ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১৬)
শৈলবালা এবারে ভীষণ ভয়ার্ত চোখে গোলকপতির দিকে তাকিয়ে আবার পরক্ষণে নিজের চোখদুটো তখুনি বুজে ফেলল।
যদিও এখন ওর মাথা ঘোরাটা একটু কমেছে তাও যেন ভয়ে খুব বুক ঢিপঢিপ করছে। একটু পরেই তো ওর খোঁজ পড়বে, আর সবাই এই জায়গাটা তোলপাড় করে তুলবে আর মারধোর করবে । তারপর সব শেষে ওকে বুড়োটার সাথে চিতায় উঠিয়ে ও পুড়িয়ে মেরে সতী মাহাত্ম্য প্রচার করার জন্য মুখিয়ে আছে।
মনে পড়ছে দশ কি এগারো বছর বয়সে ঋতুমতী হওয়ার পরেই তো তার বাপের বাড়িতে থাকার মেয়াদ ফোরালো। ওদের তেঁতুলতলা গ্রামে সেই ন'বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরে নতুন সৎমার মুখে আপদবিদায়ের তাড়ায় নিশ্চিন্ত হয়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারের সামান্য আয়োজনে হয়ে যাওয়া সেই বিয়ের ঝাপসা হয়ে আসা কিছু স্মৃতি এখনও তার মনে আছে।
তারপর শ্বশুরবাড়িতে এসেও স্বস্তি নেই। তার বদলে দীর্ঘ কিছু বছর ধরে বৃদ্ধ পতিটির সাথে এবং তার অগণিত সপত্নীদের বিনা মূল্যের দাসীবৃত্তি করাটাই যেন একটা চিরাচরিত নিয়মের মধ্যেই পড়ে গেছিল।এরমধ্যে দু'একজন মাতব্বর দেওরগোছের ছোকরারা যে একটু আধটু ব্যাভিচারের ইঙ্গিতটিও কখনো দেয়নি সেটাও যেন মুখ ফুটে নিজের বাপের বয়সী সোয়ামীটিকে মুখ ফুটে বলা বারণহয়ে রইল।
সধবার সিঁদূরে সিঁথি রাঙিয়ে থাকার বদলে এতদিন ধরে তাকে সহ্য করতে হয়েছে প্রতিপদে সে পেয়েছে ক্রমাগত সতীনকাঁটায় বিদ্ধ হওয়াটাই।
সোয়ামীর সোহাগ তো এ জন্মে জোটেনি।
আর পেটের মধ্যেও নড়েচড়ে ওঠেনি কোনও সন্তানের অস্তিত্ব। অথচ আজ তাকেই সব কিছুর পরিণামে চিতাগ্নিতে উঠতে হবে? সহমরণের এই অদ্ভূত পরিণতিটি দেখতে পাওয়ার বদলে ওর মরা মা আঁতুড়েই যদি ওকে বিষ এনে খাওয়াতে পারত তাহলে সৎমা'র কাছে বা শ্বশুরবাড়িতে এসেও বোধহয় এতটা বাড়াবাড়ি হতনা।
আজ শেষবারের মত নিজেকে যেন মরীয়া হয়ে উঠতে দেখতে একবার ইচ্ছা করছে। তবে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া একজন অসতী 'মেয়েছেলে'র ব্যাভিচার না সতী হয়ে আগুনে জ্বলে মরতে বসা! এদুটোর মধ্যে কোনটা যে বেশী শ্রেয় সেটা ভাবতে গেলেই নিজের মাথার ভেতরটা কেবল গুলিয়ে যাচ্ছে। দুটো ঘোলাটে চোখ শেষমেশ আবার তার স্বাভাবিক বাঙ্ময় অবস্থাটি থেকে অনেকদূরে নিজের ঠিকানাটা আবার হারিয়ে ফেলবার আগে সে টের পাচ্ছিল একটি পেশীবহুল ও কবোষ্ণ বাহুবন্ধন তাকে ঘিরে রেখেছে পরম মমতায়। তখন তার কানে থেকে থেকেও আসছিল দুটি দূরাগত মহাজাগতিক শব্দের উচ্চারিত পুনরাবৃত্তি , "... চলো পালাই " !
........
আজকের সকালবেলা বেড়াতে এসে রামমোহন দেখছিলেন যে নিমতলা ঘাট সংলগ্ন এলাকাটি যেন একটা কিসের ভয়ে বেশ থমথমে হয়ে আছে। যদিও দাহকার্য্য যেমন চলার তা চলছে তবুও যেন আড়ালে সবাই তাঁর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। যদিও মজবুত দেহী রামমোহনকে দেখে সচরাচর লোকে মান্যজ্ঞান করে থাকে, তাও আজ যেন সবাই কিসের যে একটা চাঞ্চল্যে বা ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে সেটা ঠিক বোধগম্য হলনা।
একটি খোঁড়া ভিখারী ছেলে অনেকক্ষণ তাঁর পিছনে 'ভাত খাব! ভাত খাব' বলে ঘুরছিল। ছেলেটিকে দেখে বেশ চালাকচতুর মনে হতে তিনি ওকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন। তারপর ছেলেটির হাতে ধরা মালসাটির বদলে তিনি ওকে কিছু বাড়তি পয়সা আর একবান্ডিল ' সংবাদ- কৌমুদী' ধরিয়ে তাকে সেগুলি ঘাটে আসা লোকেদের কাছে বিক্রয় করে আগামীকাল খাদ্যসন্ধান করতে বললেন।
অমৃতস্য পুত্রাঃ হয়ে মানুষ তার ক্ষমতার প্রতি সন্দিহান হয়ে কেবল ভিক্ষাজীবি ও পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকবে সেটা রামমোহন কখনোই যেন ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারেন না।
ওকে বললেন যে তিনদিন পর তিনি আবার যখন এদিকে আসবেন তখন আরও একবান্ডিল কাগজ আবার তাকে দিয়ে যাবেন।
এবারে যেন নিজের মনেই হাসলেন রামমোহন। এই কদিন আগেও এসব তাঁর সতীদাহ বিরোধী অনেক জ্বালাময়ী প্রবন্ধস্বরূপ অস্ত্রের অস্ত্রাগার ছিল, যা আজ আর কালাকালের গর্ভে হারিয়ে যেতে চাওয়া কয়েকটি নথির বেশী তাদের আর কোনও মূল্য তাঁর কাছে নেই। অগত্যা, কোচম্যানটিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্রফুল্লমনে তিনি মির্জাপুরের পথ ধরলেন।
.....
আজ দ্বিপ্রাহিক আহারের কিছু আগে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্র এসে দর্পনারায়ণ ঠাকুরদের বাড়িতে আগামী পরশুদিন একজন গর্ভবতী নবোঢ়ার সাধভক্ষণের শুভ অনুষ্ঠানের জন্য সেখানে সপরিবারে রামমোহনকে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানাতে এসেছিল। এইসব পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের সংখ্যা এতই বেশী যে এসব অনুষ্ঠান সারাবছর ধরেই লেগে থাকে।
বন্ধুবর দ্বারকানাথ এখন বৃহত্তর পিরালী-ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর এখন একজন হর্তাকর্তা বিশেষ। এদের অন্য শাখার ঠাকুর নামাঙ্কিত পরিবারটিও পাথুরিয়াঘাটায় যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসাবে পরিচিত।যদিও পাথুরিয়াঘাটা আর জোড়াসাঁকোর মধ্যে আক্ষরিক ভৌগলিক দূরত্ব খুব কম, তবুও ধনীক সমাজে সে-ই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত এক নব্যধনী।
যদিও শহরে বসে বিলাস ব্যসনে ডুবে থাকার বদলে সে এখন কয়লা খনির ব্যবসার কাজে অনেকগুলি দেশীয় রাজন্যবর্গের সাথে ইংরেজ কোম্পানীর দৌত্যে নিয়মিত সহায়তা করে থাকে বলে তার এখন ব্যস্ততাটিও বেড়েছে।
তাই তার অন্যতম পুত্র দেবেন্দ্র এখন সবে কৈশোর অতিক্রমণ করছে বলে সে এখনই তার পিতার একজন যোগ্য সহকারী হিসাবে বেশ নন্দিত ।
যদিও বাল্যকাল থেকে সে রামমোহনেরও খুব প্রিয় পাত্র ছিল। এর কারণটি হল এই যে, সমবয়সের কারণে পুত্র রাধাপ্রসাদ আর দেবেন্দ্রের মধ্যে তিনি কখনই সেইভাবে ভেদাভেদ করতেন না।
রামমোহনের বাড়ির বাগানে খেলা করতে করতে সে তাঁর বিশালকায় উন্মুক্ত বক্ষদেশে কুন্ঠাবিহীন সহজতায় লাফিয়ে মজা পেত আর খিলখিল করে হেসে উঠত।
.......
যদিও আজ সে এখন ধীরে ধীরে পিতার যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে উঠছে বলে সে এখন নানারকম সামাজিক কার্য্যেও তাকেও ঘনঘন দেখা যাচ্ছে।
দেবেন্দ্রকে আলিঙ্গন করে তিনি তাঁর জোব্বার ভিতর থেকে কয়েকটি আখরোট আর কিশমিশ বের করে দিতে দিতে বললেন সে যেন রাধাপ্রসাদের সাথে আজ এখানেই আহার করে যায় ও তাকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলে।
পৌত্তলিকতার আতিশয্য তিনি এখন আর মেনে নিতে পারেননা বলে শালগ্রাম শিলার উপস্থিতিটিএ তাঁর পছন্দ নয় বলে এখন সেভাবে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াটা এড়িয়ে চলেন।
তবে দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাড়িটিতে যেহেতু ওসবের বালাই থাকেনা বলে মাঝেমাঝে সেখানে গেলে নিজেও বেশ খুশী হন। দ্বারকানাথ যদিও প্রকাশ্যে হিন্দুয়ানী বর্জন করেনি তাও ওর মধ্যে গোঁড়ামি অনেক কম।
সতীদাহ বিরোধী অনেক জমিদারের স্বাক্ষর সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে সংগ্রহ না করলে বেন্টিঙ্ক সাহেবের কাছে তিনি বড়ই অপ্রস্তুত হতেন।
রামমোহন এখন একটা অন্য বিষয়ে চিন্তিত।
এ দেশে মেয়েদের পুড়ে মরাটা এখন আইন করে আটকানো গেলেও এদের বেশীরভাগই অশিক্ষাজনিত কারণে দূর্বল।
এর ফলে এদের অনেকেই আত্মীয়স্বজনের কাছে ভ্রষ্টা হয়ে শেষমেশ বনিতাপল্লীতে গিয়ে উঠছে। তাই এসব দেখলে মাঝে মাঝে নিজের মনে হয় যে সতীদাহ হয়ে পুড়ে মরাটা যতটা মর্মান্তিক বিষয় এটাও তার চেয়ে কিছু কম নয়। স্বামীহীনা মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার উপায়টা বের করাই এখন বেশী দরকার।
তবে রামমোহন কি আর পারবেন, তাঁর জীবদ্দশায় আর একটি অসম ও মানবিক লড়াইতে নতুন করে নামতে?
........
কপালে অজস্র ভাঁজ থাকা সত্ত্বেও দেবেন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে তাকে পরম যত্নে সঙ্গে করে নিয়ে তিনি ভিতরবাড়ির দিকে গেলেন। দেবেন্দ্রর মুখশ্রীতে একটা মায়াময় ও জিজ্ঞাসু মনোভাব তিনি সর্বদা দেখতে পান।
সেবার সে একটি কঠোপষনিৎের একটি সংস্কৃত পুস্তিকা নিয়ে রামমোহনের কাছে এসেছিল।
এসব জানার ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক জ্ঞানপিপাসা আছে সেটা তাঁকে বরাবর মুগ্ধ করে। গৃহাভ্যন্তরে রামমোহন এখন গৃহস্বামী ও রাধাপ্রসাদের পিতা। তাই এসব জটিল ন্যায় নীতি ও বিষয়ভাবনা দূরে রেখে সামনে সাজানো রোহিৎ মৎস্যের একটি অতিকায় কষায়িত মুন্ড ও পলান্ন সহযোগে তিনি পুত্র রাধাপ্রসাদ ও পুত্রপ্রতীম দেবেন্দ্রের সাথে কৌচ টেনে নিয়ে একসাথে আহারে প্রবৃত্ত হলেন।