Next
Previous
1

পথে প্রবাসে - অচিন্ত্য দাস

Posted in









চাঁদিপুরের মতো সমুদ্র আমি কোনোদিন দেখিনি। জল ছুঁতে যেতে হয় কম করে মাইল খানেক। বিকেলের দিকে চাঁদিপুর পৌঁছে বালির ওপর হেঁটেহেঁটে জলের দিকেই যাচ্ছিলাম। প্রথম দিকে বালি খুব মিহি আর এঁটেল মাটির মত শক্ত। গাড়ি, মোটর সাইকেলের চাকার দাগ ছাড়া আর কিছু নেই। আর একটু যেতেই দেখা গেল বালি অপেক্ষাকৃত নরম আর বালুতট জুড়ে ডোরা ডোরা দাগ। বোঝা যায় জল এই অবধি আসে, হয়তো রোজ। এই ডোরা দাগগুলো জলের আসা-যাওয়ার চিহ্ন। সৈকত রেখা বলে কি কোনো কথা আছে? ঠিক জানি না তবে ইংরেজিতে “বীচ মার্ক” কথাটা শুনেছি। মনে হচ্ছিল সমুদ্রদেব আসবেন, তাই তাঁর দূতেরা আগে এসে বালিতে আলপনা এঁকে রেখে গেছে। কিন্তু কখন আসবেন? গুগলবাবাকে প্রশ্নটা ঠিক কী ভাবে করবো বুঝতে না পেরে এক ডাবওয়ালাকে জিগেস করলাম। সে বলল “আজ আর আসবেনি, কাল আসতে আসতে সাড়ে নটা দশটা বাজবে।”

আমাদের চাঁদিপুর ভ্রমণে, এই ডাব বিক্রতার একটি মুখ্য ভূমিকা ছিল। বলছি। আমার এক বন্ধু বলল “একটা জিনিস চেখে দেখতে চাস?” সম্মতির অপেক্ষা না করে সবার জন্য এক একটা ডাব কিনে ফেলল। ডাবের জল খাওয়ার জন্য যথারীতি কাটা অংশটায় একটা প্লাস্টিকের সরু নল মানে ‘স্ট্র’ ডোবানো। বলল “একটুখানি জল খেয়ে নে।” নিলাম। এবারে সে পকেট থেকে একটা চ্যাপটা রামের বোতল বার করে সকলের ডাবের জলে একটু একটু মিশিয়ে দিল।

সারাদিনব্যাপী যাত্রার ধকল আর শীত শেষ হয়ে গরম পড়ার আবহাওয়ায় শরীরে খানিকটা ক্লান্তি জমেছিল। প্রথম চুমুকটা দিয়েই মনে হলো, উফ কী দারুণ! শরীর মন একেবারে জুড়িয়ে গেল। এ জিনিসের পরে সমুদ্র-মন্থনের অমৃত পর্যন্ত বিস্বাদ লাগতো। অতি সাধারণ কায়দায় তৈরি এই অসাধারণ পানীয়টি চাঁদিপুরে আমার একটা বড় প্রাপ্তি। আবিষ্কারও বলা যেতে পারে।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে। পশ্মিম দিকে সূর্যদেব পাটে নামবেন তাই সেদিকটায় বিচিত্র রঙের খেলা – যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। আরও খানিকটা যাবার পর দেখলাম বালি আর শুকনো নেই, বালি আর জল মিশে রয়েছে। তার ওপর অস্তসূর্যের আলো বেশ একটা চিকিমিকি ভাব নিয়ে এসেছে। একটি পুরুষ, স্ত্রীলোক আর তাদের সঙ্গে একটি শিশু সেই চিকচিকে বালিতে পায় পায় সাগরের দিকে যাচ্ছে। এখান থেকে তাদের কালো স্যিলুট ছবির মতো লাগছে। ‘ম্যান, ওম্যান অ্যান্ড চাইল্ড’ কথাটা মনে পড়ে গেল। ফোন তাক করে ছবি তুললাম, কিন্তু সচরাচর এ সব জায়গায় যা হয় তাই হলো। ফোনের ক্যামেরায় মনের ভাবটুকু তেমন করে ধরা পরল না।

সাগর এখান থেকে আর বেশি দূর নয়। জলের সঙ্গে বালির নিয়মিত সহবাস – তাই বালি নরম আর জোলো। এখানে সৈকত রেখার নকশা অন্য ধরনের। ডোরা দাগ নয়, ছোট ছোট ডুমো ডুমো ছাপ, যেন চরাচর জুড়ে কেউ আশ্চর্য নিপুণতায় বড়ি দিয়ে রেখেছে। অনেকে জলের দিকে যাচ্ছে আমাদেরই মতো। কিংবা সেই নারী-পুরুষ-শিশুটির মতো। পায়ের ছাপ পড়ছে বালিতে। একটু এগিয়ে একবার ফিরে দেখলাম। নাঃ, আমাদের পায়ের ছাপ মুছে গেছে। সাগর বেলায় কারোর পায়ের ছাপই থাকে না। কোনোটা মিলিয়ে যায় একটু আগে কোনোটা তারপরে।

বঙ্গোপসাগরের জল স্পর্শ করে ফিরে আসছিলাম। দু-দুবার পাখির ঝাঁক দেখলাম, ছবি তুলতে না তুলতেই তারা হুস করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দূরে। দু-একটা ছোট সামুদ্রিক প্রাণী বালিতে আটকা পড়ে গেছে – এদের আর এ জীবনে সমুদ্রে ফেরা হবে না। পূব আকাশে আলো কমে আসছে আর সেই পড়ন্ত আলোতে মঞ্চে আসছেন এক নতুন চরিত্র। চাঁদ।

সেদিনটা ছিল পূর্ণিমা। পূব আকাশে খুব আবছা একটা সোনালী বৃত্তরেখা চোখে পড়ছে যদিও অন্যদিকে সূর্যদেব তখনো বিরাজমান। যতক্ষণে আমরা আবার রাস্তার ধারে ফিরে এলাম ততক্ষণে অবশ্য সূর্যদেব অস্তাচলে গেছেন। আকাশের রাজত্ব প্রায় সোমদেবের দখলে এসে পড়েছে।

বালুতট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে গোটা সাত-আট সিড়ির ধাপ পেরিয়ে রাস্তায় ওঠা যায়। সিমেন্টের বাধানো ধাপগুলোর আড়াআড়ি বিস্তার অনেকটা। আমরা সেই সিড়ির ধাপে জায়গা করে বসলাম। সেদিন শুক্রবার, মানে কাল পরশু ছুটি। চাঁদিপুর জমজমাট। আমাদের মত দু-চারজন বাইরে থেকে এসেছে ঠিকই তবে বেশির ভাগ লোকজন আশেপাশের লোকালয় থেকেই সমুদ্রতীরে সন্ধে কাটাতে এসেছে। তেলেভাজা, মাছভাজা থেকে ঘুগনি, চাওমিন ইত্যাদি বেশ বিক্রি হচ্ছে। এখানে অন্যান্য সমুদ্রতীরের তুলনায় ঝিনুকের মালা, শাঁখ, ঘর-সাজানোর স্যুভেনির ধরনের জিনিসের দোকানের চেয়ে খাবারের আয়োজনই বেশি।

আমার মনোযোগ গিয়ে পড়ল মানুষ ছাড়া আরও চার রকমের প্রাণীর দিকে। গরু, কুকুর, বেড়াল আর ছাগল। ইংরেজিতে সিমবাওসিস বলে একটা কথা আছে যার মানে সহাবস্থান। দোকানদার আর ভ্রমণকারীদের সঙ্গে এদের চমৎকার সহাবস্থানের সম্পর্ক। ঘুরছে ফিরছে খাচ্ছে, কোনো ভয়ডর নেই। গরু, কুকুর বেড়াল – এরা তো বুদ্ধিমান প্রাণী জানতাম। কিন্তু ছাগল? এদের বুদ্ধি, সাহস আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যে কতটা হতে পারে তা চাঁদিপুরে না এলে জানতে পারতাম না। গোটা কতক কালো ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছিল – আমি তাদের লক্ষ করছিলাম। ছাগলের তাকানো যতই ফ্যালফ্যালে মনে হোক না কেন এদের দৃষ্টির জোর আছে। এত লোকের মধ্যে কারা পশুপ্রেমিক তা এরা সহজেই বুঝে নেয়। শুধু তাই নয়। এরা আরও বুঝতে পারে সে পশুপ্রেমিকের ধরনটা কেমন। মনুষ্য সন্তানটি কি সেই ধরনের পশুপ্রেমিক যে নিজের খাবার থেকে বা দোকান থেকে খাবার কিনে তাকে ভাগ দেবে! যদি সেরকম বুঝল তাহলে নারী, পুরুষ বা শিশু যাই হোক ছাগল তাকে ছাড়বে না। একেবারে গা ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকবে! শালপাতায় কিছুটা ঘুগনি, বিস্কুট যা পাচ্ছে তা পাতা-কাগজ সমেত খেয়ে নিচ্ছে। একবার দেখলাম শালপাতায় লেগে থাকা ঘুগনি দু-একবার শুঁকে একটা কুকুর ছেড়ে চলে গেল। তারপর এলো একটি ছাগশিশু। সে দেখেই বুঝল কুকুরভাই না খেলে কী হবে, এতে যথেষ্ঠ খাদ্যগুণ আছে। সময় নষ্ট না করে সব উদরস্ত করে নিল।

চাঁদ তখন আরও অনেকটা উঁচুতে উঠেছে, তা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী মতো হবে। সমুদ্র কি একটু কাছে এসেছে? হতে পারে। দূরের দিকটা চাঁদের আলোতে কীরকম যেন মোহময় লাগছিল। বেলা থাকতে যা দেখা যায় এ দৃশ্য তার থেকে একেবারে আলাদা। অন্ধকার হয়ে গেছে বলে সমুদ্রের দিকে বিশেষ কেউ যায়নি। রবীন্দ্রনাথের গানে ‘রক্তিম মরীচিকা’ বলে একটা কথা শুনেছি। দূরে যা দেখছি তাকে কি ‘চন্দ্রিম মরীচিকা” বলা যাবে!

আজ এই নিয়ে দ্বিতীয় বার জলের দিকে হাঁটা লাগালাম। বেশ খানিকটা যাবার পর দেখলাম বালির ওপর জলের একটা পাতলা স্তর এসে গেছে। পা দিলে থসথস করে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। বালুতীর মেঝের মতো সমতল নয়, তার গায়ে সৈকত রেখার বিচিত্র নকশা কাটা। সেই জল মেশা নকশা-কাটা বালিতে চন্দ্রালোক অদ্ভুত খেলা খেলছে। এ ধরনের প্রতিফলিত চাঁদের আলো কখনো দেখিনি – অপার্থিব বললে ভুল হয় না। আর একটু দূরেই সমুদ্র, তার সঙ্গে চাঁদের আলোর সম্পর্কটা একটু বেশি চপল। তবে বালুতট, চাঁদের আলো আর সমুদ্র – এরা চরাচরব্যাপী একটাই ক্যানভাসে একই ছবির অংশ। যদিও বা কখনো ছবিতে বা সিনেমায় এর কাছাকছি কিছু দেখে থাকি, এরকম দৃশ্য স্বচক্ষে এ জীবনে কখনো দেখিনি। আর জনহীন এই বালুকাবেলায় পূর্ণিমা রাতে সে ছবির ভেতর নিজের ঢুকে পড়াও এই প্রথম। কয়েক মিনিট হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হতবাক হওয়াটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, বহুযুগ থেকেই মানুষ চন্দ্রালোকে সমুদ্র দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সে যুগের হতবাক মানুষেরা এসব দৃশ্যের স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরে যেত। তাছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। দিন পালটে যাওয়ায় মানুষ হতবাক হয়ে যাবার পর আর তা করছে না। মানুষ মাত্রেরই পকেটে ফোন। আজকাল আবার সব রকম ফোনেই ভালো জাতের ক্যামেরা লাগানো থাকে। আজকের মানুষ যেখানে যা দেখে কচাকচ তার কটা ফটো তুলে নেয়।

আমিও তাই করলাম। এরকম দৃশ্যের সাংঘাতিক ভালো ফটো হতে পারে তা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সে ভালো ছবি কী ভাবে তুলতে হয় তা আমার জানা নেই। তাই ফোন বার করে ওপরে নিচে এপাশে ওপাশে এলোপাথারি গোটা কয়েক ছবি তুলে রাখলাম। কখনো ভাবছিলাম ফোন আড়াআড়ি ধরলে ভালো হবে, কখনো লম্বালম্বি। পরে দেখেছিলাম ছবিগুলোতে ঘুটঘুটে অন্ধকারটাই ভালো এসেছে, তাছাড়া বিশেষ কিছুই নেই। একটা দুটোতে কী করে যেন খানিকটা চিকমিকে আলো দেখা যাচ্ছে।

ঠিক এই সময় আমি মনে মনে একটা কথা বুঝতে পারলাম। এই চাঁদিনী রাতের সমুদ্র আমার ভালো লাগছে না। একেবারে ভালো লাগছে না। এই চাঁদ, এই বালুকা বেলা, সমুদ্রের এই মৃদু তরঙ্গ – এরা যেন নিজেদের নিয়েই আছে। আমি এর মধ্যে নিমন্ত্রণ ছাড়া ঢুকে পড়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। এরা আমাকে চেনে না, নজরও করছে না। এই চরাচরব্যাপী উদাসীনতার মধ্যে আমি কারোর নই, কেউ আমার নয়। আমি সম্পূর্ণ একা। একাকীত্বের ভার বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তা এখানে বহুগুণ বেড়ে গেছে।

পা চালিয়ে ফিরে এলাম সিমেন্টের বাধানো সিড়ির ধাপে। প্রায় নটা বাজতে চলল, তাই ভীড় পাতলা হয়ে গেছে। সন্ধের মেলা ভেঙে গেছে। গাঢ় লাল টমেটোর সস লেগে থাকা একটা কাগজের থালা সাগরের হাওয়ায় এদিকে সেদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে এলোমেলো। বেড়ালটা একটা বন্ধ দোকানের বেঞ্চিতে আধশোয়া, কুকুরগুলো বসে পড়েছে। গরু ফিরে গেছে। পশুপ্রেমিক-সন্ধানী ছাগল কিন্তু আছে। আমি যেতেই একটা ছাগল আমার কাছে এসে আমার পশুপ্রেমের ধরনটা বুঝে নিতে চাইছিল। মানে আমি কি কিছু কিনে একে ভাগ দেবো? তেলেভাজার দোকানের লোকটা আমার দিকে ঘুম চোখে তাকালো, বন্ধ করার আগে এ লোকটা কি এক ঠোঙা ফুলুরি কিনবে।

বেশি রাত্তিরে বালুতটে কেউ থাকুক তা এখানকার কতৃপক্ষ চান না। তাই নটা বাজলেই সব আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়। সাগরতীরের এলাকা জুড়ে উঁচুউঁচু খুটিতে যতগুলো জোরালো এল ই ডি আলো ছিল সব একসঙ্গে নিবে গেল। চন্দ্রালোক এতক্ষণ এল ই ডি আলোর দাপটে সুবিধে করতে পারছিল না। আলো নিবতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।

দূরের দিকটায় যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে জল-স্থল-আকাশের বিরাট ক্যানভাসে আলো ছড়িয়ে চাঁদ আজ আশ্চর্য এক ছবি এঁকেছে। তবে বুঝতে পারলাম সে ছবির ভেতর থাকার চেয়ে চাঁদের আলোতে এই অপরিষ্কার আতি-সাধারণ জায়গাটুকুই আমার ভালো লাগছে।

সিমেন্টের বাধানো সিড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম এখানে কত লোক এসেছে, তারপর চলে গেছে। আমি এই হাজার হাজার বেড়াতে আসা লোকের একজন মাত্র। আমিও দুদিনে চলে যাব। আমার কোনো বিশেষ পরিচিতি নেই, কেউ আমাকে আলাদা করে চেনেও না। তবু মনে হলো চাঁদের আলোতে এই কুকুর, ছাগল, বেড়াল, ফেরিওয়ালা আর তেলেভাজার দোকানিকে ভারি আপন লাগছে। আমি এদের কেউ না হলেও এই চন্দ্রালোকিত মুহূর্তটিতে আমি এদেরই একজন।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম ডাবওয়ালা এখনো আছে কি না। ডাবের জলে রাম মেশানো ককটেল আরেকবার যদি পাওয়া যেত...