গল্প - কুমকুম বৈদ্য
Posted in গল্পএকটা ঝিরঝিরি বৃষ্টির অপেক্ষা করে উপল, একটা ভাঙ্গা ছাতা সম্বল করে বেরিয়ে পড়ে ফুটো পকেটে| উপল মানে আমাদের উপলের অবস্থা বেশ সঙ্গীন, বি.এসি. সি পাশ করার পর এদিক সেদিক দু চার খানা অফিসে কোনটাতে সাড়ে তেরো দিনের বেশি টিকতে পারে নি , প্রত্যেকটাতেই ১৪ দিনের লাঞ্চ টাইম পার করে সে দাসত্ব শৃঙ্গল ঘুচিয়ে পালিয়ে এসেছে| পাড়ায় দুটো বাড়িতে পালা করে সাড়ে তিন জন ছাত্র পড়ায় সে, আসলে দুজনের জন্য পয়সা পায় বাকি দেড়খান সে ফ্রিতে নিজ উদ্যোগে পড়ায়| হাফ ছাত্র হল চঞ্চল, কারণ সে এতটাই চঞ্চল যে মুখে মুখে পড়া ছাড়া, লেখালিখির খাতার সাথে ভাব করানো যায় নি এখনো| এই দেড়া ছাত্রদের আসলে উপলের মত মা বাপের পাট মিটে গেছে, একান্নবর্তী পরিবারে খিদমত খাটে| স্কুলে যাচ্ছে কিনা , খাচ্ছে কিনা খোঁজ নেবার কেউ নেই| এদের জন্যই উপলকে পাড়ায় ফিরতে হয় রোজ রাতে| হ্যাঁ যা বলছিলাম উপলের ভাঙ্গা ছাতা, সেটা তাকে মা কিনে দিয়েছিল ক্লাস সেভেনে, হাতল ভেঙ্গেচুরে খুলে পড়ে গেছে, কাপড়েও বিস্তর ফুটো| যদিও এতদিনে উপল পাখিদের মত ভিজতে অভ্যস্ত , ছাতার প্রয়োজন বিশেষ নেই, খোলাখুলির ঝামেলা বিশেষ করে না, যদি আরো একটা শিক ভেঙ্গে পড়ে| জামা প্যান্টও বেশ পুরোনো| সেও বছর সাতেক আগে লাস্ট কেনা হয়েছিল| এ বিষয়ে উপল বেশ যত্নশীল, জামা যাতে ফিট করে মেপে মেপে খায়, সারা দিনে খাই খরচ সাড়ে তেইশ টাকা|
আপনারা এতক্ষনে ভাবছেন এর সব কিছুতেই আধা. আসলে পুরো হতে গেলে যা যা লাগে তার কোন কিছুতেই উপলের বিশেষ উৎসাহ নাই| তবে বৃষ্টি পড়লে ছাতাটা সে সাথে রাখে, ঝড় বাদলে একটা সঙ্গী নিয়ে বেরোনো ভালো| কত লোকে কত কারণে ঘরছাড়া হয়, উপলের কারণটা বৃষ্টি, বেশ আদেখলে ইচ্ছে বটে| তবে উপন বলে তার বৃষ্টি নেশা, বৃষ্টির জলে ভিজে ন্যাতানো বিড়ি খেতে খেতে সে শহরের দৃশ্য জমায় মাথার মধ্যে আর বিশ্লেষণ করে পরে সময় মত| ও বলে গরু খায় কেন? তুমি আমি বলি খিদে পায় বলে| উপল বলবে উহুঁ হল না গরু খাবার খায় পরে মনের সুখে জাবর কাটবে বলে| জাবর কাটা খুব স্বাস্থ্যকর, চুপচাপ বসে না থেকে তবু একটা কাজ করা তো হয়| তেমনি উপলও জাবর কাটে|
আজ তেমনি একটা নেশা করার দিন| রাত দুটোর সময় যখন তার সাড়ে ছয় নম্বর গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া চতুর মুঠোফোন সে দেখেছিল ১ এ.এম এ বৃষ্টি হতে পারে, তখনই তার ঘুমটা আনচান করছিল| সেই ঘুমের বেড়া ডিঙিয়ে ভোর পাঁচটার সময় পিঁচুটি সুদ্ধ চোখে বগলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে |বাইরে বেরিয়েই তার গায়ে শীত শীত করলো , একটা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট পরে বেরিয়েছে সে, যার পকেটের একপাশ ছিঁড়ে গেছে| গলির মুখে গোষালদের ভাড়া