Next
Previous
Showing posts with label ব্যক্তিগত গদ্য. Show all posts
0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


আন্তর্জাতিক নারী-দিবস
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী  



‘আন্তর্জাতিক নারী-দিবস’ ৮ এ মার্চ ! সারা বিশ্ব নারী-দিবস পালন করছে বলেই কি আমরা করবো? নিজেকে প্রশ্ন করুন “এ দেশে নারী কি সুরক্ষিত?” শুধু এ দেশ কেন, সারা বিশ্বে নারী কি সুরক্ষিত? উত্তরটা সম স্বরে - না না না না.........না !!! তবে কিসের নারী দিবস ? আমার প্রশ্ন ! কে কাকে জাগরণ করবে বা করাবে ? যারা দিন মজুরিতে কাজ করেন এমন মহিলা শ্রমিক: যেমন এপার্টমেন্টে তৈরির কাজে নিয়জিত, ক্ষেত খামারের, কারখানাতে, চা বাগানে, বাড়ীর কাজে এরা সবাইকি সুরক্ষিত ? তবে এই প্রহসন কেন ? 

নিত্য দিন ক্রাইম ফাইল খুলুন কাগজ পড়ুন, ওই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় ধর্ষণ, নয় হত্যা, স্ত্রী নির্যাতন, বধূ নির্যাতন, ট্যাক্সি চালকের দ্বারা নারী ধর্ষণ, অবলা শিশু কন্যাকে স্কুলে ধর্ষণের মতন জঘন্য অপরাধ !! আর কি বাকি রইলো আমার মাথায় আসছে না । আমি পুরুষ হয়ে বলছি, ধর্ষণকারীদের লিঙ্গ ছেদন করা উচিৎ । 

কোথায় না কোথায় নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। হাবড়ার যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী আত্মহত্যা করেছে, সেই ছাত্রীটির কথা চিন্তা করুন । তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে, কারণ সে পরীক্ষার পড়া করার সময় ধর্ষিত হয়েছে। তার মা বাবা ছিলোনা। তারা অন্ন সংস্থানের উদ্দেশ্যে বাইরে কাজে গিয়েছিল। কি বলেন আপনারা, এটা “নারী সুরক্ষা” !! 

আমি এগুলোকে ভড়ং বাজি বলবো । তাই নারী দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন রাত ১২ টায় একলা নারী স্ব-ছন্দে নির্ভয়ে নিজের গন্তব্য স্থানে যেতে সক্ষম হবে । নারী সুস্থ ভাবে, সুস্থ সমাজে, সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার যেদিন পাবে, সেইদিন নারী দিবস পালন করার কিছু মানে হবে, নতুবা নয় ।
0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


আমি পুরুলিয়া মানভূমি ভাষা বলি 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 


ভাষা কি নিছক ভাব বিনিময়, সেতু ? এই যে গুছিয়ে বলতে চাই, কতকিছু কতটুকু বলি । আদৌ কি পারি বলতে যা মনের ভেতর তোলপাড় করে, যা ক্রমাগত পুড়িয়ে মারে, জ্বালিয়ে মারে অস্থির করে। পারি কি তুলে আনতে সেই সমুদ্রঝিনুক ? পারিনা । তাই শব্দ সাজাই মায়াবন্ধনীর। আলো ফেলে দেখি নিজের যাতনা, রক্তপাত , আটুপাটু। না কি বেদনা আড়াল করে একগাল হেসে উঠি সৌজন্য সুন্দর? শূন্য কলস আর দারিদ্রের বিজ্ঞাপন অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ঐশ্বর্যময় কারুকাজ রঙিন আড়ম্বরে মুড়ে দিই তুমুল । । ভাষার বুননে কী অপরিসিম বিশ্বাসযোগ্য করে তুলি এই কৃত্রিম দুনিয়া । আমাদের জিভ কখনও শুকোয় না । অনলস বাক্যের পর বাক্য গঠিত হয় । আর আবরণ দিয়ে নিজেকেই মুড়ে ফেলি এক গুহার চাদরে । আমি যা , যতদূর প্রসারিত আমার স্বদীপ তাও কি সুন্দর নির্ভুল মন্ত্রে আরোপিত বাক্যবন্ধে নিভিয়ে দিচ্ছি না ? তাহলে কি এটাই শেষ অবধি প্রসারিত হল না যে ভাষা প্রোটাগনিস্ট চরিত্রকেও বিভ্রান্ত করে । ধোঁয়াশায় ঢেকে দেয় আপাদমস্তক । এতে প্রাণ কোথায় ? আমি র স্পন্দন কই ? 

প্রাণ যদি তুলে আনতে নাই পারি তাহলে ভাষাও তো এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল । নিছক ক্রিয়া বিশেষ্য আর বিশেষণের সমন্বয় । প্রাণ কই , কোথায় জিয়নকাঠি ? আর প্রাণের বিহনে কোন গান নেই । তাহলে গণসংগীতের নামে কোন গান গাইছি আমি ? ই গানে ত মাদল বাইজবেক নাই, আইজ্ঞা । হ্যাঁ, এই মাদলের আওয়াজ ই তো আমার ভাষা । আমার নিজের আত্মচিত্রের অহংকার । 

মাটির ভেতরে থাকা জীবন প্রবাহ আর শেকড়ের ধ্বনিময় ঝর্ণার বাঙময় প্রকাশ ই শিল্পসম্ভব হয়ে ওঠে নিজের দৈনন্দিনতায় । 

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে যখন আমরা দেখি সামগ্রিকতার বহুচিত্রিত প্রেক্ষিত । যখন দেখি ক্লান্ত বিধস্ত উদ্ভ্রান্ত এক দিশাহীন পৃথিবী এবং অনুভব করি এর সমাধানের রাস্তা কিম্বা এই ভীরু অন্ধকার থেকে পলায়মান অমানবিক শক্তিও আমার নেই। নাতিশীতোষ্ণ আড়াল থেকে বেরিয়ে তখনও কি একধরনের ভাষা আমরা রপ্ত করি না ? । যা ক্লান্তিমোচনের যা বিচ্ছিন্নতাবোধ ( অ্যালিয়েশন ) থেকে মুক্তিমোক্ষণের এক কবোষ্ণ আশ্রয় হয়ে ওঠে । এ থেকে কি আমরা সঙ্গ এবং শুশ্রূষার উদ্দামতা ও আহ্বান অর্জন করিনা ? করি এবং তখন ভাষা শুধুমাত্র এক নিঃশব্দ প্রহরা হয়ে ওঠেনা, বেঁচে থাকার সাথে অঙ্গীভূত এক অধ্যায় ও হয়ে যায় । 

শিরা আর ধমনী জুড়ে এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের বিস্তার । ভিড়ের মধ্যে থেকেও নিজস্ব সত্ত্বা লালনের প্রয়াস অথবা অভিকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়ানো । আর বর্শা ফলকের মত কিছু অনুভূতি এসে সামগ্রিক ভিজিয়ে দেয় ঘরদোর । ভাষা তো পরে, এর অনেক আগে তো গড়ে নিতে হয় চোখ আর কান । কান যদি ঠিক না থাকে তাহলে পিওরেষ্ট ইমোশন কেও মনে হবে ন্যাকামি । আর চোখও যদি প্রতারণা করে তাহলে অন্যের হান্ড্রেড পারসেন্ট অনেষ্টিকেও মনে হবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায় । এর ফলে ধারনাই গড়ে উঠবে এক সন্দেহ বিক্ষুব্ধ পরিবেশে । তখন গড়ে উঠবে এক জগাখিচুড়ি অবয়ব । আলো আর আঁধারের মাঝে এক টালমাটাল দশা । যা আত্মবীক্ষণীক নয় ফলে শিল্পবান্ধব ও নয় ।

ভাষা তো সেই অনুভূতি যা একটি স্থির ছবিকে সচল করে । এই যে আমি পুরুলিয়ার মেঠো পথে হেঁটে চলা এক প্রান্তিক মানুষ । পলাশ আর পুটুশের বনে পা রাখি । কলমকাঠি চালের গন্ধে আলুলায়িত বাতাস । গোবরের মাড়ুলি দেওয়া উঠোন জুড়ে ধানের পালই । কাঁসাই এর জল থেকে উঠে আসে উৎসবের সুখ । ভাদু গানে মেতে উঠে বাইদ বহাল । কুঁখড়া লড়াইয়ের আমোদ পরব । ২১ শে ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি আমাদেরও ১লা নভেম্বর আছে । মাতৃ ভাষার দাবিতে দীর্ঘ লড়াইয়ের দলিল । অবিভক্ত মানভুমের বঙ্গভুক্তির ইতিহাস । আর আছে বুকের মধ্যে গুন গুন করতে থাকা ঝুমুর । আমি যদি বলি ভাষা সেই অনুভূতি, যা স্থির ছবিকে সচল করে - ইটাও ঠিক হামদের পরানের ভাষা লয়, আইজ্ঞ্‌ ই ভাষাতে ত মনের ভিতরের ছবিট ছুইটবেক নাই । ইঁড়কে উইঠবেক নাই, পাঘা ছিঁড়া গাই বাছুর এর পারা । 

হ্যাঁ, ভাষা এটাই । ঠিক এইভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারা । আত্মমোচন করতে পারার নাম ই তো নিজের সাবলীল প্রকাশ । এই ভাণ্ডারের অমুল্য রতন গুলি কেন অবহেলা করব ? কেন খুঁজে নেব অন্য মানচিত্র ?
0

ব্যক্তিগত গদ্যঃ তন্ময় গুপ্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য

ফল্গু - প্রথম পর্ব 
তন্ময় গুপ্ত


বেশ কিছু জিনিষ আছে, যা পুরনো হবার সাথে জমে বা মজে। দামী হয়। সে আমাদের দেশি আচার হোক বা বিলাতী মদ। অনেকে বলেন পুরানো বন্ধুত্ব। সে অবশ্য সৌভাগ্যের ব্যাপার,তবে পুরান প্রেম যে বয়সের সাথে সাথে ঘন হয়, জমে ওঠে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আজকের যুবক যুবতীরা অবশ্য সে প্রেমের স্বাদ থেকে বঞ্ছিত। শীতের দুপুরের কয়েতবেল মাখার স্বাদের মতোই। বর্তমান যুগে ‘অপশন’এত বেড়ে গেছে যে প্রেমেও তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই প্রেম পুরনো হওয়ার আগেই তা বদলে যাচ্ছে।

তখন আমি কলেজে পড়ি। আমার এক দঙ্গল বন্ধুবান্ধবের জীবনে তখন ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোর লাগা, প্রায় সবারই প্রিয় কবিতা “১৮ বছর বয়স কি দুঃসহ,স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি...”। শুধু ব্যতিক্রম-শোভন।আমাদের সবার প্রিয় খ্যাপাটে বন্ধু-শোভন পাল। বাল্যবয়সেই মাতৃহারা শোভন অতিরিক্ত আদর যত্ন পেত আমাদের বন্ধুদের বাড়ীতে।যে কোন বাড়ীতেই শোভনের প্রবেশ অবাধ। 

ভাস্করের মা শোভনকে খুব স্নেহ করতেন। মাঝেমধ্যেই ভালোমন্দ রান্না করে ওকে ডেকে এনে খাওয়াতেন। শোভনের মাকে নিজের বোনের মতোই দেখতেন ভাস্করের মা।ভাস্করের বোন মুন্নি খুব খবরদারী করতো শোভনের ওপর। শোভন খেপে যেত যথারীতি।

কোনও ছুটির দিনে যখন আমরা দল বেঁধে ফুটবল খেলতাম, সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে যখন দুপুরের দোরগোড়ায় দাঁড়াত, দেখতাম মাঠের ধারে মুন্নি এসে হাজির হতো।

-কি গো, তোমরা খেলা বন্ধ করবে এবার? কটা বাজে খেয়াল আছে?

শোভন রেগে যেত- তাতে তোর কি ?

-মা কতক্ষণ বসে থাকবে তোমার জন্য ? সকালে কিছু খাওয়া হয়েছে ?

-ভাগবি তুই? কে পাকামো করতে বলেছে তোকে?


একদিন একান্তে শোভনের সাথে গল্প করতে করতে আমি বললাম- কিরে? প্রায় সবাই তো নিজের হিল্লে করে নিলো, তোর কি খবর?

-খবর আবার কি ? ওসব আমার দ্বারা হবে না। তোরা কি করে সহ্য করিস কে জানে! 

-আরে! তুই এমন ভাবে বলছিস কেন? কেউ তোর খেয়াল রাখছে দিনরাত, এটা ভাবতে তোর ভাল লাগেনা?

শোভন একটু আনমনা।
-নাহ। আমার খেয়াল কেউ রাখে না, রাখবেও না। 

সাহস করে ওর মনের কথা জানতে আগ্রহী হই। বলি- আচ্ছা, মুন্নিকে তোর কেমন লাগে রে?

-মুন্নি-ই? তুই বলতে পারলি? একটা নোংরা মেয়ে!

আমি বিরক্ত হই- দেখ শোভন তোর ভাল না লাগতেই পারে, তা বলে তুই একটা ভাল মেয়েকে, বিশেষ করে যাকে আমরা ছোট থেকে দেখছি, আমাদের বন্ধু ভাস্করের বোন, তাকে তুই নোংরা বলতে পারিস না। কি নোংরামো দেখেছিস তুই?

-আরে ও নখ কাটে না। সাবানও মাখে না বোধহয় রোজ। বেশ করব নোংরা বলব। অম্লান বদনে বলে শোভন।

বোঝ! আমি হাসি চাপতে পারিনা। আমার সরল সাধাসিধে খ্যাপাটে বন্ধুটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।


কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। আমরা কলেজ ছাড়িয়ে কেউ কেউ তখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। শোভনও একটা কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। সেদিন ছিল সরস্বতী পুজো। আমরা বন্ধুরা রাস্তার পাশে মল্লিকদের রকে বসে আড্ডা মারছি। সকালবেলা থেকেই অনভ্যস্ত শাড়ীতে বালিকা কিশোরী তরুণী সরস্বতীদের যাতায়াত। দল বেঁধে স্কুল কলেজ থেকে ফিরছে সবাই। এমন সময় সাইকেল বাহনে শোভনের আগমন। বিপরীত দিক থেকে একটা লরি আসছিল। হঠাৎ দেখি শোভন বিপজ্জনক ভাবে রাস্তার মাঝে চলে এসেছে। লরিটা সুনিপুণ ভাবে প্রচণ্ড আওয়াজ করে ব্রেক কষলো। শোভন খুব দ্রুত রাস্তার ধারে চলে এল। সবাই হৈহৈ করে উঠল।

উত্তেজিত হয়ে শোভন আমায় বলল -দেখবি একদিন ওর জন্যই আমার প্রাণটা যাবে!

সবাই জিজ্ঞাসা করে -কে?কার জন্য?
শুধু আমি চুপ করে ওকে শান্ত করতে লাগলাম। উল্টো দিক দিয়ে বান্ধবীদের সাথে দল বেঁধে মুন্নি সুন্দর সাজে সেজে হেঁটে আসছিল, সেটা আমার চোখ এড়ায় নি। 



একটু ফাঁকা হতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম –কি হয়েছিল? এমন ভাবে না দেখে রাস্তা পার হচ্ছিলি?
খেঁকিয়ে উঠে জবাব দিল-কি করব? কোন দিকে দেখব? কে ওকে তাকাতে বলেছিল?
আমি সামাল দিলাম- ঠিক আছে ঠিক আছে।



এরপর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের নিজের কর্মজীবনে। অনেকেই দূরদূরান্তে পাড়ি দিলাম বদলির চাকরির জন্য। জন্মস্থান ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় জীবন যুদ্ধে যেতে হল। কেউ কেউ বৈবাহিক জীবনেও প্রবেশ করছে সে সময়। আর ঠিক সেই সময় একদিন খবর পেলাম মুন্নির নাকি বিয়ে।

ঠিক তারপরের মাসেই আমারও বদলির দিন স্থির হয়ে আছে। যেতে হবে চিত্তরঞ্জন। সেদিনই সন্ধ্যায় শোভনের সাথে হল। খুব ব্যস্ত হয়ে সাইকেল নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছিল। ওকে থামালাম,
-আরে! শোন শোন!

-হেই! কি খবর রে! তোকে তো দেখাই যায় না! কিন্তু এখন তো বসা যাবেনা রে! মেলা কাজ পড়ে আছে।

-আরে দাঁড়া না! একটু চা খাই চল। কাজের চাপে তো দেখাও হয়না, কথাও হয়না।

-ও.কে। চল, কিন্তু জাস্ট পাঁচ মিনিট।


আমি চা খেতে খেতে আসল কথায় চলে এলাম। –ব্যাপারটা কি?
-তো চললি কোথায়?
-সে অনেক কথা! অনেক কাজ।
-উফ্‌। তুই না! কিছুতেই ঝেড়ে কাসবি না।
-হ্যাঁরে, শুনলাম মুন্নির নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
-হ্যাঁ হয়েছে। তো আমি কি করব? আমার ঝামেলা বেড়ে গেছে শুধু, এই দ্যাখ! সব জোগাড়-যন্ত্র, বাজার-হাট সব আমায় সামলাতে হচ্ছে। কি করি বল, কাকিমাকে তো মা এর মতই দেখেছি। না করা যায়? যত্তো সব!
আমি বললাম-কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম, তোরই পছন্দ ছিল মুন্নিকে। এমন কি ভাস্করকে এ কথা বলব এমনটাও ভেবেছিলাম।
–আমার বাপের ভাগ্যি যে তুই শেষমেশ এ কথা বলিসনি। তোর মাথা খারাপ নাকি? ফুঃ 
-কেন রে? হেসে বলি- “নোংরা”?
খ্যাপাটে বন্ধুটা গুম হয়ে বলল-হুম্‌।
ওকে আর ঘাঁটাইনা।


মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল বেশ ধুমধাম করে। শোভন প্রতিটি দিকে খেয়াল রেখে অমানুষিক খাটা খাটনি করলো।মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে বরের গাড়িতে উঠে বসল। শুধু যাওয়ার সময় ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমার কানে কানে বলে গেল- “বাপি দা, ওকে একটু দেখো”।

পরের মাসেই আমার বদলী হয়ে গেল। পরের বছরের পুজোতে বাড়ী ফিরে ভয়ানক এক দুঃসংবাদ পেলাম। মুন্নির স্বামী পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি এতটাই শোকাহত হলাম যে ওদের সাথে দেখা করার সাহস হল না। কোন মুখে দাঁড়াব মুন্নির সামনে? বন্ধুদের কাছে শোভনের খোঁজ করলাম। সবাই বলল সে নাকি অফিসে অনুরোধ করে আসাম না কোথায় চলে গেছে। মুন্নির বিয়ের পর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি।

ব্যাস্‌। ধীরে ধীরে ওরা সবাই ঝাপসা হয়ে গেল আমার মনের ক্যানভাসে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আরও পাঁচজনের মতোই।

(চলবে)
0

ব্যক্তিগত গদ্য: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য



বই-রাগী বৃত্তান্ত
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 



ঋতবাক-এর মাননীয়া সম্পাদিকা পইপই করে বলে দিয়েছেন, বই নিয়ে কিছু লিখতে। কারণ সামনে বইমেলা, বই নিয়ে হৈচৈ উন্মাদনা। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। কিন্তু আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে একটাই আশঙ্কা কি যে লিখি, কিছুই তো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। ভুল মানুষকে ওঁরা দায়িত্ব দিয়েছেন, এসব নিয়ে গুল মারার। বই আর আমি – অহি নকুল সম্পর্ক আমাদের। 

পুরোপুরি বই-রাগী মানুষ আমি। বই নিয়ে কি লিখি বলুন তো ? বন্ধু সুস্মিতার কথা শুনে তখন থেকে মাথায় চেপে আছে একবস্তা রাগ। এত সস্তা নয় সে রাগ জল ঢেলে নেভানো যাবে। দুঃসাধ্য জেনেও বাধ্য হয়ে কলম আর কাগজের শ্রাদ্ধ করার জন্য বসেছি। বুঝতে পারছি হাজার চেষ্টা করেও আজ আর কিছু হবে না। মগজ তো অচল। স্থিতিজাড্য নিয়ে বসে আছে। আজ বলতেই হবে, আর পারলাম না বই নিয়ে ওইসব খই বাছতে, শিবের গান গাইতে। চিরকাল মিতবাক আমি । ঋতবাক-এর জন্য কি আর লিখব । 

হ্যাঁ, বই। বই এর সাথে আমার বরাবরের বিবাদ। এই বৈরিতার সুত্রপাত তো সেই ছোটবেলায়। মা একটার পর একটা বর্ণপরিচয় কিনে আনতেন। আর আমি কত অবলীলায় সেগুলো ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলতাম। হাওয়ায় উড়ত বই-এর পাতা। ঠিক যেন ঘুড়ি উড়ছে আকাশে। সেই নীল আকাশের কাগজ দিগন্তে মনও উড়ে যেত – কি মজা কি মজা আর পড়তে হবে না। ভাবতাম – মা একদিন বলবেনই, আর তোকে বই কিনে দিতে পারবনি বাপু, তা তোর সাতজন্মে লেখাপড়া হোক বা না হোক। না, মা কোনদিন সেকথা বলেননি। বরং ধৈর্য হারিয়ে একদিন মা কে বলেছিলাম – আমার জন্য বই কিনতে কিনতে একদিন তো সব পয়সাই শেষ হয়ে যাবে । 

বই কিনে কেউ কোনদিন দেওলিয়া হয়না ... কথাটা মিলিয়ে নিস বড় হয়ে। 

পড়া মানেই তখন ছিল দাদুর কাছে কানমলা। পড়া মানেই এক বন্দিশালা। সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিত আকাশ। স্বপ্ন দেখাত চিল আর চড়ুইয়ের ডানা। নামতার খাতা নৌকো হয়ে নেমে আসত বর্ষার রাস্তায়। পড়ার বইখাতাগুলো এভাবেই ভালবাসার মানচিত্র হয়ে যেত। 

বাবার বৈঠকখানায় ঢুকে দেখতাম বইএর পাহাড়। বুঝতাম নিস্তার নেই এই জগত থেকে। বই আর পত্রিকার পাতা গুলো কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতাম। যেন প্রতিজ্ঞাই করে ফেলেছিলাম পৃথিবী থেকে সব বই নিশ্চিহ্ন করে দেব। তাহলে কেউ আর আমায় পড়তে বলবে না। উইপোকাদের বন্ধু হয়ে উঠতে চাইতাম মনেপ্রাণে । 

ভুখা মানুষ বই ধরো ওটা তোমার হাতিয়ার – কথাটা খুব শুনতাম। কিন্তু বুঝতে পারতাম না, বই নিয়ে কীভাবে যুদ্ধ হয় ? কীভাবে সংগ্রামের অস্ত্রাগার হয়ে উঠতে পারে কালির বর্ণমালা । অক্ষরের ভেতর কি বারুদ থাকে ? কীভাবেই বা সেই বারুদ থেকে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সূচনা বিন্দু তৈরি হয় ? প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠত মন। এত প্রশ্নের উত্তর কোথায় থাকে ? – বই। বইকে বাদ দিলে সমাজ আর জঙ্গলের মধ্যে কোন দূরত্ব থাকেনা। এসব জেনেছি অনেক পরে। তার আগে অনুভব করে নিয়েছি দেশ আর জাতি সীমান্তের বেড়া টপকে নিজেদের অনুভব বিনিময়ের সেরা মাধ্যম এই অক্ষরদুনিয়া। যা বিচ্ছিন্নভাবনা বা বিবাদমানতায় খণ্ডিত নয়। চারপাশের এই অস্থিরতা, ব্যক্তিগত অহংকারের আস্ফালন থেকে মুক্তির আশ্রয়। সাদা পাতার মাঝে লাইনে লাইনে বাক্যের ভাঁজে যে ইশারা যা সৃজনতৃষায় সক্রিয় করে তোলে অনুভবী মন। এই আনন্দ শিহরণ কোন ভাষা মাটি দিয়ে নির্মাণসফলতা লাভ করবে ? 

বইমেলা দেখি। বইসয়িক মানুষের বই ভাবনা। বই চিত্রের আনন্দনিকেতন। শিশুরাও আসে। কত বাচ্চা তাদের মায়ের হাত ধরে বইমেলায় আসে। মুখে নির্মল হাসি। এই ছবিগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে চলি অবিরাম। দেখতে পাইনা। আমার মা আমাকে কখনও হাত ধরে বইমেলায় নিয়ে যাননি। কিন্তু বইএর যে মেলা, তার প্রবেশদ্বারের চাবিটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল কোনদিন। আমি সযত্নে তা রেখেছি। 

বইএর গন্ধ আজও আমাকে তাড়া করে। যেখানে যা বই পাই কিনি। সংগ্রহ করি। ঐতিহ্যবিচ্যুত নতুন ভাবনার কোন গ্রন্থ পেলেই অস্থিরতা তৈরি হয়। মনে হয় এখনই হাতের মাঝে তুলে নিই তাকে। অনেক সময় তা সম্ভব হয়েও ওঠে না। তখন ভীষণ বিরক্ত লাগে। বুঝতে পারি রাগটা এখনও তীব্র। অনুরাগ। 



1

ব্যক্তিগত গদ্য: ইন্দ্রাণী ঘোষ

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


বইমেলা
ইন্দ্রাণী ঘোষ



বিশ্বের কোথাও এমন মেলাটি খুঁজে পাবে না কো তুমি । ফ্রাঙ্কফ্রুট আর লন্ডনে এমন বইমেলা যদিও হয়ে থাকে, কলকাতার মত এমন প্রাণেরমেলা হয় কিনা জানা নেই । 

এই মেলায় মিশে আছে বই আর মানুষের আত্মা । বইমেলা কলকাতার মানুষের মনের আনাচে কানাচে । গানে বইমেলা, লিমেরিকে বইমেলা, হালফিলের ব্যানডের গানে বইমেলা । চন্দ্রবিন্দু বলে - "বইমেলা ধুলো কোন গার্গী, শ্রেয়সী, চেনা চেনা মুখগুলো পরিচিত হাসি ... বন্ধু তোমায় এ গান শোনাব বিকেল বেলায়" । আহা জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে বইমেলা নিয়ে লিখতে বসে যে ধুলোমাখা, পাতাঝরা বিকেলগুলো গুটি গুটি পায়ে ফিরে আসে। 


কি বিশাল মেলা এই বইমেলা । দেশ বিদেশের গল্পের মেলা, কবিতার হাতছানি, অধরা মাধুরীর অমোঘ টান । পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় আটকে থাকে এক নতুন জগত । এই কলকাতা বইমেলা একমাত্র বইমেলা যা ব্যবসায়ী ছাড়া আমজনতার ও বটে । এই মেলার জন্ম ১৯৭৬ সালে । কলকাতার বইএর দোকানের অভাব পূরণ  করতে বইমেলার শুরু । তারপর তার শ্রী  বৃদ্ধি পেয়েছে । ক্রসওয়ার্ড, স্টারমার্ক, ইত্যাদি বই দোকানের সম্ভার আজ হাতের মুঠোয় তবু কমে নি বইমেলার আকর্ষণ । যদিও বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা ঢুকে পড়েছে বইমেলায় তবুও বইমেলার আকর্ষণ অদ্বিতীয় । বইমেলায় রয়েছে কাফে কফি ডে, কে এফ সির ঝকঝকে উপস্থিতি তবুও সেই ঝলকানি এড়িয়ে রসিক মানুষ ঠিক নিজের রস আস্বাদন করে নেন। বইমেলার ধুলোতে ওড়ে ফেলে আসা সময়ের মন কেমন করা গন্ধ। চেনা মুখগুলো, পরিচিত হাসি কেমন বেরিয়ে পড়ে ভিড় ঠেলে । 


আগের প্রজন্মের মানুষের কাছে বইমেলা এক “ফেসবুক” । কম্পিউটার স্ক্রীন এ ভেসে ওঠার বদলে জলজ্যান্ত বন্ধুটা পুরনো বন্ধুটা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে যখন পিঠে হাত রাখে, ফেলে আসা সময়টা একছুটে চলে আসে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে । বইমেলা মানেই মিলন মেলা । শীতের শুরুতেই মনে হয় বইমেলা কবে ? আচ্ছা অমুক বন্ধু তাঁর নিজের প্রকাশনার স্টল নিয়ে বসবেন, খুঁজে বার করলে হয় না তাঁকে । আচ্ছা ম্যাপটা দেখা যাক।

হয়ত বা সেই বন্ধু আর পৃথিবীতে নেই । স্টল আগলে বসে আছে তাঁর সদ্য যুবতী হওয়া মেয়েটি । দেখে বলবে “ভাল আছ মাসি ? মা হঠাৎ চলে গেল তোমার ফোন নম্বরটা ছিল না, তাই খবর দিতে পারি নি, জানতাম আমাদের স্টলে তুমি ঠিক আসবে”। এই হল কলকাতা বইমেলা। প্রাণের আদান প্রদান চলে যেখানে সহজিয়া চলনে । বন্ধুকন্যের মাথায় হাত রেখে ফিরে আসব । পিছনে সানাইয়ে বাজবে বিদায় ব্যাথার ভৈরবী । 


হাঁটতে হাঁটতে যাব লিটল ম্যাগাজিন প্যভিলিওনে । একশোর ওপর লিটল ম্যাগাজিনের পশরা সাজিয়ে বসবে এপার বাংলা ওপার বাংলার মানুষ । লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, লেখিকা, কবির দল মিলে সে এক চাঁদের হাট । আজ কত যুগ ধরে সাহিত্যের জন্ম হয়েছে এই লিটল ম্যাগাজিনের আঁতুড়ঘরে । লিটল ম্যাগ এক একটি স্বপ্ন গাঁথা মালা । এই মালা গাঁথার পরই দিগন্তে উড়ানের পালা । এমনও দেখেছি, এক কবি তাঁর সামান্য পুঁজি তুলে দিচ্ছেন লিটল ম্যাগের সম্পাদকের হাতে। ‘আমার টিউসুনির পয়সা যতটুকু সম্ভব বাঁচিয়ে বইমেলায় লিটল ম্যাগের জন্য দিতে পারলে বছর ভর শান্তি পাই ” । এই প্রাণের পরশ পেতে হলে বইমেলা ছাড়া আর কোথায় যেতে পারি আমরা ।