Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in




















বন্ধু শব্দটি অনেক ব্যাপক।বন্ধু আকাশ হয়ে থাকে আমাদের মাথার ওপর।ছায়া হয়ে তা যেন আমাদের ছায়া দিতে থাকে অনবরত। সেই বন্ধুতার আকাশকে প্রসারিত করার জন্য অনেক অনেক প্র‍য়াস আমাদের জীবন বহমান।আমরা একজন ভালো বন্ধুকে সবসময় পেতে চাই। কিন্তু সঠিক বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন।কেননা বন্ধু হচ্ছে সেই, যে আমার দুঃখে, বিষাদে, কষ্টে, আনন্দে, আহ্লাদে, মৃত্যু এবং জীবনের ছন্দে পাশে থাকবে।সঙ্গে থাকবে ,পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে,বুকে হাত বুলিয়ে দেবে, স্পর্শ করবে, নয়তো প্রলেপ দেয় আমাদের কথায়, আমাদের শোকে, বন্ধু সেই। বন্ধুর বিপ্রতীপে আছে শত্রু।তার ব্যাপারে আমরা উপসংহারে কথা বলব।শত্রুদের নিয়েও আমাদের জীবন-যাপনে অনেক তরঙ্গ ওঠে।শত্রুকে চিহ্নিত করা কর্তব্য এবং তাকে সতর্ক করাও কর্তব্য।আবার বন্ধু শত্রু হয়ে যায়।এমনও আছে যে ছিল পরম বন্ধু সেও পরম শত্রু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় মুখ দেখাদেখি। এবং তারফলে মনের ভেতর তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব নীল বেদনার তরঙ্গ।আমরা আমাদের এই কথাবার্তায় এই সাহিত্য যাত্রাপথে খানিকটা বন্ধুত্ব,খানিকটা শত্রুতা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি।

জীবনের চলার পথে আমরা অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হই কেউ আমাদের অনেক বহু কাছের বন্ধু হয়ে যায় আবার কেউ শত্রু। বাস্তব জীবনে চলতে হলে আপনি কখনোই একা চলতে পারবেন না। জীবনে চলার পথে আপনার বন্ধুর প্রয়োজন হবে। আর পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের অনেক বন্ধুই থাকে। কিন্তু সব বন্ধুই প্রকৃত হয় না। একজন বন্ধুকে চিনতে হলে আপনার অবশ্যই বিপদে পড়তে হবে। আপনি যদি বিপদে পড়েন তাহলেই বোঝা যাবে কে আপনার প্রকৃত বন্ধু আর কে প্রকৃত বন্ধু না। আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন প্রকৃত বন্ধু কখনই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে না। আর যে আপনার প্রকৃত বন্ধু নয় সে আপনার বিপদে দেখলেই ছেড়ে চলে যাবে।

মানুষের জীবনে বন্ধু অনেককেই থাকে কিন্তু সবাই 'প্রকৃত' হয় না। বিপদে পড়লে অনেক বন্ধু চেনা যায়। প্রকৃত বন্ধু হল এমন একজন যে আপনার হাত কখনই ছাড়বে না সেটা সুখ আর দুঃখ হোক না কেন। আর যারা আপনার বিপদ দেখে ছেড়ে চলে যাবে তারা বন্ধু ছিল না। আমাদের সমাজে প্রত্যেকটা মানুষেরই অনেক বন্ধু থাকে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কে ভালো, কে মন্দ, এটা কেউ বলতে পারবে না। একমাত্র বোঝার উপায় হচ্ছে যদি আপনি বিপদে পড়েন। কেননা বিপদে পড়লে প্রকৃত বন্ধু সঙ্গে থাকে কিন্তু যারা প্রকৃত না তারা কখনই আপনার পাশে থাকবে না। বিপদে পড়লে আপনারা বন্ধু পরিচয় পেয়ে যাবেন।

বন্ধুত্ব জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একটা সময়ের পর জীবনকে যেন আমরা বুঝতেই শিখি বন্ধুর হাত ধরে। কিন্তু বন্ধুর সব সংকটে, সব বিপদেই কি আমরা নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়াতে পারি? এমনও তো দেখা যায়, বন্ধুর বিপদে গা বাঁচানর জন্যই আমরা পীঠ দিই। নিজের দোষের কারণে বন্ধু যখন কোনো ঝামেলায় জড়ায়, তখন কি মনে হয় না খামাখা এই ঝামেলায় নিজে না জড়ানই ভালো।

খুবই নির্ভর আর স্বাধীন এ সম্পর্কে সেভাবে ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটি উচ্চকিত না থাকলেও, ‘বন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তাদের কথাই মনে হয়, যারা ভালো ও খারাপ সময়ে শর্তহীনভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে এ কথাও ঠিক, বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না, ঠিক কীভাবে তাকে সাহায্য করব। চাকরিচ্যুতি, সম্পর্কে সমস্যা বা বিচ্ছেদ, অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে আইনগত জটিলতা, মামলা, অর্থসংক্রান্ত সমস্যায় ফেঁসে যাওয়া ইত্যাদি নানা জটিলতায় কিন্তু যে কেউ পড়তে পারে।

যেকোনো ধরনের সমস্যা বা বিপদে পড়াই এক ধরনের মানসিক চাপ। এই চাপ কিছুটা হলেও কমান যায় কারও কাছে মনের কথা নির্দ্বিধায় খুলে বললে। কাজেই বন্ধুকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপই হবে তার সমস্যার কথা বলতে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে তার কথা শোনা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কোনো ব্যক্তি কিছু শোনার মতো অবস্থায় থাকে না বলে এই সময় কোনো ধরনের মন্তব্য বা বিষয়টার বিশ্লেষণ না করাই ভালো।

বিপদের সময়ে তার দৈনন্দিন কাজে আপনার সামর্থ অনুযায়ী যতটা পারেন সাহায্য করুন। গুজবে কান না দিয়ে বা অন্যের কাছ থেকে না শুনে, সরাসরি বন্ধুকে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। তার অবস্থান থেকে তাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন।

সবকিছু শোনার পর আগে নিজের কাছে পরিষ্কার হোন নৈতিক দিক থেকে বন্ধুর কাজটি সমর্থন না করলেও আপনি তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন কিনা। তার কাজের ফলাফলে ভবিষ্যতে যে ঝামেলা বা বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটার আঁচ আপনি বন্ধুর জন্য নিতে প্রস্তুত কিনা। সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিলে আপনার বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে দিন। আপনি এই বিপদে তার পাশে আছেন, এটা জানানর সঙ্গে সঙ্গে তার এই কাজটির (?) ব্যাপারে আপনার নৈতিক অবস্থান কী তা-ও পরিষ্কারভাবে জানান। কোনোভাবেই বিষয়টা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে, এই বিষয়ে আপনার মতামত এবং অপারগতা স্পষ্ট করে তাঁকে বলুন।

মুখে বলুন, আচরণে প্রকাশ করুন। তার সঙ্গে বেশি করে দেখা করুন, ফোনে তার খোঁজ নিন। বিপদের সময় বা যেকোনো খারাপ সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ছোট লাগে বা মনে হয় এ অবস্থা থেকে যেন মুক্তি নেই। এই খারাপ সময়টা যে একসময় আর থাকবে না, সে ব্যাপারে তাকে মুখে বলুন ও আশ্বস্ত করুন। আপনার এই আশ্বাস আর পাশে থাকা এ ধরনের ঘোরপ্যাচ থেকে অবস্থা মোকাবিলা করতে বড় ধরনের শক্তি ও সাহস জোগাবে।

যেকোনো বিপদে আমাদের মন নানা ধরনের যৌক্তিক-অযৌক্তিক আবেগ, যেমন রাগ, কষ্ট, ঘৃণা, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদিতে আপ্লুত থাকে। এসব আবেগের ঠিক-বেঠিক বিচার না করে তার মন থেকে এসব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তাকে কাঁদতে দিন, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিমান তার মতো করে প্রকাশ করতে দিন।

কোনো ঘটনা শুনলে প্রথমেই আমরা ঠিক-বেঠিক বা নৈতিক-অনৈতিকতার বিচারে লেগে যাই। নানা রকম উপদেশমূলক কথা বলি, যা আসলে এক ধরনের বিরক্তি ঘটায়।

কাজেই এই সময় অহেতুক উপদেশ দেওয়া বা অতিরিক্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা থেকে আপাতত নিজেকে বিরত রাখুন। বরং তার অবস্থানে গিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে জানতে চান আপনি কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন।

মনে রাখবেন, বন্ধুর পাশে দাঁড়ান মানে এই নয় যে, নীতিগতভাবে না মানলেও তার যেকোনো বিষয়ের সঙ্গে আপনাকে থাকতেই হবে। সাহায্য মানে এই নয় যে কারও বিরুদ্ধে বন্ধুর সঙ্গে প্রতিহিংসায় আপনি যোগ দেবেন। আপনি বন্ধুর জন্য ততটুকুই করবেন, যতটুকু আপনার মন সায় দেবে।

জীবনের নানা জটিলতার জট খুলতে, তার ভার লাঘব করতে সব সম্পর্ককে পেছনে ফেলে আমরা প্রথমেই ছুটে যাই বন্ধুর কাছেই। বলা হয়, বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যার প্রয়োজন আর গুরুত্ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে মূলত যেকোনো সংকটে। খুব বেশি আপনার নীতির বিরুদ্ধে না হলে বন্ধুর সেই সংকটে আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনারও হয়ত কোনো একসময় কোনো এক বন্ধুর হাতের প্রয়োজন হতে পারে।

এই প্রসঙ্গে এইটি লোককথার অবতারণা করছি।

কোনো এক কালে মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে এক গৃহস্থ ছিল।ঐ গৃহস্থের বসতভিটের খালের পাশে এক বাঁশঝাড় ছিল। সেই বাঁশঝাড়টির গোড়ার মাটি খালের স্রোতে ধুয়ে নিয়ে যায়।তাই গেরস্থ বাঁশঝাড়টিকে রক্ষার জন্য খাল থেকে মাটি তুলে ভরাট করে দেয়।তার মনে প্রত্যাশা বাঁশঝাড়টির গোড়া শক্ত হলে বংশ বিস্তার করবে অর্থাৎ কড়ুল ছাড়বে।

বর্ষার সময়কাল।অবিরাম বর্ষণে বাঁশঝাড়ের গোড়ায় দেয়াল মাটির দেওয়ালগুলো গলতে শুরু কিরে।বাঁচার আশায় মাটির দলা - এভাবেই গলে গলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভাগ্যলিপি।মাথা উঁচু করে দাঁড়ানর উপায় নেই।

মাটির দলার কথিত বেদনার মতো বাঁশঝাড়ের বুড়ো পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ে যেতে থাকল।বাতাসের তীব্র গতিতে উড়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে যায়।কোথাও পুকুরের জলে,আবার কোথাও খালের জলে ছিটকে পড়ে পচে গলে হারিয়ে যায়। আর কখনও ব্যতিক্রমী কিছু পাতা বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ঝরে পড়ে যায় তাদের ভাবনা আবার ভিন্ন।ঐগুলো ভাবে, হায়,আমাদের স্বজনদের মতো বাতাসের আক্রমণে খালে- বিলে পড়ে যেতাম তবে তাদের মতো হারিয়ে যেতাম।আর বাঁশপাতা বলে কোনো অস্তিত্বই থাকত না। সত্যিই এভাবে পচেগলে যাওয়াই আমাদের বিধিলিপি।দুর্বল বলেই কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই?

এই কথাগুলো নীরবে আউড়ে বুকভাঙ্গা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। এ ধরনের এলোমেলো চিন্তাভাবনার মুহুর্তে কোথা থেকে প্রবল ঘূর্ণি ঝড়ো বাতাস শোঁ শোঁ করে ধেয়ে ছুটে এল।বাঁশগাছের গোড়ার পাতাগুলো দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক উড়ে যেতে লাগল।তখন এক বাঁশপাতা মাটির শক্ত দলার পাশে এসে উড়ে পড়ল।

তার করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলার মন করুণায় ভরে গেল।তারপর মাটির সেই পিণ্ড বলল- ওহে বন্ধু! ভয় কর না কিসের চিন্তা মনে তোমার? আমি শক্তপোক্ত হয়ে তোমার পাশে আছি এই ঘূর্ণিহাওয়া আমার গায়ে লাগে না। তুমি নির্ভয়ে আমার দেহতলে আশ্রয় নাও।বাতাস তোমাকে কাবু করতে পারবে না।

বাঁশপাতাটি এলোমেলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে নীরবে মাটির দলার নীচে আশ্রয় নিল।বাতাসের গতি তার ধারেকাছেও যায় নি এবারের মতো সে বেঁচে গেল।ঘূর্ণি হাওয়া থেমে পর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাটির দলাকে বলে,বন্ধু তোমার স্নেহচ্ছায়ায় আমি রক্ষা পেলাম।নতুবা কোথায় হারিয়ে যেতাম বলা মুস্কিল।তোমার এই উপকার জন্ম-জন্মান্তরে ভুলতে পারব না।

এভাবে কিছুক্ষন অন্তরঙ্গ আলাপের মাঝে তারা দু'জন মজে গেল।তখন আবার হঠাৎ আকাশ গর্জন উঠল।চারদিকে দৈত্যের মতো কালো মেঘে ছেয়ে গেল।এদিক-ওদিক বাদলা মেঘের আনাগোনা। মুহুর্তেই অঝোরে বৃষ্টি নামল।বাঁশপাতা বন্ধু মাটির দলার উপকারের কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞ চিত্তে কথা বলা নেই,নিজেই তার ওপরে ছাতার মতো মেলে রইল।বৃষ্টির জল তার গায়ে ছিটেফোঁটা লাগেনি।বৃষ্টি থামার পর মাটির দলা বন্ধুকে জড়িয়ে বলে, বন্ধু এই তো প্রকৃত বন্ধু এভাবেই চিরকাল আমরা একে-অপরকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে বাঁচতে হবে।

বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানর অঙ্গীকারে দুই বন্ধু আবদ্ধ হল দুই বন্ধু আবার হাসিতে মশগুল হয়ে দিন কাটাতে লাগল।

এমনিভাবে চলার মাঝে আচমকা একদিন ঝোড়ো হাওয়া বৃষ্টি আছড়ে পড়ল।চারদিকে ঝড়-বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ করতে লাগল।দুই বন্ধু দিশেহারা হয়ে উঠল।খাল-বিল-নদী-নালা জলের তীব্র স্রোতে ভাসতে লাগল।তখন বাঁশপাতা আর নিজেকে রক্ষে করতে পারল না, জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে বাঁচার আশা ভঙ্গ হয়ে করুণ সুরে বন্ধু মাটির দলাকে বলে ওঠে, বন্ধু! আমার আর রক্ষে নেই।আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।

বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলা অশ্রুভরা কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে, বন্ধু! আমিও তোমার পথের পথিক।

ঠিক কিছুক্ষণ পরে অঝোর বৃষ্টির জল তার গায়ে তীব্র আঘাত করতে শুরু করল।ধীরে ধীরে মাটির দলা গলে গলে জলের স্রোতে মিশে গেল।এভাবেই দুই বন্ধু- বাঁশপাতা ও মাটির দলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

মানুষ মানুষেরই শত্রু হয়। এই মানুষের ভেতরে যে শত্রুতা জন্ম হয়, তা চিহ্নিত করাটা খুুবই কঠিন। পৃথিবীতে ‘কে- শত্রু’ আর ‘কে- মিত্র’ তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যায় না। কেবলই প্রয়োজনের সময় কিংবা বিপদের মুহূর্তেই সত্যিকারের শত্রু-মিত্র চেনা যায়।

গৌতমবুদ্ধ একটা কথা বলেছেন,- জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।

খুব গোপন শত্রু প্রকৃত বন্ধু বা কাছের ও দূরবর্তী মানুষের নিকটেই যেন একটা মুখোশে চিত্র। বিদ্রূপ যাকেই করা হোক না কেন তা অবশ্যই নেতিবাচক। এসমাজের ব্যক্তিত্ববান কোনও মানুষকে যদি ঠাট্টা-মশকরা করে অপমান করা হয়, তা হলে সমাজে তিনি যা দিতে পারতেন তা থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে। সুতরাং এতে সমাজের যে ক্ষতি হয় তাকে সচেতন নাগরিকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শত্রুরাই নিজ ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই যেন কৌশলে মিত্রকে ঘায়েল করে শত্রুতার পথ বেছে নেয়। তাদের কাছে এই কঠিন কাজ সহজভাবেই করতে যেন বাধে না। মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে বা ক্ষতি সাধন করে, এ ব্যক্তিরাও মানুষ মানুষের শত্রু হয়।

এবার আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো শত্রু। শত্রু শব্দটা’কে বাংলা প্রতিশব্দের মাধ্যমে নানা ভাবেই যেন মানুষ চিনে থাকে। যেমন বৈরী, অরি, দ্বিষৎ, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। শত্রুতা করা, শত্রু ভাবাপন্ন ব্যক্তিরা কখনও সমাজের বৃহৎ কর্মকান্ডে থাকতে পারে না। অবশ্য তাদের কখনও না কখনও পতন ঘটেছে। তাই সাক্ষী ইতিহাসের পাতায় আছে। অনেক শাসকের পতন ঘটেছে তাদের নিকট বন্ধু রূপেই লুকিয়ে থাকা শত্রুতার কারণে।

ধন-সম্পদ, প্রাসাদ বা রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের কথা তো হরহামেশাই মানুষের মুখে শোনা যায়। এ ধরনের শত্রুরা নিজ ইচ্ছা বা ক্ষমতাসীনদের দ্বারাই নিয়োজিত এজেন্ট এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতে নিজসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তির ফায়দা হাসিল করার জন্যই গোপনে ও প্রকাশ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকে। তাই, মানুষের কল্যাণে এরা কমই আসে, চতুরতা বা কৌশল খাটিয়েই যেন শত্রুতা করে। সুতরাং প্রয়োজনের সময়ে কেবল সত্যিকার মানুষের কেমন পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার গভীর মনে সেটা উপলব্ধি করলেই জানা যায়।

সুতরাং এরা সমাজ এবং দলের নীতিনির্ধারকদের অতি আপন জন হয়ে খুব সহজে গুপ্তচর বৃত্তির কাজেই লিপ্ত থাকে। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও অনেক সময় এ সব শত্রুর কারণেই সমাজ বা দল নিজস্ব সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে পারে না। এই মানুষরা সর্বক্ষণ অপরের খুঁত ধরতে থাকে। তাদের কাছে অন্যদের চিন্তা-ভাবনা, রুচি-পছন্দ, কাজ, পোশাক-আশাক, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মতো অনেকে অপছন্দ করে। এক কথায় সব কিছুই তাদের চোখেও খারাপ লাগে। পরশ্রীকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকেরা গোপন শত্রুতা পোষণ করে থাকে। ওদের থেকে অনেক দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। তাদের কর্ম ও আচার-আচরণে দৃষ্টি দিলে অনেকাংশে পরিষ্কার হয়। তবে 'গভীর জলের মাছ' ধরতে হলে গভীরে নামতে হবে। তাদের কথা বার্তা ,আচরণ এবং গতিবিধির মধ্যে সর্বপ্রথমেই চলে আসে টাকা বিষয়ক ব্যাপার। কৌশলে টাকা নিতে পারলেই লেনদেন চুকিয়ে দেওয়াটাই তাদের কু-চরিত্রে বিরাজ করে।

বাঙালি আবেগপ্রবণ, আর এমন আবেগপ্রবণতাই যেন তাদের আত্মত্যাগের জন্যেই উদ্বুদ্ধ করে। ভালোবাসাতে যেমন আপ্লুত হতে পারে এ-জাতি, তেমনই- নিষ্ঠুরতা বা শত্রুতার চরম রূপও দেখাতে পারে। অদ্ভুত এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে মানুষের মধ্যে। চরিত্রের এ বৈপরীতধর্মীতা দৃশ্যমান হয় কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্যেই তা অকপটে বলা যায়।

সুতরাং, খুব ভালো মানুষ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আর প্রতিটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুন্দর ভাষা বা শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের প্রভাব অনস্বীকার্য। যদি ধর্মের যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করি- তাহলে বলা যেতেই পারে, শত্রুর সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলা। পাশাপাশি , ‘মানুষের উচিত শত্রুর নোংরা কথার জবাব খুবই সুন্দর কথায় দিয়ে দেওয়া।’ তুমি অসৎ কাজকে সেই 'নেকি'- পূণ্য দ্বারাই নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তা হলেই দেখা যাবে যে,- আপনার সাথে শত্রুতা যাঁর ছিল তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও গেছে।’’ শত্রুতা নয়- আপোস করতেই হয়, সেটাই তো জ্ঞানীদের সঠিক কাজ। সফলতার অর্জনের পাথেয়- বলা যেতেই পারে। ‘ভালোবাসা’ দিয়েই হবে জয়, আর শত্রুতা দিয়েই হবে পরাক্ষয়।

পৃথিবীতে মানুষ একা বাস করতে পারে না। মিলেমিশেই বসবাসের পাশাপাশি তারা যার যার ধর্ম পালন করে। এই বসবাসের সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্কের বাইরেও অনেক মানুষের সঙ্গে মানুষের নানারকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মধুর ও পবিত্র সম্পর্ক বলা যায় ‘বন্ধুত্ব’। কারণ মানুষ তার বন্ধুর কাছে সুখ-দুঃখের বিভিন্ন কথা অকপটে ব্যক্ত করে। মানুষ তার বন্ধুর বিপদে- আপদেই সবার আগে এগিয়ে আসে এবং বিপদে-আপদে আশার বাণী শোনায়, তারাই তো- সুখ-দু:খের মুহূর্তগুলো ভাগা ভাগি করে উপভোগ করে।

জ্ঞান ও সভ্যতার ‘বাহ্যিক উন্নতি’ যদি আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহন করে, তার পরও সে সমাজকে মানবীয় পূর্ণতায় সমৃদ্ধ সমাজ বলা যাবে না। যে সমাজের লোকজন একে- অপরের কাছে অনিরাপদ বোধ করে কিংবা একে-অপরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ ও পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে না বরং ভেতরে ভেতরে শত্রুতা এবং ক্ষতি কামনা করে, ষড়যন্ত্র করে, অপরের ধন-সম্পদের প্রতি ‘লোভ-লালসা’ লালন করে, সেই সমাজে কোনো রকম শান্তি বা স্বস্তির অস্তিত্ব নেই।

বিপদের বন্ধুই প্রকৃত ‘বন্ধু’। আর যে ‘বন্ধু’ বন্ধুর বিপদের সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে বন্ধুরূপী শত্রু। তাই বন্ধু নির্বাচনে সদা সতর্ক থাকতেই হবে। প্রচলিত সর্বজনীন মূল্যবোধ, আইন এবং অধিকার-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড যখন সংঘটিত হয় তখনই মানুষের প্রতি মানুষের শত্রুতা এবং অবিচার সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র ন্যায়নীতির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই সর্বস্তরের শত্রুতাকে দমন করে 'শান্তি প্রতিষ্ঠা' করা সম্ভব। অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে হয়, যেখানে ন্যায়নীতি আছে সেখানেই শান্তি আছে। আবার যেখানে ন্যায়বিচার নেই কিংবা আদর্শবোধ বা সহনশীলতা নেই, সেখানে কখনও শান্তি বিরাজ করতে পারে না। নিজ ঘর থেকে শুরু করে গোষ্ঠী এবং জাতি সকল ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।

সর্বশেষে বলতে চাই যে, ‘আমার হাতে কোনো পাথর নেই, আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমি কারও সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করি না, কেননা আমি গোলাপ বাগানের মতই সুমিষ্ট’। । আবার ‘‘শত্রুরা শত্রুতা করতে কৌশলে ব্যর্থ হলে তারপর বন্ধুত্বের সুরত ধরে”। সুতরাং মানুষের এই চরিত্রের পরিবর্তন করানটা খুবই কঠিন। তবুও- বুদ্ধির জোরেই শত্রুকে জয় করা প্রয়োজন। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও একমত পোষণ করে বলা যায়,- “আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই শান্তি চান,.. আপনাকে আপনার শত্রুদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে, তাহলেই তিনি আপনার সহকর্মী হতে পারবেন। তবুও একটি কথা বলতেই চাই যে, হত্যা, সন্ত্রাস, নাশকতা বা গুজবের মতো শত্রুতা না করে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গল পথে সততা দিয়েই নিজেকে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সুতরাং শত্রুতার ওপরেই দাঁড়ান মানুষদের মনোবল কিংবা নিযেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া নিচু মনের পরিচয়।

আমরা বন্ধুর কথা শুনলাম,আমরা শত্রুর কথা শুনলাম।এর ভাইরেও বন্ধুত্ব থাকে,দুশমনি থাকে। আর বন্ধুতা বা বন্ধুত্ব আছে বলেই আমরা শত্রুতা বুঝতে পারি।কারণ কালো না থাকলে সাদা বা আলো বোঝা যায় না।রাত্রি না থাকলে অনুভব করা যায় না দিন।আমরা বন্ধুত্বের ময়ূরপঙখী নাও বাইতে বাইতে পৌঁছে গেলাম কোনো স্বপ্নের দেশে।
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” কিন্তু, আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, এক ধরণের গোল রুটি যা মূলত উত্তর ভারতে ‘চাপাটি’ নামে পরিচিত তা আতঙ্ক ধরিয়ে প্রায় ঝলসে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনেক ব্রিটিশ অফিসারদের এ দেশকে শাসন করার আশা। আসলে, ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া অনেক অন্দোলনের কথাই কালের সমুদ্রে আজ হারিয়ে গেছে। আর সেই আন্দোলন যদি হয় রহস্যময়, তাহলে? তাহলে, তো কোনও কথাই নেই। রহস্যময় আন্দোলনই প্রায় অমীমাংসীত অবস্থায় স্থান পায় ইতিহাসের কালের গভীরে।

আমাদের ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ঘটনাই ইতিহাসে লিপিলব্ধ হলেও, সেগুলো সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। যদিও আমরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিখেছি, শিখে চলেছি এবং ভবিষ্যতেও শিখব। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই আমাদের শিক্ষাদান করে চলে যখন তা সংগঠিত হয়েছিল তখনকার তার সামাজিক প্রভাব ও বিস্তারও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও সেগুলো আমাদের শিহরণ জোগায়, বিস্মিত করে তোলে। এরকমই এক রহস্যময়, প্রায় অজানা আন্দোলনের নাম ‘চাপাটি আন্দোলন’, যে আন্দোলনের অস্ত্র কোনও বন্দুক, রাইফেল বা তলোয়ার কোনও কিছুই ছিল না, ছিল একটি গোল রুটি। যে রুটি হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থাপ্পড় মেরে বানানো হয়। তাই, এর আকার চ্যাপ্টা। এর চ্যাপ্টা আকারের জন্য আর থাপ্পড় দিয়ে বানানোর জন্য এর নাম ‘চাপাটি’। ‘চাপাটি’ শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ‘চপত’ থেকে যার অর্থ ‘চ্যাপ্টা’। আবার এর অপর অর্থ হল ‘চড়’। এই চাপাটি ভারতীয়দের বিশেষ করে উত্তর ভারতীয়দের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় খাদ্য। এমনকি, ১৬ শতকে আবুল ফজলেরর লেখা আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে, সম্রাট আকবরের পছন্দের খাবারের তালিকাতে ছিল এই চাপাটি। আর, সেই চাপাটি নিয়েই একটা আন্দোলন ঘটে গিয়েছিল ১৮৫৭ সালে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সেপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগেই।

কোনও সংগঠিত ঐতিহাসিক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসবিদদের অনেক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু, চাপাটি আন্দোলনের প্রামাণ্য হিসেবে রয়েছে একটি চিঠি আর কিছু লেখা। সেইসব কিছু নিয়েই রোমমন্থন করা যাক রহস্যময় চাপাটি আন্দোলনকে।

এই আন্দোলনের কথা প্রথমবার উল্লেখ করেছিলেন ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র সামরিক সার্জন ডক্টর গিলবার্ট হেডো। তিনি ব্রিটেনে অবস্থিত তাঁর বোনকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, “There is a most mysterious affair going on throughout the whole of India at present. No one seems to know the meaning of it. It is not known where it originated, by whom or for what purpose, whether it is supposed to be connected to any religious ceremony or whether it has to do with some secret society. The Indian papers are full of surmises as to what it means. It is called the chapati movement.” বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “বর্তমানে গোটা ভারত জুড়ে এক রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলছে। কেউ এর অর্থ জানে বলে মনে হয় না। এটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কার দ্বারা বা কি উদ্দেশ্যে, এর সাথে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা বা কোন গোপন সমাজের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে কি না তা জানা যায়নি। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এর অর্থ কী তা নিয়ে অনুমানে পূর্ণ। একে চাপাটি আন্দোলন বলে।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই চিঠিতে 'চাপাটি আন্দোলন'-এর কথা উল্লেখ ছিল আর যার ফলেএই চিঠিই ভারতবর্ষের ইতিহাসে 'চাপাটি আন্দোলনের' একমাত্র প্রমাণ হিসেবে গণ্য। আর এই চিঠি থেকে এটা স্পষ্ট যে চাপাটি আন্দোলন কোনও ছোটখাটো ঘটনা ছিল না বরং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অনেক ব্রিটিশ অফিসারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই চাপাটি আন্দোলন।

আসলে ঘটনাটি এইরকম। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনও এক সকাল। মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল অফিসে এসে হঠাৎ দেখেন যে তাঁর টেবিলে রয়েছে এক টুকরো রুটি। বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ রুটি এখানে কে আনল আর কেনই বা আনল? অনুসন্ধান করে থ্রনহিল সাহেব জানতে পারেন যে, রুটিটি এনেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যিনি সেটা পেয়েছেন একজন গ্রামের চৌকিদারের কাছ থেকে। সেই চৌকিদার রুটি কোথা থেকে পেয়েছিল? জানা যায় যে, জঙ্গল থেকে কেউ একজন প্রহরীদের হাতে রুটি তুলে দিচ্ছিলেন আর তার সাথে এটাও বলে দিচ্ছিলেন যে আরও চারটে রুটি বানিয়ে যেন সকলকে বিতরণ করা হয়। আবার, সেই চারজনকেও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় তারাও যেন প্রত্যেকে আরও চারটে করে রুটি বানিয়ে বিতরণ করে। অর্থাৎ, এর ফলে জ্যামিতিক অগ্রগতিতে বাড়বে রুটির সংখ্যা। অপর মতে একদিন মার্ক থ্রনহিল সাহেব বাড়ি থেকে থানায় এসে নিজের টেবিলে দেখেন যে, রুটি বা চাপাটি ভর্তি একটি বস্তা পড়ে আছে। তিনি অবাক হয়ে এই বিষয়ে একজন ভারতীয় সেনার কাছে জানতে চাইলেন। সেই সেনা জানান যে, রাতে হয়তো এই বস্তা কেউ রেখে দিয়েছে। মার্ক অবাক হয়ে বলেছিলেন যে, “এই বস্তা ভর্তি চাপাটি কে দেবে?” কয়েকদিন পর খবর এল যে মাথুরার আশেপাশের প্রতিটি গ্রাম ও চৌকিতে এই ধরণের চাপাটির বস্তা পাওয়া যাচ্ছে।

মার্ক থ্রনহিল সাহেব ক্ষান্ত হলেন না। তিনি আরও তদন্ত ও অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে, রুটির ক্রমাগত বিতরণ চলছে উত্তর ভারত এমনকি উত্তরে নেপালের সীমানা থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকা পর্যন্ত। এই রুটির বিতরণ চলছে প্রায় কয়েকশো মাইল পর্যন্ত বলা যায় দুই থেকে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত। তিনি এই রুটির বিতরণের তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তকালে তিনি ভারতীয় সৈন্যদের থেকে কোনও সাহায্য বা সুবিধা পেলেন না। কেননা, সৈন্যরা ও পুলিশেরা নিজেরাই চাপাটি তৈরি এবং বিতরণে সাহায্য করছিলেন। শুধু সাহায্যই নয়, মনে করা হয় যে, ৯০ হাজার কি তারও বেশি ভারতীয় পুলিশ একত্রিত হয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চাপাটির বস্তা বিতরণ করতেন। তাই, এভাবেই মথুরার ম্যাজিস্ট্রেটের নাকের ডগা থেকেই চাপাটি বিতরণ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি গ্রামে। ব্রিটিশ অফিসারেরা কড়া প্রমাণ ছাড়াই তদন্ত করে জানতে পারেন যে, এক রাতের মধ্যে এক গ্রাম থেকে তৈরি চাপাটি দীর্ঘ ৩০০ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করে অন্য এক গ্রামে পৌঁছায়! এই বিতরণের ব্যবস্থা তো ব্রিটিশ মেইল ব্যবস্থার থেকেও দ্রুত! নেটিভদের এই অজ্ঞাত কৌশলে মাথাব্যথা ধরে যায় ব্রিটিশ অফিসারদের। মজার ব্যাপার হল এই যে, যারা বিতরণ করত তারা অনেকেই জানত না ব্যাপারটা কী হচ্ছে। গ্রামে একজন অচেনা মানুষ আসতেন এবং চাপাটির একটি বস্তা রেখে দিয়ে চলে যেতেন। যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের বলে দিতেন যে তারা যেন আরও বেশি করে রুটি তৈরি করে অন্য গ্রামে যেন পৌঁছে দেয়। কেন পৌঁছে দিতে হবে তা কেউ বুঝত না। গ্রামবাসীরা তাদের নিজেদের জমির গম থেকে আটা পিষে চাপাটি তৈরি করত আর তা বিতরণ করত। ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও কোনও সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অনেক গুজব ও জল্পনা ছিল চাপাটি ঘিরে। অনেকের মতে এই যে, চাপাটির মাধ্যমে গোপন কোনও বার্তা পাঠানো হচ্ছে। হয়তো ইংরেজ সরকারের বা কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোনও গোপন আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে। এরকম আরও কত কি! কিন্তু এসবের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি, থ্রনহিল সাহেব তাঁর অফিসে চাপাটি খুব গভীরভাবে পরীক্ষা করেও অস্বাভাবিক কিছু পেলেন না। চাপাটিগুলো স্বাভাবিক আকারেরই ছিল। তাতে না ছিল কোনও বার্তা, না ছিল কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন।

ধীরে ধীরে শত শত চাপাটি বিতরণের খবর প্রচার হয়ে গেল ভারতের উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কলকাতা, মধ্য ভারত, গুজরাট সহ নানান জায়গায়। কিন্তু, এই চাপাটি বিতরণের রহস্যময় আন্দোলনের যে কি উদ্দেশ্য তা কেউই বুঝতে পারছিল না। আবার এদিকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আগামীদিনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠল। আর তাই অনেকেরই প্রিয় খাদ্য, এই নিরীহ চাপাটি রুটির অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলা বিতরণের ফলে তাদের ঘুম উড়ে যায়। এদিকে, রুটি বিতরণ তো আইনত অবৈধ কিছু নয়। এই রুটির মধ্যে তো কোনও বার্তা নেই। তাই, রুটির বিতরণকে ব্রিটিশ অফিসাররা গুরুতরভাবে সন্দেহ করলেও একে আইনত প্রতিরোধ করতে পারছিলেন না। তাই, চাপাটি রুটি বহনকারীদের কাউকে গ্রেফতার বা কারুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতেও তাঁরা পারছিলেন না।
এই আন্দোলন সম্পর্কে যতই গুজব বা জল্পনা প্রচলিত থাকুক না কেন, অনেকেই মনে করেন যে, সেই সময় মধ্য ভারতে কলেরা রোগ দেখা দিয়েছিল। তাই, সেই রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে চাপাটি রুটির বিতরণ করা শুরু হয়েছিল। যদিও এই যুক্তি বা কারণের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাই, ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে তো বটেই এমনকি ভারতীয় ইতিহাসবিদদের থেকে শুরু করে আমজনতার কাছেও 'চাপাটি আন্দোলন' ব্রিটিশদের কাছে চিরকালই এক ‘রহস্যময় আন্দোলন’ হিসেবে রয়ে গেছে।
3

প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী

Posted in








দিব্যি সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চায়ের কাপ আর কাগজটা নিয়ে বসেছি, আচমকা কোত্থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে কাগজটাগজ উড়িয়ে দিয়ে, কাপ থেকে চা চলকে ফেলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে দিল। কোনক্রমে নিজেকে সামলে সম্মুখপানে ঠাওর করে দেখি, বাগানে একটা ইয়াব্বড় উড়ন্ত চাকতি নেবেছে! আর তার ভেতর থেকে বড় বড় জানলার মত চোখওয়ালা, ঢ্যাঙা লম্বা, বিকটদর্শন এক জোড়া জানোয়ার বেরিয়ে আমার দিকেই থপ্ থপ্ করে এগিয়ে আসছে। আমি তো দেখেই থরহরিকম্প! জন্তু দুটো ক্রমশঃ আমার কাছ অবধি এসে কি একটা ইশারা করে বলল, "হিজিবিজিবিজিহিজি!" অমনি আমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভিরমি খেয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলাম।

জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, কোথাও কিচ্ছু নেই। চেয়ার, কাগজ, চায়ের কাপ সব যে যার মতই আছে, আমিই শুধু বোকার মত মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি। মনে কেমন একটা সন্দেহ হল। ধড়ফড় করে উঠে এক ছুটে বসার ঘরের আলমারি থেকে স্টিফেন হকিংয়ের একটা বই ধুলো ঝেড়ে তুলে নিলাম। অনেক বছর আগে রাজীব বলে আমার এক শ্যালক বইটা আমায় উপহার দিয়েছিল। ব্যাটা বড্ড জ্ঞান বিজ্ঞান আওড়াত; ভেবেছিল এইসব বই পড়িয়ে আমাকেও দলে টানবে। আমিও কম নই। বইটাকে সেই যে শো-পিস্ বানিয়ে তাকে তুলে রেখেছি, এই এতো বছরে ধুলোটা পর্যন্ত ঝাড়ি নি। আজকে ওই ঘটনার পর কেন জানিনা এই বইটার কথাই সবার আগে মনে হল। দেখি তো হকিং সাহেব এই বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে পারেন কিনা! ইটি বলে সত্যি কিছু হয় কি? বইটার নাম: Brief Answers to the Big Questions। দেখলাম বইটাতে দশখানা পরিচ্ছেদ আছে। ঈশ্বর আছেন কিনা, কি করে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল, ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি আছে, সময়ভ্রমণ সম্ভব কিনা, এই সব বিষয় নিয়ে এক একটা অধ্যায়। ধুত্তোর এতো কে পড়ে? লাফ দিয়ে চলে গেলাম তৃতীয় পরিচ্ছেদে যেখানে হকিং আলোচনা করেছেন অন্য গ্রহে বুদ্ধিমান জীব থাকার সম্ভাবনা নিয়ে। তাতে যা পড়লাম তা মোটের উপর এইরকম:

প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি তা নির্ভর করে কার্বন পরমাণুর ওপর। অথচ এই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াটি মোটেই সোজা ছিল না। ১৩৮০ কোটি বছর আগে যখন বিগ-ব্যাঙের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয় তখন অকল্পনীয় উষ্ণতার কারণে মহাবিশ্বে কোন মৌল উপাদান সৃষ্টি হয়নি। তখন ছিল শুধু প্রোটন এবং নিউট্রনের একটা স্যুপ। এরপরে ব্রহ্মাণ্ড একটু ঠাণ্ডা হলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম সৃষ্টি হল। এই দুটি উপাদান থেকেই প্রথম নক্ষত্রের সৃষ্টি হল। এবং এই দুটি উপাদানকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়েই প্রথম কার্বন, অক্সিজেন এবং লৌহ পরমাণুর সৃষ্টি হল ওই নক্ষত্রগুলিতে। হিসেবের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হত না, আর তাই প্রাণও সৃষ্টি হতে পারত না। যাই হোক, প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলি কিছু সময় পরে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেই মৌলগুলিকে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিল এবং সেই উপদানগুলি থেকেই ক্রমশঃ নতুন নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে থাকলো। আমাদের সূর্যের এবং সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলির সৃষ্টি হল বেশ কিছুটা পরে, বিগ-ব্যাঙের প্রায় সাড়ে ন'শো কোটি বছর পরে। কিন্তু গ্রহের সৃষ্টি হলেই ত হল না, প্রাণ সৃষ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশও তো দরকার। পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন পরিবেশ এত বেশি উত্তপ্ত ছিল যে জীবন্ত কোষিকা তৈরি হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। ধীরে ধীরে পৃথিবী শীতল হলে কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু কোন এক অজানা প্রক্রিয়ায় এমন এক ধরনের যৌগের সৃষ্টি করলো যারা নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম ছিল। এদের বলা হয় RNA । এই সরলাকৃতির RNA থেকে আবার কাকতালীয়ভাবে উৎপন্ন হল জটিলতর গঠনের DNA, জীবনের মূল উপাদান। DNA অণুগুলো ভাঙাগড়া, পুনর্বিন্যাস এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে নানা রকমের এককোষী প্রাণীর সৃজন করলো। অনেক পরে এই এককোষী প্রাণী থেকেই বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিই ঘটেছে একের পর এক চান্স বা সমাপতনের মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন এই রকম কাকতালীয়ভাবে পর পর ঠিক ঠিক পরিস্থতি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাব্যতা খুবই কম তাই পৃথিবীতে আদিম প্রাণ নিশ্চয়ই অন্য কোন গ্রহ কিংবা গ্রহাণু থেকে এসেছিল। হকিং অবশ্য তাঁদের যুক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, মহাবিশ্বের ভয়ংকর বিকিরণের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকাল টিকে থেকে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাওয়া DNA র পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, তাই প্রাণ নিশ্চয়ই পৃথিবীতেই সৃষ্টি। কোনভাবে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গিয়ে পৃথিবীতেই জীবনের সৃজন হয়ে থাকবে। কিন্তু সেই একই রকমের পর পর সমাপতন অন্য গ্রহে ঘটা খুবই অস্বাভাবিক।

এই বিষয়ে, হকিং দু'টি আশ্চর্য যুক্তি উত্থাপন করেছেন: উনি মনে করেন, যদি নিম্নস্তরের এককোষী বা বহুকোষী জীবন সৃষ্টির কথা ছেড়েও দেওয়া হয়, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভব কিন্তু আরো বেশি আশ্চর্য একটা ব্যাপার। সূর্যের মতো কোন নক্ষত্রের সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে সময়টা মোটামুটি ১০০০ কোটি বছর ধরা হয়। এই সময়কাল পৃথিবীর মত কোন গ্রহে উন্নত বুদ্ধির জীব সৃষ্টি হওয়া এবং সেই সৌরমণ্ডল ধ্বংসের আগে সেই বুদ্ধিমান জীবের অন্য কোন বাসযোগ্য নক্ষত্রলোকে বসতি স্থাপন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পৃথিবীতে এককোষী প্রাণী সৃষ্টি হয় সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে, অর্থাৎ সৌরমণ্ডল সৃষ্টি হওয়ার মাত্র পঞ্চাশ কোটি বছর পর। যদি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি আপনা আপনি হঠাৎ করে না হয়ে থাকে তাহলে উপলব্ধ সময়ের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যেই এককোষী প্রাণ উদ্ভূত কেন হলো? এদিকে কিন্তু এক কোষ থেকে বহুকোষী জীব সৃষ্টি হতে সময় লেগে গেল আরো প্রায় ২৫০ কোটি বছর। যেই একবার বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টি হয়ে গেলো অমনি আবার আকস্মিকভাবে জীব সৃষ্টির পক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর রকম ত্বরান্বিত হয়ে গেলো। কিছু লক্ষ বছরেই অগুন্তি রকমের প্রাণীতে পৃথিবী ছেয়ে গেলো। মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি হতে লাগলো আরো মাত্র ১০ কোটি বছর — মহাজাগতিক সময়ের হিসেবে যা এক পলকের সমান। প্রশ্ন হল — যদিবা এককোষী জীব কোনক্রমে সৃষ্টি হল, বহুকোষী জীব আসতে এতখানি সময় কেন লাগলো? তাও যদি এলো তাহলে মানুষের মত এত জটিল জীব মোটে ১০ কোটি বছরের মধ্যে কি করে এসে গেলো? এসব সঙ্গতিহীন ব্যাপারস্যাপার দেখে হকিং সাহেব বিধান দিলেন: পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টি পূর্বনির্ধারিত কোন ঘটনা নয় বরং আচমকা ঘটে যাওয়া একটা কাকতালীয় ব্যাপার। যেহেতু বুদ্ধিমান জীবের উদ্ভব আরো কঠিন তাই অন্য কোন গ্রহে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণী থাকলেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকার আশা ক্ষীণ। এখানেই শেষ নয়, হকিংয়ের দ্বিতীয় যুক্তিটিকে বলা চলে দাবার মোক্ষম চাল। ওঁর মতে, যে কোন গ্রহকেই যে উৎপাত থেকে থেকে সহ্য করতে হয় তা হল asteroid বা গ্রহাণুদের হানা। পৃথিবীও এর ব্যতিক্রম নয়। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এরকমই এক গ্রহাণুর সংঘাতে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল ডায়নোসর সহ অসংখ্য প্রাণী। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এইরকম একটা মহাবিধ্বংসী গ্রহাণু হানা অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রে গড়ে দুই কোটি বছরে একবার ঘটে। তার মানে, পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমরা উদ্বৃত্ত সময়ে বেঁচে আছি, যেটা একটা লাকি চান্স মাত্র। কিন্তু অন্য গ্রহের ক্ষেত্রেও যে এই চান্স কাজ করবে এমন কোন কথা নেই। অন্য কোন গ্রহ উচ্চ মেধার ইটি তৈরি করার মত সময় নাও পেয়ে থাকতে পারে। এই অবধি বলে থেমে গেলে বেশ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। কিন্তু শেষে হকিং সাহেব কেন যে দুধে একটু চোনা রেখে দিলেন বুঝলাম না। এতো কিছু বলেও পরিচ্ছেদের ঠিক শেষে উনি বলে বসলেন, "আমার আশা করি যে অন্য গ্রহে মানুষের মতোই উচ্চ সভ্যতার প্রাণী আছে। শুধু তারা এখনও পর্যন্ত আমাদের খুঁজে পায়নি এই যা।" আচ্ছা, এইভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে হয়? মনের অস্বস্তিটা যেতে যেতেও গেলো না। সকালে যা দেখলাম, সেটা হ্যালুসিনেশনই ছিল তো? নাকি সত্যি তেনারা এসেছিলেন? গুটি গুটি পায়ে আবার বারান্দায় ফিরে গিয়ে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলাম। বেশ ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে মনের মধ্যে নানা কথা চলতে লাগলো। হকিং শেষে ওরকম কেন বললেন? উনি কি কোন ইঙ্গিত দিলেন? ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, রাজীব একবার বলেছিল ফার্মি প্যারাডক্সের কথা। বিখ্যাত পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নাকি বলেছিলেন, মহাবিশ্বে কোটি কোটি নক্ষত্র আছে, তাদের আবার কত কত পৃথিবীর মত গ্রহ আছে। যদি সেইসব গ্রহের মধ্যে সামান্য সংখ্যক গ্রহেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকত তাহলে এতদিনে তারা আমাদের নিশ্চয় খুঁজে নিত। কথাটা হকিং সাহেবের ভয় ধরানো বাক্যগুলোর ঠিক উল্টো। যাক, অকারণেই ভয় পাচ্ছিলাম তাহলে। ইটি ফিটি বলে নিশ্চয়ই কিছু হয় না। মনে মনে বলছি বটে কিন্তু তেমন জোর পাচ্ছিনা, মনটা সেই খুঁতখুঁত করেই চলেছে। এতো বড় বড় সব বিজ্ঞানী, এঁরা কি আর ভুল বলবেন? কি জানি, হতেও তো পারে যে আমরা যেমন আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহে এখনও পৌঁছতে পারিনি, ইটিরাও তেমনি তাদের সৌরমণ্ডল কিংবা নীহারিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি! আবার এমনও হতে পারে যে এতো বড় ব্রহ্মাণ্ডের কোন দিক থেকে তারা শুরু করবে তাই নিয়ে খেউখেই করে কোনো দিকেই আর তারা এগোতে পারেনি। আরে বাবা, ইটি হলেও, মানুষ তো!

"বাবু, আরেক কাপ চা দেব?" হঠাৎ বিশ্রী খ্যানেখ্যানে গলায় হাবুলের ডাকে আঁতকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে মিটিমিটি হাসছে। দেখে গা-পিত্তি একেবারে জ্বলে গেল, "চা দিবি তো দে না! খামোখা ওরম চেঁচানোর কি আছে!" সে বেচারা থতমত খেয়ে চা বানাতে ছুটলো। আসলে, সকালের ওই ঘটনার পর মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে। দ্বিতীয় রাউন্ড চা খেয়ে পায়ে জুতোটা গলিয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম। একটু হাওয়া খাওয়া যাক। শরতের সকালে পাড়াগাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে, পুকুরের পাশ ঘেঁষে, আকন্দের ঝোপে ফুলের হাসি দেখতে দেখতে মনটা ভাল হয়ে গেল। হেরোম্ব ডাক্তারের পরিত্যক্ত বাড়িটা পার করে ভটচাজ্জি পাড়ার দিকে পা বাড়াতেই দেখি আকাশে এক ঝাঁক নীলকন্ঠ পাখি, শরতের নরম আলোয় তাদের ডানাগুলো ঝিকমিক করছে। ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, "বর্ষার পর নীল আকাশে তুলোমেঘ আর নীলকন্ঠ পাখি একসাথে দেখা গেলেই বুঝবি দুগ্গা পুজোর আর দেরি নেই।" চেয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, প্রকৃতির সব কিছুই কেমন ঘড়ি ধরে নিয়ম করা। সবই যেন খোপে খোপে বসানো । নিয়মের সামান্য হেরফের হলেই পৃথিবীটা আর এইরকম হতে পারতো না। এই কথাটা যেই ভেবেছি, মনের মধ্যে যেন একটা আলোর ঝিলিক দিয়ে গেলো। তাই তো! এই সহজ কথাটা এতক্ষণ মাথায় কেন আসেনি! এই চেনা পৃথিবীতে এবং পুরো ব্রহ্মাণ্ডেই একটা প্যাটার্ন আছে। এই প্যাটার্নগুলোকেই আমরা বিজ্ঞানের সূত্র বলি। মানুষ ছাড়া প্রকৃতির সেই ভাষা কেউ পড়তে পারে না। মানুষ হিসেব কষে, ফর্মুলা বাঁধে, পরে মিলিয়ে দেখে অবাক হয় — সত্যিই তো বিশ্ব সেই ফর্মুলায় চলছে! ঠিক যেমন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র। মানুষ প্রকৃতির মনের কথা পড়তে শিখেছে তার বুদ্ধির জোরে, তার মস্তিষ্কের কারণে। তার মস্তিষ্ক সে পেয়েছে বহুযুগের বিবর্তনের ফলে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক এবং সামাজিক অবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তার একটা বোধ তৈরি হয়েছে। আজকের বিজ্ঞান অবধি পৌঁছতে মানুষকে অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ইতিহাসের বিশেষ কিছু ঘটনা না ঘটলে বিজ্ঞান আজকের এই অবস্থায় পৌঁছত না। মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ষষ্ঠীক সংখ্যাপদ্ধতি আবিষ্কার না করলে আমরা ঘড়ি পেতাম না। ঠিক সময়ে নিউটনের মাথায় আপেলগাছ থেকে আপেলটা না পড়লে আমরা মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব পেতাম না। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মহাবিশ্বের সব জায়গাতেই একই। অন্য কোন গ্রহে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে হয় এবং তাদের যদি চিন্তাশক্তির সাহায্যে প্রকৃতির সেই প্যাটার্নকে বুঝতে হয় তাহলে তাদেরও আমাদেরই মত একটা মস্তিষ্ক থাকতে হবে যা তাদের মাধ্যাকর্ষণ বা রিলেভিটির মত তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। সেই মস্তিষ্ককে আমাদের মত করেই অঙ্ক বুঝতে হবে। তাদেরও একটা ভাষাপদ্ধতি থাকতে হবে যা মাধ্যাকর্ষণের মত থিওরিগুলোকে ব্যাখ্যা করবে। আমরা জানি পৃথিবীতে মানুষেরই একমাত্র উন্নত ভাষা আছে এবং সেই কারণে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন অন্যান্য বানরপ্রজাতির জন্তুর তুলনায় একটু হলেও আলাদা। বিবর্তনের আশ্চর্য ম্যাজিকে মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভাষার শক্তি আয়ত্ত করেছিল। ভাষা বলতে এবং বুঝতে যদি হয় তাহলে ভিনগ্রহী ইটিদেরও মস্তিষ্কের গঠনশৈলী আমাদের মতই হতে হবে — একই রকমের স্নায়ুতন্ত্র, বিশ্বকে অনুভব করার মতো ইন্দ্রিয় ইত্যাদি। আমাদের মস্তিষ্ক যে পরিবেশ এবং বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই অবস্থায় পৌঁছেছে ঠিক একই রকমের পরিবেশ এবং বিবর্তন ওই গ্রহেও হতে হবে। শুধু তাই নয়, যদি এই তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে হয় তাহলে ভিনগ্রহীদের একটা পূর্বপ্রস্তুতি লাগবে অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞানচেতনা থাকতে হবে। বিজ্ঞানচেতনার জন্য একটা সমাজব্যবস্থা থাকতে হবে যার ইতিহাস আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে তুলনীয় হতে হবে। ঠিক ঠিক লোককে ঠিক ঠিক সময়ে জন্ম নিতে হবে। যে অবস্থার কারণে পৃথিবীর মেধাবী মনীষীদের মধ্যে জিজ্ঞাসা জন্মেছিল এবং যেসব অবস্থার কারণে তাঁরা সেই জিজ্ঞাসার সমাধান করতে পেরেছিলেন, জীবন এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে সেই ভিনগ্রহীদেরও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি এবং বোধ থাকতে হবে। মোট কথা পৃথিবীর পরিবেশ এবং ইতিহাসের প্রায় পুনরাবৃত্তি না হলে ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকা অসম্ভব। একটা দু'টো ক্ষেত্রে কাকতালীয়ভাবে পুনরাবৃত্তি সম্ভব হলেও, সব ব্যাপারটা খাপে খাপে মিলে যাওয়াটা অলৌকিক বলেই মনে হয়। ইটি তাই একটি কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আসলে সহজ সত্যিটা আমরা সহজেই ভুলে যাই। ভুলে যাই যে আমাদের পৃথিবীটা অনন্য, অদ্বিতীয়। বিরাট অতলান্ত মহাশূন্যে ভেসে থাকা কোটি কোটি নীহারিকায় কোটি কোটি গ্রহ তারার মধ্যে এই ছোট্ট নীল বিন্দুতেই প্রকৃতির আশ্চর্য ম্যাজিক ঘটেছিল — প্রাণস্পন্দহীন মাটি-পাথরের একাংশ কালের পৌরহিত্যে হঠাৎ একদিন জেগে উঠেছিল! তাদেরই উত্তরসূরীরা একদিন প্রশ্ন করেছিল নিজের উৎস নিয়ে। তারাই আবার আজকে তাদের আদিম বাসভূমিকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বের অপার দূরত্বকে জয় করার স্বপ্ন দেখছে! এই সুন্দর গ্রহের ভবিষৎ একমাত্র তাদেরই অনাগত প্রজন্মের হাতে।
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in




















বছর খানেক আগে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে এক শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কি? না, এবার থেকে হিপোক্রেটিক ওথ-এর পরিবর্তে না কি চালু হতে পারে বা হতে চলেছে চরক শপথ। বলাবাহুল্য, চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি একটি বড়সড় বদলের ইঙ্গিত। কেননা, চিকিৎসকেরা তাঁদের চিকিৎসা ডিগ্রির শেষে হিপোক্রেটিক ওথ বা হিপোক্রেটিক শপথ নিয়েই চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা চিকিৎসা পেশায় আসার অধিকার পান। গোটা বিশ্ব জুড়ে এই ব্যাপারটা চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী। ঠিক এই বিতর্কের সময়েই বা প্রসঙ্গে আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে আর আসাটাই বরং স্বাভাবিক– কে এই হিপোক্রেটাস, যাঁর নামে হিপোক্রেটিক ওথ সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। আসলে, আমাদের এই প্রবন্ধে আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন প্রাচীন গ্রীক  চিকিৎসক ও দার্শনিক হিপোক্রেটাস (অনেকের মতে– হিপোক্রেটিস) (Hippocrates)।

হিপোক্রেটাস-কে বলা হয় চিকিৎসাবিদ্যার জনক। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছুই জানা যায়নি। তিনি মোটামুটি ৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসের ঈজিয়ান বা এজিয়ান সাগরের বুকে অবস্থিত কস নামক দ্বীপে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন চিকিৎসক। পিতার চিকিৎসক হিসেবে কাজকর্ম দেখে পুত্রেরও ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ছোটবেলা থেকেই হিপোক্রেটাস ছিলেন লেখাপড়ায় বেশ আগ্রহী। আর তাঁর এই অসীম

আগ্রহ ও অসধারণ মেধা দেখে তাঁর পিতা সেকালের সেরা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে তাঁর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমনই একজন মহাজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এথেন্সের ডেমোক্রিটাস (যিনি পরমাণুবাদেরও অন্যতম জনক) (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ - খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০)(অনেকে উচ্চারণ করেন– দেমোক্রিতোস, ইংরেজিতে Democritus)। ইনি প্রায় গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করে প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ও চারুশিল্পে বিশাল ও সুগভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের কাছেই উচ্চশিক্ষা শুরু হয় হিপোক্রেটাসের। গুরু ডেমোক্রিটাসের মতো তিনিও সারা বিশ্বের সেই প্রাচীনকালের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় যান। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরীতে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা ও অধ্যাপনা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি এথেন্সবাসীকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা করে এথেন্সবাসীর কাছে সম্মানীয় হয়ে ওঠেন। তিনি যখন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর গুরু ডেমোক্রিটাসের চিকিৎসা করেছিলেন তখন তিনি কোনও অর্থ নেননি। ডেমোক্রিটাস ছাড়াও আরও কয়েকজন মহাজ্ঞানী পণ্ডিতদের কাছে হিপোক্রেটাস শিক্ষালাভ করেছিলেন।চিকিৎসকের পুত্র হিপোক্রেটাস গভীর জ্ঞান ও তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও যুক্তি দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবৈজ্ঞানিক দিকগুলো উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি চারিত্রিক দৃঢ়তার সাথে ও অসাধারণ প্রতিভায় সফলভাবে অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। এথেন্সে আগত নানান জ্ঞানীগুণীদের সাহচর্যেও তিনি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তিনি এইভাবেই সেই যুগের অন্ধ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস জর্জরিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে একটি পরিপূর্ণ ধারণা তৈরি করে ত্রুটিমুক্ত ও কুসংস্কারমুক্ত করে প্রকৃত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। বহুদূর থেকে রোগীরা আসত নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের কাছে। এর ফলে এথেন্সের প্রবীণ চিকিৎসকরা এই নবীন চিকিৎসকের সাফল্যে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আসলে, হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শীতার পাশাপাশি একজন সুচিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসাবিদ্যাকে যেসব চিকিৎসক তথা পুরোহিতেরা ভণ্ডামি ও শঠতার

পর্যায়ে নিয়ে গেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদে গর্জে উঠে বিরোধিতা করেছিলেন। এজন্যে, পুরোহিত সম্প্রদায়ও রেগে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে লাগল। নিরাপত্তাহীনতার ফলে হিপোক্রেটাস এথেন্স পরিত্যাগ করলেন আর এর কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে তুললেন। জানা যায় যে,ওই সময়ে গ্রীস দেশে শব-ব্যবচ্ছেদ করা ছিল নিষিদ্ধ। আর এই ব্যাপারটাই চিকিৎসাবিদ্যা ভালোভাবে অধ্যায়ন ও চর্চা করার ক্ষেত্রে ছিল প্রধান বাধা। আর ঠিক এই শব-ব্যবচ্ছেদ না করার জন্যই সেকালের গ্রীক চিকিৎসকেরা শরীরবিদ্যা ও রোগ নিরূপণ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী হতে পারতেন না। হিপোক্রেটসের জন্মের সময় গ্রীসের চিকিৎসাবিজ্ঞান কুসংস্কার ও তন্ত্রমন্ত্রের অন্ধকারে আবৃত ছিল। প্রাচীন গ্রীকদের চিকিৎসার দেবতা একজন ছিল যাঁর নাম ‘অ্যাপোলো’। সেই দেবতার হাতে হার্মিসের দণ্ডটিকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতীক হিসাবে মনে করা হত। প্রাচীন গ্রীসের বিভিন্ন জায়গায় ছিল অ্যাপোলোর মন্দির। তখনকার দিনে লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়লে আরোগ্য কামনায় তারা মন্দিরে পুজো দিত। শুধু পুজো নয় সাথে পশু উৎসর্গও করত। কেননা তখনকার লোকেরা মনে করত যে অ্যাপোলো দেবতার ক্রোধের জন্যই তারা অসুস্থ হয়েছে আর মন্দিরের পুরোহিতরা হল দেবতার প্রতিনিধি আর তাদের ইচ্ছাতেই রোগীর রোগমুক্তি ঘটবে তাই তাদের তুষ্ট করতে পারলেই তারা সেরে উঠবে। আর এই সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চিকিৎসক পুরোহিতরা তাদের ইচ্ছামতো রোগীদের চিকিৎসার বিধান দিত। এইভাবেই এই এক শ্রেণির পুরোহিতেরা চিকিৎসাবিদ্যাকে নিজেদের জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এই পুরোহিতারা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিকিৎসা করলেও তাদের এই চিকিৎসার জ্ঞানকে দেবতা অ্যাপোলোর দান বলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের চিকিৎসাবিদ্যাটি গোপন করে রাখত। আর এভাবেই সেকালের চিকিৎসাবিদ্যা হয়ে  উঠেছিল এক ‘গুপ্তবিদ্যা’ যার অধিকারী থাকত কেবলমাত্র চিকিৎসক পুরোহিত পিতা ও তাদের সন্তানরা। এইরকমই এক চিকিৎসক, অ্যাপোলো মন্দিরের প্রধান

পুরোহিত হেরাক্লিদেস (Heraclides)-এর পুত্র ছিলেন হিপোক্রেটাস। তাই সমাজে তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুবই বেশি ছিল। যার ফলে, হিপোক্রেটাস সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে লালিত পালিত হয়েছিলেন। হিপোক্রেটাস তাঁর পিতার কাছ থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তবিদ্যা লাভ করেছিলেন। বলা যায়, চিকিৎসায় তাঁর পিতাই ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। তাই তাঁর অস্থি-সংযোজক ঝিল্লী সম্পর্কে, মাংসপেশীর গঠন ও কার্য সম্পর্কে, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো কিংবা সরে যাওয়া হাড়কে পুনরায় সঠিক জায়গায় বসানোর ব্যাপারে এবং আরও ইত্যাদি চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। আর এইসবের পরিচয় পাই তাঁর লেখা চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো পড়লে। তিনি এও জানিয়ে গেছেন যে ভাঙা হাড়কে জুড়বার জন্য পাতলা কাঠ কোথায় ও কিভাবে বসাতে হবে এবং তার ওপর কিভাবে পটি বা পট্টি বাঁধতে হবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত কথা। মজার বিষয়, এইসব পদ্ধতি বর্তমান আধুনিক পদ্ধতিরই অনেকটাই কাছাকাছি। অর্থাৎ, হিপোক্রেটাস হলেন প্রথম অস্থিচ্যুতি ও অস্থিভঙ্গের চিকিৎসাসহ শল্য-চিকিৎসার প্রচলনকারী। তৎকালীন যুগে গ্রীসে শরীরচর্চা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত আর এই গুরুত্বটা এতটাই মারাত্বক ছিল যে স্পার্টায় অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ  শিশুদের হত্যা করা হত কেননা গ্রীকদের মতে সুস্থ ও সবল নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এর ফলে তখনকার গ্রীসে শরীরচর্চার জন্য খেলাধুলা ও ব্যায়ামচর্চার জন্য ব্যায়ামাগার গড়ে উঠেছিল। যখন এই সকল ব্যায়ামগারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটত তখন হিপোক্রেটাস যেতেন চিকিৎসা করার জন্য। দুর্ঘটনায় অস্থিসংক্রান্ত অসুবিধার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান দ্বারা চিকিৎসা করতেন বা চিকিৎসার বিধান দিতেন। আর এইভাবেই তিনি শল্য চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটান। ক্ষতস্থানে চিকিৎসার ব্যাপারেও তিনি অনেক নির্দেশ দিয়ে গেছেন যা প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী ও বাস্তবধর্মী। এমনকি, তিনি জানিয়ে গেছেন অস্ত্রোপচারের ঘর কেমন হবে বা হওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি কেমনভাবে থাকবে বা তার প্রস্তুতি কিভাবে নেওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের পর ক্ষতস্থানের যত্ন কেমনভাবে নেওয়া উচিত ইত্যাদি মূল্যবান বিষয়। রোগীর পথ্য, পরিচর্যা সহ নানান ব্যাপারে তাঁর অনেক মূল্যবান উপদেশ রয়েছে। বলাবাহুল্য, তাঁর পিতার থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তকথাগুলো জেনেছিলেন কোনও শব-ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ না পেয়েই। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানলাভ করেছিলেন। হিপোক্রিটাসের মতে, একজন চিকিৎসকের শুধুমাত্র রোগের উপসর্গ থেকে বিধান দেওয়া উচিত নয় বরং রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, পেশা, দৈনন্দিন কাজকর্ম তিনি যা করে থাকেন, তাঁর চারপাশের পরিবেশ, বংশানুক্রমিক রোগের ইতিহাস, তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এগুলো জানলে ও বুঝলে তিনি রোগীর রোগ সহজভাবেই নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে পারবেন। মানবদেহের তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন হিপোক্রেটাস। হিউমোরাল মানবদেহ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন ধরনের রস সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থারও তিনি প্রচলন করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের দেহ, মানসিকতা, আচার  ব্যবহার এমনকি মৃত্যুরও প্রধান কারণ হল এই দেহ থেকে নির্গত রস। এই রস কখনো ঠান্ডা, কখনো গরম বা আবার কখনো শুকনোও হতে পারে। এই রসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেহেরও স্বাভাবিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন (Galen) (আনুমানিক ১২৯ - ২১৬ খ্রিস্টাব্দ) হিপোক্রেটাসের এই হিউমোরাল মতবাদকে সমর্থন ও গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

তখনকার দিনে সন্ন্যাসরোগ বা মৃগীরোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তো বটেই এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও হরেক রকম কুসংস্কার ছিল। সাধারণ এমনকি চিকিৎসকেরাও ভাবতেন যে, ঈশ্বর রেগে গেলে কিংবা ভূতে ভর হলে মানুষের মৃগীরোগ হয়। অতএব, এই রোগ অত্যন্ত মারাত্মক আর এর চিকিৎসা হয় না। অর্থাৎ, এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ সেরে ওঠে না। চিকিৎসক হিপোক্রেটাস এ ধারণা ভ্রান্ত বলে আখ্যা দিলেন আর শুধু তাই নয় বরং উক্ত ভ্রান্ত ধারণাটির নিরসন ঘটালেন।সেই যুগে হিপোক্রেটস তাঁর ‘অন দি স্যাক্রেড ডিসিস' গ্রন্থে লিখেছেন মৃগীরোগ আর দশটি রোগের মতোই একটি রোগ। তিনি বললেন, যতই ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক রোগ হোক না কেন, তার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক কারণ থাকবেই। তাই রোগের চিকিৎসার জন্যেও কোনওরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করা অনুচিত বরং প্রকৃতিই হচ্ছে আমাদের চিকিৎসক। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, It is thus with regard to the disease called Sacred: it appears to me to be nowise more divine nor more sacred than other diseases, but has a natural cause from the originates like other affections. Men regard its nature and cause as divine from ignorance and wonder....। অর্থাৎ, ভূতে ভর করার ঘটনা বা ঈশ্বরের ক্রোধের মতো ঘটনার ফলে যে রোগটি হয় তা তিনি নাকচ করলেন। তার পরিবর্তে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের মধ্যে এক বৈজ্ঞানিক মনোভাব তিনি গড়ে তুললেন। যার অভাব তখনকার দিনে তো ছিলই এমনকি এখনকার দিনেও কিছুটা হলেও আছে। মানবদেহে সংগঠিত বিভিন্ন ধরনের ঘা, ফোঁড়া, কাটা, পচনের কারণ ও তার প্রতিকার করার উপায় ছিল তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। তিনি এইসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এইসব রোগ অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য ও দূষিত দ্রব্য ব্যবহার করার ফলে হয় এবং বৃদ্ধিলাভ করে। চিকিৎসার জন্যে তাই তিনি উপযুক্ত খাবার, নির্মল বাতাস, পরিস্কার দ্রব্যাদি, আবহাওয়া পরিবর্তন, অভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন প্রণালী ইত্যাদি দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দিতেন। আবার, উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রোগীকে ঔষধ দিতেন না। আসলে তিনি অপ্রয়োজনীয় ও অনির্দিষ্ট ওষুধ রোগীকে দেওয়ার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক মনে করতেন। তিনি বলেছেন, If you want to learn about the health of a population, look at the air they  breathe, the water they drink, and the places where they live.। তিনি  আরও বলেছিলেন যে, কোনও রোগ নিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণার ফলে সেই রোগের সঠিক কারণ জানতে হবে তারপর সেই অনুযায়ী রোগের উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। তাঁর মতে, একজন চিকিৎসকের একমাত্র উদ্দেশ্য হল রোগীর সেবা এবং রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা। হিপোক্রেটাস মনে করতেন যে, চিকিৎসাবিদ্যা অন্যান্য সকল বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। তাঁর মতে অন্যান্য শিল্পকলার মতো চিকিৎসাবিদ্যাও এক সুন্দর শিল্পকলা। কি অসাধারণ কথা! কিন্তু, দুঃখের বিষয় যে এই শিল্পকলাটি অন্যান্য শিল্পকলার চেয়ে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে কিছু চিকিৎসকদের অজ্ঞতার জন্যই। তিনি বলেছেন, এই চিকিৎসাবিদ্যার পুনরুজ্জীবনের জন্যে নবীন চিকিৎসকদেরই ভার নিতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক হিপোক্রেটাস তাঁর ছাত্রদের জন্য এক সুন্দর ও অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। চিকিৎসাবিদ্যা সমাপ্ত করার পর যখন তাঁরা চিকিৎসক হিসেবে জীবন শুরু করতে যাবেন তখন সেই নবীন চিকিৎসকদের দাঁড় করিয়ে তিনি এক শপথবাক্য পাঠ করাতেন। আসলে, চিকিৎসকরা তাঁদের চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের পর যাতে তাঁদের সেবা ও মহানতার সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন সেজন্যেই তিনি নব্য চিকিৎসকদের শপথ করাতেন। সেই শপথবাক্যটি হলঃ- সারাজীবন ধরে আমি নিষ্ঠাভরে আমার কর্তব্য সম্পাদন করে যাব এবং আমার পেশার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখব। সেই শপথ বাক্যে এও বলা হয়ে থাকে চিকিৎসকদের শিক্ষাগুরু অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষাদান করেছেন বা করতে সাহায্য করেছেন তাঁরা তাদের মাতৃপিতৃতুল্য। তাঁদের সন্তানরা তাদের ভাতৃ ও ভগ্নীসম এবং তারা যদি এই বিদ্যালাভের ইচ্ছুক হয় তাহলে বিনা পারিশ্রমিকে তাদের বিদ্যাদান করা হবে। যে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ চিকিৎসকরা দেবেন সেটি তাঁর যোগ্যতা, বিচার ও বিবেচনা অনুসারে রোগীর উপাকারে লাগবে। কোনও ব্যক্তি যদি চিকিৎসকের কাছে কোনও মারাত্মক ও ক্ষতিকারক ওষুধ চায় তাহলে সেই চিকিৎসক কখনোই সেই ওষুধগ্রহণ করার পরামর্শ দেবেন না। রোগী ও পরিবারের সকল তথ্য যা চিকিৎসক জানবেন চিকিৎসার জন্যে তা সেই চিকিৎসক অন্য কোনও কাউকে জানাবেন না অর্থাৎ গোপন রাখবেন। চিকিৎসকদের কর্তব্য যে তাঁরা যেন সবসময় চিকিৎসাশাস্ত্রকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করেন। চিকিৎসকরা যেন এই শপথবাক্যকে যথাযথভাবে পালন করে সকল মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে তাদের জীবন ও বিদ্যাকে সমভাবে সম্মানিত করে তোলেন। আর এটাই হল সেই বিখ্যাত হিপোক্রেটিক ওথ (Hippocratic Oath) (বাংলায় যা ;হিপোক্রেটিসের শপথ বা হিপোক্রেটীয় শপথ নামে পরিচিত) যা ওই নবীন চিকিৎসকদেরকে বলতে হত আর এখনও বলতে হয়। তবে জানা নেই যে, ভারতীয় আয়ুর্বেদাচার্য চরক কোনও ওইরকম শপথবাক্য পাঠ করাতে কিনা। হয়তো আগাম গবেষণা তার হদিস দেবে। তবে, হিপোক্রেটাসের শপথ বিশ্বজুড়ে বেশি বিস্তারলাভ করেছে। আমাদের কাছে যদিও দুজনেই আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধেয়, নমস্য ও প্রণম্য প্রাচীনকালের চিকিৎসক। হিপোক্রেটাস ছিলেন একজন সুচিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিদ্যার স্বনামধন্য অধ্যাপক। চিকিৎসকদের হিপোক্রেটাসই প্রথম শিখিয়েছিলেন কোনও রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে তুলনামূলক মূল্যায়নের পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে। বলা যায় যে, তিনিই প্রথম যিনি চিকিৎসাবিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নীতির ওপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বগুলো ‘করপাস হিপোক্রেটিকাম (Corpus Hippocraticum বা Hippocratic Corpus) নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এই গ্রন্থে চিকিৎসাবিষয়ক প্রায় ৬০ কি তার বেশি চিকিৎসা সম্পর্কিত কাজ বা নিবন্ধ ও গবেষণাপত্র রয়েছে। হিপোক্রেটাস ৩৭০ (মতান্তরে ৩৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নব্বই (কি তার বেশি বয়সে) আমাদের ছেড়ে চলে যান।আসলে, হিপোক্রেটিসের জন্ম ও মৃত্যুসাল যে ঠিক কত সালে সে সম্পর্কে একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি চলে গিয়ে রেখে গেছেন সারাজীবন ধরে লিখে যাওয়া চিকিৎসাবিদ্যার বহু প্রবন্ধ যা তাঁর ছাত্ররা সংগ্রহ করে যত্ন  সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর বিখ্যাত লাইব্রেরিতে। অনেকের মতে তা এক-দু খণ্ড নয়, বরং মোট সাতাশি খণ্ডের সেই বৃহৎ হিপোক্রেটাসের রচনাবলী ছিল রচনার পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে চিকিৎসকদের কাছে এক অমূল্য গ্রন্থের মতো। এক একটি খণ্ডে চিকিৎসার এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর রচনায় উল্লেখিত চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে ও চিকিৎসকদের চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর সকল নির্দেশাবলী সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক।বলা যায়, সেই রচনাবলী ছিল চিকিৎসাবিদ্যার বাইবেল। তিনি সর্বদা চাইতেন যে, সমস্ত অজ্ঞতা, অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে চিকিৎসাবিদ্যাকে যুক্তিনিষ্ঠ তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এই কাজের জন্যে ও চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল অবদানের জন্যে গ্রীসের মহান দার্শনিক প্লেটো (Plato) (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ - খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৮)-র কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার মহাগুরু ও আদর্শ শিক্ষক। আর সর্বযুগের চিকিৎসক তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে আছেন এক প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক আর চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক।




তথ্যসূত্রঃ-

দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী – অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
নির্বাচিত বিজ্ঞানীদের জীবনী – পৃথ্বীরাজ সেন, আদ্রিশ পাবলিকেশন, কলকাতা।
ছোটদের বিজ্ঞানকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উইকিপিডিয়া সহ নানান ওয়েবসাইট।
0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






স্যর মুহাম্মদ ইকবাল ( ১৮৭৭-১৯৩৮) । বা, আল্লামা ইকবাল । পঞ্জাব প্রদেশের এক কাশ্মীরী পণ্ডিত বংশে জন্ম । কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস ডিগ্রি আর জার্মানির লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি । তিনি ব্যারিস্টারি করতেন , দর্শনচর্চা করতেন।কিন্তু তাঁর বড় পরিচয় তিনি কবি । তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রভাবিত হয়েছিল সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমির কাব্য-দর্শনের দ্বারা । রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল প্রায় সমসাময়িক । এক দেশের মানুষ । তবু তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি কোন যোগাযোগ । যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২) ।

ইকবালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের যে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র পাওয়া যায় , যে কথা আমরা এই নিবন্ধে আলোচনা করব , তা কিন্তু বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রে নেই । সেই পর্যালোচনা করে পূরবী বসু লিখেছেন একটি বই –‘রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়া : কাছে থেকেও দূরে ।‘ বেগম রোকেয়ার কর্মক্ষেত্র ছিল কলকাতায় , তবু রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে কেন নীরব রইলেন তিনি , রবীন্দ্রনাথেরও নীরবতা কেন , তা বোঝা যায় না । আমাদের বন্ধু সাংবাদিক অনল আবেদিন এবং তাঁর মতো আরও কিছু মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়ার যোগাযোগহীনতার রহস্য উন্মোচনের কথা বলেন । কিন্তু তথ্যের অসদ্ভাবে তা বোধহয় সম্ভব হবে না ।

ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে ফিরে আসি । দুজনেই কবি । তবে কবি-স্বভাবের পার্থক্য আছে । রফিক জাকারিয়া তাঁদের কবি-স্বভাবের পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথে আছে কমনীয় সৌন্দর্য , আর ইকবালে আছে পৌরুষের দৃপ্ততা । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে সংগীতের সুর , আর ইকবালে আছে আগুনের তপ্ততা [ “ Tagore brought out romantic in man ; Iqbal the heroic . Tagore exulted in feminine beauty ; Iqbal in masculine strength . There was music in Tagore’s poetry; there was fire in Iqba’s . Tagore was humble ; Iqbal was proud . Tagore was always active ; Iqbal easy going and lazy . “

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইকবালের সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ইকবালের আদ্যন্ত নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর চেয়ে একটু বেশি সক্রিয় । আমির বাট [ Aamir Butt] তাঁর ‘ Tagore and Iqbal : Views ‘ [ Tagore – animikh Rabindranath –World Press 12 Janury, 2012 ] প্রবন্ধে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ লাহোরে গেলে ইকবালের মেয়ো রোডের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন । ইকবাল তখন ভাগলপুরে গিয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি । ইকবাল ভাগলপুর থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথের আগমন সংবাদ শুনেও নীরব ছিলেন , যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি। মহম্মদ ইক্রাম চুঘাটি [ Muhammad Ikram Chughati ] পাকিস্তানের ইকবাল বিশেষজ্ঞ , উর্দু সায়েন্স বোর্ডের ডাইরেক্টর । তিনি তাঁর বই ‘ Iqbal and Tagore’ -এ বলেছেন যে ইকবাল নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিলেন । তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে নীরব ছিলেন, যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি ।

১৯৩৭ সালে লাহোরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উদ্যোগে যে ইকবাল দিবস পালন করা হয় , তাতে রবীন্দ্রনাথ যে বাণী পাঠান তা হল :

--” স্যার মহম্মদ ইকবালের কবিত্বের প্রতি সমগ্র ভারতের শ্রদ্ধা নিবেদনে আপনাদের সহিত আন্তরিকভাবে যোগদান করিতেছি । উর্দু ভাষায় অনভিজ্ঞতার দরুন আমি তাঁহার রচিত প্রাঞ্জল মৌলিক রচনা পাঠের আনন্দ হইতে বঞ্চিত । এজন্য আমি সততই দুঃখ অনুভব করিয়া থাকি । দীর্ঘকাল জীবিত থাকিয়া তিনি দেশের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করুন , এই প্রার্থনা করি । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ১৬ ডিসেম্বর , ১৯৩৭ ] ।

রবীন্দ্রনাথ যখন এই বাণী পাঠাচ্ছেন , তখন ইকবাল জীবিত । কিন্তু তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল , তা জানা যায় না । ইকবালের মৃত্যুর পরে ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ নিম্ন শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন :

--” ইকবালের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে স্থান শূন্য হইল তাহা পূরণ হইতে দীর্ঘকাল লাগিবে। আমাদের সাহিত্য জীবনে ইহা একটি মারাত্মক আঘাত । জগতে আজ ভারতের স্থান অতি সংকীর্ণ ; এই সময়ে ইকবালের মতো একজন কবিকে হারানো তাহার পক্ষে খুবই কষ্টের কথা। কারণ ইকবালের কবিতার একটা বিশ্বজনীন মূল্য ছিল । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ২২ এপ্রিল , ১৯৩৮ ] ।

ইকবালের কবিতায় বিশ্বজনীন মূল্যের কথা স্বীকার করছেন রবীন্দ্রনাথ । কথাটা সত্য । কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ইকবাল কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন না ? ইকবালের পক্ষ নিয়ে এর আলোচনা করেছেন মিলি গেজেট [ Millie Gazette] ‘ Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ প্রবন্ধে । তিনি প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন যে হাফিজের ভাব অপহরণ করেই ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলির উদ্ভব –” While Tagore almost plagiarized Hafiz in his 103 poems in Gitanjali, that won him 1913’s Nobel, Iqbal’s inspiration was devoid of pilfering . “

আবার কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়ার পেছনে রাজনীতি আছে।মুসলমানদের অবজ্ঞা করার জন্য ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কারের কর্তারা । তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের দহরম-মহরম ছিল ---” The reasons behind overlooking Iqbal were more political than the perceived lack of profundity , Tagore’s family hobnobbed with the high-ranking English officials and he ( Tagore) had influenced English friends . Though Tagore belonged to Brahmo Samaj , a subdivision of Hinduism , he was viewed by the Brits a ‘refined Upper Class Hindu’ ( Nirad C Chaudhary’s words) and they wanted to project a ‘Hindu’ above a Muslim . “ ( ‘Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ )

সমস্ত পুরস্কারের পেছনে যে রাজনীতি থাকে , সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই। দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বহু সম্ভ্রান্ত ইংরেজের সঙ্গে যোগাযোগও প্রমাণিত সত্য । কিন্তু ইকবালকে বঞ্চিত করে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়া হয়েছে তা কি মুসলিম জগত বিশ্বাস করে?  তা যদি হবে , তাহলে ১৯৩২ সালে ইরানের রাজা রবীন্দ্রনাথকে কেন এমন উষ্ম সংবর্ধনা দেন, কেন তেহেরানে তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে মানুষ ? কেনই বা বাগদাদ রাজা নিজে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করেন রবীন্দ্রনাথকে ? আমরা অনুমান করতে পারি মুসলিম জগতে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সংবর্ধনা কবি ইকবালকে ক্ষুব্ধ করেছিল। এ ব্যাপারে ইকবালের অনুরাগীদের কিছু ভূমিকা থাকা বিচিত্র নয় । তাঁরা ইকবালের অন্তর্নিহিত ক্ষোভে অগ্নিসঞ্চার করেছিলেন হয়তো ; যেমন রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভক্তরা আধুনিক কবিদের সম্বন্ধে , নজরুল সম্বন্ধে তাতিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে । 
[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ]
0

প্রবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে রাম ও সীতার বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মিথিলা জ্ঞান সাধনা সংস্কৃতির প্রানকেন্দ্র - "সাধু সাধ্বিতি শংসন্তো মিথিলাং সমপূজযন্"। অন্যদিকে অযোধ্যা হলো ধর্মের ও বীরত্বের সমৃদ্ধির রাজ্য। মিথিলার জ্ঞান আর অযোধ্যার ঐতিহ্য - এই দুয়ের মেলবন্ধন হলো আর্ষ রামায়ণের আর্য ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভা।

এই দুই প্রধান রাজ্যের মধ্যে ধর্মবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। তিনি (ও পরে বশিষ্ঠ) চেয়েছিলেন ভারতের এই পূর্ণপ্রতিভা জাগ্রত হোক। তাই এই বিবাহবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন বয়সে রাম ও সীতার বিয়ে হয় - এটি একটি রামায়ণের অন্যতম বিতর্কিত একটা বিষয়, যেটা ক্রিটিক্যাল এডিশন (সংক্ষেপে CE; রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ) ও পর্যন্ত মীমাংসা করতে পারেনি, এত ভিন্ন পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ করা সত্ত্বেও।

অরণ্যকাণ্ডে, প্রচলিত টেক্সটে (ভালগেট) যখন রাবণ সীতার কাছে সাধুবেশ ধারণ করে আসে, তখন সীতা বলছে (৪৭/৪):

উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷৷

"ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজভবনে বারো বছর বাস করে মনুষ্যোচিত মনোবাঞ্চিত ভোগ্যবিষয়সমূহ ভোগ করলাম..." (গীতা প্রেস অনুবাদ)

এখানে - "দ্বাদশ সমা" - মানে দুই ও দশ বছর। মানে ১২ বছর।

সীতা এটাও বলে: (৪৭/১০)

মম ভর্তামহাতেজা বযসা পঞ্চবিংশকঃ৷৷
অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে৷

"বনবাস গমনকালে আমার মহাতেজস্বী পতির বয়স পঁচিশ বৎসর (ছিল) আর জন্মের সময় থেকে গণনা করলে আমার বয়স আঠারো।"

তেমনি সুন্দরকাণ্ডে যখন হনুমান সীতার সঙ্গে দেখা করতে আসে, বৈদেহী তাকে বলেন: (৩৩/১৭)

সমা দ্বাদশ তত্রাহং রাঘবস্য নিবেশনে৷৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷

এখানেও আমরা দেখি - "সমা দ্বাদশ" - মানে ১২ বৎসর।

"আমি অযোধ্যায় শ্রীরঘুনাথের অন্তঃপুরে দ্বাদশ বৎসর পর্যন্ত সর্বপ্রকার মানবীয় বিলাস ভোগ করতাম এবং আমার অভিলাষ সর্বদা পরিপূর্ণ হতো।"

এর থেকে এটা পরিষ্কার - যেটা আমাদের বাঙালি অনুবাদক ও অন্যান্য গবেষক রাও ভেবেছেন যেমন Sheldon Pollock - সীতার বয়স বিয়ের সময় ছয় বৎসর ছিল (১৮-১২= ৬).

রামায়ণে টীকা লেখার একটা দীর্ঘ চল ছিল। প্রাদেশিক টীকাকার (মূলত দক্ষিণী) গোষ্ঠী এটিকে সম্মতি দিয়েছে। এর দুটো প্রধান কারণ। ক্রিটিক্যাল এডিশন স্কলার দের মতে দক্ষিণে ধর্মীয় আবেগের ফলে বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত টেক্সট খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষিত হয়েছে। কবিরা / যারা কপি করেছেন কোনো ভাবেই টেক্সটকে পরিবর্তন হতে দেয়নি। হলেও সেগুলো খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত, এঁরা এই ধর্মীয় কারণেই টেক্সটকে ক্রিটিক্যাল (অর্থাৎ কোনটি সঠিক পাঠ হবে সেটির নির্ণয়) ভাবে দেখতে শেখেননি। অন্যদিকে উত্তর ভারতে (বিশেষ করে গৌড়, মৈথিলি, কাশ্মীর ও নেপাল) বাল্মীকি রামায়ণকে মূলত কাব্য হিসেবে দেখা দেখতো কবিরা। বিহার ও বারাণসী এই অঞ্চল গুলো ছিল সংস্কৃত চর্চার আখড়া। সেখানে তারা অনেকক্ষেত্রেই শুদ্ধ পাঠ বুঝতে পেরে পরিবর্তন করে ও লিখিত রূপে সেটি প্রবেশ করে খুবই প্রাচীন কাল, যেটি পরবর্তী সময়ে অগণিত বার কপি হয়েছে।

নাগেশ ভট্ট, যাঁর 'তিলক' টীকা খুব বিখ্যাত (ওঁর টেক্সটকে প্রচলিত টেক্সট / vulgate ধরা হয়) - তিনি শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। উনি লিখছেন তিলক টীকাতে:

"পঞ্চবিংশকঃ সাংখ্যসিদ্ধং পঞ্চবিংশং তত্ত্বং চৈতন্যং সো যমেব ৷ এতচ্চৈতন্যেনৈব জগদ্ব্যাপ্তং ন ততো ধিকং কিঞ্চিদস্তীতি সূচযিতুং তথোক্তিরিতি তত্ত্বম্1৷৷"

সরল অনুবাদ: "রামের বয়স ছিল ২৫ যখন তিনি অযোধ্যা ছেড়ে বনে যান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন ২৫ হলো সাংখ্য মতে "চৈতন্য পুরুষ"। যেটা স্বয়ং রাম। বালকান্ডতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে। উনি তাই চৈতন্য পুরুষ, ওঁর মধ্যে সমস্ত বিশ্ব সমাহিত। তার উপর সত্য কিছু নেই। তিনিই জীবন শক্তি।

তেমনি বনবাস গমন কালে (রাবণকে যেটি বলছে, অর্থাৎ ১৮) সীতার বয়স সম্পর্কে তিলক টীকায় আছে:

"মমপঞ্চতন্মাত্রপঞ্চমহাভূতপঞ্চেন্দ্রিযাহঙ্কারবুদ্ধিমনোরূপাণ্যষ্টাদশ বর্ষাণি পর্বাণি জন্মনি কার্যে গণ্যন্ত ইতি তন্মূলীভূতা প্রকৃতিরহমিতি সূচিতম্"

১৮ গুন পঞ্চ তন্ত্র, পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, রূপ ও মন সব কিছুর সমাহার। এটা প্রমান করে সীতাই প্রকৃতি। সীতাই হলো সাংখ্য তত্ত্বের আদিরুপ।"

তেমনি, যখন বিস্বামিত্র রামকে নিয়ে যেতে এসেছেন রাক্ষসদের উৎপাত থেকে ব্রাহ্মণ দের রক্ষা করার জন্য, তখন রাজা দশরথ বিশ্বামিত্র কে বলেছেন: (১/২০/০২)

ঊনষোডশবর্ষো মে রামো রাজীবলোচন:৷
ন যুদ্ধযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈ:৷৷1.20.2৷৷

"আমার কমলনয়ন রামের বয়স এখনো ১৬ বছর হয়নি; সুতরাং রাক্ষসদের সঙ্গে তার যুদ্ধ করার যোগ্যতা আমি দেখছি না।"

এর অর্থ এমন হতেই পারে, রামের বয়স তখন ১৬ হয়নি, কিন্তু ১৬-এর আশেপাশে। তর্কের খাতিরে ধরা যেতে পারে ১৫-১৬ এর মধ্যে।

শিরোমনি টীকা অনুযায়ী - "বযসা পঞ্চবিংশক: পঞ্চবিংশেন যুক্তা: কা: ত্রযো যস্য স" - বনবাসে গমন কালে রামের বয়স ছিল- ২৫+৩ = ২৮.

এটা সীতার কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যদি রামের বয়স ১৫ হয়, এবং সীতাকে যদি সে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করে, এবং ১২ বছর তারপর অযোধ্যায় থাকে, তাহলে বনবাস গমন কালে তার বয়স ২৮ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সীতা বলেছে সে - "অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে" - তার মানে সে যখন অযোধ্যা ছেড়েছিল তখন তার বয়স ১৮।

এখানে কৌশল্যার বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অযোধ্যাকান্ডে রানী কৌশল্যা বলছে রামকে, যখন রাম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সে বনে যাবে: (২/২০/৪৫)

দশ সপ্ত চ বর্ষাণি জাতস্য তব রাঘব!
অতিতানি প্রকাঙ্ক্ষন্ত্যা মযা দুঃখপরিক্ষযম্৷৷

"রঘুনন্দন! (আমার) দুঃখের পরিসমাপ্তির আশায় আশায়, তোমার দ্বিজত্ব প্রাপ্তির ১৭ বছর চলে গেল।"

এখানে "জাতস্য" শব্দটি একটা ইঙ্গিত দেয় রামের বয়সের ব্যাপারে।

দশরথ বলছে ঋষি বিশ্বামিত্রকে রামের বয়স ১৬ এর নিচে। ধরা যাক ১৫ বছর বয়সে রাম গিয়েছিল বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ও তারপর ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। সীতার বয়ান অনুযায়ী রাম ১২ বছর বিয়ের পর অযোধ্যায় ছিল, তারপর ১৩ বছরের মাথায় দশরথ তার রাজ্যভিষেক করার কথা ভাবেন। তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ১৭ হতে পারেনা অযোধ্যা ছাড়ার সময়।

জাতস্য মানে দ্বিতীয় জন্ম। এটাকে ধরা হয়েছে রামের উপনয়নের সময়কে। এটিকে দ্বিতীয় জন্ম ধরা হয়েছে। মনুস্মৃতি বলে উপনয়নের বয়স ১০-১১ বছরের মধ্যে হওয়া উচিত "একাদশে রাজ্যানম"।

সেটা ধরলে, রাম তখন ২৭-২৮ হবে যখন সে অযোধ্যা পরিত্যাগ করে।
---------


এবার আমরা দেখবো ক্রিটিক্যাল এডিশন বা রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ ও এখান থেকেই শুরু হয় আসল বিতর্ক।

संवत्सरं चाध्युषिता राघवस्य निवेशने
भुञ्जाना मानुषान्भोगान्सर्वकामसमृद्धिनी।। (৩/৪৫/৪)

ক্রিটিক্যাল এডিশন এই শ্লোকটিতে কিছু পরিবর্তন করেছে। প্রচলিত টেক্সটে শ্লোকটি ছিল:

"উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷"

কিন্তু শুদ্ধ সংস্করণ বলছে সীতা ১২ বছর নয়, বরং মাত্র এক বছর ছিল রামের গৃহে বনবাসের আগে।

এখানে MSS (ম্যানুষ্ক্রিপ্ট; পাণ্ডুলিপি) পাঠভেদ বোঝা দরকার।

N1 - একটি নেপালি পাণ্ডুলিপি (manuscript - ms), S1 - একটি সারদা ms, D 1-3 - 3টে দেবনাগরী mss, ও গোটা দক্ষিনের সমস্ত mss এ আছে ১২ বছর। এর মধ্যে N1 - নেপালি (উত্তর ভারতের) যেটা ১০২০ AD তে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেটি রামায়ণের সবচেয়ে পুরানো লিপি, সেখানেও বলা আছে ১২ বছর। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন ওটাকে সরিয়ে দিল?

এখানে আরো একটা জিনিস খেয়াল করার ব্যাপার। ক্রিটিক্যাল এডিশন "ইক্ষ্বাকুণাং" শব্দের জায়গায় "রাঘবস্য" বলেছে।

ক্রিটিক্যাল এডিশন মোট ৪২টি MSS জোগাড় করে অরণ্যকান্ড স্টাডির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে থেকে ওরা ২৯টি বেছে নেয় ক্রিটিক্যাল স্টাডির জন্য। অরণ্যকান্ডের এডিটর PC Divanji অসাধারণ যত্নের সঙ্গে এই কাজটি করেছেন।

নর্থ এর mss হল - বাংলা, মৈথিলি, সারদা, নেওয়ারী ও দেবনাগরী। এতে আছে মোট ১৪ খানা mss। সাউথে আছে তেলুগু, গ্রন্থ, মালায়লাম ও দেবনাগরী mss। ওটা মোট ১৫ mss নিয়ে গঠিত।

তাহলে যেটা পেলাম সেটা হলো ১৫টা mss + একটা নেপালি, একটা সারদা (কাশ্মীরি), 3টে দেবনাগরী = ২০/২৯ পাণ্ডুলিপিতে আছে সীতা ১২ বছর ছিল রামের বাড়িতে। মাত্র ৯টি - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনাগরী - mss আছে সীতা এক বছর ছিল বিয়ের পর অযোধ্যায়।

প্রশ্ন ওঠে PC Divanji তাহলে কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলেন? ক্রিটিক্যাল এডিশন (CE) এর আদর্শ অনুযায়ী ১) দক্ষিণের লিপি বেশি প্রাধান্য পাবে, কারণ তাদের মতে এটাই আদিরূপের মূল রিডিং বহন করছে ২) যেখানে দক্ষিণ ও উত্তরের লিপির মধ্যে সংঘাত, সেখানে মূলত দক্ষিণ-ই প্রাধান্য পাবে। ৩) যদি কোনো একটি অংশ দক্ষিণে আছে অথচ উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি একদমই সাক্ষ্য দেয় না, তখন ঐ শ্লোকগুলি বাদ যাবে। তাই ক্রিটিক্যাল এডিশন একপ্রকার নর্থের টেক্সটকে ব্যবহার করে দক্ষিনের প্রচলিত টেক্সটকে শুদ্ধ রূপ দিয়েছে, এটা বলা যায়।

ক্রিটিক্যাল এডিসন যারা নিরপেক্ষ ভাবে পাণ্ডুলিপি গবেষণা করছে তাদের উচিৎ ছিল ১২ বছর রেখে দেওয়া। কিন্তু Divanji লিখলেন -- এক বছর এই ঘটনার "context" এর সঙ্গে মিশে যায়।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিসনের এর থিওরি অনেকটা এরকম দাঁড়াচ্ছে।

যখন বিশ্বামিত্র দশরথের কাছে যায়, তখন উনি বলেন রামের বয়স ১৬ হয়নি। ধরা যাক ১৫। রাম ১৬ তে বিয়ে করলো। বিয়ের পর এক বছর তারা অযোধ্যায় থাকলো। ১৭ বছর বয়সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে গেল। এটা কৌশল্যার বয়ানের সঙ্গে মিলছে। যদি রাম ও সীতা ১২ বছর কাটায় ও সংসারের আনন্দ উপভোগ করে সেটা রামের মহৎ চরিত্রের সঙ্গে যায় না (রামায়ণ গবেষক কামিল বুল্কে ও এই মত পোষণ করেন) বা বলা ভালো বাকি রামায়ণে রামের যে বিস্তর কর্মকান্ড আমরা দেখি তার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করে সুখে দিন কাটানো ঠিক যেন রামের চরিত্রের সঙ্গে যায়না। বুল্কে তাঁর গবেষণা মূলক বই - "রামকথা: উৎপত্তি ও বিকাশ" (pg 359) এ লিখেছেন এই ১২ বছর অযোধ্যায় থাকার বয়ানটি তাই প্রক্ষিপ্ত।

Divanji-র পরের যুক্তি এটাকে আরো পোক্ত করে।

সীতা রাবণকে বলছে ১৩ বছরের মাথায় রাজা ঠিক করেন রামের রাজ্য অভিষেক হবে। এবং সুন্দরকাণ্ডে (৫/৩৩/১৭-১৮) সীতা হনুমানকে একই কথা বলছে - যে তিনি ১২ বছর অযোধ্যায় ছিলেন, ও ১৩ বছরের মাথায় রামের অভিষেক হওয়ার কথা।

এখানেও সুন্দরকাণ্ডের critical apparatus বলছে N2 - V1 - B - D6-7 (৯ - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনগরী) এগুলোতে বলা আছে সীতা এক বছর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পর এবং তার পরের বছর রামের অভিষেক হওয়ার কথা ছিল। নর্থের তিনটি প্রধান এডিশন - গোরেসিও ও কলকাতা এডিশন - এক বছর রেখেছে কিন্তু আশ্চর্য এটাই লাহোর এডিশন এই ক্ষেত্রে রামের রাজ্যাভিষেকের শ্লোকটা রাখেই নি।

তাহলে কী দাঁড়ালো? দক্ষিণের ও নর্থ ইস্ট এর পাণ্ডুলিপি ধরলে, রামের বয়স দাঁড়ায় ২৫ রাজ্যাভিষেক এর ঠিক আগে। তেমনি নর্থ ওয়েস্ট ধরলে ওটা ২৭।

বিয়ে ও রাজ্যাভিষেক এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি এক বছর হয়, তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ২৫-২৭ হতে পারেনা। CE মনে করে এটা পরে যোগ হয়েছে। এক্ষেত্রে সারদা ও নেপালি ২টো স্ক্রিপ্ট প্রাচীন হলেও CE এগুলোকে মান্যতা দেয়নি। কারণ বাল্মীকির লেখার স্টাইল থেকে সরে গিয়ে ২টো স্ক্রিপ্টেই ৩-লাইনে করে শ্লোকটি লিপিবব্ধ হয়েছে। তেমনি CE ওই শ্লোকটি উড়িয়ে দিয়েছে যেখানে সীতা বলে তার বয়স ছিল ১৮ যখন সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে চলে আসে।

কিন্তু সমস্যা হলো সুন্দরকান্ডে গিয়ে।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিশনের কী করা উচিত ছিল? সীতা হনুমানকে যেটা বলছে সেই বক্তব্যের সামঞ্জস্য রাখা উচিত ছিল অরণ্যকাণ্ডের সঙ্গে,অর্থাৎ তিনি এক বছর কাটিয়েছেন রাঘবের সাথে রাজমহলে।

সুন্দরকাণ্ডের এডিটর - GC Jhala - কিন্তু ১২ বছর-ই রেখেছেন। তাহলে কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলো না?

Jhala ক্রিটিকাল নোটে এ লিখেছেন এখানে ১২ বছর রেখে দেওয়া হয়েছে CE এর যে methodology অর্থাৎ শ্লোক নির্বাচনের পদ্ধতি সেটার উপর নির্ভর করে। যখন এই সমস্যা CE এর জেনেরাল এডিটর GH Bhatt কে জানানো হয়, উনি এক বছর রেখে দেন অরণ্যকান্ডে। সমস্ত এভিডেন্স সাপোর্ট না করা সত্ত্বেও (কারণ যেটা আমি আগে লিখেছি) - উনি ও Divanji মনে করেছেন এটা "context" এর সঙ্গে যায় না।

আমি একটু গুছিয়ে সামারী করে দিই:

১) CE এখানে কৌশল্যার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যে অভিষেকের সময় রামের বয়স ছিল ১৭। এখানে কিন্তু "জাতস্য" শব্দের অর্থ ও "context" তারা ধরলো না।

২) যদি রাম ১৫-১৬ বছর বয়সে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যায়, অস্ত্র শিক্ষা লাভ করে ও তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করে, নিশ্চই সেখান থেকে ৮ বছর লাগেনি তাদের মিথিলায় যেতে।

৩) CE এখানে ধরছে রামের বয়স ১৭-১৮ ছিল যখন সে বনে গিয়েছিল। আবার, কৌশল্যার কথাকে মান্যতা দিয়ে, সীতার কথাকে এখানে গ্রাহ্য করলো না। শ্লোকটি উড়িয়ে দেওয়া হলো। রামের দ্বিতীয় জন্ম - জাতস্য - এর কনসেপ্ট গ্রাহ্য করলো না, যদিও টেক্সটে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ CE টেক্সটে অরণ্যকাণ্ডে সীতা বলছে সে রামের বাড়িতে ১ বৎসর ছিল, অন্যদিকে সুন্দরকাণ্ডে আমরা দেখছি সে হনুমানকে বলছে ১২ বৎসর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পরে।

৪) বুল্কের মতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে -- তাহলে ১২ বছর সময় কেন তিনি নষ্ট করবেন সুখে দিন কাটিয়ে?

৫) এখানে CE যেটা করেছে সেটাকে বলে higher criticism। অর্থাৎ টেক্সটের বাইরে গিয়ে নিজেদের বুদ্ধি কমন সেন্স কাজে লাগিয়েছে। সমস্যা হলো এটা সুন্দরকাণ্ডের ক্ষেত্রে তারা কেন করল না?
--------


আমাদের এখানে তাহলে কীভাবে টেক্সট দেখতে হবে?একটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ নিতে হবে। Holistic approach.

ভালগেট / প্রচলিত টেক্সট অনুসারে সীতার বয়স ৬ যখন তার বিয়ে হয়েছে। আমরা ক্রস-রেফারেন্স দেখবো, টেক্সটের মধ্যে।

বৈদিক যুগে, মহাভারতে ও সূত্রগুলিতে বলা হয়েছে একটি মেয়ের বিয়ের আদর্শ বয়স ১৬, বা যখন সে বয়‍‌ঃসন্ধি কাল প্রাপ্ত করে। বাল্য বিবাহের নিদর্শন পাওয়া যায় না।

রাজা জনক ঋষি বিশ্বামিত্রকে সীতার ব্যাপারে বলেছেন:

ভূতলাদুত্থিতাং তাং তু বর্ধমানাং মমাত্মজাম্৷ ১/৬৬/১২)

পরিষ্কার ভাবে উনি বলছেন সীতা "বৃদ্ধিপ্রাপ্ত" হয়েছে।


তিনি এটাও বলেন সীতাকে বীর্যশুল্কা ঘোষণা করার পর অনেক দেশ থেকে রাজারা আসেন ও ধনুক তুলতে ব্যর্থ হন। "হে মুনিপ্রবর! অতঃপর সৎবৎসরকালব্যাপী পীড়ন হেতু আমার সৈন্যাদিসহ যুদ্ধোপকরণ সকল সর্বতোভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লাম।"

এটা ধরে নেওয়া অন্যায় যে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা একটি ৩-৫ বছরের নাবালিকাকে পত্নী রূপে পাওয়ার জন্য মারপিট করছিলেন।

তেমনি সীতা ঋষিপত্নী অনসূয়াকে বলেন:

পতিসংযোগসুলভং বযো দৃষ্ট্বা তু মে পিতা৷ (২/১১৮/৩৪)

"কিছুকাল পরে পিতা আমার বিবাহের বয়স হয়েছে লক্ষ্য করে...চিন্তিত হলেন।"

পতিসংযোগসুলভং - যে বয়সে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পবিত্র মিলন সম্ভব - সেটা কি কোনোভাবে ৫-৬ বছর বয়সে হতে পারে?

তেমনি সীতা এটাও বলেছে:

সুদীর্ঘস্য তু কালস্য রাঘবোযং মহাদ্যুতিঃ৷
বিশ্বামিত্রেণ সহিতো যজ্ঞং দ্রষ্টুং সমাগতঃ৷৷ (২/১১৮/৪৪)

"সুদীর্ঘকাল পরে মহাদীপ্তিমান রামচন্দ্র সেই ধনুতে জ‍্যা-রোপন যজ্ঞ দর্শনের জন্য মহর্ষি বিস্বামিত্র ও লক্ষ্মণের সঙ্গে মিথিলায় এলেন।"

অর্থাৎ রামের মিথিলায় আগমন হয়েছে সুদীর্ঘকাল পরে। সীতা যে রামকে নিজের হৃদয়ে চিরতরে স্থান দিয়েছিলেন (১/৭৬/১৪) এবং বিয়ের পর সমস্ত দাম্পত্য সুখভোগ করেছেন, এটাই প্রমান করে তিনি নাবালিকা ছিলেন না। আমরা যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে নাও ভাবি, তাহলেও ৬ বৎসরের একটি কন্যা কাউকে নিজের শরীর ও মন দিয়ে ভালোবেসেছে, এটা মানতে বড়ই কষ্ট হয়।

তাহলে, অনেক সম্ভাবনা রয়েই যায়। বিয়ের সময় রামের বয়স ১৬ অথবা ২৪ হতে পারে, কিন্তু সীতার বয়স কোনোভাবেই ৬ বৎসর হওয়া সম্ভব নয়।


Reference:

[1] – Valmiki Ramayana – Hanumanta Rao
[2] – Valmiki Ramayana – Rajsekhar Basu
[3] – Valmiki Ramayana – Upendranatha Mukhopadhyay
[3] Valmiki Ramayana, Critical Edition – Volume 1,3,5
[4] Valmiki Ramayana with Tilaka commentary
[5] Valmiki Ramayana – Gita Press
[6] Manu Smriti – Sacred Text (online)
[7] Valmiki Ramayana, Lahore Edition
[8] Ramkatha – Camille Bulcke
[9] History of Dharmasastra – P.V. Kane
[10] The Riddle of the Ramayana – C.V. Vaidya





ReplyForward
0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






সময়টা ছিল অদ্ভুত! একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ। ধর্মীয় ও সামাজিক কৃষ্ণ গহ্বরে বাস করতে করতে মানুষ কেবল পাঁকে মজে চলেছে। অন্যদিকে এসব কিছুকে তোয়াক্কা না করে মানুষের জন্য দেশের জন্য অপার ভালোবাসা নিয়ে কিছু মানুষ দিনকে রাত করে পরিশ্রম করে চলেছেন। সম্বল তাঁদের মেধা মনীষা এবং মানবিকতা। একদিকে বিদেশী মিশনারির প্রচার - ভারতবর্ষ ভূত প্রেত আর সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় সংস্কারে ঠাসা এক দেশ। অন্যদিকে কলকাতার নব্য ধর্মের বাবুদের, এদানির ব্রহ্মজ্ঞানীদের বিরুদ্ধ প্রচার। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, এ ধর্মের শতেক আচার বিচার আসলে সঙ্কীর্ণ এক ধর্মের পরিচয়। ব্রাহ্ম ধর্ম তখন মানুষের ধর্মান্তরকরণ ঠেকাতে এমনই একটি অবস্থান নিয়েছিল। আদি সমাজ তৎকালীন হিন্দু নেতাদের সঙ্গ প্রায় ত্যাগ করেছিল। নববিধানীরা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের সেই সরল মানুষটির প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক কে স্মরনে রেখে হিন্দু ধর্মের মধ্যে মহৎ দর্শনকে স্বীকার করেছিলেন। তবে সে তাৎক্ষণিক। এই সময় যারা নিজের সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে জীবন পণ করেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের অন্যতম। দেশের মানুষের চরম দারিদ্র, দুঃখ দুর্দশা, তাঁকে অহরহ কষ্ট দিত। সেই দুর্দশা নিবারণের জন্য তিনি তাঁর চরিত্রানুগ কর্মক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর পারিবারিক দুর্ভাগ্য এর সঙ্গে মিলে গিয়ে তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। অথচ স্বভাবের কারণেই আধ্যাত্মিক চেতনা ছিল প্রবল। তাঁর শৈশব ও বাল্যের বহু কাহিনী আমরা জানি যা তাঁর সেই চেতনার পরিচায়ক। দিন কতক ব্রাহ্ম সমাজে ঘোরাঘুরি করেছিলেন। তারপর দেখলেন স্বয়ং কেশবচন্দ্র গিয়ে পরেছেন দক্ষিণেশ্বরের সেই পুরোহিতের কাছে। কেশবচন্দ্রের মতো জ্ঞানী গুনী বিদ্বান মানুষ কিসের আকর্ষণে গেলেন তাঁর কাছে? সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সেদিনের উনিশ বছরের তরুণ গিয়ে পড়েছিলেন তাঁর কাছে। বাকি ইতিহাস। এরপর ভারতের ধর্মজগতে আমরা উজ্জ্বল কতগুলি নক্ষত্রের বিচরণ দেখতে পাই। তা সত্ত্বেও দেশের মানুষের অপমান দুর্দশা ঘোচেনি।

