0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







৩. শহীদুল জহিরের ছোটগল্প: বিষয় ও বৈচিত্র্যে


হৃদীবরেষু সুস্মি,

গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। মাত্র সাত মাসেই ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন ঐকতানে অভাবনীয় পতন হয়েছে সেই সরকারের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ ২০২১ সালের আফগানিস্তান পরিস্থিতি ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়। তখন গণ-আন্দোলনের মুখে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশত্যাগ করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫ আগষ্ট বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদন, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। হামলা হয় জাতীয় সংসদে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জেলায় জেলায় হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছে থানায়। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে খুব করে মনে পড়ছে একজনের কথা। আমি বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে থাকলে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুন কিছু লেখা পড়ার সুযোগ ঘটতো, জানি এই বিষয়ে তুমিও একমত হবে। বস্তিজীবন থেকে যে গল্পধারার শুরু তা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেরিয়ে খুব উঁচুতে যেতে পারেনি। তাঁর গল্পে উচ্চবিত্ত চরিত্র খুবই কম, যেমন কম উচ্চশিক্ষিত বা এলিট শ্রেণির চরিত্র। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই বলেছেন, “তাঁর তাবৎ গল্প থেকে একটি চারিত্র্যই উদ্ভাসিত হয়- সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রণই তাঁর লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তর্লোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশের, শুধু ঢাকা শহর নয়- ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। আমি জানি এইটুকু পড়েই তুমি ঠিক বুঝতে পারছো আমি কার কথা লিখছি।

বাংলা ছোটগল্পের উত্তরাধিকারে ভিন্নধারার কথাশিল্পী শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) এর কথাই বলছিলাম, যার আবির্ভাব জীবনানন্দ দাশের মতো শিল্পীসত্তায় নির্জনতাকে সঙ্গী করে । বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তিনি সংযোজন করেছেন অসামান্য কিছু গল্প। তাঁর গল্পের জীবনসংবেদী বিষয়, অভিনব আঙ্গিক, অন্তরঙ্গ চরিত্র- আর সবকিছু ছাপিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় সমৃদ্ধ বিচিত্র বর্ণনাকৌশল বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। আবহমান সমাজকাঠামোর পুরনো গল্পগুলোই তিনি নতুন করে উপস্থাপন করেছেন, আর তাঁর অভূতপূর্ব উপস্থাপনভঙ্গির কারণে সেগুলো স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। তিনি বহির্বাস্তবকে গৌণ করে অন্তর্বাস্তবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বাস্তব-অবাস্তবের খেলায় বাস্তব ধরা দিয়েছে তীব্রভাবে। জাদুর ঘোর লেগে গেলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবই থেকে গেছে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে এ ধারা শুরু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র হাত ঘুরে শহীদুল জহিরে এসে তা পুষ্ট হয়েছে এবং স্বকীয় বর্ণনাশৈলিতে পূর্বসূরীদের আড়াল করে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন, বলাই বাহুল্য। শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় ঘটে যাওয়া গল্প লেখেন। সেই গল্পটা আবার তিনি নির্মাণ করেন সমষ্টির বয়ানে। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। তিনি তাদের মুখে গল্পটা তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে যান। অনেকটা পাঠকের অবস্থানে অবস্থান করেন। ফলে তিনি গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কথন তৈরি করেন সেখানে আখ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলীটা ভেঙে পড়ে। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদী (Post-structuralist) হিসেবে আমরা ভাবতে পারি।

আজ্ছা, বাংলাদেশে তোমার যেসব আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের সাথে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছে। ভালো আছেন তো তারা? দেশভাগের শিকার প্রজন্মের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাঁদের স্মৃতিতে আছে দেশভাগের বহু গল্প। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি ১৯৪৭ সালের জুন মাসের আগেই দেশত্যাগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনো ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যেই মানুষ ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ অভিবাসন করছিলেন। দেশভাগের মতো নির্মম বাস্তবতার সামনে পূর্ব পাকিস্তান নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। 'কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'- পাকিস্তানিদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান। তার পরম্পরায় শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি নতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বলা যায়, এভাবেই দেশভাগ ভিন্ন এক আলো নিয়ে আসে বাঙালির জীবনে। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিমূহুর্তে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে ভারত বিদ্বেষ সম্প্রীতি হারিয়ে যাবার কারণ হিসেবে আমার বারবার মনে হয় দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় অভিজাত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকট মুখ্য। পূর্ববাংলার আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশীল ও নিয়ন্ত্রণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত বা উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত। এর পাশাপাশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তোমার কি মনে হয়? চল্লিশের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে সাময়িকভাবে হলেও ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দেশের মুসলিম জনগণ। তারা ভুল বুঝেছিল। কৃষক ভেবেছিলেন জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। মধ্যবিত্ত ভেবেছিল তাদের শ্রেণিগত উন্নতি হবে। দ্রুতই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। এখনো যারা মনে করে, মুসলমানিত্ব পরিচয়ের জন্য বাঙালিত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে।

একটা জিনিস তুমি খেয়াল করেছো নিশ্চয় শহীদুল জহির ছাড়া বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তাঁর আগে বা সমকালে জাদুবাস্তবতার দেখা পাওয়া যায়নি বা অন্য কারো লেখায় এ-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত তা কিন্তু নয়। ষাটের দশকের কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সচেতনভাবেই গল্পে, উপন্যাসে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আবার জহিরের সহযাত্রী নাসরীন জাহানের একাধিক উপন্যাসেও এর বিন্যাস ভাষ্যরূপ পেয়েছে। কথাসাহিত্যে অভিনব গদ্যভঙ্গির চর্চা শহীদুল জহিরকে অনন্য করে তুলেছে। আঞ্চলিক কথ্য ভাষাভঙ্গির অনায়াস ব্যবহার তাঁর গদ্যশৈলীকে করে তুলেছে শক্তিশালী আর তার চরিত্রগুলোকে দান করেছে মাটিঘেঁষা শেকড়সন্ধানী অভিযাত্রা। বেশিরভাগ গল্পের চরিত্রগুলো তাঁর জন্মস্থান পুরান ঢাকা, কখনও পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জ, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ বা সাতকানিয়ার ভাষায় কথা বলে। জাদুবাস্তবতার ধারণা আয়ত্ত করা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কয়েকটি সাক্ষাৎকারে মার্কেজের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রাম, নগর, পাড়া-মহল্লা নির্বিশেষে তাঁর কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার যে-ভুবন গড়ে ওঠে, তা একান্তই এদেশীয় জনমানুষের প্রাত্যহিকতা ও শিকড়ঘেঁষা জীবনের স্বাদ, আবহ, গন্ধ ও সৌকর্যকে ধারণ করে বিচিত্র গল্পকথা, আখ্যান, গুজব ও কিংবদন্তিযোগে। উত্তরাধুনিক সাহিত্য-রচনার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জহির জাদুবাস্তবতাকে গল্প ও উপন্যাসের আধার ও আধেয় – উভয় দিকের উৎকর্ষ সাধনের হাতিয়ার করে তুলেছেন।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক, প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এর গল্পগুলোতে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রচনাকালের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশকে তার নিজস্ব দেখা থেকেই তিনি সমাজে বঞ্চিতদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের জীবনসংগ্রামের কথা এবং সেই সংগ্রামে জয়লাভের কথা বলতে চেয়েছেন। সমাজে বঞ্চিত, দলিত মথিত মানুষগুলোর মধ্যে একধরনের ঋজু দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রত্যয় এই পর্বের গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘পারাপার বইটাই গরিব লোকদের নিয়া লেখা, শহরের গরিব, গ্রামের গরিব।’ তাই গল্পগুলোকে প্রতিবাদী চেতনার ফসল বলে মনে হয়।

তুমি তো জানই আমার ঠাকুরদা দেশভাগের সময় অসমে চলে আসেন। নওগাঁর শিয়ালমারীতে বিশাল সম্পত্তি বিনিময় করে এলেও সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। বাঙালি খেদাও আন্দোলনের সময় আবার আমার পরিবার উদ্বাস্ত্ত, সব ছেড়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন ঠাকুরদা কোাচবিহারে। তোমার পরিবারকে নিশ্চয় এতবার উদ্বাস্তু হতে হয়নি। হিন্দু বাঙালীরা সব সময়েই মনে হয় উদ্বাস্তু তাদের কোন দেশ নেই। পঞ্জাবের দিকে দেখো। প্রথম প্রথম কাটাকাটি, খুনোখুনি যা হবার তা হয়ে গেছে। ওদিক থেকে ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ এলে তার প্রত্যুত্তরে এদিক থেকেও ট্রেন ভর্তি শব গেছে। মাউন্টব্যাটেনের আমলেই ওদিক থেকে যারা চলে আসবার এসেছে, এদিক থেকে যারা যাবার, গেছে। কিন্তু বাংলার দিকে যে আগমন-নির্গমন কিছুতেই থামছে না।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা’(১৯৭৪) গল্পটিতে অন্যরকম এক ভালোবাসার রূপ দিয়েছেন জহির। বাবুপুরা বস্তি এলাকার গল্প। তুচ্ছ একটা ফুল দিয়ে যে মানুষের মনকে জয় করা যায়, তার সত্যিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন তিনি ‘ভালোবাসা’ নামক গল্পে। বস্তিবাসী হাফিজদ্দি এবং তার স্ত্রী আবেদার প্রাত্যহিক নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিকের জন্য ঢেউ তোলে হলুদ রঙের ডালিয়া ফুল। বস্তির মেয়েদের প্রায় সবাই কাছাকাছি কোনো বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে, পুরুষরা হয় ঠেলাগাড়ি ঠেলে বা দিনমজুর। ঝুপড়ির এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে দিনাতিপাত করে। এমনি এক পরিবেশে হাফিজদ্দি ডালিয়া ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরলে সবার মধ্যে ঔৎসুক্য তৈরি হয়। আর ‘আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।’ সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষদের জীবনে ভালোবাসার পেলব উৎস হয়ে দাঁড়ায় ফুলটি। তাই ‘তহুরা তো জানে না বাবা মাকে কী জাদু করে রেখে বাইরে গেছে।’লেখকের অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ফুলটিই শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় গল্প ‘তোরাব শেখ’ (১৯৭৫) গল্পটি একটি চমৎকার আঙ্গিকের শক্তিশালী গল্প। বস্তিজীবনের প্রাত্যহিকতা, স্বপ্ন-বাস্তবতা আর জীবন সংগ্রামের গল্প। জহিরের গল্পে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে তিনি শব্দ নিয়ে এঁকেছেন চিত্র। কাহিনিকে আরো স্বাবলম্বী ও উদ্ভাসিত করতে এক ধরনের কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপি নিখুঁতভাবে দেখেছেন অথবা অনুভব করেছেন বলেই অনেক চিত্র অন্ধকারাচ্ছন্নের মধ্যেও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠভাবে। তোরাব সেখ, লতিকা, জমির, লালবানু প্রত্যেকেই অস্তিত্বসংগ্রামী। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে যারা তারা জেগে উঠলেই বদলে যাবে পৃথিবী, মার্কসীয় এ বিশ্বাসের প্রতিফলন এ গল্প। লেখকের জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা, সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে “পারাপার”(১৯৭৫) গল্পে।গণমানুষের নিয়তিতাড়িত জীবনধারার পরিবর্তনে শৈশব থেকে প্রাণান্ত চেষ্টার গল্প এটি। ছোট দুটি শিশু আবুল আর বশিরের জীবন সংগ্রাম, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের নির্দয় আচরণ, এবং তাদের রোষানল থেকে মুক্তিপ্রত্যাশা গল্পটিকে অনন্য করেছে। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত সহজ পরিসরে উঠে এসেছে। ওলি চরিত্রটির অবস্থান এই দুই শ্রেণির মাঝে।

সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবন, স্বাভাবিক অশ্লীলতা বা সাবলীলভাবে কোনো বাচ্চার জন্ম নিয়ে কথা তোলা গ্রামীণ আবহে সম্ভব। মানুষ সামাজিক বিষয়ে গালগল্পের ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ সংস্কৃতির নিবিড় অবলোকন থেকে উঠে আসা এমনি একটি গল্প “মাটি ও মানুষের রং” (১৯৭৬)। গল্পটি পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক, ধনী-গরিবের যে-তারতাম্য তার প্রকৃত একটা চিত্র শহীদুল জহির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দারিদ্রে্যর প্রতি যে-অবিচার করা হয়, অবিচার করা হয় শ্রেণিহীন মানুষের ওপর, তা রূপকের মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বলে গেছেন। আমাদের এই সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে ধনী-গরিবের বৈষম্যে। এখানে মানুষের আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই মানবিকতার। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। অভাব বা দারিদ্র্য স্বপ্নকে কোনোভাবে আটকাতে পারে না। “ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে”(১৯৭৬) গল্পে সামাজিক পীড়ন, শোষণে পিষ্ট সহায়হীন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ নবাব। সে সমগোত্রের প্রতিহিংসার শিকারও বটে। নিজেকে বড় করতে না পেরে অন্যকে ছোট করে দেখানোর চিরন্তন মানবীয় হীন মনোবৃত্তি এস্থলে লক্ষ্যণীয়। নিম্ন শ্রেণির মানুষের তাই অপরের জীবন সম্পর্কে অহেতুক কৌতুহল। নিরীহ নবাবকে কোনোভাবেই শায়েস্তা করতে না পেরে ঘৃণ্য অপবাদ দিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এটাও এক বিনোদন। শহীদুল জহিরের আঞ্চলিক ভাষার বিচিত্রবর্ণা মুকুটে ভিন্ন পালক যোগ করেছে এ গল্পে নবাবের মুখের ভাষা। তার প্রকৃত নাম আলফাজুদ্দিন আহম্মদ। পুরান ঢাকার চরিত্রে লেখক সতত যেসব নাম ব্যবহার করেছেন, এ নামটি সেগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম। তেমনি ব্যতিক্রম নবাব চরিত্রটি। অত্যন্ত প্রমিতভাষী নবাব চালচলনে এ সমাজে বেমানান। তাই তার প্রতি সবার অবিশ্বাস একসময় আক্রোশে পরিণত হয়।

জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই এমন কিছু ‘বোধোদয়’ হয়, যা আরও আগে হলে জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতে পারত। অনেকে হয়তো জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে এটা উপলব্ধি করেন। কিন্তু তাতে তো আর ফেলে আসা দিনগুলো সুন্দর করে তোলা যায় না! আমার পরিবারের যারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেছিলো তাদের প্রায়শ বলতে শুনি বাংলাদেশে ফেরাটা তাদের ভুল ছিল। তোমার আত্মীয়স্বজনও কি তাই বলে? আমরাই কি আদতে ভালো আছি? ভুলে গেলে চলবে না আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত।

জহিরের গল্প-যাত্রাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা চলে। ‘পারাপার’ এর পরবর্তী গল্পগ্রন্থের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫ বছর। ‘পারাপার’ এর গল্পগুলো তাঁর ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সেলেখা। 'পারাপার'-এর রিয়েলেস্টিক ধারার গল্প। পারাপারে জহির অনেক বেশি ট্র্যাডিশনাল, যেখানে গল্প একটি বক্তব্য বা অদেখা বিষয়কে সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। অন্যদিকে তার পরের গল্পগ্রন্থটি জাদুবাস্তবতার আখ্যান, ২য় গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ র ১ম গল্পটি লেখা তাঁর ৩৮ বছর বয়সে অর্ধাৎ তাঁর সাহিত্যমানস তখন আরও পরিণত। ততদিনে তাঁর উপন্যাস ‘জীবন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮) এবং ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বাংলা উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সফলতম প্রয়োগ বলে স্বীকৃত। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ নিয়ে ২০০০ সালে তিনি যখন আবির্ভূত হলেন, তখন তার বাস্তব আর জাদুর জগৎ এক হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর গল্পের আঙ্গিক আর ভাষাশৈলী চলে এসেছে দৃষ্টিসীমার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে চরিত্রেরা রয়েছে পুরনো শ্রেণি-পেশার বা বর্গের। বেশিরভাগ গল্পে পুরান ঢাকার এমন একটি এলাকা বা মহল্লাকে বেছে নিলেন যেখানে জীবন সরলরৈখিক হলেও বৈচিত্র্যে ঠাসা। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত এসব মানুষ কখনও আঁকড়ে থাকে তাদের চিরায়ত ধ্যান-ধারণায়, কখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের সঙ্গে ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ খেলে আবার কখনও নিজের অজান্তেই কোনো মহৎ কাজের অংশীদার হতে এগিয়ে আসে। ঘটনার পুনাবৃত্তি থাকলেও তাঁর আশ্চর্য বর্ণনকৌশলের কারণে পাঠকের মুগ্ধতা কাটে না।

‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ (১৯৯১) এই গল্পে নয়নতারা ফুলগাছগুলো এ গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে। আবদুল করিম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জড়িয়ে যায় বিশেষত্বহীন ফুল নয়নতারার সঙ্গে। ভূমিকম্পের সময় দুটো নয়নতারার টবকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেই চারতলা থেকে পড়ে মগজ থেঁতলে মারা যায় এবং পরবর্তীতে তার শোকে গাছগুলো আত্মহত্যা করতে থাকে।এমন একটি জাদুবাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকেছেন যা একইসঙ্গে পাঠকের মোহগ্রস্ততা এবং ধন্দ তৈরি করে। এ গল্প থেকেই তিনি জড়িয়ে গেলেন জাদুর জগতে যা পরবর্তীতে আরও বিকশিত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরকে এক সূত্রে বেঁধেছেন ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ (১৯৯২) গল্পে, ভূমিহীন অতিদরিদ্র আকালু ও তার স্ত্রী টেপি, রিকশাচালক চান্দু এবং তাদের সারল্যমাখা জীবনাচরণে। ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাকের অলৌকিক ভূমিকা, জাদুবাস্তবতাধর্মী আখ্যান ও ঘটনাংশ, অবিশ্বাস্য লোককথা ও গুজব, সর্বোপরি গল্পের ব্যাখ্যাতীত পরিসমাপ্তি। বহুদিন আগে ঢাকা শহর কাকশূন্য হওয়ার বৃত্তান্তকে ঘিরে এ-গল্পের ঘটনাবিন্যাসের সূত্রপাত। সেই ইতিবৃত্ত নির্মাণে বাস্তবতা ও রূপকথার অলৌকিক-অতিলৌকিক সমাবেশের মাধ্যমে পাঠককেও এক পরাবাস্তব জগতে লেখকের আহবান গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।

শহীদুল জহিরের একটি ভিন্নধর্মী গল্প ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ (১৯৯২)। গল্পে জনৈক মোহব্বত আলী পাড়ায় পাড়ায় জাদু দেখায় আর ডুমুর বিক্রি করে। প্রথমে ফ্রি দিয়ে যে ডুমুর বিক্রি শুরু হয় ক্রমেই তা অমূল্য হয়ে ওঠে। বেশি দামে বিক্রি করলেও মোহব্বত তার গ্রাহকদের বলে, মজা হলেও এই ডুমুর জুগিয়ে খাওয়া উচিত, যাতে শেষ জীবন পর্যন্ত চলে। ডুমুরকে যৌবনের প্রতীকও মনে হয়। কারণ বুড়ো ও বয়স্করা এই ফল বারবার খেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। মোহব্বত ডুমুর বিক্রি করলেও ডুমুরের গাছ বিক্রি করতে রাজি হয় না। গাছ না পেয়ে মোহগ্রস্ত মানুষেরা জাদুকরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং একসময় নিজেরাও মৃত্যুবরণ করে। জাদুকরের রহস্যময় হাসির মতোই লেখক রহস্যাবৃত করে রেখেছেন গল্পের শেষ অংশ। তাই গল্প শেষ করে পাঠককে ভাবতে হয় ‘এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তা স্বপ্ন ছিল।’

নরনারীর হৃদয়াবেগ ও প্রেম নিয়ে শহীদুল জহির বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা চালিয়েছেন এমনি একটি গল্প ‘এই সময়’ (১৯৯৩)। ‘কাঁটা’(১৯৯৫) গল্পে যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্নার প্রতি যদিও সবাই অসহায় মমতা অনুভব করে কিন্তু আপন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি তারা। যেখানে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে 'কুয়ো'র প্রসঙ্গটি। সুবোধ-স্বপ্না দম্পতির কুয়োতে ডুবে মরা বেশ সিম্বলিক। এখানে একটি ইতিহাস ভ্রমণের ব্যাপার আছে। এই কুয়োটি যে সাম্প্রদায়িকতার কূপ তা বুঝতে পাঠকের আর বাকি থাকে না। তাই গল্পে কুয়োটি বন্ধ করার জন্য এলাকাবাসীকে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা যায়, যা ইতিবাচক।

নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা গল্প ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ (১৯৯৭)। পাখির রূপকে লেখক নূরজাহান ও আবদুল ওয়াহিদের মনোবিশ্লেষণ করেছেন যা প্রেম সম্পর্কে পাঠকের উপলব্ধিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। একই চরিত্র একই মহল্লা শহীদুল জহিরের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও মহল্লাও আবির্ভূত হয়েছে চরিত্র হিসেবে। এই পরিচিত গন্ডির মধ্যেও লেখক কখনও চিত্রিত করেছেন সামষ্টিক জীবনাচরণ, আবার কখনও ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, একরৈখিকতা। এমনি একটি গল্প ‘চতুর্থমাত্রা’ (১৯৯৮)। এটিকে গল্প না বলে ‘একাঙ্কিকা’ বলা যায়।

‘হিন্দুস্থান কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি ভারতে বাস করছে আমাদের অতিথি হিসেবে। অতিথি হিসেবে যতদিন ইচ্ছে তারা এখানে বাস করতে পারে'—এমনটাই বলেছিলেন ১৯৩৩ খ্রি. পাঞ্জাবের বিখ্যাত আর্যসমাজপন্থী হিন্দু মহাসভার নেতা পরমানন্দ । আবার এমনই একটি সুর শোনা যায় লাহোরে ‘জামাত-ই-ইসলামী'-র প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবদুল আলার কণ্ঠে। তিনি বলেন—‘মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অপরিহার্য এবং তাহা ইসলাম ব্যতীত আর কিছুই নহে।' তাহলে পথ কোথায় ? এই উগ্রতা কোনো লক্ষ্যে কি পৌঁছে দেয় আমাদের? মৌলবাদ আসলে কী? সময় কী সাক্ষ্য দেয় এই মৌলবাদের প্রেক্ষিতে? আর সাধারণ মানুষের মনে কোন ভাবনা এসে জমে এই শব্দটিকে ঘিরে? ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি আর মৌলবাদ শব্দগুলো কি পরস্পরের হাত ধরে চলে? ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এর ভূমিকাই বা কী? এটি সংহতি নাকি সংকীর্ণতা—কোন গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দেয়? এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল অনেক বেশি। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট শুরু হয় আশির দশক থেকে। উপমহাদেশজুড়ে মুসলিম মৌলবাদ এবং হিন্দু মৌলবাদ ক্যানসারের মতো বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদও। মৌলবাদ আসলে ফ্যাসিবাদও। মৌলবাদীর কাছে ‘আমরা’ ছাড়া অন্যরা ‘অপর’। ‘অপরদের ওপর’ ‘আমাদের’ ধর্মের আলো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো অপরাধই অপরাধ নয়। সব অত্যাচার করা বৈধ। ইউরোপের এনলাইটমেন্টের সময় থেকে পৃথিবীজুড়ে ‘অপরের’ ওপর অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়া শুরু। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়ে যে কোনো মানবিক মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমার নিরপেক্ষতার ভাাবনা তোমার ভাবনার সাথে হয়ত মিলে যাবে। কিন্তু এও জানি আমার তোমার ভাবনায় ডানা মেলে দেবে না ধর্মান্ধ পৃথিবী।

তৃতীয় এবং শেষ গল্পগ্রন্থ ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কোথায় পাবো তারে’(১৯৯৯)। পুরান ঢাকায় সামষ্টিক শ্রেণিচরিত্রের মাঝে আবদুল করিমের প্রেমের বিষয়টি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ময়মনসিংহ বা ফুলবাড়িয়া যাওয়ার ঘটনায় মহল্লার সবাই আন্দোলিত হয়। ‘ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে-- ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘিœত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহে তারা বিছানায় জেগে থাকে।’ শহীদুল জহিরের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যহলো একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্পের অন্তর্বয়ন। এমনি একটি গল্প ‘আমাদের বকুল’(২০০০)। আকালু বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি গাভী পায়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার স্ত্রী ফাতেমা আর গাভীটির সমান্তরাল জীবনাচরণ- একই সঙ্গে গর্ভধারণ, একই সঙ্গে জমজ বাচ্চা প্রসব এবং একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সবই প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আঠারো বছরের তরুণ শহীদুল জহিরের সংবেদনশীল সত্তায় গভীর ক্ষত তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। সেই অতৃপ্তি বা হাহাকার থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা’ (২০০০) গল্পে ভূতের গলির জনজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখি -‘ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং আবদুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে, আহা রে আবদুল হালিম, আহা রে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না।’ বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ ভূতের গলির মানুষ প্রথমদিকে কারও ভাতের হাঁড়ি বা হাতঘড়ি বা হরলিকস এর বয়াম হারানোর ঘটনায় অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে এবং ঘটনাগুলো রহস্যময়ই থেকে যায়। ধীরে ধীরে বানর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে।একই সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল হালিম আর ঝর্ণার প্রেম, যুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে ঝর্ণার আকস্মিক মৃত্যু, আবদুল হালিমের যুদ্ধে যাওয়ার পথেই বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে মৃত্যু এসবই লেখক বানরের গল্পের সঙ্গে বলে গিয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর পর তার মা ছেলের তোষকের নিচে ঝর্ণার লাল সাটিনের ফিতা আবিষ্কার করেন এবং বহুবছর পর গৃহকর্মীর মেয়ে জবাকুসুমকে ফিতাটি দিয়ে চুল বেঁধে দেন ‘এবং তারপর সেদিন মহল্লায় লাল চুলের ফিতার ইতিহাস প্রকাশিত হয়।’ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার পাশাপাশি বানরদের এই সামান্য চুরিকে লেখক মানবিকই বলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের জনজীবনে মানুষরূপী কিছু হায়েনার হিংস্রতার নৃশংসতার ভয়াবহতা লেখক শহীদুল জহির অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’ গল্পে যুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে হানাদার-রাজাকারদের নিয়মিত হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নকে লেখক বলেছেন ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’- ‘তারপর ভূতের গলিতে ৩০ মে রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার সময় পাকিস্তানি মিলিটারি আসে। ... টিপু সুলতান রোডের মোড়ে ট্রাক থামার সঙ্গে সঙ্গে মহল্লায় খবর হয়ে যায়।... মহল্লার লোকেরা গাট্টি বোঁচকা মাথায় করে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বলধা গার্ডেন এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেগে যায়। মহল্লায় কোনো লোক না দেখে পাকিস্তানি মিলিটারি দলের নেতা লেফটেনান্ট শরিফ খেপে, সে বলে, কেয়া বাত হ্যায়, শালে লোগ সব ভাগ গিয়া? ... আবদুল গণি বলে, হালারা চুহা হ্যায়।... ইয়ে এক খেইল হ্যায়, ইন্দুর বিলাই খেইল হায়, চুহা বিল্লি হায়। তারপর মহল্লার চল্লিশটা বাড়ির ভেতর কেবল খতিজা বেগমদের ৩১ নম্বর বাড়িটা ছাড়া অন্য সব বাড়ি ২৭ অক্টোবর বুধবার পর্যন্ত মোট দুইবার করে পোড়ে।’ এই খেলা মহল্লায় বলবৎ থাকে যুদ্ধের পরও এবং স্বাধীন দেশে সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষের সঙ্গে এই জীবনমরণ খেলায় লিপ্ত হয়। শিশুদের সাধারণ ‘লৌড়ালৌড়ি’ থেকে শুরু করে ডেঙ্গুজ্বর বা মানুষের জিম্মিদশা পর্যন্ত এই খেলায় প্রতিভাত হয়। লেখক এই খেলার মাধ্যমে ভিন্ন আঙ্গিকে একটি মহল্লায় তথা সমগ্র দেশে সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকে পুননির্মাণের চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ‘প্রথম বয়ান’ (২০০২) গল্পে আবদুর রহমান শেপালি আকতারের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনেকটা খেয়ালের বশেই। পরবর্তীতে কৈশোরের সে প্রেম খুঁজে বেড়ায় সারাজীবন। শেপালি আকতার ‘দান দান তিনদান’ চেষ্টার পরও যখন আবদুর রহমানকে চম্পা ফুলের ডাল দিতে পারেনি তখন তার অভিমান হয় এবং পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে তার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। আবদুর রহমানের কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়েই থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হানাদারদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভূতের গলির বাসিন্দারা জিঞ্জিরায় আশ্রয় নেয়। তখন কোনো এক রাতে তাদের দুজনের দেখা হয় এবং শেপালির মুখে চম্পাফুলের গল্প শুনে ‘আবদুর রহমানের মনে হয়তো দুঃখ জেগে ওঠে, অধিকারের ভেতরকার পাকা আম পঁচে গেলে যে দুঃখ হয়, সেই দুঃখ, সেই শোক’। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পের নায়কের কথা। কৈশোরে সুরবালাকে হেলায় হারনোর পর উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী হিসেবে যখন তাকে আবিষ্কার করে তখনই নায়কের আত্মপীড়ন শুরু হয়। এতকালের আত্মপ্রবঞ্চনার খতিয়ান নিয়ে ‘বানের জল’ থেকে বাঁচতে প্রলয়রাত্রে সুরবালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোনো কথা না বলে ফিরে যাওয়াকেই সে জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করে।

অনেক দীর্ঘ লিখে ফেলেছি, আসলে আরো কত কিছুই তো লেখার বাকী আছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশটাকে নিজের বলেই জেনে এসেছি কিন্তু এই কদিনে এত বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চেনা মানুষগুলোকেও ভীষণ অচেনা ঠেকছে। এত দ্বেষ এত ঘৃণা জমেছিল মানুষের মনে আগে বুঝিনি। আমি রাজনীতি বুঝিনা, ইনফেক্ট রাজনীতি বুঝতে চাইও না। চারদিনে কলকাতা দখল কিংবা সেভেন সিস্টার দখল করার গল্প শুনে কষ্ট পেলেও আমি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাইনা। শুধু বলতে ইচ্ছে করে শহীদুল জহিরের প্রথম বয়ানের ভাষাতেই-‘ সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত’- এই বোধ আবদুর রহমানকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং বহুবছর পরেও ‘কেরোসিন বাত্তি খোঁজার ছলে’ তার বাল্যপ্রেমকেই খুঁজে বেড়ায়। কারণ “আবদুর রহমানের হয়তো এক শোক হয়। যে ঘটনা ঘটার সময় বোঝা যায় না, পরে বোঝা যায়, তার জন্য শোক করা ছাড়া আর গতি কী? ভূতের গলিতে আবদুর রহমান এই অবস্থায় পড়ে ‘চাপা খায়া থাকে’।

নিরন্তর ভালো থেকো। পরশু কয়েকদিনের জন্য পাহাড়ে যাবো আশা করি সেখান থেকে ফিরে এসে দেখবো তোমার চিঠি অপেক্ষা করছে নতুন কোন আলো নিয়ে।

ইতি-
বাসু
১৫ জানুয়ারি,২০২৫

বিঃদ্রঃ নতুন বছরে কি এখনো বই কেনো নতুন কি কি বই কিনলে জানিও। ফেব্রুয়ারি মাসে তো তোমার জন্মদিন, বুড়ি হয়ে যাচ্ছো সুস্মি! কেমন লাগছে? চিরনতুন বৃদ্ধাকে অগ্রীম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

0 comments: