Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in












নবনীতা দেবসেন: নারীকেন্দ্রিক জীবনদৃষ্টি




প্রিয় বাসু,

গতকাল সন্ধ্যায় তোমার চিঠি পেলাম। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতন পড়তে পারি কোথাায় বলো! বিগতা যৌবনা শব্দটা ব্যবহার করে খোঁচা দিলে মনে হলো তবে তা তুমি বলতেই পারো। আগের মতন রোজ কবিতা পড়া হয়না তাই বলে ভেবো না সব ভুলে গেছি। খুব প্রিয় একটা কবিতার শেষ কটি লাইন তোমার সমস্ত চিঠির উত্তর হতে পারে।

আমি তোমার হই
তুমি
আমার কোলের শিশু হ'য়ে আমাকে বরণ করো
আমাকে হরণ করো
পূরণ করো।

বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়‘ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। তখন তাঁর মাত্র একুশ বছর বয়স। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বৃন্তহীন একটি গোলাপ‘ কবিতাটির কথা মনে আছে? কবিতার শুরু এই রকম: “কিন্তু, তুমি এখন তো জানো/ বর্ণ গন্ধ ফুলের জঞ্জালে/ বুক রেখে কিংবা মুখ রেখে/ কোনো লাভ নেই।” বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। কিন্তু চোখে লাগে ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি। বর্ণ গন্ধ ফুল তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিদের কাছে মহার্ঘ ছিল। নবনীতা এক কালোপযোগী তিক্ততা হানেন বর্ণ গন্ধ ফুলের প্রতি, ওই ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি প্রয়োগ করে। কবিতাটিতে শুধুমাত্র ওই একটি শব্দই আধুনিকতার নিশান ওড়ায়। নবনীতা দেবসেনকে পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হবে না প্রতিবাদী চেতনার বিস্ফোরণ আছে। দুঃসাহসী দামাল নবনীতার অকুতোভয় প্রকৃতি সেখানে ডালপালা মেলেনি। এজন্য তাঁর নারীবাদী চেতনায় বিদ্রোহী বিকার নেই, রয়েছে স্বাধিকারবোধে অসহনীয় আত্মপ্রত্যয়। ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতে আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কখনও কখনও। নবনীতার কবিতাগুলিকে মনে হয় তাঁর স্পষ্টশ্রুত স্বগতোক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নবনীতা আসলে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সব দুঃখ-শোক বা প্রণয়বাণী নিজেকেই শোনাতে চেয়েছেন। নবনীতার কবিসত্তাতেও নারীজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবাদী চেতনা সবাক্‌মূর্তি লাভ করেছে। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিপিয়াসী নবনীতা ত্রাতা হিসাবে পুরুষের রাজকীয় ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। ওঁর সারাজীবনের কবিতাতেই এক অতৃপ্ত প্রেমতৃষ্ণা ধিকিধিকি জ্বলতে দেখা যায়। প্রেমের রাশ হাতে রেখে পুরুষই বলতে চেয়েছে শেষকথা, নারী বাধ্য হয়েছে তা পালন করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মস্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত প্রেমের রাজদণ্ডধারী রূপ ক্রমে প্রকট হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃস্বার্থ সমর্পণের অবমূল্যায়ন বুঝতে শিখেছে নারী। এর মধ্যেকার ‘ঐতিহ্যপ্রসূত’ মহনীয়তা শিকারি ও শিকারের বাস্তব সম্পর্কে জর্জরিত। প্রেমিক হলেন প্রভু, নারীর আত্মোপলব্ধি ‘শিকার’ হিসাবে। নবনীতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রাখলেন ‘লায়নটেমারকে’ (১৯৮৯-১৯৯৫)। নামকরণের মধ্যে পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তবে এই আক্রমণ, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল নারীর নিজস্ব যন্ত্রণার সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশে। কবি যেন নিজের থেকে এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেকেই চেনাতে চাইলেন প্রহার-দগ্ধ নারীর বিকৃত স্বরূপ। নবনীতার কবিতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তার একাকীত্বের সুর। প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে আকুল কবি। কিন্তু প্রণয়মুকুটের বদলে তাঁকে যেন চিরদিন শিরোধার্য করতে হয়েছে বিরহের বা নিঃসঙ্গতার কাঁটা। নবনীতা সেই শ্রেণির কবি, যিনি নিজের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে জটিল অস্পষ্টতায় পেশ করতে চান না। তাই তাঁর কাব্যভাষা খুব সহজ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কবিতা সবলে সমস্ত পেশি ফুলিয়ে এক অত্যাশ্চর্য শক্তিরূপ প্রকাশ করতে পারে না। বড় বিনম্র তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির সঠিক পরিচয় পাঠককে পেতে হয় সেই নম্রতা স্পর্শ করে। কবিতার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার ছটা আটপৌরে প্রকাশভঙ্গিতে হয় হৃদয়ের সম্পদ।

তোমাকে এত বছর পর এইসব কেন লিখছি, লেখার কোন মানে আছে কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চিঠি অজান্তেই উস্কে দিচ্ছে অনেক কিছু। নবনীতা দেবসেনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম ‘সংসারের কোনো কোনো বাসন কোসন, কাপ পিরিচ সম্ভাব্য বন্ধুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়ত দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কে রসিকতার ছলে এক হৃদয়গ্রাহী স্বীকারোক্তি, অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে মনে হয় না কি চরম সত্য খেলাচ্ছলে লিখে দিলেন? আমাদের সম্পর্কটাও…

বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।

হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।

তোমার মনে আছে আমাদের বমডিলা ভ্রমণের কথা। পাহাড়ের গায়ে অজস্র স্ট্রবেরি গাছে লাল স্ট্রবেরি ঝুলে রয়েছে। অয়ন, তুমি আর সোমজা পাকদণ্ডি পথে পাহাড়ের উপরে উঠে হারিয়ে গেছিলে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি সহসাই আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল। কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের খুঁজে পেলাম পাহাড়ের উপরে মনস্ট্রিতে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্যমুনি বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মূর্তির একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্যপাশে রিনচেংপংযের মূর্তি। মনস্ট্রির মধ্যে ছায়াছন্ন বন্য ধুপের গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে এক রহস্যময় প্রাচীনত্বের আভাস ছড়িয়ে পড়ছিল। আচ্ছা, আমাদের যে দিন গেছে সে কি একেবারই গেছে?

নবনীতার গল্পে অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা একদিকে আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থেকেছে আবার সেই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। যেমন ‘বিমাতা’ গল্পের তাপসী। তাঁর গল্পের নারীরা জীবনের কথা বলে। ‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। সে চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তার ভালো লাগলেও একসময় খারাপ লাগতে থাকে। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়; কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই। ‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পটিতে একজন ছোট পিসিকে পাই আমরা, যিনি বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে ব্যথা পান। মেনে নিতে পারেন না। সুকৌশলে তিনি চারপাশের মানুষগুলোকে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের কথা শোনান। ‘দাদামনির আংটি’ এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। দাদামনির আংটি চুরি গেলে এই বধূ থানায় ডায়েরি করতে যায়। থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি করে। বধূ প্রতিবাদ করে। সাফ সাফ বলে দেয়, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। ‘পরীর মা’ গল্পের মা নিজের সন্তানকে ঘটনাচক্রে হারিয়ে ফেললেও অন্যের সন্তানকে বুকে টেনে নেন।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’ গল্পে শুভমিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও প্রথম সন্তান শুভকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক মানবিক বার্তা আছে তাঁর গল্পে। আবার আধুনিক গল্পও রয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ তেমন একটি গল্প। এ-গল্পে এলিজাবেথ এক অসাধারণ নারী। সে অন্য পন্থায় সন্তান ধারণ করে কারো বাধা না মেনে। একটি অসাধারণ বাক্য আছে এ-গল্পে, ‘মায়ের মুখের একটা কথার ওপরে বাবার বাবাত্ব টলমল করছে। আর তো কেউ জানে না প্রকৃত বাবাটি কে!’ তাঁর গল্পে নারীর বহুমাত্রিক রূপ আমরা দেখি। গল্পের নারীরা হিংস্র নয়। পুরুষের ব্যাপারে তাদের অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও তারা দেখায় না। তাদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে। পুরনো ঐতিহ্যের মাঝে যে ভালো থাকে সেই ভালো বার্তাই পাই আমরা তাঁর সাহিত্যে।

পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দিনগুলি আর হয়ত ফিরবে না। পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় কোন রূপকথার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। ‘মাঝে মাঝে ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? সব ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! সন্ধ্যার সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডায় কেন জানি বড় একা লাগে মনে হয় প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ সবাই খুব নিঃসঙ্গ।

রূপকথার কথায় মনে পড়ল নবনীতা দেবসেনের রূপকথা। তাঁর প্রিয় বিষয় রূপকথা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে রূপকথায়। তাঁর রূপকথায় মেয়েরা কুশীলব। রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করে। রূপকথায় পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করে। মেয়েদের বন্দি করে, পেটায়, কাটে আবার উদ্ধারও করে। পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই উদ্ধার করে। মেয়েদের আসল চেহারা নেই, তারা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তাঁর রূপকথায় মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। তারা উদ্ধার করে যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্রবলে। কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের নিস্তেজ শীর্ণ আলোতে প্রকৃতি, তার সবুজ, হলুদ, লাল, কালো নানা-রঙা নিশান উড়িয়ে দেয় আকাশে আকাশে, বহুবর্ণ গালচে বিছিয়ে দেয় জমিতে, উজ্জ্বল, অগণিত স্পন্দিত তারা আর জোনাকির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয় আকাশের চাঁদোয়ার নীচে; অন্ধকার রাতে। জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল, গাছের মধ্যে গাছ, পাতার মধ্যে পাতা, ফুলের মধ্যে ফুল, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতি সেঁধিয়ে যায়। মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো তো? সেই চোখ দিয়ে দেখছি। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। জানো, প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। ভাালো থেকো নিরন্তর। আশা করি দ্রুতই তোমার চিঠি পাবো।

শুভেচ্ছান্তে-

সুস্মি

২৪ নভেম্বর,২০২৪