শিকাগো ধর্ম মহাসভা বসেছিল আমেরিকায়। ব্রিটিশদের দেশে নয়। সেখানে ভারতীয়রা দাস বলে চিহ্নিত ছিলোনা। ফলে ধর্ম মহাসভায় যখন স্বামী বিবেকানন্দের জয়জয়কার হলো তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পত্রিকা গুলোতে সে সংবাদ কিঞ্চিত রেখে ঢেকে পরিবেশিত হয়েছিল। দাসেদের এই উত্থান তাদের চোখে বিষ ঠেকেছিল নিশ্চয়! স্বামিজীর ধর্ম মহাসভায় যোগদানের উল্লেখ তো ছিলোনা বললেই হয়। কেউ জানতেন না তিনি সেখানে যাচ্ছেন, এমনটি নিশ্চয় নয়! কিন্তু জয়ের খবর যখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরল তখন দেশের মানুষের আনন্দ দ্যাখে কে! আজ পর্যন্ত সাহেবদের থেকে দেশীয়দের সম্মান আদায় করতে কি পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে সে সকলেরই জানা ১।কিন্তু এই প্রথম মানুষ দেখল যে স্বামিজী আত্মসম্মান বজায় রেখে কোনোরকম ত্যাগ স্বীকার না করেই কি বিপুল সম্মান আদায় করেছেন! তাদের মাথা উঁচু করেছেন। সারা প্রতীচ্য জানতে পেরেছে যে ভারতবাসী মাত্রই কিছু অসভ্য বর্বর নয়। তারাও উচ্চতর বিদ্যা ধর্ম ও দর্শনের অধিকারী। ধর্ম মহাসভার ভাষণ শেষে হল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে এক শ্রোতা বলেছিলেন২ “এদের দেশে মিশনারীরা ধর্ম প্রচার করতে যায়? কেন? এরাই বরং এদেশে মিশনারী পাঠাক!” এই সম্মান এই শ্রদ্ধা স্বামী বিবেকানন্দের ভারতবাসীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এর আগে মানুষ মরমে মরে ছিল। মাথা উঁচু করে বাঁচতে তারা ভুলেছিল সেই চৈতন্য নিধনের সময় থেকে। হুজুরের গোলামি করতে করতে ভুলেছিল যে তারা কারোর ক্রীতদাস নয়। তারাও মানুষ। স্বামীজি এই দুঃখ তাঁর স্বদেশবাসীর জন্য বুকে বহন করে গিয়েছেন সারা জীবন। এই দুঃখ থেকেই তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সুখ, ব্যাক্তিগত উন্নতি, এমনকি ব্যক্তিগত লক্ষ্যকেও গৌণ জ্ঞান করেছিলেন। এই ভালোবাসাই তাঁকে স্থির থাকতে দিতনা। নয়ত ত্যাগী সন্ন্যাসী স্বদেশে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মানুষের মঙ্গলে নিয়োজিত থাকবেন ভেবে বিদেশের পথে পথে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবতে পারতেন? তাঁর শক্তি মূলত আধ্যাত্মিক। কিন্তু সে ক্ষেত্র সমষ্টির, ব্যষ্টির নয়। এইটি ফুটিয়ে তুলতে একটি উদাহরণ হাজির করা যাক। সবে বিলেত থেকে ফিরেছেন। ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ। উঠেছেন কাশীপুরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন স্টেশনে গিয়েছিলেন একটি তরুণ। নাম সুধীর চক্রবর্তী। সেই প্রথম সে স্বামিজীকে দেখেছে। এক অদ্ভুত আকর্ষণে সে হাজির হয়েছিল ওই বাগানবাড়িতে। সেখানে তখন উপস্থিত শরতচন্দ্র চক্রবর্তী। গুরুশিষ্যে আলাপ চলছে। সুধীর শুনছে। তার মনে একটি প্রশ্ন। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না স্বামিজীকে জিজ্ঞেস করে। অবশেষে শরতচন্দ্র সাহস জোগানোয় সে প্রশ্ন করল – “অবতার ও মুক্ত বা সিদ্ধপুরুষে পার্থক্য কি? এত ভয়। অথচ স্বামিজী কি অবলীলায়, কত ভালোবেসেই না এই তরুণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণের কথা, তাঁর লক্ষ্য! কি বলেছিলেন তিনি? বলেছিলেন – “বিদেহমুক্তিই যে সর্বোচ্চ অবস্থা, এ আমার সিদ্ধান্ত। তবে আমি সাধনাবস্থায় যখন ভারতের নানাদিকে ভ্রমণ করতুম, তখন কত গুহায় নির্জনে বসে কতকাল কাটিয়েছি, কতবার মুক্তিলাভ হলো না বলে প্রায়োপবেশন করে দেহত্যাগ করবার সঙ্কল্প করেছি, কত ধ্যান কত সাধন ভজন করেছি, কিন্তু এখন আর মুক্তিলাভের জন্য সে বিজাতীয় আগ্রহ নেই। এখন কেবল মনে হয়, যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর একটা লোকও অমুক্ত থাকছে ততদিন আমার নিজের মুক্তির কোনও প্রয়োজন নেই।” এই কথা কটি কি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে যে স্বামিজী বলেছিলেন তা ভাবলে বিস্ময় জাগে। আজকের স্বার্থপর লোভী পৃথিবীতে এই আবেগ বিলুপ্ত। তাই আমরা সারাক্ষণ ভাবতে থাকি, চরিত্রে ত্রুটি কোথায়, কোথায় তাঁর এতটুকু স্খলন। তবেই তাঁকে নিজের সঙ্গে সমান করে দেওয়া সম্ভব। অথচ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর জগতের প্রতিটি মানুষের প্রতি কি অপার মায়া! তিনি একার মুক্তি চাননি। চেয়েছেন সারা জগতের মুক্তি। কখন? যখন ভারতবর্ষ দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়ে এক অপমানিত বন্দীদশা কাটাচ্ছে। মনুষ্যত্বের নিদারুন অপমানের জ্বালা বুকে বয়ে শত শত তরুণ যখন এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। সমসাময়িক বিপ্লবীদের জীবন আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁরা অধিকাংশ স্বামিজীর রচনা পড়ে তাঁর বানীতে আকৃষ্ট হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে নামেন। স্বামিজীও মুক্তি চেয়েছিলেন, এঁরাও চেয়েছেন। এঁরা চেয়েছেন ব্যবহারিক মুক্তি। সম্মানের সঙ্গে বাঁচার স্বাধীনতা। আর স্বামিজী চেয়েছিলেন চেতনার মুক্তি। আধ্যাত্মিক মুক্তি। সেই তো প্রকৃত মুক্তি! কিন্তু এহেন মুক্তির সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। আর সে সম্মানের শুরু অন্নহীনের শ্রদ্ধার অন্ন পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। নিরাশ্রয়ের আশ্রয় পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। কারণ – খালিপেটে ধর্ম হয়না, একথা তাঁর পরমপুরুষটি বলে গিয়েছেন। ক্ষুধার্তকে ধর্মকথা শোনানো পাপ। মনুষ্যত্বের অপমান। তাঁর সেই পরমপুরুষের ভাব ছিল একান্ত নির্ভরতার। তিনি জানতেন জগতে যা কিছু ঘটছে তা সবই শক্তির খেলা। এই ঘটমান কালই কালী। সেখানে ‘গাছের পাতাটিও নড়ে তাঁর ইচ্ছেয়’। এই নির্ভরতা থেকে একরকমের নিষ্ক্রিয়তা আসে। কর্মবিমুখতা। বেশি কাজে না জড়ানো। ‘আমি খাই দাই আর থাকি। আর সব মা জানে’। এই যে জীবনের প্রবাহ, তা থেকে একটু সরে দাঁড়ানো। একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করা। এও এক ধরনের বোধ। যে বোধ থেকে তিনি বলেছিলেন – ‘সেবা যারা করে তারা অন্য থাকের লোক’। কারণ মনুষ্য জীবনের একটিই উদ্দেশ্য। তা হলো, ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বর লাভ। তবে তাঁর প্রধান শিষ্যটি কি আদর্শচ্যুত হলেন? এ বড় জটিল প্রশ্ন। এখানে কিছুটা প্রকৃতির কথা আসে। স্বামিজীর প্রকৃতি তাঁকে এই কল্যাণ কর্মে জড়িয়েছে। ‘তাঁর ইচ্ছে’। এই প্রকৃতি থেকেই স্বামিজী তাঁর শিষ্য বিরজানন্দকে বলছেন – দ্যাখ, যদি নিজের মুক্তি খুঁজিস তো জাহান্নামে যাবি, আর অপরের মুক্তির জন্য যদি কাজ করিস তো এখনই মুক্ত হয়ে যাবি ৩। সেই পরমপুরুষের অসাধারণ স্থৈর্য তাঁকে স্থিতিশক্তি জুগিয়েছিল। আর স্বামিজীর অস্বাভাবিক তেজ, তাঁর শক্তি, তাঁকে স্থির হতে দেয়নি। এর ফল যে সবসময় ভালো হতো তা নয়। তাঁর কোনও কোনও গুরুভাই মনে করেছিলেন তাঁদের গুরুর আদর্শে তাঁরা সাধন ভজন করেই দিন কাটিয়ে দেবেন। অন্তর্মুখ সন্ন্যাসীমণ্ডলী পরে শুধু স্বামিজীর কারণেই কি বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেদের নিযুক্ত করেছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। গুরু নয়, গুরুভ্রাতার প্রতি সন্দেহাতীত আনুগত্য। সোজা কথা? ঈশ্বর দর্শনই যখন উদ্দেশ্য তখন জাগতিক সব যোগ ছিন্ন হোক, এই ছিল তাঁদের মনের কথা। স্বামিজী যখন বিদেশে, চিঠিপত্র, সংবাদে জানা যাচ্ছে তাঁর বক্তৃতার অংশবিশেষ। তাঁর খ্যাতি ও প্রাপ্তির কথা। এর ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান সন্ন্যাসী স্বামী প্রেমানন্দ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন খুব ৪। এক চরম হতাশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। এর আগে স্বামিজী একবার পওহারী বাবার কাছে দীক্ষা নেবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। পুনরায় ফিরে আসেন এখানে। কারণ – ‘তাঁর গুরুর জুড়ি নেই’। সেই থেকে বাবুরাম মহারাজের মনে সন্দেহ ছিল তাঁকে নিয়ে। বিদেশের খবরে স্বভাবতই বিচলিত হয়ে তিনি মনে করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ তবে ব্যক্তিগত খ্যাতি ও উচ্চাশার জন্যই এত কাঠখড় পুড়িয়েছেন। গুরুর নাম কোথাও নেই কেন? হয়ত পরে নিজের সঙ্গে নিজেই আপোস করেছেন বাবুরাম মহারাজ। পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি শান্ত হয়েছিলেন। কারণ নরেনের পত্রে উল্লেখ আছে – এখানে কেউ মুষ্টিভিক্ষা দেয়না। এখানে বক্তৃতায় পয়সা পাওয়া যায়। গুরুর নাম করলে পাছে লোকে তাঁকে হেয় করে, তাই আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হচ্ছে। এ থেকে অনুভব করা যায় যে বিশ্বখ্যাত স্বামীজিকেও কিছু বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। শর্তহীন আনুগত্য তিনিও প্রথমে পাননি। এইখানেই সমকালের সীমাবদ্ধতা। কেশবচন্দ্র সেনের প্রচারের পরে একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দর খ্যাতিতেই সারা বিশ্ব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসর কথা জানতে পারল।

বিদেশ যাত্রা প্রাক্কালে স্বামীজি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাঁর গুরু তাঁকে বিস্তীর্ণ সাগরের ওপারে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। তিনি এর অর্থ করেছিলেন – তিনি তাঁকে বিদেশ যাত্রায় ডাকছেন। ধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে বলছেন। সে সময় তাঁর অশান্ত মনে দেশের সম্মানের জন্য, সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার জন্য যে আকুলিবিকুলি সেটিই তাঁকে বিচলিত করেছিল। তিনি স্বপ্নের এই অর্থ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে একটিই অর্থ ভাসে। সেটি হলো – মামনুসর। আমাকে, আমার আদর্শকে অনুসরণ করো। যা আমরা বুঝেছি, তা স্বামীজির মতো মানুষ উপলব্ধি করেননি এ ভাবা নির্বুদ্ধিতা। তবে তিনি নিজের অন্তরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন না কেন? এমন দ্বিধায় কেন পরলেন? আসলে তাঁর প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনও একটি মহৎ কর্মে জড়াতে না পারলে শান্তি হতো না তাঁর।

এ শুধু একটি দিক। যেদিকটিতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বচেতনা সমগ্র জগতে ছড়িয়ে। আর একটি দিক থেকে তিনি কখনও কখনও সেই পরমপুরুষের ভাবে র’সে থাকতেন। আলমোড়াতে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে শ্রান্ত সন্ন্যাসী কখনও বলতেন – জীবনের কটা দিন এরকম নির্জনে ভগবৎ আরাধনায় অতিবাহিত করতে চাই। এই আমার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু এ আর ঘটে ওঠেনি। ঈশরোপলব্ধির চরম কথাটি বলতে গিয়ে বলেছেন – Being one with divinity, there cannot be any further progress in that sense. তাঁর কাছে Divinity হলো এই অনন্ত জনসমুদ্র। তার সাথে এক হওয়া। এই একত্ববোধই, এই point of unionই তাঁর আজীবনের আরাধ্য ছিল। এই একত্ববোধ থেকেই তিনি জাতিভেদকে ঘৃণা করেছেন। শ্রেনীভেদকে ঘৃণা করেছেন। আমরা স্বামীজির শত ভুল খাড়া করতে পারি, তাঁকে হাজার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারি, কিন্তু মানবপ্রেমিক এই সন্ন্যাসীর মতো করে মানুষকে ভালোবাসতে পারবনা। সেই ক্ষমতা যদি কেউ অর্জন করেন তবেই তাঁর পক্ষে স্বামীজির কাজের পর্যালোচনা সম্ভব। তাঁর উপলব্ধির সেই কথাটি – ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ, তুমিই এ বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, আপাতত এই উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হবার প্রয়াস করি বরং।



তথ্য সূত্র

১) শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৭, মণ্ডল বুক হাউস।
২) তদেব
৩) স্বামী অব্জজানন্দ, স্বামিজীর পদপ্রান্তে, ১৯৮৩, রামকৃষ্ণ মিশন সারদাপীঠ, বেলুড় মঠ।
৪) মহেন্দ্রনাথ দত্ত,শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৭৪


অতিরিক্ত পাঠ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম কথিত।

[ঋতবাক মুদ্রিত ২০১৮]