অমৃত সদন - শামিম আহমেদ
Posted in অমৃত সদন৩
ভীষ্মের কথা মতো ব্রাহ্মণ দ্রোণ ক্ষত্রিয়বৃত্তিতে যোগ দিলেন। দুর্যোধন প্রভৃতি ১০১ জন ভাই; যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এই পাঁচ পাণ্ডব; অন্ধক, বৃষ্ণি প্রভৃতি বংশের কুমার, এমনকি সূতপুত্র কর্ণও এসে দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে লাগলেন।
একলব্য এতক্ষণ মন দিয়ে রাজা হিরণ্যধনুর বলা আখ্যান শুনছিলেন। তার পর এক সময় বলে উঠলেন, আচার্য দ্রোণ কি এখন জীবিত, নাকি এও পুরাকালের কাহিনি?
নিষাদরাজ হিরণ্যধনু বললেন, জীবিত এবং তিনি হস্তিনায় থাকেন। তবে হস্তিনার আকাশে এখন দুর্যোগের কালো মেঘ! আর সেই মেঘ কেটে গিয়ে কবে সূর্য উঠবে, তা কেউ জানে না।
“কেন পিতা?” একলব্য জিজ্ঞাসা করেন।
হিরণ্যধনু জবাব দেন, যে দেশের রাজা অন্ধ হন, সে দেশের ভাগ্য অন্ধকার!
“তবে যে শুনলাম, ভীষ্ম আর রাজমাতা সত্যবতী রাজ্য চালান?”
“সিংহাসনের বাইরের লোক রাজ্য চালালে দেশের ভাল হয় না বৎস! চারদিকে বৈশ্যরা ওৎ পেতে আছে, কবে যুদ্ধ লাগবে সেই প্রতীক্ষায়!”
একলব্যের এ সব কথা শুনতে ভাল লাগে না। তিনি দ্রোণাচার্যের ধনুর্বিদ্যা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমি কি হস্তিনানগরে গিয়ে ধনুর্বিদ্যা শিখে আসতে পারি?”
হিরণ্যধনু বলেন, পারো। কিন্তু দ্রোণাচার্য তোমাকে কি শিষ্য হিসাবে মেনে নেবেন?
“কেন নেবেন না? নিষাদ বলে?”
“না। নিষাদ বলে নয়। সূতপুত্র কর্ণও তো দ্রোণের শিষ্য। ভীষ্ম চাইবেন না, তিনি নিষাদ-ভীলদের ভয় পান। বনজঙ্গলের মানুষরা সব রাজা জরাসন্ধের পক্ষে।”
“একবার চেষ্টা করে দেখা করা যায় না?”
নিষাদরাজ বলেন, আমি তোমাকে বাধা দেব না, আবার যেতেও বলব না। ভীষ্ম কিন্তু সমস্ত খবর রাখেন। তুমি পিতার নাম হিরণ্যধনু বললে কেউ তোমাকে শিষ্য করবে না।
একজন নিষাদ যুবক বলে, ধনুর্বিদ্যা শিখতে নগরে যেতে হবে কেন? আমরাই তো সবচেয়ে ভাল ধনুকতীর চালাতে পারি, ওইজন্য আমাদের নাম ভীল। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা পশুদের শ্বাসের আওয়াজ পেয়ে তাদের তীরবিদ্ধ করতে পারি। কোন নগরের কোন আচার্য তা শেখাতে পারে, বলো শুনি?
একলব্য বলেন, মহাত্মা পরশুরামের কাছে দ্রোণাচার্য সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন। সেই শাস্ত্র পাঠ করলে জঙ্গলের ধনুর্বিদ্যা আরও শক্তিশালী হবে।
একলব্যের মা জাম্ববতী বললেন, সে যখন সময় হবে যেও খোকা। এখন চান করে তোমরা চাট্টি খেয়ে নাও দেখি। সূর্য ঢলে পড়ছে মাথা থেকে।
হিরণ্যধনুর অনুমতি নিয়ে নিষাদ পুরুষরমণীরা নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল। একটি মেয়ে বসে রইল চুপচাপ। তাঁর নাম অঙ্গা—অঙ্গাগ্রণী।
********************************
অঙ্গা’র নামটি বড় খটোমটো। এমন নাম দিয়েছিলেন পাঠশালার গুরুমশাই। নিষাদ মেয়েরাও ছেলেদের মতো পাঠশালায় যায়। অঙ্গাও যেত ছেলেবেলায়। তখন থেকেই সে একলব্যের অনুরক্ত। পাঠশালা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অনুরাগ আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই মাঝেমধ্যে নীল মেঘের মতো এক বনে এসে তারা দুজনে বসে। এমনই এক বসন্তকালের বনে অনেক ফুল ফুটে আছে, অঙ্গা সেই ফুল তুলে খোঁপায় গুঁজছে, কখনও বা একলব্যের কানে গুঁজে দিচ্ছে।
একলব্যের সে সবে মন নেই। ধনুর্বিদ্যা শিখতে সে যাবে হস্তিনানগরে। অঙ্গা বার বার বোঝাচ্ছে, হস্তিনা হল নগর, সেখানে অরণ্যচারী নিষাদ থাকবে কী প্রকারে? তাছাড়া ও রাজ্যের নিয়মকানুন জলা-জঙ্গল-পাহাড়ের মতো নয়। সেখানে একজন লোকের গাছ থেকে অন্য লোকে পেড়ে খেলে রাজপেয়াদা ধরে নিয়ে যায়। সকলে বাড়িতে খাবার জমায়। সোনাদানা ভরে রাখে সিন্দুকে। জঙ্গলের নিষাদরা সব ফেলে রাখে। সব প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রত্যেক লোকের সমান অধিকার। হস্তিনায় গিয়ে একলব্য কী খাবে, কে তাঁকে খেতে দেবে? সে তো জঙ্গল নয়!
একলব্য বলে, কয়েকটা দিন তো মাত্র। শুনেছি, হস্তিনার কাছে কুরুক্ষেত্রে এক কালে কুরুজঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে পলাশ, তিল, আম্র, চম্পক, দেবদারু, স্থলপদ্ম, অশোক, কুরুবক, নাগকেশর, তিনিশ প্রভৃতি বৃক্ষ ছিল। সেই বনে ফুটে থাকতো ফুল, ফলতো ফল। পারিজাত গাছকে জড়িয়ে থাকতো লতা।
অঙ্গা এসে একলব্যকে জড়িয়ে ধরে।
একলব্য বলতে থাকে, কত পাখি ছিল সেখানে! কোকিল আর ভ্রমর রব করতো!
অঙ্গা বলে, তুমি কবে গিয়েছিলে সেখানে?
একলব্য উত্তর দেয়, যেতে হয় না। জঙ্গল তো এমনই সুন্দর হয়। ঠিক সেই সময় দূর থেকে মৃদুমন্দ বায়ু এসে তাদের কামভাব জাগিয়ে তোলে।
তারা দুজনে উঠে যায় আরও ঘন বনে, যেসব জায়গায় ঢুকতে নিষাদরাও ভয় পায়। সেখানে থাকে জঙ্গলের আসল রাজা পশুরা। সেই ঘন বনের মধ্যেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এখন মধুমাস। অনেক জঙলি ফুল ফুটে আছে সেখানে। আমের মুকুলের অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকটি ঘুঘু পক্ষী আর কিছু শালিখ ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে কীসব আগডুম বাগডুম বলে যাচ্ছে। বনের সকল গাছ যেন কামভারে অবনত। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী সেই বনের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
অঙ্গা একলব্যকে জিজ্ঞাসা করে, আর কতদূরে যাবে একো?
একলব্য উত্তর দেয়, নীল মেঘের মতো এই জঙ্গলের ভিতর একটা গনগনে সূর্য আছে, সেখানে যাব আমরা!
“পুড়ে যাব না?”
“গায়ে বাকল পরে নিলে সূর্যদেব আর পোড়াতে পারেন না!”
“তুমি কি দেবতা যে সূর্য ঠাকুর তোমাকে ছেড়ে দেবেন?”
“না রে কন্যা, আমি নিষাদ, ভীল কখনও দেবতা হয় না!”
অঙ্গা বলে, আর কতদূর যাবে, আমার ভয় করছে!
“ভয়ই যদি পাবে, তবে এলে কেন?”
“কী জানি কে আমাকে তোমার সঙ্গে ঠেলে দিল গো ভীলবীর! সে বোধ হয় তনু ঠাকুর! বড় খতরনক চিজ, তনুর তীর-ধনুক দেখেছো? পাঁচ খানা মুখ তার—একটো মারে ভোরে, আরেকটো দুফরে, বাকিগুলান বিকাল-সাঁঝ আর রাত্তিরবেলা!”
একলব্য থমকে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণীর বদনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে।
মনে মনে মা জাম্ববতী আর বাপ হিরণ্যধনুর সম্মতি নিয়ে একলব্য অঙ্গাকে নিয়ে নীল মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ে। অঙ্গার অজনবি সুরতে একা তখন ফানা হয়ে গিয়েছে। অঙ্গা একলব্যকে বলে, “এই বলো না গো, আমি নিষাদকন্যা না রাক্ষসী?”
একলব্য জবাব দেয়, “তোমার শরীরখানি নিষাদীর, কিন্তু তুমি আসলে ডানাওয়ালা পরি। রাত গভীর হলে তোমার ডানা গজায়। অঙ্গার ওই বক্ষদেশে আছে যে তনুমন তা আসলে গন্ধর্ব গানের গোলা।’’
“তবে একখান গান গাও, আমার তনুর গান, মন-পসন্দ!”
একলব্য গান ধরে, হতাহমিতি চাক্রুশ্য...।
অঙ্গাগ্রণী তার পাহাড়ী মায়ায় একলব্যকে প্রেমাতুর করে তোলে। এই সেই পিরিতি, যাকে তন্ত্রসাধকরা কামনদী বলে থাকেন। নীল মেঘের মতো বনে একটি ক্ষুরধারা নদী এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অঙ্গাগ্রণী তার উর্ধ্বদেশের বস্ত্র অনাবৃত করে গেয়ে ওঠে, তীরধারা বয় গো নদীর তীরধারা বয়। তার পর দুজন নেমে পড়ে সেই খরস্রোতা নদীতে। অঙ্গা তার দুই কৎবেলবৎ স্তন দ্বারা একলব্যের বক্ষ মর্দন করতে করতে বলে, তুমি কি দানো না যক্ষ, না গন্ধর্ব, নাকি নক্ষত্রপুরুষ? তুমি আমার ভীল, তুমি আমার তিল এই সব কথা আগে জানলে তোমাকে আমের ননীর মতো চুষে চুষে খেতাম!
একলব্য বলে, তিল থেকে তাল হয় শুনেচি বাপু, কিন্তু তিল থেকে একলব্য হয় কী প্রকারে!
“একলব্য মানে তাল। ফল নয়, এ হল সুরতাল। আমার গোটা দুনিয়া হল সেই একলব্য নামের তাল, আর দুনিয়া ছেনে তুমি যা পাও তাই হল তিল—হৃদয়মন। তোমাকে তালের আঁটির মতো চুষে খেয়ে ফেলতে বাসনা হয় গো জাম্বোর পো!”
“কেন অঙ্গাগ্রৈণী! এই নদীর স্রোতে আমাকে তো তুমি খাচ্ছোই। তবে আমিও ছাড়ার বান্দা নই। আঁটির ভেতরে থাকে যে শাঁস, যাকে তান্ত্রিক বলে রুহ, আমি সেই থানে যেতে চাই।
একলব্য অঙ্গাগ্রণীর ওষ্ঠ পীড়ন করতে লাগল। একলব্যের নিষ্ঠুর আক্রমণে অঙ্গার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। নদীর স্রোত এসে তাদের দুজনের সব বস্ত্র হরণ করে নিয়ে গেল। উর্ধ্বাঙ্গের পীড়নে নিম্নাঙ্গে জ্বলে উঠল কামনা। ঢেউ আসতে লাগল একের পর এক। বাসনার প্রবলতায় তরল এক বাড়বাগ্নি অঙ্গাগ্রণীর জঠরে প্রবেশ করে। আপ্লুত হয়ে ওঠে সে।
তার পর দুজনেই দেখে সেই তীরধারা নদী আর নেই। দূরে বায়ু বইছে মৃদুমন্দ। ছালবাকল খুঁজে পরে নিয়ে তারা ফিরে এল হিরণ্যধনুর নিষাদরাজ্যে। তখন সেখানে গান গাইছে নিষাদরমণীরা। সেই গানের ভাষা নেই কোনও। একটানা সুর যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে নদীর স্রোতের মতো, আর সেই সুরে ভর দিয়ে সূর্যদেব চলে যাচ্ছেন বিশ্রাম নিতে, দূরে কোথাও।
এমন সময় একলব্যের খুব বিষণ্ন লাগে। সূর্যাস্তের এই কালে মনে হয়, জগৎ সংসার সব মিছে। আর একটু পরে ভীলদের সভা বসবে। অঙ্গাগ্রণী বাড়ি চলে গিয়েছে। সন্ধ্যা গাঢ় হলে সে আসবে রাজা হিরণ্যধনুর মাটির ঢিপির কাছে। আজই সভায় ঠিক হবে, একলব্য হস্তিনায় গিয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে কিনা! কয়েকটা লোক ইতিমধ্যে এসে গিয়েছে। মশাল জ্বালানোর তোড়জোড় করছে তারা। এমন সময় মাতব্বরের একটা দল এল। সভায় যে শুধু মাতব্বরদের কথা শোনা হয়, এমন নয়। রাজা হিরণ্যধনু সাধারণ অল্পবয়সীদের কথাও মন দিয়ে শোনেন। ভীল সমাজে কেবল পুরুষ নয়, মহিলারাও সভায় আসেন এবং তাঁদের মতামত দেন। হস্তিনানগরের রাজকার্যে যা হয় না বলেই শোনা যায়।