কবিতা - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in কবিতাকোন জাতির জীবনে তাকেই আমরা চরম দূর্যোগের সময় বলে থাকি যখন মামুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন, নীতি ও আদর্শের অভাব দেখা যায়। এমনই এক সন্ধিক্ষণে জন্নম গ্রহণ করেন ভগবান বুদ্ধ। তাঁর প্রেম ও আদর্শের বাণী প্রাণিত করেছিল সকল স্তরের মানুষকে। বুদ্ধের নীতিনির্ভর জন্মকাহিনির সংকলন যাকে বলা হয় ’জাতক’সেই মহাগ্রন্থ থেকেই নেওয়া হল তাঁর দুটি পূর্বজন্মের কাহিনি।প্রকৃতপক্ষে ‘জাতক’ হল বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মের গাথা ও কাহিনির সংকলন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে—‘জাতক’ প্রাচীনতম গল্প সংকলন। প্রায় পাঁচশোরও অধিক গল্প আছে এতে। কিন্তু শুধু কাহিনিই নয়, এই কাহিনিগুলিতে পাওয়া যায় তৎকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার ও জীবনযাপনের চিত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কাহিনিগুলিতে পাঁচটি বিভাগ বা স্তর আছে। সূচনাপর্ব, মূলকাহিনির বর্ণনা, প্রাচীন উপকরণ, গাথা বা কাহিনিগুলির অর্থ এবং বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যাখ্যা। কিন্তু যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল জাতক থেকে প্রাপ্ত নৈতিক শিক্ষা। শীল-অশীল, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় এগুলি বোধগম্য হয় সহজেই।
আসন্ন বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে ‘জাতক’ থেকে দুটি কাহিনি কবিতা বা ছন্দের আকারে বর্ণনা করার দুঃসাহস হয়েছে নিছক আনন্দের তাগিদে। পাঠকের ভালো লাগলে কৃতজ্ঞ থাকব।
‘জাতক’ কাহিনিমালা থেকে কবিতায় রূপান্তর পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে দুটি কাহিনি —‘অশ্বজাতক’ ও ‘সুবর্ণহংসজাতক’।
.
১) মঙ্গলাশ্ব ( ‘অশ্বজাতক’ থেকে)
পুরাকালে সিন্ধুদেশে ছিল এক অশ্ব
নাম অজানেয়
শৌর্যে-বীর্যে অতি পরাক্রম, শক্তি অপরিমেয়
ক্রমে অশ্ব আসি পঁহুছিল বারাণসী ধামে
ব্রহ্মদত্ত রাজার আলয়
খ্যাতি বর্ধিত হইল তাহার মঙ্গলাশ্ব রূপে
পাইল সকলের বড়ই আদর
অকস্মাৎ একদিন সাত জন রাজা
করিল আক্রমণ বারাণসী রাজে
কহিল—যুদ্ধ কর, নতুবা দিব দখল
তোমার সাম্রাজ্যে।‘
হইল শলা-পরামর্শ মন্ত্রণাসভায়
অজানেয়-অশ্বারোহী কহিল ফুকারি--
আছে মোদের মঙ্গলাশ্ব অজানেয় নাম
যদি অনুমতি দাও রাজন্ পরাইতে যুদ্ধসাজ
ফেলিব ভূতলে ওই সপ্ত তরবারি’
ক্রমে ক্রমে অশ্বারোহী অজানেয়রে লয়ে
জিনিলেন ষষ্ঠরাজা, আনি দিলা ষষ্ঠ তরবারি
রাজার চরণে
ক্লান্ত, শ্রান্ত অজানেয় বুঝি আর নাহি পারে
হইবে কি তবে হার বারাণসীরাজের এক্ষণে?
ফেলি দিয়া সব ক্লান্তি, উঠিল অজানেয়
আবার পরিল যুদ্ধসাজ
দ্বিগুণ তাহার শক্তি হইল অপরিমেয়
অশ্বারোহী জিনিলেন সপ্তমরাজারে, তরবারি লয়ে রাজদরবারে
কহিলেন—প্রণতি হে রাজ!’
রক্তাক্ত দেহ, ক্লান্তিতে জরোজরো অজানেয় দাঁড়াইল আসি
রাজার সমুখে
অশ্বারোহী খুলি দিল যুদ্ধসাজ দেহ হতে তার
রাজার মঙ্গলাশ্ব ত্যাজিলেন প্রাণ হাসিমুখে
বীর বিক্রমে
শিক্ষা নিল রাজ-মন্ত্রী-মহারথীগণে
অজানেয়রূপী বোধিসত্ত্ব হতে
অগ্রে কর্মসম্পাদন তাহার পর মৃত্যুবরণ
ইহাই যথার্থ ধর্ম আপনার চিতে।
২) অথ সুবর্ণহংস কথা (‘সুবর্ণহংস জাতক’ থেকে)
ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিল বারাণসী ধামে
ব্রাহ্মণকুমার রূপে বোধিসত্ত্ব তথায় জন্মে।
আছিল তিন কন্যা তাহার রূপ-গুণবতী
নন্দা, সুন্দরীনন্দা আর নন্দাবতী।
যথাকালে ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্ব গতি প্রাপ্ত হইলা
পুনরায় সুবর্ণহংস রূপে তথা জনম লইলা।
রমণীয় দেহ হংসের গাত্রে সুবর্ণ পালক খচিত
অকস্মাৎ পূর্ব স্মৃতিতে উদ্বেল হইল যে চিত।
দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছিল দরিদ্র ব্রাহ্মণী
তিনটি কন্যা ছিল তাহার রূপেতে লাবণী।
কন্যাগুলি মাতাসহ এক্ষণে দাসীবৃত্তি করে
সুবর্ণহংস ভাবে দারিদ্র্য ঘুচাবে কিরূপে?
আছে স্বর্ণপঙ্খ মোর না জানে তাহারা
প্রতিদিন বেচিলে মুদ্রা পাইবে উহারা।
ধন পাইবে রাশি রাশি দারিদ্র্য ঘুচিবে
প্রত্যহ একটি করি যদি পালক তথা দিবে।
এত ভাবি সোনার পঙ্খ একটি করিয়া
হংস দেয় ব্রাহ্মণীরে শতেক চিন্তিয়া।
প্রতিদিন স্বর্ণপঙ্খ পাইয়া ব্রাহ্মণী
লোভে কাতর হইলা সে পাইতে সকলই।
কন্যাদের সঙ্গে মাতা করে আলোচনা
হংসের স্বর্ণপঙ্খ উৎপাটিতে বড়ই বাসনা।
একাধিক স্বর্ণমুদ্রা পাইলে একসাথে
ত্বরিতে ঘুচিবে দশা সন্দেহ নাই তাতে।
পিতার দুর্দশা ভাবি কন্যাগণ নিষেধ করিল
লোভী ব্রাহ্মণী কথা কিছু না মানিল।
অগোচরে একদিন ব্রাহ্মণী হংসেরে ধরিয়া
আছে যত স্বর্ণপঙ্খ নিল উৎপাটিয়া।
বিস্ময়ে চাহিয়া দেখে পতিত স্বর্ণপঙ্খের স্তুপে
নিমেষে পরিণত তাহা শ্বেতহংস পালকে।
হায় হায় করি রমণী হংসে লুকায়ে রাখে
হংসে রাখি জালার ভিতর উপরেতে ঢাকে।
কিয়ৎদিন পর হংসের পুনঃ পালক জন্মিল
কিন্তু তাহা শ্বেতপঙ্খ, স্বর্ণ না হইল।
সুযোগ বুঝিয়া হংস সংসার ছাড়িল
গেল কোনখানে তাহা কেহ না জানিল।
যাহা আছে তাহাতে যদি না ভরে চিত্ত
অতি লোভে ব্রাহ্মণীর দশা পাইবে নিশ্চিত।