বাড়ির একটা জানলা খোলা, সে উঁকি মেরে দেখল একটা আধ ল্যাংটা লোক তার সোয়া ল্যাংটা বৌ জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে | বউটা সে অ্যাসিউম করল কারণ এইবাড়িতে যারা ভাড়া থাকে তারা বেশ্যা বাড়ি যেতে পারে, কল গার্ল বাড়িতে ডাকার পয়সা নেই| আচ্ছা ওরা কি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কিছু করে? তারই মতো আরো একজন উঁকি দেবার চেষ্টায় আছে ওদের জানলায়, উপলকে দেখে কেমন সুট করে পাতলা হয়ে গেল| উপল এদিক ওদিক তাকিয়ে উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দা পেরিয়ে সামনে পড়ল লোকটা, তাকে দেখেই হলুদ দাঁত গুলো বের করে চত্রিশপার্টির হাসি দিল| উপল চোখ নাচিয়ে শুধোলো কি মতলব? বলল ,তেমন কিচু নয়, মদন কাল দুটি লুপুর লে এসেচে দাসের দোকান থেয়ে , তাই ভাবলুম আঁকশি গইলে বৌটার পা দিয়ে খুলে নি, বর জড়িয়ে শুয়ে আচে মালুম হবে নি| তা পেলে? কি? নুপূর? ধূস মাগীর পা খালি| মদন কার জন্য নেচে কে জানে, তাও ওর মার নোয়া বেচে নিচে| যাক এ নিতান্ত ছোটলোকি কান্ড কারখানা, বউটার পায়ে লোম আচে কি ? মাথার মধ্যে একটা ফটো উঠে গেল একটা বৌ , তার উরু অবধি কাপড় তুলে বরকে বুকে জড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে আর তার লোমশ একটা পা উপরের দিকে উঠে আচে , তাতে একটা নুপূর|বাহ বেশ একটা জব্বর ওয়েল পেন্টিং আর্ট ধরা পড়েছে| হো হো করে হাসি এল উপলের, তার হাসি দেখে চোরটা আবাক হয়ে পাগল নাকি বলতে বলতে চলে গেল|
তারপর এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ভোরের জাল বাতাস গায়ে মেখে মেখে উপল এসে দাঁড়ালো ময়দানের কাছে, ভিক্টোরিয়ার পরী আজ ঘুরবে , ওর মন বলছে, ঝোড়ো হাওয়া তেমন নয়, তবে ও জানে ২০ কিলোমিটারের বেশি জোরে হাওয়া হলেই পরী ঘোরে, এ ওর বহু দিনের রিসার্চ, যারা বলে ভিক্টোরিয়ার পরী ঘোরে না তারা শালা আসল খবরটাই রাখে না, বড় বড় বাড়ি তুলে দিয়ে হাওয়া আটকে পরীকে ঘুরতে বললে পরি ঘুরবে না, পরীর ডানায় হাওয়া লাগাতে হয়| ওই একটু ঘুরলো যেন, উপলের চোখদুটো বুজে আসছে, পিঁচুটি আর জল , আগের রাতের আধভাঙ্গা ঘুম সব আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে উপলকে|পার্কের যে বেঞ্চিটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে মুখ করে আছে বলে উপল জানে, সেইখানে শুয়ে পড়ল| বৃষ্টির জোরটা বাড়ছে, ছাতাটা বুকে জড়িয়ে , জামার হাতা দুটো পরির মতো দুদিকে ছড়িয়ে| বৃষ্টিতে খোলা বেঞ্চ ঘুম কি সুখ! হুড়ো হুড়ি নেই, সারা শরীর ভিজে শিরশির করে|
ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে যখন উঠল বৃষ্টির বেগ তখন অনেক কম, সারা হাত পায়ে জল হাজা উঠেচে, বুপসে গেচে হাত পার চামড়া এইবার চায়ের দোকান খোঁজা দরকার| উপলের পয়সাকড়ি এক্কেবারে যে নেই তা নয় তবে বর্ষার দিনে ও পয়সার ধার ধারে না এটাও একটা নেশা | চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দোকানি গরম গরম এককাপ আদা দেওয়া চা হাতে ধরিয়ে দিল, বৃষ্টি বাদলে খদ্দের কম, এখন আর উনুন জ্বালায় না , গ্যাসে জ্বলে| আর চা করে ফ্লাস্কে রেখে দেয়| সকালের দিকে এলে তবেই গরম চা মেলে চায়ের দোকানগুলোতে| নির্দিধায় হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে আয়েশ করে খায় উপল, আহ কি দারুণ শান্তি গলার নদীর মতো ঠান্ডা একটা জায়গায় সাবমেরিনের মধ্যেকার ওম উপভোগ করে সে| আর তার পরের ঘটনাটা ভেবে মনে মনে ভুসভুসিয়ে হাসতে থাকে| খেতে খেতে চট করে চায়ের কাগজের কাপ হাতে নিয়ে বৃষ্টির জল ধরতে ধরতে ছুট লাগায়| অমন জোয়ান ছেলের এই কির্তী দেখে দোকানী কিছুটা হতবমম্ভ তারপরে আরে ও ভাই আমার চায়ের দাম, চায়ের দাম বলে চেঁচাতে লাগল , বৃষ্টিতে ভিজে যাবার ভয়ে ধাওয়া করল না|এই যে খুচরো চুরি এতে উপলের একটুও অনুশোচনা নেই| এই যে জল , গ্যাস, চা পাতা সবই প্রকৃতির দান| বিনিময় প্রথার সুবিধার জন্য যে টাকা মানুষে চালু করেছিল তা পৃথিবী শুদ্ধু মানুষের অসুবিধার কারণ| সারা পৃথিবীর কোথায় কি আছে জেনে নিয়ে যে পেরেছে তার দখল নিয়েছে , তারপরে ছবি এঁকে ভাগা ভাগি করে দেশ রাজ্য কিসব বলে ডাকা ডাকি করে মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, পাখিদের মধ্য়ে এইরকম অসভ্যতা নেই|
বৃষ্টিটা এইবার ধরে এসেছে কিন্তু আকাশে কালো মেঘ, দুর্যোগ বলতে যা বলে তাই, রাস্তাঘাটে বিশেষ লোকজন নেই, শহরের ছেলেমেয়েরা জলকাদায় রাস্তায় নামে না নাক সিঁটকোয়| বৃষ্টিতে কলকাতা শহরের একটা জিনিস উপলের জব্বর লাগে বৃষ্টির জল, ড্রেনের জল, মুত সব একাকার , তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ম্যানহোল খোলা থাকলে তলিয়ে যাবে, বেশ মজার ব্যাপার বলে মনে হয়, তবে উপলের সে সৌভাগ্য হয় নি, একবার লেক মার্কেট চত্তরে প্রায় গলা অবধি ডুবে গেছল তবে তাই কিচ্ছু হয় নি| শুধু পরের দু দিন গা চুলকেছিল বেশ লাগে চুলকে চুলকে ছিলে গেলে জ্বালা জ্বালা করে| উপল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল| খুব জোরে বাজ পড়ল, খুব কাছেই মনে হয়, বাইপাশের ধারে কতগুলো নারকেল গাছের মাথা নেড়া| বাজ পড়লে আর সে গাছে নতুন পাতা গজায় না| নারকেল গাছ দিয়ে যদি খাট বানানো যেত , তাহলে মানুষগুলো ডেকে ডেকে বাজ ফেলত| গাছ কাটা বারণ তো সরকার থেকে| বাজ পড়া নারকেল গাছ একটা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, কেমন নাকের উপর কাঁচকলা দেখাচ্ছে|
হাঁটতে হাঁটতে উপলের জামা শুকাচ্ছে গায়ে, তবে ভালোভাবে শুকাতে পারছে না, বাতাসে জলীয় বাষ্প এত বেশি টানছে না| উপলের গলার কাছটা খুশ খুশ করছে আর হাঁচি আসছে| আহা কদিন আগে পর্যন্ত কেউ হাঁচলে এলাকা ফাঁকা হয়ে যেত|
সামনের মন্দিরে ভোগ বিতরণ করছে, উপল জানে যত বড় বড় মন্দির আছে দক্ষিনেশ্বর থেকে পুরীর মন্দির, ছেলেবেলার মা বাবার সাথে গেছিল সব জায়গায় ভোগ বিক্রি করে, কিনে নিতে হয় পয়সা দিয়ে| দানের পয়সায় হয় না ওদের ভোগ ও বোক্রি করে পুরো দোকান শালা, ভগবানের দোকান| মসজিদের সামনেও দেখেছে জড়ুবুটির দোকান, চার্চের ব্যবস্থা কিছু ভাল ওরা প্রসাদের ধার ধারে না ২৫শে ডিসেম্বর কেক দেয় আর জারা খ্রীষ্টান হয় তাদের অনেক কিছু দেয় চার্চ থেকে|এরা আবার ভক্ত কিনছে|ধর্ম মানেই শালা বেচা কেনার হাট| তবে যে সব মন্দিরে লোক খাওয়ায় তাদের উপল ভালোবাসে, আজ যেমন খিচুড়ি লাবড়া চেটেপুটে খাচ্ছে| মন্দিরের চাতাল ভিজে যাচ্ছে তার জামা প্যান্টের জলে| যাক যদি কিছু ধূলোবালি মরে যায় কাদা হয়ে যায়|
ছোটবেলা মা সকালে বাতাসা আর বিকালে নকুলদানা দিত ঠাকুর কে, দেবার পর পাক্কা ৩ মিনিট উপল পাহারায় থাকত, যদি টিকটিকি চলে যায় সেই ভয়ে, তারপর সেই প্রসাদ উপল পেতো| খাবে যখন উপলই ওর হাতে দিলেই হত, মানুষের শরীরেই তো ভগবান, তাও মা ঠাকুরের সামনে দিত, ঠাকুরের এঁটো হলে প্রসাদ হবে| উপল মাঝে মধ্যে ভাবে প্রায় সে ঈশ্বরের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, তার কোন পিছুটান নেই শুধু মনের ক্যানভাসে এঁকে চলেছে| এই যে মন্দির , একটা কুকুর , পেচ্ছাপ করে দেবে তুলসি তলায়| শুধু এই ছবি তার মন্দির ঘিরে| কুকুরদের ভগবান লাগে না, আর কারোর লাগে না শুধু অসভ্য মানুষের লাগে কেলাকেলি করবার জন্য, হাসি পায় উপলের| রাস্তায় রাস্তায় যারা ফ্যা ফ্যা করে, এরকম বর্ষার দিনে তারা কোথায় যেন সব চলে যায় ছাউনির তলায়|ইলেকট্রিকের তার গুলো শুধু একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভেজে , উপলের ইচ্ছা করে ইলেকট্রিকের তার গলায় জড়িয়ে মরে যায়, কলকাতা শহরটাও তো ওই ভাবে ফাঁসে ঝুলে আছে কতদিন, প্রাণখানি বেরোবো বেরোব করেও বেরাচ্ছে না , উপলেরও যদি ওরকম হয়, গা টা শিরশির করে ওঠে, বেদম জ্বর আসছে মনে হয়, টলমল পায়ে উপল তার পলেস্তরা খসা পুরোনো ঘরে ফরে আসে, আসতেই হয়| আলমারির মাথায় গুঁজে রাখা বাঁশিটিতে ফুঁ পড়ে তার| ঘরের মধ্যে সে বাজিয়েই চলে সন্ধ্যে ছাপিরে রাত , গভীর রাত বাজতেই থাকা, গলিতে তখন সুরের বন্যা ভেসে যাচ্ছে মোড়ের মাথা পর্যন্ত আশ্চর্য সেই সুর| বাঁশি আর বৃষ্টির ঝুগলবন্দিতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা যোগাড় দেয়| উপলের পাশে এসে বসে তার মা, গলায় দড়ি দিয়েছিল |আর সেই প্রথম প্রেমিকা, কার ভুলে বিষ খেয়েছিল| ঘুমিয়ে পড়ে উপল, আপাতত মনের সব দরজা বন্ধকরে ঘুম দেবে সে আগামী কদিন , পারলে আর একটা বৃষ্টির আগ অব্ধি