প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রবন্ধসময়কাল খৃষ্টপূর্ব দশম কি নবম শতক। সবে উত্তরের জনপদগুলি রাজ্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। সবে কৃষক-ক্ষত্রিয় ভূপতিগণ উদ্বৃত্ত শস্যের বিপণন শুরু করেছেন। ফলে একটি স্থানীয় বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। একদিকে ভূপতি ও অন্যদিকে বণিক সম্প্রদায়। দু’য়ে মিলে একটি পরিবর্তিত অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠছে। ফলে, ভূপতিদের ক্ষমতাকে স্বীকার করছেন ব্রাহ্মণ ঋষিগণ। এতদিনের ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য থেকে সরে সরে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলে, একটি কূটনৈতিক সমাধানে ব্রতী হলেন ভারতের তৎকালীন ব্রাহ্মণ ও কৃষক-ক্ষত্রিয় কুল। তাঁরা স্থির করলেন, একাধিপত্যের পরিবর্তে একটি সংঘবদ্ধ আধিপত্য থাকুক। তাহলেই সকলের মঙ্গল।
এসময়ে নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবতে গিয়ে চোখে পড়ল উপনিষদের দুটি কাহিনীতে। তাই নিয়েই এই নিবন্ধ।
এই সময় মিথিলার অধিপতি, তৎকালীন জনক বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। তিনি মিথিলা নামক গণরাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বলে রাখা যাক, মিথিলার সমস্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিই ‘জনক’ উপাধিতে ভূষিত হতেন। তাঁকে ব্রাহ্মণ কৃষক বণিক, সকলকে নিয়ে থাকতে হয়। অত্যন্ত বলশালী, পরিশ্রমী, ও মেধাবী জনক গুরু যাজ্ঞবল্ক্যের কাছ থেকে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে চান। কিন্তু গুরু কী চান? যাজ্ঞবল্ক্যের মনোজগতের এক অদ্ভুত সংঘাত নিয়ে এই রচনা, যে সংঘাতের কেন্দ্রে দুই নারী। গার্গী ও মৈত্রেয়ী। একজন তাঁর পত্নী। অন্যজন গার্গী, এক ঋষিকা। যিনি ব্রহ্মচারিণী আশ্রমবাসিনী ও যাজ্ঞবল্ক্যের সন্ন্যাসের অন্যতম কারণ।
জনক রাজর্ষি উপাধিধারী। গুরু যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক। সে একদিন। ঋষিকে তিনি প্রশ্ন করছিলেন অগ্নিহোত্র বিষয়ে। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে জানিয়েছিলেন, একে একে সূর্য চন্দ্র নক্ষত্র অস্তমিত হলে অগ্নিপ্রভাই জ্যোতি। মানুষ রাতের অন্ধকারে এই অগ্নির দ্বারাই কর্ম অব্যাহত রাখতে পারে। অগ্নিবলয়ের মধ্যে কোনও বন্যপ্রাণী আসেনা। তাদের শত শত জন্মের সংস্কার। অগ্নি দহন করে। তবে যাজ্ঞবল্ক্যর এই উত্তরে জনক খুশি হননি। দর্শন যদি না প্রতিভাত হয় তবে বিদ্যার মূল্য কি? তিনি জিজ্ঞেস করেছেন – আচার্য, যখন বাহিরের সব জ্যোতিই অস্তমিত তখন অন্তরে কি প্রভা বিরাজ করে? যাজ্ঞবল্ক্য বুঝেছেন। রাজা ব্রহ্মবিদ্যা চান। জনককে অদেয় কিছুই নেই। কিন্তু তিনি নিজে কি সেই অসীমকে ধারণা করতে পেরেছেন? তবু বললেন – আত্মজ্যোতিই শ্রেষ্ঠ জ্যোতি, রাজন। সেই আত্মজ্যোতি আসে আত্মার থেকে। সেই আত্মাকে সাধারণ মানুষও উপলব্ধি করতে পারে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে। সেই হিরন্ময় পুরুষ আপনার অভিপ্রেত বিষয় সকল নির্মাণ করে স্বপ্নদ্রষ্টার চেতনায় মুদ্রিত করে দেন নিজের উপস্থিতি। য এষ সুপ্তেষু জাগর্তি, কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ, তদেব শুক্রং, তদ ব্রহ্ম, তদেব অমৃতমুচ্যতে। জনক তন্ময় হয়ে শোনেন। যাজ্ঞবল্ক্যকে মাঝে মাঝে তাঁর কবি মনে হয়। কাব্য রচনা করেন যেন! এ কি কল্পনা? নাকি উপলব্ধি? স্বপ্নে তো কত কিছুই দেখেন তিনি! কর্ষিত ক্ষেত্র, বহ্নিমান অরণ্য, রক্তচক্ষু নারী। এসবের অর্থ কী কে জানে! কিন্তু গুরু যে তাঁকে পরমত্ব দান করতে পারছেন না, তা জনক বোঝেন। কিন্তু বিশ্বাস রাখেন, একদিন যাজ্ঞবল্ক্য নিজে জানবেন ও তাঁকে জানাবেন।
একদিন রাজ্যের নানা চিন্তায় চিন্তিত জনক লক্ষ্য করলেন রাজসভায় প্রবেশ করছেন যাজ্ঞবল্ক্য। জনক তাঁর সহজাত বোধ দিয়ে বুঝেছেন, যাজ্ঞবল্ক্য অন্যরকম। তাই তাঁকে গুরু হিসেবে বরণ করেছেন। কিছুকাল আগেও এই আশ্রমিক ঋষি যথেষ্ট দরিদ্র ছিলেন। কোথাও কোনও দানের কথা শুনলেই হাজির হতেন। নিজের অর্জিত বিদ্যার থেকে কিছু দান করে চেয়ে নিতেন সমস্ত দেয়বস্তু। জনক দেখেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য সত্যিকারের বিদ্বান। তাঁর বিদ্যার কদর করে এমন কেউ নেই। তিনি তাই যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রচুর গোধন দিয়ে সুবর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে সুস্থিত করেছিলেন। ভেবেছিলেন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষির এতেই ইহজগতের প্রয়োজন মিটবে। কিন্তু না। ন জাতু কামানাম উপভোগেন সাম্যতি। যাজ্ঞবল্ক্য আসছেন মানেই কিছু প্রার্থনা আছে। অথচ সত্যিই যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মবিদ। অন্তত সমগ্র ভারতবর্ষ সেকথা মানে। তাঁর আচার্যের তালিকায় নামগুলি দেখলেই বোঝা যায়। জিত্বা শৈলিনি, বর্কু বার্ষ্ণ, উদঙ্ক শৌল্বায়ন, সত্যকাম জাবাল, কে নয়! জনক সিংহাসন থেকে নেমে এসে তাঁকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে বসালেন। যাজ্ঞবল্ক্য কিছু চিন্তিত। জনক জিজ্ঞেস করলেন – কি হয়েছে আচার্য? চিন্তিত কেন? কি হেতু রাজসভায় আগমন? পশু কামনায়? না আত্মবিষয়ক প্রশ্নকামনায়? যাজ্ঞবল্ক্য রাজসভায় এসে জনকের কাছে প্রশ্ন কামনা করেন, আর তার উত্তর দেন। জনক তখন বিদ্যাদানের পরিবর্তে ঋষিকে গোদান করেন। এইই প্রচলিত রীতি। আজ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন – আপনি শুধু পুজ্য ও ধনী হয়েছেন তাই নয়, আপনি বেদজ্ঞ ও উপনিষদ উপদিষ্ট হয়েছেন। আপনি জানেন সেই অক্ষর, পুরুষ। হে জনক, আপনি তাঁকে জেনে অভয়প্রাপ্ত হন, এই কামনা করি। জনক অনুভব করছেন আজ ঋষি কিছু গুরুতর প্রার্থনা নিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন – আপনিও অভয় লাভ করুন আচার্য। এই বিদেহ আপনার নিজের রাজ্য। আমিও আপনার সেবক। এখন বলুন কি হেতু আগমন? যাজ্ঞবল্ক্য এই কথা ক’টির অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন - আপনি একটি বিদ্দ্বজন সভার আয়োজন করুন রাজন। উত্তরাপথে আমার শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপনা প্রয়োজন। নাহলে ব্রাহ্মণত্বের অস্তিত্ব সঙ্কটে। কারণ ব্রাহ্মণত্বের ভিত্তি স্থিত হয়েছে পরম একক পুরুষের অস্তিত্বে। সেই ব্রহ্ম পুরুষ। অধুনা গার্গী বাচক্নবী ঘোষণা করছেন তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। নারী কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞ হবেন? সেই পরম এক যে পুরুষ! তিনিই উত্তমপুরুষ! কোনও নারীর অধিকার নেই ব্রহ্মবিদ্যায়। কিছুকাল হল নারীকে ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চলছে। যবে থেকে আর্যপুরুষ অনার্য রমণীকে পত্নীরূপে বরণ করতে শুরু করেছে তবে থেকে রমণীকে বেদ অধ্যয়ন থেকে বিরত করার চেষ্টা সর্বস্তরে দেখা দিচ্ছে। তবু কিছু স্নেহশীল পিতা অণূঢ়া কন্যাকে নিজের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কখনও কোনও কোনও স্বামীও। যেমন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর পত্নী মৈত্রেয়ীকে। যেমন গার্গীকে তাঁর পিতা।
