Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















[ হিন্দি গদ্যসাহিত্যের দশটি শ্রেষ্ঠ রচনার মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে থাকবে শ্রীলাল শুক্ল রচিত “রাগ দরবারী”। এটি স্বাধীনতা পরবর্তী দুইদশকের হিন্দিবলয়ের গ্রামজীবনের স্যাটায়ার । উত্তর প্রদেশের কাল্পনিক গ্রাম শিবপালগঞ্জ আসলে ওই সময় এবং গ্রামজীবনের প্রোটোটাইপ। প্রান্তিক গ্রামে আধুনিক বিকাশের খঞ্জ পদচাপ এবং তার ফলে মূল্যবোধের পতন ধরা পড়েছে এক তেতো হাসির মাধ্যমে। এই অনুবাদে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর অক্ষম প্রচেষ্টায় যদি একজন পাঠকও মূল হিন্দি রচনাটি পড়তে আগ্রহী হন, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।] 


অধ্যায়-১

শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই গ্রাম-ভারতের মহাসাগরের ঢেউ।
ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ট্রাক। দেখলেই মনে হয় যে শুধু সড়কের সাথে বলাৎকার করার জন্যেই এর জন্ম। সত্যের যেমন নানা রং,এই ট্রাকেরও তেমনি। ওদিক থেকে দেখলে পুলিসের মনে হবে যে ওটা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আবার এদিক থেকে দেখলে ড্রাইভার ভাববে যে ও তো রাস্তার একপাশে দাঁড় করানো রয়েছে। চালু ফ্যাশনের হিসেবে ড্রাইভার ওর ডানদিকের দরজাটা খুলে ডানার মত ছড়িয়ে রেখেছে। এতে ট্রাকের সৌন্দর্য নিঃসন্দেহ বেড়ে গে্ছে, আর ওর পাশ কাটিয়ে কোন গাড়ি যে এগিয়ে যাবে তার ভয় ও এড়ানো গেছে।
রাস্তার এক দিকে পেট্রল পাম্প, উল্টো দিকে খাপরা কাঠ আর টিনের পচে যাওয়া টুকরোটাকরা নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি কিছু দোকানের চালাঘর। একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায় যে এগুলোকে দোকানের মধ্যে গন্য করা মুশকিল। সবগুলোতে জনগণের প্রিয় একটি পানীয় পাওয়া যায়-- যা কিনা ময়লা কালো চা বানাতে বার কয়েক ব্যবহৃত পাতা আর গরম জলের মিশ্রণ মাত্র। এর মধ্যে বারকোশে কিছু মেঠাই আপনার চোখে পড়বে যেগুলো রাত-দিন ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাত ও মশা-মাছির হামলার বাহাদুরের মত মোকাবিলা করে টিঁকে আছে। এগুলো আমাদের দেশি কারিগরের হস্তশিল্প ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির নমুনা বটে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে যদিও আমরা এখনো ভালো ব্লেড বানাতে পারিনি কিন্তু আবর্জনাকে সুস্বাদু খাদ্য পদার্থে পরিবর্তিত করার দক্ষতা গোটা দুনিয়ায় শুধু আমাদেরই আয়ত্ত্বে।
ট্রাকের ড্রাইভার ও ক্লিনার একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল।
রঙ্গনাথ দূর থেকে ট্রাকটাকে দেখতে পেয়ে জোরে পা চালাতে লাগল। আজ রেলওয়ে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। লোক্যাল প্যাসেঞ্জার ট্রেনটাকে ও রোজকার মত দু'ঘন্টা লেট ধরে নিয়ে ঘর থেকে রওনা দিয়েছিল। গিয়ে দেখল সে ব্যাটা আজ মাত্তর দেড় ঘন্টা লেট। নালিশ-বইয়ের কথাসাহিত্যে নিজস্ব যোগদান করে আর রেলওয়ের অফিসারদের চোখে বোকা সেজে ও স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তায় চলতে চলতে ট্রাক দেখতে পেয়ে ওর মন- সেটা শরীরের যে জায়গাতেই থাকুক না- নেচে উঠল।
ট্রাকের কাছে পৌঁছে গিয়ে দেখল ড্রাইভার ও ক্লিনার চায়ের শেষ চুস্কি-চুমুক নিচ্ছে। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের খুশি ঢেকে ড্রাইভারকে একটু নির্বিকার ভাবে জিগাইল,--কি গো ড্রাইভার সাহেব, ট্রাক শিবপালগঞ্জের দিকে যাবে?
ড্রাইভার খাচ্ছিল চা আর দেখছিল চা-ওয়ালিকে; দায়সারা জবাব দিল--যাবে।
" আমাকে সঙ্গে নেবেন? পনের মাইলের মাথায় নেমে যাবো। শিবপালগঞ্জ পর্য্যন্ত ।"
ড্রাইভার এতক্ষণে চা-ওয়ালির মধ্যে নিহিত সমস্ত সম্ভাবনাকে জরিপ করে নিয়েছে। এবার চোখ ফিরেছে রঙ্গনাথের দিকে। আহা! চেহারা বটে! নবকঞ্জলোচন-কঞ্জমুখকর-কঞ্জপদ-কঞ্জারুণম্! মাথায় খদ্দরের টুপি, গায়ে খদ্দরের খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবী। কাঁধে ঝুলছে বিনোবা ভাবের ভূদানী-ঝোলা। হাতে চামড়ার অ্যাটাচি। ড্রাইভার ওর দিকে অবাক হয়ে দেখতেই থাকল। তারপর কিছু ভেবে বলল-- বসুন শিরিমানজী, এক্ষুণি রওনা দেব।

ঘরঘরিয়ে চলছে ট্রাক। শহরের আঁকাবাঁকা মোড়ের প্যাঁচ থেকে ফুরসত পেয়ে একটু এগোতেই অনেক দূর পর্য্যন্ত জনহীন পরিষ্কার রাস্তা। ড্রাইভার প্রথমবার টপ গিয়ার লাগালো, কিন্তু সেটা পিছলে পিছলে নিউট্রাল হতে শুরু করল। প্রতি একশ'গজ চলতেই গিয়ার পিছলে যায় আর অ্যাকসিলারেটরে চাপ থাকায় গাড়ির ঘর-ঘর আরো বাড়ে।
রঙ্গনাথ বলল," ড্রাইভার সাহেব, তোমার গিয়ার তো একদম দেশের সরকারের মত"।
ড্রাইভার মুচকি হেসে এই সার্টিফিকেট গ্রহণ করল। রঙ্গনাথ ভাবল যে নিজের বক্তব্যটি আরো একটু স্পষ্ট করে দেয়। --" ওকে যতই টপে চড়াও না কেন, দু'গজ যেতে না যেতেই পিছলে ঠিক নিজের পুরনো খাঁচায় ফিরে আসে।"
ড্রাইভার হেসে উঠলো " অনেক বড় কথা বলে দিলেন শিরিমানজী।"
এইবার ও গিয়ার কে টপে নিয়ে নিজের এক পা' প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণে বেঁকিয়ে গিয়ারের জঙ্ঘার নীচে চেপে দিল। রঙ্গনাথ ভাবল যে বলে- দেশ শাসনের স্টাইলও এমনিই হয়। কিন্তু কথাটা বড্ড বেশি বড় হয়ে যাবে ভেবে চুপ করে রইল।

ইতিমধ্যে ড্রাইভার নিজের ঠ্যাংখানা গিয়ারের জঙ্ঘার থেকে সরিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।আর গিয়ারের ওপর একটা কাঠের লম্বা টুকরো গুঁজে দিয়ে ওর আর এক মাথা প্যানেলের নীচে ঠুকে দিয়েছে।
ট্রাক দৌড়ুচ্ছে ভীমবেগে। ওটাকে দেখামাত্র সাইকেল-আরোহী, পথচারী, এক্কাগাড়ি সবাই ভয়ের চোটে অনেক দূর থেকেই রাস্তা ছেড়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। ওদের পালানোর স্পীড দেখে মনে হচ্ছে যে ওটা ট্রাক নয়, কোন দাবানল, বঙ্গোপসাগরের ঘুর্ণিঝড়, অথবা পিন্ডারি দস্যুদলের হামলা।
রঙ্গনাথ ভাবছিল যে অনেক আগেই হাঁকা পাড়া উচিৎ ছিল---শোনো গ্রামবাসী ,শোনো! নিজেদের পশু ও বাচ্চাদের ঘরের ভেতর আটকে রাখো। শহর থেকে এক্ষুনি একটা ট্রাক বেরিয়েছে।
এবার ড্রাইভার বলল, " বলুন শিরিমানজী! কী খবর? অনেক দিন পরে গাঁয়ের দিকে যাচ্ছেন।"
রঙ্গনাথ শিষ্টালাপের জবাবে একটু মুচকি হাসলো। ড্রাইভার বললো," শিরিমানজী, আজকাল কি করছেন?"
--"ঘাস কাটছি।"
ড্রাইভার হেসে ফেললো। কপাল খারাপ, একটা ন্যাংটো-পুঁটো বাচ্চা ট্রাকের নীচে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল আর পাশের নয়ানজুলিতে টিকটিকির মত আছড়ে পড়ল। ড্রাইভার অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে দাঁত বের করে বলল," কি কথাই বল্লেন! একটু খুলে বলুন।"
--" বল্লুম তো, ঘাস কাটছি। একেই ইংরিজিতে রিসার্চ করা বলে। গত বছর এম এ পাশ করেছি, এবছর রিসার্চ শুরু করেছি।"
ড্রাইভার যেন ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প শুনছে। মুচকি হেসে বললো," তো শিবপালগঞ্জে কি করতে যাচ্ছেন?"
-" ওখানে আমার মামা থাকেন। অসুখে পড়েছিলাম। কিছুদিন গাঁয়ে থেকে শরীর ভাল করে আসব।"
এবার ড্রাইভার অনেকক্ষণ হাসতে থাকলো," কি যে গল্পো বানিয়েছেন শিরিমানজী?"
রঙ্গনাথ ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো," এর মধ্যে গল্প বানানোর কি হল?"
ড্রাইভার ওর সারল্যে হাসতে হাসতে বিষম খেল। " কি যে বলেন! আচ্ছা, কাটিয়ে দিন ওসব। বলুন, মিত্তাল সাহেবের কি অবস্থা? ওই পুলিশের গারদে খুনের ব্যাপারটা কদ্দূর?"
রঙ্গনাথের রক্ত শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলায় বললো," আরে, আমি কি জানি এই মিত্তাল কে?"
ড্রাইভারের হাসিতে ব্রেক লেগে গেছে। ট্রাকের গতি কিছু কমেছে। রঙ্গনাথের দিকে কড়া করে তাকিয়ে ও জিগ্যেস করলো," আপনি মিত্তাল সাহেবকে চেনেন না?"
-" না তো।"
--" আর জৈন সাহেবকে?"
--" একদম না।"
ড্রাইভার এবার ট্রাকের জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে সাদা গলায় বলল," আপনি সি আই ডি বিভাগে কাজ করেন না?"
রঙ্গনাথ এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল," সি আই ডি? সেটা কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?"

ড্রাইভার বেশ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। ক'টা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। একটি জনপ্রিয় থিয়োরি হল যখ্ন যেখানে জায়গা পাবে, ঠ্যাং লম্বা করে দখল নেবে। গাড়োয়ানের দল ওই থিয়োরি মেনে গরুর গাড়ির ওপর মুখ ঢেকে পা লম্বা করে শুয়ে আছে। গরুগুলো নেহাৎ অভ্যেসবশে গাড়িগুলোকে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়েও 'জনগণ-জনার্দন' মার্কা ডায়লগ আছে, কিন্তু রঙ্গনাথের মুখ খোলার সাহস হল না। সি আই ডিওলা কথায় ওর মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ড্রাইভার প্রথমে রবারের হর্ন বাজালো। তারপর এমন একটা হর্ন বাজালো যা সঙ্গীতের আরোহ-অবরোহ সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বড় ভয়াবহ। কিন্তু গরুর গাড়ি আপন মনে আগের মতই যাচ্ছিল। ড্রাইভার বেশ স্পীডে ট্রাক চালাচ্ছিল, ভাবখানা যেন গাড়িগুলোর ওপর দিয়ে পার করবে। হটাৎ ওর আক্কেল হল যে ও ট্রাক চালাচ্ছে, হেলিকপ্টার নয়। তাই আচমকা ব্রেক কষলো, প্যানেলে ঠুঁসে রাখা কাঠের টুকরোটাকে ফেলে দিয়ে গিয়ার বদলে গরুর গাড়িগুলোকে প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে আগে বেরিয়ে গেল। এবার ও ঘেন্নার চোখে রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে বলল," সি আই ডি না হলে অমন খাদির কাপড় কেন পরেছ?"
এই আচমকা আক্রমণে রঙ্গনাথ হড়বড়িয়ে গেল। কিন্তু এটাকে সামান্য কথাবার্তা ভেবে সহজভাবে বলল," খদ্দর তো আজকাল সবাই পরে।"
--"দূর! কোন ঢঙের লোক এইসব পরে নাকি?" তারপর ও আবার জানলা দিয়ে থুতু ফেলে টপ গিয়ারে গাড়ি চালাতে লাগল।
রঙ্গনাথের পার্সনালিটি কাল্ট শেষ হয়ে গেছল। খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ও ঠোঁট গোল করে সিটি বাজাতে লাগল। ড্রাইভার ওকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে বললো-- দেখো জী! চুপচাপ বসে থাকো, এটা সংকীর্তনের জায়গা নয়।"
রঙ্গনাথ চুপ করল। তখন ড্রাইভার বিরক্তির সঙ্গে বলল," এই গিয়ার হতচ্ছাড়া বারবার পিছলে গিয়ে নিউট্রাল হয়ে যাচ্ছে। দেখছ কি? একটু ধরে থাক না!"
পরে আবার চটে গিয়ে বলল, " আরে অমনি করে নয়, এমনি করে! ভালকরে চেপে ধরে বসে থাকো।"
ট্রাকের পেছন থেকে বার বার হর্নের আওয়াজ ভেসে আসছে। রঙ্গনাথ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু ড্রাইভার না শোনার ভান করছিল। এমন সময় ক্লীনার ঝুলতে ঝুলতে এসে ড্রাইভারের কানের পাশের জানলায় খট খট করতে লাগল। ট্রাকওয়ালাদের ভাষায় এই কোডের নিশ্চিত কোন গূঢ় ভয়ংকর মানে আছে। কারণ, ড্রাইভার তক্ষুণি স্পীড কম করে ট্রাককে বাঁদিকের একটি লেনে চালান করে দিল।
হর্নের আওয়াজ এমন একটি স্টেশন-ওয়াগন থেকে আসছিল যেগুলো আজকাল বিদেশের আশীর্বাদে শ'য়ে শ'য়ে আমাদের দেশের প্রগতির জন্যে আমদানি হচ্ছে। স্টেশন-ওয়াগনটি ডানদিক দিয়ে এগিয়ে গিয়ে স্লো হয়ে একপাশে থামছিল। ওর থেকে বেরিয়ে আসা একটি খাকি হাত ট্রাককে থামতে ইশারা করল। এবার দুটো গাড়িই থেমে গেল।
স্টেশন-ওয়াগন থেকে নামল একজন অফিসারের মত দেখতে চাপরাশি আর চাপরাশির মত দেখতে এক অফিসার। খাকি পোশাকে গোটা দুই সেপাই ও নেমে পড়েছে। দলটা এসেই পিন্ডারী-দস্যুদের মত লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেড়ে নিয়েছে ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স, তো কেউ নিয়েছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড।কেউ ব্যাক-ভিউ মিররের নড়া ধরে নেড়ে দেখছে , তো কেউ ট্রাকের হর্ন বাজিয়ে দেখছে। তারপর এরা ব্রেক দেখল, ফুটবোর্ড নাড়িয়ে দেখল, লাইট জ্বালালো, ব্যাক করার সময় যে ঘন্টি বাজে তাও বাজালো। ওরা যা নেড়েচেড়ে দেখল তাই খারাপ। যেটাকে ছুঁলো সেটাই বিগড়ে গেল। এই ভাবে চারজনের দলটি চারমিনিটে প্রায় চল্লিশটি দোষ খুঁজে বের করল। তারপর একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডিবেট শুরু করল যে এই শত্রুর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ?
