Next
Previous
Showing posts with label ঝরনাতলার নির্জনে. Show all posts
0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৮
শিবাংশু দে


''... সেই বাল্যকালে কবে থেকে গান গাইতে শুরু করলাম তা আমার মনেও নেই-- গান গাইছি-তো-গাইছি-তো-গাইছি। কোনো ওস্তাদ অথবা শিক্ষকের কাছে নাড়া বেঁধে বারীতিমতো লেখাপড়া শেখার মতো করে গান আমি কখনও শিখিনি। ছোটবেলার দিনগুলি থেকে শুরু করে, বড় হয়েও শুধু গান শুনেছি আর গেয়েছি। কোনো সঙ্গীত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গান শিখবার সৌভাগ্য আমার অদৃষ্টে কখনও জোটেনি।''


১৯২৮ সালের গোড়ার দিকে পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এক সতেরো বছর বয়সের সদ্যোতরুণ কলেজ ছাত্র উত্তর কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে প্রথমরবীন্দ্রনাথের দেখা পেয়েছিলেন। একটু অপ্রত্যাশিত ছিলো সেই অনুষ্ঠানে কবির আগমন। কারণ এই সময় 'ভদ্র'ঘরের 'বয়স্থা' মেয়েদের দিয়ে জনসমক্ষে নৃত্য অনুষ্ঠানপরিবেশন করার অপরাধে ব্রাহ্মসমাজের চাঁইরা কবিকে তীব্রভাবে নিন্দা ও ভর্ত্সনা করে যাচ্ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বা দৃষ্টিকোণকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়েসমাজকর্তাদের এক তরফা বিষবর্ষণে তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ছিলেন। কিন্তু সেই সব 'রুচি'বাগীশ কর্তাব্যক্তিদের আমন্ত্রণ তিনি অস্বীকার করেননি এবং সেই সভায়অত্যন্ত অসুস্থ শরীরে তিনি উপাসনা পরিচালনা করা ছাড়াও একটি ব্রহ্মসঙ্গীতও গেয়েছিলেন। এই ঘটনাটি, সেই মূহুর্তে না হলেও ধীরে ধীরে এই তরুণটিকে বিশেষভাবে প্রভাবিতকরে। কবিকথিত, '' সব বিদ্বেষ যেন দূরে যায় তব মঙ্গলমন্ত্রে'' বাণীটি কীভাবে তিনি নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন তার প্রথম পাঠ পেলেন তরুণটি , এভাবেই।


১৯২৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কয়েকজন মানুষের, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় আর সন্তোষ কুমার সেনগুপ্ত ।সন্তোষকুমার আর তিনি সে সময় একটি মেসে একই ঘরে থাকতেন। সঙ্গীতের আবহের মধ্যে থাকলেও তাঁর সঙ্গীতচর্চা সীমাবদ্ধ ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেসমবেত গায়কমন্ডলীর একজন হিসেবে। সেই সময় ব্রাহ্মসমাজের গায়করা ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দিতেন নিজের মতো করে। সেই তরুণের নিজের ভাষায়, ''.... তখনকার দিনেকোনো স্বরলিপির বই সামনে রেখে শেখানো হত না, গাওয়াও হত না। (শিক্ষকেরা) যেভাবে গাইতেন, আমরাও ঠিক সেইভাবেই গাইতাম। ব্রহ্মসঙ্গীত যা গাওয়া হত তা কার বাকাদের রচিত এইসব প্রশ্নও তখন মনে হতনা। 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বলে আলাদা কোনো শ্রেণীবিভাগ তখন একেবারেই ছিলোনা। কিশোরগঞ্জে বাবা মায়ের মুখে, ময়মনসিংহেরব্রাহ্মদের মুখে এবং কলকাতাতেও মাঝে মাঝে শুনতাম 'রবিবাবুর গান' অথবা 'রবিঠাকুরের গান'।'' তিনি অবশ্য এক দিক থেকে সৌভাগ্যবান ছিলেন। পারিবারিক যোগাযোগেরকারণে আরও অনেকের সঙ্গে শুনতেন টুলুমাসী, বুঁচিমাসী বা মেজদি'র গান। টুলুমাসী'র গানের গলা ছিলো '' যেমন সুরেলা, তেমন মিষ্টি'', আর বুঁচিমাসীর গলায় '' মিষ্টিত্ব তোছিলই, আবার 'জোয়ারী' বলে একটি মজার ব্যাপারও ছিল''। এই টুলুমাসী ও বুঁচিমাসী, সাহানা দেবীর মতো কবির বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিলেন। টুলুমাসী হলেন সুপ্রভা রায়, সুকুমাররায়ের পত্নী ও সত্যজিতের মাতা, বুঁচিমাসীর ভালো নাম কনক দাশ এবং মেজ'দি ছিলেন সতীদেবী।

''... তখনকার দিনে রুচিসম্পন্ন অবস্থাপন্ন রবীন্দ্র-ভক্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে অন্যান্য রেকর্ডের সঙ্গে সাহানা দেবী, কনক দাশ ও সতীদেবীর রেকর্ড বাজতই...'' 


ব্রাহ্ম হলেও, শান্তিনিকেতনের অন্দরমহলে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিলোনা। বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে বেড়াতে যেতেন সেখানে। কিন্তু সেখানে যে গান শুনতেন তারকোনও প্রভাব তাঁর উপর পড়তো না। ''.... এক নম্বর কারণ হতে পারে যে , ঐ গানগুলির রস গ্রহণ বা উপভোগ করার ব্যাপারে আমার নিজের অক্ষমতা কিংবা দু নম্বর কারণহতে পারে এই যে যাদের মুখে ও গলায় ঐ সব গান শুনতাম, গানের মধ্যে রস সঞ্চারণে তাদের অক্ষমতা। আবার এই কথাটিও সত্যি যে তখনকার দিনে সঙ্গীতরসিকরা এবংসাধারণ শ্রোতারাও রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান এবং ঋতুসঙ্গীতগুলিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন না। এই সব গানগুলির প্রতি তাদের রীতিমতো অশ্রদ্ধাই ছিল।''


১৯৩৫ সালে চাকরিতে ঢুকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। সুরেন্দ্রনাথের পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। এই সময় তিনি সুবীরঠাকুরের সূত্রে ইন্দিরাদেবীর সংস্পর্শে আসেন। ইন্দিরাদেবীর পাম অ্যাভেনিউয়ের বাড়িতে তাঁর নিয়মিত গতায়াত হতে থাকে। ইন্দিরাদেবীই তাঁকে কবির অধ্যাত্মসঙ্গীতের বৃত্তেরবাইরে থাকা গানের সঙ্গে পরিচিত করান। ইন্দিরাদেবী পিয়ানো বাজিয়ে কোন গান কীভাবে গাইতে হয় তার প্রশিক্ষণ দিতেন। ''আমি চিনি গো চিনি তোমারে'' গানটি পশ্চিমীকায়দায় হার্মোনাইজ করে তিনি গাইতেন। তাঁরই নির্দেশনায় যুবকটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাকী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু করেন। ''.... সেই দিনগুলি থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রেম ওনানা পর্যায়ের গানগুলির রসে আমি মজা পেতে লাগলাম।'' তখনও তিনি 'স্বরবিতান' নামের কোনও স্বরলিপি বইয়ের নাম শোনেননি। স্বরলিপি বুঝতেনও না। তবে পরবর্তীকালে'টাকা জমিয়ে' কিছু স্বরলিপির বই তিনি কিনে ফেলতে পেরেছিলেন এবং নিজে নিজে স্বরলিপি দেখে গান গাওয়ার অভ্যেসও হয়ে যায় তাঁর। তিরিশের দশকের শেষদিকে সুরেশচক্রবর্তী মশায়ের উদ্যোগে তিনি বেতারকেন্দ্রে গান গাওয়ার সুযোগ পা'ন আর শৈলজারঞ্জনের নির্দেশনায় কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে এইচ এম ভি থেকে একটিরবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশ করেন। গানদুটি ছিলো, ''সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান'' আর '' হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব'' । কিছুদিন পরে আবার দু'টি গানকনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে রেকর্ড করেন তিনি, '' ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে'' আর ''ঐ ঝঞ্ঝার ঝংকারে ঝংকারে...''। মোটামুটি এই সময়েই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয়হয় দ্বিজেন চৌধুরী, অজিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ রায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আরেকজন ঘনিষ্ট বন্ধুও তিনি পেয়েছিলেন এই সময়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। এইসব বন্ধু,গণনাট্য সঙ্ঘ, ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি এবং পথেঘাটে ইতরশ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় বোঝা এবং ততোধিক ভিন্ন শৈলিতেপরিবেশন করার একটা ক্ষমতা এনে দেয়। এই সময়েই শ্রীহট্ট থেকে আসা একটি ছেলে তাঁকে বলেন, '' জর্জদা, রবীন্দ্রসঙ্গীত যেভাবে আপনি গাইলেন সেইভাবে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগাওয়া যায় তা আগে ভাবতেও পারিনি।'' এই ছেলেটির নাম ছিলো হেমাঙ্গ বিশ্বাস। শুধু যে নতুন প্রজন্মের শ্রোতারাই জর্জ'দার গুণগ্রাহী ছিলেন তাই নয়, সেই সময় বাংলা গানেরজগতে অলিখিত রাজা পঙ্কজকুমার জর্জদা'কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পঙ্কজকুমার জর্জদা'কে কখনও ডাকতেন 'সম্রাট' বা কখনও 'মিস্টার ট্রাস্ট' সম্বোধনে। ডেকে নিয়ে গিয়েনিউ থিয়েটার্সের ফিল্মে কোরাস গাওয়াতেন। সত্যি কথা বলতে কি সেই সময়, অর্থাৎ চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে, জর্জদা প্রকাশ্যে মাঠেঘাটে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বা হারীনচট্টোপাধ্যায়ের লেখা গান গাইতেন মূলতঃ গণনাট্যের অনুষ্ঠানে।এ ছাড়া ব্রাহ্মসমাজ সম্পৃক্ত আসরে বা ইন্দিরাদেবীর গীতবিতানের অনুষ্ঠানে, সমবেত বা একক রবীন্দ্রসঙ্গীতগায়ন ছিলো তাঁর গানের বিশ্ব। গণনাট্যের আসরেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তিনি, কিন্তু সেখানে চাঁইরা তাঁর এই শখটিকে 'বিচ্যুতি' বলেই মনে করতেন। তাঁর একক রবীন্দ্রসঙ্গীতেররেকর্ড কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিলো চল্লিশ দশকের শেষ দিকে। ঠিক কবে হয়েছিলো তা তাঁর মনে ছিলোনা। তবে খুঁজে পেতে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৭ সালে তাঁর প্রথম ডিস্ক কলাম্বিয়াকোম্পানি বাজারে ছাড়ে। একদিকে, ''এ শুধু অলস মায়া'' আর অন্যদিকে ''দিন পরে যায় দিন''। তার পর বছর ন-দশ তিনি কলাম্বিয়া ছাপেই রেকর্ড করতেন। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়েযায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডের বাজার যথেষ্ট ভালো নয় বলে।

গণনাট্য সঙ্ঘ ও কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে এই 'ঘনিষ্টতা' ও তদ্ভব অনুপ্রেরণা, জর্জদাসহ আরো যে দুজন শিল্পীকে ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীত মানচিত্রে চিরস্থায়ী গরিমার আসন এনেদিয়েছিলো তাঁরা হলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র। 


জর্জদা বা দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বা শ্রোতাদের মনে যে অনুভূতিটি রয়েছে তা'কে নৈসর্গিক বলা যেতে পারে। অনুভবের জগতে ব্যক্তি জর্জদা হয়তোএকজন আত্মীয়ের মতো মুগ্ধ জনতার হৃদমাঝারে নিজের স্থান করে নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর গাওয়া গান আজকের শ্রোতাদের কাছে জল-মাটি-অক্সিজেনের মতো প্রাকৃতনৈসর্গিক সম্বল। তাঁর যে দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের বিবরণ ইতোমধ্যে দিয়েছি সেখানে একটা সূত্র অতি স্পষ্ট, তাঁর গান শোনা বা শেখার পদ্ধতি ছিলো একান্ত নিজস্ব। তার সঙ্গে আরকোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর শিক্ষা বা অনুশীলন ক্রিয়াকে তুলনা করা যায়না। যে দুজন শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চা সিদ্ধির বিচারে তাঁর নিকটতম, সেই পঙ্কজকুমার বাহেমন্তকুমারের সঙ্গেও এই ক্ষেত্রে তাঁর কোনও সমান্তরাল মাত্রা নেই। তাঁদের তিনজনের মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য সাধারন লক্ষণগুলি রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান তাঁদের প্রত্যেকেরনিজস্ব বিপুল জনপ্রিয়তা। কোনও পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল্যে নয়, স্বকীয়তার উজ্জ্বল মানদন্ডে তাঁরা শ্রোতার মনের নিভৃতকোণে নিজেদের তো বটেই, আরো সরাসরি বলতেগেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য প্রাপ্য সিংহাসনটি পেতে দিয়েছিলেন।


জর্জদার গান আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন আসরে শুনেছি পাঁচ-ছ'বার। রেকর্ডের গান তো জ্ঞান হওয়া থেকে প্রায় নিত্যদিনের সঙ্গী। বহুবার বোঝার চেষ্টা করেছি ওঁর গানের মধ্যেকোন লক্ষণটি এতো বেশি মোহগ্রস্ত করে? তা কি তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠ অথবা শব্দে সুর প্রয়োগের অন্যতর ভঙ্গি, কিংবা সাড়ে তিন মিনিটের এক-একটা নির্মাণে প্রত্যেকবার পাল্টেযাওয়া প্যাটার্ন। মন্দ্রসপ্তকে কাঁচ চুরমার জোয়ারির টান আর তারসপ্তকে পঞ্চম পেরিয়েও অনায়াস সুর ধরে রাখা, '' ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি''।কমবয়সে বুঁচিমাসীর গলায় জোয়ারি শুনে রোমাঞ্চিত স্মৃতিকে ম্লান করে তাঁর নিজের কণ্ঠে, '' গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা''। এইসব জাদু পেরিয়ে থেকে সম্পূর্ণ অন্যমেরুতে থাকা তাঁর মহাভারতের কর্ণের মতো একটি ভাবমূর্তি, যার সারাজীবনের 'পরাজয়ে'র পদাবলীই শ্রোতার কাছে জয়ের ফলকপ্রস্তর। পন্ডিতের ভৎর্সনা প্রপাত, শ্রোতাদেরহাত ধরে ফিরে আসতো পুষ্পবর্ষা হয়ে। শ্বাসরোগে সীমিত দমের আকুলতাকে ব্যবহার করতেন ম্যারাথন দৌড়ে শেষ ল্যাপে সাফল্যের অধীরতার মতো। সব মিলিয়ে একটাএকেবারে অন্যরকম একটা পরিবেশনা, যা শুনলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিরায় রক্তের লালিমা অনুভব করা যেতো। তপ্ত, উজ্জ্বল, চরিতার্থ মাত্রার সম্পূর্ণ অনুভব। 

যতো বয়েস বেড়েছে, জর্জদা'র কন্ঠস্বরের ন্যাচরল বেস বেড়েছে আর কমেছে লয়ের দ্রুততার দম। এই প্রাপ্তি ও ক্ষতি, দুটোকেই তিনি অবলীলায় ব্যবহার করতে পেরেছেননিজের পক্ষে। যতোদিন গেছে তিনি গানের লয় কমিয়ে দিয়েছেন। স্বরবিতানে যে তালনির্দেশ করা আছে তাতে বদ্ধ না থেকে তালমুক্ত নাটকীয়তা নিয়ে এসেছেন গাইবার সময়।এই গুলো ই তো ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। তবে এ সবই তাঁকে শ্রোতার কাছে বেশি করে নিয়ে এসেছে, সে শ্রোতা 'প্রস্তুত' বা 'অপ্রস্তুত' তার অপেক্ষা রাখেনি।‘পন্ডিত’রা পরিস্থিতিটি ঠিক বুঝতে পারেননি তখন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলেন।


কণ্ঠের সুর দিয়ে গানকে বেঁধে রাখা ছাড়াও তিনি সম্পূর্ণ অন্য শৈলিতে চিন্তা করেছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডে যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগ নিয়ে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর শেষ যুদ্ধ তোছিলো-ই এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। গান পরিবেশনের সময় সহযোগী যন্ত্রসঙ্গীতের কুশল ব্যবহার, সম্পূর্ণ আবহ ও গানের চরিত্রটিকে অন্যস্তরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তুকর্তাবাবারা তাঁকে অতোটা স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বাকিটা তো ইতিহাস। এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার সামান্য কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে। যেমন, 'এইতো ভালোলেগেছিলো', পুরোনো রেকর্ড, যন্ত্রানুষঙ্গ শুনলে মনে হবে যেন একজন বাউল গাঁয়ের পথে পথে গেয়ে চলেছে, সুরের উচ্চাবচ, ধারাস্রোতের মধ্যে একটা গড়িয়ে যাওয়ার গতিআছে। এটাই ঐ সুরবিন্যাসের নাট্যরস। পুরোনো গানের মধ্যে 'আজি যতো তারা তব আকাশে'যন্ত্রবিন্যাসের মধ্যে একটা বিরাটকে ধরার জমকালো প্রয়াস আছে। অন্তত ষোলোপিস অর্কেস্ট্রা ব্যবহার হয়েছে মনে হয়। কয়েকটি গানের যন্ত্রায়োজন বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, যেমন, গায়ে আমার পুলক লাগে, এ কী মায়া লুকাও কায়া, বহুযুগের ওপারহতে, দারুণ অগ্নিবাণেরে, গোধূলিগগনে মেঘে ইত্যাদি ইত্যাদি। 'বহুযুগের ওপার হতে' শুনলে মনে হয় সলিল চৌধুরির কম্পোজিশন। 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে'র প্রায় সমান সুরেতৈরি ' আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে'র লয় ধরে রেখেছে ম্যারাকাস। গলার রিভার্ব বাড়িয়ে শুধু কর্ডে আঘাত করে লয় ধরে রাখা তাঁর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আর কেউ করেনি।যেসব গানের সুরে অভিভাবক রাগের ভূমিকা প্রকট থাকে, সেখানে মূলত বাঁশি ( কারণ তাঁর কন্ঠের মন্দ্র ও বাঁশির তার পরস্পরকে বেঁধে রাখে) মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তারসঙ্গে থাকে সেতার ও বেহালা। যেমন, আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে, আমার যেদিন ভেসে গেছে, আমার রাত পোহালো ইত্যাদি। আবার একটু দ্রুত লয়ে, অনেক দিনের আমার যেগান, প্রিলিউড পিয়ানো দিয়ে, কিন্তু চলে যাচ্ছে বাঁশিতে। আবার ঢিমে লয় 'এ মণিহার' য়ে তিনি তাঁর কন্ঠের বেসকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, তাই গানটি বাঁশি দিয়ে শুরু করে বেহালায়চলে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ও বাণীর মধ্যে যে নাটকীয় টানাপড়েন তাকে তিনি সতত সফলভাবে খুঁজে পেয়েছেন এবং নিজের পরিবেশনায় তাকে মূলস্রোতের সঙ্গে পূর্ণমর্যাদায় মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

আজকের শ্রোতাদের কাছেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে স্বীকার্য। তাঁর গায়ন পদ্ধতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে একটি ভিন্নমাত্রায় নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য, তাঁকে নিজেরসময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছিলো।

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে

জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড -৭
শিবাংশু দে


'... তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে' 


১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পঙ্কজকুমারের যখন বছর বাইশ বয়স, তখন কেউ তাঁকে গার্স্টিন প্লেসে রেডিও কোম্পানির দফতরে নিয়ে যান। বৃহত্তর জনতার কাছে পৌঁছোনোর জন্য ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির এই মাধ্যমটিই ছিলো একমাত্র উপায়। যদিও পঙ্কজকুমারের নাড়াবাঁধা গুরু ছিলেন দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, কিন্তু দিনু ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিলো। দিনু ঠাকুর ছিলেন সদাশিব প্রকৃতির মানুষ। কেউ ভালোবেসে রবিবাবুর গান শিখতে চাইলে তিনি সাগ্রহে এগিয়ে আসতেন। এইসূত্রেই পঙ্কজকুমারের সঙ্গে তাঁর একটা বিনিময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। পঙ্কজকুমারের বিধিবদ্ধ সঙ্গীতশিক্ষা ছিলো অন্য গুরুর কাছে, কিন্তু দিনু ঠাকুর তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরূপ ও সাধনার বিষয়ে দিকনির্দেশ করতেন। এই নতুন পাওয়া 'ভালোবাসার ধন'টি তরুণ পঙ্কজকুমারকে এমন আচ্ছন্ন করে রাখতো যে অন্য সব গান ছেড়ে তাঁর রেডিও স্টেশনের প্রথম অনুষ্ঠানে তিনি গাইলেন দু'টি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ' এমনদিনে তারে বলা যায়' এবং 'একদা তুমি প্রিয়ে' । রেডিও কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের সম্পর্ক এভাবেই তৈরি হলো।


১৯২৯ সালে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি আরম্ভ করলেন পরবর্তীকালের প্রবাদপ্রতিম 'সঙ্গীত শিক্ষার আসর। বাংলাগানের প্রথম 'গণসঙ্গীতশিক্ষণ প্রকল্প'। এই 'গণসঙ্গীত' শব্দটি যেভাবে আজকাল একটি নির্দিষ্ট জঁরের গীতধারা হিসেবে ব্যবহার হয়, এটি তা নয়। এ ছিলো আমাদের দেশের জনমাধ্যমে প্রথম আপামর জনসাধারণকে শর্তবিহীন গান শেখানোর আয়োজন। যদিও এই আসরে সবরকম বাংলাগানই শেখানো হতো, কিন্তু সিংহভাগ ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমাদের শৈশবে দেখতুম, যদিও সময় তখন অনেক বদলে গেছে, সারা বাংলাদেশে রবিবারের সকালে সাধারণ গৃহলক্ষ্মী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী, চাকুরে কিম্বা প্রবীণ গুরুজনেরা নিয়ম করে এই অনুষ্ঠানটি শুনতেন । শুধু তাই নয়, কেউ গুনগুন করে বা উচ্চস্বরে পঙ্কজকুমারের সঙ্গে গানের মহলাও দিতেন। এই আয়োজনে যোগ দেবার একমাত্র শর্ত ছিলো যোগদানকারীকে বাংলা জানতে, বুঝতে হবে এবং গান'কে ভালোবাসতে হবে। আমরা প্রবাসী বাঙালিরা দেশের নানা প্রান্তে অনেক অবাংলাভাষীকেও এই অনুষ্ঠানটি নিয়মিত শুনতে দেখতুম। কারণ, ভাষা নির্বিশেষে, এক বিশেষ প্রজন্মের ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে পঙ্কজকুমার একজন স্বীকৃত আইকন ছিলেন। এই অনুষ্ঠানটি হয়তো কোনও 'বড়ো' গায়কগায়িকা আমাদের দিতে পারেনি, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মূলস্রোতের মানুষজনের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে এসে শিল্পহিসেবে তার ভাবমূর্তিটি তৈরি করে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে জনরুচির উৎকর্ষের যে মান ও স্বাভাবিক মূল্যবোধের বিকাশ আমরা চল্লিশ দশক থেকে লক্ষ্য করি, তার প্রেক্ষিতে পঙ্কজকুমারের এই প্রয়াসটির বৃহৎ ভূমিকা ছিলো। মনে রাখতে হবে ১৯২৯ সালে পঙ্কজকুমারের বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর এবং সেই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'মালিকানা' ছিলো অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক অভিজাত মানুষের অধিকারে, যাঁদের সঙ্গে ইতরযানী মানুষের কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিলোনা। ১৯৩১ সালে কবির সত্তরতম জন্মবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে মূল রবীন্দ্রবলয়ের বাইরের মানুষ হয়েও গান গাইবার জন্য পঙ্কজকুমার ডাক পেয়েছিলেন সসম্মানে। হয়তো দিনু ঠাকুরেরও এর মধ্যে কিছু ভূমিকা ছিলো। কারণ সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত শিক্ষা ও নির্দেশনার দায়িত্ব ছিলো দু'জনের হাতে, দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী। 


এর পর থেকে পঙ্কজকুমার পিছনে ফিরে তাকাননি। তাঁর সম্বল ছিলো অনুপম কণ্ঠসম্পদ ও আশিরনখর রবীন্দ্রভক্তি। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধারণ শ্রোতার কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়ে আসে। বস্তুতঃ তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠের গায়নশৈলি পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের জন্য লোকপ্রিয় হবার সব থেকে জরুরি শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। যদিও তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে কিছু তালিম ছিলো, কিন্তু গাইবার সময় তিনি সচেতনভাবে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ঢঙে সুর লাগানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। দিনু ঠাকুর রবীন্দ্রসঙ্গীতে নিজস্ব ধরনে খোলা গলায় সোজা স্বরস্থান নির্ভর যেভাবে সুর লাগাতেন, তাঁর দুই শিষ্য শান্তিদেব ও পঙ্কজকুমারকেও সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। পঙ্কজকুমারের জন্য এই শিক্ষা অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাদ নিয়ে এলো। ব্যারিটোন কণ্ঠ ও সোজা সুর লাগানোর গায়নভঙ্গিটি তাঁর টার্গেট শ্রোতৃদল, অর্থাৎ বৃহত্তর ইতর জনতার কাছে বিশেষ সমাদৃত হয়ে ছিলো। তিনি কিন্তু সে অর্থে ন্যাচরল গায়ক ছিলেন না, ছিলেন না কুন্দনলাল সহগলও । কিন্তু তাঁদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের উপজিত স্বেদবিন্দু টের পাওয়া যেতোনা। 'গুরু' ও 'শিষ্যে'র পরিবেশিত এই গায়নকৌশলের জাদু সংখ্যাগুরু শ্রোতাদের জন্য ছিলো মাঠঘাট, গলি-রাজপথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতার আবিষ্কার। স্বতই রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'ন্যাচরল' গায়ন ও লোকপ্রিয়তা পেয়ে গেলো এক মুদ্রার দুই দিক হিসেবে সহজ স্বীকৃতি। শ্রোতাদের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি নির্দিষ্ট ছাঁচ এই সূত্রে গড়ে উঠেছিলো। 


পঙ্কজকুমারই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালবাদ্য হিসেবে তবলার প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়নেরও তিনি ছিলেন ভগীরথ। এর থেকেও বড়ো কথা তিনিই প্রথম একজন সুরকার যিনি রবীন্দ্রনাথের রচনায় সুর করার শুধু 'দুঃসাহস'ই করেননি, কবির অনুমতিও লাভ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে 'মুক্তি' ছবি করার সময় প্রমথেশ বড়ুয়া পঙ্কজকুমারকে নিয়ে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোয়। কবির সামনে অর্গ্যান বাজিয়ে নার্ভাস পঙ্কজকুমার খেয়া কাব্যের কবিতাটি নিজের সুরে পরিবেশন করেছিলেন। কবি তৎক্ষণাৎ কিছু বলেননি, কিন্তু পরে তাঁর স্বীকৃতি জানিয়ে দিয়েছিলেন। 

কবি স্বীকার করেছিলেন গায়কে গায়কে এক্সপ্রেশনের ভেদ থাকবেই, থাকবে ইন্টারপ্রেশনের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ তো আমরা দেখতে পাই দেবব্রত বিশ্বাস ও সুবিনয় রায়ের গানে অথবা সুচিত্রা মিত্র বা কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের পরিবেশনে। কবির মনে এই স্বাধীনতার ব্যাখ্যা ছিলো, ' স্বরোচ্চারণে, গায়নভঙ্গিমায় গায়কের নিজস্ব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাণীর অন্তর্গত বোধের উন্মোচন'। 


(ক্রমশ)

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৬
শিবাংশু দে

বাংলায় একটা শব্দ আছে, 'ট্র্যাডিশনাল', অর্থাৎ শিল্পের আদিরূপের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রবণতা। আমার কিন্তু মনে হয় 'ঐতিহ্য' ব্যাপারটি নদীর মতো বহমান। তার প্রতিটি ঘাটের নিজস্ব ট্র্যাডিশন রয়েছে এবং সেটা সময় নিরপেক্ষ। তার প্রাসঙ্গিকতা শুধু মানুষের কাছে পৌঁছোতে পারার প্রয়াস থেকেই বিচার্য হওয়া উচিত। গঙ্গোত্রীর ঐতিহ্য বা গঙ্গাসাগরের ঐতিহ্য, দুয়েরই নিজস্ব গরিমা রয়েছে। তাদের সার্থকতা মানুষের তৃষ্ণাকে নিবারণ করতে পারার ক্ষমতা থেকেই নির্ধারিত হয়। এই কথাগুলি এই জন্য মনে এলো যে এই পাঁচজন শিল্পী নিঃসন্দেহে এই অর্থে ট্র্যাডিশনাল এবং তাঁদের রসসৃজনের ক্ষমতা ও মানুষের শিল্পতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করতে পারার জাদু, বহু যুগ পেরিয়ে এসে, আজও সমঝদার শ্রোতার কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এই সব শিল্পীদের বৃহত্তর শ্রোতাদের সামনে গান শোনাবার সুযোগ হয়নি। মুষ্টিমেয় কিছু রসগ্রাহী শ্রোতা এবং ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত আগ্রহী রসিকবর্গ ব্যতিরেকে এঁদের গান শোনার অবসর ইতর সাধারণের ঘটেনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে উপাসনামন্দির বা অভিজাতবর্গের বৈঠকখানা থেকে সর্বশ্রেণীর শ্রোতাদের নাগালে নিয়ে আসার কাজটি করেছিলেন অন্য কেউ। 

'... কোন রাতের পাখি গায় একাকী, সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে'

পৃথিবীর যেকোন বনেদি ভাষায় শব্দ উচ্চারণ থেকে বক্তা'র শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়। সংস্কৃতে 'অশুদ্ধ' অর্থাৎ যথেষ্ট আর্ষ নয়, এমন উচ্চারণকে শূদ্রের স্তর দেওয়া হতো। এমনটিই ছিলো লাতিনে বা ফার্সিতে। পরবর্তী ঔপনিবেশিক কালে এই প্রবণতাটি ইংরিজি ও ফরাসি ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যেও দেখতে পাই। লোকে বলে, শেক্সপিয়রের সময় ইংরিজি উচ্চারণ নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিলোনা, যেমন দেখা যায় মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময়কালে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ও মৌখিক শব্দের উচ্চারণ দিয়ে 'শোষক' ও 'শোষিতে'র ফারাক করার প্রয়াস হতো। অর্থাৎ চিরকালীন অভিজাত আর ইতরজাত'র বিভেদ। এই ধরণের স্বীকৃতির কাঠিণ্য ভাষাগুলির বানানপদ্ধতির ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। এই কাঠিণ্য বস্তুতঃ শাসকের (পড়ুন অভিজাতর) জেদ। যে জাতি যতো বেশি প্রাকৃত সম্পদ লুটতে পারে, তার তত অধিক বলের অভিমান। ঔপনিবেশিক অভিজাতর বানান, উচ্চারণ, উপস্থাপনার প্রতি ইতরজাত সদা সন্দিগ্ধ ও বিপ্রতীপ। কাব্যের মর্মবাণী যেহেতু শব্দ আশ্রিত এবং শব্দের আত্মা যেহেতু উচ্চারণে, তাই কোনও শ্রাব্য কাব্যসৃষ্টিই মূলশব্দের স্বীকৃত উচ্চারণ ভঙ্গিকে অস্বীকার করে ধরা দেবেনা। অন্যপক্ষে দৃশ্যশব্দের কাব্যপাঠে স্বীকৃত বানানশৈলীর গুরুত্ব অপরিসীম। উভয় নিরিখেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের 'শুদ্ধতা' স্বীকৃত উচ্চারণ ও বানান শৈলির প্রতি দায়বদ্ধ। যেকোনও ভাষার মতো বাংলাতেও উচ্চারণ ও বানান পরস্পর নির্ভরশীল। 


এখন প্রশ্নটি হচ্ছে কোনও শব্দের বানান উচ্চারণভিত্তিক হবে না তার আনুগত্য উৎস শিকড়ের প্রতি অধিক থাকবে। এই অনুপাতের কার্যকারণ সম্পর্কের উপরেই শব্দের ও উচ্চারণের শরীর নির্ভর করে। জোড়াসাঁকো দ্বীপের বাইরের কোলকাতায় যে বাংলা ব্যবহৃত হতো, জোড়াসাঁকোর লোকজন তা সযত্নে পরিহার করে চলতেন। যার পরিচয় কালী সিংহি থেকে নরেন দত্ত, সবার লেখাতেই পাওয়া যায়। কারণ 'জোড়াসাঁকো', 'রাঁড়ি-বাড়ি-জুড়িগাড়ি'র কোলকাতায় এক টুকরো য়ুরোপীয় উপনিবেশ। সেখানে উপনিষদও চর্চা হতো য়ুরোপীয় পণ্ডিতদের 'বৈজ্ঞানিক' নিষ্ঠায়। তাই আজ যে ভাষাকে 'বাংলা' বলা হয় তার সৃজক দুজন বঙ্গভাষী য়ুরোপীয়। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ। আমি সচেতনভাবে এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের নাম নিচ্ছিনা, কারন তিনি ছিলেন গঙ্গোত্রীর উৎস, নদী হতে পারেননি। ঠাকুরবাড়ির 'বাংলা' উচ্চারন তাই শিমলা-গরানহাটা- ঠনঠনের উচ্চারন থেকে ভিন্ন। এর পিছনে ব্রাহ্মসমাজি শ্রেণীসচেতনতাও কাজ করেছে। বরিশালের ব্রাহ্মরাও 'জোড়াসাঁকো'র বাংলায় কথা বলতে প্রয়াস পেতেন। বাংলাভাষাকে একটি আধুনিক অগ্রসর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপীয়, মূলত ইংরিজি, structured ব্যবস্থাটির শরণ নেন। এটি মূল সংস্কৃত বানান ও ব্যাকরণ পদ্ধতির থেকে পৃথক। এই কারণে হিন্দি বানান ও উচ্চারণ অনেক বেশি সমগোত্র, কিন্তু বাংলা বানান ও উচ্চারণ ইংরিজির মতো বহুরূপী। রবীন্দ্রসংগীতের উচ্চারণ প্রকরণে এই সব নানা কার্যকারণ কাজ করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথমযুগের স্বরলিপি যাঁরা করেছেন, জ্যোতিরিন্দ্র, ইন্দিরা বা দিনু ঠাকুর, তাঁরা তো ঐ পারিবারিক ব্যবস্থারই অঙ্গ। 


পরবর্তীকালে শৈলজারঞ্জনের শিক্ষাও তো ইন্দিরাদেবীরই পথানুসারী। তাই স্বরবিতানে অ-কার ও ও-কারের যে দিশানির্দেশ আছে তার উৎসও এই নিয়মেরই অন্তর্গত। সম্প্রতি একজন প্রতিষ্ঠিত সুগায়িকা বন্ধুর (যাঁর শিক্ষা কোলকাতায় অনেক গুণীজনের কাছে) সঙ্গে 'বিজনঘরে' প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হলো। সেখানে সব সম্ভাব্যতা, যেমন বিজন (হসন্ত), বিজন(অ) বা বিজনো, নিয়েই কথা হলো। তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে উচ্চারনটা বিজন(অ) হওয়াটাই সমীচীন, তবে ঘাতটা তীব্র হবেনা, মৃদু হওয়াই কাম্য। কিন্তু কিছু সেরা শিল্পীরা ব্যতিক্রমও তো আছেন।



আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে নিজের সঙ্গে কথা বলা। তাই সততা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও অঙ্গকেই ঠিক আত্মস্থ করা যায়না। এই বিষয়টি কথা, উচ্চারণ, সুর বা গায়ন, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতোগুলি সূক্ষ্ম লক্ষণকে সঠিক মাত্রায় আয়ত্ব করে রস উপভোগ করার জন্য যে প্রস্তুতি লাগে, তা বৃহত্তর শ্রোতামণ্ডলীর নাগালের বাইরে। আমজনতার কাছে শোনার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। 'কানে' শুনে 'ভালো' না লাগলে তাঁদের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বিজড়িত থাকার কোনও গরজ নেই। শব্দঝংকারের ক্ষেত্রে , দৈনন্দিন পথেঘাটে শোনা উচ্চারণধ্বনির সঙ্গে কোনও ব্যতিক্রম হয়ে গেলেই, তাঁরা বিযুক্ত হয়ে যা'ন। এ ভাবেই কয়েকজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের ক্ষেত্রেও অভিযোগ আসে, তাঁরা 'চিবিয়ে' শব্দ উচ্চারণ করেন। এটা যতোটা ব্যক্তিস্তরের অরুচি, তা'র থেকে অনেক বেশি ইতরজাত'র আপত্তি। একালে কণিকা বা নীলিমার বা অন্য কোনও সিদ্ধ শিল্পীর প্রতিও এই অভিযোগ শোনা যায়। আবার জর্জদা'র গানে আকাশ 'ভওরা' উচ্চারণ বিতর্কটি মনে পড়ছে সুভাষ চৌধুরী মশাইয়ের বক্তব্য ছিলো, যেটা এক্ষণের ( পরে আজকাল কাগজেও) জন্য রায়মশাইয়ের সাক্ষাৎকার নেবার সময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন। 


সুচিত্রার উচ্চারণের প্রতি বৃহত্তর শ্রোতৃকূল অতি প্রসন্ন, আবার অনেক 'সমঝদার' তাঁর উচ্চারণে অকারণ অতিরিক্ত শ্বাসাঘাত প্রয়োগে কখনো অস্বস্তি বোধ করেন। তবে শ্রোতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঠিক কোন ধরনের উচ্চারণে আশ্বস্ত বোধ করবেন? এর কোনও প্রশ্নাতীত সমাধান নেই। তবে স্পষ্ট ও প্রযুক্ত শব্দগুলির গভীরতর ইঙ্গিতের প্রতি যথোচিত সম্মান জানিয়ে যে উচ্চারণ, তার আবেদন সচরাচর ব্যর্থ হয়না। কিন্তু কণিকা তো সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তবু এক শ্রেণীর শ্রোতার কেন এই অনুযোগ? একজন বলেছিলেন, কণিকার গায়নভঙ্গি মাত্রাতিরিক্ত 'কোমল', একটু আদুরে, ললিত সমর্পণে অতি নিবেদিত। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটু বেমানান। আমি ঠিক নিশ্চিত ন'ই এটাই যথার্থ কারণ কি না। 


সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ''..... সকলের উচ্চারণ শুনে নিশ্চয়ই আমার ভাল মনে হয়না। স্পষ্ট উচ্চারণই অনেকে করেনা। কয়েকজন - সুচিত্রা-টুচিত্রা আছে, যারা ভাল গাইয়ে - তাদের মধ্যে উচ্চারণটা বোধ হয়..... সুচিত্রার উচ্চারণ খুব পরিষ্কার। '' তখন প্রশ্ন ওঠে সুচিত্রা 'সন্ধ্যা' শব্দটি 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণ করেন, কিন্তু ব্যাকরণের নির্দেশ অনুযায়ী তা 'সোন্ধ্যা' হওয়া উচিৎ ছিলো। তখন সত্যজিৎ বলেন 'স(অ)ন্ধ্যা' উচ্চারণটি 'খুবই খারাপ'। আরও বলেন,''.....In general, বাচনভঙ্গিটা খারাপ হয়ে গেছে।.... বাংলা উচ্চারণের সেই awarenessটা অনেকটা চলে গেছে।....উচ্চারণটি সেখানে অঙ্গ ছিলো শিক্ষার। এখন সে পরিমাণে মোটেই নেই। যে জন্য সেটা গানেও reflected হচ্ছে।''


'চিবিয়ে' অর্থাৎ শব্দগুলিকে ঈষৎ চেপে বঙ্কিমভঙ্গিমায় উচ্চারণ করার প্রবণতা, যা তৎকালীন অন্যান্য বাংলাগানের গায়কির অঙ্গ ছিলো, আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রথমদিকের কিছু প্রধান শিল্পীদের গানের মধ্যে পাই। পথিকৃৎ হিসেবে এঁরা নমস্য, কিন্তু এখন আমরা এ ব্যাপারটি হয়তো পছন্দ করিনা। রুচি তো বদলাতে থাকে। এঁদের মধ্যে কনক দাসও ছিলেন, কিন্তু কণিকার গায়নশৈলি ও শব্দোচ্চারণ ছিলো একান্ত নিজস্ব, নিবেদিত ও তল্লীন। 

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড-৫ 
শিবাংশু দে
 

বিংশ শতকের শুরুতে সম্ভ্রান্ত বাঙালির অন্দরমহলে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে একটা অন্য ধরনের সামাজিক মন্থনও শুরু হয়েছিলো। অমলা দাশ ছিলেন বিখ্যাত দুর্গামোহন দাশের ভাই ভুবনমোহন দাশের কন্যা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভগ্নী। এছাড়া তিনি ছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর ঘনিষ্ট সহেলি। অমলা ও মৃণালিনীর অন্তহীন মেয়েকথার ধারাস্রোত কবিকে প্রেরিত করেছিলো একটি গান রচনা করতে, ''ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই''। ইতোপূর্বে ঠাকুরবাড়ির দুই মেয়ে প্রতিভা ও ইন্দিরা চৌধুরীবাড়ির বৌ হয়ে এসে 'সঙ্গীত সঙ্ঘ' নামে একটা গানের ইশকুল খুলেছিলেন। 'ভদ্র'ঘরের মেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো সেখানে। কিন্তু তখনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের প্রকাশ্যে গায়ন ছিলো অকল্পনীয় কৃত্য। সেই পরিবেশে অমলা প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাঁর সাঙ্গীতিক পারদর্শিতা ছিলো অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় কোন গান রচনা করলে সেটি তৎক্ষণাৎ অমলাকে শিখিয়ে দিতেন। বস্তুতঃ দিনু ঠাকুরের আগে অমলাই রবীন্দ্রনাথের গান লিখে রাখার কাজটি করতেন। তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং হেমেন্দ্রমোহন বসুর কন্যা মালতী বসুর (ঘোষাল) প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা অমলা'র কাছেই হয়েছিলো। 


এই তিন কন্যা ও অমিয়া রায় (ঠাকুর) এবং কনক দাশ (বিশ্বাস) ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি নতুন মানচিত্র প্রস্তুত করে দেন। এঁদের গান নিয়ে এ পর্যন্ত বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত পরিবেশনের কোন জাদু এতোদিন পরেও শ্রোতাদের মজিয়ে রাখে, সেই সূত্রটি খুঁজতে তাঁদের তৎকালীন রেকর্ডগুলি একটু অভিনিবেশ সহকারে শোনা প্রয়োজন. এঁদের পাঁচ জনের মধ্যে সাধারণ সূত্র যে'টি রয়েছে তা' হলো, এঁরা প্রত্যেকেই ব্রাহ্মসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং জীবনের কোন না কোন পর্বে কবির থেকে সরাসরি গান শুনেছেন ও শিক্ষা নিয়েছেন। 'শিক্ষা' বলতে আমি সুরটি তুলে নেওয়া বোঝাচ্ছি না। তাঁরা যে শিক্ষাটি পেয়েছেন তা হলো 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঠিক কীভাবে গাওয়া উচিৎ। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সুকণ্ঠী, নিখুঁত সুরেলা এবং ওজনদার স্বর। সেই সময়ের তালিম অনুযায়ী তাঁদের ছিলো মীড়প্রধান গায়কি এবং নানা সূক্ষ্ম অলঙ্করণ অবলীলায় কণ্ঠে ধারণ করতে পারতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে অকারণ গলা ঘোরানোর মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন। কণ্ঠের ওজস ছিলো মুক্ত ও সতেজ। অর্থাৎ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক এবং সব থেকে জরুরি যে শর্তটি রয়েছে, সংযম ও পরিমিতিবোধ, সেই শিক্ষাটি তাঁরা সযত্নে আত্তীকৃত করেছিলেন। সেকালের অদক্ষ রেকর্ডিং যন্ত্রের ত্রুটি ছাপিয়ে তাঁদের এই পরিবেশন ক্ষমতা এখনও বিস্ময়কর লাগে। যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবে স্রেফ হারমোনিয়াম বা অর্গ্যান, কনক দাশের সঙ্গে লয় ধরে রাখতে গিটারে অনুচ্চ স্ট্রোক ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও সামান্য বাঁশির ছোঁয়া। কোনও তালবাদ্য ব্যবহার হয়নি। সাহানা দেবী একবার বলেছিলেন কবি নিজে কখনও তালবাদ্যের সঙ্গে গীত পরিবেশন করেননি, যদিও স্বরলিপির সঙ্গে তালের উল্লেখ সতত রয়েছে। শান্তিদেব সাহানা দেবীর এই মতটির বিরোধিতা করেছিলেন। সম্প্রতিকালে এক প্রিয় শিল্পী প্রয়াতা রমা মন্ডল কোন রকম যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যতিরেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সেটি শুনলে আবার প্রমাণ হয় কোন স্তরের আত্মবিশ্বাস থাকলে আশি-নব্বই বছর আগে পঞ্চকন্যা এই ধরনের ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। কণ্ঠসম্পদ ব্যতীত তাঁদের সফলতার সম্বল ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক নতুন শিল্পমাধ্যমটি থেকে আনন্দ সন্ধানের নিরন্তর প্রয়াস। আমার ধারণায় এই উপলব্ধিটিই পরবর্তীকালের সফল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রধান অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। 


সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায়.. 

এই শিল্পীদের পরিবেশন পদ্ধতিটিকে আদত জোড়াসাঁকো শিক্ষণের রূপ হিসেবে ধরা যেতে পারে। অমলা দাশ বিংশ শতাব্দীর প্রথম-দ্বিতীয় দশকে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং যে রেকর্ডগুলি করেছিলেন, তার থেকে এই শৈলীটি সম্বন্ধে একটি ধারণা তৈরি করা যায়। তাঁর গাওয়া, 'অয়ি ভুবনমনমোহিনী', ' কে বসিলে আজি' বা ' ঐ রে তরী দিলো খুলে' অথবা ' তোমার গোপন কথাটি' ইত্যাদি গানে ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীতের পথটি কী রকম হবে তার কিছু আভাস পাওয়া যায়। যদিও আজ শুনলে মনে হবে সামান্য তাড়ায় পড়ে গাইছেন। মাঝে মাঝে সুরচ্যুতও হয়ে যাচ্ছেন। সেটা কতোটা কণ্ঠের জন্য বা রেকর্ডিং যন্ত্রের জন্য তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। কিন্তু সেই গান'কে আজকের বিচারেও পরিপূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে চিনে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান নির্দিষ্টভাবে পরিবেশনের রূপরেখা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াস মনে হয় কাজে আসছিলো। কারণ ১৯২৫ সালে মিস নীহারবালার গাওয়া ' এবার উজাড় করে নাও হে আমার' তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে অনেক পরিণত ও স্বীকার্য বোধ হয়। 


অমলার কাছে যাঁরা সরাসরি গান শিখেছিলেন, তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং মালতী বসু, তাঁদের গায়কীতেও বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নপদ্ধতির বিবর্তনটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাহানা দেবীর গুণমুগ্ধ কবি স্বয়ং তাঁকে আহ্বান করে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে রাতারাতি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে পন্ডিচেরি চলে যান দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে, কবি অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি যদি দেশের রাজা হতেন তবে সৈন্য পাঠিয়ে সাহানা'কে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনতেন। ভাবা যায়, ১৯২৮ সালের রবীন্দ্রনাথ, যাঁর 'পদতলে' ততোদিনে প্রায় সমগ্র কীর্তির সাম্রাজ্য পড়ে আছে, তিনি সাহানা দেবীর কণ্ঠে নিজের গান শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় স্বয়ং কবির মনে তাঁর গানের কোন মডেলটি প্রকৃতপক্ষে ধরা ছিলো। সাহানা দেবীর গাওয়া যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি তাঁর নামের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছে, যেমন 'খেলার সাথি', 'রূপে তোমায়', 'আহা তোমার সঙ্গে', 'নতুন করে পাবো', 'তিমিরদুয়ার খোলো' বা 'যদি প্রেম' ইত্যাদি তার সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হয়েছে। নতুন করে বিশেষ বলার নেই। কিন্তু কয়েকটি গান, যেমন 'আমার যাবার বেলায়', 'শুকনো পাতা কে ঝরায়', 'যদি তারে নাই চিনি গো' বা 'ওদের সাথে মেলাও' শুনে আমার প্রতীতি হয়েছে, যে কথাটা ইতোপূর্বে কবির নিজের ভাষায় ঊদ্ধৃত করেছি এবং অবিরাম শুনে আসছি ছোটোবেলা থেকে, যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকৃতপক্ষে আগে কবিতা পরে গান, তার চেয়ে বড়ো সত্য কিছু নেই। সুরবিন্যাসটি আধারমাত্র, হিরণ্ময় পাত্রের মতো, তার কাজ কবিতার অমৃতটিকে ধরে রাখা শুধু। সুরের যাবতীয় চাকচিক্য, বহির্মুখী প্রিয়ত্ব, সবই অন্তঃস্থ কবিতাটিকে গরিমান্বিত করার আয়োজন মাত্র, সেই খানেই তার সার্থকতা। 



এই উপলব্ধিটি মালতী ঘোষালের গান শুনেও অনেকের মনে হয়েছিলো। তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা নগণ্য, কিন্তু যাঁরা তাঁর গান সাক্ষাতে শুনেছেন তাঁরাও এই রকম একটি ধারণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত 'ট্রেইন্ড' শিল্পী, সঙ্গীতের কৃৎকৌশল সম্পূর্ণ আয়ত্ব ছিলো তাঁর। তিনি আর কিছু গান যদি নাও করতেন, শুধু 'এ পরবাসে রবে কে'র রেকর্ডটির জন্য তাঁকে চিরকাল মনে রাখা যেতো। শোরী মিঁয়ার মূল পঞ্জাবি টপ্পাটিতে সুর খেলানোর যে মজা রয়েছে, তা'কে সংযত শিল্পবোধে পোষ মানিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম যে শিল্প কবি সম্ভবতঃ তাঁর সৃষ্টির থেকে প্রত্যাশা করতেন, মালতীর উপস্থাপনায় তার প্রকাশ ঘটেছিলো। অমিয়া ঠাকুরেরও রেকর্ড প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু তাঁর গায়নভঙ্গির নিজস্বতা কবিসহ সবাই স্বীকার করেছিলেন । একটা গল্প শুনেছি, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্রোণাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্বয়ং কবিকে বলেছিলেন 'মরি লো মরি' গানটি শিখতে তিনি কলকাতায় অমিয়াদির কাছে যেতে চা'ন। তাই শুনে কবি ছদ্ম খেদ প্রকট করেন এই বলে যে স্বয়ং রচয়িতা মজুত থাকতে অমিয়ার প্রতি এ রকম পক্ষপাতিত্ব তাঁকে ঈর্ষিত করে। 


তবে এঁদের সবার মধ্যে অধিক সময়কাল সৃষ্টিপর ও প্রভাবী ছিলেন কনক দাশ (বিশ্বাস)। তিনি তাঁর গানের সঙ্গত হিসেবে হারমোনিয়াম বা অর্গ্যানের সঙ্গে গিটার, বাঁশি ও তালবাদ্য ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবহারের সংযত মাত্রা গান ও গায়নের সঙ্গে অবলীলায় একীভূত হয়ে গিয়েছিলো। পূর্বোক্ত শিল্পীদের গানে যে দাপট ও মজিয়ে দেওয়া সুরেলা উপস্থাপনা আমরা পেয়েছি, কনক দাশের গানেও তা পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত ছিলো। শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ এবং তা'কে ধরে রাখা স্বরের স্থিতি সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর গাওয়া অনেক গানের মধ্য থেকে কয়েকটি গান, যেমন, 'আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা', 'দিনশেষের রাঙা মুকুল', 'কাছে যবে ছিলো', 'এখনও গেলোনা আঁধার' বা 'আসা যাওয়ার পথের ধারে', তো এখনও পুরোনো হলোনা। 



1

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৪ 
শিবাংশু দে

'...ফেরার পন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহু ডোরে 
ওরা আমায় মিথ্যে ডাকে বারে বারে 
জানি নাই...' 


রবীন্দ্রনাথকে 'এলিটিস্ট' বলার প্রথাটি আধুনিক বাঙালি, অর্থাৎ বঙ্কিমপরবর্তী যুগের নব্যশ্রেণীর নাগরিক সমাজের কাছে একধরনের সেরিব্রাল কণ্ডূয়ণ হয়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। হয় এই সৃষ্টিটিকে ‘ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া’দিয়ে পুজোআচ্চা অথবা সঙ্গীতবোর্ডের সংরক্ষণ দিয়ে দিয়ে আবেষ্টিত রাখা হবে। নয়তো মাঠময়দান, চা'য়ের ঠেকে চীৎকৃত নানা অগভীর যুক্তিঝঞ্ঝায় ছিন্নভিন্ন করাটাই অভীষ্ট স্মার্টনেস। যতো সময় এগিয়েছে, দ্বিধাবিভক্ত বৃহত্তর আমশ্রোতার জগৎ পরস্পর আরো দূরে চলে গেছে। এই নিয়ে প্রথম বিভাজনটি প্রকট হয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার সূত্রে। তিনি নিজে ছিলেন ন্যাচরল গায়ক। সুকণ্ঠ এবং একান্তভাবে রবীন্দ্রমনস্ক। খোদ রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচারপ্রসারে নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেন। লোকপ্রিয় জনমাধ্যম চলচ্চিত্রের তারকা কুন্দনলাল সহগলকে অনর্গল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সুযোগ করে দেন। তার সঙ্গে নিজেও সবধরনের গণমাধ্যমে নিরন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি পৃথক জঁর, যেটা জোড়াসাঁকো-শান্তিনিকেতনের গায়নধারা থেকে ভিন্ন, সাধারণ শ্রোতার শ্রবণ অভ্যাসের মধ্যে জায়গা করে নিতে থাকে। চলিত গণমাধ্যমের শ্রোতাদের কাছে তখনও পর্যন্ত জোড়া-নিকেতনের গান বিষয়ে বিশেষ স্পষ্ট ধারণা ছিলনা। শ্রোতাদের যে অংশটি চিরকাল এলিটিজমের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলো, তারা পঙ্কজকুমারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে নিজস্ব মতপ্রকাশের একটি মঞ্চ খুঁজে পায়। যদিও পঙ্কজকুমার নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এই জাতীয় কাজিয়ার অংশ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর এবং কুন্দনলাল সহগলের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিপুল জনসমাদর জোড়া-নিকেতনের অনেক প্রভাবশালী মানুষকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলে। 


এই বিরূপতা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে, যখন দেখা যায় পঙ্কজকুমারের অনুসারী গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা আরো পরে কিশোরকুমার গীত রবীন্দ্রসঙ্গীত বৃহত্তর শ্রোতৃবর্গকে একেবারে অভিভূত দিয়েছিল। এই দুই ধারাকে সমন্বিত করার একটা আন্তরিক প্রচেষ্টা করতেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত মশায়। তিনি নিজে ছিলেন একজন গুণী শিল্পী ও এইচ এম ভির রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষক। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত জোড়া-নিকেতন নির্দিষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে দেবব্রত বিশ্বাস নামক নেমেসিসকে আটকাতে পারেননি। মনে হয়, তিনি চান'ওনি। কারণ প্রথমতঃ তিনি দীর্ঘকাল ব্যবসায়িক রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে জনগণেশের রুচি ও চাহিদার ক্রমবিবর্তন বিষয়ে ওয়াকিফ ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি দীর্ঘকাল ধরে জর্জদার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে জর্জদার ধারণাটির সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয় ছিলো। একবার একটি একান্ত আলাপচারিতার সময় উপস্থিত থাকার সুবাদে তাঁর কাছে শুনেছিলুম রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গীতধারাটিকে অনভিজাত শ্রোতার দরবারে পত্রপুষ্পে ভরিয়ে তোলার যে শ্রেয়ফল তা পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদেরই প্রাপ্য। পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদের ন্যাচরাল গায়নভঙ্গির অংশীদার হওয়া ব্যতিরেকে জর্জ বিশ্বাস নিজে সচেতনভাবে এই বিভাজনের সঙ্গে সংলিপ্ত ছিলেন না। কিন্তু পাকেচক্রে তিনিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অতি লোকপ্রিয় অথচ 'এলিট' শ্রোতা অনাদৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন ঘরানার পথিকৃৎ হয়ে পড়েন। কালক্রমে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক শিল্পধারণাটির ভবিষ্যতের অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দেন। 



'...আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা' 



জর্জ বিশ্বাসের 'স্বেচ্ছায়' রেকর্ডিং বন্ধ করা একালের বাঙালিমানসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে একটি নির্ণায়ক মোড়। এই ঘটনাটি বৃহত্তর শ্রোতাসমগ্র ও পরবর্তী প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে একটা নতুন বাঁক এনে দিয়েছিলো। 

" এলিটিস্ট বলতে যা বোঝায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত যে কেবল তাঁদেরই 'বিষয়' হয়ে রইলো, একথাটা আমি মানিনা তত। স্কুলের প্রাঙ্গনে, পাড়ার ক্লাবে, রাজনীতির আখড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও একেবারে অপাঙক্তেয় বা অপরিচিত হয়ে যায়নি। এলিটিজমের বৃত্তে নয়, এইটুকু হয়তো বলা যায় যে এই গান আমাদের মধ্যবিত্ত গণ্ডিটিকে এখনও পেরিয়ে যেতে পারেনি।" (শঙ্খ ঘোষ) 

'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়ে খোদ রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি কী ছিলো? মানে নিজস্ব চিন্তা-কল্পনা ও মননে সৃষ্ট সঙ্গীতের রূপ নিয়ে তাঁর প্রত্যাশাটি কেমন ছিল তা নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। 

যখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড হতে শুরু করেছে তখন থেকে একটা ডকুমেন্টেশন আছে। কিন্তু তার আগের পর্বে লোকমুখে ও স্মৃতিকথাসূত্র অনুসারে জনমনে এই গানের ছাঁচটি কেমন ছিল তাও মনে রাখতে হবে। 

১৮৯৮ সালে গায়ক শ্যাম ভট্টাচার্য মশায়কে মাসিক বেতনের চুক্তিতে শান্তিনিকেতনে নিযুক্ত করা হয়। তিনি উপাসনামন্দিরে প্রভাতী ও সান্ধ্য অধিবেশনে ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এই সব গানের সিংহভাগের রচয়িতা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সদস্যেরা। উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন মুখ্য রচয়িতা। তিনি যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন তখন রবীন্দ্রনির্দিষ্ট স্বরলিপি ও গায়নভঙ্গির বিশেষ তোয়াক্কা করতেন না। সম্পূর্ণ নিজের ঢঙে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেছেন খোদ শান্তিনিকেতনে বসে ১৯৪০ সালে তাঁর দেহাবসান পর্যন্ত। কবি যখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন, তিনি এই ভঙ্গিতেই নিজের গান শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কখনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে জানা যায়না। ১৯১৫-১৬ সালে শান্তিদেব যখন ৫-৬ বছরের বালক তখন তিনি দেখতেন দেহলি বাড়ির একতলার অধিবাসী দিনু ঠাকুরকে দোতলার মালিক রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধে শোনাচ্ছেন আর দিনু ঠাকুর তৎক্ষণাৎ সেগুলির সুর লিখে ফেলছেন। তার পর সেই সব গান সবাইকে ডেকে শেখানোর মধ্যেই তাঁর আনন্দ। 'সবাই' মানে পাঁচ থেকে পঞ্চান্ন বয়সি সব আশ্রমিক। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও যথার্থ সঙ্গীত শিক্ষা ছিলোনা। কিঞ্চিৎ বেসুরো বা বেতালা হবার ক্ষেত্রে কোনও বাধাও ছিলোনা। সচরাচর বিকেলের দিকে এই গানের আসর অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে অধিকাংশ দিনই কবি স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন। তিনি নিজে দিনু ঠাকুরসহ গলা মেলাতেন খোলা মনে। সানন্দে, সমস্ত সহগায়কদের সঙ্গেই। এই পরিবেশনের সময় একটা বিষয় স্পষ্ট থাকতো, সবাই যেন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের সঙ্গে এই যজ্ঞে ভাগ নেয়। অতএব শুরু থেকেই এটা নির্দিষ্ট ছিল তাঁর গান নিছক আনন্দের গান, 'আভিজাত্যে'র ছদ্ম আবরণ মুক্ত। বাঁধাবাঁধির বহুদূরে তার স্থান। 

কবির গান পরিবেশনের শাস্ত্রীয় অঙ্গটি নিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস নে'ন পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। তিনি যে শুধু বিভিন্ন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় গায়নকলায় দক্ষ ছিলেন তাই নয়। তিনি তবলা, পাখোয়াজ আদি বাদ্যযন্ত্রেও সমান পারদর্শী ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত অধ্যাপক হয়ে আসেন এবং প্রায় পনেরো বছর ধরে এই দায়িত্বপালন করে যন। তিনি বাংলা জানতেন না, কিন্তু একান্ত আগ্রহী চেষ্টায় বাংলা শেখেন। তার পর রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে শুরু করেন। যদিও তাঁর বাংলা উচ্চারণে কিছু জড়তা ছিলো, কিন্তু কবি তাঁর গায়ন খুব পছন্দ করতেন । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে দিয়ে একক গানও করাতেন। অতএব ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চারণের নিখুঁতত্বও কবির বিচারে তেমন জরুরি ছিলোনা। 



প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন পেশাদার গায়কগায়িকারা রবিবাবুর গান গ্রামোফোন রেকর্ড করতে উদ্যোগী হয়ে পড়েন। এঁরা কেউ সুর-বাণী-লয়-তালের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রাবীন্দ্রিক মানদণ্ডের ধার ধারতেন না। যে যেমনভাবে পেরেছেন, গান রেকর্ড করে গেছেন। 


সেকালের যে রেকর্ডিংগুলি রয়েছে সেখানে প্রাচীনতম দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী গীত 'কেন যামিনী না যেতে জাগালে না'। ১৮৯৭ সালে রচিত এই গানটি ১৯০৪ সালে প্রথম রেকর্ড হয়। প্রথম থেকেই বিতর্কিত এই গানের বাণী এবং বক্তব্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো রীতিমতো যুদ্ধং দেহি রব তুলেছিলেন এবং অশ্লীল বলে ঘোষণাও করেছিলেন এই গানটিকে। আমাদের পিতৃদেবেরা যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুরু করেন, তখন হেমন্ত গীত এই গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এখনও পর্যন্ত সেটাই স্ট্যান্ডার্ড গায়ন। হেমন্তের মাপদণ্ডের নিরিখ নিয়ে যদি নিরপেক্ষও থাকি, তবু দ্বিজেন্দ্র বাগচী গীত রেকর্ডটি নবীন প্রজন্মের শ্রোতা কেন, আমাদের প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছেও একটি কমিক গান বোধ হবে। সেই একই পরিণাম দেখবো ১৯০৫ সালে রেকর্ড করা পূর্ণকুমারী দাসীর দু'টি গান, 'পুরানো সেই দিনের কথা' ও 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে'। 


আমি নিশ্চিত, বলে না দিলে একালের শ্রোতা বুঝতেই পারবেন না, এগুলো আসলে কোন গান রেকর্ড করা হয়েছিলো। অথবা ১৯০৬ সালে বেদানা দাসীর গাওয়া 'আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে'। 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে বসন্ত রায়ের গান, কিন্তু আমরা এই গানটি যাঁর কণ্ঠে শুনে বড়ো হয়েছি, অর্থাৎ অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে এই গান বা গায়কি এত-ই আলাদা যে বোঝাই যায়না যে কোন গান। 



এর সঙ্গে ১৯০৫ সালে মানদাসুন্দরীর গাওয়া 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' নেওয়া যেতে পারে। এই সব গায়িকারা দু'রকম গান জানতেন, টপ্পা-খেমটা বা নিজের মতো করে কীর্তন। তাই এই সব 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঐ সব শৈলীর জারজসন্তান হয়ে বিক্রি হতো। আবার ১৯১৮ সালে জিতেন্দ্রনাথ দত্তের গাওয়া 'একদা তুমি প্রিয়' বা ' এতোদিন যে বসেছিলেম' শুনলে মনে হবে প্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত শুনছি। 


কবি এ সমস্তই শুনতে পেতেন। কিন্তু এই সব যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কোনও সরব প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, এমন কোনও উল্লেখ দেখিনি। ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হবার পর কবি এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেন। যেসব রেকর্ড কোম্পানি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকাশ করতো, তাদের তিনি নির্দেশ দেন যে গানের বাণী ও সুর যথার্থভাবে শেখার পরেই যেন গায়কেরা তা রেকর্ড করেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিলোনা কখনও। বরং তিনি স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে তৎকালীন লোকপ্রিয় শিল্পীদের উৎসাহিত করেন। যদিও এই সব শিল্পীদের সঙ্গীত শিক্ষণ ছিলো অন্য ধারার, কিন্তু তাঁরা কবির প্রেরণা ও আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য, কুন্দন লাল সহগল, কানন দেবী, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নীহারবালা, শান্তা আপ্তে, রেণুকা দাশগুপ্ত প্রমুখ। লক্ষ্য করার বিষয়, কবি কিন্তু নিজে কখনও এঁদের গায়নপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও অসম্পূর্ণতা বা বিধিচ্যুতি আবিষ্কার করেননি, যা পরবর্তীকালে তাঁর তাঁদের নিজস্ব ধ্বজাধারীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। 


অনেক পরে কবির পরিণত বয়সেও এ নিয়ে তাঁর অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। ১৯৩১ সালে কবির সত্তরবর্ষ জন্মদিন উদযাপনকালে সেই সময়ে বাংলার যতো প্রথিতযশা শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতধারা নির্বিশেষে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেখানে ২৭ জন পুরুষ শিল্পী ও ৪৭ জন মহিলা শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন, বিষ্ণুপুরের গোপেশ্বর, সত্যকিঙ্কর, রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অনাদিকুমার দস্তিদার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনিলকুমার বাগচি, সুধীর কর থেকে মালতী বসু (ঘোষাল), কনক দাস, রমা কর, সাবিত্রী গোবিন্দ (কৃষ্ণন), অমিয়া ঠাকুর, অমিতা সেন, হাসি বসু এবং আরো অনেকে। এই চুয়াত্তর জন শিল্পীর মধ্যে শান্তিনিকেতন থেকে ছিলেন মাত্র কুড়ি জন। তাই বোঝা যায় শিল্পী নির্বাচন নিয়ে কোনও গোঁড়ামি আয়োজকদের মধ্যে তখনো দেখা যায়নি। 


আর্নল্ড বাকে সাহেব ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন। যদিও তাঁর নিজস্ব গায়ন বা শিক্ষণ পদ্ধতি একেবারে পৃথক ছিলো, কিন্তু কবি নিজে বা দিনু ঠাকুর কখনও তা নিয়ে কোনও বিরূপ অবস্থান নেন'নি। এর থেকে স্পষ্ট হয়, কবি নিজে বা তাঁর সহযোগী রবীন্দ্রসঙ্গীতের চিহ্নিত ধারকবাহকেরা এই সৃষ্টিমাধ্যমটির বিস্তৃত প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। জনগণেশের মধ্যে একে আরো অধিক মাত্রায় প্রসারিত করার জন্য যথাযোগ্য প্রয়াসে তাঁদের অনীহা ছিলোনা। 

যদিও এ প্রসঙ্গেও শঙ্খ ঘোষের বক্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য। 

“.... রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা, তার অনুভূতিজগৎ, তার সুরকাঠামো একেবারে সেই সাহিত্যরেখারই সঙ্গে লগ্ন, সাহিত্যেরই যেন আরো-একটা দিক। তাই ঐতিহাসিক কারণেই একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে এর প্রতিপত্তি হওয়া শক্ত। রামপ্রসাদি বা বাউলগান, পদাবলীসঙ্গীত বা পল্লিগীতি, তার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যপ্তিগত দূরত্ব একটা থেকেই যাবে। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে 'গীতাঞ্জলি'র গান পথের ভিখিররও কাছে পৌঁছে যাবে, সাতাশি বছর আগে (শঙ্খ এই কথা ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন) বলা ইয়েটসের এই ভবিষ্যবাণী সফল হয়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনাই নেই কোথাও।“ 


'... এ জীবনে যা কিছু সুন্দর, সকলই আজ ভরে উঠুক সুরে' 


0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন জেনএক্স রকেটপ্যাড
 শিবাংশু দে



যে সমস্ত নমস্য শিল্পী আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে, বুঝতে ও ক্রিয়াশীলভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে শিখিয়েছেন, তাঁদের সবার নিজস্ব সদগুরু সাধন হয়েছিলো। নিজস্ব সাধনার দ্বারা তাঁরা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পঙ্কজকুমার, সুবিনয়, দেবব্রত, হেমন্ত, সাহানাদেবী, কনক দাশ, রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা, সুচিত্রা, নীলিমা , ঋতু এবং আরো বেশ কিছু নাম আসা উচিত এই তালিকায়, যাঁরা আজ আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে যা বুঝি তার রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা যদি কৌতূহলী ও প্রশ্নশীল হয়ে নিজেদের মধ্যে খুঁজতে চাই পরিবেশনার ঠিক কোন অঙ্গটির প্রতি মুখ্যত আমরা আকৃষ্ট হই, তবে দেখবো আবেগের শিল্পিত ও সংযত প্রকাশই প্রধান শর্ত। যার শিকড় নিহিত রয়েছে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র ভূমিতে। 


সব মুখ্য শিল্পীই নিজেদের সিদ্ধি অনুযায়ী এই শর্তটি সযত্নে অনুপালন করে থাকেন। তবে বোধ ও আবেগের যে আনুপাতিক পরিমাপ, সেখানে প্রত্যেকে নিজস্ব মানদণ্ড স্থির করে নেন। শিল্পী হিসেবে সেখানেই তাঁরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন। ঠিক যেমন কবি দিলীপকুমারকে বলেছিলেন, 'আমি যখন সাহানার গান শুনি, তখন নিজের গানের সঙ্গে আমি সাহানার গানও শুনি'। অর্থাৎ একজন সিদ্ধ শিল্পী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনান তখন কবির সঙ্গে আমরা সেই শিল্পীর গানও শুনি। যে সব শিল্পীদের নাম করলুম, আপাতভাবে তাঁরা আবেগমুখর গানকেও সন্তুলিতভাবে বোধের মাটিতে বেঁধে রাখতে পারেন। সহজাত কুশলতায় বহির্মুখী আবেগ ও অন্তর্মুখী বোধের প্রতি সমান সুবিচার করতে পারেন । সুচিত্রা, কণিকা, নীলিমা বা ঋতুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নে এই সব বৈশিষ্ট্য তাঁদের সমসময়ে ও পরবর্তীকালে সার্থকতার উচ্চতম আসনে বসিয়েছিল। যদি আজকের শ্রোতা ইন্দিরাদেবীর মতো ‘কলকাতা’ ও ‘শান্তিনিকেতন’ নামের দুটি ঘরানা স্বীকার করেন, তবে এঁদের পরিবেশনের মধ্যে দুই সৃষ্টিস্রোতের গঙ্গাযমুনা সমন্বয়ের ধারা খুঁজে পাবেন। গান ধরে ধরে হয়তো তার বিশ্লেষণ করা যায়, কিন্তু তা দীর্ঘ পরিসর প্রত্যাশা করে। সুচিত্রার গান মজিয়ে রাখে আবাল্য, কিন্তু ব্যক্তি আমার কণিকা, নীলিমা, রাজেশ্বরী, ঋতু'র গান 'শুনতে' শেখার শিক্ষা হয়েছে পরবর্তীকালে। এখনও অনেক শেখা বাকি থেকে গেছে। বস্তুতঃ এই শেখার কোনও 'শেষ' নেই। এই উপলব্ধিটি কবির ভাষায় কমলহীরে, যে দিক করেই ফিরে দেখি, নতুন রঙের, নতুন আলোর বিচ্ছুরণ চোখে পড়ে।


'.... লাগলো ভালো, মন ভরালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই"

ছোটোবেলা থেকে অসংখ্য মানুষের থেকে শুনেছি 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' শুনলে 'কান্না' পায়। নজরুলগীতির মধ্যে বেশ একটা 'চনমনে' ব্যাপার আছে। একালের বাংলায় এই 'গুণ'টিকে 'সসি পাঞ্চ' বলা যেতে পারে। কবি মলয় রায়চৌধুরির একটি লেখায় পড়েছিলুম, সম্প্রতি সব রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই তাঁর শোক সঙ্গীত (মোর্নিং সং) মনে হয়। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করেননি ঠিক কোন শিল্পীর গান বা ঠিক কোন কোন লক্ষণ তাঁকে এভাবে ভাবায়। কিন্তু এটা প্রচলিত এবং প্রায় স্বীকৃত একটা ধারণা যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে সেই 'পাঞ্চ' নেই যা একালের জীবনযাপনের নবরস'কে ধরে রাখতে পারে। অভিযোগটি খুব অনৃত নয়। নানা ঐতিহাসিক কারণে আমরা দেখি বহুদিন ধরেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নে কণ্ঠ, সুরপ্রয়োগ এবং শব্দ উচ্চারণে প্রত্যাশিত মডিউলেশন শুনতে পাওয়া যায়না। এই অভিযোগটি অবশ্য মূলতঃ অল্পপ্রাণ কিন্তু সংখ্যাগুরু গায়কদের জন্যই প্রযোজ্য। এই গোত্রের গায়কদের 'ফ্ল্যাট' গায়ন, গায়ক হিসেবে তাঁদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা শক্তির অভাবকেই সূচিত করে। কিন্তু প্রশ্ন তুললে তাঁরা 'দিনু'দা' বা 'শৈলজা'দা'কে সাক্ষী মানেন। ততোটা দীক্ষিত নয়, এমন বহুজনশ্রোতাসমাজ টেকনিক্যাল ব্যাপারটা পুরো না বুঝলেও ফাঁকিটা ধরতে পারেন। এইভাবে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র বিরুদ্ধে ক্রমাগত অসঙ্গত নানা জনমত গড়ে ওঠে। 


একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়। লোকপ্রিয় বাংলা গানের ঠিক কোন কোন অঙ্গটি মানুষের কাছে অধিকতর আবেদন নিয়ে আসে। স্মার্ট লিরিক, নতুনতর যন্ত্রানুষঙ্গ না সফল মেলোডির জাদু। হয়তো সব গুলিই বিভিন্ন মাত্রায় । তবে সময়ের সঙ্গে দ্রুততর বদলায় লিরিকের প্রকাশভঙ্গি এবং নতুনতর যন্ত্রসঙ্গত বা সহযোগী সুরবিন্যাস। মেলোডির কাঠামোর মধ্যে কিন্তু ততো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনা। সময়ের সঙ্গে মেলোডির বিবর্তনের অন্যতর সূত্র রয়েছে। লিরিক ও যন্ত্রানুষঙ্গের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার করা অনেক সহজ, কিন্তু মেলোডিকে বিকৃত করার ঝুঁকি সুরকাররা নিতে চান'না। কারণ অধিকাংশ শ্রোতা শুধু কানে শুনে সঙ্গীতের মান নির্ধারণ করেন। কাব্যগীতির ক্ষেত্রেও লিরিকের প্রাথমিক আবেদন সুরের সঙ্গে তার নির্ভার মিশে যাওয়ার নৈপুণ্যে। লিরিকের গুণগত মান বা গভীরগামিতার প্রশ্ন আসে পরবর্তী স্তরে। এই স্তরে পৌঁছোনো শ্রোতার সংখ্যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম। বিশেষতঃ আজকের শ্রোতার কাছে ভাবার সময় অল্প। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার তাৎক্ষণিক ভালো লাগার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণ শ্রোতার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আগে ছিল। এখন তার অনুপাত অনেকটা বেশি। প্রশ্ন, আজকের শ্রোতার কাছে পৌঁছোনোর জাদুটি কী? 

কমবয়সে গানবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু স্বপ্ন ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও ভবিষ্যতে আমরা 'সঙ্গীতেই কথাবার্তা কহিব' বা ' সঙ্গীতই আমাদের অনুভাব-প্রকাশের ভাষা হইয়া দাঁড়াইবে'। এইসব ভেবেই তিনি শান্তিনিকেতনে ছেলেদের জীবনে গানশেখা বা গাওয়ার ব্যবস্থাটিকে একটা নৈসর্গিক অনিবার্যতার মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। গান যে রোগশয্যায় ওষুধের মতো শুশ্রূষা এনে দিতে পারে, তা তিনি সেই অতীতেও অনুভব করেছিলেন এবং 'গৃহপ্রবেশ' নাটকে সে রকম একটি পরিস্থিতিও সংযোজিত হয়েছিলো। অর্থাৎ সঙ্গীত শুধু একটা শ্রাব্য বিনোদনমাত্র নয়; তাঁর এই ধারণা ও আমাদের আজকের অভিজ্ঞতা বলছে গান শোনা শুধু বিমূর্ত উপভোগ নয়। এ ব্যাপারে একটা ক্রমবিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে। সামূহিক শ্রোতাসমষ্টির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমাদর হঠাৎ বেড়ে যায় চল্লিশের দশকে যখন পঙ্কজকুমার চলচ্চিত্রে নিজে এবং সহগলসাহেবকে দিয়ে ক্রমাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে থাকেন। গানের যে একটা ভিজ্যুয়াল সফলতাও রয়েছে সেটা এভাবে সপ্রমাণ হয়। পরবর্তীকালে হেমন্তকুমার বা কিশোরকুমারের সুবাদে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে জনগণেশের স্বীকৃতিটি পাওয়া সহজ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র মাধ্যমটি স্বপ্রতিষ্ঠ হবার পর তাঁদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতও জনপ্রিয় হতে থাকে। বৃহত্তর শ্রোতাসমাজের কাছে পৌঁছোনোর বাহন হিসেবে দৃশ্যমাধ্যমের সফলতার কিছু অংশ শ্রাব্যমাধ্যমেরও নসিব হয়ে যায়। এর মানে এই নয় যে হেমন্ত ও কিশোরগীত রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয়তা তাঁদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংলিপ্ত থাকার সুবাদেই হয়েছে। সেই সব গান অবশ্যই নিজস্ব নৈপুণ্যে উজ্জ্বল। কিন্তু এই মাধ্যমের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ থেকে তাঁরা শিখেছিলেন কার্যকরীভাবে অধিকতর শ্রোতার সঙ্গীততৃষ্ণাকে স্পর্শ করা যায়। পরিবেশনে স্পষ্ট, কিন্তু সংযত নাটকীয়তার ছোঁয়া থাকলে সাধারণ শ্রোতার কাছে এই সব গান সহজে গৃহীত হয়। এই সত্যটি দেবব্রত বিশ্বাস, চলচ্চিত্র নয়, তাঁর গণনাট্যের দিনের স্বতোৎসার জনসংযোগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে সফল জনসংযোগ করতে পারার ক্ষমতাই পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল সহগল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস বা কিশোরকুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাফল্যের মূল কারণ। অবশ্য তাঁদের অতুলনীয় 'ন্যাচরল' কণ্ঠসম্পদ, যার অভিঘাত শ্রোতাদের সহজেই মুগ্ধ করে । নিঃসন্দেহে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, পঞ্চাশের দশক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মুখ হিসেবে সফলতম যে ত্রয়ী শিল্পী নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র, তিন জনেই গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে অল্পবিস্তর ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। অধিকন্তু এর সঙ্গে একটা প্রাসঙ্গিক ব্যাপারও মনে রাখা দরকার, উল্লেখিত শিল্পীদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অনুকারকেরা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন চিরকাল। কেউ কেউ কিছু মাত্রায় সফলও হয়েছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নাটকীয়তার কতোটা চাপ সইতে করতে পারে সেই বোধ পূর্বোক্ত শিল্পীরা সাধনার মাধ্যমে পেয়েছিলেন। কিন্তু নিছক অনুকারী শিল্পীরা সেই বোধ অর্জন করতে পারেননি। গানের চেয়ে নাটকই অধিক উপজীব্য হয়ে পড়েছিলো তাঁদের কাছে। সে কারণে তাঁরা কিছু সাময়িক লোকপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন একটি পর্বে। 


এই যে নাটকীয়তার লক্ষণ, অথবা বলা ভালো, আবেগের পরিমিত নাট্য অভিব্যক্তি, তার সফলতম প্রয়োগ আমরা দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস এবং সুচিত্রা মিত্রের পরিবেশনে। সচরাচর রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু কুশল শিল্পীকেও দ্বিমাত্রিক ( সুর ও লয়/ তাল) পরিবেশনের বাইরে গিয়ে ঝুঁকি নিতে সেকালে বিশেষ দেখা যায়নি। আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেও যে নাট্যমাত্রা আনা যায়, সেটা প্রথম পাই পঙ্কজকুমারের ঘরানায়। গানের মধ্যে যে সংলাপ তার শুদ্ধ বিবরণীপাঠ না করে যদি তাতে 'রক্তমাংস'এর মানবিক মাত্রা (পড়ুন, নাটকীয় আবেগ) যোগ করা যায়, তবে তা দৈবী মন্ত্রপাঠের ঊর্ধে গিয়ে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছোয়। এই 'আবেগ' কতোটা স্বীকারযোগ্য তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। প্রশ্নটা আজকের দিনে খুব প্রাসঙ্গিক, কারণ শিল্পীদের মধ্যে এই স্বাধীনতাটির অপপ্রয়োগ বেশ দেখা যাচ্ছে। জর্জদার মেধা ও সংযম ছিলো অতি উচ্চকোটির। কিন্তু তাঁকে হনুকরন করে নিম্ন বা মধ্য মেধার গায়করা শৈল্পিক সীমারেখাটির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে না। হয়তো সেটাই ছিল সঙ্গীতবোর্ডের আশঙ্কা। মনস্ক শ্রোতাদের এমত আশংকাও একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না হয়তো। 


এই সব আশঙ্কার কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্রসংস্কৃতি নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যথেষ্ট তলিয়ে ভাবেননি। তাঁরা যান্ত্রিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আশির দশক থেকে সাধারণ বাঙালি শ্রোতার শ্রবণ রুচির একটা ভূমিগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটি এই সব নিয়ন্ত্রকদের নজরে পড়েনি। সেই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের যাঁরা তারকা শিল্পী ছিলেন, তাঁরা স্বধর্মচ্যুত হয়েছিলেন, আমার এমন কখনো বোধ হয়নি। কিছু শক্তিমান শিল্পী, যেমন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন, চিণ্ময় চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লোকপ্রিয় শিল্পীদের ঐ সব নিয়ন্ত্রকরা বিশেষ কল্কে দিতেন না। কিন্তু কেন দিতেন না , তার কারণও কখনো স্পষ্ট করেননি। অশোকতরু বন্দোপাধ্যায় বা অর্ঘ্য সেনের মতো শিল্পীদের নিজস্ব অনুরাগী শ্রোতা সমূহ ছিলো। তবে তাঁদের প্রতিও প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বজাধারীরা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন বলে বোধ হয়নি। এঁদের তালিকার বাইরেও কিছু আরও শিল্পী ছিলেন যাঁরা দু'তিন দশক পরে জন্মালে এই মূহুর্তের মুখ্য শিল্পীদের তুলনায় উৎকর্ষের বিচারে অনেক উপরে থাকতেন। এই মূহুর্তের কিছু বাজারকাঁপানো রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীর প্রধান কৃতিত্ব তাঁরা তিন/ চার দশক পরে জন্ম নিয়েছেন। এই প্রশ্নে আবেগ যতোটা কাজ করে, মনন ততোটা করেনা। ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে যায় প্রজন্মগত কলহে। ব্যক্তিগত রুচিপছন্দ নিয়ে তর্ক করে কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায়না, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত যে মিঠে গলায় গানের ঊর্ধে আরও কিছু দাবি করে, শিল্পী ও শ্রোতা উভয়ের থেকে, এই সত্যটি উপলব্ধি থেকে আসে, তর্ক থেকে নয়। বহুধরনের গান গেয়েও যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নোঙরে বাঁধা থাকা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন অনেক শিল্পী। পঙ্কজকুমার, কুন্দনলাল ও হেমন্ত ব্যতিরেকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের নাম তো আনাই যায়। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে সক্ষম গায়কের অভাব না থাকলেও যে এক্স ফ্যাক্টর থাকলে একটা সাধারণ বাংলা কাব্যগীতির থেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আলাদা করে চেনা যায়, সেই বোধের পর্যায়টি নতুন গায়করা ঠিক ছুঁতে পারেননি। ফুল ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্যটি শুধু কণ্ঠসম্পদ, সুর লাগানো বা জনগণেশের সময়বদ্ধ রুচির নিরিখে বিচার করা যায়না। সম্প্রতি রাঘব চট্টোপাধ্যায় নামের একজন লোকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। টিভির বিভিন্ন 'প্রতিভাসন্ধান' প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা নবীন শিল্পীরা বিভিন্ন জনবহুল শ্রোতা সমাগমে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' পরিবেশন করছেন। লোকে শুনছে, তাই বলে কি গায়নধারাটিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে স্বীকার করা যায়? প্রশ্নটা শুদ্ধতাবাদের নয়। আবার ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করেছিলুম। প্রকাশ্যে কবির গান গাইতে যাবার আগে কী তাঁরা কবিকথিত 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্যে'র সাধনাটি সমাপন করেছেন?


(ক্রমশ)

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে



জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড 
শিবাংশু দে



২ 

আমি যে গান গাই, জানিনে সে... 


নিজের গান, বা বৃহদার্থে 'গান' সম্বন্ধে কবির ধারণা সারা জীবনে পাল্টে গেছে বারবার। নিজের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভাইস' হলো 'ইনকনসিস্টেন্সি' আর তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভার্চু'ও হলো ঐ 'ইনকনসিস্টেন্সি' । 

নিজের সম্বন্ধে তাঁর এই মূল্যায়ণ যে কতো যথার্থ ছিলো তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যেমন ১৯১২ সালে 'জীবনস্মৃতি'র একটি অধ্যায় তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে, '' বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেই খানেই গানের প্রারম্ভ।'' তিনি লিখেছিলেন, ''সুর কেন কথার দাস হইবে'' অথবা '' .... গীতকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয়না সেই সুযোগে গান'কে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে।'' এখানে 'গান' বলতে তিনি সুর'কেই সমার্থ বোধ করছেন। সেই গ্রন্থেরই আরেক স্থানে তিনি একটি বিশেষ স্মৃতির উল্লেখ করে বলছেন, ''... সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না।'' অথচ দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর যখনই প্রাসঙ্গিক আলাপ হয়েছে তিনি আমাদের কালোয়াতি গানে সুরের ইম্প্রোভাইজেশন, অর্থাৎ দৈলীপী 'সুরবিহার', বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকট করেছেন। ১৯১২ সালে তাঁর এ বিষয়ে ধারণা ১৯৩৮ সালে পাল্টে গেলো। তখন তিনি বলছেন ( এ বিষয়ে) '' ....মত বদলিয়েছি। কতোবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।'' তিনি আরও জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গানের তিনি কদরদান, তার রস তিনি পূর্ণতঃ উপভোগ করেন। কিন্তু 'খাঁচার পাখি'র মতো শুধু বুলি আউড়ে গেলে কিন্তু সঙ্গীতে মুক্তি নেই। তিনি চাইছেন নতুন সৃষ্টি ও গণ্ডী ভেঙে নতুন জীবনের পথ। এই ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেছেন আবহমান কালের বাংলা পদাবলীসঙ্গীত থেকে। যে শৈলিতে পদাবলী, গীতকলাকে সঙ্গিনী করে শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছিলো। সুর যখন কথার সঙ্গিনী হয়ে উঠবে, তখনই এই যুগলবন্দি থেকেই সার্থক হয়ে উঠবে সঙ্গীত। এই বর্ণনাটি কিন্তু যথার্থ উপমা সহকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'তে বহুকাল আগেই, ''.... আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।'' ১৯৩৭ সালে তিনি ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছিলেন , ''... কথাও সুরকে বেগ দেয়, সুরও কথাকে বেগ দেয়, উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে।'' ১৯২১ সালে বলেছিলেন, ''... সংগীতের মধ্যে বাণীর মিলন সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে'' (আমাদের সংগীত)। এই সময়েই তিনি আরো লিখেছিলেন, ''... বাংলাদেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে এক অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্খলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না।'' তার পর ১৯২৬ সালে তিনি দিলীপকুমারকে আবার লিখেছিলেন, ''... কীর্তনে বাঙালির গানে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই।'' 

দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর এই বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল কাঠামোটি বিষয়ে কবির অবস্থান কী রকম। দিলীপকুমার চেয়েছিলেন তাঁর গানের ব্যক্তিত্বস্বরূপটি নির্মাণ করবেন গায়ক নিজেই। তিনিই হবেন গানের 'রূপকার'। আমাদের কালোয়াতি গানের মতো। কিন্তু কবি জানতেন গানের ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গেছে সুরকারের সৃজিত কাঠামোতে। গায়ক বা রূপকার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বকে প্রাণ দেবেন তাঁর স্বরে, পরিবেশনায়, কিন্তু সুরকারকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার তাঁর থাকবে না। 

'' ... যে মানুষ গান বাঁধিবে আর যে মানুষ গান গাহিবে দুজনেই যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তবে তো রসের গঙ্গাযমুনাসংগম। যে গান গাওয়া হইতেছে সেটা যে কেবল আবৃত্তি নয়, তাহা যে তখন-তখনি জীবন-উৎস হইতে তাজা উঠিতেছে, এটা অনুভব করিলে শ্রোতার আনন্দ অক্লান্ত অম্লান হইয়া থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা জগতে বিরল। যাদের শক্তি আছে তারা গান বাঁধে, আর যাদের শিক্ষা আছে তারা গান গায়–সাধারণত এরা দুই জাতের মানুষ। দৈবাৎ ইহাদের জোড় মেলে, কিন্তু প্রায় মেলে না। ফলে দাঁড়ায় এই যে, কলাকৌশলের কলা অংশটা থাকে গানকর্তার ভাগে, আর ওস্তাদের ভাগে পড়ে কৌশল অংশটা। কৌশল জিনিসটা খাদ হিসাবেই চলে, সোনা হিসাবে নয়। কিন্তু ওস্তাদের হাতে খাদের মিশল বাড়িতেই থাকে। কেননা, ওস্তাদ মানুষটাই মাঝারি, এবং মাঝারির প্রভুত্বই জগতে সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা। এইজন্যে ভারতের বৈঠকী সংগীত কালক্রমে সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায় নামিয়াছে। সেখানে তান-মান-লয়ের তাণ্ডবটাই প্রবল হইয়া ওঠে, আসল গানটা ঝাপ্সা হইয়া থাকে।'' (সংগীতের মুক্তি) 

এ বিষয়ে আমার মনে হয় তাঁর অভিপ্রেত অনেকটা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনের সঙ্গে মেলে। সেখানেও স্বরলিপির নির্দিষ্ট বাঁধনকে আপোসহীনভাবে স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনে নিজস্বতার সিলমোহর লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিলটা শুধু সুরের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, সুর ও বাণীর মালা গাঁথার সাফল্য এক্ষেত্রে অর্জিত হয়না। নিজের সৃষ্টির অবয়বকে এইভাবে রক্ষনবেক্ষণ করার সাধ ও সাধ্য, শুধু বাংলায় কেন সারা ভারতবর্ষে কোথাও চোখে পড়েনি। বাংলাতে অন্য যেসব প্রধান কম্পোজার ছিলেন, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল বা নজরুল কেউই নিজস্ব সৃষ্টির পরিবেশন পদ্ধতি বিষয়ে এ জাতীয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ রেখে যাননি। তাই তাঁদের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে দিলীপকুমারের ঈপ্সিত পদ্ধতিটিই বলবতী হয়েছে । উল্লেখ্য, যা আমাদের আবহমান কালের গীতকৌশল। 


এখন হবে প্রাণের আলাপ 

রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচার করার সময় পণ্ডিতেরা মোটামুটি দুটি পর্যায় লক্ষ্য করেন। ১৯১৩র আগে ও তার পরে। ইন্দিরাদেবী ১৯৪২ সালে ( অর্থাৎ কবির চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে) বলেছেন , তিনি নোবেল পাওয়ার আগের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'সাবেক' এবং পরবর্তী কালের রচনাকে 'আধুনিক' আখ্যা দিয়েছিলেন। এই 'আধুনিক' রবীন্দ্রসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে ১৯১৫ সালের পর থেকে। 'সাবেক' রচনাগুলি মূলত রাগাশ্রয়ী ঐশী ও আরাধনাকেন্দ্রিক, যার রচনা, সুরসৃষ্টি ও স্বরলিপিকরণ হয়েছিলো ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি রেখে। এই ধারার বাইরে যেসব গান, ধরা যাক তাঁর নিজের সুর করা একেবারে প্রথমযুগের গান, শাহিবাগের প্রাসাদে বসে লেখা 'বলি ও আমার গোলাপ বালা' গোছের গান অবশ্যই রবিবাবুর গান, কিন্তু 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' হয়ে উঠতে পারেনি। এরকম অনেক উদাহরণ হয়তো দেওয়া যায় কিন্তু তা নিষ্প্রয়োজন। মূল কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান নোবেল পাওয়ার পর। এই ধরনের কথা শুধু ইন্দিরাদেবী নন, ধূর্জটিপ্রসাদও বলেছিলেন। তাঁর 'আমরা ও তাহারা' বইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করেছিলেন সুরপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। প্রথমযুগের গানে নানা শাস্ত্রীয়গানের উৎস থেকে আহরণ করা অমিশ্রিত সুরপ্রয়োগ পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাগের মিশেলে সম্পূর্ণ নতুনধরনের সুরব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলো। প্রমথনাথ বিশী যেরকম বলেছিলেন, ''প্রথমবয়সের গানের মুখ বিরহমিলনপূর্ণ খণ্ডক্ষুদ্র সংসারের দিকে, শেষ বয়সের গানের মুখ বিরহ-মিলনাতীত অখন্ড সৌন্দর্যলোকের দিকে; মধ্য বয়সের গানে, অল্প কিছুদিনের জন্য এই দুই স্বতোবিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধনের সুর।'' 


এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব বলেছেন, '' মধ্যজীবনে দেখি ছন্দপ্রধান গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি ও আগের অনুপাতে ঢিমে লয়ের গানের সংখ্যা অনেক কম''। কবি নিজে ইন্দিরা দেবীকে বলতেন, ''আগেকার গান গুলি ইমোশনাল , এখনকার গুলি এসথেটিক''। আবার কবি নিজে বলছেন, ''।।। প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য''। এই 'রূপ' দেওয়া প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন যে গানটির, '' কেন বাজাও কাঁকন কনকন'', সেটি কিন্তু তাঁর মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের রচনা। তাই তাঁর নিজের মতে গান বিষয়ে 'পরিণত বয়স' এসে গেছে আরো আগেই । 


আবার ধূর্জটিপ্রসাদ ব্যাপারটিকে দেখছেন সম্পূর্ণ অন্য স্তর থেকে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করছেন সুর যোজনার লক্ষণ থেকে। তিনি লিখেছিলেন, '' ... রাধিকাবাবুর মুখে ভালো ধ্রুপদ শুনে হিন্দুস্তানি কথার বদলে বাংলা কথা বসানো-ই তাঁর কাজ, যেমন- 'সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি', 'মন্দিরে মম কে'; এই সব গান হিন্দুস্তানি সুরের তর্জমা। দ্বিতীয় যুগে তিনি কথায় ভালো ভালো সুর বসাচ্ছেন, যেমন-'ঝরঝর বরিষে বারিধারা, 'রিমঝিম ঘন ঘন রে' প্রভৃতি গান । তৃতীয় যুগে তিনি সঙ্গীত রচনা করলেন -বাহারের সঙ্গে মল্লার মিশল, ভৈরবীর সঙ্গে মিশল খাম্বাজ, বেহাগের সঙ্গে কেদারা।'' এই মূল্যায়ণটি আজকের দিনে শ্রোতারা হয়তো সঠিক মনে নাও করতে পারেন, কিন্তু যাঁরা কালোয়াতি গানের সমঝদার, তাঁদের বিচারে এই রকম একটা পর্ববিভাগ সমুচিত মনে হওয়াটা অসম্ভব নয়। 

আমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় লঘুমেজাজে বলতুম মহর্ষির পাঁচশো টাকা পুরস্কারের মোহ কবিকে নোবেল পাওয়া পর্যন্ত ‘রবিবাবু’ করে রেখে দিয়েছিলো। যখনই আমাদের কেউ ঐ সব পর্যায়ের গান গাইতে বলতেন, আমরা হয়তো ঈষৎ আড়ষ্টবোধ করতুম, স্বতোচ্ছাস গায়ন হয়ে উঠতো না। এ বিষয়ে সম্প্রতি একজন পরিণতমনস্ক গায়কের সঙ্গে আলাপসূত্রে সেই কথাই হচ্ছিলো। তাঁকে দীর্ঘকাল ধরে সনিষ্ঠভাবে পূজা পর্যায়ের ঐ সব গান পরিবেশন করতে শুনেছি, কিন্তু তিনিও এখন জানালেন ঐসব গানে তিনি ঠিক স্ফূর্তি পাননা। এর একটাই কারণ , আমাদের মনে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র শ্রেষ্ঠতর কাজগুলির ছাপ এতোটা প্রবল, যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর কাজগুলির প্রতি তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া বিশেষ আগ্রহ আর উৎসাহ বোধ হয়না। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়ভেদ বিষয়ে এত বিশদ চর্চা এই জন্য প্রয়োজন, যে আমাদের সময়ে যেসব শিল্পী রবিবাবুর গানকে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' করে তুলেছিলেন, তাঁদের পরিবেশনায় এই গুণগত পর্যায়বাচী সৃষ্টির ধারা বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার যে সমস্ত ঘরানাগুলি রয়েছে তার মধ্যে মুখ্য উৎস জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতন। ইন্দিরা দেবী বলেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক ঘরানা মুখ্যত ব্রাহ্মসমাজমুখী, যেখানে কাঙালিচরণ সেন, প্রতিভাদেবী, সরলাদেবী ও তিনি নিজে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতন সঙ্গীতঘরানার মুখ্য ব্যক্তি দিনু ঠাকুর ও সঙ্গে অনাদি দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন ও শান্তিদেব। এই দুই ঘরানার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার বিবিধ অঙ্গ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক চলতো। বিশেষত দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরাদেবীর মধ্যে। দিনু ঠাকুর যে গায়নশৈলির প্রচারক ছিলেন সে প্রসঙ্গে ইন্দিরাদেবীর কিছু ভিন্নমত ছিলো। 

আপাতভাবে মনে হতে পারে ইন্দিরাদেবী হয়তো একটু 'রক্ষণশীল', কিন্তু তিনি যখন লেখেন, "..... স্বরশুদ্ধি এক জিনিস, সুরসিদ্ধি বা রসসিদ্ধি আর। সেই রসপূর্ণ গায়কীতে উত্তীর্ণ হওয়াই গায়কের লক্ষ্য ; এবং সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধ করবার জন্য সদগুরুর দ্বারস্থ হওয়া চাই, নিজ সাধনা দ্বারা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা চাই।'' ইন্দিরা দেবীর দীক্ষিত বিখ্যাততম শিল্পী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথাগত 'গুরু' বলতে তিনি সংক্ষিপ্তকালের জন্য হলেও শুধু ইন্দিরাদেবীরই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার আগে তাঁর চর্চা তো সীমিত ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের সমবেত স্বরের একটি স্বর হিসেবে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'রক্ষণশীলতা'র মিথটি মনে হতে পরে কিছু কায়েমি স্বার্থান্বেষীর গড়ে তোলা ব্যাপার। যদি ইন্দিরা দেবীর মতো 'রক্ষণশীল' গুরুর শিক্ষা শ্রোতাদের জন্য একজন দেবব্রত বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে, তবে এই রটনাটিকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ভেবে বর্জন করাই শ্রেয়। এই ভ্রান্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আরো একটি প্রমাণ, স্বত্ববিলোপের এতোদিন পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূলস্রোতটিতে এখনও সৎ শিল্পী ও শ্রোতাদেরই স্বরাজ চোখে পড়ে। 


0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড
শিবাংশু দে

জোড়াসাঁকো জংশন থেকে যখন গাড়িটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলো তখন কি মায়া কেটে গিয়েছিলো তার? দক্ষিণের বারান্দার মৃদু বসন্ত বাতাস অথবা জ্যোতিদাদার ছাতবাগানের জুঁইফুল ভাসাভাসি সন্ধের বিলোল আমেজ কি ছেড়ে গিয়েছিলো তা'কে? অনেক দীর্ঘ পথ অপেক্ষা করে আছে, এমন কোনও প্রতীতি হয়েছিলো কি? জোড়াসাঁকো থেকে জালিয়াঁওয়ালা বাগ, সুরুলকুঠি থেকে সুইডিশ আকাদেমি, শিলাইদহ থেকে সান ইসিদ্রো...

ক্লান্তিহীন যাত্রাপথের গান, শুধু কি আনন্দে? নাহ, মানুষের যাবতীয় ভাবনার শ্রমসংহিতা, সবাইকে জায়গা করে দেওয়ার অলিখিত ঈশ্বরী দায় , একলা ইঞ্জিনের পিছনে অন্তহীন সারিবাঁধা কামরার ঝমঝম সিম্ফনি .... রবীন্দ্রসঙ্গীত ....


'... মীড়গুলি তার, মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন'

'বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়টি এই মুহূর্তে বুদ্ধির কাছে এত বহুকথিত, আবেগ বা নিরাবেগ কলুষিত প্রদূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রসিকজন হয়তো এই নিয়ে কিছু পড়ার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনতেও অধিক আকৃষ্ট হবেন। সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন'এর আরও 'কাছাকাছি' আনার জন্য এক যোগে যে ধরনের এলিট ও সাব অল্টার্ন রুদ্ধশ্বাস প্রয়াস চলেছে, তাতে 'সঙ্গীতসরস্বতী'র (খুব ক্লিশে শব্দ হয়তো, তবু বিকল্প না থাকায় ব্যবহার করলুম) অবস্থা কুরুরাজসভায় পাঞ্চালী প্রতিম এবং এক্ষেত্রে বাসুদেব যেহেতু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাই এখনও পর্যন্ত কোনও মতে লজ্জারক্ষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, আগে কহো আর।



নিধুবাবু, রাম বসু, দাশরথি রায়, রামমোহন, ব্রাহ্মসঙ্গীত থেকে জোড়াসাঁকো। দেড়শো বছর আগেই তা বাঙালিদের জন্য বেশ বড়ো কালচারাল শক ছিলো। তার মধ্যে ১৮৭৭ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এক রবীন্দ্রনাথ এবং তার পর আরেক বা অনেক রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির রসবোধ ও সাংস্কৃতিক রুচি যে গতিতে এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সর্বদা তার থেকে অনেক অধিক বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই গরমিলের কারণে দু'টি প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রকট। রসগ্রাহীদের মধ্যে এই সূত্রেই স্পষ্ট দু'টি ভার্টিক্যাল প্রথম থেকেই তৈরি হয়ে গেছে। একদল প্রহ্লাদ, যারা পূজা করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে, অপর দল ধরে আছে হিরণ্যকশিপুর টোটেম। তারা চিরকাল বিরোধিতা করে, বিরূপ থেকে, অনীহা দেখিয়ে, নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধির নিরিখে নানা কটূক্তি করে, রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছে। ঘটনা হচ্ছে এই যে পছন্দ করুক বা নাই করুক, কোনও বাঙালিই রবীন্দ্রনাথ বা সমার্থে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন' থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানে রাজি নয়। বাঙলির নানা স্ববিরোধী অবস্থানের মধ্যে এটিও একটি। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজনীতি বাঙালির নিত্যদিনের সড়ক রাজনীতির মতো-ই ধূসর, ধূমিল ও পরিণতিহীন।

অধরামাধুরী ধরেছি.....

-----------------------------

রাজনীতিসহিত বা রাজনীতিরহিত, যেকোনও অবস্থাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গত অন্ততঃ অর্ধশতক ধরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এই সংযোগটা খুব সহজে হয়নি। নানা ধরণের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী টানাপড়েন এর মধ্যে কাজ করেছে। 'বাঙালি রুচিবোধ' নামক একটি ধারণার প্রতি মোটামুটি সব বাঙালিই বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। এটি প্রকৃত না অলীক, তা নিয়ে তর্ক করবো না। তবু এর কিছু স্বীকৃত লক্ষণ আছে। তার মধ্যে একটি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি আনুগত্য। এই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গরিষ্ঠ শতাংশ বাঙালির কাছে গানের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অন্যধারাগুলির প্রতি সংখ্যাগুরু বাঙালির আগ্রহ বিষয়ে সন্দিহান হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, যা আজ উভয়পারের বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্রোত, উত্তর কপিরাইটযুগে তার রূপরেখা কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অথচ, রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি অতীব নথিবদ্ধ গীতধারা। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিন্যাসের সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। 'নতুন' কিছু করো'র উন্মাদনায় তার মূল চারিত্র্য'কে সওদাগরের নিলামে চড়ানোটাকে সঙ্গতভাবেই 'যথেচ্ছাচার' আখ্যা দেওয়া যায়। যে 'রুচিবোধ' নিয়ে বাঙালির বেশ একটু অহমভাব রয়েছে, তার অনেকটা জুড়েই তার সঙ্গীতরুচির ব্যাখ্যান চলে। তারও সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ন্যায্য অনুরাগ অতি প্রকট। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে দেখছি রবীন্দ্রসঙ্গীত'কে গায়ন ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের স্থূল, শিল্পবোধরহিত পরীক্ষার শিকার হতে হচ্ছে। আগের প্রজন্মের শ্রোতারা, যাঁদের সঙ্গীতরুচি পরিণতিলাভ করে গেছে, তাঁদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহী শ্রোতারা, যাঁরা নিজেদের জেন-এক্স বলে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কাছে গত এক শতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশন শিল্পটি কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তার একটি খতিয়ান প্রস্তুত করার ইচ্ছে হ'লো। ইতিহাসটি জেনে নিয়ে তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতরুচি তৈরি করুন, সেটাই ঈপ্সিত উদ্দেশ্য। বিষয়টি বিস্তৃত এবং নিজের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমি অবহিত। তবু মোটামুটিভাবে একটি সামগ্রিক আলোচনা করার প্রয়াস করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার নিরীক্ষাটি এপার বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওপার বাংলায় এই বিষয়ে যে সমৃদ্ধধারাটি রয়েছে, ব্যক্তি আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবার সঙ্গতি অর্জন করতে পারিনি।

----------------------------------------

যেকোন শিল্পসৃষ্টি অনুধাবন বা উপভোগ করতে গেলে কিছু মৌল প্রস্তুতি লাগে। শিল্পটি যদি সঙ্গীত হয়, তবে আগে গান 'শুনতে' শেখার অভ্যেস করতে হয়। তাই প্রথমে আমাদের গান শোনার অভ্যেস বিষয়ে দুটো কথা বলে নিই। উত্তর ভারতে যে শাস্ত্রীয় গান আমরা শুনে থাকি সেখানে কোনও একটি সুর, যাকে স্ট্রাকচারড ভাবে 'রাগ' বলা হয়, তার শুধু কংকালটুকুই নথিবদ্ধ থাকে। আরোহ ও অবরোহ। এর পর শিল্পীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় ঐ কংকালের উপর রক্ত মাংস মেদ ত্বক আরোপ করে একটি রাগের শরীরী ও আত্মিক সত্বাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তারও অনেক প্রথাবদ্ধ নিয়ম আছে, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা স্বরলিপির সংস্থান নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সুরস্রষ্টার তৈরি করা স্বরলিপির বাইরে একবিন্দু সরে যাবার অধিকার পরিবেশক শিল্পীর থাকেনা। এ নিয়ে 'স্নেহের মন্টু', ধূর্জটি ও 'গুরুদেবে'র অসংখ্য বোধ, যুক্তি ও আলোচনার কথা সবাই জানেন।

তা মন্টুর নাম যখন এসেই গেল, তখন বলি তাঁর গান কীভাবে গাইতে হবে সে নিয়ে কবিকে প্রথম সিরিয়স চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুত্রবৎ এই মানুষটি। আসলে কবির গান শুধুমাত্র খণ্ডসুরের নির্মিতি নয়। যে গানটি আমাদের কাছে আসে তা বস্তুত একটি দীর্ঘ অন্তর্লীন প্রস্তুতির গভীর থেকে উঠে আসা সুন্দরের ছায়ামাত্র। সুন্দর নিজে ন'ন। দারুব্রহ্ম জগন্নাথের মূর্তি যেন । অন্তস্থ 'ব্রহ্ম' রয়েছেন সুদূর গভীর কন্দরে। এই গানকে ধরতে চাইলে সুন্দরকে চিনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

দিলীপকুমারের এক 'বিশেষ ভক্তিভাজন' শুভার্থী একবার তাঁকে বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্টতা করছ হে, ঘা খাবে। উনি প্রতিভাধর, কিন্তু স্নেহশীল নন। উনি স্নেহ করেন বুদ্ধি থেকে, হৃদয় থেকে নয়- একথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।" পরে আরও কেউ কেউ দিলীপকুমারকে একই কথা বলেছিলেন। দিলীপকুমার প্রতিবাদ করেছিলেন এই ধারণার। তর্ক করেছিলেন প্রথম বয়সে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহশীলতা, হৃদয়বত্তা, ভালোবাসার ক্ষমতার অসংখ্য পরিচয় তিনি পেয়েছেন আকৈশোর। কবির নিজের ভাষায় "আদর করিতে জানা, অনাদৃতজনে", তার পরিচয় পেয়েছেন তিনি নিজে ছাড়াও অযুত মানুষ। কিন্তু যাঁরা অন্যরকম ভাবতেন, তাঁরাও কেউ 'নির্বোধ' ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ভিতর কবির অন্তর্লীন সুন্দরকে চিনে ওঠার এলেমটি ছিলনা। তাঁর ব্যক্তি পরিচয়ের মতো, তাঁর সঙ্গীতের পরিচয় পেতে গেলেও প্রস্তুতি লাগে। 

দিলীপকুমার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "...আমার মতন সামান্যের এজাহারের মূল্য যে আমাকে তিনি গভীরভাবে স্নেহ করেছিলেন বলেই আমাকে বারবার ক্ষমা করেছিলেন-আমি ঝোঁকের মাথায় তাঁকে বারবার আঘাত করা সত্ত্বেও। আজ একথা ভাবতে আমার অনুশোচনার অবধি থাকেনা।" এই 'বারবার আঘাত'টি কী ছিল? দিলীপকুমারের ভাষায়, "...বাংলা গানে সুরবিহার- অর্থাৎ তান বিস্তারের স্বাধীনতার পথ খোলা রাখা দরকার। কিন্তু এখানেও আমার কাঁচা বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ধোপে টিকবে কিনা এ-জিজ্ঞাসা আমার মনে ওঠা উচিত ছিল নিশ্চয়ই। মনে মনে আরও গভীরভাবে সচেতন হয়ে ওঠা উচিত ছিল বই কী যে, তিনি তাঁর সঙ্গে সমানে তর্কাতর্কি করার অধিকার দিলেও আমার পক্ষে সে-অধিকারে উল্লসিত হয়ে ওঠা স্পর্ধারই সগোত্র।" এই সময়ে দিলীপকুমার ছিলেন একজন 'যৌবনমদান্ধ' যুবক (১৯২৩)। তার পরেও একবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আলিপুরের বাড়িতে দিলীপকুমার কবির সঙ্গে তুমুল তর্কে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার সখ্যের অধিকারে দিলীপকুমারকে 'খুব ধমকে' দেন। দিলীপকুমার কবির কাছে যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন তখন কবি তাঁকে লেখেন, তিনি (কবি) দিলীপকুমারকে 'অন্তরের সঙ্গে স্নেহ' করেন, কারণ তাঁর (দিলীপকুমার) মধ্যে তিনি 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' দেখেছেন। চাবিকাঠিটি ঠিক এখানেই আছে। রবীন্দ্রনাথকে পেতে গেলে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' অর্জন করতে হবে। তাঁর সঙ্গীত কীভাবে গাইতে বা শুনতে হবে তার সূত্রটিও এখানেই। ঐ বোধটির মধ্যেই আছে। দিলীপকুমারের সুরবিহারের জেদ কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ট সাহানা দেবীর এই গানটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, শুনলেই বোঝা যাবে। যদিও রবীন্দ্রসান্নিধ্যের সাহানা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদিতম রূপকারদের একজন। কিন্তু দৈলীপী প্রভাবে কীভাবে তাঁর গায়নের ধরনটি বদলে গিয়েছিল তা এই গানটিতে লক্ষিত হয়। পরিণতবোধের দিলীপকুমার অবশ্য এই অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন। 


সঙ্গীত উপভোগ করার নানা মার্গ আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে আবেগমুখী ও সন্ধানমুখী। একটু সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলি, প্রথমটি আমাদের ধরন, দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্য ধরন।

আমাদের সঙ্গীত চর্চা ও উপভোগ করার ব্যাকরণ যেহেতু ইম্প্রোভাইজ করার কৌশলকেই অনেক বেশি মূল্য দেয়, তাই আমাদের সন্ধানমুখী সাঙ্গীতিক প্রবণতা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। স্বরলিপির মাধ্যমে সুরের কাঠামো ধরে রাখার কায়দাটি য়ুরোপীয়রাই আমাদের দিয়েছে। পণ্ডিত ভাতখণ্ডে যখন সুরসংস্থানের বিচারে হিন্দুস্তানি রাগরাগিনীর বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁকে প্রভূত বিরোধের সম্মুখীন হতে হয়ে ছিলো।

সুরকে নির্দিষ্ট খাঁচায় বেঁধে রেখে সঙ্গীত চিন্তা ও পরিবেশন আমরা ভিতর থেকে এখনও খুব একটা মেনে নিতে পারিনা। বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ থাকে, স্বরলিপির বাঁধনে গানের আবেগ উচিত মাহাত্ম্যে প্রকাশ করা যায়না।

আমরা সতত মনে রাখি, যে কবি লেখেন ' বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে' বা 'তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে, পথ দিয়ে তুই আসিসনি যে, ফিরে যারে', তাঁকে এই বাঁধনে বদ্ধ করার চেষ্টা অনুচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা ভালোবেসে শোনেন, তাঁদের অনেকেরই মত, স্বরলিপি থেকে ঈষৎ বিচ্যুতি থেকে যদি গানের স্পিরিটকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, তবে তাই হওয়া উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি সহমত। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে আমার অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার মতো 'যুক্তি' আমার কাছে থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গান বহিরঙ্গে যতটা সরল, প্রকৃতপক্ষে তা নয়।

রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রধান বঙ্গীয় সুরস্রষ্টা যিনি এই স্বরলিপির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে তাকে কার্যান্বিত করেন। মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর সম্যক ধারণা ছিলো তাঁর গানের প্রকৃত স্বরলিপি তৈরি না করে গেলে তাঁর আপাত সরল সৃষ্টিসকল একদিন শিকড়হীন লোকরুচি ও লোকমতের বেনোজলে মাহাত্ম্য হারাতে পারে। এর সঙ্গে তিনি বিশেষ সচেতনও ছিলেন যে তাঁর গানকে এই য়ুরোপীয় পদ্ধতির ধরাবাঁধার মধ্যে চেপে রাখলে তার প্রাসঙ্গিকতা ও লোকপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। তাই জীবৎকালে তিনি কাউকে কাউকে তাঁর গানে 'স্টিমরোলার' চালানোর অধিকারও দিয়েছিলেন। তবে এই অধিকার নেহাতই ব্যক্তিস্তরের, তার সামূহিক কোনও প্রয়োগ তিনি স্বীকার করেননি।

স্বরলিপির প্রয়োগ একটি ডিসিপ্লিনের অঙ্গ, যা মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে চলে। তাকে কোনও ‘এসমা’দিয়ে মানাতে হয়না। যাঁরা অধিকারী, তাঁরা স্বরলিপির 'বন্ধন'এর মধ্যে পূর্ণত থেকেও অতি উপভোগ্য সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন। তবে অধিকারীর পাত্রভেদ আছে। যে সব শিল্পীর সঙ্গীতের এই ধারাটিতে সিদ্ধিলাভ হয়েছে তাঁরাই অধিকারী। এই সিদ্ধিলাভের তকমা কোনও কলেজে কিনতে পাওয়া যায়না। দীর্ঘসময়ের নিবিষ্ট সাধনা ও অনুশীলন ও তার সঙ্গে অন্তর্লীন সঙ্গীত চেতনার মেলবন্ধন যখন সংবেদনশীল শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায় তখন এই স্বীকৃতি আপনিই আসে। যাঁদের নামে মাঝে মাঝে 'সুরচ্যুতি' বা বাঁধাপথের বাইরে' গিয়ে গান শোনানোর অভিযোগ ওঠে, সেই সুচিত্রা মিত্র বা জর্জ বিশ্বাস সিদ্ধির সেই স্তরে পৌঁছে গেছিলেন, যেখানে তাঁদের কাছে সেই সব 'বিচ্যুতি'র জন্য কৈফিয়ৎ চাওয়াটা বাতুলতা। কারণ তাঁরা নিজস্ব পরিবেশনায় 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য'কে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সব বাঁধাবাঁধি আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যমেধার মানুষের জন্যই থাক। আমরা সেই সুধাসাগরের পারে বসে থাকার লোক, ডুব দেবার সামর্থ্য অর্জন করা হয়ে ওঠেনি।

(ক্রমশ)