0

প্রবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে রাম ও সীতার বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মিথিলা জ্ঞান সাধনা সংস্কৃতির প্রানকেন্দ্র - "সাধু সাধ্বিতি শংসন্তো মিথিলাং সমপূজযন্"। অন্যদিকে অযোধ্যা হলো ধর্মের ও বীরত্বের সমৃদ্ধির রাজ্য। মিথিলার জ্ঞান আর অযোধ্যার ঐতিহ্য - এই দুয়ের মেলবন্ধন হলো আর্ষ রামায়ণের আর্য ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ প্রতিভা।

এই দুই প্রধান রাজ্যের মধ্যে ধর্মবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। তিনি (ও পরে বশিষ্ঠ) চেয়েছিলেন ভারতের এই পূর্ণপ্রতিভা জাগ্রত হোক। তাই এই বিবাহবন্ধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন বয়সে রাম ও সীতার বিয়ে হয় - এটি একটি রামায়ণের অন্যতম বিতর্কিত একটা বিষয়, যেটা ক্রিটিক্যাল এডিশন (সংক্ষেপে CE; রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ) ও পর্যন্ত মীমাংসা করতে পারেনি, এত ভিন্ন পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ করা সত্ত্বেও।

অরণ্যকাণ্ডে, প্রচলিত টেক্সটে (ভালগেট) যখন রাবণ সীতার কাছে সাধুবেশ ধারণ করে আসে, তখন সীতা বলছে (৪৭/৪):

উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷৷

"ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজভবনে বারো বছর বাস করে মনুষ্যোচিত মনোবাঞ্চিত ভোগ্যবিষয়সমূহ ভোগ করলাম..." (গীতা প্রেস অনুবাদ)

এখানে - "দ্বাদশ সমা" - মানে দুই ও দশ বছর। মানে ১২ বছর।

সীতা এটাও বলে: (৪৭/১০)

মম ভর্তামহাতেজা বযসা পঞ্চবিংশকঃ৷৷
অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে৷

"বনবাস গমনকালে আমার মহাতেজস্বী পতির বয়স পঁচিশ বৎসর (ছিল) আর জন্মের সময় থেকে গণনা করলে আমার বয়স আঠারো।"

তেমনি সুন্দরকাণ্ডে যখন হনুমান সীতার সঙ্গে দেখা করতে আসে, বৈদেহী তাকে বলেন: (৩৩/১৭)

সমা দ্বাদশ তত্রাহং রাঘবস্য নিবেশনে৷৷
ভুঞ্জানা মানুষান্ভোগান্সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷

এখানেও আমরা দেখি - "সমা দ্বাদশ" - মানে ১২ বৎসর।

"আমি অযোধ্যায় শ্রীরঘুনাথের অন্তঃপুরে দ্বাদশ বৎসর পর্যন্ত সর্বপ্রকার মানবীয় বিলাস ভোগ করতাম এবং আমার অভিলাষ সর্বদা পরিপূর্ণ হতো।"

এর থেকে এটা পরিষ্কার - যেটা আমাদের বাঙালি অনুবাদক ও অন্যান্য গবেষক রাও ভেবেছেন যেমন Sheldon Pollock - সীতার বয়স বিয়ের সময় ছয় বৎসর ছিল (১৮-১২= ৬).

রামায়ণে টীকা লেখার একটা দীর্ঘ চল ছিল। প্রাদেশিক টীকাকার (মূলত দক্ষিণী) গোষ্ঠী এটিকে সম্মতি দিয়েছে। এর দুটো প্রধান কারণ। ক্রিটিক্যাল এডিশন স্কলার দের মতে দক্ষিণে ধর্মীয় আবেগের ফলে বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত টেক্সট খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষিত হয়েছে। কবিরা / যারা কপি করেছেন কোনো ভাবেই টেক্সটকে পরিবর্তন হতে দেয়নি। হলেও সেগুলো খুবই সামান্য। দ্বিতীয়ত, এঁরা এই ধর্মীয় কারণেই টেক্সটকে ক্রিটিক্যাল (অর্থাৎ কোনটি সঠিক পাঠ হবে সেটির নির্ণয়) ভাবে দেখতে শেখেননি। অন্যদিকে উত্তর ভারতে (বিশেষ করে গৌড়, মৈথিলি, কাশ্মীর ও নেপাল) বাল্মীকি রামায়ণকে মূলত কাব্য হিসেবে দেখা দেখতো কবিরা। বিহার ও বারাণসী এই অঞ্চল গুলো ছিল সংস্কৃত চর্চার আখড়া। সেখানে তারা অনেকক্ষেত্রেই শুদ্ধ পাঠ বুঝতে পেরে পরিবর্তন করে ও লিখিত রূপে সেটি প্রবেশ করে খুবই প্রাচীন কাল, যেটি পরবর্তী সময়ে অগণিত বার কপি হয়েছে।

