Next
Previous
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in








একলব্য তীরধনুক নিয়ে প্রতিদিন সেই মৃন্ময় মূর্তির কাছে আসে, পাঠ নেয় আর চলে যায় বনের দুর্গম এলাকায়। মহাদেবের মন্ত্র পড়ে শর নিক্ষেপ করে। এই ভাবে সমগ্র ধনুর্বিদ্যা তার করায়ত্ত হয় কয়েক মাসে। অঙ্গাগ্রণী তখন গর্ভবতী।

এমনই সময় একদিন অরণ্যে বিস্তর কোলাহল দেখা দিল। অনেক লোকজন নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করল। তাদের দ্রুতগামী রথ বনের প্রান্তসীমায় রাখা। সেই সব লোকজনের কারও হাতে দড়ি, কেউ বা জাল, বল্লম, তীরধনুক ইত্যাদি মৃগয়ার উপকরণ নিয়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শিকারী কুকুররা ছূতে বেড়াচ্ছে। লোকজনের মধ্যে কারও কারও বেশভূষা একটু অন্য রকম, তাদের দেখে রাজপুত্র মনে হয়।

একলব্য একমনে ধনুর্বিদ্যার নানা কৌশল ও নিয়মকানুন স্মৃতি থেকে বর্তমান অভিজ্ঞতায় তুলে এনে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। এমন সময় একটি কুকুরের আওয়াজে তার মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে। কুকুরটি বোধ হয় এমন মানুষ আগে দেখেনি, সে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। একলব্য প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু চীৎকার যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল, সে একসঙ্গে সাতটি বাণ কুকুরের মুখে নিক্ষেপ করল। একে বলে শব্দহরণ বাণ। যে কোনও জীবের স্বরনির্গমনের দ্বারে এই সপ্ততীর নিক্ষিপ্ত হলে সেই প্রাণীর সপ্তস্বর সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। কুকুরটিরও তাই হল। সে ছুটে গিয়ে প্রভুদের কাছে উপস্থিত হল। প্রভুরা ছিলেন হস্তিনাপুরের পাণ্ডব রাজকুমার—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। শরবিদ্ধ কুকুরটিকে দেখে তাঁরা চমকে গেলেন। কে সেই তীরন্দাজ যে এমন অদ্ভুত শরশাস্ত্র সম্পর্কে বিদ্বান! সম্ভবত তাঁদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যও এই শব্দহরণ শরনিক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন। তাঁরা তীরন্দাজের খোঁজে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন।

পাণ্ডবরা দেখলেন, একজন কৃষ্ণবর্ণ, ধূলিধুসরিত, কৃষ্ণজিনজটাধারী যুবক অনবরত বাণক্ষেপ করছে। যুধিষ্ঠির তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুমি? কার লোক?

কৃষ্ণজিনজটাধারী একলব্য জবাব দিল, আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র, দ্রোণাচার্যের শিষ্য এবং ধনুর্বেদশিক্ষা সম্পন্ন করেছি।

ভীম বললেন, তুমি কার লোক?

একলব্য উত্তর দিলেন, আমি আমার লোক।

অর্জুন খুব বিস্মিত হলেন। গুরুদেব দ্রোণ তাহলে জঙ্গলের নিষাদদের সঙ্গে ষড় করছেন! এই কথা পিতামহ ভীষ্মের কানে তুলতে হবে। আচার্য তাদের জল আনতে বলে অশ্বত্থামাকে অনেক গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছেন তা অর্জুন বিলক্ষণ জানেন। এখন শত্রু পাঞ্চালরাজকে শায়েস্তা করার জন্য হস্তিনাকে ভরসা না করে আচার্য নিষাদদের শরণাপন্ন হয়েছেন। অর্জুন একলব্যকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, আচার্য দ্রোণ এখানে আসেন না তুমি হস্তিনায় যাও শিক্ষা নিতে?

একলব্য জবাব দেয়, আমি একবার গিয়েছিলাম। তার পর থেকে দ্রোণাচার্য স্বয়ং এই বনের মধ্যে আমাকে সমগ্র ধনুর্বেদশাস্ত্র শিখিয়েছেন।

পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্বান সহদেব বললেন, আমাদের মৃগয়া না করে হস্তিনায় ফিরে সব কথা পিতামহ ভীষ্মকে জানানো উচিত।

দ্রুতগামী রথ চলল হস্তিনানগরের দিকে।

হস্তিনায় পৌঁছে অর্জুন সোজা চলে গেলেন পিতামহ ভীষ্মের কাছে। পাণ্ডুর এই পুত্রটিকে পিতামহ অত্যন্ত স্নেহ করেন। অর্জুনের কাছে সব শুনে ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন বিদুরকে।

বিদুর কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পুত্র। তাঁর মা দাসী ও শূদ্রা। সেইজন্য বিদুরকে ক্ষত্তা বলা হয়। বর্ণবিচারে প্রজ্ঞাবান বিদুর পারশব—শবতুল্য, কিন্তু তাঁর বিচক্ষণতা ও কূটবুদ্ধি অপরিসীম। ভীষ্মের ডাকে বিদুর এসে সব শুনে দ্রোণাচার্যকে ডাকা সমীচীন মনে করলেন।

দ্রোণ এলেন, সব শুনলেন। তাঁর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে। তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, বিশ্বাস করুন গাঙ্গেয়, আমি একলব্যকে কোনও প্রকার গুপ্ত বা প্রকাশ্য শিক্ষা দিইনি। আপনি যেমন বলেছিলেন, তেমন ভাবেই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি।

ভীষ্ম বললেন, তবে নিষাদপুত্র এই বিদ্যা কোথা থেকে শিখলো?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন, আমি নিজেই এই বিদ্যা জানি না। কী করে শেখাবো?

অর্জুন বললেন, কিন্তু গুরুদেব, নিষাদপুত্র জানাল যে তার গুরু আপনি, আপনার একটি মূর্তির সামনে সে অস্ত্রশিক্ষা করে থাকে। আপনি অনুমতি না দিলে সে এই সাহস পায় কোথা থেকে!

দ্রোণ ক্ষণকাল চিন্তা করে জানালেন, এখন দেখছি সে বাহ্যত আমার শিষ্য না হলেও ফলত আমারই শিষ্য।

বিদুর এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। তিনি এ বার মুখ খুললেন, এই ভাবে কথার খেলা খেললে চলবে না আচার্য!

অর্জুন ক্রোধবশত বলে বসলেন, হে আচার্য! একদা আলিঙ্গন করে প্রীতিপূর্বক আমাকে বলেছিলেন ‘আমার অন্য কোনও শিষ্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ হবে না’। অথচ আজ? আপনার ‘বাহ্যত নয় কিন্তু ফলত’-শিষ্য আমার থেকে তো বটেই, সমস্ত বীর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

দ্রোণ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমাকে একলব্যের কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

অর্জুন জবাব দিলেন, পিতামহ আদেশ দিলে নিশ্চয় নিয়ে যাব।

ভীষ্ম অর্জুনসহ অন্যান্য পাণ্ডবদের চলে যেতে বললেন। দ্রোণাচার্য ও বিদুরকে নিয়ে তিনি একটি কক্ষে উপস্থিত হয়ে তার দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।

বিদুর ফিসফিস করে বললেন, হে আচার্য, আপনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করতে পারবেন?

দ্রোণ উত্তর দিলেন, বিশ্বাস করুন আমি একলব্যকে ধনুর্বেদশিক্ষা দিইনি।

ভীষ্ম বললেন, বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের প্রশ্ন এখানে তুলছেন না ক্ষত্তা, তিনি প্রমাণ চাইছেন।

দ্রোণ ভয় পেয়ে বললেন, একলব্যকে কোনও প্রকার শিক্ষা যে দিইনি তা আমি দেবতাদের নামে শপথ করে বলছি।

বিদুর হেসে ফেলে জানালেন, একলব্য বলছে আপনি তার গুরু আর আপনি বলছেন সে আপনার শিষ্য নয়। আচ্ছা এক কাজ করুন, আমরা যা বলব, তাই আপনি করতে পারবেন?

দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, কী?

বিদুর বললেন, একলব্যকে হত্যা করতে হবে।

দ্রোণাচার্য ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন, না মানে হত্যা করব, মানে...

ভীষ্ম বললেন, ক্ষত্তা, খামোখা আচার্যকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলো না। হস্তিনাকে সুরক্ষিত রাখার দায় আমার। একলব্য বেঁচে থাকলেও সেই সুরক্ষা সম্ভব।

দ্রোণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ভীষ্ম বলতে লাগলেন, আচার্য! আপনাকে ডানহাতি সেই তীরন্দাজের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে আনতে হবে।

দ্রোণাচার্য অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। বিদুর ও ভীষ্ম হো হো করে হাসতে লাগলেন। প্রাতিকামী এসে দ্রোণের চোখেমুখে জল ছিটিয়ে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিল।

স্ত্রী কৃপী ও পুত্র অশ্বত্থামাকে সব কথা খুলে বললেন আচার্য।

কৃপী উপদেশ দিলেন, এই চাকরি আপনি ছেড়ে দিন ভর্তা।

অশ্বত্থামা বললেন, হে পিতা, সব কথা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্রদের অবিলম্বে জানান। আপনার চাকরি চলে গেলে আমরা খাব কী?

ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন অশ্বত্থামার বিশেষ বন্ধু। দুর্যোধন নিজেকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করেছেন কারণ তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনার রাজা। ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু অন্ধ, তাই তাঁর অনুজ পাণ্ডু রাজা হওয়ার দাবিদার ছিলেন। কিন্তু তিনি রাজত্ব ছেড়ে বনে চলে যান এবং সেখানেই প্রয়াত হন। তাঁর পাঁচ ছেলে এখন হস্তিনার অর্ধেক দখল নিতে চাইছেন। দুর্যোধন তাঁদের কোনও অংশ দেবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। পিতামহ ভীষ্ম এবং বিদুর সব সময় পাণ্ডবদের পক্ষে থাকেন। ভীষ্ম দ্রোণকে অস্ত্রগুরুর পদে বসিয়েছেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন বাধা দিলে পিতামহ আচার্যকে সরাতে পারবেন না।

দ্রোণ পুত্রকে বললেন, এক্ষুণি কিছু বলার দরকার নেই। দেখি ঘটনা কোন দিকে যায়।

হঠাৎ রাজসভার দূত এসে দ্রোণকে জানাল, বাইরে দ্রুতগামী রথ প্রস্তুত। এক্ষুণি তিনি যেন প্রস্তুত হয়ে রথে উপবেশন করেন, মহামান্য ভীষ্ম এই আদেশ পাঠিয়েছেন।

দ্রোণাচার্য দূতের সঙ্গে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখেন, রথ প্রস্তুত। সারথি ছাড়া সেখানে বসে রয়েছেন অর্জুন।

রথ চলতে শুরু করল। গুরু-শিষ্য কারও মুখে কোনও কথা নেই। এই ভাবে সারা রাস্তা অতিক্রম করে তাঁরা একলব্যের কাছে পৌঁছলেন।

দ্রোণ দেখলেন, ধূলিধুসরদেহ, জটাধারী ও কৌপীনপরিধায়ী নিষাদ একলব্য একমনে ধনু ধারণ করে অনবরত বাণক্ষেপ করছে।

দ্রোণাচার্যকে আসতে দেখে অভিভূত একলব্য তাঁর কাছে গিয়ে চরণযুগল ধারণ করে মস্তক দ্বারা ভূতল স্পর্শ করল। দ্রোণাচার্য বাধা দিলেন না।

আচার্যকে পূজা করে একলব্য নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে ঘোষণা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

দ্রোণ বললেন, হে বীর যদি তুমি আমারই শিষ্য হও তবে আমাকে সেই শিক্ষাদানের বেতন দাও।

একলব্য আনন্দিত হয়ে বলল, কী চান গুরুদেব, আদেশ করুন। হে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ, গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নেই।

দ্রোণাচার্য একটু থামলেন। বললেন, আমাকে শব্দহরণ বাণনিক্ষেপের পাঠ দাও।

অর্জুন অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।