুরেশ্বর, সৌদামিনী ও কৌমুদিনীর একদিকে দেশ হারা অপরদিকে শেকড় ছেঁড়ার বেদনা,অসহায়ত্ব তাকে পশুতে পরিণত করে।এর মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা দাম্ভিক পৌরুষত্ব।ভারতী নাম্নী নামে এক সাধারণ মেয়ে আর পাঁচজন নারীর মতোই স্বামীর অবহেলা ও অত্যাচারে ওষ্ঠাগত প্রাণ। স্বামী নামক ব্যক্তিটির কাছে সে চিরকাল অবহেলিত। উপন্যাসিকের উদ্দেশ্যই হল মেয়েদের অসহায়ত্ব বর্ণনা করা।
'যোগ্য কন্যা' মঞ্জুরাণী বিশ্বাসের লেখা এক অভিনব উপন্যাস। কাহিনির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই কমলনাথ ও কাকলি বাড়ৈ- এর সন্তান হিসেবে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হল। প্রত্যেক পরিবারের চির কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান কিন্তু কমল ও কাকলী তাদের কন্যা অর্পিতাকে নিয়েই সুখী। ক্রমে অর্পিতার বুদ্ধির বিকাশ ও প্রতিভার স্ফূরণ ও চিন্তাশীলতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল। অর্পিতা এন সি সি করত।সে জানে এন সি সি করা মেয়েরা নির্ভীক হয়।আর শারীরিক গঠন হয় অটুট। এন সি সি করা মেয়ের উপর কোন পুরুষ অত্যাচারের কথা ভাবতেই পারে না। দশম,দ্বাদশ পাশ করে এম বি বি পড়ে চাকরি পায়।ফলে সে বিয়ে করে মৃণাল নামে এক যুবককে।বিয়ের সময় সে শর্ত রাখে যেগুলো পুরুষতন্ত্রকে সরাসরি নাকিচ করেছে সমাজের প্রতিভূ রূপে।
অর্পিতা সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে নারী স্বাধীনতার বীজ বহন করেছে। প্রথাগত হিন্দু ধর্মের কৌলিণ্য প্রথার বিরুদ্ধে সে সোচ্চার হয়ে নিজ শর্তে বিবাহ করেছে। অর্পিতা ও মৃণাল আর পাঁচটা দম্পতির মতো একঘেয়ে জীবনযাপন করেনি।তারা নিজেদের আত্মনিয়োজিত করেছে সমাজের নানা কাজে।অর্পিতা ও মৃণালের সুখী সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।এই আনন্দকে তারা খুশির উৎসবে পরিনত করে।সমগ্র উপন্যাসটিতে রয়েছে নারীমুক্তির বীজ।মেয়েদের রক্ষা করার জন্য অর্পিতা একটি সামাজিক সংস্থা গঠন করে।নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে। তাদের কাজ বিভিন্ন ঘটনা পুলিশের গোচরে নিয়ে আসা।পূজা সেন হত্যা মামলা,রেবা দাশের ওপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ এর মতো ঘটনাকে পুলিশের প্রত্যক্ষ গোচরে আনে।শুধু তাই নয় নারীর ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে মৌন মিছিলের মাধ্যমে সমাজে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় অর্পিতার নেতৃত্বে।
স্বল্পায়তন এই উপন্যাসটিতে লেখক সুকৌশলে নারীবাদী ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।আজও রাষ্ট্রে,সমাজে,পরিবারে ও ঘরে নারীরা যে কত অবহেলিত ও অত্যাচারিত তার অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে এই উপন্যাসে।নারীর কলমে নারীর সামাজিক অবস্থানের নিখুঁত প্রতিবিম্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে আলোচ্য আখ্যানে।মল্লিকা সেনগুপ্ত, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসুর মতো মহিলা কথাকারদের মতো মঞ্জুরাণী বিশ্বাস- এর উপন্যাসেও ফুটে ওঠেছে নারীদের মুক্তির প্রয়াস, তাদের ক্ষমতায়ন এবং স্বাধিকার অর্জনের লড়াই। ত্রিপুরার বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে মহিলা কথাকার হিসেবে তার অভিনবত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টগর ভট্টাচার্যের 'খোলা জানালায়' আখানে প্রধানত নারী জীবনের নানা সামাজিক সমস্যা ও নারীর জন্মগত কিছু ত্রুটির কথা তোলে ধরা হয়েছে।একজন নারী তার পারিবারিক, সামাজিক এবং শারিরীক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কীভাবে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে তাই উপন্যাসে ফুটে ওঠেছে। মা হারা অরুণিমা সংসারে তিন ভাই আর বাবা থাকলেও সকলের উদাসীনতায় সে ছোটোবেলা থেকেই নিঃসঙ্গ।এক নিঃসন্তান মাসীর তত্ত্বাবধানে সে বড় হয়।অনাদর অবহেলায় সে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে থাকে।সে বুঝে নেয় বেঁচে থাকতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে,নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।স্বাধীনচেতা অরুণিমা প্রতিষ্ঠিত বাড়ির ছেলে দীপ্তনুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও সে কখনো দীপ্তনুর উপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় নি।অরুণিমার জীবনে অনেক সমস্যা এসেছে, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সে অন্যের সাহায্যও পেয়েছে।একটা সময় সে কলকাতায় ত্রিপুরা ভবনে ক্লার্ক কাম রিসেপশনিস্ট এর চাকরি পায়।কর্ম জীবনে অরুণিমা একটি হোস্টেলে ছিল।সেখানের জীবনও ছিল দুর্বিষহ। হোস্টেলে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নারীদের সঙ্গে অবস্থানকালে তাকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।একাধিকবার মুখোমুখি হতে হয়েছে অশ্লীল মন্তব্য ও ইঙ্গিতের। কখনো আবার পুরুষের লোভ লালসায়ও নিগৃহীত হতে হয়েছে।প্রতি পদে পদে হোঁচট খেয়েও সে পথ চলা বন্ধ করেনি।এমনকি উচ্চপদস্থ ডাক্তারের আহবানে সারা দেয়নি অরুণিমা।সে ব্যক্তিত্বময়ী,স্বতন্ত্র। দীপ্তনুর জন্য সে ভালোবাসাকে পোষে রাখে অন্তরে।
তবে অরুণিমার কিছু শারিরীক ত্রুটি ছিল যার জন্য সে মা হবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ছিল।ডা মিত্রের কাছ থেকে নিজের শারিরীক অক্ষমতার কথা জেনেও নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করেছে।নিজের অসহায়তার জন্য অন্যের দেওয়া সুযোগের অসৎ ব্যবহার জরে সে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় নি।গ্রহণ করেনি ডা মিত্রের দেওয়া বিবাহের প্রস্তাব। পাশাপাশি দীপ্তনুকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও পিতা হবার সুখ দিতে অক্ষম বকে তাকে বিবাহ না করার সীদ্ধান্ত নেয়।সমগ্র উপন্যাসে অরুণিমাকে কোথাও অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হতে দেখা যায় নি।নিজের সচেতনতাই অরুণিমাকে জীবনের সঠিক পথ বেছে নিতে সাহায্য করেছে।
উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে বার বার সুচিত্রা ভট্টাচার্যের 'আমি রাইকিশোরী' উপন্যাসটির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী।দুটি উপন্যাসের মধ্যেই রয়েছে নারীর একক পথ চলা,তার উত্তরণের কাহিনি। অন্দরমহলের সকল সংস্কারের বাধা অতিক্রম করে রাইকিশোরী পেয়েছিল তার আত্মোপলব্ধির নিজস্ব জমি।অরুণিমাও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল।দুজনেই ঘটনাক্রমে পুরুষের লালসার শিকার হলেও দুজনেই সততা আর প্রচেষ্টার জোরে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিল।এখানেই উপন্যাসিকের সার্থকতা।

আসলে আগুনের ডালপালারা তো পুড়তে চায়। পোড়াতে চায় না।তারা পুড়তেই চায়।সারাজীবন পুড়তে পুড়তে তাদের গভীর থেকে ওঠে আসে একধরনের দীর্ঘশ্বাস।একধরনের প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস।যে দীর্ঘশ্বাসের কথা সমাজের কার্পেটের নীচে,সমাজের জুতোর তলায় সমাজের টেবিলের নীচে একটু একটু করে চাপা পড়ে যায়। নারীর সৌন্দর্য, আসলে নারীর সৌন্দর্যে পুরুষ আপাত মুগ্ধ থাকে কিন্তু নারীর যে বিদ্যাবত্তা, যে সারস্বত চেতনা সেইটাকে কিন্তু অন্যভাবে বাঁচতে দিতে হয়। মানে যে গান গায়,পড়ে,যে লেখা,ছবি আঁকে,সিনেমা বানায়,নাটক লিখে,নাটক পরিচালনা করে,নাটক বানায়,যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলে এদের কথা কিন্তু সবার আগে আসা উচিৎ। যে গ্রামের মেয়ে ফসল ফলায়,যে কিষাণী ফসল ফলান।