প্রচ্ছদ নিবন্ধ - নীলাঞ্জন হাজরা
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
ওরা বলবে না: বাতাস যখন ঝাঁকিয়ে
গিয়েছিল আখরোট গাছটাকে
বরং বলবে: যখন বাড়িরংমিস্তিরি1 মজুরদের পিষে দিয়েছিল।
ওরা বলবে না: যখন বাচ্চাটা
চ্যাপটা পাথরটা দিয়ে ক্ষিপ্র ধারাটায় ব্যাঙবাজি করেছিল
বরং বলবে: যখন বিরাট সব
যুদ্ধের জন্য তৈয়ার হচ্ছিল জমিন।
ওরা বলবে না: যখন মহিলা ঘরে
ঢুকলেন
বরং বলবে: যখন প্রবল
শক্তিধরেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
তবে, ওরা বলবে না: অন্ধকার ছিল দিনকাল
বরং বলবে: কেন নীরব ছিল ওদের
কবিরা?
(অন্ধকার দিনকালে / বের্টোল্ট ব্রেখ্ট2)
‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই
কবিতার3’— শঙ্খ ঘোষের এই আপাত-সরল উচ্চারণ প্রত্যেক কবিকে
অজস্র প্রশ্নসঙ্কুল কঠোর পরীক্ষার মুখে দাঁড় করায়। কবির সত্য কী— তা নিরুপণ সেই পরীক্ষার হয়তোবা প্রথম মৌলিক প্রশ্ন। এই লেখায় আমরা যে প্রশ্নের
উত্তর অনুসন্ধান করব, তা যে-কবির প্রসঙ্গে তিনি জীবনের
গোড়ার দিকেই — ১৯৪০-এর দশকের শুরুতেই বা তারও আগে — তাঁর কবিতার সত্যকে সেই গোত্রের কবিদের স্বরে সামিল করেছিলেন যাঁরা নিজেদের
প্রিয়তমার অঙ্গরূপের প্রাকৃতিক অস্তিত্বের পরম বিষ্ময়ের থেকে মানুষের সজ্ঞানে
সৃষ্ট রাস্তাময় মানুষেরই চাপ চাপ রক্তের সত্যের কথা বলাই শ্রেয়তর ঠাউরে থাকেন—
…অলি-গলি হাট-বাজার বিক্রি হয় দেহের সার
হিঁচড়ে আনা ধুলোর পথে, রক্তস্নানে একাকার
সে দিকেও তো বারংবার দৃষ্টি ফিরে যায় যে আমার, কী-ই বা আমি করতে পারি বলো
হৃদয়হরা রূপ তোমার অটুট তবু চোখ নিরুপায়, কী-ই বা আমি করতে পারি বলো
·
(প্রিয়তমা, আমার কাছে চেয়ো না সেই প্রথম প্রেম আর। মূল কবিতা ‘মুঝসে পহলিসি
মুহব্বৎ মেরি মহবুব না মাঙ্গ’। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়।4)
ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় (১৯১১ – ১৯৮৪)। মুশকিল হল, এমনটা যাঁরা ঠাউরান, প্রায়শই তাঁদের সেই সিদ্ধান্তের
সাংঘাতিক মূল্য দিতে হয়। কতটা মূল্য, তা নির্ভর করে তিনি
কোন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে সে সিদ্ধান্ত নিলেন তার ওপর। পাকিস্তানের কবি
ফয়েজ় কী ভয়ঙ্কর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে নিজের সেই সিদ্ধান্তে অনড়
ছিলেন তার চর্চা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, সে জন্য তাঁকে কারারুদ্ধ হতে হয়েছে একাধিক বার, স্বেচ্ছা নির্বাসনে
দেশ ছাড়তে হয়েছে বারংবার। তাঁর কবিতা মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় সেই সব নির্বাসনের দিন
তাঁর কাছে কারাবাসের থেকেও তিক্ত যন্ত্রণাকাতর ছিল। চিন্তাবিদ এডোয়ার্ড সয়ীদ এ যন্ত্রণাকে
বলেছেন— ‘The crippling sorrow
of estrangement’— বিচ্ছিন্নতাবোধের একেবারে
পঙ্গু করে দেওয়া বিষাদ। বলেছেন ফয়েজ় প্রসঙ্গেই। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জ়িয়া উল
হকের জমানায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে বইরুত শহরে বসবাসকারী ফয়েজ়ের সঙ্গে কবিতাময় এক
সন্ধ্যা কাটিয়ে লিখছেন সয়ীদ, “To see a poet in exile – as
opposed to reading the poetry of exile – is to see exile’s antinomies embodied
and endured with unique intensity.5” কবির সারাটা অস্তিত্ব উপচে ঝরা এক অনির্বচনীয় ‘অ্যান্টিনমি’, ‘বিরোধাভাস’— ‘defiance and loss’, ‘মানছি না’ এবং ‘সব হারানোর’-র বিরোধাভাসী ধারার ঘূর্ণী — ফয়েজ়ের কবিতা, ফয়েজ়ের
জীবনের এক বিরাট অংশ। পাকিস্তানে পোঁতা ছিল তাঁর হৃদয়ের বীজ। দেশ ছেড়ে
বিদেশে গিয়ে পাকাপাকি বসবাসের সুযোগ তাঁর এন্তার ছিল। পাত্তাই দেননি কখনো তেমন
নানা আমন্ত্রনকে।
ফয়েজ় সেই বিরলতম কবিদের একজন যাঁর জীবন আর কবিতা
পরস্পর সম্পৃক্ত। গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতো শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথেরই উচ্চারণ ‘মহাজীবন’ কথাটা যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, ফয়েজ় ঠিক সেই অর্থেই, এমনকী হয়তো গভীরতর অর্থেও এক ‘মহাজীবন’। রবীন্দ্রনাথের মহামেধা ফয়েজ়ের ছিল না অবশ্যই, ফয়েজ় জিনিয়াস ছিলেন না, কিন্তু একদিকে উগ্র
রক্ষণশীল মোল্লাকুল, একদিকে অনন্ত জমির
মালিক কতিপয় সামন্ত, এবং আর একদিকে এই
দুইয়ের মিশ্রণ থেকে উঠে আসা, অথচ প্রায়শই আধুনিক
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও মানুষের ন্যূনতম
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের বিরোধী সামরিক নেতার দল — এই ত্র্যহস্পর্শে
আনখশির শৃঙ্খলিত পাকিস্তানি সমাজে থেকে, সামরিক শাসনের পর
সামরিক শাসনের ভয়াবহ সন্ত্রাসের প্রতিস্পর্ধী যে কাব্যধারা ফয়েজ় তৈরি করেছিলেন তা
শুধুমাত্র কাব্যপারদির্শাতা বা সাহিত্যিক মেধায় অসম্ভব। সে জন্য একদিন প্রতিদিনের
অতি অকাব্যিক কেজো জীবনে যে অটল সততা আর সাহস দরকার হয়, তা গণতন্ত্রের দুধে-ভাতে বড়ো হওয়া ভারতীয়দের পক্ষে কল্পনা করাও মুশকিল। ২০১৪ সাল থেকে আমরা তার
যৎকিঞ্চিত আঁচ অনুভব করতে শুরু করেছি। সেই জীবন প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বেশ দীর্ঘকালীন
সাংবাদিকতায়, ইংরেজিতে এবং উর্দুতে। তাঁর সুস্পষ্ট মার্কসবাদী
রাজনৈতিক অবস্থানে ও ক্রিয়াকাণ্ডে। এবং ফয়েজ়ের কবিতা সেই জীবনের পরিশ্রুত রূপ বই
আর কিছুই নয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনের মধ্যে থাকা এ হেন মহাজীবনের বিশুদ্ধ নিষ্কুলষতাকে
প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন কয়েকজন বাংলাদেশী সাহিত্যানুরাগী। আমার এক সময়ের সাংবাদিক
সহকর্মী ও বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু প্রবীরদার (রায়) এক দল বাংলাদেশী বন্ধু বহু বছর আগে, ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে, ট্যাংরার কিম লিং রেস্তোরার
শুঁড়িখানায় প্রথম আমার কাছে এ অভিযোগ তুলেছিলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তি
আন্দোলন দমন করতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী ঢাকা ও
অন্যত্র যে নারকীয় গণহত্যা সংগঠিত করেছিল, তা বিলক্ষণ জেনেও
নীরব ছিলেন ফয়েজ়। এই নীরবতা বিশেষ করে অসহনীয় এই কারণেই যে এই গণহত্যায় খুন
হয়েছিলেন ফয়েজ়ের একাধিক বন্ধু ও পরিচিতজন। প্রসঙ্গত, এই বর্বরতায় ঠিক
কতজন নিহত হয়েছিলেন তার অভ্রান্ত হিসেব কখনওই জানা যাবে বলে মনে হয় না— অন্তত দু লক্ষ ঊনসত্তর হাজার, হয় তো দশ লক্ষেরও বেশি।
বাংলাদেশের সরকারের হিসেবে তিরিশ লক্ষ6।
উত্তরে আমি আমার মুখস্ত ফয়েজ়ের বিখ্যাত কবিতা ‘ঢাকা সে ওয়াপসি পর’ (ঢাকা থেকে ফিরে) শুনিয়ে তাঁদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম ১৯৭১-এর ঘটনাক্রম কী ভাবে কবিকে মর্মাহত করেছিল। তাঁরা কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ‘too little, too
late’ বলে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমি ফয়েজ়ের
বিরুদ্ধে সেই বাংলাদেশীদের তোলা নিদারুণ অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারিনি।
প্রশ্নটা স্পষ্ট — বাংলাদেশে পাকিস্তানি খানসেনার নারকীয় গণহত্যা নিয়ে
ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় কি তবে সত্যিই কার্যত নীরবই ছিলেন? কেন? খোঁজটা সেই থেকেই শুরু হয়েছিল। সে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। এবং তা যে অন্তত
পুরোপুরি সত্য নয় সে তথ্যও হাতে চলে আসছিল ক্রমে ক্রমে— আগে কিছুটা
অমনোযোগে পড়া কবিতাকে ফিরে পড়তে হচ্ছিল, রচনাকাল মিলিয়ে।
কিন্তু সেই খোঁজ একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যের গতিমুখ পেল ২০২০ সালে এসে। ফয়েজ়ের
মতো এক কবির কবিতা যে তাঁর দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র ও তাঁর সমসময় উভয়কেই পরাস্ত
করে ভিনকালের ভিনদেশের হরেক কিসিমের প্রতিবাদের স্বরের স্লোগান হয়ে উঠতে পারে তার
অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা দেখেছি নরেন্দ্র মোদী সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের
(সিএএ) বিরুদ্ধে আসমুদ্রহিমাচল রুখে
দাঁড়ান ছাত্রদের মিছিলে ফিরে ফিরে আসা — ‘বোল্, কে লব আজ়াদ হ্যায় তেরে’ (বল্, স্বাধীন তো ঠোঁট
দুটো তোর) কিংবা ‘হম দেখেঙ্গে’ (দেখব আমরাও) কবিতায়। যেমন দেখেছি এ উচ্চারণে ক্রুদ্ধ
হিন্দুত্ববাদী প্রবল শক্তিবিন্যাসের বিভিন্ন মহল থেকে ফয়েজ়কে আক্রমণের হিড়িক।
যেমন, ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রতিবাদী মিছিলের সময় ‘হম দেখেঙ্গে’ আবৃত্তি করে ‘হিন্দু ভাবাবেগে
আঘাত করার’ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কানপুর আইআইটির মতো দেশের প্রথম
সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসকরা বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে
তদন্ত কমিটি গঠন ক’রে, যিনি এই কবিতা পড়েছিলেন তাঁকে
ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছিল। কমিটি তার লিখিত রিপোর্টে এই কবিতা পাঠকে ‘সময় ও প্রেক্ষিতের নিরিখে অনুপযুক্ত7’ অভিহিত করেছিল। এ
ঘটনা ২০২০-র ১৭ ডিসেম্বরের।
এমনি এক সুচতুর, অতি সুচিন্তিত, সুগবেষিত আর এক
মহলের নাম ‘স্বরাজ্য’ পত্রিকা। ১৯৫৬ সালে
প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকা গোড়া থেকেই ভারতীয় দক্ষিণপন্থী চিন্তা-চেতনার বাহক। ১৯৮০ সালে এ সাপ্তাহিক বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে, যে বছর নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন, সে বছরই তা বেশ
তোড়জোড় করে অনলাইন অবতারে প্রকাশিত হল দ্বিতীয় দফায়। তারিখের যোগাযোগগুলি নজরে পড়ে
বৈকি। ২০১৯-এর ১২ ডিসেম্বর নরেন্দ্র মোদী সরকার সংশোধিত
নাগরিকত্ব আইন প্রবর্তনমাত্র সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তার বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবদের তীব্র প্রতিরোধ। ফয়েজ়ের কবিতাগুলো স্লোগান হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের ৪
জানুয়ারি এই স্বরাজ্য অনলাইন পত্রিকা একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে — Genocide, Refugees, And Faiz: How Media Covered The
1971 Crisis – From The Pages Of The Illustrated Weekly8। লেখক অরবিন্দন নীলকান্দন।
দীর্ঘ এই প্রতিবেদন নানা যুক্তি সাজিয়ে প্রথমে জওহরলাল নেহরু ও মৈত্রেয়ী
দেবীকে বেদম গাল পেড়ে, প্রবন্ধের শেষাংশে ফয়েজ়কে নিয়ে পড়ে। সে অংশের
উপশিরোনাম — Deafening Silence of Faiz। প্রতিবেদকের এই অংশের মূল প্রতিপাদ্যগুলি এ রকম — ১। ফয়েজ় আসলে ভারতীয় উপমহাদেশের
ইসলামি-মার্কসবাদী কুচক্রীদের (Islamo-Marxist cabal) খাড়া করা প্রগতিবাদী। ২। তিনি তিব্বতে
মাওবাদী চিনা সরকারের অত্যাচার বা স্তালিনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কখনও কোনও কথা বলেননি। ৩। ‘হাম দেখেঙ্গে’-র মতো কবিতা প্রমাণ করে তিনি ইসলামবাদী, এবং এমন ইসলামি কবিতা যে সিএএ
বিরোধী ভারতীয় ইসলামবাদীরা ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক। ৪। এ হেন কবি বাংলাদেশে ১৯৭১-এর হিন্দুদের
গণহত্যার সময় যে নীরব থাকবেন, তাও স্বাভাবিক।
এর মধ্যে প্রথম তিনটি হাস্যকর তকমা বা দাবি খণ্ডন করাও এ লেখার উদ্দেশ্যের
মধ্যে পড়ে না। আমরা খতিয়ে দেখব চতুর্থ অভিযোগ— ১৯৭১-এ বাংলাদেশের হিন্দু গণহত্যা নিয়ে ফয়েজ়ের চিৎকৃত নীরবতা। এখানে বলে রাখা
দরকার ফয়েজ়ের বিরুদ্ধে ভারতে এই অভিযোগ ওঠে ১৯৭১ সালেই এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের
মধ্যে প্রকাশিত ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ নামের পত্রিকার একাধিক প্রতিবেদনে। স্বরাজ্য ২০২০ সালের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে সেই অভিযোগকে সেই সব পুরনো পত্রিকার পাতা থেকে খুঁড়ে
বার করে, তার সঙ্গে আরও কিছু ‘প্রমাণ’ জুড়ে পাঠকের সামনে হাজির করে।
এক্ষণে আমার তরফ থেকে এও বলে রাখা দরকার, আমার কাছে এ খোঁজ
তাত্বিক কৌতুহল চরিতার্থ করা নয়। ফয়েজ়ের কবিতা ও তাঁর জীবন আমার অস্তিত্বের সঙ্গে
সম্পৃক্ত। সেই অস্তিত্বের গলায় এ খোঁজ সহসা কাঁটার মতো আটকে না গেলে কোনও কট্টর
দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী একটা পত্রিকার ওই লেখা কাকের কান নিয়ে
যাওয়া মনে করে বাঁকা হেসে উপেক্ষাই করতাম। কিন্তু তা হতে পারল না। আর তা না হতে
পারার আর একটা জরুরি কারণ, এই প্রববন্ধেই একটা বই থেকে
উদ্ধৃত কয়েকটা বাক্য। বহু চেষ্টায় বইটা বাংলাদেশ থেকে জোগাড় করে মিলিয়ে দেখলাম উদ্ধৃতিতে
ভুল নেই — “Even such an eminent poet and humanist Faiz Ahmed Faiz who still has
many admirers in the Dhaka intellectual circles remained silent. When I met him
in a friend’s house who threw a lavish cocktail party in his honour I asked Mr.
Faiz why he was so quiet when the Pakistan army was massacring the helpless
Bengalis. He replied as if nothing had happened, ‘Hame to koi patai nahi tha…
(We did not know anything that was happening)’.9” বইয়ের নাম — Spring 1971. লেখক ফারুক আজ়িজ় খান। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে পরিচালিত বাংলাদেশের নির্বাসনে-গঠিত-সরকারের (Government in exile) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সেক্রেটারি। এই বই ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত
হয়। এ রকম একজনের কথা ঠিক উপেক্ষা করার মতো নয়। কাজেই একটা খোঁজ অবশ্যম্ভাবি হয়ে
উঠেছিল।
সেই খোঁজ একটা অদম্য তাড়না হয়ে উঠল এই সেদিন— ২০২২ সালের ২৫
ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার নাতিদীর্ঘ ঢাকা সফরকালে — অন্য কোনও ব্যক্তির কোনও লেখা বা মন্তব্য-তাড়িত হয়ে নয়, সম্পূর্ণ নিজের এক না-ছোড় তাগিদে। এক অনির্বচনীয়
আনন্দ নিয়ে সক্কাল সক্কাল পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে বাকরখানি খোঁজ করতে করতে আমার
সেই সফর শুরু করেছিলাম। তারপর সহসা এক সাংঘাতিক ধাক্কায় কেমন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে। আর পাঁচটা নতুন দেশে যাওয়ার মতোই
বাংলাদেশ সফরের আগেও আমি সাধ্যমতো পড়াশুনার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের গভীর রাত্রি থেকে পাকিস্তানি সেনার বর্বরোচিত অপারেশন সার্চলাইট, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, খান-সেনা ও রাজাকারদের
যৌথ পরিকল্পনায় গণহত্যার পর গণহত্যা। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধশেষের ঠিক আগে, কেবল পরাজয়ের ক্রোধ চরিতার্থ করতেই সম্ভবত, ১৪ ডিসেম্বর
বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে বার করে অকথ্য অত্যাচারের পরে খুন— এই সব নানা তথ্য মোটামুটি জানা ছিল। তারপর, একদিন প্রবেশ করলাম
ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। মনের মধ্যে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির ছোট্টো সীতা বহুরূপী কালীর মুখোমুখি হল— এ ছাড়া আর কোনওভাবে
আমার পক্ষে আমার মনের মধ্যে সেই কয়েক ঘণ্টার ধাক্কা বোঝান সম্ভব নয়। আমার ভাষার তত
জোর নেই। Shock।
সেই জাদুঘর থেকে আমি আর কখনও বেরতে পারব বলে মনে হয়
না। এরপর ঢাকা শহরের পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি বুঝতে পারি গোটা শহরটাই আসলে ধামাচাপা
দিয়ে রাখা এক বিরাট আর্তনাদ। রুমীর রঙিন স্পর্ধা আর তার উত্তরবিহীন পরিণতির অসহ্য
নিরবতার ভারবাহী একদিন-প্রতিদিনের কোলাহলময় এলিফ্যান্ট
রোডে10 হাঁটতে হাঁটতে, কবে-যেন-কী-হয়েছিল চাপা দেওয়া রিকশার সারি-রঙময় জগন্নাথ হলের11 সামনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার আর
স্লোগানের ঠোঙায় মোড়া পুরনো মধুদার12 ক্যান্টিনের
সামনের স্থানু হয়ে যাওয়া সাক্ষী বটগাছটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে — মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকল ফয়েজ়ের সেই বিখ্যাত কবিতাটা — ঢাকা সে ওয়াপসি পর (ঢাকা থেকে ফিরে)। কবিতাটার থেকেও প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়াল মূল কবিতাটার নিচে লেখা তারিখটা— ১৯৭৪। ১৯৭৪? ১৯৭৪? এতকাল কী করছিলেন
ফয়েজ়? কী বলছিলেন?
আমার একটা হেস্ত-নেস্ত খোঁজ শুরু
হয়।
ফয়েজ়-এর সঙ্গে বাংলার সাহিত্যের ও
পূর্ব পাকিস্তানের সরাসরি যোগাযোগ মেলে ১৯৫০-এর দশকের শেষ
থেকেই। ১৯৫৯ সালে লাহোরের পাকিস্তানি চলচ্চিত্রকার আখতার জে করদার একটি ছবি তৈরি করেন
— জাগো, হুয়া সবেরা। জাগো, ভোর হল। এই ছবির সংলাপ এবং স্ক্রিপ্ট
করেছিলেন ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। গীতিকারও ছিলেন তিনি। ছবির মূল কাহিনি নেওয়া হয়েছিল
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুগান্তকারী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি থেকে। ছবিতে
উপন্যাসের কপিলা চরিত্রটির নাম বদলে করা হয় মালা— অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিমিরবরণ। ছবির দীর্ঘ
আউটডোর দৃশ্যের লোকেশন শুটিং হয়েছিল পদ্মানদীর পাড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।
অসামান্য এই ঐতিহাসিক ছবিটিকে মুক্তি পেতে দেননি পাকিস্তানের তদানীন্তন
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এরপর ছবিটি কার্যত হারিয়ে যায়। অনেক পরে, ২০১০ সালে তা অবশেষে মুক্তি পায়।
মনে রাখতে হবে, ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির পাকিস্তানি পুলিশের গুলি-জর্জরিত রক্তাক্ত
জনজোয়ার থেকে ততদিনে সে সময়ের পূর্বপাকিস্তানের ভাষার অধিকারের আন্দোলনের ছোট ছোট
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য বেয়ে স্বাধীনতার দাবি জোরদার হতে শুরু করে দিয়েছে।
১৯৫৬-র ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার অন্যান্য ভাষার
সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে
জয়ের স্বাদ পেয়েছে। অমোঘ ১৯৭১-এর দিকে ইতিহাস এগোচ্ছে। ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পরেই সে জয়ের আনন্দের ওপর ফের হামলা
শুরু হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক বামদরদি তফাজ্জল
হোসেন মানিক মিয়া এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হচ্ছেন ১৯৫৯-এ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসনের নানা দাবি সংবাদপত্রে তুলে ধরার অপরাধে। প্রতীকী
অর্থে, ঢাকার বিখ্যাত শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে আমরা দেখছি এ.জে. করদার, ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-রা তাঁদের ছবির
জন্য শুধু একটি বাংলা উপন্যাসই বেছে নিচ্ছেন না, ‘হিন্দু’ বাঙালিদের করছেন সে ছবির প্রধান কুশীলব। এখানে ‘হিন্দু’ প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষার দাবি পাকিস্তানের
ক্ষমতার অলিন্দে যে বিবিধ অনুরণনে অনুরণিত হয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল এ দাবিকে
খাঁটি মুসলমান পাক (পবিত্র অর্থে) রাষ্ট্র ও তার পাক
সংস্কৃতির পিঠে বিশ্বাসঘাতকতার ছোরা হিসেবে অনুভব করা। এই ভাবনা কী ভাবে পশ্চিম
পাকিস্তানের শাসকদের মনে সঞ্চারিত হচ্ছিল তার অসাধারণ উদাহরণ মেলে মৃত্যুর পর
প্রকাশিত আয়ুব খানের ডায়েরির একটা এন্ট্রিতে — ‘‘ওরা সজ্ঞানে
নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির হিন্দুআয়ন ঘটাচ্ছে। টেগোর হয়ে উঠেছে ওদের ঈশ্বর। সবকিছুর
বঙ্গীকরণ হয়ে গিয়েছে, এমনকী গাড়ির নাম্বার প্লেটগুলোও বাংলায় লেখা। পশ্চিম
পাকিস্তানের মানুষ ঢাকায় গেলে তার নিজেকে বিদেশী মনে হয়। বুঝেশুনে বা না বুঝে তারা
বিচ্ছিন্নতার দিকে এগোচ্ছে এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে বিলীন হওয়ার জন্য নিজেদের
উন্মুক্ত করে ফেলছে।13’’(মে, ১৯৬৭)
এ বোধ একদিনে জন্ম নিতে পারে না। কিন্তু ১৯৫৯-এই ফয়েজ়রা এই বোধের মূলে কুঠারাঘাত করতে চাইছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে যাঁরা
ফয়েজ়কে এবং তাঁর কবিতাকে বাংলায় জনপ্রিয় করছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন
সাংবাদিক ও লেখক রণেশ দাশগুপ্ত এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে
ফয়েজ় ঢাকায় কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তা বুঝতে একটা কিস্সা শোনা যেতে পারে।
শুনিয়েছেন বিখ্যাত বাংলাদেশী উর্দু কবি ও সাংবাদিক আহমদ ইলিয়াস (১৯৩৪-২০২৩), তাঁর স্মৃতিকথায়14। ১৯৭০। সবে ফয়েজ়-সম্পাদিত লয়েল ও নহার সাপ্তাহিক পত্রিকায় ঢাকা করেস্পন্ডেন্টের চাকরি পেয়েছেন
ইলিয়াস। এরই মধ্যে ঢাকা এসেছেন
ফয়েজ়। উঠেছেন শাহবাগ হোটেলে। সে হোটেল এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল
বিশ্ববিদ্যালয়। দেখা করে ফিরে আসছেন ইলিয়াস, তাঁকে পিছন থেকে
ডাকলেন ফয়েজ়। হাতে একটা একশো টাকার চেক— সাংবাদিকতার জন্যে
নোটবুক ইত্যাদি যা প্রয়োজন আর একটা নতুন পোশাক কিনে নিও! সে সময় ইলিয়াসের
আর্থিক অবস্থা শোচনীয়— তাঁর পোশাক থেকেই তা স্পষ্ট। হোটেল থেকে বেরিয়েই
ইলিয়াস ঠিক করলেন আগে একটা জামা কিনবেন। গুলিস্তান বিল্ডিংয়ে একটা দোকান আছে, গালভরা নাম ‘স্টাইল হাউস’। মালিক মনজ়ুর আহমদ। সেখানেই
প্রথম ঢুঁ মারলেন ইলিয়াস আগেভাগে জামাটা কিনে ফেলতে। সেদিন মালিক নিজেই
দোকানে হাজির। ইলিয়াস তাঁকে ফলাও করে শোনালেন ফয়েজ়ের কাছে থেকে চেক পাওয়ার কথা।
নতুন একখানা জামা চাই। মনজ়ুর সাহেব জানালেন— চেকটা তাঁর চাই, পরিবর্তে তিনি ইলিয়াসকে দেবেন ২০০ টাকা এবং একটা পছন্দসই নতুন জামা! সে কী? চেকে তো ইলিয়াসের নাম লেখা আছে, তা নিয়ে মনজ়ুরের কী হবে? মনজ়ুরের ঝটিতি উত্তর— সে চেক বাঁধিয়ে নিজের বৈঠকখানায় টাঙিয়ে রাখবেন তিনি, কারণ তাতে রয়েছে
ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের সই!
কিন্তু এর থেকে আমার কাছে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ
তথ্য এই যে, ইলিয়াস জানাচ্ছেন, ১৯৭০-এর সেই উত্তাল দিনকালে লয়েল ও নহার পত্রিকার সাংবাদিক নিযুক্ত হওয়ার
প্রক্রিয়ায় নিজের ‘রেজ়ুমে’-র সঙ্গে তিনি যে
প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন লয়েল ও নহারে তার বিষয় ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
সম্পাদক ফয়েজ় সে প্রতিবেদন ছেপে দিয়েছিলেন পত্রিকায়। আর তার থেকে আরও বহুগুণ
জরুরি তথ্য এই যে, ১৯৭১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি ইলিয়াস ঢাকা
থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠান লয়েল ও নহারে। তাতে ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের
রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আমি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, ৩ মার্চের ন্যাশনাল
অ্যাসেম্বলির অধিবেশন যদি পিছিয়ে দেওয়া হয় তা হলে পাকিস্তানের ইতিহাসের গতিপথ বদলে
যাবে। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় আমার সেই ডিসপ্যাচ লয়েল ও নহারের, ১ মার্চ, ১৯৭১ সংখ্যার কভার স্টোরি করে ছেপে দেন।15’’
পাকিস্তানের সে সময়ের ঘটনাক্রমের সঙ্গে একেবারেই
অপরিচতিদের জন্য এক্ষণে এক নজরে কয়েকটি তারিখ ও কিছু ঘটনা দেখে নেওয়া দরকার—
- ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ — পাকিস্তানের
প্রথম সরাসরি দেশজোড়া নির্বাচন হয় ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি গঠনের লক্ষ্যে। মোট
৩১৩টি আসন— পূর্ব
পাকিস্তানে ১৬২টি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি।
এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি আসন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল— শেখ
মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর নেতৃত্বে
পাকিস্তান পিপল্স পার্টি (পিপিপি)। সে সময়
দেশের প্রেসিডেন্ট— জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সামরিক শাসন।
- ফলাফল— আওয়ামী
লীগ জেতে ১৬০টি আসন এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি আসনের ৭টি — মোট
১৬৭টি । মহিলাদের ৫টি আসন মিলিয়ে পিপিপি জেতে মাত্র ৮৬টি। বাকি আসন একাধিক
ছোট ছোট দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
- ইয়াহিয়া খান এবং জ়ুলফিকার
ভুট্টো উভয়েই এই ফলাফল কার্যকর করে ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি গঠনের বিরোধিতা
করেন। তাঁদের ভয়, মুজিবুর রহমান সরকার গঠন করলে পূর্বপাকিস্তানের
স্বায়ত্তশাসন সহ তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা দাবি আটকানো যাবে না। পাকিস্তানের
ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পূর্বপাকিস্তানে বাঙালিদের হাতে চলে যাবে।
- ১২ জানুয়ারি, ১৯৭১। ইয়াহিয়া
খান ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশন শীঘ্রই শুরু হবে।
- ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭১। ভুট্টো
ঢাকায় এসে মুজিবুরের সঙ্গে বৈঠক করে পিপিপি-আওয়ামি লীগ
ক্ষমতা ভাগাভাগি করে যৌথ সরকারের প্রস্তাব দেন। স্বাভাবিকভাবেই মুজিবুর এই
বিচিত্র আবদার প্রত্যাক্ষাণ করেন।
- ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। ইয়াহিয়া
খান ৩ মার্চ
ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশন আহ্বান করার কথা ঘোষণা করেন। জ়ুলফিকার বলেন
তাঁর দল অ্যাসেমব্লি বয়কট করবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হলে।
- ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। ইয়াহিয়া
– জ়ুলফিকার বৈঠক। জ়ুলফিকার
অ্যাসেমব্লি বয়কটে অটল।
- ১ মার্চ, ১৯৭১। দুপুর ১:৫০।
ইয়াহিয়া অনির্দিষ্ট কালের জন্য ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি মুলতুবি করে দেন। ঢাকা
শহর সহ সারা পূর্বপাকিস্তান প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে।
- ২ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেয়। পূর্ব
পাকিস্তানে কঠোর সামরিক শাসন ও রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়। পূর্ব
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয় শাহাজ়াদা ইয়াকুব খান-কে। মুজিবুর দেশ-জোড়া
হরতাল ডাকেন।
- ৩ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকার
পল্টন ময়দানে, মুজিবুরের
উপস্থিতিতে, ছাত্রনেতৃত্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন।
এই প্রেক্ষিতে আমাদের পড়তে হবে সম্পাদক ফয়েজ় আহমেদ
ফয়েজ়ের লয়েল ও নহার পত্রিকায় ১৯৭১-এর ১ মার্চ ছাপা সেই কভার
স্টোরি, যা পাকিস্তানি সরকারকে হুঁশিয়ার করে— ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশন বাঞ্চাল করলে পাকিস্তানের ইতিহাস বদলে যাবে।
সারা পশ্চিম পাকিস্তান তখন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বাঙালি পূর্বপাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব
আক্রান্ত। দেশাত্মবোধের গণজোয়ার— পাকিস্তান ভাগ হতে দিচ্ছি না, দেব না। দলীয় কোনও নেতা পূর্বপাকিস্তানে গেলে তাঁর ‘টাঙ্গে তোড় দুঙ্গা16’ (ঠ্যাং ভেঙে দেব) বলে হুমকি দিচ্ছেন, ফয়েজ়ের
বন্ধুস্থানীয়, কথিত বামপন্থী, সে সময়ে পশ্চিম
পাকিস্তানের সব থেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো।
কিন্তু অতি মিতবাক, মৃদুভাষী কবি অটল।
চোখ রাঙিয়ে ফয়েজ়-কে যে স্তব্ধ করা যায় না, এই প্রতিবেদন তার
আশ্চর্য উদাহরণ। কী সাংঘাতিক মনোবল থাকলে ঠিক ওই মুহূর্তে জ়ুলফিকারের রাজনৈতিক
ক্ষমতার বীজতলা করাচি থেকে প্রকাশিত একটি বিখ্যাত পত্রিকায় এই প্রতিবেদন শুধু ছাপা
নয় কভার স্টোরি করা যেতে পারে, তা ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই।
কাজেই একটু খতিয়ে খোঁজ করলেই বেরিয়ে আসে— বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে ফয়েজ় ‘নীরব’ ছিলেন না। অন্তত এ পর্যন্ত। কিন্তু তারপর?
সে খোঁজে এর পরের ঘটনাক্রমও সংক্ষেপে জেনে নেওয়া
প্রয়োজন—
- ৭ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায়
ঐতিহাসিক জনসভা করেন মুজিবুর। মূল দাবি— সামরিক
শাসন তুলতে হবে।
টহলদারি সেনাকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। জয়ী জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা
তুলে দিতে হবে।
- ১৪ মার্চ, ১৯৭১। জ়ুলফিকার
প্রস্তাব দেন পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়া হোক পিপিপি-কে, পূর্ব
পাকিস্তানের ক্ষমতা আওয়ামী লীগকে।
- ২২ মার্চ, ১৯৭১। মুজিবুর
ঘোষণা করেন সামরিক শাসন রদ না করা পর্যন্ত কোনও আলোচনাই ফলপ্রসূ হবে না।
ইয়াহিয়া ফের ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবির কথা ঘোষণা
করেন।
- ৩ মার্চ – ২২
মার্চ, ১৯৭১। পূর্বপাকিস্তানের
অসামরিক শাসনের উপর কার্যত সমস্ত কর্তৃত্ব হারায়
ইয়াহিয়া সরকার। গণআন্দোলন তুঙ্গে।
- ২৩ মার্চ, ১৯৭১। মুজিবুর
৩২ ধানমণ্ডিতে
নিজের বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকা
সরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়।
- ২৫ মার্চ, ১৯৭১। জ়ুলফিকার
ও ইয়াহিয়া ৪৫ মিনিট বৈঠক করেন সকালে। গভীর
রাতে ঢাকা ও বাংলাদেশে শুরু হয় পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার ‘অপারেশন
সার্চলাইট’।
গণহত্যার পরে গণহত্যার পরে গণহত্যা। চলতে থাকে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত। ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনা সমর্থিত বাংলাদেশী
মুক্তি ফৌজ জয়ী হয়। তার ঠিক দু-দিন আগে দুপুর বারোটার সময়
পাকিস্তান সমর্থক রাজাকারদের নানা দল ও পাকিস্তানি সেনা শুরু করে এক পৈশাচিক
বুদ্ধিজীবী গণহত্যা। একটি হিসেব মতে, ঢাকায় ১৪৯ জন সহ, সারা বাংলাদেশ জুড়ে ১১১১ জন17 বুদ্ধিজীবীকে খুন
করে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকারদের সহায়তায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভাষাবিদ, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, বামপন্থী আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী সেদিন ছিলেন হাতিরপুলের সেন্ট্রাল
রোডে তাঁর মায়ের বাড়িতে। দুপুর বেলা পাকিস্তানি সেনার সহযোগী আল-বদর বাহিনি তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি ফয়েজ় আহমদ
ফয়েজ়ের বন্ধু মুনীরের। বাংলাদেশে ফয়েজ়ের লেখালিখি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর
সক্রিয় উৎসাহের কথা আগেই বলেছি। তাঁর দেহাবশেষটুকুও মেলেনি কোথাও।
প্রশ্ন হল, ফয়েজ়ের কাছে কী সে
খবর পৌঁছয়নি? বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই সূত্রেই কবির বিরুদ্ধে এই কঠোর
অভিযোগ। এই সূত্রেই সম্ভবত জীবনে একমাত্রবার ভিনদেশী বন্ধুদের কাছ থেকে অনাদৃত, অপমানিত, আহত ফিরে আসছেন ফয়েজ়। ২৭ জুন, ১৯৭৪। ঝলমলে সকাল। ১০৭ জনের এক বিশাল ডেলিগেশন নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো
তিন দিনের সফরে পৌঁছলেন ঢাকা। এয়ারপোর্ট থেকে শহরের পথে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী বিপুল উদ্দীপনায় রাস্তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন
পাকিস্তানী অতিথিদের18। সেই দলে ছিলেন ফয়েজ়। ততদিনে
তিনি ভুট্টোর বিশেষ অনুরোধে পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ দি আর্ট্স-এর চেয়ারম্যান হয়েছেন19। এত হইচই, এত আতিথ্য, পুরনো বৈরিতা পিছনে ফেলে নতুন সম্পর্কের গোড়াপত্তনের চেষ্টা— সবই হল, কিন্তু ফয়েজ়ের পুরনো বাংলাদেশী বন্ধু ও গুণগ্রাহীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে
পর্যন্ত অস্বীকার করলেন।
কী হয়েছিল ১৯৭৪-এর ২৭ থেকে ২৯ জুন। এ বিষয়ে সব থেকে প্রামাণ্য তথ্য
আমরা পেয়ে যাই পাকিস্তানের ১৯৫০-এর দশকের বিখ্যাত বামপন্থী
ছাত্রনেতা, পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, লেখক ও ফয়েজ়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাঃ আয়ুব মির্জ়ার জবানিতে—
‘‘এক সন্ধ্যায় ইসলামাবাদের বিষণ্ণ উদ্বিগ্ন সন্ধ্যায়
আমি ফয়েজ় সাহেবের সঙ্গে ওঁর বাড়ির লনে বসে ছিলাম।… ফয়েজ় সাহাব বললেন, ‘ভাই, আপনাকে এই জন্য ডেকেছি যে, সরকারের কাছ থেকে
বার্তা এসেছে, ঢাকা যেতে হবে। ভাই, ভুট্টো সাহেব যে
ডেলিগেশন নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আমাকেও রাখা হয়েছে।’ আমি বললাম, ‘আপনি অবশ্যই যান।’ সে সময় জোর খবর
ছড়িয়েছিল যে ফয়েজ়কে বাংলাদেশ কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রদূত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশগামী প্রথম পাকিস্তানী ডেলিগেশনে ফয়েজ় থাকছেন শুনে আমি খুব খুশি হলাম।
আমার মনের মধ্যে একটা আবছা আকাঙ্খা আড়মোড়া ভাঙল— আহা, সেই টর্নেডোর পরে আমিও যদি এই ডেলিগেশনে থাকতে পারতাম, আর টুকরো টুকরো
তারা আর ভেঙে পড়া সব হৃদয়কে জুড়ে ফেলতে পারতাম। আমি সেই খবর শুনে নিজের ভীষণ খুশি
হওয়ার কথা তাঁকে জানিয়ে, আমার অসংখ্য বাংলাদেশী বন্ধুদের
উদ্দেশে অনেক ভালোবাসার বার্তা দিলাম। তাঁদের মধ্যে দু-জন বাঙালি ভাই
আমাকে কখনও ভোলেননি। ফয়েজ় তাঁদের মধ্যে স্রেফ একজনকে জানতেন, কিন্তু ওই দুই বাঙালিই ফয়েজ়কে চিনতেন খুব ভালো মতোই।
‘‘শহীদুল্লা কায়সর বাংলাদেশের এক নবীন মার্জিত
ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান ফেডারল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্ট্স (পিএফইউজে)-র শেষ দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ইসলামাবাদে এসে শহজ়াদ
হোটেলে উঠেছিলেন। তিনি একদিন কনফারেন্সের আয়োজকদের বললেন, ডক্টর মির্জ়ার
সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাদের দেখা হল এবং গভীর বন্ধু হয়ে গেলাম দু-জনে। শহীদুল্লা কায়সর20 কোনও এক হাবিলদারের গুলির
নিশানা হয়ে গিয়েছিলেন। ফয়েজ় তাঁকে খুব ভালো করে চিনতেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে আমার সেলাম-ভালোবাসা জানানোর প্রতিশ্রুতি
আদায় করলাম ফয়েজ়ের কাছ থেকে।
‘‘দ্বিতীয় বাঙালি ভাইটিকে ফয়েজ় চিনতেন না। এইসব বাঙালি
আর পাঞ্জাবিদের কেউই চেনে না। তারা জনতার মধ্যে জন্ম নিয়ে জনতার মধ্যেই ভস্মীভূত
হয়ে যায়। সে অশিক্ষিত ছিল। কলকাতায় রিকস টানত। বস্তির ঝুপড়িতে থাকত। কুমিল্লায় তার
নিজের গ্রাম ছিল। এবং সেখানকার হিন্দু বানিয়াদের কাছে ধারে ডুবে ছিল। তার মা-বাপের অনেক বাচ্চা-কাচ্চা ছিল। তারা না পারত
বানিয়ার ধার চুকাতে, না বাচ্চাদের স্কুলের ফি দিতে। ধার আরও হুহু করে
বাড়তে থাকে কারণ তারা আগামী দিনের ধারের পরিবর্তে কেবল ধান দিতে পারত। ইস্কুল
মাস্টারের টাকা বা প্রথম দফায় যে ধার নিয়েছিল তা শোধের সাধ্য তাদের ছিল না। এক
ক্ষুধার্ত, অসহায়, ধারকর্জে ডুবে থাকা বাপের
সন্তান— তার জ্ঞানের দরকার নেই, খাবার দরকার। সেই
সব উৎপীড়িত নবীনদের একটাই নারা ছিল— চলো কলকাতা। কলকাতা এক বিশাল
আশ্রয়দাতা। তারপর এই নবীনেরা কলকাতার নির্দয়তাও চিনে ফেলল। কলকাতা আর কুমিল্লার
নির্দয়তা এক। সে তার সহায়সম্বলহীনতা আর ধনবাদী ব্যবস্থার ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করে কঠোর পরিশ্রম, বিবেক এবং গভীর বিশ্বাসের জোরে
এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যা রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টির পরিধিরও বাইরে ছিল।
সে একদিন পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কয়েকটা চা-বাগানের মালিক হয়ে
হাজির হল। তার নাম মহম্মদ আলি।
‘‘রাওলপিন্ডির ফ্ল্যাশম্যান হোটেলে তার সঙ্গে আমার
প্রথম দেখা হয়। সে আমার বন্ধু হয়ে গেল। বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনও বিদ্যে তার ছিল না।
তারপর সে যে কী নিষ্ঠুর ভয়াবহ দিনকাল শুরু হল। শেষে আলি রাওলপিন্ডি থেকে ঢাকা চলে
গেল। তারপর সেখান থেকে পালিয়ে নিজের গ্রামে (কুমিল্লায়)। সেখানে সে সন্ত্রস্ত, অক্ষম, অসহায়, দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব নিল। তার একটাই লক্ষ্য ছিল— রুটি, চাল, ধান আর ভাত।… তার কাছে অর্থ ছিল। সে টন টন চাল কিনে এক খরিদ্দারের গুদামে জমা করে রাখল নিজের গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী
অঞ্চলের মানুষের জন্য। যাতে ক্ষুধার্ত মানুষ পেট ভরে খেতে পারে এবং সে যাতে তাদের
গণহত্যা থেকে দূরে রাখতে পারে। এর অধিক রাজনীতির কোনও জ্ঞান তার ছিল না।
‘‘একদিন সকালে একটা জিপ এসে দাঁড়াল। সেই ধানের গুদামের
কথা জানাজানি হয়ে ছি-ছি পড়ে গেল। আলিকে চালের মজুতদার বলে শনাক্ত করা হল। এবং কার যেন নির্দয় গুলিতে সে নিজের জীবনের কারাগারের মেয়াদ শেষ করে পরলোকের
পথিক হয়ে গেল। বিনা বিচারে তাকে বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া হল। শোনা যায়
হত্যাকারী মুক্তিবাহিনীর ‘অকুতোভয় বিপ্লবী’
ছিলেন।
‘‘ফয়েজ় সাহেবকে বললাম, আমি কখনও কুমিল্লা
যাইনি। আমি তার স্ত্রী বা সন্তান কাউকেই দেখিনি। আপনি তাদের কাছে আমার হৃদয়ের
সেলাম পৌঁছে দেবেন। আলি নিজের গ্রাম এবং আশপাশের এলাকায় স্কুল খুলেছিল। কুয়ো
খুঁড়িয়েছিল। রাস্তা তৈরি করিয়েছিল। এবং বানিয়াদের ধার শোধ করে বহু গ্রামকে মুক্ত
করেছিল।
‘‘ফয়েজ় সাহেব বললেন, ‘ভাই, বাংলাদেশে আমার অসংখ্য পরিচিত মানুষ আছেন। কিন্তু আমি এই ব্যক্তিটির নাম কখনও
শুনিনি।’ আমি বললাম, ‘ফয়েজ় সাহেব এ সেই
অসংখ্য নামহীন মানুষের মধ্যে একজন যাদের আপনি বৌদ্ধিকভাবে বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু চেনেন না। যদি আগামীতে কখনও আমাদের দেশে
সমাজবাদী বিপ্লব হয়, এরাই সেই সমাজবাদকে রক্ষা করবে এবং সমাজবাদী জয়জয়কারের নেশা-আবরণের অর্থহীন, বেকার স্লোগানে বুঁদ হয়ে থাকবে।’ বললাম, ‘রাওলপিন্ডিতে আলির ড্রাইভার ঠেট
পাঞ্জাবি ছিল। তার ছিল ছয় সন্তান। এবং সে মাসে ১৩০ টাকা মাইনেতে এক পাঞ্জাবি পুলিশ অফিসারের ট্যাক্সি চালাত। চিরকালের মতো পিন্ডি ছেড়ে
যাওয়ার আগে আলি তাকে একটা টিভি কিনে দিয়েছিল যাতে তার পরিবার দেখতে পারে, আর তাকে কিনে দিয়েছিল একটা ওপেল ট্যাক্সি যাতে সে নিজেই রোজগার করতে পারে। এবং
তাকে বলেছিল— এবার তুমি ওই হারামজাদা অফিসারটার হাত থেকে নিজেকে
মুক্ত করো। নিজের বৌ-বাচ্চাকে ভালো রাখো। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাও। সে
জানত, হয়তো রাওলপিন্ডি আর কখনও আসা হবে না। সেই পাঞ্জাবি
ড্রাইভার মিলিটারি অ্যাকশনের সময় আলি ভালো আছে কিনা জানার জন্য আমায় খুঁজে বেড়াত।
সে শুধু এটুকু জানার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল যে, আলি সাহেব জীবীত
আছেন তো। আমি তাকে বলেছিলাম আলি বেঁচে আছে। সে কখনও মরতেই পারে না। যতদিন
রিকসাওয়ালারা বেঁচে আছে, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা বেঁচে আছে, চাষি আর শ্রমিকেরা বেঁচে আছে আলি কি মরতে পারে?’
‘‘ফয়েজ় সাহেব বলতে লাগলেন, ‘ভাই, আমি তার পরিবারের খোঁজ অবশ্যই করব। এই সব মানুষ মরে গিয়ে কিংবদন্তি হয়ে যায়।
যখন সমস্ত করুণা আর ভালোবাসার ছোঁয়া শুকিয়ে যায়, এরা নিজস্ব শিখরে
আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।’
--------
‘‘ফয়েজ় সাহেব জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর ডেলিগেশনে
বাংলাদেশ গেলেন। ফিরেই আমাকে ফোন করলেন, ‘ভাই, চলে এসো। আমি এসে গিয়েছি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (রাওলপিন্ডিতে) সরকারি মেহমান হয়ে আছি। ব্যাস, শিগগিরি চলে এসো।’
‘‘ঢাকাতে কী হল— এটা জানার জন্য আমি
অধীর হয়ে ছিলাম। তাড়াতাড়ি ওঁর ঘরে পৌঁছে গেলাম। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। ফয়েজ়
সাহেব হাসছিলেন। বললেন, ‘ভাই, তোমার সালাম-টালাম আমি কাউকেই পৌঁছাতে পারিনি। কথাটা শুনে দুঃখ হল। বললাম, ‘ফয়েজ় সাহেব, আপনি আমার মন ভেঙে দিলেন।’ বললেন, ‘ভাই, আমি কী করতাম বলো, আমাদের সঙ্গে তো
কাউকে দেখাই করতে দেওয়া হল না। আমি তো মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম খুব ঘোরাঘুরি করব।
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করব। তাদের কথা শুনব, নিজের কথা বলব।
পারস্পরিক অভাব-অভিযোগ হবে আর বন্ধুত্বগুলো গোড়া থেকে ঝালিয়ে নেব
ফের। কিন্তু তা হতে পারল না। ভাই, বাংলাদেশ এখন এক ভিন্ন দেশ। আর
সেখানের নাগরিকরা এক অন্য দেশের নাগরিক। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক
সম্পর্কও তো ছিল না। আর আমরা সেখানে পৌঁছতেই যে জাঁকজমকে আমাদের স্বাগত জানান হল, তার ফলেও আমাদের হোটেলে বন্দি করে দেওয়া হল। ভাই, ওই একটা যুক্তিই দেখান হল আমাদের— নিরাপত্তা। আমাদের নিরাপত্তাটাই জরুরি হয়ে উঠল। আমরা শহরে বেরতেই পারলাম না।’
‘‘জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেখানে হলটা কী?’ ফয়েজ় সাহেব বললেন, ‘ভাই, শুনলাম মুজিবুর
রহমান নাকি বলেছেন, পিআইএ21-র এতগুলো প্লেন চাই
(অর্ধেক ফ্লিট), এতগুলো জাহাজ
আমাদের দিয়ে দিন আপনারা, আর এত টাকা দিয়ে দিন আগে, তারপর আমরা কথাবার্তা বলব। আর ভুট্টো সাহেব বলেছেন, তা তো হতে পারে না।
এরপর মুজিবুর জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কী এনেছেন?’
‘‘জানতে চাইলাম, ‘তারপর?’ ফয়েজ় সাহেব বললেন, ‘ভাই, কিছুই হল না। ব্যাস, যেমন গিয়েছিলাম, তেমনই ফিরে এলাম। প্রথম দিন আচার-অনুষ্ঠানে গেল। দ্বিতীয় দিন কথা ছিল আমরা শহিদবেদীতে ফুল দিতে যাব। এ সময় খবর
এল সেখানে যাওয়া বিপজ্জনক— ঢাকাতে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। মুজিব
জোর দিচ্ছিলেন যে এই আচারটা হওয়া জরুরি। শওকত হয়াত, মুস্তাফা খর এবং
আগাশাহির মত ছিল যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ভুট্টো সাহেব যাওয়া ঠিক করলেন। যাই হোক, আমরা তো গাড়িতে কবর পর্যন্ত পৌঁছলাম। আর ভুট্টো সাহেব এলেন হেলিকপ্টারে। দূরে
একটা ছোট মতো বিক্ষোভ সমাবেশ চোখে পড়ল। ফুল দেওয়ার পর মুজিব আর ভুট্টো
সেক্রেটারিয়েটে আলোচনা করতে চলে গেলেন। আমাদের বলা হল, ভুট্টো সাহেব
আমাদেরও সেক্রেটারিয়েট যেতে বলছেন, যাতে আলোচনায় প্রয়োজনমতো আমাদের
পরামর্শ মেলে। এটা আমাদের সেকেন্ড কিংবা থার্ড সেক্রেটারি জানালেন। যাই হোক, আমাদেরও সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে মহমুদ হারুনও ছিলেন।
ব্যাস, আমরা দুজন একটা ঘরে বসে সিগারেট খেতে থাকলাম। মুজিব আর ভুট্টো আর একটা ঘরে
আলোচনায় ডুবে ছিলেন। আধঘণ্টা পরে আমাদের জানানো হল হয়তো আর আমাদের
প্রয়োজন হবে না। আমরা ফের হটেল চলে গেলাম। আমি বুঝলাম আলোচনা আটকে গিয়েছে। হোটেল
পৌঁছনোর পর আমি প্রস্তাব করলাম আমরা বাংলাদেশ স্কুল অফ ফাইন আর্টস দেখতে চাই। পরের
দিন কামরুল হাসান ও অন্যান্যদের কাছ থেকে বাংলা অ্যাকাডেমিতে বক্তৃতা দেওয়ার
আমন্ত্রণ এল। আমরা বললাম ঠিক আছে। সুফিয়া
কামাল, কামরুল হাসান, কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম প্রমুখদের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইছিলাম। সকালে দলের লোকজনকে বললাম, ভাই, আমায় বক্তৃতা দিতে যেতে হবে। ওঁরা বললেন, যাবেন বইকি। আমি অ্যাকাডেমির লোকজনকে বললাম, এসে আমায় নিয়ে যান।
নটা বেজে গেল, দশটা বেজে গেল — কেউ এল না। তারপর সাড়ে
দশটা নাগাদ ওঁদের টেলিফোন এল — ‘আমরা দুঃখিত যে আপনাকে আমন্ত্রণ
জানানোর অনুমতি পাইনি। অনুষ্ঠান বাতিল করা হল।’ আমি হোটেলের রেস্তোরাঁতে চলে গেলাম। দেখি কী এঁরা সবাই সেখানে বসে আছেন। জহুর
হুসেন চৌধুরীও (এডিটর— সংবাদ) ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার ঘনিষ্ট বন্ধুদের খুন করা হল, আপনি কী করেছেন?’ আমি বললাম, ‘আমি তো শুধু কবিতাই লিখতে পারি। তাই লিখেছি।’ তারপর তাঁকে — সেজেছে গণহত্যার মেলা, পরতে পরতে প্রাণের
ক্লেদ, দুচোখ উপচে এলেও কোনও উপায় ছিল না, ইত্যাদি শোনালাম। ভাই, ফেরার সময় আমার প্লেনে আমার
পাশে আগা শাহি বসে ছিলেন। তাঁর কাছে খোঁজ করে জানলাম ফাইনাল কথাবার্তা কী হল। আগা শাহি বললেন আলোচনার শেষে কোনও কমিউনিকে প্রকাশ করা হয়নি। এর দায়িত্ব
সম্পূর্ণ মুজিবুরের। ব্যাপারটা পরিষ্কার— কোনও বিষয়েই কোনও
সামঝোতা হয়নি। ভাই, বুঝলাম আলোচনার সময় মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দলের
বিশেষজ্ঞরা হিসেব-পত্তর বই-খাতা নিয়ে তৈরি
ছিলেন। গোড়াতেই বক্তব্য রাখার সময় বলে দিয়েছিলেন — ইতিহাসের
পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। ওদিকে ভুট্টো বলতে থাকলেন যে-সব ভুল হয়েছে আমার
সরকার সে সব করেনি। সে সব ভুলে যান। কিন্তু মুজিবুর জেদ করেছিলেন— আমি যা বলছি মেনে নাও নয়তো বাড়ি যাও। আমাদের মনে হয়েছিল, বিষয়টা গোড়াতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং শিমলা চুক্তির মতো কিছু একটা ব্যাপার
দাঁড়াবে। কিন্তু ওঁরা চাইছিলেন ওই পরিস্থিতিতেই, ওই মুহূর্তেই সব
লেন-দেন চুকিয়ে ফেলা হলে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টা নিয়ে
অগ্রসর হওয়া যাবে। ভুট্টো বললেন এমনি করে কিছু হয় না। আগে একটা যৌথ কমিটি গঠন করা
হোক। এই কমিটি সব হিসেব-নিকেশ খতিয়ে দেখবে। তারপর যার
ভাগে যা পড়বে তা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এখনই সম্পর্ক বহাল করা হোক, কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হোক। ভাই, মুজিবুর রহমান রাজি
হলেন না। মুজিবুর রহমান নিজের অবস্থান থেকে নড়লেন না, একটুও নমনীয় হলেন
না। অর্থাৎ আগে হিসেব-নিকেশ, পরে সম্পর্ক। ভুট্টো এতে রাজি
ছিলেন না।’
‘‘ফয়েজ় সাহেব একটু দম নিয়ে একটা লম্বা টান22 দিলেন, তারপর বললেন, ‘ভাই, আমি মনে করি অন্তত এই ক্ষেত্রে ভুট্টো সাহেবের অবস্থান ঠিকই ছিল। মুজিবুর রহমান
যে বিকল্পের কথা বলছিলেন সেভাবে দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের সংঘাতের সমাধান করা হয় না।
তাড়াহুড়ো করে এ সব বিষয়ের নিস্পত্তি হয় না। তিনি বলতে থাকলেন, একটা বড় কথা এই যে আমরা যখন ঢাকা পৌঁছলাম সারা শহরটা সেখানে এসে হাজির হয়েছিল।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান তুলছিলেন তাঁরা। যখন ফিরে এলাম, যেন কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট শুনশান, জনমনিষ্যি নেই।
তারপর গার্ড অফ অনার দেওয়া শেষ হল। আমি মালিক জফরকে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বললাম, একটা সিগারেট হয়ে যাক। কত ঘণ্টা পরে যে সিগারেট
খাওয়ার অনুমতি মিলল। ভুট্টো সাহেব এসে পড়লেন, এবং আমরা বাড়ি ফিরে
এলাম।’ জিজ্ঞেস করলাম, মুজিবুর রহমানের
সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল? ‘ভাই, তা হয়েছিল। মুজিব আমার সঙ্গে
দেখা করলেন গভীর উষ্ণ আবেগ নিয়ে। জড়িয়ে ধরলেন। বললেন — ফয়েজ় ভাই, কিছু লিখুন। আমি ওঁকে বললাম, অনেক কিছু লিখেছি। বললেন, ফয়েজ় ভাই আমাদের বিষয়েও লিখুন। বললাম, অবশ্যই লিখব। তারপর
ফেরার সময় প্লেনেই একটা কবিতা হয়ে উঠল। ভাই সেটাই তো —
ঢাকা থেকে ফিরে23
আতিথ্যের ঘটা এত, অপরিচিতের মতো তবু
সেই মুখোমুখি হওয়া।
বন্ধু কবে হব যে আবার, প্রয়োজন কতবার আরও
দেখা হওয়া?
নিদাগ সবুজে কবে বসন্ত আসবে আবার?
রক্তের দাগ ধুয়ে দিতে কত বর্ষা আরও দরকার?
মুহূর্ত মুহূর্ত কত গিয়েছে নির্দয়, তিলে তিলে ভালোবাসা-হারানো ব্যথায়।
স্নেহময়ী সেই সব রাত গেছে চলে, নিষ্ঠুর সকাল আসে যায়।
চেয়েছিল, খুব চেয়েছিল প্রাণ
তবু সুযোগই দেয়নি এই ধ্বস্ত হৃদয়,
সেরে নিতে পারি যাতে অভিযোগ অনুযোগও কিছু শেষ হলে
দোয়া বিনিময়।
যে কথা বলবে বলেই, ফয়েজ়, তুমি গিয়েছিলে প্রাণাঞ্জলি নিয়ে
সব কথা বলা হল শুধু সেইটিই রয়ে গেল না-বলা-কথা হয়ে।
(১৯৭৪)24’’
দীর্ঘ উদ্ধৃতি। কিন্তু আমাদের এই খোঁজে অপরিহার্য। ফয়েজ় অতি মৃদুভাষী মিতবাক
মানুষ ছিলেন। তাই ওই ক’দিন ঢাকায় কী হয়েছিল সে বিষয়ে
তাঁর দেওয়া বর্ণনার কিছু অংশের নীচে দাগ দিয়ে তা আর একটু ভেঙে বলা দরকার। যেমন, বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে গড়ে ওঠা দূরত্ব তাঁকে কতটা পীড়া দিয়েছিল তা তিনি
কেবল ইঙ্গিতেই সাঙ্গ করেছেন। কল্পনা করা কঠিন নয় যে কতটা গভীর আনন্দে, প্রায় শিশুসুলভ আনন্দে, নিজের ডেলিগেশনের লোকজনকে বলে
বেড়িয়েছিলেন বাংলা অ্যাকাডেমিতে ভাষণের আমন্ত্রণের কথা। সকাল থেকে হয়তো বা স্যুট-বুট-টাই (পোশাকে পাক্কা সাহেবই ছিলেন তিনি) পরে তৈয়ার। গাড়ি আসবে। প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে ফের দেখা হবে। মনপ্রাণ খুলে আড্ডা
হবে। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে গাড়ি আসছে না। অধীর হয়ে উঠছেন ফয়েজ়।
এমন সময় সহসা টেলিফোন— সভায় ফয়েজ়কে ডাকার অনুমতি মেলেনি, সভা বাতিল। বিশ্বাসযোগ্য? বাংলা অ্যাকাডেমি সরকারি
প্রতিষ্ঠান— আগের দিন যে ফয়েজ়ের কাছে আমন্ত্রণ গেল তা অনুমতি
ছাড়াই? যে মানুষটাকে সে সময়ে বাংলাদেশের ভগবান নিজে বুকে
জড়িয়ে ধরছেন তাঁর সভা সরকার বাতিল করে দিল? নথি ছাড়া এ কথা
বিশ্বাস করছি না। যদি বা বাতিল হল, আমন্ত্রণকারীদের একজনও কী
সাক্ষাতে সে কথা ফয়েজ়কে জানাতে পারতেন না, যদিও ঠিক সেই সময়েই
ফয়েজ়েরই হোটেলের রেস্তোরাঁয় তাঁরা সদলবলে আড্ডা দিচ্ছিলেন? এর থেকে অপমান আর কী হতে পারে?
এরপর রেস্তোরাঁয় গিয়ে ফয়েজ় আবিষ্কার করলেন তাঁর পরিচিত জনেদের। কী বার্তা
বিনিময় হল তা বিশদে জানাননি ফয়েজ়। শুধু সাংবাদিক জহুর হুসেন চৌধুরীর এই ধারাল
প্রশ্ন ছাড়া — ‘আপনার ঘনিষ্ট বন্ধুদের খুন করা হল, আপনি কী করেছেন?’ এ প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে? জানি না ফয়েজ় ঠিক কী করতে পারতেন বলে আশা করেছিলেন তাঁর অত্যাচারিত, ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশী বন্ধুরা, কিন্তু ফয়েজ় এক পরমাশ্চর্য
বিনয়ে একের পর এক কবিতা শুনিয়ে হারানো বন্ধুদের কাছে প্রমাণ করতে বসেছিলেন নিজের
হৃদয়ের আঘাত। মনে রাখুন, সে সময়ে ফয়েজ় বিশ্ববিখ্যাত
কবি। যা এক সময় পরিচিত ছিল বামপন্থী দুনিয়ার নোবেল হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার দেওয়া
সেই লেনিন শান্তি পুরস্কার ১৯৬২ সালেই পেয়ে গিয়েছেন তিনি — এশিয়ার প্রথম কবি।
নিজেকে প্রমাণ করার কোনও দায় কি তাঁর ছিল? তিনি নিজে মনে
করেছিলেন ছিল। প্রসঙ্গত মনে করতেই হয়, ফয়েজ়ের পরিচিতদের
ব্যবহারের সঙ্গে মুজিবুর রহমানের নিজের ব্যবহারের তফাৎ। পলিটিশিয়ান কাতারে কাতারে
মেলে, স্টেট্সম্যান বিরল। এও মনে করতে হয়, মুজিবের অবস্থান ফয়েজ় সমর্থন করেননি, কিন্তু গোটা
জবানিটায় কোথাও কারও বিরুদ্ধে একটাও কটু কথা নেই। যাঁরা তাঁকে অপমান করলেন, তাঁদের বিষয়েও নয়।
আর এই প্রসঙ্গে মনে করতে হয়, ওই একই প্রশ্নের জবাবে ফারুক
আজ়িজ় খান উদ্ধৃত ফয়েজ়ের এক বাক্যের অসমাপ্ত উত্তর— ‘হামে তো কোই পাতাহি
নেহি থা…’। খটকা লাগে, একই প্রশ্নের উত্তরে
দুই বাংলাদেশীকে সম্পূর্ণ দু-রকম উত্তর
দিয়েছিলেন কবি? ওই তিনটি পুটকি আমার নয়, খান সাহেবের দেওয়া
উদ্ধৃতির অংশ, যা ইঙ্গিত করে আরও কিছু বলেছিলেন ফয়েজ়। কী বলেছিলেন? ফয়েজ়ের কন্যা সালিমা হাশমি তাঁর বোন, ফয়েজ়ের কণিষ্ঠ
কন্যা মুনীজ়া হাশমির মারফৎ আমায় জানিয়েছেন যে, সে সময় পশ্চিম
পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী নিয়ে যাবতীয় খবরের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি
ছিল। ছিল নিশ্চয়ই। সাধারণ মানুষ একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মহলে যে
বহু খবরই পৌছচ্ছিল তার অকাট্য প্রমাণ আছে, যার অন্যতম আহমদ
সালিম সম্পাদিত বই — We owe an apology to Bangladesh25। কবি আহমদ সালিম (১৯৪৫ – ২০২৩) নিজে সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিরুদ্ধে
একাধিক কবিতা লেখেন। তাঁর জবানিতেই শুনি, ‘‘১৯৭১-এর ২৬ মার্চ আমরা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার খবর পেয়ে
বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলাম… তার আগের রাতে এবং
সেদিন আমি নিরপরাধ বাঙালিদের উদ্বেগ নিয়ে দু-তিনটি কবিতা লিখি।
এর মধ্যে একটি… আমি উর্দুতে তরজমা করিয়ে বর্ষীয়ান কমরেড এম আর হাসান
পরিচালিত আওয়ামি আওয়াজ়-এ প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিই।
পরে কবিতাটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে, কী লাহোর কী
করাচিতে, সেনা-আমলাদের মধ্যে তা সাংঘাতিক
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। লাহোরে আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
কিছুদিন পরে আমায় গ্রেপ্তার করা হয়, আর করাচিতে এম আর হাসানকে এর
মাশুল দিতে হয়।
‘‘সে সময় আমার চার বছরের ভাইঝি তার মাকে শুধোয়, ‘কাকাকে পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করল?’
‘‘মা উত্তর দেয়, ‘কারণ তোর কাকা
ইয়াহিয়া খাঁয়ের বিরুদ্ধে একটা কবিতা লিখেছে।’
‘‘বাচ্চা মেয়েটি যুক্তি দেয়, ‘তাতে কী? ইয়াহিয়া খানও তো কাকার বিরুদ্ধে একটা কবিতা লিখতে পারে। গ্রেপ্তার করল কেন?’
‘‘মা তাকে দুঃখের সঙ্গে জানায়, ‘ইয়াহিয়া যদি কবিতা
লিখতে পারত, তাহলে নিজের দেশের মানুষদের সে খুন করতা না।’…
‘‘আমার দণ্ড হয়— ছ’মাস কারাবাস, ছয় ঘা চাবুক এবং ২০০০ টাকা জরিমানা, যা না দিতে পারলে কারাবাসের মেয়াদ বাড়বে। ফয়েজ় উক্ত অর্থ জোগাড় করে
কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেন যাতে আমার তাড়াতাড়ি মুক্তি হয়।26’’
আহমদ সালিম জানাচ্ছেন ফয়েজ় ও হাবিব জালিবের মতো বিখ্যাত কবি ছাড়াও এম আর
হাসান, সহর আনসারি, আনওয়ার আহসান
সিদ্দিকি, ফেহমিদা রিয়াজ়, আটা শাদ, গনি খান, শেখ আয়াজ় (সিন্ধি), গুল খান নাসির (বালুচি), আজমল খট্টক (পাশ্তু), আসিফ শাকদার, ডঃ আজ়িজ়ুল হক সহ
বহু বুদ্ধিজীবী, এমনকী পাকিস্তান বায়ু সেনার অফিসার ও সিন্ধি কবি
আনওয়ার পিরজ়াদো-র মতো মানুষেরাও ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের
গণহত্যার অব্যবহিত পরেই তার কঠোর নিন্দায় মুখর হচ্ছিলেন, মিছিল করছিলেন, জেলে যাচ্ছিলেন। কাজেই, একেবারেই কোনও খবর পৌঁছচ্ছিল না, এ যুক্তি ধোঁপে টেকে না। মুশকিল হল, যেহেতু এ সব
প্রতিবাদই প্রকাশিত হচ্ছিল স্থানীয় পত্রপত্রিকায়, বাংলাদেশ বা
কলকাতায় বসে বাংলাদেশীরা সেই প্রতিবাদের খবর একেবারেই পাচ্ছিলেন না।
আর সে কথা বুঝেই সম্ভবত, ফয়েজ় তাঁর বাংলাদেশী
পরিচিতজনদের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র ক্রুদ্ধ না হয়ে, আত্মপক্ষ সমর্থনের
গভীর দায় অনুভব করেছিলেন। যে কবিতা বহু আগে লেখা তাই শোনাচ্ছিলেন আহত হৃদয়গুলিকে।
রেস্তোরাঁয় বসে কোন কোন কবিতা শুনিয়েছিলেন ফয়েজ়? দুটি — ‘সেজেছে গণহত্যার মেলা’, আর ‘পরতে পরতে প্রাণের
ক্লেদ’ এবং ‘দু চোখে উপচে এলেও কোনও উপায়
ছিল না’ আসলে একটিই কবিতার দুটি পঙ্ক্তি। আমরা পড়ব অনতি
বিলম্বেই।
এক্ষণে আমাদের এক ঝলক ফিরতে হবে স্বরাজ্য পত্রিকার সেই প্রবন্ধে— প্রতিবেদক শুনেছেন ফয়েজ়ের ‘চিৎকৃত নীরবতা’। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে পল সাইমন ও আর্ট গারফাঙ্কলের যুগান্তকারী ‘বক্সার’ গানের সেই অভ্রান্ত
পঙ্ক্তিগুলো — ‘Still a man hears what he
wants to hear / and disregards the rest’। আমরা শুনবো রেস্তোরাঁর সে কবিতা
দুটো ও আরও কয়েকটা। সে জন্য আমাদের উল্টাতে হবে ‘নুসখাহা-এ-বফা’— বিশ্বাসের লিপিগুলি — ফয়েজ় আহমেদ
ফয়েজ়ের কবিতার সম্পূর্ণ সংকলন। এই সংকলনের পঞ্চম বইয়ের নাম সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। সিনাই উপত্যকার মাঝে। ১৯৬৭ সালে মিশরের সিনাই
উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলাকে কেন্দ্র করে যে ইসরায়েল-ফলস্তিন যুদ্ধ
হয়েছিল তার পরে ফয়েজ় বইটির এই নাম-কবিতাটি লিখেছিলেন। বইটিতে
সংকলিত কবিতাগুলিকে রচনাকালের নিরিখে প্রতি বছরে ভাগ করা হয়েছে। ১৯৬৫-র কবিতাগুচ্ছ দিয়ে শুরু হয়ে এই বাৎসরিক বিভাজন চলেছে ১৯৭১ পর্যন্ত। এরপর
দাগেস্তানের কবি রসুল হামজ়া-কে উৎসর্গ করে একটি বিভাগ আছে, পৃথক সূচি সহ তেরোটি কবিতার, যেগুলির রচনাকাল অনুল্লিখিত।
আমরা চলে যাবো ১৯৭১ চিহ্নিত বিভাগে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
এই সালে রচিত কবিতাগুলির থেকে সেই দিনকালে কবির হৃদয়ের অনুগততর ছবি আর হতে পারে
না। কী বলছে সে সব ছবি আমাদের? গোটা ১৯৭১-এ মাত্র ছ’টি কবিতা লিখেছিলেন ফয়েজ়, অন্তত প্রকাশ
করেছিলেন সে কটিই। সেটা অস্বাভাবিক নয়, শুধু স্বভাবেই নয়, কবি হিসেবেও অত্যন্ত মিতবাক ছিলেন তিনি। এই ছটি কবিতাই আমরা পর পর গভীর
মনোযোগে কান পেতে শুনব ওপরে উল্লিখিত পাকিস্তান-বাংলাদেশের
ঘটনাক্রম মাথায় রেখে। তারপর ভাবার চেষ্টা করব ১৯৭১-এর কবির কাছে আমরা
কী পেলাম—
১।
গজ়ল
এ নির্দয় পরিস্থিতির কোনও বর্ণনা হতে পারল না27
এবারও তো হৃদয়ের আতিথ্য হতে পারল না।।
ফের সেই প্রতিশ্রুতি যা স্বীকারোক্তি হতে পারল না
ফের সেই কথা বিশ্বাসের যোগ্যই যা হতে পারল না।।
ফের সেই পতঙ্গ যাকে বলা হল না শহিদ
ফের সেই প্রদীপের শিখা যা কোনও রাত পেতে পারল না।।
মদিরার মজা লোটার আগে, ফের সেই কলজেটা
কণ্ঠে উঠে আসা
ফের সেই আসর যা পানশালা হতে পারলনা।।
দর্শনের মুহূর্তে দুচোখ রইল ফের দৃষ্টির খোঁজে
ফের মিলনের রাতে সাক্ষাতই হতে পারল না।।
মাথার ওপর প্রতিদিন যে ধ্বংস গিয়েছে ফয়েজ়
একটা দিনও তো প্রায়শ্চিত্ত হতে পারল না।
(২৩ মার্চ, ১৯৭১)
২।
সাবধানে থেকো
এই দেহ থেকে28
সাজতেই যদি হয় কী করে
সাজবে বলো তো, এই মেলা
গণহত্যার
বলো তো, প্রলোভিত করবে কাকে আর্তনাদ এই রক্তের আমার
শীর্ণ এ শরীরে আমার
কতটুকু রক্ত আছে আর
জ্বলবে না প্রদীপ কোনও, ভরবে না তো কোনও পেয়ালাই
জ্বলবে না আগুন কোনও, মিটবে না কারও তৃষ্ণাই
ক্ষতবিক্ষত এই দেহে
কতটুকু রক্ত রয়েছে বাকি আর
শিরায় শিরায় শুধু ভরে আছে
বিষ
ছিদ্র করো, প্রতিটা বিন্দু বুঝি বিষের পারাবার
শত শত বছরের আঘাত আর
অপূর্ণ আকাঙ্খায় পরিশ্রুত বিষ
ফোঁটায় ফোঁটায় শুধু
গুমরানো ক্রোধ আর তাপ বেদনার
সাবধানে থেকো আমার এই
দেহ থেকে, এ দেহ বিষের
পারাবার
সাবধানে থেকো আমার এই দেহ
থেকে, এ দেহ মরুর
কাঠ
জ্বালিয়ে দিলে জ্বলে যাবে
করে দিয়ে বাগানের উঠোন উজাড়
জুঁই নয়, ধূপী নয়, বাবালার কাঠ— আমার হাড়
উড়িয়ে দিলে মরু থেকে
শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়বে শুধু
কঠোর জীবনের এই ধুলো, সৌরভে ভরা বাতাস এতো নয়
সাবধানে থেকো আমার এই দেহ
থেকে, এই প্রাণ
রক্তপান চায়
(মার্চ ১৯৭১)
৩।
স্তরে স্তরে প্রাণের এই ক্লেদ29
যদি দমকে দমকে আমার দু-চোখে আছড়েই পড়ে, আমি নিরুপায়
মেনে নিই তার কথা যে চিকিৎসক আমায় করে নিরাময়—
ক্লেদাক্ত এ দু-চোখ রক্তে ধুয়ে
ফেলি
ক্লেদাক্ত এ দু-চোখ রক্তে ধুয়ে
ফেলি আমি
এবার প্রতিটি মুখ
এ বিশ্বচরাচরের সব কিছু
আমার দু-চোখের রক্ত-রঙে রঙিন হয়ে গেল—
সূর্যের সোনালী রক্ত
রুপোলি রক্ত জ্যোৎস্নার
ভোরের হাসিও রক্তের
রক্ত কান্না রাত্রির
প্রতিটা গাছ রক্ত-মিনার, রক্তাক্ত চোখ প্রত্যেক ফুল
দৃষ্টিগুলো রক্তে গাঁথা, প্রতিটা ছবি রক্তে
ঢাকা
ধাবমান যতক্ষণ রক্তের ঢেউ রঙ তার টকটকে লাল
রঙ তার শহিদ হওয়ার আকাঙ্খা-উদ্বেল ব্যথা, গুমরানো ক্রোধ, শোক
আর থেমে গেলে করে দেয় কালো
শুধুই ঘৃণার রাত মৃত্যুর
প্রত্যেক রঙের শোকের রঙ
তুমি যে আমায় করো নিরাময়, চিকিৎসক, হতে দিওনা, হতে দিও না এমন
যেখান থেকে পারো বানডাকা অশ্রু নিয়ে এসো
ওজু করি, নিয়ে এসো জল
যদি সেই জলে মিশে যায় তবেই হয়তো যেতে পারে
আমার দু-চোখের, আমার ক্লেদাক্ত দু-চোখের রক্তপ্রলেপ
(৮ এপ্রিল ১৯৭১)
৪।
সোজা-সাপটা ভালোমানুষ ছিলাম এমনই, সবকিছুই স্বাগত বলে গ্রহণ করেছি30
হেমন্ত এল যখন ঝরিয়ে সব পাতা, এসে গিয়েছে বসন্ত
আমরা ভেবেছি।।
গোলাপি চোখের দৃষ্টি নিয়ে বাগান দেখেছি
যা দেখেছি সবকিছুতেই গোলাপ দেখেছি।।
করুণার একটু আশায় দু-জনেই তো বিষণ্ণতায়
ডুবে থেকেছি
তুমি তোমার আসরে আর আমি আমার নিঃসঙ্গতায় নিঃস্ব
বেঁচেছি।।
অভিন্ন হৃদয় হয়ে উঠতে পারিনি, অপরিচিত হয়ে যেতেও
পারিনি আমরা
হৃদয় চিরে এমন গেছে ভালোবাসার ছোরা।।
সাম্প্রদায়িক মেকিপ্রেম আর বিশ্বাসের শোরগোল বেজায়
ওখানে
ভাষাহারা একাকিত্ব আর লজ্জার তীব্র স্বাদ বজায়
এখানে।।
সেই দেহটার পানে তাকাও, বধ্যভূমি যা হয়েছে
হৃদয়ের
হাড়িকাঠে আর কী আছে দেখার কোনও দর্শকের।।
৫।
সব বন্ধু অচিন অপরিচিত হয়েছে বিলকুল31
অপরিচিতরা জেদ ধরেছে
তারাই নাকি প্রাণের আমার বন্ধু-সমতুল
নির্ভেজাল বন্ধু কোথাও একজনও কি আছে
সুরারসিক সক্কলে পাঁড় মাতাল হয়েছে
(১৯৭১)
শেষ হোক আঁধিঝড় হৃদি-আসরে32
কোথাও তো শেষ হোক ব্যথার কাফেলা, থামুক এসে কোনও ঠিকানায়
লাগুক তো কোনও তীরে দু-দণ্ডের এ জীবন, নয়তো বা থামুক হৃদয়।
কীসের ফুরসত, মাথায় আছড়ে পড়া
রক্তের ঢেউ আজও হয়নি তো শেষ
শেষ হলে হয়তো বা ঘাতকের হাত থেমে যায়।
আর ক’ পলক শুধু, সুরাতরণীর পাল কষে বেঁধে রাখো
শেষ হোক আঁধিঝড় হৃদি-আসরে, দু-দণ্ড শুধু আর থাকো অপেক্ষায়
এমন সম্মানের কে আছো যোগ্য, আজ আসরে থেকে যাও
বিষ ছাড়া কিছু আর বাকি নেই সাকির পেয়ালায়।
আমার এই নীরবতা হৃদয় ও ঠোঁটের মাঝে বিরতি বই নয়
আসলে তো এ তুফান, থমকে আছে এক লহমা
ঠোঁটের কিনারায়।
আগ্রহীর দৃষ্টি আর কত কাল সাজিয়ে যাবে পথের দুই ধার
ব্যথার মরুর কোথাও তো প্রিয়তমের পাল্কি এবার থামুক না
হয়।
কী পাই আমরা এই ছয় কবিতায়? বিষাদ, বিষাদ। কিন্তু ফয়েজ়ের কবিতায় বিষাদ কোনও বিরল আবেগ নয়। অন্তত তাঁর দ্বিতীয়
কাব্যগ্রন্থ ‘দস্ত্-এ-সবা’ (ভোরের হাওয়ার হাত) থেকেই তাঁর কবিতা মৌলিকভাবে বিষাদের। তবে, ফয়েজ়ের কবিতার যে অতুলনীয় মৌলিকতা তা তার বিষাদে নয়, বিষাদ উপচিয়ে এক
গভীর শ্বাশ্বত আশা, শুভের শেষ জয়ের প্রতি এক অনড় প্রত্যয়। আমার মনে হয়েছে
ফয়েজ়ের কবিতার নির্যাস ধরে রাখা কোনও পঙ্ক্তির হদিশ যদি করতেই হয়— তবে আমাদের আঙুল রাখতে হবে এ রকম পঙ্ক্তির ওপর—
‘‘প্রদীপ একটাই, ঘিরে রাখো বন্ধুরা
কিছু আলো এখনও তো বাকি, হোক না অল্পই।’’
কিংবা
‘‘হায়রে ব্যাধের বজ্রমুঠি, হায় ফুলছেঁড়া মালী
না থামাতে পারলি তোরা বুলবুলির ঠোঁট, না তো ফুলের সুবাস।।’’
১৯৭১ সালে লেখা ফয়েজ়ের এই কবিতাগুলি পড়ে চমকে উঠি।
বারবার পড়ি। ‘সাবধানে থেকো এই দেহ থেকে’ আর ‘স্তরে স্তরে
প্রাণের এই ক্লেদ’ কবিতা দুটোতে যে
চিৎকার, যে রক্তপাত, যে বিষ তিক্ততা আছে
তার তুলনা ফয়েজ়ের কাব্যসমগ্রে মেলা ভার। আমি অন্তত আর মনে করতে পারি না।—
‘‘এমন সম্মানের কে আছো যোগ্য, আজ আসরে থেকে যাও
বিষ ছাড়া কিছু আর বাকি নেই সাকির পেয়ালায়।’’
এরপর আর বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। এই কবিকে সইতে
হবে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনার গণহত্যার সময় ‘চিৎকৃত নীরবতা’-র অভিযোগ? ব্রেখ্টের কবিতার প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম — কেন নীরব ছিল ওদের কবিরা? সাংবাদিক জহুর হুসেন চৌধুরী সে
প্রশ্নই একটু ঘুরিয়ে তোলার তিন বছর আগে ফয়েজ় নিজের অজান্তেই তার উত্তর দিয়ে
দিচ্ছিলেন। তাই দিয়েই শেষ করি—
আমার এই নীরবতা হৃদয় ও ঠোঁটের মাঝে বিরতি বই নয়
আসলে তো এ তুফান, থমকে আছে এক লহমা
ঠোঁটের কিনারায়।
(আঁধিঝড় শেষ হোক হৃদি-আসরে)
*****
টীকা
1. ব্রেখ্ট মূলত সেনসরশিপ এড়ানোর জন্য নিজের কবিতায় হিটলারকে ‘বাড়িরংমিস্তিরি’ বলে উল্লেখ করতেন।
2. In Dark Times. Bertolt Brecht. Bertolt Brecht
Poems. Ed. John Willet and Ralph Manheim. P 174. Eyre Methuen. London. 1976
3. শ্রেষ্ঠ কবিতা। শঙ্খ ঘোষ। ভূমিকা। দে’জ। ২০০৪।
4. নক্শ-ই-ফরিয়াদি। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৬১-৬২।
5. এ বিষয়ে বিশদে জানতে হলে পড়তে হব— Reflections on Exile and Other Literary and Cultural
Essays. Edward Said. Granta. 2000
6. The Blood Telegram: Nixon, Kissinger
and a Forgotten Genocide. Gary J Bass. Vintage Books. New York. 2014. P350
7. কী ঘটেছিল বিশদে জানতে পড়ুন —
<https://thewire.in/rights/faiz-ahmad-faiz-iit-kanpur-hum-dekhenge>
8. <https://swarajyamag.com/politics/genocide-refugees-and-faiz-how-media-covered-the-1971-crisis-from-the-pages-of-the-illustrated-weekly>
9. Spring 1971. Faruq Aziz Khan. Agamee Parakashan. 2014.
P59-60.
10. রুমী বা এলিফ্যান্ট রোডের প্রসঙ্গ একান্তই না জানা থাকলে
পড়ুন — একাত্তরের দিনগুলি। জাহানারা ইমাম। জাহানারার
ছেলে তরুণ রুমী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরে তাঁকে পাকিস্তানি সেনা বাড়ি থেকে তুলে
নিয়ে যায়। তাঁর দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
11. ১৯৭১-এর ২৫-২৬ মার্চ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ট্যাঙ্কের গোলা ও মেশিনগান চালিয়ে শতাধিক ছাত্র, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীকে হত্যা করে। <https://www.shomoyeralo.com/details.php?id=175393>
12. মধুসূদন দে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন
চালাতেন। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনা তাঁর বাড়িতে হামলা করে তাঁকে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধুকে হত্যা করে।
13.
Ayub’s Diaries. Azizul Jalil. September 26, 2014. The Daily Star
<https://www.thedailystar.net/ayubs-diaries-43166>
14. The World as I Saw: Memoir of a
Commoner. Ahmad Ilias. Published by Tanjila Ilias. 2014.
15. ঐ। পৃ ৯১।
16. সূত্র — <https://www.dawn.com/news/1359141>
17. <https://www.bbc.com/bengali/news-59647929>
18. সূত্র —
The New York Times. June 28, 1974. <https://www.nytimes.com/1974/06/28/archives/bhutto-talking-with-bangladesh-pakistani-leader-arrives-on-mission.html>
19. Love and Revoltion: Faiz Ahmed Faiz:
Authorized Biography. Ali Madeeh Hashmi. Rupa. 2016. P 227
20. বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা
সুফিয়া কামাল ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘বিচিত্রা’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে শহীদুল্লাহ
কায়সারের (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭ – ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১) বিষয়ে এই কথাগুলি বলেছিলেন—
বিচিত্রা: সেই মাসগুলির সব থেকে স্মরণীয় ঘটনা কী ছিল?
সুফিয়া কামাল: ৭ ডিসেম্বর
শহীদুল্লাহ কায়সার আমার বাড়িতে এলেন। আমি তাঁকে তৎক্ষণাত চলে যেতে বললাম, কারণ গুজব রটছিল যে
পাকিস্তানি সেনা ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে বলে একটা তালিকা তৈরি করে ফেলেছে।
শহীদুল্লাহ কায়সার বললেন, ‘‘আমি ঢাকা ছেড়ে যাব না। আমি চলে গেল কাজ কে করবে?... কিছুদিন পরে শুনলাম আমার পরিচিতদের অনেককেই পাওয়া
যাচ্ছে না। শুনলাম পাকিস্তানি সেনা আর তাদের সহকারীরা শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী ও ডাঃ
ফজলে রাব্বী সহ বহু বিখ্যাত মানুষকে তাঁদের বাড়ি তুলে নিয়ে গেছে। সূত্র — < https://archive.thedailystar.net/suppliments/2004/victory_day/vic02.htm>
21. পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স।
22. সিগারেটের টান নিশ্চয়ই। বহু বহু বছর আগে কলকাতার বিখ্যাত
উর্দু কবি সালিক লখনওয়ি তাঁর সুতারকিন স্ট্রিটের বাড়িতে বসে আমাকে বলেছিলেন তাঁর
বন্ধু ফয়েজ় সাহেব তাঁদের দীর্ঘ আড্ডার গোড়াতে একবার দেশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাতেন, তারপর আড্ডার সারাক্ষণ তাঁর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলত
কিন্তু দেশলাই দিয়ে কেউ তাঁকে দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালাতে দেখত না। আক্ষরিক অর্থেই
চেন-স্মোকার ছিলেন।
23. ঢাকা সে ওয়াপসি পর। শাম-এ-শহর-এ-ইয়ারাঁ।
নুখাহা-এ-বফা। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৫৩৮
24. ফয়েজ় নামা। ডক্টর আইয়ুব মির্জ়া। পৃ ৩০১-৩০৮। অ্যাপলায়েড পাবলিকেশন্স, নিউ দিল্লি।
25. We Owe an Apology to Bangladesh. Ed. Ahmad
Salim. Sahitya Prakash. Dhaka. 2012
26. ঐ। পৃ ২৩৫-২৪৫।
27. গজ়ল। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৪৫৭
28, হজ়র করো মেরে তনসে। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা।
নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৪৫৯-৬০
29. নজ়্ম। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৪৬১
30. হজ়র করো মেরে তনসে। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি,
১৯৮৬। পৃ ৪৬৩
31. ইয়ার আঘিয়ার হো গয়ে হ্যায়ঁ। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি,
১৯৮৬। পৃ ৪৬৪-৬০
32. গুবার-এ-খাতির-এ-মহফিল ঠহর যায়ে। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুখাহা-এ-বফা। এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি,
১৯৮৬। পৃ ৪৬৫