Next
Previous
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








সতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানুষিক ও অমানবিক প্রথা চালু ছিল হিন্দুধর্মালম্বীদের মধ্যে।

সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রমাকান্ত রায় ও মাতার নাম তারিণী দেবী। সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজা রামমোহন রায়। কোন সময় সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে দিগ্বীজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে।

তা ছাড়া পৌরাণিক কাহিনীগুলোয় এমন আত্মাহুতির অনেক উদাহরণ রয়েছে। ‘সতী’ শব্দটি এসেছে দেবী সতীর নাম থেকে। রাজা দক্ষের কন্যা ও দেবতা শিবের স্ত্রী সতী। রাজা দক্ষ সতীর সামনে শিবকে তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেতে তিনি আত্মাহুতি দেন। তা ছাড়া মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে সহমরণের এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সতীদাহের আদেশ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এমন অনেক নারী চরিত্র আছেন, যারা স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। ধর্মগুরুরা এসব পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করেছেন সতীদাহ প্রথার নামে নারী হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে। সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন। খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই ভারতে সতীদাহের মতো ঘটনা ঘটে আসছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় পাঞ্জাবে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে আছে সতীর ঘটনা। বরাহমিহির সতীর গুণগান গেয়েছেন। মঙ্গলকাব্যে আছে সতীর উল্লেখ। মুলতান থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা আমঝারিতে তিনজন মেয়েকে সতী হতে দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আবার বার্নিয়েরের মতো কেউ কেউ সতী হওয়া থেকে কোনো কোনো মেয়েকে রক্ষা করেছেন। তার নজর এড়ায়নি যে প্রধানত ব্রাহ্মণরা হিন্দু মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। সবাই স্বেচ্ছায় সতী হত না। কিন্তু একটা বিধবা মেয়ের আজীবন ভরণপোষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অথবা তার সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য জোর করে তাকে চিতায় উঠতে বাধ্য করা হত। স্বপন বসুর ‘বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস’ বইতে পাই যে মেয়েরা সতী হলে কোনো কোনো ধনী পরিবার থেকে তখনকার সময় দুইশ টাকা অবধি সাম্মানিক জুটত। এই অর্থের লোভে ব্রাহ্মণরা মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক বইতেই আছে একটি অল্পবয়সি মেয়ের স্বামী মারা যেতে সে সতী হবে বলে মনস্থির করল। আত্মীয়স্বজন বেজায় খুশি। চারিদিকে সাজ সাজ রব। চিতার আগুন জ্বলে উঠতেই মেয়েটির কাকা মেয়েটিকে ধরে চিতায় তুলে দিল। আগুনে ঝলসে মেয়েটি বাঁচবার জন্য চিতা থেকে লাফ দিল। শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। চিতা থেকে পালালে চলবে না। সংকল্প যখন করেছে তাকে সহমরণে যেতেই হবে। আধপোড়া মেয়েটা প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে একটা ঝোপের পিছনে আশ্রয় নিল। তার কাকা কিন্তু লোকজন সঙ্গে এনে তাকে ঠিক খুঁজে বের করে আবার জবরদস্তি করে চিতায় তুলে দিল।

পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে পুরো পরিবারের মান সম্মান বাড়িয়ে দিয়ে গেল মেয়েটি। ব্যাপক হারে বাংলায় সতীদাহ প্রথা চলছিল। এক তথ্য অনুযায়ী বাংলা বিভাগে ১৮১৫ সালে সতী হয়েছে ৩৭৮ জন (তার মধ্যে কলকাতা বিভাগে ২৫৩ জন), ১৮১৬ সালে সতী হয়েছে ৪৪২ জন (কলকাতা বিভাগে ২৮৯ জন); ১৮১৭ সালে সতীর সংখ্যা ৭০৭ জন (কলকাতায় ৪৪২ জন); ১৮১৮ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে সতীর সংখ্যা ৮৩৯ জন (কলকাতা বিভাগে তার মধ্যে ৫৪৪ জন); ১৮১৯ সালে বাংলায় সতীর সংখ্যা ৬৫০ (কলকাতায় ৩৭০ জন); ১৮২০ সালে সর্বমোট ৫৯৭ জনের মধ্যে কলকাতায় সতীর সংখ্যা ৩৭০। তখন তো বাংলা প্রেসিডেন্সিতে কলকাতা বিভাগ ছাড়াও ঢাকা বিভাগ, মুর্শিদাবাদ বিভাগ, পাটনা বিভাগ, বেনারস বিভাগ ও বেরিলি বিভাগ ছিল। কিন্তু সতীদাহ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল কলকাতা বিভাগে। পার্লামেন্টের পেপারের তথ্য অনুযায়ী সতীদাহে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বেনারসকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা বিভাগ।

আবার কলকাতা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সতীদাহ হয়েছে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া, কলকাতার উপকণ্ঠ ও জঙ্গলমহলে। ১৮১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সতীদাহের সংখ্যা- বর্ধমান: ৭৫, হুগলি: ১১৫, নদিয়া: ৪৭, কলকাতা উপকণ্ঠ: ৫২, জঙ্গলমহল: ৩১, কটক/পুরী: ৩৩, যশোর: ১৬, মেদিনীপুর: ১৩ ও ২৪ পরগণা: ৩৯। হাউস অব কমন্সের নির্দেশে এই পরিসংখ্যান ১৮২৫ সালের ১ জুলাই লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়।

কেরীর তালিকা অনুযায়ী ১৮০৩ সালে সতী হয় ২৭৫ জন। ১৮০৪ সালে ছয় মাসে ১১৬ জন। অদ্ভুত ব্যাপার শিক্ষার হার যেখানে একটু বেশি সেখানেই সতীদাহর ঘটনা বেশি। ১৮২৩-এ ৫৭৫ জন সতী হয়। ১৮২৬-এ ৬৩৯ জনের মধ্যে কলকাতায় ৩৬৮ জন। আবার এমন ঘটনাও দেখা যায় যে স্বামীর সঙ্গে একদিনও ঘর করেনি, সে স্বেচ্ছায় স্বামীর বুকের ওপর নিশ্চিন্তে মাথা দিয়ে ‘স্বর্গারোহন’ করেছে। মাঝে বৃষ্টি হয়ে চিতার আগুন নিভে সে আধপোড়া হয়ে শুয়ে আছে। তবু তার বিকার নেই। ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে যখন আবার চিতায় আগুন জ্বালানো হল তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।

বাংলায় সতী হওয়ার অনুষ্ঠানটিও ছিল অদ্ভুত। যে মেয়ে সতী হবে বলে মনস্থির করত সে স্নান করে নতুন কাপড় পরে পা আলতায় রাঙিয়ে একটি আমডাল নিয়ে শবের কাছে বসত। মাথার চুল বিছিয়ে দেওয়া হত। ছেলে বা নিকট আত্মীয় অনুষ্ঠানের সব জিনিস জড়ো করে চিতা প্রস্তুত করত। সে গায়ের গয়না খুলে সিঁদুরের টিপ পরে সাতবার চিতা প্রদক্ষিণ করে আঁচলে বাঁধা খই, কড়ি বা গয়না ছুড়ে ছুড়ে দিত উন্মত্ত জনতাকে। লোকে কাড়াকাড়ি করত ওগুলো পাওয়ার আশায়। তারপর বিচিত্র, গগনভেদী বাজনার মধ্য দিয়ে সে চিতায় উঠত। মেয়েদের চিতার সঙ্গে বুকে, কোমরে, পায়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হত যাতে তারা পালিয়ে না যায়। শুধু সহমরণ নয়, সমাজে তখন অনুমরণ, সহসমাধি, কতরকম প্রথা। স্বামীর সঙ্গে একসাথে পুড়ে মারা গেলে সহমরণ। স্বামীর মৃত্যুর সময় অনুপস্থিত থাকলে, অসুস্থ হলে বা গর্ভবতী হলে পরে স্বামীর ব্যবহৃত যে কোনো জিনিস যেমন লাঠি, চটি, থালা, বাঁধানো দাঁত, স্বামীর লেখা চিঠি ইত্যাদি নিয়ে চিতায় উঠত স্ত্রী। এটি হল ‘অনুমরণ’। যেমন ভোলা চামারের বউ উদাসীয়া। ভোলা মারা যাবার সাত বছর পরে সে ১৮২২ সালের ৫ মে ভোলার ব্যবহৃত থালা নিয়ে সতী হয়। কোঙ্কন অঞ্চলের মেয়েরা স্বামীর অনুরূপ এক চালের মূর্তি গড়ে অনুমৃতা হত।

এটি ‘পলাশবুদি’। মৃত ভাই-এর চিতায় বোনের আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাও আছে। সেখানে বাবা নিজে একসঙ্গে পুত্র ও কন্যার চিতা সাজিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছিল। ১৮১৮ সালের শেষদিকে চন্দননগরের এক তরুণী ভাবী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেয়। বিয়ের আগেরদিন ছেলেটি কলেরায় মারা যায়। মেয়েটি জোর করে সতী হয়। রক্ষিতারাও সতী হত। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত সাধ্বী স্ত্রী সতী হবে না রক্ষিতা। সম্ভবত ১৮১৭ সালে সরকার আইন করে রক্ষিতাদের সহমৃতা হওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ‘দিল্লির এক শেঠজি স্বর্গে গেছেন। শেঠজি কোটিপতি। ঘরে তার চার-চারটি স্ত্রী। দলে দলে খিদমদগার, হুঁকোবরদার। যমুনার ধারে কয়েকশ মণ চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি করা হল আকাশছোঁয়া চিতা। চিতায় শেঠজির সঙ্গে উঠলেন তার চারটি স্ত্রী। কিন্তু অমন মানী লোকের স্বর্গে গিয়ে চারটি স্ত্রীতেই কেবল কুলোবে কেন? এতএব ঝি-চাকরকেও স্বর্গে যেতে হল তার সঙ্গে। তামাক সাজবে কে- পা টিপে দেবে কে- হাওয়া করবে কে? সেইখানেই শেষ নয়। দুটো প্রকাণ্ড আরবি ঘোড়াকেও চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হল। আবার ঘোড়া কেন? বা-রে নইলে শেঠজির মতো অমন দিকপাল লোক কীসে চড়ে স্বর্গের দেউড়িতে ঢুকবেন? এমনই ছিল সে যুগের কুসংস্কার। সেদিন রামমোহনের চোখ ফেটে জল এসেছিল লজ্জায় ও ক্ষোভে। সেদিন রাজা রামমোহন রায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই ইতিহাস বদলাতে হবে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে এক মন্ত্রে মিলিয়ে দিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি মহাজাতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মিলনমন্ত্র আসবে এই দেশের উপনিষদ থেকেই। সেই সংকল্প বুকে নিয়েই চার বছর পরে রামমোহন রায় দেশে ফিরলেন।’ ১৮১২ সালে তার ভাই মারা যান, আর সেইসময় তার ভাইয়ের স্ত্রীকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়। এই নির্মম দৃশ্য চোখে দেখে তিনি মেনে নিতে পারেননি।

এই ঘটনা তার মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। আর তাই তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথার বিরুদ্ধে একটি বাংলা পুস্তক রচনা করেন। তখনকার দিনে যা হত সব শাস্ত্র মেনে হত। আর তাই তিনি মনুসংহিতা সহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে প্রমাণ করেন সতীদাহ প্রথা অন্যায়। এ ছাড়া তিনি সম্বাদ কৌমুদী সহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ক লেখা প্রকাশ করতেন। এরপর নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক-এর কাছে একটি আবেদনপত্র দেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ১৭ নম্বর রেগুলেটিং আইন পাস করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন। শত শত বছর ধরে চলে আসা নৃশংসতম সতীদাহ প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তার সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তার লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না।

১৭৯৯ সালে খ্রিস্টান যাজক ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক উইলিয়াম কেরি এই প্রথা বন্ধের প্রয়াস নেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তিনি সতীদাহ বন্ধের আবেদন জানান। এরপর রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ও তার লোকেরা বিভিন্নভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং তা শাস্ত্র ও আইনবিরুদ্ধ। ১৮২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ শিরোনামের ছোট একটি পুস্তিকা।

১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি সতীদাহ প্রথার কথা আগে থেকেই জানতেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের যুক্তি অনুভব করে আইনটি পাসে উদ্যোগী হন। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন।

সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা হিসাবে রাজা রামমোহন রায় নমস্য হয়ে থাকবেন চিরদিন।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







৩. শহীদুল জহিরের ছোটগল্প: বিষয় ও বৈচিত্র্যে


হৃদীবরেষু সুস্মি,

গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। মাত্র সাত মাসেই ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন ঐকতানে অভাবনীয় পতন হয়েছে সেই সরকারের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ ২০২১ সালের আফগানিস্তান পরিস্থিতি ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়। তখন গণ-আন্দোলনের মুখে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশত্যাগ করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫ আগষ্ট বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদন, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। হামলা হয় জাতীয় সংসদে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জেলায় জেলায় হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছে থানায়। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে খুব করে মনে পড়ছে একজনের কথা। আমি বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে থাকলে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুন কিছু লেখা পড়ার সুযোগ ঘটতো, জানি এই বিষয়ে তুমিও একমত হবে। বস্তিজীবন থেকে যে গল্পধারার শুরু তা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেরিয়ে খুব উঁচুতে যেতে পারেনি। তাঁর গল্পে উচ্চবিত্ত চরিত্র খুবই কম, যেমন কম উচ্চশিক্ষিত বা এলিট শ্রেণির চরিত্র। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই বলেছেন, “তাঁর তাবৎ গল্প থেকে একটি চারিত্র্যই উদ্ভাসিত হয়- সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রণই তাঁর লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তর্লোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশের, শুধু ঢাকা শহর নয়- ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। আমি জানি এইটুকু পড়েই তুমি ঠিক বুঝতে পারছো আমি কার কথা লিখছি।

বাংলা ছোটগল্পের উত্তরাধিকারে ভিন্নধারার কথাশিল্পী শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) এর কথাই বলছিলাম, যার আবির্ভাব জীবনানন্দ দাশের মতো শিল্পীসত্তায় নির্জনতাকে সঙ্গী করে । বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তিনি সংযোজন করেছেন অসামান্য কিছু গল্প। তাঁর গল্পের জীবনসংবেদী বিষয়, অভিনব আঙ্গিক, অন্তরঙ্গ চরিত্র- আর সবকিছু ছাপিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় সমৃদ্ধ বিচিত্র বর্ণনাকৌশল বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। আবহমান সমাজকাঠামোর পুরনো গল্পগুলোই তিনি নতুন করে উপস্থাপন করেছেন, আর তাঁর অভূতপূর্ব উপস্থাপনভঙ্গির কারণে সেগুলো স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। তিনি বহির্বাস্তবকে গৌণ করে অন্তর্বাস্তবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বাস্তব-অবাস্তবের খেলায় বাস্তব ধরা দিয়েছে তীব্রভাবে। জাদুর ঘোর লেগে গেলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবই থেকে গেছে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে এ ধারা শুরু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র হাত ঘুরে শহীদুল জহিরে এসে তা পুষ্ট হয়েছে এবং স্বকীয় বর্ণনাশৈলিতে পূর্বসূরীদের আড়াল করে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন, বলাই বাহুল্য। শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় ঘটে যাওয়া গল্প লেখেন। সেই গল্পটা আবার তিনি নির্মাণ করেন সমষ্টির বয়ানে। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। তিনি তাদের মুখে গল্পটা তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে যান। অনেকটা পাঠকের অবস্থানে অবস্থান করেন। ফলে তিনি গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কথন তৈরি করেন সেখানে আখ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলীটা ভেঙে পড়ে। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদী (Post-structuralist) হিসেবে আমরা ভাবতে পারি।

আজ্ছা, বাংলাদেশে তোমার যেসব আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের সাথে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছে। ভালো আছেন তো তারা? দেশভাগের শিকার প্রজন্মের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাঁদের স্মৃতিতে আছে দেশভাগের বহু গল্প। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি ১৯৪৭ সালের জুন মাসের আগেই দেশত্যাগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনো ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যেই মানুষ ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ অভিবাসন করছিলেন। দেশভাগের মতো নির্মম বাস্তবতার সামনে পূর্ব পাকিস্তান নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। 'কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'- পাকিস্তানিদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান। তার পরম্পরায় শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি নতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বলা যায়, এভাবেই দেশভাগ ভিন্ন এক আলো নিয়ে আসে বাঙালির জীবনে। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিমূহুর্তে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে ভারত বিদ্বেষ সম্প্রীতি হারিয়ে যাবার কারণ হিসেবে আমার বারবার মনে হয় দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় অভিজাত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকট মুখ্য। পূর্ববাংলার আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশীল ও নিয়ন্ত্রণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত বা উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত। এর পাশাপাশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তোমার কি মনে হয়? চল্লিশের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে সাময়িকভাবে হলেও ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দেশের মুসলিম জনগণ। তারা ভুল বুঝেছিল। কৃষক ভেবেছিলেন জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। মধ্যবিত্ত ভেবেছিল তাদের শ্রেণিগত উন্নতি হবে। দ্রুতই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। এখনো যারা মনে করে, মুসলমানিত্ব পরিচয়ের জন্য বাঙালিত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে।

একটা জিনিস তুমি খেয়াল করেছো নিশ্চয় শহীদুল জহির ছাড়া বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তাঁর আগে বা সমকালে জাদুবাস্তবতার দেখা পাওয়া যায়নি বা অন্য কারো লেখায় এ-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত তা কিন্তু নয়। ষাটের দশকের কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সচেতনভাবেই গল্পে, উপন্যাসে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আবার জহিরের সহযাত্রী নাসরীন জাহানের একাধিক উপন্যাসেও এর বিন্যাস ভাষ্যরূপ পেয়েছে। কথাসাহিত্যে অভিনব গদ্যভঙ্গির চর্চা শহীদুল জহিরকে অনন্য করে তুলেছে। আঞ্চলিক কথ্য ভাষাভঙ্গির অনায়াস ব্যবহার তাঁর গদ্যশৈলীকে করে তুলেছে শক্তিশালী আর তার চরিত্রগুলোকে দান করেছে মাটিঘেঁষা শেকড়সন্ধানী অভিযাত্রা। বেশিরভাগ গল্পের চরিত্রগুলো তাঁর জন্মস্থান পুরান ঢাকা, কখনও পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জ, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ বা সাতকানিয়ার ভাষায় কথা বলে। জাদুবাস্তবতার ধারণা আয়ত্ত করা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কয়েকটি সাক্ষাৎকারে মার্কেজের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রাম, নগর, পাড়া-মহল্লা নির্বিশেষে তাঁর কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার যে-ভুবন গড়ে ওঠে, তা একান্তই এদেশীয় জনমানুষের প্রাত্যহিকতা ও শিকড়ঘেঁষা জীবনের স্বাদ, আবহ, গন্ধ ও সৌকর্যকে ধারণ করে বিচিত্র গল্পকথা, আখ্যান, গুজব ও কিংবদন্তিযোগে। উত্তরাধুনিক সাহিত্য-রচনার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জহির জাদুবাস্তবতাকে গল্প ও উপন্যাসের আধার ও আধেয় – উভয় দিকের উৎকর্ষ সাধনের হাতিয়ার করে তুলেছেন।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক, প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এর গল্পগুলোতে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রচনাকালের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশকে তার নিজস্ব দেখা থেকেই তিনি সমাজে বঞ্চিতদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের জীবনসংগ্রামের কথা এবং সেই সংগ্রামে জয়লাভের কথা বলতে চেয়েছেন। সমাজে বঞ্চিত, দলিত মথিত মানুষগুলোর মধ্যে একধরনের ঋজু দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রত্যয় এই পর্বের গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘পারাপার বইটাই গরিব লোকদের নিয়া লেখা, শহরের গরিব, গ্রামের গরিব।’ তাই গল্পগুলোকে প্রতিবাদী চেতনার ফসল বলে মনে হয়।

তুমি তো জানই আমার ঠাকুরদা দেশভাগের সময় অসমে চলে আসেন। নওগাঁর শিয়ালমারীতে বিশাল সম্পত্তি বিনিময় করে এলেও সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। বাঙালি খেদাও আন্দোলনের সময় আবার আমার পরিবার উদ্বাস্ত্ত, সব ছেড়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন ঠাকুরদা কোাচবিহারে। তোমার পরিবারকে নিশ্চয় এতবার উদ্বাস্তু হতে হয়নি। হিন্দু বাঙালীরা সব সময়েই মনে হয় উদ্বাস্তু তাদের কোন দেশ নেই। পঞ্জাবের দিকে দেখো। প্রথম প্রথম কাটাকাটি, খুনোখুনি যা হবার তা হয়ে গেছে। ওদিক থেকে ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ এলে তার প্রত্যুত্তরে এদিক থেকেও ট্রেন ভর্তি শব গেছে। মাউন্টব্যাটেনের আমলেই ওদিক থেকে যারা চলে আসবার এসেছে, এদিক থেকে যারা যাবার, গেছে। কিন্তু বাংলার দিকে যে আগমন-নির্গমন কিছুতেই থামছে না।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা’(১৯৭৪) গল্পটিতে অন্যরকম এক ভালোবাসার রূপ দিয়েছেন জহির। বাবুপুরা বস্তি এলাকার গল্প। তুচ্ছ একটা ফুল দিয়ে যে মানুষের মনকে জয় করা যায়, তার সত্যিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন তিনি ‘ভালোবাসা’ নামক গল্পে। বস্তিবাসী হাফিজদ্দি এবং তার স্ত্রী আবেদার প্রাত্যহিক নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিকের জন্য ঢেউ তোলে হলুদ রঙের ডালিয়া ফুল। বস্তির মেয়েদের প্রায় সবাই কাছাকাছি কোনো বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে, পুরুষরা হয় ঠেলাগাড়ি ঠেলে বা দিনমজুর। ঝুপড়ির এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে দিনাতিপাত করে। এমনি এক পরিবেশে হাফিজদ্দি ডালিয়া ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরলে সবার মধ্যে ঔৎসুক্য তৈরি হয়। আর ‘আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।’ সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষদের জীবনে ভালোবাসার পেলব উৎস হয়ে দাঁড়ায় ফুলটি। তাই ‘তহুরা তো জানে না বাবা মাকে কী জাদু করে রেখে বাইরে গেছে।’লেখকের অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ফুলটিই শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় গল্প ‘তোরাব শেখ’ (১৯৭৫) গল্পটি একটি চমৎকার আঙ্গিকের শক্তিশালী গল্প। বস্তিজীবনের প্রাত্যহিকতা, স্বপ্ন-বাস্তবতা আর জীবন সংগ্রামের গল্প। জহিরের গল্পে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে তিনি শব্দ নিয়ে এঁকেছেন চিত্র। কাহিনিকে আরো স্বাবলম্বী ও উদ্ভাসিত করতে এক ধরনের কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপি নিখুঁতভাবে দেখেছেন অথবা অনুভব করেছেন বলেই অনেক চিত্র অন্ধকারাচ্ছন্নের মধ্যেও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠভাবে। তোরাব সেখ, লতিকা, জমির, লালবানু প্রত্যেকেই অস্তিত্বসংগ্রামী। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে যারা তারা জেগে উঠলেই বদলে যাবে পৃথিবী, মার্কসীয় এ বিশ্বাসের প্রতিফলন এ গল্প। লেখকের জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা, সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে “পারাপার”(১৯৭৫) গল্পে।গণমানুষের নিয়তিতাড়িত জীবনধারার পরিবর্তনে শৈশব থেকে প্রাণান্ত চেষ্টার গল্প এটি। ছোট দুটি শিশু আবুল আর বশিরের জীবন সংগ্রাম, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের নির্দয় আচরণ, এবং তাদের রোষানল থেকে মুক্তিপ্রত্যাশা গল্পটিকে অনন্য করেছে। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত সহজ পরিসরে উঠে এসেছে। ওলি চরিত্রটির অবস্থান এই দুই শ্রেণির মাঝে।

সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবন, স্বাভাবিক অশ্লীলতা বা সাবলীলভাবে কোনো বাচ্চার জন্ম নিয়ে কথা তোলা গ্রামীণ আবহে সম্ভব। মানুষ সামাজিক বিষয়ে গালগল্পের ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ সংস্কৃতির নিবিড় অবলোকন থেকে উঠে আসা এমনি একটি গল্প “মাটি ও মানুষের রং” (১৯৭৬)। গল্পটি পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক, ধনী-গরিবের যে-তারতাম্য তার প্রকৃত একটা চিত্র শহীদুল জহির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দারিদ্রে্যর প্রতি যে-অবিচার করা হয়, অবিচার করা হয় শ্রেণিহীন মানুষের ওপর, তা রূপকের মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বলে গেছেন। আমাদের এই সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে ধনী-গরিবের বৈষম্যে। এখানে মানুষের আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই মানবিকতার। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। অভাব বা দারিদ্র্য স্বপ্নকে কোনোভাবে আটকাতে পারে না। “ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে”(১৯৭৬) গল্পে সামাজিক পীড়ন, শোষণে পিষ্ট সহায়হীন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ নবাব। সে সমগোত্রের প্রতিহিংসার শিকারও বটে। নিজেকে বড় করতে না পেরে অন্যকে ছোট করে দেখানোর চিরন্তন মানবীয় হীন মনোবৃত্তি এস্থলে লক্ষ্যণীয়। নিম্ন শ্রেণির মানুষের তাই অপরের জীবন সম্পর্কে অহেতুক কৌতুহল। নিরীহ নবাবকে কোনোভাবেই শায়েস্তা করতে না পেরে ঘৃণ্য অপবাদ দিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এটাও এক বিনোদন। শহীদুল জহিরের আঞ্চলিক ভাষার বিচিত্রবর্ণা মুকুটে ভিন্ন পালক যোগ করেছে এ গল্পে নবাবের মুখের ভাষা। তার প্রকৃত নাম আলফাজুদ্দিন আহম্মদ। পুরান ঢাকার চরিত্রে লেখক সতত যেসব নাম ব্যবহার করেছেন, এ নামটি সেগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম। তেমনি ব্যতিক্রম নবাব চরিত্রটি। অত্যন্ত প্রমিতভাষী নবাব চালচলনে এ সমাজে বেমানান। তাই তার প্রতি সবার অবিশ্বাস একসময় আক্রোশে পরিণত হয়।

জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই এমন কিছু ‘বোধোদয়’ হয়, যা আরও আগে হলে জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতে পারত। অনেকে হয়তো জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে এটা উপলব্ধি করেন। কিন্তু তাতে তো আর ফেলে আসা দিনগুলো সুন্দর করে তোলা যায় না! আমার পরিবারের যারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেছিলো তাদের প্রায়শ বলতে শুনি বাংলাদেশে ফেরাটা তাদের ভুল ছিল। তোমার আত্মীয়স্বজনও কি তাই বলে? আমরাই কি আদতে ভালো আছি? ভুলে গেলে চলবে না আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত।

জহিরের গল্প-যাত্রাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা চলে। ‘পারাপার’ এর পরবর্তী গল্পগ্রন্থের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫ বছর। ‘পারাপার’ এর গল্পগুলো তাঁর ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সেলেখা। 'পারাপার'-এর রিয়েলেস্টিক ধারার গল্প। পারাপারে জহির অনেক বেশি ট্র্যাডিশনাল, যেখানে গল্প একটি বক্তব্য বা অদেখা বিষয়কে সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। অন্যদিকে তার পরের গল্পগ্রন্থটি জাদুবাস্তবতার আখ্যান, ২য় গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ র ১ম গল্পটি লেখা তাঁর ৩৮ বছর বয়সে অর্ধাৎ তাঁর সাহিত্যমানস তখন আরও পরিণত। ততদিনে তাঁর উপন্যাস ‘জীবন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮) এবং ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বাংলা উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সফলতম প্রয়োগ বলে স্বীকৃত। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ নিয়ে ২০০০ সালে তিনি যখন আবির্ভূত হলেন, তখন তার বাস্তব আর জাদুর জগৎ এক হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর গল্পের আঙ্গিক আর ভাষাশৈলী চলে এসেছে দৃষ্টিসীমার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে চরিত্রেরা রয়েছে পুরনো শ্রেণি-পেশার বা বর্গের। বেশিরভাগ গল্পে পুরান ঢাকার এমন একটি এলাকা বা মহল্লাকে বেছে নিলেন যেখানে জীবন সরলরৈখিক হলেও বৈচিত্র্যে ঠাসা। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত এসব মানুষ কখনও আঁকড়ে থাকে তাদের চিরায়ত ধ্যান-ধারণায়, কখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের সঙ্গে ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ খেলে আবার কখনও নিজের অজান্তেই কোনো মহৎ কাজের অংশীদার হতে এগিয়ে আসে। ঘটনার পুনাবৃত্তি থাকলেও তাঁর আশ্চর্য বর্ণনকৌশলের কারণে পাঠকের মুগ্ধতা কাটে না।

‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ (১৯৯১) এই গল্পে নয়নতারা ফুলগাছগুলো এ গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে। আবদুল করিম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জড়িয়ে যায় বিশেষত্বহীন ফুল নয়নতারার সঙ্গে। ভূমিকম্পের সময় দুটো নয়নতারার টবকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেই চারতলা থেকে পড়ে মগজ থেঁতলে মারা যায় এবং পরবর্তীতে তার শোকে গাছগুলো আত্মহত্যা করতে থাকে।এমন একটি জাদুবাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকেছেন যা একইসঙ্গে পাঠকের মোহগ্রস্ততা এবং ধন্দ তৈরি করে। এ গল্প থেকেই তিনি জড়িয়ে গেলেন জাদুর জগতে যা পরবর্তীতে আরও বিকশিত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরকে এক সূত্রে বেঁধেছেন ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ (১৯৯২) গল্পে, ভূমিহীন অতিদরিদ্র আকালু ও তার স্ত্রী টেপি, রিকশাচালক চান্দু এবং তাদের সারল্যমাখা জীবনাচরণে। ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাকের অলৌকিক ভূমিকা, জাদুবাস্তবতাধর্মী আখ্যান ও ঘটনাংশ, অবিশ্বাস্য লোককথা ও গুজব, সর্বোপরি গল্পের ব্যাখ্যাতীত পরিসমাপ্তি। বহুদিন আগে ঢাকা শহর কাকশূন্য হওয়ার বৃত্তান্তকে ঘিরে এ-গল্পের ঘটনাবিন্যাসের সূত্রপাত। সেই ইতিবৃত্ত নির্মাণে বাস্তবতা ও রূপকথার অলৌকিক-অতিলৌকিক সমাবেশের মাধ্যমে পাঠককেও এক পরাবাস্তব জগতে লেখকের আহবান গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।

শহীদুল জহিরের একটি ভিন্নধর্মী গল্প ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ (১৯৯২)। গল্পে জনৈক মোহব্বত আলী পাড়ায় পাড়ায় জাদু দেখায় আর ডুমুর বিক্রি করে। প্রথমে ফ্রি দিয়ে যে ডুমুর বিক্রি শুরু হয় ক্রমেই তা অমূল্য হয়ে ওঠে। বেশি দামে বিক্রি করলেও মোহব্বত তার গ্রাহকদের বলে, মজা হলেও এই ডুমুর জুগিয়ে খাওয়া উচিত, যাতে শেষ জীবন পর্যন্ত চলে। ডুমুরকে যৌবনের প্রতীকও মনে হয়। কারণ বুড়ো ও বয়স্করা এই ফল বারবার খেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। মোহব্বত ডুমুর বিক্রি করলেও ডুমুরের গাছ বিক্রি করতে রাজি হয় না। গাছ না পেয়ে মোহগ্রস্ত মানুষেরা জাদুকরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং একসময় নিজেরাও মৃত্যুবরণ করে। জাদুকরের রহস্যময় হাসির মতোই লেখক রহস্যাবৃত করে রেখেছেন গল্পের শেষ অংশ। তাই গল্প শেষ করে পাঠককে ভাবতে হয় ‘এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তা স্বপ্ন ছিল।’

নরনারীর হৃদয়াবেগ ও প্রেম নিয়ে শহীদুল জহির বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা চালিয়েছেন এমনি একটি গল্প ‘এই সময়’ (১৯৯৩)। ‘কাঁটা’(১৯৯৫) গল্পে যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্নার প্রতি যদিও সবাই অসহায় মমতা অনুভব করে কিন্তু আপন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি তারা। যেখানে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে 'কুয়ো'র প্রসঙ্গটি। সুবোধ-স্বপ্না দম্পতির কুয়োতে ডুবে মরা বেশ সিম্বলিক। এখানে একটি ইতিহাস ভ্রমণের ব্যাপার আছে। এই কুয়োটি যে সাম্প্রদায়িকতার কূপ তা বুঝতে পাঠকের আর বাকি থাকে না। তাই গল্পে কুয়োটি বন্ধ করার জন্য এলাকাবাসীকে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা যায়, যা ইতিবাচক।

নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা গল্প ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ (১৯৯৭)। পাখির রূপকে লেখক নূরজাহান ও আবদুল ওয়াহিদের মনোবিশ্লেষণ করেছেন যা প্রেম সম্পর্কে পাঠকের উপলব্ধিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। একই চরিত্র একই মহল্লা শহীদুল জহিরের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও মহল্লাও আবির্ভূত হয়েছে চরিত্র হিসেবে। এই পরিচিত গন্ডির মধ্যেও লেখক কখনও চিত্রিত করেছেন সামষ্টিক জীবনাচরণ, আবার কখনও ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, একরৈখিকতা। এমনি একটি গল্প ‘চতুর্থমাত্রা’ (১৯৯৮)। এটিকে গল্প না বলে ‘একাঙ্কিকা’ বলা যায়।

‘হিন্দুস্থান কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি ভারতে বাস করছে আমাদের অতিথি হিসেবে। অতিথি হিসেবে যতদিন ইচ্ছে তারা এখানে বাস করতে পারে'—এমনটাই বলেছিলেন ১৯৩৩ খ্রি. পাঞ্জাবের বিখ্যাত আর্যসমাজপন্থী হিন্দু মহাসভার নেতা পরমানন্দ । আবার এমনই একটি সুর শোনা যায় লাহোরে ‘জামাত-ই-ইসলামী'-র প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবদুল আলার কণ্ঠে। তিনি বলেন—‘মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অপরিহার্য এবং তাহা ইসলাম ব্যতীত আর কিছুই নহে।' তাহলে পথ কোথায় ? এই উগ্রতা কোনো লক্ষ্যে কি পৌঁছে দেয় আমাদের? মৌলবাদ আসলে কী? সময় কী সাক্ষ্য দেয় এই মৌলবাদের প্রেক্ষিতে? আর সাধারণ মানুষের মনে কোন ভাবনা এসে জমে এই শব্দটিকে ঘিরে? ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি আর মৌলবাদ শব্দগুলো কি পরস্পরের হাত ধরে চলে? ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এর ভূমিকাই বা কী? এটি সংহতি নাকি সংকীর্ণতা—কোন গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দেয়? এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল অনেক বেশি। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট শুরু হয় আশির দশক থেকে। উপমহাদেশজুড়ে মুসলিম মৌলবাদ এবং হিন্দু মৌলবাদ ক্যানসারের মতো বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদও। মৌলবাদ আসলে ফ্যাসিবাদও। মৌলবাদীর কাছে ‘আমরা’ ছাড়া অন্যরা ‘অপর’। ‘অপরদের ওপর’ ‘আমাদের’ ধর্মের আলো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো অপরাধই অপরাধ নয়। সব অত্যাচার করা বৈধ। ইউরোপের এনলাইটমেন্টের সময় থেকে পৃথিবীজুড়ে ‘অপরের’ ওপর অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়া শুরু। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়ে যে কোনো মানবিক মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমার নিরপেক্ষতার ভাাবনা তোমার ভাবনার সাথে হয়ত মিলে যাবে। কিন্তু এও জানি আমার তোমার ভাবনায় ডানা মেলে দেবে না ধর্মান্ধ পৃথিবী।

তৃতীয় এবং শেষ গল্পগ্রন্থ ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কোথায় পাবো তারে’(১৯৯৯)। পুরান ঢাকায় সামষ্টিক শ্রেণিচরিত্রের মাঝে আবদুল করিমের প্রেমের বিষয়টি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ময়মনসিংহ বা ফুলবাড়িয়া যাওয়ার ঘটনায় মহল্লার সবাই আন্দোলিত হয়। ‘ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে-- ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘিœত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহে তারা বিছানায় জেগে থাকে।’ শহীদুল জহিরের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যহলো একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্পের অন্তর্বয়ন। এমনি একটি গল্প ‘আমাদের বকুল’(২০০০)। আকালু বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি গাভী পায়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার স্ত্রী ফাতেমা আর গাভীটির সমান্তরাল জীবনাচরণ- একই সঙ্গে গর্ভধারণ, একই সঙ্গে জমজ বাচ্চা প্রসব এবং একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সবই প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আঠারো বছরের তরুণ শহীদুল জহিরের সংবেদনশীল সত্তায় গভীর ক্ষত তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। সেই অতৃপ্তি বা হাহাকার থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা’ (২০০০) গল্পে ভূতের গলির জনজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখি -‘ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং আবদুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে, আহা রে আবদুল হালিম, আহা রে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না।’ বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ ভূতের গলির মানুষ প্রথমদিকে কারও ভাতের হাঁড়ি বা হাতঘড়ি বা হরলিকস এর বয়াম হারানোর ঘটনায় অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে এবং ঘটনাগুলো রহস্যময়ই থেকে যায়। ধীরে ধীরে বানর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে।একই সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল হালিম আর ঝর্ণার প্রেম, যুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে ঝর্ণার আকস্মিক মৃত্যু, আবদুল হালিমের যুদ্ধে যাওয়ার পথেই বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে মৃত্যু এসবই লেখক বানরের গল্পের সঙ্গে বলে গিয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর পর তার মা ছেলের তোষকের নিচে ঝর্ণার লাল সাটিনের ফিতা আবিষ্কার করেন এবং বহুবছর পর গৃহকর্মীর মেয়ে জবাকুসুমকে ফিতাটি দিয়ে চুল বেঁধে দেন ‘এবং তারপর সেদিন মহল্লায় লাল চুলের ফিতার ইতিহাস প্রকাশিত হয়।’ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার পাশাপাশি বানরদের এই সামান্য চুরিকে লেখক মানবিকই বলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের জনজীবনে মানুষরূপী কিছু হায়েনার হিংস্রতার নৃশংসতার ভয়াবহতা লেখক শহীদুল জহির অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’ গল্পে যুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে হানাদার-রাজাকারদের নিয়মিত হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নকে লেখক বলেছেন ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’- ‘তারপর ভূতের গলিতে ৩০ মে রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার সময় পাকিস্তানি মিলিটারি আসে। ... টিপু সুলতান রোডের মোড়ে ট্রাক থামার সঙ্গে সঙ্গে মহল্লায় খবর হয়ে যায়।... মহল্লার লোকেরা গাট্টি বোঁচকা মাথায় করে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বলধা গার্ডেন এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেগে যায়। মহল্লায় কোনো লোক না দেখে পাকিস্তানি মিলিটারি দলের নেতা লেফটেনান্ট শরিফ খেপে, সে বলে, কেয়া বাত হ্যায়, শালে লোগ সব ভাগ গিয়া? ... আবদুল গণি বলে, হালারা চুহা হ্যায়।... ইয়ে এক খেইল হ্যায়, ইন্দুর বিলাই খেইল হায়, চুহা বিল্লি হায়। তারপর মহল্লার চল্লিশটা বাড়ির ভেতর কেবল খতিজা বেগমদের ৩১ নম্বর বাড়িটা ছাড়া অন্য সব বাড়ি ২৭ অক্টোবর বুধবার পর্যন্ত মোট দুইবার করে পোড়ে।’ এই খেলা মহল্লায় বলবৎ থাকে যুদ্ধের পরও এবং স্বাধীন দেশে সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষের সঙ্গে এই জীবনমরণ খেলায় লিপ্ত হয়। শিশুদের সাধারণ ‘লৌড়ালৌড়ি’ থেকে শুরু করে ডেঙ্গুজ্বর বা মানুষের জিম্মিদশা পর্যন্ত এই খেলায় প্রতিভাত হয়। লেখক এই খেলার মাধ্যমে ভিন্ন আঙ্গিকে একটি মহল্লায় তথা সমগ্র দেশে সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকে পুননির্মাণের চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ‘প্রথম বয়ান’ (২০০২) গল্পে আবদুর রহমান শেপালি আকতারের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনেকটা খেয়ালের বশেই। পরবর্তীতে কৈশোরের সে প্রেম খুঁজে বেড়ায় সারাজীবন। শেপালি আকতার ‘দান দান তিনদান’ চেষ্টার পরও যখন আবদুর রহমানকে চম্পা ফুলের ডাল দিতে পারেনি তখন তার অভিমান হয় এবং পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে তার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। আবদুর রহমানের কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়েই থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হানাদারদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভূতের গলির বাসিন্দারা জিঞ্জিরায় আশ্রয় নেয়। তখন কোনো এক রাতে তাদের দুজনের দেখা হয় এবং শেপালির মুখে চম্পাফুলের গল্প শুনে ‘আবদুর রহমানের মনে হয়তো দুঃখ জেগে ওঠে, অধিকারের ভেতরকার পাকা আম পঁচে গেলে যে দুঃখ হয়, সেই দুঃখ, সেই শোক’। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পের নায়কের কথা। কৈশোরে সুরবালাকে হেলায় হারনোর পর উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী হিসেবে যখন তাকে আবিষ্কার করে তখনই নায়কের আত্মপীড়ন শুরু হয়। এতকালের আত্মপ্রবঞ্চনার খতিয়ান নিয়ে ‘বানের জল’ থেকে বাঁচতে প্রলয়রাত্রে সুরবালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোনো কথা না বলে ফিরে যাওয়াকেই সে জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করে।

অনেক দীর্ঘ লিখে ফেলেছি, আসলে আরো কত কিছুই তো লেখার বাকী আছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশটাকে নিজের বলেই জেনে এসেছি কিন্তু এই কদিনে এত বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চেনা মানুষগুলোকেও ভীষণ অচেনা ঠেকছে। এত দ্বেষ এত ঘৃণা জমেছিল মানুষের মনে আগে বুঝিনি। আমি রাজনীতি বুঝিনা, ইনফেক্ট রাজনীতি বুঝতে চাইও না। চারদিনে কলকাতা দখল কিংবা সেভেন সিস্টার দখল করার গল্প শুনে কষ্ট পেলেও আমি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাইনা। শুধু বলতে ইচ্ছে করে শহীদুল জহিরের প্রথম বয়ানের ভাষাতেই-‘ সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত’- এই বোধ আবদুর রহমানকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং বহুবছর পরেও ‘কেরোসিন বাত্তি খোঁজার ছলে’ তার বাল্যপ্রেমকেই খুঁজে বেড়ায়। কারণ “আবদুর রহমানের হয়তো এক শোক হয়। যে ঘটনা ঘটার সময় বোঝা যায় না, পরে বোঝা যায়, তার জন্য শোক করা ছাড়া আর গতি কী? ভূতের গলিতে আবদুর রহমান এই অবস্থায় পড়ে ‘চাপা খায়া থাকে’।

নিরন্তর ভালো থেকো। পরশু কয়েকদিনের জন্য পাহাড়ে যাবো আশা করি সেখান থেকে ফিরে এসে দেখবো তোমার চিঠি অপেক্ষা করছে নতুন কোন আলো নিয়ে।

ইতি-
বাসু
১৫ জানুয়ারি,২০২৫

বিঃদ্রঃ নতুন বছরে কি এখনো বই কেনো নতুন কি কি বই কিনলে জানিও। ফেব্রুয়ারি মাসে তো তোমার জন্মদিন, বুড়ি হয়ে যাচ্ছো সুস্মি! কেমন লাগছে? চিরনতুন বৃদ্ধাকে অগ্রীম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in









বের্নহার্ডের বাবা মা এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা অনুভব করেছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে সমাজে তাদের চেনা লোকজনেরা সবাই কেন ছেলেটাকে ঠিক নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে না। গোটা ব্যাপারটা তাদের রাগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে তারা নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের উপরে রেগে গিয়েছিলেন। কারণ এর ফলে তাঁদের অভিভাবকত্বের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছেন যে বের্নহার্ডের আচার আচরণের মধ্যে উদ্ভট কিছু জিনিস আছে এবং এটা বুঝতে পেরেই তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। বিশেষত বের্নহার্ডের মা, তিনি যথেষ্ট ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী মহিলা, যিনি লক্ষ্য করেছেন যে বের্নহার্ড ক্রমশ তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বের্নহার্ডকে বেশ ভাল বুঝতে পারেন এবং ছেলের স্বভাবচরিত্র কতকটা তাঁরি মত হয়েছে। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, এটা বোঝা যাচ্ছে যে বের্নহার্ড একটু আলাদা রকমের আচরণ করছে। এটা বুঝতে পেরে বের্নহার্ডের মায়ের মনে প্রশ্ন জাগছে যে তবে কি ছেলে তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছে আজকাল? ছেলে ঠিক কী করছে, সেটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর হৃদয় সব সময় বের্নহার্ডের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকছে। ছেলের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের জন্য দু’ হাত বাড়িয়ে প্রস্তুত তিনি, অথচ মনে আশঙ্কা যে ছেলে আর ফিরে আসবে না আগের অবস্থানে। কোথাও কি একটা ভয় আর তিক্ততা তৈরি হয়ে যাচ্ছে? কেন? কোথায় সমস্যা? মায়ের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কেউ যদি এসব তাঁকে জিজ্ঞেস করে… তিনি উত্তর দিতে পারবেন না এবং তাঁর চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রুপাত হতে থাকবে।

এদিকে আবার বের্নহার্ডের বাবা সঠিকভাবেই জানেন যে বের্নহার্ডের চরিত্রের সমস্যা ঠিক কোথায়। তাঁর মতে, বের্নহার্ড যথেষ্ট সপ্রতিভ এবং ভাল ছেলে; তবে বেশি স্বাধীনতা বের্নহার্ডের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, সে সহজে অন্য মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। ফলে তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্ষতিকারক সঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার এবং ভবিষ্যতে যাতে তাঁর আচরণ বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে, সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সেটা তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় বের্নহার্ডের বাবার মতে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও ছেলের সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত হলেন। তারপর অবশ্য তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে, কারণ সময় প্রায় রাত বারোটা এবং বের্নহার্ডের বাবা বললেন যে তিনি বের্নহার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চান।

দু’টো বাজল। বের্নহার্ড ফেরেনি এখনও।

বের্নহার্ডের দু’ চোখ ভর্তি ঘুম। শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। সে গের্টের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন তাঁকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি পাঠানো অসম্ভব ব্যাপার, ভাবছিল ইনেস। গের্ট যদি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।

বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগছিল। ইনেস তাঁকে ঘুম থেকে তুলবার জন্য চুম্বন করছিল। শুধু তাই নয়, ঘুম থেকে উঠে যখন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বের্শেন ফরাসি ভাষায় বিড়বিড় করছিল, তখন ইনেস তাঁর দুটো কান ধরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তাঁকে অন্তত আরও তিনবার চুমু খেয়েছিল। নিজেকে আদুরে খরগোশের মত মনে হচ্ছিল বের্শেনের। গের্ট নিজের বড় কোটের ভেতরে মালপত্র প্যাক করবার মত করে তাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে একতলায় নামিয়েছিল। তারপর বের্শেন গাড়িতে আধঘুমন্ত অবস্থায় নিজেকে ইনেস আর গের্টের মাঝখানে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল। খুব ভাল লাগছিল তাঁর; ইচ্ছে করছিল যেন প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে এই গাড়ির যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ হয়।

বের্নহার্ডের বাবা বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়েছিলেন। নিজের ঘরের দরজা খুলে ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে একতলার আলো জ্বলে উঠল এবং কয়েকজন ঢুকল। তিনি তাড়াতাড়ি ছায়ায় সরে গিয়ে নিচে কী হচ্ছে সেটা দেখতে লাগলেন। লম্বা একহারা চেহারাটা দেখে তিনি গের্টকে চিনতে পারলেন। গের্ট প্যাকেট খুলবার মত করে একটি ছেলেকে মোটা কোটের ভেতর থেকে বের করছে, সে নিঃসন্দেহে বের্নহার্ড। পাশে ইনেস দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হাতে বের্নহার্ডের নিজের কোট। গের্ট তারপর বের্নহার্ডকে প্রায় টানতে টানতে একতলায় ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো। কাজটা করতে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োজন। বের্নহার্ড তারপর ইনেসের হস্তচুম্বন করল। উত্তরে ইনেস বের্নহার্ডের মাথার চুলে আলতো টোকা দিল। তারপর বেশ জোরে জোরে বলে উঠল... ‘গের্ট, তুমি বের্শেনকে দোতলায় তুলে দিয়ে এসো। আমি বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’ তারপর বের্নহার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুভরাত্রি বের্শেন! আগামীকাল ভাল ভাবে স্কুলের ক্লাস কোর।’

বের্নহার্ড, যাকে খুব ঘুমন্ত দেখাচ্ছে, সে ধীরে ধীরে গের্টের হাত ধরে এবং গের্টের কাঁধে মাথা রেখে উপরে উঠে এল।

বের্নহার্ডের বাবা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে, গের্ট এবং ইনেস কেউ তাঁকে দেখে ফেলবার আগে, যতটা নিঃশব্দে সম্ভব, সেইভাবে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।

বের্নহার্ডের সঙ্গে তাঁর বাবার কথোপকথন মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। অবশ্য সেটাকে ঠিক কথোপকথন বলা চলে না। কারণ, বের্নহার্ড সেরকম কোনো কথাই বলেনি। এমনকি যে ক্ষেত্রে আপত্তি জানাবার প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রেও বের্নহার্ডের বক্তব্য অনেকখানি ক্ষমাপ্রার্থনার মত শোনাচ্ছিল।

সেই মুহূর্তে বাবা মায়ের ভাবনা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সেই কারণে যে তাঁর মা এতখানি কষ্ট পেয়েছেন, সেটা শুনে সে ভারি আশ্চর্য হয়েছিল। সে এইভাবে ভেবে দেখেনি ব্যাপারটা। এ কথা, সে কথা বলতে বলতে তাঁর বাবা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন যে ইনেস কখনও বের্নহার্ডকে চুম্বন করেছে কি না। বের্নহার্ড এই প্রশ্নে ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলে দিল যে না, সেরকম কিছু হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল সেটা বলাই সঠিক কাজ। তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে নাহলে তাঁর বাবার ইনেস সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে। তাছাড়া ইনেস তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসবার জন্যই চুমু খেয়েছিল সেদিন। নাহলে সাধারণ ভাবে এরকম কিছু ঘটে না। কিন্তু বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন তাঁর জবাব শুনে এবং পরবর্তী প্রশ্নটা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগল। রাগত স্বরে বলে উঠলেন তিনি…

-‘তোমার লজ্জা করে না সারাক্ষণ মিছে কথা বলে যেতে?’



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





একুশ

আজ সুনীতা গ্রামের বাড়ি যাবে। সে পরিবারের সঙ্গে বাসস্টপে এসেছে ব্যাগপত্তর নিয়ে। সুনীতাকে দেখে অতনু কাছে এল। অতনুর মা বললেন, সুনীতার মুখে তোমার কথা শুনেছি। আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি পুজো দেখতে চল। অতনু বলল,আমি অনাথ পুজোবাড়িতে আমার স্থান হবে? সুনীতার মা বললেন, কে বললো তুমি অনাথ। তুমি আমাদের পরিবারের একজন হলে। আমরা আছি, চল। অতনু তার সঙ্গিদের বললো, আমি পুজোয় গ্রামে যাচ্ছি। তোরা সাবধানে থাকিস।

গ্রামের পুজোবাড়িতে আরতির বাজনা বাজছে। ধুনোর গন্ধে পুজোবাড়ি মাতোয়ারা। আর একটু পরেই ধুনুচি নাচ শুরু হবে।

সুনীতা ধুনুচি নাচ নাচছে। ধুনোর গন্ধে অতনু খুশি। একটা শিহরণ তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুনীতার চোখ তার দিকে। সুনীতার মা অতনুকে হাত নেড়ে হাসিমুখে ডাকছেন। সুনীতার মায়ের মুখটা ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অতনু এই প্রথম বলে উঠলো, মা, মা গো...।

রাজুকে বিপিন তার বাড়ি নিয়ে আসে,গল্পগুজব করে।সে বলে,তোমার যখন ইচ্ছে হবে আমার বাড়ি আসবে। এবার পুজোয় আমরা আবাডাঙা যাব।বিপিন বলে,শুনেছি ওখানে পটের ঠাকুর পূজিত হন।রাজু বলে,হ্যাঁ।দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।রাজু বিপিনকে নিয়ে এল আবাডাঙা।সে বলল,বীরভূমের আবাডাঙা গ্রামে বাড়ুজ্জে পরিবারের পটের পুজো বিখ্যাত। পটের দুর্গা,পটের লক্ষী,পটের কার্তিক নানা জায়গায় পূজিত হন। পাটের থিম "পট ও পুতুল এর মাঝে এস ই ও " মূলত প্রতিটি জেলার হস্তশিল্পের তাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ।থিমটি প্রথমবারের মতো বাংলার ২৩টি জেলার প্রতিটি হস্তশিল্পের সারমর্ম। সমৃদ্ধসাংস্কৃতিক এই ঐতিহ্যকেই মূলত তুলে ধরতেই চেয়েছে এসইও।এসইও র এই উদযাপন শুধু বাসিন্দাদের জন্যই নয়।ঘরের মেয়ের এই আগমন উৎসব সমস্ত দর্শকদের উপভোগের জন্যও সমান খোলা থাকে। ভাস্করশিল্পী প্রদীপ রুদ্র পালের হাতে এবার তৈরি হচ্ছে তাদের মাতৃমূর্তি।দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে আসে সিলভার ওকের এমন নির্মল ও কল্যাণময় মাতৃমূর্তি দেখতে। সারল্যই এই মূর্তির বৈশিষ্ট। মা পরে থাকেন সুতির শাড়ী। সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ের সাজে সেজে ওঠেন ওখানে মা। সঞ্জায় দাসের সৃজনশীল নির্দেশনায় এবার সেজে উঠছে সিলভার ওকের মন্ডল। আলোকসজ্জ করছেন এবারে বিশ্বজিৎ সরকার। প্যান্ডেল ডিসাইনের দায়িত্বে আছেন সুরজিৎ সেন।

পূজার সময় একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবার। তাদের মধ্যে

প্রথম হলো আনন্দমেলা উৎসব এই উৎসবে বাড়ির শেফরা তাদের রান্নার দক্ষতা প্রদর্শন করবেন ।

দ্বিতীয়ত আবাসিকদের জন্য থাকছে ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, যেখানে নাটক, আবৃত্তি, নাচ, গান প্রভৃতি পরিবেশন করতে পারবেন ৮ থেকে ৮০ সকলে

তৃতীয়ত স্বনামধন্য গায়ক অনীক ধর ও উর্মি চৌধুরী আসছেন এই পুজোয় গান গাইতে।

চতুর্থত থাকছে মহাভোজ। এই চারদিন আবাসিকরা মণ্ডপেই পুজোর ভোগ খাবেন। আর খাওয়া দেওয়ার সাথেই চলতে থাকবে আড্ডা।

ভগ্নপ্রায় মন্দিরেই পুজো পান দেবী পটেশ্বরী। বর্ধমান রাজবাড়িতে যখন রাজা রাজত্ব করতেন তখন সাড়ম্বরে পূজা পেতেন দেবেন পটেশ্বরী। কিন্তু এখন সেই পুজোর জৌলুস খানিকটা মলিন হয়েছে। অতীতে বহু মানুষ এই পুজো দেখতে ভিড় জমাতেন। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই বাড়ির পুজো দেখতে। বর্ধমান রাজার তৈরি লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হতো।

এই পুজোতে বাড়ির মহিলারা কখনই সবার সামনে আসতেন না। গোপন রাস্তা দিতে তাঁরা মন্দিরে আসতেন এবং সেখানকার দ্বিতলে বসে পুজো দেখতে। পুজোটা আজও হয়। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দির প্রায় ভেঙে গিয়েছে। গত দুই বছর করোনার কারণে জনসাধারণ এই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৮.২

গ্রামসভার প্রধান হতে হলে শনিচরকে আগে জনগণকে বোঝাতে হবে—দেখ ভাইলোগ, আমি কিন্তু কারও চেয়ে কম ধূর্ত নই। আমাকে নেহাত ভালমানুষ ভেবে ভোট না দেয়ার ভুল করে বোস না যেন!

ও ভাবছিল যে গাঁয়ে কোন বড় কাজ করে দেখাবে। রঙ্গনাথের থেকে শুনেছে ভোটের আগে বড় বড় নেতারা নিজের নির্বাচন ক্ষেত্রে কোত্থেকে যেন কী এক কায়দায় টাকার বাণ্ডিল ঠেলাগাড়ি করে নিয়ে যায়। তারপর জনকল্যাণের নামে ওসব নর্দমায় ফেলে দেয়। শনিচরও অমনই কোন ম্যাজিক দেখাবে। এসব ও বৈদ্যজী মহারাজকে জানায় নি। শেষে এই কাজের জন্য কালিকাপ্রসাদ নামের এক ‘গঞ্জহা’কে নিজের দোসর বানিয়ে ফেলল।

কালিকাপ্রসাদের পেশা হল সরকারি গ্রান্ট এবং ঋণ গিলে ফেলা। ও সরকারের পয়সার ভরসায় এবং সরকারি পয়সার জন্যে বাঁচত। এই পেশায় সাহায্য পেত তিনজনের থেকে--এই অঞ্চলের এম এল এ; খদ্দরের পোশাক এবং এই কথাটি---‘ না না, এখন টাকা ফেরতের কথাই বলবেন না। আপনার যাতে ঋণ আদায়ের কাজ কিছুদিন চেপে রাখতে অসুবিধে না হয় তার জন্য উপরমহলে দরখাস্ত করে দিয়েছি’।

আমার চোখে ও হল গাঁয়ের সবচেয়ে আধুনিক লোক। কারণ ওর পেশাটি আধুনিক কালের। ও একেবারেই প্রেমচন্দের গল্পের নায়ক নয় যে খাজনা আদায়ের সরকারি আমলাকে দেখলে ঘাবড়ে গিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়বে আর বৌকে বলবে—দরজায় যম দাঁড়িয়ে আছে।

ও সেইরকম নায়ক যার বাড়িতে হাজার টাকা আদায়ের জন্য বাড়িঘর নীলাম করতে সরকারি আমিন এসেছে। তবে আমিন দাঁড়িয়েছে বারান্দার নীচে আর খোশামদ করছে, কিন্তু আমাদের নায়ক বারান্দায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রয়েছে। উলটে আমিনকে বলছে—‘আপনার নীলাম বন্ধ করতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলুন, উপর থেকে লিখিয়ে আনি’!

কালিকাপ্রসাদের পুরো কর্মযোগ সরকারি স্কীমের ফিলজফির উপর টিকে রয়েছে। যেমন, মুর্গীপালনের জন্য গ্রান্ট দেয়ার স্কীম বেরোল তো ও ঘোষণা করল-- মুর্গী পুষবে। একদিন ও বলে দিল---‘জাতপাত সব ফালতু। বামুন হই বা চামার, আমরা সব্বাই এক’।

এর পেছনের কারণটা হল সরকার চামড়া পালিশের জন্য গ্রান্ট দেবে বলেছে। ব্যস্‌, চামারের দল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এদিকে কালিকাপ্রসাদ চামড়ার গ্রান্ট আদায় করে নিজের গায়ের চামড়া আরও চকচকে করে ফেলল। এইভাবে ও একের পর এক জৈবসার তৈরির গর্তকে পাকা করার, ঘরে ঘরে ধোঁয়াহীন উনুন লাগানোর এবং নতুন ধরনের পায়খানা বানানোর গ্রান্ট আদায় করে ফেলল। সরকার কাজ কতদূর হয়েছে জানতে চাওয়ায় ও অনায়াসে যেমন রিপোর্ট চাই তেমনটি লিখে জমা করে দিল।

একই অবস্থা সরকারি কর্জা এবং তাকাভি বা চাষের জন্য নেয়া নগদ ঋণের। ওর ছিল পাঁচ বিঘে জমি। সেটাকেই জামিন রেখে পঞ্চাশ রকমের ঋণ নেয়া হয়েছে। তিনি প্রত্যেক সরকারি যোজনাতেই ঋণের টাকা নগদে চান, প্রত্যেক হাকিম তাঁকে নগদে দেয়ার সুপারিশ করেন, প্রত্যেকবার ওকে নগদ ঋণ দেয়া হয় এবং প্রত্যেকবার টাকা আদায়ের সময় সরকারি কদম উপরের নির্দেশে থেমে যায়।

ওর জ্ঞান ছিল বিপুল এবং বিশদ। যোজনা আয়োগ গ্রান্ট বা ঋণ দেবার জন্য কোন নতুন স্কীম খালি ছকে ফেলার দেরি, দেখা যাবে শ্রীমান এর মধ্যেই সেটার হাড়হদ্দ জেনে বসে আছেন। হতে পারে ওর চালচলন খানিকটা গেঁয়ো, কিন্তু যেসব ব্যবসায়ীরা নতুন বাজেট আসার আগেই ট্যাক্সএর খুঁটিনাটি জানতে পারে – উনি তাদের থেকে চতুর। উপর থেকে টাকা পয়সার স্যাংশন আসার আগেই দরখাস্ত নিয়ে জেলা- অফিসে হাজির। দেখা যাবে, আগামী দিনে কী কী নতুন স্কীম আসছে ও সেসব হাকিমদেরও বুঝিয়ে ছেড়েছে!

এমনই কালিকাপ্রসাদ এখন শনিচরের নতুন সহকারী।


গোড়ার দিকে যে ময়দানের কথা বলেছিলাম তার সবটাই ভূদান যজ্ঞে আহুতি দেয়া হয়নি। একটা টুকরো বেঁচে গেছল। তার বেশিরভাগই এবড়োখেবড়ো, যেটুকু সমতল সেটাও রুক্ষ্ম উষর। কিন্তু সরকারি কাগজপত্তরে সবটাই ‘উদ্যান’। জমিটির দশমুখী ব্যক্তিত্ব, তাই বিগত কয়েক বছর ধরে ওই জমি নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রতি বছর গাঁয়ে ‘বন-মহোৎসব’ পালন করা হয়। ভুল বুঝবেন না, এরমানে জঙ্গলে পিকনিক নয়, বরং উষর জমিতে বৃক্ষরোপণ। কখনও কখনও তহসীলদার সাহেব এবং বিডিও সাহেব লোকলস্কর নিয়ে মহাসমারোহে এখানে গাছ লাগাতে আসেন।

ওই জমির টুকরোকে কলেজের সম্পত্তি দেখিয়ে ইন্টারমিডিয়েট স্তরে কৃষি বিজ্ঞানের শাখা খোলা হল। ওটাকেই খেলার মাঠ দেখিয়ে শিবপালগঞ্জ গ্রামের নবযুবকদের যুবক-মঙ্গল-দলের নামে গ্রান্ট পাওয়া গেল। এই জমিটাকে শনিচর নির্বাচনের আগে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে পছন্দ করল।

গ্রামসভার প্রধান পদের নির্বাচনের প্রায় একমাস বাকি। একদিন ছোটে পালোয়ান বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় বলল, ‘শনিচর তিনদিন ধরে কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকে খবর পাওয়া গেল যে মামলা সেট হয়ে গেছে’।

বৈদ্যজী তক্তপোষে সমাসীন ছিলেন। খবরটা শুনতেই মনের ভেতরে কৌতুহল ছটফটিয়ে উঠল। কিন্তু বেশি আগ্রহ দেখানো আর ‘ছোটে’কে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করা—দুটোই ওনার সম্মানের পক্ষে অনুচিত। তাই উনি রঙ্গনাথকে বললেন—‘শনিচরকে ডেকে আনা হোক’।

ছোটে পালোয়ান নিজের জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থাতেই হাঁক পাড়ল—‘ শনিচর, শনিচর, শনিচর হো-ও-ও’!

যে লোকটি দৃষ্টিপথের এবং হাতের নাগালের বাইরে, তাদের ডাকার জন্যে শিবপালগঞ্জে এক বিশেষ পদ্ধতি প্রচলিত। এই পদ্ধতির প্রয়োগের জন্য তিনটে জিনিস দরকার—গলার নির্লজ্জ জোর, মজবুত ফুসফুস আর বিশুদ্ধ গোঁয়ার্তুমি। এই পদ্ধতির প্রয়োগের পেছনে পাক্কা বিশ্বাস হল যাকে ডাকা হচ্ছে সে যেখানেই থাকুক, তিনডাকের মধ্যে একবার তো শুনতে পাবে। যদি নাও শোনে, দ্বিতীয়বার যখন ডাক দেয়া হবে তখন তো শুনবেই। কারণ, দ্বিতীয়বারে তার নাম ডাকা হবে এভাবে—‘আরে কোথায় মরে গেলি রে! শনিচরা, শনিচরা রে’!

যেভাবে কোন ভদ্রতা ছাড়াই ছোটে পালোয়ান শনিচরকে ডাক দিল, সে ব্যাটাও ডাক শোনা মাত্র অমনই ভাবে বৈদ্যজীর দরবারে হাজির হল। ওর আণ্ডারওয়ার বিশেষ জায়গায় ফাটা, খালি গা, তবে চুল সরষের তেলে চপচপে। মুখের ভাব বেশ হাসিখুশি। এটা বোঝা মুশকিল যে কোনটার হাঁ বেশি বড়—মুখের নাকি আন্ডারওয়ারের?

এটা বলার তাৎপর্য এই যে শনিচরের মুখের বর্তমান চেহারা প্রমাণিত করছে --আমাদের মনে আনন্দ থাকলে দারিদ্র্য আমাদের দুখী করতে পারে না। অতএব, গরীবী হটাও প্রকল্পের সার কথা হল আমাদের হাসিখুশি থাকতে হবে, তবে না!

বৈদ্যজী প্রশ্ন করলেন—কী সমাচার শনিচর? শুনলাম, শহরে গিয়ে খুব কৃতিত্ব দেখিয়েছ?

শনিচর বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ মহারাজ। আমাকে বাধ্য হয়ে অনেক কৃতিত্ব দেখাতে হল। যখন সবদিক থেকে কৃতিত্ব, খুব কৃতিত্ব দেখালাম, তখন গিয়ে ‘খাপে খাপ পঞ্চার বাপ’ হল।

রঙ্গনাথের আর সহ্য হল না।

--‘আরে হেঁয়ালির ভাষা ছেড়ে আসল কথাটা বল; হয়েছেটা কী’

শনিচর দাঁত চেপে শিস টেনে বলল,’রঙ্গনাথ বাবু, এসব গঞ্জহাদের হেঁয়ালি। এত সহজে বুঝতে পারবে না’। কিন্তু এসব বলার পরে ও অল ইন্ডিয়া রেডিও’র খবর পরার ঢঙে একের পর এক হেডলাইন ও ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু করল।

--‘গুরু মহারাজ, ওই লোকটা, যার নাম কালিকাপ্রসাদ, ও কিন্তু মহা হারামী’। কথাটা এমনভাবে বলল যেন কালিকাপ্রসাদকে পদ্মশ্রী উপাধি দেয়া হচ্ছে।

‘হাকিমের থেকে নিজের পছন্দমত রায় পেতে মুখের চেহারা কালিকাপ্রসাদের মত হওয়া চাই। দরকার পড়লে ও বড় বড় ভাষণ ঝাড়তে পারে, কান-লেজ সব নাচিয়ে মুখ থেকে আগুন ছড়াতে পারে। এক নিঃশ্বাসে পাঁচ-পাঁচ সাত-সাত এমএলে’র নাম নিতে পারে। আর হাকিম বেচারার মুখ খোলা থাকে, বন্ধ হয় না। ওই সময় কেউ কালিকাপ্রসাদের লাগাম টেনে ধরুক দেখি!

‘কিন্তু মহারাজ, ওই কালিকাপ্রসাদ যদি কোন এঁড়ে হাকিমের মুখোমুখি হয়, তখন প্রথমেই কেঁচোর মতন নরম এবং বাঁকাচোরা হয়ে যায়। বলব কি মহারাজ! মাটির দিকে চোখ রেখে এমন ভূ-দানী নমস্কার করে যে হাকিমও ভাবতে থাকে লোকটা কে? বিকাশভাই নাকি প্রকাশভাই? বুদ্ধিতে চাণক্য কিন্তু এমন ভোঁদা চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে যে কারও সাধ্যি নেই ওর আসল রূপ টের পায় ! বড় বড় বুদ্ধিমান ওকে বোকা ভেবে খারিজ করে দেয়। আর তখনই ও পেছন ত্থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘আর গুরু মহারাজ, ওর দাঁও-প্যাঁচেরও বলিহারি! এ-হে- হে! সরকারি অফিসে চাপরাশি থেকে বড়বাবু, আর বড়বাবু থেকে হাকিম—সর্বত্র ওর অবাধগতি। ও একটি ঘুণপোকা, পাক্কা ঘুণ! যে ফাইলটা বলবেন সেটাতেই ঢুকে চেটেপুটে বেরিয়ে আসবে।

‘শিবপালগঞ্জের মুখ উজ্বল করেছে।

‘গুরু মহারাজ, আমাকেও বেশ কেরদানি দেখাতে হয়েছে। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ না থাকলে আমি টানাটানি করে একগাছি ছিঁড়তে পারতাম না। ও নিজেও আমার সঙ্গে থেকে তিনদিন ধরে গোটা শহর চষে বেড়িয়েছে। এমন হয়েছে যে বড় বড় রিকশাওলাও হার মেনে গেছে।ও কিন্তু তৈরি, বলে এখানে কাজ না হলে চলো ওখানে যাই। ওখানে না হলে ফের সেখানে চলো। পুরো শহরের নকশা মুখস্থ হয়ে গেল!

‘গুরুজী, কিছু আক্কেল তো আমারও আছে। বলতে গেলে বুদ্ধিটা আমারই। তার জেরে গাড়ি লাইনে এল। কিন্তু সেটা চালাতে লাগল কালিকাপ্রসাদ। আপনার দরবারে ওঠ-বোস করে করে আমিও কিছু দাঁও-প্যাঁচ শিখেছি। কথায় বলে—কুস্তির আখড়ায় রোজ লাথি খাওয়া লোকও একদিন পালোয়ান হয়ে ওঠে। বদ্রী ভাইয়ার আখড়া থেকে যেমন ছোটে পালোয়ান হয়েছে। তেমনই কিছু বিদ্যা আমার পেটেও ঢুকেছে।

‘ তো জানতে পারলাম যে আজকাল সমবায় আন্দোলনের হাওয়া বইছে। ব্লক অফিস থেকে একজন এডিও* এসে বলল—নিজের চাষের জমিকে ‘নিজের’ বলবে না। সবার খেতকে তোমার খেত বলো আর নিজের খেতটিকে সবার খেত বল। তবে গিয়ে সমবায় চাষ সম্ভব হবে আর খুব ফসল ফলবে।

‘আমি বললাম—এ তো মন্দ নয়! আমি গ্রামসভার প্রধান হয়ে গেলে সমস্ত খেত সরকারকে দিয়ে দেব। বলব-- নাও, সমবায় চাষ কর।

কিন্তু এডিও বলল—সরকার তোমার খেত নিয়ে কী করবে? চাষের খেত কী কল-কারখানা? খেত তোমারই থাকবে, চাষ তুমিই করবে। একটু কাগজের পেট ভরে দাও, তাহলেই চাষবাস সরকারি হয়ে যাবে। গাঁয়ে কু-অপারেটিব ফারম খুলে যাবে। শিবপালগঞ্জ সব বাপারে এগিয়ে। এই বিষয়েও সবার আগে হবে।

‘গুরু মহারাজ! আমি ভাবলাম, শিবপালগঞ্জ এগিয়ে যাক কি পিছিয়ে—আমাকে তো গুরু মহাআরাজের হুকুম মেনে চলতে হবে। প্রধান হবার জন্য দাঁড়িয়েছি, তো প্রধান হয়েই ছাড়ব। আমি এডিওকে বললাম- সাহেব, শিবপালগঞ্জকে কতটুকু চিনেছ? আমাদের পেচ্ছাপ কারও থেকে পাতলা নয়। আমরা সব ব্যাপারে এগিয়ে আছি, এগিয়ে থাকব। তাই এডিও সাহেবকে আমড়াগাছি করে বললাম—মামলা শুকনো, নাকি ভেজা? ও স্বীকার করল।

‘তখনই গুরুজী, আমার কালিকাপ্রসাদের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম—হে বজরঙ্গবলী! তুমি কালিকাপ্রসাদকে তো উজাড় করে দিয়েছ। এবার তোমার ভক্ত এই বাঁদরটার কিছু গতি করে দাও। সব টাকাপয়সা কেবল কালিকাপ্রসাদের ঘরের দিকেই ছুটে যায় কেন? বজরঙ্গবলী, একবার আমার ঘরের পথেও কিছু পাঠাও”।

* এডিও=এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট অফিসার।

‘ব্যস্‌, বজরঙ্গবলীর ধ্যান করে লাল ল্যাঙোট বেঁধে আমিও কালিকাপ্রসাদের ঘরে হাজির। কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে কোন ছ্যাঁচড়ামি করিনি। নিজেকে বললাম-বেটা শনিচর, ‘খুল্লা খেল ফারুকাবাদী’ খেলো! তবে কাজ হবে। আমরা দুজনে মিলে এমন এক ইস্কীম বানালাম যে ব্লকের এডিও-ফেডিও সবার হাগু নরম, পেট সাফ। এডিও পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন—এই না হলে গঞ্জহা! কাল কথা হয়েছে আর আজ ইস্কীম তৈয়ার।

‘গুরুজী, হয়েছে কি এই গাঁয়ে একটা কুওপারেটিব ফার্ম খুলবে। এ তল্লাটে কোথাও এই ফারম নেই। পশ্চিম দিকের উষর জমিতে ফারম দুলে উঠবে। উষর হয়েছে তো কী! কাগজপত্তরের কাজগুলো ব্লকওলারা সামলে নেবে। কাগজের ব্যাপারে ওরা তহসীল অফিস বা থানাদারের বাপ! বলুন তো আকাশে কুওপারেটিব বানিয়ে দেবে, এ তো সামান্য ধরতীর মামলা।

‘শহরে গিয়ে সব ফিট করে এসেছি। ভাবলাম, আপনি তো গত বছর কলেজে এক মিনিস্টারকে ধরে এনেছিলেন। এবার আমিও এক মিনিস্টার আনবো। তবে এই কাজটা আপনি ছুঁয়ে না দিলে হবে না। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ বলল—এর জন্য মিনিস্টার কেন, হাকিমকে পটাও। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।

‘এরপর তো সব কালিকাপ্রসাদের এলেম। শহরের নানা জায়গায় ঘুরে ও কখনও মুখ থেকে আগুন উগরে দিচ্ছে , তো কখনও একেবারে কেঁচো হয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। ওখানে টের পেলাম কালিকার কেমন চেনাজানা! কত জায়গায়! ও ঠিক বলেছে – যাই হোক, হাকিমই সব । ও এমন একজন হাকিমকে পাকড়েছে যার খুব মালা পরার ও লেকচার দেয়ার শখ। সকাল থেকে গলায় দশটা মালা চড়ার আগে ও দাঁতন করে না। আছোঁচা মুখে বসে থাকে।

‘তাহলে গুরুজী, মাথায় তো দশটা কাজের বোঝা চাপিয়েছি। তিন দিনের পরেই এখানে ফারমের সভা হবে। সামনে আপনিই থাকবেন। জলসা-বাদ্যি, মালা-সামিয়ানা, ফটো-টটো এসব ব্লকওলারা সামলে নেবে। কিন্তু আমাদেরও জোরদার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার ব্যাপারে মটর-ঘুগনিতেই কাজ চলে যাবে। হাকিম বলেছেন উনি চাষিদের সঙ্গে বসে চাষিদের মত করে খাবেন। আমরা বুঝেছি- গুরু, যার মত করেই খাও, আসলে তুমি না খেয়ে ছাড়বে না! মটর তো শহর থেকে আনাতে হবে, এখানে মটর কোথায়’?

শনিচর তো জলসার ব্যবস্থার কথায় মত্ত, ছোটে পালোয়ান দিল ধমক।

--‘এবার মটর নিয়ে সটর সটর থামাও। কাজের কথা বল। হাতে কী এল’?

শনিচর নিস্পৃহভঙ্গীতে বলল, ‘আমার হাতে কী আসবে, পালোয়ান? যে সুসাইটি তৈরি হবে ফারমের কাজ শুরু করতে ওকে পাঁচশ’ টাকা দিতে হবে। সব জায়গায় এটাই রেট। যা পাওয়ার, সুসাইটি পাবে’।

ছোটে পালোয়ান ঠা-ঠা করে হাসল। ‘ বাহ্‌ রে বেটা মঙ্গলদাস! কী কথাই না শোনালে! কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ’!

বৈদ্যজী প্রসন্নচিত্তে সব শুনছিলেন। ওনাকে দেখেই মনে হচ্ছে ভবিষ্যত উজ্বল। উনি পঞ্চতন্ত্রের স্টাইলে একটা কিসসা শুনিয়ে শনিচরের তারিফ করে বললেন—বাঘের বাচ্চা প্রথম বার শিকার করতে বেরিয়ে একলাফে একটা সম্বর হরিণ মেরে এনেছে।

(চলবে)
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব-২১

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে
(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-দ্বিতীয় অংশ


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র এই অন্তর্দ্বন্দের সুযোগে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছিল তাই নয় তারা এই সুযোগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেছিল এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছিল।এর আর একটা বড় কারণ হলো যে পারস্পরিক সংঘাত আন্তঃরাজ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছিল। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত পিটসের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী যদিও সামরিকখাতে ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত রেখে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসাবৃদ্ধির উপরে গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনকে কার্যতঃ খারিজ করে দিল। ওয়েলেসলির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। নিজেকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে দেখার স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিল সে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ইজিপ্ট এবং সিরিয়া আক্রমণ এবং অধিগ্রহণের চেষ্টা ওয়েলেসলিকে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকারকে ভারত অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহমত হবার জন্য। যদিও কারণ হিসাবে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল ওয়েলেসলি কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করতো যে ইজপ্ট থেকে স্থলপথে অথবা কেপ অফ গুড হোপের দিক থেকে জলপথে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা সেই সময় ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারে অনীহাকে মাথায় রেখে ওয়েলেসলি ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথা প্রস্তাব করে যাতে বলা হয় কোম্পানি কেবলমাত্র রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করবে কিন্তু রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেবে না। ওয়েলেসলির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ভারতে কর্মরত অন্যান্য ব্রিটিশ আমলারাও সহযোগিতা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলে যে ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের ব্যবসা করার পরিবেশ অনুকূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যে আবশ্যিক সে কথা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত তখন সেটাকে ভয়ঙ্কর বলে আবার যখন পরিস্থিতি শান্ত তখন সেখানে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে বিপথে চালিত করেছিল ওয়েলেসলি। তবে ব্রিটিশ সরকারের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এতটা নির্বোধ ছিলনা যে তারা কিছু না ভেবে ওয়েলেসলির এই কর্মকান্ডে মদত দিয়েছিল। অন্য কোনও ইউরোপিয়ন শক্তি যেন কোনওভাবেই ভারতবর্ষ দখল করতে না পারে তার জন্য ওয়েলেসলিকে সবরকম মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়লো তখন ওয়েলেসলিকে দেশে ফিরিয়ে নিল ব্রিটিশ সরকার। সেটা ছিল ১৮০৫ সাল।

এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন মাইসোরে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটিশদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। ওদিকে মাইসোরের সীমানা উত্তরে কৃষ্ণা এবং পশ্চিমে মালাবার উপকূল অবধি এগিয়ে গেল। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য মূলতঃ হায়দ্রাবাদ এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। এই রাজ্যগুলি প্রায়শই ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করতো। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হত এই ভেবে যে মাইসোরের পিছনে ফরাসিদের সমর্থন আছে। কিন্তু এই আতঙ্ক অযৌক্তিক ছিল। মালাবার উপত্যকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে মাইসোরের নিয়ন্ত্রন ব্রিটিশরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গোলমরিচ এবং এলাচের ব্যবসা ছিল মাইসোরের নিয়ন্ত্রনে। ১৭৮৫ সালে টিপু সুলতান গোলমরিচ, এলাচ এবং চন্দনকাঠের আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৮৮ সালে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছে মাইসোরের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রইলো না। কিন্তু টিপু সুলতান তখন মাইসোরকে কেন্দ্র করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। টমাস মুনরো এবং আলেক্সান্ডার রিডের মত কমবয়সী সামরিক আধিকারিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যদিও অসামরিক প্রশাসকেরা ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তারাও কিছুদিনের মধ্যেই বিপদের আঁচ পেয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং পরবর্তীকালে ওয়েলেসলির সঙ্গে ভারতের মানচিত্র থেকে মাইসোরের চিরকালীন বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য জানাল। তারপর চারদফা যুদ্ধের পর ১৭৯৯ সালে মাইসোরের দখল নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। প্রথম যুদ্ধে(১৭৬৭-৬৯) মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হায়দার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে আবার ১৭৯০ সালে তৃতীয় দফার যুদ্ধে এই দুই ভারতীয় শক্তি ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশের নেতৃত্বে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশদের আর এক মিত্র রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করেছিল টিপু সুলতান। এই যুদ্ধে ডিন্দিগুল, বারামহল এবং মালাবারকে মাইসোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশ। এর কিছুদিন পরে ফরাসিদের সাময়িক উত্থান এবং তাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের গোপন আলোচনাকে অজুহাত করে মাইসোর আক্রমণ করে ওয়েলেসলি। এই ঔপিনিবেশিক আগ্রাসনের যুদ্ধে মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপট্টম দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শ্রীরঙ্গাপট্টম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় টিপু সুলতান। মাইসোরকে আবার নিয়ে আসা হয় ওয়েলেসলির অনুগত ওয়েদার রাজবংশের অধীনে। মাইসোর হারালো তার স্বাধীনতা চিরকালের মতো। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত চুক্তি অনুযায়ী মাইসোর অন্য কোনও ইউরোপিয়ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। মাইসোরের রাজদরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্থায়ীভাবে থাকবে এবং তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে মাইসোরের রাজা। এই চুক্তির অধীনে থাকতে সম্মত হওয়ার জন্য মাইসোরের কিছু অংশ হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে বোম্বে এবং গুজরাতের মধ্যে দিয়ে চিনের সঙ্গে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান তুলার ব্যবসা তাদের ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। রাজত্বের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক পারিবারিক বিবাদকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা ঐ অঞ্চলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। রঘুনাথ রাও চক্রান্ত করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পেশোয়া নারায়ণ রাওকে হত্যা করলে ঐ অঞ্চলের মারাঠা সর্দারদের রোষের মুখে পড়ে এবং বাঁচবার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৫ সালে রঘুনাথের বাহিনী গুজরাতে বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হয় এবং তাকে উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ এবং বোম্বে থেকে বিশাল সেনাবাহিনী গুজরাতে এসে পৌঁছোয়। রঘুনাথের বিরোধীরা কোম্পানিকে রঘুনাথের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সর্তে বেশ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার প্রস্তাব করে পুরন্দর শান্তিচুক্তির খসড়া পেশ করে। কিন্তু পুরন্দর চুক্তি কলকাতার কোম্পানি অধিকর্তারা বাতিল করে দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মারঠারা নানা ফাডনিস, সিন্ধিয়া এবং হোলকারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াদগাঁও এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে। এরপর বাঙলা থেকে বিশাল বাহিনী এসে এলাকা পুনরুদ্ধার করে। নানা ফাডনিস এবং ভোঁসলে পরিবার ১৭৮১ সালে নিজাম এবং হায়দার আলির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু ১৭৮২ সালে এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের অনুকূলে যায় এবং ১৭৮২ সালে সালবাই চুক্তির মধ্য দিয়ে মারাঠারা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং মাইসোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিতে সম্মত হয়।              

0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






“হেলো”!

ব্যারিটোন ভয়েস কানে যেতে, এতোক্ষণ প্রকৃতিতে মগ্ন শ্রুতি, তাকিয়ে দেখে তার সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।

কখন এসে বসলেন ভদ্রলোক ! এতোক্ষণ তো ছিলেন বলে মনে হচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট শ্রুতি যখন ট্রেনে ওঠে তখন এই ফার্স্টক্লাস কোচটা একরকম ফাঁকাই ছিল। কোচের শেষ দিকে বোধহয় দু’ একজন ছিলেন।

এই সুন্দর আরামদায়ক কোচখানা প্রায় পুরোপুরি তার দখলে, ভেবেই শ্রুতির ইন্ট্রোভারটেড চিত্ত আনন্দে নেচে উঠেছিল। আ:, কী শান্তি! ভিড়ভাট্টা, বাচ্চাদের চিৎকার, কান্না কোনো ঝামেলা নেই। প্রকৃতি দেখতে দেখতে একা একা সুন্দর সময় কাটানো যাবে !

কিন্তু হা হতোস্মি! তার সেই আশায় এবং একাকীত্বে জল ঢালতে কে এই মূর্তিমান আবির্ভূত হলেন!

আর তার সামনে এসে বসলোই বা কখন.কে জানে! হয়তো শ্রুতি যখন এটেন্ডেন্ট মহিলার সঙ্গে কথা বলতে ওপাশে গেছিলো তখন এসে বসেছে।

অবশ্য আগে পরেও হতে পারে, কারণ ট্রেনের চারপাশের সৌন্দর্যে শ্রুতি এমনই বুঁদ হয়েছিল, যে অন্য কোনো দিকে মন দেবার মতন অবস্থাতেও সে যে ছিলনা, এটাও ঠিক।

আর এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এই প্রথমবার গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাচ্ছে শ্রুতি। উ:, কী রোমাঞ্চকর! গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আর তার আশেপাশের সৌন্দর্য , যা সে এতোদিন শুধু ছবিতে দেখেছে, এবার চাক্ষুষ দেখবে। ভাবা যায়!

এখনো তো গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আসতে একটু দেরী আছে, অথচ এখনই চারদিক কী অপরূপ হয়ে উঠেছে!

ট্রেনের বাইরে যেদিকেই তাকাও বরফের পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছে স্নো পিক গুলোকে, ট্রেনের মস্ত মস্ত কাঁচের জানলার গায়ে কেউ যেন আঠা দিয়ে ছবির মতো সেঁটে রেখেছে।

আর ট্রেনের সঙ্গে ছুটে চলা চোখ ঝলসানো রকমের সাদা বরফ পাহাড়ের নীচে দিগন্ত ছোঁয়া , ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এমন গাঢ় সবুজ তৃণভূমি।

আর সেই সবুজ মেডো তে চরে বেড়াচ্ছে বাদামী সাদা ছোপ ছোপ গরু, দারুণ মিষ্টি বাচ্চা ভেড়া, মা-ভেড়া, পক্ষীরাজের মতো ঘোড়ারা-কোনোটা ধপধপে সাদা, কোনোটা কুচকুচে কালো,কোনোটা বাদামী, তাছাড়া মেশামেশি রঙের তো আছেই। ঠিক যেন রূপকথার দেশ।

গরুগুলো আবার একটু বেশি সাহসী। ট্রেনের প্রায় কাছ ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে। আর তাদের গলায় সব বড়ো বড়ো ঘন্টা বাঁধা। সে সব ঘন্টার আবার কী সুরেলা আওয়াজ! শ্রুতির মনে হচ্ছে ওরা যেন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ডাকছে।

হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে দূরে দূরে একেকখানা কটেজ । ছোটবেলায় শ্রুতি ড্রয়িং খাতায় যেমন আঁকতো,ঠিক তেমনি ছবির মতো তাদের ঢালু ছাদ, আর ছাদের কোনায় একটা করে চিমনি। ওপরে আশ্চর্য নীল আকাশ…

“ প্রথম বার কি”?

উল্টোদিকের সীটের ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফেরে শ্রুতির। রূপকথার দেশ থেকে তার মন ঝপ করে ফিরে আসে ট্রেনের কামরায়।

শ্রুতির বিভোরতা দেখেই কিনা কে জানে,

ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী গভীর নীল চোখ! আর সেই চোখদুটোয় আশ্চর্য কিছু যেন ঝিকমিক করছে! মুখে মৃদু হাসি।

ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতির সারা শরীর হঠাৎ অকারণে কেন যেন কেঁপে উঠল।

কী হ্যান্ডসাম দেখতে! মনে হয় ছ'ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবেন, গ্রীক গডের মতো মুখ, মাথার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে এলেও তার গাঢ় সোনালী রঙ, সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আগুন একেবারে।

হ্যান্ডসাম , আকর্ষক বিদেশি পুরুষ, শ্রুতি তো আর প্রথম দেখছেনা, কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতর কী যেন আছে! চোখে চোখ পরা মাত্র তাকে পাগলের মতন টানছে। ভদ্রলোকের আকর্ষণের কাছে, এতোক্ষণ তাকে বুঁদ করে রাখা আশপাশ, প্রকৃতি সবকিছু একেবারে ফিকে, আলুনি লাগছে।

টেবিলের উপর রাখা ভদ্রলোকের গ্লাভস পরা হাতদুটো একবার ছোঁয়ার জন্য তার সমস্ত শরীর যেন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। সামনের ভদ্রলোকের শরীরের ভাষাতেও যেন সেই একই আকুলতা!

এটা কি হচ্ছেটা কি? আর এই চল্লিশের ওপরে এসে? লাভ এট ফার্স্ট সাইট?

ফু:.!..সে সব গল্প কথা মাই ডার্লিং। বাস্তবে হয়না,, বলে মনে মনে নিজেকে কষে এক ধমক দিলো শ্রুতি

“ প্রথম বার?”-

আবার সেই স্বর।

“ হ্যাঁ,… মানে অফিসের কাজে বার্লিন এসেছিলাম, তো ভাবলাম গ্রিন্ডেলওয়াল্ড টা দেখেই যাই। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন “

“স্বাভাবিক '

”স্যরি'?

শ্রুতির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই আশ্চর্য হাসিটি হাসেন ভদ্রলোক।

“আপনি চা খাবেন? আমি একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি “

“ নো, থ্যাংকস “

শ্রুতির অনুরোধ উপেক্ষা করেই একমনে খুব খেয়াল করে শ্রুতির আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগলেন ভদ্রলোক। ঠোঁটের কোনের হালকা হাসিতে খানিকটা অবয়সোচিত দুষ্টুমির আভাস।

,” নাউ ইউ হ্যভ নাইস অলিভ স্কিনকালার”-

আবার শ্রুতির অন্ত:স্থল ছুঁয়ে যাওয়া, গভীর অথচ মজার ভঙ্গিতে বলা পাগল করে দেওয়া সেই ব্যারিটোন ভয়েস।

একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল শ্রুতি। তারপরেই খানিকটা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টায়, আর খানিকটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, একটু বেশিই জোরে হেসে উঠলো , “না,না, আপনি ভুল করছেন,। আমার স্কিন ট্যানড হয়ে এরকম হয়নি। আমার স্কিন টোন এরকমই। আমি ভারতীয় তো, আমাদের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ এরকমই হয় সাধারণত “

মজাদার ভঙ্গিটা মুছে গিয়ে বিষন্নতার মতো কিছু ভদ্রলোকের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

অন্যমনস্ক ভাবে বার দুয়েক যেন ঘোরের মধ্যে “ ইন্ডিয়া… ইন্ডিয়া “ বলে চুপ করে গেলেন।

“আচ্ছা, আগে কি আমাদের কোথাও দেখা হয়েছে ? “

কিন্তু শ্রুতি তার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের আগের স্টেশন থেকে স্টার্ট করেও ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। ভদ্রলোক ও উঠে, কোচের পিছনে, বোধহয় রেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

কি হলো আবার! বিদেশের ট্রেন তো সাধারণত যেখানে সেখানে, যখন তখন থেমে যায়না! ব্যাপারটা কি হলো?

তখনই ট্রেনের অ্যনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে জানানো হলো যে অপ্রত্যাশিত ভাবে ইন্জিনে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। তাই স্টেশন থেকে ছাড়তে একটু দেরী হবে; অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি, মানে আধঘন্টা খানেকের মধ্যেই ট্রেন পরের স্টেশন, গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। প্যাসেঞ্জারদের এই অসুবিধার জন্য তারা নিতান্ত দুঃখিত।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি, যার নাম মারিয়া _মানে শ্রুতি এই মাত্র ই খেয়াল করলো তার আইডিতে লেখা রয়েছে , শ্রুতির পাশ দিয়ে যাছিল। শ্রুতি ও ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললো। “ “এক্সকিউস মি, ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক হতে তো একটু দেরি আছে, এই সময়টায় আমি কি নীচে নামতে পারি?”

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে তাকে নামার পারমিশন দিলো। কিন্তু সেই সঙ্গে সাবধানও করে দিল, সে যেন দূরে না যায়। এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়েই শ্রুতি জিগ্যেস করলো, “ কেন বলুন তো? জায়গাটা কি সেফ নয়?”

“না, না এই জায়গাটা খুব ই সেফ। আমার বাড়িও এখানে। এখন অবশ্য আমি আর আমার পার্টনার ইন্টারলেকেনে থাকি। গেছেন? না গেলে একবার ঘুরে নেবেন। ভারী সুন্দর শহর।

যাইহোক, এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিশ্চিন্তে কাছাকাছি ঘুরুন ফিরুন। নো প্রব্লেম।

বরং একটা কাজ করুন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান। ট্রেন ছাড়ার আগে আমি আপনাকে কল করে ডেকে নেব “

তাই সই।

সেটা অবশ্য খারাপ ও হবেনা। ওই সবুজ মেডোতে হাঁটা মানে এক অপার্থিব অনুভূতি! ভালোলাগায় ভরপুর হয়ে পাহাড় ছোঁয়া সবুজ মেডোর দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো শ্রুতি।

অন্য কোচ থেকেও কয়েকজন নেমে এসে পায়চারি করছেন দেখা গেল। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মনের আনন্দে সবুজ ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। সত্যি এখানে ভয়ের কিছু নেই। চমৎকার জায়গা আর লোকজন।

হঠাৎ ঝপ করে শেষ বিকেলের রোদটা মরে গেলো আর চারদিকে কেমন যেন চাপা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সঙ্গে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শ্রুতি কোটের পকেট থেকে বের করে টুপিটাও পরে নিলো।

শুধু যে সন্ধ্যে নেমে আসছে তা নয়, আকাশ জুড়ে গভীর কালো মেঘ করেছে। শ্রুতি দু এক পা সবে হেঁটেছে তার মধ্যেই ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

“ আমার বাড়ি এক মিনিটের রাস্তা। এখানে ঠান্ডায় কষ্ট না পেয়ে, আসুন আমার সঙ্গে “

ও মা, আবার ট্রেনের সেই ভদ্রলোক!

কথাটা বলেই ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে শ্রুতির সামনে সামনে চলতে লাগলেন।

হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাবে শ্রুতি তো একদম হকচকিয়ে গেল , আর তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তায় ও পড়ে গেল। গা টা একটু ছমছম করে উঠলো।

ট্রেনের আলাপ…না ঠিক আলাপ ও বলা যায়না কারন এখনও তারা কেউ কারুর নাম পর্যন্ত জানেনা। এই অবস্থায় ভদ্রলোকের তাকে একেবারে বাড়ি যেতে বলাটা… স্বাভাবিক কি?

সুইটজারল্যান্ডে ছুটকো ছাটকা পিকপকেট ছাড়া ট্যুরিস্টদের সঙ্গে অন্য রকম ক্রাইম হয়না বললেই চলে। তাহলেও বলা তো যায়না। এই ভদ্রলোকের ধান্দা অন্যরকম হতেও তো পারে!

“ শ্রুতি! তোমার যখন এতোই ভয়, একা একা বেড়াতে এসেছো কেন?”-

মায়ের গলায় শ্রুতি নিজেই নিজেকে একটা ধমক দ্যায়।

“ ভয় করছে? “

আবার সেই মদির ব্যারিটোন ভয়েস।

ভদ্রলোক কি মনের কথাও পড়তে পারেন? মনে ভাবে শ্রুতি।

মুখে অবশ্য বলে, “ না, ভয় করবে কেন? “

আর সত্যি বলতে কি এখন ওর ততো ভয়ও লাগছেনা। এমন একজন নাইস এন্ড হট ভদ্রলোকের সঙ্গে সবুজ ঘাসের মখমলি কার্পেট মাড়িয়ে একসঙ্গে হেঁটে চলার সম্ভাবনা…না: মন্দ নয়!

ঠোঁটের কিনারে একটু হালকা হাসির রেখাও ফুটে উঠলো শ্রুতির।

যদিও তার স্বাভাবিক স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেলেনা, তাহলেও এইমুহূর্তে কোনো এক আশ্চর্য কারণে, এই চিন্তা তার কাছে দারুণ, দারুণ আকর্ষক লাগছে।

তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কী ভীষণ যে ঢিপঢিপ করছে!

আহা হা…এই পথ যদি না শেষ হয়..

“এই যে বাড়ি। আসুন “

শ্রুতি ভদ্রলোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, সুখ কল্পনায় গা ভাসিয়ে কখন একখানা দারুন কটেজের সামনে চলে এসেছে, খেয়াল ই করেনি।

“ আসুন “

এবার পুরোপুরি সম্বিত ফেরে শ্রুতির।

ঠিক যেন গল্পের বই থেকে তুলে আনা একখানা কটেজ । দরজায় বড় সাদা নেমপ্লেটে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা-“ ডঃ লিয়াম বাখম্যান “, আর তার নীচে, “পেট্রা বাখম্যান”।

“পেট্রা আপনার স্ত্রী?”


আবার সেই রহস্যময় হাসি।

“ভালোই হলো আলাপ হয়ে যাবে।আপনার স্ত্রী কি এখন বাড়িতে?’- অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার মতন ই কৌতুহলে শ্রুতি জিগ্যেস করলো।

“ এক মিনিটে ঢুকে যাবে। এসেই পড়েছে।“

সেই আকর্ষক দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ডঃ লিয়াম বাখম্যান। আর শ্রুতি এই প্রথম লক্ষ্য করে , লিয়ামের শ্বাদন্ত দুটো অন্য দাঁতের তুলনায় অনেকটা বেশী লম্বা আর ছুঁচলো।


বাড়ির ভেতরে ঢুকে শ্রুতি একেবারে মোহিত হয়ে যায়। কী সুন্দর সাজানো ঘর! জানলায় সাদা লেসের পর্দা, সিলিং থেকে অপূর্ব কারুকাজ করা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, নীচে নরম কার্পেট , ছবি, ডেকরেটিং পিস…সব মিলিয়ে এ ঘর যে অনেক ভালোবাসায় সাজানো , তার ছাপ সর্বত্র।

এইরকম, ঠিক এই রকম বাড়িই তার চিরকালের ইচ্ছে ছিল। তার রূপকথার সংসার! এমন একটা বাড়ি আর এমন রোম্যান্টিক একজন পার্টনার পেলে শ্রুতিও হয়তো বিয়েটা করেই ফেলতো। আর তাহলে মা ও খুশ। বাবাও।

আচ্ছা, লিয়ামের বউ পেট্রাকে তো এখনো দেখা গেলোনা! বোধহয় কিচেনে চা কফি কিছু বানাচ্ছে।

লিয়াম এসেই ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।

এখন বেড়িয়ে এসে সোফায় বসলো।

মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে আছে শ্রুতি আর লিয়াম। লিয়ামের চোখে সেই আকর্ষণ, আকুলতা আরও অজানা কী যেন মেশা আশ্চর্য দৃষ্টি, স্থির হয়ে আছে শ্রুতির চোখে।

সারা ঘর জুড়ে সুরের হিল্লোল ছড়িয়ে বিজিসের গান প্রেম ছোঁয়ানো মদিরার মতো বাজছে,”হাউ ডিপ ইস ইয়োর লাভ”

শ্রুতির খুব প্রিয় গান। গানটা শুনতে শুনতে শ্রুতির সারা শরীর মন জুড়ে কী সাংঘাতিক উন্মাদনা! তার শরীর কাঁপছে, মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে… আর কেন কে জানে চোখ জ্বালা করছে…খুব…খুব”

“ আমার স্ত্রীর প্রিয় গান”- বলতে গিয়ে লিয়ামের গলা যেন ধরে আসে।

, *আমারও “

ধরা গলা শ্রুতির।

“ একটা অনুরোধ আছে। আপত্তি শুনবোনা”- আবেগপূর্ণ গলা লিয়ামের।


লিয়ামের ওই গলা শুনে শ্রুতির হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল কথা বলার শক্তি নেই যেন। তার দুচোখ জুড়ে শুধুই লিয়াম।

“ একটা গিফট আছে। আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছিনা আঙুলে পরলে কেমন লাগবে। পছন্দ হবে কিনা। আপনার আঙুল টা একটু..”

নিঃশব্দে মোহগ্রস্তের মতো হাতটা বাড়িয়ে দেয় শ্রুতি। আংটি টা শ্রুতির অনামিকায় পরিয়ে দেয় লিয়াম। একমুহুর্তের জন্য লিয়ামের গ্লাভস ছুঁয়ে থাকে শ্রুতির হাত।

“ আপনার সঙ্গে আগে কখনও কি আমার দেখা হয়েছে”?

আবারও জিজ্ঞেস করে শ্রুতি।

কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই

ঝনঝন করে মোবাইল বেজে ওঠে।

ট্রেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে।

আকাশ গম্ভীর অন্ধকার আগেই হয়েছিল। এখন অল্প অল্প বরফ পড়ছে। জোরে হাওয়া ও দিচ্ছে।

ট্রেনে উঠে শ্রুতি সীটের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে লিয়াম দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

অবাক শ্রুতির চোখে প্রশ্নের ইশারা।

শ্রুতির চোখের দিকে কষ্টে ভরা গভীর চোখে তাকিয়ে নরম গলায় লিয়াম বললো, “ আমার গন্তব্য এই পর্যন্ত ই। আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন।“

“আর কোনো দিন কি আমাদের দেখা হবেনা লিয়াম “- শ্রুতির হৃদপিন্ড যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

“ হয়তো হবেনা…হয়তো হবে…গ্যালাক্সি অন্তহীন “

বলতে বলতে শ্রুতির কাছে এসে তাকে বুকের মধ্যে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো লিয়াম। হালকা পালকের মতো শ্রুতির ঠোঁটে লিয়ামের ঠোঁট।ও:, কী হালকা স্পর্শ, ছুঁয়ে আছে কী নেই যেন বোঝা যায়না। শুধু তার ভালোবাসার উত্তাপ বিস্মিত, আকুল শ্রুতিকে ছুঁয়ে থাকে মুহুর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে সরে যায় লিয়াম।

তার সাগর নীল চোখ থেকে জল উপছে ওঠে।

সুখ দুঃখ মেশা গভীর বিষন্ন স্বর লিয়ামের , “গুডবাই মাই লাভ “

ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

“ আপনাকে একটু চা দিই ম্যাম?” মারিয়া এসে জিজ্ঞেস করে শ্রুতিকে।

“আচ্ছা মারিয়া, আপনার বাড়িতো এখানেই বলেছিলেন। আমার সামনের সীটে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে চেনেন আপনি ?”

আকুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে শ্রুতি। যেন এর উপরে তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।

“আপনার সামনের সীটে…!”

খানিকটা বিভ্রান্ত শোনায় মারিয়ার গলা..” না ম্যাম কেউ তো ছিলেননা “

“ বুঝতে পারছি , আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি। নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম লিয়াম বাখম্যান। ডঃ লিয়াম বাখম্যান”

আতংক বিস্ফারিত চোখে এমনভাবে চেয়ে থাকে মারিয়া, যেন ভূত দেখেছে।

“ ডঃ লিয়াম?!...কিন্তু উনি তো অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।“

“কি বলছেন কি ?!আমি তো এখুনি ওনার বাড়ি থেকেও ঘুরে এলাম”

“কিছু মনে করবেননা ম্যাম, এটা অসম্ভব। ১৯৭৭/৭৮ সাল নাগাদ ডঃ লিয়াম আর ওনার স্ত্রী পেট্রার বিবাহবার্ষিকীর দিন পেট্রা ইন্টারলেকেন থেকে এই ট্রেনে করে ফিরছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই ট্রেনের একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পেট্রা শুধু যে মারা যায় তাই নয়, তার দেহ এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে গেছিলো যে তাকে আর চেনাই যায়নি। ওই সামান্য পোশাক আশাক দেখে আর কী… “

“ এসব কী বলছেন আপনি?” প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো অস্ফুট স্বর শ্রুতির।

“ সেই শোক ড:লিয়াম সহ্য করতে পারেননি। ওঁরা দুজনে দুজনকে খুব ভালো বাসতেন। একরকম লিজেন্ডারি লাভ বলতে পারেন। তারপর থেকে ড: লিয়াম কাজকর্ম প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন এই ট্রেনের ভেতর পেট্রাকে খুঁজে বেড়াতেন। মাথাটাই আরকি…

বারবার বলতেন, “ ওর মুখ আমাকে আর একবার দেখতেই হবে। ওকে প্রপারলি গুডবাই না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। ওকে আমার কাছে আসতেই হবে।“

শোকের যন্ত্রণাতেই হয়তো স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই ডঃ লিয়ামও মারা যান।

ওনাদের অতো ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা কটেজটাও একদম ভেঙে চুরে পড়ে আছে।“

“আপনি ভুল লোকের কথা বলছেন মারিয়া। এ হতে পারেনা।

আমি অন্য লিয়ামের কথা বলছি। আমি এইমাত্র লিয়ামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম যে”।

শ্রুতির দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে চলে যাবার আগে মারিয়া বলে গেল – “আপনি জানলা দিয়ে দেখুন, ট্রেনটা বাঁক নেবার মুখে ডঃ লিয়ামের বাড়িটা দেখা যায়। দেখুন তাকিয়ে ।“

জানলা দিয়ে আকুল হয়ে বাইরে তাকায় শ্রুতি। দুহাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ট্রেনের জানালার কাঁচ আঁকড়ে ধরে পলকহীন চোখে বাইরের দিকে কটেজ খানা খুঁজতে থাকে।

হ্যাঁ, ওইতো, ওইতো কটেজ টা, কিন্তু একমুহুর্তে এ কী অবস্থা!

ভাঙাচোরা ছাত…তার খানিকটা আবার উড়েই গেছে। শুধু মাত্র আধভাঙা একপাশে হেলে থাকা দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা ডঃ লিয়াম বাখম্যান। নামটা কালচে হয়ে গেলেও এখনও পড়া যাচ্ছে।

শ্রুতির মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।

সে কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে!

নাকি হ্যালিউসিনেট করছে!


কিন্তু তার বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে.. ফোঁপানোর মতো কিছু বুকের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসছে… ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে সামনের টেবিলে রাখা টিস্যু পেপারের দিকে হাত বাড়াতেই শ্রুতির চোখ আটকে গেলো আংটিটাতে। যেটা লিয়াম একটু আগেই তার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছে।

আংটিটার ' এল ' আর '- পি' অক্ষর দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে মিশে আছে যেন,

আর তাদের চারপাশ ঘিরে গোল করে এমবস করা একটাই শব্দ –' Liebe ' ।

শ্রুতি জানে তার মানে 'ভালোবাসা'।।