0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



বসন্ত এল। লাল পলাশের রঙে রঙে নতুনের ডাক দিয়ে প্রকাশিত হলো ঋতবাক তৃতীয় বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা। 

আচ্ছা, কোনও নতুনই কি এই বসন্তের মতো আপনাআপনি আসে? যাও পুরাতন বললেই কি নতুন খেলা আরম্ভ হয়? এই যে গত ৮ই মার্চে এত মত মতান্তর, নারী দিবস না মানব দিবস তা নিয়ে কথার তুফানের কি সত্যিই প্রয়োজন আছে? শতাব্দী প্রাচীন এই স্মারক দিবসটির ইতিহাস সকলের জানা। সে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু যে কোনও একটি বিশেষ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি দিবস চিহ্নিত করা এবং সেটিকে যুগপৎ নিষ্ঠা ও উত্তেজনার সঙ্গে পালন করার অর্থই হলো বিষয়টি সম্বন্ধে ব্যপক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস ও প্রয়োজনীয়তা। আর এই প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই কোথায় যেন নিহিত রয়েছে পুরুষের প্রচ্ছন্ন অহংকার। পৃথিবীতে ‘পুরুষ দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা তো কই অনুভূত হচ্ছে না এমন ব্যপক ভাবে? এর কারণ একটাই হতে পারে। ক্ষমতার অসম বন্টন। বারবার দেখা যায় এই 'প্রয়োজন' অনুভব করে তারাই যারা ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে থেকে এই অসাম্যের জন্য একটা অস্বস্তি বোধ করে এবং মোটামুটি স্থিতাবস্থা বজায় রেখেই এক ধরণের 'রিফর্মেশনের' তাগিদ অনুভব করে। যদি অধিকার থেকেই থাকে তাহলে আজও সেটা অর্জন করার কথা বলতে হবে কেন নারীকে? একটা বিশেষ দিন বরাদ্দ করাটাই তো ফারাককে মনে করিয়ে দেওয়া। একবার ভাবুন, মাধ্যমিকে প্রথম দশের মধ্যে থাকা কোনও ছাত্রীকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বলে পিঠ চাপড়ানোর প্রবণতা আসে কোন অবস্থা থেকে? অবস্থাটা হলো এই যে সারা বিশ্বে সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতির নিরিখে নারীর অগ্রগতির হার এখনও বেশ কম। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বারবার সেটা প্রমাণ করে। একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। চাষের কাজে সাহায্য, গ্রামাঞ্চলে দূর দূরান্ত থেকে গৃহস্থলীর কাজের প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করা, ইঁট ভাটায় সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করার মতো অজস্র কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় ৬৫% বেশী। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের প্রয়াসে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতাসম্পন্ন একজন নারী পারিশ্রমিক এবং দায়িত্বশীল পদাধিকার লাভে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে পুরুষদের তুলনায়। সামগ্রিক সামাজিক সুরক্ষা লাভের অভাবে উচ্চকোটির স্বনিযুক্তি প্রকল্পেও মেয়েদের অংশগ্রহণ দুঃখজনক ভাবে কম। আন্তর্জাতিক স্তরে উচ্চপর্যায়ের অধিকর্তা পর্যায়ে মেয়েদের কাজ পাওয়ার অধিকার এখনও মাত্র ২৫%। সমাজের অন্যান্য স্তরে মেয়েদের বহুল চর্চিত বঞ্চনার বিবরণে আর নাই গেলাম। সচেতনতা বেড়েছে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, সচেতনতা বাড়ার অর্থ কি শুধুই জ্ঞান সংগ্রহ, মোমবাতি মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রদর্শন আর ফেসবুক-ট্যুইটারে পাতা ভরানো? এখনও যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তাবে আর কবে? আমার সন্তানকে কোন্‌ মুল্যবোধ, কোন্‌ বাসযোগ্য পৃথিবীর উত্তরাধিকার দিয়ে যাবো, সে কথা ভাবার সময় কি এখনও আসেনি? আর শুধু ভেবে ভেবে বসে থাকাই বা কেন? আসুন না, হাতে হাত মিলিয়ে সক্রিয় প্রয়াস ও সদ্‌ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সম্মার্জনাকে জীবনচর্চার প্রাসঙ্গিক অন্তরঙ্গ সঙ্গী করে তুলি! আলাদা করে নারী বা পুরুষ নয়, সসম্মানে মানুষ হিসাবে মিলে মিশে ভালো থাকা কি নিতান্তই অসম্ভব?

এই মাস আমাদের এক অপূরণীয় ক্ষতিও করেছে। পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন প্রিয় গায়ক কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। বন্ধ হয়ে গেল লোকসঙ্গীত চর্চা ও গবেষণার এক ধারা। 

তবুও বসন্ত আসে, নতুনের নিশান ওড়ায়, আমরা বসন্ত উৎসব করি।

ঋতবাকের বসন্ত-উদযাপন এবার হলো দিল্লীতে। বেঙ্গল অ্যাসোশিয়ন আয়োজিত দিল্লী বইমেলায় ১৪ই মার্চ থেকে ১৯শে মার্চ পাঠকের রঙ ছড়ানো মনে খুঁজে পেলাম বসন্তকে। সঙ্গে ছিলেন ঋতবাক পরিবারের দিল্লিবাসী আত্মজনেরা।

স্বস্থ থাকুন। সুস্থ থাকুন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


হোলি ও হরমোন:নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে
শিবাংশু দে



ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলন কোমলমলয় সমীরে।
মধুকরনিকর করম্বিতকোকিল কূজিতকুঞ্জকুটীরে ।।
বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে ।।
(বসন্তরাগ যতিতালাভ্যাং গীয়তে) (গীতগোবিন্দমঃ জয়দেব)


জয়দেব গোস্বামী বলেছিলেন, শ্লোকটি গাইতে হবে রাগ বসন্ত, তাল যতি, যাকে সংক্ষেপে যৎও বলা হয়, সেই ভাবে। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, তরুণ বয়সে বনারসে বড়ি মোতিবাইয়ের কাছে শেখা তাঁর এই গান। এক হোলির পূর্বসন্ধ্যায়। সুরের এবং সংরচনার জাদু এমন, এই গানটি শ্রোতাকে, এমনকি গায়ককেও যেকোনও ঋতুতে বসন্তের কাছে নিয়ে যেতে পারে। বসন্ত মানেই তো হোলি। তিনি তো যৎ তালে গাইতেন না। প্রথম চরণদুটি মুক্তবিস্তারে আর তার পর রাধাকান্ত নন্দীর (আহা, রাধাকান্ত, দু'টি রোমাঞ্চকর হাত ও সিম্পলি ডুবিয়ে দেওয়া দশটি আঙুল ছিলো তাঁর) সঙ্গতে তিনতালে। হোলির উন্মাদনা কি তিনতাল ছাড়া ধরা যায়?

'বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে।
নৃত্যতি যুবজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে।।'

ঢিমে থেকে লয় বাড়তে থাকে, রাধাকান্ত চলে যান তাঁর প্রবাদপ্রতিম উল্টো ঠেকায় আর রামকুমার নক্শা কাটতে থাকেন সুরে। চিলের ডানার মতো স্থির নৈঃশব্দ্যে বসন্ত নেমে আসে বুকের ভিতরে। চেতনার আধো আলোর ভুবনে ঝির ঝির স্পষ্ট হতে থাকে আবির গুঁড়োর শীৎকার।

'প্রদ্যোতস্য সুতা বসন্তসময়স্তংচেতি নাম্রা ধৃতি
কামঃ কামমুপৈত্বয়ং মম পুনর্মনৈ মহানুৎসবঃ।।'
(শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে কামউৎসবে রাজার উক্তিঃ সপ্তম শতক)

'প্রদ্যোতের কন্যা (রতি দেবী), বসন্তসময় এবং তুমি বিদ্যমান। অতএব নাম দ্বারাই কাম পর্যাপ্ত সন্তোষ লাভ করুন। এই মহান উৎসবকে (বসন্তকালীন কামমহোৎসবকে) নিজস্ব উৎসব মনে করছি।'

জীমূতবাহন লিখেছিলেন দায়ভাগ গ্রন্থ দ্বাদশ শতকে। তা'তে রয়েছে হোলাক বা হোলক উৎসবের কথা। সারা উত্তর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেও এই উৎসবটির সম্যক প্রচলন ছিলো। সময়ের সঙ্গে এই পার্বণটির ক্রমবিবর্তন বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। আদিযুগে এই উৎসবটি ছিলো কৃষিসমাজের পূজা অনুষ্ঠান। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাসম্পৃক্ত নৃত্যগীত উদযাপন ছিলো এর মুখ্য অঙ্গ। এই অনার্য ঐতিহ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালের বৈদিক উপচার হোমযজ্ঞ মিলে যায়, নরবলির বদলে পশুবলি প্রচলিত হয়। সুশস্যকামনায় পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে যেমন বলি ও যজ্ঞ গৃহীত হয়, একইভাবে হোলির শৃঙ্গাররসমুখর দিকটি কেন্দ্র করে বসন্ত, মদন ও কাম উৎসবের এবং রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার উৎপত্তি হলো। এর সঙ্গে কোনও এক মূর্খ রাজাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন-ইচ্ছাটিও প্রথা হিসেবে সামগ্রিকভাবে হোলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলো।

যেরকম নথিভুক্ত ইতিহাসে দেখা যায়, তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পুরাণযুগে বসন্ত বা মদন বা কামমহোৎসব নামে একটি উৎসব উত্তরভারতের সর্বত্র অতিসমারোহে পালিত হতো। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের কামসূত্রে, সপ্তম শতকে শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে, অষ্টম শতকের মালতী-মাধব নাটকে, একাদশ শতকে অল-বিরুনির লেখায়, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের বিবরণে। এই উৎসবে প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, শৃঙ্গারসূচক সংলাপ ও যৌনতাব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি মুখ্য স্থান নিয়ে থাকতো। পূজা অনুষ্ঠানের অভীষ্ট দেবতা ছিলেন মদন ও রতি দেবী এবং পুষ্পময় চৈত্রের অশোকবৃক্ষের ছায়ায় তার আয়োজন করা হতো। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে মদন মহোৎসবে ভিজ্যুয়ালটি এইভাবের বর্ণনা করা হচ্ছে...

'অহো, পৌরগণের আহ্লাদ অত্যন্ত উৎকর্ষ প্রাপ্ত হইতেছে, যেহেতু দিবস প্রারম্ভতুল্যকারী কুম্কুমমচূর্ণবদ গৌর, বিক্ষিপ্ত পীত চূর্ণরাশি ও স্বর্ণালংকরণ দীপ্তি এবং কিণ্কিরাত পুষ্পশোভিত ভার অবনত পীত পরিচ্ছদশোভিত কৌশাম্বী নগর যেন স্বর্ণদ্রব মণ্ডিত লোকযুক্ত হইয়া শোভা পাইতেছে'।(অর্থ, পীত বস্ত্রশোভিত পুরবাসীরা পীতচূর্ণরাশি (আবির) প্রক্ষেপ করে অশোকবৃক্ষের ছায়ায় স্বর্ণমন্ডিত হয়ে কামউৎসব উদযাপন করছে।)

যেরকম অনুমান করা হয়, ষোড়শ শতকের পরবর্তীকালে চৈত্রীয় কামমহোৎসব, ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় প্রচলিত হোলি উৎসবের সঙ্গে মিলে যায় এবং মদন উৎসব উদযাপনের দিন শেষ হয়ে যায়। আসলে মুসলিম রাজাদের আমলে হোলি উৎসব রাজ অনুগ্রহে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং মদন উৎসবকে গ্রাস করে নেয়। তবে এর ধর্মীয় দিকটি বেঁচে থাকে যখন একাদশ শতক নাগাদ রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব এই চৈত্রীয় পার্বনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অল-বিরুনির বিবরণ ছাড়াও গরুড় ও পদ্মপুরাণে এমত পড়া যায়। তারও পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠান চৈত্র পূর্ণিমা থেকে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এগিয়ে আসে। এই উৎসবের প্রধান পালনীয় কৃত্য ছিলো ঝুলন আরোহী রাধা ও কৃষ্ণের প্রতি সখিসহচরীরা আবীর, কুমকুম ও পুষ্পবৃষ্টি করবে। বাংলায় এই জন্যই উৎসবটিকে 'দোলযাত্রা' বলা হয়, ঝুলনে দোলায়িত পুরুষ-প্রকৃতির যুগ্মসম্মিলনের দৈবী মাহাত্ম্য মুখর এর গরিমা। প্রাক বৈদিক আদিম কৃষিজীবী সমাজের ব্যাকানালিয়ার উদযাপন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে হোলির বর্তমান রূপে বিবর্তিত হয়েছে। এখনও এই উৎসব মূলত 'শূদ্রে'র উৎসব। হোলিকাদহন বা বাংলায় যার নাম চাঁচর, তার আগুন অস্পৃশ্য শূদ্রদের থেকে গ্রহণ করার বিধি রয়েছে।

উত্তর ভারতে প্রচলিত হোলি উৎসবের যে সাধিত অমার্জিত উদযাপন রয়েছে, তার থেকে ঊনবিংশ শতকের বাবুকালচারভিত্তিক নাগরিক বাঙালির 'দোলযাত্রা'র চোরাস্রোত আর অবক্ষয়ের ডাইনামিক্সের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিলোনা। এই পর্যায় থেকে দোলউৎসব উদযাপনে ব্রাহ্ম রুচিবোধ ও য়ুরোপীয় সফিস্টিকেশন নিয়ে আসার কৃত্যটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেকালের বাঙালির থেকে একালের বাঙালির রুচি ও মননবোধে আরো অসংখ্য পরিমার্জন সাধনের পথে কবির এই প্রয়াসটিও অল্পবিস্তর সফল হয়েছিলো। মঙ্গলকাব্য থেকে নিধুবাবু, বাংলায় বসন্তঋতু ও উৎসব নিয়ে অনেক কিছুই লেখাটেখা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এসে সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতটি পাল্টে যায়। আমাদের সমৃদ্ধতম ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দি ও উর্দুর সাহিত্য ও মননসৃজনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় থাকার সুবাদে বলতে পারি বসন্ত বা বর্ষা নিয়ে বাঙালির মননবিশ্বে যে গহন আততি রয়েছে, তার জুড়ি এই ভাষাগুলিতে দেখিনি। এর শ্রেয়ফল রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য।

বাঙালির পক্ষে বসন্ত নিয়ে কোনও কথা বলতে গেলে বা বসন্তের হৃদমাঝারে যাত্রা করার কোনও ইচ্ছে থাকলে পাসপোর্ট নিতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। কারণ, কোত্থাও ছিলোনা, বসন্তের এমন একটা চিত্রচলন তাঁর ধারণা থেকে আমাদের মধ্যে এসেছে। এত প্রগাঢ় তার আবেষ্টন আর অন্তঃসলিল অভিঘাত, যে আমাদের চেতনায় বসন্ত শুধু একটা ঋতু হয়ে নেই, একটা অন্তর্জলী সমর্পণ হয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনী দোলের পৌত্তলিকতার থেকে ভিন্ন, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে পৃথক বা বিহার অওধের শারীরমাংসে তপ্ত রং বর্ষে জুনুন থেকে আলাদা এক নিগূঢ় রণিত সন্ধান।

--------------------

গাঙ্গেয় অববাহিকায় হোলি উদযাপন করার মূল অঙ্গ হচ্ছে 'ধমাল'।(এটার ইতিহাস অতি প্রাচীন।'ধমার' নামের যে সফিস্টিকেটেড সঙ্গীত শৈলী আছে তা বস্তুত হোলির 'ধমাল'এর সময় গাওয়া হতো এবং তার নাম থেকেও এটি প্রকাশ পায়)। এই ধমালের অবক্ষয়িত রূপসামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ পরিবেশে বহু সময়ই নিতান্ত রুচিহীন নোংরামি দিয়ে পালন করা হয়। যেহেতু হোলি বসন্ত উৎসব এবং এই উৎসবের সঙ্গে ফার্টিলিটি কাল্ট ও ব্যাকানালিয়ান মাত্রা ওতপ্রোত জড়িত, তাই বেশ প্রকট আদিরসাত্মক প্ররোচনা সবসময় দেখা যায়।কিছু রাজনীতিক, যেমন ধরা যাক, বিহারের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ, লাটসাহেবকে (পাটনায় রাজ্যপালকে তাই বলে)হোলির দিন আবির লাগাতে যাওয়ার সময় প্রায় নির্বস্ত্র ভাঙ্গমত্ত অবস্থায় গলায় একটি ঢোল ঝুলিয়ে, বিহারের মাপকাঠিতেও নিতান্ত অশালীনফাগুয়া বা চইতা গাইতে গাইতে, বিবিসির নিউজটিমকে ডেকে ছবি তোলাতেন। তাঁর মতে হয়তোএই কাজটি তাঁর 'গরীব কা মসীহা' ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতরকরে। কারণ এদেশে হোলি হাজার বছরেরও অধিক কাল ধরে এভাবেই উদযাপিত হয়।কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্রতমমানুষদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়াএত অসম্ভ্রমের সঙ্গে হোলি পালন করতে দেখা যায়না। অথচ বিহারের ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলে এই সব রাজনীতিকদের অনুকরণে জনতাকে ধমাল করতে দেখা যাবে। সব থেকে মৃদু উদাহরণ, পচা গোবরের চৌবাচ্চায় মানুষকে ফেলে দিয়ে ডোবানোর চেষ্টা। অন্য ক্রিয়া কলাপগুলি না হয় নাই বললাম। এটা হয়তো একটা আরোপিত উদ্যম। সম্পন্ন, ক্ষমতাশালী মানুষদের (ভদ্রলোক?) সম্ভ্রমবোধের অভাব প্রকাশ করছে ঐতিহ্যের নামে। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে নীতীশ কুমারের মতো আদ্যন্ত গ্রামীণ, রুচিশীল, 'ভদ্রলোকের' হোলি উদযাপনও দেখা যাবে। তিনিও রাজনীতিক এবং দীর্ঘকাল ধরে নানারকম মন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছেন। তিনিও ভাঙ্গ সেবন করেন, আবির লাগান এবং 'হোলি' উদযাপনের কোনও অঙ্গকেই অবহেলা করেননা। অথচ সম্ভ্রমবোধের সহজ লক্ষণরেখাটি অতিক্রম করেন না কখনও। মনে রাখতে হবে, বিহারের হোলি সেন্টিমেন্ট কখনও শান্তিনিকেতনী ধরনে 'খোল দ্বার খোল' বা মাথায় পলাশের মালা পরে পেলব নৃত্যে প্রকাশ করা যায়না। শান্তিনিকেতনী দোলযাত্রা আর বিহারী কি উত্তরদেশীয় হোলি হয়তো বহিরঙ্গে পৃথক, কিন্তু যাঁদের 'সম্ভ্রমবোধ' আছে তাঁরা সেটা কদাপি বিসর্জন দেননা। সহজ উদাহরণ,বেশ কিছুদিন ধরে খোদ শান্তিনিকেতনেও বসন্ত-উৎসবও বহিরাগত এক শ্রেণীর অতিথিদের অত্যাচারে প্রায় পুলিস হেফাজতে পালন করা হয়।

মল্লিকা চোপরা দীর্ঘদিন মার্কিন প্রবাসী। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন ঐ দেশে তাঁরা যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে দিওয়ালি পালন করেন, সেভাবে হোলি উদযাপন করতে পারেন না। কারণটা সিম্পল। এদেশে যে আবেগ বা উদ্যম নিয়ে হোলি পালন করা হয়, সে আবহ বা উৎসাহ বিদেশে সৃষ্টি করা যায়না। তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে হোলির সময় এদেশে আসেন। যদি তারা সেন্টিমেন্টটি কিছুটা ধরতে পারে। বস্তুত সাহেবরা এই উৎসবটির অন্তর্লীন সেন্টিমেন্টটি কখনই ধরতে পারেননি। যদিও রোমান লুপারক্যালিয়া, ব্যাকান্যালিয়া বা স্যাটারন্যালিয়ার সঙ্গে হোলির সাদৃশ্য তাঁরা সতত খুঁজে পেতে চান। অথবা লাতিন বিশ্বের প্রাক-লেন্ট মত্ততা ও ইংলিশ মে-ডে'র গ্রামীণ উদযাপনও বাদ যায়না। কিন্তু এদেশে হোলির দিন সকালে দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে যাবতীয় সামাজিক স্তর বিভেদকে অস্বীকার করে পরস্পরকে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রথাটির শিকড়টি ঠিক খুঁজে পাননা। সাহেবরা প্রথম যখন এদেশে আসেন তখন এ দেশীয়দের হোলি উৎসবটি নিয়ে বিশেষভাবে বিরক্ত থাকতেন।জনৈক পাদ্রি ফাদার ওয়েন্ডেল এই উৎসবটিকে Crudest foolishness বলেছিলেন। তৎকালীন বাদশা মুহম্মদ শাহ রঙ্গিলে যেভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে হোলি খেলতেন, তা তাঁর চোখে 'হিন্দু'দের থেকেও অধিক মূর্খতা মনে হয়েছিলো। উইলিয়ম ক্রুক লিখেছেন "Among the Ramoshis of (Balaghat district in Central provinces) on the day after (Holi) pyre is lighted, they throw filth at each other, pour mud out of a pot on any respectable man they chance to meet, and challenge him to a wrestling match; the next day cowdung isflung on all well dressed people." ক্যাপ্টেন ব্রাউটনও সমানভাবে বিতৃষ্ণ। তিনি লেখেন ''In Central India, the Mahrattas cast the ashes of Holi pyre upon one another, and throw them in air, repeating their favourite extemporary stanzas, full of grossest indecency, in which they freely introduce the names of their superiors, coupled with most abominable allusions." ক্রুক সাহেব আরো লিখেছিলেন, "The rites are purely animistic; at any rate, they have no connection with orthodox Hinduism. The otiose legends which profess the rites are figments of a later age invented to bring it in line with Brahminism." তাঁর সহকারী, রামগরিব চৌবে, একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ,ক্রুকসাহেবকে জানিয়েছিলেন হোলির সময় বর্ণব্যবস্থার অচলায়তনকে আক্রমণ করা আমাদের ওর‌্যাল ট্র্যাডিশনের অংশ। হোলির সময় তিনি একটি গান শুনেছিলেন যেখানে একজন দুসাধ জাতির ব্যক্তি(অতি নিম্নবর্ণ) একজন ব্রাহ্মণকে কুস্তিতে পরাজিত করে তার ভগ্নীকে বিবাহ করেছিলো। অন্য বিপদও ছিলো সেসময়। প্রায় আজকের মতন। বিখ্যাত স্লীম্যানসাহেব (ঠগী দমনকারী) হোলির দিন তটস্থ থাকতেন কোনও মুসলিম প্রতীক বা ব্যক্তির প্রতি যেন আবির ছোঁড়া না হয়। সেক্ষেত্রে হাঙ্গামা থামানো পুলিসের পক্ষে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতো। মনে হয় সে ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।

ঐতিহাসিক লিভি জানিয়েছেন, ১৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সেনেটররা ব্যাকাসদেবতার অনুগামীদের ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া প্রভাব রোধ করতে আইনি ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ সফল হওয়া যায়নি। সিজার অগস্টাস এই প্রথাগুলিকে 'বহিরাগত', 'অবাঞ্ছিত' ইত্যাদি ফতোয়া দিলেও ব্যাকান্যালিয়ার নেশা দূর করতে পারেননি। আমাদের দেশেও সেই সময় থেকেই হোলিকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে মানুষের নৈতিক বাঁধাবাঁধির লক্ষণরেখাকে প্রত্যাখ্যান করার ঐতিহ্য বেড়ে উঠতে থাকে। মনস্তত্ত্ববিদরা বিষয়টি নিয়ে নানাকথা বললেও সর্বজনসম্মত ব্যাখ্যা বা চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া যায়নি। বঙ্গসংস্কৃতির স্বভাবজ মৃদুতর মাত্রায় উৎসবটি কখনও দোলযাত্রা, কখনও বসন্ত উৎসব। ব্যক্তি আমার অবচেতনার মানচিত্রে উত্তরভারতের হোলি তার মহিমা নিয়ে নিঃসন্দেহে সতত জেগে থাকে। কিন্তু আমার কবি যেভাবে তার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে দিয়েছেন, মাশাল্লাহ! রক্তে আমার তাহার পায়ের রঙ লেগেছে। সেই রং, কবীর যাকে বলেছেন, অ্যায়সে রঙ্গা দেঁ, কি রঙ্গ নাহি ছুটে....

"..... সেইখানে মোর পরানখানিযখন পারি বহে আনি,
নিলাজ-রাঙা পাগল রঙে রঙিয়ে নিতে থরে থরে ॥
বাহির হলেম ব্যাকুল হাওয়ার উতল পথের চিহ্ন ধরে—
ওগো তুমি রঙের পাগল, ধরব তোমায় কেমন করে ।
কোন্ আড়ালে লুকিয়ে রবে,তোমায় যদি না পাই তবে
রক্তে আমার তোমার পায়ের রঙ লেগেছে কিসের তরে ॥"

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালীর পারিবারিক সম্পর্কের ডাক ও ভাষা রাজনীতি (২য় পর্ব)
সুজন ভট্টাচার্য



বাংলা বা বাঙালীর বাসভূমি বলতে আমরা বুঝি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামের বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্ব বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যার পূর্বপ্রান্ত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তের এই অঞ্চলের মানুষের ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার জাতি নিরূপণের আগে এই অঞ্চলে জনবসতির ইতিহাস এবং বাসিন্দাদের নৃতাত্ত্বিক গঠনবুঝে নেওয়া দরকার। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যারা বাস করেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা মধ্যমাকৃতি, গায়ের রঙ পীত অথবা কৃষ্ণ-পীত, নাক চওড়া অথবা ছোট, হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির একদম উপরের পর্ব চওড়া। এর ভিত্তিতেইনৃতাত্ত্বিকরা অস্ট্রিক অর্থাৎ কোল, সাঁওতাল ইত্যাদি বনচারী জনজাতি এবং টিবেটো-বার্মিজ অর্থাৎ পার্বত্য মঙ্গোলয়েড জাতিকেই বাঙালী জনসত্ত্বার মৌলিক উৎস বলে মনে করেন। এর সাথে মিশ্রআর্য উপাদানও যেমন সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তেমনি মিশেছে তাতার, তুর্ক, ইরানি, আরবির মতো সেমেটিক বা মিশ্র মঙ্গোলয়েড রক্ত। তাহলে প্রাথমিকভাবে এটা বুঝে নেওয়া যায় যে নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালী মূলগতভাবে অনার্য জাতি। 

পরবর্তী প্রশ্ন, এই অঞ্চলে জনবসতির ইতিহাস কী? প্রাক-ঋকবৈদিক যুগে কি এখানে জনবসতি ছিল? নাকি আর্যদের প্রসারের পরবর্তীকালে এখানে জনাগম ঘটে? প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, মৌখিক সাহিত্য হিসাবে ঋকবেদের সূচনা খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। এবং সম্ভবত আর্যদের ভারতে প্রবেশের আগেই ঋকবেদের সূচনা হয়েছিল। ঋকবেদে সরস্বতীর স্তুতিতে বলা হয়েছে “অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী/ অপ্রাশস্তা ইভ স্মসি প্রশস্তিম অম্ব নস কৃধি”। বাঙলায় এর অনুবাদ এমনটা করাই যায় –“সরস্বতী, মাতাশ্রেষ্ঠা, নদীশ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠা দেবী তুমি/অপ্রকাশ আমাদের জন্য, হে মাতা, তুমিই প্রকাশের জন্মদাত্রী”। এই স্তোত্রে সরস্বতী একাধারে নদী, মাতা ও দেবী। এর থেকেই অনুমান করা যায় প্রাথমিক বৈদিক সভ্যতা সরস্বতী নামক কোনও এক নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। সভ্যতার প্রাণস্বরূপা সেই নদীকে মা কিংবা দেবী হিসাবে কল্পনা করে নেবার মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব কিছুই নেই। 

কেউ কেউ মনে করেন হিমাচল প্রদেশের শিবালিক পর্বতে সৃষ্ট এবং হরিয়ানা-পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঘগগর-হরকা নদীতন্ত্রই আসলে সেই সরস্বতী নদী। সাম্প্রতিককালে ঘগগর-হরকা অববাহিকায় রাখিগড়িতে খননকার্যের ফলে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাপ্তিকে তাঁরা এই মতের প্রমাণ বলেই বিবেচনাকরেন। এই বিচারে খানিকটা বিভ্রান্তি আছে। কেননা, রেডিও-কার্বন পরীক্ষায় রাখিগড়িতে প্রাপ্ত মানবকঙ্কালগুলি খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি বলেই মনে করা হয়। আবার রাখিগড়ির সভ্যতার সাথে সিন্ধু সভ্যতার মিলটাই অনেক বেশি। তাই ঘগগর-হরকা অববাহিকার সাথে বৈদিক সভ্যতার কোনও সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না। ঐতিহাসিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কিন্তু ঘগগর-হরকার তীরে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল মেনে নিতে রাজি নন। পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ ঝিন্দ-আবেস্তায় একটি মহতী নদীর কথা বলা হয়েছে, যার নাম হরক্সাবতী। পারস্যে শব্দের আদি স হ-আকার নেয়। সেই হিসাবে হরক্সাবতীই সরক্সাবতী বা সরস্বতী বলে তাঁরা মনে করেন। আফগানিস্তানের হেলমন্দ নদীকেই হরক্সাবতী বলে গণ্য করা হয়। সেই বিচারে হেলমন্দই হল সরস্বতী নদী। পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় ধর্মে ও ঋক বেদে বহু শব্দেরসাদৃশ্য থাকায় এই মতটাই অনেক যৌক্তিক বলে মনে হয়। 

সরস্বতীর অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, ভারতের বৈদিক সভ্যতার প্রসার যে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকেই শুরু হয়েছিল, এটা অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে একদম বিপরীত প্রান্তের এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যে তার বিস্তার হবে অনেক পরে, সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে এই অংশের পরিস্থিতি কী ছিল? এখানে কি আর্যদের বিস্তারের মাধ্যমেই জনবসতির সূচনা হয়? নাকি তার আগে থেকেই মানুষের বসবাস ছিল? যদি থাকে, তাদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী? এই আলোচনায় ঢোকার আগে মানুষ নামক বিশেষ প্রজাতির সৃষ্টির ইতিহাসকে একবার ছুঁয়ে গেলে ভালো হয়। কেননা, প্রায়শই রাজনৈতিক প্রচারের স্বার্থে নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের দ্বারা সাধারণভাবে স্বীকৃত তত্ত্ব ও তথ্যকে বিকৃত করে দেওয়া হয়। এবং সাধারণ মানুষের কাছে সেইসব তত্ত্ব ও তথ্যের হদিশ না থাকায়, তাঁরাও প্রভাবিত হয়ে যান।

মানুষ বলতে আমরা নিজেদের যেভাবে বুঝি, সেই প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম হলো হোমো স্যাপিয়েন্স। পৃথিবীর বর্তমান সমস্তস্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে হোমো স্যাপিয়েন্সই হলো নবীনতম। কিন্তু এই প্রজাতিও ঈশ্বরের বরপুত্রের মতো রাতারাতি আকাশ থেকে আসে নি। হোমো স্যাপিয়েন্সের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল চার পায়ের বদলে দুই পায়ে চলার ক্ষমতা, সোজা হয়ে দাঁড়ানো, দুই হাতের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার এবং মস্তিষ্কের আকার ও সক্রিয়তা। স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক ধরণের প্রাণীগোষ্ঠীর জন্ম হয়, যারা পূর্বতন প্রাণীদের থেকে বেশি বুদ্ধি রাখে এবং সামনের দুই পা চলাফেরা ছাড়াও অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে। এই ধরণের প্রাণীগোষ্ঠীকে বলা হয় প্রাইমেট। এদের মধ্যে আছে বাঁদর, লেমুর, শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাং ওটাং ইত্যাদি। আবার বাঁদর বা লেমুরের চেহারা ছোট, বড় লেজ আছে এবং প্রয়োজনমতো চার পা ও দুই পায়ের সাহায্যে চলাফেরা করতে পারে। শিম্পাঞ্জি, গোরিলা বা ওরাং ওটাঙয়ের চেহারা অনেক বড়ো, লেজ নেই অথবা খুব ছোট এবং মূলত দ্বিপদ চলনে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় দলের যে গণ বা জেনাস, তাকে বলা হয় এপ বা নরসম। বোঝাই যাচ্ছে, আধুনিক মানুষও আসলে এপ জেনাস এবং সেইসূত্রে প্রাইমেট অর্ডার বা ক্রমের অন্তর্ভূক্ত। 

বাইপেডালিজম, অর্থাৎ দুই পায়ের সাহায্যে হাঁটতে পারে এবং মাথার খুলির ভিতরে মস্তিষ্ক দ্বারা পূর্ণ,এমন প্রাইমেটদের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক ৫০ লক্ষ বছরেরও আগে। এদের বলা হয় হোমিনয়েড। বিবর্তন-বিজ্ঞানীদের অনুমান, ৮০ থেকে ৬০লক্ষ বছর আগের আফ্রিকার জঙ্গলে বসবাসকারী কোনও এক অভিন্ন পূর্ব-প্রজাতি থেকেই মানুষ এবং গোরিলা ও শিম্পাঞ্জির পৃথকপৃথক বিবর্তন শুরু হয়। ৪০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই হোমিনয়েডদের একাংশের মধ্যে আরও বিবর্তনের ফলে দেখা দিল অস্ট্রালোপিথেকাস, যাকে এপ ও মানুষের মধ্যে এক অন্তর্বর্তী পর্যায় বলা যায়। অস্ট্রালোপিথেকাসের চেহারাও ছিল বড়সড় মাপের; কিন্তু দ্বিপদ চলনের স্বাচ্ছন্দ ছিল অনেক বেশি। এই অস্ট্রালোপিথ থেকে হোমো জেনাস বা গণের উৎপত্তি হয়, যাদের মস্তিষ্কের মাপ অস্ট্রালোপিথের থেকে অনেকটাই বেশি। হোমো গণের প্রথম প্রজাতি ছিল হোমো হ্যাবিলিস। 

২৯ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতেই হোমো হ্যাবিলিসের জন্ম হয়। এদের পা ও হাতের গড়ন অনেকটাই মানুষের কাছাকাছি। ফসিলের কাছাকাছি পাথরের যন্ত্রের উপস্থিতি প্রমাণ করে, হোমো হ্যাবিলিস পাথরের যন্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। আরো কতগুলি অন্তর্বর্তী প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে ২০ লক্ষ বছর আগে দেখা দিল হোমো ইরেকটাস, যাকে আজকের মানুষের সবথেকে কাছের পূর্বজ বলে গণ্য করা হয়। এর আগে পর্যন্ত যাবতীয় প্রাক-মানব প্রজাতির ফসিল আফ্রিকাতেই পাওয়া গেছে। এই কারণেই আফ্রিকাই যে মানব বিবর্তনের রঙ্গমঞ্চ, এ বিষয়ে সবাইই একমত। কিন্তু হোমো ইরেকটাসের ফসিল আফ্রিকার বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া যায়, যেগুলো ১৯ থেকে ১৬ লক্ষ বছরের পুরোনো বলে জানা গেছে। এর অর্থ, হোমো ইরেকটাস আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। 

আমরা আগেই বলেছি হোমো হ্যাবিলিস পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। স্বভাবতই পরবর্তী প্রজাতিগুলিও তার থেকে আলাদা ছিল না। বরং হোমো ইরেকটাস প্রজাতির পাথরের অস্ত্রগুলো ছিল তুলনায় উন্নত ও আরো কার্যকরী। হোমো ইরেকটাসই প্রথম আগুন ব্যবহার শুরু করেছিল। হাতিয়ার ব্যবহারই সম্ভবত হোমো ইরেকটাসের বিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে। ১২ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ বছরের মধ্যে হোমো হেইডেলবার্গেনসিস নামে নতুন প্রজাতির জন্ম হয়।¹ সম্ভবত ৫ লক্ষ বছর আগে জন্ম নেয় হোমো নিয়েন্ডার্থাল প্রজাতি। নিয়েন্ডার্থালই সম্ভবত প্রথম সাংস্কৃতিক মনোবৃত্তির পরিচয় রাখে। ইরাকের শানিদার গুহায় ৩৫ থেকে ৬৫ হাজার বছরের পুরনো ১০টি নিয়েন্ডার্থাল ফসিল পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে অন্তত দুটিকে যে কবর দেওয়া হয়েছিল, বোঝা যায়। আফ্রিকাতেই ১ লক্ষ ৯৫ হাজার বছর আগে জন্ম নেয় নবীনতম প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স। ৯০ হাজার বছর আগে এই নতুন প্রজাতি এশিয়ার দিকে যাত্রা করে। ৬০ হাজার বছর আগে সেখান থেকেই তারা ইউরোপে পৌছোয়। হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাবের পর নিয়েন্ডার্থাল প্রজাতি আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হয়ে যায়। 

আমরা দেখলাম যে হোমো হ্যাবিলিসই প্রথম পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। অর্থাৎ প্রস্তর যুগ বলতে আমরা যাকে বুঝি তার শুরু মোটামুটি ৩০ লক্ষ বছর আগে। প্রস্তর যুগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – আদি, মধ্য ও নব্য প্রস্তর যুগ। আদি প্রস্তর যুগ মোটামুটি ৩০ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যে সময়ে পরপর হোমো হ্যাবিলিস, হোমো ইরেকটাস, হোমো হাইডেলবার্গেনসিস ও হোমো নিয়েন্ডার্থালদের রাজত্ব ছিল। ২ লক্ষ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত ছিল মধ্য প্রস্তর যুগ। অর্থাৎ মধ্য প্রস্তর যুগেই হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব। নব্য প্রস্তর যুগ ৩০ হাজার থেকে ১১৭০০ বছর আগে পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপরেই তুষার যুগের পরে পরেই এল তাম্র যুগ, অর্থাৎ মানুষ তামা নিষ্কাশন ও তার সাহায্যে যন্ত্র বানাতে শিখল। 

প্রাক-বিভাজন ভারতবর্ষে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে বালুচিস্থানের মেহেরগড়ে। মেহেরগড়ে প্রাপ্ত মানবকঙ্কাল ২২ হাজার বছর আগের বলেই জানা গেছে অর্থাৎ নব্য প্রস্তর যুগের। হরপ্পা-মোহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা পরবর্তীকালীন তাম্র যুগের সভ্যতা। অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালির ছাগলনাইয়া, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড কিংবা সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে পাথরের কুঠার ও অন্যান্য হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এর থেকেই বুঝে নেওয়া যায় যে নব্য প্রস্তর যুগে এখানেও মানুষের বসবাস ছিল। তাহলে তারা কি আর্য হতে পারে? সহজ উত্তর হলো, না; তারা আর্য নয়। আমরা দেখেছি, নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালী জনসত্ত্বার মৌলিক উপাদান হলো অস্ট্রিক ও মোঙ্গলয়েড। সেই হিসাবে এখানকার নব্য প্রস্তর যুগের বাসিন্দারাও চরিত্রগত বিচারে তেমনটাই হওয়া উচিৎ। একইভাবে উত্তর চব্বিশ পরগনার দেগঙ্গার কাছে আবিষ্কৃত চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতাও ৪০০০ থেকে ২৫০০ বছরের পুরোনো তাম্র যুগের সভ্যতা বলেই প্রমাণিত। 

এবারে দেখা যাক, বাঙলার সম্বন্ধে আর্য সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গী কী ছিল। মহাভারতের বনপর্বেদেখা যায়, ভীম ছদ্মবেশে অঙ্গদেশে উপস্থিত হন।² অঙ্গ মানে কোশী ও গঙ্গার মধ্যবর্তী মিথিলাঞ্চল। ভীম আরো পূর্বদিকে এগোতে চাইলে সেখানকার ব্রাহ্মণেরা তাঁকে বারণ করেন। তাঁরা বলেন, গঙ্গার পূর্ব তীরের সেই অরণ্যে যারা থাকে, তারা পাখির মতো কিচিরমিচির করে দুর্বোধ্য এক ভাষায় কথা বলে; আবার পাখির মতই তারা নিয়মকানুন না মেনেই এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। না, ভীম আর পূর্বদিকে এগোননি। মহাভারতের যুদ্ধে বঙ্গের কোনও প্রতিনিধির দেখা পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ, উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্ররাজ বাসুদেব মগধের সম্রাট জরাসন্ধেরবন্ধু ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে শ্রেষ্ঠ মানব হিসাবে কাকে বরণ করা হবে, এই প্রশ্ন উঠলে ভীষ্ম বাসুদেব অর্থাৎ কৃষ্ণের নাম প্রস্তাব করেন। তৎক্ষণাৎ দুর্যোধন পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেন, হ্যাঁ, ইনিই উপযুক্ত। কেউ হয়তো এই ঘটনাকে পুন্ড্রের প্রতি উত্তর ভারতের সম্মান প্রদর্শন বলেই মনে করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এটা ছিল কৃষ্ণের প্রতি দুর্যোধনের অবজ্ঞারই প্রকাশ। এর মাধ্যমে দুর্যোধন এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, কৃষ্ণ পৌণ্ড্রক বাসুদেবের থেকেও নিকৃষ্ট।³আবার বৌধায়নের ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে বঙ্গভ্রমণ করে ফিরে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। 

হরিবংশে বলা হয়েছে, দানবরাজ বলির পালিত পুত্র বঙ্গ এইখানে রাজত্ব স্থাপন করেন। তাঁর নাম থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় বঙ্গ। বৈদিক বা উত্তর বৈদিক কৃষ্টিতে অসুর আর দানবরা অপশক্তি বলেই চিত্রিত; সুর অর্থাৎ আর্যদের সাথে তাদের নিত্য লড়াই। কাজেই স্বচ্ছন্দে ধরে নেওয়া যায়, এরা হলো অনার্যদের প্রতিনিধি।আবার দানবরাজ বলিকে বিষ্ণু নাকি তাঁর বামন অবতারে পরাস্ত করেন। সেই বলির পালিত পুত্র বঙ্গ নিশ্চয়ই আর্য কৃষ্টিতে খুব প্রশংসনীয় চরিত্র হতে পারেন না।⁴ যাই হোক না কেন, এই আখ্যান থেকে এটাই বোঝা যায় যে বঙ্গ অঞ্চলে অনার্যদেরই প্রাথমিক বসবাস ছিল। প্রসঙ্গত বঙ্গ শব্দটি বোঙ্গা থেকেই এসেছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন। বোঙ্গা হলো অস্ট্রিক সভ্যতার সূর্যদেবতা। হরিবংশের ব্যাখ্যা আর এই অভিমতের মধ্যে একটাই সাধারণ সূত্র আছে। সেটি হলো এই যে, এই অঞ্চল আসলে ছিল অস্ট্রিক-অধ্যুষিত অঞ্চল। 

তাহলে এই অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা নিশ্চয়ই ছিল, যাকে মহাভারতে পাখির মতো কিচিরমিচির বলে বলা হয়েছে। সেই জনগোষ্ঠী নিশ্চয়ই রাতারাতি উবে যায় নি। বরং এটা বলাই ঐতিহাসিকভাবে সঠিক হবে যে তারাই অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্রিত হয়ে বর্তমান বাঙালী জনগোষ্ঠীর চেহারা নিয়েছে। উত্তর ভারতে যখন মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, তখন কিন্তু পূর্ব ভারতের এই প্রান্তে কোনও উল্লেখ নেই। যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পুণ্ড্র, প্রাগজ্যোতিষপুর কিংবা মণিপুরের রাজাদের ভূমিকা দেখে এটা অনুমান করা যায় যে উত্তর ভারতের সাথেতাঁদের যোগাযোগ ছিল। এবং গঙ্গার পূর্ব তীরে পা না রেখেই এই অঞ্চলগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা অবশ্যই সম্ভব ছিল। সেই হিসাবে মহাভারতের আখ্যানের একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। মোদ্দা কথা, উত্তর বৈদিক সভ্যতার কাছে বঙ্গভূমি ছিল অবহেলিত। এই জনপদকে প্রভাবিত বা পরাজিত করা যায়নি বলেই হয়তোআর্যরা তাকে অচ্ছুৎ করে রেখেছিলেন।

বঙ্গ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া গেল আলেকসান্দারের সময়ে। তখন মগধে নন্দ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রীক ঐতিহাসিক দিওদোরাস সিকুলাসের বিবরণ অনুযায়ী পুরুকে পরাজিত করার পর আলেকসান্দার জানতে পারেন পূর্ব অভিমুখে রয়েছে প্রাসী (প্রাচী?) রাজ্য এবং গঙ্গানদীর অপরপ্রান্তে রয়েছে এক প্রবল পরাক্রান্ত রাজ্য গঙ্গারিদেই অর্থাৎ গঙ্গাহৃদি। সেই গঙ্গাহৃদির রাজা সেন্দ্রামের বিশাল সেনাবাহিনীর ভয়েই নাকি আলেকসান্দার ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রীক ভাষায় যাকে সেন্দ্রাম বলা হয়েছে, তাকে স্বচ্ছন্দে চন্দ্রম বা চন্দ্রকেতু বলে ধরে নেওয়াই যায়। চন্দ্রকেতুগড়ের কথা আমরা আগেই বলেছি, যাকে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের জনপদ বলে গণ্য করা হয়। আলেকসান্দার ভারত আক্রমণ করেন খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে। সেই হিসাবে দিওদোরাস সিকুলাসের বিবরণের সাথে চন্দ্রকেতুগড় ও আলেক্সান্দারের সময়টা কিন্তু মিলেই যায়। 

সম্রাট অশোকের⁵ সময়ে আসা গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস তাঁর বিবরণীতে গঙ্গাহৃদি রাজ্যের বিশালতা ও সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। তিনি একথাও বলেন, কোনও বৈদেশিক শক্তি কোনদিন গঙ্গাহৃদি জয় করা তো দূরস্থান, আক্রমণ করার সাহসও দেখায়নি। আবার প্লিনির বিবরণ অনুযায়ী প্রাসীর রাজধানী ছিলপালিবোথরা (পাটলিপুত্র)। এখান থেকেই পাটলিপুত্র, অর্থাৎ মগধের নন্দ বংশ এবং গঙ্গাহৃদির মধ্যে গ্রীকবিরোধী একটা জোট যে তৈরি হয়েছিল, বোঝা যায়। আবার এটাও ঘটনা, মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী অন্তত অশোকের সময় পর্যন্ত গঙ্গার পূর্বতীরে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেনি; এই অঞ্চল ছিল “পাণ্ডববর্জিত”। প্লিনি এমনও বলেছেন, গঙ্গাহৃদির অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ সূর্যের তাপে পোড়া, যদিও তারা ইথিওপিয়ার লোকেদের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়। 

বঙ্গে যদি আর্য অনুপ্রবেশ নাই ঘটে থাকে, তাহলে এখানকার তৎকালীন ভাষার উপর আর্যদের ভাষার প্রভাব পড়ার কোনও কারণই থাকতে পারে না। অবশ্য যদি দুই সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকে, তাহলে প্রভাব পড়তে পারে। টলেমি গঙ্গাহৃদি রাজ্যের সমুদ্রবন্দর সোওনাগৌড়ার কথা বলেছেন। আবার বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী অঞ্চলের উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পরিত্যক্ত খাতের মধ্যে খননকার্য চালিয়ে ২৫০০ বছর আগের নগর-দূর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। এমনকি চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে জাহাজ-অঙ্কিত মুদ্রা বা সিলমোহর প্রচুর পাওয়া গেছে। এর থেকেই অনুমান করা যায়, গঙ্গাহৃদি রাজ্য সমুদ্রবাণিজ্যেও অভ্যস্ত ছিল। গ্রীক উপকথায় বলা হয়েছে টিউটন তৃতীয় পার্সের বাহিনীতে দাতিস নামক গঙ্গাহৃদির এক সামরিক নায়ক ছিলেন।ভার্জিল তাঁর জর্জিক্স কাব্যেও গঙ্গাহৃদির সোনা ও হাতির দাঁতের উল্লেখ করেছেন। এমনকি রোমানবাহিনীর সাথে গঙ্গাহৃদির যে যুদ্ধ হয়েছিল, তারও উল্লেখ করা হয়েছে।

গঙ্গাহৃদির সমুদ্রযাত্রার প্রমাণ আরেকটি তথ্য থেকেও পাওয়া যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ শ্রমণদের দ্বারা লিখিত মহাবংশ বিবরণী অনুযায়ী বুদ্ধের মহানির্বাণের প্রায় সমসময়ে (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দ) বঙ্গের নির্বাসিত রাজকুমার বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কা দখল করে তার নাম রাখেন সিংহল। বিজয় সিংহকেই সিংহলের প্রথম রাজা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে সিংহলে যেতে হলে সমুদ্রযাত্রা অবশ্যম্ভাবী। যদি নিয়মিত অভিজ্ঞতা না থাকে এবং সঙ্গে যদি একটি পরাক্রমী সেনাদল না থাকে, তাহলে বিজয় সিংহের পক্ষে শ্রীলঙ্কা দখল সহজ হতো না। অবশ্য এমনটা হওয়াও সম্ভব যে বিজয় সিংহ একটি জনমানবহীন দ্বীপেই আপন অস্ট্রিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সেক্ষেত্রে রামায়ণের কাহিনীর সাথে একটা সাযুজ্যও পাওয়া যায়। রামায়ণ যে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছে, অধিকাংশ ঐতিহাসিক সেটাই মনে করেন। কাজেই সিংহলের অস্ট্রিক সভ্যতার উপর আর্য আগ্রাসণ হিসাবে এই কাহিনীকে ব্যাখ্যা করাই যায়।

যাই হোক, সম্ভবত গঙ্গাহৃদির এই সামরিক দাপটের কারণেই আর্যরা সহজে বঙ্গে ঢুকতে পারেনি। সমুদ্রগুপ্তের আমলেই প্রথম বঙ্গভূমি আর্যাবর্ত্যের অধিকারে আসে। সেও হলো চতুর্থ শতাব্দীর ঘটনা। আবার দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় বঙ্গের রাজাদের মিলিত বাহিনীর সাথে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রবল যুদ্ধ হয়। সেটি পঞ্চম শতাব্দীর একদম শুরুর দিকের ঘটনা। এই সময়ের আগে পর্যন্ত যে বঙ্গের উপর আর্য প্রভাব ছিল না, ইতিহাস সেটাই প্রমাণ করে। আবার এটাও ঘটনা, এই সময় পর্যন্ত বঙ্গের ভাষা সম্পর্কে কোনও ধারনা পাওয়া যায় না। তবে যেহেতু এই অঞ্চলে অস্ট্রিক আধিপত্য ছিল, ফলে অস্ট্রিক ভাষার তদানীন্তন রূপই যে বঙ্গের ভাষা ছিল, এটা ধরে নেওয়া ভুল হবে না। কিন্তু বিশ্বের কোন অঞ্চলেই ভাষা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত থাকে না। কাজেই বঙ্গের ভাষাও যে অপরিবর্তিত থাকে নি, সেটাও অনুমান করে নেওয়া যায়।

প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মহাবীর ও বুদ্ধ বিহারের মগধ অঞ্চলে পালি ভাষাতে তাঁদের বাণী প্রচার করেছিলেন। সম্রাট অশোকের সময়ে এই পালি ভাষাও পরিবর্তিত হয়ে মগধী প্রাকৃতের চেহারা নিয়ে ফেলে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এই সময়ে মগধ ছিল আর্যাবর্ত্যের প্রাণকেন্দ্র। ফলে সেখানে জনগণের ভাষা ও রাজশক্তির ভাষার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙলার ক্ষেত্রে এই সম্পর্কের জন্য আমাদের চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। ইতিমধ্যে মগধী প্রাকৃত কিন্তু অনেকদূর অগ্রসর হয়ে গেছে। এতদিন পরে সংস্কৃতের সংস্পর্শে এসে বাংলার ভাষা - যা আবার আদতে একটি অস্ট্রিক ভাষা - মগধী প্রাকৃতের রূপ ধারণ করবে, এটা ধরে নেওয়াটা খুব অযৌক্তিক। বরং স্থানীয় অস্ট্রিক ভাষা, মগধী প্রাকৃত ও সংস্কৃতের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একটা নতুন ধরণের প্রাকৃত ভাষা গড়ে ওঠাটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। 

ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাহ এক্ষেত্রে যে গৌড়ীয় প্রাকৃতের প্রস্তাবনা করেন, সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, ইতিহাস ও যুক্তির বিন্যাস মগধী প্রাকৃতের বদলে গৌড়ীয় প্রাকৃতের বাস্তবতাকেই বৈজ্ঞানিক বলে দেখায়। আবার স্থানীয় ইতিহাসের ভিত্তিতে মগধী প্রাকৃতের তুলনায় গৌড়ীয় প্রাকৃত নবীনতর হওয়াটাই উচিৎ। ফলে তার গঠন অনেকটাই এগিয়ে থাকাও যুক্তিযুক্ত। সব মিলিয়ে আপাতত এটুকুই বলা যায়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্কৃতের ভূমিকা অনেকটাই সীমায়িত। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসাবে এরপরে আমরা তদানীন্তন বাঙলার ধর্মীয় চেহারাটা একবার আলোচনা করবো।

1. হোমো হাইডেলবার্গেনসিসের উদ্ভব আনুমানিক ২০ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ বছর আগের মধ্যে।

2. ভীম মহাভারতের সভাপর্বে পূর্ব দিকে গিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের কর আদায় করতে এবং সেখানে ছদ্মবেশের কোনও প্রসঙ্গ নেই।

3. ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞকালীন পৌণ্ড্রক বাসুদেবের উপস্থিতির কোনও উল্লেখ মহাভারতে নেই। কৃষ্ণকে গালাগাল দেবার সময় শিশুপাল একবার পৌণ্ড্রক বাসুদেবের কথা বলেছিলেন, দুর্যোধন নন।

4. দানবরাজ বলি আর অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্মের পালক পিতা এক লোক নন। এই বলি গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলে কোথাও রাজত্ব করতেন। তাঁর স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার ঔরসে এই পাঁচজনের জন্ম হয়।

5. মেগাস্থেনিস ভারতে এসেছিলেন এবং পাটলিপুত্রে ব্যাকট্রিয়ান সম্রাট সেলুকাস নিকেটরের দূত হিসেবে অবস্থান করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে।

0 comments:

1

প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


পদ্য গদ্য মদ্য
দীপারুণ ভট্টাচার্য


বোতল পুরাণ রচেন যিনি, তিনি নাকি দা-ঠাকুর,
ঠাকুর দাদা এরস পেলে উঁচু গ্রামে চড়ান সুর।
মাতাল পেঁচো এই রসেতে ডুব দিয়ে রয় রাত্রিদিন,
প্রানের মতো বন্ধু পেলে গল্প জমে অন্তহীন।

মদ্য ও তার পান সম্পর্কে কোন প্রগাঢ় জ্ঞান আছে বলেই লিখছি, এমন ভাবলে ভুল হবে। আমি আবগারি দপ্তরের কর্মী নই যে অমূল্য সুরা পেতে পারি বিনামূল্যে অথবা আমি নেশামুক্তি অভিযানের আহ্বায়কও নই। তাই আপনি পছন্দ করলে যেমন আমি ঠেকাবো না,অপছন্দ করলে উৎসাহও দেবো না। আমি শুধু কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করতে চাই। কথায় বলে ভাগ করলে আনন্দ বাড়ে। রসিক বন্ধুদের কাছে একথার ব্যাখা নিষ্প্রয়োজন।

কলেজে পড়ার সময় এক রসিক বন্ধু এ বিষয়ে কটা লাইন লিখেছিলো। আসরে টেবিল চাপড়ে সুরটা অবশ্য আমিই করেছিলাম। তারপর থেকে প্রায় প্রতি আসরেই উল্লাস পর্ব শুরুর আগে এই গানটি গাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এখানে শুধু গানের কথাই রইলো। আশা করি রসিক বন্ধুরা নিজ সুরে আসর মাতাবেন। ছাত্রজীবনের এ লেখার সাহিত্যগুণ বিচার কিন্তু অনর্থক।

হুইস্কিতে আছে শশুর, শাশুড়ী রামের-মতি
বৌ আমার লজ্জাবতি, ওয়াইনে কি বা ক্ষতি!
বন্ধুরা বাংলা মালে, সাজিয়েছে বাসি ছোলা,
বান্ধবী জিনের ভিতর, দুয়েক ফোঁটা কোকাকোলা।

মদ্যপানের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। বেদ যে পানীয়ের সন্ধান দিয়েছে তা হলো সোমরস। বস্তুটি ঠিক কি ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। ইন্দ্রের প্রিয় এই পানীয় নাকি ছিলো সুস্বাদু। কেউ বলেন সোম লতা থেকে তৈরি হয় তাই সোম রস। সোম লতাকে অনেকে আখ মনে করেন। কেউবা বলেন সোমরস তৈরি হতো এফেড্রা (ephedra) জাতীয় গাছের রস থেকে। 

যাই হোক বস্তুটি যে শক্তি ও মাদকতা দিতো সে বিষয়ে সবাই একমত। হয়তো সে জন্য সোমরসকে আধুনিক কালের ওয়াইন-এর সাথেও তুলনা করা যায়। দ্রাক্ষারস শব্দটিও আমরা শুনেছি। ওয়াইন আসলে তাই। আঙ্গুর কে ফার্মেন্টেশন করে এই পানীয় তৈরি হয়। সাধারণত এতে চিনি, জল বা অন্য কোন বস্তুকে বাইরে থেকে মেশানো হয়না। তবে কিছু কিছু ওয়াইনে চিনি মিশিয়ে Sweet Wine বানানো হয়। ওয়াইন মূলত দুই প্রকার, সাদা ও লাল। লাল রঙ হয় আঙ্গুরের খোসাfermented হয়ে। তাই খোসা সহ fermentation করলে ওয়াইন লাল হয় আর খোসা ছাড়া করলে হয় সাদা।

এই পানীয়তে অ্যালকোহলের পরিমান ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়, এবং তা আঙ্গুরের উৎস ও তৈরির পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। একটা ধারণা আছে, ওয়াইন পুরোন হলে মূল্যবান হয়। এখনও পর্যন্ত জর্জিয়াতে পাওয়া গেছে সবচেয়ে পুরোনো ওয়াইন। যা প্রায় আট হাজার বছর আগেকার বলে অনুমান। তেমনই ইরাকে পাওয়া গেছে সাত হাজার ও আমেরিকাতে ছয় হাজার বছর আগেকার ওয়াইন। 

শেরী (Sherry), এই পানীয়ের নাম আমি প্রথম শুনি 'ওগো বধূ সুন্দরী' ছবির একটি গানে। এটিও কিন্তু এক প্রকারের ওয়াইন। স্পেনের এই বিশেষ ওয়াইন তৈরির সময় আঙ্গুরের সাথে কিছুটা জলপাই ও মেশানো হয়। এতে অ্যালকোহলের পরিমান হয় ১৫.৫ শতাংশের থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। ইতিহাস ১১০০ বি.সি.তে এই পানীয়ের উল্লেখ করে। মনে হয় তখনই এই পানীয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।

শ্যাম্পেনের নাম শোনেননি এমন সুরা-রসিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। যে ওয়াইনকে পানের চেয়ে ধবল ফেনিল অবস্থায় উড়িয়ে দেওয়ার প্রতি মানুষের বেশি আগ্রহ, সেটাই শ্যাম্পেন। ফরাসী এই পানীয়কে তাই sparkling wine বলা হয়। ফ্রান্সের এক বিশেষ অঞ্চলের আঙ্গুর দিয়েই শুধুমাত্র এই পানীয় তৈরি করা সম্ভব। কাঁচামালের মতোই এই পানীয়ের বোতল, ছিপি এবং তৈরির পদ্ধতি, সব কিছুই বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া কেউ এই পানীয় তৈরির সুযোগ পায়না।

আমাদের এক সহকর্মী প্রায়ই অফিস ছুটির সময় বলতেন, তাড়া আছে; আজ আবার বিহার ঘুরে বাড়ি ফিরবো। অফিসের সবাই জানতেন তার বিয়ার (Beer) তৃষ্ণার কথা। তৃষ্ণাই বটে। শুনলে অবাক হতে হয়, জল ও চায়ের পরেই, বিয়ার পৃথিবীর তৃতীয় পছন্দের পানীয়। বার্লি, গম, ভুট্টা ও চাল থেকে তৈরি এই পানীয়তে সাধারণত ৪%-৬% অ্যালকোহল থাকে। তবে সেটা ১৪% পর্যন্তও যেতে পারে। বহু পুরনো এই পানীয়ের ইতিহাস। প্রায় ৯৫০০ বি.সি.তে এই পানীয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার বছর আগেও বিয়ার পাওয়া যেতো ইরাক ও ইজিপ্ট অঞ্চলে। যে সব শ্রমিকরা সে যুগে পিরামিড তৈরির কাজ করতো, তাদের প্রতিদিন ৪-৫ লিটার বিয়ার দেওয়া হতো। পানীয়টি তাদের পুষ্টি ও মনোরঞ্জনের প্রয়োজন মেটাতো। এবাদে চীন দেশে প্রায় সাত হাজার বছর আগে, বর্তমান সিরিয়াতে চার হাজার এবং ইউরোপে প্রায় ৩০০০ বি.সি.তে বিয়ার এর অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়।

মদ্যপানের ব্যাপারে ছুঁৎমার্গ কিন্তু বিলক্ষণ বজায় আছে কিছু মানুষের মধ্যে। দিল্লীতে থাকার সুবাদে দেখেছি উত্তর ভারতে এই বিষয়ে নাক উঁচু ভাব কম। কিন্তু বাংলায় এখনও কিছু মধ্যবিত্ত পরিবার মদের নাম শুনলেই রে রে করে তেড়ে আসে। এসব আলোচনায় এক প্রবীণ মানুষ একবার বলেছিলেন, 'যাদের কালচার মানে এগ্রিকালচার (হরিয়ানা ও উল্টোপ্রদেশ প্রসঙ্গ) ; আমাদের কি তাদের থেকে শিখতে হবে, কাকে কোন চোখে দেখবো!' কথাটা হয়তো ঠিক। তবে বাংলায়, যাঁদের আমরা সংস্কৃতির মাথা মনে করি, তারা কিন্তু প্রায় সকলেই এই রসের রসিক।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এ বিষয়ে উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন বলে কয়েকটি লেখায় উল্লেখ আছে।

তবে রসাস্বাদন সীমা ছাড়ালে তা বিরক্তির কারন হয়। যেমন, আমার বর্তমান অফিসের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে এক বিরাট বিক্রয়কেন্দ্র। কাছেই মারুতির গাড়ি কারখানা। কাজেই অনেক শ্রমিকেরা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বোতলটি সংগ্রহ করে আসপাশের সিগারেটের গুমটির পাশে দাঁড়িয়েই তৃষ্ণা মেটান। একদিন সকাল আটটাতে সিগারেট কিনতে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর রোষানলে পড়লো এক তৃষ্ণার্ত শ্রমিক। বেশ বিরক্ত হয়েই সে বলল, 'সকাল সকাল কি করছো ভাই! এসব তো সন্ধ্যেবেলা ভালোলাগে।' খানিকটা জড়ানো গলায় যুবকটি বললো, 'সন্ধ্যে? আমিতো নাইট ডিউটি করে ফিরছি দাদা!' বাক্ যুদ্ধে পরাজিত আমার সহকর্মী সেদিন, রাম রাম বলে পালিয়েছিল।

এবার আসি রামের কথায়। প্রাচীন ভারত ও চীনে, চিনির সিরা বা আখের রস থেকে যে রঙ্গীন পানীয়টি বহুবছর আগে তৈরি হয়েছিল, কেন জানিনা তার নাম দেওয়া হয় রাম (RUM)। তবে আধুনিক রামের উৎপত্তি স্থল দক্ষিণ আমেরিকা। ওক কাঠের পিপেতে রেখে পুরনো করা হয় এই লাল বা বাদামি রঙের পানীয়। প্রায় ৪০% অ্যালকোহল যুক্ত এই পানীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোকেদের কাছে একটা সংস্কারের মতো। যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে সেখানে রাম ব্যাবহার বাধ্যতামূলক।

চিরকুমার সভায় রবিঠাকুর লিখেছেন, 'অভয় দাও তো বলি আমার wish কী....../ একটি ছটাক সোডার জলে পাকি তিন পোয়া হুইস্কি।'

ভুট্টা, যব, বার্লি ও গম থেকে প্রথমে ফার্মেন্টেশন ও পরে পাতন পদ্ধতিতে তৈরি এই পানীয়র নাম কেন হুইস্কি হয়েছে বলা মুশকিল তবে পরিচিত এক রসিক এর নাম দিয়েছেন ইচ্ছের চাবি (উইশ কি)। ইতিহাস বলে মেসোপটেমিয়ার সময়, ব্যাবিলনের লোকেরা প্রথম এই পানীয় তৈরি করেছিলেন। তারা পাতন পদ্ধতি জানতেন। পানীয়টিকে ওক কাঠের পিপেতে রেখে পুরোন করার পদ্ধতিটি অবশ্য তত পুরনো নয়। প্রথমে এই পানীয় তৈরি হয় ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। মনে হয় পরে এর গুণমুগ্ধরা একে শুধু মাত্র ওষুধে সীমাবদ্ধ থাকতে দেননি। পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি ব্র্যান্ড আছে শুধু মাত্র এই পানীয়ের। গ্রীক মহাবীর আলেকজান্ডার এই পানীয় খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রসার করেছিলেন। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে হুইস্কির সর্বাধিক প্রচার ও প্রসারের উল্লেখযোগ্য কারন পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের মানুষ আধুনিক পাতন পদ্ধতি জানতেন। স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে প্রস্তুত হুইস্কিকে আমরা মূলত স্কচ নামে চিনি। এডওয়ার্ড ডায়ার (Edward Dyer) ১৮২০ সালে ভারতের সোলান জেলার কাসাওলিতে প্রথম হুইস্কি তৈরির কারখানা খোলেন।

কলেজ জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের কলেজের লেডিস হোস্টেলের উল্টোদিকে একটা খুপচিতে দুষ্টু ছেলেদের দুষ্টু পানের আস্তানা ছিলো। এতে রথ দেখা ও কলা বেচা দুইই হতো। বলা বাহুল্য, সেখানে আমাদের দামাল সহপাঠীদের সংখ্যাই ছিলো সর্বাধিক। দুষ্টু দমনে হোস্টেল সুপার এক নেতার সাহায্য নেন। এলাকায় পোস্ট হয় দুজন পার্টি পুলিশ। তারা পান করতে দেখলেই পিটিয়ে জান বার করে দিতো। কিন্তু নেশা বড় দায়। একদিন তথাগত নামক ছেলেটি তথাগত ভঙ্গীতে পান করতে গিয়ে ধরা পড়ে। নিজেকে বাঁচতে সে বলে, আমি হোস্টেলের ছেলে নই, আমি ক্যান্টিনে কাজ করি। এই মিথ্যার পুরস্কার স্বরূপ তাকে পাশের হোটেলে সারাদিন বাসন মাজতে হয়েছিলো।

এর থেকেও আশ্চর্য ঘটনা একবার ওভারল্যান্ড কাগজে (এখন আর এ কাগজ নেই) পড়েছিলাম। তখন সোভিয়েত রাশিয়া সবে ভেঙেছে। টাকার অভাবে এক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের মাইনের বদলে দিচ্ছিলেন সপ্তাহে ১৪ বোতল ভদকা (Vodka)। হ্যাঁ ভদকা নামক পানীয়টি রাশিয়ার দেশীয় বলেই পরিচিত। পাতন পদ্ধতিতে ইথানল থেকে তৈরি হয় এই পানীয়। মূল উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয় আলু ও অন্য খাদ্যশষ্যকে। প্রায় ৪০% অ্যালকোহল যুক্ত এই পানীয় অত্যন্ত ঠাণ্ডা অবস্থায় জল ও বরফ ছাড়া নীট খাওয়ার নিয়ম রাশিয়াতে। ইতিহাস মতে ১৪০৫ সালের পর থেকে বস্তুটি কারণ হিসেবে ব্যবহার হলেও আগে এটি ছিলো ওষুধ।

একই রকম স্বচ্ছ আরও একটি পানীয় হল্যান্ড-এ প্রথম জুনিপার বেরি (juniper berry) থেকে তৈরি করা হয়েছিল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। পরে অবশ্য সেটিও পরিণত হয়েছে কারণে। পানীয়ের নাম জিন (Gin)। ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের রাজা উইলিয়ামব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন থেকে এই পানীয়টি লন্ডনে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সুগন্ধের জিন বাজারে পাওয়া যায়, যেমন পাতি লেবু, কমলা লেবুর সুগন্ধ ইত্যাদি।

দুই বা তার বেশি পানীয় মিশিয়ে যখন একটি পানীয় তৈরি হয়, যার মধ্যে অন্তত একটি পানীয় অ্যালকোহল যুক্ত তখন তাকে ককটেল বলে। ককটেল (Cocktail) তৈরির কাজে অবশ্য ভদকা ও জিনের জুড়ি মেলা ভার। তবে মদ বস্তুটিকে শুধুমাত্র সোডা বা ফলের রস মিশিয়ে পান করার একটা চল আছে। ১৮৯০ সালে এমন অ্যালকোহল পানীয়ের নাম দেওয়া হয় High Ball. কেউ কেউ অবশ্য Cocktail কে ও High Ball বলে থাকেন। তবে Cocktail এর ইতিহাস খুব বেশি পুরাতন নয়। প্রফেসর জেরি টমাস, ১৮৬২ সালে লেখেন Cocktail recipes, How to Mix Drinks। আর ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ককটেল পার্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।

একটা পুরোনো কথা মনে পড়ছে। তখন স্কুল পড়ি। এক মুদিদোকান থেকে দুটো সোডার বোতল কিনে বেরোচ্ছি, আমরা দুই বন্ধু। উদেশ্য বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ লাইম সোডা খাবো। ঘটনাচক্রে মুদিদোকানের পাশেই ছিলো মদের দোকান। সোডার বোতল হাতে দুই নাবালকের দিকে সেদিন এক জ্যাঠামশাই টাইপ বৃদ্ধ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন যেন, সর্বস্ব রসাতলে গেছে। সেদিন না জানলেও আজ জানি, জল, সোডা, লেবুর রস বা অন্য অ্যালকোহল হীন পানীয়ের মিশ্রণকে মকটেল বলে। তবে যেমন তেমন ভাবে পানীয় মিশিয়ে কিন্তু ককটেল বা মকটেল তৈরি করা যায় না। তার জন্য রয়েছে নিদৃষ্ট উপাদান, পরিমাপ ও পদ্ধতি। সাথে রয়েছে তার আকর্ষণী নামও। এখানে কয়েকটি পরিচিত ককটেলের নাম উল্ল্যেখ করছি, Vodka martini, Cosmopolitan, Vodka Tonic, Screwdriver, Greyhound, Moscow Mule, Bloody Mary ইত্যাদি।

ট্যাকিলা (Tequila) মদ্য জগতে একটি পরিচিত নাম। নামটির উদ্ভব মেক্সিকোর ট্যাকিলা শহরের নাম থেকে। এই মদ্যটি তার সেবন পদ্ধতির জন্য বিখ্যাত হয়েছে। পানীয়টি নীট অবস্থায় পানের পর নুন ও লেবু চেটে নিজেকে পরবর্তী পান বা শট এর জন্য প্রস্তুত করাটাই দস্তুর। এই পানীয়টি তৈরি হয় নীল আগেভি (Blue Agave) গাছের রস থেকে। গাছটিকে অনেকটা অ্যালোভেরা গাছের মত দেখতে।

মদ জগতের আরও দু-একটি কথা এখানে বলা জরুরি। যেহেতু প্রায় সব রকম মদের উৎপত্তি কোনও না কোনও কার্বোহাইড্রেট থেকে, তাই চিনি মদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মদের থেকে চিনি বার করাকে বলে Dry করা। মদ যত dry হবে তত দাম বাড়বে। কোনও কোনও রসিক জনকে নেশা বাড়াতে সেবনের পর মিষ্টি খেতে দেখেছি। মিষ্টি নেশার উৎকর্ষ বাড়ায় কিনা জানিনা, তবে মনে হয় মিষ্টি প্রেমী বাঙালিকে এক তূরীয় তৃপ্তি দেয়।

ব্লেন্ডেড মদ জগতে খুব পরিচিত শব্দ। ব্লেন্ডিং শব্দের অর্থ এক কথায় বোঝানো কঠিন। যেমন কঠিন বছরের পর বছর ধরে একই মদের একই স্বাদ ও গন্ধ ধরে রাখা। আসলে কাঁচামাল ও জলবায়ুর পরিবর্তন এ কাজের মূল চ্যালেঞ্জ। উৎপাদকেরা বিভিন্ন বছরের মদ খানিকটা খানিকটা করে মিশিয়ে ধরে রাখেন তাদের স্বাদের পরম্পরা। অনেক সময় এই মিশ্রণকে বেশ কয়েক বছর ধরে পুরনো করে তবে বাজারে ছাড়া হয়। বোতলের উপর লেখা থাকে সেটি কত বছরের পুরনো। এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিটির নাম ব্লেন্ডিং।

যে সব মদ্য এতক্ষণের আলোচনাতে উঠে এসেছে সেগুলো সবই বিদেশী। এই বিদেশী মদের মধ্যে যে গুলো ভারতে তৈরি হয় তাদের বলে India made foreign liquor বা IMFL. বিদেশী মদ্যপানের বিভিন্ন পদ্ধতি বা প্রত্যেকটি মদের জন্য ব্যবহৃত আলাদা ধরনের স্ফটিক পাত্র পানের উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। মদ্যপানের ক্ষেত্রে 'পেগ' শব্দটি অতি পরিচিত। শব্দটি সম্পূর্ণ ভারতীয়। মূলত ভারতে ও নেপালে এর ব্যাবহার বেশি। 'পেগ' মদের পরিমাপক। ছোটো পেগ মানে ৩০ মিলি লিটার আর বড় পেগ মানে ৬০ মিলি লিটার। কেউ কেউ বলেন পাতিয়ালা পেগ। এটা পাঞ্জাব উদ্ভূত ১২০ মিলি লিটারের বিশাল এক পেগ।

বিদেশী মদ বা ভারতে তৈরি বিদেশী মদ ছাড়াও ভারতে তৈরি দেশী মদ বা India made country liquor (IMCL) অর্থাৎ দেশী দারুর বাজার কিন্তু বিরাট। ভারতে বিক্রি হওয়া সমগ্র মদের প্রায় ৩০% ই এই দেশী দারু। বছরে এর পরিমাণ প্রায় ২৫ কোটি লিটার (২০১৫ এর পরিসংখ্যান)। ভারতের দেশী দারুর বাজার বৃদ্ধির পরিমান প্রায় ৭%, যা আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির প্রায় সমতুল্য। তবে এই দেশী দারুর হিসাবের মধ্যে কিন্তু আদৌ ধরা নেই মহুয়া, তাড়ি বা চুল্লুর মতো মদ গুলি। এই ক্রমবর্ধমান মদ বিক্রিতে পশ্চিমবঙ্গও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে লাইসেন্স-রাজ নরম হয়েছে। On Shop লাগোয়া Off Shop খোলা বাধ্যতামূলক হয়েছে। গুটিকতক জাতীয় ছুটির দিন বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই দোকান খোলা থাকে। তবু কোন এক অজানা কারনে বাঙালিরা প্রকাশ্যে মদ্যপানকে এখনও ঘৃণা করেন। এ যেন অনেকটা খরগোসের শুধু মুখটুকু লুকিয়ে রাখার মতো।

একটা পরিচিত গল্প দিয়ে লেখা শেষ করবো। এক মদ্যপ ছেলে রোজ গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খোলার জন্য, বাবাকে 'জামাইবাবু' বলে ডাকতো। একদিন বিরক্ত হয়ে বাবা কারণ জানতে চাইলে ছেলে বলে, 'জামাইবাবু ডাক শুনে পাড়ার লোকেরা ভাববে তোমার শালা মাতাল। বাবা বলে ডাকলে, তুমিতো পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবে না।' 

আমার বিশ্বাস, এই সব ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সেই মহান প্রবাদ, 'জাতে মাতাল, তালে ঠিক'।

1 comments:

2

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


হিতোপদেশের গল্প - রাজশেখর বসু
চয়ন

বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইংলণ্ডে খুঁজে পাওয়া যায় এক হাতে লেখা বই। শিশুসাহিত্যের গবেষকরা নড়েচড়ে বসেন। খুলে যায় চিন্তার এক নতুন দিক। কী ছিল সেই পাণ্ডুলিপিতে? ১৭৪০এর আশেপাশে নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য হাতে করে এই বই তৈরী করেছিলেন জেন জনসন। গল্প লিখেছিলেন, ছবি এঁকেছেলেন, যত্ন করে বাঁধিয়েছিলেন নিজের হাতে। এই হাতে গড়া বইয়ের চল সেসময় ইংলণ্ডে ঘরে ঘরে ছিল। কেননা একেবারে ছোটদের জন্য লেখা পড়ার বই সে দেশে তখন খুব একটা পাওয়া যেত না। কত মমতা, কত অধ্যবসায়, কতটাপরিশ্রম যে এসব বইয়ের শরীরে মাখানো থাকে সেটা বোধহয় না বললেও চলে।


জেন জনসনের বইয়ের একটি পাতা

বাংলা ভাষাতেও যে এরকম হাতে গড়া বই আছে, তার হদিশ আমরা সদ্য পেয়েছি। এবং পেয়ে চমকে উঠেছি, গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কারণ, দৌহিত্রীপুত্র দীপংকর বসুর জন্য এই অমূল্য শিল্পকীর্তিটি ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছিলেন 'পরশুরাম' রাজশেখর বসু।

রাজশেখর বসু রচিত 'হিতোপদেশের গল্প' বইটির একটি সচিত্র সংস্করণ প্রকাশ করে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, মাঘ ১৩৫৭বঙ্গাব্দে। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি সযত্নে রাখা আছে দীপংকর বসুর কাছে। আমরা হাতে পেয়েছি ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকাশিত সেটির হুবহু প্রতিকৃতি। ২০১৫ সালে দি কালার্স অফ্ আর্ট (৫২ ডি হিন্দুস্থান পার্ক, কলকাতা --৭০০০২৯) থেকে প্রকাশ পায় এটি। সম্পাদনা করেন পরিমল রায় এবং কাজী অনির্বাণ।

আমরা দেখছি সাড়ে আট ইঞ্চি লম্বা, সাড়ে ছয় ইঞ্চি চওড়া, তিরিশ পাতার একটি খাতা। দেখা যাচ্ছে, খাতাতে ব্রাউনরঙের বোর্ডের কাভার। বেগুনি রঙের মোটা কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া হয়েছিল খাতাটিতে। তিন ইঞ্চি লম্বা ও আড়াইইঞ্চি চওড়া মেটে রঙের এক চিরকুটের চারদিকে তিন ধাপে কালো কালির আয়তাকার বর্ডার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ডারের মধ্যের স্থানে হালকা সবুজ রঙের আভাস। ঠিক মাঝখানে কালো কালি দিয়ে রাজশেখর এঁকেছেন এক তোতাপাখি ---এক পা তুলে, বাঁ দিকে মুখ করে গাছের ডালে বসে আছে সে। তার নীচে লেখা বইয়ের নাম : হিতোপদেশের গল্প'। নামের নীচে সরল পাদরেখা। লেখকের নামের জন্য নির্ধারিত স্থানটিতে লেখা শ্রী দীপংকর বসু। এই অনুপম অলংকরণটি আঠাদিয়ে সাঁটা আছে পাণ্ডুলিপির মলাটের ওপরে বাঁ -- কোণে।

তোতা পাখি

যে কোনও কাজ আরম্ভ করলে তার তারিখ লিখে রাখতে কখনও ভুল হতো না রাজশেখরের। পাণ্ডুলিপির সামনেরকাভারের পেছন দিকে ওপরের বাঁ-দিকের কোণে, মলাটের ভেতরের ভাঁজে, লেখা রয়েছে ১৪০৩৪৩, অর্থাৎ তিনি হিতোপদেশের গল্প লিখতে আরম্ভ করছেন ১৪ মার্চ, ১৯৪৩।

মলাট ওলটালে চোখে পড়ে পাণ্ডুলিপির আখ্যাপট। ওপরদিকে দু --ধাপে লেখা বইয়ের নাম :

বিষ্ণুশর্মা রচিত হিতোপদেশের গল্প।

তারপর এক আশ্চর্য লেখক পরিচিতি :

শ্রীমান দীপংকর বসুর বড়দাদুর লেখা।

নীচে তারিখ: ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮। পাতার নীচে যেখানে সচরাচর প্রকাশকের নাম ঠিকানা লেখা থাকে সেখানে লেখা আছে রাজশেখরের বসতবাটীর ঠিকানা :

৭২, বকুলবাগান রোড,
কলিকাতা

আখ্যাপট

তারপর রুলটানা কাগজের প্রথম পাতার শীর্ষে লেখা বইয়ের নাম : হিতোপদেশের গল্প। নীচে বারোটি গল্পের শিরোনাম ওপ্রত্যেকটি গল্পের শুরুর পৃষ্ঠাসংখ্যা সমেত সূচিপত্র।

প্রথম গল্পের প্রথম পাতার ওপরে আবার বইয়ের নাম। তলায় প্রথম গল্পের শিরোনাম 'বিষ্ণুশর্মার পাঠশালা।'

সূচিপত্র

প্রতি পাতার দু -- পিঠেই লেখা। বারোটি গল্প চব্বিশটি পাতায়। সবার শেষে টানা পাদরেখায় ঘোষিত সমাপ্তি। শেষ পৃষ্ঠারনীচের দিকে বাঁ -- কোণে সবুজ কালিতে লেখা ২৪০২৪৮। অর্থাৎ, লেখা শেষ হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে।

বিষ্ণুশর্মার পাঠশালা

তাঁর একমাত্র ছোটদের জন্য লেখা বইয়ে কী ভাষা ব্যবহার করেছিলেন রাজশেখর বসু? দেখা যাক :

"ভাগীরথী নদীর তীরে পাটলিপুত্র নামে এক নগর আছে। এখন তার নাম পাটনা। সেই নগরে সুদর্শন নামে এক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি শুনতে পেলেন একজন লোক এই কবিতাটি পড়ছে ---

মনের সংশয় যাতে দূর হয়,
যাতে জানা যায় অজানা বিষয়,
যে জন শেখে না বিদ্যা এমন 
চক্ষু থাকিতে অন্ধ সে জন। 
অল্প বয়স আর বহু ধন, 
প্রভুত্ব আর কুকাজেতে মন,
একটিতে এর হয় কত ক্ষতি,
চারটি থাকিলে ভয়ানক অতি।।

কবিতা শুনে রাজা ভাবলেন, 'আমার ছেলেরা লেখাপড়া শিখছে না; তাদের বয়স অল্প, টাকাও অনেক পায়, লোকজনের উপর হুকুম চালায়, কুকাজও করে; চারটি দোষই তাদের আছে। তারা যাতে বিদ্বান আর গুণবান হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।'..."

কোনও রকম বাহুল্য নেই; কোনও ন্যাকামি বা খোকাপনা নেই; ঋজু, সরল, গদ্য। যে কোনও প্রকৃত শিশু সাহিত্যিকের মতোই রাজশেখর জানেন শিশুদের আধা-মানুষ ভাবতে নেই। তার ওপর এই বই তিনি লিখছেন এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি চান তাঁর দৌহিত্রী-পুত্রকে মাতৃভাষার উত্তরাধিকার প্রদান করতে। চান আবহমান দেশজ কৃষ্টি-সংস্কৃতির অংশ ভাগ করতে। সেই কারণেই, এই বই সযত্নে তিনি গড়ে তুলেছিলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে। যেদিন তিনি পাণ্ডুলিপি লিখতে আরম্ভ করেন সেই ১৪ই মার্চ ১৯৪৩-এ দীপংকরের বয়স মাত্র এক বছর ন'মাস। রাজশেখর জানেন এইবার মুখে বোল ফুটবে তার। তোতাপাখির মতো বুলি শিখবে শিশু। আর তাই, মলাটে আঁকা ছবিতে তোতাপাখি হাজির, সেই পাখির ছবির তলায় নাম লেখা দীপংকর বসু। রাজশেখর স্পষ্ট ভাষায় 'হিতোপদেশের গল্প'-র ভূমিকা রচনা করছেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক মন প্রস্তাবনার পর মূল লেখা আরম্ভ করতে চায়। ভারতভূমে যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিতোপদেশের নানাকাহিনী থেকে বাছাই করা বারোটি গল্প তুলে এনে এক শিশুকে ভাষা দুনিয়ার শরিক করতে চান রাজশেখর। ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, যখন পাণ্ডুলিপি শেষ হ'ল তখন দীপংকর সাত পেরিয়ে আটে পড়েছেন। অক্ষর পরিচয় হয়ে গেছে, এবার নিয়ম মেনে লেখাপড়া শুরু হবে। ভবিষ্যতের ভিত তৈরীর ঠিক শুরুর মুহূর্তটিতে পাণ্ডুলিপির আখ্যাপত্রে বেগুনীকালিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখটি লিখে নিজের হাতে তৈরী করা বিষ্ণুশর্মার হিতোপদেশের গল্প তাঁর হাতে তুলেদেন রাজশেখর। ভবিষ্যৎ নির্মাণের অন্যতম সেরা হাতিয়ার, কথাভুবনের চাবিকাঠি। এইখানে এসে আমাদের মধ্যযুগের ইহুদী সমাজের একটা প্রথার কথা মনে পড়ছে। যে শিশু ভাষা শিখতে আরম্ভ করবে তাকে কোলে বসাতেন গুরুমশাই। একটা স্লেটে লেখা হিব্রু বর্ণমালা, আর ধর্মগ্রন্থের একটা অনুচ্ছেদ শব্দ ধরে ধরে যত্ন করে উচ্চারণ করতেন তিনি। শিশুটি তোতাপাখির মতো অনুকরণ করত গুরুর উচ্চারণ। তারপর স্লেটটায় মধু মাখিয়ে দেওয়া হতো আর খুদে ছাত্র চেটে খেয়ে নিত সেটা। ব্রহ্মী বাক্ এখন তার দেহযন্ত্রের অংশ। আপনারাই বলুন, মিল পাওয়া যাচ্ছে না? অন্তরের সবটুকু বাৎসল্য মধু ঢেলে আদরের দীপকের জন্য যে বই পাঁচ বছর ধরে গড়ে তুলেছেন তার মায়ের দাদু, অপেক্ষা করেছেন এই সময়টির জন্য, সে বই কি শুধু একটা বই? কখনও নয়। সে একটা প্রতীক। রাজশেখর তাঁর দৌহিত্রী পুত্রকে দিচ্ছেন তাঁর মনন, মেধা, শিল্প বোধ, রুচি আর বাণী সাধনার উত্তরাধিকার। এককথায় তাঁর সম্পূর্ণ শীলন। দীপংকরের অস্তিত্বের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে চিরবহমান সংস্কৃতি চেতনা। আর এই চেতনা যিনি জাগিয়ে তুলছেন তিনি তাঁর সবটুকু সৃজনক্ষমতা ঢেলে একটা বই গড়ে তুলেছেন শুধুমাত্র দীপংকরের জন্য। তিনি সাহিত্যিক রাজশেখর বসু নন। তিনি শুধুই দীপংকরের বড়দাদু।

এই পাণ্ডুলিপির শুরুর তারিখ লেখা কালো কালিতে, সমাপ্তির তারিখ সবুজ কালিতে, একই তারিখ আখ্যাপত্রে লেখা বেগুনী কালিতে। প্রতি গল্পের শিরোনামের তলায় সবুজ কালির নিম্ন-রেখা; মাঝে মাঝে পৃষ্ঠার নীচের দিকে বেগুনি রঙে লেখা পাদটীকা। এই রঙের বৈচিত্র্য একদিকে যেমন পাণ্ডুলিপির সৌন্দর্য বাড়ায়, অন্যদিকে জানিয়ে দেয় যে রচয়িতা সচেতন ভাবে শিশুমনে রঙ ধরানোর কাজে নেমেছেন।

আমরা পাণ্ডুলিপিটিকে অনুপম শিল্পকর্ম নামে ডেকেছি। এবং, পাণ্ডুলিপিটি তাইই। ভাষা, লিপি, মাত্রা, ও বিন্যাসের শিল্পকর্ম। রাজশেখরের হাতের লেখা দেখে সত্যজিৎ রায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও হয়েছি। গল্পগুলি আগাগোড়া কালো কালিতে লেখা। কোথাও সামান্য কাটাকুটি বা অপরিচ্ছন্নতা নেই। প্রতি অনুচ্ছেদের শেষ পংক্তি বাদে অন্য পংক্তিগুলির দৈর্ঘ্য সমান। প্রতি পৃষ্ঠা ওপরে, নীচে, ডাইনে আর বাঁয়ে সমান মার্জিন রেখে লেখা। রূপে-বর্ণে-সৌষ্ঠবে পটে আঁকা চিত্রকে হার মানিয়ে দেয় এই পাণ্ডুলিপি। বই ছাপা হওয়ার সময় আখ্যাপত্র, সূচিপত্র ইত্যাদি তৈরী করেন প্রকাশক। 'হিতোপদেশের গল্প'তে সে কাজটিও করে রেখেছেন রাজশেখর। বইয়ের বেশে এরকম composite art form (একথার বাঙলা করলেও বাঙলা হবে না)এর কোনও নিদর্শন আমাদের বইঘরে অতীতে কখনও আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে বলে মনে হয় না।


ঋণস্বীকার : 
১) রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
২) পরিমল রায় ও কাজী অনির্বাণ
৩) কিম্বারলি রেনল্ডস্
৪) আলবের্তো মাঙ্গুয়েল্।

2 comments:

0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in

বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট


পোস্টকার্ড গল্প
রাজা সিংহ
সম্পাদনা : পিয়ালী মজুমদার
প্রকাশক : খোয়াবনামা
বিনিময়মূল্য : ১৭৫টাকা

'পোস্টকার্ড গল্প'তে সংকলিত সব রচনাই গল্প নয়। আর কথা এগোনোর আগে ঠিক করে নেওয়া যাক গল্প বলতে আমরা কী বোঝাচ্ছি। যে নাতিদীর্ঘ কাহিনীতে প্রতীতি বা impression গুলি সংবদ্ধ হয়ে এক অখণ্ড রসানুভূতি সৃষ্টি করে তাই ছোটগল্প বলে বিবেচনা করছি আমরা। এই যুক্তিতে 'পোস্টকার্ড গল্প'-- এর 'টম অ্যাণ্ড জেরি শো', বা 'সু - কে চিঠি' জাতীয় রচনাকে আমরা আলোচনার পরিসরে আনছি না। তবে, একই সঙ্গে এও যোগ করছি যে মুচমুচে স্বাদু গদ্য বা মরমী রোমান্টিক গদ্যের উদাহরণ হিসেবে এগুলি প্রথম শ্রেণীর। বাকি গল্পগুলির মধ্যে কয়েকটি অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। আমরা দেখতে পাই হিংসায় ক্ষুব্ধ এক মহাবিশ্বকে যেখানে ক্ষমতা ও নিপীড়নের বহুমাত্রিক উপস্থাপনা ( যেমন একুশ' গল্পে); যেখানে নির্মম প্রতিহিংসাপরায়ণতা প্রেমে শমিত হয় না (যেমন ' কিংবা নিছক প্রেমের গল্প'টিতে); যেখানে এক অন্ধ শক্তি মানুষকে টিপে মারে (যেমন 'পোকা' গল্পটিতে); সম্পর্কের ক্লেদ ভ্রূণহত্যা করে (যেমন 'নীল পাখিটা' গল্পে)। আবার আমরা পাই গভীর জীবনমায়ার সন্ধানও। তাই 'দেবতা'র মানবায়ন ঘটে, 'মহিষাসুর' অসুররূপ ছেড়ে মানুষ হয়ে যায়, আলোকপথযাত্রী কবি 'কবিতার গাছ' হন, নীল যন্ত্রণা 'প্রজাপতি' হয়ে পাখনা মেলে। এই বইয়ের তৃতীয় অনুষঙ্গটি আমাদের মন কাড়ে বেশী। আর আমাদের মনে হয় এই অনুষঙ্গ নির্মাণেই লেখকের ক্ষমতার সার্থকতম প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর শৈশবের কাটিহারকে প্রেক্ষাভূমি করে যেকটি গল্প রচনা করেছেন তিনি সেখানে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধের অপরূপ সমাবেশে এক ওমে ভরা পৃথিবী স্পন্দিত। 'সংক্রান্তি'র পুলিপিঠের স্বাদ, 'মাসকাবারি'র চায়ের প্যাকেটের গন্ধ সে বিশ্বকে এতটাই মায়াবী করে যে 'বরফসাহেব'--এর হিংস্রতার কাহিনী গৌণ হয়ে পড়ে ৭৪ এর রেলওয়ে হরতালের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাহিনীর সামনে। আর এই বিশ্বেরই পটভূমিকায় লেখক রাজা সিংহ রচনা করেন তাঁর মাস্টারপিস 'শোক'। আমরা মুক্তকণ্ঠে বলতে চাই যে এটি আমাদের এযাবতকাল পড়া শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পগুলির একটি। বাক পরিমিতি, নিখুঁত মাত্রাজ্ঞান, ক্লাইম্যাক্স--এর তীব্র অভিঘাত আমাদের কিছুক্ষণ স্তব্ধবাক করে রাখে। খণ্ড প্রতীতি সমূহ সংহত হয়ে যে অখণ্ড অনুভূতিটির জন্ম দেয় ইংরিজিতেই তাকে অভিহিত করার সুবিধে বেশী : Awe। সমীর সরকার কৃত প্রচ্ছদ ও অলংকরণে দৃষ্টিনন্দন এই বইটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখার যোগ্য।



আবার বৃষ্টি নামল
দীপঙ্কর দাস
প্রকাশকঃ দিবারাত্রির কাব্য
কলকাতা- 700012

প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেও অবসর সময়ে কবিতার সঙ্গে সময় কাটান কবি দীপঙ্কর দাস। বাঁকুড়ার রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আবার বৃষ্টি নামল' সম্প্রতি কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হলো। কলকাতারই 'দিবারাত্রির কাব্য' থেকে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের 64 পৃষ্ঠায় 55 টি কবিতা জায়গা পেয়েছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল গোসাবার জন্মস্থানের ছবি যেমন কবিতায় ফুটে উঠেছে তেমনই কর্মস্থল বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের অভিজ্ঞতাও অনায়াসে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। আবার তাঁর কবিতায় 'মেঘ-বাদলের-রুপকথা'র বর্ণনাও করেছেন সুনিপুণভাবে। সুখপাঠ্য কবিতা, ফয়সল অরফিয়াসের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ যুক্ত কাব্যসংকলনটি কবিতাপ্রেমী পাঠকদের ভালো লাগতে বাধ্য।



অনুগল্প পঞ্চাশ
প্রকাশক অভিযান পাবলিশার্স
লেখক সত্যবান বিশ্বাস
দত্তপুকুর ব্যায়াম সমিতি;দত্তপুকুর উঃ২৪পঃ। 

এসময়ের একজন উদীয়মান লেখক। আটপৌরে জীবনের কথা-কোলাজ; সমাজ ও ধর্মীয় জীবনের অন্ধবিশ্বাস, ইত্যাদি - তাঁর টুকরো টুকরো কাহিনীতে দারুণভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। 

0 comments:

0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক - তৃতীয় পর্ব
মিথিল ভট্টাচার্য


পরপর ছটি পুত্র সন্তান কংসের হাতে বধ হওয়ার পর, সপ্তম সন্তান দেবকীর গর্ভেই মারা যায়। এই একই সময় বসুদবের প্রথমা পত্নী রোহিনী গর্ভবতী হওয়ায় যাদব গোষ্ঠী তাদের চির বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে দিয়ে রটনার চেষ্টা করে যে রাজকুমারী দেবকীর সন্তানই, ঈশ্বরের আশীর্বাদে, দেবী রোহিনীর গর্ভে স্থান নিয়েছে। কিন্তু এই রটনা খণ্ডন করা কংসের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিকের পক্ষে কঠিন ছিলনা। বসুদেবের যেকোনও সন্তান হোকনা কেন, যতক্ষণ না সে দেবকীর গর্ভজাত ততক্ষণ মথুরার সিংহাসনের উপর তার কোনও ন্যায্য অধিকার থাকতে পারে না। রোহিনীর পুত্র কোনও দিক থেকে তাঁর জন্য বিপদের কারণ নয়, তাই তাকে আক্রমণ করা তো দুরস্থান বরং ভগ্নীপতির প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানকে তিনি সহাস্যেই আশীর্বাদ করেন। সামান্য ব্রাহ্মণরটনাকে প্রতিহত করতে বিশেষ কষ্টও তাঁকে করতে হয়নি।

এই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর শুধু মাত্র একটি উপায়ই পড়ে থাকে যাদবদের কাছে। যেকোনও উপায়ে, অন্তত দেবকীর একজন গর্ভজাত পুত্রকে মথুরা থেকে সরিয়ে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে গোপনে বড় করে তোলার। আশ্রয়ের কথা মাথায় আসলেই সর্বাগ্রে যে ব্যক্তির কথা তাদের মনে আসে তিনি হলেন বসুদেবের প্রিয় বন্ধু, গোকুলের ঘোষ সম্প্রদায়ের প্রবল পরাক্রান্ত নেতা, নন্দ। তাঁর কাছেই সসম্মানে রয়েছেন রোহিনী ও তাঁর সদ্যজাত পুত্র বলরাম। ভাগ্যক্রমে, এই সময় রাজকুমারী দেবকী ও নন্দপত্নী দেবী যশোদা একই সঙ্গে গর্ভবতী হন। এই অবস্থার সুযোগ নিয়েই যাদবপ্রধানরা অতি গোপনে নন্দ ও বসুদেবকে নিয়ে এক চরম দুঃসাহসিক পরিকল্পনার জন্ম দিলেন। যাদবকুলের স্বার্থে, মথুরার ভবিষ্যতের জন্য, নিজের সন্তানের বলি দিতে অবশেষে নিজেকে রাজি করালেন নন্দ।

দেবকীর সাত সাতটি সন্তানের বিনা বাধায় মৃত্যুর পর নিজের অজান্তেই বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেছিলেন কংস। তাঁর এই নিশ্চিন্ততার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই মথুরার কড়া পাহারাও খানিক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যাদবেরা পরিকল্পনা নিল সঠিক সময়ে যেন-তেন-প্রকারেণ দেবকীর গর্ভের এই অষ্টম সন্তানকে গোকুলে নন্দের গৃহে পাঠিয়ে দিয়ে, তার বদলে নন্দের ভাবী সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেওয়ার। মথুরার রাজবংশের অন্তত একজন উত্তরাধিকারী যেন জীবিত রয়ে যায় যে কংসের অধিকারকে প্রশ্ন করতে পারে। সেই কারণেই তাদের বলি দিতে হবে নন্দের ভবিষ্যত সন্তানকে, এক বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী নন্দ সময়মতো তাঁর আসন্নপ্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে যমুনা নদীর ধারে এক নির্জন কুটিরে চলে যান। একমাত্র ধাত্রী যিনি উপস্থিত থাকেন তিনিও এই পরিকল্পনা সর্ম্পকে অবগত এক যাদব বংশীয়া রমণী। যশোদা যাতে প্রসবের পরেও জানতে না পারেন তাঁর কী সন্তান হয়েছে তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে যথেষ্ট মাত্রায় আফিমও সংগ্রহ করা হয়, প্রয়োজনে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য।

অবশেষে আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। কারাগারে দেবকী জন্ম দেন তাঁর অষ্টম সন্তানের। সেই সন্তান, যার নিরাপত্তার জন্য জন্মের বহু আগেই সচেষ্ট হয়েছিল একাধিক গোষ্ঠী, সেই সন্তান যে মথুরার গণ্ডী ছাড়িয়ে একদিন গোটা আর্যাবর্তকে নিয়ন্ত্রণ করবে, হয়ে উঠবে আর্যাবর্তের ভবিষ্যত ভাগ্যনায়ক। তার জন্মের দুই এক দিন পূর্বেই যশোদা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এই খবর গোপনে পৌঁছে গিয়েছিল মথুরার কারাগারে। দেবকীর অষ্টম পুত্রের জন্মের পরেই যাদবদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হলো। কিছু প্রহরী আগে থেকেই যাদবদের অর্থে বশীভূত হয়েছিল, আর বাকিদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বসুদেবের বলরাম এবং রোহিনীকে দেখতে যাওয়াকে অনুমোদন করা কংসের নকল অনুমতিপত্র। দেবকীর অষ্টম পুত্রের জন্মের পরেই অতি সন্তর্পণে, বেতের ঝুড়িতে সদ্যজাত পুত্রকে লুকিয়ে নিয়ে, বসুদেব যাত্রা শুরু করলেন গোকুলের উদ্দেশ্যে। যাদবদের সহায়তায় যমুনা নদীর ধারে শেষনাগ জাতির আদিবাসীদের একজন একটি ছোট্ট নৌকা নিয়ে তাঁর অপেক্ষা করছিল। সেই নৌকায় তরঙ্গসঙ্কুলা যমুনা নদী পার হয়ে বসুদেব পৌঁছে ছিলেন নন্দের সেই কুটিরে। বসুদেবের হাত থেকে সদ্যজাত পুত্রকে অচেতন যশোদার কোলে দিয়ে, সদ্যজাত কন্যাকে শেষবারের মতো নিজের বুকে টেনে নিয়ে, ভেজা চোখে বসুদেবের হাতে সেই দিন তুলে দিয়েছিলেন নন্দ। প্রথম ও শেষ উপহারের মতো গোকুলের তাঁতশিল্পীদের নির্মিত দেবী দুর্গার নবরূপ অঙ্কিত একটি লাল কাপড়ে সযত্নে ঢেকে দিয়েছিলেন এই শিশুকে। দেবী দুর্গার রূপ নিয়ে ছিন্ন করুক সে কংসের ষড়যন্ত্রের জাল, রক্ষা করুক মথুরার শেষ উত্তরাধিকারীকে। একবার, শেষ বারের মতো, পুত্রকে নিজের আশিস দিয়ে নন্দের শিশু কন্যাকে বুকে আগলে, ছোট্ট নৌকাটি করে, গোপনে আবার মথুরার কারাগারে ফিরে আসেন বসুদেব। হতভাগিনী যশোদা জানতেও পারেননা তাঁর কন্যাকে কীভাবে তাঁর অজান্তে বলি দেওয়া হলো রাজনৈতিক ক্রীড়ার ক্রীড়নক বানিয়ে। 

কংসকে সঠিক সময়েই খবর দেওয়া হলো দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানের জন্মের। পুত্র নয়, এবার কন্যা হয়েছে দেবকীর। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই কংসের কাছে। কন্যাও যদি হয় তবে সেই কন্যার ভবিষ্যৎ স্বামী এবং পুত্ররা কংসের সবথেকে বড় বিপদ হতে পারে। সেই সুদূর ভবিষ্যতের কথা যদি বাদ দেওয়াও হয়, তাহলেও এই কন্যার রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়ে বসুদেব নিজে সহজেই মথুরার সিংহাসন দাবি করতে পারেন। সুতরাং এই বিষবৃক্ষকে কোনওভাবেই বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। তাই, কংসের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হলো সেই শিশুকে। কিন্তু এই শিশুই কংসের মনে সবথেকে বড় আতঙ্কের জন্ম দিয়ে গেল। নিজের মৃত্যু দিয়ে এই কুটিল রাজনীতিকের জীবনের শান্তি হরণ করে নিয়ে গেল সে। যে কাপড়ে ওই শিশু আবৃত ছিল সেই কাপড় কংসের মনে একটি অজানা আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। যত বড় অত্যাচারীই হন না কেন, দেবী দুর্গার চিত্রাঙ্কিত ওই কাপড় তাঁর মতো নিষ্ঠুর ব্যক্তির মনেও জাগ্রত করেছিল এক অজানা ভয়। এর পরেই ক্রোধে, বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কোথা থেকে এলো এই কাপড় মথুরার কারাগারে? এই জাতীয় কাপড় বোনা তো গোকুলের তন্তবায়দের বৈশিষ্ট্য। দেবী দুর্গার নবরূপের চিত্র দিয়ে গড়া এই কাপড় গোকুলেই একমাত্র বানানো হয়। তবে? এর অর্থ কি? তার মানে কি এই সন্তান গোকুলের কোনও পরিবারের? তা যদি হয় তবে দেবকীর অষ্টম সন্তান কোথায় গেল? চরেদের মাধ্যমে অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য সামনে আসতে বেশি দেরী হলো না। যে কন্যাকে তিনি হত্যা করেছেন সে কন্যা গোকুলের ঘোষনেতা নন্দের কন্যা। তাঁর সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ, তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বেড়ে উঠছে গোকুলে; যাদবদের চক্রান্তে তাকে বিনাশ করার জন্য। কিন্তু, এবার তিনি নিরুপায়। যে কৌশলে তিনি এতদিন যাদবদের স্তব্ধ করে রেখেছিলেন, সেই একই কৌশলে তাঁর গতিও আজ রুদ্ধ। কোনও প্রমাণ নেই যে সেই সন্তান দেবকীর, আর তার উপর নন্দ কোনও দিক থেকে দুর্বল নন। সমস্ত ঘোষ সম্প্রদায় তাঁর অধীনে। এর উপর আছে যাদবদের সক্রিয় সহায়তা, প্রয়োজনে বসুদেবের জেষ্ঠা পৃথার পালকপিতা মহারাজা কুন্তীভোজও তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই অবস্থায় গোকুল আক্রমণের অর্থ, যে সামরিক অভ্যুথানকে এত দিন তিনি অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে এসেছেন তাকেই নিজে থেকে বরণ করে নেওয়া; যাদবদের সুযোগ এনে দেওয়া তাঁর সঙ্গে সামরিক শক্তির দ্বন্দ্বে নামার। এই মুহূর্তে, ফাঁদে পড়া পশুর মতো তীব্র খেদোক্তি করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা মথুরাধিপতির। তবে, এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে তিনিও শেখেননি। তাঁর শ্বশুর ও নিয়ন্ত্রক জরাসন্ধের পরামর্শে এবার তিনি আরম্ভ করলেন চোরাগোপ্তা আক্রমণ। যেখানে সামরিক শক্তির সরাসরি আক্রমণের পথ রুদ্ধ সেখানে কার্যসিদ্ধি করতে তিনি ব্যবহার শুরু করলেন গুপ্তঘাতকদের। 


(ক্রমশ)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥৯॥


বিবর্ণ বাদামি তামাকের ছেঁড়া পাতার ভিতর দিয়ে পূর্ণিমার আলো স্নিগ্ধ মদির 



গোরাচাঁদ

বিভ্রান্ত। হতবাক গোরাচাঁদ। ভেবেছিলেন খনিজ নিষ্কাষণের ব্যাপারে সরকারি অনুমতিতে রাশিয়ান কম্পানীর দল ও তার রক্ষকেরা ভারতীয় সুরক্ষা বাহিনীর সাথে এখানে তাঁবু গেড়েছে। হয়তো তাই জনজাতির কাছে নিজেদের উদার ও বন্ধু মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য ওরা জেরকার সেবা শুশ্রষার কাজে তড়িঘড়ি হাত লাগিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ান রক্ষাবাহিনীর এই মানুষটি যে সামরিক বাহিনীর একটি উচ্চপদস্থ কমাণ্ডিং অফিসার এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যৌথ অভ্যাস মহড়ার নামে এন্টিটেররিস্ট অপারেশন ও ড্রিল চালানো হবে সে কথা কোনও ভণিতা না করে সোজাসুজি বলে দিলেন গোরাচাঁদকে। যেহেতু গোরাচাঁদ রাশিয়ান ভাষা বোঝেন ও বলতে পারেন তাই কথাবার্তা শুধু দুজনের মধ্যেই। তাও আবার ক্লোজড ডোর। এতে গোরাচাঁদের বিভ্রান্তি বাড়লো বই কম হলো না। ওঁর নাম সারগেই ইভানোভিচ এবং ইন্ডিয়ান পার্ট থেকে মেজর জেনারেল তাঁরই সুপুত্র সৌমজিত দাস উগ্রবাদী দমনে এই যুগ্ম অভিযানে হত্যা করার খোলা অনুমতি পেয়েছেন সে কথাও তিনি বলে দিলেন। রাত পার হয়ে তরতর করে সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। তাঁবুর তৈরি অফিসঘরে গোরাচাঁদ ও সারগেই। ঘরটিতে একটি পুরু পারদর্শী প্লাস্টিকের জানালা। সেখান থেকে দূরে খুব ছোট ছোট অনেকগুলি সামরিক তাঁবুর জটলা। একদুটোর উপর ভারতের পতাকা দেখে গোরাচাঁদের শরীর হিম হয়ে গেল। গোরাচাঁদ যে সৌমজিতের বাবা সেকথা তো অফিসার বলেই দিল। তাই হয়তো প্রাণে না মেরে বসিয়ে রেখেছে। জেরকার বিষয়ে তবে এরা নিশ্চয় জানেনা। জানলে ওরা ওকে প্রাণে বাঁচাতো না। ওখানেই খতম করে দিত। মনে হয় আর একটু পরে সমুর হাতে আমাদের তিনজনকে তুলে দেবে। তাহলে এরা দেরি করছে কেন?এইকথা ভাবতে ভাবতে গোরাচাঁদ দেখলেন সারগেই তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যে গোরাচাঁদ শিউরে উঠলেন। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এমন এক্স রে নজর কখনও দেখেননি তিনি। ভীষণ অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। ওই অবস্থাতেই শুনলেন সারগেই বলছে জেরকার ব্যাপারে সে সমস্ত তথ্য জোগাড় করেছে। শুধু জেরকা কেন, গোরাচাঁদ, পেরো এবং অন্য সব এক্টিভিস্টদের ব্যাপারে যতটা ও জানে ঠিক ততটা মেজর জেনারেল সৌমজিতও জানেনা। এমনকি এই প্রান্তরের ভৌগলিক খনিজ বনজ সবকিছুই তার জানা হয়ে গেছে।

গোরাচাঁদের বিস্ময়ের আর সীমা রইলনা। একি! এই লোকটা কি থট রিডিংও জানে নাকি? ও যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে গোরাচাঁদের মনের কথা পড়ে নিয়েছে! কিকরে সম্ভব? উনি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন সারগেই মিটিমিটি হাসছে। গোরাচাঁদ এবার সরাসরি চোখে চোখ রাখলেন। দেখলেন ওর দৃষ্টি তিক্ষ্ণ আর সম্মোহক। ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে হেসে ফেললেন তিনি। ওর ভাষাতেই বললেন, এসব কথা আমাকে বলে কি লাভ? যেমন করার আছে করুন। আমরা তো সমর্পিত। সারগেই তেমনি ভাবেই তাকিয়ে থেকে বেল বাজাল। একজন সশস্ত্র রক্ষী ভেতরে আসতেই চোখ একটুও না সরিয়ে বলল, কফি। গোরাচাঁদও ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরালেন না। রক্ষী চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর আবার এসে যখন দুকাপ কফি রেখে গেল, সারগেই গোরাচাঁদের উপর থেকে এবার দৃষ্টি সরিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে উঠল, ভেরি টাফ এন্ড ইন্টেলিজেণ্ট। ইংরেজি ভাষাতেই তড়বড় করে ওঁর মানসিক শক্তির অনেক প্রশংসা করতে লাগলো সারগেই। গোরাচাঁদ সহজ হয়ে গেলেন। কফি তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। লোকটার গেসচার পজেটিভ। বললেন,-আপনার ইংরেজিতে ফ্লুয়েন্সি সত্যিই প্রশংসনীয়।

সারগেই আবার বলে উঠল ইংরেজি ভাষাতেই, -শ্যাল আই কনটিনিউ ইন ইংলিশ, মিঃ দাস? গোরাচাঁদ রাশিয়ান ভাষাতেই উত্তর দিলেন, না না আমি আপনার ভাষাতেই খুব সহজ বোধ করব, মিঃ সারগেই। আপনি আপনার ভাষাতে কথা বলতে পারেন। সারগেই উত্তর দিল, -আমার মাতৃভাষা যদিও চেক কিন্তু আপনাকে ধন্যবাদ যে রাশিয়ান ভাষা আপনার ভালো লাগে।

-ধন্যবাদ। আমি চেক রিপাবলিক ভাষাও একটু একটু বুঝতে পারি। এটি রাশিয়ান পোলিশ আর ক্রোয়েশিয়ানদের সাথে মিল আছে। আমাদের ফ্রাঞ্চ কাফকার ভাষা তো চেক ছিল।

কাফকার নাম করতে সারগেই গদগদ হয়ে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে এসে গোরাচাঁদের হাত দুহাতে ধরে বলল,-আপনি মহান, মিঃ দাস। কাফকাকে আপনি 'আমাদের' বললেন! আপনি আর আপনার ছেলে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি ইংরেজি ভাষা সহজ ভাবে বলতে পারি। তা সত্ত্বেও আপনার ছেলের সাথে দোভাষী নিয়ে গেছি। কেবলমাত্র পাওয়ার ক্ল্যাশ। আপনার মতন বিপ্লবী মানুষ থাকতেও আপনাদের দেশে যে কেন সাম্যবাদ বলিষ্ঠ নয়। শোষণ আর শোষিত সমাজ এখানে সর্বত্র।

গোরাচাঁদের মনে হলো এবারে আসল কথাটা জানা যেতে পারে। বললেন,-ধন্যবাদ মিঃ সারগেই। আমি সব বুঝতে পেরেছি আমাদের ব্যপারে আপনি সব কিছুই জানেন। এবার আপনি দয়া করে যদি বলেন আমাদের নিয়ে আপনি কী করবেন? অবশ্য যদি আপনার অফিসিয়ালি বলতে বাধা না থাকে।

সারগেই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,-মিঃ দাস, আপনাদের এখানে রাশিয়া ও ইন্ডিয়ার যে যুগ্ম অভ্যাসের মেনু ঠিক করা হয়েছে সেটা এখানে না হয়ে কাশ্মীর কিংবা দেশের অন্য কোনও বর্ডারে হতে পারত। যেখানে উগ্রবাদীর আসল মানে আমরা সবাই জানি, দেশদ্রোহিতা। এই মহড়ার নাম রাখা হয়েছে অসুর নিধন। কথা হচ্ছে অসুর এখানে কে? আপনার ছেলে এবং অন্য কোনও সুবিধাবাদী মাইন্সওনার, পোচার, টিম্বার মার্চেন্ট কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল্স রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই ব্যবস্থা করেছে। এ সব দেশেই হয়। কিন্তু আপনাদের দেশে একটু বেশিই টুইস্টিং। আপনার ছেলে নিজে ইনিসিয়েটিভ নিয়ে এখানে উগ্রবাদী মারার চিরুনি তল্লাশির ব্যবস্থা করেছেন। এখানের উগ্রবাদী মানে আমি যতটা জানি, কিছু ভীতু আদিম মানুষ। যারা নানারকম রোগ অভাব দারিদ্রতা ও অপুষ্টিজনিত কষ্টে জর্জরিত। তারা এমনিই মরে আছে। তাদের মারার ব্যবস্থা? হ্যাঁ, একান্তই ব্যক্তিগত আক্রোশ আপনার ছেলের থাকতে পারে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। সেটা আপনিই ভাল জানেন। সেটা বলবেন কি?

গোরাচাঁদ তার উত্তর দিলেন না। বললেন,-আমি জানিনা আপনি ব্যক্তিগতভাবে এর কারণ জানতে চাইছেন, না অফিসিয়াল? এখানে আসার আপনাদের দেশের কি স্বার্থ?

সারগেই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,- না না এই জানতে চাওয়াটা একান্তই ব্যক্তিগত। তবে শুনুন এই এলাকায় চিরুনি তল্লাশিতে সম্মত হওয়ার পিছনে আমার দেশের কি স্বার্থ। আমাদের প্রতিবেশী মঙ্গোলিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি এলাকায় আর সাইবেরিয়াতে প্রচুর লেপ্রসি। প্রতিবছর আমাদের দেশে নিয়ম করে লেপ্রসির সংখ্যা গণনা করা হয়। এখন যদিওবা সংখ্যায় কম কিন্তু ওদের মধ্যে প্রচুর ড্রাগ রেজিস্টাণ্ট। কোনও ওষুধই কাজ করছেনা। তাছাড়া ইউক্রেন, কাজাখস্থান, তুর্কি, -এইসব প্রতিবেশী দেশগুলির সীমান্তের কাছে এতবেশি ক্যানাবিস, মারিজুয়ানা, হাসিস, এইসবের উপজ প্রচুর হয়যে তার ফলে এখন রাশিয়াতে আড়াই মিলিয়নের বেশি ড্রাগ এডিক্টেড। হেরোইন নেশায় সারা পৃথিবীতে প্রথম স্থান। এই অবস্থায় রাশিয়া এই দুই রোগ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে গেছে।

-এতে আমাদের দেশ কি করতে পারে?

-আমাদের কাছে যখন ইন্ডিয়ার টপ সিক্রেট দফ্তর থেকে আমন্ত্রণ এলো, বিশেষ করে আপনাদের এই এলাকায় জয়েন্ট মিলিটারি এক্সারসাইজ হবে, তখন আমরা এখানটা স্যাটেলাইট ছবিতে খুব ক্লোজ ওয়াচ করেছি। এখানের মাটি, জল, মেডিসিন্যাল প্ল্যাণ্ট - সবকিছু স্টাডি করেছি। এমনকি এখানের জিওগ্রাফিক্যাল ও পলিটিক্যাল অবস্থা সবকিছুই জেনে নিয়েছি। বহু আগে আপনাদের দেশে ইংরেজদের আমলের একজন ইংরেজ পর্যটক এই জায়গাতে এমন একধরনের প্ল্যাণ্ট আবিষ্কার করেছিলেন যেটা বিড়ি, হেরোইন, গাঁজা, চরসের নেশা ছাড়ানোতে অব্যর্থ ভেষজ। খুব কম সময়ের মধ্যে। আবার সেটা লেপ্রসি সারিয়ে তো দেয়ই, এমনকি ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গের নাকি রিজেনারেশন হয়ে যায়। এই আশ্চর্য ভেষজটির প্রমাণ ইন্ডিয়ার ভূতত্ত্ববিদেরাই দিয়েছেন।

সারগেই একনাগাড়ে এত কথা বলে থামল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,-দেখুন, মিঃ দাস। হিপনোটিজমে আমার স্পেশ্যাল ট্রেনিং নেওয়া আছে। আমি মানুষের চরিত্র ভালই বুঝি। আপনি যে উদার প্রকৃতির মানুষ আমি বুঝেছি বলেই এত গোপনীয় কথা বললাম। আজ সকালে আমাদের ডাক্তার বলেছে জেরকা ম্যাডামের বেশ কয়েকটা স্ট্যাব করা গভীর ক্ষত দুদিনের পুরোনো। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে তাজা। তাই অপারেশন করা ও স্টিচ করা সম্ভব হয়েছে। মেডিক্যাল সায়েন্স এটা বিশ্বাস করবে না। এত পুরোনো ঘা পচতে বাধ্য। সেলাই সম্ভব নয়। কিন্তু এটা ঘটনা। যেভাবে নোংরা নালায় পড়েছিল এখন তো সেপ্টিক হয়ে পচে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিশ্চয় কোনও হার্বাল ট্রিটমেন্ট করেছেন আপনারা। আপনাদের উপরে আমার কোনও আক্রোশ নেই বরং আপনাদের রক্ষা করার ভার আমাদের বাহিনীর। কিন্তু গোপনে। আইনত নয়। বিনিময়ে ওইসব ভেষজ আমাদের চাই। এবং তারপর পেটেণ্টের ব্যবস্থা আমাদের সরকার করবে।


0 comments: