প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধমনযোগের অর্থনীতি এক নতুন ধারণা। আমরা দেখেছি মনযোগ দিয়ে কাজ করলে কাজ ভালো হয় , ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, এছাড়াও দেখেছি যে কাজের বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যায় , মনযোগের ফলে।
মার্কিন মনোবৈজ্ঞানিক সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যাতে সংজ্ঞানীয় সম্পদগুলি পরিবেশের অন্য সব দিক বাদ দিয়ে কিছু বিশেষ দিকের উপরে কেন্দ্রীভূত হয়।"
আরেকটি সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল কোনও বিশেষ তথ্যের উপরে কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের চেতনায় আসে, আমরা বিশেষ কোনও তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপরে সিদ্ধান্ত নেই কোনও পদক্ষেপ নেব না কি নেব না।"
মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ। কেন দেখা যাক ।
বর্তমানে আধুনিক তথ্য যুগে এসে প্রায় সবার আন্তর্জাল তথা ইন্টারনেট সংযোগ থাকার সুবাদে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল বিষয়বস্তু (তথ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা) তাৎক্ষণিকভাবে সুলভ এমনকি বিনামূল্য হয়ে পড়েছে।
কিন্তু মানুষের মনে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন সময়ের পরিমাণ এক মিনিটও বাড়েনি। ফলে তথ্য নয়, বরং মনোযোগ একটি সীমিতকারী নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রচুর তথ্য , মনযোগের সময় সীমিত – কাজেই টানাটানি ।
তাত্ত্বিকভাবে পরিমাপযোগ্য না হলেও কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপরে মানুষ কতটুকু সময় মনোযোগ দান করে, তার উপর ভিত্তি করে মনোযোগের একটি মূল্যমান বের করা সম্ভব।
ইংরেজিতে "মনোযোগ দিয়ে পরিশোধ" (টু পে অ্যাটেনশন) নামক যে পদবন্ধটি আছে, তা থেকে বোঝা যায় মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে।
একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অপর দিকে সেটি দেওয়া সম্ভব নয়।
সবার কাছে এখন এত বেশি তথ্য লভ্য হয়ে পড়েছে যে এর ফলে মনোযোগ ব্যবহার করে সবচেয়ে মূল্যবান তথ্যটি বের করে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালেই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে "একটি তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছু ঘাটতির সৃষ্টি হবে, যা হল তথ্য যা কিছু ভোগ করে। তথ্য কী ভোগ করে, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান: তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে।
সমসাময়িক তথ্য যুগে এসে পরিগণক যন্ত্র (কম্পিউটার), বুদ্ধিমান মুঠোফোন (স্মার্টফোন) ও আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সবার হাতের কাছে চলে আসায় তথ্য আর কোনও মূল্যবান সম্পদ নয়, বরং মানুষের মনোযোগ হল তার চেয়ে বেশি মূল্যবান। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলি (যেমন গুগল, মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তাদের তথ্য সরবরাহ সেবাটি প্রদান করে থাকে। ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগ দিয়ে (অর্থাৎ মোটা দাগে কতটুকু সময় তারা ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মঞ্চে ব্যয় করছে) ঐসব প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করে। ব্যবহারকারী যত বেশি সময় কোনও ওয়েবসাইটে বা আন্তর্জাল মঞ্চে ব্যয় করবে, তাকে কোনও কিছু ক্রয় করতে প্ররোচিত করা তত বেশি সহজ হয়ে উঠবে।
এ কারণে কোনও কোনও বিশ্লেষক ২১শ শতকের প্রথম দুই দশককে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গোল্ডহেবারের মতে ২০শ শতকের শেষে এসে উন্নত বিশ্বের শ্রমশক্তির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আর ভৌত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের সাথে জড়িত নয়, বরং তারা তথ্যের কোনও না কোনও রূপ ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এই নতুন অর্থনীতির নাম দেওয়া হয় "তথ্য অর্থনীতি"।
কিন্তু তার মতে এই উপাধিটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোনও সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলি কীভাবে ব্যবহার করে, সে সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। কিন্তু আধুনিক তথ্যযুগে এসে তথ্য কোনও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়, বরং তথ্য বাতাসের মত সর্বক্ষণ ও সর্বব্যাপী বিদ্যমান। অন্যদিকে আন্তর্জালে সত্যিকার অর্থে যে জিনিসটি দুষ্প্রাপ্য, তা হল মানুষের মনোযোগ। তাই স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাল জগতের অর্থনীতির মূল বিনিময় মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।
নতুন আন্তর্জাল অর্থনীতিতে সেবাগ্রাহক বা ব্যবহারকারীর মনোযোগ যে অর্থের সমতুল্য, তার একটি উদাহরণ হল আন্তর্জাল ভিত্তিক সরাসরি সঙ্গীত পরিবেশনা মঞ্চ স্পটিফাইয়ের মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি।
প্রাথমিকভাবে গ্রাহকেরা স্পটিফাইয়ের বিনামূল্যের একটি সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তাদেরকে গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে কিছুক্ষণ বিজ্ঞাপন শুনতে হয়, নইলে পরবর্তী গান শোনা যায় না।
এভাবে ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাইয়ের সেবার মূল্য পরিশোধ করেন।
কিন্তু স্পটিফাইয়ের দ্বিতীয় একটি সংস্করণে যদি ব্যবহারকারী অর্থের দ্বারা মাসিক একটি মূল্য পরিশোধ করেন, তাহলে তাকে আর কোনও বিজ্ঞাপন শুনতে হয় না।
এভাবে মনোযোগকে বিনিময়যোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাই গ্রাহক ধরে রাখে ও ভবিষ্যত অর্থ-পরিশোধকারী গ্রাহক সৃষ্টি করে।
আমাদের কাছে পড়ে রইল কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা আর মনযোগ – সেটাকেই না হয় শান দেই – ধারালো করি , তথ্য তো আসবেই বিনামূল্যে।
0 comments: