Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in










১৮ (১) 

“ অনেকদিন আগের কথা। এক ছিলেন নবাব সাহেব, আর তাঁর ছিল এক শাহজাদা, বাপের সুপুত্তুর।

“ ভাল হল তোমরা পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ। সেই প্রসঙ্গেই আমার এই কিসসা মনে পড়ল। ছোটে পালোয়ান সরপঞ্চকে মুখের উপর চ্যালেঞ্জ করেছে—বেশ করেছে। পঞ্চায়েত আদালতের বিচার ছোটেলালের মত লোকের জন্যে নয়। ও হল বড়মাপের মানুষ। এত বড় পালোয়ান! তায় আমাদের কলেজ কমিটির মেম্বার। ওখানকার বিচার তো গেঁয়ো লোকদের জন্য। কানাকড়ি দাম নেই এসব বিচারের। কোড়িল্যা মার্কা বিচার। হেঁ—হেঁ –হেঁ, কোড়িল্যা কাকে বলে জানো? রুক্ষ উষর জমিতে আপনা থেকেই জন্মায়। গ্রীষ্মকালে দেখে থাকবে—সাদা সাদা ফুল।

“আরে তুমি হলে শহুরে বাবু, এসব কী করে দেখবে? এই পঞ্চায়েতী আদালত? ওরা ওই কোড়িল্যা-ছাপ রায় দেয়। আর ওই সরপঞ্চ? সবাইকে কিছু একটা ফালতু গুরুগম্ভীর লেকচার দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার পালা পড়েছিল ছোটে পালোয়ানের সাথে—একেবারে কুপোকাত! ও যেমন বুনো ওল, ছোটে তেমনি বাঘা তেঁতুল! ----

“কুসহরপ্রসাদকে আগেই বলেছিলাম-- পঞ্চায়েতী আদালতে যেওনা। শুনলে তো! এখন মাথায় ঢুকেছে। সরপঞ্চ চার-পাঁচটা কাঁচাপাকা শুনিয়ে দিতেই সব শুধরে গেল। ওখানেই ছোটেলালজীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।

“ ঠিকই হল, বাপ-বেটার মধ্যে কীসের আকচা-আকচি?

যা বলছিলাম, ওঁর ছিল এক শাহজাদা। কার? নবাব সাহেবের। হ্যাঁ, হ্যা; ওই কিসসাটাই তো বলছি। একবার ওর হল খুব অসুখ। জ্বর কিছুতেই নামছে না। কয় মাস ধরে ভুগছে; অনেক দামি দামি ওষুধ, বড় বড় কবিরাজ, হাকিম, ডাক্তার। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা নর্দমার জলের মত খরচ হচ্ছে, কিন্তু শাহজাদার হাল যে কে সেই।

“নবাব সাহেব মাথা চাপড়াচ্ছেন। চারদিকে ডঙ্কা বাজানো হল—কেউ এসে আদ্দেক সম্পত্তি নিক, শাহজাদিকে বিয়ে করুক,--কিন্তু শাহজাদাকে সারিয়ে তুলুক! এবার দূর দূর থেকে হাকিমের দল এলেন। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহজাদা চোখ মেললেন না।

“শেষে এলেন এক বুড়ো হাকিম। শাহজাদাকে দেখে বললেন, ‘আদ্দেক সম্পত্তি ও শাহজাদীতে আমার লোভ নেই, ভোগ-বিলাসে রুচি নেই। যদি আমার একটা দরখাস্ত মঞ্জুর করেন তো শাহজাদাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। কিন্তু দরখাস্ত গোপনে পেশ করব’।

“তো নবাবের হুকুমে দরবার খালি হয়ে গেল। হাকিম বললেন, ‘বন্দাপরবর! দাসের প্রতি আপনার অনেক কৃপা। এবার বেগমকে এখানে আসতে হবে। যা জিজ্ঞেস করব তার জবাবে সত্যি কথা বলতে হবে।‘

“নবাব সাহেবও সেখান থেকে চলে গেলেন। বেগম সাহেবার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে হাকিম বললেন, ‘যদি শাহজাদার প্রাণ বাঁচাতে চান তো সত্যি কথা বলুন। শাহজাদা আসলে কার সন্তান? কার ঔরসে জন্ম’?

“বেগমা সাহিবা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কাউকে বলবেন না! একসময় মহলে কাজ করত এক ভিস্তি, শাহজাদা তার ছেলে। তরতাজা জোয়ান, গ্রাম থেকে নতুন নতুন এসেছিল, তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল তা’ জানিনা’।

“এটা শোনামাত্র হাকিম বললেন, ‘শুক্রিয়া! আর কিছু বলতে হবে না’। চুটকি বাজিয়ে বললেন, ’কথায় কথায় বুঝে গেছি শাহজাদা কীভাবে সারবেন’।

“তারপর হাকিম সাহেব আগের সব ওষুধ ফেলে দিলেন। কত দামি দামি দ্রব্যের অনুপান! হীরেমোতি, সোনাচাঁদি! কত রকমের অদ্ভুত সব আরক! সব নর্দমায় বয়ে গেল। তারপর উনি শাহজাদার চোখে জলের ছিঁটে দিয়ে বললেন, ‘আবে উঠ! ভিস্তির ব্যাটা! উঠে পড়’।

“ব্যস্‌, শাহজাদা চমকে উঠে চোখ খুললেন। তারপর হাকিম গেলেন মাঠে। সেখান থেকে কয়েকটা কৌড়িল্যার চারা উপড়ে এনে জলের ছিটিয়ে পিষে শাহজাদাকে গিলিয়ে দিলেন। তিনদিন নিয়মিত কৌড়িল্যার রস খেয়ে শাহজাদা চাঙ্গা!”

এই কিসস্যাটি বৈদ্যজীর দরবারে বসে শোনাচ্ছিলেন -প্রিন্সিপাল। মুখ্য শ্রোতা -রঙ্গনাথ। মুখ্য বিষয়—পঞ্চায়তী আদালত। গল্পের প্রেরণাশক্তি—ভাঙের শরবত।

উনি বলছিলেন, ‘তো রঙ্গনাথ বাবু, এই হল কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার। দেহাতিদের এরকমই ধরে নেওয়া হয়—যত্ত নীচু জাতের লোকজন! ওদের আর কী চাই? চলে এসো পঞ্চায়তী আদালতে আর কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার পেয়ে বাড়ি যাও!

“আর যারা বড় মানুষ, রঈস-টইস, হাকিম-হুকাম, উঁচু জাতের লোকজন। ওদের চাই দামি বিচার। ঘাস কাটার সরপঞ্চ নয়, মোটা চশমা পরা ইংরেজের মতন ইংরেজিবলা জজসাহেব। বড় মানুষদের জন্য রয়েছে জেলার বড় বড় আদালত, যেমনটি চাই তেমন।

“ওদের চেয়েও বড়দের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হাইকোর্ট। সবচেয়ে উঁচু জাতের জন্য সুপ্রীম কোর্ট। কেউ একবার বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখুক তো! তাতেই সোজা দিল্লি গিয়ে রিট পিটিশন লাগিয়ে দেয়া হয়।

“কৌড়িল্যামার্কা আদালত আর যত নীচু জাতের লোক! ওখানে যদি একবার ফেঁসে যায় তো ধরে নাও বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা দাঁড়াতে পারবে না। এক দানা খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াবে।

“হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট—এসবের শখ কী সবাইকে পোষায়? এক-একজন উকিলের পেছনে একশটা বেশ্যা পোষার খরচ!

“তাই গেঁয়ো লোকজনের জন্যে কৌড়িল্যা-মার্কা ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা। না হিং-লবঙ্গ, না ফিটকরি! তাতেও রঙ চোখা! এক দাগ খেয়ে দেখ, জ্বর নেমে যাবে। আমাদের দেশের কানুন একদম পাকা, --যেমন লোক, তার তেমনই আদালত”।

হঠাৎ উনি হিন্দি ছেড়ে অবধী বোলিতে চলে গেলেন। ‘যেমন পশু, তেমনি করে বাঁধা’।


গাঁয়ের বাইরে এক লম্বা চওড়া ময়দান যা ধীরে ধীরে ঊষরভূমি হয়ে গেছে। আজ একগাছি ঘাসও গজায় না। দেখলেই মনে হবে -আচার্য বিনোবা ভাবেকে ভূদান দেবার জন্য একেবারে আদর্শ জমি। আসলে তাই হয়েছিল। বছর দুই আগে এটাকে ভূদান-আন্দোলনে দিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওটা ফিরতি দান হয়ে গ্রামসভার অধিকারে এল। গ্রামসভা আবার ওটা প্রধানকে দান করে দিল।

প্রধান এটাকে কয়েক ভাগ করে নিজের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে দিল। তারপর একটু আধটু টুকরো যা বেঁচে ছিল সেগুলো বাজারের কেনাবেচার নিয়ম মেনে কিছু গরীব ও ভূমিহীনকে “দান” করে দিল। পরে জানা গেল যে গরীব এবং ভূমিহীনকে দেয়া জমির টুকরোগুলো আসলে ওই ময়দানের অংশ নয়, বরং অন্য কোন কৃষকের জমির অংশ। সুতরাং এটা নিয়ে মোকদ্দমা শুরু হল, এখনও চলছে, ভরসা আছে—পরেও চলতেই থাকবে।

যাই হোক, ভূদান-যজ্ঞের ধোঁয়া এখনও ময়দানের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ওখানে খেত তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রমাণ বলতে প্রতি পদে একএকটা আল বাঁধা হয়েছে, তার উপর বিছিয়ে দেয়া বাবলা গাছের কাঁটাওলা ডাল। সার-জল-বীজ বিনা স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, গত বছর থেকে নাকি ভাল করে চাষ শুরু হয়েছে। আর স্রেফ পাটিগণিতের জোরে এটা প্রমাণ করা গেছে যে গ্রামসভায় গত বছর-- আগের সব বছরের থেকে – অনেক বেশি অন্ন উৎপাদন হয়েছে।

গাঁয়ের পশুর পাল কখনও কখনও ওই ময়দানকে নিজেদের চরে খাবার স্থান ভেবে পুরনো অভ্যাসে এদিকে চলে আসে। কিন্তু তারপরেই চাষিদের মধ্যে গালাগালি, মারপিট, পঞ্চায়েতের খোঁয়াড়, থানাপুলিশ, কোর্ট-কাচারি সব শুরু হত। তাই ধীরে ধীরে ওদিকে পশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

ময়দান আজকাল নিঃশব্দ নীরব। আশাবাদী কেউ যদি ওদিকে পা ফেলে তবে তার মনে হবে যে এই নীরবতার মধ্যেই প্রগতির শঙ্খ বেজে উঠল বলে!

ময়দানের এক কোণে বন-সংরক্ষণ, বৃক্ষারোপণ এসব শুরু হয়েছিল। যোজনা সফল হল কি বিফল—সেটা বিতর্কের বিষয়। চোখে পড়ে যে নালা কাটা হয়েছে আর শোনা যায় যে ওখানে বাবলা গাছের বীজ বোনা হয়েছে। এটাও শোনা যায় যে এই ‘গঁজহা’ লোকগুলো যদি অমন ‘গঁজহা’ নাহয়ে আশপাশের গাঁয়ের মত উদ্যোগী পুরুষসিংহ হত তাহলে এই উষর মরুতেও এতদিনে বাবলা গাছের বন গজিয়ে উঠত।

কিন্তু মাটি ভালো নয়, তাই নালার পাশে বাবলা গাছ গজালো না, কিন্তু পুরো যোজনা থেকে শিবপালগঞ্জের লোকেদের একটা লাভ হল। নালাগুলো ওদের সার্বজনিক শৌচালয় হয়ে গেল। এই ধরণের সরকারী স্কীম বানানো হয়েছিল বন নির্মাণের জন্য, এখন হয়ে গেল ঘরোয়া কাজের।

ময়দানের অন্য কোণে শূন্যতাকে ধর্ষণ করার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল বটগাছ। তারপাশে একটি কুয়ো। ওই কুয়োর বাঁধানো পাড়ে রঙ্গনাথ বসে আছে। হিন্দুস্তানের লেখাপড়া জানা লোকেদের মাঝে মাঝে একটা অসুখ হয়, তার নাম ‘ক্রাইসিস অফ কনশান্স’—বিবেকের দংশন! কোন কোন ডাক্তার এর মধ্যে ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’ বা বিশ্বাসের সংকট নামক অন্য একটা অসুখের লক্ষণও কষ্ট করে খুঁজে পান।

এইসব অসুখ সাধারণতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যেও তাদেরই হয় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে। মজার ব্যাপার হল এরা কেউ বুদ্ধির ভরসায় বাঁচে না, বরং আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনের মাধ্যমেই বাঁচে। (কারণ, শুধু বুদ্ধির ভরসায় বাঁচা অসম্ভব)।

এই অসুখের রোগী মানসিক চিন্তা এবং অবসাদে ভোগে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ে এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে। নিজেকে --বুদ্ধিজীবী হয়েছে তাই অসুস্থ, এবং অসুস্থ হয়েছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী-- বলে প্রমাণ করত চায়। শেষে এই অসুখ নিরাময় হয় কফি হাউসের বিতর্কে, চঞ্চল মেয়েদের বাহুবন্ধনে, সরকারি চাকরি পেয়ে, কখনও কখনও আত্মহত্যায়।

কলেজে ম্যানেজারের নির্বাচন দেখার দিন থেকে রঙ্গনাথের মনে ওই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিল। ওর মামা বৈদ্যজীকে দেখামাত্র ওর মনে সেদিনের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—প্রিন্সিপাল সাহেব শূলে বেঁধা শুয়োরের মতন চিঁচিঁ করতে করতে কলেজের গেট থেকে বেরোচ্ছেন আর জয়ধ্বনি করছেন। ওর মনে হল বৈদ্যজীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ও যেন কোন ডাকাত দলের সদস্য হয়ে গেছে। যখন প্রিন্সিপাল সাহেব দাঁত বের করে ওকে কোন রগরগে কিসসা শোনাতে থাকেন---ওনার ভাণ্ডারে এমন কিসসা অগুনতি—তখন ওর মনে হয় এই লোকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কারও গলা টিপে দিতে পারে।

শহরে থাকলে এখন ও কফি হাউসে বন্ধুদের সামনে বসে এই নির্বাচন নিয়ে একটা লম্বাচওড়া লেকচার ঝাড়ত। বলত—কীভাবে দেশি পিস্তলের জোরে ছংগামল ইন্টার কলেজের ম্যানেজারি কব্জা করা হল। আর টেবিল চাপড়ে বলত যে মুলুকে ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট ক্ষমতা হাতিয়ে নিতে এমন সব করা হয়, সেখানে বড় বড় ক্ষমতা লাভের জন্য কী না হতে পারে!

তারপর ঠিক বা ভুলে ভরা দু-চারটে ইংরেজি কোটেশন আউড়ে কফির কাপ খালি করার পর শান্তি পেত এই ভেবে যে ও একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী, এবং চারটে অকম্মার ঢেঁকির সামনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝেড়ে ধরে নিত যে এবার ও ভেতরের জমে থাকা উষ্মা বের করে নিজের ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’কে ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো শহর নয়, নেহাত পাড়া -গাঁ, এখানে রূপ্পনবাবুর ভাষায়, নিজের বাপকেও বিশ্বাস নেই। এছাড়া , শনিচরের ভাষায়, এখানে কাটা আঙুলে পেচ্ছাপ করার মতও কেউ নেই। তাই রঙ্গনাথ এখানে নিজের মানসিক অসুখ থেকে রেহাই পেল না। ওর মাথায় দিনরাত একটা জিনিসই ঘুরছে----ও কোন ডাকাত দলে ফেঁসে গেছে। ডাকাতগুলো হামলা করে কলেজ লুট করেছে। এবার অন্য কোথাও আচমকা হামলা করার তালে আছে। ওর শরীরমন চাইছে বৈদ্যজীকে গালি দিতে আর তার চেয়েও বেশি উসখুস করছে কার সামনে বিশ্বাস করে গালি দেয়া যায়?

এমন বন্ধু আর কে আছে? খান্না মাস্টারের পেটে কথা থাকে না। ওর সামনে বললে পরের দিন গোটা গাঁও জেনে যাবে যে বৈদ্যজীর ভাগ্নে নিজের মামাকে গালি দেয়! দেখে নাও, আজকালকার লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোক-- ভদ্রতা শেখেনি। হ্যাঁ, মালবীয় মাস্টারের কাছে বলা যেতে পারে। ও দলবাজিতে যুক্ত হলেও বড্ড সাদাসিধে। ওর সামনে গাল দিয়ে মজা নেই। বাকি রইল কে? রূপ্পনবাবু?

রঙ্গনাথের রূপ্পনবাবুর উপর খানিক ভরসা ছিল। কারণ, ওমাঝে মাঝে প্রিন্সিপালকে গাল দিয়ে বলত—কলেজের দুর্ভাগ্য! ওনার অভিযোগ—প্রিন্সিপাল লেখাপড়ায় গবেট, কিন্তু দুনিয়াদারিতে মহা ওস্তাদ! পাক্কা ছকবাজ! বাবাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে সব কাজ ওই ব্যাটার ইচ্ছেতে হলেও বাবা ভাবে বাবার কথায় হচ্ছে। ব্যাটা খান্না মাস্টারের সঙ্গে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। মানছি, খান্না মহাবেকুব। কিন্তু ওকে এত বেশি অপমান করা ঠিক নয়। আমার বাবার কাঁধে বন্দুক রেখে এক ব্যাটা বেকুব অন্য বেকুবকে মেরে দেয়া? এটা অনুচিত।

আজ ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় কুয়োর পাড়ে বসে রঙ্গনাথ প্রশান্ত চিত্তে এক লম্বা শ্বাস টানল। অনেক দিন পরে আজ ওর সেই অসুখ ওকে বিচলিত করছে না। হল কি,আজ ও হিম্মত জুটিয়ে রূপ্পনবাবুর কাছে নিজের আত্মসংকট নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল। স্পষ্ট করে বলল যে মামাজীর এমনটা করা ঠিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ম্যানেজারি হাসিল করলেন বটে, কিন্তু চারদিকে অপযশ তো রটেছে!

রূপ্পনবাবু ওনার ‘ধর -তক্তা- মার- পেরেক’ ভঙ্গিতে বললেন—‘দেখ দাদা, এসব তো পলিটিক্স। এটা তো কিছুই নয়। এ’লাইনে অনেক বড় বড় বদমাইশি হয়। পিতাজি যে পথে এগিয়ে চলেছেন তাতে আরও কিছু করতে হতে পারে। দুশমনকে –সে যেই হোক—চিৎ করতে হয়। না পারলে উনি নিজেই চিৎ হবেন, তারপর বসে বসে কবরেজি পুরিয়া বানাতে থাকবেন। কেউ ফিরেও তাকাবে না।

‘তবে কলেজটাকে অনেক শোধরাতে হবে। প্রিন্সিপাল ব্যাটা মহা হারামী। সারাদিন দলবাজি, সারাদিন কিচকিচ। খান্না মাস্টারও একনম্বরের গর্দভ, কিন্তু হারামী নয়। শালার প্রিন্সিপাল ওকে অনেক অপমান করেছে, নীচে নামিয়েছে। এবার ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি পিতাজীর সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু উনি প্রিন্সিপালকে খাটো করতে চান না।

‘ভেবেছি , কিছুদিন বাবাকে কিছু না বলে খান্না মাস্টারকে একটু হাওয়া দেব। তাতেই প্রিন্সিপাল চিতপটাং হবে। ও শ্যালক ফুলে ঢোল হয়েছে। এখন ওর ফাটার সময়। একবার ব্যাটা চিৎ হলে বাবাও টের পাবেন ব্যাটা কত তালেবর---‘!

এইসব শুনে রঙ্গনাথ বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস টানল। এটা তো বোঝা গেছে যে রঙ্গনাথ এই বিষয়ে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও স্পষ্ট হল যে রূপ্পনবাবুর সামনে ও খান্না মাস্টারের জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে, যে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে পারে, যে ফুলে গেছে তাকে ফাটিয়ে দিতে পারে। সোজা কথায়, অন্যায়ের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারলেও চোরাগোপ্তা ভাবে লড়াই করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওর থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে রূপ্পনবাবু একটা গাছের পেছনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে পেটের ভেতরের গণ্ডগোল সাফ করছিলেন। এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সার্বজনিক সমাধান করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন রঙ্গনাথও কুয়োর পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। রূপ্পনবাবু ওর দিকে আসছিলেন না, তাই রঙ্গনাথই ওনার দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)