ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৭
রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক কবিতা, কম্যুনিস্ট পার্টি ও ইন্দ্রপতন
কিছু নিয়ম বদলে গিয়েছে। আগে দুবেলাই ঘরে বসে পড়াশুনো দেখতেন আশ্রমিক টিচারেরা। এখন একবেলা পড়াবেন বাইরে থেকে এসে প্রফেশনাল টিউটররা। এমনি ভাবে পেয়েছিলাম দুর্গাপুরের ভব রায়কে।
উনি শেখালেন কবিতা আবৃত্তি, উৎসাহ দিতেন কবিতা লিখতে বা দেওয়াল পত্রিকা বের করতে। আর আমার সঙ্গে কথা হত কম্যুনিস্ট পার্টি নিয়ে।
আমি দেখলাম ষাটের দশকের কম্যুনিস্টরা ভীষণ ভাবে রাবীন্দ্রিক,প্রায় শান্তিনিকেতনীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেন। এঁরা মাঝে মাধ্যে শান্তিনিকেতনে যান। জীবনানন্দেরও ভক্ত, মাথায় অবিন্যস্ত বাবরি চুল ও দাড়ি কাটতে অনীহা। পরনে খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবী ও সাদা পায়জামা, কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। এদের চেহারায় ক্রোধের থেকেও কেমন একটা উদাসী বাউল ভাব। যেন 'আমি রব নিস্ফলের হতাশের দলে'।
উনি আমাকে পড়ালেন "শেষের কবিতা"। আমার দারুণ লাগল। মনে হল তাহলে একসঙ্গে দুজনকেও ভালবাসা যায়। কেটি মিত্র ঘরের পুকুর আর লাবণ্য পুরীর সমুদ্র--বাঃ!
আর একটা জীববানন্দের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ। তাতে এজরা পাউন্ড, পল ভালেরি ও এলিয়ট নামগুলো শুনলাম--কি্স্যু বুঝলাম না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও অন্য কবিদের নিয়ে কিছু কবিতা ছিল। কোন একজনের কথা ছিল যে বনে বাদাড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে নাদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায় --কিন্তু প্রকৃতির রহস্য তার কাছে ধরা দেয় না।একটা অনুবাদ কবিতার লাইনে চোখ আটকে গেল--" তোমারে চুম্বন করি মুর্চ্ছাহত ইন্দ্রিয়সকল। ঊর্ধগামী অঙ্গ মোর---"।
হে ঈশ্বর! কবিদের কি মাথাখারাপ? কাউকে ভালবেসে চুমু খেলে ইন্দ্রিয়ে পক্ষাঘাত হয়? মানুষ গ্যাসবেলুনের মত হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়? নাঃ, আমি অমন চুমু খেতে চাইনে।
ভবদার সঙ্গে এলেন এক ভদ্রলোক -- আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্যে গান শেখাতে "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে" আর " এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা"।
উনি আমাদের কানাই মহারাজের সান্নিধ্যে নিয়মিত আসা বিল্টুদির ভাই। একবার স্পেশাল গেটপাস বানিয়ে ওঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন লিন্টুদির বাড়িতে। বিল্টুদির পরিশীলিত পোশাক , চেহরায় আভিজাত্যের সঙ্গে ওঁদের বাড়ির কোন মিল নেই। উনি বাড়িতে ছিলেন না। তবে আমরা গেছলাম ওঁদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
বাঁকুড়া রেলকলোনী এলাকায় টালির চালের দুখানা ঘর। উঁচু চৌকাঠ। পায়ার তলায় ইঁট পেতে উঁচু করা চৌকির উপরে মলিন চাদরে ঢাকা বিছানায় শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ, উঠে বসতে পারেন না। কোমর পড়ে গেছে। গেঞ্জিটি রোজ বদলানো হয় না। পরনের লুঙ্গিটিও ও তথৈবচ। অবিন্যস্ত সাদা চুল ও চার পাঁচদিনের না কামানো দাড়ি। সব মিলিয়ে মনটা কেমন দমে যায়। উনি নাকি বাঁকুড়ার গভর্নমেন্ট স্কুলের কোন একসময়ে হেডমাস্টার ছিলেন।
কিন্তু একটু পরেই আমরা ভুলে গেলাম যে উনি অসুস্থ, চলৎশক্তিহীন। সকাল নটা-দশটার রোদ্দূর এসে পড়েছে চৌকাঠে। আর সেইখানে এবং রাস্তায় মোড়া টেনে বসে আছে পাড়ার কয়েকটি তরুণ। তারা নাকি এঁর বন্ধু! এরা বিভিন্ন পত্রিকা থেকে পড়ে শোনাচ্ছে নানা খবর। উনি মন দিয়ে শুনে মহাউৎসাহে মেতে উঠছেন তর্কে। উনি নিজের বিছানায় পাশে রেখেছেন একটি দৈনিক--"স্বাধীনতা"। আমি জানি, ওটা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা।
আমার অবাক রাখল ওনার খেলা নিয়ে আবেগ দেখে। বাইটন কাপ, সন্তোষ ট্রফি হয়ে তর্ক শুরু হল এবছর বেঙ্গলের সম্ভাব্য হকি ইলেভেন নিয়ে। ইস্টবেঙ্গল থেকে কাকে নেওয়া হবে আর কাকে কাস্টমস থেকে। ইনামূর রহমান কোথায় খেলবে, লেফ্ট ইন কে বেটার ইত্যাদি। নতুন প্রজন্ম মন দিয়ে শুনছে বৃদ্ধের আর্গুমেন্ট এবং সমানে সমানে তর্ক করছে।
আমার মনটা ভালো হয়ে গেল।আশ্রমে ফিরে বন্ধুদের কাছে সাতকাহন করে ওঁদের বাড়ির গল্প বললাম।
বিকেলে আমাকে মলয় বাড়ুরি বলল--তোর সঙ্গে কথা আছে।
-- কী কেস?
-- আমি আশ্রম ছেড়ে দিচ্ছি। এখন কাউকে বলবি না।
-- সে কী! কেন?
-- বিকেলে ঘরে একা থাকিস। আমি আসব, ক্থা হবে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। মলয় বাড়ুরি হস্টেল ছেড়ে দেবে?
গোয়ালতোড়ের ছেলে। বাবাকে হারিয়েছে। দিদি চাকরি করে পড়াচ্ছে। বাড়িতে কিছু ধানীজমি আছে।
টানা চোখের লম্বা হিলহিলে ছেলেটাকে দেখে ভবদা বলেছিলেন--ওকে দেখ, ঠিক যেন সহজপাঠে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি।
ও আমাকে খুব পছন্দ করত; আমার সঙ্গ চাইত । সেকথা বলেওছিল। কিন্তু আমার সারাদিন বিপ্লবের সঙ্গে লেপটে থাকা দেখে একটু সরে গিয়েছিল। খালি সময়ে কানাই মহারাজের গল্পদাদুর আসরে নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার দলে ভিড়ে গেল। এই নিয়ে কখনও সখনও খেপিয়েছি--কিন্তু কখনও রাগ করে নি। জবাব দেয় নি, শুধু হেসেছে। ও হটাৎ আশ্রম ছাড়তে চাইছে কেন?
সে যাক গে। বিকেলে সবাই ফুটবল পেটাতে গেল। পরনে সেই কোমরে ইলাস্টিক লাগানো ছাতার কাপড়ে তৈরি কালো খেলার প্যান্ট। আমি শরীর ভালো নেই বলে ঘরের দরজা ভেজিয়ে আধশোয়া হয়ে সদ্য লাইব্রেরি থেকে আনা 'শার্লক হোমস ফিরে এলেন' পড়তে লাগলাম। মিনিট পনের পরেই দরজায় টোকা। বেশ হোমস্ স্টাইলে 'কাম ইন্" বলার আগেই মলয় দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল। হাঁপাচ্ছে, চারদিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হবার ভাব করছে। তারপর ঘরের কোণের কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে আমার বিছানার কোণে বসে আবার বড় বড় শ্বাস টানতে লাগল।
কিছু বলছে না। আমি তাকিয়ে আছি। ও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।
-- কী রে! কিছু বল।
--কী বলব?
-- মানে? তুইইতো আমাকে কীসব বলবি বলে ঘরে একা থাকতে বললি। এখন ন্যাকামি করছিস কেন?
ও তবু চুপ। অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু পরে খেলা শেষের ঘন্টা পড়বে। সবাই কলতলায় হাত-পা ধুয়ে ঘরে আসবে। জামাকাপড় বদলাবে, প্রেয়ারে যাওয়ার জন্যে তৈরি হবে। তো?
--ফালতু আমার বিকেলটা নষ্ট করলি। ঠিক আছে, তুই তোর ঘরে যা। আমি বইটা একটু পড়ে নিই। কাল ফেরত দেব।
-- না প্রদ্যুম্ন; এ কথাটা তোকে ছাড়া আর কাউকে বলতে পারব না। তাই আজ বলতেই হবে। জানতে চাস কেন হস্টেল ছাড়ছি? আমার মন ভেঙে গেছে। এখানে এই ছাদের নীচে আর একটা দিনও থাকতে চাই নে। দিদিকে সব বলেছি। দিদি বলেছে কোন রকমে দুটো মাস কাটিয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষাটা দিতে। তারপর দিদি আমাকে ছাড়িয়ে নেবে। আর হস্টেলে দেবে না। বাড়ির কাছে গর্মেন্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে।
--আরে আগে কী হয়েছে সেটা বলবি তো? কেন মন ভেঙে গেছে? তুইও শেষে কারও প্রেমে পড়লি নাকি?
-- ধেৎ! তুই বল সবচেয়ে বেশি আমি শ্রদ্ধা করতাম কাকে? ভালবাসতাম কাকে?
-- কানাইদাকে, আমাদের মেজ মহারাজকে।
--ঠিক; সেই শ্রদ্ধার জায়গাটা একেবারে--!
--আরে কাঁদছিস কেন? দাঁড়া , আর এক গেলাস জলে এনে দিচ্ছি। তারপর বল। আর তাড়াতাড়ি কর। অন্যেরা এসে পড়বে।
একটু ধাতস্থ হয়ে ও বলতে শুরু করল।
-- গত গরমের ছুটি। তোরা সবাই বাড়ি চলে গেছিস। হস্টেল খাঁ খাঁ করছে। আছি মাত্র তিনজন। দুজন ফ্রিতে পড়ে। এখানেই থাকে। বাকি ছিলাম আমি। দিদি অফিস থেকে ছুটি পায় নি। তাই রোববারের দুপুরে নিতে এল।ট্যাক্সিতে স্যুটকেস, বেডিং তোলা হয়ে গেছে। আমি প্রতিবারের মত দোতলায় উঠেছি কানাইদাকে যাবার আগে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব বলে। উঠে দেখি দরজা জানালা বন্ধ। দুটো ঘরেরই। ঘুমিয়ে পড়েছেন? কী করি? দেখা না করেই চলে যাব? তা কী করে হয়? এর পর তো একমাস গ্যাপ। শেষে একটা জানলার খড়খড়িতে একটু হালকা চাপ দিলাম। অল্প খুলল। আধো অন্ধকার ঘরে চোখটা সইয়ে নিতে কয়েক সেকন্ড লাগল। তারপর যা দেখলাম আমি---।
--কী দেখলি? শীগ্গির বল।
-- দেখি বিল্টুদি ওঁর বিছানাতে কেলিয়ে পড়ে আছেন। আর কানাইদা খালি গায়ে একটা আন্ডারওয়ার পরে এঘর থেকে ওঘর করছেন। তারপর উনি অন্য ঘরটা থেকে চুমুক দিয়ে শরবত মত কিছু খেয়ে এঘরে হড়বড় করে এলেন। আর বিল্টুদির দুপায়ের--।
--কী বলছিস কী? এরকম হতে পারে না।
-- অন্য কেউ বললে আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু নিজের চোখে দেখা। নিজেকে খুব জোরে চিমটি কাটলাম। সত্যি দেখছি?
তারপর নীচে এসে গাড়িতে বসলাম। সারারাস্তা একটাও কথা বললাম না। দিদি জানতে চাই কী হয়েছে। বাড়ি পৌঁছে কিছু খেলাম না। রাত্তিরে দিদি জোর করলে বলেছি। আজ তোকে বললাম। ছুটি থেকে ফিরে আর একদিনও ওঁকে প্রণাম করতে যাই নি। সামনেও যাই নি। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন, তবুও না।
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।
দরজায় ধাক্কা পড়ল। গুরুর গলা-- কী রে! আলো জ্বালাস নি! দরজায় ছিটকিনি ? কী কেস?
মলয়ের সেই গোপন কথা কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু জলবিছুটির মত জ্বালা ধরিয়ে দিল যে! এসব যদি সত্যি হয় তো মাস চারেক আগের ব্যাপার। এতবড় ঘটনা, কিন্তু কোথাও তো কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশও ভেঙে পড়েনি। ধরণী দ্বিধা হয় নি। সব আগের মতই চলছে। কাল সন্ধ্যেতেও বিল্টুদি কে দেখলাম। স্বাভাবিক ভাবভঙ্গী। কোথায় মলয়ের সেই বর্ণনা-- বিল্টুদি বিছানায় কেলিয়ে পড়ে আছেন! খাওয়ার আগে কানাইদার ঘরে গানের আওয়াজ শুনে গিয়ে জাজিমের এককোণে বসে পড়লাম।
তানপুরা ধরেছেন বিষ্ণুপুরের এক প্রৌঢ় খেয়ালিয়া। ওনার মুখ যেন সপাট তান করতে করতে একদিকে একটু বেঁকে গেছে।
কানাইদা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়মে সা-পা টিপে গান মালকোষে ধরেছেনঃ
" তারা মুজ্বল পশিল ধরা পর
সুন্দর হৃদয় প্রকাশি।
রত্নগর্ভা নারী রত্ন প্রসবিল--
হা- আ-আ-০০০০০০!"
আমাকে ইশারায় খঞ্জনী তুলে নিতে বলে হাতে তাল দেখিয়ে দিতে লাগলেন-- তিন তাল। অসুবিধে নেই। চৌতালের গানগুলোয় বড় মনোযোগ লাগে।
এর পর ভজন-- পগ ঘুংঘরুবন্দ মীরা নাচি রে! আবার মালকোষ এবং সেই তিনতাল। কিন্তু যেই ওই লাইনটা এল--জহর ক্যা প্যালা রাণাজী ভেজা পিবত মীরা হাঁসি রে!-- উনি এর মধ্যে একটু তানকর্তব করে নিলেন। খেয়ালিয়া ভদ্রলোক তানপুরা ছাড়তে ছাড়তে কেয়াবাৎ বলে উঠলেন।
খাওয়ার ঘন্টা পড়লে উঠে যাচ্ছিলাম। উনি ডেকে বললেন-- শোন ব্যাটা! প্রথম গানটা কার লেখা জানিস? স্বয়ং গিরিশ ঘোষের। বিবেকানন্দের উদ্দেশে। পরে আমার থেকে তুলে নিস।
খাওয়ার ঘরে যাচ্ছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে। না, এই লোক অমন হতে পারে না। হিসেব মিলছে না।
ঠিক করলাম কাল ভবদার সঙ্গে বিল্টুদির বাড়ি যাব, ওঁর সঙ্গে যাচ্ছি বললে গেট পাস হয়ে যাবে।
খেয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শার্লক হোমস খুলেছি কি গুরুর ডাক পড়ল। কথা আছে।
গিয়ে দেখি ভাল গ্যাঞ্জাম। আমাদের বন্ধুরা ছাড়াও উঁচুক্লাসের কয়েকজন রয়েছে।
এদের মধ্যে মিথিলেশদা, অসীমদা আর সেই বিখ্যাত স্বামী-স্ত্রী জোড়া রাজুদা-বিমানদাও রয়েছে। গুরু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-- যে কজন এসেছে তাই যথেষ্ট; অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। অসীম, বল কী বলতে চাস্?
--বলার কী আছে? তোরা দিন দিন ঢ্যামনা হয়ে যাচ্ছিস। খেয়াল আছে যে রাত্তিরে খাওয়ার পর যে ঘরে ঘরে দুধ দেওয়া হত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে?
-- ঠিক বন্ধ হয়ে যায় নি। হস্টেলের চাকরের পক্ষে আর ঘরে ঘরে গিয়ে 'কে দুধ খাবে' বলে সুর করে হাঁক দিয়ে বাটি বাটিতে দুধ ঢেলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
-- কেন?
--- পঞ্চা আর আপর্তি কে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই।
-- তাতে কী? নতুন লোক রেখে নিলেই হয়।
--- তাই তো বলছি, যখন লোক পাওয়া যাবে , তখন ফের শুরু হবে।
-- অমিয় , তোর চ্যালাটাকে চুপ করতে বল। ওরে পোদো, দুধ কী আমাদের দানছত্তর করে দেওয়া হয়? এর জন্যে আমাদের বাবা-কাকারা মাসে মাসে ছ'টাকা করে চার্জ দিচ্ছেন না? সে টাকা কোথায় যাচ্ছে
-- কোথায় যাচ্ছে মানে? দুধের জন্যে নেওয়া টাকা দুধ কিনতে যাচ্ছে।
-- অ! তা সেই দুধ কে খাচ্ছে?
-- আমরাই খাচ্ছিলাম, এখন কেউ না।। নতুন লোক লাগাতে পারলেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে।
-- তুই দেখছি মহাক্যালানে! শোন, না জেনে বকবক করিস না। ওই টাকা দিয়ে রাণীবাঁধে জমি কিনে বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
আমি তোতলাতে থাকি।
-- কী বলছেন? কার বাড়ি?
--কার আবার তোদের কানাইদার। স্বামী শান্তিময়ানন্দের।
আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়।
-- মুখ সামলে অসীমদা! কানাই মহারাজের ব্যাপারে ভাল ভাবে কথা বলবেন। সন্ন্যাসী মানুষ। উনি বাড়ি বানাতে যাবেন কার জন্যে?
মিথিলেশদা আমার গালে ঠাঁটিয়ে চড় মারে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। বন্ধুরা টেনে তোলে। আমাদের চোখ জ্বলে ওঠে। প্রশান্ত বলে-- পোদোকে মারলেন কেন?
-- সিনিয়রদের মুখ সামলে বলেছে! আস্পদ্দা কম নয়! নিজের মুখ সামলাক।
এবার গুরু অমিয়দা এসে মাঝখানে দাঁড়ায়।
--ব্যস্ ব্যস্! আর না। পোদো তো খালি জিগ্যেস করেছে সন্ন্যাসী মানুষ খামোখা বাড়ি বানাতে যাবেন কেন?
-- ও না জেনে বালের মত কথা বলছে! আমাদের কাছে খবর আছে যে কানাই মহারাজ শীগ্গিরই গেরুয়া ছেড়ে সংসার ধর্মে ফিরে যাবেন।
আমাদের বাক্যি হরে গেল। এ ও কী সম্ভব? একবার গেরুয়া ধরলে সেটা ছেড়ে আবার সংসারে ফেরা যায়?
অমিয়দা বলল--যায় , কিন্তু এ নিয়ে আর কথা না। বরং ভাবা শুরু কর--কোনটা ঠিক হবে? এই দুধ বন্ধ হওয়া নিয়ে গার্জেনদের কাছে কমপ্লেইন করব? না কি কানাই মহারাজের কাছে গিয়ে বলব -- দুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাদের ছেলেরা পালা করে দুধ দেওয়ার ডিউটি করবে। ঘরে ঘরে নয়, খাওয়ার পরে ডাইনিং হলে। যার দুধ খাওয়ার সে নিজে হলে এসে গেলাসে করে নিয়ে যাবে।
এই নিয়ে কথা শুরু হতে দেখা গেল অধিকাংশের মতে প্রথম অপশনটা বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। দ্বিতীয়টা বরং--।
এমন সময় দোতলা থেকে একটা পরিত্রাহি চিৎকার। আবার ! আবার! আবার! সেই হাড়হিম করা আওয়াজ মিলিয়ে যাবার আগেই ক্লাস এইটের সুজিত দৌড়তে দৌড়তে এল।
-- আপনারা প্লীজ শিগ্গির দোতলায় চলুন। ক্লাস নাইনের রমেন সিনিয়র বিমলদার বীচি টিপে ধরেছে, কেউ ছাড়াতে পারছে না। বিমলদা মরে যাবে।
দোতলায় ১১ নম্বর ঘরের সামনে বিমলদা শুয়ে আছে; যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ। কিন্তু মুখের রং কেমন একটা অস্বাভাবিক ধরণের নীল।
আর রমেন পাশেই মাটিতে বসে আছে; গুম হয়ে, কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না।
অন্যদের থেকে সারমর্ম যা বোঝা গেলঃ
আজকে ওই ঘরের টিউটোরিয়লে স্যার আসেন নি। ছেলেরা নিজেদের মধ্যে বইখুলে পড়াশুনো আড্ডা এইসব চালিয়ে যাচ্ছিল যথারীতি। নাইন সায়েন্সের জ্যোতির্ময় সন্ধ্যা মুখার্জির লেটেস্ট গান একটা চিরুনির সঙ্গে কাগজ জড়িয়ে বাঁশির মত আওয়াজ বের করে বাজাচ্ছিল।
এমন সময় বিমলদা এসে ঢোকে। কী হচ্ছে জিগ্যেস করে আড্ডায় বসে যায়। জ্যোতির্ময়কে খেপাতে থাকে। তারপর ভালমানুষ মত অমলকে বলে জ্যোতির প্যান্টটা টেনে খুলে দিতে! অমল রাজি না হলে ওকে মারবে বলে ভয় দেখায়। সবাই জানে বিমলদা কোন ক্লাবের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। ওর লেফট হুক খেলে নাকি লেফ্ট চোয়ালের সব কটা দাঁত পড়ে যায়। রনি বলে এক মাস্তানের নাকি ওই দশা হয়েছিল। আশ্রমে সবাই বিমলদাকে ভয় পায়। কেউ লাগতে যায় না।
অমল ভয়ে ভয়ে জ্যোতির প্যান্টে হাত দিতেই জ্যোতি সপাটে ওকে একটা চড় মারে। তখন বিমলদা গিয়ে ওর হাত দুটো টেনে ধরে রাখে আর অমলকে বলে--ওর প্যান্টটা খোল, কোন ভয় নেই।
রমেন উঠে দাঁড়ায়।
--বিমলদা, আপনি এখান থেকে যান। এক্ষুণি! নইলে আমি চেঁচাবো।
বিমলদা তেড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু খাবার ঘন্টা বেজে ওঠায় লফড়া কেঁচে গেল।
খাওয়াদাওয়া চুকলে বিমলদা আবার ওদের ঘরে এল। এসেই রমেনের কলার চেপে বারান্দায় নিয়ে এসে দেয়ালে ঠেসে ধরল।
--কী রে! তখন খুব রোয়াব দেখাচ্ছিলি। কী ভেবেছিস কি তুই! সিনিয়রদের ঘর থেকে গেট আউট বলিস। এত সাহস!
--- আপনি সিনিয়রদের মত থাকুন না! কেন জোর করে ওর প্যান্ট খোলাচ্ছিলেন?
--- তাতে তোর কী? আমার ব্যাপার আমি বুঝব; তুই কি ওর গার্জেন?
--- আমি ওর রুমমেট। এটা আমার ব্যাপার। যে নিজে থেকে আপনার কোলে এসে বসে তার সঙ্গে এসব করুন গে যান।
--- কার কথা বলছিস?
-- আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন।
ভীড় জমে গেছল। সবার সামনে রমেনের এমন ধারা কথায় বিমলদা হতভম্ব। কেউ কেউ মুচকে হাসছে। আর সহ্য হয়?
--শুয়োরের বাচ্চা!
--অ্যাই, বাপ-মা তুলবেন না বলছি; ভাল হবে না।
বিমলদার এক ঘুঁষিতে রমেনের মাথা পেছনের দেওয়ালে ঠুকে গেল। টেনশন বাড়ছে। কিন্তু এরপরে যা ঘটল সেটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি।
রমেন একবার মাথা ঝাঁকাল। তারপর বিমলদার বাঁহাতের পাঞ্চ মুখে লাগার আগে চট করে নীচু হল। সেটা গিয়ে লাগল সোজা দেয়ালে আর বিমলদা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। কিন্তু সেই কঁকিয়ে ওঠা একটা ওঁক্ আওয়াজে না থেমে লম্বা মীড়ের মত গড়িয়ে যেতে লাগল।
রমেন হাঁটু গেড়ে বসে বিমলদার অন্ডকোষ টিপে ধরে মুচড়ে দিচ্ছে।
দৌড়ে এসেছে অন্যান্যরা।
-ছাড় ছাড়্, বিমল মরে যাবে যে!
সেই রাত্রেই বিমলদাকে বাঁকুড়া মিউনিসিপ্যাল হসপিটালে ভর্তি করতে হল। ওর পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে গেছল। আর পরের দিন কানাই মহারাজ রমেনকে একমাসের জন্যে সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ওর অপরাধ -- সিনিয়র ছাত্র বিমলের গায়ে হাত তোলা, গুন্ডামি যা ফ্যাটাল কেস হতে পারত।
আমাদের কয়েকজনের গিয়ে অনুরোধ, এবং পুরো ঘটনাটা বলা কোন কাজেই এল না।