0

সম্পাদকীয়

Posted in




কোজাগরী... কে জাগে? আসলে জাগে সকলেই। নিজের মনের কাছে সকলেই জাগ্রত, অতন্দ্র। সকলেই মনে মনে জানে সন্ত্রাস, বিদ্বেষ, ভিন্নতা, সবই নিরর্থক, অবিমৃষ্যকারিতা। তবুও ইন্দ্রিয়ের কাছে, রিপুর কাছেই আমাদের পরাজয়। দীর্ণবিদীর্ণ হই মনে মনে, তবুও সংযম অভ্যাস হয় না। 

উৎসবের আলো নিবে আসে একদিন। যে আলোর বিস্তারে অন্তর আলোকিত হওয়ার কথা ছিলো, সে আলোর বিপ্রতীপ গতিতে ভেলা ভেসে যায় দূরান্তের যুদ্ধক্ষেত্রে। অচেনা এই পৃথিবীর গভীরতম অসুখ সেরে যাবে কবে! সীমান্তের প্রান্তে অতন্দ্র বসে সেই সাধনায় নিমগ্ন হয়ে খানিক অবসর যাচনা করি, যে সাধনা আমাদের শুদ্ধ করে, নির্মল করে, যে সাধনায় অন্তরের জ্ঞান ও তার অর্জনের বিস্তার এক অপ্রতিরোধ্য গতি লাভ করে। 



প্রকাশিত হলো ঋতবাক অষ্টম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা। নিয়মিত বিভাগগুলির সঙ্গে শুরু হলো নতুন বিভাগ 'নোলা পরিক্রমা - দুই পেটুকের স্বাদ সন্ধান' - বেসিক্যালি ফুড রিভিউ, লেখায় ময়ূখ, ছবি তোলায় ইরাবান - মতামত দুজনেরই। আশা করি, উপভোগ্যই হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। 
 
শুভ বুদ্ধির জয় হোক

শুভেচ্ছা নিরন্তর 

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শ্রীশুভ্র

Posted in




















ইতিহাস অবশ্যই চর্চার বিষয়। ইতিহাস কি অতীত হয়ে যায়? যায় নিশ্চয়ই। ইতিহাসের চর্চা যখন স্তব্ধ হয়ে যায়। ব্যহত হয়ে যায়। তখন সত্যিই, ইতিহাসও অতীত হয়ে যায় বইকি। অতীত হয়ে যাওয়া মানে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া। চেতনার নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। সম্পূর্ণ অতীত হয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস আর আমাদের কোন কাজে আসে না। কিন্তু নিজের ইতিহাস না জানলে নিজের বর্তমানকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আর বর্তমানকে না চিনতে পারলে, সময় থাকতে ভবিষ্যতের দিশা ঠিক করাও সম্ভব নয়। দিশাহীন ভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর অর্থ দিকভুল হওয়া। না, সেরকম ভাবে দিকভ্রান্তের মতো এগোতে চাই না নিশ্চয়ই আমরা কেউই। আর ঠিক এই কারণেই ইতিহাসের চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নিজের ইতিহাসটুকু জানা খুব জরুরী। নিজের ইতিহাস অর্থে নিজ দেশের ইতিহাস। সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনীতির ইতিহাস। স্বজাতির ইতিহাস। নিজ সংস্কৃতির ইতিহাস। আবার তাই বলে দেশের প্রতিটি মানুষ এক একজন ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন। সেটাও নিশ্চয় নয়। সেকথা কেউই বলে না। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষ তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির, সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের কিছুই জানবেন না। তেমনটাও নিশ্চয়ই কোনভাবেই অভিপ্রেত নয়। শুধুই যে শিক্ষিত মানুষ আপন ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন তাই নয়। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে পড়ে থাকা জনগণের বৃহত্তর অংশও কিন্তু সমাজিক ভাবেই আপন ইতিহাস সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা রাখে। সেটা কিভাবে সম্ভব হয়? সম্ভব হয়, আমরা যাকে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বলে থাকি। সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার ভিতর দিয়েই সাধারণ ভাবে প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থাকা মানুষও আপন ইতিহাসের খোঁজ রাখেন। এইভাবেই কালে কালে সমাজ এগিয়ে চলতে থাকে। এগিয়ে চলতে থাকে ইতিহাসের চর্চাও। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই চর্চা অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুসংহত ভাবে করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর বাইরেও সামাজিক জীবনেও ইতিহাসের যে চর্চা চলতে থাকে। তার মূল্যও কম নয়। মূল্য কম নয় তার একটা বড়ো কারণই হলো, সাধারণ মানুষের চিন্তা ও চেতনা, জ্ঞান ও বুদ্ধির উপরে সেই চর্চার একটা স্থায়ী প্রভাব পড়তে থাকে। সমাজ তার নিজস্ব গতিতে ইতিহাসের যে চর্চাটুকু চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, সামগ্রিকভাবে সাধারণ জনমানসে তার প্রভাবই সমধিক। বস্তুত ইতিহাসের বইয়ের পাতায় কোন ইতিহাস কিভাবে লেখা থাকলো। তার থেকেও ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় যে ইতিহাস দাঁড়িয়ে যেতে থাকে তার প্রভাব অনেক বেশি। বেশি তার কারণ এইখানেই যে, সেই ইতিহাস প্রায় প্রতিটি মানুষকেই ছুঁয়ে থাকে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়জন ইতিহাসের পরীক্ষায় পাস করে কতো বড়ো সার্টিফিকেট পেল, তাই দিয়ে সমাজ চলে না। সমাজ যেভাবে তার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরাকে বহন করে নিয়ে চলে। সেইভাবেই জনমানসে ইতিহাসের চর্চা জারি থাকে। এইভাবে চলতে চলতেই আমরা ব্রিটিশ শাসন পর্বের তথাকথিত আধুনিক যুগে এসে পৌঁছিয়েছিলাম একদিন।

আবার একথাও ঠিক। শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরেই নির্ভর করে থাকলে ইতিহাস চর্চা কখনোই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। তার অন্যতম বড়ো কারণ হলো এই। ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরা কোন স্থায়ী রূপে আবর্তিতও হয় না। চলতে থাকে না একরকম ভাবেও। কালে কালে, নতুন কালের হাওয়া লেগে ঐতিহ্যও সময়ের সাথে বদলাতে থাকে। ফলে পরবর্তীতে উত্তরাধিকারের হাত ধরে ঐতিহ্যের বদলটাই সামনের কালের অভিমুখে টিকে থাকে বেশ কিছুকালের জন্য। কিন্তু ততক্ষণে ঐতিহ্যের বদলের পূর্বরূপটা পরবর্তী প্রজন্মগুলির কাছে হারিয়ে যেতে থাকে। হারিয়ে যায়। ফলে ইতিহাসের চর্চা যখন শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে পরম্পরায় সংঘটিত হতে থাকে। তখন ইতিহাসের দৈর্ঘ্য কালে কালে ক্ষয়ে যেতে থাকে। ধরা যাক গৌতম বুদ্ধের জীবৎকালে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় যে ইতিহাসটুকু সজীব ছিল। গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী এক হাজার বছর পরে নিশ্চয় সেই ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। তার পরের হাজার বছরে আগের হাজার বছরের ইতিহাসেরও অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। কারণ সময়ের সাথে ঐতিহ্য কখনোই এক জায়গায় এক ভঙ্গিমায় থেমে থাকে না তো। ফলে ঐতিহ্যের বদলের সাথে সাথে অতীত ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে যেতে থাকে। যায়। অর্থাৎ শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরে নির্ভর করে থাকলে বেশিদূর অতীতের ইতিহাস মুছে যেতে থাকে। যদি না ইতিহাসের চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ধারণ করে রাখা যায়। আর ঠিক এইখানেই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সুসংহত ভাবে ইতিহাসের চর্চাকে ধারণ করে রাখতেও হয়। ইতিহাসের চর্চাকে নিরন্তর সজীব ও সচল করে রাখতেও হয়। না, সেকাজ সাধারণ জনসাধারণের নয়। সেই কাজ বিশেষ ভাবে শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের। সেই কাজ ঐতিহাসিকদের। তাদের কাজের ভিতর দিয়ে চর্চিত ইতিহাসের দীক্ষাকে জনসমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষা ব্যবস্থার। যে দেশ, যে জাতি সেই কাজে যত বেশি সফল। সেই দেশ সেই জাতি তার বর্তমানকে তত বেশি করে উন্নত করে তুলতে সক্ষম হয়। এটা ইতিহাসেরই বিধান। আজকে ইউরোপ, আমেরিকা তাদের দেশ ও সমাজ, অর্থনীতি ও শক্তিকে যতটা উন্নত করে তুলতে পেরেছে। সেটি সম্ভব হয়েছে তারা যতটা সফল ভাবে তাদের ইতিহাসকে সমগ্র জাতিসত্ত্বায় প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছে। তার ভিত্তিতেই। অনে‌কেই বলতে পারেন তা কেন। ইউরোপ, আমেরিকা উন্নতি করতে পেরেছে তার কারণ তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বলেই। অনেকের আবার এমনও ধারণা, ইতিহাসের চর্চা করা মানে পিছিয়ে পড়ে থাকা। এই দুই ধারণাই অভ্রান্ত নয়। পথ চলার সময়ে আমার পিছনের পা ঠিক কোনখানে কোন অবস্থানে ছিল, সেই সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলে, প্রায় প্রতি পদেই সামনের পা অজায়গায় ফেলার সম্ভাবনা থাকে ষোলো আনা। এগিয়ে চলতে গেলে সামনের পা ঠিক কোথায় ফেললে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলা সম্ভব সেটি জানতে গেলে পিছনের পায়ের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করা ছাড়া কোন গতি নেই। থাকতেই পারে না। যেকোন দেশ ও জাতির সম্বন্ধেও ঠিক একই কথা। সেই পিছনের পায়ের অভিজ্ঞতার জ্ঞানই ইতিহাস। যেটি ঠিকমতো না জানতে পারলে সঠিক দিশায় দ্রুত সমানের দিকে এগোনা মুশকিল। পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। অবোধ শিশু যখন টলমল পায়ে চলতে শুরু করে। তখন তার এই পিছনের পায়ের কোন অভিজ্ঞতার বোধ জন্মায় না। ফলে সামনে গর্ত থাকলেও সে এড়িয়ে যাওয়ার বুদ্ধির কোন খোঁজ পায় না। ফলে হোঁচোট খেয়ে পড়ে। ইতিহাস বিমুখ জাতিও তাই উন্নত হয়ে উঠতে পারে না। শিশুর মতোই তাকে অন্যের হাতের উপরে নির্ভর করে পথে চলতে হয়। এইখানেই উন্নত দেশ ও সমাজগুলির উন্নতির পিছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাবসা ও বাণিজ্যের অবদানের অনেক আগে সঠিক ইতিহাস চর্চার অবদান রয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের নিরন্তর চর্চার ভিতর দিয়েই তারা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই শিক্ষা ও দীক্ষা, জ্ঞান ও দর্শনের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এইগুলির উন্নিত না হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাবসা ও বাণিজ্যের উন্নতি ঘটানো অসম্ভব। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগুলির ভিতরে এবং বিশেষত বাঙালির চেতনায় এই সোজা কথাটি আজও ঢোকে নি। যার মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিন।

ফলে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশের সূর্য উদয় হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের চর্চা মূলত সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। এখন ইতিহাসের চর্চা যখন ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় চলতে থাকে, তখন ইতিহাসের ভুলগুলি থেকে সঠিক শিক্ষা নেওয়ার কোন অভিজ্ঞতাও গড়ে ওঠে না। অন্ধবিশ্বাসের মতো যখন ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরাকে আমরা সতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিতে থাকি, তখনই সতীদাহের মতো মর্মান্তিক প্রথাও চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। আর এইখানেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রণালীর ভিতর দিয়ে ইতিহাসের গবেষণা ও চর্চার প্রয়োজন সীমাহীন। ব্রিটিশ শাসনের আগে অব্দি আমরা সেই প্রয়োজনের গুরুত্ব সম্বন্ধেই সচেতন ছিলাম না কোনদিন। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন জাতিই নিজের ইতিহাসের সন্ধান করেনি তেমনভাবে। ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরায় সমাজিকভাবে যতটুকু ইতিহাসকে ধারণ করা যায়, তার বেশি ইতিহাসের সন্ধান ছিল না আমাদের চেতনায়। ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি ভারতীয় উপমহাদেশকে সঠিক ভাবে চেনার ও জানার লক্ষ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সন্ধান শুরু করলো। যে কোন জাতিকে তার সমাজ ও সংস্কৃতিকে জানতে গেলে সেই জাতির ইতিহাস জানা সবচেয়ে বেশি জরুরী। ইউরোপের জাতিগুলি সেই সত্য সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন ছিল বলেই, ব্রিটিশ শাসন পর্বে তারা ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগুলির ইতিহাসের সন্ধানে তৎপর হয়ে উঠলো। আর ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করার কাজে ব্রিটিশের পক্ষে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস জানা তো অনিবার্য্য ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধুমাত্র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরার উপরেই তারা নির্ভর করলো না। কারণ পূর্বেই বলেছি। এই পথে কেবলমাত্র সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকুই সজীব থাকে। বহু পূর্বের ইতিহাস জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায় কালের বিবর্তনে। ফলে ইউরোপের গবেষকরা একেবারে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শুরু করে দিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সন্ধান ও গবেষণা। আর সেই কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এলো ব্রিটিশ। তাদের দায় ছিল এই ভূখণ্ডকে শতকের পর শতক পরাধীন করে রাখার। কোন ভূখণ্ডের মানুষকে শতকের পর শতক পরাধীন করে রাখতে গেলে, সেই ভূখণ্ডের ইতিহাসের নাড়িনক্ষত্র জানা জরুরী। এই কথাটুকু ব্রিটিশ শাসকরা সকলের প্রথমেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আবার একথাও ঠিক। ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাসের অনুসন্ধানের ভিতর দিয়েই ইউরোপের জাতিগুলি সামনের দিকে এগিয়ে চলার সঠিক পথনির্দেশও অর্জন করেছিল। ভারতীয় ভূখণ্ডের জাতিগুলি দীর্ঘ কাল সীমায় যে যে ভুল করেছিল। তার থেকে সকলের আগে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার পথনির্দেশ লাভ করে নিল ইউরোপ ও আমেরিকা। আমরা পড়ে রইলাম আমাদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের পরম্পরা নিয়েই। আর সেই সুযোগে ব্রিটিশ আমাদের উপরে প্রবল পরাক্রমে জাঁকিয়ে বসে পড়লো।

ফলে সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থা দিনে দিনে বিলুপ্ত হতে থাকলো। আমরা ব্রিটিশের পত্তন করা শিক্ষা ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে উঠতে থাকলাম। এখন ব্রিটিশের পত্তন করা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে ব্রিটিশের অনুগামী একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত মোসাহেব গোত্রের ভৃত্য তৈরীর। যারা ব্রিটিশের শাসন শোষণ অত্যাচার ও লুন্ঠনের কাজে ব্রিটিশকে কায়মনবাক্যে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এবং ব্রিটিশ, ইংরেজি ভাষায় দক্ষ এই শ্রেণীর সাহায্যেই ভারত শাসন চালিয়ে যাবে শতকের পর শতক। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোটা কালপর্ব এইভাবেই চলেছিল, সেকথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এতে একটা সর্বনাশ যেটা ঘটেছিল সেটি হলো এই। ব্রিটিশের স্কুলে ঢুকে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে যে নব্য শিক্ষিত ইংরেজি জানা শ্রেণীটি তৈরী হলো। তারা ভারতীয় উপমহাদেশের সেই ইতিহাসই জানতে পারলো ব্রিটিশ যে ইতিহাস ঠিক যেরকম ভাবে জানাতে চেয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের যে মূল্যায়ণ ব্রিটিশ করেছিল, সেটি যেমনই হোক না কেন। আমাদেরকে তারা যে সিলেবাসের খোঁড়ারে বেঁধে রেখে তৈরী করেছিল। সেই সিলেবাস তাদের হাতে তৈরী। তারা ঠিক যেভাবে আমাদের ইতিহাস আমাদেরকে জানাতে চেয়েছিল। আমরা ঠিক সেইভাবেই আমাদের ইতিহাস জানতে শিখেছিলাম। ব্রিটিশ শুধুই যে রাজনৈতিক ভাবে প্রশাসনিক ভাবে আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল তা নয়। তারা আমাদের চেতনাকেও পরাধীন করে রেখে দিয়েছিল। ইতিহাসকে মানুষ জানবে শাসকের চোখ দিয়ে। শাসক যেভাবে ইতিহাস জানাতে থাকবে। মানুষকে সেই ভাবেই যখন ইতিহাস জানতে হয়। তখনই মানুষ শাসকের হাতে পরাধীন হয়ে যায়। সেই শাসক দেশীয়ই হোক আর বিদেশী হোক। তফাৎ বিশেষ কিছু থাকে না। ফলে সুচতুর ব্রিটিশ শতকের পর শতক ভারতীয় উপমহাদেশকে পরাধীন করে রাখার উপায় স্বরূপ এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের এক ধরণের মূল্যায়ণ চাপিয়ে দিয়েছিল আমাদের উপরে। আমরাও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠার সাথে সাথেই ইতিহাসের সেই মূল্যায়ণকেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত মূল্যায়ণ বলে গ্রহণ করে নিলাম। যার ফলে আমাদের ভিতরে ব্রিটিশের প্রতি ভক্তি বংশ পরম্পরায় অটুট থাকতে শুরু করে দিল। হ্যাঁ আমরা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছি। নিজের দেশের শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে চেয়েছি বইকি। যাকে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন বলে অভিষিক্ত করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে আমাদের ভিতরে ব্রিটিশের প্রতি ভক্তি ভালোবাসার ঐতিহ্য উত্তরাধিকারের পরম্পরায় আজও ছেদ পড়েনি। আজও দেশশুদ্ধ লোক বিশ্বাস করে, ভাগ্যে ব্রিটিশ এসেছিল। আমাদের পরাধীন করে দেশটাকে দখল করে নিয়েছিল। না হলে আজও আমরা আধুনিক হয়ে উঠতে পারতাম না। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা। ইংরেজি না জানতে পারলে বিশ্বের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ঘটানোই নাকি সম্ভব হতো না। ভারতীয় উপমহাদেশের যাবতীয় উন্নতির কারিগর তো সেই ব্রিটিশই। এই যে বদ্ধমূল বিশ্বাস। এবং সেই বিশ্বাসজনিত ভক্তি। সেই ভক্তি সময়ের সাথে আরও বেশি করে সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের সাড়ে সাত দশকের সময় সীমাতেও।

এখন প্রধান যে বিষয়টির উপরে আলোকপাত করা দরকার। সেটি হলো, ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস থেকেই আমাদের চেতনায় এক বদ্ধমূল ধারণা জন্মিয়ে গেল যে ভারতবর্ষ একটি দেশ। সেটি সম্ভব হলো কারণ ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে আমাদের সামনে এমন ভাবেই উপস্থাপন করলো যে আমরাও ধরে নিলাম জার্মানী, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো ভারতবর্ষও একটি দেশ। অথচ ইতিহাসের যে ধারায় ইউরোপ একটি দেশ নয়। মহাদেশ। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতি ও ভাষা ভিত্তিক এক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সমষ্টি, ঠিক সেই একই ধারাতেই ভারতবর্ষ নামে কখনো কোনদিন বিশ্বের কোথাও কোন দেশ ছিল না। কিন্তু আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হলো ঠিক উল্টোটাই। ব্রিটিশের হাতে পরাধীন হওয়ার আগে অব্দি ইতিহাসের কোন পর্বেই ভারতবর্ষ বলে কোন দেশের অস্তিত্বই ছিল না। এটা কারুর ব্যক্তিগত মত বা তত্ত্ব নয়। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস। অথচ ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে আমরা ঠিক উল্টোটাই জানলাম। না, শুধু আমরাই নয়। বাংলা ও বাঙালির সবচেয়ে বড়ো আত্মশ্লাঘার যে পর্ব। বাংলার সেই নবজাগরণের পর্বের রামমোহন থেকে নেতাজী পর্যন্ত এই ভুল ইতিহাসের সিলেবাসের প্রোডাক্ট। যার মূল্য আজও বাংলা ও বাঙালিকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। সে অন্য প্রসঙ্গ। শাসকের স্বার্থে তৈরী করে দেওয়া ইতিহাসের সিলেবাস কি নির্মমভাবে এক একটি জাতিগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ ঝাঁঝরা করে দিতে পারে। এই ঘটনা তার অন্যতম বড়ো প্রমাণ। না, ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে বলেই যে এই অভিশাপের সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে তেমনটাও নয় আদৌ। আলোচনার পরবর্তীতে আমরা সেই বিষয়ে আলোকপাত করবো যথাসময়ে। এখন অনেকের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে। প্রায় একটি মহাদেশসম উপমহাদেশের ইতিহাসকে ব্রিটিশ কেন একটি দেশের ইতিহাস বলে চালিয়ে দিল। এবং শুধু দিলই না। একেবারে পাখি-পড়া করে আমাদের বিশ্বাস ভরসা চেতনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। যার থেকে একজন মানুষও আজও মুক্ত হতে পারলো না। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, যে কোন ভূখণ্ডের মানুষকে যদি তার জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকে উপড়িয়ে তুলে আনা সম্ভব হয়। তবে তাকে অনন্তকালের জন্য বশংবদ করে রাখা সহজ হয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই ব্রিটিশ শাসন পর্বে আমরা আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বার চেতনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। উল্টে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করে সম্পূর্ণ এক কাল্পনিক মনগড়া ভারতীয় জাতিসত্ত্বায় বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক যে কারণে আমরা বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা চাইনি কোনদিন। আমরা ভারত ও ভারতীয়দের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। ব্রিটিশ জানতো, এর ফলে ব্রিটিশ যেদিন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলেও যাবে। সেদিনও ব্রিটিশের বদলে যারা শাসকশ্রেণী হয়ে উঠবে। তারাও ব্রিটিশের মতোই শাসন ও শোষণ অত্যাচার ও লুন্ঠনের কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সহজেই। একটি দেশ গড়ে ওঠে এক ভাষা ও এক জাতিগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। এটাই ইতিহাসের বিধান। তখন সেই দেশের জনসাধারণের ভিতরে যে স্বদেশ প্রেম যে জাতীয়তার বোধ গড়ে ওঠে, তাতে এক দেশ এক প্রাণ এবং একটিই জাতীয় স্বার্থের বোধ জন্ম নিতে থাকে। ফলে সেই দেশ তখন সমাগ্রিকভাবে সমগ্র দেশ ও সকল দেশবাসীর উন্নতির জন্য স্বচেষ্ট হয়। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশের দিকে তাকালেই আমরা ইতিহাসের এই বিধান প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু পঁয়ত্রিশটি জাতি, ভাষা ও আলাদা আলাদা দেশকে একটিমাত্র মানচিত্রে গেঁথে দিলে যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে। তাতে কখনোই এক দেশ এক প্রাণ এক জাতিসত্ত্বার উদ্বোধন হয় না। সেই জগাখিচুড়ি অবস্থাকে বৈচিত্রের ভিতরে ঐক্যের সমন্বয় বলে চালানো সহজ হলেও তাতে লাভ হয় শুধুমাত্র শাসন ও শোষণের। অত্যাচার ও লুন্ঠনের। ভারতীয় উপমাদেশকে ভারতবর্ষ বলে চালিয়ে ব্রিটিশ সেই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেছিল। আজকে ব্রিটিশের বদলে যারা শাসকশ্রেণী। তারাও সেই একই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে চলছে। এটাই এই ভূখণ্ডের অন্যতম প্রধান অভিশাপ।

শাসক তার স্বার্থে যে ইতিহাস রচনা করে। সেই ইতিহাস মানুষের বিশেষ উপকারে আসে না। উল্টে অপকার নিশ্চিত করে। ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের ভিতর ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যতটুকু মিল। বাংলা ও মহারাষ্ট্রের ভিতরেও ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ততটুকুই মিল। ফ্রান্স যেমন এককালে ইংল্যাণ্ড অধিকার করে শাসন করেছিল। মারাঠী বর্গীরা বাংলা দখল করে তেমন ভাবে শাসন না করলেও বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন একজন ফরাসী কিন্তু কখনোই একজন ব্রিটিশকে আপন স্বজাতি বলে মনে করবে না। কিন্তু ভারতীয় বাঙালি মাত্রেই মারাঠীদের আপন স্বজাতি বলে মনে করে থাকে। তার কারণ বাঙালিরা ব্রিটিশের সিলেবাস মুখস্থ করে মারাঠীদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ভারতীয়। যদিও কোন মারাঠীই বাঙালিকে আপন স্বজাতি বলে মনে করে না। করার কথাও নয়, করা উচিতও নয়। কজন তামিল পাঞ্জাবীদের আপন স্বজাতি বলে মানে? এই দুই জাতির ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভিতর এমন কি জলবায়ুর ভিতরেও কতটুকু মিল রয়েছে? একটু স্বাধীন ভাবে ভাবলেই সঠিক উত্তরটি জানা সম্ভব বইকি। ঠিক তেমনই গুজরাটীদের সাথে তেলেঙ্গানার অধিবাসীদেরই বা মিল কোথায়? কিংবা রাজস্থানীদের সাথে আসামীদের? এই যে প্রত্যক্ষ অমিলের বিষয়গুলি। এই ধরণের অমিলগুলি ইটালী, জার্মান, পোলিশ, সুইডিশ, গ্রীক, রাশিয়ানদের ভিতরেও একই রকমভাবে প্রত্যক্ষ। কিন্তু তাই বলে কেউ দাবি করে না তারা একই জাতি। কিন্তু ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাসে আমাদের মনে করতে হচ্ছে তামিল, নাগা, পাঞ্জাবী, বাঙালী, মারাঠী, আসামী, গুজরাটি, কাশ্মীরী সব এক জাতি। না, এই সর্বনাশা ইতিহাস কোনদিন কোন মানুষের উপকারে আসতেই পারে না। আসার কথাও নয়। তাহলে এই ইতিহাসে উপকার কাদের হয়? কাদের কোন কোন স্বার্থ রক্ষিত হয়? উপকার হয় শাসকশ্রেণীর। উপকার হয় শিল্পপতিদের। তাদের শাসন ও শোষণের চুরি ও লুন্ঠনের স্বার্থ রক্ষা হয়। ১৯৪৭ এর আগে সেই স্বার্থ পূরণ হতো ব্রিটিশের। লিভার ব্রাদার্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলির। ১৯৪৭ এর পর সেই স্বার্থ পূরণ হয়েছে কংগ্রেসের। টাটা বিড়ালাদের। আজকে পূরণ হচ্ছে বিজেপির। আদানী আম্বানীদের। রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকে তখন মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। নয় বলেই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে গিয়েছিল। বাঙালির যত স্বার্থহানিই হোক না কেন। তাতে অবাঙালিদের কিছুই এসে যাবে না। মারাঠীদের ক্ষতিতে তামিলরা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত বোধ করবে না। আজ অবরুদ্ধ কাশ্মীরবাসীদের যন্ত্রণায় ভারতের বাকি কোন জাতগোষ্ঠীরই কিছু এসে যাচ্ছে না। এইভাবে কোন দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। দেশের উন্নতি মানে দেশের আপামর মানুষের উন্নতি। কয়েকজন শিল্পপতির উন্নতিতে দেশ উন্নত হয় না। এই বোধ আমাদের ভিতরে আজও গড়ে ওঠেনি। তার মূল কারণ। আমরা ইতিহাসের পাঠ নিয়েছি শাসকের তৈরী করে দেওয়া সিলেবাস মুখস্থ করেই। যে ইতিহাস শাসকের স্বার্থ রক্ষায় তৈরী করা হয়। এটাই ইতিহাসের রাজনীতি।

ব্রিটিশ চলে গিয়েছে সাড়ে সাত দশক আগে। কিন্তু ইতিহাসের এই রাজনীতি বহাল তবিয়তে আরও নানান শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশের পরে শাসকশ্রেণী হিসাবে কংগ্রেস তার নিজ স্বার্থে ইতিহাসের একটা পাঠ তৈরী করে তুলেছিল কয়েক দশকের সাধনায়। যে পাঠে, ভারতবর্ষের সাধীনতার কাণ্ডারী একমাত্র কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবার। দেশের রূপকার মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশের হাতে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিস্তৃত ইতিহাসকে দশকের পর দশক ধরে ভুলিয়ে দেওয়ার সিলেবাস চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। শুধুমাত্র গান্ধী, নেহেরু ও প্যাটেলের হাতেই ব্রিটিশের পরাজয় ঘটছে। এমনই সম্পূর্ণ অসত্য এক ইতিহাসের সুচতুর নির্মাণ হয়েছে কংগ্রেস শাসনে। গোটা ভারতবর্ষের জনমানস থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী ও তার আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদানকে প্রায় সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে দক্ষ হাতে। বাংলার বিপ্লবীদের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসকে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসের সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা মাধ্যমে সুশিক্ষিত বাঙালি ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষ ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, রাসবিহারী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রতিলতা ওয়াদ্দেদার সহ শতশত বাঙালি শহীদদের নামই জানে না। তাদেরকে সচেতন ভাবে পরিকল্পনা করেই জানতে দেওয়া হয়নি। জানতে দেওয়া হয় না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালির অবদান সম্বন্ধে অবাঙালিদের ভিতর প্রকৃত কোন ধারণাই গড়ে ওঠেনি। উঠতে দেওয়াই হয়নি। হয়নি কারণ। কংগ্রেসের স্বার্থ রক্ষার কারণে। গান্ধী ও নেহেরু পরিবারের স্বার্থে। যে নেহেরু পরিস্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, নেতাজী ফিরে আসলে সকলের আগে তিনিই তরবারি নিয়ে রুখে দাঁড়াবেন। সরকারী দপ্তরে নেতাজীর ছবি টাঙানো ও প্রতিকৃতি রাখার বিষয়ে অলিখিত নিষেধ ছিল। ফলে কংগ্রেসী শাসনামলে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বাঙালির প্রকৃত অবদান প্রায় নস্যাৎ করে অকিঞ্চিৎকর করে দেখাতে হয়েছিল। যাতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রধান রূপকার হিসাবে কংগ্রেস ও গান্ধী এবং নেহেরুই প্রধান হয়ে ওঠে জনমানসে। এই সেই ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি। শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় ইতিহাসের সিলেবাস নির্মাণ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকাকেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। হয়েছে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির স্বার্থেই। শাসকশ্রেণী ও শিল্পমহল তাদের শাসন ও শোষণের স্বার্থেই ইতিহাসের সিলেবাসকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে। সেই ইতিহাস মানুষকে অন্ধকারে রাখতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সেই ইতিহাস মানুষকে শাসকের স্বার্থে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। সেই ইতিহাস দেশের সম্পদ লুঠ করতে সাহায্য করে। ব্রিটিশের তৈরী করে দিয়ে যাওয়া এই রাজনীতিই স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের অন্যতম ইতিহাস। যে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস নয়। শাসকের ইতিহাস।

ভারতবর্ষ যে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। ক্ষমতা হস্তান্তর আর স্বাধীনতা অর্জন যে এক বিষয় নয় সেই ধারণাও আমদের ভিতরে গড়ে ওঠেনি। যদি এই স্বাধীনতা অর্জিত স্বাধীনতা হতো। তাহলে ব্রিটিশ শাসনামলের পর্বের ইতিহাসের বয়ান অন্য রকমের হতো। আজও ভারতবর্ষের মানুষের ভিতরে এমন অহেতুক ব্রিটিশভক্তি দেখা যেত না। আজও ভারতবাসী ব্রিটেন আমেরিকার মোহান্ধ হয়ে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, ব্রিটিশের হাত ধরেই ভারতবাসী সভ্য শিক্ষিত আধুনিক হয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে তার কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের শাসনামলে ইতিহাসের যে সিলেবাস রচনা করা হয়েছিল, তাতে ব্রিটিশকে ভারতবন্ধু হিসাবেই তুলে ধরা হয়েছে বেশি করে। এই হলো ইতিহাসের বয়ান নির্মাণ। এই হলো ইতিহাস নিয়ে রাজনীতির কূটকৌশল। অনুমান করা কষ্টকর নয়, ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির ভিতরেই হয়তো এই নির্দেশ রয়ে গিয়েছিল। যে চুক্তি আজও সম্পূর্ণ গোপন করে রাখা হয়েছে। ইতিহাসের এই বয়ানের দুইটি প্রধান দিক। এক দিকে দেশের স্বাধীনতা এনেছে কংগ্রেস। দেশ ভাগের দায় মুসলীম লীগসহ জিন্নাহর। আর এক দিকে ব্রিটিশের হাত ধরেই ভারত আধুনিক ও সভ্য হয়ে উঠেছে। ফলে ভারতবর্ষ ও ব্রিটেন আর পরস্পরের শত্রু নয়। বরং মিত্র। এই মিত্রতার নির্মাণ ইতিহাসের সিলেবাস তৈরীর ভিতর দিয়েই সম্ভব হয়েছে। শাসকশ্রেণী হিসাবে কংগ্রেস তার গোষ্ঠী স্বার্থকে রক্ষা করতেই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ একপেশে করে পরিবেশিত করেছে। কংগ্রেসের গোষ্ঠী স্বার্থের সাথে যোগ দিয়েছে টাটা বিড়লা সহ গুজরাটি, মারোয়ারী শিল্পমহল। যাদের স্বার্থে স্বাধীনতার আন্দোলনে কমিউনিস্ট ধারার কোন ভূমিকাই দেখানো হয় না। উল্টে কমিউনিস্টদের বিদেশের দালাল হিসাবে চীন, রাশিয়ার দালাল বলে দেখানো হয়ে থাকে। যাতে দেশের ভিতর শিল্পমহলের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের ক্ষোভ বিক্ষোভ কমিউনিস্ট ভাবধারায় সংহত হয়ে উঠতে না পারে। কারণ তাহলেই ধনতন্ত্রের বিপদ। ধনতন্ত্রের বিপদ মানেই দেশের শিল্পমহলের বিপদ। এবং সেই শিল্পমহলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে শাসকশ্রেণী কংগ্রেসেরও বিপদ। ফলে জনমানসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোন প্রভাব যাতে না পড়ে, কংগ্রেসের শাসনামলের ইতিহাসের বয়ান সেই দিকে লক্ষ্য রেখেও নির্মিত হয়েছিল। এর ফলে দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে দেশবাসীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কাজটি সুচারুরূপে সার্থক করে তোলা সহজ হয়ে যায় অনেকটাই। দেশব্যাপী জনমানস যখন প্রকৃত ইতিহাস থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন সেই জনগোষ্ঠীকে ইচ্ছে মতোন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা মাখনের ভিতর দিয়ে ছুরি চালানোর মতো আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণীর কাছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় সাত দশক কংগ্রেস সেই আনন্দকে ধরে রাখতে পেরেছিল অক্লেশে। এইখানেই স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসের নির্মিত বয়ানের সাফল্য।

শাসন ক্ষমতায় সেই কংগ্রেসও আর নেই। শিল্পমহলও শিবির বদল করে ফেলেছে। নতুন শতকে নতুন শাসক। শাসকের শ্রেণী একই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের জায়গায় ক্ষমতার দখল এখন বিজেপির হাতে। এদিকে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের তৈরী করা ইতিহাসের বয়ানে বিজেপি বা তার পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এর কোন ছবি তো নেই। এমনকি প্রকৃত ইতিহাসেও তাদের কোন ভূমিকা নেই। ভূমিকা যেটুকু রয়েছে সেটা ব্রিটিশের পক্ষেই রয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কোন ভূমিকাই নেই। এটাই বিজেপি তথা আরএসএস-এর সবচেয়ে নড়বড়ে আর দুর্বলতার জায়গা। তাই এই দুর্বলতাকে যেভাবেই হোক ঢাকা না দিলে তো কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। ফলে গত সাত বছরে শাসক শ্রেণীকে ইতিহাসের নবতর এক বয়ানের নির্মান কার্য শুরু করতে হয়েছে। একাজ যদিও এক আধ দিনের কাজও নয়। আগামী কয়েক দশক এই কাজ চালিয়ে নিয়ে না গেলে কংগ্রেস নির্মিত ও চর্চিত বয়ানের প্রভাব থেকে দেশের মানুষককে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। আর সেটি না করতে পারলে দশকের পর দশক জুড়ে শাসন ক্ষমতা দখলে রাখাও সম্ভব হবে না। ঠিক এই কারণেই বর্তমান শাসকশ্রেণীকে সাভারকারকে নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর জায়গায় সাভারকারকে যেভাবে হোক বসানোর একটা প্রতিজ্ঞা হয়তো তাদের মধ্যে দৃঢ় হয়ে উঠেছে। তারই নানা রকম লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে বিজেপি ও আরএসএস-এর কর্মকাণ্ডে। একদিকে সাভারকারকে হিন্দুত্বের জাগরণের সাথে জুড়ে রেখে নাথুরাম গডসেকে শহীদ বানানোর প্রয়াসের ভিতর দিয়েই হয়তো তাদের লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনার পথ বিস্তৃত হচ্ছে দিনে দিনে। কিন্তু এতো করেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে আরএসএস-এর অবদানের ইতিহাস নির্মাণ যে সম্ভব নয়। সেকথা তারাও বিলক্ষণ জানে। ফলে তাদেরকে ইতিহাসের নবতর বয়ান নির্মানে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে কয়েক হাজার বছর। শুরু করতে হচ্ছে রামায়ণ মহাভারতের সিরিয়াল দিয়ে। মহাকাব্যকেই ইতিহাসের সিলেবাসে নিয়ে আসতে হচ্ছে একেবারে ঢাক ঢোল পিটিয়ে। ফলে রাম ও রামমন্দির দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। আর অযোধ্যাই সে শুরুর পবিত্রভূমি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও সেখানে রামমন্দির নির্মাণই ইতিহাসের বিজেপিকরণের সূত্রপাত হিসাবে ধরা হচ্ছে। এখন বিজেপি তথা আরএসএস-এর কাছে অযোধ্যা আর রামমন্দির সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার একটা কারণ রয়েছে। যেহেতু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে তাদের কেন ভুমিকা নাই। সেই অক্ষমতা ঢাকা দেওয়ার জন্য তাদের নির্মিত ইতিহাসের বয়ানে হিন্দুত্বের পুনরজাগরণের গল্পকে গেঁথে তোলা ছাড়া হাতে অন্য কোন বিকল্প কোন পথও নেই। আর এই পুর্নজাগরণের লড়াই কাদের বিরুদ্ধে? না ইসলামের বিরুদ্ধে। সেটি না হলে ব্রিটিশের উদ্ভাবিত ডিভাইড এণ্ড রুল সংঘটিত করাই বা যাবে কি করে? ফলে অযোধ্যা থেকেই ইতিহাসের নবনির্মাণ শুরু করতে হচ্ছে আরএসএস ও বিজেপিকে। এবং রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়েই ইতিহাসের নতুন বয়ানের পাতাগুলি দিনে দিনে খুলতে শুরু করবে। যার মূল গতি থাকবে ইসলামের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্বের নবজাগরণের অভিমুখে। ঠিক এই কারণেই ইতিহাসের এই নবনির্মাণে ভারতবর্ষে ইসলামী আক্রমণ ও সাম্রাজ্যবিস্তারকে দেশের পরাধীনতা হিসাবে দেখানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যাতে অনেকই সহমত হবেন। ঠিকই তো শক হুন দল মোগল পাঠান, আসলেই তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবেই এখানে ঢুকে ভারতবর্ষ দখল করেছিল। কোন ভারতবর্ষ? না, ব্রিটিশের তৈরী করা ভারতবর্ষ। তাদেরকে আদৌ বোঝানো যাবেই না। ব্রিটিশের তৈরী করা মানচিত্রের ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ব্রিটিশ আসার আগে ছিলই না কোনদিন। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা জাতির নানান সাম্রাজ্য ছিল এখানে। নানা ভাষা নানা মত। নানা পরিধান। হ্যাঁ, একের পর এক বিদেশী শক্তি বারংবার হানা দিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নানান সময়ে। এক এক সময়ে এক এক বিদেশী শক্তি এক একটি সাম্রাজ্য দখল করে নিয়ে সেই সাম্রাজ্যের শাসক হয়ে বসলেও। কালক্রমে সেই সাম্রাজ্যেরই একজন হয়ে উঠেছিল। নাদির শাহের মতো সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে ফিরেও যায়নি। কিংবা ব্রিটিশের মতো এই ভূখণ্ডকে পরাধীনতার নাগপাশে বেঁধে রেখে শোষন করতে থাকেনি শতকের পর শতক ধরে। উল্টে এই ভারতীয় ভূখণ্ডেরই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এক এক জাতির অংশ হয়ে উঠেছিল। এই যে প্রকৃত ইতিহাস। সেই ইতিহাসই নতুন করে ঘুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে যে, সেটি কিন্তু পরিষ্কার। ইতিহাসের এই নব নির্মাণের একদিকে হিন্দু রাজাদের জাতীয় বীর বলে তুলে ধরা হচ্ছে, হবে। আর এক দিকে মুসলিম শাসকদের বিদেশী শত্রু বলে তুলে ধরে তাদের বংশধরদেরকেও ভিলেন বানিয়ে তোলা হবে। আর সেটি করতে গেলে, তো মোগল পাঠানদের হাতে মন্দির ধ্বংস, হিন্দু নারীদের সম্মানহানি, লুঠপাট অগ্নিসংযোগের পুরনো ইতিহাসগুলি আরও বেশি করে ফাঁপিয়ে এবং বাড়িয়ে পরিবেশন করতেই হবে। প্রথমে সিনেমা সিরিয়াল দিয়ে এবং পড়ে ইতিহাসের নতুন সিলেবাস তৈরী করে ভারতবর্ষকে শুধুমাত্র হিন্দুর দেশ আর মুসলিমদের বিদেশী শত্রু হিসাবেই চিহ্নিত করার কাজ পাকাপাকি বন্দোবস্তে সম্পন্ন করা হবে। আর সেটি করতে পারলেই হিন্দুত্বের নবজাগরণ ঘটানোর নেপথ্যে বিজেপি তথা আরএসএস-এর অবদান ও ভূমিকাকে আগামী ইতিহাসে স্থায়ী করে দিয়ে যাওয়ার পথ খুলে যাবে বইকি।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রয়াস নতুন বা প্রথম নয় আদৌ। এই প্রয়াসের শুরু সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই। যখন আর্যরা অনার্যদের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। পরাজিত নির্যাতিত অনার্যরা ক্রমশ পিছু হটতে হটতে সমাজের মূল স্রোত থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে মূলত বন জঙ্গলেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যাদের রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যে রাক্ষসকূল বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর্যরাই হিরো। আর অনার্যরা ভিলেন তথা রাক্ষস। আজকে যাদেরকে আমরা দলিত বলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলে অভিহিত করে থাকি। ফলে বৈদিক যুগের ইতিহাসের বয়ানে অনার্যরা যেভাবে রাক্ষস হয়ে উঠেছিল। ঠিক সেই ভাবেই হিন্দুত্বের নবজাগরণের ইতিহাসের যে বয়ান তৈরী হতে চলেছে। তাতে ভারতীয় মুসলিমদেরকেই ভিলেন তথা বিদেশী শত্রু আর হিন্দু নেতাদের হিরো তথা দেশপ্রেমিক ইত্যাদি হিসাবে প্রচার করা হতেই থাকবে। এর ভিতর দিয়েই দেশের অধিকাংশ হিন্দুদেরকে বিজেপি তথা আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলেই কেল্লাফতে। সমস্ত দেশীয় সম্পদের মালিকানা তখন দুই একজন শিল্পপতির হাতে তুলে দিলেও ক্ষমতার গদি টলে যাবে না। ফলে কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়তে ইতিহাসের এই নবনির্মাণ জরুরী। হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে গেলে ইতিহাসের এই নবনির্মাণ জরুরী। দেশের সব সম্পদ শিল্পমহলের মালিকানায় তুলে দিতে গেলে ইতিহাসের এই নবনির্মান জরুরী। লক্ষ্য করে দেখতে হবে। মুসলিম ও খ্রিষ্টান এই দুই সম্প্রদায়ই ভারতীয় উপমহাদেশের নানান সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে নিয়েছিল। মুসলিমরা এসেছিল আগে। ইউরোপীয়ানরা এসেছিল পরে। কিন্তু হিন্দুত্বের নবজাগরণের ইতিহাসের নবনির্মাণে ভিলেনের জায়গাটি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমদেরকেই। আওরঙ্গজেব অত্যাচারী শাসক ছিল। কিন্তু ইতিহাসের এই নব নির্মাণে ব্রিটিশ কিন্তু অত্যাচারী শাসক নয় আদৌ। মোগল পাঠানরা হিন্দুদের উপরে অত্যাচার করলেও। ব্রিটিশের অত্যাচার নিয়ে ইতিহাসের এই নবনির্মিত বয়ান একেবারেই কিন্তু নিশ্চুপ। লক্ষ্মনীয় আরও একটি বিষয়। ব্রিটিশকে ইতিহাসের গুডবুকে রাখার বিষয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির ভূমিকা কিন্তু একই রকম। এই একটি বিষয়ে কি অত্যাশ্চার্য মিল এই দুই শিবিরের।

অর্থাৎ ব্রিটিশ তার স্বার্থে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে একভাবে উপস্থাপিত করে গিয়েছে। কংগ্রেস তার স্বার্থে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে তাদের মতো করে উপস্থাপিত করে দশকের পর দশক শাসন করে গিয়েছে। আর বর্তমানে ইতিহাসের আরও এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করা শুরু হয়ে গিয়েছে বর্তমান শাসক ও তার মহা পরিচালক আরএসএস-এর স্বার্থরক্ষায়। কিন্তু এইসব একাধিক বয়ানের ভিতরে একটি জায়গায় খুব মিল রয়েছে। সেটি হলো এই ভূখণ্ডের সম্পদের মালিকানার দখল নেওয়া। একদিন সেই মালিকা ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতে গিয়ে পড়েছিল। সেই সূত্রে ব্রিটেনের শিল্পমহলের হাতে গিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের হাত ধরে সেই মালিকানার একটা বড়ো অংশ টাটা বিড়লাদের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। আর বর্তমান সরকার তো সরাসরি দেশের সব সম্পত্তিই জলের দরে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আর এই গোটা প্রক্রিয়ায় জনতার প্রতিক্রিয়া শূন্য করে রাখতেই ইতিহাসের এক একটি বয়ানের নির্মান ও প্রচারের ব্যবস্থা। ফলে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ এই ভূখণ্ডের মানুষের অধরাই রয়ে গিয়েছে। শাসকের মুখের বদল ঘটেছে শুধু। শোষণের ধারার বদল হয়নি কোন। ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন বয়ান নির্মাণ ছাড়া শোষণের ধারা বজায় রাখাও মুশকিল। তাই দেশের প্রকৃত ইতিহাস থেকে জনসাধারণ যত বেশিদিন বিচ্ছিন্ন থাকবে। ততদিনই শোষণের এই ধারা চলতে থাকবে অব্যাহত গতিতে। নিরন্তর সঠিক ইতিহাসের চর্চা ও তার আলোচনা ছাড়া জনমানসে কোনটি ঠিক আর কোনটি নয়, সেই বোধ গড়ে ওঠে না। সেটি গড়ে না উঠলে সেই জনতার পক্ষে তার দেশ ও স্বজাতি সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোও সম্ভব নয়। ইউরোপের অধিবাসীরা এই সত্য বেশ কয়েক শতক আগেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল। হয়েছিল বলেই তারা দ্রুত নিজেদের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে আর গোটা বিশ্বকেই তারা আজ ভাগ করে নিয়ে অধিকার করে বসে রয়েছে। এই শক্তি তারা অর্জন করেছে নিরন্তর ইতিহাসের চর্চা ও গবেষণা থেকে। কিন্তু আমাদের মতো উপনিবেশিক ভূখণ্ডের জনসাধারণের ভিতরে সেই বোধ আজও অর্জিত হয়নি বলেই, আজও আমরা একটির পর একটি শাসকের অধীনে শোষিত ও নিপীড়িত হয়ে চলেছি। স্বাধীনতা তাই আমাদের কাছে একটি দিন মাত্র। জীবনের মূল সত্য নয়। আর বিশেষ করে ইতিহাস বিমুখ ও ইতিহাস বিস্মৃত জাতির পক্ষে নিরন্তর অপরের গোলামী করে যাওয়া ছাড়া করারও কিছু থাকে না। সে বিদেশী কি দেশীয় শক্তিই হোক না কেন। আর ঠিক এই কারণেই বিশ্বের যাবতীয় সূচকে তারাই সবচেয়ে পিছনের সারিতে পড়ে থাকে। পড়ে থাকবেও।

আমরা যদি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত ইতিহাসের অনুসন্ধান ও চর্চা করতাম, তাহলে খুব স্পষ্টভাবেই কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতো। প্রথমত, পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতবর্ষ কোন দেশ ছিল না কোনদিই। ইউরোপের মতো আফ্রিকার মত এশিয়ার মতোই নানান সাম্রাজ্য ও জাতির অবস্থান নিয়েই গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। যেখানে প্রতিটি জাতি ইউরোপীয় জাতিগুলির মতোই পরস্পরের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থেকে আপন সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে অধিকতর ব্যস্ত থাকতো। এবং তাদের ভিতর পারস্পরিক শত্রুতা এতটাই তীব্র ছিল যে, ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যখনই ভারতীয় উপমহাদেশের কোন একটি সাম্রাজ্য আক্রমণ করতো, এই ভূখণ্ডের অন্যান্য সাম্রাজ্যগুলি বসে বসে মজা দেখতো। এবং তদের পড়শীর পতনে উল্লসিত হতো। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময় থেকে এই ধারাই চলে আসছিল। নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ যদি একটি মাত্র দেশ হতো, এমন ঘটনা সম্ভব হতো না। না, ইতিহাসের এই সহজ কথাটা আমাদের চেতনায় ধরা দেয় না আজও। দ্বিতীয়ত, আলেকজাণ্ডার চেঙ্গিস খাঁ তৈমুর লঙ্গ নাদির শাহের মতো স্বল্প সংখ্যক ব্যাতিক্রম বাদ দিলে, বাকি সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারীরা কিন্তু এই ভূখণ্ডেই রয়ে গিয়েছিল। নিজ মাতৃভুমিতে আর ফিরে যায়নি কোনদিন। এই ভূখণ্ডেই তারা তাদের সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কালে কালে। তৃতীয়ত, একমাত্র ব্রিটিশ বাদে অন্য কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই ভারতবর্ষকে পরাধীন করে রাখেনি কোনদিন। সাম্রাজ্য বিস্তার ও দখল করা এক বিষয়। আর একটি ভূখণ্ডকে পরাধীন করে রাখা অন্য বিষয়। ফলে শক হুন মোগল পাঠানের সাথে ব্রিটিশ জাতির পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। শক হুন মোগল পাঠানের মতো ব্রিটিশ জাতি ভারতীয় ভূখণ্ডের অপরাপর জাতির সাথে মিশে যায়নি আদৌ। এইখানেই তাদের সাথে শক, হুন, মোগল, পাঠানদের প্রভেদ। তারাও আর্যদের মতোই এই ভারতীয় উপমহাদেশই রয়ে গিয়েছে। আজকে তাই আর্য থেকে শুরু করে শক হুন মোগল পাঠান কাউকেই আর বিদেশী বলে চিহ্নিত করার উপায় নাই। কালের বিবর্তনে আজকে এসে একমাত্র মাতৃভাষা দিয়েই এই ভূখণ্ডে জাতিগত পরিচয় নির্ধারিত হতে পারে। অন্য কোন উপায়ে নয়। এবং ধর্ম দিয়ে তো নয়ই। বিশ্বের কোন প্রান্তেই ধর্ম জাতিগত পরিচয় নির্ধারণ করে না। ভাষা খাদ্যাভ্যাস কিছুটা পরিমাণে পোশাক পরিচ্ছদের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিই জতিগত পরিচয়ের নির্ধারক। এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগুলি ব্রিটিশের কাছে পরাধীন হওয়ার আগে অব্দি কখনো কোনদিন ভারতীয় পরিচয়ে আপন জাতিসত্ত্বা বিসর্জন দেয়নি। এবং তারা সকলে মিলে পারস্পরিক স্বাতন্ত্রের উর্দ্ধে উঠে কাল্পনিক ভারতীয় পরিচয়কেও কোনদিন বরণ করে নেয়নি। ব্রিটিশ এসে সর্বপ্রথম এই ভূখণ্ডের সকল জাতিকে পরাধীন করে এই এক ভারতীয় জাতীয়তার শিকলে বেঁধে ফেলে। পরে ডিভাইড এণ্ড রুল তত্ত্বেই জন্ম হয় পাকিস্তানের। ভারতবর্ষের ইতিহাসের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হল, বর্ণভেদ প্রথা। ইউরোপের ইতিহাস যে অভিশাপ থেকে মুক্ত ছিল। ইউরোপের জাতিগোষ্ঠিগুলি ধনী ও দরিদ্র, শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। কিন্তু এই ভূখণ্ডের জাতিগুলির ভিতরে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যের সাথে এই বর্ণভেদ জুড়ে থাকায় কোন জাতির ভিতরেই স্বতন্ত্র জাতীয়তার বোধ সেভাবে জমাট বাঁধেনি ইউরোপের জাতিগুলির মতোন। বার বার বৈদেশিক শক্তিগুলির কাছে পরাজিত হওয়া এবং শেষমেশ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করে পরাধীনতা বরণের পিছনে এটি অন্যতম বড়ো কারণ। এবং এই বর্ণভেদ প্রথার কারণেই এই ভুখণ্ডে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত সমাজ কোনদিনের জন্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় না। আবার ভারতীয় উপমহাদেশ এই কারণেই ধনতন্ত্র চর্চার পক্ষ সবচেয়ে আদর্শ স্থান। ফলে ব্রিটিশ থেকে শুরু করে কংগ্রেস ও বর্তমানে বিজেপি ও তার নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এর স্বার্থ যে একই সূত্রে ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি চালিয়ে যাবে, সে আর বিচিত্র কি? ইতিহাস নিয়ে এই রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার ভিতরেই ব্রিটিশের হাতে গড়া ভারতবর্ষে ধনতন্ত্রের প্রাণভোমরা।

1 comments:

6

প্রবন্ধ - সিদ্ধার্থ মজুমদার

Posted in





“সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রা দোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?”—
কবির এই বহু উচ্চারিত লাইনগুলি মনে পড়ে গেল। কত মানুষের কত রকমের মুদ্রাদোষ। তবে ‘মুদ্রাদোষ’ যে কতটা ‘দোষ’ তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সাধারণভাবে যা আমরা ‘মুদ্রাদোষ’ হিসেবে বলে থাকি, তা হয়ত দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা এক বিচিত্র অভ্যেস অথবা ‘বদ-অভ্যেস’ হিসেবেও বলা যায়। এই গড়ে ওঠা বিচিত্র অভ্যাস বা মুদ্রাদোষ, যা ই বলি না কেন—এই বিকারগ্রস্থতার পেছনে হয়ত থাকতে পারে কোনো না কোনও প্রকৃত কারণ। কখনও সেসব কারণ জানতে পারা যায়। কখনও তা অজানাই থেকে যায়। কত অদ্ভুত ধরনের সব মুদ্রাদোষ। কেউ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে নিজের মনে। কেউ আবার হাঁটার সময় খানিক অন্তর অন্তর পা ছোঁড়ে। কেউ কিছুক্ষণ পরে পরেই বাঁ হাতের কোনো একটি আঙুলের নখ কামড়ায়। এইরকমই বিচিত্র স্বভাবের একজন মানুষের কথা বলব এই লেখায়।

নিজস্ব ক্ষেত্রে বিশিষ্ট হওয়া ছাড়াও পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে আরও একটি কারণে তিনি বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সেই কারণটি হল, তাঁর দীর্ঘ নীরবতা। কেমন ছিল সেই নীরবতার ব্যাপারটি দেখা যাক। হয়ত কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে, তিনি অনেকক্ষণ পরে একটি দুটি কথায় তার উত্তর দিলেন। সেই বিচিত্র স্বভাবের মানুষটির কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার জন্যে প্রশ্নকর্তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। এমনও হয়েছে, কখনও আধঘণ্টা পরে উত্তর দিয়েছেন তিনি। তাঁর উত্তর দেওয়া কিংবা কথা বলার মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমিত থাকত ‘হ্যাঁ’, ‘না’ অথবা ‘আমি জানি না’। এরকমই অদ্ভুত মানুষ ছিলেন তিনি।

স্বনামধন্য এই মানুষটি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম একজন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী। নাম পল ডিরাক। পুরো নাম পল এড্রিয়ন মরিস ডিরাক (১৯০২- ১৯৮৪)। এই ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডাইনেমিক্স ক্ষেত্রের সূচনা ও উন্নয়নে তাঁর মৌলিক অবদানের জন্যে তিনি বিশ্ববন্দিত। ডিরাকের গাণিতিক সমীকরণ থেকে অ্যান্টি-ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। এই কাজের জন্যে ১৯৩৩ সালে এরউইন শ্রোয়েডিংগারের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান ডিরাক। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে করা কাজের ওপর মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তখনও পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী নোবেলপ্রাপক। তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই ‘ফিজিক্যাল থিয়োরি’ সংক্রান্ত কাজে তাঁর অবদান একটি চূড়ান্ত সাফল্য গণ্য করা হয়ে থাকে। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্যে ডিরাক-কে ‘গড ফাদার অফ ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স’ বলা হয়ে থাকে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কেমব্রিজে ‘লুকাসিয়ান চেয়ার অফ মেথামেটিক্স’-এর সন্মানীয় পদ অলঙ্কৃত করেন। যে সম্মান একদা পেয়েছিলেন কিংবদন্তী গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ স্যার আইজাক নিউটন।

আবার ডিরাকের নীরবতার কথায় ফিরে আসি। তাঁর নির্বাক স্বভাব নিয়ে নানান মজার গল্প আছে। সেই সব কাহিনির দু একটি বলব এখানে। কেউ কেউ কৌতুক করে বলতেন ‘মাথার ছিট আছে’। তবে এটা ঠিক যে অনেক জিনিয়াস বা সহজাত সৃষ্টিশীল মানুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্টের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের পাগলামি লক্ষ্য করা গেছে। অসম্ভব মেধা ও সৃজনশীলতার সঙ্গে পাগলামির এই মেলবন্ধন বিষয়টি সাইকোলজি এবং কগনেটিভ সায়েন্সের গবেষণার বিষয়। এই ক্ষেত্রে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণাও করছেন। কবি, চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী সব ধরণের সৃজনশীল মানুষের আচরণেই এই অদ্ভুত আচরণের বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। যেরকম পাগলপনার কথা জানতে পারা যায় ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, ভার্জিনিয়া উলফ,এডগার অ্যালেন পো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, মোজার্ট, বেঠোভেন, সিলভিয়া প্লাথ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মধ্যে। সেরকমই আইজাক নিউটন, লুডভিগ বোলজমান, নিকোলা টেসলা কিংবা জন ন্যাশ প্রমুখ বিজ্ঞানীদের মধ্যেও দেখা গেছে এই অদ্ভুত বিকারগ্রস্থতা। এই ম্যাডনেস বা খ্যাপামি, অদ্ভুত আচরণ, ভারসাম্যহীনতা, অপ্রকৃতিস্থ অবস্থাকে পার্সোনালিটি ডিজর্ডার, সাইকো-প্যাথোলজি বা বাইপোলার ডিজঅর্ডার হিসবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

ডিরাকের সায়েন্টিফিক কেরিয়ারের সর্বোচ্চ সীমা লক্ষ্য করা যায় নভেম্বর ১৯৩৩ নাগাদ। সে বছরই তিনি জানতে পারেন তিনি সেই বছর ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কারের জন্যে বিবেচিত হয়েছেন। নোবেল প্রাপ্তির খবরে যে কোনো প্রাপকই যে যারপরনাই উচ্ছসিত ও আনন্দিত হবেন এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আশ্চর্যের হলেও ডিরাকের ক্ষেত্রে এরকমটি হল না। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দারুণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান। আর ওই মুহুর্তে তিনি ঠিক করে নিলেন যে এই পুরস্কার তিনি নেবেন না। প্রত্যাখ্যান করবেন। কিন্তু কেন? আসলে তাঁর এরকম উদ্ভট সিদ্ধান্তের কারণ হল অমূলক ভয়, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা। কীসের দুশ্চিন্তা? নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে প্রচারের যে বিপুল আলো নোবেল প্রাপক হিসেবে তাঁর গায়ে পড়বে, সে কথা অনুমান করে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন ডিরাক। তাই ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে তিনি দুঃশ্চিন্তা করছিলেন যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের ওই সুতীব্র লাইমলাইটে চলে আসার বিষয়টি সামলানো তাঁর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়!

যাইহোক, ডিরাকের আতঙ্কের কথা শুনে ব্রিটিশ ফিজিসিস্ট আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, ডিরাককে বোঝালেন—‘বরং নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলে আরও বহুগুন বেশি পাবলিসিটির ধাক্কা সামলাতে হবে ডিরাককে’। যাই হোক, রাদারফোর্ডের ওই কথা শুনে অনিচ্ছাভরে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করলেন ডিরাক। সেসময় লন্ডন নিউজ পেপার ‘সানডে ডিসপ্যাচ’-এ মজা করে লেখা হল—‘একত্রিশ বছর বয়সী কেমব্রিজ প্রোফেসার যিনি গজলা হরিণের মতন লাজুক এবং ভিক্টোরিয়ান পরিচারিকার মতন বিনয়ী ও নম্র’। আরও লেখা হল—‘তিনি সব মহিলাদের খুব ভয় পান’।

একদিকে যেমন অসম্ভব কম কথা বলতেন অন্যদিকে ডিরাক ছিলেন প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, লাজুক এবং ভীতু প্রকৃতির মানুষ। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটতেন একদম রাস্তার ধার ঘেঁষে বিল্ডিঙের পাশে চোরের মতন লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটতেন। যাতে কারোর সঙ্গে কথা বলতে না হয় তাই তিনি ওইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে হাঁটতেন। এতটাই কম কথা বলতেন তিনি যে তাঁর কেমব্রিজের সহযোগী বন্ধুরা পরিহাস করে ‘এক ডিরাক’ নামের একটি এককের (ইউনিট) কথা চালু করেছিলেন। ‘এক ডিরাক’ মানে হল—‘এক ঘন্টায় একটি শব্দ বলা’।

ডিরাকের জীবনীকারদের লেখায় ডিরাকের বেড়ে ওঠা এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে পারিবারিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ডিরাকের মা ছিলেন ব্রিটিশ এবং বাবা ফ্রেঞ্চ স্পিকিং সুইশ। ডিরাক ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ডিরাকের ওপরে ছিল এক দাদা এবং পরে এক বোন। যে কথাটি উল্লেখ করা দরকার তা হল, ডিরাকের বেশ কয়েকজন আত্মীয় পরিজন গভীর ডিপ্রেশনের শিকার হয়েছিলেন। জানা যায়, একশ বছরে তাঁদের পরিবারে ছ’জন আত্মহনন করেছিলেন। আর এই ছ’জনের মধ্যে ছিল ডিরাকের বড় ভাইও। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে আত্মহনন করেন ডিরাকের দাদা। পরিবারের বাকি সদস্যদের মতন ডিরাকের ছেলেবেলাও সুখের ছিল না। যার একমাত্র কারণ ডিরাকের বাবা। অসম্ভব একগুঁয়ে, জেদী আর রাগী ছিলেন ডিরাকের বাবা। বাড়িতে সবার কাছে তিনি ছিলেন এক আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। পরিবারে তিনি যা মনে করবেন সেটিই ছিল শেষ কথা।

ডিরাকের বাবা স্কুলে ফ্রেঞ্চ পড়াতেন। তাই স্কুলেও ডিরাককে মেনে চলতে হত কঠোর অনুশাসন, যা মাঝে মাঝে অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। পরবর্তী সময়ে ডিরাক ছোটবেলায় বাবার প্রভুত্ব ও নিদারুণ যন্ত্রণা দেওয়ার কথার উল্লেখ করেছেন একাধিক সময়ে। ডিরাকের মা, দাদা এবং বোন ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার করতে পারতেন না। রান্নাঘরে ডিনার করতে হত তাদের। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসত শুধু ডিরাক আর তাঁর বাবা। ডিরাকও যে বাবার সঙ্গে খেতে বসতে চায়তো এমন নয়। কিন্তু তাকে খেতে বাধ্য করতেন বাবা। আর সে সময় ডিরাককে নির্ভুল ভাবে ফ্রেঞ্চ বলতে হত। উচ্চারণ বা ব্যাকারণের সামান্য ভুল হলেই ডিরাকের ওপর পীড়নের মাত্রা বাড়ত। ওইসময় অসুস্থতা বোধ করছে বলে ডিরাক ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে যেতে চাইলেও যেতে দিতেন না বাবা। আর এইসব নানা কারণে ডিরাকের হজমশক্তি সংক্রান্ত বেশ সমস্যা তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়াও বাবার ওই অস্বাভাবিক নিপীড়নের জন্যে কথা বলা আর ভাষাশিক্ষার ব্যাপারের যে স্বাভাবিক প্রবণতা, তা নষ্ট হয়ে গেল ডিরাকের। ফ্রেঞ্চ তো বলতোই না। কথাবার্তাও খুব প্রয়োজন ছাড়া বলত না। ছোটোবেলার ওই যন্ত্রণা আর আতঙ্ক আজীবন ডিরাকের সঙ্গী হয়ে থাকল। পরবর্তী সময়ে ডিরাক যে কথা বলতে চাইতেন না তার পেছনে রয়েছে ওই অস্বাভাবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিগুলি।

যাই হোক বাবার ইচ্ছেনুসারে ব্রিস্টল ইউনিভারসিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেন (১৯১৮-২১) ডিরাক। গ্রাজুয়েশেনের পরে কোনও চাকরি পেলেন না। সেই জন্যে আরও দু বছর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স নিয়ে পড়লেন। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ পেয়ে গবেষণা করেছেন ডিরাক।

ছোটোবেলা থেকেই যখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত সেই উত্তরটুকু ছাড়া খুব একটা কথা বলত না ডিরাক। নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখত নিজেকে। এইভাবেই সামাজিক মেলামেশা করার ক্ষমতা বা কোনো বিষয়ে কিছু বলার পারদর্শিতা তৈরি হয়নি ডিরাকের। তবে ছোটবেলা থেকেই তার ছিল গাণিতিক সমাধানের অসাধারণ পারঙ্গমতা। কিন্তু সাহিত্য বা শিল্প নিয়ে ডিরাকের একদমই আগ্রহ ছিল না। যদিও পরবর্তীকালে ডিরাকের লেখা ফিজিক্সের গবেষণাপত্র বা বইগুলিতে শব্দের ব্যবহার ও বাক্য গঠন ওইসব রচনাগুলিকে সাহিত্যগুণ ও গাণিতিক উপস্থাপনার দিক থেকে এক একটি চূড়ান্ত মাস্টারপিস হিসেবে মনে করা হয়।

অনেকেই মনে করেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞানকে উচ্চতার তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পল ডিরাকের অবদান আইনস্টাইনের থেকে কোনও অংশে কম নয়। অথচ আইনস্টাইন বা নীলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, শ্রোয়েডিনজার কিংবা রিচার্ড ফেইনম্যানের নাম মানুষ যেরকম জানে, সেই তুলনায় পল ডিরাকের নাম আজও কম মানুষই জানেন। বস্তুত ফিজিক্স জগতের বাইরে অসাধারণ প্রতিভাধর পদার্থবিদ পল ডিরাকের নাম আজও অজানার অন্ধকারে রয়ে গেছে।

বিজ্ঞানী পল ডিরাকের মেধা ও গগনচুম্বী কৃতিত্ব ও অবদান যেন তাঁর অস্বাভাবিক এবং জটিল চরিত্রের অন্ধকার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদাস ভঙ্গীতে। ড্যানিশ পদার্থবিদ নীলস বোর যাকে ‘দ্য স্ট্রেঞ্জেস্ট ম্যান’ বলেছেন; আইনস্টাইন যার সম্পর্কে লিখেছেন ‘…an awful balance between genius and madness.’ সেই জিনিয়াস, মৌনী, স্ট্রেঞ্জেস্ট কিংবদন্তী মানুষটির সমাধিস্থলে শ্রদ্ধার কয়েকটি ফুল রেখে গেলাম।

6 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


কি অমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছ আমায়, এই সাত সকালে?

তোমায় গো তোমায়। আর কাকে দেখব? আশেপাশে কেউ কি আছে এমন অপরূপ সেজে?

ধুস্‌, এমন করছ যেন কখনো দেখনি আমায়!

দেখেছি গো দেখেছি। দেখেছি তো। এই সাতষট্টি বছর ধরে দেখে আসছি। থুড়ি, ভুল বললাম, তেষট্টি হবে। বেশ মনে আছে আমার আজও সেই দিনের কথা। তখন আমার চার বছর বয়স। প্রথম দেখে চমকে গেছিলাম। এত উজ্জ্বল নির্মল রূপ হতে পারে সেই ধারনা প্রথম পোষিত হল মনে, প্রাণে, হৃদয়ের অন্তরে। সেই থেকে তোমার এই প্রথম আগমনী দিনটার জন্য আমার প্রত্যাশী চোখ দুটো চাতকের মত চেয়ে থাকে। চক্রবাকীর মত ঘুরে ঘুরে আনাচে কানাচে খোঁজে তোমায়। আর যেদিন দেখা পাই, আঃ! কী আনন্দ যে হয় তা তুমি টেরটিও পাও না। সে তোমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। তোমার সৌন্দর্যই আছে কিন্তু বোঝার মন নেই। বুঝলে অপরূপা?

অপরূপা! বেশ বলেছ। আচ্ছা, আমায় একটু বলবে কী এমন দ্যাখ তুমি আমাতে। তাহলে আমিও সেটা জেনে একটু গর্ব করতে পারি।

কিচ্ছু নয়। একটা বিস্তীর্ণ ঝকঝকে নীল। বৃষ্টিধোয়া উজ্জ্বল নীল। তার ওপর ধুনুচির জ্যা থেকে ছিটকে বেরোনো অথবা শিমুল ফল ফেটে ইতিউতি ভেসে থাকা ততোধিক উজ্জ্বল সাদা পেঁজা তুলো।

ইস্‌! ব্যস, এইটুকুতেই এত আনন্দ! কিন্তু তুমি এমনভাবে দ্যাখো, বড় লজ্জা লাগে আমার।

ও, তাই বুঝি ওই সাদার ভেতর একটা হালকা কাজল ল্যাপা! হা হা। ভয় নেই, নজর দিই না।

তুমি না একটা যাচ্ছে তাই। তোমার তো দেখি যাই দ্যাখ তাতেই মন নেচে ওঠে ময়ূরের মত। এত বোঝো আর এটুকু বুঝলে না। ওটা আমার পুরনো স্মৃতি।

তার মানে?

এ বাবা, এটাও বুঝলে না! এতদিন ধরে যে বর্ষাকে নিয়ে তোমার এত আদিখ্যেতা, তার কৃষ্ণকলি রূপে তোমার মুগ্ধতা, তার নুপুরের রিনিঝিনি শিঞ্জন, এলোমেলো চুল ওড়ানো হাওয়া সবই তো তোমায় উৎফুল্ল করে। তার স্মৃতি একদিনে কী করে হারাই বল। আর সেই বা আমায় এত সহজে ছাড়বে কেন।

তুমি ভুল বলনি, বর্ষা আমায় বেশি বেশি মাতাল করে। আসলে এই একমাত্র একটা ঋতু যাকে স্পর্শ করা যায় সরাসরি। আর অন্য সবই তো অনুভূতি, জাগানো আবেগ। বৃষ্টিকে হাতে গায়ে পায়ে মাথায় মাখা যায়, এমন আর কিছুতে হয় না।

কেন, আমার শিশির? তাকেও তো স্পর্শ করা যায়।

তার জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কখন তেনার দয়া হয়ে ঝরে পড়বে। আর, সত্যি বল তো শরতে কি শিশির আর আসে? সে আসবে তুমি চলে গেলে, হেমন্তের হাত ধরে।

প্রতি বছর আমার আগমনে তোমার এই আদেখলাপনা আনন্দ আমি দেখে আসছি। কেন হয়? আসলে আমার নিজের কোন অনুভূতি নেই তো তাই জিজ্ঞেস করছি। তোমার মত প্রাণ নেই আমার। অবশ্য যাদের প্রাণ আছে সবাই কি মানুষের আবেগ পায়? তার জন্য একটা আস্ত ঘিলু-ওলা মস্তিষ্কের দরকার। সেটা একমাত্র মানুষেরই আছে। দ্যাখ, পাখিদের ফুলেদের সৌন্দর্য আছে কিন্তু ওদের তা বোঝার ক্ষমতা নেই যা তোমাদের আছে।

ঠিকই বলেছ, দুঃখের হলেও সত্যি। তবে এটাও সত্যি তোমার যদি আবেগ থাকত তাহলে আজকের এই সৌন্দর্যের গর্বে তোমার মাটিতে পা পড়ত না।

যাঃ, কি যে বল না। তেমন হব কেন? আর আমার সঙ্গে মাটির তো সম্পর্কই নেই। আকাশে ভেসে ভেসে থাকি।

দেখি তো, এই মানুষেরই একটু সাধারণের থেকে অন্যরকম, মানে ভালোর দিকে, হলে মাটিতে পা পড়ে না।

তবে তোমার এই নিবিড় চাহনি কিন্তু আমায় বেশ ঈর্ষা জাগায়। আচ্ছা, তুমি প্রেম করেছ? নাকি, শুধু আমাদের সাথেই তোমার ভালোবাসা। মানুষের ভালোবাসা শুনেছি অন্যরকম।

ওসব কথা থাক, শরৎ। একটা কথা তোমায় বলি, এই ঋতুদের মধ্যে বর্ষা আমায় স্পর্শ করলেও আমি কিন্তু আমার সপ্তম ইন্দ্রিয় দিয়ে আর পাঁচটা ঋতুরও স্পর্শ পাই। সত্যি বলছি। কী করে তা যদি জিজ্ঞেস কর বলতে পারব না কিন্তু পাই যেমন তৃতীয় নেত্র অনেক বেশি কিছু দেখতে পাই। এই যেমন আজকের সকালে তোমার স্পর্শ পেলাম। প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পেলেও তার স্পর্শের আনন্দ পাই। তবে চুপিচুপি একটা কথা বলি, ঘাম আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আগে কৈশোরকাল অবধি ঘাম হোত না তখন কোন সমস্যা ছিল না। পরে বাংলার বাইরে থেকে যখন আবার ফিরলাম তখন জলীয় বাষ্পে ভেজা ময়েশ্চারাইজড গরমে শুরু হল ঘাম। অসহ্য। সেই গরমকে ঠাণ্ডা করতে আসে বর্ষা। হাওয়া ঘুরে যায় দক্ষিণ থেকে পুবে। পুবের হাওয়া আনে মেঘ, জলভরা মেঘ। তার বর্ণনার শেষ নেই। তবে কি জান তো, বর্ষা খুব একলা করে দেয়। এমন করে ঘরের চারিদিকে গণ্ডি টেনে রাখে বেরতেই দেয় না। একা একলা ঘরে বসে বসে একাকীত্বের কবলে পড়ে যাই। বিষন্নতা ছেয়ে ফেলে ঘন কুয়াশার মত। সেটা যখন গভীর থেকে আরও গভীরে নিমজ্জিত হয় তখনই আমার দৃষ্টি চাতকের মত আকাশে তাকিয়ে থাকে রোজ সকালে, কবে দেখতে পাব তোমায়। এই যে দিনের পর দিন এই আকাঙ্খা আকুতি তীব্র পাওয়ার তিতিক্ষা মনটাকে আকুল করে তোলে। আর তাই যেদিন প্রথম তোমায় দেখি সেদিন আনন্দে বিহ্বল হয়ে যাই। হৃদয় পূর্ণ আনন্দে উথলে ওঠে। বুঝি আমি। তখনই তোমার প্রথম স্পর্শ পাই।

আর বোলো না, থাম। আমি আর নিতে পারছি না। তোমার এই এত আনন্দে আমিও যে ভেসে যাচ্ছি। দ্যাখ, আমি কেমন কাঁদছি। যদি পার তো আমার এখনকার এই চোখের দু ফোঁটা জল হাতে ধর। আমি সরাসরি তোমার অঙ্গে মিশে যাব। তুমি এতটা চাও আমায়!

আমি দুটো হাত বাড়িয়ে দিই ব্যালকনি থেকে। সত্যি, সত্যি বলছি, হাতে কয়েক ফোঁটা জল টপটপ করে পড়ল, আমি গায়ে মাথায় মেখে নিলাম। আমার শরতের স্পর্শ সারা শরীরে মেখে নিলাম। এরকমই হয় প্রতিবছর। বর্ষা বিদায়ের সরকারি ঘোষণার তোয়াক্কা করি না। আমার শরৎ কবে প্রথম আসে তা আমিই জানি। জানো তো শরৎ, জানি না আর কেউ এমন করে পেতেন কিনা তবে আর এক পাগল ছিলেন, আমার কবি, রবীন্দ্রনাথ। তিনিও শরতের আসার নীরব পদধ্বনি শুনতে পেতেন। কী অদ্ভূত তাঁর ক্ষমতা ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, পূর্ব ভারতে আমাদের এই বাংলায় যেমন করে ছটা ঋতুই তার নিজ নিজ বৈচিত্র্য মেলে ধরে এমনটি আর কোথাও দেখিনি। অনেক নিন্দুকে বলে এখন আর ঋতুদের ফিল করা যায় না। আমার সন্দেহ হয় কোনদিন তেমন করে অনুভব করেছে কি না। অনুভূতির জন্যে ধৈর্য্য দরকার, আবেগের জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি আবশ্যক। আবহাওয়া পরিবর্তনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো হয়তো তৈরিই হয়নি। বই পড়ে শিশুরা জানে ছটা ঋতু—ছ’য়ে ঋতু। সেটা কি, তার কোন আন্দাজ নেই। জানে শুধু মোটা দাগের উঃ আঃ গরম, ঝমঝম বৃষ্টি আর হুহু হিহি ঠাণ্ডা। তাও গরমে এয়ারকন্ডিশনে অভ্যেস আর ঠাণ্ডা পড়ল কি না পড়ল সারা শরীর ঢেকে ফেলল উলের জামাকাপড়ে। শরীরের চামড়ায় এগুলো না মাখলে এদের বুঝবে কী করে! এদের ফিল করতে হবে, চামড়ার রোমকূপ দিয়ে ভেতরে ঢুকে রক্তে, অন্তরে মাখামাখি না হলে বুঝবে কী করে! তখন বই পড়ে বা লোকমুখে জানতে হয় ঋতুদের অভিনবত্ব। এদের মাঝে আর তিনটে ঋতু যে কিছু দিনের জন্যে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যায় সে উপলব্ধি করার মত শিক্ষা হয় না। আর এক দল আছে যাদের খিদের জ্বালাটাই এত প্রকট যে প্রকৃতি তো ছাড় অন্য কোন দিকে মন দেবার মত মনটাই তৈরি হয় না।

ছাড় ওসব। তুমি কি বলছিলে রবীন্দ্রনাথের কথা। সেটা বল।

রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলতেই হবে। ওনাকে ছাড়া কোন কথাই শেষ হয় না। তবে তার আগে জানিয়ে দিই, তোমার এই আকাশ পেলে কি করে। জানো তো, আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম সূর্যের থেকে। কিন্তু ক’জন জানি যে আমাদের এই সূর্য দ্বিতীয় প্রজন্মের। এই তো, চমকে গেলে। হ্যা, ঠিকই তাই। প্রথম প্রজন্মের সূর্য কবে মরে গেছে আর তার থেকে সৃষ্টি এই দ্বিতীয় প্রজন্মের সূর্যটার জন্ম পাঁচশো কোটি বছর আগে। এর শরীর থেকেই ছিটকে আসা নানা মাপের ও ভরের গলিত পাথরগুলো সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয় এবং মহাকর্ষীয় শক্তি সূর্যের চারিদিকে তাদের আবর্তনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। এই গলিত পাথরগুলোই সূর্যের গ্রহ এবং গ্রহের উপগ্রহ। এ ছাড়াও আছে অনেক গ্রহাণু আর উল্কা যারা মাঝে মধ্যে পৃথিবীর মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঘটনাচক্রে তৃতীয় গ্রহের অর্থাৎ যাকে আমরা পৃথিবী নামে চিনি, তার অবস্থান এমন একটা জায়গায় হয়েছে যেখানে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের বাইরে না গিয়ে তার ভেতরেই রয়ে গেছে। আপন অক্ষের চারিদিকে নিজের আবর্তন অথবা সূর্যের চারিদিকে তার ঘুর্ণন কিছুই পৃথিবীর এই অবস্থাকে একচুলও বদলাতে পারেনি সাড়ে চারশো কোটি বছরেও। জমা জলীয় বাষ্প জল হতে পেরেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলের চাপ এবং সার্বিক পরিবেশে বৃষ্টির জল বিশাল বিশাল গহ্বরে জমা হয়ে তৈরি হয়েছে সমুদ্র। সৃষ্টি হয়েছে প্রাণের তিনশো আশি কোটি বছর আগে। প্রাণের বিকাশ ও তার ক্রমাগত বিবর্তন এনেছে মানুষকে। সেই মানুষেরও বিবর্তন হয়েছে তার মস্তিষ্কে। সে ভাবতে, কল্পনা করতে শিখেছে। স্মৃতি হয়েছে প্রখর, দীর্ঘস্থায়ী। তৈরি হয়েছে আবেগ। সেই আবেগের জন্যেই আজ তোমায় দেখে আমার আনন্দ হচ্ছে।

বাব্বা! এত কিছু। এর থেকে মেঘের জন্মের একটা আভাসও পেলাম। আমি ছাই এসবের কি জানি। নিজের আনন্দে উড়ে উড়ে বেড়াই। কে আমাকে নিয়ে গবেষণা করে বা কবিতা লেখে আমি তা কেমন করে জানব বল। তবে জানতে পারলে ভালই লাগত। তাহলে ঋতু পাল্টায় কি করে?

সূর্যের চারিদিকে ঘোরার জন্যেই ঋতু পরিবর্তন। গরম, বর্ষা আর শীত এই তিনটে প্রধান ঋতুর গায়ে গায়ে আরও তিনটে ঋতুর আভাস পাই, যেমন তোমায়, শরৎ, আর তোমার গায়ে লেপ্টে থাকা হেমন্ত; শীত আর গরমের মাঝে আসে বসন্ত। এর জন্যেই প্রকৃতির রঙ বদলে যায়, আকাশের রঙ পাল্টায়, গাছে গাছে আসে নিত্য নতুন ফুল আর ফল। ঋতুর সাথে রঙের এই আত্মিক সম্পর্ক মানুষ দেখেছে। চিহ্ণিত করতে পেরেছে দার্শনিকেরা। বিজ্ঞানীরা নানাভাবে এই সম্পর্কের প্রামাণ্য দাখিল করেছে। আর ভাবুকেরা, কবিরা নানা রঙের স্বপ্নের ও কল্পনার জাল বুনে চলেছে।

আমাকে নিয়েও লিখেছে কবিরা কবিতা? কী মজা! খুব ভালো হবে যদি আমাকে একটা শোনাও। শোনাবে, আমার সোনা?

শোনো, আমার কবি লিখেছেন, “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া”। এটা গান। খুব আলিস্যি ভরা এই গান। ঠিক তোমার মত। তোমার আলিস্যি তো জগৎ বিখ্যাত। ভরা নদীর ওপরে কাঁচা সোনার মতো অথবা চাঁপা ফুলের মতো রঙের রোদ। রোদের এমন রঙ আর দেখা যায় না। সেই রোদ পড়ে মাঠের ধারে কাশ ফুলের ওপর। কাশ সেই রোদ মেখে হালকা হাওয়ায় দোল খায়। সেই বাতাস লাগে মেঘেদের গায়। তাদের নড়াচড়ার কোন লক্ষণ প্রায় দেখাই যায় না। সারা প্রকৃতিই যেন আলসেমিতে ভুগছে। এমন মৃদুমন্দ বাতাসে ধীর গতিতে চলা তরণী আর কোন কালে দেখা যায় না। রাতভর শিউলি ফোটে আর যেই আলো ফুটলো অমনি তাদের মাটিতে ঝরে যাবার জন্যে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। একমাত্র তোমার মেঘের মত সাদা কাশ একেবারে এঁটে লেগে থাকে ডাঁটির সাথে। সেও যেন অতি কষ্টে দোলে কখনও সখনও। চুপটি করে মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার যত আনন্দ। আর তোমার এই আলসেমির ছোঁয়াচ মানুষের গায়ে লেগে তাকেও প্রভাবিত করে। কোন কাজ করতে চায় না। সবসময়ই মনে হয় ছুটি আর ছুটি। কাজের থেকে ছুটি। তাই জন্যেই বোধহয় এটাকে উৎসবের সময় করা হয়েছে।

সুযোগ পেয়ে আমাকে খুব কথা শোনালে। আমার কি দোষ বল? যদি হাওয়া না বয় তাহলে আমি চলি কেমন করে? আমার তো নিজের চলার শক্তি নেই। তা তোমার যদি আমাকে অলস বলে মনে হয় বলতে পার, আমি রাগ করব না।

শোনো, ভারতের কাব্য সাহিত্যে, বিশেষ করে বৈদিক যুগের পরে, প্রথম কালিদাস পরিচয় করান বর্ষার সাথে মানুষের প্রেম-বিরহের আবেগ। এরপর আসে বৈষ্ণব সাহিত্য। সেখানে বর্ষার সাথে সাথে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয় মানুষের প্রেমাবেগ। আর সবকটা ঋতুর বৈচিত্র্য উপলব্ধি করেন এবং গান ও কবিতার মাধ্যমে আলাপ করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু তাই নয়, মানুষের আবেগ কীভাবে প্রভাবিত হয় এই প্রতিটা ঋতুতে সেটাকেও তাঁর রচনায় প্রকাশ করেন। তাঁর আশ্রমে শুরু করেন ঋতু উৎসব যা কেবলমাত্র এবং একমাত্র প্রকৃতিকেন্দ্রিক। তার সাথে কোথাও মিশে থাকতে পারে স্থানিক লোকাচার। তার থেকেই আমরা শিখেছি শুধু প্রকৃতিকে নিয়ে উৎসব করা। তবে রবীন্দ্রনাথ পড়ার অনেক আগে থেকেই আমার তোমায় নিয়ে আবেগ তৈরি হয়েছে সেটা প্রথমেই বলেছি। তাঁর আর একটা রচনা বলছি, শোনো, “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে,/এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরিপর্বতে/এসো মুকুট পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল-শিশির-ঢালা”।

অপূর্ব। খুব ভালো বুঝেছি। এ তো আমারই বন্দনা। জানো, আজ আমার এত কান্না পাচ্ছে, এত আনন্দ তুমি আমায় দিচ্ছ আজ এমন করে, তেমন করে কেউ তো কখনো দেয়নি। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ তোমাদের জন্যে লিখেছেন, আমাকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু তুমি যেমন করে আমায় শোনালে আমি আগে শুনিনি। তোমায় আমি খুব ভালোবাসি। খুউউব। একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যেটুকু জানলাম তোমাদের রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি আর সুন্দরের পুজারি। পৃথিবীতে অসুন্দরও তো আছে। তারা কবিতায় স্থান পায় না? যেমন ধর, বর্ষার বৃষ্টি, শীতের ঠাণ্ডা ইত্যাদিতে অনেকের কষ্টও তো হয়, বন্যা হয়, লোক মারা যায়। এসব নিয়ে কবিতা হয়?

দিলে তো আমার আবেগে লঙ্কা ফোড়ন। শোন, সবকিছু নিয়েই কবিতা হয়। কাব্যের দুটো উদ্দেশ্য—বর্ণন ও শোধন। যা কিছু দেখতে, শুনতে, শুঁকতে, কোমলস্পর্শে সুন্দর বলে ভালো লাগে সেগুলো খুঁজতে হয় না, আপনিই তাদের পরিচয় মেলে। তা দিয়ে কাব্যি হয়। কিন্তু, ঠিকই বলেছ, অসুন্দরের অভাব নেই। কদাকার, কুবর্ণ, পুতিগন্ধ, কর্কশস্পর্শ ইত্যাদিতে সৌন্দর্যের অভাব। আবার নিরপেক্ষ, মানে সুন্দরও নয় আবার অসুন্দরও নয়, এমনও আছে আমাদের জগতে। এসবই কাব্যে পাওয়া যায় নানাভাবে বর্ণনায়। পুরুষ-নারীর মত সুন্দর-অসুন্দরও অবিচ্ছিন্ন। সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত বর্ণনাকাব্যের উদ্দেশ্য, স্বরূপ বর্ণনা। যেমনটি দেখছি, তেমনই বর্ণনা। তবে একদল কবি আছেন যারা অসুন্দরকে বেছে ফেলে শুধু সুন্দরটুকু বর্ণনা করেন। তাতেও তাদের স্বস্তি নেই। যা নেই, তা কল্পনায় এনে সুন্দরকে আরও সুন্দরময় করে তোলেন তাদের কাব্যে। এই ধরনের শোধন কাব্য বর্ণন কাব্যের থেকে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ বর্ণন ও শোধন দু’ধরনের কাব্যেরই প্রণীতা।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তোমরা এত ক্যালেন্ডার মেনে ঋতুকে প্রাধান্য দাও কেন? কই তুমি তো তা নও?

মানুষের ধর্মই হল সব কিছু তার গড়ে তোলা নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখা। তাতে তার নিজের কাজের হিসেবের সুবিধে হয়। সবই হিসেব করে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে মানুষ। সব রুটিন মানা জীবন। প্রকৃতির মত খামখেয়ালিপনা সহ্য করতে পারে না। অথচ প্রকৃতি তো সত্যি আর খামখেয়ালে চলে না, তারও একটা নিয়ম আছে শৃঙ্খলা আছে। সে অনেক বড়। এত বড় যে মানুষ তার নাগাল পায় না তাই নিজের মত করে একটা নিয়মশৃঙ্খলা করেছে। আর তার থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘গেল গেল’ রব তোলে। তার কারণ জান? প্রকৃতির কাছে হেরে যাওয়ার ভয়। এটাই সত্যি। প্রকৃতিতে আপাতভাবে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন হলেই মানুষ ভয় পেয়ে যায়। চেঁচামিচি করে। প্রকৃতিকে যেন তার নিয়ম মানতে হবেই। যেমন ধর, ‘বৈদিক শরৎ’ একটা দিন/সময় আগে ঠিক ছিল। নিশ্চই বৈদিক কালে বর্ষার শেষে শরতের আকাশ দেখে একটা ঋতু-সূচী তৈরি হয়েছিল, এভাবে সব ঋতুরই সময় নির্ধারিত ছিল। কবি দার্শনিকদের মনেও এর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরে বাংলা ক্যালেন্ডারে ভাদ্রের প্রথম দিনটাকে ধরা হয়েছে। আচ্ছা বল, এগুলো তো সবই ‘আপেক্ষিক’। কবে তুমি তোমার কাঁচা সোনা রোদ নিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়না উড়িয়ে উজ্জ্বল করে তুলবে পৃথিবীর মাটি-জল, তা কেমন করে মানুষ জানবে! যতই প্রযুক্তি উন্নত হোক।

তোমার কথা শুনতে এত ভাল লাগছে, কিন্তু আমার সময় বড় কম। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আমায় নিয়ে উৎসবের কথা কি একটা বলছিলে, সেটা বলবে?

সংসারে নিত্যদিনের কাজকর্মের মধ্যে মানুষের স্বার্থ কাজ করে বেশি করে। সারাদিনে মানুষ কত লোকের সাথে মেশে, কথা বলে কিন্তু তার মধ্যে স্বার্থের ভাগই বেশি। মানুষ যখন নিঃস্বার্থভাবে অপরের সাথে মেশে, সেই মিলন হয়ে ওঠে উৎসব। এই যেমন ধর, তোমার এই উজ্জ্বলতা, চাঁপা রঙের কোমল সোনারোদ, এই নীল আকাশ, শ্বেতহংসের মত ভাসমান মেঘ, আর নিচে গাছে গাছে শিউলি ফুল, শিশির ভেজা ঘাসের আগা, বৃষ্টিধোয়া ঝকঝকে সবুজ পাতা ডালে ডালে ঘাসে ঘাসে, ভিজে মাটি, টইটুম্বুর জল নদী নালা খাল বিলে, এই সব মিলে সৌন্দর্যের একটা রূপ পূর্ণতা পায়। এরা একা বিচ্ছিন্ন, টুকরো সুন্দর, কিন্তু মিলেমিশে একটা উৎসব হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে উদ্‌লোকের জন্যে একটা নতুন কিছু উপহার দিতে চায়। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এই সত্যটা প্রকাশ পায় না, আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না। এই যে তোমার যে রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হই তা শুধু ওই নীল আকাশ আর সাদা মেঘ নয়, চোখ যা দেখে তা চোখের দৃষ্টির মধ্যে যা আসে সবটা নিয়েই দেখে আর তাতেই সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা প্রকাশ পায়। এখানেই তৃতীয় নয়ন আর সপ্তম ইন্দ্রিয়ের কাজ। এর মধ্যে আছে মৃদুমন্দ হাওয়া, আছে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভৈরবীর সুরে বীণের মধুর ধ্বনি যা কানে শোনা যায় না কিন্তু অন্তরে রণিত হয়। এখানেই উৎসব হয়ে ওঠা, একলা নয়, অনেকে মিলে, সবাই মিলে একটা আনন্দ। তোমায় বলেছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই, তোমার মধ্যে এক ধরনের আলসেমি দেখি। আসলে আলসেমি না থাকলে উৎসব হয়ে ওঠে না। আলসেমি মানে চুপ করে বিছানায় শুয়ে থাকা নয়, মনটাকে বিশ্রাম দেওয়া। যেমন দিনের বেলা আমরা কাজ করি আবার রাতের বেলা বিশ্রাম নিই। সেটাও একটা কাজ কিন্তু এই কাজে কারোর কাছে দায়বদ্ধতা নেই অথচ সম্পূর্ণতা আছে। কি সেই সম্পূর্ণতা? বিশ্রাম, মনের আরাম। এই মনের বিশ্রাম না থাকলে উৎসব হয়ে ওঠে না। প্রেম আসে না। আকাশে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী রোজ রাতে উৎসব হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় তাদের এই উৎসব দেখতাম। এখন শহরে বাস করে দেখা যায় না তবে পাহাড়ে, জঙ্গলে গেলে, সমুদ্রে ভেসে থাকলে দেখা যায়। মস্তিষ্ক বিশ্রামে থাকে বলেই রাতের বেলায় সব উৎসব হয়। সেখানেও আমরা প্রকৃতির উৎসব পালন করতে গিয়ে প্রদীপ, মোমবাতি বা বিজলি বাতি আর যান্ত্রিক শব্দের মাঝে আসল উৎসবটাই হারিয়ে ফেলি। পুরো আকাশ জুড়ে যেখানে আনন্দের জ্যোতি সেখানে একটা প্রদীপ বা বিজলির আলোকমালা কি করবে? রাতের নীরব বাঁশির মধুর ধ্বনি হারিয়ে যায় যান্ত্রিক আওয়াজে। আসলে উৎসবের আয়োজন করা যত সহজসাধ্য, তার উপলব্ধি ততই দুরূহ। প্রকৃত উৎসবের নির্যাস কতজন গ্রহণ করে সে বিষয়ে সন্দেহ প্রবল। বিশেষ করে আজকের এই আন্তর্জাল দুনিয়ায় যেখানে আত্মপ্রচার এক বিশেষ মাত্রা অধিকার করে বসে আছে। যতই প্রাচূর্য, ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য থাকুক তা প্রেমে রূপান্তর হতে পারে না কারণ প্রেম বিতরণ করার, সবাই মিলে উপভোগ করার। তুমি বলছিলে না, অসুন্দরকে নিয়ে কবিতা হয় কিনা, যে জায়গা বন্যার জলে ভেসে গেছে সেখানের মানুষের কাছে আজকের এই সকাল কতটা উৎসবের হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ আছে। আমি নিরাপদ গণ্ডির মধ্যে থেকে তোমার সৌন্দর্যের উপাসনা করতে পারছি, আমার আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু নিজের একলার আনন্দ তো আর উৎসব হয়ে ওঠে না। তাই মনে মনে উৎসবের আমেজ পেলেও আমি হেরে গেলাম। তবে তোমায় আমার প্রণাম জানিয়ে আমার কবির একটা নিবেদন দিয়ে শেষ করব,

“নিখিলে তব কী মহোৎসব। বন্দন করে বিশ্ব
শ্রীসম্পদভূমাস্পদ নির্ভয় শরণে।”

আমিও পালাই। হাওয়ায় হাওয়ায় মেঘেরা সরে গেছে দূরে। রোদও চড়ে গেছে। আবার দেখা হবে কখনও...

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in




















(২য় পর্ব)


মহারাজা প্রতাপচাঁদ
নানকী দেবী ও পুত্র প্রতাপের মৃত্যুর পর(যদিও সেই মৃত্যু ঘিরে অনেক সন্দেহ, অনেক প্রচার ও অপপ্রচার) পরিণত বয়সে মহারাজা আবার সন্তানের আশায় বিবাহ করেন উজ্জ্বলকুমারীকে। তাঁর একটি সন্তানও হয় কিন্তু সেই সন্তানের মৃত্যু হয় এবং পরে মহারাজার মহিষী উজ্জ্বলকুমারীরও মৃত্যু হয়। ইনি ছিলেন মহারাজ তেজচাঁদের সপ্তম মহিষী। মহারাজ তেজচাঁদের পঞ্চম মহিষী কমলকুমারী ব্যতীত অন্যান্য মহিষীদের নাম বা পরিচয় রাজপরিবারের ইতিহাসে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। উজ্জ্বলকুমারীর মৃত্যুর পর মহারাজা তেজচাঁদ দত্তক নেন কমলকুমারীর ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলালকে। দত্তক নেবার পরে যাঁর নাম হয় মহতাব চাঁদ। এরপরেও মহারাজ বৃদ্ধ বয়সে আবার বিবাহ করেন রাণী বসন্তকুমারীকে। বালিকা বসন্তকুমারীকে বৃদ্ধ বয়সে বিবাহ মনে প্রশ্ন জাগায়। কিন্তু তেজচাঁদের অষ্টম মহিষীর পরিচয় জানার আগে জানা প্রয়োজন রাণী কমলকুমারীকে। বিষেণকুমারীর পর বর্ধমান রাজপরিবারে যে নারীর নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন মহারাজা তেজচাঁদের পঞ্চম পত্নী মহারাণী কমলকুমারী। রাণী কমলকুমারীর মহারাণী বিষেণকুমারীর মত রাজকার্য্য, রাজ্য পরিচালনার দক্ষতা তাঁর ছিল না, কিন্তু রাজপুরনারীদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী, প্রখর বুদ্ধিশালিনী এবং সুচতুরা মহিলা ছিলেন এই নারী। ছল, কপটও তাঁর কম ছিল না। পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে এই নারীর হাত আছে বলে অনেকের অনুমান। সুরায় আসক্ত প্রতাপের সঙ্গে প্রতাপের স্ত্রীর ছদ্মবেশে মিলিত হ’লে মাতৃগমনের পাপবোধে প্রতাপ গৃহত্যাগ করেন এইরকম একটি জনশ্রুতি আছে। কমলকুমারীর ছলনায় প্রতাপ পরাজিত হন। মহারাজার প্রিয় পত্নী হবার সুবাদে কমলকুমারী যে কিছু সুযোগ কাজে লাগাতেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। একরকম তাঁর চতুরতার জন্যই পরাণচাঁদ কাপুরের ভগিনী কমলকুমারী নিজ ভ্রাতার পুত্র (পরানচাঁদের পুত্র) চুনিলালকে রাজার দত্তক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। কিন্তু প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর পর( এখানে বলা ভালো যে মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদও প্রতাপচাঁদের মৃত্যুকেই সমর্থন করেন এবং জাল প্রতাপচাঁদকে স্বীকার করেন না, সম্ভবতঃ বর্ধমান রাজপরিবারের কেউই তা স্বীকার করেন না) পরাণচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলাল ওরফে মহতাব চাঁদকে দত্তক নেবার পরেও পরিণত বয়সে পরানচাঁদ কাপুরের কনিষ্ঠা কন্যা বসন্তকুমারীকে মহারাজ তেজচাঁদ আবার বিবাহ মনে ঔৎসুক্য জাগায়।

বসন্তকুমারীর বয়স তখন ছিল মাত্র এগারো বৎসর। শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে এই বিবাহ ছিল কেবলমাত্র মহারাজা জনিত খেয়াল। আবার এই বিবাহ রাণী কমলকুমারীর অতিশয় চতুরতার ফল হতে পারে। পরানচাঁদ ছিলেন বর্ধমান রাজকার্যে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। কমলকুমারী ছিলেন তাঁর ভগিনী। দুজনেই ছিলেন অর্থলোলুপ, অতিশয় চতুর। একই পরিবারের দুই কন্যা(পিসি কমলকুমারী এবং ভাইঝি বসন্তকুমারী)এবং এক পুত্র(মহতাব চাঁদ) রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত হলে রাজ-ঐশ্বর্য্যের যে অনেকখানি কাপুর পরিবারের করায়ত্ত হবে, তা পরানচাঁদ কাপুরের অজানা ছিল না। সুচতুরা কমলকুমারী ভ্রাতার সঙ্গে সহমত ছিলেন। পরানচাঁদের কনিষ্ঠা কন্যা বসন্তকুমারীর সঙ্গে মহারাজার বিবাহ হ’লে রাজ্য-রাজত্বের প্রায় সমস্ত কিছুর উপরেই কায়েম হবে দেওয়ান পরানচাঁদের একরকম একছত্র অধিকার। ভগিনী, কন্যা আবার পুত্রের পরবর্তীকালে মহারাজা হ’বার আকাঙ্খায় (কারণ পরবর্তী সময়ে মহারাজ তেজচাঁদ যাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন তিনিই হন মহারাজাধিরাজ মহতাবচাঁদ) এই ধরণের একটি কাজ করা তাঁদের উভয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল। মহারাজা তেজচাঁদ এই বিবাহ করেন দত্তক পুত্র গ্রহণ করার পর, সুতরাং পুনরায় পুত্র আশায় যে তিনি এই বিবাহ করেননি তা বোঝাই যায়। তাছাড়া মহারাজ তেজচাঁদ তখন বৃদ্ধ, তাঁর বয়স তখন ছিল ৬৭ বৎসর। সুতরাং এই বিবাহ পরানচাঁদ কাপুর ও কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র, মহারাজার উপর চাপসৃষ্টি এবং রাজপরিবারে প্রাধান্য স্থাপন এমন একটি সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতেই পারে। এছাড়া এই বিবাহের অন্য কোন অর্থ হতে পারে না কারণ বসন্তকুমারী রাণী কমলকুমারীর মত পূর্ণযোবনা এবং সুন্দরী ছিলেন না যে, মহারাজ তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে পারেন। তাছাড়া বিবাহের সময় বসন্তকুমারী ছিলেন এগারো বৎসরের প্রায় বালিকা মাত্র। পাঁচ বৎসর পরেই মহারাজার জীবনাবসান হয়। রাণী বসন্তকুমারীর বয়স তখন মাত্র ষোল।
মহারাজ তেজচাঁদের জীবনাবসানের সময় তাঁর অষ্টম মহিষী রাণী বসন্তকুমারীর বয়স ছিল মাত্র ষোল বৎসর। কিন্তু মহারাজ তেজচাঁদের মৃত্যুর পর এই অল্পবয়স্কা রাণীর জীবন কাটে অত্যন্ত কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে। তাঁকে প্রায় একবৎসর ঘরবন্দী করে রাখা হয়। যুক্তি ছিল, অল্পবয়স্কা নারীর নানান প্রলোভনে চরিত্র নষ্ট হতে পারে এবং কুসংসর্গে পড়তে পারেন। রাণীর রাজপরিবারের অপর পুরুষমানুষের প্রতি প্রণয়াসক্তিও জন্মাতে পারে। তাই ঘরবন্দী করে রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, প্রধানতঃ এই যুক্তি ছিল রাণী কমলকুমারী এবং পরানচাঁদ কাপুরের। কারণ রানী বসন্তকুমারীকে বিষয় আশয় থেকে বাইরে রাখলে তাঁদের লাভই ছিল সকলের চেয়ে বেশি। রাণী বসন্তকুমারী নিজ অধিকারের জন্য মামলা করেন এবং এই মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য নিতে হত কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানীর ব্যারিষ্টার তখনকার বিখ্যাত ডিরোজিও সাহেবের শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলের দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। একটা কথা হয়ত বলা যেতে পারে কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানী ছিল বর্ধমান মহারাজাদের আইনী পরামর্শদাতা। এই কার এন্ড ট্যাগোর কোম্পানীর একজন ছিলেন আমাদের অতি পরিচিত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরমহাশয়ও। জাল প্রতাপচাঁদের মামলার সময় বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষে ইনি ছিলেন একজন প্রধান সাক্ষী ও সহায়। সে প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে।

দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাণী বসন্তকুমারীর পক্ষের উকিল। এই সময়েই দুজনের মধ্যে প্রণয় জন্মায় এবং রাণী বসন্তকুমারী এক দুঃসাহসিক যাত্রা করেন দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে যা বর্ধমান রাজপরিবার তো বটেই, সে যুগের পক্ষেও এক অতি দুঃসাহসের পরিচয়। দুজনে পলায়নের পর রাজার লোকলস্কর দিয়ে তাঁদের ধরে আনলেও আবার দুজনে পলায়নে সক্ষম হন এবং তাঁরা কোর্টে সিভিল আইন অনুযায়ী বিবাহ করেন। বিবাহের পর তাঁরা অযোধ্যার নবাবের অন্তর্গত লক্ষ্মনৌ শহরে বাকি জীবন কাটান এবং তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মে। রাণী বসন্তকুমারীকে নিয়েও অনেক গবেষক, লেখক নানা আলোচনা ও চিন্তাভাবনা তাঁদের লেখনীতে প্রকাশ করেছেন। এখানে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে বলা যেতে পারে তিনি একজন অসমসাহসী মহিলা। রাণী বসন্তকুমারী যে তাঁর নিজের ইচ্ছামত জীবনকে বেছে নিতে পেরেছিলেন, একজন রাজঅন্তঃপুরবাসিনী হয়েও এতে তাঁর অসম সাহসিকতার পরিচয় মেলে, যদিও সেই জীবনকে বেছে নেবার পথ ছিল অত্যন্ত দুরূহ এবং কঠিন। তবু, একথা বলা যেতে পারে যে বর্ধমান রাজপরিবারে বসন্তকুমারী অবশ্যই এক অন্যরকম চরিত্র।

প্রতাপেশ্বর মন্দির
শ্রী প্রণয়চাঁদ মহতাবের মতেও রাণী বসন্তকুমারী যা করেছিলেন তা সঠিক কাজ। অল্পবয়স্কা এক মহিলা যিনি রাণীর জীবন কাটাতে অভ্যস্ত, তাঁর বন্দী জীবন কাটানোর চেয়ে নিজের খুশিমত জীবন কাটানো অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে তাঁর। সকল মানুষেরই অধিকার আছে তার নিজের জীবনকে বেছে নেবার। মাত্র এগারো বৎসরের বালিকার পক্ষে বৃদ্ধ রাজাকে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া এবং সেই স্বামীর অবর্তমানে বন্দী জীবন কাটানো এক নারীর পক্ষে যে কি ভয়ানক সেটা যে কোন মানুষই চিন্তা করলে বুঝতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তৎকালীন রাজপরিবারের মান-মর্যাদা এবং সামাজিক বাধা কাটিয়ে সে যুগে এই নারী যে একজন প্রেমিকের হাত ধরে গৃহত্যাগের মত(তাও আবার রাজপরিবারের বধূ এবং বিধবা মহারাণী) সাহস দেখাতে পেরেছিলেন, এজন্য তাকে বাহবা দেওয়া উচিত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাণী বসন্তকুমারী বর্ধমান রাজ অন্তঃপুরবাসিনী রমণীগণের মধ্যে অবশ্যই এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যদিও রাণী বসন্তকুমারী বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে বর্ধমান রাজপরিবারও তাঁদের পারিবারিক ক্রিয়াকরণ ইত্যাদি থেকে রাণী বসন্তকুমারী এবং তাঁর পরবর্তী পরিবার-পরিজনদের নাম রাজবাড়ির বংশলতিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন এবং এককথায় বলতে গেলে বর্ধমান রাজপরিবারে তাঁদের আর কোন স্থান নেই।

তেজচাঁদের পর বর্ধমান রাজপরিবারের রাজা হন দেওয়ান পরানচাঁদ কাপুরের পুত্র চুনিলাল, যাঁকে মহারাজ তেজচাঁদ দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী কালে যাঁর নাম হয় মহতাবচাঁদ। ইনি ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন না, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। বলতে গেলে একরকম তাঁর আমল থেকেই ব্রিটিশ ভক্তি শুরু হয় এবং পরিবারেও ব্রিটিশ নিয়ম-কানুন লাগু হয়। মহতাবচাঁদের দুই বিবাহ। প্রথমা পত্নী নয়নকুমারী। তাঁর মৃতুর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নারায়ণকুমারীকে। রাজপরিবারে নারায়ণকুমারীর বেশি কিছু অবদানের কথা শোনা যায় না। কিন্তু মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদের মতে নারায়ণকুমারী ছিলেন একজন জবরদস্ত মহিলা। রাজকার্য বা অন্যান্য ব্যাপারে নারায়ণকুমারীর বিশেষ কোন অবদান না থাকলেও তিনি মহারাজের সবরকম কাজের সহায়ক ছিলেন এবং অনুমোদন করতেন, বাধা দিতেন না। নারায়ণকুমারী এবং মহতাব চাঁদেরও কোন সন্তানাদি না থাকায় মহারাণীর ভ্রাতা বংশেগোপাল নন্দের পুত্রকে দত্তক নেওয়া হয়। তাঁর নাম হয় আফতাব চাঁদ। পরে আফতাব চাঁদেরও সন্তান না থাকায় দত্তক পুত্র গ্রহণের সময় আফতাব চাঁদের মহিষী বেনোদেবীর সঙ্গে নারায়ণ কুমারীর মকদ্দমা বাধে, কিন্তু নারায়ণকুমারী মিতাক্ষরা আইন অনুসারে পরাজিত হন। সেই সময় দত্তক পুত্র নেবারও একটা নিয়ম ছিল। যাকে বিবাহ করা যায় না সেই রকম কোন সম্পর্কের কারো সন্তানকে দত্তক নেওয়া যেত না। তাই শেষ পর্য্যন্ত বেনোদেবীর মতানুসারেই বনবিহারী কাপুরের পুত্র বিজনবিহারী কাপুরকে দত্তক পুত্র গ্রহণ করা হয়, যাঁর পরবর্তী নাম হয় বিজয়চাঁদ মহতাব।

বিজয়চাঁদই প্রথম ‘মহতাব’ উপাধি কে পদবী হিসাবে গ্রহণ করেন। নারায়ণ কুমারী মামলায় হেরে গেলেও বেশ কিছু বিষয় সম্পত্তির অধিকারিণী হন। শ্রী প্রণয়চাঁদের মতে, নারায়ণকুমারী ছিলেন তন্ন্ত্রসাধিকা। রাজবাড়ির ভিতরে এইরকম মড়ার মাথা, খুলি এইসব নিয়ে তন্ত্রসাধনা রাজ পরিবারের অন্যান্য লোকজন সুনজরে না দেখার জন্য আফতাব চাঁদ রাজমাতা মহারাণী নারায়ণ কুমারীর জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই মন্দিরটি রাজবাড়ির কাছাকাছি অবস্থিত ভুবনেশ্বরী কালিমন্দির, বর্ধমানের বুকে যা আজও ‘সোনার কালিবাড়ী’ নামে খ্যাত এবং নারায়ণ কুমারী সেইখানেই তাঁর জপতপ, সাধনা নিয়েই বাকী জীবন কাটান। নারায়ণ কুমারীর কথা চিন্তা করলে একটা কথা অতি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবা যেতে পারে যে সেই কালেও একজন মহিলা (যদিও তিনি রাণী) স্বাধীনভাবে একা তন্ত্রসাধনার মত কঠিন পথকে বেছে নিতে পেরেছিলেন, রাজপরিবারের লোকেরা তা অনুমোদন করেছিলেন এবং তাঁর থাকা ও সাধনার জন্য অন্যত্র মন্দির ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা অবশ্যই। তবে তেজচাঁদের আমল থেকেই সাধক কমলাকান্তের তন্ত্রসাধনার সঙ্গে রাজপরিবার পরিচিত ছিলেন। যার কিছু আধ্যাত্মিক প্রভাব পড়েছিল প্রতাপচাঁদ এবং পরবর্তী কালে মহারাজ বিজয়চাঁদের উপরেও, যদিও তা তন্ত্রসাধনা ছিল না।

বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেইযুগের একজন মহিলা, যিনি রাজরাণী, রাজমাতা আবার তিনিই যে তন্ত্রসাধিকা---একথা ভেবে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কতরকমের যে বিস্ময় লুকিয়েছিল এই অন্তঃপুরে, ভাবলেও অবাক হতে হয়! সাধারণভাবে যে সকল অন্তঃপুরবাসিনীরা ছিলেন ঘেরাটোপের মধ্যে, বাইরে বেরোতে পারতেন না, ছিলেন পর্দানশীন তাঁরাও কিন্তু সকলের অলক্ষ্যে রচনা করে গেছেন নিজ নিজ ইতিবৃত্ত। তাই কখনও পাই রাণী ব্রজকিশোরীর মত দান-ধ্যান রতা রাণী, কখনও পাই রাণী বিষ্ণুকুমারীর মত জমিদারি রক্ষাকর্ত্রী, আবার কখনো পাই নারায়ণকুমারীর মত তন্ত্রসাধিকা, ছিলেন বসন্তকুমারীর মত দুঃসাহসিকা।
কিন্তু বর্ধমান রাজঅন্তঃপুরে ছিলেন আরো অনেকে। তাঁদের কথাও জানা যাক......
(ক্রমশঃ)

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো-কোম্পানি
আমার ভারতবর্ষ-৬


ললিতগিরি


একশো বছরের উপর হয়ে গেলো। ১৯০৫ সাল। জাজপুরের এসডিও চক্রবর্তীসাহেব বেরিয়েছিলেন জঙ্গলমহাল সরজমিন ঘুরে দেখতে। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ে গভীর বনের মধ্যে কিছু ভাঙাচোরা পাথরের ভাস্কর্য। সঙ্গীদের কাছে জানতে চান এই জায়গাটার নাম কী? তারা বলে নালতিগিরি। ঘন গাছ-বনস্পতির আলোছায়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছে উঁচুনিচু টিলা আর লালমাটির রং। জাজপুরে ফিরে এসে তিনি ব্যাপারটা একেওকে জানান। কিন্তু তা নিয়ে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেননি। শেষে ১৯২৮ সালে ভারতীয় জাদুঘরের পণ্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ মশাই এখানে এসে নিদর্শনগুলি পরীক্ষা করেন। তার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের দলিলে নালতিগিরি জায়গা পেয়ে যায়। ক্রমাগত খোঁজাখুঁজির সুবাদে ১৯৩৭ সালে সরকার স্থির করেন এই পুরাবশেষটিকে সংরক্ষিত তকমা দেওয়া দরকার। কিন্তু তার পরেও কোনও ব্যবস্থা হলো না। কেটে গেলো আরো চল্লিশ বছর। ১৯৭৭ সালে উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় আর পুরাতত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে খোঁড়াখুঁড়ির কাজে কিছুমাত্রায় গতি দেখা গেলো। তাও যথেষ্ট নয়। অবশেষে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ মধ্যে পাওয়া নানা
নিদর্শন দেখে পণ্ডিতেরা বুঝতে পারলেন এই নালতিগিরিই প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখিত ললিতগিরি'র গরিমাময় বৌদ্ধবিহার। ললিতগিরি ছিলো প্রবাদপ্রতিম পুষ্পগিরি বিহারের একটা অংশ। পৃথিবীতে প্রাচীনতম বৌদ্ধসংস্কৃতির নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি প্রধান পীঠ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দশম শতক পর্যন্ত এখানে ছেদহীনভাবে বৌদ্ধসভ্যতার বৈজয়ন্তী উড়েছিলো। অনেকে বলেন ললিতগিরি উত্তর মৌর্যযুগ থেকে তেরো শতক পর্যন্ত পূর্বভারতে বৌদ্ধধর্মের নিরন্তর তীর্থভূমি হয়ে থেকেছে।


খননকাজের পর এখানে ছোটো পাহাড়ের চূড়ায় একটি বিশাল স্তূপ আত্মপ্রকাশ করে। এই স্তূপটির গভীর থেকে একটি খোণ্ডালাইট পাথরের বাক্স পাওয়া যায়। প্রথম বাক্সটির ভিতরে আরেকটি স্টিয়াটাইট পাথরের কৌটো। তার ভিতর প্রথমে রুপোর ও তারও ভিতরে একটি সোনার কৌটো। এই সোনার কৌটোর ভিতরে ছিলো শাক্যমুনি বুদ্ধের দেহাস্থি।




এই স্তূপটি ছাড়া আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরানিদর্শন রয়েছে ললিতগিরিতে। পূর্বমুখী উপবৃত্তাকার চৈত্যগৃহ। ৩৩X১১ মিটারের ইঁটের নির্মাণ। যার দেওয়ালগুলি ১১ ফিট চওড়া। এর কেন্দ্রে আছে একটি বৃত্তাকার স্তূপ। তার উপর কুশান ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত শিলালেখ। এটি এবং আনুষঙ্গিক পুরা নিদর্শনগুলি দেখে মনে করা হয় এগুলি পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের নির্মাণ।


ললিতগিরি গড়ে উঠেছিলো বিভিন্নপর্বে তৈরি হওয়া চারটি বৌদ্ধবিহারকে কেন্দ্রে রেখে। প্রথম বিহারটি বৃহত্তম ও দশম-একাদশ শতক নাগাদ নির্মিত হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিহারটি পরবর্তীকালে, যখন বৌদ্ধধর্মের দিন ফুরিয়ে আসছিলো এদেশে। তৃতীয় ও চতুর্থ বিহারগুলি আগে পরে তৈরি হওয়া। এখানেই একটি নবম-দশম শতকের পোড়ামাটির সিলমোহর পাওয়া যায়। তার উপর উৎকীর্ণ ছিলো "শ্রী চন্দ্রাদিত্যবিহার সমগ্র আর্য ভিক্ষু সঙ্ঘস্য।" এই উল্লেখটি থেকেই ললিতগিরির পরিচয়টি পণ্ডিতেরা জানতে পারেন।

ওড়িশার বৌদ্ধ ঐতিহ্যের বহুকথিত স্বর্ণিম'ত্রিভুজের প্রাচীনতম বিন্দুটি এই ললিতগিরি। কটক থেকে পারাদিপের পথে জগৎসিংপুর জেলায় রাজপথ থেকে একটু ভিতরদিকে এই পুরাবশেষটি দেখতে পাওয়া যাবে। মূলস্রোত থেকে একটু দূরবর্তী হওয়ার জন্য রত্নগিরি বা উদয়গিরির মতো জনসমাগম এখানে দেখতে পাওয়া যায়না। কিন্তু ললিতগিরির গুরুত্ব অবিসম্বাদী এর প্রাচীনত্বের কারণে। এখানে মহাযানী সংস্কৃতির নানা পুরা নিদর্শন পাওয়া গেছে। সোনারুপোর অলংকার, শিলাপট্ট, নানা শিলমোহর ছাড়াও অবলোকিতেশ্বর, তারা, হারীতি, অমিতাভ, মহিষমর্দিনী, গণেশ, বুদ্ধ, বোধিসত্ব, জম্ভলা ইত্যাদি মূর্তি প্রধান। এইসব ভাস্কর্যে গান্ধার ও মথুরা শৈলির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। শেষ পর্যায়ে এখানে বজ্রযানী তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রও গড়ে উঠেছিলো।

মহাস্তূপের উপর থেকে নিচে তাকালে আদিগন্ত সবুজের সমারোহে উজ্জ্বল উৎকলের সমভূমি। রোমাঞ্চ লাগে, যখন ভাবি হাজার হাজার বছর আগে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষারা নিজেদের কর্মভূমি, তপোভূমি হিসেবে এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণ করাই আমাদের তর্পণ। আলোয় ছায়ায় নিরন্তর আসা যাওয়া। আমার ভারতবর্ষ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



একটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? কতজন এ লেখা পড়ছেন বা পড়বেন জানি না, তবে লেখার একটা পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে বিদেশের হেঁশেল সংস্কৃতি নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করছি না তো? দেশজ রন্ধনশিল্প এত বিস্তৃত এবং বিপুলা হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক কিছু পদের প্রকরণকৌশল ও তার ইতিহাস প্রসঙ্গে লেখা ছাড়া এখনও পর্যন্ত অন্য প্রদেশের রান্নাবান্নার একরকম বহিরঙ্গেই ঘোরাফেরা করেছি। প্রথমত একথা বলা দরকার যে এটি কোনও বিশেষ উদ্দ্যেশ্যপ্রসূত নয়। একদিন নিজের অজান্তেই যেমন এই যাত্রাপথে নিজেকে আবিষ্কার করে একাধারে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম কিন্তু কোথাও পৌঁছনোর তাগিদ ছিল না। অসামান্য সেই সরণি ধরে যত এগিয়েছি, তত ক্ষুদ্র মনে হয়েছে নিজেকে আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি চারপাশের শোভা। চলার পথ তৈরি হয়ে গেছে আপন খেয়ালে। আর দ্বিতীয়ত দেশের কোনও রান্নার হাঁড়ির খবর অনুসন্ধানে সিপিয়া-রঙা ছবি ওলটাতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছি অন্য আরেক দেশের অনুষঙ্গ আর গোয়েন্দা গল্পপ্রিয় আমার মন হাজির হয়ে গেছে অচেনা কোনও ভূখণ্ডে। তখন গৌণ হয়ে গেছে আলাদা আলাদা রন্ধনসংস্কৃতি – সবকিছুই এক বৃহৎ রান্নাঘরের অংশ বলে হয়েছে আর তারই কোনও কোনও বিচ্ছুরণ কখনও কখনও ঢেকে ফেলেছে পথ হারিয়ে সেখানে ঢুকে পড়া এক অর্বাচীনকে।

স্টেক। এর আভিধানিক অর্থ ব্যপক। রসনার সঙ্গে এই শব্দটিকে জুড়ে দিলে তার ফল হয় অতি সাঙ্ঘাতিক। কেমব্রিজ অভিধানে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে পাচ্ছি স্টেক বলতে ‘a thick, fat piece of meat or fish, especially from a cow’ কে বোঝাচ্ছে। এর থেকে কিছুটা বোঝা গেলো বটে কিন্তু যদি কোনও খাঁটি স্টেকরসিকের পাল্লায় পড়েন, তাহলে বুঝবেন এই সংজ্ঞা আসলে জলের তলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থাকা হিমশৈলের চুড়া কিছুই নয়। আসুন প্রবেশ করি স্বাদু সেই জগতে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্ক্যান্ডিনাভিয়াতে প্রথম এই খাদ্যটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু যে আধুনিক স্টেকের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে, মাংস আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার প্রাচীন রীতি থেকে। সেই ফ্লোরেন্স! ইতালিয়ান রেনশাঁসেরও জন্ম যেখানে। আজও যেখানে সারাবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন রেনেশাঁসের অবিশ্বাস্য সুন্দর নিদর্শনগুলি একটু সামনাসামনি দেখার জন্য। একসময়ের ব্যবসা- বানিজ্যের কেন্দ্র, তুমুল বিত্তশালী এই জনপদটি ‘মধ্যযুগের এথেন্স’ বলেও পরিচিত। এবার একটা ছবি কল্পনা করুন। প্রবল শীতের রাত। আলো-আঁধারির মধ্যে এক বিশাল আগুনকে ঘিরে কিছু মানুষ আর সেই আগুনে ঝুলিয়ে পোড়ানো হচ্ছে একটি পশুকে। ধীরে ধীরে জমে উঠবে নৈশাহার! সেইদিন থেকে কীভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে স্টেক হয়ে উঠলো পৃথিবীর জনপ্রিয়তম একটি আহার্য, সেইদিকে একটু তাকানো যাক। একেবারে শুরুতেই যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, তা হলো স্টেকের মাংস কাটার নিয়ম। সবসময় লম্বালম্বিভাবে, আড়াআড়ি নয় আর এখানেই স্টেক আর রোস্টের মাংসের মধ্যে মৌলিক তফাৎ। লম্বালম্বি কাটার অর্থ শরীরের পেশীতন্তুর বিপরীতে ছুরি চালানো, যে কারণে স্টেক তৈরির সময় রোস্টের থেকে তুলনামুলকভাবে কম। কারণ রোস্টের জন্য মাংস কাটা হয় পেশীতন্তুর অভিমুখে। তাই রোস্ট ‘স্লো কুক’ করা হয় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আর স্টেক ‘ফাস্ট ফুডে’র তালিকায় পড়ে। শোনা যায় যে ফ্লোরেন্স শহর থেকে স্টেকের উৎপত্তি, ব্যবসার প্রয়োজনে সেখানে যাতায়াত ছিল ইংরেজদের। তাঁরাই এই বস্তুটির স্বাদে এমন মজে যান যে দেশে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে যান এর রেসিপি এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হওয়ার তাইই হয়েছিল। অর্থাৎ পৃথিবীর যেখানে যেখানে তাদের উপনিবেশ ছিল, সেইসব জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ল পোড়া মাংসের গন্ধ! কলকাতা নিশ্চিতভাবেই বাদ পড়ল না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে জন্ম নিল নতুন এক হেঁশেল সংস্কৃতি – যার নাম ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কুইজিন’। যার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল শহরের অলিতে গলিতে আর পার্ক স্ট্রিট নামক এক অঞ্চলে কয়েকটি পদ খুঁজে পেল তাদের স্থায়ী ঠিকানা। যার একটি ছিল অলিপাব। অলিপাবের স্টেক, বিশেষত শাতু ব্রিয়াঁর খ্যাতি হলো ভারতজোড়া। আপাত সাধারণ এই রেস্তোরাঁটির সামনে অপেক্ষমান স্টেকপ্রেমী জনতার জটলা বিরল কোনও দৃশ্য ছিলনা এই সেদিন অবধিও। ভুলে গেলে চলবেনা আশপাশে আরও এমন কয়েকটি জায়গা ছিল, বোদ্ধামহলে স্টেক পরিবেশনে যারা যথেষ্ট কৌলীন্য দাবী করতে পারতো। এছাড়াও ছিল কিছু ক্লাব, কলকাতার স্টেক-প্রেমের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যে যাদের অবদান ছিল গগনস্পর্শী। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বাঙালিদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার প্রশ্নে আজকের তুলনায় ছুৎমার্গ ছিল অনেক কম। ‘প্রাইমাল কাট’ কী বা টি-বোন, পোর্টারহাউস কিংবা সিরলয়েন, টেন্ডারলয়েন বা ব্রিস্কেট কাকে বলে – এ নিয়ে মন্তব্য করার মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। আজ সে প্রজাতি লুপ্তপ্রায়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরাণার দুয়েকটি ক্লাবে বছরের কিছু বিশেষ সময়ে কাঠকয়লার আঁচের ওপর জাল দিয়ে বারবিকিউ এর সময় সদস্যদের মধ্যে যে উৎসাহের ঢল দেখা যেত, তা এখন ইতিহাস। এখন ওইসব দিনগুলিতে যা দেখা যায়, তা হলো ‘সাজানো ঘটনা’। বারবিকিউ এর সস্তা বানিজ্যিকরণ। বহু আগে থেকে সব কিছু তৈরি করে প্লেটে সাজিয়ে রাখা।

ইউরোপের মাটিতে সেবার পা রাখার আগেই ইউরোপীয় খাবার, বিশেষত স্টেক খাওয়ার বিষয়ে আমরা যথাযথভাবে দীক্ষিত হয়েছিলাম অশোকদার কাছে। অশোক সেন। কলকাতার একটি অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা, দীর্ঘসময় বিলেতে কাটানো, ভিন্ন রুচি আর মনন – সব মিলিয়ে এক অন্য গ্রহের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সমান উৎসাহ নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর কিশোর গল্পসংকলন সম্পাদনা করতেন বা স্টেটসম্যানের জন্য করতেন কোনও গ্রন্থ সমালোচনা আর পাশাপাশি আমাকে শেখাতেন পশ্চিমী রান্নার নানান কৌশল।

দেশের বাইরে স্টেকের স্বাদ পেতে লেগে গেলো অনেকটা সময়। আমাদের সেই ভ্রমণ যখন শেষ পর্বে। ইংল্যান্ডে এক সপ্তাহের বেশি কাটালেও স্টেক খাওয়ার সুযোগ হয়নি। যা হলো ক্যোলন্‌, হির্শবার্গ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে বার্লিনে বারবারার কাছে গেলাম যখন। বার্লিন শহরে একটা বিশেষ রাস্তা আছে। উন্টার ডেন লিন্ডেন। এর একটা তর্জমা হতে পারে ‘লেবু গাছের তলায়’। ইতিহাসের নানা অধ্যায়ের সাক্ষী পুব আর পশ্চিম বার্লিনকে জুড়ে রাখা প্রশস্ত এই পথটি। চারপাশের সৌধগুলি দেখতে দেখতে কত যে হেঁটেছি! এখানেই একটি হোটেলে একসময় দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় আছে। এই পথের দুপাশে অজস্র পাব আর রেস্তরাঁ। বারবারা আমাদের নিয়ে একদিন হাজির হলো স্টেক হাউস-এ। নাম থেকেই জায়গাটির মাহাত্য বোঝা যাচ্ছে। তাই না? বিভুয়ে স্টেকদর্শনের সেই প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় যা চোখে পড়েছিল তা হচ্ছে পরিমাণ। মাংসের টুকরোটা বেশ বড়, স্যালাড এবং আনুসঙ্গিকতাও বেশি। তখন ভেবেছিলাম, ওদেশের লোকজনের চেহারা যেমন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়েই হয়তো ওই আকার। কিন্তু না। অচিরেই একটা মৌলিক পার্থক্য আবিষ্কার করলাম দুদেশের রেস্টুরেন্ট মালিকদের মানাসিকতার মধ্যে। মাংসের বড় টুকরো তো বটেই, তার সঙ্গে স্যালাড ইত্যাদি পর্যাপ্ত দেওয়াটাই ওদেশের রেওয়াজ। মাংসের গুণগত মানটাও অনস্বীকার্যভাবে আলাদা। আর এখানেই আসল ম্যাজিক! যেকোনোও রান্নার শিরদাঁড়া হলো উপাদান। উপাদান সঠিক এবং টাটকা না হলে নিছক জ্ঞান বা চোখ-ধাঁধানো গ্যাজেট প্রার্থিত ফল এনে দিতে পারে না। তবে এখনও অবধি বিদেশের মাটিতে সেরা স্টেক খাওয়ার অভিজ্ঞতা জার্মানিতেই, খাদ্যরসিক বন্ধুদম্পতি রলফ্‌ আর মনিকার সঙ্গে হামবুর্গে। কিন্তু হ্বিনার শ্নিৎসেল (Wiener Schnitzel)? স্বর্গীয় এই বস্তুটি পরখ করার জন্য বারবার ফিরে এসেছি বার্লিন আর উন্টার ডেন লিন্ডেন এ। রক্তের মধ্যে এই নেশা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য যিনি এককভাবে দায়ী, তাঁর নাম বারবারা কাপ্টাইন। সম্ভবত সেবার ফেরার একদিন আগে বারবারা আবার আমাদের নিয়ে গেলো বার্লিন শহরের ওই অঞ্চলে। তখনও এই বস্তুটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না। এমনকি আমাদের সামনে হাজির হলেন যখন তিনি কারটোফেলসালাটের (বিখ্যাত জার্মান আলুর স্যালাড) সঙ্গী হয়ে, তখনও জানিনা সারা জীবন তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাবো। বাছুরের ঘাড়ের কাছের হাড় ছাড়া ফিলেতে প্রথমে নুন, মরিচ মাখিয়ে নিতে হবে ভালো করে। তারপর প্রথমে ময়দা (রাইস ফ্লাওয়ার হলে ভালো হয়) তারপর ডিম আর সবশেষে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ডুব তেলে ভাজতে হবে। এই বর্ণনাটা যত সহজে করলাম, মনে রাখতে ঠিকঠাক স্বাদ আনা ততোটাই কঠিন। কারণ শ্নিৎসেল খাওয়ার জন্য বিশেষ জায়গা আছে আর সেখানে আগে থেকে টেবিল বুক করা না থাকলে হতাশ হয়ে ফিরতে হতে পারে। বাছুরের মাংসের বদলে অবশ্য শুয়োরের মাংসও ব্যবহার হয়ে থাকে মূলত দামের কারণে। তবে সে স্বাদ আলাদা। আরেকটি জরুরি প্রসঙ্গ। নাম থেকেই মালুম এ জিনিসের কপিরাইট ভিয়েনা শহর আর অস্ট্রিয়ার কিন্তু আবার সেই ধাঁধাঁ। তথ্য বলছে উনিশ শতকে এক অস্ট্রিয়ান সেনাধ্যক্ষ্য ইতালির মিলান শহরে এটি চেখে দেখেন এবং দেশে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এর রেসিপি। আবার সেই ইতালিয়ান যোগ!

কলকাতা ফেরার পথে আমাদের নামতে হয়েছিল মস্কো বিমান বন্দরে। তখন অনেক রাত। আমাদের সকলের পেট চুঁইচুঁই। সস্তার বিমান সংস্থার খাবারে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়নি। কিন্তু কী খাবো, কোথায় খাবো? বিশাল এয়ারপোর্টের এমাথা ওমাথা চষে ফেলতে ফেলতে প্রথমে বিখ্যাত রুশ খেলনা পুতুলের সেট মাত্রুশকা কিনে ফেললাম। খিদে তখন চরমে। শেষমেশ পৌঁছলাম সেইসময় খোলা থাকা একমাত্র রেস্তরাঁটিতে। ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে বোঝাতেও পারলাম আমাদের বুভুক্ষু অবস্থার কথা। একগাল হেসে মোটাসোটা চেহারার মহিলা আমাদের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন। ফিরলেন যখন, তাঁর হাতের প্লেটে মাংসের একটা বড়সড় টুকরো। স্টেক!! হলফ করে বলতে পারি এমন স্টেক আর কখনও দেখিনি। ফলত, সে রাত আমাদের অভুক্তই কেটেছিল।

0 comments: