প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রবন্ধসুবোধ ঘোষ সম্পর্কে আলোচনায় আমার মতো অজ্ঞজনের কতটা অধিকার আছে , তা যদি জানতে চান তবে বলব পাঠকের অধিকারে এ লেখায় হাত রাখলাম। পাঠকের দরবারে যে সৃষ্টি কালের গণ্ডি অতিক্রম করে আধুনিক কালের পাঠককেও মুগ্ধ করে সেই কালোতীর্ণ সৃষ্টিকে সমালোচনা করে কোন আহাম্মকে ? সুবোধ ঘোষের ছোটগল্পগুলো নিয়ে দুকথা লিখেই ফেলি তাই ।
সাহিত্যের দরবারে সুবোধ ঘোষের আগমন একেবারেই আকস্মিক। বন্ধুদের গল্পপাঠের আসরে অনুরুদ্ধ হয়ে, নিতান্ত অনিচ্ছায় ও সঙ্কোচে দুটি গল্প লিখে ফ্যালেন। সেই দুটি গল্পই তাঁর যশ প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। এরকমটা আমরা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনেও পড়েছি । এক বন্ধু আক্ষেপ করেছিলেন , নামী পত্রিকা সুপারিশ ছাড়া গল্প ছাপে না । মাণিক তখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র । এই অভিযোগ ভুল প্রমাণ করতেই তিনি নামী পত্রিকায় একটি গল্প পাঠান । এবং তা ছাপা হয় । অতসী মামী নামের সেই গল্পটি বাংলা সাহিত্যের আগমনবার্তা সরবে ঘোষণা করে । সুবোধ ঘোষে ফিরি । কেমন ছিল তাঁর লেখার প্রেক্ষাপট ? কেমনভাবে চেতনে অবচেতনে তৈরি ছিলেন তিনি ? ফিরে দেখি । টিউশনি বাস কন্ডাক্টরি ট্রাক ড্রাইভারি সার্কাস পার্টি , এমনকি বোম্বাই মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারি পর্যন্ত । এত সব অদ্ভুত বিচিত্র পেশায় নিজেকে যুক্ত রাখার ফলে জীবনে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তাঁর পূর্ণ ছিল। এছাড়াও ছিল সর্বভুক একটি চিত্ত। কত যে বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন! গল্পগুলোর বিষয় বৈচিত্র অনুভব করলেই বোঝা যায় যে সেই সব পাঠ ও অভিজ্ঞতার জারিত ফল তাঁর সৃষ্টি আর তাই একটু বেশি বয়সেই তাঁর সাহিত্যের আসরে আবির্ভাব। এবং জয়।
যারা মনে করেন, লিখতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন, সঠিক দীক্ষা নইলে কেউ ঠিক লিখতে পারবেননা, তাদের জানা দরকার এটি একটি মিথ। লিখতে গেলে যে ঠিক কি কি চাই, তার বোধ হয় কোনও নির্দিষ্ট তালিকা হয়না। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই, শুধু একটি অনুভতিপ্রবণ মন নিয়ে এবং অবচেতনে জারিত অভিজ্ঞতা ও পাঠের মিশেলে একের পর এক অপূর্ব সব গল্প উপহার দিয়েছেন সুবোধ ঘোষ। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পই স্বতঃস্ফূর্ত। লিখতে বসে অনায়াসে লিখে ফেলা। এমনকি সাগরময় ঘোষের অনুযোগ অনুযায়ী, তাড়া না দিলে লেখা পাওয়া কষ্টকর ছিল। এবং, শারদীয়ার লেখা পাওয়া যেত সবার শেষে। সুতরাং, রিসার্চ করে, পরিকল্পনা করে, প্লট খাড়া করে না লিখলেও অবিস্মরনীয় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। সেদিক দিয়ে সুবোধ ঘোষ যেন পথিকৃৎ। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত রমাপদ চৌধুরী বিমল কর মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ, তাঁর গল্প বলার ধরনটিকে বাংলা গদ্যের নতুন একটি চলন বলে মেনেছেন। ছোট ছোট বাঁক, অপ্রত্যাশিত মোড়, এবং তীব্র শ্লেষ ও গভীর দর্শন ভেদ করে হঠাত আলোর ঝলকানির মতো বেরিয়ে এসেছে জীবনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।
স্বল্প পরিসরে আলোচনা করতে গিয়ে মনে হয়েছে তাঁর প্রেমের গল্প নিয়েই আলোচনা করি । দেখেছি, প্রেমকে তিনি যেন অমূল্য এক হীরকখণ্ডের মতন বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিফলিত করেছেন । নানাদিকে সেই বিচ্ছুরিত আলোয় আমরা দেখেছি প্রেম নিয়ে তাঁর লেখা অন্য মাত্রা নিয়েছে । অন্য একটি কারণ, ব্যাক্তিগতভাবে ওঁর লেখা প্রেমের গল্পের অনুরাগী আমি। এখনকার প্রজন্ম অবশ্য এধরণের প্রেমের গল্প পরে একটু অবাক হবেন। প্রেমের জন্য যে বিস্তৃত পরিসর লাগে, কল্পনা ও বাস্তবের যে মেল লাগে তা এখনকার লেখক ও পাঠক দুপক্ষই নিঃশেষে ভুলেছেন। এখন যেমন বাসস্থানগুলিও শহর শহরতলি নির্বিশেষে একে অন্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফ্যালে, মানুষেরও তেমনি ব্যাক্তিগত পরিসর আর নেই বললেই চলে। এই পরিসর শুধু মানসিক নয়, একেবারেই বাস্তবিক, দৈহিক। ফলে কল্পনার স্থান হয়না। একটুকু ছোঁয়ার সঙ্গে একটু সুষমা জড়িয়ে একটি অপূর্ব অনুভূতির জন্ম দেয়না। সুবোধ ঘোষের গল্পে এই পরিসর বড় বিস্তৃত। ভারী সুন্দর তার ব্যবহার। এক একটি কথার আঁচড়ে এঁকে দ্যান মনের গহনে থাকা অভিমানের আবেগ, দীর্ঘকালের সঞ্চিত কষ্টের উৎসমুখ যায় খুলে।
প্রথম যে গল্পটির উল্লেখ করব তার নাম সুনিশ্চিতা। সামান্য একটি ঘটনা। বিমলেন্দু গিয়েছিল হীরাপুরে কর্মযোগে। ব্যাচেলর বিমলেন্দুর সেখানে তিন তিনটি সুন্দরী ও ধনী কন্যার সঙ্গে আলাপ হয়। বিমলেন্দুর বাংলোটি ফুলগাছে ঘেরা। ভারী শৌখিন সে। তার শৌখিন জীবনে ধীরা অতসী ও সুমনা নাম্নী তিন কন্যা, যারা বিমলেন্দুর রোম্যান্টিকতার সুযোগে তাকে একটু খেলিয়ে দেখেছে। একটু নাচিয়ে দেখেছে, কেমন লাগে। একটা আমোদ বই তো নয়! কিন্তু রোম্যান্টিক বিমলেন্দু ভেবেছে এরা সত্যিই তাকে মনে স্থান দিয়েছে। আর তাই হীরাপুর ছেড়ে চলে যাবার দিনে প্ল্যাটফর্মে ফার্স্ট ক্লাস কোচের সামনে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ তো একটি ফুলের তোড়া তাকে দেবে! কিন্তু তার স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে তিন তিনটি ফুলের তোড়া পৌঁছে যায় গাড়ির একমাত্র সেলুনের কাছে। যেখানে কোলপ্রিন্স ডি কে রায় অপেক্ষমাণ গাড়ি ছাড়ার জন্য। যার বাংলোয় ফুলের কোনও আতিশয্য ছিলনা। যার বাংলোয় কারো এমন আহ্বান ছিলনা। ছিলনা মেয়েলি হাসির শব্দ। ছিলনা অনর্থক কিছু গুনগুন। অথচ আজ তারই কাছে এমন আত্মসমর্পণ? শুধু সম্পদের জন্য এমন লোভ? আর কি তুচ্ছতায় ভরিয়ে দিয়ে ডি কে রায় সেই তিনটি ফুলের গোছা নিতে হুকুম করেন চাপরাশিকে! লোভ তিনি চিনেছেন বই কি! গল্পটি এতো দূর হলে বেশ সরলরৈখিক একটি ভাষ্য মিলত। কিন্তু লেখক যে এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন। তিনি যে মনের গহীনে প্রবেশ করছেন! বিমলেন্দুর বিরক্তি উদ্রেক করে নিখিল সরকার বলে এক ভদ্রলোক তাঁর কন্যার লেখাপড়ার জন্য বিমলেন্দুর কাছে সাহায্য চাইতে আসতেন। বারবার তিনবার। শেষবারে বিমলেন্দু তাঁকে সতর্ক করেছিল। আর নয়। এমন একটি রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে ঘষা খাওয়াটা বিমলেন্দু একেবারেই মেনে নিতে পারছিলনা। অভাবের তাড়নায় কেউ এমন করে সাহায্য চাইতে পারে? তার নরম রোম্যান্টিক মন কষ্ট পাচ্ছিল। আজ হঠাত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটি স্যাটায়ার দেখতে দেখতে সে যখন সত্যিই বাস্তবের মাটিতে নামছিল, ঠিক তখনই নিখিল সরকারের মেয়ের আগমন। সাহায্যের কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞচিত্তে সে এসেছে বিমলেন্দুর পথের পাথেয় হিসেবে কিছু আহারের সংস্থান নিয়ে। আজ বিমলেন্দুও নতুন দৃষ্টি পেয়েছে। মেকি ন্যাকামির চেয়ে মীরা নামের এই মেয়েটির উপস্থিতি যে তাকে একরকমের শান্তি দিচ্ছে তা সে উপলব্ধি করতে পারে। মীরার হাত ধরে সে নেমে আসে হীরাপুরে। নিজেকে পরীক্ষা করার দরকার হয়না তার। কারণ নিজের মনটা আর অকারণ রোম্যান্টিকতার আবরণে ঢাকা নেই। এ কাহিনী তখনকার, যখন একটি মেয়ে তার গোত্রান্তরকেই জীবনের পরম পরিণতি ভাবত। তার পরিবারের সকলেও এই লক্ষ্যে নিয়ত কাজ করে যেত। এবং, পাত্র মাত্রই ঈশ্বরের অবতার হিসেবে পরিগণিত হতো। সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করলে অবশ্য এ গল্পের সমসাময়িকতাকে উপলব্ধি করা মুশকিল।
দ্বিতীয় গল্পটি শ্মশানচাঁপা। ভয়ঙ্কর একটি গল্প। হতাশার মধ্যে, নিরন্তর ঠেলে দেওয়ার মধ্যে, সমস্ত কিছু হারিয়ে ফেলার মধ্যেও যা জেগে থাকে। এ গল্পে একটি চরিত্র কিছু শাগরেদ যোগাড় করে সমাজসেবার উদ্দেশ্যে। সঠিক উদ্দেশ্য শবদাহর ছাইয়ের তলায় চাপা পড়ে যায়। কিন্তু সেই সমাজসেবীর অকারণ নিরীহ ঘাটবাবু ওরফে মাধব গাঙ্গুলির প্রতি আচরণ লোকটিকে যেন কি এক বিষাদে কি এক নিস্তব্ধতায় ঠেলে দেয়। সে যখন শ্মশানের ছাই আর কাঠ, শব আর মৃত্যুর ধূসরতার মধ্যে একটুকরো জীবনের ছবি আঁকে, তখনই কুমারসাহেবের পোষা সেই সমাজসেবী সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার হতাশায় ডুবে যায় ঘাটবাবু। নিশ্চিত চলে যাওয়ার পথ থেকে সরে সে আবার সেই ধুসর জগতে অপেক্ষা করে। তারপর একদিন ঘাটবাবুর সেই একটুকরো জীবন, সেই লাল গোলা সিঁদুরের টিপ পরা সুন্দর মুখটি ফিরে আসে শব হয়ে। রানীমার শব। কুমারসাহেবের অমন কত রানী আছে! সবাই কি আর বিয়ে করা বউ হয়? ঘাটবাবুর অদ্ভুত আনন্দ ও উল্লাস দেখে এই প্রথম ভয় পায় সেই সমাজসেবী। এ কি অদ্ভুত ব্যাপার! মৃতাকে দেখে আনন্দ? কিন্তু ঘাটবাবু খোঁজ করতে থাকেন মৃতার শিশুসন্তানের। সে কই? তার এখানে আসতে কত দেরি? সে এলে বহুদিনের ইচ্ছে, সেই পারিবারিক ফটোটি যেন তোলা হবে। এমন বিভীষিকাময় পরিবেশ, এমন দমবন্ধ কষ্ট, সব ছাপিয়ে শব নিয়ে যাওয়া ছেলেরা বুঝতে পারে। ঘাটবাবু স্বপ্নের মানুষ। ‘লোকটা জাগা চোখে স্বপ্ন দ্যাখে’। সে মৃতার নামের পাশে স্বামীর নাম লেখে – মাধব গাঙ্গুলি। যে জীবনের স্বাদ, যে প্রেমের স্বাদ, বেঁচে থেকে মিললনা, মরণে যেন তাই পাওয়া হয়। গল্পটির অভিঘাত বড় বেশি। সবলে নাড়া দেয় আমাদের। প্রেম বলতে আমরা যে কি অনুভব করি, তার গোড়া ধরে টান দেয়। যে স্ত্রী অপহৃত হয়, যে সন্তান অপরের কাছে নির্দয় অবহেলায় শুয়ে থাকে, সেই স্ত্রী সেই সন্তানের প্রতি কি মর্মান্তিক ভালোবাসা!
জীবনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ে প্রেম নিঃশব্দ চরণে এসে দাঁড়ায়। টের পাওয়া যায়না। যেমন মানশুল্কা গল্পে। আগো তার অরণ্যজীবনে স্বাধীন এক নারী। দেহের আনন্দ সেও অনুভব করে। কিন্তু তার জন্য এমন জবরদস্তি কেন? কেন এমন গামছা দিয়ে হাত পা মুখ বাঁধা? একটু কি ভালো কথায় হয়না? একটু ভালোবেসে বললে কি এমন ক্ষতি? তা নয়, শুধুই জোর। শুধুই পশুর মতন গুঁতিয়ে খাবলে সুখের খোঁজ করা। সেই আগো পালিয়ে এলো কলকাতা শহরে। বাঃ! বেশ তো শহর! কেউ এমন পেছনে পড়েনা। কেউ তাকে বিরক্ত করেনা। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগলনা। সে যেন খেপা কুকুর। কেউ তার হাঁটু খিমচে ধরে। কেউ তার কোমরে চিমটি কাটে। আর এর মধ্যেই দাঁত বের করে হাসে একটা লোক। অশরীরির মতো তাকে অনুসরণ করে। শেষমেশ ক্লান্ত আগো যখন ময়দানে শুয়ে পড়ে, ক্ষণিক ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে উঠে দেখতে পায় সেই লোকটা। পালিয়ে পালিয়েও নিস্তার মেলেনি। সে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে। কিন্তু লোকটা তার সামনে নামিয়ে দেয় এক ঠোঙা তেলেভাজা। বলে – সারাদিন কিছু খাওনি। দেখেছি। খেয়ে নাও। আমি জল নিয়ে আসছি। আগো অবাক হয়ে দেখে, লোকটি দুটো খুরি করে তার জন্য জল আনছে। অবশেষে ট্রেনের টিকিট কেটে সে আগোকে তুলে দেয় আগোর গন্তব্যে। নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। ট্রেনের জানলায় তার হাতের ওপরে মাথা রাখে আগো। ঠিক এমনই একটা ভালোবাসার পুরুষ যে খুজেছিল সে! লোকটাকে তখন পুলিশে হাতকড়া লাগাচ্ছে। সে চোর। আগো ভাবে এই ভালো। শুধু হাতের ওপরে মাথা রেখেছে। নইলে তার বড় পাপ হতো। এ গল্প কিন্তু কালজয়ী । এখনো প্রাসঙ্গিক ।
বৈদেহী। যে নারীর শরীর এতই ক্ষীণ, যে তা ভরাট করতে বিধাতা তাকে দিয়েছেন বিশাল হৃদয়। গল্পটি আপাতভাবে বেশ মিষ্টি। মল্লিকা ফুলের মতো নরম মেয়েটি তার স্বামীর মনের দুয়ার খুলে দেয়। কিন্তু এতই কি সহজ? গল্প থেকে সরাসরি তুলে দিই একটি সংলাপ।
মল্লিকা – কোথায় যাচ্ছ?
...হেসে ফেলে মল্লিকা। - একটু সেজে যেতে হয়। কথাগুলি একটা অর্থহীন বাজে ঠাট্টার মতোই, কিন্তু শুনে আশ্চর্য হয় বিকাশ। কথা বলতে গিয়ে যেন ছলছল করে উঠেছে মল্লিকার গলার স্বর।
- একটু সাজিয়ে নিতেও হয়। পরপর বলতে থাকে মল্লিকা। - মুখের দিকে তাকাতে হয়, একটু হাসতে হয়, আর আলো নেবাতে হয়না।
কী চমৎকৃত হই! একটি নরম সরম মেয়ে, যে স্বামীর ঘরে সোহাগ আদরের অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি নয়, বরং পুরুষের দৈহিক প্রয়োজনে দাসীর মতো বেশ্যার মতো সাড়া দিয়ে নিজেকে ক্ষয়ে ফেলেছে, সে আজ বিকাশের দুর্বলতাকে সঠিক ধরে ফেলেছে। এ পুরুষ জানেনা এমন করে। এ পুরুষ জানেনা একটি নারীর শরীরের আগে তার মনকে জাগাতে হয়। শরীরের আদরও শুরু হয়ে মনের সংযোগে। তাই হতবাক বিকাশ এই প্রথম পাঠ নেয় মল্লিকার কাছে। মল্লিকা থামেনা। একটু জোরেই বলে ফেলে – ফুলশয্যার ফুল সরিয়ে দিতে হয়না।
এ এক অতি আধুনিক লেখকের কলম। যিনি নারীর মনস্তত্ব বিশদে বোঝেন। যিনি জানেন নারীর সম্মান, তার স্পর্শকাতরতাকে আদর করতে জানতে হয়। শিখতে হয়। এমন কত কত হীরের টুকরোর মতো মুহূর্ত ঝলকে ওঠে! চমকে উঠি। গল্পগুলো কিন্তু এখনকার নিরিখে ছোট আয়তনের নয়। আজকের মতো শব্দসীমা বেঁধে দিলে তাঁর গল্পের এমন বিস্তৃত ব্যাঞ্জনা পাওয়া যেত কিনা সে কে জানে! আয়তনে কম নয় বলেই লেখক দর্শনের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি, তিনি ভেদ করতে পেরেছেন অন্তরের নিভৃততম ব্যাথা বেদনার উৎস। ভালোবাসার উৎস।
উল্লেখ করব অন্য দুটি গল্পের । একটি গল্পের নাম জতুগৃহ , অন্যটি অচিরন্তন । অদ্ভুত পরীক্ষা করেছেন ! জতুগৃহ গল্পে এক বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতির আবার দেখা হয় এক ওয়েটিং রুমে । দুজনের জীবনই ভিন্ন খাতে ভিন্ন সঙ্গীকে নিয়ে বয়ে চলেছে । এই হঠাৎ দেখায় দুজনের প্রাথমিক আড়ষ্টতা কি সুন্দর ধরেছেন লেখক ! কিন্তু সেই আড়ষ্টতা কেটে দুজনের সামান্য আলাপ জানিয়ে দেয় , সমাজে তারা অন্য পরিচয়ে বাঁচলেও প্রাক্তন সম্পর্কের কিছু টুকরো টাকরা রয়ে যায় । সব মোছেনা । এবার তাঁর অচিরন্তন গল্পটি । এ গল্পে এক ভয়াবহ অবস্থায় স্টেশন মাষ্টারের পরামর্শে দুই অচেনা যুবক ও যুবতী একটি গেস্ট হাউসে থাকতে বাধ্য হয় । সেইরকমই আড়ষ্টতা । অচেনা দুটি মানুষ আপাতত স্বামী স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন । প্রথমেই একে অপরকে সন্দেহ , ভয় , এবং প্রবল বিরুদ্ধতা পেরিয়ে দুটো দিন কাটল । তৃতীয় দিন সকালে দুজনেই নিরাপদে ট্রেনে উঠছে । মহিলা কামরায় উঠে বসা যুবতীকে যুবক বলছেন – গলায় কম্ফর্টারটা ভালো করে জড়িয়ে নিও । যুবতীও আপনির বেড়া ছাড়িয়ে বলে – সাবধানে যেও । যেন দুটিদিনের নকল দাম্পত্য চিরকালীন হয়ে স্থান করে নিলো দুটো মনে । কেউ কি ভোলে ? যেমন বারবধূর লতা । দুদিনের নকল দাম্পত্যের আকর্ষণ তাকে ঘোর লাগিয়ে দিলো । সংসারের সকল সম্পর্কের আকর্ষণ তাকে এমন ভোলালো যে পতিতা লতা পর্যন্ত নকল স্বামী প্রসাদকে হারিয়ে ফেলার কারণ হিসেবে আভা ঠাকুরঝিকে দায়ী করে ।
চোখ গেল গল্পে যেমন অপরাজিতা অনুভব করে , হিরন্ময়ের বাইরের চোখ না থাকলেও অন্তর্দৃষ্টি এমনই যে অপরাজিতার প্রতিটি চলন সে অনুভব করে ।
তবু কথা থাকে । আজকের পাঠক হয়ত এত সময় নিয়ে এমন গভীর অনুভূতি ও এত জটিল বিশ্লেষণে প্রেম পড়তে ভালবাসবেন না । এমন গভীরতায় যেতে কেউ কি আর ভালোবাসে আজকাল ?
[গল্পমেলা ২০১৮]