রঙ্গনাথ বুঝে গেল যে এই দুনিয়ায় কর্মফলের সিদ্ধান্ত, 'পোয়েটিক জাস্টিস' আদি গল্প--সব সত্যি। এখন ট্রাকের চেকিং হচ্ছে -মানে ওকে অপমান করার জন্যে ভগবান ড্রাইভারকে শাস্তি দিচ্ছে, হাতে হাতে । ও নিজের সীটে বসেছিল। এক ফাঁকে ড্রাইভার ওকে বললো--"শিরিমানজী, একটু নীচে নেমে আসুন। এখন আর গিয়ার ধরে বসে থেকে কি লাভ?"
রঙ্গনাথ নীচে নেমে অন্য একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ওদিকে ড্রাইভার আর চেকিং স্কোয়াড ট্রাকের এক-একটা পার্টস্‌ নিয়ে তর্ক জুড়েছে। দেখতে দেখতে তর্ক ট্রাক ছেড়ে দেশের পরিস্থিতি ও আর্থিক দুরবস্থা পর্য্যন্ত পৌঁছে গেল। আর একটু পরেই ওখানে উপস্থিত জনগণের মধ্যে ছোট ছোট সাব-কমিটি তৈরি হয়ে গেল। তারা আলাদা আলাদা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে এক একটি বিষয় নিয়ে এক্স্পার্ট ওপিনিয়ন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে সবাই মিলে একটি গাছের নীচে ওপেন সেশন শুরু করে দিল। আর একটু পরে বোঝা গেল সবার দম ফুরিয়ে এসেছে, সেমিনার সমাপ্ত প্রায়।
সব শেষে রঙ্গনাথের কানে এল অফিসারের মিনমিনে কন্ঠস্বরঃ
-- কি গো মিয়াঁ আশরফ, কি ভাবছ? ছেড়েই দিই?
চাপরাশি বলল,-- আর কি করবেন হুজুর! কহাঁ তক চালান-টালান বানাতে থাকবেন? এক-আধটা ভুলচুক হলে না হয় চালান করতেন?
এক সেপাই বলল,-- চার্জশীট ভরতে ভরতে রাত কাবার হয়ে যাবে।
কিছু আশকথা-পাশকথার পর অফিসারটি বলল,--- যা ব্যাটা বন্টা সিং, তোকে এবার মাপ করে দিলাম।
ড্রাইভার খোশামুদে স্বরে বললো-- এটা শুধু শিরিমানজী বলেই করতে পারলেন।
অফিসার অনেকক্ষণ ধরে দূরে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনাথকে দেখছিলেন। কাছে এসে বল্লেন," আপনিও এই ট্রাকে চড়ে যাত্রা করছেন?"
--আজ্ঞে হ্যাঁ।
--- কোন ভাড়া-টাড়া দেন নি তো?
-- আজ্ঞে না।
- - সে আপনার পোশাক দেখেই বুঝেছি। তবু জিগ্যেস করা আমার কর্তব্য।
রঙ্গনাথ ওকে একটু খ্যাপাবার জন্যে বলল,-- এটা আসল খদ্দর ভেবেছেন নাকি? এতো মিলে তৈরি খাদি।
কিন্তু অফিসারটি বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, " খাদি খাদিই হয়, তার আর আসল-নকল!
অফিসার চলে যেতেই চাপরাশি আর ড্রাইভার রঙ্গনাথের কাছে এল। ড্রাইভার বলল, "দুটো টাকা বের কর দিকি!"
ও মুখ ঘুরিয়ে কড়া সুরে বলল," ব্যাপারটা কি? আমি কেন টাকা দিতে যাব?"
ড্রাইভার তখন চাপরাশির হাত ধরে বলল," আসুন শিরিমানজি, আমার সঙ্গে এদিকে আসুন।" যেতে যেতে ও রঙ্গনাথকে শুনিয়ে দিল," তোমার জন্যেই আমার চেকিং হল, আর আমার বিপদের সময় তুমিই এমন ব্যভার করলে? এই লেখাপড়া শিখেছ?"
বর্তমান শিক্ষা-পদ্ধতি হল রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের মত, যার ইচ্ছে দুটো লাথি মেরে যাবে। ড্রাইভারও যেতে যেতে ওর ওপর দুটো ডায়লগ ঝেড়ে চাপরাশির সঙ্গে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল।
রঙ্গনাথ দেখল--- সন্ধ্যে নেমে আসছে, ওর অ্যাটাচি ট্রাকে তোলা রয়েছে, শিবপালগঞ্জ এখনো মাইল পাঁচেক হবে, ফলে ওর এখন মানুষের সহানুভূতির একান্ত দরকার। ও ধীরে ধীরে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। এদিকে স্টেশন-ওয়াগনের ড্রাইভার বার বার হর্ন বাজিয়ে চাপরাশিকে তাড়া দিচ্ছে। রঙ্গনাথ ড্রাইভারকে দুটো টাকা দিতে চাইল। ও বলল," যদি দেবেই তো আর্দালি সাহেবকে দাও। আমি তোমার টাকা নিয়ে কি করব?"
বলতে বলতে ওর গলার স্বরে সেই সব সন্ন্যাসীর প্রত্যয় এসে গেল, যাঁরা কারো পয়সা নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখেন না, শুধু অন্যদের বলতে থাকেন- আরে, তোমার পয়সা তো হাতের ময়লা মাত্র। চাপরাশি টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বিড়ির সুখটান দিয়ে ওটার আধজ্বলা টুকরোটা প্রায় রঙ্গনাথের পাজামার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সটান স্টেশন-ওয়াগনের দিকে চলে গেল। ওরা রওনা হয়ে গেলে ড্রাইভারও স্টার্ট দিল আর আগের মত টপ গিয়ারে গিয়ে রঙ্গনাথের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর কী জানি কী ভেবে মুখ ছুঁচলো করে শিস দিয়ে সিনেমার গানের সুর ভাঁজতে লাগল। রঙ্গনাথ চুপচাপ শুনছিল।

রাস্তার দুপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্টতার মাঝে কিছু যেন কাপড়ের গাঁঠরি মতন দেখা যাচ্ছে। এরা হল গাঁয়ের মেয়েছেলের দল, লাইন বেঁধে রাস্তার দুপাশে বসে আছে। এরা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসে বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছে, হাওয়া খাচ্ছে আর হয়ে যায় তো মলমূত্র ত্যাগও করছে। রাস্তার নীচে নোংরা ছড়িয়ে আছে আর তার দুর্গন্ধের ভারে সন্ধ্যের হাওয়াও কোন গর্ভবতী নারীর মতন আলস্যভরা চালে বয়ে চলেছে। একটু দূর থেকে কুকুরের খ্যাঁক-খ্যাঁক শোনা যাচ্ছে। চোখের সামনে ধোঁয়ার একটি জাল ছড়িয়ে পড়ছে। কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটি গাঁয়ের সীমানায় এসে পড়েছি। হ্যাঁ, এটাই শিবপালগঞ্জ।

ক্রমশ