0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in



































এক সম্রাট মাটির তলায় ঘুমিয়ে ছিলেন অনেক শতাব্দী জুড়ে। তাঁর সময়ে তিনি বিতর্কিত। মৃত্যুর বহু বছর পর আবার তাঁর রাজত্বে ঘটে যাওয়া কর্মকাণ্ড আতশকাচের তলায়।

এই ঘটনাক্রম আমাদের খুব চেনা। এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঘটনাবলী এই উপমহাদেশের বাসিন্দাদের প্রজন্মসঙ্গী। পরাধীনত্বের তকমা ঘুচিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের 'সফল' প্রয়োগ জন্ম দিয়েছিল দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের। সেই বিষবৃক্ষটি রোপণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই ছিলেন স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সেনানী।

'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।' স্বাধীনতার প্রায় আশি বছর অতিক্রান্ত। এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি সেই কাঙ্খিত পরিণতিবোধ, যা আমাদের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের দিকে অনেকটাই এগিয়ে দিতে পারত। কোনও একটি চলচ্চিত্র বা সাহিত্যকর্ম এখনও আমাদের আবেগকে এতটাই বিপথগামী করতে পারে, যার মূল্য দিতে হয় আমজনতাকে। এমন উদাহরণ ভুরিভুরি।

সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবির কিছু দৃশ্য হঠাৎই যেন ঘুমন্ত বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগ করল। অশান্তির আঁচ লাগল এমন অনেক মানুষের গায়ে, ইতিহাসের ওই পর্বের সঙ্গে সুদূরতম যোগাযোগও যাঁদের নেই। যাঁরা সঠিকভাবে জানেনও না ঠিক কী ঘটেছিল। আর যাঁরা আগুন লাগালেন তাঁরা? তাঁরা ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি সম্পর্কে কতটা অবগত আছেন? পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের দূরভিসন্ধি থেকে যে মন্তব্যগুলি করছেন, সেগুলি আরও কতবড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা কি মুহূর্তের জন্যও ভেবে দেখেছেন? তাঁরা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে 'ইতিহাস' শব্দটির সত্যতা নিহিত আছে এটির অপরিবর্তনশীল রূপের মধ্যেই। ভালো বা মন্দ, সেটি যেমন, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করতে হয়। যা প্রকৃত শিক্ষা আর পরিণতিবোধের পরিচায়ক।

সুস্থ থাকুন। সতর্ক থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








আকাশে সেদিন জল টসটস মেঘ। সরোবরের জল মেঘের ছায়ায় গভীর কালো। পদ্মবনে নীল আলো ফেলে ভোর আসছে। মহাদেব ডুব দিলেন। পরপর তিনটি। ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রথম অঞ্জলিটি ঢেলে দিলেন জলে। মেঘমন্দ্র স্বরে গুড়গুড় গমগম করে উঠল চারপাশ। আকাশে কড়াৎ কড় বাজ, রুদ্রবীণায় বেজে উঠল ভৈরবী সুর। তাঁর মেঘের মত জটায় উথালপাথাল পদ্মবন, দিশেহারা ভ্রমরের দল। চুলে লেগে রইল কয়েকটি বৃন্তচ্যুত পদ্মকলি। মহাদেব ফুলগুলি নিয়ে এলেন দেবী পার্বতীর পুজোঘরে। দেবী তখন ধ্যানমগ্না। হেমবর্ণ আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। কপালে জ্বল জ্বল করছে কুমকুমের ফোঁটা। ভোর হচ্ছে চরাচর জুড়ে। দেবী ফুলের সাজিটি টেনে নিলেন। উঠে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। কে তুমি!

"মনসা, শঙ্কর নন্দিনী।"

বিষে ভরে গেল আকাশ পাতাল।ঝিকিয়ে উঠল কাল নাগিনীর ফণা। দেবীর মনের বিষে অধিষ্ঠান হল বিষের দেবী, সাপের দেবী মনসার।

মনসা জন্মের এ গল্প বিহারের। এই গল্পই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাঙালির মনসামঙ্গলে। কিন্তু এমন এক সর্পদেবীর জন্ম নিছক মহাদেবের ফুলের সাজিতে হয়না। দেবী জন্মাতে থাকেন মনে মনে, তলে তলে। হাজার হাজার বছরের মানুষী স্রোতের গভীরে। মনসার উৎস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয় সময়ের পথে হাজার হাজার মাইল। পৃথিবীর তখন সদ্য কৈশোর। মানুষের দল চলে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে । "আ কন্টিনিউয়াস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রেসেস" তখন জল জমিনের খোঁজে। আদি অস্ট্রালয়েড, অ্যালপো দিনারীয়, নর্ডিক কত না গোষ্ঠী, দলকে দল ছড়িয়ে পড়েছে পারস্য,ইরান, ইউরোপ, এশিয়ার মাঠে মাঠে।

কত তো মানুষ এসেছে গেছে, ধুলোর পায়ে পায়ে...

ভারতবর্ষে আর্যরা এসেছিল আলাদা আলাদা দুটি বড় দলে বেশ কিছু সময়ের আগে পরে। তারও অনেক আগে এসে গেছে তুরানি মানুষ। তুরানি মানুষ ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতেই। সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের জীবন , যাপন। মিশে গেছে সে দেশের ছায়ায় মায়ায়।

ঐতিহাসিক ফার্গুসন বলছেন পৃথিবীজোড়া সর্পপূজার চল হয়েছে তুরানিদের থেকেই। যেখানে যেখানে তারা পা রেখেছে সেইসব দেশেই পাওয়া গেছে জ্যান্ত সাপের পুজো করার রীতি। সেই কবে টোটেম জমানা থেকেই পশু পুজোর চল মানুষের পাড়ায় পাড়ায়। কুমির, বাঁদর, হাতি, কচ্ছপ, ভাল্লুক, বাঘ আরও কত কী । কিন্তু সাপ? দেশে দেশে সাপ ছিল শয়তানের ভূমিকায়। শয়তান থেকে দেবত্বে উঠে আসার এই রাস্তাটা সহজ ছিল খুব?

বেদে বা বেদের পরে মহাভারত কিম্বা প্রথমদিকের পুরাণগুলোতে কোথাও সর্পপূজার কথা নেই। তারও পরে বিভিন্ন উপপুরাণ , দেবী ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ইত্যাদিতে সাপের দেবী হিসেবে মনসার নাম পাওয়া যায়। জায়গায় জায়গায় সাপের ঘর। গুহার ভেতর দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে কারা? কাদের ঘরে ঘরে বিষের আড়ৎ? খুঁজতে খুঁজতে পায়ে পায়ে চষে ফেলতে হয় দীনদুনিয়ার আদাড়বাদাড়–ব্যাবিলন থেকে রোম, ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাবিলনীয়,আসিরিয়, সুমেরীয়দের ঘরে ঘরে সাপের বেদী। বেদীতে নাগ দেবতার চাষ। মিশরের স্থাপত্যে সাপ ছিল বড় পবিত্র । মনে পড়ে সেই আলেকজান্ডারের কথা? তার বাবা ফিলিপ নিজে রাজ্যে বলে বেড়ালেন আলেকজান্ডারের বাবা নাকি কোন এক সাপ।

যেদিন খান্ডব বন পুড়িয়ে বনভোজন করছিলেন কৃষ্ণ,অর্জুন সেদিন সেই দাউদাউ বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তক্ষক নাগ–জোড়হাত, নত মস্তক। আগুনে না পুড়িয়ে তাকে সপরিবার বন ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিল কৃষ্ণ। চিরঋণী হয়ে রইল নাগ। যেদিন মহাভারত লেখা হচ্ছিল সেদিন নাগ শব্দের ব্যবহার সাপ অর্থে করা হতনা। নাগ ছিল সম্ভবতঃ সাপ টোটেমের এক উপজাতি। কশ্যপ মুনির স্ত্রী কদ্রু নাগদের আদিমাতা। বাসুকি, অনন্ত, শেষ নানান বিখ্যাত নাগের দলে মেয়েটি অজ্ঞাতনামা, জরৎকারু। জরৎকারুর বিয়ে হয়ে গেল জরৎকারু মুনির সাথে, কুটির আলো করে সন্তান জন্ম হল। আস্তিক। এতদিনে একটা বলার মতো পরিচয় পেল মেয়েটি "আস্তিকস্য মুনির্মতা"! কিন্তু তারপর? তারপর মেয়েটি হারিয়ে গেল অন্ধকারে। স্বামী পরিত্যক্তা, ভাই বাসুকির সাম্রাজ্যে মেয়েটি বেঁচে রইল নামহীন খ্যাতিহীন অস্তিত্বের মতো।

খান্ডব বন থেকে বেঁচে ফেরা তক্ষক নাগের রাজ্য দেখতে দেখতে তক্ষশিলা। আবারও ফার্গুসন বললেন, এই তক্ষশীলা আদতে এক নাগরাজ্য। তথাগত বুদ্ধ তখন ছড়িয়ে যাচ্ছেন জলে। পাহাড় ছাড়িয়ে, গিরিপথ পেরিয়ে দূরে, আরো দূরে। বোধিবৃক্ষের বেদীটিতে তখন পুণ্য আয়োজন। সাঁচি আর অমরাবতীর স্তূপের গায়ে গায়ে সেইসব বৃক্ষপূজা, চক্রপূজার স্মৃতি। পাঁচমাথাওয়ালা নাগের ছবি ফিরে এসেছে বারে বারে। হিন্দু পুরুষ, নারী ছাড়াও যাদের পোশাকআশাক খানিক আলাদা, যারা চেহারায় ঠিক আর্যসুলভ নয়, বরং তারও আগের সময়ের লোকজনের মতো তাদের ফার্গুসন বললেন তক্ষক কিম্বা দস্যু। তারা থাকে অরণ্যের আড়ালে, গাছের ছায়ায়। শহর থেকে দূরে তাদের ঘর। ঘরের ভেতর সাপের ঝাঁপি, সদর দুয়ারে আগুন মশাল। দেশের রাজা যায় দস্যু সন্দর্শনে ।

আগুন আর সাপের উপাসনা আসলেই সূর্য উপাসনার প্রতীক কিনা সে কথা বলবেন পণ্ডিত। কিন্তু ঋকবেদে দশম মণ্ডলের সর্পরাজ্ঞী সূক্তে বাক বিজ্ঞানের আলোচনায়, এবং তৃতীয় মণ্ডলের ঋষি বিশ্বামিত্র সূর্যরশ্মির ভেতরের কাঁপনের প্রকৃতিকে নাম দিয়েছেন "সসর্পরী বাক" ।

বাক সেই শুদ্ধতম প্রকাশের একক যার আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক আত্মা । আর সাপের কামড়ে চিকিৎসা এমন এক বিদ্যা যার নামে অথর্ব বেদে আলাদা এক শাখাই তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেইসব প্রাচীন দিনে যখন ঠান্ডা দেশের মানুষ আর্যরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে ভারতের উষ্ণ জলবায়ু আর সাপের বিভিন্ন প্রজাতির সাথে, ততই সাপ হয়ে উঠছে এক ভয়ানক অস্তিত্ব। মহাভারতে ঘৃতাচি নামের শূদ্র মেয়েটি ছিল সর্পবেদে বিশারদ। এই ঘৃতাচীই মনসার প্রথম প্রতিচ্ছবি। বাগদেবী সরস্বতীর হাতে প্রথমদিকে ছিল বীণা আর সাপ। আভিজাত আর্যরা পরে অনার্যদের সাপকে সরিয়ে বেদ দিয়েছে সরস্বতীর হাতে। সেকালে বেদ বিশারদ হতে হলে সর্পবেদের জ্ঞান থাকা ছিল প্রথম শর্ত।

গাঙ্গুরের জলে কলার মান্দাস ভাসাল যে একলা মেয়েটি,ভেসে গেল ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশ সেই কি কবির হৃদয়ে গান হয়ে উঠল না কি সেই মানুষটি যে শত বিপণ্নতার প্রেক্ষাপটেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল সে হঠাৎ অন্ধকার ঠেলে সব মানুষের হয়ে গান গেয়ে উঠল?

কাব্য আসলে হাঁটাপথ বেয়ে জীবনেরই কথা বলে। বাংলার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার একেবারে প্রথম ধাপটিতেই লেখা মঙ্গলকাব্য-কথা। এ সেই সেদিনের কথা যেদিন জলাজঙ্গলে ঢাকা বাংলার কালো মানুষগুলো আর্য-ভারতের কাছে ব্রাত্য ছিল,জীবন বয়ে যেত তিরতিরে স্রোতে নিজস্ব ধারায়,মানুষ বাঁচত মাটির ছন্দে।

আবহাওয়ার নিয়মেই এ জায়গা সাপের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সেই কোন আদিম সময় থেকে অরণ্যচারী মানুষ ভয় পেতে শিখেছে এই সরীসৃপটিকে,ধীরে ধীরে তার উপরই আরোপ করেছে দেবত্ব, পুজো করেছে,দয়া প্রার্থনা করেছে।

মনসা,বাংলার সর্পদেবী। ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে এই দেবীর যাত্রাপথ খুঁজবো আমরা।

সেই কোন ভুলে যাওয়া অতীতে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে থাকত তুরানী উপজাতি,তারা ছিল সর্প উপাসক। একসময় তারা এদেশের পশ্চিমসীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সিন্ধুনদের তীরে,ঘর বানাল,চাষ করল সঙ্গে আনল তাদের উপাস্যকেও। এরাই দ্রাবিড়দের আদিপুরুষ। সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা আর মহেঞ্জদরোতে এদেরই সর্প দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে। এখনো বালুচিস্তানে ব্রুহাই ভাষী দ্রাবিড়রা রয়েছে। ভারত ছাড়া আরো যে যে দেশে তারা গেছে যেমন গ্রিস স্ক্যান্ডানেভিয়া ইত্যাদি জায়গাতেও সর্পপূজার প্রথা এরাই বয়ে নিয়ে গেছে।

এই তুরানী দ্রাবিড়রাই পরে আর্যদের কাছে হেরে গিয়ে সরে যায় দাক্ষিণাত্যের দিকে। বাকিরা চলে যায় পূর্বদিকে আসাম ,ত্রিপুরা,বাংলায়।সেখানে কখনো অস্ট্রালয়েড কখনো বা মোঙ্গলদের সাথে মিশে তৈরি হতে থাকে এক মিশ্র জাতির।

আজকের মনসা আসলে দ্রাবিড় বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণ্য তিন ধারার মিশেলে পাওয়া এক দেবী। বৌদ্ধ মহাযানদের তন্ত্রমতে জাঙ্গুলি নামে এক দেবী পাওয়া যায়। তিনি শুক্লবর্ণ,শুক্ল অলঙ্কার শোভিতা,বীণাবাদিনী,কোথাও বা ময়ূরপালক হাতে লেখনীর প্রতীক হিসেবে। সেই হিসাবে সরস্বতীর সাথে মিল প্রচুর। এঁরই একহাতে সাপ।

যজুর্বেদে সঙ্গীতের মতো সর্পবিদ্যারও কথা বলা আছে। আবার সরস্বতীকে বলা হয়েছে বিষনাশিনীও। অথর্ববেদে সর্পবেদ আর সর্পবিদ্যা নামে দুই শাস্ত্রের কথাও আছে। তাহলে বলাই যায় এই জাঙ্গুলিতারা আর সরস্বতী প্রায় একই।

আর্য সমাজে স্ত্রীদেবতার পুজোর চল ছিলনা। কিন্তু চন্ডী, কালি ইত্যাদি লৌকিক দেবীর মত মনসারও পৌরাণিক পরিচিতি পাবার কারণ মনে হয় এ দেশের প্রবল সংস্কারের প্রভাব,সাথে সর্পভীতি। শীতের দেশে সাপের উপস্থিতি কম,তুলনায় ভারতের উষ্ণ ভেজা আবহাওয়া সাপের পক্ষে অনুকূল এবং তার ছাপ পড়ে সমাজ ও লোকাচারেও।

তবুও খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে সর্পদেবী হিসাবে মনসার গুরুত্ব সেভাবে পৌরাণিক সাহিত্যে জায়গা পায়নি। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং দেবীভাগবতে।কাজেই ইতিহাসের নিয়মে হয়ত তারও বেশকিছু আগে প্রায় দশম একাদশ শতাব্দীতে মনসাপূজা আর্য সমাজেও চালু ছিল।

পাশাপাশি দক্ষিণাত্যে মুদমা, মঞ্চাম্মা ইত্যাদি নামের সর্পদেবীর খোঁজ পাওয়া যায়।মঞ্চাম্মা এক ধরনের সাপ। তাতে দেবত্ব আরোপ করে পুজো করেন দুএকটি আদিবাসী গোষ্ঠী। মুদমা মূর্তি মহীশুরে ব্যাপক হারে পাওয়া গেছে মন্দির ভাস্কর্যেও। বাংলার বর্তমান মনসা সম্ভবতঃ পৌরাণিক দেবী সরস্বতী,জাঙ্গুলিতারা ও মুদমার মিলিত রূপ।

প্রাচীন মনসামূর্তির নমুনা হিসেবে পাওয়া গেছে বীরভূমের পাইকোড়ে, সেন বংশের প্রথম রাজা বিজয়সেনের তৈরি মূর্তিটি।সেন রাজারা দক্ষিণাত্য থেকেই এখানে এসে রাজত্ব করেছিলেন। সেক্ষেত্রে রাজার সাথে দক্ষিণভারতীয় বিশ্বাস ও লোকাচার বাংলায় আসাই স্বাভাবিক,এবং তা সহজেই মিশেও গেছে বাংলার দ্রাবিড় সংস্কারের সাথে। সমাজতাত্বিকের ধারণা যদি কোনো সংস্কার বা প্রথা অন্য সমাজে গিয়ে সহজেই মিশে যেতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই প্রথা ওই সমাজেও প্রচ্ছন্নভাবে বহমান ছিল। এক্ষেত্রেও আদতে দুই দ্রাবিড় সংস্কৃতির মূলগত বনিবনা সহজেই হয়েছে এবং সর্পদেবীর পূজা বাংলায় হাজার বছরেরও প্রাচীন সংস্কার বলেই প্রমাণ হয়।

'মনসা' নামের উৎপত্তি কিন্তু সঠিক বলা মুশকিল। মহাভারত বলছে জরৎকারু কাশ্যপের মানসকন্যা,শিবের শিষ্যা। বাসুকির বোন। চতুর্বেদ বিশারদ।জরৎকারু মুনির স্ত্রী। অস্তিকের মাতা। আস্তিকের কৃতিত্ব হল জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞের সময় নাগকুলকে রক্ষা করা।

মনে করা হয় অনার্য মনসা চরিত্রে আভিজাত্য যোগের উদ্দেশ্যই মনসা এবং জরৎকারু এক ও অভিন্ন করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে পরবর্তী সময়ে,যদিও মহাভারতে মনসা নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না এবং জরৎকারু চরিত্রেও দেবত্ব আরোপিত হয়নি।

আবার অন্যদলের পন্ডিতরা বলছেন মনচা আম্মা―> মনসা মা উৎপত্তি হতে পারে। দক্ষিণী ভাষায় চ এর উচ্চারণ প্রায় স এর মতো। তবে এমতও স্থিরভাবে বলা মুশকিল। চেংমুড় হল তেলেগু ভাষায় ফনীমনসা গাছ। ফনীমনসা গাছের নিচেই মনসাপুজো হয় বাংলায়। চাঁদ সদাগর মনসাকে বলেছেন চেংমুড়ী কানী। অথচ চেংমুড়ী শব্দের কিন্তু কোনো বাংলা প্রয়োগ নেই। তাহলে এমনও ভাবা যেতে পারে এটি আদতে দক্ষিণী শব্দ।

পাণিনি বা অমরকোষে মনসা শব্দের উল্লেখ নেই,কাজেই বলাই যায় যে আদতে এটি কোনো অনার্য শব্দ সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে এই নাম এসেছে।

এইসব জটিল বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকে পড়ব মঙ্গলকাব্যের যুগে। পন্ডিতেরা বলছেন মনসামঙ্গল কাব্যের জন্ম মোটামুটি দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী এবং তার অন্ততঃ দেড়শ বা দুশ বছরের আগে মনসাপুজোর রীতি চালু হয়।

সেসময় মনসা বন্দনার গান ছোট ছোট পালায় গাওয়া হত,কোনো লিখিত রূপ ছিলনা।

খন্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে থাকা এইসব গান ও গল্প পরম্পরাকে একসময় পুঁথিবদ্ধ করলেন কোনো কবি,সেদিন থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের যাত্রা শুরু।

যদিও দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত লেখকই তাঁদের রচনাকে মনসা পাঁচালী নামেই পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম কবি হিসেবে নাম পাওয়া যায় কানা হরিদত্তের।তারপর একেএকে বিজয়গুপ্ত,নারায়ণ দেব,ষষ্ঠীধর,বিপ্রদাস,দ্বিজবংশীদাস কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ এবং আরো অনেকেই লেখেন এই মনসাপাঁচালী।

এইসব গল্পের অভিনবত্ব তেমন হয়তো নেই, এবং অনেকখানিই পুরাণের গল্পনির্ভর হলেও যা নিজস্ব তা হল চাঁদ সদাগরের গল্প। এ গল্পের হদিস নেই পুরাণে। চাঁদ আসলে মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব চরিত্র।

এ গল্পও সেই সময়ের যখন ব্রাহ্মণ্য মাহাত্ম্য ভারী করে তোলেনি মানুষের বিশ্বাস ও লোকাচার। সমস্ত গল্পের কোথাও ব্রাহ্মণ চরিত্রের হদিস নেই।

চরিত্রের নামকরণ খেয়াল করলেও তা স্পষ্ট। চাঁদ, সোনেকা, বেহুলা, লখিন্দর , সাহো, হরিসাধু এসবই অনার্য নাম।

সমাজের মাথা তখন বণিকগোষ্ঠী। ধনী বণিক চাঁদ সমাজপতি। এ গল্পে দেব চরিত্রের চেয়ে মানবচরিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে,মাহাত্ম্যও মানুষেরই। দেবচরিত্র নেহাতই পূজার ভিক্ষাপ্রার্থী,তাই নিয়েই গল্পের অলিগলি।

মঙ্গলকাব্য হিসাবে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার কারণও বুঝি তাই। এ মানুষের নিত্যকার সুখদুঃখ চাওয়া পাওয়ার গল্প। সোনেকার চরিত্রটি যে কোনো মাঝবয়সী মহিলার রোজনামচা।ইতিহাসের হিসাবে সেসময় বাংলায় এসেছে মুসলমান শাসক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিড়ম্বনায় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে চারিত্রিক আদর্শ। চাঁদ সেই আদর্শের প্রতীক। তুলনায় ব্যতিক্রমী বেহুলা। বঙ্গনারীর তুলনায় সে অনেকবেশী স্বাধীনচেতা, সাবলীল ও সাহসী। স্বর্গের সভায় তার নৃত্য প্রদর্শনের নমুনাও বাংলার সমাজে বিরল। এই নৃত্যবিদ্যা দক্ষিণের মন্দিরে সুপ্রচলিত। দেবদাসী সেই প্রথার নাম। সে হিসাবে অনেকে এই গল্পকে দক্ষিণের গল্প বলেও মনে করেন। তবে কি এই গল্পের চরিত্রেরা বাস্তবে কোথাও ছিল?

দুই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ,বিহার আসাম ত্রিপুরায় চাঁদের বাড়ি,লখিন্দরের বাসর,নেতি ধোপানীর ঘাট ইত্যাদির লোকপ্রবাদ চালু রয়েছে। অনেকে বলেন বিহারের চম্পাই নামের জায়গাই চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরী। সোনেকা, মানিকো, সাহো এইসব নামের সাথে ওই অঞ্চলের নামকরণরীতিরও মিল পাওয়ায় পন্ডিতেরা মনে করছেন বিহারই হল মনসামঙ্গলের গল্পের উৎসস্থল। বাসর ঘরে নববধূর বৈধব্যের গল্প হয়ত সত্যি,তেমনই সত্যি হয়ত চাঁদ সদাগরের মতো ব্যক্তিত্ব। সমাজের উঁচুতলায় থাকা সর্বজনমান্য শৈব মানুষটির কাছে পুজো পেলে যে এক লৌকিকদেবীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয় এও সত্যি।

সাহিত্য হিসাবে মনসামঙ্গল খুব উঁচুদরের কদর পায়নি কখনও। মুকুন্দরাম কিংবা ভারচন্দ্রের মতো কবির পরশ পায়নি এইসব লেখা। তা সত্বেও বাংলা বিহার আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় একই গল্প অবিকৃত ভাবে স্বীকৃত হয়েছে দেখেও একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক গল্পটির কাহিনী সত্যতা না থাকলে এমন ব্যাপক স্বীকৃতি সম্ভব ছিলনা। আর এসব টুকরো সত্যি ঘিরেই হয়ত কবিকল্পনা গল্প তৈরি করে যা কালক্রমে হয়ে ওঠে মঙ্গলকাব্য।

এতদূর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন হাঁফিয়ে উঠবে পাঠকের মন,তখন যাবার আগে টুক করে বলে যাই এ কাব্য কেন মঙ্গলকাব্য।

মঙ্গল মানে সুর করে গাওয়া গান। মঙ্গল মানে দেবতার আশীর্বাদ কামনায় প্রার্থনা। আবার এই গান মঙ্গলবার শুরু হয়ে একসপ্তাহ পরে আরেক মঙ্গলবার শেষ হয়,যদিও মনসামঙ্গল ব্যতিক্রম। এই গান সারা শ্রাবণমাস জুড়ে গাওয়া হয়। একে ভাসানের গানও বলে।

সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গলই সবচেয়ে বেশী প্রচার পেয়েছে। তার কারণ বোধহয় চরিত্রগুলির বাস্তব চিত্রায়ন। সাধারণের সুখদুখের সাথে চরিত্রগুলিকে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা,তাই মনসামঙ্গল বাঙ্গালীর প্রাণের কথা হয়ে থেকেছে বহু শত বছর। আজও সেই স্রোত বহমান।

ফিরতি পথে বিকেল ফুরানো আলোয় হয়ত আজও কানে ভেসে আসবে লখিন্দরের করুণ আর্তনাদ.....


"ওঠো ওঠো ওহে প্রিয়া কত নিদ্রা যাও।

কালনাগে খাইল মোরে চক্ষু মেলি চাও।।

তুমি হেন অভাগিনী নাহি ক্ষিতিতলে।

অকারণে রাঁড়ি হইলা খন্ড ব্রত ফলে।।

কত খন্ড তপ তুমি কৈলা গুরুতর।

সে কারণে তোমা ছাড়ি যায় লখিন্দর।।

মাও সোনকা মোর মৃত্যু কথা শুনি।

অগ্নিকুন্ড করি মাও ত্যজিব পরাণি।।

আমার মরনে মায় বড় পাবে তাপ।

পুত্রশোকে মাও মোর সাগরে দিবে ঝাঁপ।

......."

গুনগুনিয়ে উঠবে সুর,পাক খাবে বাংলার মাঠেঘাটে, জমিতে, হাওরে....

আমরা হেঁটে যাব হাজার বছরের পথ অবিরাম।

1 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







অনেক কিছুই ইতিহাসকে বয়ে বেড়ায়। এমনকি নিজের মনের কথা বলতে না পারা গাছেরাও। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে কোনো কোনো গাছও। সেই গাছ নানাভাবে ব্যক্ত করে থাকে ইতিহাসের কোনও এক করুণ অধ্যায়ের কথা। সেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে চায় বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক কালো দিনের কথা। অতীতে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুর জেলার মুঘল রোডে অবস্থিত ‘বাওয়ানী ইমলি’ নামক একটি বিখ্যাত তেঁতুল গাছ। বর্তমানে অবশ্য তা ভারতের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ফতেহপুর জেলার বিন্ডকি মহকুমার খাজুয়া শহরের কাছে বিন্ডকি তহশিল সদর দপ্তর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভরূপী এই গাছ বহন করে চলেছে ১৮৫৮ সালের ২৮ শে এপ্রিলে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়কে। এই তেঁতুল গাছেই ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ৫৩ জন বিপ্লবীকে! এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।

১০ই মে, ১৮৫৭ সালে বাংলার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিপাহী মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির পর যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই হিসেবে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ শুরু হয় তখন বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের জন্মভূমি উত্তরপ্রদেশেও। উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরে বিপ্লবীরা ঠাকুর যোধা সিং-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহের দিকে পা বাড়ায়। এমনকি যোধা সিং-এর সহকারী ছিলেন ফতেহপুরের ডেপুটি কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খান। যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা বিপ্লবীরা প্রথমে ফতেহপুর আদালত ও কোষাগার নিজেদের দখলে নেয়। আসলে, যোধা সিং আটাইয়ার মনে অনেকদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আগুন জ্বলছিল। তাঁর মনে সেই আগুন জ্বালাতে সহায়ক ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের আরেক বিপ্লবী তাঁতিয়া টোপি। মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে বিদেশি ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য এই দুই মহারথী পাণ্ডু নদীর তীরে ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে জড়ান। মুখোমুখি যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যরা মাঠ ছেড়ে পালায়। এই দুই বীর কানপুরে তাঁদের পতাকা উত্তোলন করে। যোধা সিং আটাইয়ার মনের সেই স্বাধীনতার জন্য আগুন এতেও নিভল না। ১৮৫৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, মাহমুদপুর গ্রামে যখন একজন ইংরেজ ইন্সপেক্টর ও একজন সৈনিক একটি বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি তাঁদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। ভুললে চলবে না যে তখনও দেশে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এরপর ওই একই বছরের ৭ই ডিসেম্বর তিনি গঙ্গাপার রাণীপুর পুলিশ চৌকিতে হামলা চালান ও একদল ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করেন। আওয়াধ এবং বুন্দেলখণ্ডের বিপ্লবীদের তিনি সংগঠিত করে ফতেহপুর দখল করেন। পরিবহনের জন্য বিপ্লবীরা খাজুহাকে তাঁদের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। কর্নেল পওয়েল প্রয়াগ থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। সেই সময় একজন বেইমান সর্দার বা প্রধানের খবরে সেই কর্নেল সাহেব সেই স্থানে জড়ো হওয়া বিপ্লবী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। কর্ণেল পওয়েল চেয়েছিলেন যোধা সিং-এর শক্ত ঘাঁটি ভাঙতে। কিন্তু, যোধা সিং-এর অব্যর্থ পরিকল্পনায় তা হয়ে ওঠেনি। যোধা সিং গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ণেল পওয়েলকে হত্যা করেন।

কর্নেল পওয়েলের হত্যার পর ব্রিটিশরা কর্নেল নেইলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি নতুন দল পাঠায় যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা সমস্ত বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল নেইলের হাতে বিপ্লবীরা ভারী ক্ষতির মুখে পড়েন, তবুও যোধা সিং-এর মনোবল একটুও কমল না। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের যুদ্ধের জন্য নতুন সামরিক সংগঠন করেন আর তার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনাও করেন। এইসব কাজের জন্য ছদ্মবেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিপ্লবীরাও যেমন ছিলেন যাঁরা নিজেদের দেশ তথা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন ঠিক তেমনি কিছু বিশ্বাসঘাতকরাও ছিল যারা বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনা বিদেশি শাসক ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে বিপ্লব আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে রোধ করত। হয়তো দাসত্ব বা পশুত্ব এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রিয় ছিল। আসলে এই বিশ্বাসঘাতকরা প্রকৃত মানুষের সন্তান ছিল না। অর্গাল নরেশের সাথে আলোচনা করার পর যখন যোধা সিং আটাইয়া খাজুহাতে ফিরে আসেন তখন বিশ্বাসঘাতকেরা এই বৈঠকের খবর ব্রিটিশদের দিয়ে দেয়। ঘোড়হা গ্রামের কাছে ব্রিটিশের সেনাবাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। অল্প সংগ্রামের পর, যোধা সিং ও তাঁর ৫১ জন সহ বিপ্লবীগণ ব্রিটিশের হাতে বন্দি হন। অর্থাৎ, আমরা দেখলাম যে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে যোধা সিং আটাইয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দল ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে প্রথমদিকে সফলভাবেই বিজিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের সেই বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল। নিজেদের জাতির মধ্যে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে ব্রিটিশরা এই বিপ্লবীর দলকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিল।

২৮ এপ্রিল, ১৮৫৮। ভারতীয় সিপাহী বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক ‘কালো দিবস’। উত্তরপ্রদেশে ফতেহপুর জেলায় অবস্থিত মুঘল রোডের তেঁতুল গাছে যোধা সিং আটাইয়া ও তাঁর ৫১ জন সঙ্গী এবং গৌতম ক্ষত্রিয়— অর্থাৎ মোট ৫৩ জনকে ব্রিটিশ বাহিনী ফাঁসিতে ঝোলায়। তবে এখানেই ব্রিটিশ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা থামেনি। তারা গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে, “যদি কেউ গাছ থেকে মৃতদেহ নামায় তাহলে তাকেও এই একইভাবে এই তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়া হবে।” গ্রামবাসীরা ব্রিটিশ বাহিনীর এই হুমকিতে বেশ ভয় পেয়ে যায়। তারা আর সাহস করেনি মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামাতে। দীর্ঘ ৩৭ দিন ধরে মৃতদেহগুলো গাছে ঝুলতে থাকে। শকুনের দল সেই মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। গ্রামবাসীরা কিছুই করতে পারছিল না। অবশেষে, ওই বছরের জুন মাসে, মহারাজ ভবন সিং তাঁর সহকর্মী সহ আসেন এবং মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সেগুলোর দাহ বা সৎকারের ব্যবস্থা করেন। পরে সাহসী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে সে বাওয়ানী ইমলি গাছটিকে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিন্ডকি ও খাজুহার মাঝে অবস্থিত সেই অভিশপ্ত তেঁতুল গাছটি আজ বাওয়ানী ইমলি বা বাওয়ানী তেঁতুল গাছ হিসেবে এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতীক। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে ১৮৫৮ সালে ২৮ এপ্রিলের দিনটি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এই পঞ্চাশের অধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রকাশ্যে তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা আজও অনেকের কাছে অজানা। এমনকি যাঁরা ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করেন বা পড়ান তাঁদের অনেকেই হয়তো এই ঐতিহাসিক নৃশংস ঘটনার কথা তেমন জানেন না। ইতিহাসের এক অন্ধকারতম দিনটির সাক্ষী সেই তেঁতুল গাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো ইতিহাসকে ধরে রেখে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, সেইদিনের নৃশংস ঘটনায় সেই তেঁতুল গাছটিও নিদারুণ কষ্ট পেয়েছে আর তাই সেই গণহত্যার পরে গাছটির বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, ইতিহাসের কালো দিনের সাক্ষী এক গাছও হয়। সেও প্রকৃত মানুষের মতো অনুভব করতে পারে নৃশংস ঘটনায় মানুষকে হারানোর হাহাকার ও ব্যথা। আর কালো ইতিহাসকে ধরে রাখতে কিংবা বোঝাতে সেও আর বাড়তে চায় না। হয়তো এই গাছের মতো ইতিহাসও থমকে থাকে মানব সমাজে ঘটা কোনও এক নৃশংস ঘটনায়!

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















মহাভারতের প্রধান মহিলা চরিত্র বলতে দ্রৌপদীকে আমরা বুঝি। তাঁর বিক্রমশালী পঞ্চ স্বামী। নিঃসন্দেহে তিনি এই মহাকাব্যের প্রধান নারী চরিত্র। তাঁর চরিত্রের গভীরতা ও সাহস মনে দাগ কাটে। কিন্তু দ্রৌপদী ছাড়াও মহাভারতে এমন অনেক অনেক নারী চরিত্র আছে, যাঁরা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও কাব্যে উপেক্ষিতা থেকে গিয়েছেন। তাঁদের নাম সহসা কেউ মনেও আনে না

এমনই একজন উপেক্ষিতা নারী আহিল্যাবতী। এই নাগকন্যার জন্যই একদা প্রাণরক্ষা হয়েছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের। কিন্তু সেভাবে তাঁর কথা জানে না প্রায় কেউই। সর্পরাজ বশকের মেয়ে ছিলেন আহিল্যাবতী। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং প্রতিভাময়ী ছিলেন। নিজের ছেলেকে নিজের হাতে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছিলেন তিনি।

একদা মহাদেবের বাগান থেকে একটি ফুল চুরি করেছিলেন আহিল্যাবতী। তাঁর এই কাজে অত্যন্ত রেগে গিয়ে দেবী পার্বতী বসক-কন্যাকে মানবী জন্মের অভিশাপ দেন। তবে এই গল্পের শুরু আরও আগে। পঞ্চপাণ্ডব তখনও ছোট। দুর্যোধন ও শকুনি মিলে একবার ভীমকে বিষ খাইয়ে নদীর জলে ফেলে দেন। অচেতন অবস্থায় ভীম এসে পৌঁছন আহিল্যাবতীর নাগ-রাজ্যে। বুদ্ধিমতী আহিল্যা ভীমকে দেখেই তাঁকে দ্বিতীয় পাণ্ডব হিসেবে চিনতে পারেন। বিষক্রিয়ায় ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে ভীমের। আহিল্যাবতীর অনুরোধেই তাঁর বাবা নাগরাজ বশক মহাদেবে দেওয়া বর ব্যবহার করে ভীমের প্রাণ ফিরিয়ে দেন।
পরবর্তীকালে মানবীজন্ম নিয়ে ভীমের পুত্র ঘটোত্‍কচের সঙ্গে বিয়ে হয় আহিল্যাবতীর। আহিল্যাবতী ও ঘটোত্‍কচের ছেলে বারবারিক। তাঁকে যুদ্ধবিদ্যা শেখান আহিল্যাবতী নিজেই। ছেলের অন্তরে দয়ামায়ারও সঞ্চারও করেন তিনি। বারবারিকের প্রতিভায় খুশি হয়ে তাঁকে তিনটি অসাধারণ তীর উপহার দেন মহাদেব এবং অগ্নিদেব দেন একটি ধনুক। মা আহিল্যাবতীর থেকে শিখে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী বারবারিক মহাভারতের যুদ্ধেও পাণ্ডবদের পক্ষে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in










হৃদিবরেষু সুস্মি,

গত পরশু এসেছি কিন্তু পাহাড় থেকে ফিরতে মন চায় না, ব্যস্ততম শহরের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে আর তখন বারবার মনে পড়ে মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা। পাহাড়গুলো যেন এক জায়গায় এসে হেলে পড়েছে আকাশে। চারদিকে শুধু সবুজ। সকালে ঘুম ভাঙলেই পাখির ডাক। পাহাড়ের গায়ে কান পাতলে শোনা যায় চার্চের ঘণ্টার ধ্বনি। পাইন ও কফি গাছের সমারোহে আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে নদী ও জলপ্রপাতে।

কেমন হয় একজন পুরুষের নারীবিহীন জীবন? অনেকেই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেন। তারপর চাইলেই কি তাকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়?একজন একাকী ছেলে, নিজের জীবন নিয়ে ডুবে থাকে, সে কি পারে না প্রেমে পড়তে? অথবা নারীদের আজীবন ঘৃণা করে চলা পুরুষটি যদি হুট করে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যায়? আমাদের গেছে যে দিন সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে জামাল উদ্দিন রুমির কথা খুব মনে পড়ে- যা কিছু হারিয়েছো তার জন্য দুঃখ করো না। তুমি তা আবার ফিরে পাবে, আরেকভাবে, আরেক রূপে। এইবার পাহাড়ে গিয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে পরিচয় হলো, এক সন্ধ্যায় বন্ধন, মায়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো। আমি জানতাম না গৌতম বুদ্ধ এই কথাটি বলেছিলেন তাই আমি যখন তার ভাবনা জগৎ নিয়ে প্রশংসা করছিলাম আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জানান এই বানী বুদ্ধদেবের। পরক্ষণেই তিনি জানতে চাইলেন আমি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েছি কিনা? একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মুখে ধর্মকথা বাদ দিয়ে সাহিত্যের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তাই হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললাম না। কিন্তু আমি জানি হারুকি মুরাকামি এই শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। যদিও জাপানি এই লেখকের বিরুদ্ধে খোদ জাপানে একটি অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে যে, তিনি জাপানি ভাষায় মার্কিনি উপন্যাস লেখেন। যেখানে জাপানি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভিনদেশি পাঠকের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বয়ান বেশি থাকে। আধুনিক জাপান যে ধরনের সংযত, পরিশ্রমী, সুশৃংখল, কর্মনিষ্ঠ জীবনধারার জন্য বিখ্যাত মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। তবে মুরাকামির কাহিনিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পণ্য নির্ভর অতি আধুনিক সমাজের দেখা মেলে। অথচ এই আধুনিক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম উপকরণ থাকা মানুষগুলো কোথায় এসে যেন থমকে যায়। এক আশ্চর্য একাকীত্ব, কখনো একঘেয়েমি বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতের নাগালে সুখে থাকার সব উপকরণ থাকলেও কোথাও না কোথাও জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপূর্ণতা বিরাজ করে তাদের মানস জগতে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কি বুঝলেন জানিনা তবে তার ঠোঁটের কোণে যে হাসি ফুটে উঠেছিল তা দেখে আমার মনে হলো সে হাসিতে আমার জন্য বিদ্রুপ আঁকা কিংবা তিনি মনে মনে আমাকে সস্তার পাঠক ভেবে হাসিতে বলতে চাইছিলেন তোমার পাঠের পরিধি বড় কম! কিছু কিছু সময় মানুষ বোধ করি হেরেও জিতে যায়। যেমন ঠিক সেই সময়টায় আমি! তিনি চোখ বন্ধ রেখে বৌদ্ধকে স্মরণ করলেন হয়ত বা আমাকে কী কী বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে চোখ খুলে বলতে শুরু করলেন সত্যি বলতে হারুকি মুরাকামির লেখাকে এর আগে আমি কখনো এইভাবে বৌদ্ধ দর্শনের নিরিখে পড়িনি। সত্যি বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা শোনার পরে নিজেকে বড় নির্বোধ মনে হচ্ছিল কিন্তু আমার চোখ খুলে দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করিনি।

ছোটগল্প নাকি আজকের দিনে এক ‘মৃতপ্রায় শিল্প’ বা ‘ডায়িং আর্ট’, কারণ পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে যে আধুনিককালের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা আর ছোটগল্প লিখছেন না। গত কুড়ি বছরে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভক্ষতির হিসেবেই জাপানের হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্প বিশিষ্ট আসন লাভ করেছে। জাপানি-ভাষায় রচিত লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া তাঁর উপন্যাসগুলো ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আজ বেস্টসেলার। সেরকমই মুরাকামি’র ছোটগল্পের অনুবাদও তাঁর উপন্যাসের মতো একইরকম আদরণীয়। মুরাকামি’র ছোটগল্প-সংকলনগুলোর অধিকাংশই আগের শতকের শেষবেলায় প্রকাশিত, কিন্তু ইংরেজি-অনুবাদে বইগুলোর বিশ্বের বাজারে পদার্পণ বেশিদিন আগেকার নয়। জাপানি-ভাষার হালের সবচাইতে জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের ছোটগল্পে কী এমন বিষয়ধর্মীতা রয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের পাঠকের কাছে নিরবচ্ছিন্ন আবেদন রেখে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে? ব্যাপারটিকে আধুনিক এক-সংস্কৃতির বিশ্ব বা বিশ্বায়নের নিরিখে ভাবতে চাইছেন অনেকেই। মুরাকামি’র বিশ্বে পূর্ব আর পশ্চিমের সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে চলা রয়েছে, সংঘাত এবং পরাভব রয়েছে, কিন্তু দুই সংস্কৃতির ‘এক’ হয়ে যাওয়ার কথা কোত্থাও বলা নেই।

বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘হাতিটা উধাও’ গল্পটি নিয়ে কথা শুরু করে বলেছিলেন এই গল্পটি পড়লে দেখবেন, বৃদ্ধ হাতি মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে যায়। যে মাহুতের সাথে হাতিটার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ এই সম্পর্কের ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবে হাতিটা বৃদ্ধ, সে যেকোনো সময় মরে যেতে পারে। সে একটা বিশাল গরাদে বন্দি অবস্থায় থাকে, এ অবস্থায় সে কিভাবে মাহুত সমেত উধাও হয়ে যেতে পারে! এই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবাই তার তত্ত্বাবধায়নকারী সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু এই গল্পের কথক জানান, হাতিটা তিনি মাহুত সমেত আকার পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতে দেখেছেন। অর্থাৎ হাতিটা তার আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গরাদের বাইরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আবার একই সাথে বিষয়টি তার কাছে অতো পরিস্কারও নয়, যেন ঝাপসা এক ঝলক মাত্র। এই ঘটনা কথকের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তিনি কিছু একটা করতে চান বলে ঠিক করেন আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে পার্থক্যটা কি! এক ধরনের দোলাচলে ভোগা লোকটা ভাবেন, চারপাশের সবকিছুর সঠিক ভারসাম্য যেন নেই। বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে যদি চিন্তা করেন ঠিক এই পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তি তখন ধর্মহীন৷ ‘ধর্মহীন’ শব্দটির বৈদিক ও বৌদ্ধ অর্থে, বা ব্যুৎপত্তিগতভাবে ভাবলেও, সেই ব্যক্তি এমনই এক সত্তা যার কোনও ‘আধার’ বা ‘ধারক’ নেই। এই ‘মুক্ত’ সত্তাটির জন্য কোনও চেতনার রূপান্তর বা চেতনা হতে চেতনায় পৌঁছে যাওয়া, বা ‘চেতনান্তর’ ঘটবে না। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী আর তার অন্তর্জগতের মধ্যে কোনোরকম সাম্যতা লক্ষিত নাও হতে পারে। তাই তার দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে, কার্য-কারণের সাধারণ হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে। সে যেন আজকের পৃথিবীর বহুল পরিচিত সেই মানুষ, যার সব থাকা সত্ত্বেও সে অন্তর থেকে অসুখী এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কেউ একজন। এমন মানুষের পরিচয় ইতিপূর্বে পশ্চিমের সাহিত্যে আমরা হয়ত অনেকবারই পেয়েছি। কিন্তু এই নিরিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত। মুরাকামি’র নিরিক্ষা একান্তভাবেই পূর্বদেশীয়, যা পশ্চিমের অধিকাংশ আলোচকদের চোখে ‘এ সাটল টাচ অফ জেন! ইস্টার্ন ম্যানিফেসটেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গ্লোবালাইজেশন!’ ভিন্ন আর কিছু নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু গল্প ধরে ধরে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে প্রতিটি গল্পকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার ভাবনায় তখন রামায়ণের একটা কাহিনি ভেসে ওঠে। যেখানে রামচন্দ্রের প্রেমে পড়ে সূর্পণখা নামের এক রাক্ষস, এবং রাম তার কুৎসিত রূপ দেখে তার নাক কেটে দেয় ও প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। হারুকি মুরাকামি রামায়ণ পড়েছেন কিনা জানিনা তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মুরাকামি জাপানের উন্নত সাহিত্য ধারণায় নিজেকে আটকে না রেখে বিচরণ করছেন বিশ্বজনীনতায়, আধুনিকতায়। তাই হয়ত ভাবনায় বা চেতনা জগতে রাম ও সূর্পণখা এসে মিলে মিশে যায় ‘একটি ছোট্ট সবুজ রাক্ষস’গল্পে, যেখানে বাগানের মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে এক সবুজ রাক্ষস প্রেম নিবেদন করে এক নারীকে। যে নারী তার স্বামী কাজে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর সারাদিন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। ওই কুৎসিত দর্শন রাক্ষস নিশ্চয়ই তার কল্পনা নয়! আবার অখণ্ড অবসর কাটানোর উপাদানও হতে পারে না। তবু লেখক কেন প্রেমপ্রার্থী হিসেবে এমন এক কুৎসিত, ভয়ংকর দর্শন রাক্ষসকেই নির্মাণ করলেন! যার প্রেম তো অকৃত্রিম। কিন্তু তার কদাকার চেহারা ওই নারীর কাছে একই সাথে ভয়ঙ্কর ও বিরক্তি উদ্রেককারী। রাক্ষস দীর্ঘদিন ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে টানেলের মত তৈরি করে তার ভেতর থেকে ক্রোলিং করে এসে যেভাবেই প্রেম নিবেদন করুক না কেন, নারীর তাতে সম্মতি দেয়ার কোনো কারণ নেই! সে মনে মনে রাক্ষসটাকে যতরকম ভয়ংকর ও বীভৎস নির্যাতন করা যায় তা ভাবতে থাকে। নারীর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব রাক্ষসটার ওপরে পড়তে থাকে। নির্যাতিত রাক্ষস ক্রমাগত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যতই বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে এভাবে নির্যাতন করার কথা ভেবো না। নারী তত তাকে আরো ভয়ংকর নির্যাতনের কথা ভাবে। এবং বলে, ‘এবার দেখো খুদে রাক্ষস তুমি জানো না, মেয়ে মানুষ কি জিনিস! তোমাকে যে কি কি করার কথা আমি ভাবতে পারি তার শেষ নেই।’ আপাতদৃষ্টিতে কাহিনীটি অদ্ভুত মনে হলেও! এর গভীরে রয়েছে ব্যক্তির হতাশা, বিষন্নতা বা অবিশ্বাস।

মুরাকামির গল্প উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সংগীত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি থেকে পপ, জ্যাজ থেকে র‌্যাপ, বারোক সংগীত থেকে রবিশঙ্কর, মোৎজার্ট থেকে বেটোফেন, আবার মাইলস ডেভিস, জোহান স্ত্রাউস বা হালকা চালের হুলিও ইগ্লেসিয়াশ। এছাড়াও ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফবেক, ডোরস সহ অসংখ্য ঘরানার দেখা মেলে। মুরাকামির লেখায় পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশের শিল্প- সংস্কৃতি বা সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুরাকামি আদতে তাঁর কাহিনীজুড়ে চেতনাতে বড়ো ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে আসছে ছোট ইতিহাসের নানান ঘটনা, আবার বড়ো ইতিহাস সরাসরি কিভাবে ছোট ইতিহাসের নির্মাণে অংশ নিচ্ছে, কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা তার চিন্তার মধ্যে কীভাবে বিশ্বজগতকে ধারণ করে রেখে দিতে পারে, বা তাকেও বিপরীত অভিমুখে দেখতে চাইলে দেখা যাবে যে, প্রতিনিয়ত তার স্মৃতির ভেতর নিত্যনতুন অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ সব সত্তার জন্ম এবং একইসঙ্গে মৃত্যুও ঘটছে। একটি মানুষ আসলে অতি-বৃহৎ একটি মানুষ, যে কিনা একসঙ্গে মানব-ইতিহাসের অনেকটা ধারণ করে রেখেছে তার সত্তার ভেতরে। তার প্রকাশ কখনো সরাসরি সত্তার প্রকাশে, কখনো বা বহিরঙ্গে সাদৃশ্যহীন এক পৃথিবী, জীবনযাপন, কিংবা বিসদৃশতায়। কদর্য, রূপহীন, বা কুরূপ নয়। আকারহীন বা সম্পূর্ণ নিরাকারও নয়। একটি জীবন, বা একটি মানুষ যেন বিসদৃশ। ফ্রানৎস কাফকা উত্তরাধুনিক সাহিত্যকালের যত লেখককে কমবেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাফকা’র চরিত্রদের মতোই অসংখ্য বিসদৃশ চরিত্রের আনাগোনা তাঁর উপন্যাস আর ছোটগল্প জুড়ে। ‘একটি জানলা’ গল্পের সেই প্রোটাগনিস্ট, কোনও এক সংস্থার তরফে যে চিঠি লিখে বিষাদগ্রস্ত বা প্রেমে আঘাতপ্রাপ্ত একলা মহিলাদের কাউনসেলিং করত, বা ‘অঘটন পথচারী’ গল্পের সেই নিঃসঙ্গ পিয়ানো টিউন-করা ভদ্রলোক, কিংবা ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পের সেই নারী, যে অবিকল কাফকা’র এক নারী-চরিত্রের মতোই চিরকালের নীরব। নিঃসঙ্গ মানুষ নয় তারা কেউই, কিন্তু প্রত্যেকে পৃথিবীর সামনে একটু যেন বিসদৃশ। মুরাকামি আমাদেরকে দেখিয়ে চলেছেন এই দৃশ্যমান এবং চোখে সয়ে যাওয়া জগতটার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের ছোট্ট উপাংশ অচেনা এক বিশ্বের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে। একটি ‘লেডার-হাওজেন’ বা ইয়োরোপের মহিলাদের জন্য নির্মিত একরকম লেদারে প্রস্তুত গরম মোজা, যেটি দেহের মাপে মিলে যাওয়া মাত্র এক নারী জীবনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে ফেলে, অথচ এতকাল সেই সাহসটুকু তার কাছাকাছি এসেও কীভাবে যেন অধরা রয়ে যাচ্ছিল। কিংবা অত্যন্ত পছন্দের এক পুরুষকে খুঁজে পেয়ে এক নারী জানতে পারে যে সে আসলে ‘গে’, কিন্তু কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করার মতো জোর খুঁজে পায় না। কিংবা, ‘এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে’ একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘আমি যে সারা জীবন তোমাকেই খুঁজছি। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু তুমিই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।’

মুরাকামি কখনই তার ছোট গল্পের সোজাসাপ্টা সমাপ্তি করেননি। সবসময় পাঠকদের সমাপ্তি ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন। যেন গল্পটি তার, কিন্তু পাঠক গল্পটি তার নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথার মতই “শেষ হয়েও হইলো না শেষ।” মুরাকামির গল্পে প্রতিটি বিষয়েরই যেন অস্তিত্ব আছে। যাকে ঠিক কল্পনা বলেও ধরে নেয়া যায় না, আবার যে কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অতি বাস্তবের প্রতীক। তিনি তাঁর গল্পে বসবাসকারী চরিত্রদের সুপ্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষার একটা অদ্ভুত রূপ দেন। তাই মুরাকামি’কে নিশ্চিত করে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানা বা গোলার্ধের লেখক বলে আখ্যায়িত করে ফেলাটা অন্যায়। মানুষে জীবনের গভীরতা উঠে আসে মুরাকামির লেখায়। বিষণ্নতা যে গভীর, সে কথাই নানাভাবে বলেন তিনি। ‘ঘুম’ গল্পটাতে আমরা দেখি টানা ১৭ দিন-রাত না ঘুমানো একজন ইনসোমনিয়ার রোগী ঘুম না হওয়াকে এক সময়ে ভাবছেন, ঘুম না হলে হবে না, তবে এই নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে না ভুগে বরং এটা ভাবতে হবে যে সে তার জীবনটাকে প্রসারিত করছে। অর্থাৎ যে সময়টায় সে ঘুমাতো সেই সময়টা এখন তার একান্ত নিজস্ব একটা সময়। যে সময়টাতে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না, যদিও এভাবে টানা নিদ্রাহীনতা তাকে বাঁচাতে পারেনি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম গল্পটার মতো তাঁর এমন অনেক গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সাধারণ বা একঘেয়ে মনে হতে পারে,তবুও তার ভেতরেও থেকে যায় যন্ত্রণাময়, বিপজ্জনক বা কখনো মায়াবী এক কাহিনি। ‘কিনো’ গল্পটি, কিনো নামের এক ছেলেকে নিয়ে। যে একটি বার চালায়, শহর থেকে দূরে খুব নিরিবিলি এক এলাকায়। ফাঁকা জায়গা, নিশ্চুপ পরিবেশের ভেতরই কেমন একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে। এর চেয়েও বিশাল বিষণ্নতা কিনোর ভেতরেই বসবাস করে। যদিও এ ব্যাপারে সে উদাসীন, তার স্ত্রী এবং সংসার হারানোর কষ্ট সে অনুভব করে না। কিন্তু তার বিষণ্নতা লেখক বারবার পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন, এমনকি সে যে তার অজান্তেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি চাইতে শুরু করে, তা-ও পাঠকের সামনে মেলে ধরেন লেখক। কী অদ্ভুত এক খেলা শুরু হয়, গল্পের মূল চরিত্রের সাথে পাঠকের যেন সরাসরি দেখা হয়ে যায়, লেখক আড়াল থেকে বিষণ্নতাগুলো ফুটিয়ে তোলেন। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, পাঠকও একাকিত্ব অনুভব করতে শুরু করে!

হারুকি মুরাকামির গল্পে যৌনতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। যৌনতা, গল্পে একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে। কিন্তু সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; বরং চরিত্রগুলোর সংকট প্রকাশের একটি ভাষা হয়ে ওঠে। মুরাকামি আসলে সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং সবার সামনে নশ্বর পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকাশ করে দেয়। আমরা মানুষকে চিনতে পারি বলি বটে, কিন্তু আদতে চিনতে পারি না। প্রেম কি কেবল একটি স্বপ্ন যা আমরা আমাদের একাকী অস্তিত্বের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার জন্য দেখি? মানুষের মানসিক এমন সব আলোচনা, যা মানুষ আসলে বলতে চায় না, কিন্তু পুষে রাখে। কেমন হয় একজন মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন? মানুষের বিষণ্নতা কেমন করে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যখন কেউ তার নিজের ভালবাসার নারীকে হারিয়ে ফেলে? এসবের মনস্তাত্ত্বিক দিক আর সে সময়ের বিষণ্ণতা নিয়ে মুরাকামি ‘দম দেয়া পাখি আর মঙ্গলবারের মেয়েরা’ গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয় কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশে যেন কেউ পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় ভাসছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক। ‘ক্যাঙ্গারু বার্তা’ গল্পটাতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার তার কাছে পাঠানো ক্রেতার একটি অভিযোগপত্র পেয়ে হঠাৎই ওই অজানা অচেনা নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম ঠিক ওভাবে নেই। একটা নির্দোষ, সাদামাটা, বা একটু ভিন্নধর্মী অভিযোগপত্র পেয়ে কেউ কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করতে পারে এমন অদ্ভুত কাহিনি মুরাকামির পক্ষেই লেখা সম্ভব! যেখানে কাহিনি ছাপিয়েও এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির বিষণ্নতা। বান্ধবী থাকা সত্বেও তার মানসিক নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ সবকিছু হাতের নাগালে থাকতেও এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন তাদের জগৎ। এই শূন্যতার প্রতীকী প্রতিফলন প্রকাশ পায় প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখায়। এই অশান্তির অর্থ কি? উপশম কিসে? সেই খোঁজ কি রয়েছে মুরাকামির সব লেখায়? ব্যক্তি তার একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে একদম একা। এক ধরনের বিমর্ষ একাকীত্ব নয়, আলাদা নানারকম একাকীত্ব আছে। যা খুবই যন্ত্রণার। স্নায়ু ছিড়ে যাওয়ার মতো। একইভাবে ‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ তার সারাজীবন ধরে একজন আদর্শসঙ্গীর অপেক্ষায় থাকে। আর যে কোন সময় সেই সঙ্গীর দেখা পেতে পারে সে। হয়ত বিয়ের কয়েক বছর পরেও মিলতে পারে এমন কোন সঙ্গীর দেখা। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়তো মসৃণভাবে চলছে, যেখানে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা সব থাকার পরও হয়ত এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাকে দেখলে মনে হয় এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরা যায়। মুরাকামি এই ধারণাটাকে ঠিক ভালোবাসার লেবেল দিতে চাননি। এ যেন পরিপূর্ণ সহমর্মিতা। তিনি বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্কটাকে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, এতো সহজতায় যে তাদের জৈবিক সম্পর্কটা যেন ঠিক যৌনতার জন্য নয়, ভালোবাসার এক শান্ত সমহিত প্রসন্ন টান। মুরাকামি’র উপাখ্যানে বাস্তব জগতে যে ‘বিসদৃশতা’ লক্ষ্য করা যায়, পশ্চিমের আলোচকেরা সেটিকে কাফকা’র কাহিনিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো বিচিত্র সব মানব-চরিত্র বা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ততোধিক বিচিত্র ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করলেও, এই বিসদৃশতা-কে একান্তভাবে পশ্চিমের উত্তরাধিকার-ভাবনা বলা চলে না। ‘খামার-দহন’ গল্পটাতে এক যুবক জানায়, দুমাস পর পর এক একটা খামার পোড়ানো তার শখ। এখানে সে কোন নৈতিকতার ধার ধারে না। নৈতিকতা তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের ভারসাম্য। একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব। যেন একই সাথে টোকিওতেও আছে আবার টিউনেশিয়াতেও। ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পে নিজের দেশ জাপান’কে লিখতে বসে আমেরিকা, এবং আমেরিকা’র এক বিপরীত-সংস্কৃতি হিসেবে চায়না’কে নতুন করে মেলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। এক নিঃসঙ্গ চাইনিজ ভদ্রলোক, যিনি টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তোকিয়ো শহরে বসবাসকারি চাইনিজ’দের ফোন নম্বর বের করেন, এবং তাদের বাড়ি গিয়ে ‘চাইনিজ এনসাইক্লোপেডিয়া’ বিক্রি করেন। এটিই তার পেশা। তার সঙ্গে একসময়ে যখন কাহিনির প্রোটাগনিস্টের দেখা হয়, তার মনে পড়ে যায়, ভদ্রলোক আসলে ছিলেন তার উচ্চতর ক্লাশের সহপাঠী। আজ তিনি শহরের চাইনিজ’দের বাড়িতে ঘুরে এনসাইক্লোপেডিয়া বিক্রি করেন। মুরাকামি একথাটি একবারও লেখেননি কোথাও, কিন্তু পাঠক নিজের থেকে উপলব্ধি করবেন, স্বদেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রাণ যে ‘চাইনিজ’ ছেলেটি এককালে তার সহপাঠী ছিল, সে আজও একইরকম ‘চাইনিজ’ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাহিনির প্রোটাগনিস্ট অর্থাৎ জাপানি ছেলেটি কীভাবে যেন নিঃশব্দে ‘আমেরিকান’ হয়ে গিয়েছে। এক অভূতপূর্ব প্যাসিভ ন্যারেটিভ হচ্ছে সুদীর্ঘ এই উপাখ্যানের প্রাণস্পন্দন, যা চরম উপভোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।

হারুকি মুরাকামি সামান্য ছোটগল্পকেও বৃহৎ পরিসরে লিখে থাকেন। আর কাফকা অন দ্য শো’র পরিসরই বৃহৎ, যা মুরাকামির লেখনীতে হয়ে উঠেছে অকল্পনীয় এক সৃষ্টি। জটিলভাবে গল্প না বললেও গল্পের বিষয়বস্তু জটিল হবার কারণে এই বই বিশ্লেষণ করা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, নীরবতা, ভালোবাসা, মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মুরাকামি বাস্তব ও কল্পনাকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। তিনি এমন এক ঘরানা নিয়ে লেখালিখি করেন যে ঘরানার লেখক বর্তমানে হাতে গোনা। মানুষের জীবনের গল্প বা একটি মানুষের বেঁচে থাকা জীবনকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটা গল্পে তা মুগ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যায়। হিয়ার দ্য উইন্ডো বইতে মুরাকামি একটি কথা বলেছিলেন, “যখনই আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই, সবসময় তখন আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি কারও সাথে কথা বলি, তখন আমার ইচ্ছা করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি এরকমই অদ্ভুত একজন মানুষ।” বাস্তব ও পরাবাস্তব নিয়ে প্যাঁচ লাগানো নিয়মতান্ত্রিক লেখকের জীবন কি আসলেই এমন অদ্ভুত?

নিরন্তর ভাল থেকো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আশা করি হারুকি মুরাকামির লেখায় পেয়ে যাবে কিংবা আমারও…

ভালবাসা সহ-

বাসু
১২ মার্চ,২০২৫

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















হঠাৎ মনি খিলখিল করে হেসে ওঠে… ‘আমি ভেবেছিলাম যে তুমি ভুলে গিয়েছ!’

মনি বের্শেনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কপালে, গালে, নাকের উপরে চুমু দিতে থাকে। ভেজা ভেজা শিশুর ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের গন্ধ আর প্রাতরাশের ছোট ছোট গোল রুটির গন্ধ পায় বের্শেন।

বের্নহার্ডের বয়স মোটে সতের এবং এই প্রথমবার সে প্যারিসে এসেছে। সে সাধারণত একটা বাদামি রঙের স্যুট আর সাদা শার্ট পরে। যে মহিলার বাড়িতে প্রথমে সে থাকতো, তিনি বলেছিলেন যে সে যেন রঙিন শার্ট পরে, নাহলে তাকে প্রতিদিন জামা বদলাতে হবে, আর সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। বের্শেন লজ্জিত হয়ে লক্ষ্য করল যে তার শার্টের আস্তিন এর মধ্যেই বেশ ময়লা হয়ে গেছে। তার পর থেকে অবশ্য সে তার নীল স্পোর্টস শার্টটাই পরা শুরু করেছিল। এমনিতে মহিলা ভালই। তাঁর যা বয়স, তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানাদি থাকবার কথা। কিন্তু সেরকম কেউ আছে বলে মনে হয়নি। ফলে বের্শেন ধরে নিয়েছিল যে তার প্রতি ওই মহিলার অপত্যস্নেহ বর্ষিত হবে।

সে তার নিজের দুটি লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখতে লাগল। তার চিরকালের গোছানো স্বভাব। বিছানার পাশে সে রাখল মনির ছবি। বাবা মায়ের ছবি বিছানা থেকে একটু দূরে রাখা দেরাজের উপরে। তার পাশে চুলের ব্রাশ, স্বরলিপির খাতা আর ক্যামেরা। ডেস্কের উপর রাখা হল আরেকটা ছবি, গের্ট আর ইনেস ঝুঁকে বসে ফ্লককে আদর করছে। এই ছবিটা রূপোলি ফ্রেমে বাঁধিয়েছে বের্শেন। এই ঘরে ডেস্ক না থেকে যদি একটা পিয়ানো থাকত, তাহলে খুব ভাল হত। তবে বাড়িওয়ালি জানিয়েছেন যে সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই বামদিকে বাদ্যযন্ত্রের একটা বেশ বড় বিপণি আছে। বের্শেন দরকার হলে সেখানে গিয়েও অভ্যেস করতে পারে। এই খবরটা পেয়ে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। তার তখনি সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তার এখন বেশ খিদে পেয়েছে। বেলা প্রায় দু’টো বাজে। আজ সকালে তার প্রাতরাশ করাও হয়নি।

খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে প্যারিসের মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। এখানে আসবার আগে এই মানচিত্রটা তার মা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। সে এখন যেখানে বসে আছে, জায়গাটা ওডিয়নের কাছে। লুক্সেমবুর্গ প্যালেস আর বাগানও খুব কাছে। ইচ্ছে হলেই সে ওই বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। মোঁপার্নাস্সে অবধিও সহজেই চলে যেতে পারবে সে। তবে রিভ দ্রোয়াত এখান থেকে অনেকটা দূরে। তার শিক্ষক যেখানে থাকেন, সেই জায়গাটা, অর্থাৎ পাস্‌সি, সেটাও অনেকটা দূরে। সেখানে পৌঁছাতে তার ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে। অনেকটা দূর যেতে এখন একটুও ভাল লাগছে না তার। ভারি স্বরলিপির ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে বাসে কিম্বা মেট্রোতে এতখানি সে কী ভাবে যাবে, সেটা চিন্তা করতে লাগল। তাছাড়া হেঁটে হেঁটে এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের ফ্যাকাসে হাতের দিকে চেয়ে রইল সে। ফোল্ডার বয়ে বয়ে হাতে ব্যথা হয়ে, হাত শক্ত হয়ে ফুলে যাবে, ভাবতে লাগল সে। বাজনা বাজাবার জন্য হাত ঠিকঠাক রাখা খুব জরুরি।

অবশেষে পাস্‌সিতে বের্নহার্ড তার শিক্ষকের বাড়িতে ঠিকঠাকভাবেই পৌঁছেছিল। তবে সেখানে যাবার পরে সব কিছুই অন্যরকম মনে হয়েছিল তার। জায়গাটা তার ভাবনা, তার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। বন্ধুত্বপূর্ণ চেহারার এক কিশোরী তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। গানের ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। পুরু কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছিল তার। দেওয়ালে অনেক ছবি ঝুলছে, যেগুলোর কোণে স্বাক্ষর করা। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ঘরের মধ্যে বিশাল একটা পিয়ানো অদ্ভুত আধিপত্য বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বরলিপির কাগজে ঢেকে গিয়েছে বাদ্যযন্ত্রটার দেহ।

বের্নহার্ড দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পিয়ানোটার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বাম হাতটা সে পিয়ানোর চাবিগুলোর উপরে রাখলো এবং লক্ষ্য করল যে তার হাত একটু একটু কাঁপছে। সবে দু’ দিন হল সে বাড়ির বাইরে। একটা গোটা দিন অবশ্য কেটেছে যাত্রাপথে। একটা অজানা একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে। নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন মনে হয়েছে। পথে অজস্র মানুষ হেঁটে চলেছে স্রোতের মত। কাউকে সে চেনে না। তাদের কারো সঙ্গে তার কোনও দরকার নেই। এক অন্ধ মানুষের মত ঘুরে বেড়িয়েছে পথে পথে। একটা দোকানের জানালা থেকে আরেকটা দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, যদিও তার বিশেষ কিছু কেনাকাটি করবার প্রয়োজন ছিল না। লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে; পা ব্যথা করছিল । নতুন নতুন রাস্তা যেন খুলে গিয়েছে তার সামনে। সে ইচ্ছেমত যে কোনও একটা ধরে চলতে পারে। ঠাকুমার বাড়িতে থাকাকালীন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাকে ফিরতে হত। খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বাঁধাধরা রুটিন ছিল। এখানে সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। কেউ অপেক্ষা করে বসে থাকবে না তার জন্য। দিনের সময়টা অন্তহীন মনে হচ্ছে। রাতও সেরকম। শুরু নেই। শেষ নেই কোনোখানে। রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল তার। মাঝে একবার উঠে জল খেল সে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, সে জানালার শাটারের ফাঁক দিয়ে হালকা আলোর রেখা দেখতে পেল। তার মনে হল যে ভোর হয়েছে।

বাড়িতে থাকাকালীন এমন আলো দেখে সে ভোরের কথাই ভাবতো। ঊষার প্রথম কিরণ, কুয়াশাজড়ানো ভোর। কিন্তু এখানে প্রায় নটা বেজে গিয়েছে। বের্নহার্ড লাফ দিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। তবে উঠেই মনে পড়ল যে তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। সে বেল বাজিয়ে প্রাতরাশ চাইল। তাকে একটা ট্রেতে সাজিয়ে দুধ ছাড়া এক কাপ কালো কফি আর একটা লম্বাটে রুটি দেওয়া হল। খেয়ে পেট ভরল না তার। একপাশে সরিয়ে রাখল সে ট্রেটা। তারপর আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ধূসর সিলিংএর দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই মুহূর্তে ধূসর রংটা দেখে তার এত অসহ্য লাগছে যে কহতব্য নয়। অতীতে এরকম বিশ্রী দেখতে কখনই মনে হয়নি তার এই রঙটাকে; কেমন যেন নোংরা আর বিষণ্ণ। তার মন হতাশায় আর বিরাগে ছেয়ে গেল। যে দিনটা শুরু হবে, সেই দিনটার প্রতি এবং নিজের প্রতি অবিশ্বাসে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।

সারা সকাল জুড়ে ওই সিলিং-এর ধূসরতা তাকে তাড়না করতে লাগল; তার মনে হল শহরটার আকাশ, বাড়িঘরদোর, পথঘাট সব… সবকিছুই যেন ধূসরতায় ডুবে গিয়েছে। পাস্‌সি যাবার পথে যে সাবওয়েতে সে ঢুকেছিল, সেখানেও তার মনে হয়েছিল যে তার চোখে যেন একটা ধূসর পর্দা পড়ে গিয়েছে। নিজেকে কেমন যেন অনুভূতিহীন, ভোঁতা, ব্যথাতুর, অকর্মণ্য বলে মনে হচ্ছিল তার।

ধূসর বিষাদ পেরিয়ে এখন এই পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বের্শেন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। এই মুহূর্তে এই বিরাট শহরে সে একাকী নয়। এখনই এক পরিচিত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠ তাকে সম্বোধন করবে; সে এমন একজনকে দেখবে যিনি গের্টকে চেনেন (কারণ বহুবার সঙ্গীতের ক্লাস শেষ হলে গের্ট তাকে গাড়িতে করে আনতে যেত); হঠাৎ গের্টের কথা ভেবে অপ্রত্যাশিতভাবে বের্শেনের বাড়ির জন্য মন খারাপ হল। মনে হল যে সে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, এখনই তার চোখে জল আসবে।

তার শিক্ষক পাশের ঘর থেকে এসে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। বের্শেন উত্তেজনায় কাঁপছিল। … ‘ভয়লা দোঙ্ক লে পেতিত কোরাজোঁ’*- উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন শিক্ষক। হৃদ্যতাপূর্ণ প্রবল স্বরে বের্শেনকে জানালার আলোর কাছে নিয়ে এলেন তিনি, ‘তারপর, কেমন আছেন আপনি? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কোথায় উঠেছেন? জায়গাটা ভাল তো? আপনি কঠিন পরিশ্রম করবার জন্য তৈরি তো?’

বের্শেন একটু ঘাবড়ে যায় এত প্রশ্নের সামনে। কারণ, ফরাসি ভাষায় তার খুব বেশি দখল নেই। সে অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে যায় নিজের অস্বস্তি গোপন করার জন্য।

-‘আমি কিছু কিছু অভ্যাস করেছি।’ … বলে সে শিক্ষকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই পিয়ানোর সামনে বসে পড়ে; বসে তার নিজেরই একটু বিব্রত বোধ হয়। অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে জোরে জোরে হাতের আঙুল ঘষতে থাকে।

শিক্ষক অনুমতি দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়েন… ‘চলুন, বাজাতে শুরু করুন। অসুবিধে নেই। আমি আমার এক বন্ধুকে খবর দেব, যিনি আপনার বাজানো শুনে খুব খুশি হবেন।’

বের্শেন গত বেশ কয়েক মাস বাখের কম্পোজিশন বাজায়নি। তবুও সে চুপচাপ বাজানো শুরু করল। বাজাতে বাজাতে সে চারপাশের দুনিয়া ভুলে এক ধ্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। সুরের প্রদীপ্তির আবেশ তাকে ঘিরে রেখেছিল। বাজাতে বাজাতে এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে সে একজন অচেনা মানুষকে দেখতে পেল। সেই মানুষটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পিয়ানোর ঢাকনার উপরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। বের্নহার্ডের একটু অদ্ভুত লাগে তাঁর দিকে তাকিয়ে; মুখমণ্ডলে মধ্যে গভীর এক বিষাদ ছেয়ে আছে; তাঁর মুখখানা ভারি ফ্যাকাসে। ঘরের আলোটা ততখানি উজ্জ্বল নয় বলেই তাঁর মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কি না, সেটা সে বুঝতে পারে না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে মন কেন্দ্রীভূত করে পিয়ানোর চাবির উপরে। সুরের মায়ায়, ঐন্দ্রজালিক স্বপ্নের মাঝে ডুবে যেতে যেতে নেশাগ্রস্তের মত বাজাতে থাকে সে।

(চলবে)



* Voilà donc le petit courageux- ফরাসি ভাষার এই বাক্যবন্ধের অর্থ… ‘তাই তো এই ছোট্ট সাহসী মানুষটি এসেছে।’

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৯.২

এসব তো সকালের ঘটনা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হবার আগে থানায় দু’পক্ষেরই রিপোর্ট লেখানো হয়ে
গেল। যার থেকে বোঝা গেল যে স্কুল মাস্টারের দল মারামারি করেছে এবং একে অপরকে খুন করতে
চাইছিল। কিন্তু তখন ওদের থামানোর জন্য কেউ ছিল না। তাহলে একটাও খুন হল না কেন?
পুলিশের মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠায় ওরা এবার উলটো দিক থেকে তদন্ত শুরু করল।

সেদিন দুপুরের দিকে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় এ’নিয়ে ভারি কাটাছেঁড়া শুরু হল। সেখানে হাজির সাধারণ
নাগরিকদের মনে হল—ব্যাপারটা আরও একটু গড়ালে ভাল হত। ঠিক আছে, নিজেদের কারও হাড়
ভাঙেনি—সেটা ভাল, তবে খানিকটা রক্ত বেরনোর মত চোট লাগা উচিত ছিল। তবেই দুশমনদের
বিরুদ্ধে একটা খাসা মামলা দাঁড়াতে পারত। শনিচর ভাবল—গ্রামপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে
আরেকটু নেতাগিরি করে নিই। অতএব, নিঃশুল্ক উপকার করার চেষ্টায় বলল,-- প্রিন্সিপাল রাজি
হলে আমি ওনার হাতে কোঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত বের করে দিই? তাহলে ওটাও খান্না মাস্টারের
কাজ বলে থানায় লিখিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওকে দূর দূর করে চুপ করিয়ে দিল।
সেই দুপুরে রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন, নিজে একবারও মুখ খোলেননি।
সেটা অবশ্য শিবপালগঞ্জে বোকামির চিহ্ন। আসলে ওরা ভেতরে ভেতরে প্রিন্সিপালের উপর রাগে
ফুঁসছিলেন। খানিক বাদে রূপ্পন বাইরে এসে বললেন—এই শালা বাবাকে কোর্ট-কাছারির দিকে নিয়ে
যাচ্ছে, এরপর জেলের ভাত খাইয়ে তবে শান্ত হবে।
এদিকে বৈদ্যজী সেই দুপুরে প্রিন্সিপালের মুখে খান্না মাস্টারের উৎপাতের গল্প গম্ভীর মুখে
শুনছিলেন। শেষে এমন একটা কথা বললেন যার সঙ্গে এই মামলার কোন সম্পর্ক নেই। কথাটি
একদম সত্ত্বগুণ সম্পন্ন এবং সেটা কোন লোককে নীরোগ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
উনি বললেনঃ
“জেলা স্কুল ইনস্পেক্টরের ধর্মে মতি দেখে আমি তো হতভম্ব। গত মঙ্গলবার শহরে যেতে
হয়েছিল। দেখলাম, একজন লোক হনুমানজীর মন্দিরের সামনে মাটিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছে।
যখন ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল দেখি আর কেউ নয়—আমাদের জেলা স্কুল ইনস্পেক্টর। চোখ থেকে,
কী আর বলব, প্রেমের অশ্রুধার বইছিল। আমি নমস্কার করায় উনি প্রতি নমস্কার করে রূদ্ধ
সরে ‘হাউ হাউ’ করে কীসব বলে ফের চোখ বন্ধ করলেন।
“ পরের বার পাঁচ -ছয় সের উত্তম ভৈঁসা ঘি নিয়ে যেতে হবে। এমন ধার্মিক মানুষ! খামোখা ডালডা
বনস্পতি খেয়ে খেয়ে ধর্ম নষ্ট করছে।
মহাকালের লীলা”।
একটা পুরনো শ্লোক ভুগোলের একটি উপপাদ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেটা হল—সূর্য কোন
নিয়ম মেনে পূর্বদিকে উদিত হয় না, বরং যেদিকে ওঠে সেটাই পূবদিক হয়ে যায়।তেমনই উঁচু স্তরের
সরকারি আমলা কাজের প্রয়োজনে ট্যুর করেন না। তিনি যখন ইচ্ছে যেদিকে যান, তখন সেখানেই
প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। এই নবীন সূর্য সিদ্ধান্তের নিয়ম মেনে এক মহাপুরুষ সেদিন বিকেল চারটে
নাগাদ শহর থেকে মোটরগাড়ি চড়ে গ্রামের পথে যাচ্ছিলেন। পথের চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ
দেখে উনি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলেন—হ্যাঁ, গতবছর যে লেকচার দিয়ে গেছলেন তার ফলেই
এদিকের গাঁয়ে এবার রবি ফসলের বাড়-বাড়ন্ত। চাষির দল ওনার পদ্ধতি মেনেই চাষ করেছে।

ওরা বুঝতে পেরেছে যে এই খেতগুলো লাঙল দিয়ে চষতে হবে। আর তাতে খালি সার দিলে হবে না,
বীজও বুনতে হবে। এই সব তত্ত্ব ওরা বুঝে নিচ্ছে এবং নবীন পদ্ধতির চাষের ব্যাপারে ওদের ভয়
দূর হয়েছে। কিসান এবার প্রগতিশীল হয়েছে, তবে ওরা আজও আগের মত চাষা-কে- চাষাই রয়ে
গেছে, সেজন্যেই পিছিয়ে পড়েছে।
মোটরগাড়ি চলছে তীব্র বেগে, আর রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে থাকা লোকজন ঝড়ের মুখে শুকনো
পাতার মত উড়ে উড়ে রাস্তার কিনারে সরে যাচ্ছে। ফের নিজেকে ধন্যবাদ! যত আলসে নাগরিক ওঁর
মোটরের গতিবেগের ধাক্কায় কেমন চটপটে হয়ে উঠছে! দেখ, ওরা কেমন চালাক হয়ে গেছে! এমন
দ্রুতবেগে চলা গাড়ির চাকায় ওদের একটা বুড়ো আঙুলও পিষে যায়নি! উনি পরম সন্তোষে একবার
নিজেকে, ফের একবার গোটা ভারতকে বললেন—সাবাশ! তোর ভবিষ্যৎ উজ্বল বটে।
গাড়ি ছঙ্গামল ইন্টার কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আন্ডারওয়ারের উপরে বুশশার্ট এবং
ডোরাকাটা পাজামার উপর গেঞ্জি -ছাড়া- জামা পরা ছেলের দল নালার পাশে ছোট্ট পুলের উপর
বসেছিল। দুটো দল নিজেদের মধ্যে তিতির-বুলি’র সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সাহেব
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বুঝে ফেললেন যে এরাই ছাত্র।
গাড়ি প্রায় এক ফার্লং এগিয়ে গেছল। কিন্তু মহাপুরুষের খেয়াল হল যে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় উনি
নবযুবকদের কোন লেকচার দেননি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এই তাজা তরুণদের জন্য উনি কত না
দুঃখ সয়েছেন! ওদের ভালর জন্যেই উনি গ্রামে নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে বাংলোয়
থাকছেন। পুকুর পাড়ে বসে থাকার বদলে সকাল-সন্ধ্যে একটা ছোট্ট কামরায় বসে থাকার অভ্যেস
করেছেন। নিজেকে কত বদলে ফেলেছেন!
যেই মনে হল যে ওনার বিশেষ পছন্দের নওজোয়ানদের সঙ্গে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় কোন
কথাবার্তা হয়নি, অমনই খেয়াল হল—আরে! এতক্ষণ বিনা লেকচার ঝেড়ে রয়েছি? আমার মনে এত
ভালো ভালো চিন্তা উঁকি দিচ্ছে আর আমি কিনা সেসব স্বার্থপরের মত নিজের কাছে চেপে রেখেছি?
সত্যি, আমি আজকাল বড্ড কিপটে হয়ে গেছি। ধিক্‌ ধিক্‌! এই দেশে জন্মেও এতক্ষণ মুখ বন্ধ?
আটচল্লিশ ঘন্টা! মানে ২৮৮০ মিনিট? আর ৬০ দিয়ে যদি গুণ করি তো যা হবে তত সেকেন্ড; –
আচ্ছা, কত সেকেন্ড? এতটা সময় নওজোয়ানদের উৎসাহ দিতে কিছু জ্ঞান বিতরণ না করে
রয়েছি! আমার হলটা কী? পক্ষাঘাত নয় তো!
এক পলকে উনি ডিসিশন নিলেন—ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও! এই কলেজটার স্ন্যাপ ইনস্পেকশন
করব।
উনি কলেজে পৌঁছে গেলেন আর ছুটির ঘোষণা হয়ে গেল। ছেলের দল ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে
বসে পড়ল। স্থানীয় সরকারি আমলা, মাঠে ঘাটে কড়ি খেলার জুয়াড়ির দল, তাড়িখানায় বসে থাকা
নেশাখোর—সবাই দেখতে দেখতে এসে ভীড় জমিয়ে দিল। বেশ বড়সড় মিটিং হয়ে গেল। এরা না
এলেও মিটিং হত। বক্তা নির্লজ্জ হলে একটা ল্যাম্পপোস্টকেও শ্রোতা বানিয়ে একাই মিটিং করে
নেয়। কিন্তু এখানে তো সত্যি সত্যি ভালরকম মিটিং হল।
ছেলেপুলের ব্যাপারটাই এ’রম। ওদের ক্লাসের মধ্যে আটকে রাখ তো কলেজ হয়, আর ক্লাস থেকে
বার করে খোলা মাঠে ছেড়ে দাও তো মিটিং!
উনি ছেলেদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের ভবিষ্যৎ আর মাস্টারদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের
ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। ছাত্র এবং মাস্টার এসব আগে থেকেই জানত। উনি ছেলেদের ধমকাতে
লাগলেন – কেন ওরা, আটচল্লিশ ঘন্টা তো দূর, আটঘন্টাও চুপ করে শুনতে পারেনা। তারপর উনি
টিচারদের ধমকালেন—কেন ওরা ছেলেগুলোকে সংযম শেখাচ্ছে না? উনি নালিশ করলেন—এই

ছোকরাগুলো জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে কিচ্ছু জানে না। আর মাস্টারের দল এসব
দেখেও খালি মাগ্যিভাতা বাড়াও, বেতন বাড়াও বলে চেঁচায়।
মাস্টার এবং ছেলের দল এসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার আগেই ঊনি অন্য বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। সেই
বিষয়, যেটা স্কুল-কলেজে লেকচার দিতে আসা সব মহাপুরুষই না বলে ছাড়ে না।
বললেন—“আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এই ব্যবস্থায় পড়াশুনো করে সবাই খালি ক্লার্ক হতে
চায়”।
ছাত্রদের পরামর্শ দিলেন যে এই শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। উনি অনেক
বিদ্বান, বিশেষজ্ঞ এবং শ’য়ে শ’য়ে সমিতি ও কমিশনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বোঝালেন যে
বর্তমান শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। বিনোবাজী এবং গান্ধীজির নামও বাদ পড়ল না। তখন কলেজের
ম্যানেজার বৈদ্যজীও মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন-- আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। তারপর কলেজের
প্রিন্সিপাল, ওঁর দলের মাস্টার, যত ভবঘুরে, নেশাড়ু সবার মাথা নাড়ানোর পালা। এইভাবেই ওরা
মেনে নিল যে আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এবার উনি বললেন - গত শতাব্দীর শিক্ষা পদ্ধতি
যে ভালো ছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল সবাই সাত তাড়াতাড়ি বুঝে গেল-- আমাদের শিক্ষা-
পদ্ধতি খারাপ।
ছাত্রদের বললেন যে ওদের উচিৎ চাষ করা, দুধ খাওয়া, শরীর চর্চা করা, আর আগামী দিনের
নেহেরু-গান্ধী হবার জন্য তৈরি থাকা। মুশকিল হল, এসব ছেলের দল ওনাকেও বলতে পারত। এসবের
পর উনি সমন্বয়, দেশের ঐক্য, রাষ্ট্রভাষা প্রেম ইত্যাদি হরেক বিষয়ে এক একটি বাঁধাগতের
বুলি বলে , কলেজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার বার্ষিক আশ্বাস দিয়ে, কিছু মেওয়া ইত্যাদি খেয়ে,
চা খেয়ে ফের ঘন্টায় সত্তর মাইল বেগে ফুরুৎ হয়ে গেলেন। মাস্টার আর ছাত্রের দল খানিকক্ষণ
ওনার “ভাইয়োঁ ঔর বহেনোঁ’ জাতীয় বাঁধা বুলির নকল করে যে যার ঘরে চলে গেল। ফলে শিক্ষা-
পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল কলেজের মালী, চাপরাসি ও মজুরদের ঘাড়ে।
ক্লার্ক মেওয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র একটা কাজু পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে ময়ূখে
দিতে গিয়ে কী ভেবে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলল।

(চলবে)

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








তেইশ

লালজি মন্দির চত্বরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লম্বা-চওড়ায় ৫৪ ফুট বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় চার ফুট বেদির ওপর অবস্থিত। মন্দিরের সামনে আছে চারচালা নাটমন্দির। চত্বরে প্রবেশপথের উপরে আছে নহবতখানা। বাঁ-দিকে রয়েছে পর্বত আকৃতির গিরিগোবর্ধন। মূল মন্দিরের চারদিকে চারচালা ছাদযুক্ত দীর্ঘ এবং ত্রিখিলান বারান্দা আছে। প্রথম তলের ছাদের চার কোণে সৃষ্ট খাঁজে তিনটি করে---দুটি চূড়া সমউচ্চতায় এবং মাঝেরটি একটু পেছোনো অবস্থায় সমতল করে বসানো আছে। দক্ষিণমুখী মন্দিরের সম্মুখভাগে আছে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বার। মন্দিরের সম্মুখভাগ টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ। রামায়ণ, নানা পৌরাণিক কাহিনির ফলকের পাশাপাশি নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখে মন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে কৃষ্ণলীলার নানা কাহিনির প্রতিফলন।

লালজি মন্দিরের বর্তমান বয়স ২৮০ বছর। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর রাজবাড়িচত্বর প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার অন্তত ৪৫ বছর পর সমগ্র চত্বরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডল অধিগ্রহণ করে। চত্বরের সৌন্দর্যায়নের কাজটি চমৎকারভাবে হলেও স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ।

রিমির মনটা আনবাড়ির আঙিনার ধুলোয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে মনটা।সকালে উঠে সমীরণের উঠোন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে।তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়।বিপিন ও সমীরণ হরিনাম করে।রিমি খোল বাজায়।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত এই সতীপীঠ আমার জন্মস্থান বড়পুরুলিয়া গ্রামের কাছাকাছি। তাই বারবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সতীপীঠে।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবের নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। এর পর মহাদেব কালভৈরবকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে। সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে মন্দির তৈরি হয়েছে। এগুলোকে সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। পীঠনির্ণয়তন্ত্র তন্ত্র মতে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল বহুলায়। পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয় কেতুগ্রাম ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন।সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খন্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহ খন্ড গুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকমই একটি সতীপীঠ হলো “বেহুলা” বা “বহুলা” সতীপীঠ।অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে এটিকে আবার “বাহুলা” পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে এবং এখানের অধিষ্ঠিত দেবীকে “বাহুলা চন্ডিকা” বলা হয়েছে। আবার “শিবচরিত গ্রন্থ” অনুযায়ী কেতুগ্রামেরই ‘রণখন্ড’ নামে একটি জায়গায় সতীর ‘ডান কনুই’ পড়েছে। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলাক্ষী ও ভৈরব মহাকাল।

বর্ধমানের কাটোয়া থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রামে বহুলা সতীপীঠ অবস্থিত। অনেক বছর আগে এই গ্রামে তিলি বংশজাত ভূপাল নামক এক রাজা বাস করতেন। সেই রাজার একটি ছেলে ছিল, তার নাম চন্দ্রকেতু। মনে করা হয় চন্দ্রকেতুর নামেই এই গ্রামের নাম হয়েছে কেতুগ্রাম। প্রাচীনত্ত্বের বিচারে এই কেতুগ্রামের বয়স অনেক। অনেকের মতে এই কেতুগ্রামেই জন্মেছিলেন নানুরের বিশালাক্ষী-বাশুলি দেবীর উপাসক চন্ডীদাস। এই গ্রামে ছিল তার আদি বাসস্থান। এই কেতুগ্রামের উত্তরদিকের একটি জায়গাকে স্থানীয় মানুষজন চন্ডীভিটা বলে সম্বোধন করে থাকে। গ্রামেই অবস্থান বহুলা মায়ের মন্দিরের। রাও পদবিধারী জমিদারেরা বহুলা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের যে সেবাইতরা রয়েছেন তারা এই রাও জমিদারদের বংশধর। এই কেতুগ্রামে “মরাঘাট মহাতীর্থ” বলে একটি জায়গা রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে শিবচরিত গ্রন্থে রণখন্ড বলে যে জায়গার উল্লেখ করা আছে সেটি আসলে কেতুগ্রামের মরাঘাট মহাতীর্থ নামক জায়গাটি। এখানেই দেবীর দেহখন্ড পড়েছিল। এই মরাঘাটের পাশ দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মরাঘাট মহাতীর্থ অনেক বছর আগে শশ্মান ছিল। শশ্মানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে মৃত শিশুদের দেহ পোঁতা হতো। এখানে অনেক সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। এখানেই রয়েছে দেবীর ভৈরব ভীরুক। তবে এটা নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে কেতুগ্রামে বহুলা দেবীর সাথেই ভৈরব ভীরুকের অবস্থান। আবার অনেকের মতে কেতুগ্রাম থেকে একটু দূর “শ্রীখন্ডে” আছে মায়ের আসল ভৈরব ভীরুকের লিঙ্গ ও মন্দির।

সমীরণ বলে,গ্রামে মায়ের যে মন্দির আছে, সেটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে দেবীর মূর্তিটিকে একটি কালো পাথরের উপর স্থাপন করা হয়েছে। দেবীর মুখ বাদে সারা শরীর সুন্দর বস্ত্র দ্বারা আবরণ করা থাকে। মায়ের মূর্তির চারটি হাত। মায়ের পাশেই রয়েছে অষ্টভুজ গণেশের মূর্তি। গণেশের এই মূর্তিটি অনেক পুরানো। মা এখানে স্বামী পুত্র নিয়ে একসাথে বাস করেন। এখানে দেবীর নিত্য পুজো করা হয়। মাকে রোজ অন্নভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে, অনেকের বিশ্বাস এই পুকুরে অবগাহন করলে রোগ ভালো হয়ে যায়।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















প্রথম পর্ব – বারৌনি প্রত্যাবর্তন

হিন্দোশিয়ার বিদেশসচিব আমান্ডা আইনস্টাইনের আতিথ্যে প্রায় ছ’মাস কাটানোর পর একদিন সকালে সমুদ্রতীরে তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির ব্যালকনি থেকে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে মাধাই পানু রায়ের কাছ ঘেঁসে এসে বসলো। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ মাধাই, কিছু বলবি?’ মাধাই বলল,’ না তেমন কিছু নয়। ভাবছি আপনি এখন সূর্যোদয়ের আনন্দ উপভোগ করছেন , আপনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে কি না?’ পানু রায় বললেন,’ তোর গলায় উৎকণ্ঠার সুর শুনছি। সূর্যোদয়ের আনন্দ তো প্রাত্যহিক ব্যাপার। তুই নির্দ্বিধায় বলতে পারিস।‘ মাধাই হাত কচলাতে কচলাতে বলল,’ এমনি করে আরও কিছুদিন কাটালে আমার কাজকর্মের সূর্যাস্ত হতে আর দেরি হবে না। দেশে ফিরে যাবার কথা কিছু ভাবছেন?’ পানু রায় বললেন,’ দেখ মাধাই, আমি চাইলে আমার বাকি জীবন এখানে বসে বসে কাটিয়ে দিতে পারি। আমান্ডা যে আমায় যেতে দিতে চায় না সে কথা তোরা জানিস। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি এভাবে সময় কাটাতে থাকলে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।‘ পাশ থেকে পচা বলল,’ তোমার বয়স তো ১০৫ হল। আরও বেশিদিন বাঁচা মানে কী? আরও কত বছর?’ পানু রায় বললেন,’ ঠিক বলেছিস ,পচা। বেশিদিন আর নেই । বাকি জীবনটা বসে না থেকে নতুন কিছু একটা করতে চাই। এখানে থাকলে তা হবে না। তার চেয়ে চল সবাই মিলে বারৌনি ফিরে যাই। জগাই আর সুন্দরীর মধুচন্দ্রিমা তো অনন্তকাল চলতে পারে না। কেষ্ট, জগাই, সুন্দরীদেরও একটা গোটা জীবন পড়ে আছে। তুই বোকাসোকা মানুষ , তুই না হয় মাধাই এর কাছেই কাজ করবি সারাজীবন।‘ পচা গম্ভীর হয়ে বলল,’ দাদু, তুমি ভুলে যেও না সে দিন আমি দরজা না খুললে আজকের দিন তোমরা কেউ দেখতে পেতে না।‘ পানু রায় বললেন।‘ তুই রাগ করলি পচা। আমি মজা করছিলাম। তোকে আমি সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসি আর তার জন্যে আমায় কম কথা শুনতে হয় না।‘ পচা পানু রায়ের একেবারে কাছে এসে বসে। পানু রায় পচার কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। ততক্ষণে জগাই আর সুন্দরীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে মাধাই। আরও কিছুদিন এখানে কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও মাধাইএর কথায় রাজি হয়ে গেল ওরা। কেষ্টদার কথা অবশ্য আলাদা। কেষ্টদা এখনও শয্যাত্যাগ করেনি।সুস্বাদু খাদ্য এবং সুনিদ্রার ব্যবস্থা থাকলে হিন্দোশিয়ার সমুদ্রসৈকত আর বারৌনির পুকুরপারের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই কেষ্টদার। ব্রেকফাস্টের টেবিলে ঠিক হল যে পানু রায় আজ কালের মধ্যেই প্রসঙ্গটা উত্থাপন করবেন আমান্ডার কাছে। তারপর আমান্ডাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বারৌনি ফেরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ব্যবস্থা করা হয়ত অসুবিধে হবে না। বিনা পাসপোর্টে যখন আসা গেছে যাওয়াও যাবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া আমান্ডা এখনও হিন্দোশিয়ার বিদেশ সচিব। সুতরাং ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। জগাই বলল,’ কিন্তু চিন্তার কথা হচ্ছে যে সোনিয়ার ওজন এখন বেড়ে ৫৫০০ কেজি হয়েছে।‘ সুন্দরী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। বলল,’ তোমরা নিজেরা বসে বসে কী হয়েছ চোখে দেখতে পাচ্ছ? সোনিয়ার একটুখানি ওজন বেড়েছে তাই নিয়ে তোমাদের চিন্তার শেষ নেই।‘জগাই বলল,’ আহা, রাগ করছো কেন? আসার সময় কী হয়েছিল মনে নেই তোমার? প্লেনে তুলতে জীবন বেরিয়ে গিয়েছিল আমাদের।‘ সুন্দরীর রাগ কমল না। বলল,’ শোন, ওকে যদি প্লেনে তোলা না যায় নিতে হবে না সোনিয়াকে। তোমরা চলে যাও। আমি আর সোনিয়া থেকে যাব এখানে।‘ পানু রায় এতক্ষণ ওদের কথোপকথন শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। এবার দেখলেন তিনি না থামালে ঝগড়া বন্ধ হবে না। বললেন,’ সুন্দরী, সোনিয়াকে যখন আমরা এনেছি , নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। আমরা তো আছি। ৫৫ কেজির মা আর ৫৫০০ কেজির মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাব আমরা। তুমি কি আমাদের এতটা স্বার্থপর মনে কর?’ পানু রায়ের আশ্বাস শুনে রাগ কমল সুন্দরীর। বলল,’ দাদু, ১০৫ বছর বয়সে যে দায়িত্ব তুমি নিতে পারলে, ৩০ বছর বয়সে সে দায়িত্ব জগাই নিতে পারছে না। হাজার হলেও সোনিয়া তো ওর মেয়েই হল, না কি? হস্তিনী বলে কি মানুষ নয় ও? ‘বাস্টার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচামেচি করে বুঝিয়ে দিল যে কথাটা ওর জন্যেও সত্যি। সুন্দরী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বাস্টারকে কোলে তুলে আদর করতে করতে সোনিয়ার দিকে এগিয়ে চলল। হাঁ করে জগাই তাকিয়ে রইল সুন্দরী আর তার ছেলেমেয়েদের দিকে। সুন্দরীর এই অপত্যস্নেহ মাঝে মাঝে অবাক করে জগাইকে। ভয় হয় বাস্টারকে কোলে নিয়ে কোথাও যাবার সময় যদি সোনিয়াকে কোলে নেবার জন্য ওকে বলে তাহলে কী করবে ও? পানু রায় জগাই এর পিঠে হাত রাখেন। বলেন,’ কী দেখছিস জগাই? ভয় করিস না। আমি তো আছি। সংসার সমরাঙ্গনে যুদ্ধ করো দৃঢ়পণে, ভয়ে ভীত হয়ো না কাতর।‘পরম ভরসায় ৩০ বছরের জগাই ১০৫ বছরের পানু রায়ের কাঁধে মাথা রাখে। জগাই এর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেন পানু রায়। পানু রায়ের বড় আদরের এই জগাই।

মধ্যাহ্নভোজের সময় আমান্ডার কাছে আস্তে আস্তে কথাটা পাড়লেন পানু রায়। বললেন,’ আমান্ডা, অনেকদিন তো হল হিন্দোশিয়ায়। আর কিছুদিন এমনি করে কাটালে চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে যাব আমি। তাছাড়া, আমার নাতি-নাতনিদেরও তো কিছু একটা করতে হবে। তোমার আদরে থেকে থেকে বাঁদর হয়ে উঠলে ওদের ভবিষ্যৎ রসাতলে যাবে যে।‘কথাটা শুনে আমান্ডা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ সত্যি করে বল তো তোমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? ‘সকলে হাঁ হাঁ করে বলে উঠল,’ কী যে বলেন ম্যাম! একথা বললে নরকেও জায়গা হবে না আমাদের।‘কেষ্টদা কথাটা ঠিকঠাক না শুনেই বলে উঠল,’ জায়গা না হলে হিন্দোশিয়ায় ফিরে আসব সবাই মিলে।‘সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কেষ্টদা বোকার মত তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে থাকল কী এমন হাসির কথা বলেছে সে? কিছু বুঝতে না পেরে পাশে রাখা মিষ্টির প্লেটের দিকে হাত বাড়াল কেষ্টদা। তার বড় ভালবাসার এই জলভরা সন্দেশ। অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে আমান্ডা বলল,’ ঠিক আছে আমি যদি সকলের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি এখানে তাহলে তো কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। ইন্ডিয়া থেকে কত লোক কত কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে কাজের জন্য আসে। আমি একসপ্তাহের মধ্যে তোমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর তোমাদের মনে হবে না তোমরা বসে বসে খাচ্ছ।‘পচা আনন্দে একেবারে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল,’এ তো দারুন ব্যাপার! কি কাজ করতে হবে ম্যাম?’ পাশ থেকে সুন্দরী উত্তর দিল,’ সৈনিকের। ম্যাম যুদ্ধে পাঠানোর জন্য তোকে বেছে রেখেছেন। দাদুর সঙ্গে ম্যামের কথা হয়ে গেছে। কাল থেকে তোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা মিলিটারি ক্যাম্পে। খুশি তো? ‘পচার মুখের হাসি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। পানু রায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কাঁদোকাঁদো গলায় জিগ্যেস করলো,’ দাদু, সত্যি?’ পচার কষ্ট পানু রায় একদম সহ্য করতে পারেন না। পচাকে সকলের চেয়ে বেশি স্নেহ করেন পানু রায়। পানু রায় হেসে বললেন,’ দুর বোকা, তাই কখনও হয়? ওরা তোকে নিয়ে মজা করছে। তোকে ছেড়ে আমরা কি কেউ থাকতে পারি?‘ হাসিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পচার।

একটু ইতস্তত করে পানু রায় বললেন, ’আমান্ডা, দেশে ফেরাটা আমাদের খুব দরকার। তোমার আতিথ্যে আমরা মুগ্ধ। তোমাদের ছেড়ে যাবার কোনওরকম ইচ্ছে আমাদের নেই সে কথা বলা বাহুল্য। দেশে ফিরে হয়ত এত আদর যত্ন আরাম আমাদের জুটবে না। তবুও ঘরের টান! বুঝতে তো পারছোই। তুমি মন খারাপ করো না, আমান্ডা। আমি তোমার সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা দেখা করব। তোমাকে এখন আর বিরক্ত করব না।‘ আমান্ডা উঠে এসে পানু রায়ের হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ’তুমি আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু। তোমাকে ছেড়ে দিতে আমার মন চাইছে না। কিন্তু তোমার কথাও ফেলা যায় না। তুমি আজীবন মুক্ত বিহঙ্গ। কী সাধ্য আমার যে তোমাকে সোনার খাঁচায় বেঁধে রাখি।‘ আমান্ডার চোখ জলে ভরে যায়। পানু রায় বললেন, ’তোমার মত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতবছর ধরে কত শত জায়গায় আমি ঘুরেছি। কত যে মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তোমার মত কাউকে পাইনি। যখন সারাজীবনের জন্য তোমাকে চেয়েছিলাম তখন পাইনি। আজ আর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মায়ায় জড়াতে চাইনা। আমান্ডা বলল,’ আমি সে কথা জানি। অন্তর দিয়ে তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করি। তুমি যেখানে ভালো থাকবে সেখানেই থাকো। আমার হৃদয়ে তোমার জায়গা সবসময়। যেদিন ইচ্ছে হবে চলে এসো। সবাইকে নিয়ে এসো। তোমরা আমার পরিবারের চেয়ে কম কিছু নয়।‘ সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমান্ডা সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার আগে পানু রায়কে বলে গেল,’ সন্ধ্যাবেলা এস। কথা আছে।‘

আমান্ডা চলে যাবার পর সুন্দরী পানু রায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে এক গাল ঝকঝকে হাসি মুখে নিয়ে বলে,’ দাদু, তোমার পেটে পেটে এত! আগে গিয়ে আরও কত কী যে দেখব কে জানে?’ ঘরশুদ্ধু সবাই পানু রায়কে ঘিরে দাঁড়ায়। সকলের হাসি মস্করায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমান্ডার সঙ্গে দেখা করে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল পানু রায়ের। যখন ফিরলেন তখন নৈশভোজের আয়োজন সম্পূর্ণ। সকলে ডাইনিং হলে পানু রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সুন্দরী স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় এক গাল হেসে বলল,’ দাদু, এত দেরি হল? ছাড়তে চাইছিল না নিশ্চয়ই। পুরনো প্রেম বলে কথা। কত কথা যে জমে আছে!’ পানু রায় হেসে বললেন,’ সে কথা তো শেষ হবার নয়। কিন্তু যাবার ব্যাপারে যা কথা হল তা এই যে আমাদের উড়োজাহাজের ব্যবস্থা আমান্ডা করবে যাতে সোনিয়াসহ আমরা সকলে একসঙ্গেই যেতে পারি। আগামী রবিবার মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা বেরিয়ে পড়ব। হিন্দোশিয়ার প্রথাগত পদ্ধতি মেনে আমাদের বিদায়ী মধ্যাহ্নভোজে হিন্দোশিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। অতএব এবার আমাদের গোটাবার পালা। সুতরাং চলো বারৌনি!! মাধাই, তোমার লোকজনদের খবর দিয়ে দাও আমরা সদলবলে রবিবার বারৌনি পৌঁছচ্ছি। এবার খাওয়া শুরু করা যাক।‘


দ্বিতীয় পর্ব - আমান্ডা আর পানু রায়ের কথা

ওরা সবাই বারৌনি এসে পৌঁছেছে প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল। অনেকদিন না থাকার জন্য বেশ কিছু কাজ জমে গিয়েছিল সবার। তার ওপর হিন্দোশিয়াতে অতিরিক্ত অনেকটা সময় কাটিয়েছে সবাই। সমুদ্রের ধারে প্রাসাদোপম বাংলোতে আমান্ডার অভাবনীয় আতিথ্য উপেক্ষা করে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না ওদের পক্ষে। অবশেষে মাধাইএর মাথাতেই এই মাত্রাতিরিক্ত অবসর যাপনের অপকারিতার কথা এসেছিল। তা না হলে আরও কতদিন যে ওখানে কেটে যেত কে জানে। যাই হোক সবকিছু ঠিকঠাক করে এখন মোটামুটি সবাই বেশ স্থিতু। আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমান্ডার কথাটা উত্থাপন করল সুন্দরী। আমান্ডার সঙ্গে পানু রায়ের সম্পর্কটা ঠিক কী ছিল সেটা কিছুতেই স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিল না সুন্দরী। দেখে মনে হয় আমান্ডা খুব বেশি হলে পনের বছরের ছোট পানু রায়ের থেকে। একটা মিষ্টি মধুর সম্পর্ক যে এককালে ছিল দু’জনের কথাবার্তায় বেশ বোঝা যায়। একটা রোমান্টিকতার আভাস দু’জনের আচরণে সুন্দরী যে মাঝেমাঝে লক্ষ করেনি তা নয়। ব্যাপারটা আরও বিস্তারিত ভাবে জানার ঔৎসুক্যে ভালো করে ঘুম হচ্ছিল না সুন্দরীর। জগাইএর সঙ্গে কয়েকবার আলোচনাও হয়েছে সুন্দরীর এ নিয়ে। আজ আর নিজেকে সামলাতে না পেরে জিগ্যেস করে বসল,’ দাদু, আমান্ডার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি শুধুই বন্ধুত্বের না আরও কিছু? অনেকদিন ধরে তোমাকে জিগ্যেস করব করব করে সাহস করে উঠতে পারিনি। তারপর মনে হল তুমি তো আমাদের একেবারে নিজের মানুষ। তোমার কাছে আমরা গল্প শোনার আবদার তো করতেই পারি।‘ সুন্দরীর কথা শুনে সবাই হৈ হৈ করে পানু রায়কে ঘিরে বসল। পানু রায় বললেন,’ হ্যাঁ, গল্পই বলা যেতে পারে। খাওয়া শুরু কর সবাই। খেতে খেতে বলছি।‘ পানু রায় যা বললেন তা এইরকম।

আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের কথা। পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরে পানু রায় তখন রাশিয়ায়। পানু রায়ের কাজ ছিল ওখানকার জেলবন্দিদের কম্যুনিজমের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার। যাতে জেলবন্দিরা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং রাশিয়ার প্রতি তাদের ভালোবাসা জন্মায়। সেইসময় নানান জেলে ঘুরতে ঘুরতে পানু রায়ের সঙ্গে দেখা হয় রবার্ট আইনস্টাইনের । রবার্ট জার্মানির লোক। প্রায় তার সমবয়সী। রবার্ট নিজের বয়স কত নিজেও ঠিকমত জানত না। রবার্টের কথা অনুযায়ী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নাকি ওর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল। হিটলারের অত্যাচারে অনেকেই তখন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সেই সময় আরও অনেকের সঙ্গে জার্মানি ছেড়ে পালায় রবার্ট। পালাতে পালাতে এসে পৌঁছয় রাশিয়ার সীমান্তে। বিনা পাসপোর্টে সীমানা পেরোনোর সময় মিলিটারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রবার্ট। তারপর প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু বিনা বিচারে রাশিয়ার জেলে বন্দি হয়ে আছে জার্মানিরা। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। হিটলারের ভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা জার্মানিতে ফিরে আসছে কিন্তু তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। রবার্টের কাহিনী শুনে তার হয়ে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান পানু রায়। এক বছর ধরে অনেক তদ্বির তদারকি করে রবার্টকে জেলের বাইরে নিয়ে আসার অনুমতি আদায় করেন পানু রায়। পানু রায়ের কাছে থেকে জার্মানিতে যোগাযোগ করে রবার্ট জানতে পারে ইতিমধ্যে তার বাবা এবং কাকা দু’জনেই মারা গেছেন। রবার্টের মা রবার্ট দেশ ছাড়ার অনেক আগে মারা গেছেন। কাকা বিয়ে করেননি এবং তাদের সঙ্গেই থাকতেন। যেহেতু রবার্ট তার বাব-মার একমাত্র সন্তান সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে পরিবারের স্থাবর এবং অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিক এখন রবার্টই। রাশিয়ার বিদেশ দপ্তরে আবেদন নিবেদন করে রবার্ট পানু রায়কে সঙ্গে নিয়ে জার্মানি যাবার অনুমতি সংগ্রহ করল। শর্ত রইল ছ’মাসের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দেশে গিয়ে জায়গা-জমি-ঘর-বাড়ি সব বিক্রি করে , ব্যাঙ্কের কাজ মিটিয়ে রাশিয়া ফিরে এল দু’জনেই। তারপর রাশিয়ায় বেশ কিছুদিন কাটল দু’জনের। একসঙ্গে থাকতে থাকতে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠল পানু রায় আর রবার্টের। বয়সের ব্যবধান কোনও বাধার সৃষ্টি করল না। রবার্ট ছিল প্রায় দশ বছরের বড়। থাকতে থাকতে পানু রায়ের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। পানু রায়ের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে রাশিয়া সরকার চুক্তির মেয়াদ এবং অর্থের পরিমাণ দুই-ই বৃদ্ধি করতে রাজি হল। কিন্তু বাধ সাধল রবার্ট । রবার্ট বলল ,’ তোমার জন্য আমার জীবনটা পালটে গেল। আজ যে আমি এত অর্থের মালিক তা তুমি না হলে সম্ভব হত না। তোমাকে আর চাকরি করতে হবে না। চল ক’টা বছর অন্য কোথাও ঘুরে আসি। সব খরচ আমার। তুমি আপত্তি কোরো না।‘ রবার্টের আবদারে অনুরোধে রাজি হয়ে গেল পানু রায়। ফিরে এসে দপ্তরে আবার কাজে যোগদান করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল পানু রায় আর রবার্ট। এখান ওখান ঘুরে অবশেষে হিন্দোশিয়া পৌঁছে মনে হল এখানে সমুদ্রসৈকতে বেশ কিছুদিন কাটানো যেতে পারে। সমুদ্রের ধারে একটা ছোট কিন্তু সুন্দর হোটেল ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করল দুই বন্ধুতে। সেই হোটেলে পরিবেশিকার কাজ করত আমান্ডা। আমান্ডার মাথা আর মন যে কোথায় থাকত কে জানে। তাকে ভদকা আনতে বললে নিয়ে এসে হাজির করত কলার শরবৎ। অমলেট আনতে বললে চিকেন কাবাব নিয়ে এসে হাজির হত। এককথা একশ’বার বললেও মাথায় ঢুকতোনা আমান্ডার। একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল পানু রায়ের। প্রচন্ড রাগারাগি করল আমান্ডার ওপর। আমান্ডা মুখ ভার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে আবার যে কে সেই। রেগেমেগে পানু রায় চলল ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানাতে। এই মেয়েকে দিয়ে আর চলবে না তাদের। পানু রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরল রবার্ট। বলল,’ থাক না। আমান্ডার মাথাটা একটু মোটা ঠিকই কিন্তু মুখটা ভারি সুন্দর। একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিলে কোনও অসুবিধে হবেনা।‘ অবাক হয়ে রবার্টের মুখের দিকে তাকিয়ে পানু রায়ের মনে হল রবার্টের চোখ অন্য কিছু বলছে। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ তোমার কী হয়েছে, রবার্ট? সত্যি করে বলতো। তোমার চোখ মুখ তো অন্য কিছু বলছে। তুমি কি শেষ অবধি হাঁটুর বয়সী মেয়েটার…?’ লজ্জায় রবার্টের মুখ লাল হয়ে উঠল। চেয়ারে আবার বসে পড়লেন পানু রায়। ভালোবাসার গতি কি বিচিত্র!

এতটা শুনে সুন্দরী জিগ্যেস করল,’ তারপর? ‘পানু রায় বুঝতে পারলেন সবাই যেটা শুনতে চাইছিল সেটার সঙ্গে গল্পটার কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই হতাশ ওরা সবাই। বিশেষ করে সুন্দরী। পানু রায় মুচকি হেসে বললেন,-তারপর আর কী? সারারাত নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে পরের দিন সকালে আমি আর রবার্ট খুঁজে খুঁজে আমান্ডার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমান্ডা ততক্ষণে হোটেলের জন্য বেরিয়ে গেছে। ওর বাবার সঙ্গে দেখা করে সবকথা বললাম। রবার্ট মাথা নিচু করে বসে রইল সারাক্ষণ। সব শুনে আমান্ডার বাবা বলল,’ আপনারা ঠিক বাড়িতে এসেছেন তো? মানে আমি জানতে চাইছি আপনারা আমার বড় মেয়ের কথা বলছেন? ওর নামও আমান্ডা। সাত আটটা জায়গায় কাজ খুইয়ে ক’মাস হল একটা হোটেলে কাজ করছে এখন। কতদিন করতে পারবে কে জানে?’ আমরা ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে বললাম,’ হ্যাঁ,আমরা ওনার মেয়ে আমন্ডের জন্যই এসেছি। রবার্ট ওকে বিয়ে করতে চায়।‘ ভদ্রলোক ধাতস্থ হয়ে একগ্লাস জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এলেন। সব জেনেশুনে আমান্ডার বাবা-মা রাজি হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার পথে মনের আনন্দে রবার্ট আমাদের দু’জনের জন্য একজোড়া স্যুট আর জুতো কিনে ফেলল। হোটেলে ফিরে সারাদিন ধরে খাদ্য আর পানীয়ের অর্ডার যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে কেঁদে ফেলল আমান্ডা। আমিও অবাক হয়ে দেখছি ভুলভাল যা এনে দিচ্ছে আমান্ডা তাই মহানন্দে উদরস্থ করে নিচ্ছে রবার্ট। আজকে একটাও ভুল হয়নি ভেবে নিজেই কেমন যেন ঘাবড়ে গেল আমান্ডা। চোখগুলো বড় বড় করে বোকার মত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বোধ হয় জিগ্যেস করতে চাইছে,’ সত্যিই কি আমি একটাও ভুল করিনি?’ কিন্তু কী করে আমি বলি,’ ভুল, সবই ভুল’? কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ভুল সব হিসেব গুলিয়ে গেল আমার। মদে বেহুঁশ হয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ল রবার্ট। আমি আর আমান্ডা দু’জনে মিলে ধরাধরি করে কোনওক্রমে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম।

বিস্ময়ের পালা তখনও শেষ হয়নি।আরও সব গোলমাল হয়ে গেল যখন পরের দিন সকালে আমান্ডা এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,’ এত বড় সাহস ঐ বুড়ো মাতালটার যে কাল আমি বেরোবার পর বাবাকে বুঝিয়ে এসেছে যে ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। কোনও লাজলজ্জা নেই। ঠিকসময় বিয়ে হলে আমার বয়সী একটা মেয়ে হত ওর। তাই ভাবছি যা দিচ্ছি কোনও কথা না বলে কেন গিলে নিচ্ছে বুড়োটা? এমনতো হবার কথা নয়। আর এই যে তুমি শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। তুমিও গিয়েছিলে ওটার সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বনাশ করতে।‘কথা শেষ করতে না করতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আমান্ডা। ওর কান্না দেখে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল রবার্ট। হোটেলের আর আশেপাশের সমস্ত মানুষ হাঁ করে দেখতে থাকল এই দৃশ্য, শুনতে থাকল রবার্ট আর আমান্ডার যুগলবন্দী। কান্না থামলে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে গেল রবার্ট। সারাদিন ঘর থেকে বেরোলো না। একটা দানাও মুখে কাটলো না।‘বাড়ি যাবার আগে আমান্ডা আমার কাছে এল। বলল,’ আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার এতটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়নি। উনি আমার বাবার কাছে গিয়ে আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। সে উনি দিতেই পারেন। রাজি হওয়া না হওয়া আমার ব্যাপার। কিন্তু আমার ওনার প্রতি এই আচরণ ঠিক হয়নি।‘ আমি তো অবাক। যে মেয়ের মাথায় কিছু নেই বলেই আমি জানি আর আজ সকালে যার এমন রণচন্ডী রূপ আমি দেখেছি সেই মেয়ে এত গুছিয়ে শান্তস্বরে কথা বলছে? কে জানে মেয়েরা বোধ হয় এরকমই হয়। বাইরে যতই কঠিন হোকনা কেন ভেতরে তারা সত্যিই কোমল। আমি বললাম,’ এসব কথা আমাকে বলে লাভ কী? তুমি রবার্টের কাছে তোমার অনুতাপের কথা জানিও।‘আমান্ডা বলল,’ সকালের ঘটনার আমি ওনার মুখোমুখি হতে পারবো না। আপনি অনুগ্রহ করে ওনাকে জানিয়ে দেবেন যে আমি আমার আচরণের জন্য সত্যিই দুঃখিত।‘আমি চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম,’ আচ্ছা,একটা কথা বলবে? আজ সকালে তুমি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করলে কেন? ওনাকে কেন এভাবে আক্রমণ করলে? সামান্য কারণে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া কি তোমার স্বভাবজাত?’ আমান্ডা বলল,’ একেবারেই না। আসলে আশাভঙ্গই আমার উত্তেজনার কারণ। আমি যা চেয়েছিলাম তা না পাবার জ্বালা থেকেই আমি এসব করে ফেলেছি। মনের দুঃখ, অপমান চেপে রাখতে পারিনি।‘ আমি বললাম,’ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। রবার্ট তোমার আশাভঙ্গের কারণ হলো কী করে? তা ছাড়া সে তো তোমাকে কোনও কষ্ট, যন্ত্রণা, আঘাত দেয়নি। তাহলে?’ আমান্ডা বলল,’ না না ওনার কোনও দোষ নেই। কেউ কোনও দোষ করেনি। সবই আমার চাওয়া আর তা না পাওয়ার দোষ। আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না।‘আমার মাথায় জেদ চেপে গেল। আমান্ডার বাবার কাছে রবার্টের প্রস্তাবে কী এমন ঘটল আমান্ডার জীবনে যে সে স্থান কাল পাত্র ভুলে রবার্টকে হেনস্থার চূড়ান্ত করল? আমান্ডার বাবা তো এই প্রস্তাবে খুশিই হয়েছিল। আশাভঙ্গ যদি কারও হয়ে থাকে তবে তা রবার্টের। এ তো দেখি উলটো কথা বলে। আমি বললাম,’ কী আশা করেছিলে তুমি যা ঘটলো না? কী চেয়েছিলে তুমি যা পেলে না? তোমাকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে।‘ আমান্ডার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বলল,’ সে আমি আপনাকে বলতে পারবো না।‘ আমি বললাম,’ না তা হয়না । জানতে আমাকে হবেই।রবার্ট আমার বন্ধু। তার অপমান আমারও অপমান। সেই অপমানের কারণ না জানলে আমার মন কিছুতেই শান্ত হবে না।‘ আমান্ডা মুখ নামিয়ে নিজের পা-এর দিকে বলল,’ আপনি যখন জানতেই চাইছেন তাহলে শুনুন। অনেকদিন ধরে আমি আপনাকে লক্ষ করছিলাম। আপনার চোখের ভাষা দেখে আমি আশা করেছিলাম আপনি হয়ত আমাকে প্রস্তাব দেবেন। মনে মনে আমি আপনাকে চেয়েছিলাম। ওনাকে নয়।‘ আমান্ডার কথা শুনে আমার তো প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাবার মত অবস্থা। জীবনে এই প্রথম কোনও মেয়ে আমাকে বলল যে সে আমাকে পছন্দ করে। আমি হাঁ করে আমান্ডার দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ বসেছিলাম কে জানে? সম্বিৎ ফিরল আমান্ডার গলার আওয়াজে। বলল,’ আপনি অবাক হলেন? আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।‘আমি বললাম,’ আমি তো কিছুই বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে সরাসরি বললে না কেন? নিজের ইচ্ছের কথা নিজের মনে গোপন করে রাখতে গেলে কেন? রবার্টকে দেখ। সে তার মনের কথা তোমার বাবার কাছে সোজাসুজি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে এসেছে। ওর ভালোবাসায় কোনও দ্বিধা নেই, একেবারে নিখাদ। তোমার প্রত্যাখানে ভয়ঙ্কর আঘাত পেয়েছে ও।‘আমান্ডার চোখ দু’টো জলে ভরে উঠলো। আমি বললাম,’ আমান্ডা, রবার্ট আমার বন্ধু। সে তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। তুমি তাকে প্রত্যাখ্যান করতেই পারো। সে তোমার স্বাধীনতা। কিন্তু তোমার ডাকে আমি কী করে সাড়া দিই বল? আমার প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা আমি কী করে করব? আর তুমি হয়ত জাননা তোমার বারবার ভুলের জন্য তোমার নামে আমি তোমার ম্যানেজারের কাছে নালিশ করতে যাচ্ছিলাম। রবার্ট আমাকে নিরস্ত করেছিল। বলেছিল সে তোমাকে ভালোবাসে। এখন আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন বারবার ভুল করছিলে? দুঃখ পেয়োনা আমান্ডা। রবার্টের কথাটা ভেবে দেখো। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই হিন্দোশিয়া ছেড়ে চলে যাব। রবার্টকে বিয়ে কর। সে তোমাকে খুব ভালো রাখবে।‘আমার কথা শেষ হবার আগেই আমান্ডা এক দৌড়ে হোটেলের ভিতরে ঢুকে গেল।

সেদিন রাত্রে রবার্ট কিছু খেল না। একবারের জন্যও ঘরের বাইরে এল না। আমি অনেকবার ডাকলাম। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখল। পরেরদিন সকালে আমি যখন লনে গিয়ে বসলাম দেখলাম রবার্ট দূরে একটা পাথরের ওপর বসে একমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে দেখে একেবারে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। বুঝলাম প্রত্যাখ্যান আর অপমানের জ্বালা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে ওর দুই চোখ দিয়ে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে শান্ত করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নিয়ে এলাম।যা ঘটে গেছে তা অনাবশ্যক জিইয়ে রেখে কোনও লাভ নেই। অস্বস্তির আবহাওয়াটা কেটে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায় ততই মঙ্গল। ভাবলাম আমান্ডাকে বুঝিয়ে তার ব্যবহারের জন্য রবার্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলব। কিন্তু ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে শুনলাম আমান্ডা আজ আসেনি। ভাবলাম ঠিক আছে কাল বা পরশু যেদিন আসবে সেদিনই ব্যাপারটা মিটমাট করে নেওয়া যাবে। এই মূহূর্তে আমান্ডা হয়ত রবার্টের মুখোমুখি হতে চাইছে না। একটু সময় গেলে আমান্ডা এবং রবার্ট দু’ জনেরই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হবে । তখন সামনাসামনি কথা বলাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে হয়ত। কিন্তু যা ভাবলাম তা হল না। দেখতে দু’ সপ্তাহ কেটে গেল আমান্ডার দেখা নেই। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিলাম। সে বলল আমান্ডা কোনও খবর দেয়নি। আর ক’টা দিন দেখে হোটেল আইনমাফিক ব্যবস্থা নেবে। আমার ব্যাপারটা খুব সুবিধের মনে হল না। আমারও যে আমান্ডার প্রতি একটা দুর্বলতা আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিছুটা কৌতূহল কিছুটা আমান্ডাকে দেখার ইচ্ছে সব মিলিয়ে ভাবলাম যদি পরেরদিন সকালেও আমান্ডা না আসে তাহলে বেলার দিকে ওর বাড়িতে একবার যাব। আমি একাই যাব স্থির করলাম। রবার্টকে কিছু বললাম না। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। সকালবেলা নিচে নেমে দেখি লনের চেয়ারে আমান্ডা আর ওর বাবা বসে আছে। রবার্ট তখনও নামেনি। আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা দু’জনেই আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমান্ডা আমাকে বলল,’ ওদিকে আসুন, জরুরি কথা আছে।‘ আমি আমান্ডার বাবার দিকে তাকালাম। উনি চোখের ইঙ্গিতে সম্মতি দিলেন। একটু দূরে গিয়ে আমান্ডা আমাকে বলল,’ গত পনেরদিন অনেক ভেবে বাবার সঙ্গে কথা বলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি রবার্টকে বিয়ে করব। কিন্তু একটা শর্তে। তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না। তোমাকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে। তুমি যদি রাজি হও তাহলে বাবা আজই রবার্টের সঙ্গে কথা বলবে। তার আগে আমি আমার অন্যায় আচরণের জন্য রবার্টের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।‘ আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু আমান্ডার যা জেদ তাতে আমি কথা না দিলে হয়ত আবার ফিরে যাবে। আমার এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার জন্য যদি ওদের বিয়েটা আটকে যায় তাহলে আমি নিজের কাছে এবং ওদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব সারাজীবন। বিশেষ করে যখন আমান্ডা রবার্টকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আমি আমান্ডার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমান্ডার বাবা আমাদের কাছে সব শুনে বললেন,’ আমি রবার্টকে গিয়ে খবরটা দিই। রবার্টের প্রস্তাবে আমি সম্মত ছিলাম গোড়া থেকেই। মাঝখান থেকে আমার মেয়েটাই পাকালো যত গন্ডগোল। যাক সবকিছু ভালোভাবেই মিটে যাবে মনে হচ্ছে। ‘ আমি আমান্ডাকে বললাম ,’ তুমিও যাও বাবার সঙ্গে। বাবা কথাটা বলার আগেই তুমি ক্ষমা চেয়ে নিও।‘ আমান্ডা শান্ত মেয়ের মত বাবার পিছু পিছু রবার্টের ঘরের দিকে হাঁটা দিল। কত পাল্টে গেছে মেয়েটা গত পনেরদিনে।

এই পর্যন্ত শুনে সুন্দরী বলল,’ আমান্ডার গল্প তো শুনলাম। কিন্তু তুমি কী করলে?’

পানু রায় বললেন- তারপর ধুমধাম করে আমান্ডা আর রবার্ট এর বিয়ে হয়ে গেল। আমি আর কী করি? কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থেকে গেলাম ওদের সঙ্গে। রবার্ট এবং আমান্ডা দু’জনেই আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইল না। যাবার কথা উঠলেই দু’জনে এত ছেলেমানুষি করত যে যাওয়া হয়ে উঠত না। সত্যি কথা বলতে কী ওদের বন্ধন ছেড়ে যেতে আমারও মন চাইত না। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। হোটেলের চাকরি ছেড়ে আমান্ডা সরকারি দপ্তরে চাকরিতে ঢুকে গেল। হিন্দোশিয়ায় টাকা খরচ করলে বা বলা ভাল ঠিক জায়গায় টাকা দিতে পারলে ডিগ্রি সার্টিফিকেট আর সরকারি চাকরি জোগাড় করা এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়। বলা যেতে পারে সরকারি চাকরি পাবার এটাই একমাত্র রাস্তা ছিল। রবার্টের টাকার কোনও অভাব ছিল না। ঠিকঠাক জায়গায় টাকাকড়ি দিয়ে আমান্ডাকে বিদেশ দপ্তরে ঢুকিয়ে দিল। আমান্ডার বাবার অনেক জানাশোনা ছিল কিন্তু টাকার জন্য কিছু করতে পারছিল না। রবার্ট প্রভূত পরিমাণে টাকা খরচ করে নিজে রাজনীতিতে যোগ দিল। হিন্দোশিয়াতে ভোট হয় ঠিকসময় কিন্তু সরকার পাল্টায় না কোনওবার। গত চল্লিশ বছর ধরে একই দল সরকার চালাচ্ছে। পয়সা খরচ করে কর্পোরেশন ভোটে একটা টিকিট জোগাড় করে ফেলল রবার্ট। হিন্দোশিয়ায় টিকিট পাওয়াটাই আসল। বিরোধীপক্ষ বলে কিছু নেই সুতরাং ভোটে হারার কোনও ব্যাপার নেই। টিকিট পাওয়া মানেই কাউন্সিলর হওয়া। ওপর মহলে আমান্ডার বাবার যোগাযোগ আর রবার্টের টাকা এই দুই এর মিলিত শক্তিতে জনপ্রতিনিধিত্বের প্রথম ধাপ অতিক্রম করল রবার্ট। বাকিটা টাকার খেলা। টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভর করবে বিধানসভার সদস্যপদ, মন্ত্রীত্ব, লোকসভার সদস্যপদ ইত্যাদি ইত্যাদি। রবার্ট যেদিন কাউন্সিলর হল আমান্ডা জানাল সে মা হতে চলেছে। আমান্ডা যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রবার্টেরও সময় নেই। মনে ইচ্ছে থাকলেও রবার্ট এবং আমান্ডা কেউই সময় দিতে পারছিল না আমাকে। বুঝতে পারতাম একটা অপরাধবোধ কাজ করছে ওদের মধ্যে। ওদের অস্বস্তি না বাড়িয়ে আমি সুইডেনে একটা চাকরি জোগাড় করে ওদের কাছে বিদায় চাইলাম। রবার্ট প্রস্তাব দিল চাকরির জন্য সুইডেনে যাবার দরকার নেই। হিন্দোশিয়াতেই আমার একটা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে সে। আমি রাজি হলাম না। বেশ কিছুদিন টানহ্যাঁচড়ার পর ওরা আমাকে যেতে দিতে রাজি হল কিন্তু শর্ত রইল সময় পেলেই আমি যেন হিন্দোশিয়ায় যাই। তারপর যা হয়। প্রথম প্রথম কয়েকবার গিয়েছিলাম। এর মধ্যে রবার্ট মন্ত্রী হল। আমান্ডার বছর বছর পদোন্নতি হতে থাকল। আমান্ডার কোলে দ্বিতীয় সন্তান এল। তারপর যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে গেল। ফোনে যোগাযোগ করাও খুব একটা সহজ ছিল না তখন। বেশ কিছুদিন পরে একদিন খবর পেলাম রবার্ট খুব অসুস্থ। গেলাম হিন্দোশিয়া। বেশ কিছুদিন যমে মানুষে টানাটানির পর রবার্ট চলে গেল। কিছুদিন রইলাম হিন্দোশিয়াতে। ধাক্কা সামলিয়ে আমান্ডা অফিস জয়েন করার পর ফিরে এলাম সুইডেনে। তারপর অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি হিন্দোশিয়ায়। বারৌনি আসার পর তোরা সবাই যেতে চাইলি বলে আবার যাওয়া হল হিন্দোশিয়া।

0 comments: