গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য
Posted in গল্প“হেলো”!
ব্যারিটোন ভয়েস কানে যেতে, এতোক্ষণ  প্রকৃতিতে মগ্ন শ্রুতি,  তাকিয়ে  দেখে  তার সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।
কখন এসে বসলেন ভদ্রলোক ! এতোক্ষণ তো ছিলেন বলে  মনে হচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট শ্রুতি যখন ট্রেনে ওঠে তখন এই ফার্স্টক্লাস কোচটা একরকম ফাঁকাই ছিল। কোচের শেষ দিকে বোধহয় দু’ একজন ছিলেন।
এই সুন্দর আরামদায়ক কোচখানা প্রায় পুরোপুরি তার দখলে, ভেবেই  শ্রুতির  ইন্ট্রোভারটেড চিত্ত আনন্দে নেচে উঠেছিল। আ:, কী শান্তি!  ভিড়ভাট্টা, বাচ্চাদের  চিৎকার,  কান্না  কোনো  ঝামেলা নেই।  প্রকৃতি  দেখতে দেখতে  একা একা সুন্দর  সময়  কাটানো  যাবে !
কিন্তু  হা হতোস্মি! তার সেই  আশায়  এবং  একাকীত্বে জল ঢালতে কে এই মূর্তিমান আবির্ভূত  হলেন!
আর তার সামনে এসে বসলোই বা কখন.কে জানে! হয়তো শ্রুতি  যখন এটেন্ডেন্ট মহিলার সঙ্গে কথা বলতে ওপাশে  গেছিলো তখন  এসে বসেছে।
অবশ্য আগে পরেও হতে পারে,  কারণ   ট্রেনের চারপাশের সৌন্দর্যে শ্রুতি   এমনই বুঁদ হয়েছিল, যে অন্য কোনো দিকে মন দেবার মতন অবস্থাতেও  সে  যে ছিলনা, এটাও  ঠিক।
আর এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এই প্রথমবার গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাচ্ছে শ্রুতি।  উ:, কী রোমাঞ্চকর!  গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আর তার আশেপাশের  সৌন্দর্য ,  যা সে  এতোদিন শুধু  ছবিতে দেখেছে, এবার  চাক্ষুষ  দেখবে। ভাবা যায়!
এখনো  তো গ্রিন্ডেলওয়াল্ড  আসতে একটু দেরী আছে, অথচ  এখনই  চারদিক কী অপরূপ  হয়ে  উঠেছে!
ট্রেনের বাইরে যেদিকেই তাকাও বরফের পাহাড় আর পাহাড়।  মনে হচ্ছে স্নো পিক গুলোকে, ট্রেনের  মস্ত মস্ত কাঁচের  জানলার গায়ে কেউ যেন আঠা দিয়ে ছবির মতো সেঁটে রেখেছে।
আর ট্রেনের সঙ্গে ছুটে চলা চোখ ঝলসানো রকমের  সাদা বরফ পাহাড়ের নীচে দিগন্ত ছোঁয়া , ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এমন গাঢ় সবুজ তৃণভূমি।
আর সেই  সবুজ  মেডো তে চরে বেড়াচ্ছে  বাদামী  সাদা ছোপ ছোপ গরু, দারুণ মিষ্টি বাচ্চা ভেড়া, মা-ভেড়া, পক্ষীরাজের মতো  ঘোড়ারা-কোনোটা ধপধপে সাদা, কোনোটা কুচকুচে কালো,কোনোটা বাদামী, তাছাড়া  মেশামেশি রঙের   তো আছেই। ঠিক যেন রূপকথার দেশ।
গরুগুলো  আবার একটু বেশি সাহসী। ট্রেনের প্রায় কাছ ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে। আর  তাদের গলায় সব বড়ো বড়ো ঘন্টা বাঁধা। সে সব ঘন্টার আবার  কী সুরেলা আওয়াজ! শ্রুতির  মনে হচ্ছে ওরা যেন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ডাকছে।
হঠাৎ হঠাৎ চোখে  পড়ছে  দূরে  দূরে  একেকখানা কটেজ । ছোটবেলায় শ্রুতি  ড্রয়িং  খাতায়  যেমন  আঁকতো,ঠিক  তেমনি  ছবির মতো তাদের ঢালু ছাদ, আর ছাদের কোনায় একটা করে চিমনি। ওপরে আশ্চর্য নীল আকাশ…
“ প্রথম বার কি”?
উল্টোদিকের  সীটের ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফেরে শ্রুতির।  রূপকথার দেশ থেকে তার মন ঝপ করে ফিরে আসে ট্রেনের কামরায়।
শ্রুতির  বিভোরতা দেখেই কিনা কে জানে,
ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী গভীর নীল চোখ! আর সেই চোখদুটোয় আশ্চর্য কিছু যেন ঝিকমিক করছে! মুখে মৃদু হাসি।
ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতির  সারা শরীর হঠাৎ অকারণে কেন যেন কেঁপে উঠল।
কী হ্যান্ডসাম দেখতে! মনে হয় ছ'ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবেন, গ্রীক গডের মতো মুখ, মাথার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে এলেও তার  গাঢ় সোনালী রঙ, সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আগুন একেবারে।
হ্যান্ডসাম , আকর্ষক বিদেশি পুরুষ, শ্রুতি  তো আর প্রথম দেখছেনা, কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতর কী যেন আছে! চোখে চোখ পরা মাত্র তাকে পাগলের মতন টানছে। ভদ্রলোকের আকর্ষণের কাছে,  এতোক্ষণ  তাকে বুঁদ  করে রাখা আশপাশ, প্রকৃতি  সবকিছু  একেবারে  ফিকে, আলুনি লাগছে।
টেবিলের  উপর রাখা  ভদ্রলোকের গ্লাভস পরা হাতদুটো  একবার  ছোঁয়ার জন্য তার সমস্ত শরীর যেন আকুলি বিকুলি  করে উঠলো।  সামনের ভদ্রলোকের শরীরের ভাষাতেও যেন সেই একই আকুলতা!
এটা কি হচ্ছেটা কি? আর এই চল্লিশের ওপরে এসে? লাভ এট ফার্স্ট সাইট?
ফু:.!..সে সব গল্প কথা মাই ডার্লিং। বাস্তবে হয়না,, বলে মনে মনে নিজেকে  কষে এক ধমক  দিলো শ্রুতি
“ প্রথম বার?”-
আবার সেই স্বর।
“ হ্যাঁ,… মানে অফিসের কাজে বার্লিন এসেছিলাম, তো ভাবলাম গ্রিন্ডেলওয়াল্ড টা দেখেই যাই। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন “
“স্বাভাবিক '
”স্যরি'?
শ্রুতির  কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই আশ্চর্য হাসিটি হাসেন ভদ্রলোক।
“আপনি চা খাবেন? আমি একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি “
“ নো, থ্যাংকস “
শ্রুতির  অনুরোধ উপেক্ষা করেই একমনে  খুব খেয়াল  করে শ্রুতির  আপাদমস্তক  জরিপ  করতে লাগলেন ভদ্রলোক।   ঠোঁটের  কোনের হালকা  হাসিতে খানিকটা অবয়সোচিত  দুষ্টুমির  আভাস।
,” নাউ ইউ হ্যভ নাইস অলিভ স্কিনকালার”-
আবার শ্রুতির  অন্ত:স্থল ছুঁয়ে  যাওয়া,  গভীর  অথচ মজার ভঙ্গিতে  বলা পাগল  করে দেওয়া সেই  ব্যারিটোন ভয়েস।
একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল শ্রুতি।  তারপরেই   খানিকটা  নিজেকে  সামলে  নেবার চেষ্টায়, আর খানিকটা    ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, একটু বেশিই জোরে হেসে উঠলো , “না,না, আপনি ভুল করছেন,। আমার স্কিন ট্যানড হয়ে এরকম হয়নি। আমার স্কিন টোন এরকমই। আমি ভারতীয়  তো, আমাদের চামড়ার   স্বাভাবিক রঙ    এরকমই হয় সাধারণত “
মজাদার  ভঙ্গিটা মুছে  গিয়ে  বিষন্নতার  মতো  কিছু ভদ্রলোকের মুখে  ছড়িয়ে  পড়লো।
অন্যমনস্ক ভাবে বার দুয়েক যেন ঘোরের মধ্যে “ ইন্ডিয়া… ইন্ডিয়া “ বলে চুপ করে গেলেন।
“আচ্ছা,   আগে  কি আমাদের কোথাও  দেখা হয়েছে ?  “
কিন্তু  শ্রুতি  তার প্রশ্নের উত্তর  পাওয়ার আগেই গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের আগের স্টেশন  থেকে স্টার্ট  করেও  ট্রেনটা হঠাৎ  থেমে গেল। ভদ্রলোক ও উঠে, কোচের পিছনে, বোধহয় রেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন।
শ্রুতি  এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
কি হলো আবার! বিদেশের ট্রেন তো সাধারণত  যেখানে সেখানে,  যখন  তখন   থেমে যায়না!  ব্যাপারটা কি হলো?
তখনই ট্রেনের অ্যনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে জানানো হলো যে অপ্রত্যাশিত  ভাবে  ইন্জিনে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। তাই স্টেশন  থেকে  ছাড়তে একটু দেরী  হবে; অবশ্য  খুব  তাড়াতাড়ি, মানে  আধঘন্টা খানেকের মধ্যেই  ট্রেন  পরের স্টেশন,  গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের উদ্দেশ্যে  রওয়ানা  দেবে।  প্যাসেঞ্জারদের এই অসুবিধার জন্য তারা নিতান্ত দুঃখিত।
শ্রুতি  এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি, যার নাম মারিয়া _মানে শ্রুতি  এই মাত্র ই খেয়াল করলো তার আইডিতে লেখা রয়েছে , শ্রুতির  পাশ দিয়ে যাছিল।  শ্রুতি  ও ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললো। “ “এক্সকিউস মি, ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক হতে তো একটু দেরি আছে, এই সময়টায় আমি কি নীচে নামতে পারি?”
মেয়েটি  একটু ইতস্তত করে তাকে নামার পারমিশন দিলো। কিন্তু  সেই  সঙ্গে  সাবধানও করে দিল, সে যেন দূরে না যায়। এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়েই শ্রুতি  জিগ্যেস করলো, “ কেন বলুন তো? জায়গাটা কি সেফ নয়?”
“না, না এই জায়গাটা খুব ই সেফ। আমার বাড়িও এখানে। এখন অবশ্য আমি আর আমার পার্টনার ইন্টারলেকেনে  থাকি। গেছেন?  না গেলে  একবার ঘুরে  নেবেন। ভারী সুন্দর  শহর।
যাইহোক,  এখানে ভয়ের কিছু নেই।  নিশ্চিন্তে  কাছাকাছি  ঘুরুন ফিরুন। নো প্রব্লেম।
বরং একটা  কাজ করুন।  আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান।  ট্রেন ছাড়ার আগে আমি আপনাকে কল করে ডেকে নেব “
তাই সই।
সেটা অবশ্য খারাপ ও হবেনা। ওই সবুজ মেডোতে হাঁটা মানে এক অপার্থিব  অনুভূতি! ভালোলাগায় ভরপুর  হয়ে  পাহাড়  ছোঁয়া  সবুজ মেডোর দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো শ্রুতি।
অন্য কোচ থেকেও কয়েকজন নেমে এসে পায়চারি করছেন দেখা গেল। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মনের আনন্দে সবুজ ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। সত্যি এখানে ভয়ের কিছু নেই। চমৎকার জায়গা আর লোকজন।
হঠাৎ  ঝপ করে শেষ  বিকেলের রোদটা মরে গেলো  আর  চারদিকে কেমন যেন চাপা অন্ধকার ঘনিয়ে  এলো,  সঙ্গে    হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শ্রুতি  কোটের   পকেট থেকে বের করে  টুপিটাও পরে নিলো।
শুধু যে  সন্ধ্যে নেমে আসছে  তা নয়, আকাশ জুড়ে গভীর  কালো মেঘ করেছে।  শ্রুতি  দু এক পা সবে হেঁটেছে তার   মধ্যেই  ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি  শুরু হয়ে গেল।
“ আমার বাড়ি এক মিনিটের রাস্তা। এখানে ঠান্ডায় কষ্ট না পেয়ে, আসুন আমার সঙ্গে “
ও মা, আবার ট্রেনের  সেই ভদ্রলোক!
কথাটা বলেই ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে    এগিয়ে  এসে শ্রুতির  সামনে সামনে চলতে লাগলেন।
হঠাৎ এমন একটা   প্রস্তাবে  শ্রুতি তো  একদম হকচকিয়ে গেল , আর তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তায় ও পড়ে গেল।  গা টা একটু  ছমছম করে উঠলো।
ট্রেনের আলাপ…না ঠিক আলাপ ও বলা যায়না কারন এখনও তারা কেউ কারুর নাম পর্যন্ত জানেনা। এই অবস্থায় ভদ্রলোকের তাকে একেবারে বাড়ি যেতে বলাটা… স্বাভাবিক কি?
সুইটজারল্যান্ডে ছুটকো ছাটকা পিকপকেট ছাড়া  ট্যুরিস্টদের সঙ্গে  অন্য  রকম ক্রাইম হয়না বললেই চলে।  তাহলেও বলা তো যায়না।   এই ভদ্রলোকের ধান্দা অন্যরকম  হতেও তো পারে!
“ শ্রুতি!  তোমার  যখন  এতোই ভয়,  একা একা বেড়াতে  এসেছো কেন?”-
মায়ের গলায় শ্রুতি  নিজেই নিজেকে  একটা  ধমক দ্যায়।
“ ভয় করছে? “
আবার সেই  মদির ব্যারিটোন ভয়েস।
ভদ্রলোক  কি মনের কথাও পড়তে পারেন? মনে ভাবে শ্রুতি।
মুখে অবশ্য  বলে,  “ না,  ভয় করবে কেন? “
আর সত্যি বলতে কি এখন ওর ততো ভয়ও লাগছেনা।  এমন একজন  নাইস এন্ড হট ভদ্রলোকের    সঙ্গে সবুজ ঘাসের  মখমলি কার্পেট  মাড়িয়ে একসঙ্গে হেঁটে  চলার সম্ভাবনা…না: মন্দ নয়!
ঠোঁটের  কিনারে একটু  হালকা  হাসির রেখাও ফুটে উঠলো  শ্রুতির।
যদিও  তার   স্বাভাবিক  স্বভাব  চরিত্রের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত  ঠিক মেলেনা, তাহলেও    এইমুহূর্তে  কোনো  এক আশ্চর্য  কারণে,   এই চিন্তা তার কাছে   দারুণ, দারুণ    আকর্ষক    লাগছে।
তার বুকের  ভেতরটা উত্তেজনায়  কী ভীষণ যে ঢিপঢিপ করছে!
আহা হা…এই পথ যদি না শেষ  হয়..
“এই যে বাড়ি। আসুন “
শ্রুতি   ভদ্রলোকের সঙ্গে  হাঁটতে হাঁটতে, সুখ কল্পনায় গা ভাসিয়ে  কখন একখানা  দারুন কটেজের সামনে চলে এসেছে, খেয়াল ই করেনি।
“ আসুন “
এবার পুরোপুরি সম্বিত ফেরে শ্রুতির।
ঠিক যেন গল্পের বই থেকে তুলে আনা একখানা কটেজ । দরজায় বড় সাদা নেমপ্লেটে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা-“ ডঃ লিয়াম বাখম্যান “, আর তার নীচে, “পেট্রা বাখম্যান”।
“পেট্রা আপনার স্ত্রী?”
আবার সেই রহস্যময় হাসি।
“ভালোই হলো আলাপ হয়ে যাবে।আপনার স্ত্রী কি এখন বাড়িতে?’- অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার মতন ই কৌতুহলে শ্রুতি  জিগ্যেস করলো।
“ এক মিনিটে ঢুকে যাবে। এসেই পড়েছে।“
সেই আকর্ষক দৃষ্টিতে শ্রুতির  দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ডঃ লিয়াম বাখম্যান। আর শ্রুতি  এই প্রথম লক্ষ্য করে , লিয়ামের শ্বাদন্ত দুটো অন্য দাঁতের তুলনায় অনেকটা বেশী লম্বা আর ছুঁচলো।
বাড়ির  ভেতরে ঢুকে শ্রুতি  একেবারে মোহিত হয়ে যায়। কী সুন্দর সাজানো ঘর! জানলায় সাদা লেসের পর্দা, সিলিং থেকে  অপূর্ব কারুকাজ করা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, নীচে নরম কার্পেট , ছবি, ডেকরেটিং পিস…সব মিলিয়ে এ ঘর যে অনেক ভালোবাসায় সাজানো , তার ছাপ সর্বত্র।
এইরকম, ঠিক এই রকম বাড়িই তার চিরকালের ইচ্ছে ছিল। তার রূপকথার সংসার! এমন একটা  বাড়ি  আর এমন রোম্যান্টিক একজন  পার্টনার পেলে শ্রুতিও হয়তো  বিয়েটা করেই ফেলতো। আর তাহলে মা ও খুশ। বাবাও।
আচ্ছা,  লিয়ামের বউ পেট্রাকে তো এখনো  দেখা গেলোনা!   বোধহয় কিচেনে চা কফি কিছু বানাচ্ছে।
লিয়াম এসেই ভেতরের  দিকে  চলে  গিয়েছিল।
এখন  বেড়িয়ে  এসে সোফায়  বসলো।
মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে আছে শ্রুতি আর লিয়াম। লিয়ামের চোখে সেই আকর্ষণ, আকুলতা আরও অজানা কী যেন মেশা আশ্চর্য দৃষ্টি, স্থির হয়ে আছে শ্রুতির  চোখে।
সারা ঘর জুড়ে সুরের হিল্লোল  ছড়িয়ে   বিজিসের গান প্রেম ছোঁয়ানো মদিরার মতো বাজছে,”হাউ ডিপ ইস ইয়োর লাভ”
শ্রুতির  খুব প্রিয় গান। গানটা শুনতে শুনতে শ্রুতির  সারা শরীর  মন জুড়ে  কী সাংঘাতিক  উন্মাদনা! তার শরীর  কাঁপছে, মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে… আর কেন কে জানে চোখ  জ্বালা  করছে…খুব…খুব”
“ আমার স্ত্রীর প্রিয় গান”- বলতে গিয়ে লিয়ামের গলা যেন ধরে আসে।
, *আমারও “
ধরা গলা শ্রুতির।
“ একটা অনুরোধ আছে। আপত্তি শুনবোনা”- আবেগপূর্ণ গলা লিয়ামের।
লিয়ামের ওই গলা শুনে শ্রুতির  হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য  আবারও  স্তব্ধ  হয়ে গেল  কথা বলার শক্তি নেই  যেন। তার দুচোখ জুড়ে শুধুই লিয়াম।
“ একটা গিফট আছে। আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছিনা আঙুলে পরলে কেমন লাগবে। পছন্দ হবে কিনা। আপনার আঙুল টা একটু..”
নিঃশব্দে মোহগ্রস্তের মতো হাতটা বাড়িয়ে দেয় শ্রুতি।  আংটি টা শ্রুতির  অনামিকায় পরিয়ে দেয় লিয়াম। একমুহুর্তের জন্য লিয়ামের গ্লাভস ছুঁয়ে থাকে শ্রুতির  হাত।
“ আপনার সঙ্গে আগে কখনও কি আমার দেখা হয়েছে”?
আবারও  জিজ্ঞেস  করে শ্রুতি।
কিন্তু   তার প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই
ঝনঝন করে মোবাইল বেজে ওঠে।
ট্রেন পাঁচ  মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে।
আকাশ গম্ভীর অন্ধকার আগেই হয়েছিল। এখন অল্প অল্প বরফ পড়ছে। জোরে হাওয়া ও দিচ্ছে।
ট্রেনে উঠে শ্রুতি  সীটের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে লিয়াম দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
অবাক শ্রুতির  চোখে প্রশ্নের ইশারা।
শ্রুতির  চোখের দিকে কষ্টে ভরা গভীর চোখে তাকিয়ে নরম গলায় লিয়াম বললো, “ আমার গন্তব্য এই পর্যন্ত ই। আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন।“
“আর কোনো দিন কি আমাদের দেখা হবেনা লিয়াম “- শ্রুতির  হৃদপিন্ড যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
“ হয়তো হবেনা…হয়তো হবে…গ্যালাক্সি অন্তহীন “
বলতে বলতে শ্রুতির  কাছে এসে তাকে বুকের  মধ্যে  আলতো  করে জড়িয়ে ধরলো লিয়াম। হালকা পালকের মতো শ্রুতির  ঠোঁটে লিয়ামের ঠোঁট।ও:, কী হালকা স্পর্শ, ছুঁয়ে আছে কী নেই যেন বোঝা যায়না। শুধু তার ভালোবাসার উত্তাপ বিস্মিত, আকুল শ্রুতিকে ছুঁয়ে থাকে মুহুর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে সরে যায় লিয়াম।
তার সাগর নীল চোখ থেকে জল উপছে ওঠে।
সুখ দুঃখ মেশা গভীর বিষন্ন স্বর লিয়ামের    , “গুডবাই মাই লাভ “
ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
“ আপনাকে একটু চা দিই ম্যাম?” মারিয়া এসে জিজ্ঞেস  করে শ্রুতিকে।
“আচ্ছা মারিয়া, আপনার বাড়িতো এখানেই বলেছিলেন। আমার সামনের সীটে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে চেনেন আপনি ?”
আকুল  আগ্রহ নিয়ে  জিজ্ঞেস  করে শ্রুতি।  যেন এর উপরে তার জীবন মরণ নির্ভর  করছে।
“আপনার সামনের সীটে…!”
খানিকটা বিভ্রান্ত শোনায় মারিয়ার গলা..” না ম্যাম কেউ তো ছিলেননা “
“ বুঝতে পারছি , আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি। নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম লিয়াম বাখম্যান। ডঃ লিয়াম বাখম্যান”
আতংক বিস্ফারিত   চোখে এমনভাবে   চেয়ে থাকে মারিয়া,  যেন ভূত দেখেছে।
“ ডঃ লিয়াম?!...কিন্তু  উনি তো অনেক দিন আগেই   মারা গেছেন।“
“কি বলছেন কি ?!আমি তো এখুনি  ওনার বাড়ি থেকেও ঘুরে এলাম”
“কিছু মনে করবেননা ম্যাম, এটা অসম্ভব।  ১৯৭৭/৭৮ সাল নাগাদ ডঃ লিয়াম আর ওনার স্ত্রী  পেট্রার বিবাহবার্ষিকীর   দিন পেট্রা   ইন্টারলেকেন থেকে এই ট্রেনে করে ফিরছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই   ট্রেনের একটা    সাংঘাতিক  অ্যাক্সিডেন্ট  হয়।  পেট্রা শুধু  যে মারা যায়  তাই নয়, তার দেহ এমন ভাবে  তালগোল  পাকিয়ে গেছিলো  যে তাকে আর চেনাই যায়নি। ওই সামান্য  পোশাক আশাক দেখে আর কী…   “
“ এসব কী বলছেন আপনি?” প্রায়  না শুনতে পাওয়ার মতো   অস্ফুট স্বর শ্রুতির।
“  সেই শোক ড:লিয়াম সহ্য করতে পারেননি। ওঁরা  দুজনে দুজনকে খুব ভালো বাসতেন। একরকম লিজেন্ডারি লাভ বলতে পারেন। তারপর  থেকে  ড: লিয়াম কাজকর্ম  প্রায়  ছেড়ে  দিয়েছিলেন।   প্রতিদিন  এই ট্রেনের ভেতর  পেট্রাকে খুঁজে  বেড়াতেন।   মাথাটাই আরকি…
বারবার বলতেন, “  ওর মুখ আমাকে আর একবার  দেখতেই হবে। ওকে প্রপারলি গুডবাই না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। ওকে আমার কাছে আসতেই হবে।“
শোকের যন্ত্রণাতেই হয়তো   স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই ডঃ লিয়ামও   মারা যান।
ওনাদের অতো ভালোবাসা  দিয়ে  তৈরি  করা কটেজটাও  একদম ভেঙে চুরে পড়ে আছে।“
“আপনি  ভুল লোকের  কথা  বলছেন  মারিয়া।  এ হতে পারেনা।
আমি অন্য লিয়ামের কথা বলছি। আমি  এইমাত্র লিয়ামের বাড়ি থেকে  ঘুরে  এলাম যে”।
শ্রুতির  দিকে  একটা অদ্ভুত  দৃষ্টি দিয়ে চলে যাবার আগে মারিয়া  বলে গেল – “আপনি জানলা দিয়ে দেখুন, ট্রেনটা বাঁক নেবার মুখে ডঃ লিয়ামের বাড়িটা দেখা যায়।  দেখুন তাকিয়ে ।“
জানলা দিয়ে আকুল হয়ে বাইরে তাকায় শ্রুতি।  দুহাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ট্রেনের জানালার কাঁচ আঁকড়ে ধরে পলকহীন চোখে বাইরের দিকে কটেজ খানা খুঁজতে  থাকে।
হ্যাঁ, ওইতো, ওইতো কটেজ টা, কিন্তু একমুহুর্তে এ কী অবস্থা!
ভাঙাচোরা ছাত…তার  খানিকটা আবার উড়েই গেছে। শুধু মাত্র আধভাঙা একপাশে হেলে থাকা দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা ডঃ লিয়াম বাখম্যান। নামটা কালচে হয়ে গেলেও এখনও পড়া যাচ্ছে।
শ্রুতির মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সে   কি ঘুমের  মধ্যে  স্বপ্ন  দেখছে!
নাকি হ্যালিউসিনেট করছে!
কিন্তু   তার বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে..  ফোঁপানোর মতো  কিছু  বুকের একেবারে  ভেতর থেকে  উঠে  আসছে…  ইচ্ছে  করছে, চিৎকার করে কেঁদে  উঠতে।
নিজেকে  সামলানোর চেষ্টা  করতে করতে   সামনের টেবিলে  রাখা   টিস্যু পেপারের দিকে হাত  বাড়াতেই    শ্রুতির   চোখ আটকে  গেলো আংটিটাতে। যেটা লিয়াম একটু আগেই তার  অনামিকায়   পরিয়ে দিয়েছে।
আংটিটার  ' এল ' আর '- পি' অক্ষর দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে  মিশে  আছে যেন,
আর তাদের চারপাশ ঘিরে গোল করে  এমবস করা একটাই শব্দ –' Liebe '  ।
শ্রুতি  জানে তার মানে  'ভালোবাসা'।।
 

 
 
 
 
 
 
 

 
  

0 comments: