Next
Previous
1

গল্প - সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in






















রংপুরের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট। প্রতিবারের মতো সেবারও আয়োজন ছিলো বিশাল। তেত্রিশটা টিম আর অজস্র দর্শক। এক বাণ্ডিল বিড়ি নিয়ে খেলা দেখতে বসেছিলো কৌশিক। প্রথম দুটো ম্যাচের সময় বিরক্তিতে আধখাওয়া বিড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলছিলো বারবার, বারকয়েক উঠে পালিয়ে যেতে চাইলেও পিকু টেনে বসিয়েছিলো ওকে। তারপর চরদাসপুর স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে বীজনগর ইলেভেনের খেলা গড়াতেই নড়েচড়ে বসে কৌশিক। বীজনগরের ন’জন স্থানীয় ছেলের সাথে দু’জন নাইজেরিয়ান, বোঝাপড়ার অভাব চোখে পড়লেও, মাঝমাঠে খেলতে থাকা নাইজেরিয়ান যুবকের ডানপায়ের জাদু দেখে তাজ্জব বনে গেছিলো ও! জ্বলন্ত বিড়ি ঠোঁটেই রয়ে গেছিলো মিনিট দেড়েক! ৫-৩ ফলাফলের মধ্যে সেই নাইজেরিয়ানের নিজস্ব গোলই চারটে! খেলা শেষ হওয়ার পর বীজনগরের এক সমর্থকের কাছে জানা গেছিলো নাইজেরিয়ানের নাম “মাদুকা”।

পরের বছর “কেন্দুল মাইতি স্মৃতি শীল্ডে” দল নামানোর ভার পড়লো কৌশিকের কাঁধে। ক্লাবের মিটিং-এ সরাসরি জানিয়ে দিলো ও, “মাদুকা’কে খেলাতে হবে দলে। টুর্নামেন্টে যতদিন ক্লাবের টিম খেলবে ততদিন ক্লাবঘরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে ঐ নাইজেরিয়ানের। শর্ত মানলে তবেই ভার নোবো।” ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সুমনদা হাসিমুখে রাজী হয়ে গেলেন, তবে ঐ ক’দিন ক্লাবঘর দেখাশোনার দায়িত্বও দিলেন কৌশিক’কে।

খেলার আগেরদিন নেহাইচণ্ডী অ্যাথলেটিক ক্লাবের ঘরে এসে উঠলো এক দীর্ঘকায় কৃষ্ণাঙ্গ। পরনে রঙচটা টি-শার্ট আর জিন্স, চোখে-মুখে আফ্রিকা মহাদেশের শতাব্দী প্রাচীন আদিম প্রহেলিকা, মাথায় খুব সামান্য ছাঁটা চুল আর পিঠে একটা মান্ধাতার আমলের ব্যাগ। ক্লাবের ছেলেরা সন্ধ্যায় ক্যারাম পিটাতে এসে বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। কোনওমতে সব সামলে মাদুকা’কে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো কৌশিক। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে চললো কথাবার্তা। কৌশিক জানতে চাইলো নেহাইচণ্ডী আসতে কোনও সমস্যা হয়েছে কিনা। মাদুকা ঘাড় নাড়িয়ে জানালো, হয়নি। এরপর দু’জনে মিলে খেলার আলোচনা চললো বেশ কিছুক্ষণ, পরেরদিন মাঝমাঠেই খেলতে আগ্রহী বলে জানালো মাদুকা। রাতে খাবারের বন্দোবস্ত করে শোওয়ার জায়গা, বাথরুম, আলো সব দেখিয়ে দিলো কৌশিক, তারপর ক্লাবের অল্প দূরে নিজের বাড়িতে চলে গেলো। সকালে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ক্লাবঘরে এসে দ্যাখে, মাদুকা নাই! কিছু চুরি করে পালালো নাকি! বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো কৌশিকের! এদিক-ওদিক আরেকবার ঘুরে দেখতেই চোখে পড়লো বাথরুমের পিছনে ছোট্ট বাগানটাতে বসে ধ্যান করছে মাদুকা, আশ্চর্য! ডাকতেই, পদ্মাসনে বসা নিগ্রো চোখ খুলে হেসে ওঠে আলতো, আর পাশ থেকে একটা বই তুলে ধরে এক ধ্যানরত সাধুর ছবি দেখায়। স্বস্তির শ্বাস নেয় কৌশিক!

খেলা শুরু হতে চলেছে, মাঠে নেমে পড়েছে প্লেয়াররা। কিন্তু জার্সি আর স্পাইক পরে মাঠের বাইরেই বসে আছে মাদুকা। কেউ মাঠে নামাতে পারছে না ওকে। ক্লাবের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে এসে একটা বিড়ি ধরায় কৌশিক, ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলে, “কি ব্যাপার মাদুকা, খেলতে ইচ্ছা নাই?” মাদুকা হাত দিয়ে টাকার ইশারা করে। বুকপকেটে হাত চালিয়ে চারটে পাঁচশো টাকার নোট বার করে মাদুকা’র হাতে দেয় কৌশিক। আলো খেলে যায় কালো মুখে, মোজার ভেতর সেই নোট চারটে ঢুকিয়ে নিয়ে মাঠে পা রাখে আফ্রিকান তরুণ! কৌশিক বসে যায় আগ্রহের সাথে। সত্যিই, যতবার মাদুকা’র পায়ে বল যায়, কৌশিকের মনে হয় যেন সময় থমকে গেছে! এতবড়ো এক ম্যাজিশিয়ান মাত্র দু’হাজার টাকায় যা যা দেখায়, সত্যিই অবিশ্বাস্য! স্কিল আর পাওয়ারের আজব মেলবন্ধন! ড্রিবলিং থেকে শুরু করে রাবোনা, ইলাসটিকো থেকে ওকোচা ফ্লিক, বাইসাইকেল কিক, গতি বাড়ানো-কমানো থেকে নিখুঁত পাস বাড়ানো, অল্প জায়গা থেকে দূরপাল্লার নেওয়া শটে বারপোস্ট কাঁপিয়ে দেওয়া, কি পারে না মানুষটা! সবথেকে অবাক লাগে, এত কিছু করে ওঠে শ্বাস নেওয়ার মতো অত্যন্ত সহজ, সাবলীলভাবে! অনায়াস এক তরল জাদু! মাদুকা নিজেও হয়তো জানে না, ওর ডানপায়ের মধ্যে ঈশ্বর বসবাস করেন!

খেলা শেষ হতেই সুমনদা ডেকে পাঠান কৌশিক’কে। হাসি হাসি মুখে বলেন, “তোমার নাইজেরিয়ান তো ওয়ান-ম্যান আর্মি, কৌশিক! একাই শেষ করে দিলো ওদের! দারুণ দারুণ, দু’হাজার টাকা জলে যাচ্ছে না!’’ বেশ গর্ব অনুভব করে কৌশিক। বিগত আট-দশ বছরে এত ভালো টিম বানাতে পারেনি নেহাইচণ্ডী অ্যাথলেটিক ক্লাব। এবার মাদুকা’র পায়ে ভর দিয়ে অন্তত সেমিফাইনাল খেললেই অনেক!

সন্ধ্যেয় ক্লাবে গিয়ে মাদুকা’র খোঁজ নিতেই বিক্রম বলে, “পুকুরপাড়ের ওদিকে গেছে দেবা’র সাথে।” ক্লাবের উল্টোদিকে রাস্তা, রাস্তার ওপারে মুখার্জীদের বাড়ির পাশেই পুকুর। সেখানে পৌঁছাতেই অবাক হয়ে যায় কৌশিক। দেবা আর জনাচারেক ছেলের সাথে আলো-আঁধারিতে বসে আছে মাদুকা, হাতে কল্কে, মুখ থেকে ভুরভুর করে একরাশ ধোঁয়া বেরিয়ে চলে যাচ্ছে ওপরে! কৌশিক’কে দেখতে পেয়েই হেসে ওঠে দেবা, বলে, “আয় ভাই, আফ্রিকান অতিথিকে বাবা ভোলেনাথের প্রসাদ খাওয়ালাম একটু। কেমন লাগলো, হাউ ইউ ফীল?’’ মাদুকা ঘাড় নেড়ে তৃপ্তি জানায়। কৌশিক কিচ্ছু না বলে মাদুকা’র হাত ধরে ক্লাবের সামনের মাঠটাতে নিয়ে আসে, তারপর বলে, “দ্যাখো মাদুকা, তোমাকে কলকাতা থেকে নেহাইচণ্ডী নিয়ে এসেছি দায়িত্ব করে! ফুটবল খেলার জন্য! পুকুরপাড়ে বসে গাঁজা টানার জন্য নয়! এখানে থাকতে হলে আমার কথামতন চলতে হবে! নাহলে বলো, কালই তোমাকে কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি!” মাদুকা হাসে আলতো, ওর লাল চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আঁধারে, তারপর আপনমনেই অসংলগ্ন ইংরাজিতে বলতে শুরু করে, “নাইজেরিয়া থেকে ভারতে এসেছিলাম। পয়সা উপার্জনের জন্য। ফুটবল খেলতে নয়। ক্যাৎসিনা থেকে দিল্লী। উত্তমনগরে ফুটবল খেলার সময় আমার খেলা দেখে ভালো লাগে এক ভারতীয়’র। পরামর্শ দেয় ফুটবল খেলে রোজগার করতে। নিজের দেশে অনেক দারিদ্র্য। অনাহারে থাকতে হতো প্রায়ই। অপুষ্টি। রোগ। তার ওপর বোকো হারামের অত্যাচার! রাইফেল তুলে না নিলেই মৃত্যু! কোনওক্রমে পালিয়ে বেঁচেছিলাম! কিন্তু এখানেও সেই পরাধীনতা, কথামতন না চললেই...” কথাগুলো বলতে বলতেই বসে পড়ে মাদুকা! কৌশিক কিচ্ছু বলতে পারে না, বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ!

দ্বিতীয় ম্যাচ সপ্তশীর স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে। নেহাইচণ্ডীর পাশের গ্রামের ক্লাব। বছর পঞ্চাশ-ষাট ধরে শত্রুতা চলে আসছে দুই ক্লাবের মধ্যে। কৌশিকের দাদু, জ্যাঠার আমলের মাঠে নেহাইচণ্ডীর দাপট থাকলেও ইদানীং সপ্তশীর ক্লাবের বিরুদ্ধে জেতা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোও মুশকিল হয়ে ওঠে! খেলার পাশাপাশি চোরাগোপ্তা মারেও সিদ্ধহস্ত ওরা! তাই গ্রামের লোকেরা প্রথম ম্যাচের পর হাল ছেড়ে দিলেও, একজন কিন্তু স্বপ্ন দেখে যাচ্ছিলো! মাঠে নামার আগে মাদুকা’র মোজার ভেতর দু’হাজার টাকা ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে কৌশিক বলে, “তুমি কারও দাস নও, মাদুকা! তোমার ইচ্ছা না হলে আজ না-ও খেলতে পারো, কিন্তু সত্যি বলছি, বল পায়ে নিয়ে যখন তুমি অন্যদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাও, একমাত্র তখনই তোমাকে সবথেকে বেশি স্বাধীন মনে হয়!” মাদুকা অবাক হয়ে তাকায় কৌশিকের চোখের দিকে, তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে যায় মাঠের ভেতর। প্রথমে মাঠের চারপাশে জনাকয়েক নেহাইচণ্ডীর সমর্থক ছিলো, কিন্তু সময়ের সাথে খেলার ফল লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তেই নেহাইচণ্ডীর লোকে ভরে যায় চারপাশ। আর একেবারে শেষে রেফারির বাঁশি বাজতেই চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে সবাই গিয়ে কাঁধে তুলে নেয় মাদুকা’কে। মাদুকা’র চোখ খুঁজতে থাকে কৌশিক’কে, আর কৌশিক আঙুলের ফাঁকে একটা আধপোড়া বিড়ি নিয়ে বিভোর হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মাদুকা’র দিকে!

“খেলার ফলে সন্তুষ্ট তো?” সন্ধ্যেয় আমবাগানে বসে জানতে চায় মাদুকা। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে কৌশিক উত্তর দেয়, “কিছু কিছু সময় ফলাফল গুরুত্ব রাখে না, আজ তুমি যা খেলেছো সারাজীবন মনে রাখবো মাদুকা!” মাদুকা হাসে, বলে, “তাহলে মেয়ে নিয়ে এসো!” কৌশিক বুঝতে পারে না, জিজ্ঞাসা করে, “মেয়ে, তারমানে?” মাদুকা হাসিমুখেই বলে, “কোথাও এরকম ম্যাচ জিতিয়ে দিলে তারা মেয়ে এনে দেয়। ভারতীয় মেয়ে। সেক্স করার জন্য।” কিছুক্ষণ গভীরভাবে মাদুকা’র দিকে তাকিয়ে থাকে কৌশিক, তারপর জিজ্ঞাসা করে, “মাদুকা নামের অর্থ কি?” নিগ্রো তরুণ উদাস হয়ে পড়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সম্পদের থেকেও মানুষ অনেক দামী। মাদুকা। আমার আসল নাম মাদুকা নয়। আমার নাম ইফেচি, যার অর্থ ঈশ্বরের আলো। বাবা রেখেছিলো নাম। কিন্তু আমি তো কালো! ভালো কাজও কিছু করি না। তাই বদলে নিয়েছি নিজেই। মাদুকা নামটা ভারতীয়দের ভালো লাগবে। তাই রেখেছি।”

পরেরদিন সকালে ক্লাবঘরে ঢুকে কৌশিক যা দেখেছিলো তা ও কোনওদিন কোনও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে-ও দেখার কল্পনা করতে পারেনি! স্যান্ডো গেঞ্জি আর থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট পরা মাদুকা’র দীর্ঘকায় কালো শরীরটা ক্লাবঘরের ফ্যান টাঙানোর হুক থেকে ঝুলছে! ইলেকট্রিক তার গলায় জড়িয়ে, ঝুলে সুইসাইড করেছে! নিজের চোখেদের বিশ্বাস করতে পারে না কৌশিক, জ্ঞান হারায়! গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জ্ঞান ফিরতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে! “মাদুকা, মাদুকা, কেন সুইসাইড করলো ও?”

তিন-চারদিন পর পিকু এসে একটা ভাঁজ করা কাগজের চিরকুট দেয় কৌশিকের হাতে, বলে, “পুলিশ এসেছিলো ক্লাবে। ওর নাম মাদুকা নয়, ইফেচি। ইফেচি নাইজেরিয়া থেকে ভারতে এসে টাকার লোভে ড্রাগ পাচার চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো। পুলিশ আর বিপক্ষ ড্রাগ লর্ডদের হাত থেকে বাঁচতে দিল্লী ছেড়ে চলে এসেছিলো কলকাতা, নাম পাল্টে রেখেছিলো মাদুকা, ফুটবল খেলতো যাতে কেউ সন্দেহ না করে! কোকেনের নেশা ছিলো, কলকাতার বেশ্যাপল্লীতে যেত নিয়মিত, যৌনরোগও ছিলো বেশকিছু। গত ম্যাচের শেষে ইফেচি’র সন্দেহ হয় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কেউ যেন প্রতিনিয়ত সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে ওর ওপর। হ্যালিউসিনেশন হতো ওর, প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতো বিপক্ষ ড্রাগ সিন্ডিকেটের অসংখ্য লোক ঘিরে ফেলেছে ওকে, প্রত্যেকের হাতেই পিস্তল! সেদিন রাতেও হয়তো... তবে প্রায় আড়াইটা থেকে তিনটের মধ্যে ক্লাবঘরে সুইসাইড করে ইফেচি। তার আগে এই সুইসাইড নোটটা রেখে যায় যেটাকে পুলিশ কোনও গুরুত্বই দেয়নি!” মাথাটা ধরে আসে কৌশিকের। পিকুর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না ও। কিছুক্ষণ পর পিকু চলে গেলে আস্তে আস্তে কাগজের ভাঁজগুলো খোলে, দ্যাখে খুব তাড়াহুড়ো করে বিশ্রী হাতের লেখায় লিখে গেছে কেউ, “I AM FREE”। ছলছল করে ওঠা দুটো উদাস চোখের দৃষ্টি চলে যায় দূরের সবুজ মাঠটাতে যেখানে তখনও এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ ডানপায়ে বল নিয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে...