ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক১৮.২
গ্রামসভার প্রধান হতে হলে শনিচরকে আগে জনগণকে বোঝাতে হবে—দেখ ভাইলোগ, আমি কিন্তু কারও চেয়ে কম ধূর্ত নই। আমাকে নেহাত ভালমানুষ ভেবে ভোট না দেয়ার ভুল করে বোস না যেন!
ও ভাবছিল যে গাঁয়ে কোন বড় কাজ করে দেখাবে। রঙ্গনাথের থেকে শুনেছে ভোটের আগে বড় বড় নেতারা নিজের নির্বাচন ক্ষেত্রে কোত্থেকে যেন কী এক কায়দায় টাকার বাণ্ডিল ঠেলাগাড়ি করে নিয়ে যায়। তারপর জনকল্যাণের নামে ওসব নর্দমায় ফেলে দেয়। শনিচরও অমনই কোন ম্যাজিক দেখাবে। এসব ও বৈদ্যজী মহারাজকে জানায় নি। শেষে এই কাজের জন্য কালিকাপ্রসাদ নামের এক ‘গঞ্জহা’কে নিজের দোসর বানিয়ে ফেলল।
কালিকাপ্রসাদের পেশা হল সরকারি গ্রান্ট এবং ঋণ গিলে ফেলা। ও সরকারের পয়সার ভরসায় এবং সরকারি পয়সার জন্যে বাঁচত। এই পেশায় সাহায্য পেত তিনজনের থেকে--এই অঞ্চলের এম এল এ; খদ্দরের পোশাক এবং এই কথাটি---‘ না না, এখন টাকা ফেরতের কথাই বলবেন না। আপনার যাতে ঋণ আদায়ের কাজ কিছুদিন চেপে রাখতে অসুবিধে না হয় তার জন্য উপরমহলে দরখাস্ত করে দিয়েছি’।
আমার চোখে ও হল গাঁয়ের সবচেয়ে আধুনিক লোক। কারণ ওর পেশাটি আধুনিক কালের। ও একেবারেই প্রেমচন্দের গল্পের নায়ক নয় যে খাজনা আদায়ের সরকারি আমলাকে দেখলে ঘাবড়ে গিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়বে আর বৌকে বলবে—দরজায় যম দাঁড়িয়ে আছে।
ও সেইরকম নায়ক যার বাড়িতে হাজার টাকা আদায়ের জন্য বাড়িঘর নীলাম করতে সরকারি আমিন এসেছে। তবে আমিন দাঁড়িয়েছে বারান্দার নীচে আর খোশামদ করছে, কিন্তু আমাদের নায়ক বারান্দায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রয়েছে। উলটে আমিনকে বলছে—‘আপনার নীলাম বন্ধ করতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলুন, উপর থেকে লিখিয়ে আনি’!
কালিকাপ্রসাদের পুরো কর্মযোগ সরকারি স্কীমের ফিলজফির উপর টিকে রয়েছে। যেমন, মুর্গীপালনের জন্য গ্রান্ট দেয়ার স্কীম বেরোল তো ও ঘোষণা করল-- মুর্গী পুষবে। একদিন ও বলে দিল---‘জাতপাত সব ফালতু। বামুন হই বা চামার, আমরা সব্বাই এক’।
এর পেছনের কারণটা হল সরকার চামড়া পালিশের জন্য গ্রান্ট দেবে বলেছে। ব্যস্, চামারের দল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এদিকে কালিকাপ্রসাদ চামড়ার গ্রান্ট আদায় করে নিজের গায়ের চামড়া আরও চকচকে করে ফেলল। এইভাবে ও একের পর এক জৈবসার তৈরির গর্তকে পাকা করার, ঘরে ঘরে ধোঁয়াহীন উনুন লাগানোর এবং নতুন ধরনের পায়খানা বানানোর গ্রান্ট আদায় করে ফেলল। সরকার কাজ কতদূর হয়েছে জানতে চাওয়ায় ও অনায়াসে যেমন রিপোর্ট চাই তেমনটি লিখে জমা করে দিল।
একই অবস্থা সরকারি কর্জা এবং তাকাভি বা চাষের জন্য নেয়া নগদ ঋণের। ওর ছিল পাঁচ বিঘে জমি। সেটাকেই জামিন রেখে পঞ্চাশ রকমের ঋণ নেয়া হয়েছে। তিনি প্রত্যেক সরকারি যোজনাতেই ঋণের টাকা নগদে চান, প্রত্যেক হাকিম তাঁকে নগদে দেয়ার সুপারিশ করেন, প্রত্যেকবার ওকে নগদ ঋণ দেয়া হয় এবং প্রত্যেকবার টাকা আদায়ের সময় সরকারি কদম উপরের নির্দেশে থেমে যায়।
ওর জ্ঞান ছিল বিপুল এবং বিশদ। যোজনা আয়োগ গ্রান্ট বা ঋণ দেবার জন্য কোন নতুন স্কীম খালি ছকে ফেলার দেরি, দেখা যাবে শ্রীমান এর মধ্যেই সেটার হাড়হদ্দ জেনে বসে আছেন। হতে পারে ওর চালচলন খানিকটা গেঁয়ো, কিন্তু যেসব ব্যবসায়ীরা নতুন বাজেট আসার আগেই ট্যাক্সএর খুঁটিনাটি জানতে পারে – উনি তাদের থেকে চতুর। উপর থেকে টাকা পয়সার স্যাংশন আসার আগেই দরখাস্ত নিয়ে জেলা- অফিসে হাজির। দেখা যাবে, আগামী দিনে কী কী নতুন স্কীম আসছে ও সেসব হাকিমদেরও বুঝিয়ে ছেড়েছে!
এমনই কালিকাপ্রসাদ এখন শনিচরের নতুন সহকারী।
গোড়ার দিকে যে ময়দানের কথা বলেছিলাম তার সবটাই ভূদান যজ্ঞে আহুতি দেয়া হয়নি। একটা টুকরো বেঁচে গেছল। তার বেশিরভাগই এবড়োখেবড়ো, যেটুকু সমতল সেটাও রুক্ষ্ম উষর। কিন্তু সরকারি কাগজপত্তরে সবটাই ‘উদ্যান’। জমিটির দশমুখী ব্যক্তিত্ব, তাই বিগত কয়েক বছর ধরে ওই জমি নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতি বছর গাঁয়ে ‘বন-মহোৎসব’ পালন করা হয়। ভুল বুঝবেন না, এরমানে জঙ্গলে পিকনিক নয়, বরং উষর জমিতে বৃক্ষরোপণ। কখনও কখনও তহসীলদার সাহেব এবং বিডিও সাহেব লোকলস্কর নিয়ে মহাসমারোহে এখানে গাছ লাগাতে আসেন।
ওই জমির টুকরোকে কলেজের সম্পত্তি দেখিয়ে ইন্টারমিডিয়েট স্তরে কৃষি বিজ্ঞানের শাখা খোলা হল। ওটাকেই খেলার মাঠ দেখিয়ে শিবপালগঞ্জ গ্রামের নবযুবকদের যুবক-মঙ্গল-দলের নামে গ্রান্ট পাওয়া গেল। এই জমিটাকে শনিচর নির্বাচনের আগে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে পছন্দ করল।
গ্রামসভার প্রধান পদের নির্বাচনের প্রায় একমাস বাকি। একদিন ছোটে পালোয়ান বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় বলল, ‘শনিচর তিনদিন ধরে কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকে খবর পাওয়া গেল যে মামলা সেট হয়ে গেছে’।
বৈদ্যজী তক্তপোষে সমাসীন ছিলেন। খবরটা শুনতেই মনের ভেতরে কৌতুহল ছটফটিয়ে উঠল। কিন্তু বেশি আগ্রহ দেখানো আর ‘ছোটে’কে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করা—দুটোই ওনার সম্মানের পক্ষে অনুচিত। তাই উনি রঙ্গনাথকে বললেন—‘শনিচরকে ডেকে আনা হোক’।
ছোটে পালোয়ান নিজের জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থাতেই হাঁক পাড়ল—‘ শনিচর, শনিচর, শনিচর হো-ও-ও’!
যে লোকটি দৃষ্টিপথের এবং হাতের নাগালের বাইরে, তাদের ডাকার জন্যে শিবপালগঞ্জে এক বিশেষ পদ্ধতি প্রচলিত। এই পদ্ধতির প্রয়োগের জন্য তিনটে জিনিস দরকার—গলার নির্লজ্জ জোর, মজবুত ফুসফুস আর বিশুদ্ধ গোঁয়ার্তুমি। এই পদ্ধতির প্রয়োগের পেছনে পাক্কা বিশ্বাস হল যাকে ডাকা হচ্ছে সে যেখানেই থাকুক, তিনডাকের মধ্যে একবার তো শুনতে পাবে। যদি নাও শোনে, দ্বিতীয়বার যখন ডাক দেয়া হবে তখন তো শুনবেই। কারণ, দ্বিতীয়বারে তার নাম ডাকা হবে এভাবে—‘আরে কোথায় মরে গেলি রে! শনিচরা, শনিচরা রে’!
যেভাবে কোন ভদ্রতা ছাড়াই ছোটে পালোয়ান শনিচরকে ডাক দিল, সে ব্যাটাও ডাক শোনা মাত্র অমনই ভাবে বৈদ্যজীর দরবারে হাজির হল। ওর আণ্ডারওয়ার বিশেষ জায়গায় ফাটা, খালি গা, তবে চুল সরষের তেলে চপচপে। মুখের ভাব বেশ হাসিখুশি। এটা বোঝা মুশকিল যে কোনটার হাঁ বেশি বড়—মুখের নাকি আন্ডারওয়ারের?
এটা বলার তাৎপর্য এই যে শনিচরের মুখের বর্তমান চেহারা প্রমাণিত করছে --আমাদের মনে আনন্দ থাকলে দারিদ্র্য আমাদের দুখী করতে পারে না। অতএব, গরীবী হটাও প্রকল্পের সার কথা হল আমাদের হাসিখুশি থাকতে হবে, তবে না!
বৈদ্যজী প্রশ্ন করলেন—কী সমাচার শনিচর? শুনলাম, শহরে গিয়ে খুব কৃতিত্ব দেখিয়েছ?
শনিচর বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ মহারাজ। আমাকে বাধ্য হয়ে অনেক কৃতিত্ব দেখাতে হল। যখন সবদিক থেকে কৃতিত্ব, খুব কৃতিত্ব দেখালাম, তখন গিয়ে ‘খাপে খাপ পঞ্চার বাপ’ হল।
রঙ্গনাথের আর সহ্য হল না।
--‘আরে হেঁয়ালির ভাষা ছেড়ে আসল কথাটা বল; হয়েছেটা কী’
শনিচর দাঁত চেপে শিস টেনে বলল,’রঙ্গনাথ বাবু, এসব গঞ্জহাদের হেঁয়ালি। এত সহজে বুঝতে পারবে না’। কিন্তু এসব বলার পরে ও অল ইন্ডিয়া রেডিও’র খবর পরার ঢঙে একের পর এক হেডলাইন ও ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু করল।
--‘গুরু মহারাজ, ওই লোকটা, যার নাম কালিকাপ্রসাদ, ও কিন্তু মহা হারামী’। কথাটা এমনভাবে বলল যেন কালিকাপ্রসাদকে পদ্মশ্রী উপাধি দেয়া হচ্ছে।
‘হাকিমের থেকে নিজের পছন্দমত রায় পেতে মুখের চেহারা কালিকাপ্রসাদের মত হওয়া চাই। দরকার পড়লে ও বড় বড় ভাষণ ঝাড়তে পারে, কান-লেজ সব নাচিয়ে মুখ থেকে আগুন ছড়াতে পারে। এক নিঃশ্বাসে পাঁচ-পাঁচ সাত-সাত এমএলে’র নাম নিতে পারে। আর হাকিম বেচারার মুখ খোলা থাকে, বন্ধ হয় না। ওই সময় কেউ কালিকাপ্রসাদের লাগাম টেনে ধরুক দেখি!
‘কিন্তু মহারাজ, ওই কালিকাপ্রসাদ যদি কোন এঁড়ে হাকিমের মুখোমুখি হয়, তখন প্রথমেই কেঁচোর মতন নরম এবং বাঁকাচোরা হয়ে যায়। বলব কি মহারাজ! মাটির দিকে চোখ রেখে এমন ভূ-দানী নমস্কার করে যে হাকিমও ভাবতে থাকে লোকটা কে? বিকাশভাই নাকি প্রকাশভাই? বুদ্ধিতে চাণক্য কিন্তু এমন ভোঁদা চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে যে কারও সাধ্যি নেই ওর আসল রূপ টের পায় ! বড় বড় বুদ্ধিমান ওকে বোকা ভেবে খারিজ করে দেয়। আর তখনই ও পেছন ত্থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
‘আর গুরু মহারাজ, ওর দাঁও-প্যাঁচেরও বলিহারি! এ-হে- হে! সরকারি অফিসে চাপরাশি থেকে বড়বাবু, আর বড়বাবু থেকে হাকিম—সর্বত্র ওর অবাধগতি। ও একটি ঘুণপোকা, পাক্কা ঘুণ! যে ফাইলটা বলবেন সেটাতেই ঢুকে চেটেপুটে বেরিয়ে আসবে।
‘শিবপালগঞ্জের মুখ উজ্বল করেছে।
‘গুরু মহারাজ, আমাকেও বেশ কেরদানি দেখাতে হয়েছে। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ না থাকলে আমি টানাটানি করে একগাছি ছিঁড়তে পারতাম না। ও নিজেও আমার সঙ্গে থেকে তিনদিন ধরে গোটা শহর চষে বেড়িয়েছে। এমন হয়েছে যে বড় বড় রিকশাওলাও হার মেনে গেছে।ও কিন্তু তৈরি, বলে এখানে কাজ না হলে চলো ওখানে যাই। ওখানে না হলে ফের সেখানে চলো। পুরো শহরের নকশা মুখস্থ হয়ে গেল!
‘গুরুজী, কিছু আক্কেল তো আমারও আছে। বলতে গেলে বুদ্ধিটা আমারই। তার জেরে গাড়ি লাইনে এল। কিন্তু সেটা চালাতে লাগল কালিকাপ্রসাদ। আপনার দরবারে ওঠ-বোস করে করে আমিও কিছু দাঁও-প্যাঁচ শিখেছি। কথায় বলে—কুস্তির আখড়ায় রোজ লাথি খাওয়া লোকও একদিন পালোয়ান হয়ে ওঠে। বদ্রী ভাইয়ার আখড়া থেকে যেমন ছোটে পালোয়ান হয়েছে। তেমনই কিছু বিদ্যা আমার পেটেও ঢুকেছে।
‘ তো জানতে পারলাম যে আজকাল সমবায় আন্দোলনের হাওয়া বইছে। ব্লক অফিস থেকে একজন এডিও* এসে বলল—নিজের চাষের জমিকে ‘নিজের’ বলবে না। সবার খেতকে তোমার খেত বলো আর নিজের খেতটিকে সবার খেত বল। তবে গিয়ে সমবায় চাষ সম্ভব হবে আর খুব ফসল ফলবে।
‘আমি বললাম—এ তো মন্দ নয়! আমি গ্রামসভার প্রধান হয়ে গেলে সমস্ত খেত সরকারকে দিয়ে দেব। বলব-- নাও, সমবায় চাষ কর।
কিন্তু এডিও বলল—সরকার তোমার খেত নিয়ে কী করবে? চাষের খেত কী কল-কারখানা? খেত তোমারই থাকবে, চাষ তুমিই করবে। একটু কাগজের পেট ভরে দাও, তাহলেই চাষবাস সরকারি হয়ে যাবে। গাঁয়ে কু-অপারেটিব ফারম খুলে যাবে। শিবপালগঞ্জ সব বাপারে এগিয়ে। এই বিষয়েও সবার আগে হবে।
‘গুরু মহারাজ! আমি ভাবলাম, শিবপালগঞ্জ এগিয়ে যাক কি পিছিয়ে—আমাকে তো গুরু মহাআরাজের হুকুম মেনে চলতে হবে। প্রধান হবার জন্য দাঁড়িয়েছি, তো প্রধান হয়েই ছাড়ব। আমি এডিওকে বললাম- সাহেব, শিবপালগঞ্জকে কতটুকু চিনেছ? আমাদের পেচ্ছাপ কারও থেকে পাতলা নয়। আমরা সব ব্যাপারে এগিয়ে আছি, এগিয়ে থাকব। তাই এডিও সাহেবকে আমড়াগাছি করে বললাম—মামলা শুকনো, নাকি ভেজা? ও স্বীকার করল।
‘তখনই গুরুজী, আমার কালিকাপ্রসাদের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম—হে বজরঙ্গবলী! তুমি কালিকাপ্রসাদকে তো উজাড় করে দিয়েছ। এবার তোমার ভক্ত এই বাঁদরটার কিছু গতি করে দাও। সব টাকাপয়সা কেবল কালিকাপ্রসাদের ঘরের দিকেই ছুটে যায় কেন? বজরঙ্গবলী, একবার আমার ঘরের পথেও কিছু পাঠাও”।
* এডিও=এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট অফিসার।
‘ব্যস্, বজরঙ্গবলীর ধ্যান করে লাল ল্যাঙোট বেঁধে আমিও কালিকাপ্রসাদের ঘরে হাজির। কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে কোন ছ্যাঁচড়ামি করিনি। নিজেকে বললাম-বেটা শনিচর, ‘খুল্লা খেল ফারুকাবাদী’ খেলো! তবে কাজ হবে। আমরা দুজনে মিলে এমন এক ইস্কীম বানালাম যে ব্লকের এডিও-ফেডিও সবার হাগু নরম, পেট সাফ। এডিও পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন—এই না হলে গঞ্জহা! কাল কথা হয়েছে আর আজ ইস্কীম তৈয়ার।
‘গুরুজী, হয়েছে কি এই গাঁয়ে একটা কুওপারেটিব ফার্ম খুলবে। এ তল্লাটে কোথাও এই ফারম নেই। পশ্চিম দিকের উষর জমিতে ফারম দুলে উঠবে। উষর হয়েছে তো কী! কাগজপত্তরের কাজগুলো ব্লকওলারা সামলে নেবে। কাগজের ব্যাপারে ওরা তহসীল অফিস বা থানাদারের বাপ! বলুন তো আকাশে কুওপারেটিব বানিয়ে দেবে, এ তো সামান্য ধরতীর মামলা।
‘শহরে গিয়ে সব ফিট করে এসেছি। ভাবলাম, আপনি তো গত বছর কলেজে এক মিনিস্টারকে ধরে এনেছিলেন। এবার আমিও এক মিনিস্টার আনবো। তবে এই কাজটা আপনি ছুঁয়ে না দিলে হবে না। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ বলল—এর জন্য মিনিস্টার কেন, হাকিমকে পটাও। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।
‘এরপর তো সব কালিকাপ্রসাদের এলেম। শহরের নানা জায়গায় ঘুরে ও কখনও মুখ থেকে আগুন উগরে দিচ্ছে , তো কখনও একেবারে কেঁচো হয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। ওখানে টের পেলাম কালিকার কেমন চেনাজানা! কত জায়গায়! ও ঠিক বলেছে – যাই হোক, হাকিমই সব । ও এমন একজন হাকিমকে পাকড়েছে যার খুব মালা পরার ও লেকচার দেয়ার শখ। সকাল থেকে গলায় দশটা মালা চড়ার আগে ও দাঁতন করে না। আছোঁচা মুখে বসে থাকে।
‘তাহলে গুরুজী, মাথায় তো দশটা কাজের বোঝা চাপিয়েছি। তিন দিনের পরেই এখানে ফারমের সভা হবে। সামনে আপনিই থাকবেন। জলসা-বাদ্যি, মালা-সামিয়ানা, ফটো-টটো এসব ব্লকওলারা সামলে নেবে। কিন্তু আমাদেরও জোরদার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার ব্যাপারে মটর-ঘুগনিতেই কাজ চলে যাবে। হাকিম বলেছেন উনি চাষিদের সঙ্গে বসে চাষিদের মত করে খাবেন। আমরা বুঝেছি- গুরু, যার মত করেই খাও, আসলে তুমি না খেয়ে ছাড়বে না! মটর তো শহর থেকে আনাতে হবে, এখানে মটর কোথায়’?
শনিচর তো জলসার ব্যবস্থার কথায় মত্ত, ছোটে পালোয়ান দিল ধমক।
--‘এবার মটর নিয়ে সটর সটর থামাও। কাজের কথা বল। হাতে কী এল’?
শনিচর নিস্পৃহভঙ্গীতে বলল, ‘আমার হাতে কী আসবে, পালোয়ান? যে সুসাইটি তৈরি হবে ফারমের কাজ শুরু করতে ওকে পাঁচশ’ টাকা দিতে হবে। সব জায়গায় এটাই রেট। যা পাওয়ার, সুসাইটি পাবে’।
ছোটে পালোয়ান ঠা-ঠা করে হাসল। ‘ বাহ্ রে বেটা মঙ্গলদাস! কী কথাই না শোনালে! কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ’!
বৈদ্যজী প্রসন্নচিত্তে সব শুনছিলেন। ওনাকে দেখেই মনে হচ্ছে ভবিষ্যত উজ্বল। উনি পঞ্চতন্ত্রের স্টাইলে একটা কিসসা শুনিয়ে শনিচরের তারিফ করে বললেন—বাঘের বাচ্চা প্রথম বার শিকার করতে বেরিয়ে একলাফে একটা সম্বর হরিণ মেরে এনেছে।
(চলবে)
0 comments: