প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী
Posted in প্রবন্ধ(১)
মধ্য ইউরোপের ড্যানিউব নদীর তীরে এক জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি। মশাল আলোকিত সেনাছাউনিতে বনফায়ারের পাশে উদ্দাম নাচাগানা হচ্ছে । রোমান সেনানায়কেরা কুয়াদিদের বিরুদ্ধে তাঁদের কষ্টার্জিত জয়ের উপলক্ষে উৎসব করছেন। অবাধ খানাপিনা, রাজনর্তকীদের লাস্যময়ী নৃত্য, হাসিঠাট্টা, আরো কত কি! মৌন গম্ভীর ব্ল্যাক ফরেস্টের প্রান্তে উদযাপনের নানা শব্দ, ক্লান্ত ঘোড়াদের হ্রেস্বাধ্বনির সাথে মিশে এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই এতো শব্দময় আয়োজনের মধ্যেও একটি অপেক্ষাকৃত বড় তাঁবুতে যেন এসব কোনকিছুরই স্পর্শ লাগেনি। তাঁবুটির ভেতরের আলোআঁধারিতে দেখা যাচ্ছে এক মধ্যবয়সী রাজপুরুষ খাটের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে তাঁর কোলের ওপর রাখা একটি প্যাপিরাসের দিস্তার ওপর ঝুঁকে পড়ে আত্মমগ্ন হয়ে কি যেন লিখছেন। তাঁর তাঁবুর মধ্যে বিরাজ করছে একটি ধ্যানপূর্ণ প্রশান্তি, অব্যবহিত দূরের অত কোলাহলেও যা ভঙ্গ হচ্ছে না।
হঠাৎ মানুষটি উঠে দাড়ালেন, কাগজের দিস্তাটা হাতে নিয়ে তাঁবুর মধ্যেই পায়চারি করতে করতে পড়তে লাগলেন, "আমি, মার্কস অরেলিয়াস সিজার, আমার পিতামহ ভেরাসের কাছ থেকে শিখেছি মূল্যবোধ। আমার পিতা অ্যানিয়াসের থেকে পেয়েছি বিনয় এবং দৃঢ়তা। আমার মা লুসিলার থেকে পবিত্রতা এবং সংযম। আমি ভাগ্যবান যে মূল্যহীন বাকচাতুরী কিম্বা কুটিল গুহ্যবিদ্যার কবলে কখনও পড়িনি। আমি ধন্য যে চিরকাল আমি উচ্চতর দর্শনের আশ্রয় পেয়ে এসেছি।" বহির্জগতের উন্মত্ত হট্টগোলের মধ্যে তিনি যেন একাগ্রতার একাকী ওয়েসিসে বিরাজ করছেন। মুহূর্তেক থেমে তিনি আবার পাঠ শুরু করলেন, "মার্কস, তুমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভেবো যে আজকে তোমার সাথে যাদের দেখা হবে তারা বেশিরভাগই হয়তো কৃতঘ্ন, চতুর এবং রূঢ় হবে। তারা ঐরকম কারণ তারা এখনও সত্যসুন্দরের খোঁজ পায়নি, ভালমন্দের তফাৎও বোঝেনি। কিন্তু তুমি তো ওরকম নও! তুমি তো সুন্দর-অসুন্দর, ভালমন্দকে ঠিক ঠিক চিনেছ। তাই তুমি ওদের কখনও ঘৃণা করো না, বরং আপন ভ্রাতাজ্ঞানে ভালোবেসো।" অকস্মাৎ প্রহরীর ডাকে তাঁর ধ্যানভঙ্গ হল। "সম্রাট, জরুরি কথা আছে। উত্তরপূর্ব সীমান্ত থেকে খারাপ খবর এসেছে।"
— "কি হল আবার?" কিঞ্চিৎ বিরক্তকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন অরেলিয়াস।
— "বর্বর সার্মেশিয়ানরা থীস নদী পার করে ঢুকে এসেছে। তাদের সঙ্গে ভ্যান্ডলরাও যোগ দিয়েছে। তাদের সাথে প্রচুর সৈন্য রয়েছে। দক্ষিণ গার্মেনিয়ার সামন্তরা বিনাযুদ্ধে আত্নসমর্পণ করেছে।"
— "কিন্তু পূর্বের লাইম ওরা ডিঙলো কি করে? ওই প্রাচীর তো অভেদ্য!"
— "জানিনা সম্রাট, তবে মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যেই কোন বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। না হলে ওই বর্বরদের পক্ষে দুর্লঙ্ঘ্য লাইম টপকানো কিছুতেই সম্ভব হত না।" মার্কস কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মশালের আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর আদেশের সুরে বললেন, "ম্যাক্সিমাসকে বল, আপাতত আসর গোটানোর সময় এসেছে। কাল সূর্য ওঠার আগেই আমরা পুবমুখে রওনা দিচ্ছি।"
সালটা ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে। রোমান সম্রাট এবং স্টোইক দার্শনিক মার্কস অরেলিয়াসের রাজত্বকাল। প্যাক্স রোমানা বা রোমক শান্তিযুগের শেষ সম্রাট তিনি। তাঁর জন্ম ১২১ খ্রিষ্টাব্দে, কুখ্যাত পম্পেই শহরে ভিসুভিয়াসের ছাই তখন সদ্যই ঠান্ডা হয়েছে। শৈশবে পিতাকে হারানোয় পিতামহ ভেরাসের কাছে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। ভেরাস ছিলেন রাজপুরুষ, নাতি মার্কসকে রাজবংশীয় আদব কায়দাতেই বড় করেছিলেন। ১৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কসের কাকা অ্যান্টনিনস্ পিয়স্ রোমান সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। অ্যান্টনিনস অপুত্রক হওয়ায় ভাইপো মার্কসকে দত্তক নিলেন এবং তাঁকেই যুবরাজ ঘোষণা করলেন। শৈশব থেকেই নীতিনিষ্ঠ এবং সত্যবাদী মার্কস ১৬১ খ্রিষ্টাব্দে অ্যান্টনিনসের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনে আসীন হলেন যদিও প্রথমে এতে তার সম্মতি ছিল না। সিংহাসনের প্রতি তাঁর বরং একপ্রকার আতঙ্ক ছিল, পাছে তিনি ক্ষমতার মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন! তিনি চেয়েছিলেন উদাসীন ঋষির মত জীবন কাটাতে কিন্তু স্টোইক কর্তব্যবোধ এবং অন্যদের নির্বন্ধাতিশয্যে তিনি অবশেষে রাজি হয়েছিলেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর ন্যায্য সিংহাসন অ্যান্টনিনসের আরেক দত্তকপুত্র লুশিয়াসের সাথে তিনি ভাগ করে নিলেন, বলা বাহুল্য, লুশিয়াসের সঙ্গে তাঁর কোন রক্তের সম্পর্কই ছিল না। যেখানে রাজত্বের লোভে ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারিই চিরকালের দস্তুর, সেখানে মার্কস সেচ্ছায় তাঁর পাতানো ভাইকে অর্ধেক ক্ষমতা দান করলেন। রোমের ইতিহাসে প্রথমবার একই সিংহাসনে দু'জন সম্রাট আরুঢ় হলেন। সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন রোমান সাম্রাজ্য ভিতরে-বাইরের অশান্তিতে জেরবার হচ্ছিল। একদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অন্তর্কলহ, অন্যদিকে বর্বর গার্মেনিক উপজাতিদের নানা দিক থেকে আক্রমণ — মার্কস পেলেন একটা টলমলে সিংহাসন এবং অস্থির বিপর্যস্ত একটি সাম্রাজ্য। অবশ্য মার্কস-লুশিয়াসের এই যৌথ রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মারকোম্যানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফেরার পথেই লুশিয়াস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকে মার্কসকে একাই বিরাট রোমক সাম্রাজ্য সামলাতে হয় এবং তাঁর গোটা শাসনকাল জুড়েই একের পর এক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।
আগেই বলেছি, অরেলিয়াস ছিলেন স্টোইক দর্শনে বিশ্বাসী এক রাজর্ষি। কৈশোরে দায়োগ্নিতাস এবং পরে সেযুগের নামকরা দার্শনিক অ্যাপোলোনিয়াস ও রাস্টিকাসের কাছে তিনি স্টোইক দর্শনে শিক্ষা পান। মার্কসের মন ছিল স্বভাবত অন্তর্মুখী। বাহ্যজগতের কর্মকাণ্ডের চাইতে দর্শনচিন্তার ধ্যানমগ্নতাই তাঁকে আকর্ষণ করতো বেশি। কিন্তু তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন তাঁকে মধুর নিভৃতিতে দর্শনচর্চা করার সুযোগ দেয়নি, বরং বারংবারই নিক্ষেপ করেছে সুদীর্ঘ রণকলাহলের মাঝে কিম্বা ভয়ঙ্কর মহামারীর দেশব্যাপী প্রলয়ের মধ্যিখানে। তাঁকে দীর্ঘদিন দূরে থাকতে হয়েছে তাঁর প্রিয় পড়ার ঘরটি থেকে। কিন্তু সারা জীবন ধরে প্রতিটা ঝড়ই আরেলিয়াস সামলেছেন অনড় এক স্টোইক দৃঢ়তায়। শুরু থেকেই এসেছে বিপত্তি। যে-বছর মার্কস এবং লুশিয়াস সিংহাসনে বসলেন, সেই বছরের শেষেই টায়বার নদী দু'কুল ছাপিয়ে এক ভীষণ বন্যায় রোমকে প্রায় ভাসিয়ে দিল। বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে গেল। দুই ভাই মিলে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সেই দুর্যোগ কোনক্রমে সামলেছেন, অমনি খবর এলো পূর্বদিক দিয়ে পার্থিয়ান সেনা আর্মেনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। আর্মেনিয়া ছিল রোমের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ। দুঁদে সেনাপতি এবং অনেক যুদ্ধের বিজয়ী বীর সিভিরিয়ারনস্ ছুটলেন সীমান্ত রক্ষা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অসংখ্য যুদ্ধে রোমের বিজয় পতাকা উড়িয়েছেন যে নায়ক, তিনি আরেক বিখ্যাত সেনাপতি পার্থিয়ার কসেরোজের চক্রব্যূহে পড়ে প্রাণত্যাগ করলেন। অরেলিয়াস দুশ্চিন্তায় পড়লেন। শেষমেষ লুশিয়াস নিজেই রওনা দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। এদিকে ব্রিটানিয়া এবং উত্তর গার্মেনিয়া থেকে দুর্ধর্ষ চ্যাটি-রা লাইম টপকে রোমের সীমানায় ঢুকে এলো। একসাথে অনেকগুলি রণমঞ্চ খুলে গেলো। প্রায় কাছাকাছি সময়ে গ্রীসের দিক থেকে আক্রমণ করলো কস্টোবোসাই জনগোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর যোদ্ধার দল। রোমের সীমান্তে ঢোকার আগে তারা ব্যালকান অঞ্চলে তাণ্ডব চালালো। অরেলিয়াস এদেরও জবাব দিলেন। কঠিন যুদ্ধের পর চ্যাটি এবং কস্টোবোসাই হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হল। এরই মধ্যে পার্থিয়ার যুদ্ধ জিতে প্রত্যাবর্তনের পথে রোমান সৈন্য এক ভয়াল বিপদকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো — অ্যান্টয়েন প্লেগ। এই প্লেগ সেযুগের অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে এক ভয়ংকর অতিমারির রূপ নিয়েছিল, নিভিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য জীবনদীপ । এর প্রকোপ রোমের মত সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যকেও অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ এবং মহামারীর কারণে রোমের কোষাগার তলানিতে ঠেকলো। সম্রাট অরেলিয়াস নির্দ্বিধায় রাজকোষের মণিমাণিক্য বিক্রি করে দিলেন। রোম তখনকার মত রক্ষা পেল।
কিন্তু এইসব ভয়ানক প্রতিকূলতার মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ ছিল ভয়াবহ মারকম্যানিয় সংঘর্ষ — গার্মেনিক বর্বরদের সাথে দীর্ঘায়িত এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। এই বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধই অরেলিয়াসের জীবনীশক্তি একেবারে শুষে নিয়েছিল। ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ড্যানিউব নদী পার করে কুয়াদি উপজাতিদের শক্তিশালী বাহিনী রোমের দিকে পা বাড়ালো। অরেলিয়াস জানতেন তাদের উত্তরসীমান্তে না থামালে রোমের রক্ষে নেই। তিনি ছুটলেন ড্যানিউবের উদ্দেশে। দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর লড়াইয়ের শেষে কুয়াদিরা পরাস্ত হল ঠিকই, তবে সাময়িকভাবে। অরেলিয়াস কুয়াদিদের চুক্তিবদ্ধ করলেন। তিনি ভেবেছিলেন কুয়াদি-যুদ্ধের পরে কিছুদিন রোমে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন । কিন্তু তা সম্ভব হল না। ঠিক ওই সময়েই ইরানিয় সার্মেশিয়ানরা বিরাট বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিক থেকে চড়াও হল। অরেলিয়াস দম ফেলার সময় পেলেন না। উত্তরপশ্চিম থেকে ছুটলেন পূর্বসীমান্তের দিকে।
এই ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কুয়াদী যুদ্ধের সময়েই ড্যানিউবের তীরে তাঁবুতে বসে অরেলিয়াস শুরু করলেন তাঁর স্বগত-কথন, Meditations। ১২ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই আশ্চর্য ডায়েরীতে অরেলিয়াস তাঁর স্টোইক উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেছেন, স্বগতোক্তির স্টাইলে। তবে সেই বিষয়ে বলার আগে স্টোইক দর্শন নিয়ে দু'য়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার।
স্টোইক দর্শনের প্রবক্তা মনে করা হয় জীনো নামক এক দার্শনিক যিনি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রীসের এথেন্স শহরে তাঁর মতবাদ প্রচার করেছিলেন। স্টোইক দর্শন আসলে বৈরাগ্যবাদী একটি মতাদর্শ এবং মনে করা হয় সক্রেটিসের বৈরাগ্যবাদী চিন্তাই স্টোইক দর্শনের প্রধান উৎস। তাঁদের বিশ্বাস ছিল এই নিখিল বিশ্বের একটি নির্ধারিত গতি এবং গন্তব্য আছে। স্টোইকরা ব্যক্তি-ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না ঠিকই কিন্তু তাঁরা মনে করতেন মহাবিশ্বের সমস্ত ঘটনার পশ্চাতে একটি আধ্যাত্মিক নিয়মতন্ত্রী আছে এবং সমস্ত ঘটনা পরম্পরাই একটি আধ্যাত্মিক যুক্তি মেনে সংঘটিত হয়। এবং তাই একজন ব্যক্তিমানুষের কর্তব্য হচ্ছে সেই মহতী বিশ্বনিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সেই নিয়মকে অনুধাবন করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা, সমাজ এবং বিশ্বের বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে। ভোগবাদী নয়, বরং মননশীল নীতিনিষ্ঠ অনাসক্ত জীবনই হল ইউদেমোনিয়া বা আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের উপায়। ইউদেমোনিয়াই মনুষ্য জীবনের উচ্চতম আদর্শ। স্টোইকরা মনে করতেন, জীবনের কিছু বিষয়ের উপর মানুষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই, যেমন ধনসম্পদ, লোকমান্য , সুখদুঃখ ইত্যাদি। এগুলিকে তারা বললেন "অ্যাডিয়াফরা।" এই সব ঘটনার প্রতি স্টোইক ঋষি উদাসীন থাকবেন। কিন্তু যে বিষয়টির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ আছে সেটি হল তার নিজের মন। বাহ্য জগৎ তার অধীনে নেই, কিন্তু বাহ্য জগতের অ্যাডিয়াফরার প্রতি মানুষের মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা তার নিজের হাতে। স্টোইক ঋষি তাই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, আবেগ কে করবেন সংযত। জীবনে যাই ঘটুক না কেন মানুষের মন যদি তাতে প্রতিক্রিয়া না করে তাহলে বহির্জগত মানুষের ওপর প্রভাব হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, স্টোইক ঋষি জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আত্মবিশ্লেষণ করবেন। সত্য এবং নৈতিকতার পরিপন্থী যা কিছু তা বিচার করে বর্জন করবেন। ভয়, হতাশা, কামের মত আবেগগুলিকে অযৌক্তিক মনে করে পরিত্যাগ করবেন। জীবনে ভালমন্দ যাই আসুক তাকে বৃহত্তর সেই মহনিয়মের অন্তর্গত জেনে, উচ্চতম আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকবেন কারণ বিশ্ব প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ একটি জীবনই হল শ্রেষ্ঠ জীবন। মোটের উপর স্টোইক দর্শনের এটাই হল নীতিতত্ত্ব। আমাদের নায়ক মার্কস অরেলিয়াস ছিলেন কায়মনোবাক্যে একজন বিবেকবান স্টোইক। তাঁর অন্তর্মুখী মনকে কষ্ট করেই তিনি বিশ্বের কাজে লাগিয়ে রাখতেন। বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্যের সম্রাট তিনি। তাঁর তো নিরিবিলি ধ্যানের মাধুর্যে ডুবে থাকার উপায় নেই। সমগ্র জাতি যে তার মুখপানে চেয়ে আছে! তাঁর এক শিক্ষাগুরু ফ্রন্টো তাঁকে একবার সরাসরি লিখেছিলেন, "যতই তুমি ক্লিন্থেস কিম্বা জীনোর মত জ্ঞানী হয়ে ওঠো না কেন, নিশ্চিন্ত বৈরাগ্যের আলোয়ান তুমি কোনদিন গায়ে দিতে পাবে না।" যেন বলেছিলেন, "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে তোমার নয়।" মার্কসের জীবনেতিহাসের সাথে পরিচিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ফ্রন্টোর কথাগুলি কেমন বর্ণে বর্ণে ফলেছিল।
ফিরে যাওয়া যাক ১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। সমর অভিযানের উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেখতে পাই অরেলিয়াস রাত্রিকালীন বিরতিতে তন্ময় হয়ে কী সব লিখে চলেছেন। "কী লিখছো অরেলিয়াস?" শুধোলেন বৃদ্ধ অনুচর।
— "নিজের মনকে শাসন করছি ক্যাটুলাস। মন যে কিছুতেই কথা শোনে না।" অরেলিয়াস লিখছেন তাঁর মনের কথা, নিজেরই মনকে উদ্দেশ্য করে। বারবার "তুমি" বলে যাকে সম্বোধন করছেন, সেটি তিনি নিজেই, অন্য কেউ নয়। বইটির তিনি কোন নাম দেননি কারণ গ্রন্থপ্রকাশের কোন উদ্দেশ্যই তাঁর ছিল না। পরবর্তিযুগের ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের নাম দেন Meditations। বইয়ের শুরুই অরেলিয়াস করলেন তার পূর্বসূরী এবং গুরুদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। যাঁদের কারণে তিনি 'মার্কস অরেলিয়াস' হয়েছেন তাদের চরণ ছুঁলেন যেন। কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি যেই সুরটা বইয়ের পাতায় পাতায় বাজতে থাকলো তা হল অনাসক্তি — সম্রাটসুলভ বিলাসের প্রতি, খ্যাতির লালসার প্রতি, ক্ষমতার দম্ভের প্রতি এবং যা কিছু তাঁর ন্যায়সংগত অধিকারের বাইরে, সেই সব কিছুর প্রতি এক গভীর অনীহা। অরেলিয়াস লিখলেন, "কত শীঘ্র সব কিছু মুছে যায়, এই মহাবিশ্বের জড়পদার্থ সব, একসময়ে তাদের স্মৃতিও মুছে যায়। হৃদয়, তুমি ভেবে দেখো, এই যে বিশ্বজোড়া সুখদুঃখের ফাঁদ, এই যে ক্ষয়িষ্ণু খ্যাতির লোভ, কি তুচ্ছ, বিস্বাদ, নশ্বর এসব! হৃদয়, তুমি মৃত্যুকে মনে রেখো। আর মনে রেখো, জগতের এই সমস্ত আয়োজনই আসলে প্রকৃতির প্রয়োজনগত।" রাজা হয়েও মনে মনে দার্শনিক তিনি, তাই লিখলেন:
"সময় একটা বিন্দু, জড়বিশ্ব একটা প্রবাহ, শরীর মরণশীল, আত্মা যেন বায়ুঘূর্ণি! অচিন বিদেশে জীবনের এই অভিযাত্রায় আশ্রয় তবে কী? আশ্রয় কেবল প্রজ্ঞা।" জীবনকে অরেলিয়াস দেখেছেন এক আদর্শবাদী দৃষ্টিতে। জীবন তার কাছে আসলে একটি দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তিনি অবলীলায় লিখলেন, "জগৎ একটা রূপান্তরণ, জীবন একটা ধারণা।"..."জীবন সুন্দর, সেই সৌন্দর্য্যকে অবলোকন কর। আকাশের নক্ষত্রদের দেখেছো? তাদের গতির সাথে তাল মিলিয়ে তোমার জীবনও ছুটছে, এই সত্য উপলব্ধি কর।"..."একটি মহৎ জীবনের লক্ষণ হল জীবনের মঙ্গলময় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। এবং এই চেতনায় মানুষ উপনীত হয় কেবল অবিরাম আত্মবীক্ষণের মাধ্যমে। জীবনসত্যের প্রতি কি গভীর প্রত্যয় থাকলে কেউ বলতে পারেন, "এই জগৎটা একটি অতিকায় জীব; জড় এবং চৈতন্য মিলিয়ে একটি প্রকাণ্ড দেহ। সমগ্র সৃষ্টির একটিই উদ্দেশ্য, সেই বিরাট নিয়তির সাথে নিজেদের ক্ষুদ্রতর নিয়তির সামঞ্জস্য রচনা করা।"
সর্বশক্তিমান পৌরাণিক ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর মনে কিছু সংশয় ছিল, এই বিষয়ে তিনি লিখছেন,
"যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন এবং তিনি যদি ন্যায়পরায়ণ হন , তবে তিনি শুধু তোমার কর্মটুকুই দেখবেন, সে তুমি তাঁকে পুজো কর বা নাই কর। আর যদি তিনি থাকেন অথচ ন্যায়পরায়ণ না হন, তবে তাঁকে উপাসনা করার কি প্রয়োজন?" ..."হয় দেবতারা শক্তিমান, না হয় শক্তিহীন। যদি তাঁরা শক্তিহীন হন তবে তাঁদের পুজো করা কেন? আর যদি তাঁরা শক্তিধর হন তবে তাঁদের কাছে এটা-ওটা না চেয়ে, নির্ভীকতা, সহ্যশক্তি এইসব প্রার্থনা কর না কেন? এই সব অর্জন করলে বাইরের কোন শক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজের বুদ্ধির ওপরই তো নির্ভর করতে পারবে!" আর একটি বিষয় এই ডায়েরিতে লক্ষ্য করার মতন — খ্যাতির প্রতি অরেলিয়াসের গভীর অরুচি। ইতিহাসে অমর হওয়ার লোভকে তিনি ঘৃণ্য মনে করতেন। লিখলেন, "এই পৃথিবীর কত যশস্বী বীর আজকে কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। আর যারা তাদের যশের শৃঙ্গে তুলে একদিন উৎসব করেছিল, তারাও আজ সেখানেই চলে গেছে।"..."জীবন অতি নগণ্য একটি বিষয়, পৃথিবীর ততধিক নগণ্য একটি কোণে যা অতিবাহিত হয়। খ্যাতিও তাই অতি তুচ্ছ একটি বস্তু, একদল ক্ষণস্থায়ী নির্বোধ মানুষের বিবেচনার ওপর যা নির্ভরশীল — সেইরকম কিছু মানুষ, যারা ইতিহাসের চরিত্র তো দূরের কথা, নিজেদের চরিত্রকেও ঠিকমত বোঝে না।" এইরকম মন্তব্য তিনি বারবার করেছেন।
Meditations পড়তে পড়তে যে মহাগ্রন্থের কথা প্রায়ই আমার মনে এসেছে সেটি হল ভগবদ্গীতা। একথা সর্বজনবিদিত যে গীতা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে ধর্মশিক্ষা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন রণভূমি। সত্যিই তো, জীবনের সমরাঙ্গণে যে নিষ্কাম কর্মসাধনার কথা বাসুদেব বলেছেন তার জন্য এর চেয়ে সঠিক ব্যাকড্রপ অন্যকিছু হতেই পারত না। "কর্মে তোমার অধিকার, কর্মফলে নয়", দ্বিধাগ্রস্থ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি। কর্মফল মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই, শুধু কর্ম এবং সেই কর্মের প্রতি মনোভাবই তার অধীনে। তাই কর্মফলের প্রতি অনাসক্তিই গীতার মূল বাণী। অনুরূপভাবে Meditations এর রচনাও রণক্ষেত্রে, যদিও এই প্রেক্ষাপটটি অরেলিয়াসের নির্বাচিত ছিল না, বাধ্যতা ছিল। কিন্তু প্রকারান্তরে অরেলিয়াস সেই নিষ্কাম কর্মের কথাই বললেন নিজের মনকে। অ্যাডিয়াফরার প্রতি অনাসক্তিই জীবনের সারকথা। গীতার "স্থিতপ্রজ্ঞই" স্টোইক পরিভাষায় "সফোস", প্রজ্ঞাবান সাধু। এই স্টোইক জীবনদর্শন যে মোটেই জীবনবিমুখ নিষ্ক্রিয়তা নয়, সম্রাট অরেলিয়াসের জীবনই তার সব থেকে বড় প্রমাণ, যা ছিল ধ্যান, আত্মবীক্ষা এবং সংগ্রামের চমকপ্রদ এক সিম্ফনি।
যাই হোক, Meditations লেখা এগিয়ে চলল জীবনের নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে। এরই মধ্যে ১৬৯ সালে ভ্রাতা এবং সহসম্রাট লুশিয়াস মারকোম্যানিদের সাথে যুদ্ধ করে ফেরার পথে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করলেন। অরেলিয়াস গভীর আঘাত পেলেন, কিন্তু রইলেন অটল। শুধু কি তাই, অল্প কিছুদিনের বিরতির পরেই কুয়াদি এবং অন্য গার্মেনিক বর্বরজাতিরা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। স্ত্রী ফস্টিনা এবং রুগ্ন ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে করে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠল সম্রাটের। মনে ভেসে উঠল রোমের প্রাসাদে নিভৃত লাইব্রেরির কোণাটাও। আহা! কতদিন হল বৃষ্টির অলস অপরাহ্নে সেই প্রিয় বাতায়নের পাশে বসে এপিকটেটাস্ পড়া হয়নি! পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো গুরু ফ্রন্টোর সেই ভবিষ্যতবাণী। "কর্তব্যের জোয়াল একবার যখন কাঁধে তুলেছ মার্কস আর তা নামানোর উপায় নেই!" মন না চাইলেও তাঁকে যেতেই হবে। একরাতে তাঁবুতে বসে অরেলিয়াস মনকে বোঝালেন বড় সুন্দর একটি কথা,"গতির প্রতিবন্ধকই গতিকে বাঁচিয়ে রাখে। আজকে বাধাই কালকের উপায়।"
কুয়াদি এবং মারকোম্যানিদের সাথে যুদ্ধ আরো অনেকদিন চলল। এমনিতেই অরেলিয়াসের স্বাস্থ্য কোনোদিন গ্ল্যাডিয়েটরসুলভ ছিল না। তার ওপর দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ক্লান্তি তাঁকে ক্রমশঃ ভগ্নস্বাস্থ্য করে তুললো। এই সবের মধ্যেই ঘটলো আরেক অনর্থ। তাঁর এতদিনের বিশ্বস্ত সেনাপতি মহাবীর ক্যাসিয়াস হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসলেন। অরেলিয়াস মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না, কারণ ক্যাসিয়াস ছিলেন তাঁর নির্ভরতার জায়গা। তিনি যে এইভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করবেন,অরেলিয়াস তা ভাবতেই পারেননি। অনেক বোঝালেন, দূত মারফত সম্প্রীতির বার্তা পাঠালেন। সময় লাগলো এবং শেষ অবধি অরেলিয়াস দক্ষতার সঙ্গে এই সমস্যার সমাধান করলেন বিনাযুদ্ধেই। শুধু তাই নয়, পুরোপুরি ক্ষমা করে দিলেন বন্ধুকে। "একি মার্কস, অত বড় বিশ্বাসঘাতককে তুমি ক্ষমা করে দিলে? প্রতিশোধ নিলে না!" "হ্যাঁ ক্ষমা করে দিলাম। কারণ, সবথেকে বড় প্রতিশোধ কোনটা জানো? তোমার শত্রুর মত না হওয়া" — লিখলেন অরেলিয়াস। অবশ্য ক্যাসিয়াসের শেষরক্ষা হলো না। তাঁর অনুগামীরাই কিছুদিন পর তাঁকে শিরোশ্ছেদ করে হত্যা করল। বিদ্রোহ ধ্বস্ত হল। অরেলিয়াস লিখলেন, "কেউ কি আমার ক্ষতি করেছে? সে নিজে ভেবে দেখুক।
তার কাজ সে স্বয়ং সমীক্ষা করুক। আমি জানি মহাপ্রকৃতির ইচ্ছাশক্তি আমার কাছে কী চায়, আমি তাই করবো যা আমার প্রকৃতি আমার কাছে প্রত্যাশা করে।"
এই সব যুদ্ধবিগ্রহ মিটিয়ে যখন অরেলিয়াস একটু শান্তির আশায় রোমে ফিরছেন, স্ত্রী ফস্টিনার মৃত্যুসংবাদ এসে তাঁকে অন্তর থেকে কাঁপিয়ে দিল। ফস্টিনা ছিলেন মার্কসের বহুদিনের সঙ্গী, তাঁর প্রথম এবং শেষ ভালবাসা। কিন্তু হায়! শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার তাঁকে কুচ করতে হল। উত্তরে গার্মেনিকরা পুনরায় আস্ফালন শুরু করেছে। এবার তাদের শেষ জবাব দিতেই হবে। রোমান সাম্রাজ্য এদের অত্যাচারে বিশ বছর ধরে জর্জরিত, এইবার এর ইতি না টানলেই নয়। আবার আরেক ধীর্ঘ সংগ্রামের জন্য নিজের অবসন্ন দেহমনকে প্রস্তুত করলেন অরেলিয়াস।
(২)
সারা জীবনের মর্মব্যথা মন্থন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু" গানটি, বাঙালিমাত্রেই যা শুনেছেন। একের পর এক শোকের ধাক্কায় কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে, কিন্তু বাইরে থেকে সেই মহাসাগরে আবেগে তরঙ্গোচ্ছাস কখনও দেখা যায়নি। শোকে তিনি বিহ্বল হননি, দুঃখকে তিনি জীবনসাধনায় পরিণত করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দুই সহস্র বছর আগে ইতিহাসের ক্ষীণ আলোকে ঠিক একই রকম আরেকটি মানুষকে আবছা দেখা যায়। আমাদের গল্পের নায়ক মার্কস অরেলিয়াসও মৃত্যুর মহাশূন্যতাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। প্রিয় ভাই লুশিয়াসের অকালপ্রয়াণ তাঁকে বড় একা করে দিয়েছিল। কিছু বছরের ব্যবধানে ফস্টিনাও বিদায় নিলেন। কিন্তু তাঁকে সব থেকে বেশি রিক্ত করেছিল একের পর এক প্রিয় সন্তানের চলে যাওয়া। ফস্টিনা তাঁকে অনেকগুলি সন্তান উপহার দিয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা কেউই স্বাস্থ্যবান ছিল না। অরেলিয়াসের নিজের মৃত্যুর আগে কেবল একটি পুত্রই বেঁচে ছিল, কমোডাস, যিনি অরেলিয়াসের পরে সম্রাট হন। ভাগ্যের কেমন পরিহাস! কমোডাস তাঁর পিতার সুকৃতি অত্যাচার এবং বিলাসের কালিমায় ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু এতো কিছুর মধ্যেও যা সবচেয়ে চমকপ্রদ তা হল অরেলিয়াসের মৃত্যুচিন্তা। জীবনের চাকচিক্যের প্রতি উদাসীন রাজা, মৃত্যুর প্রতিও ছিলেন একই রকম উদাসীন। "মরণ আমাদের দেখে স্মিতহাসি হাসে, আমরা কেবল বিনিময়ে সেই হাসি তার দিকে ছুঁড়ে দিতে পারি।" মৃত্যুর ভয়াবহতা অত কাছ থেকে দেখেও এরকম কথা বলা একজন স্থিতপ্রজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব হয়তো। মৃত্যুকে তিনি মুক্তির রূপেও দেখেছেন, জীবনের এবং জড়ের দাসত্ব থেকে চিরমুক্তি। এক জায়গায় লিখলেন, মৃত্যু হল নিষ্কৃতি। ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে, শরীরের বশ্যতা থেকে নিস্তরণ।" অরেলিয়াস চোখে জীবনের মত মরণও সেই মহানিয়মেরই একটি অধ্যায় — যে নিয়মে গাছে পাতা গজায়, ফুল ফোটে, ফল হয় এবং একসময় সেই গাছ মাটিতে মিশে যায়— মানুষ বিশ্বজীবনের বৃক্ষে একদিন উদয় হয় আবার সময়ের নিয়মে একদিন ঝরেও যায়। "কখনও ভুলে যেও না মার্কস, কত মহান দার্শনিক, কত কীর্তিমান রথী-মহারথী, কত অত্যাচারী একনায়ক, জীবনকে শোষণ করে শেষে মরণেই মিশে গেছে। হেলাইক এবং পম্পেইয়ের মত বৃহৎ গৌরবময় শহর আজ ধূলিধূসরিত। জীবন অতি হ্রস্ব এবং তুচ্ছ জিনিস মার্কস। গতকালের একদলা ঔরস আগামীকালের একমুঠো ছাই। জীবনের প্রতিটি দিন প্রকৃতির সাযুজ্যে কাটিয়ে, মৃত্যু এলে বিনা অনুযোগে চলে যাওয়াই তাই কর্তব্য। তুমি কি দেখনি, প্রকৃতির খেয়ালে গাছে কেমন অলিভ ধরে, পাকে এবং ঝরে যায়। তারা কি কখনও অনুতাপ করে?" মৃত্যু তাঁর কাছে অবকাশও, নতুনকে জায়গা করে দেওয়ার একটি সুযোগ: "তুমি কি পরিবর্তনকে ভয় পাও, মার্কস?", তিনি লিখলেন, "বৃক্ষের যদি পরিবর্তন না হতো, তুমি কি স্নানের উষ্ণতা পেতে?" খাদ্যের যদি রূপান্তর না হতো, তুমি কি দেহের পুষ্টি পেতে? তোমার জন্য যদি পরিবর্তন এতো উপকারী হয়, তবে প্রকৃতির বেলায় কেন ব্যতিক্রম হবে?" মৃত্যুকে এভাবেই নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছেন অরেলিয়াস।…"সৃষ্টি এবং ধ্বংসের চক্র অবিরাম চলেছে। আজ যা সৃষ্টি হচ্ছে কালে তা হচ্ছে নির্বাপিত। গতি এবং পরিবর্তনই বিশ্বকে প্রতিনিয়ত ধারণ করে চলেছে। প্রবহমান সময় জন্ম দিচ্ছে অনন্ত কালচক্রের।".
কালচক্র অন্য ইঙ্গিতও দিচ্ছিল। ফস্টিনার মৃত্যুর পর গার্মেনিকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধের ধাক্কা তাঁর শরীর আর বেশিদিন সইতে পারলো না। ধ্যানশীল সম্রাটের শেষ ধ্যানে ডুবে যাওয়ার হওয়ার সময় এগিয়ে আসছিল। অবশেষে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে, রোম থেকে অনেক দূরে প্যানোনিয়ার এক রণশিবিরে অন্তিমনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাজর্ষি অরেলিয়াস। পিছনে পড়ে রইল তাঁর সাধের পড়ার ঘর, তাঁর নিরুদ্বেগ নিরুত্তাপ জীবনের স্বপ্ন, তাঁর ভালোবাসার রোমা। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে অরেলিয়াস পাড়ি দিলেন তাঁর চিরকাঙ্খিত শান্তির দেশে। যাওয়ার আগে তাঁর বইয়ের শেষ অধ্যায়ের শেষ পাতায় লিখে গেলেন এই আশ্চর্য বাণী: "এবার তবে বিদায় নাও অরেলিয়াস, সন্তোষে পরিপূর্ণ হয়ে বিদায় নাও। কারণ, তোমার যিনি মুক্তিদাতা সেই তিনিও কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ।"
এই বলে রাজা নিশ্চিন্তে ঘুমোলেন।
Khub sundor lekha hoyeche.. Asha korchi aapni aaro likhben....
ReplyDeleteধন্যবাদ। নিশ্চয়ই লেখার চেষ্টা করবো।
Deletebhalo likhaychen
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।
DeleteOpurbo....story telling osadharon
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Delete