গল্প - নীলিমা চ্যাটার্জ্জী
Posted in গল্পসুমন, জয়মাল্য, শোভন আর দীপন— সেই স্কুললাইফ থেকে ওদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব…. স্কুলে সবাই ডাকতো ফোর মাস্কেটিয়ার্স বলে। স্কুল থেকে কলেজ… চার বন্ধু চারদিকে ছিটকে পড়লো। সুমন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলো, জয়মাল্য ডাক্তারিতে, শোভন অঙ্কে অনার্স আর দীপন সাইকোলজিতে। তবে বন্ধুত্বের কোনওই খামতি ছিলো না। মাঝেমাঝেই ফোন করে ওরা একটা পছন্দমতন জায়গায় জড়ো হতো, হৈ হৈ করে গল্প করতো, আশেপাশের লোকদের কেয়ার না করে উচ্চৈঃস্বরে টেবিল বাজিয়ে গান জুড়তো তারপর একরাশ খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি ফিরতো। বেশিরভাগ সময়ে তারা একত্র হতো সুমনদের দক্ষিণেশ্বরের পৈতৃক ভিটের তিনতলা বাড়িতে। একদম গঙ্গার গা ঘেঁষে চারিদিকে অনেকটা জায়গা জমি নিয়ে সুমনের প্রপিতামহের আমলের সুদৃশ্য বাড়ি। সুমনরা মাঝে মাঝে এসে থাকে, ঐ অনেকটা বাগানবাড়ির মতন আর কি! একজন কেয়ারটেকার রাখা আছে সারা বছরের জন্য।
চার বন্ধুরা একে একে সবাই বিয়ে করলো। সুমন বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রী অরুণাকে বিয়ে করলো। বাকি তিনজনেরই নিজেদের পছন্দ অর্থাৎ ভালোবেসে বিয়ে। ডাক্তার জয়মাল্যর বৌ-ও ডাক্তার, নাম সুনীপা, শোভনের বৌ তনিমা… সে স্কুল শিক্ষিকা, আর দীপনের বৌ শালিনী ইন্টিরিয়র ডেকরেটর, শালিনী অবাঙালি, তবে ঝরঝর বাংলা বলতে পারে, যদিও লিখতে পারে না।
ওরা আটজন মাঝেমাঝেই কোথাও গেট্টুর আয়োজন করে সবাই মিলে হৈ হৈ করে দিন কাটাতো। এর মধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেলো। সুমনের বৌ তখন পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাবা-মায়ের সাথে দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে এসেছিলো ছুটি কাটাতে। একদিন বাকি তিন বন্ধুও বৌ নিয়ে সবাই এল সারাদিন হৈ চৈ করে কাটাতে। ছাদের সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে অরুণা পা হড়কে পড়ে গেলো। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হলো। যমে-ডাক্তারে যুদ্ধ শুরু হলো! বাচ্চাটা যে শুধু নষ্ট হলো তাই নয়, শিরদাঁড়ায় এমন চোট লেগেছিলো যে অরুণার কোমরের নিচ থেকে একরকম প্রায় অসাড় হয়ে গেলো! কলকাতার বাড়িতে এনে বড়ো ডাক্তার দেখানো হলো… চিকিৎসা চলতে থাকলো।
সবাই প্রচণ্ড মর্মাহত হয়ে দিন কাটাতে লাগলো। তিন বন্ধু সুমনের পাশে পাশেই থাকলো। তবে ডাক্তার আশা ছাড়েনি, দামি ওষুধপত্র এবং নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি চলতে থাকলো। ডাক্তার জয়মাল্যও আশ্বাস দিলো যে অরুণা একসময় সুস্থ হয়ে যাবে।
দিন গড়িয়ে যায়, নতুন দিন আসে। অরুণা মানসিকভাবে এতই ভেঙ্গে পড়েছিলো যে সবসময় ভাবতো সে সংসারের তথা সুমনের জীবনে একটা বোঝা, তার বেঁচে থাকা অর্থহীন… সে মৃত্যুর কথা ভাবতে শুরু করলো। মাঝেমাঝেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ইচ্ছাটা সে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে প্রকাশ করে ফেলতো। সুমন তার জন্য মানসী নামে একজন ট্রেনড্ নার্স রেখে দিয়েছিলো… একদিন মানসীর হাত দুটো ধরে অরুণা কেঁদে বললো, দাও না আমায় একটা ইনজেকশন দিয়ে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে।
সেদিন রাতে অরুণার মানসিক অস্থিরতা এতটাই বাড়লো যে শুয়ে শুয়েই শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুমের ওষুধের পাতাটা পাশের টেবিল থেকে নিয়ে ফটাফট সবগুলো ওষুধ খেয়ে ফেললো। নার্স মানসী তখন পাশের খাবার ঘরে খাচ্ছিলো, সুমন একটু আগেই খেয়ে নিজের ঘরে গেছে, আর সুমনের মা-বাবাও তাঁদের নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
তখন রাত সোয়া ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা। খাওয়া শেষ করে মানসী ঘরে এসে দেখলো অরুণা ওপাশ ফিরে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। একটা ওষুধ খাওয়াতে হবে, মানসী ভাবলো আর একটু ঘুমাক, তারপর খাওয়াবো। সাড়ে দশটা নাগাদ অরুণাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো গা-হাত কেমন ঠান্ডা, নিঃশ্বাসও তো পড়ছে না, চাদর সরিয়ে হাতের মুঠোয় ঘুমের ওষুধের খালি পাতাটা পেলো। মুহূর্তে চিৎকার করে সুমনকে ডাকলো। কলকাতায় সুমনদের বাড়ির কাছেই জয়মাল্যদের বাড়ি। ডাক্তার বন্ধু এসে বললো, সব শেষ, অতগুলো ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়েছে… হার্টফেল করেছে। জয়মাল্য চোখের জলে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলো। সুমনের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো!
কালের গতি অব্যাহত! সুমনের বন্ধুরা শোকের সময় সুমনকে ঘিরে থাকলো… তারপর সময় তার চমকপ্রদ মলমের প্রলেপ লাগিয়ে সব ক্ষত নিরাময় করলো। সুমন আবারও বন্ধুদের সাথে আড্ডায় সামিল হতে লাগলো। বন্ধুরা চেষ্টা করতে লাগলো সুমনকে পুনর্বিবাহের জন্য রাজী করাতে। সুমনেরও ইচ্ছে আছে, বন্ধুরা বুঝলো।
বছর ঘুরে গেছে। সুমনদের দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে আবার বন্ধু ও বন্ধুপত্নীদের জমায়েত হয়েছে। কেউ ভুলেও অরুণার নাম আর মুখে আনছে না। কেয়ারটেকার রবিবাবুর অতিথি আপ্যায়নের অতুলনীয় আয়োজনে সবাই পরিতৃপ্ত হয়ে তিনতলার ছাদের ঘরটাতে উঠলো। তখন রাত দশটা বেজে গেছে। ছাদের ঘরটাকে চিলেকোঠা বলা যাবে না। এটা একটা বেশ বড়ো হলঘরের মতন। চারিদিকে বড়ো বড়ো কাচের জানলা। পুবদিকের জানলা দিয়ে তাকালে নিঃশব্দে প্রবহমানা গঙ্গাকে দেখা যাচ্ছে।
কৃষ্ণপক্ষ চলছে। লেটলতিফ চাঁদ কখন আসবেন তাঁর আকাশের রাজ্যপাট সামলাতে, কে জানে! গঙ্গায় ভাঁটা এখন, জলের সামান্য ছলাৎছল শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে মোহনীয় করে তুলেছে। ঘরের মধ্যে অনেক সোফা, গদিআঁটা চেয়ার, সাধারণ চেয়ার এদিক ওদিক রাখা আছে। ঘরের মাঝখানে একটা মেহগিনি কাঠের সুন্দর কাজ করা গোল টেবিল। সুমনের কাছ থেকে বন্ধুরা আগেই শুনেছিলো, এসব সুমনের প্রপিতামহের আমলের আসবাব, তিনি খুবই শৌখিন মানুষ ছিলেন।
সবাই এদিক ওদিক ঘুরে দেখছে। জয়মাল্য একশো পাওয়ারের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে একটা হালকা নীল বাতি জ্বালিয়ে বললো, আজ ওয়েদারটা দারুণ… চল আজ একটু ভূতের গপ্পো করি আমরা! সুমন হেসে বললো, তোদের আজগুবি গল্পগুলো শুনতে কিন্তু আমার মন্দ লাগে না। শোভন বলে উঠলো, আমাদের সুমন তো আবার ভূত বা আত্মা কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না। দীপন সিগারেটের শেষ সুখটানটা দিয়ে জানলা দিয়ে সেটাকে দূরের অন্ধকারে সজোরে নিক্ষেপ করে গম্ভীর গলায় বললো, তাহলে আজ এখানে আমরা প্ল্যানচেটের আসর বসাই। কোনও আত্মাকে ডেকে সুমনকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করাবই আজ… এটা আমার চ্যালেঞ্জ রইলো।
“চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্টেড” …ভূত-প্রেতে অবিশ্বাসী সুমন হাসতে হাসতে বললো। জয়মাল্য বলে উঠলো, তাহলে শুরু করা যাক। কাকে মানে কার আত্মাকে ডাকবো, আর মিডিয়ামই বা কে হবে?
দীপন বললো, আমার বৌ শালিনী মিডিয়াম হবে, ও খুব ভালো মিডিয়াম, আত্মারা চট করে ওর মধ্যে চলে আসে। আর আমরা ডাকবো… আমরা ডাকবো অরুণা বৌদিকে! দীপনের কথা শুনে সুমন যেন একটু চমকিয়ে উঠলো,
— সে কী অরুণাকে কেন?
— কেন কী হয়েছে? তোর অসুবিধা কোথায়? তোর কি ভয় করছে নাকি? তুই তো এসবে বিশ্বাসই করিস না… শোভন বলে উঠলো।
— সে তো করিই না! অরুণাকে ডাকলেই সে ড্যাং ড্যাং করে চলে আসবে প্রেত হয়ে, সে বিশ্বাস আমি একদমই করছি না। আচ্ছা, আমার বৌ যখন, তখন আমি মিডিয়াম হই না কেন! ঐ তো একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে, আর অরুণার আত্মা এলে লেখা পড়তে থাকবে কাগজে— এই তো?
দীপন বললো, বললামই তো সবাই মিডিয়াম হতে পারে না! তুই মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না তো! সুমন আর কিছু বললো না।
এরপর সবাই প্ল্যানচেটের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলো। গোল টেবিলটার চারধারে সাতটা চেয়ার পাতা হলো। সুমন ইঞ্জিনিয়ার, তার নিচের তলার পড়বার ঘর থেকে বড়ো সাদা ড্রয়িং শিট এনে সেটাকে সুন্দর গোল করে কেটে টেবিলের উপর পাতা হলো। একটা পেন্সিলও আনা হলো, আর কেয়ারটেকারের কাছ থেকে একটা বড়ো মোটাসোটা মোমবাতি নিয়ে এসে টেবিলের মাঝখানে বসানো হলো। শালিনী বললো, বাতাসে মোমবাতি নিভে যেতে পারে, সব জানলা বন্ধ করে দাও। সুমন ঠাট্টা করে বললো, তাহলে আত্মা আসবে কোথা দিয়ে? জয়মাল্যর বৌ সুনীপা বললো, ওসব নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করতে হয় না, সুমনদা!
ঘরের যে অল্প পাওয়ারের বাতিটা জ্বলছিলো, সেটাও নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালানো হলো। চেয়ারে গোল হয়ে সবাই বসলো। শালিনীর হাতে পেন্সিল, তার ডানপাশে শোভনের বৌ তনিমা, বাঁপাশে সুনীপা। তনিমা তার বাঁহাত দিয়ে আলতো করে শালিনীর পেন্সিল ধরা ডানহাতটা ছুঁয়ে আছে। তনিমার ডানদিকে একে একে বসেছে শোভন, দীপন, সুমন ও জয়মাল্য । তনিমা বললো, প্রশ্ন আমিই করবো, তবে তোমরাও ইচ্ছে হলে করতে পারো, তবে যে আসবে তাকে কেউ বিরক্ত করার চেষ্টা করবে না কিন্তু!
পুবদিকের আকাশে কেমন একটা ঘোলাটে চোখের লালচে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে সবে। জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল নিমগাছটা বাতাসে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছে, কিছু কি বারণ করছে গাছটা? রাতের পাখি ডানা ঝাপটিয়ে ত্রাসের খবর দিলো বুঝি! গঙ্গা মুখ কালো করে বয়ে চলেছে। দেওয়াল-ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করলো। ঘড়ির আওয়াজটা এমনই যে চারিদিকে একটা গা ছমছম করা পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
সবাই টেবিলের কাগজের উপর নিজেদের দু’হাত রাখলো উপুর করে, আঙুলগুলো ছড়িয়ে। প্রত্যেকের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নিজের অপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠকে ছুঁয়ে থাকলো আর কনিষ্ঠ অঙ্গুলী পাশের জনের কনিষ্ঠ আঙুলকে স্পর্শ করে থাকলো। এইভাবে সাতজন পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকলো। দীপন বললো, ভালোই হয়েছে, আমরা বিজোড় সংখ্যাই হলাম, প্ল্যানচেটে নাকি বিজোড় সংখ্যাই ভালো। শুনে সুমন নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যসূচক “ঘোঁত” আওয়াজ করে হাসলো। শোভন বললো, সবাই রেডি তো? এবার আমরা মনে মনে অরুণা বৌদিকে ডাকবো… শালিনী রেডি?
— একদম! শালিনী মৃদু গলায় উত্তর দিলো।
সবাই চোখ বন্ধ করে একমনে অরুণাকে ভাবতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, ঘরের মধ্যে যেন একটা বাতাসের শব্দ… শোঁ শোঁ করে একটা ঠান্ডা হাওয়া এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যাচ্ছে, অথচ ঘরের জানলা তো সব বন্ধ! হাওয়াটা যেন ঘরের ভিতর গোল হয়ে ঘুরছে টেবিলকে ঘিরে, প্রত্যেককে ছুঁয়ে যাচ্ছে নীরবে। সেই শীতল স্পর্শ সবাইকে সচকিত করলো, মনে হচ্ছে ঘরে যেন অষ্টমজনের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে… এক অশরীরী স্পর্শ… সবার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে যাচ্ছে! সবারই হাত-পা যেন কাঠের মতন শক্ত হয়ে গেছে, কেউ একবিন্দু নড়ছে না!
তনিমা এর আগেও শালিনীর সাথে একাধিকবার প্ল্যানচেটে বসেছে। সে আড়চোখে শালিনীর দিকে তাকালো… শালিনীর চোখ অর্ধনিমীলিত, ঘাড়টা বেঁকিয়ে মাথাটা সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে।
তনিমা মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, অরুণা তুমি কি এসেছো? শালিনীর মুখ থেকে কীরকম যেন গোঙানির আওয়াজ বার হলো, ঠিক যেমন অসুস্থ অরুণার মুখ থেকে বেরোতো। সুমন অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে। তনিমা একটু অপেক্ষা করে আবারও বললো, অরুণা বলো না, তুমি কি এসেছো? শালিনীর মুখ দিয়ে ফোঁপানোর আওয়াজ বার হলো। এবারে তার হাতের পেন্সিল চলতে আরম্ভ করলো! শালিনী বাংলা লিখতে জানে না, কিন্তু তার পেন্সিল সাদা কাগজে লিখলো, হ্যাঁ, এসেছি আমি!
— তুমি কেমন আছো অরুণা? মৃত্যুর পরের জীবন কেমন? কোথায় আছো?
— খুউব ক-ষ্ট আ-মা-র! আমার ভালো লাগে না কিছু। আমার চারিপাশে যেন অন্ধকারের সমুদ্র… দুঃখের অথৈ সাগর… ভেসে বেড়াচ্ছি কবে থেকে… পাড় নেই কোথাও… আমার ভী-ষ-ণ ক-ষ্ট... আমার একটা দেহ চাই… শালিনী কাঁদছে, তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, তার পেন্সিল খসখস করে লিখে চলেছে।
— অরুণা, প্লিজ শান্ত হও, এমন করলে আমরা সবাই কষ্ট পাবো!
— কী করে শান্ত হবো? আমার সব শান্তি কেড়ে নিয়েছে… ঐ যে উল্টোদিকে বসে আছে…
— কে?
— আমার বর সুমন!
উল্টোদিকে বসা সুমন লেখাটা পড়ে কেমন ছটফটিয়ে উঠলো। ফিসফিসিয়ে বললো, সব বুজরুকি, এসব বন্ধ কর। কিন্তু চেয়ার থেকে এক চুলও নড়তে পারলো না সে! তনিমা জিজ্ঞাসা করলো,
— কেন সুমন কী করেছে?
— আমাকে তো ওই শেষ করেছে! আমি নিজে ঘুমের ওষুধ খাইনি তো! গ্লাসের জলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে নার্স মানসীর হাত দিয়ে ও-ই তো পাঠিয়েছে!
— না না, সে কী সম্ভব?
— স-ব সম্ভব। আমি বিছানায় শোয়া, আর আমার বর আর মানসী প্রেম করতো, ওরা চাইতো আমি মরে যাই! তাই আমি যাকে এত ভালোবাসতাম সেই সুমনই আমাকে মেরে ফেললো… আমি ওকে আজ ছাড়বো না… কিছুতেই ছাড়বো না… শালিনী পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে!
— আচ্ছা অরুণা তুমি কি স্থির নিশ্চিত যে ওরা মানে সুমন আর মানসী পরস্পরকে ভালোবেসেছিলো?
— হ্যাঁ, পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি অনেকদিন ওদের ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছি!
— বেশ অরুণা, তুমি এখন ফিরে যাও, আমরা উচিত ব্যবস্থা নেবো সুমনদার বিরুদ্ধে…
— হা হা হা হা… শালিনী বিশ্রীভাবে হাসছে, তার চোখদুটো প্রতিহিংসার আগুনে ধিকিধিকি জ্বলছে। গরগর করতে করতে বললো, আমি আজ আমার হত্যার শোধ না নিয়ে যাব না…
হঠাৎ ঘরে যেন ঝড় উঠলো। একটা বাতাস রাগে গোঁ গোঁ করতে করতে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করতে লাগলো। মোমবাতিটা দুম করে নিভে গেলো। ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কারুর চেয়ার থেকে উঠে লাইট জ্বালানোর ক্ষমতা নেই, পা দু’টো সবার দুই মণ ভারী যেন, চেয়ারের সাথে যেন বাঁধা সবাই। হঠাৎ একটা চেয়ার সরানোর আওয়াজ… চেয়ার থেকে যেন কেউ পড়ে গেলো… তারপরই সুমনের আর্ত চিৎকার… বাবা রে, মা রে, আঃ মেরে ফেললো আমাকে…
কেউ উঠতে পারছে না চেয়ার থেকে, শুধু সুমনের আর্ত চিৎকার শুনছে… একটা ঝটাপটির আওয়াজ… যেন কেউ কারুর মাথা ঠুকে দিলো মেঝেতে… একটা হিংস্র হিসহিস শব্দ… ক্রুদ্ধ বাতাস ঘর তছনছ করে পাক খাচ্ছে সমানে! তারপর একসময় সুমনের গোঙানি বন্ধ হলো, উল্কার মতন বাতাসটা ঘুলঘুলি দিয়ে যেন বেরিয়ে চলে গেলো! শালিনী “মা গো” বলে একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে পড়ে থাকলো!
সম্বিত ফিরে পেতেই জয়মাল্য ছুটে গিয়ে একশো ওয়াটের বাতিটা জ্বাললো। ঘরের মধ্যে বীভৎস দৃশ্য দেখে সবাই স্তম্ভিত! সুমনের মুখটা যেন তীক্ষ্ণ নখরের সাহায্যে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে, গলায় ক্ষত চিহ্ন, জিভটা বেরিয়ে এসেছে, বোধ হয় কেউ শ্বাসরোধ করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে! দীপন অস্ফুটে বললো, সুমন এমন কাজ কী করে করলো… অরুণাবৌদি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে ফিরে গেছে! প্ল্যানচেটের এমন মর্মান্তিক পরিণাম হবে, চিন্তাই করিনি! এমন জানলে কি চ্যালেঞ্জ জানাই!
ওরা জীবনে কেউ আর কোনওদিন প্ল্যানচেট করেনি।