নাগেশ ভট্ট, যাঁর 'তিলক' টীকা খুব বিখ্যাত (ওঁর টেক্সটকে প্রচলিত টেক্সট / vulgate ধরা হয়) - তিনি শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদ দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। উনি লিখছেন তিলক টীকাতে:

"পঞ্চবিংশকঃ সাংখ্যসিদ্ধং পঞ্চবিংশং তত্ত্বং চৈতন্যং সো যমেব ৷ এতচ্চৈতন্যেনৈব জগদ্ব্যাপ্তং ন ততো ধিকং কিঞ্চিদস্তীতি সূচযিতুং তথোক্তিরিতি তত্ত্বম্1৷৷"

সরল অনুবাদ: "রামের বয়স ছিল ২৫ যখন তিনি অযোধ্যা ছেড়ে বনে যান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন ২৫ হলো সাংখ্য মতে "চৈতন্য পুরুষ"। যেটা স্বয়ং রাম। বালকান্ডতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে। উনি তাই চৈতন্য পুরুষ, ওঁর মধ্যে সমস্ত বিশ্ব সমাহিত। তার উপর সত্য কিছু নেই। তিনিই জীবন শক্তি।

তেমনি বনবাস গমন কালে (রাবণকে যেটি বলছে, অর্থাৎ ১৮) সীতার বয়স সম্পর্কে তিলক টীকায় আছে:

"মমপঞ্চতন্মাত্রপঞ্চমহাভূতপঞ্চেন্দ্রিযাহঙ্কারবুদ্ধিমনোরূপাণ্যষ্টাদশ বর্ষাণি পর্বাণি জন্মনি কার্যে গণ্যন্ত ইতি তন্মূলীভূতা প্রকৃতিরহমিতি সূচিতম্"

১৮ গুন পঞ্চ তন্ত্র, পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, রূপ ও মন সব কিছুর সমাহার। এটা প্রমান করে সীতাই প্রকৃতি। সীতাই হলো সাংখ্য তত্ত্বের আদিরুপ।"

তেমনি, যখন বিস্বামিত্র রামকে নিয়ে যেতে এসেছেন রাক্ষসদের উৎপাত থেকে ব্রাহ্মণ দের রক্ষা করার জন্য, তখন রাজা দশরথ বিশ্বামিত্র কে বলেছেন: (১/২০/০২)

ঊনষোডশবর্ষো মে রামো রাজীবলোচন:৷
ন যুদ্ধযোগ্যতামস্য পশ্যামি সহ রাক্ষসৈ:৷৷1.20.2৷৷

"আমার কমলনয়ন রামের বয়স এখনো ১৬ বছর হয়নি; সুতরাং রাক্ষসদের সঙ্গে তার যুদ্ধ করার যোগ্যতা আমি দেখছি না।"

এর অর্থ এমন হতেই পারে, রামের বয়স তখন ১৬ হয়নি, কিন্তু ১৬-এর আশেপাশে। তর্কের খাতিরে ধরা যেতে পারে ১৫-১৬ এর মধ্যে।

শিরোমনি টীকা অনুযায়ী - "বযসা পঞ্চবিংশক: পঞ্চবিংশেন যুক্তা: কা: ত্রযো যস্য স" - বনবাসে গমন কালে রামের বয়স ছিল- ২৫+৩ = ২৮.

