ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৬
বের্নহার্ডের বাবা মা এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা অনুভব করেছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে সমাজে তাদের চেনা লোকজনেরা সবাই কেন ছেলেটাকে ঠিক নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে না। গোটা ব্যাপারটা তাদের রাগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে তারা নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের উপরে রেগে গিয়েছিলেন। কারণ এর ফলে তাঁদের অভিভাবকত্বের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছেন যে বের্নহার্ডের আচার আচরণের মধ্যে উদ্ভট কিছু জিনিস আছে এবং এটা বুঝতে পেরেই তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। বিশেষত বের্নহার্ডের মা, তিনি যথেষ্ট ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী মহিলা, যিনি লক্ষ্য করেছেন যে বের্নহার্ড ক্রমশ তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বের্নহার্ডকে বেশ ভাল বুঝতে পারেন এবং ছেলের স্বভাবচরিত্র কতকটা তাঁরি মত হয়েছে। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, এটা বোঝা যাচ্ছে যে বের্নহার্ড একটু আলাদা রকমের আচরণ করছে। এটা বুঝতে পেরে বের্নহার্ডের মায়ের মনে প্রশ্ন জাগছে যে তবে কি ছেলে তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছে আজকাল? ছেলে ঠিক কী করছে, সেটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর হৃদয় সব সময় বের্নহার্ডের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকছে। ছেলের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের জন্য দু’ হাত বাড়িয়ে প্রস্তুত তিনি, অথচ মনে আশঙ্কা যে ছেলে আর ফিরে আসবে না আগের অবস্থানে। কোথাও কি একটা ভয় আর তিক্ততা তৈরি হয়ে যাচ্ছে? কেন? কোথায় সমস্যা? মায়ের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কেউ যদি এসব তাঁকে জিজ্ঞেস করে… তিনি উত্তর দিতে পারবেন না এবং তাঁর চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রুপাত হতে থাকবে।
এদিকে আবার বের্নহার্ডের বাবা সঠিকভাবেই জানেন যে বের্নহার্ডের চরিত্রের সমস্যা ঠিক কোথায়। তাঁর মতে, বের্নহার্ড যথেষ্ট সপ্রতিভ এবং ভাল ছেলে; তবে বেশি স্বাধীনতা বের্নহার্ডের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, সে সহজে অন্য মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। ফলে তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্ষতিকারক সঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার এবং ভবিষ্যতে যাতে তাঁর আচরণ বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে, সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সেটা তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় বের্নহার্ডের বাবার মতে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও ছেলের সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত হলেন। তারপর অবশ্য তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে, কারণ সময় প্রায় রাত বারোটা এবং বের্নহার্ডের বাবা বললেন যে তিনি বের্নহার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চান।
দু’টো বাজল। বের্নহার্ড ফেরেনি এখনও।
বের্নহার্ডের দু’ চোখ ভর্তি ঘুম। শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। সে গের্টের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন তাঁকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি পাঠানো অসম্ভব ব্যাপার, ভাবছিল ইনেস। গের্ট যদি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।
বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগছিল। ইনেস তাঁকে ঘুম থেকে তুলবার জন্য চুম্বন করছিল। শুধু তাই নয়, ঘুম থেকে উঠে যখন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বের্শেন ফরাসি ভাষায় বিড়বিড় করছিল, তখন ইনেস তাঁর দুটো কান ধরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তাঁকে অন্তত আরও তিনবার চুমু খেয়েছিল। নিজেকে আদুরে খরগোশের মত মনে হচ্ছিল বের্শেনের। গের্ট নিজের বড় কোটের ভেতরে মালপত্র প্যাক করবার মত করে তাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে একতলায় নামিয়েছিল। তারপর বের্শেন গাড়িতে আধঘুমন্ত অবস্থায় নিজেকে ইনেস আর গের্টের মাঝখানে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল। খুব ভাল লাগছিল তাঁর; ইচ্ছে করছিল যেন প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে এই গাড়ির যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ হয়।
বের্নহার্ডের বাবা বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়েছিলেন। নিজের ঘরের দরজা খুলে ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে একতলার আলো জ্বলে উঠল এবং কয়েকজন ঢুকল। তিনি তাড়াতাড়ি ছায়ায় সরে গিয়ে নিচে কী হচ্ছে সেটা দেখতে লাগলেন। লম্বা একহারা চেহারাটা দেখে তিনি গের্টকে চিনতে পারলেন। গের্ট প্যাকেট খুলবার মত করে একটি ছেলেকে মোটা কোটের ভেতর থেকে বের করছে, সে নিঃসন্দেহে বের্নহার্ড। পাশে ইনেস দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হাতে বের্নহার্ডের নিজের কোট। গের্ট তারপর বের্নহার্ডকে প্রায় টানতে টানতে একতলায় ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো। কাজটা করতে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োজন। বের্নহার্ড তারপর ইনেসের হস্তচুম্বন করল। উত্তরে ইনেস বের্নহার্ডের মাথার চুলে আলতো টোকা দিল। তারপর বেশ জোরে জোরে বলে উঠল... ‘গের্ট, তুমি বের্শেনকে দোতলায় তুলে দিয়ে এসো। আমি বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’ তারপর বের্নহার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুভরাত্রি বের্শেন! আগামীকাল ভাল ভাবে স্কুলের ক্লাস কোর।’
বের্নহার্ড, যাকে খুব ঘুমন্ত দেখাচ্ছে, সে ধীরে ধীরে গের্টের হাত ধরে এবং গের্টের কাঁধে মাথা রেখে উপরে উঠে এল।
বের্নহার্ডের বাবা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে, গের্ট এবং ইনেস কেউ তাঁকে দেখে ফেলবার আগে, যতটা নিঃশব্দে সম্ভব, সেইভাবে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।
বের্নহার্ডের সঙ্গে তাঁর বাবার কথোপকথন মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। অবশ্য সেটাকে ঠিক কথোপকথন বলা চলে না। কারণ, বের্নহার্ড সেরকম কোনো কথাই বলেনি। এমনকি যে ক্ষেত্রে আপত্তি জানাবার প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রেও বের্নহার্ডের বক্তব্য অনেকখানি ক্ষমাপ্রার্থনার মত শোনাচ্ছিল।
সেই মুহূর্তে বাবা মায়ের ভাবনা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সেই কারণে যে তাঁর মা এতখানি কষ্ট পেয়েছেন, সেটা শুনে সে ভারি আশ্চর্য হয়েছিল। সে এইভাবে ভেবে দেখেনি ব্যাপারটা। এ কথা, সে কথা বলতে বলতে তাঁর বাবা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন যে ইনেস কখনও বের্নহার্ডকে চুম্বন করেছে কি না। বের্নহার্ড এই প্রশ্নে ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলে দিল যে না, সেরকম কিছু হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল সেটা বলাই সঠিক কাজ। তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে নাহলে তাঁর বাবার ইনেস সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে। তাছাড়া ইনেস তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসবার জন্যই চুমু খেয়েছিল সেদিন। নাহলে সাধারণ ভাবে এরকম কিছু ঘটে না। কিন্তু বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন তাঁর জবাব শুনে এবং পরবর্তী প্রশ্নটা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগল। রাগত স্বরে বলে উঠলেন তিনি…
-‘তোমার লজ্জা করে না সারাক্ষণ মিছে কথা বলে যেতে?’
(চলবে)
0 comments: