0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব-২১

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে
(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-দ্বিতীয় অংশ


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র এই অন্তর্দ্বন্দের সুযোগে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছিল তাই নয় তারা এই সুযোগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেছিল এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছিল।এর আর একটা বড় কারণ হলো যে পারস্পরিক সংঘাত আন্তঃরাজ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছিল। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত পিটসের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী যদিও সামরিকখাতে ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত রেখে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসাবৃদ্ধির উপরে গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনকে কার্যতঃ খারিজ করে দিল। ওয়েলেসলির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। নিজেকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে দেখার স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিল সে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ইজিপ্ট এবং সিরিয়া আক্রমণ এবং অধিগ্রহণের চেষ্টা ওয়েলেসলিকে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকারকে ভারত অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহমত হবার জন্য। যদিও কারণ হিসাবে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল ওয়েলেসলি কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করতো যে ইজপ্ট থেকে স্থলপথে অথবা কেপ অফ গুড হোপের দিক থেকে জলপথে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা সেই সময় ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারে অনীহাকে মাথায় রেখে ওয়েলেসলি ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথা প্রস্তাব করে যাতে বলা হয় কোম্পানি কেবলমাত্র রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করবে কিন্তু রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেবে না। ওয়েলেসলির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ভারতে কর্মরত অন্যান্য ব্রিটিশ আমলারাও সহযোগিতা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলে যে ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের ব্যবসা করার পরিবেশ অনুকূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যে আবশ্যিক সে কথা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত তখন সেটাকে ভয়ঙ্কর বলে আবার যখন পরিস্থিতি শান্ত তখন সেখানে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে বিপথে চালিত করেছিল ওয়েলেসলি। তবে ব্রিটিশ সরকারের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এতটা নির্বোধ ছিলনা যে তারা কিছু না ভেবে ওয়েলেসলির এই কর্মকান্ডে মদত দিয়েছিল। অন্য কোনও ইউরোপিয়ন শক্তি যেন কোনওভাবেই ভারতবর্ষ দখল করতে না পারে তার জন্য ওয়েলেসলিকে সবরকম মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়লো তখন ওয়েলেসলিকে দেশে ফিরিয়ে নিল ব্রিটিশ সরকার। সেটা ছিল ১৮০৫ সাল।

এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন মাইসোরে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটিশদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। ওদিকে মাইসোরের সীমানা উত্তরে কৃষ্ণা এবং পশ্চিমে মালাবার উপকূল অবধি এগিয়ে গেল। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য মূলতঃ হায়দ্রাবাদ এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। এই রাজ্যগুলি প্রায়শই ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করতো। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হত এই ভেবে যে মাইসোরের পিছনে ফরাসিদের সমর্থন আছে। কিন্তু এই আতঙ্ক অযৌক্তিক ছিল। মালাবার উপত্যকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে মাইসোরের নিয়ন্ত্রন ব্রিটিশরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গোলমরিচ এবং এলাচের ব্যবসা ছিল মাইসোরের নিয়ন্ত্রনে। ১৭৮৫ সালে টিপু সুলতান গোলমরিচ, এলাচ এবং চন্দনকাঠের আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৮৮ সালে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছে মাইসোরের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রইলো না। কিন্তু টিপু সুলতান তখন মাইসোরকে কেন্দ্র করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। টমাস মুনরো এবং আলেক্সান্ডার রিডের মত কমবয়সী সামরিক আধিকারিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যদিও অসামরিক প্রশাসকেরা ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তারাও কিছুদিনের মধ্যেই বিপদের আঁচ পেয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং পরবর্তীকালে ওয়েলেসলির সঙ্গে ভারতের মানচিত্র থেকে মাইসোরের চিরকালীন বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য জানাল। তারপর চারদফা যুদ্ধের পর ১৭৯৯ সালে মাইসোরের দখল নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। প্রথম যুদ্ধে(১৭৬৭-৬৯) মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হায়দার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে আবার ১৭৯০ সালে তৃতীয় দফার যুদ্ধে এই দুই ভারতীয় শক্তি ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশের নেতৃত্বে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশদের আর এক মিত্র রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করেছিল টিপু সুলতান। এই যুদ্ধে ডিন্দিগুল, বারামহল এবং মালাবারকে মাইসোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশ। এর কিছুদিন পরে ফরাসিদের সাময়িক উত্থান এবং তাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের গোপন আলোচনাকে অজুহাত করে মাইসোর আক্রমণ করে ওয়েলেসলি। এই ঔপিনিবেশিক আগ্রাসনের যুদ্ধে মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপট্টম দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শ্রীরঙ্গাপট্টম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় টিপু সুলতান। মাইসোরকে আবার নিয়ে আসা হয় ওয়েলেসলির অনুগত ওয়েদার রাজবংশের অধীনে। মাইসোর হারালো তার স্বাধীনতা চিরকালের মতো। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত চুক্তি অনুযায়ী মাইসোর অন্য কোনও ইউরোপিয়ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। মাইসোরের রাজদরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্থায়ীভাবে থাকবে এবং তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে মাইসোরের রাজা। এই চুক্তির অধীনে থাকতে সম্মত হওয়ার জন্য মাইসোরের কিছু অংশ হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে বোম্বে এবং গুজরাতের মধ্যে দিয়ে চিনের সঙ্গে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান তুলার ব্যবসা তাদের ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। রাজত্বের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক পারিবারিক বিবাদকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা ঐ অঞ্চলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। রঘুনাথ রাও চক্রান্ত করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পেশোয়া নারায়ণ রাওকে হত্যা করলে ঐ অঞ্চলের মারাঠা সর্দারদের রোষের মুখে পড়ে এবং বাঁচবার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৫ সালে রঘুনাথের বাহিনী গুজরাতে বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হয় এবং তাকে উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ এবং বোম্বে থেকে বিশাল সেনাবাহিনী গুজরাতে এসে পৌঁছোয়। রঘুনাথের বিরোধীরা কোম্পানিকে রঘুনাথের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সর্তে বেশ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার প্রস্তাব করে পুরন্দর শান্তিচুক্তির খসড়া পেশ করে। কিন্তু পুরন্দর চুক্তি কলকাতার কোম্পানি অধিকর্তারা বাতিল করে দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মারঠারা নানা ফাডনিস, সিন্ধিয়া এবং হোলকারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াদগাঁও এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে। এরপর বাঙলা থেকে বিশাল বাহিনী এসে এলাকা পুনরুদ্ধার করে। নানা ফাডনিস এবং ভোঁসলে পরিবার ১৭৮১ সালে নিজাম এবং হায়দার আলির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু ১৭৮২ সালে এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের অনুকূলে যায় এবং ১৭৮২ সালে সালবাই চুক্তির মধ্য দিয়ে মারাঠারা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং মাইসোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিতে সম্মত হয়।              

0 comments: