ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক২
গের্টের মতে অবশ্য পড়াশুনার পিছনে এত সময় দেওয়া একেবারে অর্থহীন, যদি কেউ সঙ্গীত নিয়েই ভবিষ্যতে অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করে। তাছাড়া রাত্তিরে তো মানুষের ঘুমানো উচিত। না ঘুমিয়ে পড়াশুনা করা ঠিক কাজ নয়।
“তুমি আবিটুয়োর* দিচ্ছই বা কেন?” গের্ট প্রশ্ন করে। কিন্তু বের্নহার্ড তার বাবার জন্যই স্কুলে পড়াশুনা করছে। তার বাবা তাকে অনুরোধ করেছেন স্কুলে গিয়ে ভালোভাবে পড়াশুনা করবার জন্য। এক্ষেত্রে তার কোনটা ভালো লাগে, সেটা বড় ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, এরকম মনে হতে পারে যে কারো যে বের্নহার্ড অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। সে দুনিয়ার সামনে এটা প্রমাণ করে দিতে চায় যে তার বহুমুখী প্রতিভা আছে। গের্টের স্বভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষাযুক্ত অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে হাসিতামাশা করতে থাকে। অবশ্য তার প্রচুর টাকাকড়ি আছে, গাড়ি আছে, ইনেসের মত বান্ধবী আছে বলেই সে এমন করে, ব্যাপারটা এতখানি সহজ সমীকরণ দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে গের্ট প্রায়শই ভীষণ রকমের তিক্ত আত্মসমালোচনায় ডুবে যায়। কারণ, তার একমাত্র উৎসাহ আছে ছবি আঁকার ব্যাপারে, যেটা সে খুব মন দিয়ে করে এবং অবশ্যই তার প্রতিভাও আছে শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে। কিন্তু তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সেরকম কোনো সহায়তা এই বিশেষ ব্যাপারে সে পায় না; তার বাবা মা চান যে সে একজন নামিদামি পেশাদার হোক। সেইজন্য সে আইনশাস্ত্র পড়বে বলে ঠিক করেছে; যদিও এক অদ্ভুত উদাসিনতা আছে তার এই বিষয়ের প্রতি। খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না সে। ক্লাসে খুব কম দেখা যায় গের্টকে। বরঞ্চ সে আঁকাজোকা করে সময় কাটায়। এই পরিস্থিতিতে এটা খুব অস্বাভাবিক নয় যে গের্ট তার তরুণ বন্ধু বের্নহার্ডের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ নিয়ে শুধু যে উদাসীন, তাই নয়, সে অংশত বের্নহার্ডের সমালোচক। অন্যদিকে সে নিজে শিল্পের অভ্যাস করে গোপনে। ফলে সে সর্বদা সন্দিগ্ধ বোধ করে যে তার এই অভ্যাস আদৌ সঠিক কিনা। অর্থাৎ নিজের প্রতিভার বিষয়ে তার দ্বিধা আছে; নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সে এবং এই ভাবটা সে সবসময় তার বলিষ্ঠ এবং কিছুটা উদ্ধত আচরণের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এমনিতে সে খুবই মিত্রভাবাপন্ন; বের্নহার্ড এবং ইনেস তার কাছের মানুষ। বিশেষত ইনেস অন্য অনেকের চেয়ে গের্টকে বেশি চেনে। তার খিটখিটে মেজাজ, অতি সূক্ষ্ম মেয়েলি ধরনের সংবেদনশীলতা, যার ফলে সে নিজেই বেশি কষ্ট পায়, গের্টের এই ব্যাপারগুলো ইনেস জানে এবং গের্টকে ঠিকভাবে সামলাতেও জানে সে। বের্নহার্ড গের্টকে বেশ পছন্দ করে এবং তাদের এই বন্ধুত্ব তাকে খুশি রাখে। কিন্তু গের্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। গের্ট বের্নহার্ডকে একটু অদ্ভুতভাবে পছন্দ করে। বের্নহার্ডের সৌন্দর্য এবং তারুণ্য তাকে স্পর্শ করে। বের্নহার্ড পাশে থাকলে সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। বের্নহার্ডকে সামনে বসিয়ে তার ছবি আঁকতে ভালবাসে সে। দুনিয়ায় আর কোনো কাজ সে এত ভালবাসে না। প্রতি শনিবার বের্নহার্ড এবং ইনেসকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবার রুটিনটা তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি! প্রথম দিকে গের্টের সঙ্গে বের্নহার্ড শনিবার ডিনারের পর দেখা করতে যেত এবং গের্ট তার ছবি আঁকত। কিন্তু স্থির হয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকাটা তার ভীষণ একঘেয়ে লাগবার পরে সে প্রস্তাব দেয় যে গের্ট তার এখানে আসতে পারে এবং যখন সে পিয়ানো অভ্যেস করবে, তখন ছবি আঁকতে পারে। তাহলে তাদের কারো সময় সেভাবে নষ্ট হবে না। সেই থেকে গের্ট প্রায়ই আসে বের্নহার্ডের কাছে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও গের্টকে বেশ পছন্দ করেন, কারণ সে যথেষ্ট বিচক্ষণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত যুবক। প্রায়ই সে ঠাকুমার আমন্ত্রণে ডিনার খেয়ে তারপর ফেরে।
ছবি আঁকবার সময়ে গের্ট এমন কিছু মন্তব্য করে মাঝে মাঝে, যে বের্নহার্ডের অস্বস্তি হয় একটু একটু। সে প্রায়ই তাকে বলে, ‘বের্শেন, তোমার মাথার গড়নটা ভারি সুন্দর!’ শুনে বের্নহার্ড লজ্জা পায়, চোখমুখ লাল হয়ে যায় তার, চোখ নামায় সে, ভুলভাল পিয়ানোর চাবিতে হাত পড়ে। সেটা লক্ষ্য করে একবার গের্ট উঠে দাঁড়িয়ে, কাছে এসে বের্নহার্ডের মাথাটা ধরে রেখেছিল নিজের দুই হাতে। ‘সুন্দর হওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই’ বলেছিল সে। বের্নহার্ড অন্যদিকে তাকাবার চেষ্টা করছিল। গের্ট তুলে ধরেছিল তার চিবুক। আলতো করে ধীরে ধীরে চুম্বন করেছিল তার ঠোঁটে।
শনিবার কোনও ছবি আঁকার ব্যাপার থাকে না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বের্নহার্ড অপেক্ষা করে কখন এসে গের্ট গাড়ির হর্ন বাজাবে। ঠাকুমা সমানে বলতে থাকে যেন গের্ট ধীরেসুস্থে গাড়ি চালায়, যেন বের্নহার্ড সন্ধ্যাবেলায় বাবা মায়ের কাছে যাবার ট্রেন মিস না করে। বের্নহার্ড প্রতি শনিবার বাবা মায়ের কাছে যায়। এই অভ্যাসটা সে একেবারেই বদলাতে চায় না। যদিও সেটার জন্য গের্টের লং ড্রাইভের আমন্ত্রণ রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে লং ড্রাইভে যেতে না পারার ব্যাপারটাও তার কাছে সুখকর নয়। কারণ, প্রিয়বন্ধুদের সঙ্গে গ্রীষ্মে গ্রামের পথ দিয়ে লং ড্রাইভে যেতে তার খুব ভালো লাগে। বিশাল লিনডেন গাছের নিচে বসে গ্রামের কোনো ছোট সরাইখানায় বসে মহাভোজ, তারপর সরাইয়ের ধবধবে সাদা সদ্য কাচা মাড় দেওয়া চাদরের খসখসে বিছানায় রাতে ঘুমিয়ে ভোরবেলায় জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় এবং আঙিনায় ফোয়ারার জলের শব্দে ঘুম ভেঙে ওঠা… সে এক ভারি সুন্দর অভিজ্ঞতার সঞ্চয়।
কিন্তু এখন আপাতত শনিবারের বিকেলটুকুই তার সম্বল। তার বেশি সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে কাটাতে পারবে না। তারপর সন্ধের মধ্যে গের্ট তাকে শহরে পৌঁছে দেবে যাতে সে স্যুটকেস এবং ফাইল নিয়ে লক্ষ্মীছেলের মত ট্রেন ধরে যেতে পারে বাবা মায়ের কাছে। ‘লক্ষ্মীছেলে’ উপমাটা অবশ্য গের্টের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। তবে অবশ্যই বের্নহার্ডকে বন্ধু হিসেবে সে হালকা ইয়ার্কি করেই থাকে। অতিরিক্ত মাত্রায় উত্যক্ত কিম্বা বিরক্ত করা গের্টের উদ্দেশ্য নয়।
বের্নহার্ড লক্ষ্য করেছে যে গের্ট খুবই সময়ানুবর্তী। একচুল এদিক ওদিক হয় না তার সময়ের। তাকে নিতে এসে সে এত জোরে গাড়ির হর্ন বাজায় যে বের্নহার্ডের ঠাকুমা ঘাবড়ে যান, উদ্বিগ্ন বোধ করেন। সেইজন্য গের্ট আসবার আগে থেকেই তিনি বের্নহার্ডকে তাড়া দিতে থাকেন তৈরি হয়ে নেবার জন্য, বলেন যে বন্ধুদের একদম অপেক্ষা করানো উচিত নয়। বের্নহার্ড সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে সোজা গাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়, কারণ গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু গাড়িতে বসে তার খেয়াল হয় যে ফাইলটা সে ফেলে এসেছে ঘরে। এখনই একদৌড়ে নিয়ে আসবে সে। কিন্তু গের্ট বলে ওঠে,
‘ধুত্তোর, কাজ ছাড়াও মানুষের খুশি থাকা উচিত, বুঝলে হে ফ্যাকাশেমুখো!’ বলে সে বের্নহার্ডের হতাশ মুখচোখের অভিব্যক্তির দিকে পেছনে না তাকিয়েই ধাঁ করে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যায়। ইনেস তার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ভারি সুন্দর হালকা রঙের একটা কোট আর দস্তানা পরেছে সে। তার সামনে ফ্লক। ফ্লকের গলায় বাঁধা বেল্টের প্রান্ত ইনেসের হাতে।
(চলবে)
*আবিটুয়োর –(Abitur) জার্মানির উচ্চবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের প্রধান পরীক্ষা।