Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





" ভাঙ খেয়ে বিভোর ভোলানাথ, ভূতগণ সঙ্গে নাচিছে,
সদা কালী কালী কালী বলে মধুর ডমরু বাজিছে।
শিরেতে শোভিছে জটাজুট ফণী,
ললাটে শোভিছে দেবী মন্দাকিনী,
চরণ চাপিয়া ভূধর ধরণী কুলুকুলু ধ্বনি করিছে।"
সকাল দশটা বাজে। প্রেয়ার হলের বারান্দায় হারমনিয়াম ও খোল বাজছে; আমরা যে যার মত নাচছি গাইছি। আজকে আর স্কুল হবে না।
আজকে যে মহাশিবরাত্রি। শীত প্রায় চলে গেছে, সান্ধ্য বাতাসে আমের বউলের গন্ধ আর কোকিলের ডাক। আজকে সারাদিন উপোস।
তবু ভাল লাগে। বাঁধা রুটিনের বাইরে কিছু একটা হলেই ভাল লাগে। কাল থেকে তো আবার সেই! তাই আজকের দিনটা বেশি ভাল লাগে। এ যেন তেহাই দিয়ে সমে ফিরে আসা।
খালি এইটুকু? না, না। আজ আমরা সারাদিন উপোস করে বেলা বাড়লে সুনীল মহারাজের সঙ্গে মিছিল করে গাইতে গাইতে দারুকেশ্বর নদীতে যাব। সেখানে স্নান করে এঁটেল মাটি তুলে এনে শিব গড়ে আশ্রমে আমাদের ঘরের সামনে বারান্দায় রাখব। তারপর সন্ধ্যে থেকে লেবুর ও বেলের সরবত খেয়ে উপোস ভাঙ্গা হবে। এর পর ফল প্রসাদ, সন্দেশ সব খেয়ে রাত্তিরে জমপেশ করে খিচুড়ি খেয়ে পর্বটি শেষ হবে।
আস্তে আস্তে আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত গাইছি, কেউ কেউ নাচছি।
অমিয়দারা গাইছেঃ
" জয় শিবশংকর হর ত্রিপুরারি,
পাশী পশুপতি পিনাকধারী।
শিরে জটাজুট কন্ঠে কালকূট,
সাধক-জন-মন -মানস-বিহারী।"

আমি, বিপ্লব ও নিখিলেশ গাইছিঃ
" নাচে পাগলা ভোলা বাজে বম বম বম,
আবার শিঙা বাজিছে ভোঁ ভোঁ ভম ভম ভম।
শিরে করিছে গঙ্গা কল-কল-কল,
আবার চরণচাপেতে ধরা টলমল টল,
আবার মৃদঙ্গ ধরে তাল তাথম তাথম"।
এখন আমরা সবাই শিবের চেলা। তাই নন্দী-ভৃঙ্গী হওয়ার বাসনা। প্রায় সবাই খালি গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে। কেউ কেউ রুম থেকে মুখে পাউডার ঘষে ছাইমাখার অনুষঙ্গ আনার চেষ্টা করেছে। কারণ ঘন্টাখানেক পরেই আমরা মিছিল করে নদীতে স্নান করতে যাব। ভাঁটার সময়। পাড়ের কাছে কাদা। সেখান থেকে মাটি তুলে এনে শিব গড়ব-- জোয়ার আসার আগেই। আবার বিকেলে ভাটার সময় নদীতে গিয়ে শিব বিসর্জন দিয়ে ফিরে তারপর উপোস ভাঙ্গবে।
শিবরাত্রির উপোস জানতাম মেয়েরা করে, শিবের মত বর পাওয়ার জন্যে। এখানে ছেলেরাও করে। কেন করে? সবাই করে তাই।
ভুল বললাম। সবাই করে না। এর জন্যে কোন চাপ নেই। কর্তৃপক্ষ কাউকেই উপোস করতে বাধ্য করেন না। তবে যারা করবে না তাদের ব্রহ্মচারী হরেনকে জানিয়ে দিতে হবে যাতে দুপুরের রান্না কতটা হবে তার আন্দাজ পাওয়া যায়।
কোন বছর না করে দেখেছি-- নিজেকে কেমন দলছাড়া একলা লাগে। একসাথে উপোস করলে নেচে গেয়ে কখন সময় কেটে যায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় টের পাওয়া যায় না।
ক্ষিদে? পায় বই কি! তবে মাঝে মাঝে, ওই জোয়ার-ভাঁটার মত অনুভূতিটা আসে যায়।
দুপুরের দিকে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভাল।
এবার কানাইদা নেই। সুনীলদা বেসুরো। তাতে কি? আমরা চেঁচিয়ে কর্ত্তাল বাজিয়ে কোন কসুর রাখছি না।
এসে পড়ল খেয়াঘাট।
আমরা হৈ হৈ করে জলে নামছি। বেশ কাদা। পা হড়কে যাচ্ছে। কারও কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রশান্তকে নিখিলেশ ল্যাং মেরে কাদায় ফেলে দিল। ও চেঁচাচ্ছে , নিখিলেশকে শকার-বকারে আপ্যায়িত করছে। সবাই হেসে কাদায় গড়াচ্ছে। সুনীল মহারাজ আজ দেখেও দেখছেন না।
আমি সাঁতার জানি না। ভয়ে ভয়ে জলের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াই, নামি না।
যারা জানে, তারা কেউ কেউ জলে নেমেছে, স্নান করছে কম, জল ছিটোচ্ছে বেশি। অন্যেরা পাড়ে বা কাদায় বাবু হয়ে বসে গায়ে কাদা মাখছে। কেউ কেউ মাথায় মুখে এমন করে কাদা মেখেছে যে চেনাই যাচ্ছে না।
আমি এদের মধ্যে ঠিক কি করব বুঝতে না পেরে ক্যাবলা ক্যাবলা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এদের মেক আপ দেখছি।
পেছন থেকে কাদামাখা দুটো হাত আমাকে জড়িয়ে ধরে তারপর আমাকে টানতে টানতে আরও কাদায় নিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। আমি ভয়ে ঘেন্নায় চেঁচিয়ে উঠি। গঙ্গার হাওয়ায় সেই ডাক ছড়িয়ে যায়, কারও কানে পৌঁছয় না।
মূর্তিটা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে-- লাকি, গাধার মত চেঁচাস না তো! আয়, তোকে ভাল করে কাদা মাখিয়ে সাজিয়ে দিই। তারপর আমার সঙ্গে হাত ধরে জলে নেমে ডুব লাগাবি। সব ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দেব। ভয় পাস না; আমি ভালরকম সাঁতার জানি। হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় কলেজ স্কোয়ারে শিখে নিয়েছি।
বিপ্লব! মানে মিতা?
মিতা আমাকে পনের মিনিট ধরে কাদা মাখায়, সাজায়--- এই বার তোতে আমাতে মিলে পারফেক্ট নন্দী- ভৃঙ্গী , বুঝলি?
গায়ে কাদা শুকিয়ে চড়চড় করছে। এবার স্নান করতে হবে।সুনীল মহারাজের কড়া নির্দেশ-- যারা সাঁতার জানে তারা একটা চেইনের মত করে বুকজলে দাঁড়াবে। আর যারা জানেনা তারা ওই চেইনের এপারে কোমর জলে ডুব লাগিয়ে চান করবে। আনাড়িগুলো পাড়ে উঠলে পরে তবে সাঁতারুদের পালা।
আমাকে মিতা বুকজলে টেনে নিয়ে যায়, ভয় করে। ও আমার দুহাত ধরে এক-দুই-তিন বলে টেনে একসঙ্গে ডুব দেয়, খানিকক্ষণ জলের নীচে দম ধরে রাখে , আমি একটু পরেই হাঁচোড় পাঁচোড় করে ভেসে উঠে শ্বাস টানতে থাকি। ও যত্ন করে পিঠের কাদা শুইয়ে দেয়।
বলে--এই শেষ বার। এবার জলের নীচে চোখ খুলে দেখার চেষ্টা কর। মজা পাবি। সাহস বাড়বে। নে, আমার হাত ধর। এক -দুই-তিন!
আমি জলের নীচে চোখ খোলার চেষ্টা করি। কিচ্ছু দেখতে পাইনা, শুধু একটা ঘোলাটে দেওয়ালের মত। কিন্তু হটাৎ মিতা ওর হাত ছাড়িয়ে নেয়।
আমি ভয় পেয়ে ভুস্‌ করে ভেসে উঠে দেখি পাশে মিতা নেই।
চারদিকে তাকিয়ে দেখছি -কানে এল পাড়ের থেকে গেল-গেল-ডুবে গেল; মা ডেকে নিলেন-- চেঁচামেচি। নদীর দিকে ভাল করে তাকাতেই চোখে পড়ল-- বিপ্লব, অনিরুদ্ধ,অমিয়দা প্রাণপণে সাঁতরাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে নদীর আরও গভীরে। বেশ দুরে একটা মানুষ উঠছে-ডুবছে, মাঝে মাঝে হাত তুলছে।
ঘাট থেকে দুজন স্থানীয় লোক আন্ডারওয়ার পরা অবস্থায় জলে ঝাঁপ দিল। এরা দ্রুত স্ট্রোক কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ডুবন্ত মানুষটার দিকে। সমবেত চিৎকার, টেনশন, হ্যাঁ ওরা পেরে যাবে, ---না, পারবে না। মা যাকে টেনেছেন একবার--।
আমি মাথামুন্ডু কিছুরই নাগাল পাচ্ছি না। দুজন পৌঁছে গেছে। কিন্তু বডিটাকে ধরছে না। একবার ঠেলা মারছে, তারপর সরে যাচ্ছে। আবার ঘুরে এসে ওর হাত বা জামা ধরে টানছে। সেইসময় একটা নৌকো এসে পড়ায় লোকটাকে টেনে তুলে পাড়ে নিয়ে আসা হল।
এ যে আমাদের রমেন! ও কাউকে না বলে অতদূরে কেন চলে গেছল। একলা একলা? উত্তর কে দেবে? ও তো অনেক আগেই জ্ঞান হারিয়েছে।
কাশীপুর হাসপাতালের বেডে শুয়ে ওর জ্ঞান ফিরল প্রায় দুঘন্টা পরে।
ওর ঠোঁট নড়ছে। অমরা ঝুঁকে পড়লাম। কী হয়েছে? বল, কিছু বলবি? বল, শুনছি।
--- আমি বাঁচতে চাই না!


সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকে আমরা রমেনকে ঘাঁটাই না। ও একটু গুমসুম হয়ে থাকে। কিন্তু ওকে কখনও একলা থাকতে দিই না। যতক্ষণ পারি আমরা কেউ না কেউ চোখে চোখে রাখি। আর সোমেশকে ওর কাছে যেতে দিই না। আসলে আমরা ওকে ভয় পেতে শুরু করেছি।
কোথায় হারিয়ে গেছে সেই বিহার থেকে আসা চ্যাংড়ামিতে ভরপুর ছেলেটা! যে আমাদের নিজস্ব মহফিলে বেডকভার দিয়ে ঘাঘরা বানিয়ে বৈজয়ন্তীমালার নাচ দেখাত! যে একার সাহসে সিনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়নের গুন্ডামি ও ছোটদের সঙ্গে যৌন হরকত করা বরাবরের মত বন্ধ করে দিয়েছিল!
ওই ঘটনায় সেবার আমাদের শিবরাত্রি, দোল ও নববর্ষের আনন্দ কেমন পানসে করে দিল। আমাদের ব্যান্ডপার্টি আর প্র্যাকটিস শুরু করল না। ড্রাম, কেটল ও বিউগলগুলো স্টোররুমে তালাবন্ধ হয়ে গেল। নতুন মহারাজদের ব্যান্ডপার্টি নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না।
আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দোলের দিন একটা চেষ্টা করেছিলাম।
মন্দিরে সকালের পুজোর পর বড়, মেজ ও ছোট মহারাজদের পায়ে আবির দিয়ে তারপর ছোটদের রং খেলা শুরু হল। বেয়াড়া রং নিয়ে খেলার নিষেধ আছে, কিন্তু বাগানের গোবর ও কাদামাটি?
রমেন চুপচাপ গম্ভীর মুখে ঘরে যাচ্ছিল। হাতে ছোট প্যাকেটে আবির নিয়ে আমরা ওকে হাসিমুখে ঘিরে ধরলাম। একটু যেন লজ্জা পেল, কিন্তু গোমড়া ভাবটা গেল না।
আমরা সরে গেলে ওকে একলা ধরল সোমেশ। ওকে রঙ মাখিয়ে বলল-- শোন, মন খারাপ করিস না। আজ থেকে তুই আমার বন্ধু, স্পেশাল বন্ধু। কিন্তু এখানে স্পেশাল বলতে সবাই যেরকম ভাবে সেরকম কিছু না।
একটা কথা ভাব; যা আমার ভাল লাগে না সেটা নিয়ে জোরাজুরি করবি? তুই কেমন বন্ধু?
তার চেয়ে তোর আর আমার যা যা পছন্দ সেগুলো নিয়েই তো আমরা কত খুশি হতে পারি।
--- তুই কী চাস?
--- আমি চাই তুই আজ আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় আগের মত মুকেশের গান গাইবি। আমার স্পেশাল অনুরোধ তোর গলায়--দিল তড়প তড়প কে কহরহা--,; কী রাজি তো?
-- ভেবে দেখব।

সেদিনের পর থেকে রমেন একটু কথা টথা বলতে শুরু করল, কিন্তু কোথায় যেন একটু আড়ষ্ট ভাব। হয়ত সেই দারকেশ্বরের জোয়ারে নাকানিচোবানির ঘটনাটা ওকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

কয়েকদিন গেল; এল চৈত্রসংক্রান্তির বিকেল। আর এল আপাত মেঘহীন নির্মল আকাশে এক অকালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়া।
বড় মহারাজের অফিসে আমাদের তলব হয়েছে। কেন? কিচ্ছু জানি না। তবে সংবাদবাহকের হাবভাবে বুঝলাম বেশ ঘোরালো কেস-- একেবারে হাতে হ্যারিকেন!

সবাই মাত্র জলখাবার খেয়েছি। তবু মহারাজের চিরকুটে লেখা নামের লিস্টি অনুযায়ী আমরা ক্লু-লেস দশজন মার্চ করে গেলাম। আমাদের গুরু অমিয়দা বেশ অফেন্ডেড। এইসব অপোগন্ডদের সঙ্গে ওর মত মহামহিমকে কেন তলব করা হয়েছে!
অফিসে ঢুকে আমাদের মাথা আরও গুলিয়ে গেল।

টেবিলের ওপাশে বড় ও মেজমহারাজ --দুজনেই গম্ভীর । সুনীলদা বারান্দায় একটা চেয়ারে। আর টেবিলের একপাশে একটা চেয়ার ও টুলে বসে আছেন একজন অল্পবয়সী মহিলা। পাশের ভদ্রলোকটি বোধহয় ওঁর স্বামী।
ভদ্রলোক উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। মহিলা শান্ত, কিন্তু বেশ গম্ভীর।
আমরা ঢুকতেই ভদ্রলোকটির চোখের সার্চলাইট আমাদের চেহারার উপর দিয়ে একদফা ঘুরে গেল। উনি ভদ্রমহিলাটিকে কিছু বলতে যেতেই মেজ মহারাজ হাত তুলে ওঁকে থামালেন।
তারপর বাঁজখাই গলায় কম্যান্ড দিলেন-- সবাই লাইনে দাঁড়াও; ফল ইন। মেক ইট এ স্ট্রেইট লাইন, ওকে।
এবার মহিলাটিকে বললেন-- মা, আপনার কোন ভয় নেই, কোন সংকোচ নেই। আপনি উঠে যান, ওদের কাছে গিয়ে একটা একটা করে মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখুন। আইডেন্টিফাই করুন রাসকেলটাকে!
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন অমিয়দার দিকে। ভাল করে দেখে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলেন। এবার প্রশান্ত। উনি এগিয়ে গেলেন আর নিখিলেশের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এর পরেই আমি। বেশ ভয় পাচ্ছি। এসব কী হচ্ছে? আসলে কী হয়েছে?
ওঁর স্বামী ও মেজ মহারাজ বেশ উত্তেজিত।
--এই হারামজাদা?
--দিস রাস্কেল?
কিন্তু মহিলা মাথা নেড়ে আমার সামনে আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছি। ভদ্রমহিলা খুব সুন্দর দেখতে, কিন্তু আমার চেয়ে অন্ততঃ দশবছরের বড় হবেন।
উনি এগিয়ে গেলেন।
এবার সোমেশ। ও আর রমেন গাঁ ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে। উনি সোমেশ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পলক পড়ছে না। আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছেন। একবার এগিয়ে গেলেন। বাকিদের দিকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন-- এরা কেউ নয়, তবে হলে এই ছেলেটা হতেও পারে।
আমরা ভয় পেয়েছি। অজানার ভয়, অমঙ্গলের গন্ধ পাচ্ছি। কী হয়েছে?
--- শুয়োরের বাচ্চা!
চেয়ার ছেড়ে ছুটে এসেছেন স্বামীদেবতাটি আর কলার চেপে ধরেছেন সোমেশের। ও ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
এক লহমায় ওঁর হাত মুচড়ে ধরেছে রমেন।
--ছাড়ুন! ছেড়ে দিন ওকে!
--- তুমি জান ও কী করেছে?
--- জানি না, জানতে চাই না। খালি এইটুকু জানি যে ও কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।
-- এত ভরসা বন্ধুর চরিত্র নিয়ে?
এবার আমরা সরব হই।
সোজা বড় মহারাজকে বলি-- মহারাজ! কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! এনারা কে আমরা জানি না। কিন্তু এঁদের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের মুখ চেনাচ্ছেন ? অপরাধটা কি সেটা আগে বলবেন না?
-- অপরাধটা কী? তোমাদের জিগ্যেস করতে লজ্জা করছে না?
এই পরিবারটি আশ্রমের পাঁচিলের ওপাশে নতুন গড়ে ওঠা চারতলা বাড়ির দোতলায় ভাড়াটে হয়ে এসেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ এঁকে জানলায় দেখলেই অসভ্যতা করে। আয়না দিয়ে মুখে আলো ফেলে। উনি সহ্য করে যাচ্ছিলেন। বেশির ভাগ সময় বারান্দার দিকের জানলা দরজা বন্ধ রাখতেন। কাল সকালে যখন উনি কাপড় মেলতে বারান্দায় এসেছিলেন তখন সেই বদমাশ ওঁর দিকে প্যান্ট সরিয়ে অভব্য ইশারা করেছে। কে সে? তোমরা ভালয় ভালয় নাম বলে দাও। তাকে রাস্টিকেট করার আগে পিঠের ছাল-চামড়া তুলে ছাড়ব। আশ্রমের মান -সম্মান তোমরা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছ।
আমরা গুরুর দিকে তাকাই। গুরু ফিল্ডে নাম। আমরা যে কিছুই বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যম্‌?
-- আচ্ছা, বৌদি। আপনি কি শিওর যে এই ছেলেটিই?
-- ঠিক শিওর নই। তবে অনেকটা এর মত হাইট আর ফর্সা।
-- আন্দাজ ক'টা নাগাদ?
-- কাল সন্ধে ছ'টা সাড়ে ছ'টা হবে।
-- ওই ছেলেটার চেহারায় অন্য কিছু মনে পড়ছে।
--- না, তেমন কিছু না। দাঁড়ান, দাঁড়ান। অতদূর থেকে ভাল বোঝা যায় না। তবু---, ও হাসছিল আর দেখলাম ওর সামনের পাটির দুটো দাঁত নেই।
আমাদের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ। ঝটকা থেকে বাঁচতে একে অন্যের হাত চেপে ধরি।
এ তো "গ্যারেজ"! মানে ক্লাস এইটের বখা চিন্ময়!
সামনের দুটো দাঁত ভেঙে যাওয়ায় এই নাম।

মেজ মহারাজের চোখ আমাদের দিকে।
--তোমরা কেউ চিনতে পেরেছ কালপ্রিটকে?
আমরা চুপ।
গুরু এসব এড়িয়ে মহিলাটিকে প্রশ্ন করেঃ
-আচ্ছা, বৌদি,! ওই ছেলেটা কিছুদিন ধরেই আপনাকে বিরক্ত করছিল, তাই না? এই একটা ছেলেই তো, আর কেউ? কখনও একসঙ্গে কয়েকজন?
-- না,না; শুধু ওই একটাই। আমি ওর জ্বালায় বারান্দায় আসতে পারিনা। ওদিকের জানলা দরজা ভেজিয়ে রাখি।
--- আপনার বারান্দা আর ওর জানলা কী মুখোমুখি? দোতলায়?
--হ্যাঁ।
--আপনার কোন বাড়িটা বলুন তো? কী রঙের?
--হলুদ রঙের; বাড়িওয়ালা ভাড়া দেওয়ার সময় রঙ করিয়ে দিয়েছিল।
-- মহারাজ, কোথাও একটা বড় ভুল হচ্ছে। আমদের এই কয়জনের রুম নাম্বার হল ২ ও ৩। হলদে রঙা বাড়িটা আমাদের জানলার দিকেই না। ওটা প্রায় নাইনটি ডিগ্রিতে। ওঁর বারান্দার সামনে অন্য কোন ঘরের জানলা। আমাদের না।
মেজ মহারাজ ধমকে ঊঠলেনঃ হোয়াট ইজ দিস? ওঁরা কি বাড়ি বয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে ফলস্‌ কম্প্লেন করতে এসেছেন?
--- না, মহারাজ! বলছি, ওরা নয় আপনারা। আপনারা ভুল করছেন। একবার গিয়ে দোতলায় উঠে দেখে আসুন বা বাইরে সুনীল মহারাজকে জিগ্যেস করুন-- ওঁর বারান্দা আমদের ঘরের জানলার দিকে নয়। তাই উনি আমাদের মধ্যে কাউকে শনাক্ত করতে পারেন নি। উনি আমাদেব্র কখনও দেখেন নি। আমরাও না।
শঠিক ঘরের ছেলেদের ডেকে আনুন। ওনার সামনে দাঁড় করান। আসল দোষীকে উনি ঠিক চিনে নেবেন।
দুই মহারাজ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
বড় মহারাজ বললেন-- ঠিক আছে, তোমরা এখন যাও।
ঘরে এসে আমরা হাঁফ ছাড়ছি , আমি বললাম-- শালা গ্যারেজ এবার ফেঁসে গেল। ছোটলোক! ওকে চাবকানোই উচিত! তবে রমেন হেবি দিলি মাইরি! সোমেশের জন্যে লড়ে গেলি! মুহব্বত হো তো অ্যায়সা!
সবাই হেসে ওঠে। রমেন ও হাসে। বালে --আমি জানতাম ও কোন মহিলার সঙ্গে অসভ্যতা করতে পারে না।
-- কী করে জানতি?
--ব্যস্‌, জানতাম।
-- আমি জানি! আমিই জানি!
নিখিলেশ চেঁচিয়ে ওঠে।
-- কী জানিস?
--কেন সোমেশ মহিলাদের সঙ্গে কোন গড়বড় করতে পারে না-- সেটা।
--কেন?
-- ও তো নিজেই একটা মহিলা--মাদী বোস। একেবারে মাইদ্যা মাদী কুরকুরকুর!
সোমেশ রেগে যায়। আর রমেন নিখিলেশকে তাড়া করে নীচের সিঁড়ি পর্য্যন্ত খেদিয়ে দিয়ে আসে।
অমিয়দা অন্যমনস্ক।
-- কী হল, গুরু? মেজ মহারাজের শিকার ভসকিয়ে দিলে?
--ছাড় তো! আমি ভাবছি অন্য কথা।
--কী কথা? ব্যাঙের মাথা?
--আরে সবাই তো গ্যারেজ বা চিন্ময়কে দোষী ভাবছিস? কিন্তু ক্লাস এইটের গ্যারেজ তো একতলায় থাকে। ও কী করে দোতলার বৌদিকে সামনা সামনি বিরক্ত করবে?
-- হয়ত অন্য কারও ঘরে ঢুকে -- ও কী কম চালাক?
-- সে এক-আধদিন হতে পারে। কিন্তু দেখলি তো, উনি বললেন --ওই একটা ছেলেই সবসময় করে।
--- উঁ উঁ । মন্দ বল নি। তাহলে?


রহস্যের সমাধান হল আকস্মিক ভাবে।
হলদে বাড়ির ব্যালকনির উল্টোদিকের রুম নম্বর ৭।
এইঘরের ক্যাপ্টেন সমীরণদা। সেখান থেকে পাঁচজনকে আনা হল। না, অভিযোগকারিণী এঁদের কাউকে চেনেন না।
মেজ মহারাজের পুলিশি মগজে বাল্ব জ্বলে উঠল।
--সমীরণ, তোমার ঘরে নিয়মিত অন্য কেউ আসে? ধর জুনিয়র কেউ? পড়া বুঝে নিতে বা কোন সাহায্য চাইতে?
সমীরণদা ঘামতে থাকে। কার নাম নেবে? আসে তো অনেকেই।
মেজ মহারাজ এবার চোখ ছোট করে অন্য চারজনকে বললেন-- তোমরা বল। কে অন্যদের থেকে বেশি এই ঘরে আসে? রঙ ফরসা ও সামনের দুটো দাঁত ভাঙা?
বিপুল কিছু বলবে?
-- মহারাজ। বুঝতে পারছি না। খুব ফরসা একজন নীচের তলার থেকে ঘন ঘন ওপরে আসে বটে, কিন্তু তার সামনের দুটো দাঁত? ঠিক বুঝতে পারছি না, কী বলব।
-- তুমি শুধু নামটা বল। বাকি আমরা দেখে নেব।
সমীরণদা খুব ঘামছে।
--- ওর নাম ভাস্কর, ক্লাস নাইন। গত বছর ভর্তি হয়েছে।
-- ডেকে নিয়ে এস। বল, আমি ডাকছি।
সমীরণদা দরদর করে ঘামছে।
ভাস্করকে দেখেই মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন--এই-ই!
যাদবপুরের ঝিল রোডের বাসিন্দে ভাস্কর। তুলি দিয়ে টানা চোখ। চোখের মণির রং বাদামী। ওর দাঁত ভাঙা নয়, কিন্তু ঝকঝকে বাকি দাঁতের পাটির মধ্যে বেমানান দুটো কালো ক্ষয়াটে দাঁত, প্রথম নজরে মনে হবে খালি।
সেইদিনই ভাস্করকে আশ্রমের ডজ গাড়িতে করে বাক্সপ্যাঁটরা সমেত ঝিল রোডে ছেড়ে আসা হল।
কিন্তু এই ঘটনা আবার দুটো ভিন্ন ঘটনার জন্ম দিল।
সমীরণদা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
মহারাজ ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে ভাল করে কড়কে দিয়েছেন। কেন নীচের তলার থেকে ক্লাস নাইন সায়েন্সের ছেলে ভাস্কর দোতলার ৭ নম্বর ঘরে ঘনঘন আসত? আর গুপ্তচর সূত্রে জ্ঞাত যে আসত ক্যাপ্টেন সমীরণদার কাছেই। কেন? পড়া দেখে নিতে ? হতেই পারে না। বারাসতের গেঁয়ো সমীরণ আর্ট্স পড়ে। পড়াশুনোয় সাধারণ মানের। ওর কাছে সায়েন্সের ছেলে কেন আসে? আর কী ভাবে ওদের অনুপস্থিতিতে ছেলেটা ওদের জানলা দিয়ে উল্টোদিকের বারান্দায় ব্যস্ত মহিলার দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে? এর ফলে আশ্রমের যে সম্মান গেল তার কোন দায় কি সমীরণের নয়?
ওকেও সাতদিনের জন্যে সাসপেন্ড করা হল। এর মধ্যে ও যদি ক্ষমা চেয়ে চিঠি লেখে ও কথা দেয় যে এরকম ভুল ভবিষ্যতে আর হবে না তবে ওকে আশ্রমে থাকতে দেওয়া হবে। নইলে ডে-স্কলার হিসেবেই ইলেভেনের পাঠ পুরো করে বোর্ডে বসতে হবে।
সাতদিনের নিজগৃহবাস কাটিয়ে সমীরণদা ফিরে এল। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। কী ব্যাপার কেউ জানে না।
বিকেলে প্রিয়ব্রত খবরটা নিয়ে এল।
---- কী হয়েছে জানিস? সমীরণদা গেছল বারাসত থেকে যাদবপুর। ওই ঝিল রোড না কী যেন, সেই ভাস্করের বাড়িতে। তারপর কী হল শোন। ভর দুপুরে চাঁদিফাটা রোদে সমীরণদা খুঁজে পেতে গিয়ে ঠিক ওদের দোতলা বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছে।
ওরা বোধহয় দোতলার জানলা দিয়ে আগেই দেখে ফেলেছিল। দরজা খুলল ভাস্করের বাবা। কী চাই?
-- ভাস্কর আছে? এটা মানে ওর বাড়ি তো?
--- আর কার বাড়ি হবে, তোর শ্বশুরের। শালা! আমার ছেলের সব্বোনাশ করেও আশ মেটেনি? বাড়ি অব্দি ধাওয়া করেছিস?
--- এসব কী বলছেন মেসোমশায়? আমি তো কিছুই মানে?
-- শুয়োরের বাচ্চা! কে তোর মেসোমশাই? মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব।
--- প্লীজ, আমার কথাটা শুনুন।
--- কোন কিছু শোনার দরকার নেই। ছেলে আমাকে সব বলেছে। তোমরা সব এক একটি ছেলেধরা। ছি ! ছি! ছি!
সমীরণদা তখন ডেস্পারেট, বুঝলি! বলল-- মেসোমশায়, একবার ভাস্করকে ডাকুন। ও আমার সামনে এসে বলুক। দেখবেন আমি ওর কোন ক্ষতি করি নি।
--- ও আর তোমার সামনে আসবে না। চুপচাপ এখান থেকে যাও। এখন যদি আমি একটা ডাক দিই --গোটা পাড়া এসে তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
-- একগ্লাস জল দেবেন?
ভদ্রলোক ঘর থেকে জল আনিয়ে দিলেন। খেয়ে মুখ মুছে পেছন ফেরার সময় ওর চোখ গেল দোতলার জানলায়,-- ভাস্কর দাঁড়িয়ে আপেল খাচ্ছে আর হাসছে।