একা কৃষক ফসল ফলান না,কিশানীও ফসল ফলান।তিনি জমিকে উর্বর করতে চান।শ্রমিক মহল্লায় যারা নারী কর্মী তারা দায়বদ্ধভাবে শুধু স্বামীটিকেই আড়াল করেন না,ঘরের মধ্যে যাতে পরিচালন ব্যবস্থা ঠিক থাকে,সেই নিয়েও তার মাথা ব্যথার অন্ত নেই।নারী তার দায়িত্ব পালন করেও নিজের গায়ের যে আগুনের যে শুদ্ধতা সেই শুদ্ধতা,সেই শুদ্ধতাকে ঘিরে যে সারস্বত চেতনা,সেই চেতনাকে থেকে তিনি সমাজকে শুদ্ধ করতে চান করতে করতে নিজে জ্বলে যান নীরবে, নিভৃতে,একা।তার খবর কেউ রাখে না,রাখতে চায় না।দু'একজন সংবেদনশীল মানুষ হয়তো মনে করেন যে নারীর এই কষ্ট, এই যাতনা পাওয়া উচিৎ।

আখ্যানের বেশ কয়েকটি শব্দের উচ্চারণ আমরা করলাম।ত্রিপুরার নারী লেখকরা যে লেখা লিখেছেন, লিখছেন এবং আগামী দিনে লিখবেন তার একটা সংক্ষিপ্ত পুনরুদ্ধার করতে আমরা চেষ্টা করা হল এই গ্রন্থে।এই রূপরেখা সর্বাত্মক সম্পূর্ণ তো নয়ই।কিন্তু তার মধ্যে একটা সম্পূর্ণতার যাত্রা রয়েছে। দীপালি ভট্টাচার্য বা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় দুজন দু'প্রান্তের লেখক।তবু তাদের লেখার মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে।তাদের যে আখ্যান যাত্রা প্রত্যেকটি আলাদা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আখ্যানযাত্রা বলতে থাকে আমাদের সামনে।আমরা এই আখ্যানগুলোর চরিত্র নির্মাণ করার বলেছি, বলেছি সব চরিত্রদের যাত্রাপথের কথা,বলেছি দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত মানুষের যাত্রার ফলাফল ও ফসল সংকেত।আমরা জানি নারীই ফসল ফলান এবং তিনি ফসল তোলেন।ফলে এই যে লেখকরা আছেন,সেই নারী লেখকরা তাদের নিজস্ব উচ্চারণে, নিজস্ব মনোভূমির যে শাব্দিক কাঠামো সেইটাকে এক সম্পূর্ণত নতুনতর আঙ্গিকে যা পুরুষরা দেখতে পান না, দেখতে চান না বা দেখাতে চেন না,নারী তার নিজস্ব চোখ দিয়ে সেই ভুবনটিকে বারবার আবিষ্কার করে, ফলে যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়, তার গভীর প্রত্যন্ত যাতনায় যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়,ভয়ানক কষ্ট এবং বিভোর মনস্তাপের মধ্যে সেই আগুনের ডালপালাই চলে যায় সূর্য শিকারে, সূর্য ছিনিয়ে আনতে।আমরা সূর্য শিকার এবং আগুনের ডালপালা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার শেষ লগ্নে,লেখা যখন অন্তিম চরণে এসে পৌঁছেছে তখন আবারও স্মরণ করি ত্রিপুরার এইসব আখ্যানকারদের যারা তাদের আগুনের ডালপালাকে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর করে খুঁজে নিতে চেয়েছেন সম্পূর্ণত অন্য এক সূর্য ভুবনকে।সেই সূর্য ভুবনের কথা,সূর্য শিকারের কতা,সূর্য সন্ধানের কথা সূর্য আহবানের কথা আমরা বারবার বলে গেলাম এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে। এই আলোচনা একেবারেই সম্পূর্ণ নয় কিন্তু অসম্পূর্ণতার যেটুকু সেটুকু একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়, বিভিন্ন ধরনের আখ্যান এবং আখ্যান চর্চার মধ্য দিয়ে যাত্রা কীভাবে আমরা করলাম তার ফলাফলে।আমরা আশা করব আগামী দিনে ত্রিপুরায় যারা নারী লেখকরা আছেন, তাঁরা সমানভাবে সমাজের কথা,সমাজের যে বিচ্যুতি এবং অসংগতি, ভাবনার যে বহিঃপ্রকাশে নানারকম যাতনা এবং কষ্টের যে চিত্র সেই চিত্র তারা তাদের অন্দরমহলের ভাষায় নয় বাহির মহলের ভাষাকেও তোলে ধরবেন কেননা নারী আজ শুধুমাত্র সহনশীল বৃক্ষ নন, তিনি আগুনে ডালপালা সহ তার হাত প্রশস্ত প্রসারিত করে খুঁজে দিচ্ছেন সূর্য এবং সূর্যের ভুবন জয় করছেন আকাশ। পূর্ণ আকাশের চিন্তাই নারীকে ঘিরে করা উচিত, নারী সম্পূর্ণ আকাশ,পূর্ণ আকাশ,সেই পূর্ণ আকাশের যে দিগন্ত নিশ্চিত যাপন সেখানেই সূর্য শিকারের জন্য এগিয়ে এসেছেন আগুনের ডালপালারা। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।