তাঁর দুই পত্নীর মধ্যে কনিষ্ঠা, মৈত্রেয়ী, এমন বিদ্যা আয়ত্ত্ব করতে ভীষণ উৎসাহী। তিনি তাঁকে নানা উপায়ে বুঝিয়েছেন, নারীর গতি ষষ্ঠভূমি পর্যন্ত। সপ্তমভূমি পুরুষের অনুভব। নারীদেহে তা অসম্ভব। যাজ্ঞবল্ক্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়ছেন। নারীমাত্রই, পত্নীমাত্রই স্বামীর সুখের জন্য, ভোগের জন্য সদা ব্যাপৃত থাকবে। এ বিধান নস্যাৎ করে মৈত্রেয়ী তাঁর স্বশাসিত অঞ্চলে প্রবেশ করছেন। মানুষের মর্যাদায়। নারী বলে নয়। কখনও তাঁর মনে হয় বলেন – ভদ্রে, এখানে তোমার প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু তাঁর ব্যাক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে একথা উচ্চারণ করা যায়না। তাই সময় মতন তাঁর সঙ্গে বেদাদি আলোচনা করেন। তিনি অনুভব করছেন, পূর্ব ও দক্ষিণের যোগিনীদের ধর্মাচরণের প্রভাব পড়ছে আর্য রমণীদের ওপরে। তাঁরা নারীর ধর্মাচরণের অধিকার পেতে এগিয়ে আসছেন। তবে কি সন্ন্যাস শ্রেয়তর? যাই হোক, আজকে যে কাজে এসেছেন সেটি বলতে শুরু করলেন।
জনক বুঝতে পেরেছেন। হ্যাঁ, এর আশু প্রতিকার প্রয়োজন। নারীর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলে শত্রু বাড়বে। কমবে না। এরপর সম্পদেও নারী তার অধিকার জাহির করবে। রাজত্ব নিরাপদ থাকবেনা। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে আশ্বস্ত করলেন। ‘মহামান্য, আপনি নিশ্চিন্ত হোন। আমি শীঘ্রই একটি যজ্ঞ ও প্রতিযোগিতা সভার আয়োজন করছি। মহাত্মা ঋষিগণ সেখানে উপস্থিত থেকে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবেন’।
নিমন্ত্রন পেয়েছেন গার্গী। তাঁর আশ্রমের যে কতিপয় ছাত্র আছে তারা খুবই উৎসাহিত। আচার্যার সঙ্গে জনকের রাজসভায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গার্গী অবশ্য শান্ত।
মিথিলার রাজ দরবারে আজ তিলধারণের স্থান নেই। দারুনির্মিত স্তম্ভের উপর চিত্ররঞ্জিত আচ্ছাদন। সভাস্থলের মধ্যে একটি উঁচু বেদীতে নিমন্ত্রিত ঋষি ও ব্রাহ্মণগণ। রাজা আজ বহুদক্ষিণা যজ্ঞ করবেন। কুরু পাঞ্চাল থেকেও বহু জ্ঞানী গুনী ঋষি এসেছেন। জনক ঘোষণা করেছেন, আজকে যজ্ঞশেষে তিনি দশ পাদ করে সোনা দিয়ে বাঁধানো শিংয়ের এক হাজার দুগ্ধবতী গাভী তিনি দান করবেন। উদাত্ত স্বরে রাজঘোষক ঘোষণা করছেন, ব্রাহ্মণো ভগবন্তো যো ব ব্রহ্মিষ্ঠঃ স এতা উদজাতামিতি। উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি নিয়ে যান এই গরুগুলি। বাইরে প্রান্তরে বেঁধে রাখা গাভীগুলির সোনার শিং সূর্যের আলোয় চকচক করছে। নিকটস্থ মানুষজন মনে মনে ভাবছেন, আহা, আর জন্মে ব্রাহ্মণ হবো। রাজার দান পাবো। এমন সুন্দর নধর গরুগুলি, তায় আবার সোনার শিং, পেলে জীবন পূর্ণ হয়ে যেত। তাদের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। ‘সৌম্য সাম্যশ্রব, এই গরুগুলিকে তোমরা আশ্রমে নিয়ে যাও।’ কণ্ঠস্বর লক্ষ করে অত ভিড়ের মধ্যে সকলে সনাক্ত করলেন, এ যাজ্ঞবল্ক্যের কণ্ঠ। মনে মনে জ্বলে উঠলেন অশ্বল কহোল প্রমুখ ঋষিগণ। নিমেষে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। ব্রাহ্মণরা উঠে দাঁড়ালেন। জনক চুপটি করে দেখতে থাকলেন। সকলেই একভাবে বলছেন। ‘একি! আপনি কি নিজেকে ব্রহ্মিষ্ঠ দাবী করেন নাকি?’ যাজ্ঞবল্ক্য সহাস্যে উত্তর দিলেন – বাপুরা, ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার করি। আপাতত আমার গরুগুলি বড়ই প্রয়োজন। আর যেভাবে দিবাকর উত্তাপ দিচ্ছেন তাতে এই দুপুরে গরুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এই রসিকতায় তাঁরা আরও রেগে গেলেন। সকলেই তর্কযুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ব্রাহ্মণদের নির্দিষ্ট বেদীর এক কোণে বসে এই রঙ্গ দেখছিলেন এক নারী। অপেক্ষা করতে হবে তাঁকে। এই উত্তরবৈদিক কালে নারীরা ক্রমেই শক্তি হারাচ্ছেন। পুরুষের আধিপত্য নারীকে বিদ্যায় সম্পদে সামাজিক অবস্থানে ক্রমশ নীচে ঠেলে দিচ্ছে। তাই গার্গী চেষ্টা করে চলেছেন। যে বিদ্যায় শুধু পুরুষের অধিকার, আজীবন ব্রহ্মচারী থেকে সেই বিদ্যায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। পুরুষের ভুবনে নারীর নির্ভীক এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।
প্রথম প্রশ্ন করলেন ঋষি অশ্বল। ‘হে যাজ্ঞবল্ক্য, সব যখন মৃত্যুর অধীন, তখন এর হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?’ যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন – হোতা নামক ঋত্বিক, অগ্নি ও বাক্য দ্বারা, কারণ বাক্যই যজ্ঞের হোতা, বাক্যই অগ্নি, বাক্যই মুক্তির উপায়। একে একে আর্তভাগ, ভুজ্যু, উষস্ত, কহোল প্রভৃতি, কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে লাগলেন। সেই অপেক্ষারতা নারী লক্ষ করলেন, প্রশ্নের আরও কঠিন উত্তর দিতে থাকলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তাঁর অধরে একটি হাসি খেলে গেলো। সহজকে কঠিন করে তোলাই যাজ্ঞবল্ক্যের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ব্রাহ্মণরা বসে পড়লেন। দেখলেন জনক নিমন্ত্রণ করেছেন গার্গী বাচক্নবীকে। গর্গবংশীয় বচক্লু ঋষির এই কন্যা দারুন প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তাঁর নাম ঘোষণা হলো। ঘোষক বললেন – হে বাচক্নবী গার্গী, আপনিই শেষ ঋষিকা। প্রশ্ন করতে চাইলে করতে পারেন। নতুবা যাজ্ঞবল্ক্যকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হবে।
গার্গী উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পরনে শ্বেত কাষায় বস্ত্র। উত্তমাঙ্গে একটি উত্তরীয়। একটি শুভ্র উপবীত যেন তাঁকে অগ্নির ন্যায় ঘিরে আছে। তাঁর মাথায় একটি চূড়া করে কেশগুচ্ছ বাঁধা আছে। যাজ্ঞবল্ক্য লক্ষ করছেন এ নারীর সমস্ত আনন জুড়ে বিদ্যা ও প্রতিভার বিভা। শুধু কি তাই? সব ছাপিয়ে অন্য এক আলো যেন! নারী প্রশ্ন করবেন অনুমতি চাইলেন। হে উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ, আপনারা অনুমতি প্রদান করুন। পিতৃসম ঋষির সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হচ্ছেন, অনুমতি চাই। যাজ্ঞবল্ক্য প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন – ভদ্রে, প্রশ্ন করো। গার্গী শুরু করলেন – মাত্র দুইটি প্রশ্ন করব আচার্য। যাজ্ঞবল্ক্য দক্ষিণ হস্তটি তুলে অভয় দিলেন।
গার্গী বললেন, হে আচার্য, আপনি নিশ্চয় এ সকল প্রশ্নের উত্তর সম্যক ভাবে জানেন, তবু আমার জিজ্ঞাসার কারণ ভিন্ন। সমবেত মণ্ডলীর সম্মুখে এ প্রশ্নের উত্তর দিলে আপনাকেই আমি শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে নেবো। প্রথম প্রশ্নটি, জলে যদি সব ওতপ্রোত থাকে তবে জল কিসে অধিষ্ঠিত?
উঃ বায়ুতে।
প্রঃ বায়ু কিসে অধিষ্ঠিত?
উঃ অন্তরীক্ষে।
প্রঃ অন্তরীক্ষ কিসে?
উঃ গন্ধর্বলোকে।
একে একে সব পেরিয়ে ব্রহ্মলোক। গার্গী প্রশ্ন করলেন – তারপর? যাজ্ঞবল্ক্য ভিতরে আবার অস্থির বোধ করছেন। এ নারী কি অধ্যাত্মবিজ্ঞানে পারদর্শী? কিন্তু তিনি আর এগোতে দিলেন না। বললেন – তুমি অতিপ্রাক্ষী। আর প্রশ্ন কোরোনা। এরপর প্রশ্নাতীত স্থিতি। এরপর যা আছে তা ধারণা করতে গেলে তোমার মাথা খসে পড়বে। একথা উচ্চারণ করতে করতে যাজ্ঞবল্ক্য টের পাচ্ছেন, এতদিনে তিনি সমকক্ষ বিদ্বান পেয়েছেন। এ নারী ব্রহ্মবাদিনী। এতদিনে তাঁর সাধ পূর্ণ হয়েছে। অথচ ভয় হচ্ছে। ততক্ষণে গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন। সভায় উপস্থিত সকলেই ভেবেছেন আসলে গার্গীর সঙ্গে তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কীয় আলোচনা হয়েছে। তিনিও তাই অনুভব করেছেন। পৃথিবীর আদিতে জল। বিস্তীর্ণ জলভাগ একে ঘিরে রেখেছে। জলকে ঘিরে রেখেছে বায়ু। বা বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলের ওপরে আছে আকাশ বা অন্তরীক্ষ। গ্রহ নক্ষত্রের স্থান। অন্তরীক্ষের ওপরে গন্ধর্বলোক। দেবতাদের আবাস। অগণিত সৌরজগত ও ছায়াপথে ভরা। এরপরে অনন্ত অসীম। নিরালোক নিস্তব্ধ এক অবস্থিতি। মুখে বর্ণনা করা যায়না। ধারণা করা যায়না। অবাংমানসোগোচরম। ব্রহ্মলোক। যাজ্ঞবল্ক্য চিন্তিত মুখে গরুগুলি নিয়ে আশ্রমের দিকে যাত্রা করলেন। আরও কিছু বলেছে কি এই নারী? তবে কি সে আত্মবিদ্যার কথাই জানিয়েছে? যে আত্মবিদ্যা যাজ্ঞবল্ক্য জনককে শিক্ষা দিয়ে থাকেন? কিন্তু এ যে ফলিত বিদ্যা! যাজ্ঞবল্ক্য তো জানেন! জনক শুধুই শ্রোতা। তার উপলব্ধির জন্য যে চর্চা, যে জীবন যাপন প্রয়োজন তা জনকের কই? গার্গী বরং সে জীবন যাপন করেন। যাজ্ঞবল্ক্য নিজেও তো তা করেননা!
আশ্রমে চলেছেন গার্গীও। যাজ্ঞবল্ক্যের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে আনন্দ হয়েছে তাঁর। আহা! গরুগুলি বড় দরকার তাঁর। অত বড় আশ্রম। খাদ্যের প্রয়োজন আছে বৈকি! তিনি অত সোনাদানা নিয়ে করবেন কি? আজন্ম ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মবাদিনী নারীর এমন বিপুল সম্পদে কি প্রয়োজন? সংসারে তাঁর আকর্ষণ নেই তো!
চলতে চলতে তাঁর হাসিও আসছিল মনে। হায় যাজ্ঞবল্ক্য! শুধু বাইরেই খুঁজে গেলেন সেই অসীমের উপস্থিতি? তাই তো এত ঐশ্বর্যের প্রয়োজন হয় আপনার! এই তো দেহ! জল দিয়েই ওতপ্রোত! একে ঘিরে রেখেছে বায়ু। প্রাণ বায়ু। প্রাণ বায়ুর অধিষ্ঠান চিদাকাশে। অন্তরীক্ষে। এই অন্তরীক্ষে ধ্যানমগ্ন ঋষি দিব্যচক্ষে দেখতে থাকেন অন্তরজ্যোতি। নক্ষত্রলোক বা গন্ধর্বলোক। ভ্রূ মধ্যে তাঁর দর্শন। তারও ওপরে মস্তিষ্কের সহস্রদল পদ্মে, সহস্রারে, আছে ব্রহ্মলোক। শব্দহীন, আলোহীন। এক অদ্ভুত আনন্দময় অবস্থিতি। গার্গী অনুভব করেছেন। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য কি করেননি? নাকি সবটাই বাগাড়ম্বর? তিনি আত্মবিদ্যার ব্যাখ্যাতা, অন্যতম মহান ঋষি। কিন্তু ফলিত জ্ঞানের বিভা কই? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সত্যিই এর বেশি উন্মেষ না ঘটলে ধারণা অসম্ভব।
আজকাল, যজ্ঞ থেকে পুরস্কৃত হয়ে ফেরার পর থেকে যাজ্ঞবল্ক্য কিছু বিমনা হয়ে থাকেন। তবে কি গার্গী যা বলেছেন তা তিনি ধরতে পারেননি? কেমন প্রশান্ত মুখচ্ছবি ওই কন্যাসমা ঋষিকার! কি পেয়েছেন তিনি? যাজ্ঞবল্ক্য মনে মনে স্থির করতে চাইছেন। এত ধন সম্পত্তি তিনি তাঁর দুই স্ত্রীর মধ্যে ভাগ করে দেবেন। তারপর একাকী যাবেন তপস্যায়। আত্মজ্ঞানই লক্ষ। ফলিত বিদ্যার চর্চা এই সংসারে থেকে অসম্ভব। সম্ভবত গার্গীও সেইদিকেই নির্দেশ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তো ওই ঋষিকা জয়ী! তিনিই তো জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটালেন! যাজ্ঞবল্ক্য তো নিজের মধ্যে থাকা সেই অমৃতের সন্ধান না করে বাইরে স্বর্ণ ও গোধন, ভূমি ও যশ সঞ্চয় করে চলেছেন!
সেদিন প্রাতে সদ্যস্নাতা মৈত্রেয়ী এসে দাঁড়িয়েছেন। আচার্য ও পতি, যাজ্ঞবল্ক্য আজ বিশেষ কিছু বলবেন। তাঁর মনে সবসময় একটি শান্ত আনন্দ বিরাজ করে। তাঁর অগ্রজা সপত্নী কাত্যায়নী তাঁর চেয়ে বয়সেও অনেক বড়। গৃহকর্মে নিপুণা। আশ্রমমাতা। মৈত্রেয়ী তাঁর প্রতি মমতা অনুভব করেন। দূরে কাত্যায়নী তখন গাভীগুলির পরিচর্যার জন্য আশ্রমবালকদের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি এলেন যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে। এই সুন্দর সূর্যস্নাত প্রাতঃকাল। এখন তো প্রিয় সম্ভাষণের সময় নয়। তাহলে আচার্যই তাঁকে ডেকেছেন। মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন। যাজ্ঞবল্ক্য বললেন—প্রিয়ে, আমি গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেব। তোমার সম্মতি চাই। এই সময় তোমার সঙ্গে কাত্যায়নীর সম্পর্কও অবসান করতে চাই। আমরা ধারণা করতে পারি, মৈত্রেয়ী কী ভেবে ছিলেন। কাত্যায়নীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি যেন যাজ্ঞবল্ক্যের ওপরেই নির্ভর। সেই সূত্রটি কেটে দিলে দুজনেই স্বাধীন নারী। একে অন্যের সপত্নী থাকবেন না। কেউ কারোর বশ্য থাকবেন না। এমনকি দুজনে যে এককালে এক পরিবারের সদস্য ছিলেন তাও বিস্মৃত হবেন। আমরা অবশ্য জানতে পারি না যে পরবর্তী কালে কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী এই বিচ্ছেদ গ্রহণ করেছিলেন কিনা। সম্ভবত করেননি। কারণ পরে ব্যাক্ত করছি। যাজ্ঞবল্ক্য সম্পত্তির সুষ্ঠু বণ্টন করতে চাইলেন। দুই পত্নীর মধ্যে মৈত্রেয়ী বিদুষী। তাই তাঁর সঙ্গে পরামর্শে বসেছেন। এই প্রথম মৈত্রেয়ী ভিতরে ভিতরে আহত হলেন। কী সম্পদ বণ্টন করবেন ঋষি? কোন সম্পদে ঋষির অধিকার? আশ্রমের অসংখ্য সদস্যের প্রতিদিনের আহার ও আশ্রয় যিনি ব্যবস্থা করেন, এই পার্থিব সম্পদে তো তাঁরই অধিকার! সে তো কাত্যায়নী! ঋষি ব্রহ্মবিদ, আবার পার্থিব সম্পদকে নিজের জ্ঞান করেন? কই? মৈত্রেয়ী তো তা মনে করেন না? আহত মৈত্রেয়ী উত্তর দিলেন—যেনাহং নামৃতাস্যাম তেনাহং কিং কুর্য্যাম? হে ভগবন, যদিই বা ধনপরিপূর্ণা এই ধরিত্রী আমার হয়, আমি কি তা দিয়ে অমর হব? যাজ্ঞবল্ক্যের নতদৃষ্টি ভেসে উঠছে। পরাজয়, পরাজয়! তিনি হয়ত অস্ফুটে বলেছিলেন—না প্রিয়ে, আমি তোমাকে ইহজগতে দেহের প্রয়োজনে ব্যবহার্য ভোগের বস্তু দান করে যাবো। মৈত্রেয়ীর অন্তর হাহাকার করে উঠল। কি হবে এই ভোগ্যবস্তু দিয়ে? কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে বোঝাতে চাইলেন, এই যা কিছু তোমার প্রিয় তা আসলে তোমার নিজের আত্মস্পৃহা। পতি প্রিয় আপন কামনার নিবৃত্তির কারণে। পুত্র প্রিয় ভোগের বাসনা যাতে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত গতি পায়, সেই কারণে। এভাবেই যা কিছু তুমি প্রিয় মনে করো তা আসলে তোমার নিজের চরিতার্থতায়। এই আত্মচরিতার্থতা আসলে আত্মাকে সন্তুষ্ট করা। এই আত্মা কী মৈত্রেয়ী? এই আত্মাকে জানাই আমাদের উদ্দেশ্য।
মৈত্রেয়ী বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আঃ পুরুষ! তুমি কী অদ্ভুত দুর্বল যুক্তিজাল বিস্তার করেছ! আত্মা ও আত্মচরিতার্থতা এক? স্থুলদেহের ভোগ আর আত্মাকে জানার ইচ্ছা এক? কিন্তু উপনিষদ এ পর্যন্তই বলে। যাজ্ঞবল্ক্য সন্ন্যাসে গিয়ে ভোগ থেকে নিষ্কৃতি পেলেন কিনা আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু অনুধাবন করতে পারি, দুই সহোদরার মতই কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী সেই আশ্রমে থেকে গেলেন বাকি জীবন। একজন আশ্রমমাতা অন্যজন আচার্যা। যত সংগোপনেই থাকুক, কার্যত গার্গী ও মৈত্রেয়ী, এই দুই নারীর কাছে যাজ্ঞবল্ক্যের পরাজয়ের কথা লেখা রইল উপনিষদে।
তথ্যসূত্রঃ
• বৃহদারণ্যক উপনিষদ, স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন
• লঙ্কাধীশ রাবণ, অনিন্দিতা মণ্ডল, খোয়াবনামা
[সাহিত্য আর সংবাদ শারদীয়া ২০২১]