Next
Previous
Showing posts with label রম্যরচনা. Show all posts
2

রম্যরচনা - স্বাতী ব্যানার্জ্জী

Posted in


রম্যরচনা


সাগ্নিকবাবু
স্বাতী ব্যানার্জ্জী 


সাগ্নিকবাবু বিজ্ঞানী হতে পারতেন, বিজ্ঞানচর্চা করার সমস্ত গুণই তার মধ্যে ছিল। কেবলমাত্র মায়ের অনিচ্ছা এবং ক্রমাগত বাধাপ্রদানে দেশ এক প্রতিভাশালী বিজ্ঞানীকে হারালো। ঘটনা তাহলে খুলেই বলা যাক। সাগ্নিকবাবুর বিজ্ঞানীলগ্নে জন্ম। ছোটবেলায় দুধের বোতল তিনি হাত দিয়ে না ধরে দুই পা দিয়ে ধরে মুখে পুরতেন, ফলে দুটি স্বাধীন হাত অন্য গবেষণামূলক কাজে ব্যস্ত থাকতো যেমন নিজের কাঁথা টেনে ফেলে দেওয়া, ছোট্ট মশারি উল্টে ফেলে দেওয়া বা নিজের হিসুর শাওয়ারে নিজে স্নান করা ইত্যাদি। এরপর তিনি হামাগুড়ি দিতে শেখেন এবং নতুন স্হান আবিষ্কারের নেশায় বা সেরেল্যাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে খাটের তলায় ঢুকে সেখানেই নিদ্রা দিতেন। কেউ খাটে পা ঝুলিয়ে বসলে ফোকলা মুখে তাদের পা কামড়ে নতুন স্বাদ গ্রহণের তীব্র কৌতূহল ছিল তার। এইবয়সেই তিনি আত্মরক্ষার উপায় শেখেন এবং সারা গায়ে ডলে ডলে তেল মাখানোর প্রতিবাদ হিসেবে তিনি ঠাকুমার চশমা বা মায়ের কানের দুল টেনে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সামান্য হাঁটতে শিখে সাগ্নিকবাবুর কৌতূহল (বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান) বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি টলটলে পায়ে আলনা, খাট, আলমারি, শোকেস ধরে ধরে বিশ্বভ্রমণে বের হন। প্রায়ই তাকে আলনার পিছনে বা সিঁড়ির মুখে পাওয়া যেত। এই ভ্রমণ বৈচিত্র্যময় করতে তিনি প্রতিটি পাপোষে হিসু করতেন।একদিন মা এবং ঠাকুমাকে শোকেস গুছাতে দেখে তিনি ভীষণ অনুপ্রাণিত হন এবং গোছানোর জন্য কোন শো পিস না পেয়ে অগত্যা নিজের শক্ত পটি শো কেসে সাজিয়ে রাখেন। তার এই আশ্চর্য প্রতিভায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মা মাঝেমধ্যে খুব চেঁচামেচি করতেন বটে, কিন্তু ঠাকুমার ভয়ে বেশি কিছু বলতে পারতেন না।

এরপর তিনি রসায়ণবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটি হাতলভাঙা কড়াইতে নিজের ঝুমঝুমি, চটি, জনসন্স ক্রিম, চুষিকাঠি নিজের বোতলের জলে গুলে রান্না করতেন। একথা সকলেই জানেন রান্নাবান্না মানেই কেমিস্ট্রি অর্থাৎ বিজ্ঞানচর্চা। এছাড়া তার পুতুলখেলার কাপে মিছিমিছি গ্যালন গ্যালন চা সকলকেই খেতে হত। কেউ না খেলেই সাগ্নিকবাবু নিমেষে বুথ সাহেবের বাচ্চার মতো চিল চিৎকার জুড়ে দিতেন।এরপর সবার মতোই তিনিও সোফা থেকে জানলায় উঠে গ্রীল ধরে দাঁড়াতে শেখেন এবং আধো আধো বুলিতে রাস্তা দিয়ে যাওয়া সকল ফেরিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে মাম (মাছ) মামসো (মাংস) দিতে হুকুম করতেন। অনেকেই হেসে চলে যেতেন আবার কেউ কেউ বিক্রির আশায় দাঁড়িয়ে পড়তেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই দাদুকে তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনতে হতো।

এরপর সাগ্নিকবাবু বড় হয়ে যান এবং দুইপায়ে উল্টো পচ্চল (হ্যাঁ বানান ঠিকই আছে, উনি এই উচ্চারণই করতেন) সারাবাড়ি টহল দিতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে বাবার জুতোয় পা গলিয়ে বিকট ঠকাস ঠকাস শব্দ করে তিনি বাবা কিংবা ঠাকুরদার অফিসে যেতেন। এইসময় তিনি একাধিক গবেষণামূলক কাজে জড়িয়ে পরেন যেমন ফুটন্ত ডালে পিংক ক্রেয়ন ফেলে ডালের রঙ পরিবর্তনের গবেষণা বা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে খড়ম তৈরির চেষ্টা। আরেকটু বড় হয়ে তিনি কাঁচি ও ধূপকাঠির বিভিন্ন উপযোগীতা আবিষ্কার করেন; যেমন ঘুমন্ত ঠাকুমার বিনুনি কেটে ফেলে কাঁচির ধার পরীক্ষা করা বা মায়ের ছাদে মেলা শাড়িতে ধূপকাঠি দিয়ে ফুটো করা। সব প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যর্থতাই উন্নতির প্রথম ধাপ। সুতরাং দুপুরবেলা গল্প বলতে বলতে দাদু ঘুমিয়ে পড়লে তিনি দাদুর নাকের ফুটোয় পেনসিল ঢুকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইতেন যে দাদু সত্যিই ঘুমিয়েছেন কিনা !

আরেকটু বড় হয়ে তিনি সিগারেট খান। না, নিজে কেনেননি, বাবার প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে কাঁচাই চিবিয়ে খান, কারণ আশেপাশে দেশলাই খুঁজে পান নি। শেষ অবধি গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে মা বমি করান এবং তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন কিল চড় কি জিনিস। যাইহোক বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে এমন বাধা একটু আধটু এসেই থাকে। অন্যদিকে এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাকে সাবধানী করে তোলে। তাই যেদিন আলুপটলের তরকারিতে অল্পস কালো ফিনাইল দিয়ে সাদা হয় কিনা পরীক্ষা করছিলেন সেদিন মা'কে তেড়ে আসতে দেখেই তিনি ঠাকুরদার পিছনে লুকিয়ে পড়েন।

এরপরে বিজ্ঞানচর্চার গতি বেড়ে গেল। একমাত্র মা তার কাজে বিঘ্ন ঘটাতেন। একদিন ঠাকুমা পুজো দিয়ে আসার পর তিনি সিল্কিকে (স্পিৎজ কুকুর) নিয়ে ঠাকুরঘরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সিল্কি নিমেষের মধ্যে সমস্ত বাতাসা খেয়ে ফেলে। বিকালে ঠাকুমা বারবার করে বাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে মা বাবাকে বললেন যে ঈশ্বর যে আছেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। কেবলমাত্র তাকে এবং সিল্কিকে ঘেঁটি ধরে ঠাকুরঘরের থেকে বার করে আনা মা যে কেন সারা সন্ধ্যা ফিক ফিক করে হাসছিলেন, তা কেউ বুঝতে পারেনি। মা অবশ্য নানারকম অদ্ভুতকাজ করে থাকেন। সেদিন সাগ্নিকবাবু খুন্তির বদলে জেল পেন দিয়ে ডাল নেড়ছিলেন কড়াইতে। মা রেগে মেগে নোংরা বলে সব ডাল ফেলে দিলেন। অথচ আরেকদিন যখন সারাদিন কাদা ঘেঁটে তিনি দুটো গাছ লাগালেন তখন নোংরা ঘাঁটা সত্ত্বেও মা তাকে কোলে নিয়ে চুমা দিলেন। অদ্ভুত মহিলা। বাবা লোকটা আরও আশ্চর্যের। কখন আসে, কখন যায় কিছুই বোঝা যায় না। বাবা বাড়িতে থাকলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে মা বাবা গল্প করেন।তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে বাবা মা কে জিজ্ঞেস করেন, "ব্যাটা কি আমার মত দেখতে হবে?" মা হাসি চেপে বলেন, "না, শাহরুখ খানের মতো দেখতে হবে।" তারপর দুজনেই হেসে ফেলেন আর ঘুমন্ত সাগ্নিকবাবুর কপালে চুমো দেন। পরদিন কি কি গবেষণা করবেন ভাবতে ভাবতে মায়ের গায়ে পা তুলে সাগ্নিকবাবু ঘুমিয়ে পড়েন।
1

রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


বিধিলিপি
পিনাকী চক্রবর্তী 



ডাক্তারবাবু বললেন, “কি আনন্দ পাস, ওই পোকামাকড়গুলো খেয়ে? কচি বাচ্চা তো আর নোস, পৈতেও তো হয়ে গেল সেদিন, এবার একটু সাত্বিক আহার টাহার করা অভ্যেস কর। নিতান্তই যদি খেতে হয়, তো কুচো চিংড়ি খাস, বাগদা গলদার মতো ওতে এতটা গণ্ডগোল হয় না। আচ্ছা যা, বাড়ী যা এখন, বাড়ী গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবি, ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নিবি যতটা পারিস। বিকেলবেলা খেলতে যাবি না। এই ওষুধগুলো লিখে দিলাম, আজকে শুধু বার্লির জল খাবি আর এই দুটো ওষুধ, দিনে তিনবার করে খাবি। কাল থেকে খিদে পেলে কাঁচকলা সেদ্ধ আর আলুভাতে খাবি, আর খাবার পর এই ওষুধটা একটা করে খাবি।”

আর খাবি! আমার তখন খাবি খাওয়ার অবস্থা … তাই আর কথা বাড়ালাম না। ডাক্তারবাবুর ফী-টা কোনওমতে তাঁর হাতে দিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম। ধরলাম তো, কিন্তু বাড়ী পর্যন্ত সসম্মানে পৌঁছাতে পারলে হয়! ইনি আবার বলেন কিনা, “বিকেলবেলা খেলতে যাবি না…!” আমার পেটের মধ্যে যে কিসের খেলা চলছে তা যদি উনি বুঝতেন, তাহলে আর এই অবান্তর কথাগুলো বলতেন না। এই চিংড়ি মাছের সাথে আমার কেমন যেন অহি নকুল সম্পর্ক সেই ছোট্টবেলার থেকে। আমি ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার বলেই কি এই অবস্থা? না, তা তো হতে পারে না! আমাদের বাড়ীতে তো মোহনবাগানী কেউ নেই, সবারই তো ওই একই ইষ্ট(বেঙ্গল)দেবতা – কিন্তু তাও চিংড়ি মাছের মালাইকারী তো পাতেই পড়তে পায় না, তার আগেই চেটেপুটে শেষ! তবে? শুধু আমার বেলাতেই এই পক্ষপাতদুষ্ট নিয়মটা খাটবে কেন?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওষুধের দোকানটা পার হয়ে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে! খেয়াল হতেই গোঁত্তা মেরে ঢুকে গেলাম ভেতরে। কাউন্টারে তখন দোকানের মালিক অরুণদা নিজেই দণ্ডায়মান। তার হাতে প্রেসক্রিপশনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি দাও তো ওষুধগুলো, অরুণদা!” অরুণদা কাগজটার দিকে এক ঝলক দেখে একটা টুল টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললো, “আবার পেট খারাপ বাধিয়েছিস? কি খেয়েছিলি, এবারে?” আমার তখন গল্প করার কোনওরকম ইচ্ছে ছিলো না, ব্যাজার মুখ করে বললাম, “চিংড়ি, কিন্তু তুমি একটু জলদি করো না!”

আমার গলার আওয়াজে অরুণদা বোধহয় কিছু বুঝলো, পেছনে দাঁড়ানো অ্যাসিস্ট্যান্ট ভোম্পুর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “অ্যাই, তাড়াতাড়ি বের কর ওষুধগুলো। আর তুই পেছনের বেঞ্চিটাতে বস। খুব কাহিল দেখাচ্ছে তোকে।”

আমার বসার ইচ্ছে নেই। কিছু না বলে দাঁড়িয়েই থাকলাম। অরুণদা আমার দিকে খানিকক্ষণ দেখে বললো, “অ, বুঝেছি...”

দু’ মিনিটেই ভোম্পু এক তাড়া ওষুধ নিয়ে এসে অরুণদাকে দিলো। তারপর প্রেসক্রিপশনের তলার দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?”

অরুণদা বললো, “উঃ, কাকাবাবুর কি হাতের লেখা মাইরি!” বলে বার দুই তিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো কাগজটাকে। তারপর আমাকে বললো, “চিংড়ী মাছ খেয়েছিলি, না?” বলে কাউন্টারের তলায় ঝুঁকে নিচের থেকে এক পাতা ছোট্ট ছোট্ট ওষুধ বের করে ভোম্পুকে দিলো। ভোম্পু সব দামটাম হিসেব করে একটা ঠোঙ্গার মধ্যে সব পুরে আমাকে ধরিয়ে দিলো। আমি ওষুধ নিয়ে দাম মিটিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম।

দুই দিন পর পেটটা ঠিক হলেও শরীরের দুর্বলতাটা আর যায় না। আমি সকালে কাগজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি, দুপুরে মার্ক টোয়েন পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি, সন্ধ্যেবেলা পড়ার বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ছি... ক্লান্তির কোনও সীমা পরিসীমা নেই। শেষমেশ মা আমাকে ঠেলেঠুলে সেই রাত্তিরেই পাঠালো ডাক্তারখানায়, তাও আবার আমার দিদির সাথে, আমার সবরকমের ওজর আপত্তিকে ওভাররুল করে।

ডাক্তারবাবু দিদিকে দেখে আশ্চর্য হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোকে আবার আসতে হলো কেন? ওর পেট খারাপ এখনও চলছে নাকি?’’ দিদি বললো, ‘‘পেট ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু খালি ঘুমিয়ে চলেছে কাল থেকে। তাই মা বললো ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে, সাথে করে। যা অবস্থা, হয়তো আসতে আসতে মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়লো!’’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘সে কি? এরকম তো হবার নয়। এদিকে আয় তো দেখি চোখটা।’’ তা চোখ দেখা, জিভ দেখা, নাড়ি টেপা, পেট টেপা সবই হলো একে একে। শেষে তিনি বললেন, ‘‘কই প্রেসক্রিপশনটা দেখা দেখি, কি দিয়েছিলাম তোকে খেতে!’’

তা প্রেসক্রিপশনটা সেদিন সকালেই আমার হাত থেকে হাওয়ায় উড়তে উড়তে খাটের তলায় ঢুকে গেছিলো। বের করবো করবো করে করা হয় নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই পকেটে করে সব ওষুধের ছিন্নপত্র, মানে ছেঁড়া পাতাগুলো নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো টেবিলের ওপর রাখলাম। তারপর বুঝলাম দিদিকে কেন সঙ্গে পাঠানো হয়েছে। দিদি ওর ব্যাগ থেকে আমার সেই প্রেসক্রিপশনটা বের করে ডাক্তারবাবুকে দিলো, আর আমার দিকে ফিরে বললো, ‘‘মঙ্গলাদি সকালবেলা ঝাঁট দিয়ে এটা খাটের তলা থেকে বের করেছিলো। তুই ঘুমোচ্ছিলি, তাই জানতে পারিস নি...’’

এদিকে ডাক্তারবাবুর আনন তখন ক্রুদ্ধ যোগীবর মহাদেবের মুখমণ্ডলের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে, কেন কে জানে। মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বর্ণনা একদম পদে পদে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু কেসটা কি, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ ডাক্তারবাবু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের বললেন, ‘‘তোরা আয় আমার সাথে।’’ চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরে বসা রুগীদের বললেন, ‘‘দশ মিনিট বসতে হবে সকলকে। আমি এক্ষুণি আসছি...’’

পথে নেমে চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘অরুণের কাছ থেকে নিয়েছিলি ওষুধগুলো, তাই না?’’ আমি ঘাড় নাড়লাম। তিনি আর কোনও কথা না বলে হন হন করে চললেন অরুণদার দোকানের দিকে।

অরুণদার দোকানে একটাও লোক নেই। ওর দোকানের রোয়াকে দু’জন রিক্সাওয়ালা বসে বসে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পরাতের ওপর ছাতু না আটা কি যেন মাখছিলো। অরুণদা দোকানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পিঠের পেছনে হাত দিয়ে খুব দায়িত্বপূর্ণ ভাবে সেটা পর্যবেক্ষণ করছিলো। ডাক্তারবাবুকে দেখে অবাক হয়ে বললো, ‘‘এ কি কাকাবাবু... আপনি? কি হয়েছে?’’ তিনি বললেন, ‘‘ভেতরে চল, হতভাগা! আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন...’’

ভেতরে ঢুকেই বোমার মতো ফেটে পড়লেন ডাক্তারবাবু। ‘‘এটা কি ওষুধ দিয়েছিস তুই, ব্যাটা গণ্ডমূর্খ? আমি লিখেছি হজমের ওষুধ ফেস্টাল, আর সেই জায়গায় তুই দিয়েছিস অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ফোরিস্টাল? এই প্রেসক্রিপশনটা দেখ। কোনদিক থেকে তোর এটা ফোরিস্টাল মনে হচ্ছে রে, গর্দভ? তুই তো যে কোনওদিন মানুষ খুন করতে পারিস রে! দাঁড়া, তোকে আমি পুলিশে দেবো...’’

অরুণদা কাঁচুমাচু মুখ করে ডাক্তারবাবুকে বললো, ‘‘আমি কি করে জানবো কি হয়েছে, কাকাবাবু? সব ওষুধ ভোম্পু দিয়েছে, জিজ্ঞেস করুন ওকে! ও বোধহয় ভেবেছিলো চিংড়ি মাছ খেয়ে যখন অ্যালার্জিক পেট খারাপ, তখন ফোরিস্টাল-ই লাগবে। কালই আমি দূর করে দেব ওকে। নয়তো আমার দোকানের বদনাম হয়ে যাবে এইভাবে...’’

কি ডেঞ্জারাস লোক দেখেছেন? এই ফোরিস্টালটা অরুণদা নিজেই দিয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ দোষটা চাপালো ভোম্পুর ঘাড়ে। ভোম্পু তো তাও নামটা ঠিক বুঝতে পারেনি বলে জিজ্ঞেস করেছিলো অরুণদাকে। এখন তাকেই ফাঁসাতে চলেছে পুলিশের চক্করে।

ডাক্তারবাবু দেখলাম ভালোই চেনেন অরুণদাকে। বললেন, ‘‘শুধু শুধু ওই ভালোমানুষটার ভালোমানুষির সুযোগ নিস না, অরুণ। অনেক পাপ করেছিস, আর করিস না। পুলিশে দেবো না তোকে, তুই টাকা পয়সা দিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসবি। তোর দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করাবো আমি। সব্বাইকে বলে দেব তোর দোকান থেকে ওষুধ না নিতে, ব্যাটা খুনে!’’

অরুণদা হাত কচলাতে কচলাতে বললো, ‘‘আর হবে না, কাকাবাবু, এইবারের মতো মাফ করে দিন!’’ ডাক্তারবাবু আরও রেগে উঠে বললেন, ‘‘আমার কাছে মাফ চেয়ে কি হবে? এই ছেলেটার কাছে মাফ চা, ওর প্রাণ নিয়ে খেলছিলি তুই, ব্যাটা গোমুখ্যু! আচ্ছা একটা কথা বল, তুই কি পাক্কা ঠিক ওষুধ দিচ্ছিস জেনে দিয়েছিলি ওই ফোরিস্টালটা? সন্দেহ থাকলে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করে এলে কি হতো? দুই মিনিটের তো রাস্তা, তাতেও তোর কুঁড়েমি? নাঃ, তোকে এবার শিক্ষা দিতেই হবে। সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিস তুই। এবার দেখ, আমি কি করি...’’

রাগে গম গম করতে করতে ডাক্তারবাবু সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাঁটা দিলেন ডাক্তারখানার দিকে। সেইদিকে তাকিয়ে অরুণদা বললো, ‘‘ইঃ, এবার শিক্ষা দিতেই হবে…! নিজে হাতের লেখাটা ঠিকমত শিক্ষা করলেই হতো!!! আবার বলে, আমাকে জিজ্ঞেস করে এলে কি হতো? জানিস, জিজ্ঞেস করতে গেলে কি বলে? শুনবি সে কথা? শোন… বলে ডাক্তারবাবুর ভারী গম্ভীর গলা নকল করে বললো, তা তোর যদি ক অক্ষর গোমাংস হয়, তার জন্যে কি আমাকে প্রেসক্রিপশন লেখানোর স্টেনো-টাইপিস্ট রাখতে হবে? কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লিখবেন উনি, আর সেটা পড়ে উদ্ধার করবো আমি! আমি বলে শালা রোজ ভয়ে ভয়ে থাকি, কি ওষুধ দিতে কি দিয়ে ফেলবো কোন রুগীকে, আর কি কেলো হয়ে যাবে, আর এখন দেখ উনিই কিনা এলেন আমাকে ধমকাতে…’’

দিদি কিছুটা অসহিষ্ণু ভাবে আমাকে বললো, ‘‘ভুল ওষুধটা বদলে ঠিক ওষুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে আয়, আমি যাচ্ছি।’’ বলে সেও বাড়ীর পথ ধরলো। বোধহয় অরুণদার ভাষাটা ওর ভালো ঠেকলো না। কিন্তু অরুণদার সেদিকে খেয়াল নেই। আমাকে বললো, ‘‘এই প্রেসক্রিপশনটা দেখ ভালো করে। ফেস্টালের এফটা ভালো বোঝা যাচ্ছে। শেষের দিকে এসটিএএল এগুলোও বুঝে নেওয়া যায়। কিন্তু এই মাঝখানের গুগগীগুলো কি সেটা কি বোঝা যাচ্ছে, তুই বল?’’ আমি বললাম, ‘‘অত আমি জানি না, তবে ফোরিস্টাল লিখতে গেলে অনেকটা জায়গা লাগে, এখানে এফ আর এস-এর মধ্যে খুব কম গুগগী আছে।’’

অরুণদা বললো, ‘‘তুই এরকম বলছিস বটে, কিন্তু এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে তুই দে’জ মেডিক্যাল বা ফ্র্যাঙ্ক রসেও যদি যাস, এইরকমই ওষুধ পাবি। আবার ওই পোড়া বস্তির পাতি ফার্মেসীটাতে গেলে হয়তো সব ওষুধ ঠিকঠাক পেয়ে যাবি। চান্সের ব্যাপার, বুঝলি তো? কেউ ওই লেখা পড়তে পারবে, কেউ হয়তো পারবে না। আসলে কি জানিস, সব শালা ডাক্তারের হাতের লেখা হলো বিধিলিপি, মাইরি। বিধাতাপুরুষ লিখে তো দিয়ে যায় সবার কপালে, কিন্তু কার কপালে কি লিখলো বুঝতে হলে জ্যোতিষী ডাকতে হয়। সবাই ওই লেখা পড়তে পারে না। আমার কপালে শালা ওই কাকাবাবুই লেখা ছিলো, বুঝলি খোকন?’’


0

রম্যরচনা - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


রম্যরচনা


সাধনা 
সোমঙ্কর লাহিড়ী 



আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের নাম “করালবদনী” অ্যাপার্টমেন্ট। কিনতে যাওয়ার সময় দালালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আচ্ছা “মা কালীর আরও কত সুন্দর নাম আছে তারা, ব্রহ্মময়ী, এই রকম আরও কত, সব থাকতে এই ভয়ংকর নামটাকে পছন্দ করেছে?” দালালের বিগলিত উত্তর, “দাঁদাঁ আঁওঁয়াদের পোঁঙোঁটারের গুঁউঁডেব। খুঁউঁ বঁঞোঁ তাঁনঈঁক টোঁ, টাঁঈ”। ভাবছেন ভূত না গন্নাকাটা তাই তো? না। ওঁর মুখে প্রায় ২০০ গ্রাম পান মশলা ও থুতুর মিশ্রণ কাটিয়ে কথাগুলো উঠছিল।

আমি আর কথা বাড়াইনি। কারণ পান মশলার মানে-বই আমার কাছে নেই, কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না। ভাবলাম আমার তো বাড়ীর বাইরেটা নিয়ে দরকার নেই, ভিতরের ঘরদোর বাথরুম বারান্দা এই সবগুলো ঠিক হলেই হলো, আর দামের ব্যাপারটা বলাই বাহুল্য। প্রোমোটারের নাম রঞ্জিতলাল দাস। এখন আচরণে রঞ্জিত (ফিল্মের), চোখ লাল, আর কার দাস সেটা জানি না।

উল্কাসম উত্থান। রিক্সার সামনের সিট থেকে স্করপিওর পিছনের সিট - চার বছরের মধ্যে বড় কম কথা নয়। তা ওঁর অফিস ঘরে ঢুকলাম, বিনবিনে ঠাণ্ডার ঝিরিঝিরি হাওয়া। উনি টেবিলের অন্য দিকে বসে, মোবাইলে কারও সাথে কথা বলছেন। দালাল আর আমি যে বসে রয়েছি সেটা উনি দেখতেই পাচ্ছেন না, থেকে থেকে দালালের দিকে হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আর একটু সময় লাগবে কথা শেষ হতে। আর দালাল সেটা আমার দিকে তাকিয়ে ট্রন্সলেট করে দিচ্ছেন একটা গালফোলা চোখ বোজা হাসি দিয়ে।

খোকাকে পেটি করে, নাকি পেটিকে খোকা করে, কার কাছে বুধবার দুপুরের মধ্যে পাঠানোর ব্যাপারটা যখন শেষ করলেন ততক্ষণে প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন, “কিছু মনে করবেন না, এদের এত খাঁই বেড়ে গেছে না আমাদের আর কিছু করে খেতে দেবে না।”

আমি সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না যে এই 'এরা'টা কারা, শুধু ঘাড় নাড়লাম। উনি দালালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের কোন প্রোজেক্টটা দেখালি দাদা কে?”

দালালের মুখ উঠে গেল আওয়াজ এল, “কঁআঁলবঙোঁনি”

“এক লাথি মেরে খোমা বিলা করে দেবো, মুখ থেকে মশলা ফ্যাল।” রঞ্জিতের মুখ থেকে চাবুকের মত বেরল কথাটা।

দালাল হাঁকপাঁক করে উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে দেওয়ালের কোণ নোংরা করে ফিরে এল।

রঞ্জিতের সতর্ক বাণী শোনা গেল - “মায়ের নাম মুখে আনার সময় মুখে যেন কোনও নেশার জিনিস না থাকে, থাকলে আগে মুখ খালি কর, পরে উচ্চারণ কর।”

ভাবলাম, ভক্তি হো তো অ্যায়সা। মনটা ভোরে গেল বলে মনে হলো।

দালাল বলল, “ভুল হয়ে গেছে দাদা, কিছু মনে কোরো না।”

এবার আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল রঞ্জিত, “তা কোন ফ্লোর পচ্ছন্দ হল দাদা?” 

আমি বললাম, “থার্ড, সাউথ ইস্ট টা।”

সাথে সাথে টেবিলের সামনের দিকে ঝুঁকে পরে প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “জন্মতারিখটা?”

আমি থতমত খেয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “মানে?”

এবারে অধৈর্য হয়ে আবার ফিসফিসালো, “আরে বাবা যার নামে রেজিস্ট্রী হবে তার জন্মতারিখটা কী?”

আমি বুঝতে পেরে বললাম, “১৯ শে এপ্রিল ১৯৬৪।”

স্যাট করে ল্যাপটপের ঢাকনা খুলে গেল। হুমড়ী খেয়ে হিসেব শুরু হলো, “উনিশ মানে দশ, দশ মানে এক, চার মানে চার মানে চার আর একে পাঁচ, নয় আর একে দশ মানে এক, মানে ছয় আর একে সাত, মানে সাত আর চারে এগার মানে একে একে দুই মানে পাঁচ আর দুয়ে সাত, ইসসস!! জল!”

দালাল টেবিল থেকে জলের গেলাস এগিয়ে দিল। রঞ্জিতলাল তার দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বলল, “অগ্নি।” দালাল এবার লাইটার এগিয়ে দিল। তার পরে যেটা শোনা গেল সেটা লিখতে সাহস হলো না। দালাল আর আমি দুজনেই একটু পিছিয়ে বসলাম। 

ফট করে মোবাইলের গা ঘষা শুরু হয়ে গেল। তিনি আবার কানে উঠলেন,

 “বাবা?” রঞ্জিত লাল গলাকে মাখনে চুবিয়ে ফোনস্থ করলেন– “হ্যাঁ আমি! পাতঃ পোণাম নেবেন!”(বাবা! এখন তো বিকেল সাড়ে পাঁচটা!)
 “একটা পোসনো বাবা। না না একটাই, পায়ে পড়ি বাবা ফেরাবেন না একজনের জীবন বাঁচনের পোসনো বাবা! হ্যাঁ আমার সামনে বয়ে আছেন, খুব ভালো লোক, হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা মাথায় কাঁচা পাকা চুল- না না বাবা সাধারণ হাইট, ঊঃ আপনি কী বাবা সব দেখতে পান? হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়ী কিনতে চাইছেন? না মানে ফ্ল্যাট আর কী! সে তো বাবা একই হলো।”

আমার দিকে হাত উঠল অভয় হস্ত- “বাবা আপনাকে দেখতে পাচ্ছেন! হ্যাঁ আপনাকে!”

দালাল হাসল আমার দিকে তাকিয়ে, মানে আপনার তো হয়েই গেছে, আর কী!

এবার আমার চমকানোর পালা। খানিক আমার জামার দিকে তাকিয়ে বললেন- “হ্যাঁ বাবা যা বলেছেন ঠিক তাই সাদাটে রঙের জামা, সাদা গেঞ্জী। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা।
- না না কী করে জিজ্ঞাসা করি বাবা? ওঁর ডান দিকের পাছার নীচের দিকে লাল তিল আছে কিনা সেটা আমি কী করে ওঁকে জিজ্ঞাসা করব? আমার লজ্জা করবে, ওঁরও লজ্জা করবে বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। দয়া করে। 
- পাছার আড়াআড়ি কাটা দাগ? থাকতেই হবে? কিন্তু আমি...
- হ্যাঁ এটা দেখা যেতেই পারে।”

এবার আমার গলা শুকনোর পালা অফিসের মাঝখানে প্যান্ট খুলে দেখবে না কী রে বাবা? আর আমার পাছায় কী দাগ আছে তার সাথে আমার ফ্ল্যাট কেনার কী সম্পর্ক? না আসলেই হতো। দালালের দিকে তাকালাম সে ব্যাটাও ভড়কেছে, ভাবছে পার্টির পাছা দেখতে চাইলে তো পার্টিও পাছা দেখাতে পারে। আমাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু এবার বুঝলাম ওঁর নিজেরও কনফিডেন্সে ঝাড় নেমেছে।

রঞ্জিত লাল দাস আমায় প্রশ্ন করল- “আচ্ছা আপনার বাঁদিকের ডানার কাছে একটা জন্ম দাগ আছে?”

আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- “আমার ডানা?”

রঞ্জিত লাল একটু অধৈর্য হয়ে বললেন- “আরে বাবা পিঠের দিকে, বাঁ কাঁধের একটু নীচের দিকে।”

আমি হতাশ হয়ে ঘাড় নাড়লাম, জানি না, জানা আমার পক্ষে সম্ভবও না। দালাল ভাবল ট্রাই নেবে কিনা।

এবারে রঞ্জিত লাল যেটা বলল, সেটা শুনে আমি একগাল মাছি- “শুনুন বাবা বললেন আপনি জলের জাতক। আপনার পক্ষে অগ্নি কোণের উপস্থিতি হানিকারক। এই ফ্ল্যাট আপনি আপনার নামে বুক করালে আপনার সমূহ ধনহানির সম্ভাবনা।”

আমি ভাবলাম কথাটা তো ঠিক, আমি ফ্ল্যাট পাবো আমার লাখ দশেক চলে যাবে। কিন্তু সেটা তো হানি নয়। কি জানি বাবা কী সব বলছে।

রঞ্জিত আমায় আশ্বস্ত করার জন্যে বলল- “আপনি বরং নর্থ ইস্টটা নিয়ে নিন। ভগবানের দিক, সব থেকে ভাল। তাই না?”

দালালও সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। কিন্তু আমার খটকা গেল না, ছোটবেলায় শুনতাম পুব-দক্ষিণ খোলা বাড়ী নাকী খুব ভালো হয়। কিন্তু এতো জল হাওয়া আগুন কী সব বলে ঘুলিয়ে দিচ্ছে। কোনও মতলব নেই তো। আমার তো বাবা ব্যাঙের আধুলি। মন তো কু গাইবেই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম- “ওটা কত করে পড়বে?”

রঞ্জিত আমার স্বস্তিকে আরও বাড়ানোর জন্যে বলে চলল- “সে আপনি চিন্তা করবেন না, এটার থেকে কমই পড়বে। ধরুন না কেন ওটা ছিল ৫৯০ এটা ৬১০ আর ৩০% সুপার বিল্ট, মানে গিয়ে দাঁড়াল..”

এবার আমি বললাম- “আমাকে মোট কত দিতে হবে, আর কবে পজেসন পাবো, আর কবে রেজিস্ট্রি?”

- “সে আপনি কিচ্ছুটি চিন্তা করবেন না। রেজিস্ট্রির দিন তো বাবাই আমাদের জানিয়ে দেবেন। আর ধরুন না ডাউন, আপনি কবে করতে পারবেন? ব্যাঙ্ক লোনের ব্যাপার থাকবে তো? সেটা আমরাই করিয়ে দেব। সব ফরেন ব্যাঙ্ক। ঝট ডকুমেনটেসন পট স্যাংসান। আর তারপরেই পজেসান। হয়েই গেল। আপনি শুধু ডাউনপেমেন্টটা ক্যাশে করবেন, ঠিকাছে?”

বুঝলাম ফাঁদের মুখ খুলে গেল। মাথা নাড়লাম। আমি বললাম- “আমার একটা আর্জি আছে।”

রঞ্জিত লালের চোখ এবার একটু যেন লাল হলো। গলা মাখন– “কী দাদা?”

“ আমি আপনার বাবাকে একটু দেখতে চাই।” -এবার আমিই মাখন ছাড়লাম। যিনি শুধু টেলিফোনেই আমার পাছার তিল অবধি দেখতে পান তিনি যে খুব বড় মাপের যোগী তাতে আমার সন্দেহ নেই; আর আমার সেই ছোট বেলা থেকে সাধু সঙ্গ করার শখ, যদি আপনি..” 

“আপনি কবে যাবেন শুধু বলুন দাদা” রঞ্জিত লালের ছিপি খুলে গেল: 
“কী বলব দাদা ভগবান, ভগবান। আমার তো জিন্দেগী পালটে দিলেন উনিই। কী ছিলাম আজ থেকে চার বছর আগে আর আজ ওঁর আশীর্বাদে কোথায় পৌঁছেছি। সবই ওঁর দয়া। চলুন আজই চলুন, এখনই চলুন।”

দালালের দিকে তাকালাম, উনি চোখের ইশারাতে বোঝালেন যে আমার ভালো সময় এসে গেছে, বাবা ডাকছেন। স্করপিও বেরল আমি বাবা দর্শনে চললাম। দাদার হাত ধরে।



ছোটবেলায় মানে যখন আমি ক্লাস ইলেভেন ফাইনাল দিই সেই সময় আমি আমার ছোটমামার এক বন্ধু সন্তোষমামার কাছে থেকে ভেন্ট্রিলোকিজম শিখেছিলাম। মাঝে মাঝে এখনও অফিসে বা বন্ধুদের আড্ডায় সেটা নিয়ে ফাজলামি করি। আর বৌয়ের সাথে ঝগড়ায় যখন দেখি একেবারে হার অবধারিত তখন ওটার প্রয়োগ করে খেলা ঘুরিয়ে দিই। কিন্তু এটা তো বাইরের ব্যাপার। 

তবে ভিতরে আর একটা গল্পও আছে। আমি যখন এই বিদ্যা শিখেছি সেই সময় আমাদের পাড়ার নিতাই তারাপীঠের কোন এক সাধুর কাছ থেকে তন্ত্র বিদ্যা আয়ত্ব করার ফিকিরে পাড়া ছাড়া হয়েছে। চালাত রিক্সা, হতে চলল তান্ত্রিক। বছর খানিক বাদে যখন ফিরল তখন আবার রিক্সাচালানই শুরু করল নতুন করে।

যোগী নিতাইয়ের শুধুমাত্র ভূতের ভয়টা যোগ হয়েছিল। মদ টদ খেত, কিন্তু খুব একটা বেশী কিছু নয়। তবে খাবার আগে যা নাটক করত, সেটা দেখবার জন্যে অনেকে ওকে মদ খাওয়াতে ডাকত। নিতাই আমাকে নেশা না করা অবস্থায় বলেছিল যে, তান্ত্রিকদের নাকি মিনিমাম দুটো ভূতকে কব্জা করে রাখতে হয়। না হলে না কি ব্যাপারটার মধ্যে ঠিক ভাব আসে না। আর ওর যিনি গুরুদেব ছিলেন ‘সর্বাহারি বাবা’ তাঁর কব্জায় নাকি ৭৫১টা ভূত আছে, আর উনি সেটাকে ১০০০ করে তবে না কি থামবেন। সেই গুরুদেব নিতাইকে বলেছিলেন যে এদিক সেদিক থেকে দু একটা ভূত উনি জোগাড় করে দেবেন নিতাইকে। কিন্তু সেখানেই নাকি ক্যাঁচালটা বেধে যায়। উনি ওঁর নিজের ৭৫১টার থেকে দুটোকে নাকি নিতাই এর খিদমৎ খাটতে পাঠিয়েছিলেন; তা বাঘা তান্ত্রিকের খিদমৎ খাটা ভূত, সে যদি দেখে যে তার মালিক নিতান্তই এক জোলো তান্ত্রিক, তাকে মানবে? সে দুটোই নাকি নিতাইয়ের বগল ফস্কে বেরিয়ে গেছিল, আর শুধু গেছিল না নিতাইয়ের জানের দুশমন হয়ে উঠেছিল সে দুটো।

তাদের ভয়ে নিতাই শুধু তারাপীঠ ছাড়েনি, রাতে রিক্সা চালানো অবধি ছেড়ে দিয়েছিল। বড় জোর রাত নটা। ব্যাস তারপরেই নিতাই হাওয়া। বেশী পয়সা দিলেও স্টেশনের থেকে খুব বেশী দূরে যাবে না। সমস্ত গঙ্গার ধারটাই নাকি সন্ধ্যার পর থেকে ভূতেদের দখলে চলে যায়, তাই সেখানেও যাবে না। তা শীতকালের রাতে এক বিয়েবাড়ী খেয়ে আমি আর আমার বন্ধু বুড়ো হাটের দিক থেকে ফিরছি দেখি নিতাই রিক্সা চালিয়ে কোথা থেকে ফিরছে। মুখচোখে ভয়। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে রিক্সা চালাচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল। বলল,
“ওঠো ওঠো তোমরা স্টেশনের দিকে ফিরবে তো?”

আমরা বললাম, “পয়সা নেই কিন্তু।”

নিতাই বলল- “চেয়েছি? আগে গাড়ীতে ওঠো, তান্ত্রিক যোগীণীর “ভ্রুং ফট স্বহা” হয়েছে। যেখানে যত খোলা ভূত পিচাশ আছে তাদের সাথে আজ তান্ত্রিকদের লড়াই। তারাও তাদের ভাই ভাতিজাদের ছাড়িয়ে নিতে আসবে, আর তান্ত্রিকরাও তাদের বাঁধবার চেষ্টা করবে। সে মহাকালে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে।”

“ভ্রুং ফট স্বহা” ব্যাপারটা যে কী আর তান্ত্রিক যোগীনীই বা কে তা বুঝলাম না। কিন্তু বুঝলাম নিতাইয়ের আজকের ভয়টা অন্যদিনের ভয়ের চেয়ে অনেক বেশী। দাঁতের কত্তাল শোনা যাচ্ছিল। শীতে না ভূতে বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে হলো দিই ব্যাটাকে আরও ভয় পাইয়ে। গলা পালটে দুবার খালি “নিঁতাই নিঁতাই” বলে ডাকলাম। ব্যাস খেলা শুরু। নিতাই হঠাৎ রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্রাণপণে দৌড় লাগাল। সে যে কী দৌড় বলে বোঝাতে পারব না। আমি বুড়ো দুজনে পিছন থেকে ডেকে হয়রান। সে পগারপার। এইবার বুড়ো গেল খচে। 
বলল- “পিঁয়াজিটা মারার সময় একটু ভেবে মার। শালা জ্ঞানগম্যি কি বাজারে বেচে দিয়েছিস? আহাম্মোক কাঁহিকা। বেশ খেয়েদেয়ে বিনি পয়সায় ফিরছিলাম। দিলি সেটাকে চুলকে ঘা করে। এখন মাঝরাতে ভরাপেটে টান রিক্সা।”

আমি বুঝলাম সত্যি কেস খারাপ হয়ে গেছে। কী আর করা, মাঝরাত নয় মাত্র নটা সোয়া নটা হবে। আমি আর বুড়ো নিতাইয়ের রিক্সাটা টানতে টানতে নিয়ে চললাম। ফেলে রেখে তো আর যেতে পারিনা, যদি কেউ চুরি করে নেয়। আর মাইরি রিক্সা কি বেয়াক্কেলে জিনিস, একবার ডানদিকে টাল খেয়ে পালায়, তো একবার বাঁদিকে। যাই হোক, অনেকটা যাবার পরে দেখি নিতাই একটা বাড়ীর সামনের রোয়াকের উপর উঠে আমরা যেদিক থেকে আসছিলাম সেদিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় আমাদেরই খুঁজছে। আমাদের দেখে দৌড়ে এলো। বুড়ো সুযোগের সদব্যবহার করল।

নিতাইকে বলল- “তুই পালিয়ে এলি?”

নিতাই ভীত মুখে বলল- “কী করব, দেখলে তো কেমন নিশি লেলিয়ে দিয়েছিল পিছনে। ঐ দুটো ভূতেরই কাজ হবে। আর একবার ডাকত; ব্যাস তার পরে দুটো ডাবের খোলা মুখোমুখি ফট করে বন্ধ করে দিত আর আমার আত্মা ঐ ডাবের ভিতর। জম্মের জন্য ওদের দাস করে রাখত। মাথায় করে গু বওয়াত। বাবারে, খুব বাঁচা বেঁচেছি।”

বুড়ো বলল- “বাবা ভোলানাথ হচ্ছেন সব ভূতেদের বাবা, মানিস?”

নিতাই মাথা নাড়ল।

- “ বাবা ভোলানাথ কী জাত জানিস?”

নিতাই বলল- “ না তো।”

বুড়ো গম্ভীর মুখে বলল- “বামভোন।”

নিতাইয়ের অবাক জিজ্ঞসা- “বামভোন?”

এবার বুড়ো মাথা নাড়ল।

- “আর মন্দিরে আমাদের পুজো কে দিয়ে দেয় বাবা ভোলানাথের কাছে?”

নিতাই জিজ্ঞাসা করল- “কে?”

বুড়ো উত্তর দিল- “পুরুত বামুন। তাকে ছাড়া কোনও কাজ হয় সমাজে?”

নিতাই মাথা নাড়ল।

- “তেমনি ভূতেদের পুরুত কে জানিস, যে বা যারা বাবা ভোলানাথের পুজুরী?”

- “কে?”

- “বেম্মোদত্যি, তাকে ছাড়া ভূত সমাজে কোনও কাজ হবে না। আর ও কী জাত জানিস?”

বলে আমাকে দেখাল।

নিতাই মাথা নাড়ল।

বুড়ো বোঝাল ওকে- “ওরা হলো বামভোন। ওর দাদু মরে বেম্মোদত্যি হয়েছে। আজ যখন নিশি লেলিয়ে দিয়েছিল তোর পিছনে, তখন ওর দাদুও ছিল ওখানে। উনি দেখলেন নাতি রয়েছে ওখানে, সব ভূত ফুতকে ভাগিয়ে দিলেন। আমাদের দেখা দিলেন। বললেন, এখন থেকে সব সময় নাতির সাথে থাকবেন। আর পাহারা দেবেন। বুঝলি কিছু?”

নিতাই কি বুঝল কে জানে, আমায় এগিয়ে এসে প্রণাম করল। বুড়োকেও করল। তারপরে ও বেশ ভক্তি শ্রদ্ধা করত আমাকে। ভাড়া টাড়া নিতে চাইত না। তারপরে আবার শুনি তারাপীঠ চলে গেছে তন্ত্র সাধনা করতে। 



এই পর্যন্ত শুনে আপনি যদি ভেবে থাকেন যে প্রোমোটারের সেই গুরুদেব হলো নিতাই, তবে ভুল ভেবেছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রোমোটারি করে যাঁরা খান তাঁরা অত বোকা নন। যার দুটো ভূত সামলানোর সাধ্যি নেই, সে এই ভূতের যজ্ঞি সামলাবে কী করে? অত সস্তা? গিয়ে দেখি নিতাই ওখানে চা জল দেয়টেয়, কিন্তু তান্ত্রিকের বেশেই আছে। ওর গুরুদেব “সর্বাহারী বাবা”র যিনি গুরু সেই পিশাচসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” হলেন আমাদের রঞ্জিত লালের বাবা। রঞ্জিত লাল তো গিয়ে পায়ে ঝাঁপাল। আমি প্রণাম করতে গিয়ে দেখি পাশে রাখা রিবক দুটোর মাপ দুরকম: ৭ আর ৮।

রঞ্জিত লাল আমাকে আলাপ করিয়ে দিল- “বাবা ফোনে আপনার “ডেডিকেশান” শুনে উনি আর থাকতে পারেননি, আপনাকে দেখতে এসেছেন। আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছেন।”

নিমাই তখন নিমাইবাবা হয়েছে বোধ হয়, মাঝখানে বলে উঠল- “বাবা আমি ওঁকে চিনি, ওঁরও বোমভোদোত্তি বশে আছে। বামুন তো।”

পিচাশসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” একটু থমকাল, রঞ্জিত লালও তাই।

পিচাশসিদ্ধ “যজ্ঞনাশ বাবা” বলল- “তাই বুঝি? তা কী করে বুঝব যে বোমভোদোত্তি তোমার বশে?”

- “কোঁর দুঁপাঁয়েঁর জুঁকোঁর দুঁ মাঁপ শাঁক আঁরঁ আঁক। কোঁঙরেঁ শ্বেঁকী আঁখেঁ। ডাংপাঁঙের বুঁওঁ আঁঙুলে ওঁখকুনি”।

পুব দক্ষিণের কথাটা ভুল নয়। আর লোক ঠকাতে বসলে আস্তিনে কয়েকটা বেশী তাস রাখতে হয়, সেটা বোধহয় অনেকের খেয়াল থাকে না। বা রাখে না। ভেন্ট্রিলোকিজম আজকাল হয়ত হয়না সেই রকমভাবে। কিন্তু একজন বছর ৬০ বা ৬৫ র লোক সেটার সম্পর্কে কিছুই না জেনে কী করে ওত ভূত কব্জা করেছিল কে জানে?


0

রম্যরচনা - সাম্য দত্ত

Posted in



রম্যরচনা


পাঁচ এক্কে এক 
সাম্য দত্ত





29শে এপ্রিল

-না, কাল আপনাকে দেখলাম উশ্রীর ধারে, মর্নিং ওয়াক কারছিলেন।তাই ভাবলাম একবার দেখা কোরে যাই, হে হে হে।
-ওটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস, আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে করছি।
-ভেরি গুড, ভেরি গুড! তা, গিরিডিতে আপনার কেতো দিন হোলো?
-আমাদের কয়েক পুরুষের বাস এখানে। বাবা এখানকার নামী চিকিৎসক ছিলেন, দাদু...
-অউর, আপকা হাতিয়ার?
-হাতিয়ার? 
-দ্যা ভেনিশিং গান।
হেসে বললাম, আপনি বিজ্ঞানের জগতের খবরও রাখেন তাহলে?
-উপায় আছে প্রোফেসর, খবর দিবার লোক আছে।
-সে তো বুঝতেই পারছি।
লোকটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ। বসার ঘরে আজ আমার ল্যুমিনিম্যাক্সটা জ্বালানো হয়নি, কিন্তু আবছা অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারছি লোকটার জ্বলজ্বলে, ধূর্ত দুটো চোখ একদৃষ্টে আমারই দিকে চেয়ে আছে।
-একবার দিখাবেন?
-ও জিনিস তো হাতের কাছে রাখিনা সবসময়। ওটা থাকে আমার ল্যাবরেটরিতে।
আবার বিরতি, এবার আরো দীর্ঘ। তারপর আবার সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা, হিসহিসে কন্ঠস্বর, আমি ফিফটি ল্যাকস অফার করছি প্রোফেসর। আপনি ইচ্ছা কোরেন তো আজহি দিতে পারি, কেশ।


মাথা নেড়ে বললাম,  টাকার আমার অভাব নেই। তাছাড়া, হঠাৎ করে বড়লোক হবার বাসনাও নেই। একা মানুষ, দিব্যি চলে যায়।সুতরাং....
-সেভেন্টি ফাইভ ল্যাকস, সোচিয়ে প্রোফেসর।


লোকটার ধৃষ্টতা এবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে একটু কড়া করেই বলতে হলো, আমার প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমার দীর্ঘদিনের সাধনার ফল। তাদের একটিকেও বেচে মুনাফা করার মানসিকতা আমার নেই। বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না।
-ওয়ান কোরোর প্রোফেসর, ফাইনাল অফার। সোবার কাছে আমি জিনিস চেয়ে নিই না, দরকার হোলে...
-জানি। আমার আর কিছু বলার নেই। আপনি আসুন।
-এটা আপনার শেস কোথা?
-শেষ কথা।

রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু বললেন, আচ্ছা, এই অ্যানাইহিলিন যন্তরটা কি মশাই?
-নিশ্চিহ্নাস্ত্র। ফেলুদা বলল, শত্রুকে জখম না করে, বিনা রক্তপাতে তাকে একেবারে গায়েব করে দেবার মোক্ষম হাতিয়ার। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে দুশমনের দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিলেই কেল্লাফতে।
- আরেব্বাস! এর কাছে আপনার কোল্ট পয়েন্ট থ্রি টুও তো নস্যি মশাই! 
-সে তো বটেই! তবে শুধু অ্যানাইহিলিনই নয়, প্রোফেসর শঙ্কুর প্রত্যেকটি আবিষ্কারই এককথায় ইউনিক। আপনি মিরাকিউরল বড়ির নাম শুনেছেন?
এর উত্তরে লালমোহনবাবু বললেন, তিনি প্রোফেসর শঙ্কুর নামই এই প্রথম শুনছেন। 
-কাগজে ছবি দেখলুম মশাই! বেঁটেখাটো, টাকমাথা, মুখে ছুঁচলো দাড়ি। এতবড় কনভেন্টর দেখে বোঝে কার সাধ্যি! 

'কনভেন্টর' অবিশ্যি 'ইনভেন্টর'-এর জটায়ু সংস্করণ। তবে ভদ্রলোক বললেন, গিরিডিতে তাঁর এক পরিচিত থাকেন।
-অবিনাশ চাটুজ্জ্যে। এথিনিয়াম ইনস্টিটিউটে তিন ক্লাস ওপরে পড়ত। যদি যাবার মতলব করেন, তাহলে বলুন, এই বেলা লিখে দিই।


এখানে বলে রাখি, বিখ্যাত আবিষ্কারক প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর আবিষ্কার অ্যানাইহিলিন পিস্তল বা নিশ্চিহ্নাস্ত্র যে তাঁরই ল্যাবরেটরি থেকে থেকে চুরি গেছে, একথা কাগজে পড়েছিলাম। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই যে ভদ্রলোক ফেলুদাকে ফোন করে তার সাহায্য চাইবেন এই চুরির তদন্তে, সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। শঙ্কু অবশ্য বলেছিলেন, তিনি ফেলুদার সুনামের সঙ্গে পরিচিত। 

-তোমার বাবা জয়কৃষ্ণ ছিলেন আমার সহপাঠী। তোমাদের বাড়ি গিয়েছি তাঁর সঙ্গে, তখন অবিশ্যি তুমি খুবই ছোট।

উত্তরে ফেলুদা জানিয়েছিল সেও প্রোফেসর শঙ্কুর গুণমুগ্ধ, এই বিপদে তাঁকে সাহায্য করতে পারলে তার ভালোই লাগবে। 


-তাহলে তোমাকে বলে রাখি, দু'দিন আগে বেনারসের এক ভদ্রলোক হঠাৎ বেয়াড়া এক আব্দার নিয়ে হাজির হন। তিনি অ্যানাইহিলিন কিনতে চান, এক কোটি পর্যন্ত অফার করেন।
-এবং আপনি রাজি হননি, তাই তো?
-সে আর বলতে! কি জানো ফেলুবাবু, বিজ্ঞানকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজে লাগাব, তেমন ইচ্ছে তো হয়নি কখনও!
-ভদ্রলোকের নাম?
-তোমার পুরনো আলাপী। মগনলাল, মগনলাল মেঘরাজ।


ফোনটা এসেছিল আধঘন্টা আগে। ইদানীং ফোন এলে ফেলুদা স্পিকারে দিয়েই কথা বলে। প্রোফেসরের কথা শেষ হওয়ামাত্র শুনতে পেলাম, আমার ঠিক পাশেই লালমোহনবাবুর হাঁটুদুটো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খেয়ে বিশ্রী ঠকঠক আওয়াজ তুলেছে। ভদ্রলোকের মাথাটাও ক্রমশ যেন নীচের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, ধরে না ফেললে হয়ত পড়েই যাবেন। ওঁকে দোষ দেওয়া যায় না। অতীতে যতবার এই দুর্ধর্ষ দুশমনের সঙ্গে ফেলুদার সংঘর্ষ হয়েছে, প্রত্যেকবার একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে ওঁর ওপর দিয়ে। আমিও যেন বুকের ভেতরের ধুকপুকুনিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আর কতবার? কতবার এই ভয়ানক শয়তানের মুখোমুখি হতে হবে? 


ফেলুদা কিন্তু দেখলাম বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ঠিকই বলেছেন, এঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার মোলাকাত হয়েছে। নিঃসন্দেহে একটি অসামান্য বিচ্ছু। তবে ভাববেন না, এই বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুলের ব্যবস্থা আমিই করব।

ফেলুদাকে এত অস্বাভাবিকরকম গুম মেরে যেতে অনেকদিন দেখিনি। শঙ্কুর ফোনটা এসেছিল সকালে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্রথমে বেনারসের ইনস্পেক্টর তেওয়ারি আর তারপর লালবাজারের ইনস্পেক্টর গড়গড়ি ফোন করে জানালেন, ফেলুদার কথামতো কাশী এবং কলকাতায় মগনলালের দুই বাড়ি আর গদিতে একসাথে রেইড হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায় নি, তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাশীতেই মগনলালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন বাজে ন'টা। এই চার ঘন্টা ফেলুদা একনাগাড়ে আমাদের বসার ঘরটাতে পায়চারি করেছে, তার ভুরুদুটো অসম্ভব কোঁচকানো, যদিও এখন ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস দেখে বুঝতে পারছি ও হয়ত একেবারে অন্ধকারে নেই। মাঝেমধ্যে থেমে ওর নীল ডায়রিতে হিজিবিজি কিসব লিখেছে আর একটার পর একটা চারমিনার ধ্বংস করেছে। জানি এইসময় ও কথা বলা পছন্দ করে না, তবু খেতে বসে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, পিস্তলটা তো মগনলাল পায়নি, তাই না ফেলুদা! 
উত্তরে গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলল, পেলে সে আর এ তল্লাটে থাকত না। দুনিয়াময় ও জিনিসের খদ্দেরের তো আর অভাব নেই।

-তাহলে এবার?
-এবার মাছ। তারপর দই, তারপর চাটনি। তারপর একটা পান খেয়ে গিরিডিতে একটা ফোন করব। তারপর ঘুম। 
একটু থেমে বলল, তবে, আমার মন কি বলছে জানিস, তোপসে! চেনা পথে এই রহস্যের সমাধান হবে না।দেখি, প্রোফেসর কি বলেন....




30শে এপ্রিল

আজ রাত দশটা নাগাদ ফেলুর ফোন পেলাম। মগনলালের বাড়িতে খানাতল্লাসি যে নিষ্ফল হয়েছে, সেটা জানিয়ে ও বলল, প্রোফেসর, আমার ধারনা মগনলাল এই চুরির সঙ্গে জড়িত নয়। আপনার অস্ত্রের ওপর তার লোভ ষোলআনা, কিন্তু সেটা তার হাতে পৌঁছয়নি। 

মনের মধ্যে একটা সন্দেহ ক্রমেই দানা বাঁধছিল। বললাম, ফেলু, আমি যা ভাবছি, তুমিও কি ঠিক তাই ভাবছ?
ফেলু একমুহূর্ত চুপ। তারপর বলল, এছাড়া আর উপায় নেই প্রোফেসর। যিনি এসব কিছুর মূলে থেকেও এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাঁর সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর উপায় দেখছি না।

-তোমার ইঙ্গিত বুঝেছি ফেলুবাবু। বেশ, আমি আমার নিওস্পেক্ট্রোস্কোপ বের করে রাখব। তোমরা তিনজন বরং কালই এখানে চলে এস। তবে একটা কথা-
-কি?
-অ্যানাইহিলিন চুরি যাবার পর থেকে মানসিক চাপটা বেশ টের পাচ্ছি। এ অবস্থায় হয়ত আমার পক্ষে কনসেনট্রেট করার অসুবিধা হবে। সুতরাং, একজন ভালো মিডিয়ামের খোঁজ করতেই হচ্ছে! 
-সে আর ভাবনা কি? একজন তো হাতের কাছেই আছেন।

-কে? কার কথা বলছ?
-নাম বললেই চিনবেন, তারিণীচরণ বাঁড়ুজ্যে।




চা এল। দুধ-চিনি ছাড়া চা। খুড়ো তা'তে একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়ির একটা ধরালেন। কিন্তু গপ্প মাঝপথে থেমে গেলে কী আর শ্রোতাদের ভালো লাগে! তাই ভুলু একটু তাড়া দিল, কী হল খুড়ো! শুরু করুন আবার! 
-দাঁড়া, দাঁড়া! -খুড়ো বললেন, সেই বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ হেঁটে এইচি। একটু রেলিশ করে চা খেতে না পারলে কি আর গপ্প বলার মুড থাকে!
-আচ্ছা, ফেলু মিত্তির তো নামকরা ডিটেক্টিভ। -মাঝখান থেকে ন্যাপলা হঠাৎ ফোড়ন কাটল, তাঁর সঙ্গে আপনার সত্যিই পরিচয় আছে, নাকি এটাও ওই আর্টের খাতিরে রঙ চড়াচ্ছেন?

সত্যি! খুড়োকে এরকম কথা বলার সাহস এক ন্যাপলারই আছে! 

খুড়ো কিন্তু ভুরুটা ওপরে তুলে বললেন, বলিস কি! আমার ইস্কুল লাইফের বন্ধু ছিল সিদ্ধেশ্বর বোস। আমরা দুজনে ছিলাম, যাকে বলে হরিহর আত্মা! সেই সিধুকে তোদের ওই টিকটিকি জ্যাঠা বলে ডাকে, সেই সুবাদেই পরিচয়। কম করে বিশ বচ্ছর তো হবেই.... তা সে যাকগে.... আমরা গিরিডি পৌঁছলাম পয়লা মে বিকেলের দিকে। ঠিক হলো, রাত গভীর হলে শঙ্কুর ল্যাবরেটরিতেই বসা হবে। প্ল্যানচেটের অভিজ্ঞতা যে আমার আছে, সে কথা তোদের আগেও বলেছি। তবে শঙ্কুর এই যন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তাই তাকে বলেছিলাম আগেভাগে যেন আমাকে একটা ডিমনস্ট্রেশান দিয়ে দেয়। নিওস্পেক্ট্রোস্কোপ। অ্যাসিড ব্যাটারি তোরা দেখেছিস তো? অনেকটা সেইরকম দেখতে একটা যন্তরের সঙ্গে দুটো বৈদ্যুতিক তার দিয়ে জোড়া একটা ধাতব হেলমেট। মনে মনে তারিফ করলাম। এরকম যন্তর থাকলে মিডিয়ামের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

রাত দুটোর পর বসা হলো। যন্তরটাকে রাখা হয়েছে একটা গোল টেবিলের ওপর আর তা'কে ঘিরে পাঁচটা চেয়ার সাজিয়ে বসেছি আমরা পাঁচজন। আমার ডান দিকে লালমোহন, তার পাশে তপেশ। বাঁদিকে ফেলুচাঁদ আর শঙ্কু। 

আমি প্রথমেই বলে নিলাম, 'তোমরা সবাই জানো আজ আমরা কোন প্রেতাত্মাকে আহ্বান করতে চলেছি। ঘটনাচক্রে ইনি আমাদের প্রত্যেকেরই বিশেষ পরিচিত। এখন আমাদের কর্তব্য হলো, এক মনে তাঁর স্মরণ করা। শেষবার তাঁকে যেভাবে দেখেছ, সেটুকুই হুবহু মনে করার চেষ্টা কর।'


মিডিয়াম যেহেতু আমি, হেলমেট আমাকেই পড়তে হলো। প্রথম আধঘন্টা চুপচাপ। তারপর হঠাৎ একটা তবলার বোলের মতো শব্দ পেয়ে দেখি, লালমোহনের হাতদুটো কেঁপে উঠে টেবিলটাকে তবলার মতো বাজিয়ে তুলেছে। ভাগ্যিস ছোকরা নিজেই ভুলটা টের পেয়েছিল, তাই জিভ কেটে 'সরি!' বলে কোনমতে হাতদুটো স্টেডি করে নিলে।


আরো আধঘন্টা কাটল। ভেতরে ভেতরে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছি, এমন সময়! এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বুঝলি! ল্যাবরেটরির ঘড়িতে ঢং-ঢং করে তিনটে বাজছে, আর পাঁচজোড়া চোখের সামনে যন্ত্রের ঠিক সেন্টারে একটা নীলচে ধোঁয়া ধীরে ধীরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। আর তার ভেতরে ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে একটা কঙ্কালের অবয়ব। প্রথমে দেখা গেল গলা থেকে ওপরের দিকটা, তারপর ক্রমে ক্রমে শরীরের নীচের অংশ। ধারালো মুখ, ক্ষুরধার দৃষ্টি, ঠিক যেমনটি চিনতাম। থুতনির খাঁজটা? হ্যাঁ! সেটাও দেখা যাচ্ছে! আরও পনেরো মিনিট পর পুরো শরীরটা স্পষ্ট হলো। আর চিনতে ভুল হবার কোনও কারণ নেই! 


-হ্যাল্লো, মাই চিলড্রেন! অনেকদিন পর তোমাদের একসাথে দেখে বড় ভালো লাগছে।

সেই গমগমে গলা, সেই নিখুঁত সাহেবি উচ্চারণ! কি বলবো তোদের, লাস্ট শুনেচি নাইন্টি টুতে। অ্যাদ্দিন পরও গায়ে কাঁটা দিল!

আমাদের মধ্যে ফেলুই প্রথম কথা বলল,
-আমরা খুব বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।

-হ্যাঁ, জানি। খোদ নিশ্চিহ্নাস্ত্রই নিশ্চিহ্ন। কি, তাই তো, মাই ডিয়ার প্রোফেসর? 
-আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা অবিশ্যি প্রথমে মগনলালকে সন্দেহ করেছিলাম - শঙ্কুর জবাব।
-হা হা হা। মগনলাল! সেই যার একটি ভেঙে পাঁচটি হয়, সেই ভিলেন! না হে, এটা তার কীর্তি নয়।
-তবে কে?
-আই টুক ইট।
-আপনি!
 এবার আমাদের হাঁ হবার পালা। 

-ওহ্ ইয়েস! আই হ্যাড টু পারফর্ম মাই লাস্ট ভ্যানিশিং অ্যাক্ট।


আড়চোখে একবার ঘরের বাকি মুখগুলো দেখে নিলাম। অন্ধকারেও দিব্যি বুঝতে পারছি, আমি যে তিমিরে, অন্যরাও সেই তিমিরেই। তবুও সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, 
-কিন্তু কি ভ্যানিশ করলেন স্যার? একটু বুঝিয়ে বলবেন কি!" 

-ডেথ 
ঘর কাঁপিয়ে উত্তর এল। 
-মৃত্যু। অ্যানাইহিলিনের ট্রিগার টিপে মৃত্যুকেই নিশ্চিহ্ন করে দিলাম। সো দ্যাট আই কুড স্টে অ্যালাইভ, ফরেভার।

-হ্যা....হ্যা....হ্যালাইভ! 
জটায়ুর গলাটা বোধহয় ভয় আর বিস্ময়ের কম্বিনেশনেই একটু কেঁপে গেল।

-ইয়েস লালমোহন, আয়্যাম অ্যালাইভ। তোমাদের মধ্যে দিয়েই তো আমি বেঁচে আছি। তুমি, তপেশ, ফেলু, তারিণী আর শঙ্কু। অনেকটা পাজলের পাঁচটা টুকরোর মতো। এবার বুঝেছ?
-বুঝেছি।
শঙ্কুর উত্তর।

-এবার টুকরোগুলো জুড়ে দাও। কি পাচ্ছ বল দেখি?


মনে হলো ধাঁধাটা ধরতে পেরেছি। মনে জোর এনে বললাম, 
-আমরা যাঁর বহুমুখী প্রতিভার পাঁচটি প্রজেকশন, সেই আপনাকে।

-রাইট এগেইন! সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে মৃত্যু বড় অস্বস্তিকর একটা পরদার মতো, বুঝলে! তোমাদের রেখে গেলাম; যাতে বড়, আরো বড় হবার নেশায় পেয়ে সবাইকে বেজায় বুড়ো হয়ে যেতে না হয়। অথচ যখন দেখি চারপাশে ঠিক সেইটাই হচ্ছে, তখন বুঝতে পারলাম, আমার কাজ এখনও ফুরোয়নি! তাই.... আচ্ছা, রহস্যের সমাধান তো হলো, এবার বিদায়! জিতে রহো বচ্চো! ভালো থেকো, আর যারা আগামী কয়েকশো বছর তোমাদের মধ্যে দিয়ে আমায় খুঁজবে, তাদের খুব ভালো রেখো। টেক কেয়ার!


নীল ধোঁয়ার কুণ্ডলী সমেত আত্মা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক মিনিট সব চুপ। তারপর ফেলু উঠে বাইরে গেল, বুঝলাম চারমিনার ধরাবে। শঙ্কুর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ বোজা, যেন ধ্যানস্থ। জানলা দিয়ে সকালের প্রথম আলো এসে পড়ছে। সূর্য উঠছে, দোসরা মে'র সূর্য। মনে মনে বললাম, হ্যাপি বার্থডে, মানিকবাবু।



2

রম্যরচনা - সাঈদা মিমি

Posted in


রম্যরচনা


ঔরঙ্গজেব সমাচার
সাঈদা মিমি





দিস ইজ আ

মা বাবা তার নাম রাখলো ঔরঙ্গজেব, বড়জনের নাম ছিলো দারাশিকো, ছোটপুত্র হুমায়ুন, এরপরে একমাত্র কন্যা জাহানারা, পুরো মুঘল পরিবার। তাদের পিতা বাবর একজন দর্জি, মা মেহেরুন্নেসা গৃহিণী। ঔরঙ্গজেব নাইন পাশ দিয়ে আর পড়লো না, সে ভেবেছিলো কোনও ধনীকন্যাকে বিয়ে করবে, আসলে ইচ্ছেটা ষোলআনা থাকলেও পনেরআনাই জলে গেলো, বড়ভাইয়ের বিয়ে হলো, ছোটভাইয়েরও, এরপর একমাত্র বোনের, ঔরঙ্গজেব মাঝখানেই ঝুলে থাকলো। তার আর বিয়ের সম্বন্ধ আসে না, আসবে কি? সে কোনও চাকরি করে? করবেই বা কেন? সে সম্রাটপুত্র কিংবা নিজেই সম্রাট, বাপের ঘাড়েই খায়। সেবার চৈত্র মাসে এক অবাক কাণ্ড হলো, এক স্কুল মাস্টারনী এল ঔরঙ্গজেবকে দেখতে, পাত্র পছন্দ হলে রাজি হয়ে যাবে। কালোকুলো মেয়ে, গড়নও সুবিধের নয়। তবু ঔরঙ্গজেব খুশি, পাত্রী চাকরিজীবি। ঘর ঘুরে দেখলো মেয়েটা, তারপর ঢুকলো পাত্রের কামরায়, কি থেকে কি হয়ে গেলো বোঝার আগেই দেখি, মেয়েটা নাক চেপে দৌড় আর বলছে, দিস ইজ পাঁঠার গন্ধ। ওহ হো, বলাই হয়নি, ঔরঙ্গজেব অতিরিক্ত গিধর, তার কামরায় ঘরের সদস্যরাও ঢোকে না। চ্যাংড়া মফিজ এইসব দৃশ্য দেখছিলো, পরদিন সকালে দেখা গেলো ঔরঙ্গজেবের কাঠের জানালায় কে বা কারা লিখে রেখেছে, দিস ইজ আ পাঁঠার গন্ধ।




ঔরঙ্গজেব ও পিতলের বদনা

ঔরঙ্গজেবের কিছু বিষয়ে শুচিবাই ছিলো বাড়াবাড়ি ধরনের, এই যেমন ঘরলাগোয়া কোনও বাথরুমে সে যাবে না, কাউয়ার দল চোখ মেলার আগে সে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের পাশে দোকান কর্মচারীদের যে গণটয়লেট সেখানে যেতো, হাতে থাকতো একটা ঝকঝকে পিতলের বদনা, সেটা প্রতিদিন নিজেই মাজতো, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস ব্রজেশ্বর স্টাইলে স্নান করতো পুকুরে, একটা ন্যাকড়া দিয়ে শরীর ডলতো আর স্নান শেষে গামছাটা পড়ে কোনওমতে লুঙ্গি ধুয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দিতো, আমরা লজ্জায় ওদিকে যেতামই না। এদিকে ছোট কাকিমা কয়েকদিন থেকেই প্রশ্ন করে করে আমায় উত্যক্ত করছেন, “হ্যাঁ রে পরী, পাত্রপক্ষ তোকে দেখে যায়, কথা আগায় না ক্যান? তুই তো দেখতে কম সুন্দরী না!” এর উত্তর কাকিমাকে দেয়া সম্ভব নয়, প্রত্যেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এলেই আমি আর প্রতুল মিলে ভাঙ্গানি দেই। কি করবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আছে, এত পাত্র দেখার দরকার কি? কাকিমা একটু চুপ থেকে আবারও বলে ওঠেন, “কাল ভোরে দরজা খুলে যার চেহারা দেখবো তার সঙ্গেই তোকে বিয়ে দেবো!” হায় কাকিমা, ভোরে তো দুধওয়ালা এসে বেল বাজায়….. কাকা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে কাকিমার কাছে আমাকে রেখে যান। রাতের তামাশা রাতেই শেষ কিন্তু সকালে আমরা দরজা খুলতেই দেখি, ঔরঙ্গজেব পিতলের বদনা নিয়ে গণটয়লেটে যাচ্ছে! আমি হতভম্ব, কাকিমা প্রায় অজ্ঞান।



ছাত্ররা কেন না’ বলেছিলো

শেষতক বাবর দর্জি ক্ষেপে উঠলো একদিন, এই দামড়াকে আর কতদিন বসিয়ে খাওয়াবো? মেহের, ওকে কাজ করতে বলো, কিছু না পারলে আমার সাথে দর্জিগিরি শিখুক। ঔরঙ্গজেবের খুবই সম্মানে লাগলো, তার পেটে বিদ্যার জোর আছে, সে কিনা করবে দর্জির কাজ! নেভার….. হুংকার ছাড়লো সে, যদিও শব্দটা চিঁ হিঁ হ্রেষার মতো শোনালো। মাস্টারী করবো আমি…। ‘তা কর বাপু। এই যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের সাথে লজিং হুজুরের ঘর সেখানে বসে পড়া. নয়তো বৈঠকখানা ঘরেই’ -মেহেরুন্নেসা বেগম বললেন। কয়েকজন ছাত্রও জুটে গেলো, শুরুটা মন্দ ছিলো না, ছয় সাতজন ছেলেমেয়ে হেলেদুলে পড়ছে, ঔরঙ্গজেব একটা বেত হাতে বেশ ভাব নিয়ে পড়ায় এবং প্রতিটি লাইন পড়ানো শেষে বাচ্চাদের প্রশ্ন করে ‘বুঝতে পারছিস?’ এটা তার মুদ্রাদোষ, সেটা না হয় মেনে নেয়া গেলো। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যতটা না বলে তার চাইতে বেশি থুতু ছিটায়, ওর সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে সে থুতু ওয়াশ হয়ে যাবে। যারা জানে তারা ঔরঙ্গজেবের সাথে কথা বলে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে, হতভাগা বাচ্চারা এসব কিভাবে জানবে? যখন জানাটা হলো তখন ওরা আর নিশ্চুপ বসে রইলো না, একজন স্যারকে দিলো একটা রুমাল, আর প্রত্যেকে হাতে রাখা শুরু করলো জাপানী পাখা, ঔরঙ্গজেব কথা বলতে শুরু করতেই তারা মুখের সামনে পাখা মেলে ধরে। বিষয়টা আর সহ্য হলো না ঔরঙ্গজেবের, একদিন সঠিক নিয়মে বেতপ্রয়োগ করে সে বেতটাকে ভেঙেই ফেললো। ক্ষেপে গেলো বাচ্চাদের বাবামায়েরা, তিনমাসে দেড়হাজার টাকা কামাইয়ের পর ঔরঙ্গজেবের টিউশনী ব্যবসা লাটে উঠলো।



সম্বল ওই ছারপোকা ঠাসা কম্বল তার বাল্যবন্ধু ছিলো…

মেহের ফুপু বেশ ভারী মহিলা ছিলেন, তিনি হাঁটাচলা করতেন ধীরে, কথাও বলতেন আস্তে খুব নীচুস্বরে, পান খেতেন, হাসতেন, কখনও ঝগড়া করতেন না। তবে দুই একদিন পরপরই আছাড় খেয়ে পড়ে যেতেন তিনি। কি মুশকিল, সারাবাড়ি তোলপাড়, কি হয়েছে? মেহেরুন্নেসা আছাড় খেয়েছে - অ, এ আর নতুন কি? যা সবাই মিলে তোল ওকে –অর্থাৎ আছাড় না খাওয়াটাই তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই বান্দা একদিন টেনেটুনে ঔরঙ্গজেবের কম্বল ফেললেন ঘরের চালে, সাথে তর্জনগর্জন, ‘এই হারামজাদা আমার ছেলে হয় কেমনে? আমি এত ছিকছাক (সাফসুতরো) মানুষ, অরে কি হাসপাতাল থেকে বদলে দিয়েছে?’ মেহের ফুপুর জন্য কষ্ট হয়, একা একা কম্বল শুকাতে দিচ্ছেন, আমরা কেউ যাইনি, কাজের বুয়ারাও না, রিনিচিনির মা-বুয়া আম্মাকে বললো, ‘ওরে ভাবীছাব’ কোম্বল ভরা উরাস(ছারপোকা) আর কি গোন্ধ! মেহের আফায় ওয়া টানতেয়াছে কেম্নে?’  মেহের ফুপু ঔরঙ্গজেবের মা হয়ে ঠেকেছেন, তাই শীত আসার আগেই শুকাতে দিয়েছেন কম্বলটা। ঔরঙ্গজেব তখন বাসায় ছিলো না, ফিরে তার কম্বল চালের ওপর দেখেই এক চিৎকার, ‘কে আমার কম্বল ধরেছে?’ ‘আমি, আর কে তোর পিছামারা জিনিসে হাত দেবে? খবিশ, সারা কম্বলে ছারপোকা। বিছানা বালিশে সব বের কর, মর্কট পাঁঠা…… -মেহের ফুপু বলে শেষ করেছেন কি করেন নাই, চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এক খাবলা দিয়ে কম্বল টেনে নামালো ঔরঙ্গজেব, ‘খবরদার আমার কোনও জিনিসে কোনওদিন হাত দিবেন না। খাটমল, মশা এরা আমার দোস্ত, অরা না কামড়ালে আমার ঘুম ভালো হয় না’, বলেই গটগট করে ঘরে চলে সে, মেহের ফুপু বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।



পাড়ায় রটিয়া গেলো একি কারবার? মুখ দেখানোটা বুঝি হয়ে গেলো ভার…

সাত সকালে তিনটা কুকুর, আর ছয়টা ছানা মিলে শোরগোল। একটা বাড়ি বটে, এতগুলা কুকুর থাকার দরকার কি? কোথায় ঘুরছে, কাকে তাড়া করছে, কে কামড় খেলো, অতিষ্ঠ হবার উপক্রম। ঔরঙ্গজেবের একটা চাকরি হয়েছে, খাদ্যগুদামের রাত্রি পাহারাদার। আমরা বেঁচেছি, ঘাটে কিংবা উঠানে বা পিতলের বদনা হাতে তাকে যখনতখন দেখা যায় না। সে সারারাত পাহারা দেয়, পাখি ডাকার আগে বাসায় এসে ঘুমায়, দুপুরে খেয়ে আবার ঘুমায়, বিকেলে সত্তর দশকের নায়কদের মতো একটা বেলবটম প্যান্ট এবং সাদাকালো কোমর চিপা স্ট্রাইপ শার্ট পরে বের হয়ে যায়। মেহের ফুপুর গজরগজর প্রায়ই শুনি, ‘শুয়োরটার জামা কাপড় দিয়েও তেলা পোকার গুয়ের গন্ধ, এ কি পয়দা করেছি আমি এলাহী!’ তবে রবিবার ঔরঙ্গজেবের ছুটির দিন, ওই দিন আমরা ওঁদের বাসার ধারেকাছেও ঘেঁষি না। ঔরঙ্গজেবের স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো কিন্তু তার আধামাইল দূর থেকে পাঁঠার গন্ধ, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি ধরণের বর্ণনা হয়ে গেলো, হোক গে। তার ওপর শয়তানটা খালি গায়ে বাইরের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কান চুলকায়, তারপর কাঠিটা মুছে আঙুল শুঁকে আবার চুলকায়, ওয়াক, ওয়াক… এমনি এক রবিবাবের ঘটনা, সেজ কাকিমা প্রতি রবিবার একজন ফকির খাওয়ান, সেদিন দুপুরে একপিস কালবোশ মাছ, আগের দিনের মাংস, আট মিশালি শাক আর ঘন ডাল দিয়ে একপ্লেট ভাত দিয়ে ফকিরকে বিদায় করেছেন কাকিমা, আধাঘন্টা পরে তুমুল হৈ চৈ, গালিগালাজ আর অভিসম্পাত। সবাই দৌড়ে আসে, গেটের কাছে ঔরঙ্গজেবের হাতে ভাতের প্লেট এবং তখনও সে খাচ্ছে, ফকিরটা বিবিধ উচ্চারণে চীৎকার করে যাচ্ছে। হলোটা কি? কি আবার, ফকিরের মেনু চেক করতে গিয়ে সে ফকিরের খাবারটাই খেয়ে নিয়েছে! মেহের ফুপু আর ক্রোধ দমন করতে পারলেন না, একটা চেলাকাঠ নিয়ে ধাঁই করে বসিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবের পিঠে। সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো খবর, আমাদের কোথাও মুখ দেখানোর আর উপায় রইলো না….



সে কেবল হাত ধরেছিলো

ঔরঙ্গজেব দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলো না এবং কুচ্ছিতও নয়। নাকটা? বেশ টিকোলোl মুখটা? চৌকাl গায়ের রঙ? ফর্সা। হ্যাঁ, কবিতা আপু একদিন ক্ষেপে বলেছিয়া “ব্যাটাছেলের এতো সাদা হওয়ার দরকার কি? আমি এত কালো কেন?” কবিতা আপু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়l। তখন যৌথ পরিবারগুলোয় এইরকম সবাই মিলেঝুলেই থাকতো। ঔরঙ্গজেব কবিতা আপুকে দেখলেই ঝুঁকে হাতদুটি জোড় করে বলতো, 'মা কালী করালী, নমস্কার' -ক্ষেপে উঠতো আপু, আমি কি এতই কালো, অ্যাঁ! সেই কবিতা আপুর বিয়ে হলো বেজগাওয়ে, পাত্র দোজবর কিন্তু বড় ভালোমানুষ। ঔরঙ্গজেব রঙ্গ করে বললো, মা কালী, রাতের আন্ধারে তোরে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবে না তোর জামাই। বিস্ফোরিত হলো কবিতা আপু, সেই প্রথমবারের মতো সত্যটা বলে দিলো। আরও চারবছর আগে যখন ঔরঙ্গজেব ক্লাস সেভেনে পড়তো, একদিন মেজকার বাঁশঝাঁড়ের নীচে কবিতা আপুকে প্রস্তাব দিয়েছিলো সে। আপুর দুটি হাত ধরে খুব বিনয় করে বলেছিলো, তোর চামড়া কালো কিন্তু বড় মিস্টি তুই দেখতে, আহা কি গড়ন! দেবীর মতন। আপু পটে যেতে পারতো। কিন্তু পুবমুখী বাতাস সব গড়বড় করে দিলো। ঔরঙ্গজেবের শরীরের বোটকা গন্ধ তার নাকে আছড়ে পড়তেই বমি এসে গেলো শুচিবাইগ্রস্ত কবিতা আপুর, হাতটা ছাড়িয়ে ওয়াক ওয়াক করে দৌড়। সেই থেকে ঔরঙ্গজেব আর কবিতা আপুর শত্রুতার সূত্রপাত।



ঔরঙ্গজেব বিড়ালটিকে গুতা দিয়েছিলো

মেহের ফুপুর একটাই শখ, প্রতি শুক্রবার সিনেমা দেখতে যাওয়া, ফুপাও এইক্ষেত্রে দুইধাপ এগিয়ে। চিপাচুপার মধ্য দিয়ে চলা জীবন, এই কষ্টের মাঝে ওই সিনেমা দেখাটাই একটু অক্সিজেন। এদিকে প্রতিদিনের দুধের হিসেবটা মিলছে না, একপোয়া দুধ আর একপোয়া পানি ইজ ইকোয়ালটু আধাসের, কিন্তু রাতে সবাইকে ভাগ করে দিতে গিয়ে কম কম মনে হয় যেন! গলার কাঁটা ঔরঙ্গজেবকে সন্দেহ হলো, চুপিচাপি নজরদারি করে দেখলেন ঔরঙ্গ দুধের পাতিলের কাছে যায় না, ফুপুর মায়াই হলো, আহা, ছেলেটা তার খবিশ বটে, চোর নয়। এইসব সাত আট চিন্তা মাথায় নিয়ে ফুপু ফুপা গেলেন নাইট শো দেখতে, ছবির নাম বেদের মেয়ে, আর ঔরঙ্গজেব ঢুকলো রান্নাঘরে। বিকেলে সে দেখেছে, মা তার দই পেতে রেখে গেছে। ঘরে ঢুকে কি দেখলো সে? একটা সাদা লোমের ময়লা বেড়াল খালি দুধের পাতিল চাটছে। বেড়াল এল কোত্থেকে? তা বাপু চারচালা কাঠের ঘর, দুইপুরুষ পুরোনো, ভাঙ্গা ছ্যাঁদা তো আর কম নেই, সেইরকম একটা দিয়ে বেড়ালবাবা প্রবেশ করেছেন। তবে রে চোরা, বলেই একটা লাকড়ি দিয়ে বেড়ালটার পেট বরাবর গুতা মারলো সে, ‘কেঁয়াও’ শব্দ করে ছুট লাগালো বিল্লি। মাঝরাতে ফুপু ফুপা ফিরেছেন, ফুপার কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে, ‘বাইর হও বাইর হওরে সাপ, লোকে তোমায় দেখতে চায়…,’ ফুপুও তরল মেজাজে, কেবল বেদের মেয়ের কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরের তালা খুলতেই দেখেন ঔরঙ্গজেব দরজার পাশে বসে কুঁইকুঁই করে কাঁদছে, বেড়াল কেঁয়াও করে ছুট লাগানোর আগে ঔরঙ্গজেবের হাতে খামচি দিয়ে গেছে, বাজু থেকে কনুই পর্যন্ত রক্ত জমা। সাপ বের হলো না। কিন্তু ঔরঙ্গজেবকে নাভির গোড়ায় চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন নিতে হলো। প্রতিটা সুঁই ফোটানোর সময় সে একটা কথাই বারবার বলেছিলো, আমি কিছু করিনাই, কেবল বেড়ালটাকে কাঠ দিয়ে গুতা দিয়েছি।



ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া

বাবর দর্জি মানুষ খারাপ নয়, একটাই দোষ, সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। বৌ মেহেরুন্নেছা দেখতে কুরূপা নয়, কিন্তু সে বুড়ি হয়ে গেছে, ভারীও। আফসোস, সে ভাবে, আরও অনেক কিছুই তো ভাবে, একটু সাহস করে কিছু কর্ম করেও ফেলে। এই যেমন কমবয়সি মেয়েরা জামার মাপ দিতে এলে গজফিতা নিয়ে স্মার্টলি দাঁড়ায় সে, চেস্টের মাপ নেয়ার সময় আলগোছে বুকে হাত দেয়, একটু টিপেটুপেও দেখে। কাহিনী চাউর হয়ে গেলো, মেহের ফুপু সব শুনে বাবর মিয়াকে বাসা থেকেই বের করে দিলো, তার একার সাহসে কাজটা হয়নি, পুরো পরিবারই পাশে দাঁড়িয়েছিলো। বাবর মিয়া নিরীহ ঘরজামাই হয়ে থাকতে চেয়েছিলো, কি হয়ে গেলো, হায়! যদিও শোধরাবার সুযোগে রইলো সে তক্কে তক্কে, আর কাহিনী রটে যাওয়ায় মফস্বলে কমে আসতে থাকলো তার কাস্টমার। বেলার মা তো স্পষ্ট বলেই দিলো, খবরদার ও ব্যাডার কাছে কেউ কাপড় বানাইতে যাও বুঝি, দুধি হাত দেয়! পুত্র ঔরঙ্গজেব কাহিনীটা মাথায় গেঁথে রাখলো। সেবার ফাল্গুন শুরুতে মামাতো ভাইয়ের বিয়ে, সারাবাড়িতে উৎসবের ধুম, রাতে হ্যাজাক বাতির আলোয় রঙ্গীন কাগজের সজ্জাগুলি ওড়ে, আর ওড়ে ঔরঙ্গজেবের হৃদয়ের নীলঘোড়া, রোমান্টিক ভাবনায় সে ভেসে যায়। ফানাফিল্লাহ অবস্থায় মানুষ কি করে তা সে নিজেও জানে না, যেমন ঔরঙ্গজেবও জানতো না, মৃদু আলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে রাঁধুনি লতিফার বুক টিপছে। লতিফা জানতো, সে উপভোগও করছিলো, তখনি ঔরঙ্গজেবের বড়মামা দৃশ্যটা দেখে ফেলেন। নাউজুবিল্লাহ, বলে তিনি ক্যাঁক করে ঔরঙ্গের ঘাড় চেপে ধরেন, হারামজাদা, কুলাঙ্গার বাপের আওলাদ। তারপরের বৃত্তান্ত ভাসাভাসা, ঔরঙ্গজেব কেবল উপলব্ধি করে, প্রথমবারের মতো পাওয়া স্বপ্নের নীলঘোড়া উড়ে উড়ে প্রথম আসমান পার হয়ে চলে যাচ্ছে।



তাবলিগে গেলো ঔরঙ্গজেব

ঔরঙ্গজেব তীব্র হতাশায় আক্রান্ত, কোনও নারী তাকে চায় না, একটা ভুল ট্রিপ সেই সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে দিলো, কে জানতো অন্ধকারে কাজের বুয়া দাঁড়িয়ে তার সোহাগ নিচ্ছে! সে নিজে অনুধাবন করার পর নিজের প্রতি এই প্রথম তার ঘৃণা জন্মালো। এখন তো ঘরের কেউ তার সাথে কথা বলে না, খাবারটাও একা খেতে হয়। একটা চাকরি জুটেছিলো অনেকদিন আগে, সেটাও নেই, নাইটগার্ড ঔরঙ্গজেব ঘুমিয়ে পড়েছিলো পাহারার বেঞ্চিতে, আর চোর সেই রাতেই এল। কত থানা পুলিশ, ধড়পাকড়, একমাস জেলের যবের রুটি খেয়ে তার শরীরে পাঁঠা-যব ধরনের গন্ধ তৈরি হলো। বাড়ি ফেরার পর আরেক নারকীয় অবস্থা, দেখে তার বিছানাপত্র ঝকঝকে, পুরা মাথায় রক্ত উঠে গেলো, কয়েক রাত প্রায় নির্ঘুম কাটানোর পর আবার মিশ্র গন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হলো সে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমুনি লেগে এসেছিলো, এমন সময় ট্যারা মনসুর এসে এক থাবড়া লাগালো ঘাড়ে, কি ভাবতাছস হালায়? ট্যারা মনসুর ধড়িবাজ কেজো, সব শুনে ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে গেলো নটীদের পাড়ায়। প্রতিবাদ করার আগেই উপলব্ধি করলো, সে এক পানসে রূপসীর ঘরে বসে আছে.. এই পর্যন্ত থাক, বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। এরপর মেহের ফুপুর জমানো পয়সা চুরি করে সে নটীদের পাড়ায় গেলো। তারপরের ঘটনা সঙ্গীন, ধরা খেলো ঔরঙ্গজেব, উপরি পাওনা পিটুনি, তারপর জ্বর, সবশেষে প্রতিজ্ঞা, ‘থাকিতে হস্ত/ হবো না রমণীর দারস্থ…’ নাবালকরা পড়বেন না যেন। শয়তানটা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো এই পদ্য, মাকে অর্থ জিজ্ঞেস করে আমিও মার খেয়েছি। কাহিনী যখন বেতাল পথে, বড়কাকা বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবের সাথে কথা বলে, তাবলিগে পাঠিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবকে।



যারে দিবি ফালাইয়া, তারে লইয়া যা কালাইয়া

মুঘল পরিবারটি ঔরঙ্গজেবের বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। এই উৎকট সুযোগে বাবর মিয়া পুনরায় নিজ ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছেন। সবার পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার পর রাত্রির গোপনে স্ত্রীর পাও ধরেছেন তিনি। ভাবার অবকাশ কম যে, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, মেহেরুন্নেসা এখনও অপ্রসন্ন। ইতিমধ্যে বড় একটা আছাড় খেয়ে তার পা মচকেছে, পুকুরে স্নান সেরে ফেরার সময় টের পেলেন কি যেন একটা হাঁটুর কাছে নড়াচড়া করছে, তারপর দেখেন আজদাহা এক জোক, অতঃপর আছাড়। লবন দিয়ে জোক ছাড়ানো হয়েছে, কিন্তু পা ফুলে ঢোল, বিকট চিৎকার দেওয়ায় গলাও বন্ধ। এদিকে এলাকায় মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। পাড়ার ঢোল আফ্রিকান উপজাতিদের ঢোলের চাইতেও মারাত্মক। ওটাকে চোখে দেখা যায় না কিন্তু শব্দ করে ফিসফিস, তারপর সেই শব্দ বজ্রপাতের রূপ নেয়। এই মুহূর্তে প্রতিবেশীরা ঔরঙ্গকে বিয়ে করিয়ে দেবার দাবীতে সোচ্চার। মুশকিলে আছেন মেহের ফুপু, ‘কোনও মেয়ে তো হারামজাদার বৌ হতে চায় না! কোন অমাবশ্যায় এই জুতার খোলটাকে পেটে ধরেছিলাম আমি?’ পরামর্শ বেলার মা-ই দিলো, ‘যারে দিবা ফালাইয়া, তারে লইয়া যাও কালাইয়া।' মানে কি? কালাইয়া পটুয়াখালিতে, ওখানে বিবাহযোগ্য কন্যাদের অভাব নাই। ঘটক লাগানো হলো, দেখাশোনা চলতে লাগলো, শেষতক এক জোতদারের পাঁচ নাম্বার বিবির বড়কন্যার সন্ধান এল। একটা মিনিবাস ভাড়া করে পুরো দলবল রওনা দিলো পাত্রী দেখতে। মেয়ে পছন্দ হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হবে। একটা কথা না বললেই নয়, রান্না হয়েছিলো অনেক পদ, বুড়া গুড়াদের দল খেয়েছিলো নোলা ডুবিয়ে। অবশেষে ডিম গড়নের এক মেয়েকে এনে বসানো হলো পাত্রপক্ষের সামনে। সবাই করছিলো উসখুস, ঔরঙ্গজেব খুসখুস। কি যে হলো তার, প্রথমে তার পেটে কামড় দিলো, তারপর ধপাস করে পড়েই খিঁচুনি উঠলো। পাত্রের মৃগীরোগ, বিয়ে ডিসমিস। ঔরঙ্গজেব দাড়িজোব্বা রেখে যৌবনকে উৎসর্গ করে দিলো, যদিও সুখাদ্যগুলোর কথা তার সারাজীবনই মনে ছিলো।



1

রম্যরচনা - স্বাতী ব্যানার্জী

Posted in


রম্যরচনা


বীরত্ব
স্বাতী ব্যানার্জী


চোপাকুমার এমনিতে শান্ত তবে সকল বিষয়ে তার জ্ঞান সম্পর্কে কেউ সন্দিহান হয়ে উঠলে তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাজমাতার সাথে তার তর্ক বিতর্কের কথা। দুপুরবেলা আমতেল চুষতে চুষতে তিনি বললেন,”জানো দিদুন আজ ফিউরিয়াস সেভেন আছে।”

"সে কি, এত রাগ ভালো নয় দাদুভাই ।"

"রাগ? রাগের কথা কে বললো?"

“ওমা তুমিই তো বললে রেগে আজ সাতখানা হলে।”

“উফ্! এটা একটা মুভি দিদুন, কার রেসের মুভি, ফাস্ট অ্যান্ড দি ফিউরিয়াস-এর সাত নম্বর পার্ট, এর আগে আরও ছয়টা আছে। ইসস... আমিও যদি ওমনি গাড়ি চালাতে পারতাম অত স্পিডে!”

“অ”

“শুধুই অ, জানো কি ডেঞ্জারাস গেম! পল ওয়াকার তো মরেই গেল।”

“দাদুভাই খুব জোরে গাড়ি চালানোর মধ্যে কোন বীরত্ব নেই।”

“কে বলেছে নেই। জীবনটাকে বাজি রেখেই তো মানুষ কাজ করে বীর হয়। মাইকেল শুমাখারের নাম শুনেছো?”

“না ভাই, তোমার কথা মানতে পারলুম না। যদি নিজের জীবন বাজি রেখে কেউ এমন কাজ করতে পারে যাতে অন্য আরও কারুর উপকার হয় তবে বুঝি সে বীর। ইতিহাস বলে ....”

“ইতিহাসের কথা ছাড়ো। অমনি অনেক গল্প আমি জানি। জানো গতির একটি নেশা আছে। আমি মাঝেমধ্যেই সৌরভের স্কুটিটা চালাই। দিদুন বাবাকে বলো না আমাকে একটা বাইক কিনে দিতে প্লিজ।”

“একটা গল্প শুনবে ভাই?”

“আমি কি এখনও বাচ্চা আছি নাকি? আচ্ছা যদি বাবাকে বলো বাইকের কথাটা তবে শুনতে পারি।”

“আমার পাড়ায় এক মেয়ে ছিল, নাম তার আন্নাকালি। তারা অনেকগুলি ভাইবোন। আগে অনেক গুলি ভাইবোন মরে গেছে কিনা তাই এই নাম। তা বড় কষ্টের জীবন তাদের। আন্নাকালি সবচেয়ে বড়। তাদের বাবা সার্কাসে বকরাক্ষসের খেলা দেখাতেন। মাসে দশে ঘরে আসতেন।”

“বকরাক্ষসের খেলা কি গো দিদুন?”

“সার্কাসে একজনকে রাক্ষসের মতো সাজানো হয়। তাকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়। এরপর তার হাতে মুরগি, পায়রা এইসব দেওয়া হয় আর সে দাঁতে কামড়ে তাদের গলা চিরে রক্ত খায়।”

“ইসস... কি সাংঘাতিক! এখনকার দিনে এমনি করলে পুলিশ ধরবে। উনি কি সত্যি রক্ত খেতেন দিদুন?”

“মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য, সংসার প্রতিপালনের জন্যে কত কিই যে করতে হয় দাদু, সংসার বড় নিষ্ঠুর জায়গা। তা সে যাকগে, তোমাকে যা বলছিলুম দাদুভাই। আন্নাকালির বাবার রোজগারেই মূলত তাদের সংসার চলত। একবার তার বাবার ভারি জ্বর হল, দিন যায় জ্বর আর সারেনা। অমনি দশাসই মানুষ শুকিয়ে বিছানায় মিশে গেলো। তখনকার দিনে গরিব মানুষের চিকিৎসা বলতে তেমন কিছুই ছিল না।”

“সে কি, তাহলে তো লোকটা মরে যাবে। আর ওর বউ ছেলেমেয়ে খাবে কি?”

“সেটাই তো কথা দাদু। আন্নাকালির মা লোকের বাড়ি ধান বেছে মুড়ি ভেজে কোনওমতে বাচ্চাদের খাওয়া জোটাতে লাগল। তা একদিন সেও পড়ল জ্বরে। ছোট ভাইবোনদের খেতে দেওয়ার মতো একটি দানাও নেই ঘরে। আন্নাকালি পড়লে মহা বিপদে।”

“তাপ্পর! তাপ্পর!”

“তারপর পাড়ায় একদিন হলো হন্টন প্রতিযোগিতা। যে একসাথে দুদিন না থেমে হাঁটতে পারবে সে পাঁচশ টাকা পাবে।"

“শুধু হাঁটা! ধুর্। এতে বীরত্বের কি আছে?”

“আছে দাদু আছে। হাঁটতে হাঁটতে না থেমে তুমি জল শরবত খেতে পারো, কিন্তু বাথরুমের কাজ দুদিন করতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে একঘেয়ে হাঁটা শুধু মাত্র শক্তির অপচয়। এতে কোনো বুদ্ধি, বীরত্ব বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টের কাজ। যাই হোক অনেকেই হাঁটা শুরু করলো। মেয়েদের মধ্যে শুধু আন্নাকালি। তখনও মেয়েরা এত বাইরে বেরোতো না। অনেকেই মুখ টিপে হাসলে। তখনকার সামাজিক রীতির তোয়াক্কা না করে সংসার বাঁচাতে ছেলেদের সাথে সমানে সমানে লড়াই করা কম বীরত্বের কাজ ছিল না দাদুভাই।”

“তারপর বলো কি হলো?”

“তারপর হাঁটতে হাঁটতে কেউ ছয় ঘন্টা কেউ আট কেউ দশ ঘন্টা পর থেমে গেল। টলতে টলতে টিকে রইল হাতে গোনা কয়েকজন আর আন্নাকালি । একদিন রাত পেরোলো। পরদিন মাত্র দুজন। রোদ চড়তেই অন্যজন রণে ভঙ্গ দিল। টলটল করতে করতে রইল শুধু আন্নাকালি। একসময় সেও অজ্ঞান হয়ে গেল। দুদিন পূর্ণ হতে তখনও ঢের দেরি।”

“সে কি! মেয়েটা হেরে গেল? এবার টাকা না পেলে কি হবে?”

“তখনকার দিনে মানুষের মনে মায়া দয়া একটু বেশিই ছিল দাদু। তাই পুরো সময় হাঁটতে না পারলেও সবচেয়ে বেশি সময় হাঁটতে পারার জন্যে সে তিনশো টাকা পেল।”

“বাঃ এটা দারুণ। এবার তো আন্নাকালির মা বাবা সেরে যাবে। সংসার আবার চলবে। তখনকার দিনে তিনশো টাকা তো অনেক, না দিদুন?”

“জীবন অত সহজ নয় গো দাদুভাই। কিছুদিন চললেও আবার দারিদ্র ফিরে এল। কারণ ওর বাবা গেল মরে। এরপর মা আরও ভেঙে পড়লেন। শাকপাতা গেঁড়ি গুগলি কুড়িয়ে আন্নাকালি ভাই বোনের পেট ভরানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু এভাবে আর কদিন চলে। তাই একদিন আন্নাকালি পুরনো সার্কাসে তার বাবার মালিকের সাথে দেখা করলে।”

“কেন, ওখানে কতক্ষণ হাঁটতে পারবে? সার্কাস তো মাত্র দু তিন ঘন্টার।”

“না দাদুভাই, হাঁটা নয়, সে পেলে বাবার পুরনো কাজ। নিজের ঘেন্না, লজ্জা সব বিসর্জন দিয়ে সে রাক্ষসী সেজে পায়রা, মুরগির গলা চিরে রক্ত খেয়ে রোজগার করতে লাগলো। নাম নিলে পুতনা রাক্ষসী। দূর দূর থেকে লোকজন পুতনা রাক্ষসীকে দেখতে আসতো। সবাই তাকে ভয় পেতো, এমনকি তার ভাই বোনেরাও। গ্রামের কেউ তার সাথে কথা বলতো না। কোনও বন্ধু ছিল না তার। বিয়ে থা হওয়ারও কোনও আশা ছিল না। সংসারের জন্য সে তার গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিলে। অন্যের ভালোর জন্যে এই কাজকে আমি বীরত্বই বলবো দাদুভাই। এবার তুমি বলো খুব জোরে বাইক চালানোকে কি এরকম বীরত্ব বলা যায় দাদুভাই?”

“সত্যি দিদুন, এটা তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু আঠারো বছর বয়স হলে আমাকে মটর সাইকেল চালানো শিখতে হবেই। তুমি তখন বাবাকে বলবে তো? ও দিদুন বলবে তো? ও দিদুন?”