Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in






আমার ভারতবর্ষ

সুলতান ও গান্ধর্বী

---------------------

খুব গর্ব করার মতো বীরপুরুষ ছিলেন না তিনি। বাবা শুজাত খানের রাজত্ব পেয়েছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মেরে, তাড়িয়ে দখল করেছিলেন মালওয়ার মসনদ। কিন্তু সে রাজত্ব রক্ষা করার মতো এলেম ছিলোনা। রানি দুর্গাবতীর সঙ্গে লড়াইতে সর্বস্ব খুইয়ে শুধু প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মালওয়ায়। শরীরে, মনে একেবারে ঘায়েল আশ্রয় খুঁজেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম সঙ্গীতের কাছে। যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বনে-প্রান্তরে। এমন সময় খোঁজ পা'ন সেই নারীর, যাঁর সঙ্গে তিনি জড়িয়ে তিনি একদিন হয়ে যাবেন এক রূপকথার নায়ক।

সুলতান হিসেবে অনায়াসে দখল করতে পারতেন সেই নারীকে, গায়ের জোরে। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা'র জোর তুর্কিদের অস্ত্রের জোরের থেকে একটু আলাদা। তিনি বিবাহ করতে চাইলেন তাঁর দয়িতাকে। বাপ ঠাকুর থান সিং গুজ্জর রাজপুত, রাজি ন'ন যবনের হাতে মেয়েকে সম্প্রদানে। লড়াই একটা হলো, কিন্তু এক তরফা। আসলে কন্যা নিজেই তো রাজি ঐ সুপুরুষ, সুর-পাগল সুলতানের স্বয়ম্বরা হতে। ঐতিহাসিক ফিরিশতা ছিলেন এই কাহিনীর কথাকার। কিংবদন্তির উর্ধ্বে আমরা যা জানতে পারি, তা ফিরিশতার পুথি থেকেই। নায়িকার নাম রূপমতী। রূপকথার নায়িকাদের সব কিছুই মাত্রা-ছাড়া। রূপমতীও তাই। পাগলকরা রূপ, মজিয়ে দেওয়া গান, ডুবিয়ে দেওয়া শায়রি। সে রকমই তো বলে সবাই। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এক হিন্দু মেয়ে আর আফঘান সুলতানের বিবাহ হয়েছিলো ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি রীতিতে। এখনও বিরল সে জাতীয় ঘটনা।

রাজধর্ম থেকে রুচি হারিয়েছিলেন তো আগেই, রূপমতীকে পেয়ে বাকিটাও গেলো। গান বাঁধা আর গান গাওয়া। দুজনে দুজনকে চোখে হারান। রাজত্ব উৎসন্নে যায়। আকবর বাদশা এসব দেখে পাঠালেন আধম খান ফৌজদারকে। মুঘল ফৌজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিলোনা বায়জিদ খান ওরফে বাজ বহাদুর খানের। রণে ভঙ্গ দেওয়াই সাব্যস্ত করলেন তিনি। পুরো অন্তঃপুরকে পিছনে ফেলে রেখে দেশান্তরে গেলেন। আধম খানের লক্ষ্য ছিলেন রূপমতী। কিন্তু আধম খানও বলপ্রয়োগ করেননি তাঁকে পেতে। শুধু পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন সভ্যভাবে। রূপমতীর তা মঞ্জুর ছিলোনা। বাজ বহাদুর ছাড়া আর কেউ নয় তাঁর হৃদয়েশ্বর। সাক্ষাৎপ্রার্থী আধম খান তাঁর বিষপানে মৃত শরীরটির সাক্ষাৎ
পেয়েছিলেন। তার আর পর নেই। একটা রূপকথার জন্ম এভাবেই। লাইলা-কয়েস, শিরিঁ-ফরহাদ, হীর-রানঝা জাতীয় উপকথার অংশ হয়ে গেলো দু'টি ঐতিহাসিক রক্তমাংসের মানুষের গল্প। তার আর জোড়া পাওয়া যায়না কোথাও।

মাণ্ডুতে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু রূপমতী-বাজবহাদুরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চিরকালের সুরসৌরভ আর ভালোবাসার আঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মনে বাজে। সুলতানের হারেমে থাকতেন না রূপমতী। তাঁর জন্য একটা ছোট্টো পাহাড়ের উপর মহল বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাজবহাদুর। সেই প্রাসাদের ছাদ থেকে নাকি কখনও নর্মদাকে দেখা যেতো। এটা জনশ্রুতি, সত্য নয়। সুলতান রূপমতীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন 'রেওয়া কুণ্ড'। সেই সরোবরটি থেকে জল এনে রূপমতী পুজোআচ্চা করতেন। 

বাজবহাদুরের প্রাসাদটি একটু নীচে। দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেই প্রাসাদের অলিন্দ থেকে রূপমতীর মহল স্পষ্ট দেখা যায়। বাজবহাদুর ছোটো রাজা। মুঘলদের মতো জমকালো, বিপুল স্থাপত্য তাঁর সাধ্যাতীত ছিলো। কিন্তু সীমায়িত মাত্রায় ইসলামি স্থাপত্যকলা অনুসারী এই সব নির্মাণগুলি এখনও মুগ্ধ করে তাদের শৈল্পিক সংযমে। দূর দূর পর্যন্ত ঊষর, গৈরিক ঢেউখেলানো মাটি, উঁচুনীচু পাথুরে প্রান্তর আর সবুজ লতাগুল্মের সুতোবাঁধা মালওয়ার দিগন্তরেখা একটা অন্যধরণের উদাসসুরে মনের স্কেলটা বেঁধে দেয়। পিলু, কাফি না মুলতানি, ঠাহর করে ওঠা যায়না।

বাজবহাদুরের গানের গল্প, রূপমতীর ফারসি আর ব্রজভাষায় রচিত গীতিসম্ভার, সবার উপরে শ্রেণীনির্বিশেষ জনতাকে মজিয়ে রাখা ট্র্যাজিক প্রেমের কালজয়ী ফর্মুলা, এই সব নিয়ে মস্তো লেখা লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এখন তা থাক। আমরা এই রাজারানির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন নির্মাণগুলির থেকেই না হয় খুঁজে নিই সেই সব লীলা অভিরাম ছবি।