undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৭)
অন্নসত্রের বিপুল জনারণ্যে গোলকপতি আজ নিজেকে বড় অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিল।
এবারে অতি ধীর পদে সে রানীমার দানশিবিরের দিকে এগোতে এগোতে ভাবছিল যে, তার পূর্বজরা গৌড়ের রামকেলির কাছে অধিষ্ঠিত যে গয়েশ্বরী বা গৌড়েশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নবাবহাটের মন্দিরটিও যেন তার অনুকৃতি। তবে জনশ্রুতি এই যে মন্দিরের উপাস্য মাতৃকামূর্তিটিই নাকি একদা ওদের 'সেন'বংশেরই উপাস্যা ছিলেন।
এই গৌড়েশ্বরী দেবী শবারূঢ়া, খড়্গ, নরমুণ্ড পানপাত্রধারিণী রূপে অধিষ্ঠিতা হলেও এইপ্রজন্মে এসে দেবী যেন তার প্রতি আজীবন বিরূপ, বিমুখ ও অখুশি । তবে এ ব্যাপারে ওর নিজের কাছেও আজন্মলালিত অপরাধবোধটির সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার জন্য তাকে শুধুই ভাগ্যপীড়িত হয়ে থাকতে হচ্ছে।
ভীষণ মনে পড়ছে যে আচার্য্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী তাকে মাঝেমধ্যে ভীষণ অপত্যস্নেহে 'কুন্ডলিনীতন্ত্রে'র এক একটি অধ্যায় খুলে ব্যাখ্যা করে তার জ্ঞানচিকীর্ষার প্রাবল্যটিকে বেশ উস্কে দিতেন।
তেমনই এক নির্জন চৈত্রের দুপুরে তাকে সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী সেই দেবীমাহাত্ম্য বড় মধুরভাষণে বর্ণনা করে বলে উঠেছিলেন,
- " জেনে রেখ বাবা ! কালী ও উগ্রতারা উভয়েরই সাথে সাদৃশ্য আছে এই গৌড়েশ্বরী পরমা মাতৃকা রূপের। আর এই শক্তিপীঠের বিশেষত্বটি হল যে এখানে নারীগণই কেবল একটি যোনি আকৃতির কুণ্ডে তাদের পূর্বসূরীদের তর্পণ করতে পারেন। এই প্রথা একান্তভাবেই বাঙালির মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অনুসারী। যদিও পূজ্যপাদ বল্লাল সেনের পুত্র মহামহিম লক্ষ্মণসেন পরবর্তীকালে সহজযানী বৈষ্ণব ভাবনার রূপকার ও 'ব্রহ্মক্ষত্রিয়' পথের দিশারী, হলেও তিনি যদি তাঁর কূলধর্মকে যদি সামান্যতম অসম্মান করতে জানতেন তাহলে তাঁর সভাতেই সেদিন কবি জয়দেব বিষ্ণুর অন্যতম অবতার ভগবান বুদ্ধের বন্দনা রচনার সাথে আদিপ্রকৃতি বা শক্তিরূপিণী শ্রীরাধার চরণাশ্রিত কৃষ্ণের লীলাবর্ণনা করে এত খ্যাতি লাভ করে উঠতে পারতেন না!" তারপর একটু থেমে সেই বৃদ্ধ পন্ডিত ও সাধক তাঁর গম্ভীর ভাষ্যে তার উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন -
" শোন গোলকপতি, জানবে কূলধর্ম অস্বীকারে কোন দিন কেউই কখনো অভীষ্টলাভ করে উঠতে সক্ষম হয়নি। যদিও ভাগ্যবিপর্যয়ে তুমি বিবাহবহির্ভূত এক 'মধুরতি'র জাতক হলেও আদতে রক্তের উত্তরধারায় তুমিও যে একজন ' সেন' বংশধর!.. সেকথা যেন কখনও বিস্মৃত হয়ও না...জানবে স্বয়ং দেবী চাইলে একদিন তিনি তোমার বা তোমার কোনও বংশধরের নামে তার বক্ষের রক্তচর্চিত প্রসাদী ১০৮টি বিল্বপত্রের অর্ঘ্য গ্রহণ করবেন! তা সে যতই তোমার অধস্তন পুরুষে এসে সংঘটিত হলেও...এটাই দৈবনির্দিষ্ট!
আর সেদিন সেই রক্তের অঞ্জলিটি দেবেন এক নারী'ই। আহা! মাতৃকাযন্ত্রের গূহ্য উপাচারে নারীর স্পর্শই যে পরমকাঙ্খিত হে.... "!
আবার গলার স্বর একটু নীচে নামিয়ে বৃদ্ধটি তাকে স্পর্শ করে বলেছিলেন - " দেখ! নক্ষত্রসমাবেশ দেখে আমি এসবের যেটুকু জানি আজ তোমাকে অগ্রিম কেবল জানিয়ে রাখলাম মাত্র! "
.....
আজ নবাবহাটের অন্নসত্রে দাঁড়িয়ে গোলকপতি বুঝতে পারে যে তার ভাগ্য তাকে অজস্র বঞ্চনার পথে এগিয়ে দিলেও তার কূলদেবী গৌড়েশ্বরীর অলক্ষ্য লীলায় আজ সে এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সে কিছুতেই ভুলতে পারছেনা যে একজন 'বল্লালী' হয়েও আজ বর্ধমানের রাণীমার কাছে দাঁড়ানো নিছক এক জীবিকা প্রত্যাশী নিছক অসহায় 'ভঙ্গকূলীন' নয়!
.........
অন্ন ও অর্থ প্রত্যাশীদের ভীড় একটু হাল্কা হলে সে এতক্ষণে দ্বিধাজড়িত পায়ে রাণীমার কাছে এসে মাথা নীচু করে খানিক দাঁড়িয়ে থাকে। গোলকপতি অতি কন্দর্প্যকান্তি যুবাপুরুষ না হলেও তার স্বাস্থ্য মজবুত ও দেহবর্ণটি ঈষৎ পিঙ্গলবর্ণের।
তার মুখশ্রীটি তাকে সাধারণ বর্ধমানবাসীদের থেকে খুব সহজেই আলাদা করে দেয়। অন্যপ্রান্তে রাণীমাও সেই সুদূর পঞ্জাব প্রদেশের জাতিকা বলে বঙ্গালে এসেও বিবাহপরবর্তী আর পাঁচটা আদবকায়দার সাথে তাঁর মুখে 'বঙ্গালী' লবজের সাথে ফেলে আসা পঞ্চনদের তীরের সুবিস্তৃত সেই স্বর্ণবর্ণী শস্যক্ষেত্রের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেই যায়।
গোলকের আচরণে একটা জড়তার আবহ মহারাণী বিষণকুমারীকে একটু বিস্মিত করল। সাধারণ কৃপাপ্রার্থীদের জড়তা এটা নয়। যেন একটি স্বপ্নময় আধারকে কেউ যেন খামখা বলপূর্বক এক অজাচিত জীবনপ্রবাহে বন্দী করে রাখলে যেমন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, এই যুবকটির বহিরঙ্গে যেন তারই ছায়া দেখতে পেলেন।
.....
নির্বোধ, শঠ, অনুগত ও নিস্পৃহ এই চারটি চরম স্বভাবের মানব চরিত্র তিনি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আজকাল বড় সহজেই নির্ণয় করে উঠতে পারেন এমনকি সেই ক্ষমতার জোরেই তিনি নিজের পুত্র ও বর্তমানে বর্ধমানরাজ মহারাজ তেজচন্দ্রের সম্ভাব্য খল-পরিকল্পনাগুলির বিষয়ে ঠিক আগে থেকে বুঝে যান বলে স্বয়ং তেজচন্দ্রও সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে দ্বৈরথে নামতে পারেন না ও আড়াল থেকে কেবল নানা কলকাঠি নেড়েই ক্ষান্ত হন।
রাণীমা অন্য সব কৃপাপ্রার্থীদের কিছু মোহর আর বহুবিধ শস্যসামগ্রীর সিধাটি নিয়ে সবাইকে এবার মন্দিরের প্রসাদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন, কেবল গোলকপতির দিকে তাকিয়ে তাকে ইশারা করলেন এই ভীড় হাল্কা হওয়া অবধি আর একটু অপেক্ষা করতে। উনি বুঝতে পেরেছেন যে এই যুবাটি নিছক তোষাখানার কিছু দানসামগ্রীর লোভে এখানে দাঁড়িয়ে নেই।
উনি নিজে যুবাটিকে ইশারা করতেই যখন গোলকপতির দৃষ্টিতে একটা স্বস্তির পরিবর্তন দেখতে পেলেন তখন তিনিও তাঁর আন্দাজটি যেন সঠিকভাবে পেয়ে একটু আশ্বস্ত হলেন।
তাহলে এই ছেলেটি কি তেজচন্দ্র বা ইংরেজদের কাছ থেকে এমন কোন গোপন খবর পেয়ে নিশ্চয় তাঁকে জানাতে এসে কিছু পারিশ্রমিক বা সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে!
0 comments: