Next
Previous
0

গল্প - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়





















"দিদিমণি তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ?"

রমলা অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে, বারান্দা দিয়ে ক্লাস ফাইভের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। সিক্সথ পিরিয়ড। তখন ডাকটা শুনল। ইস্কুলের নতুন বিল্ডিং। তার সাথে মানানসই ছিমছাম থাম। ছাদ ধরে রাখে ঠিকই কিন্তু প্রস্থের আতিশয্য ছাড়াই। সুতরাং না দেখে উপায় কি? যে যুগের যা নিয়ম — যা কিছু অতিরিক্ত, মেদবহুল তা ছাঁটাই করে শুধু যেটুকু প্রয়োজনীয় সেইটুকুকে চিনে নেওয়ার ও ধরে রাখার এক প্রয়াস এবং তার পরিমার্জনা নিরন্তর চলছে। শুধু বেয়াড়া বয়েস আর অপরিণত মন সেই যুক্তির পাঠশালায় বারবার ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।

তেমনই এক দলছুট - যে এখনো ঘর আর বাইরের তফাৎ বুঝতে শেখেনি - ক্লাস ফাইভের নতুন এডমিশন। মাথার টিকির কাছটা থামের ওধার দিয়ে দেখা যাচ্ছে। সাধন। গুটি গুটি আগের দিন এসে বসে ছিলো কাছটিতে। বুরবুর করে কত কথা। "তুমি সাদা শাড়ি পর কেন দিদিমণি? আমি তোমায় সাদা দিদিমণি বলে ডাকবো।" কিছু কিছু ছেলে থাকে নেওটা। অবশ্য সবার নেওটা নয়। ভূগোল স্যার কে দেখলেই পিঠটান দেয়। ভূগোল স্যারের বেতের প্রসিদ্ধি সম্বন্ধে এ কদিনেই সবাই অবগত হয়ে গ্যাছে। রমলা ছেলেমেয়েদের একদম মারতে পারে না। নিজের ছেলেকেও কখনো পারে নি।

বলল "কই না তো! একদম পাচ্ছি না। কিন্তু গলাটা চিনতে পারছি। এটা নিশ্চই সাধন। কিন্তু কোথায় সে? কি কান্ড!"

"দিদিমণি তুমি এক্কেবার বুড়ি হয়ে গেছ — কিচ্ছু দেখতে পাও না। আমি তো এখানেই — তোমার সামনেই ছিলাম।" থামের আড়াল থেকে বিজয়ী মেঘনাদের মত কার্যসিদ্ধি করে সাধন বেড়িয়ে এলো। চোখে ঝিলিক দিচ্ছে খুশি।

"এই রে! সত্যি তো আমি এক্কেবারে দেখতে পাই নি। নাহ — চশমা পরতে হবে এবার দেখছি ভূগোল স্যারের মত।"

"না দিদিমণি। ভূগোল স্যারের মত অতটাও বুড়ো হওনি তুমি। চশমা লাগবে না।"

রমলা বুঝল খামোখা ভূগোল স্যারের মত হয়ে ওঠার সামান্যতম সম্ভবনাটাকেও সাধন মোটেই ভালো চোখে নেয় নি।

বলল "আচ্ছা বেশ চশমা নেব না, এখন ক্লাসে চল তো।"

বলে কিছুক্ষণের জন্য নিজেই দাঁড়িয়ে গেল রমলা। অনেক দিন আগের একটা সময় মনে পরে গেল। এখন ভাবলে স্বপ্নের মত হয় অথবা পূর্বজন্মের মত। সময় কেমন খামখেয়ালী, না? কখনো অস্থির, ভীষণ তাড়ায় টেনে হিঁচড়ে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের সব সঞ্চয়। আবার কখনো ভরদুপুর বেলায় থমকে যাচ্ছে বিনা নোটিশে। ফিরিয়ে দিচ্ছে যা কোনো একসময় টান মেরে কেড়ে নিয়ে ছিল। সময়ও ফেরত দেয় — সমুদ্রের মত — মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তবেই। স্মৃতি।

বাবাই যখন ছোট ছিলো এমনি করে আলনার পেছনে গিয়ে লুকোত। যখনই রমলা দুধের গেলাস নিয়ে যেত তখনি। দুধ খেতে একদম ভালো বাসত না তো।

"মা তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ?"

মনে হয় এই তো সেদিন। রমলার দুচোখ ভরে এলো। মন খারাপের কোনো পরোয়ানা বেরোয় না। অনাহুত অতিথি — যখন তখন ঢুকে পরে মনের চৌহদ্দিতে। বাবাইটা আজ কত দুরে — কত বছর আসে নি — কত দিন দেখা হয় নি।

লম্বা বারান্দাটা পেড়িয়ে শেষ মাথায় ক্লাসে এসে ঢুকল ধীরে ধীরে। এধারে ওধারে জটলা। খুদেগুলোকে রমলার বেশ লাগে। ঘুটঘুটে। বাড়ির আড় ভাঙ্গে নি। বাকি মাস্টারমশাইরা কিছুতেই ক্লাস ফাইভ নেবেন না। বলেন - "দূর ওই ইচ্কুনি বিচ্কুনিদের পড়াতে ভাল্লাগে না।" রমলা ফাইভের ক্লাস যেচেই নেয়। ওদের সঙ্গ ওর ভালো লাগে।

রমলা ওদের গল্প বলছিল। ইতিহাসের গল্প। গল্প করে পড়ায় রমলা। আজ গল্পের সুতো বারবার হারিয়ে ফেলছিল। যে বিষয়ে পড়াল সে বিষয়ে দুটো প্রশ্ন লিখতে দিলো শেষমেষ। এটা ও প্রায়ই করে। লেখার অভ্যেস একেবারে নেই। আজকাল প্রাইমারি ইস্কুলে কি পড়ায় কে জানে! অন্যমনস্ক হয়ে জানলার ওপারে সেগুন গাছটার দিকে চেয়েছিল। পাশেই পুকুর — গাছে গাছে উঠোনটা ভরা। সময়ের ক্রম গুলিয়ে যাচ্ছিলো — ঠিক যেমন স্বপ্নে হয়। মনের মধ্যে সযতনে আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখা মাস আর বছর গুলো একে অন্যের ঘারে এসে পরছিল। ইউনিভার্সিটির এক স্যার বলেছিলেন প্রথম দিন। "প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই একটা ইতিহাস।" যখন বিয়ে হয়ে এসেছিল তখন প্রণাম করতে শুরু করলে আর মাথা তোলার অবকাশ পাওয়া যেত না। বাড়ি ভর্তি লোক। তেরোটা পাত পড়ত রোজ দুবেলা, আর আজ সেই বাড়িতেই রমলা একা।

শেষ বার যখন বাবাই এসেছিল রমলার জন্য একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। বোতাম টিপলেই ছবি। রমলা প্রথম প্রথম খুব ঘাবড়ে গেছিল। সোজা জানিয়ে দিয়েছিল "এসব আমার দ্বারা হবে না।" বরাবর ভাইকে দেখে এসেছে ফটোগ্রাফিক ম্যাগাজিনে মুখ গুঁজে থাকতে, মাঝে মাঝে দল বেঁধে এক্সকারসনে বেরোতে। ছবি তোলাটা একটা গ্রাম্ভারী ব্যাপার ছিলো তখন। ছবি। ভাই ওকে বুঝিয়েছিল একটা ফটোকে ছবি করে তোলার জন্য কতো চিন্তা, শিক্ষা আর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থাকার প্রয়োজন। অতশত রমলা বুঝতো না; তবে ভাই যখন ফিরে আসার পর দেয়ালে পর্দা টাঙ্গিয়ে ভাই স্লাইড শোতে 'ছবি' দেখাতো তখন খুব ভালো লাগতো। মা, দিদি, সবাই বসত একসাথে। সে একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার। তারপর টুক করে কেমন সময় বদলে গেল। ভাইয়ের ডার্করুম কম্পিউটার ঘর হয়ে গেল আর ছবি দেখা যেতে লাগলো কম্পিউটার মনিটরে। দুর্বোদ্ধ বিষয় হঠাত আগল খোলা পেয়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো দশদিক।

ভাগ্যিস! রমলা ছবি তুলেছিল প্রথমবার। না — ফুল, ফল, গাছ, পাখি এসব নয় — এরা তো আছে — এরা তো থাকবে। এরাই তো থাকবে। যে চলে যাবে, যাকে রাখার কোনো সাধ্য নেই, তার ছবি। আচ্ছা, একটা ছবি — একটা দ্বিমাত্রিক আলো আর ছায়া — তার মধ্যে কাউকে দেখতে পাওয়া কি খুব সোজা? কতটা ভালোবাসলে তবে সেই আলো আর ছায়ার মাপা চৌখুপ্পিতে, হারিয়ে যাওয়া পিক্সেলগুলো মনে মনে ভরাট করে নেওয়া যায়?

বাবাই অবশ্য রোজ ফোন করে, নিয়ম করে। অনেকক্ষণ কথা বলে। মন থেকে বলে — মাতৃদায় উদ্ধার করে না। ঝগড়াও করে। চন্ডালের মত মেজাজ তো, রাগলে পরে। ঠিক ওর বাবার মত। রক্ত যাবে কোথায়! গতবার যখন মায়ের কাছে গেছিল রমলা, তখন বাবার বন্ধু বিশ্বনাথকাকু এসেছিলেন। ছেলেরা সব বাইরে। আগে কত গর্ব করতেন। "আমার চার ছেলেই বাইরে পোস্টেড। উঁচু পদ, বুঝলে মা।" এবার কেমন যেন ম্রিয়মান মনে হলো। গর্ব বড় ওপর-ওপর অনুভূতি। লোককে দেখিয়ে যতটা সুখ, মনের ভেতরে-ভেতরে ততটা গভীরে বাসা বাঁধে না। মনের ভেতরে ফাঁকা হয়ে যাওয়া আলগা মাটিতে বাঁধন দিতে পারে না। এবার জিগ্গেস করলেন - "ছেলে ফোন করে? নিয়মিত ফোন করে তো?" ফেরার পথে ফের একবার জিগ্গেস করলেন। রমলার মনে হলো বিশ্বনাথ কাকুর ছেলেরা বোধহয় খুব একটা যোগাযোগ রাখে না। খারাপ লাগলো। দুরে চলে গেলে ফোনটুকুই তো সব। কথা — কথার পৃষ্ঠে কথা। কথা দিয়েই তো ছিঁড়ে যেতে বসা সম্পর্কগুলো আবার নতুন করে রিফু করার চেষ্টা। কথা ফুরিয়ে যায় কি করে? যে ছেলে এতদিন ধরে যে মানুষগুলোর সঙ্গে আস্টেপৃষ্ঠে বাঁচলো সেই মানুষগুলো এক লহমায় কি করে ফালতু হয়ে যায়? নাকি ছেলেদের স্বভাবই এরকম? বাবাই এমন নয়। ও কথা বলতে ভালোবাসে। অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলে। মেয়ে নেই বলে রমলার আফশোস নেই।

কিছুক্ষণ পরেই হরেনদার আগমন। নিশ্চই হেডমাস্টার মশায়ের কাছ থেকে কোন খবর এসছে।

"দিদি এই পিরিয়ড এর পর আজ ছুটি। হেড স্যার জানিয়ে দিতে বললেন।"

"আজ ছুটি! কেন? কি আছে আজ?"

হরেনদা কিছু বলার আগেই পুরো ক্লাস বলে উঠলো

"আজ তো মঞ্জরীর ঝাপান। তুমি জানো না?"

"না, সে কোথায়?" অবাক হবার ভান করলেন। ছেলেরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। এত বড় একটা বিষয়ে দিদিমণির অজ্ঞতা তাদের বেশ অবাক করেছে। উত্তেজনায় চোখ গোল গোল করে বলে উঠলো "তুমি কি গো দিদিমণি? মঞ্জরীও চেন না!"

"উঁহু।"

এমন একটা গুরুত্ৱপূর্ণ বিষয়ে দিদিমণিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে ঝাপান দেখতে চলে যাওয়াটা তারা মোটেই সমীচীন বোধ করলো না।

"ভুঁয়ে পাড়া জানো তো?"

"হুঁ।"

"আচ্ছা, তারপর শানপুকুর, পাড় ধরে হেঁটে গেলে তালপুকুর। তারপর রাস্তা শেষ। তারপর মাঠে নেমে যাবে। সোজা নাক বরাবর বেদেপোঁতা যেদিকে, সেদিকে হাঁটতে থাকবে আল দিয়ে। মাঝামাঝি পাবে মঞ্জরীর ডাঙা জমি। তুমি চিনে যেতে পারবে তো দিদিমণি?"

"হ্যাঁ, সে আর বলতে!"

"ও দিদিমণি আমার বাড়ি না সেই ঘুঘুডাঙা ছাড়িয়ে। মঞ্জরী যেতে অনেক সময় লাগে গো। তুমি তো যাও নি কখনো। অনেক দূর। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। একটু আগে ছেড়ে দাও না দিদিমণি।" এক খুদে বলে উঠলো।

ব্যাস, ওমনি তৎক্ষণাৎ সমীক্ষায় দেখা গেল যে বাকি মক্কেলদের বাড়িও দুরে তো বটেই এবং ঘুঘুডাঙার চেয়ে কোন ভাবেই কম দূর নয়। সুতরাং ঘুঘুডাঙার কোনো অনৈতিক দাবি যেন দিদিমণির দরবারে না টেকে সেই সমবেত আর্জি এলো। রমলা দেখল পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। জোর করে রাখা যায় বটে। তবে ওই জোরটুকুই রয়ে যাবে। মাথায় পড়া আর কিছু রইবে না।

"বেশ, পালা। পালা সব।" ছুটি দিয়ে দিলো।

আনন্দ করে ইস্কুলে যেটুকু শিখল ওটুকুই ভালো! আনন্দ কে দাবিয়ে দিয়ে পড়াশোনা হয় না। বরং শিক্ষাই যখন আনন্দ হয়ে ওঠে, সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। সেই আনন্দ হিংসুটে, একলষেঁড়ে নয়। বলে না, যে কেবল আমিই থাকব। বলে বেশ তো থাক — তুই থাক, তোরা থাক। আমিও পাশটিতে থাকব।

ছেলে মেয়েগুলো লাফাতে লাফাতে চলে গেল। ছুটি জানান দিয়ে এলে ভাল, দুম করে এলে আরো ভাল। রমলার শ্বশুরমশাই ছেলেকে পড়াতেন। আর রোববার করে পুরো ছুটি দিয়ে দিতেন। বলেছিলেন "যাও দাদুভাই, রোববার করে তুমি 'কেয়ারফ্রি লাইফ লিড' করবে।" বাবাই শনিবার রাত্তিরে এসে বলেছিল — "মা কাল আমি উশৃঙ্খল জীবনযাপন করব। দাদু বলে দিয়েছে।" কি ভয়ঙ্কর বঙ্গানুবাদ! রমলার আজও ভাবলে হাসি পায়। সেই শুরু। তারপর থেকে রোববার করে ছুটিটা ওর বরাদ্দ হয়ে গেছিল। সেই ছুটিগুলো বাবাই এর জীবনে ভাল ছাড়া খারাপ কিছু করেনি। মাঝেমাঝে শনিবার রাত্তিরে বাবাই আবদার করত দাদু "ছুটিটা আজ রাত্তির থেকেই চালু করে দাও না।" নাতির আর্জি কখনো না-মনজুর হত না।

অফিসরুমে ফিরে এসে দেখল রূপাদি চায়ের জল চড়িয়েছেন। রূপাদির সিক্সথ পিরিওড অফ। টিফিনের পর থেকে রূপাদির চায়ের কোর্স চলতেই থাকে। পারেও বটে চা খেতে এতবার। হেডমাস্টারমশাই ব্যস্ত মিড্-ডে মিলের হিসেব নিয়ে। বাকিরা যে যার ক্লাসে।

-"ছেলেগুলোকে ছেড়ে দিলাম আজ তাড়াতাড়ি। যেই না ঝাপানের কথা শুনেছে একেবারে লাফিয়ে উঠেছে।"

-"ভালই করেছিস। ছোটগুলোরই তো মজা। চা খাবি তো? জল নিই?

চা খেতে খুব একটা ইচ্ছে করছে না আজ। তবু বলল হ্যাঁ, দিও। মুখেচোখে একটু জল দিলে ভাল হয়। দুদিন টানা রোদ চলছে। রোদের তাত কি! কে বলবে বর্ষা কাল? যখন বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। পুকুর ডোবা ভেসে যাওয়ার উপক্রম। বিরক্তি লাগে, আবার এই গরম। তবু তো ভাল ইস্কুলটার চত্বরে এত ছায়া। উঠোন পেরিয়ে কলঘর। সেদিকেই গেল রমলা।

কতদিন পরে শুনল কথাটা — মঞ্জরীর ঝাপান! প্রথম প্রথম যখন বিয়ে হয়ে এসেছিল — শহরের মেয়ে — ঝাপান শুনে খুব অবাক হয়েছিল। ঝাপান কি? কোনো খেলা? লাফ-টাফ দেবার বিষয়? ননদকে জিজ্ঞেস করেছিল। পাশ থেকে হো হো করে হেসে উঠেছিল অনিমেষ, রমলার স্বামী। "শহুরে মেয়ে নিয়ে এই বিপদ! ধানকে বলে দুব্বোঘাস। ঝাপান হলো মেলার ছোট সংস্করণ। মেলা হয় হাটের মধ্যে, আর ঝাপান হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কেন বলতে পারি না। সাধারণত কোনো লোকায়ত দেবীর পুজো উপলক্ষে জমায়েত হয়। যেমন ধর বসন্তবুড়ির ঝাপান।" অনিমেষ বুঝিয়েছিল।

মঞ্জরী নামটা খুব সুন্দর শুনতে লেগেছিল সেদিন। গাঁয়েঘরে এমন কাব্যিক নাম বেশ বিরল। এই যেমন - 'বসন্তবুড়ির ঝাপান' - এটা বেশ মানিয়ে যায় চারপাশের সাথে, কিন্তু যেখানে গ্রামের নাম কলিসান্ডা আর মারশীট সেখানে মঞ্জরী বেশ বেখাপ্পা। জায়গাটাও দ্বীপের মত। চারপাশে যতদূর চোখ যায় চাষের জমি - দক্ষিণ দিকের জমি গুলো প্রতিবার ভরা বর্ষায় ডুবে যায় — লোকে বলে বন্যের জলা। জল মাঠ ছাপিয়ে উঠে আসে ভুঁয়ে পাড়ার ভেতরে। আর মধ্যিখানে একটুকরো ডাঙা জমি। বাবাই এসে বলেছিলো।

সে এক কান্ড হয়েছিল সেবার। সারা বিকেল জুড়ে ছেলের খোঁজ নেই। মাঠে নেই। বন্ধুদের বাড়িতে নেই। তখন ওর কতই বা বয়েস? ক্লাস ফোর। পিসি খুঁজছে, দাদু খুঁজছে। শেষমেষ সন্ধ্যের ঘায়ে ঘায়ে ছেলে বাড়ি এলো। উপুঝ্ঝুটি ভিজে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। সারা বিকেল তুমুল বৃষ্টি হয়েছে।

"কোথায় গেসলি বাবাই?"

"মঞ্জরীর ঝাপানে গেছিলাম মা।"

বাবাই মিথ্যে বলত না। কখ্‌খনো না। রমলা শিখিয়েছিল, তুমি যদি সত্যি বল আমি বকব না। সেই ভরসার জায়গা থেকেই বোধহয় নির্দ্বিধায় ছেলে উত্তর দিয়েছিল।

"কার সঙ্গে গেসলি?"

"কারোর সঙ্গেই নয়। একাই গেসলাম। দেখলাম শানপুকুরের ধার দিয়ে লোকেরা যাচ্ছে। আমিও চলে গেলাম।"

"জানো মা —"

"আচ্ছা জানব, আগে জামা ছেড়ে চান করে বস। নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে, বাবা। "

তারপর সন্ধে বেলায় মুড়ি খেতে খেতে বাবাই বলেছিলো ওখানে পুজো হচ্ছিল, দোকান বসেছিল খেলনার, খাবারের। একটা ফোন ছিল জানো মা? বোতাম গুলো একেবারে যেন সত্যিকারের, টেপা যাচ্ছিলো! কিনব ও ভাবলাম। কিন্তু পয়সা ছিলো না তো সঙ্গে।"

"তুই তো বলে যাস নি বাবা।"

"আমি কি জানতাম?"

তাই তো আমরা কি কেউ জানি কখন কোন পথ কাকে ডেকে নেয়? রমলা আজও ভাবলে অবাক হয়। কিভাবে আর কেনইবা ছেলেটা হুট করে চলে গেছিল ঝাপান দেখতে? আজ এত বছর পরে সত্যিই বাবাই কত দূরে! তাই বা সেদিন কে ভাবতে পেরেছিল? মানুষও আজকাল এক একটা দূর দ্বীপের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সব অনুভুতি — মায়া — সব গুটিসুটি মেরে আটকে আছে কিছু অকেজো ডাঙায়। কেজো পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে মানুষের কাছে মানুষের আসার সময় কোথায়? কিন্তু তবু আসতে হয়, আসতে হবেও — স্মৃতির পলিতে পা ডুবিয়ে। কবে? জানা নেই। অপেক্ষা থাকবে — যেমন থাকে আর সব অপেক্ষারা। অনুগত সঙ্গী হিসেবে। তারা কোথাও ছেড়ে যায় না।