এটা সীতার কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যদি রামের বয়স ১৫ হয়, এবং সীতাকে যদি সে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করে, এবং ১২ বছর তারপর অযোধ্যায় থাকে, তাহলে বনবাস গমন কালে তার বয়স ২৮ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সীতা বলেছে সে - "অষ্টাদশ হি বর্ষাণি মম জন্মনি গণ্যতে" - তার মানে সে যখন অযোধ্যা ছেড়েছিল তখন তার বয়স ১৮।

এখানে কৌশল্যার বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অযোধ্যাকান্ডে রানী কৌশল্যা বলছে রামকে, যখন রাম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সে বনে যাবে: (২/২০/৪৫)

দশ সপ্ত চ বর্ষাণি জাতস্য তব রাঘব!
অতিতানি প্রকাঙ্ক্ষন্ত্যা মযা দুঃখপরিক্ষযম্৷৷

"রঘুনন্দন! (আমার) দুঃখের পরিসমাপ্তির আশায় আশায়, তোমার দ্বিজত্ব প্রাপ্তির ১৭ বছর চলে গেল।"

এখানে "জাতস্য" শব্দটি একটা ইঙ্গিত দেয় রামের বয়সের ব্যাপারে।

দশরথ বলছে ঋষি বিশ্বামিত্রকে রামের বয়স ১৬ এর নিচে। ধরা যাক ১৫ বছর বয়সে রাম গিয়েছিল বিশ্বামিত্রের সঙ্গে ও তারপর ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। সীতার বয়ান অনুযায়ী রাম ১২ বছর বিয়ের পর অযোধ্যায় ছিল, তারপর ১৩ বছরের মাথায় দশরথ তার রাজ্যভিষেক করার কথা ভাবেন। তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ১৭ হতে পারেনা অযোধ্যা ছাড়ার সময়।

জাতস্য মানে দ্বিতীয় জন্ম। এটাকে ধরা হয়েছে রামের উপনয়নের সময়কে। এটিকে দ্বিতীয় জন্ম ধরা হয়েছে। মনুস্মৃতি বলে উপনয়নের বয়স ১০-১১ বছরের মধ্যে হওয়া উচিত "একাদশে রাজ্যানম"।

সেটা ধরলে, রাম তখন ২৭-২৮ হবে যখন সে অযোধ্যা পরিত্যাগ করে।
---------


এবার আমরা দেখবো ক্রিটিক্যাল এডিশন বা রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ ও এখান থেকেই শুরু হয় আসল বিতর্ক।

संवत्सरं चाध्युषिता राघवस्य निवेशने
भुञ्जाना मानुषान्भोगान्सर्वकामसमृद्धिनी।। (৩/৪৫/৪)

ক্রিটিক্যাল এডিশন এই শ্লোকটিতে কিছু পরিবর্তন করেছে। প্রচলিত টেক্সটে শ্লোকটি ছিল:

"উষিত্বা দ্বাদশ সমা ইক্ষ্বাকুণাং নিবেশনে৷"

কিন্তু শুদ্ধ সংস্করণ বলছে সীতা ১২ বছর নয়, বরং মাত্র এক বছর ছিল রামের গৃহে বনবাসের আগে।

এখানে MSS (ম্যানুষ্ক্রিপ্ট; পাণ্ডুলিপি) পাঠভেদ বোঝা দরকার।

N1 - একটি নেপালি পাণ্ডুলিপি (manuscript - ms), S1 - একটি সারদা ms, D 1-3 - 3টে দেবনাগরী mss, ও গোটা দক্ষিনের সমস্ত mss এ আছে ১২ বছর। এর মধ্যে N1 - নেপালি (উত্তর ভারতের) যেটা ১০২০ AD তে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেটি রামায়ণের সবচেয়ে পুরানো লিপি, সেখানেও বলা আছে ১২ বছর। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন ওটাকে সরিয়ে দিল?

এখানে আরো একটা জিনিস খেয়াল করার ব্যাপার। ক্রিটিক্যাল এডিশন "ইক্ষ্বাকুণাং" শব্দের জায়গায় "রাঘবস্য" বলেছে।

ক্রিটিক্যাল এডিশন মোট ৪২টি MSS জোগাড় করে অরণ্যকান্ড স্টাডির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে থেকে ওরা ২৯টি বেছে নেয় ক্রিটিক্যাল স্টাডির জন্য। অরণ্যকান্ডের এডিটর PC Divanji অসাধারণ যত্নের সঙ্গে এই কাজটি করেছেন।

নর্থ এর mss হল - বাংলা, মৈথিলি, সারদা, নেওয়ারী ও দেবনাগরী। এতে আছে মোট ১৪ খানা mss। সাউথে আছে তেলুগু, গ্রন্থ, মালায়লাম ও দেবনাগরী mss। ওটা মোট ১৫ mss নিয়ে গঠিত।

তাহলে যেটা পেলাম সেটা হলো ১৫টা mss + একটা নেপালি, একটা সারদা (কাশ্মীরি), 3টে দেবনাগরী = ২০/২৯ পাণ্ডুলিপিতে আছে সীতা ১২ বছর ছিল রামের বাড়িতে। মাত্র ৯টি - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনাগরী - mss আছে সীতা এক বছর ছিল বিয়ের পর অযোধ্যায়।

প্রশ্ন ওঠে PC Divanji তাহলে কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলেন? ক্রিটিক্যাল এডিশন (CE) এর আদর্শ অনুযায়ী ১) দক্ষিণের লিপি বেশি প্রাধান্য পাবে, কারণ তাদের মতে এটাই আদিরূপের মূল রিডিং বহন করছে ২) যেখানে দক্ষিণ ও উত্তরের লিপির মধ্যে সংঘাত, সেখানে মূলত দক্ষিণ-ই প্রাধান্য পাবে। ৩) যদি কোনো একটি অংশ দক্ষিণে আছে অথচ উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি একদমই সাক্ষ্য দেয় না, তখন ঐ শ্লোকগুলি বাদ যাবে। তাই ক্রিটিক্যাল এডিশন একপ্রকার নর্থের টেক্সটকে ব্যবহার করে দক্ষিনের প্রচলিত টেক্সটকে শুদ্ধ রূপ দিয়েছে, এটা বলা যায়।

ক্রিটিক্যাল এডিসন যারা নিরপেক্ষ ভাবে পাণ্ডুলিপি গবেষণা করছে তাদের উচিৎ ছিল ১২ বছর রেখে দেওয়া। কিন্তু Divanji লিখলেন -- এক বছর এই ঘটনার "context" এর সঙ্গে মিশে যায়।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিসনের এর থিওরি অনেকটা এরকম দাঁড়াচ্ছে।

যখন বিশ্বামিত্র দশরথের কাছে যায়, তখন উনি বলেন রামের বয়স ১৬ হয়নি। ধরা যাক ১৫। রাম ১৬ তে বিয়ে করলো। বিয়ের পর এক বছর তারা অযোধ্যায় থাকলো। ১৭ বছর বয়সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে গেল। এটা কৌশল্যার বয়ানের সঙ্গে মিলছে। যদি রাম ও সীতা ১২ বছর কাটায় ও সংসারের আনন্দ উপভোগ করে সেটা রামের মহৎ চরিত্রের সঙ্গে যায় না (রামায়ণ গবেষক কামিল বুল্কে ও এই মত পোষণ করেন) বা বলা ভালো বাকি রামায়ণে রামের যে বিস্তর কর্মকান্ড আমরা দেখি তার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করে সুখে দিন কাটানো ঠিক যেন রামের চরিত্রের সঙ্গে যায়না। বুল্কে তাঁর গবেষণা মূলক বই - "রামকথা: উৎপত্তি ও বিকাশ" (pg 359) এ লিখেছেন এই ১২ বছর অযোধ্যায় থাকার বয়ানটি তাই প্রক্ষিপ্ত।

Divanji-র পরের যুক্তি এটাকে আরো পোক্ত করে।

সীতা রাবণকে বলছে ১৩ বছরের মাথায় রাজা ঠিক করেন রামের রাজ্য অভিষেক হবে। এবং সুন্দরকাণ্ডে (৫/৩৩/১৭-১৮) সীতা হনুমানকে একই কথা বলছে - যে তিনি ১২ বছর অযোধ্যায় ছিলেন, ও ১৩ বছরের মাথায় রামের অভিষেক হওয়ার কথা।

এখানেও সুন্দরকাণ্ডের critical apparatus বলছে N2 - V1 - B - D6-7 (৯ - ২টি নেপালি, ১টি মৈথিলি, গোটা বাংলা ও ২টি দেবনগরী) এগুলোতে বলা আছে সীতা এক বছর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পর এবং তার পরের বছর রামের অভিষেক হওয়ার কথা ছিল। নর্থের তিনটি প্রধান এডিশন - গোরেসিও ও কলকাতা এডিশন - এক বছর রেখেছে কিন্তু আশ্চর্য এটাই লাহোর এডিশন এই ক্ষেত্রে রামের রাজ্যাভিষেকের শ্লোকটা রাখেই নি।

তাহলে কী দাঁড়ালো? দক্ষিণের ও নর্থ ইস্ট এর পাণ্ডুলিপি ধরলে, রামের বয়স দাঁড়ায় ২৫ রাজ্যাভিষেক এর ঠিক আগে। তেমনি নর্থ ওয়েস্ট ধরলে ওটা ২৭।

বিয়ে ও রাজ্যাভিষেক এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান যদি এক বছর হয়, তাহলে কোনো ভাবেই রামের বয়স ২৫-২৭ হতে পারেনা। CE মনে করে এটা পরে যোগ হয়েছে। এক্ষেত্রে সারদা ও নেপালি ২টো স্ক্রিপ্ট প্রাচীন হলেও CE এগুলোকে মান্যতা দেয়নি। কারণ বাল্মীকির লেখার স্টাইল থেকে সরে গিয়ে ২টো স্ক্রিপ্টেই ৩-লাইনে করে শ্লোকটি লিপিবব্ধ হয়েছে। তেমনি CE ওই শ্লোকটি উড়িয়ে দিয়েছে যেখানে সীতা বলে তার বয়স ছিল ১৮ যখন সে অযোধ্যা ছেড়ে বনে চলে আসে।

কিন্তু সমস্যা হলো সুন্দরকান্ডে গিয়ে।

তাহলে ক্রিটিক্যাল এডিশনের কী করা উচিত ছিল? সীতা হনুমানকে যেটা বলছে সেই বক্তব্যের সামঞ্জস্য রাখা উচিত ছিল অরণ্যকাণ্ডের সঙ্গে,অর্থাৎ তিনি এক বছর কাটিয়েছেন রাঘবের সাথে রাজমহলে।

সুন্দরকাণ্ডের এডিটর - GC Jhala - কিন্তু ১২ বছর-ই রেখেছেন। তাহলে কেন ক্রিটিক্যাল এডিশন এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলো না?

Jhala ক্রিটিকাল নোটে এ লিখেছেন এখানে ১২ বছর রেখে দেওয়া হয়েছে CE এর যে methodology অর্থাৎ শ্লোক নির্বাচনের পদ্ধতি সেটার উপর নির্ভর করে। যখন এই সমস্যা CE এর জেনেরাল এডিটর GH Bhatt কে জানানো হয়, উনি এক বছর রেখে দেন অরণ্যকান্ডে। সমস্ত এভিডেন্স সাপোর্ট না করা সত্ত্বেও (কারণ যেটা আমি আগে লিখেছি) - উনি ও Divanji মনে করেছেন এটা "context" এর সঙ্গে যায় না।

আমি একটু গুছিয়ে সামারী করে দিই:

১) CE এখানে কৌশল্যার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যে অভিষেকের সময় রামের বয়স ছিল ১৭। এখানে কিন্তু "জাতস্য" শব্দের অর্থ ও "context" তারা ধরলো না।

২) যদি রাম ১৫-১৬ বছর বয়সে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে বনে যায়, অস্ত্র শিক্ষা লাভ করে ও তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করে, নিশ্চই সেখান থেকে ৮ বছর লাগেনি তাদের মিথিলায় যেতে।

৩) CE এখানে ধরছে রামের বয়স ১৭-১৮ ছিল যখন সে বনে গিয়েছিল। আবার, কৌশল্যার কথাকে মান্যতা দিয়ে, সীতার কথাকে এখানে গ্রাহ্য করলো না। শ্লোকটি উড়িয়ে দেওয়া হলো। রামের দ্বিতীয় জন্ম - জাতস্য - এর কনসেপ্ট গ্রাহ্য করলো না, যদিও টেক্সটে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ CE টেক্সটে অরণ্যকাণ্ডে সীতা বলছে সে রামের বাড়িতে ১ বৎসর ছিল, অন্যদিকে সুন্দরকাণ্ডে আমরা দেখছি সে হনুমানকে বলছে ১২ বৎসর ছিল অযোধ্যায় বিয়ের পরে।

৪) বুল্কের মতে রামকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে -- তাহলে ১২ বছর সময় কেন তিনি নষ্ট করবেন সুখে দিন কাটিয়ে?

৫) এখানে CE যেটা করেছে সেটাকে বলে higher criticism। অর্থাৎ টেক্সটের বাইরে গিয়ে নিজেদের বুদ্ধি কমন সেন্স কাজে লাগিয়েছে। সমস্যা হলো এটা সুন্দরকাণ্ডের ক্ষেত্রে তারা কেন করল না?
--------


আমাদের এখানে তাহলে কীভাবে টেক্সট দেখতে হবে?একটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ নিতে হবে। Holistic approach.

ভালগেট / প্রচলিত টেক্সট অনুসারে সীতার বয়স ৬ যখন তার বিয়ে হয়েছে। আমরা ক্রস-রেফারেন্স দেখবো, টেক্সটের মধ্যে।

বৈদিক যুগে, মহাভারতে ও সূত্রগুলিতে বলা হয়েছে একটি মেয়ের বিয়ের আদর্শ বয়স ১৬, বা যখন সে বয়‍‌ঃসন্ধি কাল প্রাপ্ত করে। বাল্য বিবাহের নিদর্শন পাওয়া যায় না।

রাজা জনক ঋষি বিশ্বামিত্রকে সীতার ব্যাপারে বলেছেন:

ভূতলাদুত্থিতাং তাং তু বর্ধমানাং মমাত্মজাম্৷ ১/৬৬/১২)

পরিষ্কার ভাবে উনি বলছেন সীতা "বৃদ্ধিপ্রাপ্ত" হয়েছে।


তিনি এটাও বলেন সীতাকে বীর্যশুল্কা ঘোষণা করার পর অনেক দেশ থেকে রাজারা আসেন ও ধনুক তুলতে ব্যর্থ হন। "হে মুনিপ্রবর! অতঃপর সৎবৎসরকালব্যাপী পীড়ন হেতু আমার সৈন্যাদিসহ যুদ্ধোপকরণ সকল সর্বতোভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লাম।"

এটা ধরে নেওয়া অন্যায় যে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা একটি ৩-৫ বছরের নাবালিকাকে পত্নী রূপে পাওয়ার জন্য মারপিট করছিলেন।

তেমনি সীতা ঋষিপত্নী অনসূয়াকে বলেন:

পতিসংযোগসুলভং বযো দৃষ্ট্বা তু মে পিতা৷ (২/১১৮/৩৪)

"কিছুকাল পরে পিতা আমার বিবাহের বয়স হয়েছে লক্ষ্য করে...চিন্তিত হলেন।"

পতিসংযোগসুলভং - যে বয়সে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পবিত্র মিলন সম্ভব - সেটা কি কোনোভাবে ৫-৬ বছর বয়সে হতে পারে?

তেমনি সীতা এটাও বলেছে:

সুদীর্ঘস্য তু কালস্য রাঘবোযং মহাদ্যুতিঃ৷
বিশ্বামিত্রেণ সহিতো যজ্ঞং দ্রষ্টুং সমাগতঃ৷৷ (২/১১৮/৪৪)

"সুদীর্ঘকাল পরে মহাদীপ্তিমান রামচন্দ্র সেই ধনুতে জ‍্যা-রোপন যজ্ঞ দর্শনের জন্য মহর্ষি বিস্বামিত্র ও লক্ষ্মণের সঙ্গে মিথিলায় এলেন।"

অর্থাৎ রামের মিথিলায় আগমন হয়েছে সুদীর্ঘকাল পরে। সীতা যে রামকে নিজের হৃদয়ে চিরতরে স্থান দিয়েছিলেন (১/৭৬/১৪) এবং বিয়ের পর সমস্ত দাম্পত্য সুখভোগ করেছেন, এটাই প্রমান করে তিনি নাবালিকা ছিলেন না। আমরা যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে নাও ভাবি, তাহলেও ৬ বৎসরের একটি কন্যা কাউকে নিজের শরীর ও মন দিয়ে ভালোবেসেছে, এটা মানতে বড়ই কষ্ট হয়।

তাহলে, অনেক সম্ভাবনা রয়েই যায়। বিয়ের সময় রামের বয়স ১৬ অথবা ২৪ হতে পারে, কিন্তু সীতার বয়স কোনোভাবেই ৬ বৎসর হওয়া সম্ভব নয়।


Reference:

[1] – Valmiki Ramayana – Hanumanta Rao
[2] – Valmiki Ramayana – Rajsekhar Basu
[3] – Valmiki Ramayana – Upendranatha Mukhopadhyay
[3] Valmiki Ramayana, Critical Edition – Volume 1,3,5
[4] Valmiki Ramayana with Tilaka commentary
[5] Valmiki Ramayana – Gita Press
[6] Manu Smriti – Sacred Text (online)
[7] Valmiki Ramayana, Lahore Edition
[8] Ramkatha – Camille Bulcke
[9] History of Dharmasastra – P.V. Kane
[10] The Riddle of the Ramayana – C.V. Vaidya





ReplyForward

0 comments: