Next
Previous
0

গল্প - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত

Posted in





ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে ধপ করে মেট্রোর সিটে এসে বসলেন প্রবাল সান্যাল। গন্তব্য কাতশু-শিকাকু স্টেশন, তাঁর বাড়ি। অথবা গত বারো বছর যেটাকে তিনি বাড়ি বলে এসেছেন।

জাপানী আই টি সেক্টরের ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও তাঁর বিয়েটা করে হওয়া ওঠেনি। অথচ আজকে মনে হচ্ছে একলা বাড়িটায় ফিরে কারুর কাছে আশ্রয় নিতে পারলে বোধয় ভালো হতো। রাত প্রায় বারোটা বাজে, মেট্রোর কম্পারট্মেন্ট শুনশান, দূরে একটা মেয়ে বসে আছে কেবল - ফরসা প্রায় সাদা গায়ের রঙ, দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানকার অধিবাসী।

প্রবালের নিজের অজান্তেই একটা হাই উঠে গেল, ঠিকঠাক খাওয়া হয়েছিল সেই দুপুরবেলা - লাঞ্চ। তারপর সারাদিন যা ঝড় গেল... মিটিং আর মিটিং।
অবশ্য প্রাণ বাঁচাতে মিটিংগুলো করতেই হত, কিন্তু করেই বা কি লাভ হোল?

ভিপির পদ থেকে আজ সরাসরি বরখাস্ত হলেন প্রবাল সান্যাল, কেউ কিছু করতে পারল না। হ্যাঁ, দীর্ঘ সতের বছরের কেরিয়ারে এই প্রথম তিনি জবলেস, বেকার।
মাথাটাকে পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে মেট্রোর উজ্জ্বল আলোগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। হ্যাঁ কোম্পানির কিছু শেয়ার আছে তাঁর, বেশ কিছু সেভিংসও । আর ইন্ডিয়াতে আছেন অসুস্থ বাবা, ভাইয়ের কাছে। অর্থাভাব হবে না ঠিকই, কিন্তু বাবাকে নিয়ে আসা যাবে কি? ট্রিট্মেন্টের জন্য?

ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল প্রবালের। হঠাৎ সামনে কে একটা দাঁড়িয়ে আছে ফিলিং হওয়াতে চোখ খুলে চেয়ে দেখেন... ওই জাপানী মেয়েটা ! মুখে একটা সারজিকাল মাস্ক, স্থির দৃষ্টিতে প্রবালের দিকে চেয়ে...

জাপানী ভাষায় "এক্সকিউজ মি" বলে একটু ধরমর করে উঠে বসলেন প্রবাল। রাত বিরেতের ফাঁকা ট্রেনে, কি ধান্দা কে জানে?

উত্তরে প্রবালকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বলে উঠলো, "নমস্কার, আমার নাম কুচি... কুচিসাকি ওনা..." বলে হাসল মেয়েটি, অর্থাৎ ওর চোখগুলো হাসল বলে মনে হোল।

প্রবাল একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলেন। একটু সামলে নিয়ে জাপানীতেই বললেন, "ও... নমস্কার, আমি প্রবাল সান্যাল। কিন্তু আপনি...বাংলা..."

- "আমি সব ভাষাই জানি।" বলে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। বলে পাশে বসে পড়ল।

অস্বস্তিতে প্রবাল একটু সরে গেলেন। মেয়েটার গা যেন অসম্ভব ঠাণ্ডা আর হাত-পা গুলো ফ্যাকাসে সাদা। মেয়েটার গায়ে একটা সাদা ডক্টরস কোট, পকেটে কি একটা আছে যেন...
পাশে বসেও মেয়েটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রবালের দিকে। ট্রেন চলছে শান্ত দুলুনিতে, কোথাও কোন শব্দ নেই...

আচমকা মেয়েটা বলে উঠল, "আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল..." বলে সারজিকাল মাস্কটা আস্তে আস্তে খুলে প্রবালের দিকে চাইল..."বলুন তো, আমি কি সুন্দর?"

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে প্রবাল যেন ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন। মেয়েটার ঠোঁটের দুটো প্রান্ত চেরা - যেন কোন ধারালো ছুরি দিয়ে করা কোন ম্যাকাবর শিল্পকর্ম ! এ জিনিস প্রবাল আগে দেখেছেন, ইনফ্যাক্ট পড়েছেন, স্নেহাশিসের বাড়িতে একটা মাঙ্গায়।

মুহূর্তে বুঝতে পারলেন তিনি কার পাল্লায় পড়েছেন। মেয়েটির নামটা তাই চেনা চেনা লাগছিল। জাপানে থাকতে থাকতেই এই গল্পগুলি শুনেছিলেন বন্ধুদের কাছে। ভুতের গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু এ যে সত্যি ! এরকম জঘন্য একটা দিনে তাঁরই কপালে...

মেয়েটি উত্তরের অপেক্ষায় তাঁর দিকে চেয়ে আছে। কোটের পকেট থেকে বার করে নিয়েছে একটা বড় কালো কাঁচি। প্রবাল খুব বুঝতে পারছেন কি হতে চলেছে...কোনক্রমে চোখ বন্ধ করে দুটো হাত তুলে তিনি বললেন, "হ্যাঁ তুমি সুন্দরী..."

মেয়েটি বলল, "বেশ..." বলে কাঁচি দিয়ে নিজের ঠোঁট দুটো আরেকটু চিরে দিল। ক্ষতস্থান দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্ত, মেয়েটিকে দেখতে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। এবারে মেয়েটি মুখ খুলল, "এবার? বলুন আমাকে সুন্দর লাগছে দেখতে?"

অদ্ভুতভাবে অসম্ভব ভয়ের মধ্যেও প্রবালের মনের মধ্যে কেমন যেন রাগ জন্মাচ্ছিল।

মেয়েটার প্রায় কান অব্দি চেরা মুখটার দিকে তাকিয়ে দুম করে বলে বসল, "না একবারেই সুন্দর দেখতে না আপনাকে..."

মেয়েটা অথবা ভুতটা শুনে কেমন হকচকিয়ে গেল যেন।

সাধারণত যে মানুষেরা তার খপ্পরে পড়ে, তারা "বাবা-রে মা-রে" করে ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে "সুন্দর" সুন্দর" বলতে বলতে শেষে আর বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে সত্যিটা অর্থাৎ "কুৎসিত" বলে বেঘোরে প্রাণটা খোয়ায়। যারা আবার একটু বেশি চালাক হয়, তারা হয় বলে "অ্যাভারেজ" নাহলে নিজেরাই ফিডব্যাক চেয়ে বসে। লাভের মধ্যে এতে কিছুটা সময় পাওয়া যায়।

কিন্তু এ বাঙালি সেসবের ধার না মাড়িয়ে সরাসরি কুৎসিত বলে দিল যে !!! অভিশাপ অনুযায়ী এবার একে তো এবার মারতেই হবে।

এ সমস্ত ভেবে কুচিসাকি যেই না কাঁচিটা তুলেছে বাঙালিটিকে পিস পিস করার জন্য, তখনই বাঙালি দৃপ্ত ভঙ্গীতে হাত তুলে বললেন, "দাঁড়ান..."

"দেখুন, আপনাকে যেই না সত্যিটা বলেছি সেই আপনার আপমাকে খুন করতেই হবে, তাই না? বলি, কেন? কারণটা কি? অনেস্ট ফিডব্যাক নিতে পারেন না? সেই কবে তিনশো বছর আগে ব্যভিচারের অপরাধে আপনাকে আপনার বর মিউটিলেট করে দিয়েছিল সামুরাই তরবারি দিয়ে, তার জন্য আপনাকে সেই ঘুরে বেড়াতেই হবে? একলা মানুষ পেয়ে ভয় দেখাতেই হবে? সুন্দর দেখতে কিনা উত্তরে যদি সত্যি কথা, অর্থাৎ "না" বলে, ওমনি প্রাণে মেরে দিতেই হবে? এটা কোন কাজের কথা হোল কি? যান না, আপনার বরকে খুঁজে, সেও এতদিনে মরে ভূত হয়ে গিয়ে থাকবে, দিন দু ঘা লাগিয়ে। আমাদের পেছনে পড়েছেন কেন?"

বাঙালি উত্তেজিত হয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে...

"আর তাছাড়া কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে সবাইকে সুন্দর হতেই হবে? তুমি সুন্দর, আমি নই, ব্যস, মিটে গেল। তেমনি তুমি ঝিঙে-পোস্ত রান্না করতে পারো? আমি পারি। তুমি পি এল এস্কুয়েলে কোডিং করতে পারো? আমি পারি। এরকম অনেক জিনিস আছে যেটা তুমি পারো, আমি পারি না। তেমনি আমি পারি, তুমি পারো না এরকম জিনিসও আছে নিশ্চয়ই। কি তাই তো? তা এ নিয়ে খুন জখম করার মানে টা কি?" বলে বাঙালি একটু দম নিয়ে বসল যেন।

তারপর একটু গোঁজ হয়ে বসে থেকে বলে উঠলো, "আচ্ছা, সবাইকে ইনোভেটর হতে হবে? সবার নতুন নতুন আইডিয়া থাকতেই হবে? আর আমি যে ফুজিৎসুর ভিপি হিসাবে পাঁচ বছর ধরে এতো ভালো ভালো কাজ করলাম, তার কোন দাম নেই?
আরে কোত্থেকে এসেছে পেনিসিল্ভেনিয়ার সাহেব - হিলন রাস্ক না কি নাম। এসেই ভাবছে একেবারে কেঁচে-গণ্ডূষ করবে সব কিছু। আরে এই ইন্ডাস্ট্রিতে ওনারও তো অভিজ্ঞতা নেই। যাকগে যা। আমিও প্রবাল সান্যাল, ঠিক নিজের জায়গা করে নেবো। হুহ..." বলে আবার গোঁজ হয়ে গেলেন তিনি।

পাশে বসে কুচিসাকি হাঁ করে সব কিছু শুনছিল। কাঁচিটা কখন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে টেরও পায়নি সে। সত্যিই তো কতো কতো বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে, কতো নিরীহ লোকের প্রাণ গেছে তার হাতে...তার কি কোন শান্তি নেই?

হঠাৎ পাশে বসা মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল প্রবালের - "ওঃ, ভুলেই গেছিলাম ! আপনি তো আমাকে মারবেন, তাই না? কোথায়? কাঁচি কোথায়? মারুন দেখি, বিরক্তিকর লাগছে..."

কুচিসাকি চুপ করে বসে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে জাপানী ভাষায় বলে, "আপনি কি খুব একা?"
প্রবাল কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, "হুম, আমি বরাবরই একা। সেই আট বছর বয়সে মা চলে গেল, তারপর থেকেই..."


কাতশু-শিকাকু ষ্টেশনে এসে ট্রেন থামল। বাজে রাত সাড়ে বারোটা। ট্রেন থেকে নেমে এলেন প্রবাল সান্যাল, গায়ে দামী ব্লেজার, হাতে অ্যাটাচি। আর তার ঠিক কাঁধে পা ঝুলিয়ে অদৃশ্য কুচিসাকি ওনা।

আর ছাড়াছাড়ি নেই, একাকীত্বও নেই...