Next
Previous
0

গল্প - হিন্দোল ভট্টাচার্য






















সকালবেলায় ঘুম ভাঙালো কলিংবেল। এত সকালে কলিংবেলের শব্দ শুনে বেশ বিরক্তি সহকারে রবি পাশে শুয়ে থাকা আরতিকে বলল, সাড়া দিতে হবে না।

আরতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তখন উঠে বসেছে।

সাড়া দিতে হবে না মানে কী? দরকারি কিছুও তো হতে পারে।

হুম।

আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল রবি। কলকাতার এক নামী কলেজের অফিস স্টাফ রবি। অধ্যাপকদের থেকে মাইনে অনেক কম পেলেও কাজ যে কম করতে হয়, তা নয়। শিক্ষাক্ষেত্রের কেরানিরা চিরকালই উপেক্ষিত। আরতি স্কুলটিচার। এই রোববারের ছুটিটা তবু দুজনেই বেশ উপভোগ করে। কিন্তু ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় কে এমন বেল বাজাচ্ছে? খবরকাগজওলাকেও বলা আছে । বেল বাজায় না শুধু তিনতলা থেকে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগের ভিতর খবরকাগজটা পুরে দিয়ে চলে যায়। রবি অনেক পরে উঠে বাজার যাবে হয়তো দশটার পর।

আবার হয়তো ঘুমিয়েই পড়ছিল রবি, কিন্তু চটকা ভাঙল আরতির তীক্ষ্ণ গলার স্বরে।

শুনেছ, কী হয়েছে, আরে বাবা ওঠো ওঠো।

রবি ধড়মড় করে উঠে বসল।

কী এমন হয়েছে?

সামনের ফ্ল্যাটের তনুজা এসে বলে গেল, আমাদের বাড়ির ছাদে নাকি একটা মড়া পড়ে আছে।

ছাদে? মড়া?

হ্যাঁ।

কার?

আমাদের এই আবাসনের কারো নয়।

মানে?

সকালবেলা জগিং করতে ওঠেন রুমাদি। উঠেই দেখেন এই অবস্থা।

এর মানে কী? পুলিশে ফোন করেছ?

হ্যাঁ।

নীচের দরজায় তালা দেওয়া আছে?

আছে তো।

তাহলে এলো কোথা থেকে?

জানি না।

রহস্যগল্প রবির চিরকালই পছন্দ। কিন্তু জীবনে কোনও তেমন রহস্যের মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়নি তাকে। এই প্রথম রহস্যের আঁচ পেয়ে বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়েই পড়ল রবি।

যেও না, যেও না।

আরে পুলিশ আসার আগে একবার দেখে আসি।

দরজাটা খুলেই গুঞ্জন টের পেল রবি।

সিঁড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়েই দেখল পাঁচতলার সিঁড়ির মুখে প্রায় আবাসনের সকলেই।

এই তো, শুনেছেন?

মিহিরবাবু। ইঞ্জিনিয়ার। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।। পাশেই অরিন্দম রায়। হার্ডওয়্যারের ব্যবসা। চোখ দুটো লাল। সিঁড়ি থেকে একটু নীচে লীনা বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখিকা। আরও চার পাঁচজন। সকলেরই মুখে কুলুপ।

আপনারা দেখে এসেছেন?

সকলে মোটামুটি মাথা নেড়ে জবাব দিল হ্যাঁ।

আমি কি একটু দেখে আসব?

কাছে যাবেন না। বুঝতেই পাচ্ছেন পুলিশ আসছে। ফরেনসিক আসবে।

লীনার মুখে এই কথা শুনে রবি বলল- জানি, আমি একবার দেখব চিনি কিনা।

সকলে হাঁ হাঁ করে উঠল।

আমাদের এই পাড়ার তো কেউ না। কোনওদিন মুখ দেখিনি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ছাদে উঠল রবি।

ওদিকে সূর্যটা ধীরে ধীরে মেজাজ পেতে শুরু করেছে। ছাদে পা দিতেই কিছু কাক উড়ে গেল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে এগোতেই সেই মড়াটাকে দেখতে পেল রবি।

কার মৃতদেহ এটি? কয়েক পা দূরেই শরীরটা পড়ে আছে। ঘুমিয়েই রয়েছে হয়তো। যতদূর মুখটা দেখা যাচ্ছে, মুখে কোনও যন্ত্রণার ছাপ নেই। রক্তের দাগ নেই। কেউ কি খুন করেছে? কীভাবে খুন করেছে? আশেপাশে কিছু পড়ে নেই। গন্ধ এখনো তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু রোদ যেভাবে উঠছে, তাতে গন্ধ কিছুক্ষণ পরেই পাওয়া যাবে। একটু এগিয়ে গেলে দেখলে ভালো হত। কিন্তু আশেপাশে পায়ের ছাপ যদি কারো থেকে থাকে, তাহলে প্রমাণগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

তুমি কী করছ? নেমে এসো।

চাপা গলায় পিছনে দাঁড়িয়ে বলছে আরতি। কখন যে রবির পিছন পিছন উঠে এসেছে তা জানে না রবি।

পুলিশ আসছে, নেমে এসো।

অগত্যা নেমে এলো রবি।

তার পরের দু বা তিন ঘণ্টা ধরে চলল পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ। ফরেনসিকের ছবি তোলা। ইত্যাদি। পুলিশ লাশ নিয়ে চলে গেল। তদন্ত নিশ্চয় হবে। তবে পুলিশের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, আবাসনের লোকজনকেই সন্দেহ করছে। রবির মনটাও খুঁতখুঁত করছিল। নীচের দরজা বন্ধ। ছাতের দরজা বন্ধ থাকে সারারাত। কে এই এত বড়ো লাশটকে নিয়ে এই বাড়ির ছ তলার ছাদে এসে শুইয়ে চলে গেল? নিশ্চয় এই আবাসনের কেউই এই কাজ করেছে। হয়তো তাদেরই চেনা কেউ।

মনে মনে একটা উত্তেজনা টের পেল রবি।

কিন্তু উত্তেজনাটা থিতিয়ে গেল যখন আরতি বলল,- পুলিশ বলেছে তদন্তের কিনারা না হওয়া অব্দি কেউ কলকাতার বাইরে যেতে পারবেন না।

রবি আর আরতি প্ল্যান করছিল আগামী উইকেন্ডে একটু দীঘা বা বকখালি ঘুরে আসবে। কিন্তু এ যা জটিল রহস্য, সহজে সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাজারের দিকে এগোল রবি। আজ কি আর এত বেলায় মাংস পাওয়া যাবে?



“অজ্ঞাত পরিচয় একটি লাশ পাওয়া গেছে কলকাতার উপকণ্ঠে একটি আবাসনের ছাদে। ছাদের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল এবং আবাসনের নীচের দরজাও তালাবন্ধ ছিল। অন্য কারোর আসা যাওয়ার চিহ্ন পায়নি পুলিশ। লাশটা এই আবাসন বা এলাকার কারো পরিচিত নয়। লাশটা কার এ নিয়ে এলাকার লোকেদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, এই খুন ওই আবাসনেরই কারোর কীর্তি। কিন্তু টানা একদিন দুদিন ধরে জেরা এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় কিছুই পাওয়া যায়নি।“ খবর শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে গেল রবি। পাশেই আরতি চা দিতে দিতে বলে উঠল—আমার তো এখন ছাদে যেতেই ভয় লাগছিল। পুলিশ নাকি বারবার আসবে। প্রশ্ন করবে।

সে তো আসবেই। ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক। লাশ তো আর উড়ে উড়ে আসতে পারে না। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট আমাদের কী জানাবে? কীভাবে মরল, কী কারণে মরল?

তুমি আবার এসব যেচে জিজ্ঞেস করতে যেও না। কেস তো কারো ওপরে চাপাতে পারলেই পুলিশ খুশি। আমাকে আজ স্কুলে একজন বলল, শুনলাম তোমাদের অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছে? আর খুনি নাকি তোমাদেরই বাড়ির কেউ?

কে জানে কী হচ্ছে? আবার শুনলাম পিছনের বড় পুকুরটাও বিক্রি হয়ে যাবে আর ওই গাছগুলোকেও কেটে ফেলবে।

কেন গাছ কী দোষ করল? আর আমাদের বিক্রির সময়ে তো বলেছিল প্রকৃতির মধ্যে আধুনিক যাপন। এখন পুকুর বুজিয়ে দেবে?

শুনছি তো ওখানে একটা নতুন আবাসন হবে।

তাহলে আমাদের প্রকৃতি?

আর প্রকৃতি । তুমি কি প্রকৃতি ধুয়ে জল খাবে? এমনিতেই নির্জন জায়গা। বাড়ির ছাদে লাশ পড়ে থাকে। কে খুনি আর কে নয় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবু চারিদিকে বাড়িঘর থাকলে তো এসব একটু বন্ধ হবে।

আরতি, আমাদের এই বাড়ির লোকগুলোর মধ্যেই কেউ একজন খুনি, মনে রেখো। গাছপালা, পুকুর, আলো –অন্ধকার হাওয়া এসব কি খুন করতে পারে?

আমি তা বলিনি। আমি এত মূর্খ নই।

তোমাকে আমি মূর্খ কখন বললাম?

তোমার কথার টোন আমি বুঝতে পারি না? করো তো ক্লার্কের চাকরি। আমি তবু স্কুলটিচার। লোককে বলো কলেজ যাচ্ছি। যেন প্রফেসর।

আমি কলেজ বলি না, অফিস বলি।

কলিংবেলের শব্দে দুজনেই চমকে উঠল।

অ্যাপার্টমেন্টের সমস্ত লোকেরা নাকি নীচের কমিউনিটি হলে মিলিত হচ্ছেন।

রবি আর আরতি যখন গেল, তখন সকলেই চলে এসেছেন। সকলেরই মুখ বেশ গম্ভীর। থমথমে ভাব।

৩বি ফ্ল্যাটের সুহাসিনী বললেন- দেখুন, ব্যাপারটা খুব অড। খবর পেলাম পোস্টমর্টেমে পেয়েছে হার্ট অ্যাটাক। অর্থাৎ লোকটা খুনই হয়নি।

রমেশবাবু, নবান্নের চাকুরে বলেন—এতো অন্যায়। খুনই যখন হয়নি, তখন আমাদের নামে খুনের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে কেন?

রবি বলল,- আরে বাবা, তার তো একটাই কারণ, লাশকে পাওয়া গেছে আমাদের ছাদে।

অসীমবাবু থাকেন একদম উপরের ফ্ল্যাটে। বললেন,- আরে লোকটার পরিচয় কী? তা কী জানা গেছে?

সুহাসিনী বললেন—না , তা জানা যায়নি। সম্পূর্ণ অজ্ঞাতপরিচয় লাশ। ভাগ্যিস আমার বরের বন্ধু আইপিএস। সব খবর নিয়ে বলল, এ এক অত্যন্ত রহস্যময় কেস। কারণ পোস্টমর্টেম বলছে, লোকটা মারা গেছে আজ থেকে তিরিশ থেকে বত্রিশ বছর আগে।

সকলে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারছিল না।

আমতা আমতা করে আরতি বলল- তার মানে? এ আবার হয় নাকি? পচে গলে তো দুর্গন্ধ বেরোনোর কথা। ১৯৯১ সালের একটা লাশ পড়ে আছে আমাদের বাড়ির ছাদে? তিরিশ থেকে বত্রিশ বছর আগে মানে তো ১৯৯০-৯২।

সম্ভবত বিরানব্বই।

বিরানব্বইয়ের লাশ তেইশ সালে আবাসনের ছাদে?

ঠিক যেন এখনই মরে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

এখনই?

তার মানে কী, মৃতদেহটা এতদিন জীবিত ছিল?

মানে, বিরানব্বইয়ের মৃতদেহ মরেনি এখনো।

-হয়তো আরও অনেকদিন জীবিত থাকবে।

- আচ্ছা আপনারা কেন বলছেন জীবিত? লোকটা তো মৃতই। সে কারণেই তো লোকটা লাশ।

কমিউনিটি হলের ভিতর তখন বেশ উত্তেজক পরিস্থিতি।

একতলার রবিনবাবু বলে উঠলেন, দেখুন বিরানব্বইয়ে কোনও একটা লোক যদি মরে গিয়ে থাকে, তাহলে তার মৃত্যুর দায় তো আজ আমরা নেব না। আমাদের হ্যারাস করার জন্য আগে ক্ষমা চাইতে হবে পুলিশকে । নাহলে আমরা মামলা করব।

সকলেই ব্যাপারটাকে বেশ সমর্থনই করল। যদিও, এই রহস্য নিয়ে কেউ একটিও কথা বলল না, যে কীভাবে বাড়ির ছাদে বিরানব্বই বা নব্বই সালের কোনও একটি লাশ এসে শুয়ে থাকতে পারে।

কমিউনিটি হলে ঠিক হলো, পরের দিন সকলে অফিস স্কুল না গিয়ে থানার সামনে ধর্না দেবে। নিজেদের কানেকশন কাজে লাগিয়ে এই বিষয়ে প্রেসকেও খবর দেবে।




কলকাতার প্রায় বাইরে চলে যাওয়া একটি এলাকায় কীভাবে একজন অজ্ঞাতনামা লাশ তার মৃত্যুর প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর পরে চলে এলো, তা প্রায় সবার কাছেই খুবই রহস্যময় লাগল। বারবার পোস্টমর্টেম হলো সেই বডির। কিন্তু প্রত্যেকবার একই ফলাফল। এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিতর্কসভা থেকে রাজনীতিবিদদের তরজা সবকিছুই চলতে থাকল। রবিদের আবাসনের সকলে মিলে যে ডেপুটেশন দিয়েছিল থানায় তা চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ করার পরে বিষিয়টি নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়ে যায়। কেউ বলে পিএম রিপোর্ট ট্যাম্পার করা হয়েছে আবার কেউ বলে বিরোধী পার্টির ষড়যন্ত্র। এদিকে ক্রমশ এবং ক্রমশ রবিদের আবাসনের লোকেরা চিহ্নিত হয়ে যায় খুনি হিসেবে। খুনি আবাসনের লোক বলে এলাকায় নামকরণই হয়ে যায়। তিনতলার বিদিশাবৌদি মুদির দোকানে অর্ডার দিতে গেলে শোনেন ভিতর থেকে একজন বলছে- এই ওই খুনি আবাসনের তিনতলার অর্ডারটা নিয়ে নে। বাচ্চাদের স্কুলেও তাদের দাগিয়ে দেওয়া হতে থাকে খুনি আবাসনের বাচ্চা হিসেবে। এ নিয়ে একদিন রবিদের আবাসনের সব লোক মিলে থানায় আবার ডেপুটেশন দেন এবং প্রেস আসে। ‘আমরা খুনি নয়, খুনি আবাসন বলে আমাদের মানহানি করা বন্ধ হোক’ জাতীয় প্ল্যাকার্ড নিয়ে সকলে মৌনতা অবলম্বন করেন। কিন্তু এতে খুনি আবাসন নামকরণটা আরও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রবির মাথায় ঘুরতে থাকে শুধু একটাই কথা, বিরানব্বইয়ের লাশ কীভাবে দুহাজার তেইশের আবাসনের ছাদে পড়ে থাকে অবিকৃত অবস্থায়?

এদিকে আবাসনের লোকেরা খুনি এবং ভয়ংকর, এই অপবাদ চারিদিকেই রটে যাওয়ায় কেউ এই আবাসনের দিকে আসতে চায় না। কোনও কাজের লোক পাওয়া যায় না বলে, আবাসনের সকলের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়। কমিউনিটি হলে এই বিষয় নিয়ে আলোচনার পরে রবি বসেছিল বারান্দায়। আরতি চা নিয়ে বারান্দায় এসে বলল, - আর পারছি না বুঝলে?

পারছ না জানি। কেউই সম্ভবত পারছে না।

রাজু এসে বলল, চারিদিকে ট্রোলিং চলছে।

আচ্ছা, এই ট্রোলিং ট্রেন্ডিং এসব ঠিক কবে থেকে ঢুকল বলো তো আমাদের জীবনে?

এই কয়েক বছর হলো।

তার আগে আমাদের একঘরে করে রাখা হতো।

হ্যাঁ ওই একই ব্যাপার।

ভেবে দেখো, লাশটা কবেকার

এটাই তো কেউ বিশ্বাস করছে না।

জানি, বলছে আমাদের লম্বা হাত, ঘুষ দিয়েছি। ওপরমহলে চেনাশোনা। কোনো ঘাপলা আছে। খুনি।

কিন্তু পুলিশও কিছু বলছে না।

পুলিশ তো কিছুই বুঝতে পারছে না। বলবে কী? আর না বলতে পারাটাকে তো ঢেকে রাখতে হবে। তাই চুপ।

এভাবে তো এখানে থাকা যাবে না। মরে যাব আমরা।

ভাবো, আমরা মরে গেলাম আর আমাদের লাশ পড়ে রইল ওই লোকটার মতো।

আমি এতকিছু জানি না। চারতলার একটা ফ্ল্যাট নাকি বিক্রি হয়ে যাবে। ওরা চলে যাবে। কোথায় যাবে তা এখানে কাউকে বলেনি।

হ্যাঁ, কাউকে না বলাই ভালো। বললে, সেখানেও সমস্যা হতে পারে।

কিন্তু, আমরা তো নিজেদের দেশেই পরাধীন হয়ে রইলাম রবি।

পরাধীনই তো।

আচ্ছা, তুমি বারবার কেন বলছ ওই বিরানব্বই সালের কথা?

তিরিশ বছর আগের একটা লাশ। একটা মৃতদেহ। বিরানব্বই সাল থেকে আমরাই তো বয়ে বেড়াচ্ছি আরতি।

আমিও তো বয়ে বেড়াচ্ছি অনেক কিছুই।

তোমায় আবার কী বয়ে বেড়াতে হচ্ছে?

আরতি আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। রবির মনে হলো, আরতি কি কিছু বলতে চায়? আরতির মনের মধ্যে কি কোনও সন্দেহ দানা বাঁধছে রবিকে নিয়েই? কিন্তু এতটা সন্দেহ হওয়ার তো কিছুই ছিল না। অবশ্য ধীরে ধীরে সকলের মধ্যেই তো দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। দুজনের এই সংসারে আরতিরও অনেক চাওয়া বা না চাওয়া থাকতেই পারে। কিন্তু তা নিয়ে আরতি খুব একটা হতাশা প্রকাশ কখনোই করে না। তবে কি রবির এই উদাসীনতাই তাকে এমন বিমুখ করে দিয়েছে?




এই আবাসনটা প্রায় অনেকেরই দেখার বস্তু হয়ে গেছে। লোকে দূর দূর থেকে এসে দেখে যায়। সেদিন অটো থেকে কয়েকজন নেমে বাড়িটাকে আঙুল দিয়ে দেখতে ও দেখাতে দেখাতে ঘুরছিল। আর বাড়ির লোকজনকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিল। নীচে খেলতে নেমেছিল আবাসনের তিন চারটে বাচ্চা ছেলে। তারা নাকি শুনেছে ওরা বলছিল, - এই হলো খুনিদের হাউসিং কমপ্লেক্স। এখানে খুনিরা থাকে। আর একজন একটা বাচ্চাকে দেখাচ্ছিল- ওই যে দেখছ ছাদ, ওখানে ওরা একটা লোককে মেরে রেখে দিয়েছিল।

যথারীতি বাড়ির সামনে এর পর ঝালমুড়ি, রোল সিগারেটের দোকান বসে যাবে। লোকে নাকি দূর থেকে দূরবীন দিয়েও এই বাড়িটার লোকজনকে দেখছে। এই কথা শোনার পর থেকে আরতির মতো অনেকেই জানলা বন্ধ করে রাখছিল। বারান্দায় আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল।

কমিউনিটি হলে এই নিয়ে যে সভা হল, তাতে রবি বলেই ফেলল,- তবে কি আমাদের নিজেদের মতো করে লুকিয়ে পালিয়ে অন্য কোনও জায়গায় চলে যেতে হবে?

বিধানবাবু বললেন,- কিন্তু সে না হয় গেলাম। এই ফ্ল্যাট কিনবে কে?

সকলেরই কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

অসীমবাবু বললেন,- আমার মনে হয় আবাসনের মালিকদের কাছেই যদি বিক্রি করে দেওয়া যায়, তাহলে ভালো হয়।

কিন্তু, আবাসনের মালিক বা প্রোমোটার – ওরাই বা কিনবে কেন? আর তাছাড়া মৃতদেহটার রহস্যটাও তো জানা গেল না। আমাদের তো এবার রাইট টু ইনফর্মেশনে যাওয়া উচিত। ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।

রবি এতক্ষণ শুনে বলল, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে বিরানব্বইয়ে।

আরতি এবার—তুমি চুপ করো, আবার বিরানব্বই নিয়ে পড়েছে।

বিধানবাবু বললেন, বিরানব্বই? কেন?

কারণ, মৃত্যু সম্ভবত হয়েছিল বিরানব্বইয়ে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল লোকটার। ঠিক, কিন্তু কেন হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তা আমরা জানি না।

বিরানব্বইয়ে হার্ট অ্যাটাকের কারণ কী?

বিরানব্বইতে কী কী হয়েছিল?

পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়।

একানব্বইতে গ্যাট ডাঙ্কেল চুক্তি। গ্লোবালাইজেশন।

বা, হয়তো দাঙ্গা।

দাঙ্গায় তো আর হার্ট অ্যাটাক হয় না।

না, এই দাঙ্গার ভয়ে তো হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে।

বা, কেউ দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিল। তার শোকে।

হতে পারে।

কিন্তু তাহলে লাশটা এত বছর অবিকৃত থাকবে কী করে?

আচ্ছা, কেউ কি স্টাফড করে রেখেছিল?

ভিতরের সব অর্গ্যান তো বলল ঠিক আছে।

তাহলে পুরো ব্যপারটাই অ্যাবসার্ড।

লাশ যে পাওয়া গেছে, তা তো মিথ্যে নয়।

রবি বেরিয়ে এসেছিল মিটিং থেকে। আবাসনের পিছনের পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। একটা অসামান্য কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। সেটাকেও কেটে ফেলা হয়েছে। অনেকগুলি গাছের উপর আক্রমণ চলছে প্রতিদিন। জায়গাটা আর কিছুদিন পরেই ফর্সা করে দেবে। বাজারে গিয়ে জিনিস কিনতে হাতে ছ্যাঁকা লাগছে। করোনার পর থেকে শরীরটাও ভালো নেই। কলেজে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকে রবি। চোখের সামনে ভাসে লোকটার সেই ছাদের উপরে শুয়ে থাকা। প্রাণহীন।

কার প্রাণ আছে? একটি দেশের ভিতরে আরও একটি দেশ। আর তার ভিতরে কিছু অসহায় মানুষ। যারা বেঁচে আছে, কিন্তু যাকে বেঁচে থাকা বলে না আদৌ। এই দেশ উপদ্রুত এলাকা। এই দেশের কেউ কিছু না করলেও, অজান্তেই তারা বিগত দিনের লাশ বয়ে বেড়াচ্ছে। ক্রমশ ঘিরে ধরছে তাদের অন্য একটা দেশ, যাকে তারা নিজেরই দেশ বলে ভাবত।

এখন রাতে ভালো করে ঘুমও হয় না রবির। অবশ্য রবি জানতে পেরেছে এখন এই আবাসনের কারোরই ভালোভাবে ঘুম হয় না। ঘুমোলেই দুঃস্বপ্ন। যেন সকলে তাদের ঘিরে ধরে বলছে- তোমরা খুনি। খুনি। খুনি। ওদিকে পুকুর বুজিয়ে ফেলেছে। গাছ কাটা চলছে। দোতলার রুমিবৌদি এসে বললেন, আমাদের এই বাড়িটা অপয়া। চলুন এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে আমরা সবাই চলে যাই। অপদেবতা ভর করেছে এই বাড়ির উপর। কিন্তু এখন কে যজ্ঞ করবে এই বাড়িতে এসে? কেউ আসবে না। সকলে মিলে যেন চেপে ধরেছে চারিদিক থেকে।

ঘাম হচ্ছে রবির। তাহলে কি একদিন তাদের এই বাড়িটাকেও একদিন ভেঙে ফেলবে খুনির বাড়ি বলে? তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে বাড়ির উপর হামলা চালাবে কিছু উন্মত্ত মানুষ? সারা পাড়ায়, সারা এলাকায় তাদের নিয়ে চর্চা। তারা খুনি। তারা হত্যাকারী। তারা এই আবাসনে তবু স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে আর পুলিশ গুম করে দিয়েছে সত্যিটাকে। কিন্তু সত্যি কী? সত্যি কি সেটিই, যা তৈরি করে কিছু সংখ্যাগুরু মানুষ? এক হাজার লোক যদি একসঙ্গে বলে কোনও মিথ্যাকে সত্যি, তবে কি তা সত্যি হয়ে যায়? আর যদি দুজন বলে না এটি সত্যি নয়, তাহলে তাদের এই বলার মধ্যে কোনও সত্যি থাকে না?

আর এই সব ভাবতে ভাবতে বারান্দাতেই রবি ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল সাইরেনের শব্দে।

আরতি এসে ধাক্কা মারছে।

ঘুমিয়ে পড়েছিলে, ওঠো। আমাদের ঘিরে ফেলেছে ওরা?

ওরা মানে?

দেখো দেখো।

বেশ কয়েকটি আধা সেনার গাড়ি এসে জমা হয়েছে এলাকায়। সমস্ত আধা সেনার গাড়ি থেকে জংলা পোশাক পরা অস্ত্রধারী লোকজন নেমে পড়ছে। বুটের শব্দ চারিদিকে। যেন চারিদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতি। তারা দ্রুত ঘিরে ফেলেছে এই আবাসন। এই আবাসনের সকলে এখন বারান্দায়। সকলের মুখে চোখে আতঙ্ক। তাহলে কি গুলি চালাবে এবার?

এলাকার বিভিন্ন প্রান থেকে দূরে লোকজন জমায়েত হয়েছে। দূর থেকে তাদের উল্লাস এবং ধিক্কার দুটোই শুনতে পাচ্ছে রবি। তাদের প্রত্যেকের হাতে হয় লাঠি নয় ইঁট। দ্রুত রবি দরজার কাছে গিয়ে সিঁড়িতে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল তার মতো করেই অনেকে নেমে আসছেন।

আপনি দেখেছেন আমাদের ঘিরে ফেলেছে।

শুধু পুলিশ নয়, মিলিটারি নয়, অনেক লোকও এগিয়ে এসেছে।

বলছে এই আবাসনের লোকেরা খুনি। দেশদ্রোহী। ওরা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এখানে ঢুকে পড়ে আমাদের গুলি করে দেবে।

সকলের মুখেই আতঙ্ক। সকলে বাচ্চা নিয়ে পরিবার নিয়ে দিশেহারা।

আমাদের কিছুই কি করার নেই বিধানবাবু? আমাদের কিছুই কি করার নেই? আমরা তো কিছুই করিনি। তবু আমরা খুনি? আমরা দেশদ্রোহী? আমরা...

আচ্ছা, ওরা যদি আধা সেনাবাহিনী দিয়ে ঘিরে ধরে, তার পর ওই লোকগুলোকে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে?

তাহলে তো আরও খারাপ। করতেই পারে, নিজেদের হাতে হত্যার দায় নিল না, কিন্তু অন্যদের দিয়ে হত্যার দায় চাপিয়ে রটিয়ে দেবে জনরোষে হত্যা।

মিডিয়াও এসেছে।লাইভ কভারেজ করছে।

কিন্তু আমাদের হাতে তো কিছু নেই। কোনও অস্ত্র নেই। তাহলে আমরা কী করব?

ঠিক এই সময়েই ভেসে এলো লাউডস্পিকারে ঘোষণা।

আবাসনের বাসিন্দাদের বলছি। আপনাদের কাছে যদি কোনও অস্ত্র থাকে তবে তা আমাদের কাছে সমর্পণ করুন। আত্মসমর্পণ করলে আপনাদের কোনও ক্ষতি হবে না। গোটা এলাকাতেই অসংখ্য সাধারণ মানুষ উন্মত্ত অবস্থায় আপনাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা বড়জোর আধঘণ্টা তাদের আটকে রাখতে পারি। কয়েক হাজার মানুষ চায় আপনাদের। কারণ আপনারা ঠান্ডা মাথায় খুন করে রয়ে গেছেন, তাতে এলাকার লোকজন আইন নিজেদের হাতেই তুলে নিয়েছেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে ধরা দিন। নয়তো বিপদ বাড়বে।

রবি তাকালো আবাসনের বাকিদের দিকে। সিঁড়িতে সকলেই দাঁড়িয়ে একতলা থেকে পাঁচতলা।

কী করব কিছুই মাথায় আসছে না। বললেন অসীমবাবু।

কোথায় একটা কয়েকজন বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল।

বিধানবাবু বললেন,- কোনও প্রমাণ না পেয়ে এতগুলো মানুষকে ওরা মেরে ফেলার জন্য এগিয়ে আসে কী করে?

এবার রবির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। সে চিৎকার করে বলে ওঠে—কী করে এই প্রশ্নটাই কি এখন করা যায় আর?

কিন্তু আমাদের মেরে এদের কী লাভ হবে রবি?

রবি এবার হাসতে শুরু করে।

আমাদের ওরা মারছে না। আমাদের তো এরা চেনেই না। আমাদের এই আবাসনকে ওরা মারবে। আমাদের যে একটা ইতিহাস আছে, তাকে ওরা মারবে। আমাদের মেরে ফেলতে পারলে একটা উদাহরণ খাড়া করা যাবে দেশের মানুষের কাছে। আমরা গিনিপিগ। বিজ্ঞানের গিনিপিগ নয়। শাসকের গিনিপিগ। এই কারণেই নব্বই বিরানব্বই সালের লাশ আমাদের ছাদে পড়ে থাকে। আমরা লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া ডোমের মতো। এই বাড়িটাকে ওরা ধ্বংস করবেই।

সে তো বুঝলাম, রবিবাবু, কিন্তু আমাদের এই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কী এখন কী করব?

প্রাণে বাঁচব যদি আত্মসমর্পণ করি।

বললেন বিধানবাবু। তার চোখে মুখে ভয়।

আরতি বলল,- ঠিকই। আমরা যদি আত্মসমর্পণ করি, তাহলে অন্তত প্রাণে বেঁচে যাব।

রবি বলল- কিন্তু তাহলে আমরা চিরদিনের মতো চিহ্নিত হয়ে যাব খুনি হিসেবে। খুন তো আমরা করিনি। আত্মসমর্পণ করব কেন?

আরতি বলল- আমার জন্য। এতগুলো লোকের জন্য। এটা যুদ্ধের সময়। আমরা যুদ্ধ করিনি, কিন্তু হেরে গেছি। এই দেশে জন্ম নেওয়াটাই হেরে যাওয়া। আত্মসমর্পণ করো।

তোমার ইতিহাস ওরা রচনা করবে। তোমার আসল ইতিহাস ওরা মুছে দেবে আরতি।

তবু, প্রাণে বাঁচব তো।

আমি সারেন্ডার করব না

এদিকে আবাসনের সকলে গুটি গুটি পায়ে এগোতে শুরু করে দিয়েছে নীচের দিকে।

আরতি রবির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি আত্মসমর্পণ না করলে তোমায় ওরা খুনি বলবে।

এটাই তো ভালো। একজন খুনি হলে, অন্তত বাকি আরও চল্লিশজনের ইতিহাস বেঁচে যাবে।

কিন্তু আমার কী হবে?

তোমাকে ওরা তখন ছেড়ে দেবে।

আর আমি? তোমাকে ছাড়া আমি কোথায় থাকব?

তা বলতে পারব না। কিন্তু তুমি চলে যাও। কারণ না হলে তোমাকেও খুনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে দেবে ওরা।

এই কথা বলে ছাদের দিকে একটু একটু করে এগোতে শুরু করে দিল রবি।

আরতি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এক পা এগোবার চেষ্টা করল ছাদের দিকে যাওয়ার। কিন্তু আর এগোতে পারল না। কে যেন তাকে টানতে থাকল নীচের দিকে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি? না কি প্রাণের ভয়?

আরতিও নামতে শুরু করল।



ছাদ আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ভোরের আলও। ছাদে উঠই চারিদিকে তাকাল রবি। মনে আর কোনও আতঙ্ক নেই। দূরের দিকে তাকালেই মন থেকে সমস্ত ভাবনা দূর হয়ে যায়। মাথার উপরে বেশ কিছু পাখি সারবন্দী ভাবে উড়তে উড়তে চলে গেল। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। কিন্তু রোদকে ঢেকে দেওয়ার শক্তি তাদের নেই। মানুষ যত আকাশের দিকে তাকায়, তত মানুষ, মানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু নীচের দিকে তো তাকাতেই হবে। মানুষ তো আসলে মানুষ নয় বহুদিন। নীচের দিকে তাকালেই রবি দেখল সারবন্দী অবস্থায় এই আবাসনের বাসিন্দারা ধরা দিচ্ছে। তাদের একটা বিশাল বড়ো ভ্যানে তুলে নেওয়া হচ্ছে। সকলের শেষে রয়েছে আরতি। সে মাঝেমাঝে পিছনের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে লাইনে। ‘আরতি আর তাকিও না। তোমাদের সকলের ব্যক্তিগত ইতিহাস বেঁচে থাকুক। অনেকের ইতিহাসকে রক্ষা করার জন্য কোনও একজনকে তার নিজের ইতিহাসকে ত্যাগ করতেই হয়। রবি আস্তে আস্তে ছাদের যে বিশাল বড়ো ট্যাঙ্ক রয়েছে সেই ট্যাঙ্কে উঠে গেল। জায়গাটা একটু প্রশস্ত বলে দাঁড়াতে সুবিধা হবে। রবি চাইছে, রবিকে যেন দেখতে পায় সকলে। ট্যাঙ্কের ছাদের উপরে উঠতেই সকলের নজরে পড়ে গেল রবি। নীচের উন্মাদনা শুনেই সে বুঝে নিল তাকে দেখে সকলের ভিতর একটা আলোড়ন পড়ে গেছে। তাকে দেখেই আধা সেনার বন্দুকের নল ঘুরে গেল তারই দিকে। নীচ থেকে সকলের সমবেত গলার আওয়াজ শুনতে পেল রবি—“ খুনি খুনি। আজ ধরা পড়েছে খুনি।“ এদিকে আরতিদের নিয়ে দু দুটো ভ্যান সেই বাহিনী ও জনতার মধ্য দিয়েই পাড়ি দিল অন্য কোথাও। কিন্তু কেউই তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ল না বা আক্রমণ করল না। এটাই চেয়েছিল রবি।

ট্যাঙ্কের উপরে উঠলেই জানে রবি, এক তীব্র হাওয়া দেয়। সেই হাওয়ায় মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। খুব ছোটোবেলায় যখন সে তাদের সরকারি আবাসনের ছাদে ট্যাঙ্কের উপরে উঠত, হাওয়ায় মনে হতো সে উড়ে যাবে। তখন ছিল লোডশেডিং-এর যুগ। গরমের মধ্যে না শুয়ে সে শুয়ে পড়ত ট্যাঙ্কের উপর। চিৎ হয়ে শুয়ে সে দেখত আকাশ। নক্ষত্রগুলো যেন নেমে আসত তার শরীরের উপর। ওই তো বৃহস্পতি, শনি। ওই তো লাল রঙের মঙ্গল। ওই তো কালপুরুষ। কত কত আলোকবর্ষ দূরে। আকাশ মানেই অতীত। যদি তার দৃষ্টিশক্তি থাকত, হয়তো তেরো বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের সেই প্রথম গ্যাসীয়পুঞ্জও সে দেখতে পেত। আর যদি সে চলে যেতে পারত একটা মহাকাশযানের মতো, তাহলে কেমন হতো? এই সব চিন্তা করতে করতেই সে ঘুমিয়ে পড়ত।

বুটের শব্দে তার চটকা ভাঙল। তারা আবাসনের দিকে ছুটে আসছে। বাহিনীর সঙ্গে ঘিরে ফেলেছে তাদের আবাসন জনতা। হাতে টাঙ্গি, হাতুড়ি, সবকিছুই। তারা এই আবাসনকে ভেঙেই ফেলবে। বিরানব্বইয়ের মতো।

কিন্তু রবি তার ইতিহাসকে নষ্ট করতে দেবে না।

দুটো হাত পাখির ডানার মতো বাড়িয়ে দিল দুই দিকে। হাওয়া দিচ্ছে প্রবল। ওদিকে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে আসছে বাহিনী। উন্মত্ত জনতার উল্লাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে সে।

রবি চোখ বন্ধ করল। পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো। তার পর হাতদুটো নাড়িয়েই উড়তে শুরু করল।

চোখ বন্ধ করেই রবি টের পেল বন্দুকের আওয়াজ। কিন্তু একটিও গুলি আর তার গায়ে লাগল না।