Next
Previous
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















 
(১)

আজকের ট্রেনের কাহিনিটা কল্যাণি নয় নৈহাটির। কম্পার্টমেন্টে যে ক'জন আছেন প্রত্যেকেই বসে আছেন সিটে। জনা পাচেক প্যাসেনঞ্জার উঠেছে মাত্র। তাদের মধ্যে একটা বছর একুশের মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে হলুদ সালোয়ার, ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক বেশ সুন্দর করে! খুব সুন্দরী বলছি না, তবে চোখের কাজল এত গাঢ় ও চওড়া করে পড়া যে, তা কারোর চোখকে সহজে ফিরে যেতে বলবে না! আর এত চওড়া করে কাজল পরতে কাউকে দেখেছি বলে মনেও পড়ল না এখন। হোক না অচেনা মেয়ে, তবুও সহযাত্রার অঙ্গিকারে, চোখের পাতা বন্ধ করে কি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়া যায়? সেই 'কাজল নয়না হরিণীর' প্রতি অজান্তেই কান রইল পড়ে। চোখ ফিরল শালীনতার পথ ধরে।

কানে এল, "আপনারা বাংলাদেশ থেকে আসছেন বুঝি?"
আমাকে নয়। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করছে।
"হাঁ! কেন বলত?"

"না, ঐ আপনাদের কথা শুনেই মনে হল।"

"আমার না বাংলাদেশ খুব ভালো লাগে!"

"তাই বুঝি?"
"আমার মামার বাড়ি সিলেটে। দেশ ভাগের ঠিক আগেই মা ওদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসে, দাদুর হাত ধরে। মা তখন ছোটো। দিদা দাঙ্গায় মারা যায়। দাদু সেই দু:খে আর ওদেশে ফেরেনি।"

"ওখানে তোমাদের কেউ নেই?"

"আছে। ছোটো মামা। তবে মায়ের এখানে বিয়ে। ভায়ের টানে মা বার চারেক গিয়ে ছিল ওদেশে।"
"জানেন তো মাটির টান। কিভাবে কাকে টানে কাঁটাতার আর কি করে বুঝবে?"
"ঠিক বলেছো!"
"এই একটু সরে বসত, মেয়েটিকে বসতে দেই।"
বলেই সঙ্গের পুরুষযাত্রীদের কে সরিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে বসতে দিলেন।
আলাপ গড়িয়ে চলল ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে...

পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ এই মুহূর্তে মিলেমিশে যেন এক হয়ে যাচ্ছে। যে সিট এতক্ষণে তিনজন মিলে দখল করে আসছিল গেদে স্টেশন থেকে, তা এখন অবলীলায় শরীরের সীমান্তে এক হয়ে গেছে চারজনে। ডাক্তার দেখানোর জন্য যারা কলকাতায় আসছে, আর শরীর অসুস্থ বলে এতক্ষণে কাউকে বসতে দিচ্ছিল না, সেই অসুবিধা কখন সরে গেছে তা টেরই পায়নি তারাই।

এখন আমার কান আর চোখ ওদের বশীভূত। হবেই তো, আলাপচারিতা যদি নাম, ঠিকানা ছেড়ে বিয়ের আসর অতিক্রম করে সংসারে এসে পৌঁছায়… তাছাড়া রঙ্গমঞ্চ যদি সামনেই হয়, শ্রোতার অংশগ্রহণ স্বাভাবিক নয় কি?

"শাঁখা-সিন্দুর পরনি কেন?"
"আমার ডিভোর্সের মামলা চলছে।"
"সেকি!"

ভেবেছিলাম অল্প বয়স, একটু নিজেকে দেখানোর ভাব। যাকে বলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় আরকি। কিন্তু হঠাৎ করে আঁতকে উঠলাম তার এ কথায়। সকলেরও অবস্থা আমারই মতো। আমার ধারণা আছাড় খেয়ে পড়ল। সত্যিই তো বাইরের টা বড্ড কঠিন। দেখে বিচার করা দায়। সংসারের ওলিগলি এই বয়সে পার করে এসেছে সে। এসব ভেবে যত না অবাক হচ্ছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম ওর বাঁ হাতের দিকে চোখ পড়তে। কব্জির শুরু থেকে কুনুই এর আগে পর্যন্ত অসংখ্য কাটা দাগ। এটুকু বলা যায়, সংসারের আপেক্ষিক প্রেক্ষাপটে যন্ত্রণার চিহ্নগুলো আত্মহত্যার রাস্তা প্রস্তুত করেও শেষ অবধি পৌঁছতে পারেনি।

আপেক্ষিক সংসারের, আপেক্ষিক যুদ্ধের পোড় খাওয়া ঐ বাংলাদেশি মহিলা তার ঐ হাতটা হাতের মধ্যে ধরে নিয়ে বললেন, "এগুলো…"

তাঁর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটি বলল, "অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি। ছেলের আর বিধবা মায়ের মুখগুলো বারবার হাতের চাপ কমিয়ে দিয়েছে। সেই সুযোগে হাতের শিরা যেন লুকিয়ে গেছে মাংসের গভীরে।"

এখন কিন্তু মুখোশ খসে পড়েছে। যেটুকু দেখা যাচ্ছে তা কেবলমাত্র মুখ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। কাজলের সীমারেখা, বেদনার স্রোতে ধুয়ে যাচ্ছে চিবুকের প্লাবন ভূমি ছাপিয়ে।

পাশের মহিলা জড়িয়ে ধরলেন তাকে। নিজের ওড়না হাতে তুলে চোখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। এই ক্ষণিকের পরিচয়ে

তার মাথাটা ধরে স্নেহের আবেগে কাঁধে রেখে দিলেন। একটা কথা মনে হতে লাগল বারবার, "পৃথিবীর সব মায়েরা বুঝি এইভাবে সন্তানের ব্যথা নিজের করে নেয়।"

পরিবেশটা কেমন যেন বিষাদঘন হয়ে উঠল। গাড়ির দুলুনি আর আওয়াজ হঠাৎ যেন হার মানল তার কথা শুনে। ট্রেন থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইছাপুর ছেড়ে। মহিলাও কখন আপ্লুত হয়ে পড়েছেন, তা টের পায়নি আমিও। তাঁর চোখ তারও ছলছল করছে। সঙ্গের পুরুষযাত্রীদের উদ্দেশ্য বললেন,
"অত অল্প বয়স, কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা! সঙ্গে আবার ছেলে। ছোটো।"

মুখ ফিরিয়ে মেয়েটাকে জানতে চাইল, "কত বয়স তার?

বলেই মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন |
নিজেকে সামলে নিয়ে সহেলি বলল... "আটমাস!"

সহেলি আর থেমে থাকেনি। বলেই চলেছে। তা কৌতুহলের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ একে একে...

বছর আড়াই আগে কথা। বাংলাদেশী এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। ওপার বাংলার প্রতি তার মায়ের যেমন টানছিল, তেমনি তারও। সিছেলেটা অবশ্য তার মায়েরই পছন্দ। সংসার বলতে শ্বাশুড়ী, শ্বশুর, স্বামী। স্বামী তার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। বিধবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছিল। শুনেছিল স্বামীর বয়স বেশি হলে নাকি মানিয়ে নিয়ে চলে ভালো। সঙ্গে নাকি অভিভাবক হয় ভালো।

কিন্তু তার শোনা কথা যে একেবারে কাকতালীয়, তা প্রমাণ দেওয়া জন্য এই চোখের জলের প্রতিটি বর্ণমালা আমাদের টেনে নিয় চলল তার বাংলাদেশে শ্বশুর বাড়িতে…

দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে আমরাও উপস্থিত হলাম তার ঘরে। বেশ সাজানো। দেখছি তো দেখেই চলেছি। সপ্তাহ তিনেক কাটতে না কাটতে স্নেহের-পূর্ণিমা-চাঁদ-মুখ লুকালো কদর্য রূপের অন্ধকারে।
স্বামী রাত করে বাড়ি ফেরে প্রায়ই। পা ঠিক পড়ে না মদের ঘোরে। দু'একদিন মেনেও নেয়... পুরুষমানুষ, একটু আধটু এসব করেই থাকে। কিন্তু বাধ সাধল সেদিন, স্বামীর লাম্পট্যের অন্যায় আবদারে। তাকে কিনা নাচতে হবেই এখনই। নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ঘরে। বার-ডান্সারদের মতো পোশাক তুলে দিয়েছে তার হাতে। জেদাজেদির সঙ্গে অকথ্য গালাগাল। চমকে উঠল সহেলি! এ কেমন অন্যায় আবদার? না, সে কিছুতেই তা করবে না… বলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফেলে আসা দিনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে থাকে। কই? এ ক'দিনে এই চেনা মানুষটাকে তো সে দেখেনি একবারও। এ কেমন বিকৃত রুচির মানুষ সে। তার ঘোর কাটার আগেই সে টের পায়, মদের গন্ধে ভরা মুখ শরীরে ছাপ রাখছে তীব্র দংশনে। নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সেহেলি। দেখে, আঁচল খসে পড়েছে কাঁধের থেকে। পাড়াও প্রায় রাতের গভীরতায় চুপ। এ অবস্থায় সে যাবে কোথায়? ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় ঘরেই ফিরল সে।
ততক্ষণে তার স্বামী খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেলল তাকে ঘরের মেঝে। ঘরের নীল আলো অট্টহাসি হাসিতে ফেটে পড়ছে পাশবিকতার মোড়কে। আসল রূপ যেন বেরিয়ে আসছে তার, "সবে তো শুরু। অনেক অনেক এখনও বাকি। তৈরি হ শালী।"

মাত্র কয়েক দিনের দাম্পত্য জীবন। আজকের এই দাঁত-নখ বের করা বিকৃত কামনার স্বামী, ঘরের নীল আলো, মদের গন্ধ সব কিছুই ওর মাথায় একে একে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন মরা চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেঝে। তার অনাবৃত শরীরে।

শেষ রাতের মরা চাঁদের সামনেই সে প্রথম ব্লেড চালিয়ে ছিল হাতে।


(২)

কিছু গোপন কথা বা ঘটনা চিরকাল নিজের কাছেই গোপন থাকে, মৃত্যু পর্যন্ত। তা কোনোদিনই কারো কাছে প্রকাশিত হয় না। কিন্তু সহেলির ঐদিনের ঘটনা বেশিদিন চাপা থাকেনি। থাকবেই বা কি করে? চার দেওয়াল তো চুপ করে থাকবে না। আর তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সে আভাস পাচ্ছিল দিনের পর দিন। চরিত্রহীন ছেলের কীর্তিকলাপ তার বাবা-মার কাছে অবশ্য গোপন ছিল না। আই.টি সেক্টরে কাজ করে ছেলে। কোনো কোনোদিন বাড়ি ফিরত না। বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে উৎশৃঙ্খল জীবন কাটাতো দিনের পর দিন। প্রত্যেক বাবা-মা'র মতো তাঁরাও ভেবেছিলেন, বিয়ে দিলে হয়তো ঐসব ওলিগলি, মেয়ে মানুষ থেকে দূরে থাকবে ছেলে। কিন্তু সে ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছে তাদের ছেলে।


তবে সহেলির মা'র ও ভালো লেগেছিল ছেলেটাকে। বাংলাদেশের প্রতি তার অচ্ছেদ্য টানও কাজ করেছিল এই সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। তার সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছিল তাঁর বৈধব্য আর সংসারের বোঝা। কিছুতেই আর বইতে পারছিল না তা। অভাবগুলোকে সেলাই আর তালি মেরে দুটো মেয়ের পড়া খরচ চালিয়েছেন এতদিন। এমনিতেই বাসন মাজার কাজ করতেন দু'তিন বাড়তিতে। রাতে সেলাই আর দিনে কাজ এইভাবে সংসারের পাণ্ডুলিপি রচনা করে চলেছিলেন তিনি।

তারপর একদিন সানাই বেজে উঠল বাড়িতে। সহেলি তখন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়া আর শেষ হল না তার।

এত তাড়াতাড়ি যে দাম্পত্যের অববাহিকার আছাড় খেয়ে পড়বে, তা কল্পনা করতে পারেনি সহেলি নিজেও। রাত ও দিন গড়িয়েছে নিজেদের নিয়মে, আর তার যন্ত্রণার মেঘমল্লার আর্তনাদ করেছে চার দেওয়ালের মধ্যে, ঘরের প্রতিটা কোণায়। কিন্তু তার হয়ে কথা বলেনি কোনো উপাদান। কিন্তু তারা নির্বিকারে দেখেছে। আবার হেসেছে কখনো। কখনো বা তার হাতকাটার ফিনকি দেওয়া রক্ত মেখে কানাঘুষো করেছে দিনের পর দিন। আর ফিসফিস করেছে প্রতিবেশীর মতো।

এই ফিসফিসানি শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর মরুভূমির মরুদ্যানে সন্দেহের কাঁটা গাছ বসিয়েছে দিনে দিনে। তাতে বেঁচে থাকার ছায়াটুকু, ততটাই ভয়ঙ্কর করে উঠেছে।

আনন্দ উপভোগ করছে পর দিন। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে তাদের ছেলের এই কুকর্ম যাতে না হয় তার জন্য তারাও সহেলিকে ও উল্টো জায়গার উপরের সংগোপনে। আর এই সুযোগে, তাদের অস্কার ছেলে ঘনিষ্ঠ হয়েছে অন্য মহিলার সাথে।

ঠিক সহেলি বাড়ি ফিরেও একই বিছানায় রীতম আর সেই মহিলা। চকি তাকে বিধাক্কা রীতম। চিটকে পড়ে সহেলি। সেই সুযোগে উত্তরের লেখা পড়ে তারা। রাগে তার শরীর শরীর পুড়ছে। সবটা গিয়ে পড়ে তার শ্বশুর-শ্বশুড়ীর উপর। তারা বাড়ির পাশে কোন নেতা দিল না ছেলেকে? সন্দেহ প্রকট হওয়া তার, নিশ্চয় এর আগেও তার অনুপস্থিতির কারণে কান্ড চলত।

শুরু হল কথাটি। হাতাহাতি। ছেলের ভিন্নঢাকতে বাবা-মারিয়া চেষ্টা। সহেলিকে ধরে মার আর অকথ্য ভাষা গালাগাল। সহেলির মেজাজ ও ধৈর্যের বাঁধা যায়। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, " সাধারণ কাছে তোদের পাকএফ.আই. আরে আরে।

ব্যাস, ইন্ধনের আর বাকি থাকবে কিছু?

"পুলিশের ভয় দেখায় আমাদের। তোকে আজ কোন বাবা বাঁচায়?"

শ্বশুরই চেপে ধরে তার হাতের মাপ। শ্বাশুড়ি ধরে চুলের মুঠি। টানতে টানতে নিয়ে চললে পরে প্রকাশের নাম। নোংরা আবর্জনাময় পরিপূর্ণ। সেদিক বিশেষ কেউ যায় না জানাতে। সেখানে কী নেই? আরশোলা, টিকটিকি, ঝুল নিজেরাই গুছিয়ে ঘরুল ডাক্তার। এক প্রকার তাদেরই অবারিত ছোটো রাজত্ব এটা। শুধু আলো সেখানে কৃপাণ। সহেলির আর্তনাদ আর তাদের হুড়মুওয়া ঢোকায়টা কয়েক ইঁদুর তাড়াহুড়ো করে পালাতে গেল। তাদের কার্যকারিতা কলাপে কয়েকটি জিনিস পড়ল। তবে সেই শব্দের অনুরণন ক্ষীণ হয়ে গেল আর্তনাদ ও চেঁচানে।

"তোকে এখানে শুকিয়ে মারব, হারামজাদি। নেলিশ করবি?
শ্বাশুড়ীর আস্ফালন গতিপথ পরিবর্তন,
"এই দেখছোটা কি? দড়ি নিয়ে বাঁধো না শয়তানিকে।'
রাগে ফুঁসে শুশুর। দড়ি খুঁজছে। যতটা হাতড়েছে, না পাওয়া, রাগ তার কাছে চড়েছে। কারণ খুন চেপেছে তার ঘিলুতে। ঘর এই আবছা আলোয় তার মুখের উন্ম্মত্ত খেলা মেতে আমাদের। সম্ভোম হারিয়ে ফেলল পাস। হাত দিল সহেলির আলুথালু শরীরে। তান দিল তার খসে পড়া শাড়ির আঁচলে। আরো কাতার উঠল সহেলি। চুলের মুঠির টানের ছাপিয়ে তার সম্মাননা বাঁচানোর বেদনা।
হা-হুতাশে অংশ সে। টানা হেঁচড়ায় শরীর থেকে কাপড় সরাতে থাকে শশুর হাতে। সমস্ত জোর দিয়ে চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারে পরনের শাড়িকে ।

হা,পাষ্টপিঠে বাঁধতে থাকে ঘের প্লেরের সাথে। লজ্জ্বায়, অপমানে, অসম্মানে মুচড়ে পড়ে সহেলি। প্রায় নগ্ন শরীর। সায়া আর ব্লাউজের মাঝখানে, তার এতদিনের পরিচয়ের লালিত সন্তানের সুকাঘরটি, এখন আবরণ হারিয়ে, অসহায়ের মত সম্মান ভিক্ষে করছে কাতরে,
"মা। আমাকে বাঁচান। আমার সন্তানের কষ্ট হচ্ছে, মা… মা…"
চোখের জল টপটপ করে ঝরে পড়ছে। সূতিকাগার বেদনার সিক্ত হয়ে নিদারুণ ভাবে। তার বেদনাদীর্ণ-কাতর প্রার্থনায় চমকে ওঠেন শ্বাশুড়ি।

"এ কি শুনছি আমি, আমাদের বংশধর!"

শ্বশুর স্তব্ধ হয়ে গেলেন হঠাৎ। ক্ষান্ত হয়ে গেলেন তিনি।

ততক্ষণে অপরাধের মোহময় টান টেনে নিয়ে চলেছে তাঁদের। মন থামতে চাইলেও ঘটনা তাদের চালিত করল তাঁদের, বাকিটুকু শেষ করার জন্য। হঠাৎই

কেমন যেন একটা অপরাধবোধ,জাঁকিয়ে বসল তাদের শরীরে শরীরে। হাত যেন শিথিল হয়ে পড়ল দুজনের। স্তব্ধ হয়ে গেল সেই নিষ্ঠুর খেলা। অপরাধবোধে ঘর ছাড়ল দুজন। সহেলি বাঁধা রইল নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে। দিনের আলোর নিভের আসার মতো, তার আর্তনাদও প্রাণ হারালো কিছুক্ষণ পর।


(৩)

আজ বাঁচার জন্য সহেলির প্রাণ, বড় লড়াই করতেও প্রস্তুত। কিন্তু পারছে কই? নির্যাতিত, অবসন্ন শরীর। সঙ্গে ক্ষিদের তীব্রতা, তার সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে যেন। কেঁদে কেঁদে গলা বসে গেছে... স্বর বের হচ্ছে না আর। সময় গড়িয়েছে নিজের মতো।

অবসন্ন শরীরটা তার ঝুলে রয়েছে কাপড়ের বাঁধনে। অন্ধকার গ্রাস করেছে চারপাশ। এই দিকটা মূল বাড়ি ছাড়া নির্জন ও ফাঁকা। এমনকি অন্য প্রতিবেশী বাড়িগুলো বেশ দূরে। কয়েকটা পুকুরের পরেই দুটো বাড়ি। গাছে ঘেরা এই দিকটা যেন আজকে আরও বেশি করে ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে।

ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে কি একটা কুটকুট করে কামড় দিচ্ছে। সম্বিত ফিরে পেল সহেলি। পা নাড়া দিতেই, একটা ইঁদুর বোধহয় দৌড়ে পালাল। ভয় আঁকড়ে ধরেছে তাকে। নানান প্রশ্ন পাক খাচ্ছে মনে, "শ্বশুর-শ্বাশুড়ীই বা কোথায়? কী করছে তারা এখন? তারা আমাকে আটকে রেখে অন্য কোনো প্লান করছে না তো? রীটম কি এখনও ফেরেনি? নাকি তিনজনে মিলে…"

আর ভাবতে পারছে না সে। পায়ের দিকের গিঁটটা একটু আলগা আলগা মনে হচ্ছে... তবে কি এতক্ষণ ধরে ইঁদুর এটাতেই কামড় দিচ্ছিল? তাই তো!বাঁধনটা কেমন শিথিল হয়ে রয়েছে। একটু একটু চাপ দিয়ে পা টানতে থাকে সহেলি। কিছুক্ষণের চেষ্টায় বেরিয়ে এল একটা পা। শরীরে প্যাঁচানো কাপড়ের বাঁধন, আলগা হয়ে পড়েছে খানিকটা।

ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে পেটের উপর স্নেহের দুই হাত রেখে চোখের জল আর চেপে রাখতে পারলো না কিছুতেই। কোথায় যাবে এখান সে? কি করবে? টলটল পায়ে এগিয়ে গেল ঐ অন্ধকারে। দরজা কোথায়? একটা মৃদু, ফিসফিসানির শব্দ এ ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। কানে আসছে তার, "আজ রীতম বাড়ি ফেরার আগেই হারামজাদিকে শেষ করে ফলব।"

"পাড়ার লোক জেগে ওঠার আগেই ঐ শরীর ফেলে দিয়ে আসবো নদীর জলে। কেউ টের পাবে না।"

হাঁ, এটা তো তার শ্বশুরেরই গলা। নিশ্চয়ই শ্বাশুড়ীও সঙ্গে আছে। পায়ের শব্দ এসে একটা জায়গায় থেমে গেল। ফিসফিসানি বন্ধ। দরজা কোথায় সহেলির আর বুঝতে বাকি থাকল না। ঘাপটি মেরে রইল দরজার এক পাশে। ভয়ে শরীরে তার ঘাম আসছে দরদর করে। হয়তো একেই বলে কালঘাম। কাপড়টা শক্ত করে পাক দিয়ে নিল কোমরে। দরজা খুলে ওরা ভেতরে ঢুকল দুটো শরীর। গায়ের জোর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার, তা দিয়ে দুজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ঐ অন্ধকারময় ঘরে।

তাদের হাতের লণ্ঠন ছিটকে পড়েছে সেই আবর্জনার মধ্যিখানে। দপ দপ করে নিভে গেল লণ্ঠন। অন্ধকার বেড়ে গেল হঠাৎ।দরজা বাইরে থেকে আটকে দিল সহেলি। পালিয়ে গেল অন্ধকারে।

দৌড়ে গিয়ে উঠল মূল রাস্তায়। মনে হলো, দুটো কালো শরীর যেন ধেয়ে আসছে তার দিকে। পাড়া তখন চুপচাপ। একটা বিড়াল রাস্তা পার হচ্ছিল। তাকে দেখে ভয়ে পালাল। একটু দূরেই ল্যাম্প পোষ্ট। টিমটিম করে বাল্ব জ্বলছে। শুনশান রাস্তা। খাঁ খাঁ করছে ওপাশটা। রাতের শূন্যতা এত যে একা ও ভয়ঙ্কর তা আজ সে প্রথম টের পেল। কিন্তু ওদিকে এগোলেই ওদের নজরে এড়িয়ে পালাতে পারবে না সে। সামনেই কয়েকটা বাড়ি। চারপাশে গাছপালা আর ঝোপঝাড়। টুক করে লুকিয়ে পড়ল সামনের বাড়ির পাশে, ঝোপের মধ্যে।

অভুক্ত ও অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিল ঝোপের মাঝে। তিনটে ছায়ামূর্তি রাস্তা দাপিয়ে বেড়াল এপার ওপার। তবে কি তার স্বামী রীতমও ওদের সঙ্গে তাকে খুঁজছে? আর ভাবতে পারছে না সে।

কতক্ষণ এভাবে কাটলো সে আন্দাজ করতে পারলো না। কটা বাজে কে জানে? কতক্ষণই বা এভাবে থাকবে সে? তাকে বাঁচতে হবে। তার সন্তানকে এ পৃথিবীর আলো দেখাতে হবে যে। কিন্তু দিনের আলো ফোটার আগেই তাকে পালাতে হবে এখন থেকে।

বর্ডার বেশি দূরে নয়। কিন্তু ওখান থেকে যাবে কি করে? এত রাত! একা! কাটাছেঁড়া শরীর। আর ভিসাও তো নেই তার। একবার বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য ভিসা ছাড়াই নদী পথে ওপারে উঠেছিল স হেলি। সে অনেকদিন আগের কথা। সেদিন রীতম অবশ্য সঙ্গে ছিল। কিন্তু তার দুর্বল পা অবসন্ন শরীরকে টেনে নিয়ে চলল সেদিকে, অন্ধকারেই।

এদিকটায় তেমন চেকিং হয় না। কত লোক নাকি এখন দিয়ে যাতায়াত করে চুরি করে। একটা চোরাই ঘাটও বলা যেতে পারে। সহেলি এগিয়ে গেল সেই পথে।

আবছা অন্ধকার ঢেকে রেখেছে পথঘাট। নদীর জল খলখল করছে, শুনতে পাচ্ছে সহেলি।

একটা নৌকা ঘাটে বাধা আছে এখনো। সে বার যখন তারা পার হয়েছিল, রাত ছিল তখনও। আর এসব চলে অন্ধকারেই। তবে তারা যাত্রী পার করে মোটা টাকার বিনিময়ে। এসব নাকি ঐ সীমান্তরক্ষীরাও জানে না। সবই নাকি কমিশনের ব্যাপার।

ঝোপ পেরিয়ে এগিয়ে গেল নিচে, যেখানে নৌকা বাঁধা ছিল। হঠাৎই একটা ছায়া শরীর দৌড়ে এল তার দিকে। খানিকটা দূরেই যেন ওঁতপেতে বসেছিল। শিউরে ওঠে সহেলি। "আরে! এ যে রীতম!"

তার অনুমান সত্যিই। এ পথে সে যে যেতে পারে, এই অনুমানে বসেছিল রীতম। অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে গিয়েছিল তার। পায়ের শব্দে জেগে ওঠে সে।

সহেলি প্রাণের মায়ায় কাদা মাড়িয়ে গড়িয়ে উঠল নৌকায়। দড়ি খুলে দিল সে নৌকা থেকে। স্রোতের টানে নৌকা তীর ছাড়ল ধীর গতিতে। রীতম দৌড়ে নেমে এল নদীর জলে। কিছুটা এসেই থমকে গেল। নৌকা তখন স্রোতের টানে।

রীতমের গালাগালি ও চেঁচানিতে মাঝির ঘুম ভেঙে গেল। ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। চোখ ঘষতে ঘষতে দেখে... নৌকা তীর ছেড়েছে... কে একটা কোমর পর্যন্ত জলে নেমে নিস্ফল আস্ফালন করছে হতাশায়। সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই সহেলি তার পায়ের উপর এসে পড়ল। "আমাকে বাঁচান। ওরা মেরে ফেলবে আমাকে। ওপারের ঘাটে আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে। আমার হাতের বাউটি দুটো আপনাকে…"

জ্ঞান হারাল সহেলি। এতদিন টাকা নিয়ে কত লোক পার করেছে সে। তার এই পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। আজ প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক মেয়ের কাতর আবেদনে তার মনটাকে কেমন যেন হয়ে গেল। মোবাইলে হাত দিল। সুইচটা টিপল জোরে। রাত তখন প্রায় শয়া একটা।

তার একাজ শুরু হয়ে তিনটের পর। কিন্তু আজ তাকে আগে পাড়ি দিতে হলো সহেলির জন্য। দুহাতে শক্ত করে ধরল হাল। নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে লাগছে নৌকার গায়ে। সহেলিকে আর জাগাল না সে।

হঠাৎ ঘোষণা হচ্ছে, আগরপাড়ায় অবরোধ চলছে, আপ-ডাউন ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে এখন। আমরা তখন ছিটকে এসে পড়লাম ব্যারাকপুরে।

সহেলির কখন জ্ঞান ফিরল, কিভাবে সে তার মায়ের কাছে এল, সে ইতিহাস গোপন থাকল আমাদের কাছে। সে এখন অস্থির হয়ে উঠেছে। নিউমার্কেটে যাবে সে। বিধবা মার সঙ্গে গারমেন্টসের ব্যবসা শুরু করেছে বেশ কয়েকমাস ধরে। তাই কিছু কেনাকাটা করেই আবার ফিরবে। বাড়িতে তার ছোটো ছেলে। মায়ের কাছে রেখে বেরিয়েছে। মা তার একা সামলাতে পারবে না। হিমশিম খাবে। বোনও বাড়িতে নেই। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে।

"কখন ছাড়বে কে জানে? কী করবে, বসে থাকবে?" ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখল সহেলি। পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর বয়স হবে তার। আবার বলল,
"চলো, ওঠো। ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে যাই।"

সহেলি উঠে পড়ল হুড়মুড়িয়ে।
"চলি, আপনাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।"

"আরে, তোমার নম্বরটা তো দাও…"

বাংলাদেশি মহিলাকে কোনোক্রমে নম্বর দিয়ে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল তারা।
মহিলা সহসা জিজ্ঞাসা করলেন, "কে ও?"

লাজুক হাসিতে বলে উঠল সহেলি, "আমার বয়ফ্রেণ্ড।"

দ্রুতগতিতে তারা ট্রেন থেকে নেমে গেল। জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি... গোধূলী বেলায়, কোনে দেখা আলোয় বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে সহেলি কেমন হারিয়ে গেল, এত লোকের ভীড়ে।
……………